ইলা মুৎসুদ্দী
বুদ্ধ রাজগৃহ বেনুবন উদ্যানে শ্রাবক সংঘ সহ অবস্থান করিতেছেন এই সংবাদ রাজা শুদ্ধোধন শ্রবণ করিলেন। তখন বুদ্ধকে কপিলাবস্তু নগরে আনয়নের জন্য একজন অমাত্যকে আহ্বান করিয়া বলিলেন “হে প্রিয় অমাত্য, তুমি এক সহস্র পরিষদসহ রাজগৃহ নগরে গমন করিয়া আমার পুত্র বুদ্ধকে নিমন্ত্রণ করিয়া কপিলাবস্তু নগরে আনয়ন কর। তাহাকে বলিও -তোমার পিতা এখন বৃদ্ধ হইয়াছে, অনেক দিন পিতা বুদ্ধকে দেখিতে পাইতেছে না। জীবিত ও নিরোগ অবস্থায় যাহাতে পিতা বুদ্ধকে পূজা করিতে সক্ষম হয় সেইজন্য বুদ্ধ কপিলাবস্তু আগমন করুক। বলিয়া রাজা অমাত্যকে নির্দেশ দিলে অমাত্য “উত্তম প্রভু” বলিয়া সহস্র সৈন্যসহ রাজগৃহ নগরে উপনীত হইলেন। বুদ্ধ বেনুবন বিহারে ধর্ম দেশনা করিবার সময় অমাদ্য সহস্র সৈন্যসহ বেনুবন বিহারে উপস্থিত হইলে সপরিষদ ধর্ম শ্রবণ করিতে করিতে মার্গ ফলে উপনীত হইয়া অরহত্ত্ব ফলে প্রতিষ্ঠিত হইলে ধর্ম দেশনা অবসানে বুদ্ধের নিকট প্রব্রজ্যা প্রার্থনা করিলেন। বুদ্ধ “এহি ভিক্ষু” বলিয়া আহ্বান জানাইলে ঋদ্ধিময় পাত্রচীবরাদি আপনা আপনি অঙ্গে সজ্জিত হইয়া পরিপূর্ণ ভিক্ষুত্ব প্রাপ্ত হইলে বুদ্ধের সহিত রহিয়া গেলেন। অরহত্ত্ব প্রাপ্ত হইবার পর আর্য মার্গফল গবেষণা করিয়া পরমানন্দে অবস্থান করায় রাজা শুদ্ধোধনের কথিত বিষয় ভুলিয়া গেলেন এবং বুদ্ধকে কপিলাবস্তু যাওয়ার জন্য কিছু বলা হইতে বিরত হইলেন।
রাজা শুদ্ধোধন ও বুদ্ধকে আমন্ত্রণ করিয়া আনয়নের উদ্দেশ্যে প্রেরিত অমাত্যের ফেরত আসার দিন অতীত হইলে আর একজন বুদ্ধিমান অমাত্যকে বুদ্ধকে আনয়নের জন্য পূর্বের ন্যায় প্রেরণ করিলেন। সেই অমাত্যও রাজগৃহে উপনীত হইলে বেনুবনে বুদ্ধের ধর্ম শ্রবণ করিয়া সপরিষদ অরহত্ত্ব ফলে প্রতিষ্ঠিত হইয়া বুদ্ধকে কপিলাবস্তু গমনের বিষয় কিচ্ছু না বলিয়া নীরবে ধর্মানন্দে ডুবিয়া রহিলেন।
এইভাবে নয়বার অবধি সপরিষদ অমাত্য প্রেরণ করিয়াও রাজা শুদ্ধোধন দেখিলেন কোন অমাত্য বুদ্ধকে আনয়ন করিলেন না, অধিকন্তু, কেহ ফিরিয়া আসিল না এবং কোন সংবাদই কাহারও নিকট হইতে পাওয়া গেল না। ইহাতে রাজা শুদ্ধোধন দুঃখিত হইলেন এবং অনুশোচনা করিয়া রাজপ্রাসাদে বলিতে লাগিলেন “আমার রাজপ্রাসাদে ও রাজ্যের মধ্যে আমার প্রকৃত প্রিয়জন না থাকায় আমার পুত্রের সংবাদও কেহ আনিয়া দিতে পারিল না। এখন কাহাকে প্রেরণ করিলে আমার পুত্র বুদ্ধকে দর্শন ও পূজা করিবার জন্য আনয়ন করিয়া দিবে” এই বলিয়া সকল রাজকর্মচারীদের প্রতি উদ্দেশ্য করিয়া তিনি অনুতাপ ও মর্মবেদনা প্রকাশ করিলেন।
কালুদায়ী অমাত্য বোধিসত্ত্ব সিদ্ধার্থের জন্ম দিনেই একই সময়ে ভূমিষ্ঠ হইয়াছিলেন। সম্মুখে সেই অমাত্য কালুদায়ীকে দর্শন করিয়া প্রশ্ন করিলেন, “¯স্নেহের কালুদায়ী, তুমি আমার পুত্র বুদ্ধকে এখানে আনয়ন করিয়া বুদ্ধকে দর্শন করিতে ও পূজা করিবার সুযোগ আমাকে করিয়া দিতে সক্ষম হইবে কি?” -তখন কালুদায়ী প্রশ্ন করিলেন “মহারাজ, আমি ভিক্ষুত্ব গ্রহণ করিতে পারিব কি?” এই প্রশ্নের পর রাজা শুদ্ধোধন সানন্দে বলিলেন, “বৎস, তুমি ভিক্ষুত্ব গ্রহণ কর কিংবা না কর ইহাতে কিছুই আসে যায় না, আমার পুত্রকে এখানে আনয়ন করিয়া তাঁহার দর্শন ও পূজা করিবার সুযোগ আমাকে করিয়া দিতে পারিলেই যথেষ্ট হইবে।” এই বলিয়া বুদ্ধকে আনয়নের উদ্দেশ্যে রাজগৃহে যাইবার জন্য কালুদায়ীকে উৎসাহিত করিলেন।
কালুদায়ী এক সহস্র সৈন্য পরিবেষ্টিত হইয়া রাজগৃহে গমন করিলেন। বুদ্ধের সমীপে উপনীত হইবার সময় তথাগত বুদ্ধ ধর্ম দেশনা আরম্ভ করিলে কালুদায়ী সপরিষদ সভার শেষ প্রান্তে বসিয়া ধর্ম শ্রবণ করিলেন। ধর্ম দেশনা সমাপ্ত হইলে বুদ্ধ তাঁহাদিগকে “এহি ভিক্ষু” বলিয়া আহ্বান করিলে তাঁহারা ঋদ্ধিময় পাত্রচীবরসহ তাঁহারা ভিক্ষুত্বে পরিণত হইলেন।
কালুদায়ী সপরিষদ রাজগৃহে আগমনের সাত আটদিন গত হইলে শীত ঋতু অতিক্রান্ত হইয়া বসন্ত ঋতুর আগমন হইল। তখন কালুদায়ী চিন্তা করিলেন- “এখন ঋতুরাজ বসন্তের আগমন হইয়াছে, সমগ্র ধরণীতল হরিদ্বন তৃণে সমচ্ছাদিত হইয়াছে, তরুলতা ও বনরাজি নব নব পুষ্পপল্লবে মনোরম শোভা ধারন করিয়াছে। কৃষকের মাঠ হইতে শস্য সমূহ তুলিয়া আনিয়া সর্বসাধারণের জন্য নির্বিঘ্নে চলার পথ খুলিয়া রাখিয়াছে। দীর্ঘপথ চলার পক্ষে ইহাই যথার্থ কাল। সুতরাং তথাগত বুদ্ধের জ্ঞাতি দর্শনে কপিলাবস্তু গমনের ইহাই উপযুক্ত সময়।” শুক্লপক্ষ পঞ্চদমশী দিবসের প্রত্যুষ সময়ে কালুদায়ী ষষ্ঠী গাথার সাহায্যে বসন্তকালে প্রকৃতির অভিনব সৌন্দর্য্যরে চিত্তাকর্ষক বর্ণনা করিয়া বুদ্ধকে রাজা শুদ্ধোধন কর্তৃক কপিলাবস্তুতে আমন্ত্রণের বিষয় বুদ্ধের চরণে নিবেদন করিলেন। এবং এই বসন্তকালেই দীর্ঘপথ ভ্রমণ করিয়া স্বীয় জ্ঞাতিকুল দর্শনে যাওয়ার উপযুক্ত সময়- ইত্যাদি বিনীতভাবে নিবেদন করিলেন।
এইরূপে কালুদায়ী রাজগৃহ হইতে কপিলাবস্তুতে যাইবার দীর্ঘপথ ও যাত্রা কালের মনোরম বর্ণনা করিতে করিতে স্বগৃহ কপিলাবস্তুতে গমনচিত্ত উৎপাদনের নিমিত্ত তথাগতকে অনুপ্রাণিত করিতে লাগিলেন।
সূত্র – বুদ্ধের সমকালীন ভিক্ষুসংঘ, মুদিতারত্ন ভিক্ষু