ব্রেকিং নিউজ

খুব সংক্ষেপে মহাসতিপট্ঠান সহায়িকা

একূশটি উপায়ে অরহ্ত্ত্ব লাভের উপায় তথা কর্মস্থান সংযূক্ত গভীর অর্থসংযুক্ত মহাসতিপট্ঠান সূত্তI এখানে একুশটি উপায়ে বলতে একুশটি পদ্ধতির যে কোন একটি পদ্ধতি অনুসরণে স্মৃতি অনুশীলন দ্বারা চারি মার্গফলে যে কোন স্তর অধিগম করা যায়।
এই ২১টি কর্মস্থানের মধ্যে আনাপান পর্বে ১টি কর্মস্থান, চারি ইর্য্যাপথে ১টি কর্মস্থান, চারি সস্প্রজ্ঞানে ১টি কর্মস্থান, বত্রিশ অশূভ পর্বে ১টি কর্মস্থান, চারি ধাতু ব্যবচ্ছেদ পর্বে ১টি কর্মস্থান, নব সীবথিকা পর্বে ৯টি কর্মস্থান, বেদনানুদর্শন পর্বে ১টি কর্মস্থান, চিত্তানুর্শন পর্বে ১টি কর্মস্থান, নীবরণ পরিগ্রহণ পর্বে ১টি কর্মস্থান, পঞ্চস্কন্ধ পরিগ্রহণ পর্বে ১টি কর্মস্থান, আয়তন পরিগ্রহণ পর্বে ১টি কর্মস্থান, বোধ্যংজ্ঞ পরিগ্ৰহণ পর্বে ১টি কর্মস্থান এবং সত্য পরিগ্রহণ পর্বে ১টি কর্মস্থান I তন্মধ্যে আনাপান, অশূভ এবং নয় প্রকার সীবথিকা এই ১১টি কর্মস্থান অনুশীলনে সমথ পর্যায়ে অপর্ণা ধ্যানস্তর পর্যন্ত সাধক উন্নিত হতে পারেন৷ অপরাপর ১০টি কর্মস্থান ভাবনা দ্বারা সাধক উপচার সমাধি স্তর পর্য্যন্ত শমথ পর্যায়ে উন্নীত হয়ে থাকেন ৷ তবে দীর্ঘ ভাণকমহাসীব স্থবির মতে আনাপান ও অশুভ ভাবনাদ্বয় অপর্ণা সমাধি পর্যায়ভুক্ত এবং অবশিষ্ট ১৯টি কর্মস্থান উপচার সমাধি পর্যায়ভুক্ত। কারন ইর্য্যাপথ, সম্প্রজ্ঞান, পঞ্চ নীবরণ এবং বোধ্যংগ সমূহে চিত্তের অভিনিবেশ ভাব জন্মে না। এগুলো প্রশ্ন করে করেই চিত্তের একাগ্রতা আনায়ন করতে হয়। যেমন “আমার ইয্যাপথে কি স্মৃতি নেই? আমার কি চারি সম্পজ্ঞানে স্মৃতি নেই? আমার কি পঞ্চ নীবরণে স্মৃতি নেই? ইত্যাদি।’
মহাসতিপট্ঠান সুত্তে বর্ণিত একুশটি কর্মস্থানকে চারিটি ভাগে বিভত্ত করা হয়েছে। যথা- কায়ানুদর্শন, বেদনানুদর্শন, চিত্তানুদর্শন এবং ধর্মানুদর্শন।
কায়ানুদর্শন – বুদ্ধ তথাগত কর্তৃক উত্ত হয়েছে- “হে ভিক্ষুগণ! এক ধর্ম ভাবিত বহুলীকৃত হলে মহাসংবেগ উৎপত্তির হেতু হয়ে থাকে, মহা অর্থের হেতু হয়ে থাকে, মহান যোগক্ষেমের প্রতিলাভের হেতু হয়ে থাকে, দৃষ্টধর্ম-সুখ বিহারের হেতু হয়ে থাকে, বিদ্যা বিমুত্তি ফল লাভের হেতু হয়ে থাকে; সেই এক ধর্ম কি? কায়গত স্মৃতি । হে ভিক্ষুগণ! তারাই অমৃত পরিভোগ করে? যারা কায়গত স্মৃতি অনুশীলন করে। ……
এভাবে বহু প্রকারে কায়গতানুস্মৃতি অনুশীলনের উপকারীতা বর্ণনা করে ভগবান তথাগত বললেন, “হে ভিক্ষুগণ! কিরুপে কায়গত স্মৃতি ভাবিত, বহুলীকৃত হলে মহাফল ও মহানিসংশ প্রদ হয়ে থাকে? ভিক্ষু এ বুদ্ধের শাসনে অরণ্যগত, বৃক্ষমূলগত, শুন্যাগারগত হয়ে … “কর্মস্থানের যে কোনটির গ্রহণ করে তাকে ভাবিত, বহুলীকৃত করলে তা মহাফল, মহানিসংশ প্রদ হয়ে থাকে।’
এই উচ্চ প্রশংসিত কায়ানুদর্শন ভাবনা অনুশীলন প্রণালী ভেদে আনাপান, ইর্য্যাপথ, সম্প্রজ্ঞান, প্রতিকূল মনসিকার, ধাতু মনসিকার, নব সীবথিকা-এই চৌদ্দ প্রকারে বিভক্ত করা হয়েছে। এখানে ইর্য্যাপথ, সম্প্রজ্ঞান, ও ধাতু মনসিকার এই তিন পর্ব বিদর্শন ভাবনা বশে কথিত হয়েছে। নব সীবথিকা বিদর্শন জ্ঞান সমূহে আদীনবানুদর্শন (দুঃখ, উপদ্রব এবং অসার পরিণতি ইত্যাদি সংবেগ উৎপাদক ধর্ম) বশে কথিত হয়েছে। আনাপান ও প্রতিকূল মনসিকার এই দুই পর্ব সমাধি উৎপাদক বশে কথিত।
আনাপান স্মৃতি অনুশীলন কালে ষোল প্রকারে নিজ ও পর দেহের শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়াকে কামারের ভস্ত্রার ন্যায় সারাদেহ পরিব্যাপ্ত করে বায়ুর উত্থান-পতনাদি সঞ্চালন ক্রিয়া অনুভবের কথা বলা হয়েছে।
প্রাণী মাত্রেই দাড়ান, গমন, উপবেশন ও শয়ন এই চার অবস্থায় অতিবাহিত করে থাকে । দেহের এই চারি পর্য্যায়ের অবস্থানকে ইর্য্যাপথ বলে। এই ইর্য্যাপথের যখন যেইটিতে দেহ অবস্থান করে তখন তার প্রতি মনযোগী হয়ে চিত্তের একাগ্রতা সাধনকে ইর্য্যাপথ ভাবনা বলে।
দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গাদির সংকোচন- প্রসারণ ক্রিয়া; বিশেষত হাত-পা ও ঘাড়ের কাজ, চোখের দর্শন, কানের শ্রবণ, পান ভোজনাদিতে আস্বাদন, দেহের শীতোষ্ণ, ব্যথা-বেদনা, চুলকানি ইত্যাদি অনুভূতি, পায়খানা-প্রস্রাব, ধোবন-স্রানাদি যাবতীয় ক্রিয়া, পোষাক-পরিচ্ছদাদি গ্রহণ-পরিধান, অন্যের সাথে বাক্যালাপ ইত্যাদি যখন যেটি করা হয় তখন তা অত্যন্ত সচেতন ভাবে জেনে জেনে করা; যখন যে কাজে লিপ্ত থাকতে হয় তখন সেই কাজে মন থাকছে কিনা? মনকে এভাবে প্রশ্ন করে করে সে শুরু থেকে সমাপ্তি পর্য্যন্ত দেহ মনের যাবতীয় ক্রিয়ার স্বরূপ উৎপত্তি ও সমাপ্তি বা ধ্বংস বশে জ্ঞাত হওয়ার নাম সম্প্রজ্ঞান।
এই চারি সম্প্রজ্ঞান সম্পর্কে দীর্ঘ নিকায়ে শীল স্কন্ধ পর্বের “শ্রামণ্য ফল সূত্রে” মহারাজ অজাতশত্রুকে ভগবান তথাগত বলেছেন, “মহারাজ! ভিক্ষু কিরুপে স্মৃতি সম্প্রজ্ঞান সমন্বিত হয়ে থাকেন? ভিক্ষু সম্মুখ গমনে ও পশ্চাৎ গমনে সম্প্রজ্ঞান যুত্ত হন। অবলোকনে, বিলোকনে (ডানে, বামে দর্শনে), হস্ত-পদ সংকোচনে, প্রসারণে, পাত্র-চীবর গ্রহণে, ভোজনে, পানীয় গ্রহণে, শৌচ কর্মে, দাড়ান, গমন, উপবেশন ও শয়নে, নিদ্রা ও জাগরণে, বাক্যালাপে ও নীরবে অবস্থান কালে সম্প্রজ্ঞান যুক্ত হন। মহারাজ! ভিক্ষু এভাবে স্মৃতি সম্প্রজ্ঞান সমন্বিত হয়ে থাকেন।’
প্রতিকূল মনসিকার ভাবনা সম্পর্কে বলা হয়েছে এই দেহে মাথার চুল থেকে পায়ে তালু পর্য্যন্ত পরিধিতে যা কিছু তৎ সমুদয়ের আকৃতি, বর্ণ, অবস্থান ইত্যাদি বশে জ্ঞাত হয়ে সেগুলোর প্রতি অনাসক্তি ভাব উৎপন্ন করতে হয়। এই ভাব উৎপাদনার্ধে মনের মধ্যে সেগুলোর প্রতি অশুচি ও ঘৃণাভাবের জন্ম দিতে হয়। যেমন- এইটি একটি মানব দেহ, স্ত্রী দেহ, পুরুষের দেহ, আমার দেহ, যুবক-যুবতীর দেহ ইত্যাদি ভাব মনন দ্বারা দেহ নামক একটি বন্তু পিন্ডকে ঘিরে নর-নারীর মনে আসক্তি-বিরক্তি দন্ধ-সংঘাতে যেই করুণ আর্তনাদ দিবা-রাত্র বয়ে চলছে তার হাত থেকে কত সহজেই মানুষ মুক্তি লাভ করতে পারে, যদি সে জ্ঞান নেত্রে দর্শন করতে থাকে- এইটি দেহ নহে, স্ত্রী নহে, পুরুষ নহে; ইহা চুল, লোম, নখ, দাত, চামড়া, মাংস, স্নায়ু, অস্থি, অস্থিমজ্জা, যকৃত, ক্লোম,শ্লেষা, ফুস্ফুস, হৃদপিণ্ড, নাড়ি, ভূড়ি,মল মূত্র, সিকনি, কফ্‌, লালা ইত্যাদি ঘৃণ্য বস্তুর সমষ্টি মাত্র। এই দেহের উৎপত্তি পিতার ঘৃণ্য পুযহ জাতীয় শুক্র দ্বারা, মাতৃ উদরের ঘৃণিত মল মৃত্র স্থানে সত্যিকার কৃমিকীট হিসাবে এই দেহের জন্ম। ইহা গলিত পঁচা দুর্গন্ধ খাদ্য রসের দ্বারা বর্ধিত। শ্বাস বায়ু বন্ধের সাথে সাথে বহু নন্দিত-আকাংখিত, একান্ত প্রিয় এই দেহে পচন শুরু হয়। তাই মুহুর্তেই দেহের প্রতি প্রিয় প্রেম উধাও হয়ে শ্বশানে নিক্ষিপ্ত হয়। এমন অশুচি ঘৃণ্য, এবং পরিত্যাজ্য দেহকে নিয়ে এত আসত্তি, প্রেমের কল্পনা নিতান্তই মূর্খতা প্রসূত নহে কি? নিজ দেহ ও পর দেহের প্রতি এই বিশ্বাস ও মনোবৃত্তিকে স্থায়ী ভাবে জাগ্রত রাখার প্রচেষ্টাই হল প্রতিকুল মনসিকার ভাবনা ।
এইটি দেহ নহে, স্ত্রী পুরুষও নহে, সত্ত্ব-আত্মা জীবও নহে। ইহা মাটি, জল, বায়ু, তাপ এই চারি মহাধাতু উপকরণের সমষ্টি মাত্র। একটি গরুকে হত্যার পর কসাই যখন ইহার চামড়া, মাংস, হাড় ও নাড়ি ভূড়িকে চারভাগে পৃথক করে রাখে তখন এগুলোকে ভিত্তি করে যেমন প্রাণীর ধারণা লুপ্ত হয়, একই ভাবে সাধক নিজ ও অপর দেহের গঠন উপদানে দেহের উপরোক্ত বত্রিশটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে মাটির অংশ, জলের অংশ, তাপ ও বায়ুর অংশ এভাবে বিভত্ত করে জ্ঞান নেত্রে পুনঃ পুনঃ দর্শন করতে থাকেন। তখন এই দেহ আমার দেহ, তাহার দেহ বা তোমার দেহ এ সকল মহাভ্রান্ত ধারণার বিশ্বাসের মূলোৎপাঠন হয়ে যায়। ইহাকে বলে চারি ধাতু মনসিকার ভাবনা।
নব সীবথিকা বলতে মৃত দেহকে মাটিতে পুতে না রেখে বা অগ্নি দগ্ধ না করে শ্বশানে ফেলে রাখলে অনুক্রমে যেই নয় প্রকার অবস্থা প্রাপ্ত হয় তাকে নব সীবথিকা বলে। এই নববিধ পর্য্যায়ের প্রত্যকটির যে কোন একটি অবস্থাকে ধ্যানের অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করে জীবিত দেহের এই প্রত্যক্ষ পরিণতি দৃশ্য সাধকের মনে দৃঢ় প্রতিষ্ঠা দানের দ্বারা নিজ দেহ ও পর দেহের প্রতি মমত্ব এবং আসক্তি ভাব বর্জন করা যায়। সংক্ষেপে ইহাই চৌদ্দ প্রকার কায়ানুদর্শন ভাবনা পরিচিতি ।
অতঃপর আসে বেদনানুদর্শনের কথা । সুখ, দুঃখ এবং উপেক্ষা এই ত্রিবিধ অনুভূতিকে কায়িক ও মানসিক ভাবে বিভাগ করতে গেলে সুখ ও দুঃখকে কায়িক বেদনা এবং সৌমনস্য, দৌর্মনস্য ও উপেক্ষা বেদনাকে মানসিক বেদনার পর্য্যায়ভুক্ত করে মোট পাচ প্রকার বেদনা গণনা করা হয়। অভিধর্মে প্রকীর্ণ সংগ্রহে মানসিক পর্য্যায়ে বেদনা তিনটির মধ্যে সৌমনস্য বেদনাকে মোট ৬২ প্রকারে বিভক্ত করা হয়েছে। তন্মধ্যে লোভ মূলক সৌমনস্য সহগত চিত্ত ৪, কামাবচর শোভন চিত্ত ১২, সুখ-সন্তীরণ বিপাক চিত্ত ১, হসিত্যোৎপাদ ক্রিয়াচিত্ত ১। সর্বমোট এই ১৮টি চিত্ত সৌমনস্য সহগত কামাবচর চিত্তের অন্তর্গত। অপরদিকে মহদগত চিত্ত ও লোকোত্তর ধ্যান চিত্তের মধ্যে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ ধ্যানের মোট চুয়াল্লিশটি চিত্ত সৌমনস্য সহগত। অতএব চিত্তানুসারে সৌমনস্য বেদনার সর্বমোট সংখ্যা দাড়ায় বাষট্টি।
দৌর্মনস্য চিত্তের প্রতিঘ স্বভাব অনুসারে অসংস্কারিক ও সসংস্কারিক চিত্ত ভেদে সৌর্মনস্য বেদনার সংখ্যা দুইটি। এবং উপেক্ষা সহগত চিত্তের সংখ্যানুসারে উপেক্ষা বেদনার সংখ্য পঞ্চান্নটি।
চিত্তানুসারে বেদনার এরূপ শ্রেণী বিভাগের পরেও মহাসতিপট্ঠান অট্ঠকথায় বেদনার সংখ্যা উল্লেখিত হলো- “এবম ভগবা চুদ্দসবিধেন কাযানুপস্সনা সতিপট্ঠান কথেতা ইদানি নববিধেন বেদনানুপস্সনং কথেতুং-কথঞ্চ পন ভিক্খবে ভিক্খু বেদনানুপস্সী বিহরতীপ্তি-আদিম্হা”। মহাসতিপটঠান সুত্রে বেদনা বিভাজনের প্রনালীতে বেদনার ৯টি সংখ্যাকে তাই এভাবে প্রদর্শন করা হয়েছে- সুখ বেদনা, দুঃখ বেদনা, উপেক্ষা বেদনা, সামিষ সুখ বেদনা, সামিষ দুঃখ বেদনা, সামিষ উপেক্ষা বেদনা, নিরামিষ সুখ বেদনা, নিরামিষ দুঃখ বেদনা এবং নিরামিষ উপেক্ষা বেদনা। সর্বমোট এই নয়টি বেদনা।
সতিপট্ঠানে বেদনানুদর্শন এভাবে করতে হয় যাতে সাধকের মনে এই ভাব বিদুরিত হয় যে, এখানে “আমিই সুখ, দুঃখ, উপেক্ষা এ সকল বেদনা অনুভব করছি। যেহেতু এখানে এই বেদনার অনুভূতিতে সত্ব-আত্মা জীব বলে কেহ নেই। বেদনার এই অনুভূতি তাহলে কি কারণে, কিভাবে, কাকে অবলম্বন করে অনুভূত হচ্ছে? মাটি, জল, বায়ু, তাপ এই চারি মহাভূত বস্তুকে অবলম্বন করেই সুখ, দুঃখাদি বেদনার উৎপত্তি এবং প্রবর্তন হচ্ছে মাত্র। সাধকের মনে এই ধারণা বিশ্বাসের ভিত্‌ ক্রমে দৃঢ় হতে দৃঢ়তর করতে হবে মনে মনে পুনঃ পুনঃ অনুশীলন দ্বারা। ফলে লাভ-অলাভ, যশ-অযশ, নিন্দা-প্রশংসা, মান-অপমান এই অষ্ট লোক ধর্মে নিয়ত সংক্ষুব্ধ মানব হৃদয়ে অবিরাম রত্ত ক্ষরণ সাধকের মাঝে বন্ধ হয়ে যাবে অতি সহজেই ।
‘চিত্তানুদর্শন’ বলতে সতিপটঠান অটঠকথা মতে ১৬ প্রকার চিত্তের কোনটি কখন উৎপন্ন হয়ে দেহ-মনে কখন কিরূপ প্রতিক্রিয়ায় সৃষ্টি করে তা উৎপত্তি ক্ষণে অবগত হওয়া বুঝায়। সেই ষোল প্রকার চিত্তসমূহ হল- (১)সরাগ (লোভ) চিত্ত, (২)বীতরাগ চিত্ত, (৩)সদ্বেষ চিত্ত, (8)বীতদ্বেষ চিত্ত, (৫)সমোহ চিত্ত, (৬)বীতমোহ চিত্ত, (৭)সংক্ষিপ্ত (সংকোচ বা জড়তা ভাব) চিত্ত, (৮)বিক্ষিপ্ত চিত্ত, (৯) মহদগত (পঞ্চবিধ রূপাবচর) চিত্ত, (১০)অমহদগত (অষ্টবিধ কুশল কামাবচর) চিত্ত, (১১) সউত্তর (কামাবচর বিপাক ও ক্রিয়া) চিত্ত, (১২) অনুন্তর (রূপাবচর ও অরুপাবচর উভয়বিধ) চিত্ত, (১৩)সমাহিত (অর্পণা ও উপচার সমাধিযুক্ত) চিত্ত, (১৪) অসমাহিত (উভয়বিধ সমাধি বর্জিত) চিত্ত, (১৫) বিমুক্ত (পঞ্চ নীবরণ মুক্ত) চিত্ত, (১৬) অবিমুক্ত (পঞ্চ নীবরণ যুক্ত) চিত্ত।
অভিধর্মে চিত্ত সংগ্রহ মতে সর্বমোট চিত্ত সংখ্যা ৮৯। তন্মধ্য অকুশল চিত্ত ১২, কুশল চিত্ত ২১, বিপাক ৩৬, ক্রিয়া ২০। সর্বমোট ৮৯টি চিত্ত। অন্যভাবে বিভাজনে কামাবচর চিত্ত ৫৪, রূপাবচর চিত্ত ১৫, অপর্বচর চিত্ত ১২ এবং লোকোত্তর চিত্ত ৮টি।
উক্ত ৮৯ প্রকার চিত্তের ৮টি লোকোত্তর চিত্তের প্রত্যেকটির সাথে প্রথম ধ্যানাদি বিতর্ক, বিচার, প্রীতি, সুখ, একাগ্রতা এই ৫টি ধ্যানাঙ্গযুক্ত হয়ে লোকোত্তরের সর্বমোট চিত্ত সংখ্যা দাড়ায় ৮*৫- ৪০টি। অতএব কামাবচর চিত্ত ৫৪, রূপাবচর চিত্ত ১৫ এবং অরুপাবচর চিত্ত ১২। সর্বমোট এই ৮১টি চিত্তের সাথে লোকোত্তর ৪০টি চিত্ত যুক্ত হয়ে সর্বমোট চিত্ত সংখ্যা দাড়ায় ১২১টি। এ সকল চিত্তের স্বভাব প্রকৃতি অভিধর্মে সম্প্রয়োগ বিধি অনুসারে জ্ঞাত হয়ে যেই ক্ষণে যেই চিত্ত উৎপন্ন হয় তা নিজের ও সময়ে পরের মধ্যে অনুধাবন করে চিত্তের উৎপত্তি ও নিরোধ ভাব দর্শনেই হলো চিত্তানুদর্শন ভাবনা । সাধক চিত্তের উৎপত্তি ও নিরোধ এই সময় কাল পর্য্যন্ত জ্ঞান সম্প্রযুক্ত অনাসন্তু চিত্তভাব গঠনের মাধ্যমে নিজেকে সর্বদা নির্বাণমুখি রাখা-ইহাই চিত্তানুদর্শন ভাবনার মূল লক্ষ্য ।
“ধর্মানুদর্শন’কে অট্ঠকথা অনুসারে পাচ ভাগে ভাগ করা হয়েছে। যথা- (১)নীবরণ পর্ব, (২)স্কন্ধ পরিগ্রহণ পর্ব, (৩)আয়তন পরিগ্রহণ পর্ব (8)বোধ্যংজ্ঞ পরিগ্রহণ পর্ব এবং (৫) সত্য পরিগ্রহণ পর্ব।

‘প্রভাম্বরম ইদম চিত্তম’- চিত্তের প্রকৃত স্বরৃপ প্রভাস্বর তথা আলোময়। কিন্তু লোভ, দ্বেষ, মোহ থেকে উৎপন্ন নানা অকুশল কর্মে ছাপ বা আবরণ পড়তে পড়তে চিত্তে প্রভাস্বর স্বভাবটি পূর্ণচন্দ্রের উপর গভীর কালো মেঘের আবরণের মত কর্ম সংস্কারের যে গভীর আস্তরন সৃষ্টি হয় পালি ভাষায় তাকে “নীবরণ’ বলে। এই নীবরণ ধ্যান বা স্মৃতি অনুশীলন কালে চিত্তের একাগ্রতা আনয়নের পথে বার বার বাধা সৃষ্টি করে। তাই ধ্যানে উৎকর্ষতা সাধনের জন্যে সাধককে সর্বপ্রথম অকুশল কর্ম সংস্কার জাত এ সকল নীবরণ সমূহকে চিত্ত হতে বিদূরিত করতে হয়। চিত্তের এই নীবরণকে ৫ ভাগে বিভত্ত করা হয়েছে। যথা- কামচ্ছন্দ, ব্যাপাদ, থীনমিদ্ধ, ওদ্ধত্য-কৌকৃত্য ও বিচিকিৎসা। সতিপট্ঠান অট্ঠকথার নীবরণ পর্বে সাধনার অন্তরায় এই পঞ্চ নীবরণ সমূহ কিভাবে বিদূরণ করতে হয় সে বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া আছে।
স্কন্ধ অর্থে সমষ্টি বুঝায়। “উপাদান’ অর্থে এখানে উপকরণ বুঝানো হয়েছে। এই দেহকে সংক্ষেপে পঞ্চ উপাদান স্কন্ধ বলা হয়েছে। কারণ এই দেহের স্বভাব লক্ষণ বিশ্লেষণ করতে গিয়ে দেহ বা “রূপ” এবং মন বা “নাম’ এই দুইভাগে বিভত্ত করা হয়। দেহ বা রূপকে বলা হয় রুপস্কন্ধ এবং বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞানকে বলা নামস্কন্ধ । তাই দেহ মন উভয়ের সমন্বয়ে হয়েছে পঞ্চ উপাদান স্কন্ধ। আবার “রুপ”কে ভাজন করতে গিয়ে তার মধ্যে পাওয়া যায় মাটি, জল, বায়ু ও তাপ এই চারিটি মহাধাতু । এদেরকে সংক্ষেপে “চারি মহাভূত” ও বলা হয়। উত্ত চারি ধাতুর মধ্যে মাটি-ধাতুর কাঠিন্য লক্ষণ, জল ধাতুর বন্ধন লক্ষণ, বায়ু ধাতুর সঞ্চালন লক্ষণ এবং তাপ ধাতুর শীতোষ্ণ লক্ষণ বিদ্যমান। শুধু মাত্র দেহ নহে এই বিশ্ব চরাচরে যাবতীয় বন্তু উত্ত চারি মহাধাতুর সমষ্টিতে গঠিত। এই মহাধাতুর সমষ্টি ক্ষয়শীল, ব্যয়শীল, তথা উৎপন্ন ও ধ্বংসের স্বভাবে রূপান্তর ধর্মতা বিশিষ্ট । তাই তাকে রূপ বলা হয়।
অপরদিকে নামস্কন্ধ বেদনা, সংজ্ঞা, সংক্কার ও বিজ্ঞান এই চারিটি উপদানের স্বভাব লক্ষণেও একই উৎপত্তি-বিলয় তথা অনিত্য ধর্মতা পরিলক্ষিত হয়। সাধক তাই নাম-রূপের স্বভাব লক্ষণের সাথে বিশদ পরিচিতি লাভের পর তাদের উৎপত্তি এবং বিলয়কে যেমন বিশদভাবে জানতে হয় একই ভাবে যতক্ষণ পর্য্যন্ত সেই উদয়-ব্যয় চিত্তভাব মনে বিরাজ করে ততক্ষণ পর্য্যন্ত তার জ্ঞাত অবস্থা বজায় রাখতে হয়। এতে সাধকের মধ্যে নামরূপের উদয় ব্যয় লক্ষণ বিশদভাবে উদ্ভাসিত হওয়া কারণে এই দেহ মনের সংশ্লিষ্ট সবকিছুতেই অনাসক্তধর্মী নির্বাণ চিত্ত গঠিত হতে থাকে
“আয়তন’ বলতে ষড় আয়তন কে বুঝায়। যথা- চক্ষু আয়তন, শ্রুতি আয়তন, ঘ্রাণ আয়তন, জিহ্বা আয়তন, কায় আয়তন এবং মন আয়তন । এগুলো এক একটি জন্ম অসংখ্য জন্মান্তরীন কর্ম-সংক্কার সৃষ্টি ও ধারণে সমুদ্র সদৃশঃ বিধায় এদেরকে আয়তন বলা হয়।
নিজ দেহ সংশ্লিষ্ট চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহবা, কায় ও মন এই ছয়টি আয়তনকে আধ্যাত্মিক আয়তন এবং চক্ষু, কর্ণাদি ষড়ায়তনের প্রত্যেকটি সংশ্লিষ্ট বিষয় বা আলম্বনকে বহিরায়তন বলে। যেমন- চক্ষু আয়তনের বহিরায়তন হচ্ছে “রুপ”; কর্ণের বহিরায়তন হচ্ছে “শব্দ’ ইত্যাদি। এদেরকে বাহ্যিক আয়তন বলে। সাধক নিজে ও পরের মধ্যে এই ষড়ায়তন সংশ্লিষ্ট বিষয় গুলো প্রত্যেকটির আবির্ভাব ও তিরোভাবকে অনিত্য, দুঃখ ও অনাত্ম এই ত্রিলক্ষণ জ্ঞানে বিশেষভাবে জ্ঞাত হয়ে সচিত্তকে আসক্তি বিরক্তি মুক্ত রাখেন। ফলে সাধকের মধ্যে নির্বাণমুখি অনাসন্তু চিত্তভাব গঠিত হতে থাকে। বিদ্যাবিমুক্তি লাভের পথে এই ষড়ায়তন সংশিষ্ট বিষয়ে সাধক-চিত্ত আসক্তি যুক্ত হলে সাধকের ভব বন্ধন তথা দশবিধ সংযোজন উত্তরোত্তর বৃদ্ধি বিপুলতা লাভ করে। আর নির্বাণমুখি অনাসক্ত চিত্তভাব উৎপাদন করতে পারলে বিমুক্তি পথে মহা অন্তরায় স্বরূপ সেই দশবিধ সংযোজন ক্রমে ছিন্ন হয়ে যায়। এই দশবিধ সংযোজন হলো- কামরাগ, হিংসা, মান, সন্দেহ, মিথ্যাদৃষ্টি, শীলব্রত-পরামর্শ, মাৎসর্য্য, ভবতৃষ্ণ ও অবিদ্যা।
“বোধ্যঙ্গ, কে সম্বজ্জোংগ ও বলা হয়ে থাকে। শব্দ বিভাজনে ইহা সং+বোজ্জোংগ= সম্বজ্জোংগ হয়ে পূর্ণ অর্থ প্রকাশক হয়ে থাকে । আবার ‘বোধির অঙ্গ” কে বোধ্যঙ্গ বলে। এখানে বোধি বলতে বোধ শক্তি বা বুঝবার ধারণ শত্তি বুঝায়। এবং সম্বোধ্যঙ্গ বলতে সেই বোধশক্তি উৎপাদনের অঙ্গ সমূহকে বিশেষভাবে ধারণের উপায় বুঝায়। সেই বোধশত্তি তথা বোধিজ্ঞান হলো এই জীবনকে ভিত্তি করে উৎপন্ন দুঃখ সত্যকে বিশেষভাবে জ্ঞাত হওয়া। দুঃখ উৎপত্তির কারণকে বর্জনে অবিরাম প্রচেষ্টায় নিয়োজিত হওয়া। দুঃখের উৎপত্তি ও অবসান স্বভাবকে বিশেষভাবে প্রত্যক্ষ করা এবং দুঃখের চির অবসানে একমাত্র উপায় আর্য্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ পথে জীবন গঠনে অধ্যবসায়ী হওয়া। এই অষ্টাঙ্গিক মার্গ পথে জীবন গঠনে সাফল্য লাভের অঙ্গ সমূহ হলো- স্মৃতি, ধর্ম বিচয়, বীর্য্য, প্রীতি, প্রশান্তি, সমাধি ও উপেক্ষা । এই সাতটি অঙ্গকে সম্বোধ্যংগ বলা হয়। ইহাদের উৎপাদন ও বিকাশ কিভাবে সহজ হয় সেই সম্পর্কে অত্র অট্ঠকথায় বিশদ বর্ণনা আছে।
“চারিসত্য’ বলতে চতুরার্য্য বুঝায়। বোধ্যঙ্গ পর্বে উপরোক্ত বর্ণিত মতেই চারিসত্যকে জানতে হবে, বুঝতে হবে। দুঃখ, দুঃখ সমুদয়, দুঃখ নিরোধ এবং দুঃখ নিরোধের মার্গ-এ চারিটিকে চতুরার্য সত্য বলে। দুঃখ সত্য নির্দেশে জন্ম দুঃখ, ব্যাধি দুঃখ, জরা দুঃখ, মরণ দুঃখ, অপ্রিয় সংযোগ দুঃখ, প্রিয় বিয়োগ দুঃখ, সংক্ষেপে এই দেহ তথা পঞ্চস্কন্ধ ধারণ জনিত দুঃখ কে বিশেষ ভাবে জানা ও হৃদয়ঙ্গমের জন্যে সমগ্র জীবন- দৃষ্টিকে অনিত্য, দুঃখ, ও অনাত্মা এই ত্রিলক্ষণ জ্ঞান দ্বারা আয়ত্ত করতে হয়।
লোভ, দ্বেষ, মোহ এই তিনটি যাবতীয় দুঃখোৎপত্তির যে মূল কারণ, সেই কারণ ত্রয়কে সমুদয় আর্য্যসত্য বলে। দুঃখোৎপত্তির এই ত্রিবিধ মূল কারণকে সমূলে উৎপাঠন ও বিসর্জন দ্বারা দুঃখ সমুদয় আর্ধ্যসত্য আয়ত্ত হয়।
অশেষ, বিরাগ, নিরোধ ইত্যাদি শব্দগুলো নির্বাণেরই প্রতিশব্দ । সর্ব প্রকার তৃষ্ণা তথা ভোগাকাংখা যেই যেই বস্তুকে আশ্রয় করে উৎপন্ন হয় সেই সেই উৎপত্তি স্থান দর্শন এবং সেই তৃষ্ণার অভাব হেতু উৎপন্ন তৃষ্ণার নিরোধ দর্শনই নিরোধ “আর্য্য সত্য” ।
মার্গ আর্য্য সত্য বলতে দুঃখ সত্যকে জ্ঞাত হতে, সমুদয় সত্যকে বর্জন করতে, এবং নিরোধ সত্যকে প্রত্যক্ষ করতে সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সঙ্কল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক আজীব, সম্যক প্রচেষ্টা, সম্যক স্মৃতি এবং সম্যক সমাধি-এই আটটি উপায়ের নিয়ত অনুশীলন বুঝায়।

সম্মন্ধে SNEHASHIS Priya Barua

এটা ও দেখতে পারেন

পরিস্কার বাংলায়ঃ জাতের নামে বজ্জাতি

Leave a Reply

Translate »