ইলা মুৎসুদ্দী
শাক্যবংশ পত্তনকারী রাজপুত্রগণের পিতা অগ্নিক বা ইক্ষাকু মৃত্যুর পর জন্ম জন্মান্তর মানব ও দেবযোনীতে ভ্রমণ করিতে করিতে বহুজন্মের পর ভদ্রকল্পে গৌতম বুদ্ধের আর্বিভাব সময়ে চম্পক নগর রাজ্যে (বর্তমান ভগল পুর রাজ্যে) উপশ্রেষ্ঠী নামক শ্রেষ্ঠীর গৃহে জন্ম গ্রহন করেন। তাঁহার মাতৃজঠরে প্রতিসন্ধিকাল হইতে পিতামাতার গৃহে ধনরত্নাদি বিপুল ভাবে বৃদ্ধি হইতে লাগিল। এবং সমাজে সম্মান, মর্যাদা প্রচুর বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। ধনভান্ডার সমুহ অক্ষুন্ন রহিল।
জন্মের সময় চম্পক নগর রাজ্যবাসী আসিয়া সকলে তাঁহাকে পূজা উপাচার দ্বারা অভিনন্দিত ও সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করিল। তাঁহার মাতাপিতা ভাবিতে লাগিলেন, “আমাদের পুত্রের সঙ্গে তুলনা করিবার মত জম্বুদ্বীপে কেহ নাই, অগ্নিগোলকের ন্যায় উজ্জলতার সহিত প্রজ্জলিত জম্বুরাজ সুবর্ণ প্রতিমার ন্যায় মনোরম রূপ লাবণ্যে সমৃদ্ধ। নিজের নাম যেন নিজেই সঙ্গে আনিয়াছে সুবর্ণতুল্য উজ্জল তাই তাহার নাম “সোনা” নামে অভিহিত করা হইল। নবজাত সন্তানের শরীর ও হস্তপাদ সুগঠিত, সুন্দর এবং তুলাপিন্ডের ন্যায় কোমল, মসৃণ মনোরম।
সেই সোনাশ্রেষ্ঠী নন্দনের পরিচর্য্যার জন্য জন্ম হইতে ছয়শতচারি জন ধাত্রী ছিল। এই সব ধাত্রী দ্বারা সেবা শুশ্রুষা লাভ করিয়া বড় হইতে লাগিলেন। তিনি বিশেষভাবে উৎপন্ন সুগন্ধিযুক্ত উত্তমশালী ধান্য হইতে প্রস্তুত চাউলের অন্ন ভোজন করিতেন। অন্ন পাক করিবার সময় ভগ্ন বা ক্ষুদ চাউলগুলি বাদ দিয়া অভগ্ন চাউলগুলি রতœময় ভান্ডে রাখিয়া শতবার ধৌত করিয়া রতœময় ভান্ডের ফুটন্ত জলে সিদ্ধ করা হইত, এই সিদ্ধ চাউল বা ভাত সৃত, মধু ও গুড়ের সহিত পুনরায় রন্ধন করিয়া সুবর্ন পাত্রে শ্রেষ্ঠী পুত্রকে পরিবেশন করা হইত। শ্রেষ্ঠী পুত্র পরিমান মত এই অন্ন সুস্বাদু ব্যঞ্জন সহ আহার করিয়া সুবর্ন জলে মুখ প্রক্ষালন করিত। এবং মুখে সুগন্ধি লেপন করিয়া সিংহ, ব্যাঘ্র ও তরক্কু ছবি অিখত চারি হাত প্রস্থ – অষ্ট হাত দীর্ঘ – সুকোমল গালিচায় কিছুক্ষণ পায়চারি করিয়া রতœ পালেখ শয়ন করিত। তখন ডানে বামে একশত করিয়া সুন্দরী যুবতীগণ রতœদন্ডযুক্ত সুবর্ণ ও রৌপ্য ব্যজনী দুলাইয়া সুললিত কন্ঠে মৃদু মৃদু সঙ্গীত পরিবেশন করিত। এইভাবে মহাসুখ প্রাপ্ত হইয়া শ্রেষ্ঠী নন্দন বয়স প্রাপ্ত হইতে লাগিলেন। এক সময় শ্রেষ্ঠী পুত্রের পদ ও হস্ত পল্লবের শেষ প্রান্তে মুকুতা ও পদ্ম পুষ্পের ন্যায় মনোরম তিলকসমুহ উৎপন্ন হইল। মাঝে মাঝে দইমা বা কোন দাসীকে দিয়া তিলক গুলি মর্দিত করিবার জন্য আদেশ করিতেন।
সেই সোন কুমার পূর্ণ যৌবনে উপনিত হইলে তিন ঋতুতে বাসোপযোগী তিনটি প্রাসাদে বাস করিতে লাগিলেন। প্রত্যেক প্রাসাদে দেবধীতাবিনিন্দিতা দিব্য সুন্দরী পাঁচশত করিয়া কুমারী তাঁহার সেবা করিত ও তাঁহার মনোরঞ্জন করিত।
এই সোনা শ্রেষ্ঠী মগধরাজ বিম্বিসারের অন্তরঙ্গঁ বন্ধু ছিলেন। গৌতম বুদ্ধ রাজ গৃহে অবস্থিতিকালে রাজা বিম্বিসার স্বীয় বন্ধু সোনা শ্রেষ্ঠীকে সেই সংবাদ সুবর্ণ পাতে ‘তথাগতো বুদ্ধোলোকে সমুপ্পন্নো’ লিখিয়া বুদ্ধকে পূজা করিবার জন্য অনুরোধ করিলেন। শ্রেষ্ঠী পুত্র ও “বুদ্ধ” তথাগত শব্দ শ্রবন করিলে বিশেষ আনন্দিত হইয়া স্বকীয় পরিষদসহ বুদ্ধ সমীপে আগমন করিলেন। বুদ্ধের ধর্ম দেশনা শ্রবন করিয়া বুদ্ধ ধর্মের প্রতি বিশেষ শ্রদ্ধানি¡ত ও আকৃষ্ট হইয়া ভিক্ষুত্ত্ব গ্রহণের জন্য বুদ্ধের নিকট প্রার্থনা করিলেন। বুদ্ধ শ্রেষ্ঠীর পুত্রের প্রার্থনার জবাবে বলিলেন, “ হে সোন, আমি পিতামাতার অনুমতি ব্যতীত কাহাকেও ভিক্ষুত্ত্ব গ্রহনে অনুমতি দান করিনা।”
সোন শ্রেষ্ঠী পুত্র ও সপারিষদ গৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়া ভিক্ষুত্ত্ব গ্রহনের জন্য পিতামাতার অনুমতি প্রার্থনা করিলেন। তৎশ্রবনে পিতামাতা, -“হে øেহের বৎস সোন,- তুমি আমাদের একমাত্র সন্তান, তোমাকে আমরা আমাদের প্রাণের চেয়েও ভালোবাসি, মৃত্যু ব্যতীত তোমাকে আমাদের থেকে পৃথক করা সম্ভব নহে। আমরা জীবিত থাকিতে øেহ বশতঃ তোমাকে বিদায় দানে সক্ষম হইবনা। “ইহাতে সোন শ্রেষ্ঠী নন্দন বারবার তিনবার পিতামাতার অনুমতি প্রার্থনা করিলেন। কিন্তু পিতামাতা তাঁহার প্রার্থনা বারবার প্রত্যাখ্যান করিলেন এবং গৃহে সকল দ্বার রুদ্ধ করিয়া রাখিলেন। সোন শ্রেষ্ঠী নন্দন ও অন্ন জল ত্যাগ করিয়া প্রতিজ্ঞা করিলেন, ভিক্ষুত্ত্ব গ্রহনে পিতামাতা অনুমতি দান না করিলে এখানেই জীবন ত্যাগ করিব বলিয়া শয্যাগত হইলেন। সপ্তাহকাল পর্যন্ত অন্ন জল ত্যাগ করিয়া তাঁহার সংকল্পে অটল থাকার পর পিতামাতা অগত্যা “ভিক্ষুত্ত্ব গ্রহনকর” বলিয়া অনুমতি প্রদান করিলেন।
সোন শ্রেষ্ঠী পুত্র পিতামাতার অনুমতি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অতিশয় আনন্দিত হইয়া গাত্রোত্থান করিয়া শরীর সুস্থ করিলেন। তিন চারদিন অবস্থান করার পর বুদ্ধ সমীপে আগমন করিয়া ভিক্ষুত্ত্ব গ্রহন করিলেন। ভিক্ষুত্ত্ব গ্রহন করিয়া সোন রাজ গৃহে বেনুবনে অবস্থান করিতে লাগিলেন। তখন তাঁহার গার্হাস্থ্য জীবনের জ্ঞাতি গোষ্টী, শ্রেষ্ঠী ধনী এবং সহচর বন্ধুগণ দিবারাত্রি তাঁহার সেবা পূজা করিবার জন্য আগমন করিতে লাগিল। আবার অনেক লোক তাঁহার মনোরম রূপশ্রী দর্শনকামী হইয়া সেইখানে আগমন করিতে লাগিল।
তখন সোন ভিক্ষু চিন্তা করিলেন, “ আমার নিকট প্রত্যহ এই রকম বহুলোক আগমন করিতে থাকায় আমার বিদর্শন কর্মস্থান ভাবনা করিবার সময় পাইতেছিনা, এই স্থানে থাকিলে মার্গফল লাভের মাধ্যমে কিভাবে নির্বাণ শান্তি লাভ করিব? মানুষের ঘৃনিত ও পরিত্যক্ত শ্মশানে অবস্থান করিলে কেহ সেখানে যাইবেনা, কাজেই আমি সেই পরিত্যক্ত শ্মশানে গিয়া ভিক্ষু ধর্ম আচরণ করিব, সেখানে নির্জনে আমার অভীষ্ট সাধনা করিব”। এই রকম চিন্তা করিয়া বুদ্ধের সমীপে কর্মস্থান গ্রহন করিলেন এবং নগরের অবিদুরে পরিত্যক্ত শ্মশানে গমন করিলেন। শ্মশানে গিয়া ভাবিলেন, “ আমার শরীর অত্যন্ত সুকোমল, লৌকিক সুখের প্রত্যাশায় শ্রেষ্ঠতর লৌকত্তর সুখে উপনিত হইতে পারিনাই, এখন এই সুকোমল আরামপ্রিয় শরীরকে কষ্ট দিয়া ভিক্ষু ধর্ম আচরণ করিব” এইভাবে বুদ্ধ আদিষ্ট কর্মস্থান অনুযায়ী শয়ন ঈর্ষাপথ পরিহার করিয়া দন্ডায়মান, পদচারণা ও উপবেশন এই তিনটি ঈর্ষাপথে ভাবনা বৃদ্ধি করিতে লাগিলেন। উপবেশন করিয়া ধ্যান করিবার সময় স্থ্যানমিদ্ব (তন্দ্রালস) দ্বারা আক্রান্ত হইলে চংক্রমণ করিয়া সেই স্থ্যানমিদ্ব অপনোদন করিতে আরম্ভ^ করেন। এইভাবে চংক্রমন করিতে করিতে পদপল্লবে সেখাথক উৎপন্ন হইল, তথাপি অবিশ্রান্তভাবে চংক্রমন করিয়া ভাবনা বৃদ্ধি করিতে লাগিলেন এবং মাটির শক্ত পিন্ডে আঘাত প্রাপ্ত হইয়া পদপল্লবের সেখাথক ফাটিয়া পুজ পানি ও রক্ত বাহির হইয়া চংক্রমনের স্থান রক্তে রঞ্জিত হইল।
এই রকম কঠোরভাবে তিন মাস অবধি ধ্যান করিয়াও ধ্যান সমাপ্তি ও শ্রেষ্ঠ ধর্মের নিমিত্তাদি দর্শন করিতে সক্ষম হইলেন না। ভিক্ষুত্ত্ব গ্রহন করিয়া ভিক্ষু জীবন অবলম্বন করিলে কোন ফলোদয় হইবে না। ভিক্ষু ব্রত পরিহার করিয়া গার্হাস্থ্য জীবনের বিপুল ভোগ সমৃদ্ধি পরিভোগ করাই উত্তম হইবে। এই রূপ চিন্তা করিয়া নিরুৎসাহিত হইয়া রহিলেন।
বুদ্ধ সোন স্থবিরের এই অকৃতকার্য্যতার কথা জানিতে পারিয়া সেই দিন সন্ধ্যাকালে ভিক্ষুসংঘকে আহ্বান করিয়া লইয়া যেখানে সোন স্থবির কর্মস্থান ভাবনা করিতেছিলেন সেই পরিত্যক্ত শ্মশানে গমন করিলেন। সেই শ্মশানের এক প্রান্তে মাটি রক্ত রঞ্জিত ও পুঁজলিপ্ত দেখিয়া সোন স্থবিরকে যাবতীয় বিষয় প্রশ্ন করিলেন। তখন বুদ্ধ সোন স্থবিরকে বলিলেন বেসুরে বা বেতালে বীণা বাদন করিলে ঠিকমত বীণা বাদন হয়না, তার ও সুর ঠিক করিয়া বীণা বাদন করিতে হয়-এই উপদেশ দান করিয়া ভিক্ষু সংঘ সহ বিহারে চলিয়া আসিলেন। সোন স্থবির ও বুদ্ধের উপদেশে সংবেগ উৎপন্ন হইয়া স্মৃতিসহ প্রজ্ঞাও বীর্যসহ সমাধী -সমতা রক্ষা করিয়া ধ্যান করিয়া অচিরে চারি প্রতিসম্ভিদা ও ষড় অভিজ্ঞা স¤পন্ন অষ্ট সমাপত্তি সহ অর্হত্ত্ব ফলে উপনীত হইলেন।
অরহত্ত্ব ফল প্রাপ্ত হইবার পর সোন স্থবির জেতবন বিহারে তথাগত বুদ্ধ তাঁহাকে আরদ্ধ বীর্যে সর্বাগ্রস্থানে প্রতিষ্ঠিত করিলেন।
এই সোন ভিক্ষু গৃহী জীবনে ভোগ সমৃদ্ধিশালী মহাধনবান বংশ হইতে ভিক্ষুত্ত্ব গ্রহন করায় ভিক্ষু জীবনে “কোটি যশ সোন”-নামে অভিহিত হন।
সূত্র – বুদ্ধের সমকালীন ভিক্ষুসংঘ, মুদিতারত্ন ভিক্ষু