ধর্ম দানে মহামঙ্গল কেন?
ইলা মুৎসুদ্দী
দীর্ঘ নিকায়ের ‘সক্কপঞ্হ সুত্তে’ ভগবান ধর্মদান তথা ধর্মদেশনা প্রসঙ্গে বলেন-
ধর্মদান সর্বদানকে করে পরাজয়;
ধর্মরস সর্বরসকে জয় করে নিশ্চয়।
ধর্মরতি সর্বরতির শ্রেষ্ঠ যে হয়;
তৃষ্ণাক্ষয়ী জনে করে সর্ব দুঃখ জয়।
ইতিবুত্তক অট্ঠকথায় বলা হয়েছে ইহ পরলোকের দুঃখ বিনাশক, সুখবর্ধক সম্যক সম্বুদ্ধ দেশিত ধর্ম পরহিতের জন্য দেশনা করাই ধর্মদান। কেহ কুশল অকুশল, সদোষ-নির্দোষ, বিজ্ঞজনের নিন্দিত-প্রশংসিত ধর্ম আলোচনা ব্যখ্যাদি দ্বারা প্রকাশ করে বলেন- এরূপ কর্মসম্পাদনে অহিত হয়, দুঃখ হয়; এরূপ কর্ম সম্পাদনে হিত হয়, সুখ হয়। তারা এভাবেই ধর্ম দেশনা করেন। আবার কেহ কেহ বলেন, দুঃখ সত্য জ্ঞাতব্য, সমুদয় সত্য পরিত্যজ্য, নিরোধ সত্য সাক্ষাৎকরণীয়, এবং মার্গসত্য ভাবনীয় (অনুশীলণীয়)। এভাবেই তাঁরা ধর্মদেশনা করেন।
বুদ্ধ দ্বিতীয় পর্যায়ের ধর্মদানকেই সর্বোত্তম, সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্মদান বলেছেন। কারণ, এভাবে ধর্মদেশনা মোহবিনাশক, প্রজ্ঞালোক উৎপাদক সর্বদুঃখ বিনাশক এবং পরম শান্তি প্রদায়ক। এপর্যায়ের ধর্ম দেশককে বুদ্ধ লীলায় ধর্মদেশনা কর্ত্তব্য; যেমন হস্ত পদ ও মস্তক সঞ্চালন না করে সুখাসনে উপবেশন করে ধর্মদেশনা করা। প্রথম পর্যায়ের দেশনা ভব সম্পদ লাভের সহায় হয়, এবং অভয় দাতা মাত্র। আর দ্বিতীয় পর্যায়ের ধর্মদেশনায় চিত্তশুদ্ধি লাভ হয়, ভব দুঃখের চির অবসান হয়।
যিনি ধর্ম দেশনা করেন তিনি যেমন ধর্মদান করেন, ধর্মালোচনাকারী ও তেমনিভাবে ধর্মদান করেন। একইভাবে ধর্ম সভার বা ধর্ম শ্রবণের আয়োজক দ্বারা ও ধর্ম দান হয়ে থাকে। ঠিক একই পর্যায়ে ধর্ম গ্রন্থ লেখক এবং প্রকাশকগণ দ্বারা ও ধর্মদান হয়ে থাকে। ধর্মপদের বর্ণনায় এরূপই দেখা যায়-
দেব-ব্রহ্ম-নরলোক বুদ্ধ ও প্রত্যেক বুদ্ধগণ দ্বারা পরিপূর্ণ করে কেহ যদি সর্বোত্তম সর্বোৎকৃষ্ঠ চীবর বস্ত্র, খাদ্য ভোজ্য, ঔষধ-পথ্য এবং বিহারাদি শয়নাসন দান করেন; তাতে দাতার বস্তু দান জনিত বিপুল পুণ্য লাভ হয়। এই পুণ্যে দাতা দেব-মানব কুলে উৎপন্ন হয়ে মহা-সুখ সম্পত্তির অধিকারী হতে পারবেন।
আর কোন ব্যক্তি সেই দানের অনুমোদন তথা প্রশংসায় শুধু একটি মাত্র গাথা ও যদি ভাষণ করেন, সেই ভাষণের পুণ্য বিবিধ দানীয় সামগ্রী দানের পুণ্যের চেয়ে ও বিশাল হয়। কারণ, এই ধর্ম ভাষণের দ্বারা দাতা সকল প্রকারের পাপ বর্জন এবং সর্বপ্রকার কুশল কর্ম সম্পাদনে অনুপ্রাণিত হয়ে থাকেন। বুদ্ধের সদ্ধর্মদেশনা দ্বারাই অসংখ্য অশ্রদ্ধাবান শ্রদ্ধাবানে পরিণত হয়েছেন। একইভাবে দুঃশীল হয়েছেন শীলবান, অদাতা হয়েছেন দানশীল, ভ্রান্ত-ধারণা পোষনকারী মিথ্যাদৃষ্টিজন লাভ করেছেন সম্যক দৃষ্টি এবং অজ্ঞানী লাভ করেছেন জ্ঞান। এতেই অসংখ্য দেব-নর-ব্রহ্মা মার্গ-ফল নির্বাণের অধিকারী হয়েছেন।
ধর্মরস বলতে ধর্মশ্রবণ দ্বারা মনে উৎপন্ন প্রীতি প্রমোদ্য ভাবকে বুঝায়। জগতে যত প্রকার সুস্বাদু রস আছে, তম্মধ্যে দেবতাদের দিব্য-সুধাই শ্রেষ্ঠ। কিন্তু, তাহা তৃষ্ণা তথা অতৃপ্ত ভোগ-অকাঙ্খারই জন্ম দেয়। অপরদিকে ধর্মরসের মধ্যে ৩৭ প্রকার বোধিপক্ষীয় ধর্ম এবং নবলোকুত্তর ধর্ম মার্গফল নির্বাণ এর অধিকারী করায়ে তৃপ্ত-শান্ত প্রণীত যেই সুখ-যেই শান্তি দেব মানবকে প্রদান করে তার তুলনা কোথায়?
ধর্মময় আনন্দই ধর্ম রতি। স্ত্রী-পুত্রাদি এবং নৃত্য-গীত বাদ্য বাজনাদি দ্বারা মানুষ জগতে বহু প্রকার রতি সুখ ভোগ করে থাকে। আর সেই সেই রতি-সুখ মানব মনে অতৃপ্ত ভোগ-তৃষ্ণারই জন্ম দেয়। ইহা তাই দুঃখ বৃদ্ধিরই সহায়ক হয়ে থাকে। অপরদিকে ধর্মদেশনা ও আলোচনাদি শ্রবণ দ্বারা শমথ-বিদর্শন ভাবনায় অনুপ্রাণিত হয়ে, প্রাপ্ত নিষ্কাম-তৃপ্ত শান্ত যেই প্রীতি-সুখ উৎপন্ন হয় তাতে আসব ক্ষয়ী নির্বাণ শান্তি-ই মানুষকে দান করে থাকে। তাই জাগতিক মনোজ্ঞ উপভোগ্য বিষয়াদি জাত রতি সুখের চেয়ে ধর্ম রতিই সর্বোত্তম – সর্বশ্রেষ্ঠ হয়ে থাকে।
সূত্র ঃ গল্পে গল্পে মহামঙ্গল, অনুবাদক ঃ প্রজ্ঞাবংশ মহাথেরো