ব্রেকিং নিউজ

নির্বাপিত আলোকশিখা আর্য্যশ্রাবক বনভন্তে

অন্ধকারের মাঝে আলোর প্রদীপ শিখা

নির্বাপিত আলোকশিখা আর্য্যশ্রাবক বনভন্তে

ইলা মুৎসুদ্দী

bono-v

পুণ্যের বিপাক সুখকর,

যদ্বারা সমস্ত আশা-আকাংখা পরিপূর্ণ হয়।

পুণ্যবান দ্রুতই প্রশান্তির দিকে অগ্রসর হন

এবং স্বকীয় প্রচেষ্টায় নির্বাণ পৌছেন।

—- বুদ্ধবর্গ (১৯) (৫৪)

আজ পরমপূজ্য আর্য্যশ্রাবক বনভন্তের ৯৮তম জন্মবার্ষিকী। আমরা তাকে স্মরণ করি প্রতিদিন, প্রতি মুহুর্ত। পূজা করি অন্তরের অন্ত:স্থল থেকে। কারণ তিনি পূজারই যোগ্য। প্রতি বছর জন্মবার্ষিকী পালিত হয়, হবে — কিন্তু আমাদের হৃদয়ে তিনি পূজিত হবেন এভাবেই সারাজীবন। যুগে যুগে কিছু মহামনিষীর আবির্ভাব ঘটে জগতের মানব সমাজের দু;সময়ে যখন জাতিতে-জাতিতে, সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে, গোত্রে-গোত্রে, মানুষে-মানুষে পরষ্পর পরষ্পরের সাথে দ্বন্দ্ব চরম রূপ ধারণ করে। এমনি সময়ে জগতময় আলোকিত করে সকল প্রাণীর হিতার্থে আমাদের পরমপূজ্য বনভন্তের আগমন। বাংলার ভাগ্যাকাশে উদিত এক উজ্জ্বল নক্ষত্র, ত্রিলোকপূজ্য, ভিক্ষুকুল গৌরব, বৌদ্ধধর্মের ধ্বজাধারী, মহান ত্যাগী, পঞ্চমার বিজয়ী এবং দেব মনুষ্যের পূজনীয় সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভন্তে) কাপ্তাই এর সন্নিকটে মগবান মৌজার মোরঘোনায় পিতা হারুমোহন চাকমা এবং মাতার বীরপতি চাকমার ঘর আলোকিত করে ১৯২০ সালে ৮ জানুয়ারি  জন্মলাভ করেন। জন্মের পর তাঁর নাম রাখা হয় রথীন্দ্র। পরবর্তীতে এই রথীন্দ্র কঠোর সাধনাবলে লোকোত্তর জ্ঞান আয়ত্ত করেন এবং সাধনানন্দ মহাস্থবির (বনভন্তে) নামে পরিচিতি লাভ করেন।

তৎকালিন বৃটিশ আমলে তিনি নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া শিখিয়াছিলেন। তিনি উক্ত লেখাপড়া দ্বারা বাংলা ভাষায় যেই কোন বই অনায়াসে পড়িতে পারিতেন এবং সহজেই আয়ত্ব করিতে পারিতেন। তাই গৃহী অবস্থায় তিনি বিভিন্ন বই, ধর্মগ্রন্ত’ এমনকি রামায়ণ, মহাভারতও অধ্যায়ন করিয়াছিলেন।তিনি বৌদ্ধ ধর্মীয় পুস্তক সংগ্রহ করিয়া মনোযোগের সাথে অধ্যায়ন করিতেন। তাঁহার অসাধারণ স্মৃতিশক্তি ছিল, তিনি পৃথিবীর বড় বড় বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, পন্ডিত, কবি ও সাহিত্যিকের জীবনী পুনঃপুনঃ পড়িতে ভালবাসিতেন। তিনি যখন গৃহস্থালীর কাজ করিতেন সেই সময় মাঝে মাঝে গভীর ধ্যানে মগ্ন থাকিতেন । গৃহীকালে তিনি খুব সরল, ধর্মপ্রাণ, ভাবুক এবং সর্ব বিষয়ে অনাসক্ত ছিলেন, তাই কোন জিনিসের প্রতি তাঁহার লোভ ছিল না।

ছোটবেলা থেকে তিনি বুদ্ধকীর্তন, কবিগান ও যাত্রাগান শুনে গভীরভাবে উপলব্ধি এবং চিন্তা করতেন-এই সংসারটাই যাত্রার মঞ্চ। সংসারটাই যে দুঃখময় তা তিনি সব সময় নিরীক্ষণ করতেন এবং সংসারের দোষ ছাড়া গুণ কিছুই দেখতেন না।

এক সময় জনৈক ব্যক্তির এগার বছরের একমাত্র মেয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল। সেই মৃত কন্যাকে বারান্দায় একপাশে শায়িত রেখে পিতা-মাতা কখনো উচ্চস্বরে কেঁদে উঠছে, কখনো বুকে হাত দিয়ে আঘাত করছে, কখনো অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে রয়েছে।  যুবক রথীন্দ্র ঐ সময় চিন্তা করলেন আমারও একদিন এইভাবে মৃত পুত্র-কন্যার জন্য কেঁদে কেঁদে অজ্ঞান হতে হবে। তিনি সেখানেই মনে মনে দৃঢ় সংকল্প করলেন, তিনি আর সংসার বন্ধনে আবদ্ধ হবেন না। সিদ্ধার্থ গৌতম যেমন জরা, ব্যাধি ও মৃতব্যক্তি দেখে গৃহত্যাগ করেছিলেন, ঠিক তেমনি বনভন্তেও অপরের একমাত্র মৃত কন্যা দেখে গৃহত্যাগ করার সংকল্পবদ্ধ হন।

গ্রাম হইতে অনেক দূরে ধনপাতায় অরণ্যে বর্ষাকালে বৃষ্টিতে ভিজে, নানাবিধ পোকার উপদ্রব, গ্রীষ্মকালে প্রখর রৌদ্র এবং শীতকালে অসহ্য শীত সহ্য করে ব্রতচ্যুত না হইয়া কঠোর ধ্যান সমাধিতে মগ্ন ছিলেন। তিনি কয়েক দিনে একবার মাত্র আহার করিতেন। অনেক সময় গ্রামে ভিক্ষা করিয়া ফিরিয়া আসিতে দেরি হইলে আহার ফেলিয়া দিয়া জল পান করিতেন। যুদ্ধে সৈনিকেরা যেমন পিছু না হটে সামনের দিকে যুদ্ধ করিয়া জয়ী হয় তেমনি তিনি ও পঞ্চমার জয় করে নির্ব্বাণ অধিগত করিয়াছেন। তাঁহাকে গ্রামবাসীরা রথীন্দ্র শ্রামণের হিসাবে ডাকিত এবং গভীর বনে সাধনা করিতেন বলিয়া তিনি বন সাধক অর্থাৎ বনভন্তে হিসাবে সর্বত্র পরিচিতি লাভ করিলেন।

১৯৭৪ ইংরেজীতে চাকমা রাজা ব্যারিষ্টার দেবাশীষ রায়ের শ্রদ্ধাশীলা মাতা আরতি রায় ও রাঙ্গামাটির বিশিষ্ট উপাসকদের আকুল প্রার্থনায় রাজবন বিহারে অবস্থান করিবার সম্মতি জ্ঞাপন করেন। তাই ১৯৭৬ ইংরেজীতে তিনটিলা হইতে সশিষ্য রাঙ্গামাটি রাজবন বিহারে শুভাগমন করিয়াছিলেন। তাঁহার এই আগমণের ফলে পার্বত্য অঞ্চল এবং দক্ষিণাঞ্চলে পুণ্য চেতনার জোয়ার সৃষ্ঠি হয়েছিল। ফলে এতদ্‌ঞ্চলে বৌদ্ধ শাসনের এক নতুন দিগন্তের সূচনা হয়। চাকমা রাজপরিবার ও রাঙামাটির শ্রদ্ধাবান দায়ক-দায়িকাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় রাজবন বিহার প্রতিষ্ঠা লাভ করল। ১৯৭৬ সালে শ্রদ্ধেয় ভন্তে অত্র বিহারে বর্ষাবাস যাপন করেন এবং ১৯৭৭ সালের বৈশাখী পূর্ণিমার কিছুদিন পূর্বে তিনটিলা হতে রাজবন বিহারে স্থায়ীভাবে স্থানান্তর হন।  একমাত্র বনভন্তে বুদ্ধের জীবদ্দশায় মহাউপাসিকা বিশাখা প্রবর্তিত নিয়মানুসারে কঠিন চীবর দান করার জন্য দায়ক-দায়িকাদের উৎসাহিত করেন এবং উপদেশ দেন। সেই থেকে আজ অবধি পার্বত্যাঞ্চল এবং সমতলের বেশীর ভাগ এলাকায় দিনে দিনে চীবর বুননের মাধ্যমে কঠিন চীবর দানোৎসব করা হয়। তিনি প্রায় সময় দেশনায় বলেছেন —আমার করণীয় কর্ম শেষ। এখন তোমাদের নিয়ে ভাবতে হচ্ছে। আমার এখন পুন: জন্ম নেই। তাই মৃত্যু ও নেই। তোমরা নিজে নিজের মুক্তির জন্য সচেষ্ট হও।

একমাত্র বনভন্তে ছিলেন বলেই দূর-দূরান্ত হতে প্রায় প্রতিদিন-ই পুণ্য সঞ্চয় করিবার সুযোগ পাইয়া অনেকে-ই লোকোত্তর জ্ঞান লাভের হেতু উৎপন্ন করিতে সক্ষম হইয়াছেন। বর্তমানে  রাংগামাটি রাজবন বিহার একটি পূর্ণাংগ শাসন সদ্ধর্মের অনুগামী একটি বিহার। যেখানে রয়েছে পূজ্য ভন্তের যোগ্য শিষ্যবৃন্দ। যাদের ছায়ায় আজো আমরা সুশীতল হয়ে আছি। যাঁরা বাংলায় পূর্ণাঙ্গ ত্রিপিটক (যা ছিল পূজনীয় বনভন্তের লক্ষ্য) ধর্মপ্রাণ উপাসক-উপাসিকাদের হাতে তুলে দেয়ার প্রচেষ্টায় রত। এই পুণ্যবান স্বত্ত্বের স্মৃতির উদেশ্যে করে স্থাপন করা হল তাঁরই জন্মভূমি মুরোঘোনাতে স্মৃতিস্তম্ভ। হাজারো পূজনীয় ভিক্ষুসংঘ এবং পূণ্যবান দায়ক/দায়িকাদের অংশগ্রহনে যথাযোগ্য ধর্মীয় মর্যাদায় কর্ণফুলী নদী যাত্রা’র মধ্যে দিয়ে উদ্বোধন করা হল স্মৃতিস্তম্ভ। আমরা জানি পূজনীয়ের পূজা করা উত্তম মংগল। এভাবেই যদি আমরা পূজনীয়ের পূজা করে থাকি তাহলে আমরা ও একদিন লোকোত্তর মার্গে উপনীত হবার আনিশংস লাভ করব।

তিনি ছিলেন আলোর দিশারী, আমাদের পরম কল্যাণমিত্র। আমাদের আলোর পথ দেখিয়েছেন। অন্ধজনকে আলো দিয়েছেন, সাম্য আর মৈত্রীর বাণী দিয়ে চাকমা-বড়ুয়াদের একত্রিত করেছেন। সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছেন ধর্মের আলোকশিখা। বিশ্বের বৌদ্ধকুলরবি উজ্জ্বল নক্ষত্র, মহান সাধক বুদ্ধ পুত্র পরমপূজ্য বনভন্তে নির্বাপিত হয়েছেন ঠিকই কিন্তু তিনি নিরলসভাবে সদ্ধর্মের বাণী প্রচার করে অন্ধকারের আলোর প্রদীপ শিখা জ্বালিয়ে যেভাবে আমাদের পার্বত্য অঞ্চল এবং সমতলে বসবাসরত সকল বৌদ্ধ সমাজ আলোকিত করেছেন সেই শান্তির মূর্ত প্রতীক বনভন্তে আমাদের সকলের মন হতে নির্বাপিত হবেন না কোনদিন। তিনি আমাদের সকলের মাঝে অসীম ভালোবাসা আর শ্রদ্ধার অর্ঘ্যে, পূজায় চিরদিন পূজনীয় নমস্য হয়ে থাকবেন।

সম্মন্ধে ela mutsuddi

এটা ও দেখতে পারেন

খুব সংক্ষেপে মহাসতিপট্ঠান সহায়িকা

একূশটি উপায়ে অরহ্ত্ত্ব লাভের উপায় তথা কর্মস্থান সংযূক্ত গভীর অর্থসংযুক্ত মহাসতিপট্ঠান সূত্তI এখানে একুশটি উপায়ে …

Leave a Reply

Translate »