ইলা মুৎসুদ্দী
কুশল ধর্ম আচরণ করা বিধেয়। কায়-বাক্য-মনোদ্বারে সম্পাদিত দশটি কুশল কর্ম আছে। কুশল ধর্ম আচরণের মাধ্যমে মানুষ পরম সুখী হতে পারে। কর্মের ফল অচিন্তনীয়। কুশল ধর্ম আচরণ করে সুজনেরা যেমন দেবলোক পরিপূর্ণ করে তেমন ঘোর পাপী ব্যক্তিগণও মরণের পর চারি অপায় পূর্ণ করে। ধর্মের গুণ নির্ঝরসম শীতল আর অধর্মের গুণ বড়ো তপ্ত। মূর্খ ব্যক্তিগণ পরলোক বিশ্বাস না করে গায়ের জোরে যাবতীয় অকরণীয় কৃত্য সম্পাদন করে। ফলে জন্ম-জন্মান্তর তার বিপাক ভুগিতে হয়। ধর্মের সাথে গায়ের জোর খাটে না। মুখের জোরে কাকেও গালি দিয়ে, বদ্নাম রটিয়ে, কু-তর্ক দ্বারা জিতিয়ে প্রহার করে আঘাত করে, মানসিক বেদনা দিয়ে বা বলপূর্বক ধন-সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে আত্মপ্রাসাদ লাভ করা উচিত নয়। ধর্ম উহা কখনো সহ্য করে না। অতএব ধর্মাচরণের মাধ্যমে জীবন অতিবাহিত করা একান্তই বাঞ্ছনীয়। জাগ্রত ভাবে ধর্মতঃ গৃহীজীবন যাপন উপলক্ষে ‘ধর্ম পদে’ একটি গাথায় ভাষিত হয়েছে-
উত্তিট্ঠে নপ্পমজ্জেয্য ধম্মং সুচরিতং চরে
ধম্মচারী সুখং সেতি অস্মিং লোকে পরম্হি চ;
ধম্মং চরে সুচরিতং ন তং দুচ্চরিতং চরে।
উঠ, জাগ্রত হও। প্রমত্ত হয়ো না। কল্যাণ ধর্ম আচরণ কর। ধর্মচারী ইহ-পরলোকে সুখে বাস করেন। সুচরিত ধর্ম আচরণ কর। পাপধর্ম ত্যাগ কর। সুচরিত ধর্ম আচরণে সুখফল প্রসব করে এবং পাপধর্ম আচরণে নারকীয় দুঃখ-যন্ত্রণার ভাগী হতে হয়।
এখানে বললে অপ্রাসঙ্গিক হবেনা যে-বর্তমান কোন কোন মানুষের কাছে আচ্ছন্ন দৃষ্টির প্রভাব দেখা যায়। তারা ভাবে-তরুণ বয়সে পুণ্য ধর্ম করা বা বিহার-মন্দিরে যাওয়া এত প্রয়োজন কি? বৃদ্ধ বয়সে তো পুণ্য-ধর্ম করা যায়। যদিও বা কেহ তরুণ বয়সে পরলোকের পুণ্য পাথেয় সঞ্চয়ের উদ্দেশ্যে দান-ধর্মে মনযোগী হয়, তবে সে কোন কোন ধর্মবিদ্বেষী ব্যক্তির কাছে নিন্দার বা সমালোচনার পাত্র হয় এবং তার পুণ্যধর্ম আচরণের পথে বিরাট প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। ইহা একমাত্র খলতারই লক্ষণ ছাড়া আর কিছুই নয়। অথচ সমাজের অন্য কোন সভ্য যদি লেজ কাটা শৃগালের ন্যায় আপন আপন অসম প্রভাব দেখাতে গিয়ে কোন দুর্বলকে মামলা-মোকদ্দমায় জড়িত করে বহু অন্যায় ও করে অথবা সমাজ ভাঙ্গনের কাজে লিপ্ত হয়, মদ গাঁজা নেশা সেবনে মত্ত হয়, পাকা শস্যে মই দেয়, তা’ দমন করবার জন্যে সমাজ মোড়লের মাথা ব্যথা করে না। যতসব ধর্মের উপরই বাড়াবাড়ি। তাই বলা যেতে পারে-এই সংসারে পরম হিতৈষী কল্যাণমিত্র খুবই দুর্লভ। পাপপথে টেনে নেবার কুমিত্রের সংখ্য অসংখ্য। কিন্তু একথাও সত্য যে-এই সংসারে একে অপরকে গালি ভর্ৎসনা করে, নিন্দা অপবাদ করে, চরম শত্র“তা আচরণ করে অথবা মান-মর্যাদার হানি করে কেহ কারো স্বর্গ-মোক্ষের পথ রুদ্ধ করতে পারে না। বরং ঐরূপ কদর্য আচরণে যে বা যারা লিপ্ত হয়, তাদেরই মহাক্ষতি সার্ধিত হয়। মানবের ধর্মাচরণ সম্বন্ধে দেবপ্রিয় বলিসিংহ তাঁরই সম্পাদিত ‘বৌদ্ধ জীবন দর্শনে’ লিখেছেনঃ ‘তীর্থে তীর্থে আর মঠ-মন্দিরে ঘুরে বেড়ানো কিংবা বিগ্রহের পূজাই ধর্মাচরণের শেষ কথা নয়। ধর্মের প্রকৃত নির্দেশ অনুযায়ী প্রতিদিনকার জীবনের গতিবিধি ও কার্যকলাপকে নিয়ন্ত্রিত করাই সত্যকার ধর্মাচরণ। ব্যবহারিক জীবনে যদি একদিকে আমরা পদে পদে অন্যায় করি, মানুষের প্রতি করি ক্ষতিকর উদ্ধত ও অসৎ আচরণ জীবের প্রতি হই নির্মম নিষ্ঠুর আর অপরদিকে মন্দিরে মন্দিরে হত্যা দিয়ে মন্ত্রের আবৃত্তি করে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিই, তথাপি আধ্যাÍিক উন্নতির পথে আমরা কণামাত্রও অগ্রসর হতে পারবো না।’
সূত্র ঃ বিশ্বমঙ্গল ও বিবিধ প্রসঙ্গ, শ্রী কোণ্ডাঞো ভিক্ষু।