ইলা মুৎসুদ্দী
পণ্ডিত ব্যক্তির তারা — যাঁরা সত্যধর্ম জানেন, সত্যধর্মে বিশ্বাসী, ক্রোধ-হিংসা বিহীন, শীল-সমাধি-প্রজ্ঞায় সমন্বিত, চারি আর্যসত্যে অভিজ্ঞ, দশকুশল ধর্মে সদাস্থিত, বহুশ্র“ত মেধাবী স্মৃতিধর ত্রিদ্বারে সংযত পাপকর্মে ভয়দর্শী, ইহ-পরলোক বিশ্বাসী, ভদ্র-বিনীত, ন্যায়-নীতিতে সুপ্রতিষ্ঠিত, মাতা-পিতা, শ্রমণ-ব্রাহ্মণ ও শ্লাঘনীয় ব্যক্তির সেবা-পূজায় মঙ্গলদর্শী, হিতকামী, দয়ালু, মৈত্রী গুণে সমৃদ্ধ এবং সৎপথ নির্দেশক, তাঁরাই প্রকৃত পণ্ডিত। পণ্ডিত ব্যক্তিগণ জীবনান্তেও পাপকর্ম করেন না, পরকেও তেমন হীনতর কাজে উৎসাহ দেন না। এঁরা সর্বদা সচ্চিন্তা পরোপকার আÍশুদ্ধি আত্মমুক্তির কথাই বেশী করে ভাবেন। এঁরা ভয়ে রক্ষা কবচের ন্যায়, অন্ধকারে দীপালোকের ন্যায় ও পর্থ নির্দেশক পরম কল্যাণভাজন বন্ধুর ন্যায়। পণ্ডিত সুজন কখনও মূর্খ ব্যক্তির ন্যায় কোন প্রকার ভয় উপদ্রব দুঃখ দুর্শশা মানসিক বেদনা সৃষ্টি করেন না। এঁরা নিজকে সুরক্ষা করে জ্ঞানী প্রশংসিত উন্নত জীবন যাপনে অগ্রণী ভূমিকাই পালন করেন।
সংসারজীবনে হীন-উত্তম, মুর্খ-পণ্ডিত, দুঃশীল-সুশীল, ধার্মিক-পাপী, কৃতজ্ঞ-অকৃতজ্ঞ নরাধম বিভিন্ন প্রকৃতি মানুষের সাথে পরিচয় ঘটে। জীবন-চলার পথে এসব মানুষের সাথে সাক্ষাৎ হলেও আপনার চেয়ে শীল-সমাধি গুণে উন্নতমান জ্ঞানী মানুষকে বেছে নেওয়াই সমীচীন। নিজ হতে উন্নতমান ব্যক্তির সেবায় শীল-সমাধি-প্রজ্ঞা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। মুক্তির পথ সুগম হয়। মানসিক গতি ও জীবনযাত্রা-প্রণালী সহজ-সরল, উদার-মহান, শান্ত-ভদ্র ও বিশেষ গুণ-সৌরভে সুরভিত হয়। শ্রেষ্ঠ ব্যক্তির সাক্ষাৎ না ঘটলে সমজ্ঞানী সম শ্রদ্ধাবান প্রভৃতি গুণে অলংকৃত পুরুষের সেবা করাই শ্রেয়ঃ। সমজ্ঞানী পুরুষের সেবা কখনো অবনতির কারণ হয় না। যদিচ জীবনে উত্তম কল্যাণমিত্র পাওয়া না যায়, তবুও হীন কাপুরুষের সেবা করা উচিত নয়। হীন কাপুষের সেবায় শীল-সমাধি-প্রজ্ঞা ক্রমে হ্রাস পেতে থাকে। তাই নিজ হতে উন্নতমান ব্যক্তির ভজনা করাই উচিত।
সৎ পুরুষের সংস্রব ও তাঁদের সাথে মিত্রতা স্থাপন অতি উত্তম। এরূপ সাধু-সৎপুরুষ সংসর্গে সদ্ধর্মে জ্ঞানোদয় হয়, পাপে ঘৃণা জন্মে, আপন জীবন ধন্য হয়, কখনো উন্নতি শ্রী বৃদ্ধির পরিহানি হয় না।
জগতে এঁরাই পরম কল্যাণমিত্র ও পরম পণ্ডিত সুজন; যাঁরা শ্রদ্ধাশীলে সুপ্রতিষ্ঠিত, মহান হৃদয়, সুশীল, প্রজ্ঞাবান, পরের মঙ্গলকামী, সত্যদর্শী, ধর্মভীরু, সুপথ-নির্দেশক। এবন্বিধ কল্যাণমিত্রের সেবা-পূজায়, মেলা-মেশায়, আলাপ-আলোচনায় আপন জীবনকে সৎগুণাবলীতে অভিমণ্ডিত করে তোলা যায়। পরন্তু কল্যাণমিত্রের কল্যাণকর উপদেশে, কল্যাণকর কার্য সম্পাদনে সুবুদ্ধি জাগ্রত হয়, দুর্লভ মানব জীবনের সার্থকতা সম্পাদিত হয় এবং পরকালে সুগতি লাভের হেতু হয়।
যিনি অন্যের ত্রুটি-বিচ্যুতি বা অমূলক আচরণ দেখলে সংশোধন করিয়ে দেন, হিতমূলক উপদেশ দানে সান্ত্বনা দেন, সৎপথ নির্দেশ করেন, অন্যায়ের জন্য তিরস্কার করেন, এতাদৃশ পণ্ডিত ব্যক্তি গুপ্তধন প্রদর্শক তুল্য। এরূপ সত্যনিষ্ঠ আÍ-পরহিতকামী পণ্ডিত ব্যক্তির ভজনা করা উচিত। তেমন পণ্ডিত ব্যক্তির ভজনায় মঙ্গল ব্যতীত অমঙ্গল আশংকা করা যায় না।
গোলাপ টগর চাঁপা প্রভৃতি সুগন্ধযুক্ত পুস্পকে কাপড় অথবা কোন বেষ্টনী দ্বারা বন্ধন করলে তা’ যেমন সুরভিময় হয়, তেমন ধীর পণ্ডিতের সংগ লাভে বা সেবা-পূজায় তাঁর গুণ-মহিমা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে- ‘অমুক ব্যক্তি পণ্ডিতের সান্নিধ্যে বা সুধীজনের পরামর্শে জীবন চালনা করে। তার আচরণ বড়ই সুন্দর। কথা বড়ই মধুর।’ সুতরাং সুধীজন মাত্রেই সর্বগুণের খনি। মণির সংস্পর্শে লৌহ যেমন স্বর্ণে পরিণত হয়, গুণী-সজ্জনের সংস্রবে মূর্খও অনেকটা শোধন হয়।
সূত্র ঃ বিশ্বমঙ্গল ও বিবিধ প্রসঙ্গ, শ্রী কোণ্ডাঞো ভিক্ষু।