এ প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তথাগত মহাকারুণিক ‘মহামঙ্গল সূত্র’ দেশনা করেন। তারি ধারাবাহিকতায় পড়ুন
ইলা মুৎসুদ্দী
ভগবান তথাগত পরম সম্বোধি লাভ করে শ্রাবস্তীর জেতবনে শ্রেষ্ঠী অনাথপিণ্ডিক নির্মিত মহাবিহারে সশিষ্য অবস্থান করছিলেন। তখন কতিপয় মানুষের মনে প্রশ্ন জেগেছিল-কিসে মঙ্গল হয়- ‘দর্শনে, শ্রবণে না ঘ্রাণে?’ তন্মধ্যে দৃষ্টমাঙ্গলিকগণ বললেন- ‘দর্শনে মঙ্গল’। যদি প্রভাতে সুন্দর বস্তু, পূর্ণ কলসী, সৈন্ধব ঘোটক, কপিল গরু, সজ্জিত কুমার প্রভৃতি মঙ্গলসম্মত বস্তু দর্শন করে, তাতে দর্শকের প্রভূত মঙ্গল সাধিত হয়। এই কথা কেহ কেহ বিশ্বাস করল, কেহ কেহ করল না। শ্র“তমাঙ্গলিকগণ বললেন- দর্শনে মঙ্গল হয়না, শ্রবণেই মঙ্গল সাধিত হয়। এই কথাও কেহ কেহ বিশ্বাস করল, কেহ কেহ করল না। অতঃপর আর এক বাদী বললেন- দর্শনে বা শ্রবণে কোন মঙ্গলই হয় না। কারণ চোখে কত শুভ-অশুভ বস্তু দেখা যায় এবং শ্রবণেন্দ্রিয়ে কত অপ্রীতিকর শব্দ শুনা যায়; উহা কখনো মঙ্গলসম্মত হতে পারে না। ঘ্রাণে বা স্পর্শেই মানবের কল্যাণ সাধিত হয়। একথাও কেহ কেহ বিশ্বাস করল, কেহ কেহ করল না।
এভাবে দেশের সর্বত্র আনাচে-কানাচে, গ্রামে-গঞ্জে, পথে-ঘাটে, নগরে-প্রান্তরে মঙ্গল বিষয়ের কথা ছড়িয়ে পড়ল। এমন কি দেবলোকে পর্যন্ত সেই কথার আন্দোলন চলতে লাগলো- ‘কিসে মঙ্গল হয়?’ এমনি ভাবে বার বৎসর কেটে গেল কিন্তু কেহ সঠিক সিদ্ধান্তে পৌছিতে পারল না। অনন্তর কতিপয় দেবপুত্র দেবরাজ ইন্দ্রকে এই বিষয়ে অবহিত করলে তিনি ভগবান তথাগতের নিকট এর সঠিক সমাধান পাবে বলে তাদেরকে আশ্বাস দেন।
অতঃপর জনৈক দেবপুত্র দেবরাজের আদেশে আদিষ্ট হয়ে জেতবনে বুদ্ধ সন্নিধানে উপস্থিত হয়ে ভগবানকে ‘কিসে মঙ্গল হয়’ জিজ্ঞেস করলে তিনি আটত্রিশ প্রকার মঙ্গল সমন্বিত ‘মহামঙ্গল সূত্র’ দেশনা করেন।
দেবতার প্রশ্নে করুণাঘন বুদ্ধ-তথাগত গাথাযোগে বলছেন-
অসেবনা চ বালানং পণ্ডিতানঞ্চ সেবনা
পূজা চ পূজনীয়ানং এতং মঙ্গল মুত্তমং। ৩
মূর্খের সেবা না করা, পণ্ডিত ব্যক্তির সেবা করা এবং পূজনীয় ব্যক্তিগণের পূজা করা উত্তম মঙ্গল।
(ক) মূর্খ ব্যক্তির লক্ষণ কি এবং তাদেরকে চেনার উপায় কি? শাস্ত্রে উক্ত আছে- যারা কুবিষয় চিন্তা করে ত্রিবিধ দ্বারে পাপকর্ম করে, পরকে সেই বিষয়ে উৎসাহিত করে, পরের অনিষ্ট সাধন করে, আপন মুক্তির পথ অন্বেষণ করে না, পর-কৃত বিষয়ের সমালোচনা করে, আÍশুদ্ধির উপায় চিন্তা করে না, যারা চারি আর্যসত্য ধর্মে অনভিজ্ঞ, সত্যপথ ভ্রষ্ট, দুঃশীল দুরাচার, পাপ-পুণ্যে হীন-শ্রেষ্ঠে সদোষ-নির্দোষ বিষয়ে বিবেকহীন, শীল-সমাধি-প্রজ্ঞায়, দান-শীল-ভাবনায় ও পঞ্চস্কন্ধের উদয়-বিলয়ে জ্ঞানশূন্য, পাপকর্মে লজ্জা ও ভয়হীন, ইহ-পরলোক অবিশ্বাসী, মাতা-পিতা, শ্রমণ-ব্রাহ্মণ, সাধু-সজ্জন ও শ্বশুর-শাশুড়ীর সেবা-পূজায় অমঙ্গলদর্শী, ত্রিরতœ অগৌরবী, বিনয়-সৌজন্য দর্শনে বিমুখ, গালি-ভৎর্সনা ও কু-পরামর্শদানে পটু, যারা আÍাভিমানী, অবিবেচক, ক্রোধী, মানী ও উদ্ধত, যারা সুপথকে কুপথ, কুপথকে সুপথ, ভালকে মন্দ, মন্দকে ভাল মনে করে, কুপথে পরিচালিত হয়, পরকেও সেই পথে চালনা করে, উচিত কথা বললে রেগে যায়, তারাই প্রকৃত মূর্খ। তাই বলা হয়েছে-
জগতে যত পাপকর্ম আছে, তৎসমস্ত কর্ম মূর্খেরাই সম্পাদন করে। তাদের অকরণীয় অকথনীয় কিছুই নাই এরা, সর্বদোষের আকর। এরূপ পুরুষের সংসর্গ সর্বতোভাবে বর্জনীয়। এরা পূতিমৎস্য সদৃশ। কোন পত্র-তৃণ দ্বারা পূতি মৎস্য আবৃত করলে যেমন উহা পূতিগন্ধময় হয়ে যায়, সর্বত্র দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে তেমন মূর্খ অসৎ পুরুষের সংসর্গে বা সেবা-পূজায় সৎ ব্যক্তিও নিন্দার ভাজন হয়। পরন্তু মূর্খগণের কারণেই যাবতীয় দুঃখ-দুর্দশা, ভয় উপদ্রব, মানসিক যাতনা প্রভৃতি ভোগ করতে হয়। এরা মহাপাতকী হীনচেতা তামসিক শ্রেণীতে পরিগণিত, সুতরাং এসব ঘৃণিত মানুষ থেকে দূরে থাকাই সমীচীন। ধর্মপদে উক্ত আছে-
ন ভজে পাপকে মিত্তে ন ভজে পুরিসাধমে
ভজেথ মিত্তে কল্যাণে ভজেথ পুরিসুত্তমে।
নির্বাণধর্মে অবিশ্বাসী মূর্খ পাপমিত্রের সংগ ত্যাগ করা, নীচাশয় ব্যক্তির ভজনা না করা, কল্যাণমিত্রের ভজনা করা ও শীলাদি গুণে উত্তম পুরুষের সেবা করা একান্ত বাঞ্ছনীয়। জ্ঞানান্ধ মূর্খ পৃথগ্জনের চরিত্র সম্বন্ধে ‘বোধিচর্যাবতারে’ এরূপ উল্লেখ আছে-
আÍ-শ্লাঘা, পরনিন্দা ও সাংসারিক সুখ ভোগের বাক্যালাপ প্রভৃতি পাপচর্চা মূর্খ জনগণের মুখে নিত্য লাগিয়াই থাকে। ইহারা মুহূর্তের মধ্যে সুহৃদ হয়, আবার মুহূর্তের মধ্যে শক্র হইয়া যায়। যেক্ষেত্রে সন্তুষ্ট হওয়ার কথা, সেক্ষেত্রে তাহারা ক্রুদ্ধ হইয়া পড়ে। প্রাকৃত জনকে সন্তুষ্ট করা বড় দুঃসাধ্য ব্যাপার। হিতোপদেশ দিলে তাহারা কুপিত হয় এবং হিতকর কার্য সম্পাদনে বারণ করে। যদি তাহাদের কথা না গুনে বা তাহাদের মত পোষণ না করে, তবে তাহারা অতীব ক্রুদ্ধ হয়। প্রাকৃত জনগণের চরিত্র বড় বিচিত্র। ইহারা বড় স্বার্থপর। পরের সুখ নিরাপত্তা ও উন্নতি শ্রীবৃদ্ধির কোন প্রকার হিত চিন্তাই ইহারা করে না। সর্বজ্ঞ বুদ্ধগণও তাহাদিগকে সন্তষ্ট করিতে পারেন না। ইহারা কথনো কাহারো মিত্র হইতে পারে না। তাহাদের সংস্রবে দুঃখের সৃষ্টি হয়, আনন্দ উৎপত্তির কোন কারণই হইতে পারে না। সুতরাং প্রাকৃত মূর্খজন হইতে সর্বদা দূরে সরিয়া থাকিবে।
সূত্র ঃ বিশ্বমঙ্গল ও বিবিধ প্রসঙ্গ, শ্রী কোণ্ডাঞো ভিক্ষু।