ইলা মুৎসুদ্দী
উপরাজকালে কুমার অজাতশত্রু দেবদত্তের ঋদ্ধিবলে বশীভূত হয়ে তাঁর প্রতি অত্যন্ত ভক্তিপরায়ণ হন। তিনি প্রতিদিন পাঁচশত ভিক্ষুর খাদ্য দেবদত্তের নিকট পাঠাতেন এবং সকাল বিকাল তার সেবার জন্য গমন করতেন। দেবদত্ত যখন বুঝতে পারেন যে কুমার সম্পূর্ণ তাঁর বশে এসেছেন তিনি একদিন কুমারকে বলেন-পূর্বে মানুষেরা দীর্ঘায়ুসম্পন্ন ছিল, এখন কিন্তু মানুষের আয়ু অতি কম। এমনও হতে পারে যে আপনি কুমার অবস্থাতেই মারা যাবেন। তখন আপনার রাজত্ব সুখভোগের বাসনা পূর্ণ হবে না। আপনি পিতৃহত্যা করে রাজা হন এবং আমি বুদ্ধকে হত্যা করে বুদ্ধ হব।
দেবদত্তের পুনঃপুন প্রেরণায় কুমার উদ্বুদ্ধ হয়ে এক মধ্যাহ্নে তীক্ষ ছুরিকা হস্তে পিতৃহত্যার উদ্দেশ্যে অন্তঃপুরে প্রবেশ করেন। অমাত্যগণ তা জেনে তাঁর নিকট হতে ছুরিকা ছিনিয়ে নেন এবং সে বিষয় রাজাকে নিবেদন করেন। রাজত্বের জন্য তাঁকে হত্যা করতে ইচ্ছুক জেনে রাজা কুমারকে রাজত্ব প্রদান করেন।
অজাতশত্রু রাজত্ব পেয়ে বিপুল আনন্দে ও সুখে জীবন-যাপন করছেন। তা জেনে একদিন দেবদত্ত তাঁকে বলেন- বুদ্ধিহীন মানুষ ঢোলের মধ্যে ইন্দুর রেখে ঢোল চামড়ায় ঢেকে উত্তম কাজ করেছে বলে যেমন আনন্দিত হয়; আপনাকেও তেমন মনে হচ্ছে। আপনি বুঝতে পারছেন না যে আপনার পিতা তাঁর প্রতি কৃত অপমান স্মরণ করে রাজত্ব পুনঃ ছিনিয়ে নিতে পারেন। দেবদত্তের এ বাক্য শুনে অজাতশত্রু চিন্তাসাগরে হাবুডুবু খেতে থাকেন। কি করা উচিত শেষে দেবদত্তের নিকট পরামর্শ প্রার্থনা করেন। দেবদত্তের পরামর্শানুসারে অজাতশত্রু ধার্মিক-পিতা বিম্বিসারকে কারাগারে নিক্ষেপ করেন। পরে তাঁর আহার বন্ধ করেন এবং রাজমহিষী ব্যতীত কারাগারে অন্য সবের প্রবেশ নিষিদ্ধ করে দেন।
রাজমহিষী কারাগারে মহারাজকে দর্শন করতে যাবার সময় প্রথম ঝুঁড়িতে, পরে ঝুঁটিতে, তৎপর জুতার তলায় করে খাদ্য নিতেন। তাও বন্ধ করে দেওয়া হলে সুস্নাত দেহে চতুর্মধু লেপে যেতেন। রাজা তা চেটে খেয়ে জীবন রক্ষা করতেন। শেষে মহিষীর যাওয়া বন্ধ করে দিলে রাজা চংক্রমণ করে ফলসমাপত্তি ভাবনা দ্বারা দিবারাত্র অতিবাহিত করতেন। অজাতশত্র“ তা জেনে নাপিত পাঠায়ে পায়ের তলা কেটে তাতে তেল ও লবণ মেখে আগুনের সেক দিতে আদেশ দেন। এভাবে কারাগারেই রাজার মৃত্যু হয় । মৃত্যুর পর তিনি চতুর্মহারাজিক দেবলোকে বৈশ্রবণ রাজার পরিষদে ‘জনবসভ’ নামে যক্ষ হয়ে উৎপন্ন হন।
পিতার মৃত্যুর পর অজাতশত্রুর অন্তরে তীব্র অনুশোচনা ও দাহ উৎপন্ন হয়। দেবদত্তকে জেতবনে পৃথিবী গ্রাস করেছে শুনে তার ভয় ও ত্রাস আরও বহুগুণ বর্ধিত হয়। রাজশয্যা তাঁর কাছে কণ্টকশয্যা এবং রাজসুখ অগ্নিজ্বালার মত অনুভব হতে থাকে। তাঁর সর্বদাই মনে হত এই মুহূর্তেই পৃথিবী যেন তাঁকে গ্রাস করবে। চক্ষু মুদ্রিত করলেই তিনি দেখতেন যে তিনি যেন অবীচি নরকে উত্থানাবস্থায় শুয়ে আছেন, আর চারদিক হতে জ্বলন্ত হুতাশন শতশিখা বিস্তার করে তাঁকে দগ্ধ করতে ছুটে আসছে। বিকটদর্শন যমদূতগণ জ্বলন্ত লৌহশূলে তাঁকে বিদ্ধ করতে এগিয়ে আসছে। দিবারাত্র এক মূহূর্তের জন্যও তাঁর চোখে নিদ্রা এবং মনে শান্তি ছিল না।
তাঁর ইচ্ছা হয়েছিল বুদ্ধের নিকট গিয়ে আপন দুষ্কৃতির বিষয় প্রকাশ করে তাঁর গুরুতর অপরাধের জন্য ক্ষমা ভিক্ষা করবেন। কিন্তু নিজের মহা অপরাধের বিষয় স্মরণ করে এতদিন ভগবানের নিকট উপস্থিত হতে সাহস করেননি। শেষে রাজচিকিৎসক জীবকের সঙ্গে পরামর্শ করে মহারাজ অজাতশত্র“ এক শারদ পূর্ণিমার জ্যোৎস্নাপ্লাবিত রাত্রে জীবককে সঙ্গে নিয়ে তাঁর আম্রবনে বুদ্ধের নিকট উপস্থিত হন। বুদ্ধ ও ভিক্ষুসংঘকে বন্দনা করে তিনি দীর্ঘনিকায়ের শ্রামণ্যফল সূত্রের উক্তি অনুসারে বুদ্ধকে শ্রামণ্যফল সম্বন্ধে প্রশ্ন করেন। বুদ্ধের উত্তরে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হয়ে তিনি জীবন দিয়ে বুদ্ধ ধর্ম ও সংঘের শরণাগত হন।
তিনি যদি পাপীমিত্রের সংসর্গদোষে পিতৃহত্যারূপ মহাপাপকর্ম না করতেন বুদ্ধদেশিত সেই ধর্ম শুনেই স্রোতাপন্ন হয়ে যেতেন। কিন্তু মূর্খসংসর্গ দোষে তাঁর পূর্বজন্মার্জিত সেই মহান উপনিশ্রয়-সম্পত্তিও ধ্বংস হয়ে যায়।
সেই থেকেই মহারাজ অজাতশত্রু জীবনের অন্তিমমুহূর্ত পর্যন্ত ত্রিরতœসেবক এবং সদ্ধর্মের প্রচার ও প্রসারের প্রধান সহায়ক ছিলেন। তাঁর সেই বিপুল পুণ্যপ্রভাবে পিতৃহত্যাজনিত মহাপাপে অবীচি মহানরকে পতিত না হয়ে তিনি লৌহকুম্ভী নরকে পতিত হন। তথায় ষাট হাজার বৎসর দুঃখ ভোগ করে সেই নরক হতে উদ্ধার পাবেন। তৎপর একলক্ষ কল্পকাল সুগতি-দুর্গতিতে বিচরণ করে বিদিত বিসেস নামক প্রত্যেকবুদ্ধ হয়ে পরিনির্বাণ প্রাপ্ত হবেন।
মনুষ্যহত্যার অপরাধ করে কোনও ব্যক্তির পুষ্পমুষ্টি দণ্ড দিয়ে রক্ষা পাওয়ার মত অজাতশত্রুও পিতৃহত্যারূপ মহাপাপ করে বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ কল্যাণমিত্র বুদ্ধের শরণে এসে সামান্য দণ্ড ভোগ করে মহাদুঃখ হতে মুক্তি পেলেন।
এই ঘটনা প্রমাণ করে যে মূর্খসঙ্গ মার্গফল লাভের উপনিশ্রয় সম্পত্তিও ধ্বংস করতে পারে এবং জ্ঞানীসঙ্গ মহাপাপীকেও রক্ষা করতে পারে।