ইলা মুৎসুদ্দী
মানুষের মন যখন বাহ্য-দৃষ্টিতে রূপজ মোহে অন্ধ হয়ে যায়, তখন মন আর কিছু দেখতে পায় না। হৃদয় ভাল-মন্দ উপলব্ধি করতে পারে না। মোহের তাড়নায় তখন মন এতো চঞ্চল হয়ে উঠে যে, জগতে একাকার অন্ধকার ছাড়া আর অন্যকিছু দেখতে পায় না।
রক্তক্ষরণে দুর্বল বাসবদত্তা থেমে থেমে বলে অনুশোচনার করুণ কাহিনী। নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে থেকে অনেকে বাসবদত্তার মৃত্যুর অপেক্ষায়। ঠিক সেই সময় বধ্যভূমি আলোকিত করে ধীর পদক্ষেপে মুখ-মণ্ডল পূর্ণ চন্দ্রের ন্যায় উজ্জ্বল, অপরূপ রূপ-লাবণ্য-মণ্ডিত শ্রীমান উপগুপ্ত আসছেন দেখে তপতী বাসবদত্তাকে জানাল। বাসবদত্তা তাঁর প্রতি পূর্বাভিলাষবশতঃ অন্তরে স্ফুরিত হলো বিদ্যুৎ-ঝলক্, লজ্জায় হলো সঙ্কুচিত।
এই দুর্দশার সময়ও শ্রীমান উপগুপ্তকে দেখে বাসবদত্তার অন্তরে তীব্রতর অতৃপ্ত লালসা উদ্দীপিত হয়ে জ্বলে উঠ্ল দাবাগ্নিসম অনুরাগাগ্নি। বাসবদত্তা কামিনী-সুলভা অশ্রু বিসর্জন দিয়ে তপতীকে তার কর্তিত অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলি বসনে আবৃত করতে বল্ল। বাসবদত্তা দুর্বল কণ্ঠে বল্ল “তার কণ্ঠ তৃষ্ণায় শুষ্ক হয়ে গেছে।” শান্ত, সৌম্য উপগুপ্ত তা’ শুনে জল এনে তার পাশে বসে পরম স্নেহে অতিযত্ন সহকারে মাটির কলস থেকে অল্প অল্প করে জল ঢেলে দিলেন বাসবদত্তার মুখগহ্বরে। অতঃপর অনেকটা সুস্থ হয়ে প্রশ্ন করে বাসবদত্তা “কে? কে আপনি?”
বাসবদত্তার প্রশ্নোত্তরে ক্ষমা-সুন্দর স্মিত-হাস্যে উত্তর দিলেন উপগুপ্ত “এত শীঘ্রি তুমি আমাকে ভুলে গেলে? একদিনতো তোমার রূপ ও ঐশ্বর্যের বিনিময়ে তুমি আমায় চেয়েছিলে! আমি সেই উপগুপ্ত।”
বাসবদত্তা অস্ফুটস্বরে বলে “হে প্রিয় উপগুপ্ত! কিন্তু এতোদিন পরে আপনি কেন এসেছেন? ঐ সময় আমি রে প্রার্থনা করলেও আপনি আসেননি। এখন আমি বড় মন্দভাগিনী; আমার রূপ-ঐশ্বর্য সবই বিনষ্ট হয়েছে। এখন আপনার সন্দর্শনেও আমার কি ফল হবে? কান্নায় তার কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে আসে। শান্ত-স্বরে উত্তর দিলেন উপগুপ্ত “সেজন্যই তো আজ আমি এখানে এসেছি। মনে নেই তোমার আহ্বানের উত্তরে আমি বলেছিলাম সময় হলে আমি নিজেই তোমার কাছে আসব।”
“না বাসবদত্তা। সেজন্য আসিনি। যে দেহ সৌন্দর্য তুমি হারিয়েছ তার থেকে মহত্তর এক সৌন্দর্যে তোমাকে প্রতিষ্ঠিত করতে আমি এখানে এসেছি।”
“কাকে আপনি মহত্তর সৌন্দর্য বলছেন?”
আমি এখন এক মহান পুরুষের কথা তোমাকে বলব। তিনি হলেন মহাকারুণিক তথাগত ভগবান সম্যক সম্বুদ্ধ। কঠোর তপশ্চর্যার প্রভাবে তিনি সন্ধান পেয়েছেন এক অমৃতলোকের। মৃত্যুর অলঙ্ঘ্য বিধানও তার নিকট পরাজিত।”
মধুরভাষী উপগুপ্তের মুখে শান্তিপদ লাভের আশ্বস্ত বাক্য শুনে মৃত্যুপথযাত্রী বাসবদত্তার কণ্ঠে ব্যগ্রতা ফুঠে উঠে। ক্ষীণ কণ্ঠে অনুরোধ জানায় সে “বলুন হে আমার কল্যাণকামী, আমাকে শোনান সেই মহান পুরুষের উপদেশ।”
বহুশ্রুত জ্ঞানের অধিকারী শ্রীমান উপগুপ্ত ত্রিপিটক মন্থন করতঃ বাসবদত্তার উপযোগী করে সুমধুর মৃদুস্বরে জ্ঞানময় বাক্যে শুরু করলেন বুদ্ধবাণীর সারাংশ “কেশ ও অস্থিসঙ্কুল, সতত দুঃখানলতাপে দগ্ধ সর্বাঙ্গ, বিপদ রাশির নিদান এবং অতি নিন্দনীয় বত্রিশ প্রকার ঘৃণ্য পদার্থের সমষ্টি এই অচেতন দেহ নামক শ্মশান ক্ষেত্রে যারা মুগ্ধ হয়, লালসায় অভিভূত হয়ে অনুরক্ত হয়, তারা বড়ই নির্বোধ। এই দেহ একান্তই অনিত্য, ক্ষয়শীল ও ধ্বংসশীল। তা’ দুঃসহ দুঃখের আগার।
এই দেহ পৃথিবী, আপ্, তেজ ও বায়ুধাতু ইত্যাদির ক্ষণস্থায়ী সংযোগ মাত্র। এসব দারুণ দুঃখদায়ক জন্ম-মৃত্যুর উৎস।
হে বাসবদত্তা! কায়-পরম্পরায় মায়া ও বিষয় বাসনা জনিত মনুষ্যগণের এরূপ যে দুঃখ পরম্পরা হয়ে থাকে, তা’ ভগবান তথাগত সম্যক্সম্বুদ্ধের অমৃতোপম উপাসনায় ক্ষয় প্রাপ্ত হয়।
তথাগতের সত্যধর্মের অজেয়-মহাশক্তির প্রভাবে তৃষ্ণা ও মোহকে নির্মূল করে, দুঃখ নিবৃত্তির উপায় করে দেয়। বুদ্ধের অন্তিম বাণী হচ্ছে ‘বযধম্ম সঙ্কারা, অপ্পমাদেন সম্পাদেথ, অথাৎ সকল সংস্কার ক্ষয়শীল, অপ্রমাদের সাথে সব কাজ সম্পাদন কর’।”
বাসবদত্তা শ্রীমান উপগুপ্তের সুমধুর কন্ঠে বিস্ময়কর কান্তিময়, অমৃত-মধুর প্রাণ-মাতানো মর্মস্পর্শী উপদেশ শুনে দিব্যদৃষ্টিসম মনশ্চক্ষে সম্যক্ভাবে প্রত্যক্ষ করল দেহস্থ অশুচির যথার্থ স্বরূপ।
সূত্র-শ্রীমৎ মেত্তাবংশ ভিক্ষু রচিত মার বিজয়ী অরহত উপগুপ্ত