স্বাধীনতার মূল চেতনার বিপরীতে গিয়ে সংবিধানে যোগ হওয়া রাষ্ট্রধর্ম সময় পেলে তুলে দেয়ার কথা বলেছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের একজন। দলটির সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক শনিবার ঢাকায় এক গোলটেবিল বৈঠকে বলেন, ‘কৌশলগত কারণে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে রাখা হয়েছে। দেশের বাইরেও বলেছি, এখনও বলছি, সময় পেলেই বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ইসলাম তুলে দেয়া হবে।’
জাতীয় প্রেস ক্লাবে সার্ক কালচারাল সোসাইটি আয়োজিত গত ১২/১১/২০১৬ইং অনুষ্টিতব্য আলোচনায় বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্য তুলে ধরার একপর্যায়ে এ কথা বলেন ক্ষমতাসীন দলের এ নেতা।
সব ধর্মের মানুষের সম্মিলিত সংগ্রামে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রণীত সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছিল ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর ক্ষমতা নিয়ে জিয়াউর রহমান ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ বাদ দিয়ে সেখানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা’ স্থাপন করেন। এরপর আরেক সামরিক শাসক এইচএম এরশাদ অষ্টম সংশোধনী এনে সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম যোগ করেন।
এরশাদের পতন ঘটানোর পর রাষ্ট্রধর্মের বিধান বাদ দেয়ার দাবি বিভিন্ন সময়ে উঠলেও মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগও এতে হাত দেয়নি। ২০১১ সালের ৩০ জুন পঞ্চদশ সংশোধনীতে দলটি ’৭২-এর চার মূলনীতি- জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা ফিরিয়ে আনলেও ‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ আগের মতোই থেকে যায়। সংবিধানে একই সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতা ও রাষ্ট্রধর্ম রাখার বৈপরীতে?্যর সমালোচনার মধ্যেই আওয়ামী লীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতার মুখে তা পরিবর্তনের কথা এলো।
গোলটেবিল আলোচনার প্রধান অতিথি রাজ্জাক বাংলাদেশকে একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরে বলেন, ‘অসাম্প্রদায়িকতার শক্তি বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে রয়েছে। আমাদের দেশে সংখ্যালঘু বলতে কিছু নেই।’
নাসিরনগরে হিন্দুদের ওপর হামলার প্রেক্ষাপটে অনুষ্ঠিত ‘সন্ত্রাসবাদের প্রতিরোধে প্রয়োজন বাংলাদেশ ও ভারতের গণমানুষের সুদৃঢ় ঐক্য’ শীর্ষক এ গোলটেবিলে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকরা অংশ নেন। এর মধ্যে ছিলেন সর্বভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য প্রীতম ঘোষ, সাবেক বিধায়ক অজয় দত্ত, বিজেপির অন্যতম মুখপাত্র শিলাদিত্য দেব।
রাষ্ট্রধর্ম তুলে দেয়ার বিষয়ে পরে জানতে চাইলে ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ইসলামকে সুপরিকল্পিতভাবে এ দেশের রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছি। বাংলাদেশ একটি অসাম্প্রদায়িক দেশ, সম্প্রীতির দেশ। যদি কোনোদিন এ দেশের মানুষ চায় সেদিন সংবিধান থেকে ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ তুলে দেয়া হবে।
আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘আমরা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের জন্য। আমরা সব ধর্মের মানুষ একত্রে এ দেশে বসবাস করি। বঙ্গবন্ধু ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের খসড়া সংবিধানের ওপর বক্তব্য দিতে গিয়ে বলেছিলেন, এ দেশ পূর্ব পাকিস্তান হতে পারে না, এটা পূর্ববঙ্গ। এ দেশ ইসলামিক রিপাবলিক নয়। আমরা এখনও সেই আদর্শ ধারণ করি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষ শক্তি ’৭৫ সালের পরে যুবসমাজকে বিভ্রান্ত করেছিল। দীর্ঘ প্রায় ২১ বছর ক্ষমতায় থেকে তারা তিলে তিলে সুকৌশলে দেশকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা করছিল। সামরিক, বেসামরিক, স্বৈরাচাররা ক্ষমতায় থেকে দেশকে শেষ করে দিতে চেয়েছিল। একটি অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার পাঁয়তারা তারা করেছিল। এর অংশ হিসেবে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম চাপিয়ে দেয়া হয়েছে।’
ড. রাজ্জাক আরও বলেন, ‘আমি বিভিন্ন জায়গায় বলেছি, দেশের বাইরে বলেছি, বিবিসিতে বলেছি, আমি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বাস করি না, ইসলাম ধর্ম বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রধর্ম থাকা উচিত নয়। কৌশলগত কারণে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে সংবিধানে রাখা হয়েছে। যদি এ দেশের মানুষকে প্রস্তুুত করতে পারি যে, তারাও একটি ধর্মকে রাষ্ট্রধর্ম চায় না, আমরা সেই সুযোগ পেলে, সময় পেলে ইনশাআল্লাহ এটাকে সংবিধান থেকে তুলে দেব।’