বুদ্ধগয়া ভারতের বিহার প্রদেশের অন্তর্গত বর্তমান গয়া শহর হতে প্রায় ৭ মাইল দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত। বুদ্ধগয়া বৌদ্ধদের পুণ্যস্থানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তীর্থ। এখানেই শাক্যকুমার সিদ্ধার্থ গৌতম বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে সম্বোধি জ্ঞান লাভ করে জগতে বুদ্ধ নামে খ্যাত হন।
হিন্দুদের কাছে কাশী-প্রয়াগ, খ্রিস্টানদের কাছে বেথেলহেম এবং মুসলমানদের কাছে মক্কার মতই বৌদ্ধদের কাছে বুদ্ধগয়া হল তীর্থশ্রেষ্ঠ।তাই দেশ-বিদেশ হতে পুণ্যার্থীরা শ্রদ্ধা জানাতে আসেন এ মহাতীর্থে। প্রাচীনকালে বুদ্ধগয়ার অপর নাম ছিল উরুবেলা। এটি নৈরঞ্জনা নদীর তীরে অবস্থিত। আজ ও নৈরঞ্জনা ফল্গু নামে অন্তঃসলিলা অবস্থায় দর্শকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।
প্রাচীন নৈরঞ্জনা, মধ্যযুগের লীলাজন এবং আধুনিক কালের ফল্গু নদীর তীরে বুদ্ধগয়ায় আসন গয়া থেকেই ১২ কিমি পথ বাস, টেম্পো, ট্যাক্সি চড়ে। দিল্লী-কলকাতা হাইওয়ের জি টি রোডে ধোবি থেকে ২২ কিমি, জাহানাবাদ হয়ে পাটনা থেকে ১০৯ কিমি অথবা রাজগীর হয়ে ১৮১ কিমি দূর। বাস আসছে গয়া ছাড়া পাটনা, নালন্দা, রাজগীর এমনকি বারাণসী থেকেও। নালন্দা ৬২ কিমি, রাজগীর ৪৬ কিমি। ট্রেনে এলে নামুন গয়া জংশনে। এখান থেকে পাবেন বাস, এক্কা, টমটম, রিক্সা ইত্যাদি।
এখানেই উরুবেলা গ্রামে বোধিবৃক্ষতলে বুদ্ধের বোধিজ্ঞান লাভ করেছিলেন। অবশ্য প্রাচীন উরুবিল্ব, যার বর্তমান নাম উরেল, মহাবোধি মন্দির থেকে ২ কিমি দূরে। এখানেই সুপ্রাচীনকালের বৌদ্ধতীর্থসার সম্বোধিকে কেন্দ্র করে আধুনিক বুদ্ধগয়ার উৎপত্তি। সম্বোধি কালক্রমে মহাবোধি নাম পায়। দীর্ঘ ৬ বছর কঠোর কৃচ্ছ্রসাধনের পর গৌতম এখানে একটি অশ্বত্থগাছের (বোধিবৃক্ষ) নীচে ব্রজ্রাসনের উপর বসে সসৈন্য মারকে পরাজিত করে শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে বোধবিজ্ঞান লাভ করে বুদ্ধ হন।
কী দেখবেন বুদ্ধগয়ায়___
#বোধিবৃক্ষ : এই বোধিবৃক্ষের নীচে বসে বুদ্ধ সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। এখন যে গাছটি দেখছেন সেটি সেই মূল বৃক্ষের অধস্তন পুরুষ। সম্রাট অশোক এই গাছের একটি চারা নিয়ে গিয়ে সিংহলে রোপণের ব্যবস্থা করেন। চারাগাছটি বড় হলে পুনশ্চ সেটিকে এনে এখানে পুনঃরোপণ করেন। গাছটিকে শ্রীহীন মনে হবে, অজস্র কাপড়ের টুকরো ঝুলছে বহুজনের মনস্কামনার নিদর্শন করে। উড়ছে পতাকারাজি বুদ্ধবাণী ঘোষণা করে।
অশোকের শিলালেখ হতে জানা যায় তিনি মহামাত্রগণ সহ তাঁর রাজত্বের দশম বছরে ভগবান বুদ্ধের সম্বোধিস্থান দর্শন করেন এবং শ্রামণ ব্রাহ্মণদের দান দেন। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে সাঁচির তোরণগাত্রে খোদিত অশোকের মহাবোধি দর্শনের চিত্র হতে সহজে প্রমাণ করা যায় সম্রাট অশোক নিজে বুদ্ধগয়ায় শ্রদ্ধা জানাতে আসেন।
#মহাবোধি মন্দির : বোধিবৃক্ষের সামনেই মহাবোধি মন্দির। ভারতীয় মন্দির স্থাপত্যে এই মন্দিরটি অদ্বিতীয়, কারণ এই ধারায় নির্মিত ভারতের অন্যান্য মন্দিরগুলির একটিরও শিখর এই দেশে নেই, শুধু এটি ছাড়া। মূল মন্দিরটি (বজ্রাসন-বৃহৎ-গন্ধকুটী) আনুমানিক ৬ শতকে নির্মিত। ১৮৮০-তে এর ব্যাপক সংস্কার সাধিত হয়। যদিও আগে আরো বহুবার সংস্কার করা হয়েছিল। বিশাল দোতলা এই মন্দিরটি ৪৮ মিটারেরও বেশি উঁচু___বহুবার এর গায়ে চুন-বালির পলস্তারা করা হয়েছে। পিরামিড আকৃতির এই মন্দিরের সামনে সুদৃশ্য তোরণ___পূর্বদিকে। ভিতরে গর্ভগৃহে বিরাট উজ্জ্বল বুদ্ধমূর্তি ভূমিস্পর্শ মুদ্রায় উপবিষ্ট। দেওয়ালে বুদ্ধ-জীবনের নানা আলেখ্য চিত্রিত। এখানে এসে প্রণত হয়েছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, ভগিনী নিবেদিতা, বিজ্ঞানী জগদীশচন্দ্র বসু প্রমুখ। সুচালো স্তম্ভশ্রেণীর বরাবর দেখবেন বুদ্ধের পূর্বজন্মের কথা, তাঁর পদচিহ্ন মুদ্রিত। মন্দিরের ঠিক উত্তরের দেওয়ালে উঁচু লম্বা বেদি, নাস মুক্তাপথ। এর উত্তরদিকেই গৌতম বুদ্ধ ও তাঁর শিষ্যদের স্তূপ। স্তূপের পাশেই ছোট মন্দির___ নাম রত্নাগার। এখানেই বুদ্ধ ৭ দিন ধ্যানমগ্ন অবস্থায় কাটিয়েছিলেন। উত্তর দেওয়ালের পিছনেই দেখবেন আরো একটি বেদি চংক্রমণ___যেখানে ধ্যানমগ্ন অবস্থায় পাদচারণা করতেন। এর দক্ষিণ ও পশ্চিম অংশে খোদাই করা রেলিঙের কারুকার্য বিস্ময়কর। পথ, পাখি, জীবজন্তু প্রভৃতি বুদ্ধের নানা জন্মের প্রতীক। কাছেই দেখবেন পদ্ম-ভরতি পুষ্করিণী। আর দেখবেন মুচলিন্দ লোকে পদ্মাসীন বুদ্ধের মাথায় কেমন নাগরাজ ফলার ছত্র ধারণ করে বুদ্ধকে রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা করছেন।
মন্দিরের সংলগ্ন পশ্চিম দিকে বোধিবৃক্ষের নীচে হল বোধিপালঙ্ক বা বজ্রাসন। এ বজ্রাসন এক অখণ্ড পাথরে নির্মিত। হিউয়েন সাঙ এর মতে এ আসনে বসে বহু বুদ্ধ বজ্রাসমাধি লাভ করেছিলেন বলে এর নাম বজ্রাসন। এর উপর বসে বুদ্ধ সম্বোধি জ্ঞান লাভ করেন বলে এটিকে আবার বোধিমণ্ডপ বা বোধিপাল্লঙ্কও বলা হয়। বিখ্যাত পুরাতত্ববিদ হানিংহাম বজ্রাসনের বারটি তল আবিষ্কার করেন। মন্দিরের চারিপাশে আবার কতগুলি চৈত্যও আছে এখানে কয়েকটির একটু পরিচয় দেওয়া হচ্ছে :
#অনিমেষ_চৈত্য : মহাবোধি মন্দিরের কাছেই ঘেরা প্রাঙ্গণেই রয়েছে অনিমেষ লোচন চৈত্য গৃহ। সম্বোধি লাভের পর এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গভীর কৃতজ্ঞতায় বুদ্ধ একদৃষ্টে মহাবোধি বৃক্ষকে সন্দর্শন করতেন। তাই এর নাম অনিমেষ চৈত্য।
ITDC-র ট্রাভেলার্স আলজেরীয় পাশেই রয়েছ বোধগয়া মিউজিয়ামটি। ছোট হলেও এখানে বুদ্ধের নানান ধরনের মূর্তি (১ থেকে ১১ শতকের) সংগৃহীত হয়ে রয়েছে। এগুলি সবই এই অঞ্চল থেকে খুঁড়ে পাওয়া গেছে। বিশেষ করে ১ শতকের রেলিংগুলি চত্বরে আটকানো রয়েছে দেখে আপনার ভাল লাগবে।
#আরো দেখুন ঢালু পালির ছাদযুক্ত তিব্বতী নীতির তিব্বতী বিহার। দেখুন মহাবোধি মন্দিরের ১কিমি দূরে সোনার পাতে মোড়া টালিযুক্ত থাই বিহার ও মন্দির। মাথার মোহনচূড়া মূর্তিতে বুদ্ধকে দেখে ভাল লাগবে। পিছনে থাই ভিক্ষুরা থাকেন। দেখুন___ জাপানি, ভুটানি, বর্মি, চীনা, নেপালি, ভিয়েতনামিজ, বাংলাদেশ বুড্ডিস্ট মনাস্ট্রি, চাকমা টেস্পল প্রভৃতি বৌদ্ধমন্দিরগুলিও। ইচ্ছে হলে ঘুরে আসতে পারেন মগধ বিশ্ববিদ্যালয়। ১২ কিমি দূরে দুঙ্গেশ্বরী গুহা বা সুজাতা পায়েস দানের স্থানে দেখে আসতে পারেন।
বুদ্ধগয়ায় উৎসব হয় বৈশাখী পূর্ণিমায় বুদ্ধজয়ন্তী, ডিসেম্বরে ইন্টারন্যাশনাল ত্রিপিটক চ্যান্টিং প্রভৃতি।