নিজের ভুল থাকুক বা নাই থাকুক মা-বাবার প্রতি অশ্রদ্ধা করে উচ্চশব্দে কথা বলা, মুখের উপর তর্ক করা, কথায় কথায় রাগের বহিঃপ্রকাশ করা অপরাধের৷
অার সেই অপরাধের ফল দশটি দন্ডকর্মের অন্তত একটি হলেও ইহলোকেই ভোগ করবে,
১—তীব্র অসহ্য সন্ত্রনাময়ে জীবন পার করা৷
২—অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নষ্ট হওয়া৷
৩—রোগের তাড়নায় জীবন অতিবাহিত করা৷
৪—উন্মাদ হওয়া৷
৫—বিভিন্ন কারণে রাজার দন্ডে দণ্ডিত হওয়া৷
৬—বড় ধরণের মামলা মোকদ্দমায় ফেঁসে যাওয়া৷
৭—স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, পরিবারের, সাংসারিক সুখ নষ্ট হওয়া৷
৮—ধন সম্পত্তির ধীরে ধীরে পরিহানি হওয়া৷
৯—ঘর-বাড়ি অগ্নির রাগে দগ্ধ হওয়াা৷
১০—এবং সবশেষে নরকে পতিত হওয়া৷
অার তাই, যদিও নিজের কোন ভুল নেই, তারপরও পিতা-মাতার ক্রোধের সময় ক্ষান্তি পরায়ন হয়ে সহনশীল হও৷ পরে ক্রোধ কমে গেলে ধীরে ধীরে তা বিনয়ের সাথে বলার চেষ্টা কর৷ এতে তোমার উপর তোমার পিতা-মাতা খুবই করুণার সাথে মৈত্রীস্নেহও অধিক থেকে অধিকতর হবে৷
অার এতেও যদি তারা তোমার কথাগুলোকে স্বীকার না করে তাহলে তাদের কথাগুলোকে বিনম্রের সাথে গ্রহণ করে নম্রের সাথেই সেই স্থান ত্যাগ কর৷ কারণ তাদের কথা কখনোই তোমাদের জন্য অমঙ্গলজনক নয়৷ তাই স্বীকার করলেও ক্ষতির কারণ নেই৷ ক্ষতি তখনই হবে যখন তাদের উপদেশ গ্রহণ না করে তাদের হৃদয়ে ব্যাথার সৃষ্টি কর৷ পিতা-মাতার এই অপরিসীম মৈত্রীর সাগরে তোমার দেওয়া ব্যাথাটাই তোমার কাছে অভিশাপ হয়ে ফিরে অাসবে৷
যদি ভুল বশতঃ তাদের প্রতি অপরাধ কর, তাহলে সংকোচতা না করে বন্দনার সাথে ক্ষমা প্রার্থনা কর৷
পিতা-মাতার অবর্তমানে বিহারে গিয়ে মহাকারুণিক লোকচক্ষুর নিকট করজোরে ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত৷
—মোগ্গালানথেরবত্থু দণ্ডবগ্গ৷
ধম্মপদ পালির অত্থকথা৷
_______________________________________
—————————————————–
মনুষ্যজীবন খুবই সংক্ষিপ্ত৷ এই সংক্ষিপ্ত জীবনে যতদিন অাছেন ততদিনই নিজেকে সবসময় ভালবাস৷ তার চাইতে ভালবাস তোমার পরিবার, প্রতিবেশি, সতীর্থ, কল্যাণমিত্রদের৷ সবসময় মঙ্গল কামনা কর৷ তার চাইতেও মঙ্গল কামনা কর ধরিত্রীর বিশালতাসম তোমার মহীয়সী মাতার ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম তোমার জন্মদাতা পিতার৷
তোমার এই সংক্ষিপ্ত জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান উপহার হল তোমার মা-বাবা৷ যা সারা জীবনে একবারই পাওয়া৷ অদ্বিতীয়, দ্বিতীয়বার পাওয়ার অাশা শুধুই মূর্খতা৷ বাবা-মার প্রতি যখন ক্রোধ হও তখন শুধুমাত্র একবার চিন্তা কর, যারা মাতৃহীন, পিতৃহীন তাদের অবস্থা কেমন?
ছোটকাল থেকে ২৫-৩০ বছর পর্যন্ত বাবা-মায়ের শীতল ছায়াতেই বড় হয়েছি৷ ছোটকালে কতবার তাদের কোলে মল-মূত্র ত্যাগ করেছি, কিন্তু তারপরও তিল পরিমাণ মৈত্রী কমেনি৷ বরং যতই বড় হচ্ছি ততই বেড়ে চলেছে৷ মা-বাবার অনুপস্থিতি তখনি বুঝি যখন নিজে একদিন কারও মা-বাবা হই৷
—অসুস্থ হলে মা অামার পাশে এসে কপালে তার স্নেহের হাত দিয়ে বলে, “বাবা কেমন লাগছে?”
কিন্তু তার অসুস্থতার সময় অামি কতবার তার কপালে হাত দিয়ে বলেছি, “মা কেমন অাছ?”
—অামার মা অামার পছন্দের সব খাবারগুলোই জানে৷ কিন্তু অামি কি তার পছন্দের খাবারগুলো জানি? কখনো তার মুখে তার পছন্দের খাবার তুলে দিয়েছি কি? ঠিক যেমনটি ছোট্ট বেলায় অামার মুখে তুলে দিয়েছিল?
—অামার মা অামার মুখের অবস্থা দেখেই বলতে পারে অামার মনের কথাগুলো৷ কিন্তু অামি কি তার মুখ দেখে বলতে পারি? না জানতে পারি? না বুঝার চেষ্টা করি? সবসময় নিজের স্বার্থটাকেই অাগে ভেবেছি৷ কি স্বার্থপর অামি৷ নিস্বার্থতো সেই, “অামার মা৷”
যদি সত্যিই তুমি তোমার তোমার মা-বাবাকে ভালবাস তাহলে তাদের অপায়ে যাওয়ার পথগুলো বন্ধ করে সুগতি পথের দিকে ধর্মের দর্শনে ধাবিত কর৷ ধ্যানানুশীলনের জন্য পরামর্শ দাও৷ দান-দক্ষিণায় শ্রদ্ধাচিত্ত উৎপন্ন করাও৷
বৃদ্ধকালে অনুতপ্ত হওয়ার অাগেই তাদেরকে তীর্থস্থানগুলো ঘুরিয়ে দর্শন করাও৷
তোমার দেখায় তোমার পুত্রগণও তোমাকে সেভাবেই করবে৷
তাদের মৃত্যুর পর পাশে কান্না করার চাইতে তাদের জীবদ্দশাতেই তাদেরকে কুশল কর্ম সম্পাদনের সুযোগ দিয়ে তাদের পথ তাদেরকেই গড়তে দাও৷
মৃত্যুর পর তাদের উদ্দেশ্যে দান-দক্ষিণা করে কুশলকর্মের ভাগ দেওয়ার চাইতে জীবিত অবস্থা থেকেই যাতে নিজকৃত কুশল কর্মের উপর সন্তুষ্ট হতে পারে সেইভাবে সাহায্য কর৷
অাজকাল পুত্র-কন্যাগণ নিজের মাতা-পিতাকে তেমন না করার জন্যই ঘুরে ফিরে সেই কর্ম তাদেরকেই তাড়িত করছে৷ যেমন বর্তমানে দেখতে পাচ্ছেন, অনেকের মা থাকা সত্বেও সন্তানের কপালে জুটে না মায়ের মমতা-স্হেহ মাখা স্তনের দুধ, পরিবর্তে পায় ফিটারের দুধ৷ পুত্র-কন্যগণ মা-বাবার প্রতি যেমন শ্রদ্ধাহীন, প্রেম-ভালবাসাহীন হচ্ছে সমতালে মা-বাবাও তার নিজ সন্তানের প্রতি মমতাহীন, অাদরহীন, স্নেহহীন হচ্ছে দিন দিন৷ তার একটাই কারণ, তা হল ঘাত-প্রতিঘাত৷ অর্থাৎ নিজের কৃত কর্ম নিজেকেই ঘুরে ফিরে অাঘাত করে৷