সূত্রপিটকের অন্তর্গত পটিসম্ভিদামগ্গো’ তথা পটিসম্ভিদা: বিভাজনীয় জ্ঞান, পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা-বিশ্লেষণ সম্বন্ধীয় পরিজ্ঞান বা অন্তর্দৃষ্টি। ‘পটিসম্ভিদামগ্গো’ বলতে এরূপ পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার-বিশ্লেষণের মার্গ, পথ, উপায় বা পদ্ধতি।
মিলিন্দ-প্রশ্ন গ্রন্থে পটিসম্ভিদাকে চারভাগে প্রদর্শিত হয়েছে; যথা : ১. অত্থপটিসম্ভিদা, ২. ধম্মপটিসম্ভিদা, ৩. নিরুত্তিপটিসম্ভিদা, এবং ৪.পটিভাণপটিসম্ভিদা।
১. ‘অর্থ-পটিসম্ভিদা বলতে ‘প্রত্যয়সম্ভূত ফল অর্থাৎ কোনো একটি কারণ যাকে ভিত্তি করে ফল তথা পরিণতি লাভ করে থাকে। ‘অত্থ’ বলতে কোনো বিষয়ের বিভিন্ন অংশকে বুঝায়। এ ধারণায় ‘অত্থপটিসম্ভিদা’ বলতে হেতুজাত ফল বা জাত, ভূত, উৎপন্ন, প্রতীয়মান ইত্যাদির ওপর ব্যাপক বিশ্লেষণী যেই প্রজ্ঞাশক্তি তারই নাম ‘অত্থপটিসম্ভিদা। ভদন্ত বুদ্ধঘোষের মতে, ১. প্রত্যয়সম্ভূত তথা প্রতীত্যসমুৎপাদ বিষয়ে জ্ঞান, ২.নির্বাণ সম্পর্কে জ্ঞান, ৩. বুদ্ধভাষিত বাক্য (ভাসিতত্থ) সম্পর্কে জ্ঞান, ৪. কর্মবিপাক সম্পর্কে জ্ঞান, এবং ৫. ক্রিয়া সম্পর্কে জ্ঞান – এই পাঁচ প্রকার জ্ঞানকে ‘অত্থপটিসম্ভিদা’ বলা হয় (বিভঙ্গপ্রকরণ)।
২. ‘ধম্মপটিসম্ভিদা’ বলতে ধর্মে জ্ঞানই ধম্মপটিসম্ভিদা। বুদ্ধঘোষের মতে এই ধর্ম হচ্ছে স্বভাব ধর্মতা। অর্থাৎ যেই বিষয়, ঘটনা বা বস্তুকে ভিত্তি করে (প্রত্যয়) অতীতের কোন কারণ বর্তমানে ফল প্রদান করে, সেই ফলটাই হচ্ছে ধর্ম। যেমন – এক অবোধ শিশু জ্বলন্ত প্রদীপকে দিয়ে বস্ত্রে আগুন দিল, আর তাতে বস্ত্রটি পুড়ে গেল। এখানে আগুনের দাহ্য শক্তি তথা পুড়ে যাওয়া হচ্ছে আগুনের ধর্ম বা ফল। বস্ত্রটি হচ্ছে প্রত্যয়, ‘শিশুটি’ হচ্ছে কারণ (হেতু)।
৩. নিরুত্তি-পটিসম্ভিদা হচ্ছে শ্রবণমাত্রই, দর্শনমাত্রই কোনো বস্তু বা বিষয়ের উৎপত্তি কারণসহ ইহার সত্য-অসত্য, শুদ্ধি-অশুদ্ধি ইত্যাদি সম্পর্কে তাৎক্ষণিক যেই জ্ঞান বা ধারণা তারই নাম নিরুত্তি-পটিসম্ভিদা। অভিধর্মের বিভঙ্গপ্রকরণে তে উল্লেখিত হয়েছে। ১. চারিসত্য, ২.হেতু আর কায়ধর্ম জাত সমুদয় বিষয় তথা ৩.জাত, ৪.ভূত, ৫.নিষ্পন্ন, ৬.অভিনিষ্পন্ন, ৭.প্রাদুর্ভূত, ৮.প্রতীত্যসমুৎপাদ অঙ্গ এবং ৯.সুত্তগেয়্য এই নবাঙ্গ সত্থুসাসনধম্মের নিরুত্তি অভিলাপে যেই জ্ঞান তাকেই বলে নিরুত্তি-পটিসম্ভিদা।
অভিধম্মভাজনীয়ে কুশল অকুশল বিপাক ও ক্রিয়া চিত্তের যেই প্রজ্ঞপ্তি (চিহ্নিত করণ শক্তি) তাহাই নিরুত্তিপটিসম্ভিদা জ্ঞান। বিনাপাঠে, বিনা শিক্ষায়, অপরের উপদেশ ব্যতীত আশু উপস্থিত জ্ঞান দ্বারা সত্যজ্ঞান যেই ক্ষমতা তা-ই নিরুত্তি-পটিসম্ভিদা জ্ঞান।
৪. পটিভান-পটিসম্ভিদা বলতে অভিধর্মের বিভঙ্গ প্রকরণে পটিসম্ভিদা বিভঙ্গের সুত্তন্ত ভাজনীয়ে বলা হয়েছে জ্ঞানসমূহে জ্ঞানই হচ্ছে পটিভান-পটিসম্ভিদা। সেই জ্ঞানসমূহের জ্ঞান হচ্ছে, চারি আর্যসত্য জ্ঞান, হেতু জ্ঞান, কার্য ধর্ম জাত জ্ঞান, ভূত জ্ঞান, সঞ্জাত জ্ঞান, নিষ্পন্ন জ্ঞান, অভিনিষ্পন্ন এবং প্রাদুর্ভূত জ্ঞান, প্রতীত্যসমূৎপাদ অঙ্গ জ্ঞান, সুত্ত-গেয়্য ইত্যাদি নবাঙ্গ সত্থুসাসনে জ্ঞান, আরও সংক্ষেপে বলা হয়েছে, কুশল অকুশল বিপাক-ক্রিয়া, এই ৮৯ প্রকার চিত্তের জ্ঞানসমূহে জ্ঞানই হচ্ছে পটিভান তথা প্রতিভা প্রতিসম্ভিদা। শৈক্ষ্য ও অশৈক্ষ্য ভেদে পটিভান পটিসম্ভিদা দুই প্রকার হয়ে থাকে। শৈক্ষ্য তথা অর্হত্ত্ব লাভে অক্ষমদের উল্লেখিত বিষয়সমূহে যে জ্ঞান তাকে বলা হয় শৈক্ষ্য পটিভান পটিসম্ভিদা জ্ঞান। যেমনটি ছিল স্রোতাপন্ন অবস্থায় ভদন্ত আনন্দ, চিত্ত গৃহপতি এবং কুজ্ঝত্তরা উপাসিকার মধ্যে। অপরদিকে ভদন্ত সারিপুত্র, মোগগলান, মহাকস্যপ, মহাকচ্চানপ্রমুখ অর্হৎগণের মধ্যে যেই পটিসম্ভিদা জ্ঞান ছিল, তা হচ্ছে পটিভান-পটিসম্ভিদা।
ভদন্ত নাগসেন বলেনঃ “পূর্বযোগ তথা জন্মান্তরীণ কর্মসংস্কার, বিবিধ শিল্পশাস্ত্রে জ্ঞান, বিভিন্ন দেশভাষা, সমগ্র ত্রিপিটক বা ইহার অংশবিশেষ অধ্যয়ন ও অধিগম, নানা বিষয়ে প্রশ্ন প্রতিপ্রশ্নাদি জিজ্ঞাসা এবং কল্যাণমিত্র সম্পত্তি লাভ করা; এ সমুদয় অঙ্গসমূহ পরিপূর্ণ হলে পটিভান-পটিসম্ভিদা লাভ করা যায়।
পালি “পটিসম্ভিদামগ্গো” নামক গ্রন্থটি প্রধানত তিন ভাগে বিভক্ত; যথা : মহাবগ্গো, যুগনদ্ধবগ্গো এবং পঞ্ঞবগ্গো । অতঃপর প্রত্যেকটি বিভাগে দশটি করে বিষয়বস্তু সন্নিবেশিত হয়েছে। যেমন-
প্রথম বিভাগ “মহবগ্গো” পর্বে রয়েছে ১) জ্ঞান কথা ২) দিট্ঠি কথা ৩) আনাপানসতি কথা ৪) ইন্দ্রিয় কথা ৫) বিমোক্খ কথা ৬) গতি কথা ৭) কম্ম কথা ৮) বিপর্যাস কথা ৯) মগ্গ কথা ১০) মন্ড পেয্য কথা ।
দ্বিতীয় বিভাগ “যুগনদ্ধবগ্গো” পর্বে রয়েছে ১) যুগন্ধ কথা ২) সচ্চ কথা ৩) বোজ্ঝঙ্গ কথা ৪) মেত্ত কথা ৫) বিরাগ কথা ৬) পটিসম্ভিদা কথা ৭)ধম্মচক্কপবত্তন কথা ৮) লোকুত্তর কথা ৯) বল কথা ১০) সুঞ্ঞো কথা।
তৃতীয় বিভাগ“ পঞ্ঞাবগ্গো” পর্বে রয়েছে ১) মহাপঞ্ঞা কথা ২)ইদ্ধি কথা ৩) অভিসময় কথা ৪) বিবেক কথা ৫) চরিযা কথা ৬) পটিহারিয় কথা ৭) সমসীস কথা ৮) সতিপট্ঠান কথা ৯) বিপস্সন কথা ১০) মাতিকা কথা।
‘পটিসম্ভিদামগ্গো’ গ্রন্থের মহাবগ্গো বিভাগের প্রথম বিষয়টি হচ্ছে ‘ঞাণকথা’ বা জ্ঞানকথা। এখানে ‘সুতমযঞাণনিদ্দেসে’ তথা শ্রুতিময়জ্ঞান নির্দেশ পর্বে প্রশ্ন করা হচ্ছে- কিভাবে শ্রুতির দ্বারা উৎপন্ন অনুভূতিজনিত জ্ঞান শ্রুতিময় প্রজ্ঞায় পরিণত হয়?
এ প্রশ্নের উত্তরে বলা হচ্ছে—“এই ধর্মসমূহ অভিজ্ঞাত হওয়া যায়” এই উপদেশটি শুনার পর যেই শ্রুতিময় ধারণা উৎপন্ন হয়, সেই ধারণাকে বিশেষভাবে জানার যেই প্রজ্ঞা, তা-ই শ্রুতিময় জ্ঞান।” এভাবে এই ধর্মসমূহে পরিজ্ঞান, প্রহাণময় জ্ঞান ভাবনাময় জ্ঞান, সাক্ষাৎজ্ঞান, হানিভাগীয় জ্ঞান, স্থিতিভাগীয় জ্ঞান, বিশেষভাগীয়, বির্বেদভাগীয় ইত্যাদি জ্ঞানসমূহ আলোচিত হয়েছে।
অন্তিম বিভাগ ‘পঞ্ঞাবগ্গো তথা প্রজ্ঞাবর্গের প্রথম বিষয়বস্তু ‘মহাপঞ্ঞাকথা’। এই পর্বে প্রশ্ন করা হচ্ছে- অনিত্যানুদর্শনকে, দুক্খানুদর্শনকে, অনাত্মানুদর্শনকে…প্রতিনিসর্গানুদর্শনকে কিভাবে ভাবিত বহুলীকৃত করলে প্রজ্ঞা পরিপূর্ণতা লাভ করে? এ প্রশ্নের উত্তরে বলা হলো যা তা নিম্নরুপঃ
“অনিত্যানুদর্শনকে ভাবিত বহুলীকৃত করলে ‘জবন-প্রজ্ঞা’ পূর্ণতা লাভ করে।
দুঃখানুদর্শনকে ভাবিত বহুলীকৃত করলে ‘নির্বেদ-প্রজ্ঞা’ পূর্ণতা পায়।
অনাত্মানুদর্শনকে ভাবিত বহুলীকৃত করলে ‘মহাপ্রজ্ঞা’ পূর্ণতা পায়।
নির্বেদানুদর্শনকে ভাবিত বহুলীকৃত করলে ‘তীক্ষন-প্রজ্ঞা’ পূর্ণতা পায়।
বিরাগানুদর্শনকে ভাবিত বহুলীকৃত করলে ‘বিপুল-প্রজ্ঞা’ পূর্ণতা পায়।
নিরোধানুদর্শনকে ভাবিত-বহুলীকৃত করলে ‘গম্ভীর-প্রজ্ঞা’ পূর্ণতা পায়।
প্রতিনিসর্গানুদর্শনকে ভাবিত বহুলীকৃত করলে ‘অসামন্ত’ (অসামান্য?) প্রজ্ঞা পূর্ণতা পায়।
এই সাতটি প্রজ্ঞাকে ভাবিত বহুলীকৃত করলে পান্ডিত্য প্রজ্ঞা পূর্ণতা পায়।
এই অষ্ট প্রজ্ঞাকে ভাবিত বহুলীকৃত করলে ‘বিশাল-প্রজ্ঞা’ (পুথুপঞ্ঞা) পূর্ণতা পায়। এই নয়টি প্রজ্ঞাকে ভাবিত বহুলীকৃত করলে ‘হাস-প্রজ্ঞা’(বিস্ফোরণ) পূর্ণতা পায়। হাস-প্রজ্ঞাই হচ্ছে প্রতিভান-প্রতিসম্ভিদা। তার অর্থ বিশ্লেষণ (বাত্থান) হতে সাক্ষাৎও অনুভূতি (ফস্সিতা) প্রজ্ঞাদ্বারা অধিগত হয় ‘অত্থপটিসম্ভিদা’। ধর্মের বিশ্লেষণ হতে সাক্ষাৎ ও অনুভূতি প্রজ্ঞা দ্বারা অধিগত হয় ‘ধম্ম পটিসম্ভিদা’। নিরুত্তি বিশ্লেষণ হতে সাক্ষাৎ ও অনুভূতি প্রজ্ঞা দ্বারা অধিগত হয় ‘নিরুত্তিপটিসম্ভিদা’ (বুদ্ধবচনের মূল তাৎপর্য বিশ্লেষণ দ্বারা বুদ্ধের ন্যায় বাচনভঙ্গি ক্ষমতা) এবং প্রতিভান বিশ্লেষণ হতে সাক্ষাৎ ও অনুভূতি প্রজ্ঞা দ্বারা অধিগত হয় ‘পটিভানপটিসম্ভিদা’ (উপস্থিত বুদ্ধিমত্তা দক্ষতা তথা প্রতিভা)—এভাবেই এই চার প্রকার প্রতিসম্ভিদাকে আয়ত্ত ও অনুভবযোগ্য হয়ে থাকে।”
এই চারি প্রতিসম্ভিদাকে আয়ত্তকরণ উপায় ‘পটিসম্ভিদামগ্গো’ গ্রন্থে প্রদর্শন করতে গিয়ে মহাবগ্গো, যুগনদ্ধবগ্গো (যুগ্ম) এবং পঞ্ঞাবগ্গো- এই তিন বিভাগে সন্নিবেশিত সর্বমোট ৩০টি উপায় প্রদর্শিত হয়েছে যার লক্ষ্য হচ্ছে অর্থ-প্রতিসম্ভিদা, ধর্ম-প্রতিসম্ভিদা, নিরুক্তি-প্রতিসম্ভিদা এবং প্রতিভান-প্রতিসম্ভিদা জ্ঞানচতুষ্টয়কে অধিগত করা এবং এই অধিগতকরণ দ্বারাকে কোন পর্যায়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন, তা প্রদর্শন করা।