অভিজ্ঞতার মূল্য দিন
(শ্রদ্ধেয় শাসন রক্ষিত ভান্তের দেশনা)
প্রথমে একটা বাস্তব গল্প বলি। গল্পটা রাঙ্গামাটির বরকল উপজেলার এক গ্রামের। সেখানে হুরোহুত্তে গোষ্ঠীর এক লোক ছিলেন, যিনি কলা, আদা, পেঁপেঁসহ নানা পাহাড়ী ফলমূল ও বিভিন্ন দ্রব্যাদি বিক্রি করতেন এবং সাথে সুদের কারবারও করতেন। এক জায়গা থেকে কিনে অন্য জায়গায় বিক্রি করতেন (চাকমা ভাষায় বেয়ারী)। তার ছিল কেবল একটাই পুত্রধন। সেই ছেলে যখন যুবক হলো, আয়-রোজগার করার মতো বয়স হলো তখন তিনি তাকে তাঁর কারবার শেখানোর তাগিদ অনুভব করলেন। সেজন্য ছেলেকে ডেকে প্রায় সময় নানা কাজ দিতেন। যেমন- কলা বাগানের আগাছা পরিষ্কার, আনারস বাগান দেখাশুনা, বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করা, কারো কাছে টাকা দেয়া বা আনতে পাঠানো, মোটকথা যখন যা প্রয়োজন তা-ই করতে নির্দেশ দিতেন। কিন্তু ছেলের সেসবে কোনো আগ্রহ নেই। নিতান্ত অনিচ্ছায় করতো নতুবা ঠিকভাবে করতো না। পরে সেই ছেলেকে বিবাহ করালো। বিয়ের পর ছেলে আলাদা করে বাপের মতো সুদ ও বেয়ারের কারবার করতে লাগলো। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাপ করলে লাভ না হলেও আসল তুলে আনে, অথচ ছেলে কেবল লোকসান করে।
বেশি লোকসান করতে দেখে বাপ ছেলেকে বুঝায়, “পুত্র, আগে কারবারটা শিখ। আমি কিভাবে কলা/আনারস কিনি দেখ, কিভাবে বিক্রি করি দেখ, কিভাবে টাকা দিই আর কিভাবে নিই খেয়াল করো। তারপর না-হয় নিজের ইচ্ছেমতো করে কারবার শুরু করো।” বাপের কথা শুনে ছেলে বলে, “সেই কারবারটা শেখার কী আছে? আমি কি দেখি না – কিভাবে আপনি কিনেন আর বেচেন, কিভাবে সুদের টাকা দেন আর নেন? এটা শেখার কি আছে?”
এভাবে বাপ শিখতে বললে ছেলে সেই উত্তর দেয়।
উপাসক-উপাসিকাগণ, চিন্তা করেন, যদি শেখার মতো কিছু না থাকে তাহলে কেন বাপ লাভ করে আর ছেলে লোকসান করে? কথায় আছে, ঘোমটার নীচে খোমটা। আমি বলি, খোমটা না থাকলে ঘোমটা কিভাবে থাকবে? যদিও সবকিছু পরিষ্কার, বাপ যা করে সবই দেখা যায়, তবুও কিছু প্যাঁচ আছে বলেইতো বাপ-ছেলে দুজন দু’রকমের ফল পায়।
ছেলে যখন কথা শুনছে না, তখন সেই লোক ছেলেকে ডেকে বললেন, “পুত্র এক্কান লুহ্রত দ্বিবে রাধা হুরো তেই ন পারন, থেলে হুদোহুদি বাজান। তত্তুন যদি ডাক হারিবার মনে হয়, সালে ত লুহ্রান জু’দ গর (পুত্র, এক মুরগীর খোপে দুই মোরগ থাকতে পারে না, থাকলে কামড়াকামড়ি করে। তোমার যদি ডাক দিতে ইচ্ছে হয়, তাহলে তোমার খোপ আলাদা কর)।
বাপের কথা শুনে ছেলে সাথে সাথেই আলাদা হলো। যাওয়ার সময় বাপ ছেলেকে নগদ টাকা, বাৎসরিক চালসহ সকল জিনিস দিলেন। দেখা গেল, সেই টাকায় ছেলে তিন বছর পারলো না, এমন অনটনে পড়লো যে, সকালে খেলে বিকালে অভূক্ত অবস্থার মতো হলো।
ছেলের এই দূরবস্থা দেখে পিতা ছেলেকে আবার ডাকলেন। বললেন, “পুত্র, তোমার অবস্থা দেখে আমারতো খুবই মায়া লাগছে। তোমাকে আবার আমার লুর-এ ঢোকাতে ইচ্ছা করছে। আসলে আসতে পার, তবে শর্ত একটাই – ডাক হারি ন পেবে (ডাক দিতে পারবে না)।
এরপর থেকে বাপ যেটা বলে ছেলে সেটাই করতে লাগল। এভাবে ধীরে ধীরে কারবারটা শিখতে লাগলো।
উপাসক-উপাসিকাগণ, ছেলের অবস্থা দেখুন। ঢুশ খাওয়ার পরেই হুঁশ হয়েছে, মাথা নত করেছে। তার আগ পর্যন্ত বাপের কথাকে কানেও ঢুকায়নি।
বর্তমানে আমাদের সমাজ ব্যবস্থার দিকে তাকালেও সেই পিতা-পুত্রের মতো চিত্র হরদম চোখে পড়ে। আমরা শিক্ষিত হয়ে বি.এ, এম.এ পাশ করে ৩/৪ ক্লাসে পড়া মা-বাবার মতামতকে মূল্য দিই না, গ্রামের মুরুব্বীদের কথা মানি না, রাজনীতিতে নেতার কথা মানি না, ধর্মীয় ক্ষেত্রে প্রব্রজ্যাগুরুর কথা মানি না। তাদের কথাতো মানি না, কেবল তাদের দোষগুলো/ভূলগুলো খুঁজতে থাকি, ধরতে থাকি। অথচ আমরা চিন্তা করি না, তারাও এখনো ভূলত্রুটির উর্ধ্বে উঠেনি। শুধু দোষ অন্বেষণে কেবল ক্ষতিই হয়, লাভের কিছুই নেই।
অবাধ্যতার সবচেয়ে মারাত্নক প্রভাব পড়ছে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের উপর। আমরা ছেলে-বউ হয়তো বুঝে প্রতিবাদ করছি, অবাধ্যতা করছি। কিন্তু বাচ্চারা ছোটকাল থেকে দেখছে যে, আমার মা-বাবা তাদের মনোপুতঃ না হলে দাদু-দাদীর অবাধ্য আচরণ করছে। তখন তারাও ভাবে, আমিও আমার পছন্দ না হলে মা-বাবার অবাধ্য করবো।
এভাবেই আমরা এক অবাধ্যতার সংস্কৃতি গড়ে তুলছি, যার প্রভাব সুদূরপ্রসারী ও ভয়াবহ। এটা কেবল আত্মনাশক নয়, সাথে পরিবার, সমাজ, জাতি, ধর্ম সবকিছুর জন্য হুমকিস্বরূপ।
আমাদের মনে রাখতে হবে, বয়োজৈষ্ঠ্যরা জীবনে অনেক কিছু দেখেছে, জেনেছে, বুঝেছে। তাই তাদের সেই বাস্তব অভিজ্ঞতাকে আমাদের মূল্য দিতে হবে, সম্মান জানাতে হবে। তাদের অভিজ্ঞতার সাথে নিজেদের জ্ঞানকে সমন্বয় ঘটাতে হবে। তাই তাদের বাদ দিয়ে নয়, বরং তাদেরকে মূল্য দিয়েই আমাদের এগোতে হবে। তবেই নিজেও সুখে থাকা সম্ভব, অপরকেও সুখে রাখা সম্ভব।
তাই আসুন, আজ থেকে নিজেদেরকে শুধরে নিই। উপরিষ্ঠ জনকে সম্মান জানাই, অবাধ্যতার সংস্কৃতিকে বর্জন করি।