পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের মধ্যে কে প্রথম ধর্মজ্ঞান লাভ করেছিলেন? জানতে চাইলে পড়ুন (২য় পর্ব)
ইলা মুৎসুদ্দী
যিনি একটি অঙ্গুলী উত্তোলন করে দৃঢ়তায় সিদ্ধার্থ গৌতমের বুদ্ধত্ব প্রাপ্তির কথা সুনিশ্চিত বাণী করে ছিলেন। সেই সামুদ্রিক শাস্ত্রজ্ঞ কৌন্ডিণ্যও বোধিসত্ত্বের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করতে পারলেন না। তাকে ত্যাগ করে চলে যান। এতে প্রতীতি হয় যে তিনি স্বয়ং তার ভবিষদ্বাণীর প্রতি বিন্দুপ্রাণও বিশ্বাস স্থির রাখতে পারেন নি। যদি এখনো তার স্বীয় মতের প্রতি বিশ্বাস রাখতে পারতো তাহলে সিদ্ধার্থকে কখনো ত্যাগ করতে পারতো না।
ঋষিপতন গিয়ে কৌন্ডিণ্য সহ অন্যরা সবাই (পঞ্চবর্গীয়গণ) নিজেকে নিজে ধিক্কার দিতে লাগল। তারা পরস্পর বার্তালাপ করতে লাগল- ‘ছয় বছর কঠোর তপস্যা ব্যর্থে পর্যবসিত হলো, তাকে আশ্রয় করে থাকা আমাদের মহাভুল হয়েছে। তার সংসর্গ আমাদেরকে অনেক পশ্চাৎ করেছে।’
সম্বোধি প্রাপ্তির পর অনন্তর ভগবান বুদ্ধের অন্তরে সেই সন্ন্যাস জীবনের প্রথম সেবাদানকারী সেই পঞ্চবর্গীয়দের কথা মনে পরল। প্রথম ধর্মোপদেশের উপযুক্ত শ্রোতা তাদের ছাড়া অন্য কাউকে তার দৃষ্টিগোচর হলো না। তাদেরকে প্রথমোপদেশ প্রদানের উদ্দেশ্যে ভগবান ঋষিপতনে উপনীত হলেন।
ভগবানকে দূর থেকে আসতে দেখে পঞ্চবর্গীয়গণ পরস্পর মন্ত্রণা করতে লাগল- ‘বন্ধু সেই সাধনা ভ্রষ্ট শ্রমণ গৌতম আমাদের দিকে আসছে। তাকে আমরা পূর্বের ন্যায় আর অভিবাদন করবো না। দাঁড়িয়ে সম্মানও জ্ঞাপন করবো না। তাকে কেউ আগুবাড়িয়েও নেব না। দূরে একটি আসন দাও, যদি ইচ্ছা করে তাহলে উপবেশন করবে।’
কিন্তু ভগবান যতই তাদের সমীপে আসতে লাগল ততই তাদের সঙ্কল্প থেকে তারা চ্যুত হতে লাগলেন। তারা সকলে স্বীয় স্বীয় সঙ্কল্পে স্থির থাকতে পারল না। অতঃপর পূর্বের থেকে সিদ্ধার্থ গৌতমের শ্রীসৌন্দর্যে সকলে মুগ্ধ হয়ে পড়ল। পূর্বের থেকে যেন আরো আপন মনে হতে লাগল। সকলে যার যার ইচ্ছানুসারে ভগবানের সেবায় তৎপর হয়ে পড়েন। এবং সর্বপ্রকার স্বাগত কার্যাদি সুসম্পন্ন করেন।
অতঃপর তারা যখন ভগবানকে ‘আয়ুষ্মান’ শব্দে সম্বোধন করল তখন ভগবান তাদেরকে মৈত্রী বিগলিত স্বরে সম্বোধন করলেন- “ভিক্ষুগণ! তথাগতকে ‘বন্ধু’ বা ‘আয়ুষ্মান’ সম্বোধন করো না। আমি পরম বোধিজ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছি। আমি এখন তথাগত অরহত সম্যক সম্বুদ্ধ প্রাপ্ত হয়েছি।”
পঞ্চবর্গীয়গণ ভগবানকে নিবেদন করেন- “আয়ুষ্মান গৌতম! আপনার পূর্বের সেই কঠোর তপস্যাদি, সেই দুষ্কর সাধনা করেও পরম জ্ঞান দর্শন হয়নি, সেই দুর্লভ অনুত্তর মনুষ্যধর্ম লাভ করতে পারেন নি। এখন তা কি ভাবে সম্ভব?”
অতঃপর ভগবান প্রতুত্তরে বললেন- “হে ভিক্ষুগণ! পূর্বে কখনো এই প্রকার কথা তোমাদের প্রকাশ করেছি?”
না ভান্তে! সকলে সমস্বরে ভগবানকে “ভান্তে’ বলে সম্বোধন করেন।
তা কেন করলেন।
অতঃপর কৌন্ডিণ্যাদি পঞ্চবর্গীয় সকলে ভগবানের কথা স্বীকার করেন।
এই পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুগণকে ভগবান বুদ্ধ সর্বপ্রথম যেই উপদেশ প্রদান করেন তা ‘ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র’ নামে পালি সাহিত্যে প্রসিদ্ধ হয়।
ভগবান পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুগণকে সম্বোধন করে বললেন-‘ভিক্ষুগণ! দুই অন্তের একটিও প্রব্রজিত গণের সেবন যোগ্য নয়। কদাপি তা সেবন করা উচিত নয়। কোন সেই দু’অন্ত? ১) যা হীন, গ্রাম্য, পৃথকজন, অজ্ঞ জনের যোগ্য, অনার্য সেবিত, অনর্থ যুক্ত কাম ভোগে লিপ্ত থাকা। এবং ২) যা দুঃখময়, অনার্য সেবিত, অনর্থ যুক্ত স্বীয় শরীরকে ব্যর্থ পীড়িত করা। ভিক্ষুগণ! এই দু’অন্ত হতে দূরে অবস্থান করো। তথাগত মধ্যম মার্গের সন্ধান পেয়েছে। এতে চক্ষু উদয় হয়, জ্ঞান উদয় হয় এবং যা শান্তির জন্য, অভিজ্ঞার জন্য, সম্বোধি পরিপূর্ণ জ্ঞানের জন্য, নির্বাণের জন্য একান্ত উপযোগী। কোন্ সেই মধ্যম মার্গ তথাগত অবিস্কার করেছেন?- ইহাই হলো আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ। যেমন- সম্যক্ দৃষ্টি, সম্যক্ সংকল্প, সম্যক্ বাক্য, সম্যক্ কর্ম, সম্যক্ জীবিকা, সম্যক্ ব্যায়াম (প্রচেষ্টা), সম্যক্ স্মৃতি এবং সম্যক্ সমাধি।
ভগবানের উপদেশে পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুগণ অর্থাৎ যারা ভগবানকে পথভ্রষ্ট বলে উপেক্ষা করেছিল, তারা অতীব সন্তুষ্ট হলেন, এবং ভগবানের বাক্যকে সাধুবাদে অভিবাদন করেন। এই ধর্মোপদেশ কালে ‘আয়ুষ্মান কৌন্ডিণ্য’ দৃষ্টি (জ্ঞান) প্রাপ্ত হন। ‘যা উৎপন্ন হয়েছে, যা উৎপন্ন হচ্ছে এবং যা উৎপন্ন হবে সেই সবের হেতু তার সমূলে বিনষ্ট হলো।’
কৌন্ডিণ্যর জ্ঞান প্রাপ্ত হলে ভগবান উদ্বার্ত্ত স্বরে বলেন-‘ কৌন্ডিণ্য সত্য জ্ঞাত হয়েছে, জ্ঞান প্রাপ্ত হয়েছে।’ তৎপর থেকে কৌন্ডিণ্যের নাম হয় ‘ঞাণ কৌন্ডিণ্য’ বা ‘জ্ঞান কৌন্ডিণ্য’।
সূত্র – বুদ্ধের সমকালীন ভিক্ষুসংঘ, মুদিতারত্ন ভিক্ষু