মহাসুদর্শন জাতক (পর্ব ১)
সর্বদা ত্রিবিধ সুখের অধিকারী হতে চাইলে মনোযোগ সহকারে পড়ুন মহাসুদর্শন জাতক এবং জানুন কি কি দান করলে কিরকম মহাপুণ্যের ভাগী হয়? পড়ুন, জানুন এবং জন্ম জন্মান্তর সুখের অধিকারী হবার চেষ্টা করুন।
ইলা মুৎসুদ্দী
এক সময় কোণ্ডঞো স্থবির ভগবানের আদেশ নিয়ে স্বীয় পরিষদ সহ জেতবন হতে সাকেত নগরে উপস্থিত হলেন। সাকেত রাজ স্থবিরকে দেখে প্রসন্ন চিত্তে স্বীয় অমাত্যকে বললেন- আমাদের বিহারে অবস্থানের জন্য মহামান্য এই স্থবিরকে তুমি নিমন্ত্রণ কর। তখন অমাত্য রাজার আদেশ প্রতিপালন করলেন। স্থবির অমাত্যের আমন্ত্রণে রাজ বিহারে বাস করতে লাগলেন। তখন রাজা স্থবিরের নিকট উপস্থিত হয়ে তাঁকে ভক্তি সহকারে বন্দনা করলেন এবং বিশেষ ভাবে অনুরোধ করে বললেন- ভন্তে, আমাদের বিহারে বর্ষাবাস করুন। স্থবিরও সে রাজ বিহারে তিনমাস বর্ষাযাপন করে রাজাকে বললেন- মহারাজ, এখন আমরা অন্যত্র গমন করব। রাজা স্থবিরের গমন বার্তা শুনে বিহারে এক কল্পতরু দানের অনুষ্ঠান করলেন। সে কল্পতরুর পূর্ব শাখায় শালি ধান্য, শালি তণ্ডুল, তিল, মুগ, কদলী ও ইক্ষু প্রভৃতি নানা খাদ্যদ্রব্য প্রচুর পরিমাণে ঝুলিয়ে দিলেন। পশ্চিম শাখায় কৌশিক বস্ত্র, গোলাপী ও রক্তবর্ণ কম্বল এবং কার্পাসের নানাবর্ণ মূল্যবান বস্ত্রাদি ঝুলিয়ে দিলেন। দক্ষিণ শাখায় স্বর্ণ, রৌপ্য, মণি, মুক্তা রত্ন , রত্ন ঘটিত কুণ্ডল ও দীর্ঘ মেখল হার ইত্যাদি প্রচুর পরিমাণে দিলেন। মধ্য শাখায় সপ্ত রত্নে খচিত সুবর্ণ ছত্র, কিন্ কিন্ শব্দকারী সুবর্ণ জালে পরিবেষ্ঠিত পঞ্চবর্ণ ধ্বজা পতাকায় পরিশোভিত করে ঝুলিয়ে রাখলেন। তারপর রাজা সুসজ্জিত কল্পতরু অষ্ট পরিক্খার, প্রচুর পরিমাণ অন্ন পানীয় দ্বারা শকট পূর্ণ করে বিহারে নিয়ে কোণ্ডঞো প্রমুখ ভিক্ষু সংঘকে তা দান করলেন। স্থবির সে দান অনুমোদন করে রাজাকে ধর্মদেশনা করলেন। তিনি সে ধর্মদেশনা শুনে প্রীতিফুল্ল মনে স্থবিরকে বন্দনা ও প্রদক্ষিণ করে চলে গেলেন।
অন্য এক সময় রাজা সপরিবার জেতবন বিহারে এসে বুদ্ধকে বন্দনান্তর একান্তে উপবেশন করে বললেন- ভন্তে, সর্ববিধ পরিভোগ্য বস্তু দ্বারা একটি কল্পতরু সুসজ্জিত করে অষ্ট পরিক্খার ও প্রচুর পরিমাণে অন্ন পানীয় খাদ্য-ভোজ্যাদি সহ সংঘদান করছি। এ দান মহাফলপ্রসূ হয়েছে কিনা তা আপনার নিকট জান্তে ইচ্ছা করি। ভগবান বললেন- মহারাজ, ভিক্ষু সংঘকে যা দান দেওয়া হয় তা মহাফলপ্রদ হয় ইত্যাদি বলে ধর্মদেশনা করলেন। সে ধর্মদেশনায় সপরিবার রাজা স্রোতাপত্তি ফলে প্রতিষ্ঠিত হলেন।
তখন ভিক্ষুগণ ধর্মসভায় উত্থাপন করলেন- বন্ধুগণ, অজীত রাজা কোণ্ডঞো স্থবির প্রমুখ সংঘকে সর্ববিধ পরিভোগ্য বস্তুসহ কল্পতরু ও উৎকৃষ্ট অন্ন পানীয় খাদ্য ভোজ্যাদি দান করে সারা জম্বু দ্বীপে প্রসিদ্ধি লাভ করেছেন এবং সুপরিচিত হয়েছেন। ভগবান বুদ্ধ গন্ধকুটি হতে দিব্য কর্ণে ভিক্ষুগণের আলোচনা শুনে সে সম্মিলনীতে উপস্থিত হলেন। তথায় তিনি শ্রেষ্ঠ আসনে বসে বললেন- তোমরা এখন এখানে কোন বিষয়ের আলোচনা নিয়ে বসেছ?
তখন ভিক্ষুগণ নিজেদের আলোচ্য বিষয় বুদ্ধের নিকট প্রকাশ করলেন। তা শুনে শাস্তা বললেন- হে ভিক্ষুগণ, এ মহা দান বস্তু শুধু এখন যে দান করা হচ্ছে, তা নয় পূর্বেও এক পণ্ডিত ব্যক্তি কশ্যপ সম্যক সম্বুদ্ধের শ্রাবক সংঘকে সর্ব্ববিধ পরিভোগ্য বস্তু দান করেছিলেন। এ বলে সে অতীত কাহিনী বলতে আরম্ভ করলেন।
বহু অতীতকালে বারাণসী নগরে ব্রহ্মদত্ত রাজা ধর্মতঃ রাজত্ব করতেন। তাঁর অগ্রমহিষীর নাম ছিল সুমনা দেবী। তথায় মহাধনী মহাভোগ সম্পদশালী ও মহাপরিবার সম্পন্ন এক শ্রেষ্ঠী বাস করতেন। তখন বোধিসত্ত্ব ঐ শ্রেষ্ঠী পত্ন ীর জঠরে জন্ম নিয়ে মহাপরিবারের পরম যত্নে বর্দ্ধিত হলেন। তথাকালে পিতার মৃত্যুর পর বোধিসত্ত্বই শ্রেষ্ঠীর পদে উন্নীত হলেন। তৎকালে কশ্যপ সম্যক সম্বুদ্ধ জগতে উৎপন্ন হয়ে দেব নরের উপকারে রত হয়ে তত্রস্থ মহাবিহারেই বাস করতেছিলেন। তখন তার এক শ্রাবক স্থবির বিবেক প্রিয় হয়ে অরণ্যে কর্মস্থান ভাবনায় নিরত ছিলেন, এমন সময় বোধিসত্ত্ব নিজের প্রয়োজনে অরণ্যে প্রবেশ করে এদিক ওদিক ভ্রমণ করছিলেন। এমন সময় তিনি দেখলেন এ স্থবির এস্থানে ভাবনায় নিরত আছেন। তখন তিনি প্রসন্ন মনে স্থবিরের নিকট গিয়ে তাঁকে বন্দনা করে বললেন- ভন্তে, আপনি কি এখানেই বাস করেন? স্থবির বললেন- হাঁ, উপাসক।
ইহা শুনে বোধিসত্ত্ব চিন্তা করলেন- এখানেই পুণ্য কর্ম করবার এখন উপযুক্ত সময়। এ মনে করে তিনি একখানা পর্ণশালা তৈরী করে তার চারিদিকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে ও বালুকা ছিটে গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন। পর দিবস তিনি দীপ, ধুপ, সুগন্ধি, পুষ্প, মাল্য, বিলেপন ও নানাবিধ দানীয় বস্তু নিয়ে স্থবিরের নিকট উপস্থিত হলেন। তিনি তাঁকে পঞ্চাঙ্গ লুটিয়ে বন্দনা করে বললেন- ভন্তে, আমার প্রতি অনুকম্পা করে এ পর্ণশালায় বাস করুন। এবলে দ্রব্য সামগ্রী দিয়ে স্থবিরকে পূজা করলেন। তৎপর হতে বোধিসত্ত্ব চর্তুপ্রত্যয়ের মধ্যে স্থবিরের যখন যা প্রয়োজন হত, প্রচুর পরিমাণে দান করে প্রার্থনা করতেন- এ দান আমার সর্বজ্ঞতা জ্ঞান লাভের হেতু হউক। স্থবির তাঁর এ দান অনুমোদন করার কালে ভাষণ করলেন-
· যাঁরা পর্ণশালা দান করেন, তাঁরা প্রসাদ লাভ করেন। যাঁরা পানীয় দান করেন, তাঁরা দিব্য পানীয় লাভ করেন। চংক্রমণ দায়ক প্রকাণ্ড আবাস লাভ করেন এবং স্থান বা ভূমি দায়কেরা পৃথিবীশ্বর হন। অন্নদানকারীরা জন্ম- জন্মান্তরে শক্তিশালী, নানা বস্তু দান কারীরা ভবে ভবে সর্ববস্তু লাভী হয়। যান দান কারীরা সুখী হয় ও দীপ দানকারী চক্ষুষ্মাণ হয়। যাঁরা মঞ্চ দান করেন, তারা দিব্য পালঙ্ক লাভ করেন, দণ্ড দানকারীরা বহু পুত্র লাভ করেন এবং বড় জলপাত্র দানকারীরা বড় রত্ন পাত্র লাভ করেন। এবম্বিধ বস্তু দান দ্বারা অনাগতে সম্যক সম্বুদ্ধত্ব লাভের সদিচ্ছা পূর্ণ হয়।
সূত্র –জাতক পঞ্চাশক, জিনবংশ মহাথেরো