ভবান্তরে কে শত্রু কে মিত্র লক্ষণ দেখে বোধগম্য হওয়া বেশ দুস্কর, অনেক সময় শত্রুকেও মিত্রের আশ্রয় নিতে দেখা যায়,
একটি ফুল দিয়ে যেমন মালা তৈরি হয় না, দুর্জ্জনের দু একটি ভাল কথার কুড়িতেও মিত্র ভাবা যায় না । আর এই মিত্রা মিত্র লক্ষণ বোঝার জন্যই আমার এহেন প্রয়াস ।
পূণ্যশ্লোক সুমন সুকর্মের প্রভাবে ভবান্তরের কোন এক জন্মে বারাণসীর অধিপতি হয়েছিলেন, গৌতম বোধিসত্ত্ব ছিলেন তার প্রধান অমাত্য, অর্থাৎ ধর্মানুশাসক, তিনি ছিলেন জ্ঞানে, বিচক্ষণতায় ও কর্মদক্ষতায় অপর অমাত্যগণ হতে শ্রেষ্ঠতম, তার কীর্তিকলাপ কিন্তু অন্য অমাত্যদের অসহ্য হলো, তাদের অন্তরে ঈর্ষানল জ্বলে উঠল ।
দুর্জ্জন কিছুতেই সহ্য করতে পারে না গুণবানের গুণের প্রশংসা, গুণীকে হিংসা করে দুর্জ্জন, সজ্জন যে বিষয়ে তুষ্ট হন, দুর্জ্জন তাতেই হয় কুপিত। দুর্জ্জন সর্প হতেও ক্ররতর, এদের বিদ্বেষ বিষ দুঃসহ এবং স্বচ্ছন্দে হত্যা করতে পারে সাধুজনকে, দুর্জ্জনের মাধুর্যে নম্রতায় ও প্রিয়লাপে যে ব্যক্তি মুগ্ধ হয়, বিশ্বাস স্থাপন করে, তার পতন অনিবার্য ।
দুষ্টুবুদ্ধি অমাত্যগণ রাজাকে প্রধান সচিবের বিরুদ্ধে নানা কথা বলতে লাগলেন, সবই কিন্তু মিথ্যা আর অতিরঞ্জিত, সুবুদ্ধি পরায়ণ রাজা তাদের কথা শুনে অনুসন্ধান করে তার কোন দোষ দেখতে পেলেন না, তাই নৃপতি বিরুদ্ধবাদীর কোন কথা বিশ্বাস করলেন না।
একদিন রাজা ধীর চিত্তে চিন্তা করলেন – প্রধান অমাত্য মহান ব্যক্তি, সুপন্ডিত ও শ্রেষ্ঠ রাজনীতিজ্ঞ, তার প্রজ্ঞাগুণে রাজ্যের হচ্ছে শ্রীবৃদ্ধি, আমার পরিষদের মধ্যে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী, এর বিরুদ্ধে ওরা এত কথা বলে কেন, মনে হয় মহৎ এর গুণ গরীমা ওদের সহ্য হচ্ছে না, আমার প্রতি ওরা যে কল্যাণ মিত্রের ভাব দেখাচ্ছে, তাও তাদের দুর্বুদ্ধি প্রণোদিত মিথ্যা মায়া মাত্র ।
অনন্তর একদিন প্রধান অমাত্যকে জিজ্ঞাসা করলেন – অমাত্য প্রবর শত্রু এবং মিত্রের লক্ষণ কিরুপ ? তাদেরকে অনায়াসে জানবার উপায় বা কি ?
প্রত্যুত্তরে মনীষী মহাসত্ব বললেন – মহারাজ শত্রুর ষোড়শ প্রকার লক্ষণ, আমি বলছি, মনোনিবেশ সহকারে শ্রবণ করুন :
১/ আপনাকে দেখে যার মুখ বিষন্ন হয়, মুখে হাসি থাকে না ।
২/ আপনার কথা শুনে যে ব্যক্তি সুখি হয় না ।
৩/ আপনার সঙ্গে দেখা হলেই যে ব্যক্তি চোখ ফিরিয়ে নেয় ।
৪/ আপনি যা বলেন তার বিপরীত বলে সে ব্যক্তি ।
৫/ যে ব্যক্তি আপনার শত্রুতার সঙ্গে মিত্রতা করে ।
৬/ যে ব্যক্তি আপনার মিত্রকে শত্রুর মত মনে করে ।
৭/ আপনার সুখ্যাতি শুনলে যে ব্যক্তি প্রতিবাদ করে ।
৮/ আপনার নিন্দা শুনলে যে ব্যক্তি আনন্দিত হয় ।
৯/ যে ব্যক্তি নিজের গোপন কথা আপনার নিকট প্রকাশ করে না । অথচ আপনার গোপন কথা অন্যের নিকট প্রচার করে ।
১০/ যে ব্যক্তি কোনদিন আপনার কোনও কার্যের প্রশংসা করেনা ।
১১/ আপনি যে সুবিজ্ঞ, যে ব্যক্তি তা স্বীকার করে না ।
১২/ আপনার ক্ষতিতে যে ব্যক্তি আনন্দিত হয় ।
১৩/ আপনার লাভের কথা শুনে যে ব্যক্তি ঈর্ষানলে জ্বলে ।
১৪/ উত্তম খাদ্য লাভ করে যে ব্যক্তি আপনার কথা স্মরণ করে না
১৫ / আপনি যে সুখাদ্য থেকে বঞ্চিত হলেন, তজ্জন্য যে ব্যক্তি দুঃখিত হয় না ।
১৬/ আপনি যে উত্তম খাদ্য থেকে বঞ্চিত হলেন, তজ্জন্য যে ব্যক্তি একটুকুও দুঃখিত হয় না, এবং একবারও চিন্তা করে না ।
মহারাজ সুধীজন, এই ষোড়শবিধ লক্ষণ দেখে আমি পরিজ্ঞাত হই ।
এখন শুনুন ষোড়শবিধ মিত্রের লক্ষণ, যথা :
১/ আপনার বিদেশ গমণ কালে অথবা প্রবাস অবস্থানকালীন, যে ব্যক্তি আপনার কথা সর্বদা স্মরণ করেন ।
২/ আপনার দর্শন লাভে যে ব্যক্তি অতিশয় উৎফুল্ল হন ।
৩/ বিদেশ থেকে আপনার প্রত্যাবর্তনে যে ব্যক্তি আনন্দিত হন ।
৪/ যে ব্যক্তি আন্তরিকতার সহিত আপনার প্রবাস জীবন ও আগমণ পথের কথা জানতে চান ।
৫/ আপনার মিত্রকে যে ব্যক্তি প্রীত চোখে দেখেন ।
৬/ যে ব্যক্তি আপনার শত্রুকে বর্জন করেন ।
৭/ আপনার দুর্নাম শুনলে যে ব্যক্তি প্রতিবাদ করেন ।
৮/ আপনার সুখ্যাতির কথা শুনে যে ব্যক্তি আনন্দিত হন ।
৯/ যিনি অকপটে নিজের গোপন কথা আপনাকে বলেন ।
১০/ আপনার গোপন কথা যিনি অন্যের নিকট প্রকাশ করেন না ।
১১/ যিনি সকলের নিকট আপনার গুণকীর্তন করেন।
১২/ আপনার প্রজ্ঞার বিষয় দর্শনে যিনি এরুপ প্রশংসা করে বলেন, আপনার মতো প্রজ্ঞাবান আর কা’কেও দেখা যায় না ।
১৩/ আপনার লাভবান দেখে যিনি অপার আনন্দ উপভোগ করেন ।
১৪/ আপনার ক্ষতিতে যিনি দুঃখানুভব করেন ।
১৫ / যিনি সুখাদ্য পেয়ে আপনার কথা স্মরণ করেন ।
১৬/ আপনি সুখাদ্য থেকে বঞ্চিত হলেন দেখে যিনি দুঃখিত হন ।
মহারাজ, জ্ঞানী ব্যক্তি এ ষোড়শ প্রকার লক্ষণ দেখে প্রকৃত মিত্র নির্বাচন করে থাকেন । মহামাত্যের অপূর্ব বাক্যবলী শ্রবণে রাজা অতীব আনন্দিত হলেন, তার সর্বতোমুখী জ্ঞানের পরিচয় পেয়ে নৃপতির অন্তর শ্রদ্ধায় পূর্ণ হলো । এ অসাধারণ জ্ঞানের যথোপযুক্ত সম্মানের ব্যবস্থা করলেন নরনাথ, গুণগ্রাহী ভূপতি জীবনের একমাত্র অবলম্বন স্বরূপ মহাপণ্ডিত সচিব প্রবরকে কল্যাণ মিত্ররুপে বরণ করে নিলেন । বুদ্ধ সেবক আনন্দই ছিলেন তখন এই গুণগ্রাহী রাজা, ইনি মহাসত্ত্বের সান্নিধ্য লাভে কৃতার্থ হয়েছিলেন ।
সজ্জন সতত সর্বত্র সুখি হন
চক্রবাল বাসী সুখি হউক
দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ করুক ।
[ মিত্রা মিত্র জাতক থেকে সংকলিত ]