০১। আনন্দ স্থবির রাজগৃহে
অহুত সপ্তপর্ণী গুহায় পঞ্চশত অর্হতের সম্মেলনে প্রথম মহাসঙ্গীতিতে বলিয়াছেন-
আমি এইরূপ শুনিয়াছি,- এক সময় ভগবান বারাণসীর ঋষিপতন মৃগদায়ে অবস্থান করিতেছিলেন।
তথায় তিনি কৌন্ডণ্য, ভদ্রিয়, বপ্প, অশ্বজিত ও মহানাম এই পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুদের
আহ্বান করিলেন।
০২। হে ভিক্ষুগণ, দুইটির
চরমে প্রব্রজিত ভিক্ষু-শ্রমণদের যাওয়া উচিত নহে। সেই দুইটা কী কী? প্রথমত হীন,
গ্রাম্য ও সাধারণ জনসেবিত অনার্য ও অনর্থকর কাম্যবস্তুতে অনুরক্ত হওয়া। আর দ্বিতীয়ত
অনার্য ও অনর্থযুক্ত আত্মক্লেশ-জনিত দুঃখ বরণ। এই দুই অন্ত ত্যাগ করিয়া তথাগত
মধ্যমপথ অধিগত হইয়াছেন যাহা চক্ষু উৎপাদনকারী, জ্ঞান-উপশম ও অভিজ্ঞা উৎপাদনকারী এবং
যাহা মানুষকে সম্বোধি বা নির্বাণের দিকে সংবর্তিত করে।
০৩। হে ভিক্ষুগণ, বুদ্ধ
তথাগত কর্ত্তৃক অধিগত চক্ষু উৎপাদনকারী, জ্ঞান, উপশম ও অভিজ্ঞা উৎপাদনকারী এবং
সম্বোধি ও নির্বাণের দিকে সংবর্তনকারী সেই মধ্যমপথ কী? ইহা আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ।
যথা-সম্যক দৃষ্টি, সম্যক সঙ্কল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক
চেষ্টা, সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি। ভিক্ষুগণ, চক্ষু উৎপাদনকারী, জ্ঞান, উপশম ও
অভিজ্ঞা উৎপাদনকারী এবং সম্বোধি ও নির্বাণের দিকে সংবর্তনকারী এই মধ্যম প্রতিপদা
তথাগত বুদ্ধ অধিগত হইয়াছেন।
০৪। হে ভিক্ষুগণ, জন্ম
দুঃখ, জরা দুঃখ, ব্যাধি দুঃখ, মরণ দুঃখ, অপ্রিয় সংযোগ দুঃখ, প্রিয় বিয়োগ দুঃখ,
ইচ্ছিত বস্তুর অলাভজনিত দুঃখ ও সংক্ষেপে বলিতে গেলে পঞ্চ উপাদান স্কন্ধই দুঃখ।
ইহাকে বলে দুঃখ আর্য্যসত্য।
০৫। হে ভিক্ষুগণ, ভব হইতে
ভবান্তরে পুন:পুন: উৎপাদিকা তৃষ্ণা যাহা আনন্দ ও লোভের সহিত আগমন করে এবং সেই সেই
ভবে অভিনন্দনকারিনী- ইহাকে বলা হয় দুঃখ সমুদয় আর্যসত্য। তাহা ত্রিবিধ - কামতৃষ্ণা,
ভবতৃষ্ণা ও বিভবতৃষ্ণা।
০৬। হে ভিক্ষুগণ, সেই
তৃষ্ণার নিঃশেষে বিরাগ, নিরোধ, ত্যাগ, নিক্ষেপ, মুক্তি ও অনালয়, ইহাকে বলে
দুঃখ-নিরোধ আর্যসত্য।
০৭। হে ভিক্ষুগণ, সম্যক
দৃষ্টি, সম্যক সঙ্কল্প, সম্যক বাক্য, সম্যক কর্ম, সম্যক জীবিকা, সম্যক চেষ্টা,
সম্যক স্মৃতি ও সম্যক সমাধি- এই আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গই দুঃখ নিরোধগামিনী প্রতিপদা
বা দুঃখ নিরোধের উপায় আর্যসত্য।
০৮। হে ভিক্ষুগণ, ইহা
‘দুঃখ আর্যসত্য’ বলিয়া এই অশ্রুতপূর্ব ধর্মে আমার জ্ঞানচক্ষু ফুটিয়াছে, জ্ঞান
উৎপন্ন হইয়াছে, প্রজ্ঞা উৎপন্ন হইয়াছে, বিদ্যা উৎপন্ন হইয়াছে, আলোক উৎপন্ন হইয়াছে।
সেই দুঃখ আর্যসত্য পরিজ্ঞাতব্য বলিয়া এই অজ্ঞাতপূর্ব ধর্মে আমার চক্ষু, জ্ঞান,
প্রজ্ঞা, বিদ্যা ও আলোক উৎপন্ন হইয়াছে। সেই আর্যসত্য পরিজ্ঞাতব্য বলিয়া এই
অশ্রুতপূর্ব ধর্মে আমার চক্ষু,জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বিদ্যা ও আলোক উৎপন্ন হইয়াছে।
০৯। হে ভিক্ষুগণ, ইহা
‘দুঃখ আর্যসত্য’ বলিয়া এই অশ্রুতপূর্ব ধর্মে আমার চক্ষু, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বিদ্যা ও
আলোক উৎপন্ন হইয়াছে। ভিক্ষুগণ, সেই ‘দুঃখসমুদয় আর্যসত্য’ ‘ত্যাগের যোগ্য’ বলিয়া এই
অপ্রকাশিতপূর্ব ধর্মে আমার চক্ষু, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বিদ্যা ও আলোক উৎপন্ন হইয়াছে।
ভিক্ষুগণ, সেই ‘দুঃখ সমুদয় আর্যসত্য’ পরিত্যক্ত হইয়াছে বলিয়া এই অশ্রুতপূর্ব ধর্মে
আমার চক্ষু,জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বিদ্যা ও আলোক উৎপন্ন হইয়াছে।
১০। হে ভিক্ষুগণ, ইহা
‘দুঃখ নিরোধ আর্যসত্য’ বলিয়া এই অশ্রুতপূর্ব ধর্মে আমার চক্ষু, জ্ঞান, প্রজ্ঞা,
বিদ্যা ও আলোক উৎপন্ন হইয়াছে। ভিক্ষুগণ, সেই দুঃখ নিরোধ আর্যসত্য ‘প্রত্যক্ষ-করণীয়’
বলিয়া এই অজ্ঞাতপূর্ব ধর্মে আমার চক্ষু,জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বিদ্যা ও আলোক উৎপন্ন
হইয়াছে। ভিক্ষুগণ, ‘দুঃখনিরোধ আর্যসত্য’ প্রত্যক্ষ করিয়াছি বলিয়া এই অশ্রুতপূর্ব
ধর্মে আমার চক্ষু,জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বিদ্যা ও আলোক উৎপন্ন হইয়াছে।
১১। হে ভিক্ষুগণ,
ইহা ‘দুঃখ নিরোধগামিনী প্রতিপদা আর্যসত্য’ বলিয়া এই অজ্ঞাতপূর্ব ধর্মে আমার চক্ষু,
জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বিদ্যা ও আলোক উৎপন্ন হইয়াছে। ভিক্ষুগণ, সেই ‘দুঃখ নিরোধগামিনী
প্রতিপদা আর্যসত্য ভাবনা করিবার যোগ্য’ বলিয়া এই অশ্রুতপূর্ব ধর্মে আমার চক্ষু,
জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বিদ্যা ও আলোক উৎপন্ন হইয়াছে। ভিক্ষুগণ, সেই ‘দুঃখ নিরোধগামী
প্রতিপদা আর্যসত্য, আমি ভাবনা করিয়াছি’ বলিয়া এই অশ্রুতপূর্ব ধর্মে আমার চক্ষু,
জ্ঞান, প্রজ্ঞা, বিদ্যা ও আলোক উৎপন্ন হইয়াছে।
১২। হে ভিক্ষুগণ, এই চারি
আর্যসত্য সমূহে ত্রিবিধ ক্রম অনুসারে দ্বাদশ প্রকার জ্ঞানদর্শন যতদিন আমার পরিষ্কার
হয় নাই, ততদিন আমি মার, ব্রহ্মা, শ্রমণ-ব্রাহ্মণ কিম্বা দেব মানবের মধ্যে অনুত্তর
সম্যক সম্বোধি লাভ করিয়াছি বলিয়া প্রকাশ করি নাই।
১৩। হে ভিক্ষুগণ, এই চারি
আর্যসত্যসমূহের ত্রিবিধ ক্রম অনুসারে দ্বাদশ প্রকার জ্ঞানদর্শন যখন আমার পরিষ্কার
হইয়াছিল, তখন হইতে আমি দেব, ব্রহ্মা, শ্রমণ-ব্রাহ্মণ ও দেব মানবের মধ্যে অনুত্তর
সম্যক সম্বোধি লাভ করিয়াছি বলিয়া প্রকাশ করিয়াছি।
১৪। আমার জ্ঞান-দর্শন
উৎপন্ন হইয়াছে। আমার চিত্তবিমুক্তি প্রকুপিত হইবার নহে। ইহাই আমার অন্তিম জন্ম। এই
হইতে আমাকে আর সংসারে জন্ম গ্রহণ করিতে হইবে না। ভগবান বুদ্ধ যখন এই উক্তি করিলেন,
তখন পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুগণ আনন্দিত হইয়া ভগবৎবাক্য সাধুবাদের সহিত অনুমোদন করিলেন।
১৫/১৬।
এই ধর্মচক্র সূত্র প্রবর্ত্তিত হইলে আযুষ্মান কৌন্ডণ্যের পাপরজঃমুক্ত ও
কলুষবিহীন ধর্মচক্ষু অর্থাৎ স্রোতাপত্তি মার্গফল লাভ হইয়াছিল, অর্থাৎ যাহা কিছু
উদয়শীল তাহাই বিলয়ধর্মী। ভগবান বুদ্ধের দ্বারা ধর্মচক্র প্রবর্ত্তিত হইলে ভূমিবাসী
দেবতারা এই সাধুবাদ ধ্বনি ঘোষণা করিয়াছিলেন- ‘ইহা ভগবান বুদ্ধ কর্ত্তৃক বারাণসী
ঋষিপতন মৃগদায়ে অনুত্তর ধর্মচক্র প্রবর্ত্তিত হইয়াছিল যাহা শ্রমণ-ব্রাহ্মণ, দেব,
মার, ব্রহ্মা বা অন্য কাহারো দ্বারা প্রবর্তিত হয় নাই।
ভূমিবাসী দেবগণের শব্দ শুনিয়া চতুর্ম্মহারাজিক দেবতারা সাধুবাদ ধ্বনি ঘোষণা করিলেন।
এইরূপে তাবতিংস, যাম, তুষিত, নির্মাণরতি, পরনির্মিতবশবর্ত্তী দেবগণও সাধুবাদ ঘোষণা
করিয়াছিলেন। এইভাবে ব্রহ্মা পারিসজ্জা, ব্রহ্মা পুরোহিত, মহাব্রহ্মা, পরিত্তাভ,
অপ্রমাণাভ, আভস্বর, পরিত্তশূভ, সপ্রমাণশুভ, শুভকিহ্ন, বিহপ্ফল, অবিহ, অতপ্প,
সুদর্শ, সুদর্শী এবং অকনিষ্ঠবাসী দেবগণও সাধুবাদ ধ্বনি ঘোষণা করিয়াছিলেন।
১৭। এই প্রকারে সেই
ধর্মচক্র প্রবর্ত্তন-ক্ষণে সেই মুহূর্ত্তে ব্রহ্মলোক পর্যন্ত শব্দ ঘোষিত হইয়াছিল।
তখন এই দশসহস্র সৌরজগৎ কম্পিত ও প্রকম্পিত হইয়াছিল। দিব্য আলোককেও অতিক্রম করিয়া
জগতে এক অপ্রমেয় এবং উদার আলোকরশ্মি প্রাদুর্ভূত হইয়াছিল।