আজ জানব মল্লিকাদেবীর কাহিনী। আমরা যেখানে
একটুখানি শোকে কাতর হয়ে যাই সেখানে মল্লিকাদেবী ৩২ জন সন্তান আর স্বামীর
মৃত্যুসংবাদ পেয়ে ও নির্বিকার, অবিচল ছিলেন।কিভাবে সম্ভব? জানতে হলে পড়ুন----------
কুশিনারার মল্লরাজপুত্র বন্ধুল কোশল রাজপুত্র
পসেনদির সঙ্গে তক্ষশিলায় এক আচার্যের নিকট বিদ্যা শিক্ষা করেন। তখন তাঁদের মধ্যে
প্রগাঢ় বন্ধুত্ব জন্মে। যথাসময়ে শিক্ষা সমাপ্ত করে উভয়ে আপন আপন রাজ্যে গমন করেন।
স্বজ্ঞাতি মল্লদের ব্যবহারে অসন্তুষ্ট হয়ে কয়েক বৎসর পরে বন্ধুল স্ত্রী
মল্লিকাদেবীকে নিয়ে কোশলে রাজা পসেনদির নিকট চলে আসেন। তিনি বন্ধুকে সাদরে গ্রহণ
করেন এবং সেনাপতিপদে বরণ করেন।
সেনাপতি বন্ধুল স্ত্রীর সঙ্গে সেখানে সুখে
সম্মানে বাস করতে থাকেন। কালক্রমে মল্লিকাদেবী ষোলবারে বত্রিশটি যমজপুত্র লাভ করেন।
তারা সবাই পিতার মত মহাবলশালী ও প্রয়োজনীয় সর্ববিদ্যায় পারদর্শী ছিলেন। তাঁদের
প্রত্যেকের অধীনে এক হাজার করে সৈন্য ছিল।
তখন মগধের বিচার-বিভাগ ছিল অত্যন্ত
দুর্নীতিগ্রস্ত। বিচারকগণ ঘুষ গ্রহণ করে একের সম্পত্তি অন্যকে প্রদান করতেন।
বিচারপ্রার্থীগণ মহাদুঃখে আপন অদৃষ্টকে ধিক্কার দিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ঘরে ফিরতো।
একদিন বিচারকদের অন্যায় বিচারে সর্বস্ব হারিয়ে কিছু লোক সেনাপতি বন্ধুলের কাছে
প্রতিকারের জন্য প্রার্থনা জানায়। বন্ধুল বিচারালয়ে গিয়ে ন্যায় বিচার করে প্রকৃত
অধিকারীকে তার সম্পত্তি ফিরিয়ে দিলেন। তাঁর ন্যায় বিচারের জন্য তার সুনাম চতুর্দিকে
ছড়িয়ে গেল। রাজা তা জেনে তাঁকেই বিচারক পদে নিযুক্ত করেন।
অসাধু বিচারকগণ অপমানিত ও লাভ-সৎকার হতে
বঞ্চিত হয়ে বন্ধুলের সর্বনাশের জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। তাঁরা রাজাকে বার বার
নানাভাবে বোঝাতে লাগলেন যে এই বিদেশী সেনাপতি আপন কর্মকুশলতায় সৈন্যদের তথা
প্রজাদেরও বশ করেছেন। সেজন্যই সবাই তাঁর এতই প্রশংসা করছে, অচিরে আপনাকে
সিংহাসনচ্যুত করে তিনিই সিংহাসনের অধিকারী হবেন। অবশেষে রাজা তাঁদের কথায় বিশ্বাস
করে সেনাপতিকে সবংশে নিধন করবার জন্য উপায় উদ্ভাবনে নিমগ্ন হন।
রাজা পসেনদির প্ররোচনায় মগধরাজ্যের সীমান্তে
বিদ্রোহ ঘোষিত হল। তা দমন করবার জন্য রাজা সপুত্র বন্ধুলকে প্রেরণ করেন। তাঁদের
উপস্থিতিতেই বিদ্রোহ শান্ত হয়ে যায়। এদিকে সপুত্র বন্ধুলকে পথিমধ্যে লুকিয়ে থেকে
হত্যা করবার জন্য সমর্থ যোদ্ধাগণকে প্রেরণ করেন। তারা ঐভাবেই অতর্কিতে গৃহমুখী
সপুত্র বন্ধুলকে হত্যা করে।
এই দুঃসংবাদযুক্ত পত্র যখন মল্লিকাদেবীর নিকট
পৌঁছল তখন তিনি দুই অগ্রশ্রাবক সহ পাঁচশত ভিক্ষুকে খাদ্য পরিবেশনে রত ছিলেন। সে
পত্র পাঠ করে তা শাড়ীর আঁচলের কোণে বেঁধে রেখে তিনি নিরুদ্বিগ্ন চিত্তে পরিবেশন
কাজে নিযুক্ত থাকেন। সে সময় এক দাসীর হস্ত হতে এক ঘৃতভান্ড পড়ে ভেঙ্গে যায়।
ধর্মসেনাপতি বললেন উপাসিকে ভঙ্গুর বস্তু ভেঙ্গে গেছে, শোক করো না’। মল্লিকাদেবী
শাড়ির আঁচল থেকে খুলে পত্রটি ধর্মসেনাপতির হাতে দিয়ে বললেন- ‘ভন্তে এমন শোকাবহ
সংবাদ পেয়েও শোক করিনি। এই সামান্য ঘৃতভান্ডের জন্য কি শোক করব!’
ভোজন সমাপ্তির পর ধর্মসেনাপতি সপরিষদ
মল্লিকাদেবীকে ধর্মদেশনা করে বিহারে চলে যান।
মল্লিকাদেবী বত্রিশজন পুত্রবধূকে ডেকে উক্ত
সংবাদ প্রকাশ করে উপদেশ দেয় তোমাদের স্বামী নিরপরাধ। তারা সবাই অতীত জন্মের কৃত
কর্মফলই ভোগ করেছে। রাজার প্রতি বা অন্য কারো প্রতি তোমরা দ্বেষভাব উৎপন্ন করো না।
সর্বপ্রাণীর মঙ্গলকামী হয়ে যাবজ্জীবন ধর্মময় জীবন-যাপন করতে সচেষ্ট হও। প্রজ্ঞাবতী
শাশুড়ীর সংসর্গে ও উপদেশে এমন মহাশোকের সময়ও বধূরা শোকসন্তপ্ত হয়নি, সৎসঙ্গের এটা
মহাগুণ।