লোকমুখে শুধু
একটিই নাম অঙ্গুলিমাল। তার কারনে কোশল রাজ্যে যাবার সব পথ অবরুদ্ধ হয়ে যাবার উপক্রম
হয়ে পড়ে। এভাবে অবরুদ্ধ হয়ে পড়াতে রাজ দরবারে গিয়ে সবাই বিক্ষোভ করতে লাগলো। রাজা
প্রসেনজিৎ ব্রাহ্মন ভার্গবের কাছে তলব পাঠান, সে যেন অঙ্গুলিমালকে বুঝিয়ে নিয়ে
আসেন। সবাই তার ভয়ে অস্থির। অঙ্গুলিমালের পিতা ভর্গব রাজাকে সরাসরি জবাব দেন----
এমন কুলঙ্গার, কলঙ্কিত পুত্র আমাদের প্রয়োজন নেই। রাজার যেমন ইচ্ছা তেমন করা হোক।
এদিকে কোশলবাসীর ক্ষোভের মুখে রাজা প্রসেনজিৎ তাঁর
রজ্যের সেনাবাহিনীকে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়োজিত করেন। এবং তাদের নির্দেশ
প্রদান করা হয়, যে কোন ভাবেই হোক, অঙ্গুলিমালকে জীবিত অথবা মৃত তার সামনে আনতে হবে।
আর যদি তা সম্ভব না হয়, অঙ্গুলিমালের মাথা কেটে আনা হোক।
এদিকে রাজা এ আদেশ রাজ্যের সমস্ত প্রান্তে ঘোষনা করা
হয়। এ ঘোষনাতেও অঙ্গুলিমালের কাজের মাত্রার কমতি নেই, বরং দিনকে দিন বাড়তে থাকে।
এতদিনে তার গলায় আঙ্গুলের সংখ্যাও বেড়ে গিয়ে নয়শত নিরানব্বই। আর মাত্র একটি আঙ্গুল
সংগ্রহ করতে পারলেই লক্ষ্যন পূরণ। এদিকে মানুষের যাতায়াত কমে যাওয়াতে অঙ্গুলিমালের
দুচিন্তার শেষ নাই, সে প্রলাপ বকতে থাকে-- আর মাত্র একটি আঙ্গুল, আর মাত্র একটি
আঙ্গুল যদি সংগ্রহ করতে পারি তাহলে আমার মন বাসনার পাশাপাশি গুরু দক্ষিণা দিয়ে
গুরুর উপযুক্ত জবাব ও গুরুমায়ের স্নেহ-ভালবাসায় পুনঃ সিক্ত হব! যে কোন ভাবেই হোক
আমার আঙ্গুল চাই চাই চাই।
অন্যদিকে অহিংসকের মা রাজার এ ঘোষনা শুনে ভয়ে তটস্থ।
মায়ের মন ছেলের জন্য কাঁদতে থাকে, পুত্রের জীবন বাঁচাতে বৃদ্ধা মা ছুটে চললেন ছেলের
সন্ধানে, পথে পথে তাকে বাধা দেওয়া হচ্ছে। সেনাবাহিনীর সেনারা তাকে আটকে রাখতে
চাইলেও পারলো না। ছেলেকে খুঁজতে অরণ্যে ছুটেই চললেন। জনশূন্য হওয়াতে অঙ্গুলিমাল
কোশল জনপদের বেশ কাছেই অবস্থান করছিল। কিন্তু সেনাবাহিনীর অবস্থান টের পেয়ে আবারো
গভীর অরণ্যে চলে যায়। মা, বনের ভেতর প্রবেশ করতেই ডাকতে লাগলেন--- অহিংসক, অহিংসক,
আমার অহিংসক, তুমি কোথায় বাবা, একবার এ বৃদ্ধা মায়ের কাছে আস, কতদিন দেখিনি তোমায়,
তুমি কেমন আছ, কি খেয়েছ, কেমন দেখতে হয়েছ, আস বাবা আামর কাছে আসো। এভাবে যোজন, যোজন
পথ অতিক্রম করতে করতে শ্রাবস্তী হতে তিন যোজন দূরে, জালিনী (জালি) বনে পৌঁছান।
এদিকে হঠাৎ
মানুষের অবস্থান আর শব্দ শুনে অট্টহাসি দিতে লাগলো---উ, হা,হা, হা,। মায়ের মুখে
অহিংসক নাম শুনে অঙ্গুলিমালের হৃদয় কিছুটা ব্যাকুল হলেও বহুদিনর পাওয়া থেকে বঞ্চিত
আঙ্গুলের তীব্রপীড়া তাকে বিদারিত করে। এবং বলতে থাকে আজকে তার গর্ভধারণীকে হত্যা
করে হলেও গুরু দক্ষিণা আমি দিবই দিব। আর বলতে লাগলো-- কোথায় অহিংসক, এখানে কোন
অহিংসক থাকে না, এখানে শুধু একমাত্র অঙ্গুলিমাল, সবাই আমাকে এই নামেই ডাকে। দেখছ
না, আমার গলায় আঙ্গুলের মালা, এখানে নয়শত নিরানব্বইটি আঙ্গুল, আর মাত্র একটি আঙ্গুল
দরকার। আবারো সেই ভয়ানক অট্টহাসি। তখন করুণা ঘন আবেগের কন্ঠে বৃদ্ধা মা বললেন--
বাছা, অহিংসক, আমি তোমার মা, আমাকে চিনতে পারছিস না বাবা অহিংসক। অঙ্গুলিমাল
অট্টহাসি দিয়ে উত্তর দেয়, কে মা, কার মা, আমি কাউকে চিনি না। আমি দেখতে পাচ্ছি
তোমার আঙ্গুল। এই বলে খড়গ উঁচিয়ে দৌড়াতে থাকে অঙ্গুলিমাল।
তথাগত বুদ্ধ তখন জেতবনে বিংশতম বর্ষাবাস যাপন
করতেছিলেন। প্রতিদিনকার নিয়ম অনুসারে প্রত্যূষকালে শ্রাবস্তীর জেতবন-আরামে
দিব্যদৃষ্টি বিস্তার করে ত্রিলোক অবলোকন করতে থাকেন।
তখনি দেখতে পেলেন অঙ্গুলিমাল ও তার বৃদ্ধা মাকে। বুদ্ধ
আরো জানতে পারলেন- এ জন্মে যদি অঙ্গুলিমাল তার মাকে হত্যা করে, তাহলে মাতৃ
হত্যাজনিত ঘৃণিত পাপের কারনে অবীচি নরকে গমন করবে। এবং সাথে সাথে বুদ্ধ জানতে
পারলেন, অঙ্গুলিমালের অরহত্বফল প্রাপ্তির সম্ভবনাও আছে। মাতৃ হত্যাজনিত পাপের ফলে
অঙ্গুলিমালের জীবন ধংস এবং অপায়ে গমন করা হতে বিরত করতে করুণা বশতঃ মহাকারুণিক
বুদ্ধ তৎক্ষণাৎ ঋদ্ধিশক্তি প্রয়োগ করে জালিনী বনে বৃদ্ধা মা এবং আঙ্গুলিমালের মাঝে
উপস্থিত হন। অঙ্গুলিমাল ঠিক যখনি তার খড়গ দিয়ে মাকে হত্যার পরিকল্পনা করতে থাকে তৎ
মুহুর্তে বুদ্ধকে দেখতে পেয়ে মাকে বাদ দিয়ে বুদ্ধকে হত্যার জন্যে ছুটে চলে।
অঙ্গুলিমালকে আসতে দেখে ভগবান বুদ্ধ
তাঁর এমন ঋদ্ধি প্রয়োগ করলেন যাতে করে, অঙ্গুলিমাল দৌড়ালেও ভগবান বুদ্ধকে ধরতে না
পারে। অঙ্গুলিমাল তার সমস্ত বল প্রয়োগ করেও বুদ্ধের কাছে পৌঁছাতে পারছিল না। শেষে
ক্লান্ত হয়ে সে নুইয়ে পড়ে, এবং ভাবতে থাকে-- এ কেমন মানুষ, কে এই শ্রমণ, আমি ধাবমান
হরিণকে তৎক্ষনাৎ ধরতে পারি, অথচ এই শ্রমণকে কেন ধরতে পারছি না! শেষে আঙ্গুলিমাল
দূর্বল হয়ে বলে--- হে শ্রামণ, থামো, (কঠিন গলায়) থামো বলছি, আর এক পাও দৌড়াবে না !
বুদ্ধ-- বৎস, আমি দৌড়াচ্ছি না, আমি তো
স্থির; বরং তুমিই দৌড়াচ্ছো, তুমিই অস্থির। তুমিই থামো !
অঙ্গুলিমাল ভাবতে থাকে, এ আবার কেমন
কথা, আমি এত দৌড় দিয়েও তাকে ধরতে পারলাম না আর শ্রমণ বলে কিনা সে স্থির। এটা কিভাবে
সম্ভব, তখন আঙ্গুলিমাল বললো-- হে শ্রামণ, আমার জানা মতে, শাক্য পুত্রগণ কখনো মিথ্যা
কথা বলেন না। তুমি দৌড়াচ্ছো অথচ আমাকে বলছো তুমি স্থির। এর মানে কি?
বু্দ্ধ-- হে অঙ্গুলিমাল, সত্ত্বের কৃত
কর্মের সংযোজনের দন্ড ত্যাগ করেছি। আমি স্থির আছি, কিন্তু আবাগমনের দন্ড নিয়ে তুমিই
ধাবমান। আমি শান্ত আছি এবং স্থির। তুমিও স্থির হও। আমার ন্যায় শান্ত হও। তাই তোমাকে
শান্ত এবং স্থির হতে পরামর্শ দিয়েছি।
অঙ্গুলিমাল এবার চিন্তা করলো কে এই শ্রামণ! এমন মধুর
শব্দ আমি তো জীবনেও শুনি নাই, বুদ্ধের অমৃত বাণী শুনা মাত্রই তার সারা মন-মানসিক,
মস্তিস্কে এক অদ্ভুত তরঙ্গ বয়ে যেতে লাগলো। বোধশক্তি ফিরে পেয়ে ভাবতে লাগলো এ শ্রমণ
কোন সাধারণ শ্রমণ নন। নিশ্চয়ই আমার কল্যাণে এই জনশূণ্য মহাঅরণ্যে আগমন করেছেন। তার
হৃদয়ে জ্ঞানের সঞ্চার হয়। প্রাণী হত্যার কারণ সম্পর্কে অবগত হয়ে উৎসুক হয়ে বলে
উঠে-- হে শ্রামণ, আপনি কে?
বুদ্ধ-- আমি তথাগত গৌতম বুদ্ধ।
বুদ্ধের মুখে বুদ্ধ শব্দ উচ্চারিত হতেই খড়গ ফেলে দিয়ে
বুদ্ধের পায়ে লুটিয়ে পড়ে মাথা নত করে আর্তনাদ করতে থাকে.. এবং বলতে থাকে --- ভগবান
আমাকে রক্ষা করতে আপনার এখানে আগমন। আমাকে রক্ষা করুন। তখন বুদ্ধ এস ভিক্ষু বলতেই
পূর্বজন্মের কর্মের প্রভাবে ঋদ্ধিবলে পাত্র-চীবর দিয়ে অঙ্গুলিমালের উপসম্পদা
সম্পন্ন হয়।