বুদ্ধ সমকালীন কোশল জনপদের রাজধানী ছিল
শ্রাবস্তী। ঐ কোশল জনপদের রাজা ছিলেন কোশলরাজ প্রসেনজিৎ। তাঁর রাজপুরোহিতের নামি
ছিল ব্রাহ্মণ ভার্গব। চৌর-নক্ষত্রে তাঁদের প্রথম সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়।তাঁর জন্মের সময়
রাজার অস্ত্রাগারে হঠাৎ অলৌকিক কিছু ঘটনা ঘটে, ব্রাহ্মণ ভার্গব ছিলেন শাস্ত্রে
পারদর্শী অশুভ নক্ষত্রে ছেলের জন্ম হওয়াতে তিনি গননা করে জানতে পারলেন তাঁর ছেলে বড়
হলে মানুষ হত্যা করবে। এবং রাজ্যে এক ভয়ানক পরিস্থিতিরর সৃষ্টি করবে। রাজ্যের মঙ্গল
কামনায় ভার্গব ছেলেকে হত্যা করতে চাইলে, কোশলরাজ প্রসেনজিৎতের হস্তক্ষেপে নবজাতক
শিশুর জীবন রক্ষা পায়।এবং কোশলরাজ ভার্গবকে বললেন, অমঙ্গল আসলে কেউ ঠেকাতে পারবে
না, এতে এই নবজাকের কি দোষ। বিপদ যখনি আসবে তখনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাকে উপযুক্ত
বিদ্যা শিক্ষা দিয়ে বড় করা হোক। সম্ভাব্য দোষমুক্তি অবলম্বন করে তারা সন্তানের নাম
করণ করেন " অহিংসক "। এ নামকরণের পেছনে তাদের উদ্দেশ্য ছিল এ শুভ নামের প্রভাবে এ
সন্তান কারো প্রতি হিংসাভাব পোষণ করবে না। আবার তার প্রতিও কেউ হিংসা পোষণ করবে না।
এ উপায়ে নরসংহার ও কোশল জনপদবাসীকে রক্ষা করা যাবে।
দিনে দিনে মাতাপিতা ও পাড়া-প্রতিবেশীদের
স্নেহআদরে বড় হতে থাকে অহিংসক। তার স্বাভাবিক আচরণে চৌর-লগ্নে যে তার জন্ম সে কথা
গণকদের ভবিষ্যবাণীর কথা সবাই ভুলে যেতে থাকে। বন্ধু-বান্ধব সকলের কাছে অতি প্রিয়
হয়ে উঠতে থাকে অহিংসক। বাল্যকাল কাটিয়ে উঠলে তার মাতাপিতা তাদের সন্তানকে
শাস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী করতে তৎকালীন বিখ্যাত আচার্যের নিকট শিক্ষা-দীক্ষাদানের
উদ্দেশ্যে অনান্য বাল্য-বন্ধুদের সাথে তক্ষশীলায় পাঠালেন। অল্প সময়ের মধ্যে অহিংসক
লেখা-পড়ায়, খেলা-ধূলায়, তার বিনম্র চাল-চলনে, আচার-ব্যবহারে শিক্ষকগণের বিশেষত
আচার্য ও গুরুমাতার মনে স্থান নিয়ে নেয়। অনান্য সহপাঠীদের তুলনায় সে অধিক প্রিয়ভাজন
হতে থাকে। আচার্যের ভালবাসায় শ্রাবস্তীর রাজপরিবারস্থ বন্ধু-বান্ধবরা
অপেক্ষাকৃতভাবে অহিংসকের প্রতি ঈর্ষাভাব পোষণ করতে লাগলো। কোন কিছুতেই তাকে পরাজিত
করতে না পেরে নিজেরাই তাদের ঈর্ষানলে জ্বলতে থাকে।
দিন যত যায় অহিংসক বুঝতে পারে তার
বাল্য-বন্ধুরা সেই আগের মত নেই। আগের মত তাকে ভালভাবে খোলামেলা ভাবে গ্রহন করছে না।
এদের এমন আচরণ দেখেও অহিংসক তাদের বিরুদ্ধে কোন প্রকার ঈর্ষাপরায়ণ না হয়ে নিজের
লেখা-পড়ায় আরো অধিকতর মন দেয়। তার পরিপেক্ষিতে অহিংসকের প্রতি তার বন্ধুরা আরো অনেক
বেশি ঈর্ষাপরায়ণ হতে থাকে। ঈর্ষানলের আগুনে থাকতে না পেরে এবার তারা অহিংসকের
বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে শুরু করে। তার চাল-চলনের ব্যাপারে কুৎসা রটানো শুরু করে।
শিক্ষকদের তার বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ করতে থাকে। কিন্তু শিক্ষকরা অহিংসকের
চাল-চলনে অনেক খুশি। তাই তারা এগুলা মাথায় রাখেন না। এত কিছুর করার পরেও যখন কিছু
করতে পারতেছে না তখন তারা নাছোড়-বান্দা হয়ে মাঠে নামে। এবার তারা দুরাচারী হবার
অস্ত্র প্রয়োগ করেন। শেষ চালের অংশ হিসেবে তারা একে একে কয়েকবার গুরুমায়ের সাথে
অহিংসকের অনৈতিক দৈহিক সম্বন্ধের কথা শুনিয়ে শুনিয়ে আচার্যের কান ভারী করতে শুরু
করে। গুরু প্রথমে এগুলা পাত্তা না দিলেও ক্রমশ তা দিনকে দিন বাড়তে থাকে। এদিকে
আচার্য তার স্ত্রীর প্রতি দূর্বল ছিলেন। সবার মুখে এ কথা শুনে আচার্যের
বিচার-বুদ্ধি হারিয়ে ক্ষুদ্ধ হন আর অহিংসকে কিভাবে আশ্রম হতে বিতাড়িত করা যাই তার
ফন্দি করতে থাকেন।
একদিন হঠাৎ আচার্য নির্দেশ প্রদান করলেন
অহিংসক যেন এ আশ্রম থেকে চলে যায়। এ খবর পেয়ে মাতৃস্নেহে গুরুমাতাও অনেক কষ্ট পান।
গুরুর অপ্রত্যাশিত নির্দেশে অহিংসক বড়ই ব্যথিত হয়। এ নির্দেশ প্রত্যাখান করার মানসে
গুরুর কাছে আকুতি মিনতি করতে থাকে অহিংসক। এত কিছুর পরেও আচার্যের পাষাণ হৃদয় গলে
নি। আচার্য ঈর্ষানলে এতটায় বশীভূত ছিলেন যে শুধু আশ্রম থেকে নয়, এমনকি তক্ষশীলা হতে
আজীবন নির্বাসন হয় তার ব্যবস্তা করেন। অহিংসকের পীড়াপীড়িতে শেষ মেষ আচার্য বলেন-
ঠিক আছে এক শর্তে আমি তোমাকে রাখতে পারি। তখন অহিংসক স্ব-আনন্দে আত্মহারা হয়ে বলে
ফেলে- যে শর্তই হোক না কেন আমি তা পূর্ণ করবো। আমায় আপনাদের স্নেহ-আদর হতে বঞ্চিত
করবেন না গুরুদেব।
আচার্য বললেন- তোমাকে এর জন্য গুরু দক্ষিণা
দিতে হবে । অহিংসক বলে- কি রকম দক্ষিণা বলুন, আমি দিতে রাজি আছি। আচার্য- আমাকে এক
হাজার মানুষের ডান হাতের বৃদ্ধা আঙ্গুল এনে দাও।
আচার্যের মুখে এমন বর্বর শর্ত শুনে
হতবাক। এ সব শুনে অহিংসক বলে উঠলেন- গুরুদেব মানুষ হত্যা, এ তো মহা পাপ। আপনি আর
অন্য যে কোন দক্ষিণার কথা বলুন! মনুষ্য হত্যা আমার দ্বারা সম্ভব নয়। আমাকে ক্ষমা
করুন।
অহিংসকের এমন কথা শুনে আচার্য বললেন- হ্যাঁ,
এটা যে পাপ তা আমি মানি, কিন্তু গুরুর আদেশ অমান্য করা এটা কি পাপ নয়? যদি আমাকে
সত্যিকারের গুরু দক্ষিণা দিতে চাও, তাহলে ঐ একহাজার বৃদ্ধাঙ্গুলি আমাকে উপহার দাও।
যদি আমাকে ঐ একহাজার আঙ্গুলি এনে দাও তাহলে বিদ্যা-শিক্ষার বাকিটুকু শিক্ষাদান
করবো। যাও এ মূহুর্তে এখান হতে বের হয়ে আমাকে গুরুদক্ষিণা দাও। অহিংসক আর কোন কথা
না বলে ভরাক্রান্ত হৃদয়ে আশ্রম থেকে বেরিয়ে পড়ে।