ভূমিকা

জীবন মানে কোনো একগুচ্ছ ধারণা নয়, বরং এটি হচ্ছে একটার পর একটা বুনে যাওয়া গল্পের মালা। ধারণাগুলো হচ্ছে সাধারণভাবে গৃহীত কিছু মনোভাব মাত্র, সেগুলো সব সময়ই সত্য থেকে কিছুটা দূরে অবস্থান করে। কিন্তু একটি গল্প, তার বহুমুখী অর্থ ও বর্ণনার ছটা নিয়ে বাস্তব জীবনের অনেক কাছাকাছি থাকে। এ কারণেই আমরা বিমূর্ত তত্ত্বের চেয়ে একটা গল্পকে খুব সহজে বুঝতে পারি। আমরা ভালো গল্প পছন্দ করি।

 

এই বইয়ের গল্পগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে আমার গত ত্রিশ বছর ধরে থেরবাদী বুদ্ধধর্মের বন ধারার ভিক্ষু হিসেবে জীবন কাটানোর সময়ে। বহু শতাব্দী ধরে এই থেরবাদ ছিল থাইল্যান্ড, বার্মা, শ্রীলংকা, কম্বোডিয়া ও লাওসের মানুষদের আধ্যাত্মিকতার প্রধান বাহন। এখন এই ধারার বুদ্ধধর্ম পশ্চিমে বেড়ে উঠছে, আর আমি যেহেতু অস্ট্রেলিয়ায় থাকি, তাই সেখানেও বেড়ে উঠছে!

 

আমাকে প্রায়ই বুদ্ধধর্মের প্রধান শাখাগুলো, যেমন: থেরবাদ, মহাযান, বজ্রযান ও জেন, এসবের মধ্যে পার্থক্য সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হয়। এর উত্তর হচ্ছে, এগুলো সবই একই ধরনের কেক, কিন্তু তাদের প্রত্যেকের আছে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের বহিরাবরণ। বাইরে থেকে সেগুলোকে দেখতে ভিন্ন মনে হতে পারে, তাদের স্বাদও ভিন্ন মনে হতে পারে, কিন্তু আপনি যখন সেই ধারার গভীরে যাবেন, তখন আপনি সেই একটা স্বাদই পাবেন - মুক্তির স্বাদ। শুরুতে সেই একটা বুদ্ধধর্মই ছিল।

 

বুদ্ধ তাঁর শিক্ষা দিয়েছিলেন উত্তর-পূর্ব ভারতে, সেটা প্রায় ২৬০০ বছর আগে - সক্রেটিসের একশ বছর আগে। তিনি কেবল ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদেরকেই শিক্ষা দেন নি, হাজার হাজার সাধারণ জনগণকেও শিক্ষা দিয়েছিলেন – কৃষক থেকে শুরু করে ঝাড়ুদার এমনকি বেশ্যাদেরকেও। বুদ্ধের যে প্রজ্ঞা, তা কোনো অতিমানবীয় সত্ত্ব থেকে অবতীর্ণ হয় নি। এটি জেগে উঠেছিল জীবনের সত্যিকারের স্বভাবের মধ্যেকার গভীরতম অন্তর্দৃষ্টি থেকে। বুদ্ধের শিক্ষাগুলো এসেছিল তার হৃদয় থেকে, গভীর ধ্যান সেই হৃদয়কে খুলে দিয়েছিল। বুদ্ধ তাঁর বিখ্যাত উক্তিতে বলেছিলেন, ‘মন-সম্বলিত এই ছয় ফুট দীর্ঘ দেহ, এর মাঝেই এই জগতের সূচনা ও পরিসমাপ্তি প্রকাশিত হয়ে থাকে।’

 

বুদ্ধের মূল শিক্ষা ছিল চারটি মহান সত্য। এগুলোকে নতুনভাবে সাজালে আমরা পাই :

সুখ

সুখের কারণ

সুখের অনুপস্থিতি

সুখের অনুপস্থিতির কারণ।

এই বইয়ের গল্পগুলো এই দ্বিতীয় মহান সত্য, সুখের কারণকে ঘিরে আবর্তিত হয়েছে।

 

বুদ্ধ প্রায়ই গল্পে গল্পে শিক্ষা দিতেন। আমার প্রয়াত গুরু, উত্তর-পূর্ব থাইল্যান্ডের আজান চাহ্, তিনিও গল্পের মাধ্যমে শিক্ষা দিতেন। আজান চাহ্-র ধর্মদেশনাগুলোর পরে আমার সবচেয়ে বেশি মনে থাকত তার গল্পগুলো, বিশেষ করে যে গল্পগুলো মজার হতো, সেগুলো। আর এই গল্পগুলোতেই থাকত অন্তরের সুখের পথের জন্য সবচেয়ে গভীর নির্দেশনাগুলো। গল্পগুলো ছিল তাঁর শিক্ষাগুলো বহনকারী বার্তাবাহক।

 

এ ছাড়াও বিশ বছরেরও অধিক সময় ধরে আমার অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় বুদ্ধধর্ম ও ধ্যান শিক্ষা দেয়ার গল্পগুলোর মধ্য থেকে কয়েকটি সবচেয়ে ভালো গল্প এই বইয়ে দিয়েছি। এই গল্পগুলো নিজেরাই নিজেদের কথা বলবে, তাই আমি আর অত ব্যাখ্যার ঝামেলায় যাই নি। প্রত্যেকটি গল্পই অনেক প্রকার অর্থ বহন করে, তাই আপনি সেগুলো যত বেশি পড়বেন, তত বেশি সত্য উন্মোচিত হবে।

 

যাঁরা এসব সত্যিকারের সুখের গল্পগুলো বলতে শুনেছেন, তাঁদের মতোই আপনিও এগুলো উপভোগ করবেন এই আশা করি। আরও আশা করি, এগুলো আপনার জীবনকে ভালোর পথে পরিবর্তনে সহায়তা করবে, যেমনটা অন্য অনেক অনেককে করেছে।

আজান ব্রাহ্ম্

পার্থ, অস্ট্রেলিয়া

মে ২০০৪