আমার বয়স তখন তের। আমার বাবা আমাকে একপাশে ডেকে নিয়ে এমন একটা কথা বললেন, যা পরবর্তীকালে আমার জীবনটাকে বদলে দিয়েছিল। আমরা ছিলাম শুধু দুজন, লন্ডনের অন্যতম দরিদ্র একটা এলাকার রাস্তার ধারে, তার বহু ব্যবহারে জীর্ণ হয়ে পড়া গাড়ির মধ্যে। তিনি আমার দিকে ফিরে বললেন, ‘বৎস, তুমি জীবনে যা-ই করো না কেন, এটা জেনে রেখো, আমার ঘরের দরজা তোমার জন্য সব সময় খোলা থাকবে।’
আমি তখন কেবল কিশোর। আমি ঠিক বুঝি নি তিনি কী বুঝাতে চেয়েছেন। তবে আমি জানতাম, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা। তাই আমি তা মনে
রেখেছিলাম। আমার বাবা এর তিন বছর পরে মারা যান।
যখন আমি উত্তরপূর্ব থাইল্যান্ডে এসে ভিক্ষু হলাম। আমি বাবার সেই কথাগুলো ভেবে দেখলাম। তখন আমাদের বাড়ি বলতে ছিল লন্ডনের দরিদ্র এলাকায় একটা ছোট ফ্ল্যাট। সেটা এমন ছিল না যে খোলা পাওয়া যাবে সব সময়। কিন্তু পরে বুঝলাম, বাবা আসলে সেটা বুঝাতে চান নি। আমার বাবার কথার মাঝে লুকানো ছিল আমার জানামতে সবচেয়ে সেরা ভালোবাসার প্রকাশ, যেন কাপড়ে মোড়ানো কোনো অমূল্য রত্নের মতো : ‘বৎস, তুমি জীবনে যা-ই করো না কেন, এটা জেনে রেখো, আমার হৃদয়ের দরজা তোমার জন্য সব সময় খোলা থাকবে।’
আমার বাবা নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দিয়েছিলেন। কোনো পিছুটান নেই সেখানে, নিঃশর্ত নিঃস্বার্থ আমি তার ছেলে, সেটাই যথেষ্ট। এটি ছিল অপূর্ব! এটি ছিল সত্যি। তিনি আসলেই সেটা বুঝিয়েছিলেন।
কোনো ‘যদি’ না রেখে আপনার হৃদয়ের দরজা কারো জন্য খুলে দেওয়া, এমন কথা বলতে সাহস লাগে, জ্ঞান লাগে। আমরা হয়তো ভাবতে পারি, তারা আমাদের দুর্বলতার সুযোগ নেবে। কিন্তু ব্যাপারটা তেমন নয়, অন্তত আমার অভিজ্ঞতা সেটা বলে না। যখন আপনি অন্যের কাছ থেকে এমন ভালোবাসা পান, সেটা হয় অমূল্য একটা রত্ন উপহার পাওয়ার মতো। আপনি এটাকে সযত্নে আগলে রাখেন, হৃদয়ের কাছাকাছি রেখে দেন, যেন না হারায়। যদিও
সেই সময়ে আমি বাবার কথার অর্থ আংশিক মাত্র বুঝেছিলাম, তবুও আমি এমন লোককে মনে আঘাত দেওয়ার সাহস করি নি। যদি আপনি আপনার কোনো কনিষ্ঠ জনকে এমন কথা দেন, যদি আপনি সত্যিই সেরকম ভাবেন, যদি সেই কথাগুলো আসে আপনার হৃদয় থেকে, তাহলে সেই ব্যক্তি আপনার ভালোবাসা নিয়ে উপরেই উঠবে, নিচে নামবে না।
কয়েক শতাব্দী আগে এশিয়ার কোনো এক জঙ্গলের গুহার মধ্যে সাতজন ভিক্ষু বাস করত। তারা আগের গল্পে উল্লেখিত নিঃস্বার্থ ভালোবাসার ধ্যান করত।
সেখানে ছিল প্রধান ভিক্ষু, তার ভাই ও তার সেরা বন্ধু। চতুর্থজন ছিল প্রধান ভিক্ষুর শত্রু, আর তাদের দুজনের মধ্যে কিছুতেই ভালো সম্পর্ক থাকত না। পঞ্চম ভিক্ষুটি একজন খুব বুড়ো ভিক্ষু, যে এমন বুড়ো হয়ে গিয়েছিল যে এখন মরে তো তখন মরে এমন অবস্থা। ষষ্ঠ ভিক্ষুটি ছিল অসুস্থ এমন অসুস্থ যে তারও প্রাণ যায় যায় অবস্থা। সপ্তম ভিক্ষুটি ছিল সবচেয়ে অকেজো ভিক্ষু। যখন ধ্যান করার কথা, তখন সে নাক ডেকে ঘুমাত। সে তার বন্দনার লাইনগুলো মনে রাখতে পারত না, আর পারলেও বন্দনা করত বেতালে, বেসুরে। সে এমনকি চীবরও পরতে পারত না ঠিকমতো। কিন্তু অন্যরা তাকে সহ্য করত এবং ধৈর্যের শিক্ষা দেওয়ার জন্য তাকে ধন্যবাদ দিত।
একদিন এক ডাকাতদল গুহাটাকে খুঁজে পেল। জায়গাটা প্রত্যন্ত অঞ্চলে, লোকচক্ষুর অন্তরালে। তাই তারা এটাকে তাদের ঘাঁটি বানাতে চাইল। তারা সমস্ত ভিক্ষুদের মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নিল। সৌভাগ্যক্রমে প্রধান ভিক্ষু একজ প্রভাবশালী বক্তা ছিল। সে এমনভাবে ব্যবস্থা করল - কীভাবে ব্যবস্থা করল তা
আমাকে জিজ্ঞেস করবেন না - যে ডাকাতেরা সব ভিক্ষুকে যেতে দিল, কেবল একজন বাদে, যাকে মেরে ফেলা হবে। তাকে মেরে ফেলা হবে একটা হুঁশিয়ারি হিসেবে, যাতে অন্যরা কাউকে গুহার অবস্থান বলে না দেয়। প্রধান ভিক্ষুটির এর বেশি করার জো ছিল না।
প্রধান ভিক্ষুকে কয়েক মিনিট একা থাকতে দেওয়া হলো, যাতে সে সিদ্ধান্ত নিতে পারে কাকে বলি দেবে সে, যাতে অন্যরা মুক্তি পায়।
যখন আমি শ্রোতাদের এই গল্পটা বলি, এই পর্যায়ে এসে আমি তাদের জিজ্ঞেস করি, ‘তো, কী মনে হয় আপনাদের? প্রধান ভিক্ষু কাকে বেছে নিয়েছিল?’
এমন প্রশ্ন শুনে যাদের চোখ ঘুমে ঢুলু ঢুলু হয়ে আসছিল, তারা একটু নড়েচড়ে বসে, আর যারা ঘুমিয়ে গিয়েছিল তারা ঘুম থেকে জেগে ওঠে। আমি তাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিই যে সেখানে আছে সাতজন ভিক্ষু। প্রধান ভিক্ষু, তার ভাই, তার শ্রেষ্ঠ বন্ধু, তার শত্রু, এক বুড়ো ভিক্ষু, এক অসুস্থ ভিক্ষু (দুজনেরই মরি মরি অবস্থা), আর একজন অকেজো হাবাগোবা ভিক্ষু। কাকে সে বেছে নিয়েছিল বলে আপনার মনে হয়?
কেউ কেউ তার শত্রুকে বলে। আমি বলি, ‘না।’ ‘তার ভাই?’
‘ভুল।’
সব সময়ই দেখি, সেই অকেজো ভিক্ষুটির নাম উঠে আসে খরচের তালিকায়। কেমন লোক আমরা! খানিক মজা করার পরে আমি উত্তরটা বলে দিই, প্রধান ভিক্ষু কাউকেই বেছে নিতে পারে নি।
সে তার ভাইকে যেমন ভালোবাসত, ঠিক তেমনই ভালোবাসত তার বন্ধুকে, বেশিও নয়, কমও নয়। ঠিক এমনই ভালোবাসা ছিল তার শত্রুর প্রতি, বুড়ো ভিক্ষুটির প্রতি, অসুস্থ ভিক্ষুটির প্রতি, এমনকি অকেজো ভিক্ষুটির প্রতিও। সে সেই ভালোবাসার কথাগুলো পরিপূর্ণভাবে চর্চা করেছে : ‘আমার হৃদয়ের দরজা তোমার জন্য সব সময় খোলা থাকবে, তুমি যা-ই করো না কেন, যে-ই হও না কেন।’
প্রধান ভিক্ষুটির হৃদয়ের দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত ছিল। নিঃশর্ত নিঃস্বার্থ বৈষম্যহীন, মুক্ত ও উদার ভালোবাসা। আর সবচেয়ে বড় কথা, অন্যদের প্রতি তার যেমন ভালোবাসা, ঠিক তেমন ভালোবাসা ছিল তার নিজের প্রতিও। তার হৃদয়ের দরজা তার নিজের জন্যও খোলা ছিল। এ কারণেই সে বলির জন্য অন্যদের তো বেছে নিতে পারে নি, নিজেকেও বেছে নিতে পারে নি।
আমি আমার শ্রোতাদের মধ্যে থাকা ইহুদি আর খ্রিস্টানদের স্মরণ করিয়ে দিই যে, তাদের ধর্মীয় গ্রন্থ এই কথা বলে : ‘প্রতিবেশীকে নিজের মতোই ভালোবাসো।’ নিজের চেয়ে কমও নয়, বেশিও নয়, ঠিক নিজের সমান করে। এর মানে হচ্ছে, নিজেকে আপনি যেমন ভাবেন, অন্যকেও তেমন ভাবা, আর নিজেকেও অন্যদের মতো ভাবা।
কেন এমন হয় যে, শ্রোতাদের বেশির ভাগই মনে করে যে প্রধান ভিক্ষুটি নিজেকেই বেছে নেবে বলির জন্য? আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিটা এমন কেন, যেখানে আমরা সব সময় নিজেকে বলি দিচ্ছি, আর এটাকেই ভালো চোখে দেখা হচ্ছে?
কেন আমরা নিজেদের প্রতি সবচেয়ে সমালোচনামুখর হয়ে উঠি, আর অন্যদের বাদ দিয়ে নিজেদেরই শাস্তি দিই? এর একটাই কারণ, আমরা এখনো শিখিনি কীভাবে নিজেদের ভালোবাসতে হয়।
যদি অন্যকে এ কথা বলা আপনার পক্ষে কঠিন হয় : ‘তুমি যা-ই করো না কেন, আমার হৃদয়ের দরজা তোমার জন্য সব সময় খোলা’। তাহলে এর থেকে শতগুণে কঠিন হবে নিজেকে এরূপ বলা : ‘আমি। যতদূর মনে পড়ে যে একজনের সাথে আমি সবচেয়ে কাছাকাছি রয়েছি, সে হচ্ছে আমি নিজেই। আমার হৃদয়ের দরজা আমার জন্যও সব সময় খোলা। আমি যা-ই করি না কেন, সেটা আমার জন্য ব্যাপার নয়। এসো, ভেতরে এসো।’
নিজেদের ভালোবাসা বলতে আমি এটাকেই বুঝাই। এটাকে বলা হয় ক্ষমা। এটা হচ্ছে অপরাধবোধের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে আসা। এটা হচ্ছে নিজেকে নিয়ে শান্তিতে সহাবস্থান করা। আর আপনি যদি নিজেকে এই কথাগুলো বলার মতো সাহস আনেন, নিজের অন্তরের অন্তস্থলে সেই কথাগুলো গভীরভাবে বিশ্বাস করেন, তাহলে আপনি সেই অন্তর্নিহিত ভালোবাসা নিয়ে উপরেই উঠবেন, তলিয়ে যাবেন না।
আমাদের সবারই একদিন নয় একদিন নিজেদের প্রতি এই কথাগুলো বলতে হবে। মজা করার জন্য নয়, খেলার জন্য নয়, সত্যি সত্যিই, আন্তরিকভাবে, সততার সাথে বলতে হবে।
যখন আমরা এটা করি, যেন আমাদের একটা অংশ, যাকে বের করে দেওয়া হয়েছে, যে বাইরের ঠান্ডায় এত দিন ধরে পড়ে ছিল, সে যেন এখন বাড়ি ফিরেছে। আমরা এখন অনুভব করি একত্ব সম্পূর্ণতা। সুখী হওয়ার জন্য এখন আর আমাদের কোনো পিছুটান নেই। যখন আমরা নিজেদের এভাবে ভালোবাসব, তখনই আমরা জানতে পারব, অন্যকে ভালোবাসা বলতে সত্যিকার অর্থে কী বুঝায়, যা বেশিও নয়, কমও নয়।
আর দয়া করে মনে রাখুন যে, নিজেকে এমন ভালোবাসা দিতে গিয়ে আপনাকে অত নিখুঁত হতে হবে না, অত নির্দোষও হতে হবে না। যদি আপনি পরিপূর্ণতার জন্য অপেক্ষা করেন, নিখুঁত হওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন, তা কখনো আসবে না। আমরা যা করেছি, করেছি; তা নিয়েই আমাদের হৃদয়ের
দরজা খুলে দিতে হবে নিজেদের জন্য। যখন আমরা ভেতরে প্রবেশ করব, তখনই আমরা পরিপূর্ণ।
লোকজন প্রায়ই জিজ্ঞেস করে, যখন প্রধান ভিক্ষু ডাকাতদলকে বলল যে সে কাউকে বেছে নিতে অক্ষম, তখন সেই সাতজন ভিক্ষুর কপালে কী ঘটেছিল?
এই গল্পটা আমি অনেক বছর আগে শুনেছিলাম। সেখানে তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা বলা হয় নি। আমি যতদূর বলেছি, সেখানেই গল্পটির সমাপ্তি। কিন্তু আমি জানি এর পরে কী হয়েছিল। সেটা আমি ভেবে ভেবে বের করে নিয়েছি। যখন প্রধান ভিক্ষুটি ডাকাতদলকে ব্যাখ্যা করে বলল যে সে কেন নিজেকে অথবা অন্যদের কাউকে বলি দেওয়ার জন্য বেছে নিতে পারে নি, আর তাদের ভালোবাসা ও ক্ষমার অর্থ বুঝিয়ে দিয়েছে, যেমনটি আমি আপনাদের বুঝিয়ে দিলাম, তখন ডাকাতেরা সবাই এমন মুগ্ধ ও উৎসাহিত হলো যে তারা কেবল ভিক্ষুদেরই যেতে দিল না, নিজেরাও ভিক্ষু হয়ে গেল!
ব্রহ্মচারী ভিক্ষু হওয়ার পর থেকে আমি অনেক মেয়ের বিয়ে দিয়েছি।
বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে আমার কাজের একটা অংশ হলো বৌদ্ধ বিবাহ অনুষ্ঠানের ধর্মীয় অংশটা সম্পন্ন করা। আমার বৌদ্ধ ঐতিহ্য অনুসারে, বিয়ের আনুষ্ঠানিক কাজ পরিচালনাকারী হলেন একজন গৃহী বৌদ্ধ। কিন্তু দম্পতিদের অনেকেই মনে করে, আমিই তাদের বিয়ে দিয়েছি। কাজেই, আমি অনেক
মেয়েকে বিয়ে দিয়েছি, অনেক ছেলেকেও বিয়ে দিয়েছি।
বলা হয়ে থাকে, বিয়েতে তিনটা আংটি থাকে- অ্যানগেজমেন্ট আংটি, বিয়ের আংটি এবং দুঃখের আংটিও!
তাই ঝামেলা আসাটা প্রত্যাশিত। আর যখন ঝামেলা হয়, তখন আমি যাদের বিয়ে দিয়েছি, তারা প্রায়ই আমার সাথে কথা বলতে আসে। ভিক্ষু হওয়াতে আমি সাদাসিধে জীবন পছন্দ করি। তাই আমি আমার বিবাহ-পরবর্তী সেবা হিসেবে নিচের তিনটা গল্প বলি, যতদূর পারা যায় আমরা তিনজন যাতে ঝামেলামুক্ত থাকতে পারি আর কি!
সম্পর্ক ও বিয়ের ক্ষেত্রে আমার দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, যখন তারা দুজন বাইরে একসাথে ঘুরতে যাচ্ছে, তখন তারা সামান্য জড়িয়ে গেছে মাত্র। যখন তারা অ্যানগেজ্ড, তখনো তারা কেবল জড়িয়ে গেছে, হয়তো আরও একটু গভীরভাবে। কিন্তু যখন তারা বিয়ের শপথবাক্য পাঠ করে সবার সামনে, তখন
সেটা অঙ্গীকার হয়ে দাঁড়ায়।
বিয়ের অনুষ্ঠান মানেই হচ্ছে অঙ্গীকার। লোকেরা যাতে এর অর্থ সারা জীবনের জন্য মনে রাখে, এজন্য আমি অনুষ্ঠানের সময় এর অর্থ বুঝিয়ে দিই। আমি তাদের ব্যাখ্যা করে বলি যে, জড়িত হওয়া আর অঙ্গীকারবদ্ধ হওয়া দুটো ভিন্ন জিনিস, অনেকটা শুয়োরের মাংস ও ডিমের মতো।
এই পর্যায়ে এসে বর-কনের আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুবান্ধবেরা একটু কান খাড়া করে। তারা অবাক হয়ে ভাবতে থাকে, ‘বিয়ের সাথে শুয়োরের মাংস ও ডিমের সম্পর্ক কী?’
আমি বলতে থাকি, ‘শুয়োরের মাংস ও ডিম, এই দুটো জিনিসে মুরগী জড়িত থাকে; কিন্তু শুয়োর থাকে অঙ্গীকারবদ্ধ। এই বিয়েটা তাই শুয়োরের বিয়ে
হোক!’
এটা উত্তরপূর্ব থাইল্যান্ডে আমার শিক্ষক আজান চাহ্-র একটা প্রিয় গল্প। এক নববিবাহিত দম্পতি কোনো এক সুন্দর গ্রীষ্মের সন্ধ্যায় রাতের খাবার খেয়ে জঙ্গলের মধ্যে হাঁটতে গেল। তারা দুজনে খুব আনন্দঘন সময় কাটাচ্ছিল যতক্ষণ না তারা দূর থেকে একটা শব্দ শুনল : ‘কোয়াক! কোয়াক!’
স্ত্রী বলল, ‘শোন তো, এটি নিশ্চয়ই একটা মুরগি হবে।’ ‘না, না। এটা একটা হাঁস’ স্বামী বলল।
‘না, আমি নিশ্চিত ওটা একটা মুরগি।’
‘অসম্ভব। মুরগিরা ডাকে কুক্ কুরু কু! হাঁসেরা ডাকে কোয়াক্ কোয়াক! ওটা একটা হাঁস, প্রিয়তমা।’ স্বামী এই প্রথম একটু বিরক্তি নিয়ে বলল।
‘কোয়াক! কোয়াক!’ আবার শব্দ হলো। ‘শুনেছ! এটা একটা হাঁস।’ স্বামীটি বলল।
‘না, প্রিয়। ওটা একটা মুরগি, আমি নিশ্চিত।’ স্ত্রীটি দৃঢ় স্বরে পা দাপিয়ে ঘোষণা করল।
‘শোন স্ত্রী! ওটা ... একটা ... হাঁস। ‘হ’ আকার চন্দ্রবিন্দু ‘স’। হাঁস! বুঝেছ?’ স্বামী রেগে গিয়ে বলল।
‘কিন্তু ওটা তো একটা মুরগি’ স্ত্রী আপত্তি জানাল।
‘ওটা একটা হাঁসের ছানা, তুমি, তুমি...’ স্বামীটি এমন কিছু বলে বসল যা তার বলা উচিত ছিল না।
এটি আবার ডেকে উঠল, ‘কোয়াক! কোয়াক!’
স্ত্রীটি এবার প্রায় কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, ‘কিন্তু এটা যে একটা মুরগি!’
স্বামীটি দেখল তার স্ত্রীর চোখ অশ্রুতে টলমল করছে। অবশেষে তার মনে পড়ল কেন সে তাকে বিয়ে করেছে। তার চেহারা কোমল হয়ে এলো আর সে নরম সুরে বলল, ‘দুঃখিত প্রিয়তমা। আমার মনে হয় তোমার কথাই ঠিক। ওটা একটা মুরগি।’
‘ধন্যবাদ, প্রিয়তম’ স্ত্রীটি স্বামীর হাত ধরে বলল।
বনের মধ্য থেকে ‘কোয়াক! কোয়াক!’ শব্দ ভেসে এলো আবার। তারা আবার তাদের ভালোবাসাময় যাত্রা শুরু করল।
গল্পটার শিক্ষা হলো, যা স্বামী অবশেষে বুঝেছিল যে, মুরগি হোক বা হাঁস হোক, তাতে কী আসে যায়? এর থেকে ঢের বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো তাদের মধ্যেকার সম্পর্কের ঐকতান, যেটি তারা উপভোগ করেছিল এমন এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যায়। এমন গুরুত্বহীন ব্যাপার নিয়ে কত বিয়ে ভেঙে যায়? কত বিবাহবিচ্ছেদের কারণ হয় এমন হাঁস না মুরগি বিষয়?
যখন আমরা এই গল্পটি বুঝি, আমরা আমাদের গুরুত্তপূর্ণ বিষয়গুলো বিবেচনা করি। হাঁস না মুরগি এ বিষয়ে সঠিক হওয়া থেকেও ঢের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো বিয়েটা। আচ্ছা, বলুন তো, কতবার আমরা নিশ্চিতভাবে, পরম আত্মবিশ্বাসের সাথে জানতাম যে আমরাই সঠিক, অথচ পরে জেনেছি যে আমাদের ধারণা ছিল ভুল? কে জানে, সেটি হয়তো জিন পরিবর্তিত হয়ে যাওয়া কোনো মুরগিও হতে পারে, যা হাঁসের মতো করে ডাকে!
(লিঙ্গসমতা এবং শাম্পিত্মূর্ণ ভিক্ষুজীবনের জন্য, প্রতিবার গল্পটি বলতে গিয়ে আমি সাধারণত মুরগি ও হাঁসের দাবিকারী বক্তাদের পরস্পর পাল্টে দিই।)
কয়েক বছর আগে সিঙ্গাপুরে একটা বিয়ের অনুষ্ঠানের পরে কনের বাবা নতুন জামাইকে একপাশে ডেকে নিল - বিয়েকে দীর্ঘস্থায়ী ও সুখময় করা যায় কীভাবে - সে-বিষয়ে কিছু উপদেশ দেওয়ার জন্য। সে যুবকটিকে বলল, ‘তুমি সম্ভবত আমার মেয়েকে অনেক ভালোবাসো।’
‘ও হ্যাঁ, তা তো বটেই!’ যুবকটি গভীর আবেগে বলে উঠল।
‘আর তুমি সম্ভবত মনে করো যে সে এই পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার এক মেয়ে।’ বুড়ো বলে চলল।
‘সে সবদিক দিয়েই পরিপূর্ণ ’ যুবকটি মুগ্ধ স্বরে বলল।
বুড়ো বলল, ‘যখন তুমি বিয়ে করো, তখন এমনই লাগে। কিন্তু কয়েক বছর পরে তুমি আমার কন্যার দোষ-ত্রুটিগুলো দেখতে শুরু করবে। আমি চাই, যখন
তুমি তার দোষ-ত্রুটিগুলো দেখতে শুরু করবে, তখন যেন এই কথাগুলো স্মরণ কর। গোড়া থেকে যদি তার ওই দোষগুলো না থাকত, তাহলে হে জামাইবাবু,
তোমার চেয়েও ঢের ভালো অন্য একজনকে সে বিয়ে করতে পারত।’
তাই আমাদের সঙ্গী বা সঙ্গিনীর দোষ-ত্রুটির জন্য আমাদের কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কারণ, শুরু থেকেই যদি তাদের মধ্যে সেই দোষ-ত্রুটিগুলো না থাকত, তারা আমাদের থেকেও অনেকগুণ ভালো এমন কাউকে বিয়ে করতে পারত।
যখন আমরা প্রেমে পড়ি, তখন আমরা আমাদের সঙ্গী বা সঙ্গিনীর দেয়ালে কেবল ভালো ইটগুলো দেখি। আমরা কেবল সেগুলোই দেখতে চাই, আর তাই
সেগুলোই কেবল দেখে থাকি। আরা অন্যগুলোকে অস্বীকার করি। পরে যখন উকিলের কাছে যাই বিবাহবিচ্ছেদের মামলা নিয়ে, তখন আমরা আমাদের সঙ্গী বা সঙ্গিনীর দেয়ালে কেবল খারাপ ইটগুলো দেখি। আমরা তার ভালো গুণগুলোর প্রতি অন্ধ হয়ে যাই। আমরা ওগুলো দেখতে চাই না, তাই সেগুলো আর দেখি না। আমরা আবার অন্যগুলোকে অস্বীকার করি।
কেন এমন হয় যে প্রেম ঘটে নাইট ক্লাবের আলো আধারে, অথবা কোনো মোমবাতির আলোয় সারা কোনো সান্ধ্যভোজে অথবা কোনো পূর্ণিমা রাতে? কারণ, এসব অবস্থায় আপনি তার তিলগুলো দেখেন না। তার নকল দাঁতগুলো দেখেন না। আমরা তখন মোমবাতির আলোয় আমাদের কল্পনার রঙে
স্বাধীনভাবে কল্পনা করে নিতে পারি যে অপর পাশে বসা মেয়েটি একটি সুপার মডেল, অথবা ছেলেটি দেখতে সিনেমার নায়কের মতো। আমরা কল্পনা করতে পছন্দ করি, আর আমরা কল্পনা করি প্রেম-ভালোবাসায় ভরা জীবন। অন্ততপক্ষে আমাদের জানা উচিত, আমরা কী করছি।
ভিক্ষুরা এমন মোমবাতির আলোর প্রেমের মধ্যে নেই। তারা আলো ফেলে চলে বাস্তবতার উপরে। যদি আপনি স্বপ্ন চান, কল্পনা চান, তাহলে বৌদ্ধ বিহারের ত্রিসীমানায় ঘেঁষবেন না। উত্তরপূর্ব থাইল্যান্ডে আমার ভিক্ষু হওয়ার প্রথম বছরে, একবার আমি গাড়িতে করে যাচ্ছিলাম। আমি বসেছিলাম গাড়ির
পিছনের সিটে, আরও দুজন পশ্চিমা ভিক্ষুর সাথে। আজান চাহ্ –আমার গুরু - তিনি বসেছিলেন সামনের সিটে। তিনি হঠাৎ পিছনে ফিরে আমার পাশে বসা নতুন ভিক্ষুটির দিকে তাকালেন, আর থাই ভাষায় কিছু একটা বললেন। তৃতীয় পশ্চিমা ভিক্ষুটা থাই ভাষায় পারদর্শী ছিল। সে আমাদের তা অনুবাদ করে দিল, ‘আজান চাহ্ বলেছেন যে তুমি লস এঞ্জেলসে ফেলে আসা তোমার প্রেমিকার কথা ভাবছ।’
বিস্ময়ে সেই আমেরিকান ভিক্ষুটির চোয়াল ঝুলে পড়ল। আজান চাহ্ তার চিন্তাগুলো পড়তে পেরেছেন নিখুঁতভাবে। আজান চাহ্ হাসলেন। তার পরের কথাগুলো অনুবাদিত হলো এভাবে : ‘চিন্তা করো না। আমরা সেটার একটা ব্যবস্থা করতে পারি। পরের বারে চিঠি লিখলে তাকে বলো সে যেন তোমাকে তার খুব ব্যক্তিগত, তার সাথে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত এমন একটা কিছু পাঠায়। যখনই তুমি তাকে মিস করবে, সেটা বের করে তার কথা মনে করতে পারবে।’
‘সেরকম কোনো কিছু কি কোনো ভিক্ষু রাখতে পারে?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল ভিক্ষুটি।
‘অবশ্যই।’ জবাব দিলেন আজান চাহ।
বোধহয় ভিক্ষুরাও প্রেম ভালোবাসা বোঝে।
আজান চাহ্ এর পরে যা বললেন তা অনুবাদ করতে অনেক সময় লেগে গেল। কারণ, আমাদের অনুবাদককে জোর করে হাসি থামিয়ে নিজেকে আগে সংযত করে নিতে হয়েছিল।
‘আজান চাহ্ বলেছেন,...’ সে হাসির চোটে বেরিয়ে আসা চোখের পানি মুছে শব্দগুলো বের করার চেষ্টা চালাল, ‘আজান চাহ্ বলেছেন, তুমি তোমার
প্রেমিকাকে বলো, সে যেন তার এক বোতল গু পাঠায়। এরপর যখনই তুমি তাকে মিস করবে, সেই বোতলটা বের করে খুলে দেখবে!’
সত্যিই তো, গু হচ্ছে খুব ব্যক্তিগত একটা জিনিস। যখন আমরা আমাদের সঙ্গী বা সঙ্গিনীর কাছে আমাদের ভালোবাসাকে প্রকাশ করি, তখন কি আমরা বলি না যে আমরা তার সবকিছুকেই ভালোবাসি? একই উপদেশ দেওয়া যায় কোনো ভিক্ষুণীর ক্ষেত্রে, যে তার প্রেমিককে মিস করছে।
যেমনটি বলেছিলাম, যদি আপনি প্রেম ভালোবাসা নিয়ে কল্পনার জাল বুনতে চান, আমাদের বৌদ্ধ বিহার থেকে পরিষ্কার দূরে থাকুন।
প্রেমের ঝামেলাটা হচ্ছে যখন কল্পনার জাল ছিঁড়ে যায়, তখন হতাশা ও অসন্তোষ আমাদের ভীষণ দুঃখ দিতে পারে। প্রেমের যে ভালোবাসা, তাতে আমরা আসলে আমাদের সঙ্গীকে ভালোবাসি না। আমরা কেবল ভালোবাসি, তারা আমাদের যে অনুভূতি জাগিয়ে দেয় সেটাকে। তারা কাছে থাকলে যে এক আবেশ বা ভালোলাগার অনুভূতি হয়, সেটাকেই আমরা ভালোবাসি। এজন্যই যখন তারা কাছে থাকে না, আমরা তাদের মিস করি আর এক বোতল ... পাঠাতে বলি (আগের গল্পটি দেখুন)। যে কোনো আবেশ বা ঘোরের মতোই এমন ভালোলাগার অনুভূতি কিছু সময় পরে কেটে যায়।
সত্যিকারের ভালোবাসা হচ্ছে নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। আমরা তখন অপর লোকটার ভালোমন্দ নিয়ে ভাবি। আমরা তাদের বলি, ‘আমার হৃদয়ের দরজা
তোমার জন্য সব সময় খোলা থাকবে, তুমি যা-ই করো না কেন।’ আর আমরা সেটা মন থেকেই বলি। আমরা শুধু চাই তারা সুখী হোক। এমন সত্যিকারের ভালোবাসা দুর্লভ।
আমাদের মধ্যে অনেকেই ভাবতে পছন্দ করে, আমাদের যে বিশেষ সম্পর্ক তা হচ্ছে সত্যিকারের ভালোবাসা, কোনো প্রেমের ভালোবাসা নয়। এখানে একটা পরীক্ষা দেওয়া হলো আপনার জন্য, যা থেকে আপনি বুঝতে পারবেন, কোন ধরনের ভালোবাসা এটা।
আপনার সঙ্গীর কথা ভাবুন। আপনার মনে তার একটি ছবি কল্পনা করুন। সেই দিনের কথা মনে করে দেখুন, যেদিন আপনাদের প্রথম দেখা হয়েছিল, আর এরপর থেকে কী চমৎকার সময়ই না কাটিয়েছেন আপনারা।
এখন কল্পনা করুন, আপনার সঙ্গীর কাছ থেকে একটা চিঠি এসেছে আপনার কাছে। চিঠিতে লেখা আছে, সে আপনার শ্রেষ্ঠ বন্ধুর সাথে গভীর প্রেমে জড়িয়ে পড়েছে, আর তারা দুজন পালিয়ে গেছে। আপনার অনুভূতিটা কেমন হবে?
যদি এটা সত্যিকারের ভালোবাসা হয়, তাহলে আপনি খুব রোমাঞ্চিত হবেন যে আপনার সঙ্গী আপনার থেকেও ভালো একজনকে খুঁজে পেয়েছে আর সে এখন আরও সুখী। আপনি আনন্দিত হবেন যে আপনার সঙ্গী ও আপনার সেরা বন্ধু দুজনে খুব ভালো সময় কাটাচ্ছে। আপনি খুশিতে উল্লসিত হয়ে উঠবেন যে তারা প্রেমে পড়েছে। সত্যিকারের ভালোবাসায় আপনার সঙ্গীর সুখই কি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নয়?
এমন সত্যিকারের ভালোবাসা দুর্লভ।
এক রাণী তার প্রাসাদের জানালা দিয়ে বুদ্ধকে পিন্ডচারণ করতে দেখছিল। রাজা তা দেখতে পেলেন। এই মহান সন্ন্যাসীর প্রতি রাণীর যে ভক্তি, তা রাজার অন্তরে ঈর্ষা জাগিয়ে তুলল। তিনি তার রাণীকে ডেকে জানতে চাইলেন, কাকে সে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে, বুদ্ধকে না স্বামীকে? রাণী ছিল বুদ্ধের পরম ভক্ত। কিন্তু সেই আমলে আপনার স্বামী যদি হয় রাজা, তাহলে খুব সতর্ক হতে হবে। তখন বুদ্ধি হারানো মানে মাথাটা হারানো। সে তার মাথাকে বাঁচিয়েছিল নিখাঁদ সত্যের জবাব দিয়ে, ‘আমি তোমাদের দুজনের চেয়েও বেশি ভালোবাসি নিজেকে।’