নিচের ঘটনাটি থাইল্যান্ডের একটি সত্যি ঘটনা। এতে বিস্ময়কর আজান চাহ-র অলৌকিক প্রজ্ঞা পরিষ্ফুটিত হয়েছে।
কাছের গ্রামের হেডম্যান তার এক সহকারী নিয়ে দ্রুত পায়ে আজান চাহ-র কুটিরে আসল। গত সন্ধ্যায় নাকি গ্রামের এক মহিলার উপরে খুব মারাত্মক ও শয়তানী এক ভূত এসে ভর করেছে। তারা কোনো উপায় না দেখে মহিলাকে এই মহান ভিক্ষুর কাছে নিয়ে আসছে। কথা বলতে বলতেই দূর থেকে মহিলাটির চিৎকার শোনা গেল।
আজান চাহ্ তৎক্ষণাৎ দুজন শ্রামণকে আগুন জ্বেলে পানি গরম করার নির্দেশ দিলেন। অন্য দুজন শ্রামণকে তার কুটিরের কাছেই একটা বড় গর্ত খুঁড়তে বললেন। কোনো শ্রামণই জানল না এর কারণ।
চারজন গ্রাম্য লোক, উত্তরপূর্বাঞ্চলের শক্তসমর্থ কৃষক, তারা চারজন সে স্ত্রীলোকটিকে ধরে রাখতে হিমশিম খাচ্ছিল। যতই তারা তাকে এই পৃথিবীর পবিত্রতম বিহারগুলোর একটিতে তাকে টেনে নিয়ে আসছিল, ততই সে অশস্নীলভাবে চিৎকার করে গালিগালাজ করছিল।
আজান চাহ্ তাকে দেখেই শ্রামণদের বজ্রকন্ঠে আদেশ দিলেন, ‘তাড়াতাড়ি গর্ত খোঁড়, পানি গরম কর তাড়াতাড়ি ! আমাদের বড় একটা গর্ত আর অনেক ফুটন্ত গরম পানি লাগবে।’
ভিক্ষুরা ও গ্রামবাসীরা কেউই বুঝতে পারল না আজান চাহ্ কী করতে যাচ্ছেন। আজান চাহ-র কুটিরের নিচে আনার পরে মহিলার মুখ দিয়ে ফেনা
বেরোতে শুরু করল। তার বিশাল রক্তচক্ষু যেন উন্মত্ততার ঘোরে বিস্ফারিত। আর তার মুখের অভিব্যক্তিতে চরম পাগলামির চিহ্ন দেখা দিল যখন সে আজান চাহ্-কে অশস্নীল ও নিষ্ঠুরভাবে গালাগালি আরম্ভ করল। এমন উন্মত্ত, মুখ দিয়ে ফেনা বেরোনো মহিলাকে সামাল দিতে আরও লোক এসে যোগ দিল।
‘গর্তটা এখনো খোঁড়া হয় নি? জলদি। পানি গরম করা হয়েছে? তাড়াতাড়ি!’ আজান চাহ-র গলা মহিলার চিৎকার ছাপিয়ে সবার কানে ঢুকল, ‘তাকে গর্তে ছুঁড়ে দিতে হবে। সেখানে তার উপর গরম পানি ফেলে দিতে হবে। এর পরে তাকে মাটিচাপা দিয়ে কবর দিতে হবে। এই খারাপ ভুতের হাত থেকে বাঁচার এটাই একমাত্র উপায়। আরও জলদি খোঁড়, আরও ফুটন্ত পানি আনো!’
অভিজ্ঞতা থেকে আমরা শিখেছি যে কেউই নিশ্চিত বলতে পারে না, আজান চাহ্ কখন কী করে বসেন। তিনি ছিলেন অনিশ্চয়তার ভিক্ষুরূপ। গ্রামবাসীরা নিশ্চিত ভেবেছিল যে তিনি এই ভুতে পাওয়া মহিলাকে গর্তে ঠেলে দিয়ে সারা গায়ে গরম পানি ঢেলে দেবেন এবং মাটিতে পুঁতে ফেলবেন। তারা তাকে সেটা করতে দিতও। মহিলাটিও নিশ্চিতই এমন ভেবেছিল। কারণ, সে আস্তে আস্তে শান্ত হতে শুরু করল। গর্ত খোঁড়া এবং পানি গরম করা সম্পূর্ণ না হতেই সে শান্তভাবে আজান চাহ্-র সামনে বসেছিল, আর বাড়িতে নিয়ে যাওয়ার আগে খুব সুন্দরভাবে আশীর্বাদ নিল। কী দারুণ!
আজান চাহ্ জানতেন যে, ভূতে পাওয়া হোক বা পাগল হোক, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে এমন শক্তিশালী কিছু একটা আছে, যাকে বলা হয় আত্মরক্ষার শক্তি। দক্ষতার সাথে এবং খুব নাটকীয়তার সাথে মহিলাটির মধ্যকার সেই আত্মরক্ষার শক্তির সুইচ টিপে দিয়েছিলেন তিনি, আর ব্যথা ও মৃত্যুর ভয় দিয়ে
সেই ভূতকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। প্রজ্ঞা এমনই হয়, যা অন্তর্যামী, পরিকল্পনাবিহীন, পুনর্বার তাকে অনুকরণ করা মুশকিল!
আমার কলেজজীবনের বন্ধুর ছোট্ট এক কন্যা আছে, সেটি তার প্রাইমারি স্কুলের প্রথম বছর। তার শিক্ষক পাঁচ বছর বয়সী বাচ্চাদের গোটা ক্লাসকে জিজ্ঞেস করল :
‘পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় জিনিসটা কী?’ ‘আমার বাবা’ এক ছোট্ট মেয়ে বলে উঠল।
‘হাতি’ এক ছেলে উত্তর দিল, যে সম্প্রতি চিড়িয়াখানায় গিয়েছিল।
‘পর্বত’ আরেকজন বলল।
আমার বন্ধুর ছোট্ট মেয়ে উত্তর দিল, ‘আমার চোখ হচ্ছে পৃথিবীতে সবচেয়ে বড়।’
পুরো ক্লাস তার জবাব শুনে চুপ হয়ে এর মানে বুঝার চেষ্টা করতে লাগল। ‘কেন বল তো?’ তার শিক্ষক হতভম্ব হয়ে জিজ্ঞেস করল।
ছোট্ট দার্শনিক বলতে শুরু করল, ‘দেখুন! আমার চোখ তার বাবাকে দেখতে পারে, একটা হাতিকেও দেখতে পারে, এটি একটি পর্বতকেও দেখতে পারে,
সেই সাথে আরও কত কী দেখতে পারে। এত সব কিছু যখন আমার চোখের ভেতরে এঁটে যাচ্ছে, তখন আমার চোখটা অবশ্যই পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় জিনিস!’
প্রজ্ঞা কোনো শেখার বিষয় নয়, কিন্তু যা কখনো শেখানো যায় না, সেটাকে পরিষ্কার দেখাটাই প্রজ্ঞা।
আমার বন্ধুর সেই ছোট্ট কন্যার প্রতি অনেক শ্রদ্ধা রেখেই আমি তার এই অন্তর্দৃষ্টিকে আরেকটু বাড়িয়ে নেব, আপনার চোখ নয়, বরং আপনার মনই হচ্ছে পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় জিনিস।
যা আপনার চোখ দেখে, তার সবকিছুই আপনার মন দেখতে পায়। আপনার কল্পনার চোখে এটি আরও অনেক বেশি দেখতে পায়। এটা শব্দকেও জানে, যা আপনার চোখ কখনো দেখে না। এটা স্পর্শকে জানে যা বাস্তব এবং কাল্পনিক উভয়ই হতে পারে। আপনার পাঁচটি ইন্দ্রিয়ের বাইরের বিষয়গুলোও মন জানে।
যেহেতু যা যা জানার বিষয়, তার সবকিছুই আপনার মনে এঁটে যায়। তাই আপনার মন অবশ্যই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় জিনিস। মন সবকিছুকে ধারণ করে।
অনেক বিজ্ঞানী ও তাদের সমর্থকেরা এরূপ মত দেন যে, মন হচ্ছে ব্রেন থেকে উৎপন্ন তাই আমার দেশনা পর্ব শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বে আমাকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করা হয় : ‘মন কি আছে? যদি থাকে, তাহলে কোথায়? এটি কি শরীরের মধ্যে? নাকি তার বাইরে? নাকি এটি সর্বত্রব্যাপী? কোথায় থাকে মন?’
আমি এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে তাদের হাতেকলমে বুঝিয়ে দিই। আমি শ্রোতাদের জিজ্ঞেস করি, ‘যদি আপনারা এখন সুখী হন, তাহলে আপনার ডান হাত তুলুন, প্লিজ। যদি আপনারা অসুখী হন, সামান্য মাত্র অসুখী হলেও প্লিজ বাম হাতটা তুলুন।’ বেশির ভাগ লোক তাদের ডান হাতটা তোলে, কেউ কেউ সত্যিই তোলে, বাকিরা অহংকারবশত হাত তোলে।
আমি বলতে থাকি, ‘এখন, যারা সুখী তারা প্লিজ সেই সুখকে ডান হাতের তর্জনী দিয়ে দেখিয়ে দিন। আর যারা অসুখী প্লিজ সেই অসুখী ভাবকে বাম হাতের তর্জনী দিয়ে দেখিয়ে দিন। আমাকে দেখিয়ে দিন কোথায় আছে তারা।’
আমার শ্রোতারা তাদের আঙুলগুলোকে উদ্দেশ্যহীনভাবে উপরে-নিচে নিতে শুরু করে। এরপর তারা চারপাশের লোকজনের দিকে তাকায় যারাও তাদের মতো একইভাবে বিভ্রান্ত। ব্যাপারটা বুঝে ফেললে তখন তারা হাসে। সুখ বাস্তব। অসুখী ভাবটাও সত্যি। এই জিনিসগুলো যে আছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু আপনি এমন বাস্তব জিনিসগুলোকে আপনার দেহের কোথাও দেখিয়ে দিতে পারবেন না। দেহের বাইরেও পারবেন না, কোথাও পারবেন না।
কারণ, সুখ এবং অসুখী ভাব হচ্ছে মনের একচেটিয়া রাজত্বের আওতায়। তারা মনের আওতায় থাকে। যেমনটি বাগানের ফুল ও ঘাসগুলো থাকে সেই বাগানেরই আওতায়। ফুল ও ঘাসের অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে বাগান আছে। ঠিক একইভাবে সুখ ও অসুখী ভাবের অস্তিত্ব প্রমাণ করে যে মন আছে। সুখ ও অসুখী ভাবকে যে আঙুল দিয়ে দেখানো যায় না, এই আবিষ্কারই আমাদের দেখিয়ে দেয় যে আপনি মনকে ত্রিমাত্রিক জগতে খুঁজে পাবেন না। প্রকৃতপক্ষে স্মরণ করুন যে, মন হচ্ছে এই দুনিয়ার সবচেয়ে বড় জিনিস। তাই মন এই ত্রিমাত্রিক জগতের মধ্যে হতে পারে না। বরং ত্রিমাত্রিক জগৎটাই মনের মধ্যে বিরাজমান। মন হচ্ছে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় জিনিস। এটি পুরো মহাবিশ্বকে ধারণ করে।
ভিক্ষু হওয়ার আগে আমি একজন বিজ্ঞানী ছিলাম। আমি ইংল্যান্ডের ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যায় জেন ধর্মমতের বিশ্বজগৎ সম্বন্ধে গবেষণা করছিলাম। বিজ্ঞান ও ধর্ম আমি দেখেছি যে, তাদের উভয়ের মধ্যে অনেক জিনিস কমন আছে, যার মধ্যে কমন হচ্ছে মতবাদ। আমার ছাত্রজীবনের দিনগুলোর একটা হাস্যকর প্রবাদ আমার মনে পড়ে। একজন বিজ্ঞানী কতটুকু সময় ধরে তার ফিল্ডের অগ্রগতিকে আটকে দিয়েছে, তা থেকে তার খ্যাতিকে পরিমাপ করা যায়!!
অস্ট্রেলিয়ায় বিজ্ঞান ও ধর্মবিষযক এক সাম্প্রতিক বিতর্কের যেখানে আমি একজন বক্তা ছিলাম, সেখানে শ্রোতাদের একজন একটি ক্ষুরধার মন্তব্য ছুঁড়ে দিল। সেই গোঁড়া ক্যাথলিক মহিলা বলল, ‘যখন আমি টেলিস্কোপ দিয়ে তারাদের সৌন্দর্য দেখি, তখন আমি সব সময় অনুভব করি যে আমার ধর্ম হুমকির মুখে।’
আমি জবাব দিলাম, ‘ম্যাডাম, যখন কোনো বিজ্ঞানী টেলিস্কোপের অন্য প্রান্তে চোখ রেখে আপনাকে দেখে, তখন সে অনুভব করে বিজ্ঞান এখন হুমকির মুখে?
বোধ হয় তর্কাতর্কি পুরোপুরি বন্ধ করাটাই ভালো। একটা বিখ্যাত প্রাচ্য প্রবাদ আছে এ রকম : ‘যে জানে, সে বলে না। যে বলে, সে জানে না।’
প্রবাদটা হয়তো খুব গভীর বলে মনে হতে পারে; কিন্তু ভালোমতো ভাবলে একসময় আপনি দেখবেন যে এই প্রবাদ অনুসারে, যে এটা বলেছে, সে নিজেই জানে না।
বুড়ো হলে আমাদের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়ে আসে, শ্রবণশক্তি কমে যায়, চুল পড়ে যায়, নকল দাঁত বাঁধাই করতে হয়, পা দুর্বল হয়ে যায়, হাত কাঁপে থরথর করে। কিন্তু আমাদের শরীরের একটা অংশ মনে হয় প্রতিবছর আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। আর সেটা হচ্ছে আমাদের বাচাল মুখ। এজন্যই আমাদের বেশির ভাগ কথাপ্রিয় নাগরিক বুড়ো বয়সে রাজনীতিবিদ হিসেবে বেশ নাম করতে পারে।
অনেক শতাব্দী আগে এক রাজা তার মন্ত্রীদের নিয়ে মহাসমস্যায় পড়ে গিয়েছিলেন। তারা এত তর্কাতর্কি করত যে, কোনো সিদ্ধান্তই বলতে গেলে
নেওয়ার সময় হতো না। মন্ত্রীরা সেই চিরাচরিত ঐতিহ্য অনুযায়ী প্রত্যেকেই দাবি করত যে তারা একাই সঠিক। আর বাকিরা সবাই ভুল। সে যা-ই হোক, যখন এই বুদ্ধিমান রাজা একটি বিশেষ উৎসবের আয়োজন করলেন, তখন সবাই একদিনের জন্য এতে যোগ দিতে রাজি হলো। সেই বর্ণাঢ্য উৎসবটা বিশাল এক স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। সেখানে নাচ ছিল, গান ছিল, দড়িবাজি ছিল, ভাঁড় ছিল, সঙ্গীত ছিল, আরও কত কী ছিল! অতঃপর সেই লোকে লোকারণ্য স্টেডিয়ামে, মন্ত্রীরা যেখানে সবচেয়ে ভালো আসনে বসা, সেখানে রাজা তার রাজকীয় হাতিটাকে নিয়ে স্টেডিয়ামের মাঝখানে চলে এলেন। হাতির পেছনে এলো সাতজন অন্ধ, যারা এই শহরে জন্মান্ধ বলে পরিচিত।
রাজা প্রথমঅন্ধের হাত ধরে তাকে হাতির শুঁড় কেমন তা অনুভব করতে সাহায্য করলেন আর বললেন, এটা একটা হাতি। এর পরে তিনি দ্বিতীয় অন্ধকে হাতির দাঁত কেমন তা অনুভব করতে সাহায্য করলেন। তৃতীয়জনকে হাতির কান, চতুর্থজনকে মাথা, পঞ্চমজনকে শরীর, ষষ্ঠজনকে পা, সপ্তমজনকে লেজ। প্রত্যেককে তিনি বলে দিলেন যে এটা একটা হাতি। এর পরে তিনি প্রথম অন্ধের কাছে গিয়ে তাকে বড় করে বলতে বললেন হাতি কেমন।
‘আমার বিশেষ বিবেচনা ও বিশেষজ্ঞ মত অনুযায়ী’ প্রথমঅন্ধ ব্যক্তি শুঁড়কে অনুভব করে বলল, ‘‘আমি পরম নিশ্চয়তার সাথে এই ঘোষণা দিই যে ‘হাতি’ হচ্ছে এক প্রজাতির সাপ, জেনাস পাইথন এশিয়াটিকস।’’
‘কী বাজে বকছ!’ দ্বিতীয় অন্ধ অবাক হয়ে বলে উঠল। সে হাতির দাঁত অনুভব করে বলল, ‘‘একটা ‘হাতি’ এমন শক্ত যে তা সাপ হতেই পারে না।
আসলে প্রকৃত সত্য হচ্ছে- আর আমি কখনোই ভুল বলি না- যে এটি একটি কৃষকের লাঙ্গল।’’
‘কী হাস্যকর কথাবার্তা বলছ!’ ব্যঙ্গ করে বলল তৃতীয় অন্ধ। সে হাতির কান অনুভব করে বলল, ‘হাতি হচ্ছে তালপাতার পাখা।’
‘তোমরা হাবাগোবার দল!’
চতুর্থ অন্ধ হেসে উঠল। সে মাথাটা অনুভব করে বলল, ‘আসলে হাতি হচ্ছে একটি বড় পানির টাংকি।’
‘অসম্ভব! চরম অসম্ভব!’ হৈচৈ করে উঠল পঞ্চম অন্ধ। সে হাতির শরীর অনুভব করে বলল, ‘হাতি হচ্ছে একটি বিরাট পাথর।’
‘গরুর গোবর!’
ষষ্ঠ অন্ধ চিৎকার করে উঠল। সে হাতির পা অনুভব করে বলল, ‘হাতি হচ্ছে একটি গাছের গুঁড়ি।’
‘ওরে চুনোপুঁটির দল!’ অবজ্ঞায় মুখ বাঁকাল সপ্তম অন্ধ। হাতির লেজটা অনুভব করে সে বলল, ‘আমি তোমাদের বলছি, হাতি আসলে কী। এটি এক ধরনের ঝাড়ু। আমি জানি। আমি এটা নিজেই অনুভব করছি!’
‘জঘন্য! এটা একটা সাপ।’ ‘হতেই পারে না! এটা টাংকি।’ ‘কোনো গতি রাখলে না দেখছি! এটা একটা... ’ এভাবে অন্ধরা এমন উত্তপ্ত বাকবিতন্ডা শুরু করল যে শুধু তাদের হৈচৈয়ের শব্দ শোনা গেল। কথার সাথে সাথে তাদের হাতও চলল। যদিও কার গায়ে লাগছে সে ব্যাপারে তারা নিশ্চিত নয়; কিন্তু এমন গরম সময়ে সেটা অত গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তারা তাদের নিজ নিজ মতবাদের জন্য লড়াই করছিল, তাদের সততা ও পরম সত্যের পক্ষে লড়াই করছিল। সেটা ছিল তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব ব্যক্তিগত সত্য।
রাজার সৈন্যরা যখন আহত অন্ধ যোদ্ধাদের পৃথক করে নিয়ে যাচ্ছিল, স্টেডিয়ামের লোকজন তখন লজ্জায় চুপ হয়ে যাওয়া মন্ত্রীদের উদ্দেশে ব্যঙ্গ করছিল। তারা প্রত্যেকেই ভালো করে বুঝতে পেরেছিল এই ঘটনার আড়ালে রাজা কী শিক্ষা দিতে চেয়েছেন।
আমাদের প্রত্যেকেই পুরো সত্যের ভগ্নাংশ মাত্র জানতে পারি। যখন আমরা আমাদের সীমিত জ্ঞান নিয়ে সেই সত্যকেই পরম সত্য হিসেবে আকড়ে ধরি, আমরা তখন হয়ে যাই সেই অন্ধদের মতো, যারা হাতির এক একটা অংশ অনুভব করেই স্থির সিদ্ধান্তে এসেছিল যে তাদের আংশিক অভিজ্ঞতাই হচ্ছে আসল সত্যি, বাকিগুলো ভুল।
অন্ধবিশ্বাসের বদলে আমরা আলোচনায় বসতে পারি। কল্পনা করুন তো, রেজাল্টটা কেমন হবে যখন সেই সাতজন অন্ধ তাদের পরস্পরের তথ্যকে ভুল বলে প্রত্যাখান না করে বরং তাদের অভিজ্ঞতাগুলো একসাথে একত্র করল। তারা এই সিদ্ধান্তে আসবে যে হাতি হচ্ছে বিশাল পাথরের মতো একটা কিছু যা চারটি গাছের গুঁড়ির উপর দাঁড়িয়ে আছে। সেই পাথরের পিছনে একটা ঝাড়ু, সামনের দিকে একটা বড় পানির টাংকি, টাংকির দুপাশে দুটো তালপাতার পাখা, তার নিচে দুদিকে দুটো লাঙল আর মাঝখানে লম্বা একটা অজগর সাপ।
যে কখনো হাতি দেখে নি, তার জন্য হাতির এমন বর্ণনা মোটামুটি খারাপ হবে না।