দেয়ালে শুধুমাত্র দুটি খারাপ ইট দেখাটা যদি মনস্তাপের কারণ হয়, তাহলে সেই দেয়াল দেখে দেখে ভবিষ্যতের খারাপ কিছু ভেবে বসাটা আমাদের জন্য ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। যখন আমরা ভয়ে অন্ধ হয়ে যাই, দেয়ালের বাকি অংশটা আর দেখতে পাই না। অতএব ভয়কে জয় করতে হয় পুরো দেয়ালটা দেখে, শুধু খারাপ অংশটা দেখে নয়। উদাহরণস্বরূপ, আমার সিঙ্গাপুরে সাম্প্রতিক ভ্রমণের গল্পটা বলা যায়।
সিঙ্গাপুরে আমার ধারাবাহিক চারটি দেশনা দেওয়ার কথা ছিল অনেক মাস আগে থেকেই। দেশনালয় হিসেবে বুক করা হয়েছিল ২৫০০ আসন-সম্বলিত ব্যয়বহুল সিঙ্গাপুরের সানটেক সিটি অডিটোরিয়াম। বাস স্টেশনগুলোতে দেশনার পোস্টার টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এরপর এলো সার্স সংকট (সার্স একটি সংক্রামক রোগ)। আমি যখন সিঙ্গাপুরে পৌঁছলাম, তখন স্কুলগুলো বন্ধ, আবাসিক এলাকাগুলো অবরুদ্ধ, সরকার লোকজনকে কোনো জনসভায় যোগ না দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে। ভয় ছিল আকাশচুম্বী। আমাকে জিজ্ঞেস করা হলো, ‘আমরা কি দেশনার প্রোগ্রামগুলো বাতিল করব?’
সেদিন সকালে সংবাদপত্রের প্রথমপাতায় বড় বড় অক্ষরে ছাপা হলো যে নিরানববই জন সিঙ্গাপুরিয়ানের সার্স রোগ ধরা পড়েছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘সিঙ্গাপুরের বর্তমান জনসংখ্যা কত?’ ‘প্রায় চল্লিশ লাখ।’ আমি মন্তব্য করলাম, ‘তো, তার মানে হচ্ছে ৩৯,৯৯,৯০১ জনের সার্স রোগ হয় নি। কাজেই দেশনা চলুক।’
‘কিন্তু কেউ যদি সার্স রোগে আক্রান্ত হয়?’ ভয় বলল।
‘কিন্তু যদি না হয়?’ প্রজ্ঞা পাল্টা প্রশ্ন করল। সম্ভাবনার পাল্লা ভারি ছিল প্রজ্ঞার দিকেই।
তাই আগের সিডিউল অনুযায়ী দেশনার আয়োজন করা হলো। প্রথম রাতে দেশনা শুনতে এলো পনের শ লোক। এরপর থেকে প্রতিরাতে লোকজনের সংখ্যা বাড়তেই থাকল। শেষ দেশনার রাতে হাউসফুল হয়ে গেল অডিটোরিয়াম। প্রায় ৮০০০ লোক দেশনাগুলো শুনতে এসেছিল। তারা অযৌক্তিক ভয়ের বিরুদ্ধে যেতে শিখেছিল, সেটা ভবিষ্যতে তাদের সাহসকে আরও শক্তিশালী করবে। তারা দেশনাগুলো বেশ উপভোগ করেছিল, আর খুশিমনে চলে গিয়েছিল। তার মানে হচ্ছে তাদের ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়ার রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থা আরও মজবুত হয়েছিল। প্রত্যেক দেশনার শেষে আমি তাদের জোর গলায় বলে দিয়েছিলাম যে, যেহেতু তারা আমার মজার গল্পগুলো শুনে হেসে লুটোপুটি খেয়েছে, এতে করে তাদের ফুসফুসের ব্যায়াম হয়ে গেছে, আর তাদের শ্বাসপ্রশ্বাসের সিস্টেমটা আরও সুদৃঢ় হয়েছে! সেই শ্রোতাদের মধ্যে থেকে একজনও তো সার্স রোগে আক্রান্ত হয় নি।
ভবিষ্যতের আছে অপার সম্ভাবনা। যখন আমরা খারাপ সম্ভাবনাগুলোতে নিজেদের ডুবিয়ে রাখি, সেটাকেই বলে ভয়। যখন আমরা অন্যান্য সম্ভাবনাগুলোকেও দেখতে পাই, আর সেটাই বেশির ভাগ সময় হয়, সেটাকেই বলে ভয় থেকে মুক্তি।
অনেকেই ভবিষ্যৎ জানতে চান। কেউ কেউ অধৈর্য হয়ে ভবিষ্যদ্বাণী ও ভবিষ্যৎবক্তাদের সাহায্য নেন। আমি আপনাকে ভবিষ্যদ্বাণী বিষয়ে সতর্ক করে দিতে চাই : কখনোই একজন গরিব ভবিষ্যৎ বক্তাকে বিশ্বাস করবেন না!
ধ্যানী ভিক্ষুরা দারুণ ভবিষ্যৎ বক্তা হিসেবে খ্যাত, কিন্তু তারা তা সহজে আপনাকে বলবে না।
একদিন এক ভক্ত আজান চাহ্-কে তার ভবিষ্যৎ বলে দিতে অনুরোধ জানাল। আজান চাহ্ না করে দিলেন এই বলে : ‘ভালো ভিক্ষুরা ভবিষ্যৎ বলে দেয় না।’ ভক্ত তো নাছোড়বান্দা। সে আজান চাহ্-কে মনে করিয়ে দিল কতবার সে তাকে পিন্ডদান করেছে, তার বিহারে সে কত টাকা দান করেছে, আজান চাহ্-কে সে তার নিজের গাড়িতে করে কতবার ঘুরিয়েছে, নিজের কাজ ও পরিবার ফেলে। আজান চাহ্ দেখলেন যে লোকটি তার ভবিষ্যৎ জেনেই ছাড়বে। তাই তিনি বললেন যে একবারের জন্য তার ভবিষ্যৎ বলে দেওয়া যায়। ‘ঠিক আছে, তোমার হাতটা দাও। একটু দেখে দিই।’
ভক্ত তো উত্তেজনায় ভরপুর। আজান চাহ্ অন্য কোনো ভক্তকে হাত দেখে দেন নি। এটা বিশেষ একটা সুযোগ। তা ছাড়া আজান চাহ্ একজন সিদ্ধপুরুষ হিসেবে খ্যাত। তার অলৌকিক শক্তির কথা সবার জানা। তিনি যা বলেন তা হবেই, নিশ্চিতভাবেই হবে। আজান চাহ্ তার ভক্তের হাতের রেখাগুলো আঙুল দিয়ে টিপে টিপে দেখতে লাগলেন। একটু পর পর তিনি বলতে লাগলেন, ‘ওহ, দারুণ তো’ অথবা ‘ভালো, ভালো’, ‘অসাধারণ!’ বেচারা ভক্ত ভালো কোনো ভবিষ্যদ্বাণীর আশায় খুশিতে ডগমগ।
যখন আজান চাহ-র দেখা শেষ হলো, তিনি ভক্তের হাতটা ছেড়ে দিয়ে বললেন, ‘হে উপাসক, তোমার ভবিষ্যৎ এটাই হবে।’
‘জি, বলুন।’ ভক্ত তাড়াতাড়ি বলে উঠল।
‘আর, আমি কিন্তু কখনোই ভুল করি না।’ আজান চাহ্ এর সাথে যোগ করলেন।
‘আমি জানি, আমি জানি। ঠিক আছে। আমার ভবিষ্যৎ কেমন হবে?’ ব্যগ্র সুরে বলে উঠল ভক্ত।
‘তোমার ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত’ আজান চাহ্ বললেন। তিনি কিন্তু ভুল বলেননি!
টাকা কামানো কঠিন, কিন্তু হারানো সহজ। আর হারানোর সবচেয়ে সহজ পথটি হচ্ছে জুয়া। সকল জুয়াড়িই অবশেষে হেরো পার্টিতে পরিণত হয়। তবুও
লোকজন ভবিষ্যৎ জানতে পছন্দ করে, যাতে করে তারা জুয়া খেলে অথবা বাজি ধরে প্রচুর টাকা কামাতে পারে। আমি দুটো গল্প বলব ভবিষ্যৎ অনুমান করাটা যে কত বিপদজনক তা দেখানোর জন্য, এমনকি যদি সেরকম লক্ষণ দেখা যায়, তবুও।
এক বন্ধু কোনো এক সকালে ঘুম থেকে জাগল এক স্বপ্ন দেখে। স্বপ্নটা এতই পরিষ্কার যে মনে হয়েছিল বাস্তব থেকেও বাস্তব। সে স্বপ্ন দেখেছিল যে পাঁচজন দেবতা এসে তাকে পাঁচটি বড় বড় কলসিভরা ধনসম্পদ দিয়ে গেল। ঘুম ভেঙে চোখ মেলে দেখল তার বেডরুমে কোনো দেবতা নেই, আর আফসোস, কোনো কলসিভরা ধনসম্পদও নেই। কিন্তু স্বপ্নটি ছিল খুব অদ্ভুত।
সে রান্নাঘরে গিয়ে দেখল যে তার স্ত্রী তাকে পাঁচটি ডিম সেদ্ধ ও পাঁচ পিস পাউরুটি গরম করে দিয়েছে নাস্তার জন্য। সকালের খবরের কাগজে সে তারিখ
দেখল ৫ মে (পঞ্চম মাস)। অদ্ভুত কিছু একটা হচ্ছে, তাই না! পেছনের পাতায় সে দেখল ঘোড়দৌঁড়ের খবর। সে অবাক হয়ে দেখল যে এসকটে (ASCOT)
পাঁচ অক্ষর) যে ঘোড়দৌঁড়ের খেলা হচ্ছে, সেখানে পঞ্চম দৌঁড়ের পঞ্চম ঘোড়ার নাম পঞ্চ দেবতা! স্বপ্নটা আসলে ছিল দৈববাণী!
সেই বিকেলে সে অফিস থেকে ছুটি নিল। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলল পাঁচ হাজার ডলার। ঘোড়দৌঁড়ের বাজির মাঠে গিয়ে সে পঞ্চম বাজিকরের কাছে গিয়ে বাজি ধরল : পাঁচ নম্বর ঘোড়দৌঁড়ের পাঁচ নম্বর ঘোড়া পঞ্চ দেবতার ওপর পাঁচ হাজার ডলার বাজি। স্বপ্ন তো আর মিথ্যা হতে পারে না। সৌভাগ্যের সংখ্যা পাঁচ তো আর মিথ্যা হতে পারে না। স্বপ্নটা আসলেই মিথ্যা ছিল না। ঘোড়াটা এসেছিল পঞ্চম হয়ে।
দ্বিতীয় গল্পটা সিঙ্গাপুরে ঘটেছিল অনেক বছর আগে। একজন অস্ট্রেলিয়ান লোক বিয়ে করেছিল সিঙ্গাপুরের এক সুন্দরী চাইনিজ মেয়েকে। যখন তারা সিঙ্গাপুরে তাদের আত্মীয়স্বজনের কাছে বেড়াতে আসল, লোকটার শালারা তখন বিকেলে ঘোড়দৌঁড়ের মাঠে যাচ্ছিল। তারা তাকেও যাওয়ার আমন্ত্রন জানাল।
লোকটি রাজি হলো। ঘোড়দৌঁড়ে যাওয়ার আগে তারা একটা বৌদ্ধ বিহারে গিয়ে বাতি জ্বালিয়ে সৌভাগ্যের প্রার্থনা করবে বলে মনস্থির করল। কিন্তু ছোট্ট সেই বিহারে পৌঁছে দেখল যে সেটা যেন জঞ্জালের স্তুপ । তাই তারা ঝাড়ু ও বালতি হাতে নিয়ে ঝেড়ে মুছে পরিষ্কার করল পুরো বিহারটা। তারপর তারা তাদের বাতি জ্বালিয়ে সৌভাগ্যের প্রার্থনা করল এবং ঘোড়দৌঁড়ের মাঠে গেল। কিন্তু তারা বাজিতে শোচনীয়ভাবে হারল।
সে রাতে অস্ট্রেলিয়ান লোকটা একটা ঘোড়ার স্বপ্ন দেখল। জাগার পরে তার স্পষ্ট মনে পড়ল ঘোড়ার নামটা। খবরের কাগজে দেখল যে সেদিন বিকেলের
ঘোড়দৌঁড়ে আসলেই সেই ঘোড়ার নাম আছে। সে তার শালাদের এই সুখবরটা জানাল। কিন্তু তার শালারা কিছুতেই সেটা বিশ্বাস করল না। সিঙ্গাপুরের বিহার রক্ষাকারী চাইনিজ দেবতা একজন বিদেশি অস্ট্রেলিয়ানকে জয়ী ঘোড়ার নাম বলে দেবে, এটা মেনে নেওয়া অসম্ভব। তারা এটাকে আমলেই নিল না।
অস্ট্রেলিয়ান লোকটা একাই ঘোড়দৌঁড়ে গেল, সেই ঘোড়াটার উপরে বড় অঙ্কের বাজি ধরল, আর ঘোড়াটা জিতল।
বিহার রক্ষাকারী চাইনিজ দেবতা নিশ্চয়ই অস্ট্রেলিয়ানদের পছন্দ করত। তার শালারা রাগে ফুঁসতে লাগল।
ভয় হচ্ছে ভবিষ্যতের কোনো ভুল, দোষ বা অপ্রীতিকর কোনো কিছু খুঁজে পাওয়া। ভবিষ্যত যে কীরূপ অনিশ্চিত তা যদি আমরা মনে রাখতে পারি, তাহলে আমরা আর কখনো চেষ্টা করতে যাব না কী কী ঝামেলা হতে পারে। ভয়ের সেখানেই সমাপ্তি।
একবার ছোটবেলায় আমি দাঁতের ডাক্তারের কাছে যাওয়ার ভয়ে আতঙ্কিত ছিলাম। ওইদিন আমার ডাক্তারের সাথে দেখা করতে যাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু আমি যেতে চাই নি। আমি বোকার মতো নিজেকে নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম। কিন্তু ডাক্তারের কাছে পৌঁছে জানলাম যে আমার অ্যাপয়েন্টমেন্ট বাতিল হয়ে গেছে। এতেই বুঝলাম, ভয়টা যে কী মারাত্মক সময় অপচয়কারক।
ভয় মিশে থাকে ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তায়। কিন্তু প্রজ্ঞাকে কাজে না লাগালে ভয় আমাদেরই মেরে ফেলতে পারে। কুংফু নামে একটা পুরনো টেলিভিশন সিরিজে এই ভয়টা তরুণ বৌদ্ধ শ্রামণ ছোট্ট ঘাসফড়িংকে প্রায় মেরে ফেলেছিল।
ছোট্ট ঘাসফড়িংয়ের আচার্য ছিল অন্ধ। সেই অন্ধ আচার্য একদিন তার শিষ্য ছোট্ট ঘাসফড়িংকে নিয়ে গেল বিহারের পিছনের এক রুমে, যা সাধারণত তালাবদ্ধ থাকত। রুমের ভেতরে ছিল ছয় মিটার চওড়া একটি পুকুর, যার মাঝামাঝি জায়গায় ছিল একটা ছোট কাঠের ব্রিজ। সেই আচার্য ছোট্ট ঘাসফড়িংকে সাবধান করে দিল যেন পুকুরের কিনারা থেকে দূরে থাকে। কারণ, পুকুরে পানি ছিল না, ছিল এসিড।
ঘাসফড়িংকে বলা হলো, ‘তোমাকে সাত দিন পরে পরীক্ষা করা হবে। এই ছোট্ট কাঠের ব্রিজ পার হয়ে তোমাকে পুকুরের ওপারে যেতে হবে। সাবধান! পুকুরের তলায় জমা হওয়া ওই হাড়গোড়গুলো দেখতে পাচ্ছ তো?’
ঘাসফড়িং ভয়ে ভয়ে পুকুরের তলায় তাকাল এবং অনেক হাড়গোড় দেখল। ‘ওগুলো তোমার মতো অনেক শ্রামণের হাড়গোড়।’
আচার্য ঘাসফড়িংকে সেই ভয়ংকর রুম থেকে বাইরে নিয়ে এলো। বিহারের উঠোনে ভিক্ষুরা একটা একই মাপের কাঠের ব্রিজ বানিয়ে সেটাকে দুটো ইটের উপরে বসাল। সাত দিন ধরে ঘাসফড়িংয়ের সেই ব্রিজ হেঁটে পার হওয়া ছাড়া আর কোনো কাজ ছিল না।
কাজটা সহজ। কয়েক দিনের মধ্যেই সে নিখুঁতভাবে ছোট্ট ব্রিজটা হেঁটে পার হতে পারত। এমনকি চোখ বাঁধা অবস্থায়ও পার হয়ে যেতে পারত অবলীলায়। এবার পরীক্ষার পালা আসল।
আচার্য ঘাসফড়িংকে নিয়ে গেল এসিডের পুকুরের রুমে। পুকুরের তলায় শ্রামণগুলোর হাড়গোড়গুলো চক চক করছিল। ঘাসফড়িং ব্রিজের এক প্রান্তে উঠে
দাঁড়াল এবং আচার্যের দিকে তাকাল। ‘হাঁটো’ তাকে আদেশ দেওয়া হলো। এসিডের পুকুরের উপরে যে ব্রিজটা, তা উঠোনের সেই একই মাপের ব্রিজের
চেয়ে অনেক অনেক সংকীর্ণ ঘাসফড়িং হাঁটতে শুরু করল, কিন্তু তার পদক্ষেপ নড়বড়ে হয়ে উঠল। সে টলতে শুরু করল। অর্ধেক পথও পেরোরনি, এরই মাঝে সে আরও ভীষণভাবে দুলে উঠল। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল সে এসিডের মধ্যে পড়তে যাচ্ছে। এমন শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থায় একটা বিজ্ঞাপন বিরতি হলো।
অনেক বিরক্তি চেপে সেই জঘন্য বিজ্ঞাপনগুলো সহ্য করেছিলাম আমি। মনে সব সময় ভাবনা ছিল বেচারা ঘাসফড়িং কী করে নিজেকে বাঁচাবে।
বিজ্ঞাপন শেষ হলো। আমরা আবার ফিরে এলাম যেখানে ঘাসফড়িং ব্রিজের মাঝপথে গিয়ে ভয়ে আত্মবিশ্বাস হারাতে বসেছে। আমি তাকে টলমল পায়ে পা বাড়াতে দেখলাম। এরপর সে দুলে উঠল, আর পুকুরে পড়ে গেল।
ছোট্ট ঘাসফড়িংয়ের পুকুরে পড়ার শব্দ শুনে বৃদ্ধ অন্ধ আচার্য হেসে উঠল। এটা এসিড নয়, ছিল কেবল পানি। হাড়গোড়গুলো ফেলে দেওয়া হয়েছিল ‘স্পেশাল ইফেক্ট’ হিসেবে, গল্পটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য। সেগুলোই ঘাসফড়িংকে বোকা বানিয়েছিল, আর বোকা বনে গিয়েছিলাম আমিও।
আচার্য জিজ্ঞেস করল, ‘কে তোমাকে ফেলে দিয়েছিল? ভয়ই তোমাকে ফেলে দিয়েছিল, হে ছোট্ট ঘাসফড়িং, কেবল ভয়।’
আমি শুনেছি, বড় ভয়গুলোর একটা হলো জনগণের সামনে কথা বলার ভয়।
আমাকে প্রচুর কথা বলতে হয় জনগণের সামনে, বিহারে, আলোচনা সভায়, বিয়ের অনুষ্ঠানে, দাহক্রিয়ায়, রেডিওতে, টেলিভিশনে, সরাসরি সাক্ষাৎকারে।
এটা আমার পেশার একটা অংশ।
আমার মনে পড়ে, কোনো একসময় দেশনা দেওয়ার পাঁচ মিনিট আগে ভয় আমাকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলেছিল। আমার কোনো প্রস্ত্ততিই ছিল না। কী
যে দেশনা দেব, সে-বিষয়ে আমার কোনো ধারণা ছিল না। দেশনালয়ে তখন প্রায় তিনশ জন লোক একটা ভালো, অনুপ্রেরণামূলক দেশনা শোনার আশায় আমার দেশনা শুনতে এসেছিল। আমি ভাবতে লাগলাম, ‘যদি বলার মতো কিছু খুঁজে না পাই, তাহলে কী হবে? যদি ভুল কিছু বলে বসি? যদি বোকার মতো কিছু করে ফেলি?’
সমস্ত ভয়ের শুরু হয় ‘যদি... তাহলে কী হবে?’ এমন চিন্তা থেকে এবং যা একেবারে ভয়ংকর পরিণামের চিন্তার দিকে গড়ায়। আমি ভবিষ্যতের অনুমান করছিলাম এবং না বোধক ভবিষ্যতের কথাই ভাবছিলাম। আমি ছিলাম বোকা। আমি জানতাম, আমি বোকার মতো ভাবছি। আমি থিওরি অনুযায়ী সবকিছু জানতাম, কিন্তু তাতে কাজ হচ্ছিল না। মনে সীমাহীন ভয় ঢুকতে শুরু করেছিল। আমি বেশ ঝামেলায় পড়ে গিয়েছিলাম।
এখন যখনই আমি দেশনা দিই, আমি মজা করি। আমি নিজেকে উপভোগ করি। আমি মজার মজার গল্প বলি, তা প্রায়ই বলি নিজেকে হাসাতে, আর
সেগুলো শুনে শ্রোতাদের সাথে সাথে আমিও হাসি। একবার সিঙ্গাপুরে রেডিওতে সরাসরি সংলাপে ভবিষ্যতের টাকা-পয়সা কেমন হবে সে-সম্পর্কে আজান চাহ্-র ভবিষ্যদ্বাণী নিয়ে বলেছিলাম (সিঙ্গাপুরিয়ানরা অর্থনৈতিক ব্যাপারে খুব আগ্রহী)।
আজান চাহ্ একবার ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে পৃথিবীতে একদিন টাকা বানানোর কাগজ ফুরিয়ে যাবে, পয়সা বানানোর ধাতু ফুরিয়ে যাবে। লোকজন তখন দৈনন্দিন লেনদেনের জন্য অন্য জিনিস ব্যবহার করবে। তিনি বলেছিলেন, লোকজন তখন মুরগির শুকনো বিষ্ঠাকে টাকা-পয়সারূপে ব্যবহার করবে। তারা পকেটে করে মুরগির বিষ্ঠা নিয়ে ঘুরবে। ব্যাংকের ভল্ট মুরগির বিষ্ঠায় পরিপূর্ণ থাকবে। ডাকাতেরা সেগুলো লুট করতে চাইবে। ধনীরা গর্বে নাক উঁচু করে বেড়াবে যে তাদের কাছে এত বেশি মুরগির বিষ্ঠা আছে। গরিবরা লটারিতে এক বিরাট স্তুপ মুরগির বিষ্ঠা পাওয়ার স্বপ্ন দেখবে। সরকার তাদের দেশের মুরগির বিষ্ঠার অবস্থার দিকে বিশেষ মনোযোগ দেবে এবং সামাজিক ও পরিবেশগত সমস্যাগুলো মুরগির বিষ্ঠার চেয়ে কম গুরুত্ব পাবে।
টাকা, পয়সা ও মুরগির বিষ্ঠার মধ্যে মৌলিক পার্থক্যটা কী? কোনো পার্থক্য নেই।
আমি গল্পটা বলতে বেশ উপভোগ করি। এটা আমাদের প্রচলিত সংস্কৃতির এক মর্মান্তিক চিত্র তুলে ধরে। এটি মজারও বটে। সিঙ্গাপুরিয়ান শ্রোতারা গল্পটা পছন্দ করেছিল।
আমি বুঝে গিয়েছিলাম যে লোকজনের সামনে বক্তৃতা দিয়ে আপনি যদি মজা পেতে চান, তাহলে রিল্যাক্স করুন। মনে একই সাথে ভয় ও মজা থাকাটা মনস্তত্ত্ববিদ্যামতে অসম্ভব। যখন আমি রিল্যাক্স থাকি, দেশনার সময় আইডিয়াগুলো মনে আসতে থাকে একটার পর একটা, আর মুখ দিয়ে সেগুলো মসৃণভাবে কথার ঝংকার হয়ে বেরিয়ে পড়ে। তা ছাড়া, শ্রোতারা মজার কথা শুনতে বিরক্ত বোধ করে না।
একবার একজন তিববতীয় ভিক্ষু দেশনার সময় শ্রোতাদের হাসানোর গুরুত্ব সম্পর্কে ব্যাখ্যা করেছিল। সে বলেছিল, ‘যখন তারা হাসার জন্য মুখ খুলবে,
আপনি তখন তাদের মুখে জ্ঞানের ট্যাবলেট ছুঁড়ে দিতে পারবেন।’
আমি কখনোই দেশনার প্রস্ত্ততি নিই না। বরং আমি হৃদয় ও মনকে প্রস্তুত করি। থাইল্যান্ডে ভিক্ষুদের শেখানো হয় যেন তারা কখনোই দেশনা প্রস্তুত না করে; বরং যেকোনো সময় বিনা নোটিশে দেশনা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকে।
দেশনা প্রস্তুত করবে না, প্রস্তুত করবে নিজেকে। তখন ছিল মাঘী পূর্ণিমা, উত্তরপূর্ব থাইল্যান্ডে সেটা বছরের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। আমি ছিলাম আজান চাহ-র বিহার ওয়াট পাপং এ। সেখানে ভিক্ষু ছিল দুই শ-এর মতো, আর উপাসক-উপাসিকা ছিল কয়েক হাজার। আজান চাহ্ খুব বিখ্যাত ছিলেন। তখন ভিক্ষু হিসেবে আমার বয়স ছিল পাঁচ বছর।
সন্ধ্যার পরে দেশনার সময়। এমন প্রধান প্রধান অনুষ্ঠানে আজান চাহ্ সাধারণত নিজেই দেশনা করেন। কিন্তু সব সময় নয়। মাঝে মাঝে তিনি ভিক্ষুদের সারিতে চোখ বুলিয়ে নেন। যদি তাঁর দৃষ্টি আপনার উপর এসে থামে, তাহলে আপনি ঝামেলায় পড়ে গেছেন। তিনি আপনাকে দেশনা দিতে বলবেন। যদিও আমি সিনিয়র ভিক্ষুদের তুলনায় এখনো নবীন, তবুও নিশ্চিত করে কিছুই বলা যায় না, আজান চাহ্ কখন কাকে দেশনা দিতে বলেন।
তিনি ভিক্ষুদের সারিতে চোখ বুলালেন। তাঁর দৃষ্টি আমাকে ফেলে সামনে এগিয়ে গেল। আমি নিরবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। এর পরে তার দৃষ্টি আবার সামনে থেকে পিছনে এগিয়ে আসতে লাগল। ভাবুন তো কার উপর তার দৃষ্টি থেমে গেল?
আজান চাহ্ নির্দেশ দিলেন, ‘ব্রাক্ষ্ম প্রধান দেশনাটা দাও।’
পালানোর পথ ছিল না। অপ্রস্তুত অবস্থায় আমাকে থাই ভাষায় এক ঘণ্টা ধরে দেশনা দিতে হলো আমার গুরুর সামনে, ভিক্ষুদের সামনে এবং হাজারো
লোকজনের সামনে। দেশনাটা ভালো হয়েছিল কি হয় নি, সেটা ব্যাপার না। ব্যাপার হলো, আমি দেশনা দিয়েছিলাম।
আজান চাহ্ আপনাকে কখনোই বলবেন না দেশনা ভালো হয়েছে কি হয় নি। ব্যাপারটা সেটা নয়। একবার তিনি একজন সুদক্ষ পশ্চিমা ভিক্ষুকে সাপ্তাহিক উপোসথের দিনে জড়ো হওয়া উপাসক-উপাসিকাদের সামনে দেশনা দিতে বললেন। এক ঘণ্টা থাই ভাষায় দেশনা দিয়ে ভিক্ষুটি তা সমাপ্ত করার প্রস্ত্ততি নিল। আজান চাহ্ তাকে শেষ করতে দিলেন না, আরও এক ঘণ্টা বলতে বললেন। এটি ছিল কঠিন কাজ। তবুও সে বলল। কোনোমতে থাই ভাষায় যখন সে দ্বিতীয় ঘণ্টার দেশনা শেষ করার প্রস্ত্ততি নিচ্ছে, আজান চাহ্ আরও এক ঘণ্টা দেশনা দেওয়ার নির্দেশ দিলেন। এটি ছিল অসম্ভব। পশ্চিমা ভিক্ষু হিসেবে কতটুকুই বা থাই ভাষা জানে সে? তখন আপনাকে একই কথা বার বার বলতে হবে। শ্রোতারা বিরক্ত। কিন্তু আপনার করার কিছু নেই। তৃতীয় ঘণ্টা শেষে বেশির ভাগ লোক উঠে চলে গেল, কয়েকজন যারা ছিল তারা নিজেদের মধ্যেই কথা বলছিল। এমনকি মশা ও টিকটিকিরাও ঘুমিয়ে গিয়েছিল।
তৃতীয় ঘণ্টা শেষে আজান চাহ্ আরও এক ঘণ্টা দেশনা দিতে বললেন! পশ্চিমা ভিক্ষুটি তার নির্দেশ পালন করল। সে বলেছিল যে, এমন একটা অভিজ্ঞতার পরে (দেশনাটা চার ঘণ্টা পরে তবেই শেষ হয়েছিল) যখন আপনি শ্রোতাদের প্রতিক্রিয়া যাচাই করতে যাবেন, তখন আর জনসমক্ষে বক্তৃতা দিতে ভয় পাবেন না।
এভাবেই আমরা মহান আজান চাহ্-র কাছ থেকে ট্রেনিং পেয়েছিলাম।
ব্যথার অন্যতম প্রধান উপাদান হচ্ছে ভয়। এটাই ব্যথাকে তীব্রতর করে। ভয়কে সরিয়ে দিন, কেবল অনুভূতিটা থাকবে।
১৯৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে উত্তরপূর্ব থাইল্যান্ডের দরিদ্র ও দুর্গম বনবিহারে আমার ভীষণ দাঁতের ব্যথা শুরু হয়। সেখানে না ছিল কোনো
ডেন্টিস্ট, না ছিল টেলিফোন, না ছিল বিদ্যুৎ। ওষুধের বাক্সে সামান্য প্যারাসিটামল পর্যন্ত ছিল না। বনভিক্ষুরা সহনশীল হবে, এটাই আশা করা হয়।
সন্ধ্যার পরে, অসুখের বেলায় সচরাচর যেমনটি হয় আর কি, দাঁতের ব্যথা তীব্র থেকে তীব্রতর হলো। আমি নিজেকে বেশ শক্তসমর্থ বনভিক্ষু ভাবতাম। কিন্তু এই দাঁতের ব্যথার কাছে আমার সামর্থ্যের অগিপ্ন রীক্ষা দিতে হলো। আমার মুখের একপাশ ব্যথায় শক্ত হয়ে গেল। এমন দাঁতের ব্যথা এই জনমে আর হয় নি। আমি শ্বাসপ্রশ্বাসের ধ্যানে বসে ব্যথা থেকে মুক্তি পেতে চাইলাম। আমি শিখেছিলাম, মশার কামড় সত্ত্বে ও কীভাবে শ্বাসপ্রশ্বাসে মনকে কেন্দ্রীভূত করা যায়। মাঝে মাঝে আমি এক থেকে চল্লিশ পর্যন্ত গুণতাম। একটা অনুভূতিতে মনোযোগ দিলে অন্য অনুভূতি আর থাকত না। কিন্তু এবারের ব্যথাটা ছিল অসাধারণ। আমি মাত্র দুই তিন সেকেন্ড শ্বাসপ্রশ্বাসে মনোযোগ দেওয়ার পরপরই ব্যথাটা আরও ভয়ংকর হয়ে ফিরে আসত।
আমি উঠে বসলাম, বাইরে গিয়ে চংক্রমণ করার চেষ্টা করলাম। খুব শীঘ্রই সেটাও বাদ দিতে হলো। আমি চংক্রমণ করছিলাম না, সত্যিকার অর্থেই
দৌঁড়াচ্ছিলাম, কোনোমতেই ধীরস্থির হয়ে হাঁটতে পারছিলাম না। ব্যথাটা আমাকে নিয়ন্ত্রন করছিল, এটা আমাকে দৌঁড়াতে বাধ্য করছিল। কিন্তু যাওয়ার কোনো জায়গা ছিল না। আমি ব্যথায় দিশেহারা হয়ে গিয়েছিলাম, কেবল পাগল হওয়া বাকি।
আমি দৌঁড়ে কুটিরে ঢুকে গেলাম। বসে পড়ে সূত্র আবৃত্তি শুরু করলাম। বৌদ্ধ সূত্রগুলো অলৌকিক শক্তি ধারণ করে বলে সবাই বলে। তারা আপনাকে
সৌভাগ্য এনে দিতে পারে, বিপদজনক প্রাণীগুলোকে দূরে রাখতে পারে, অসুখ ও ব্যথা ভালো করে দিতে পারে - এমনটিই বলা হয়। আমি সেটা বিশ্বাস
করতাম না। আমি বিজ্ঞানী হিসেবে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। যাদুকরী সূত্রগুলো সব ভুয়া, বুজরুকি। সেগুলো সহজ সরলদের জন্য যারা সবকিছু সহজে বিশ্বাস
করে। তাই আমি সূত্র আবৃত্তি শুরু করলাম এই অযৌক্তিক আশায় যে এতে কাজ হবে। আমি বেপরোয়া হয়ে গিয়েছিলাম। শীঘ্রই আমাকে সেটাও থামাতে হলো। আমি বুঝতে পারছিলাম আমি চিৎকার করে প্রত্যেকটি শব্দ উচ্চারণ করছি। তখন অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল, আমার ভয় ছিল অন্যরা না শুনে ফেলে!
যেভাবে তীব্র স্বরে সূত্র আবৃত্তি করছিলাম, তাতে মনে হয় কয়েক কিলোমিটার দূরের গ্রামের লোকজনকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলেছিলাম। ব্যথার শক্তি আমাকে স্বাভাবিকভাবে সূত্র আবৃত্তি করতে দেয় নি।
আমি ছিলাম একা, স্বদেশ থেকে হাজার মাইল দূরে, দুর্গম এক জঙ্গলে যেখানে কোনো সুযোগ-সুবিধা নেই, অসহ্য ব্যথা থেকে পালাবার কোনো পথ
নেই। আমি যা যা জানি সব চেষ্টা করেছিলাম, একেবারে সবকিছু। কিন্তু কোনো কিছুতেই কাজ হয় নি।
এমন বেপরোয়া মুহূতর্গুলো প্রজ্ঞার দরজাগুলোকে খুলে দেয়, স্বাভাবিক জীবনে যেগুলোর দেখা পাওয়া ভার। ঠিক সেই মুহূর্তে এমনই এক প্রজ্ঞার দরজা খুলে গিয়েছিল আমার সামনে এবং আমি সেই দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলাম। সত্যি কথা বলতে কী, আমার আর কোনো বিকল্প ছিল না।
আমার মনে পড়ল দুটো ছোট্ট শব্দ, ‘যেতে দাও’। আমি এই শব্দগুলো আগেও বহুবার শুনেছি। আমার বন্ধুদেরও এর ব্যাখ্যা করে দিয়েছি অনেকবার। আমি ভাবতাম এর অর্থ আমি জানি : মোহ এমনই হয়!
আমি যেকোনো কিছু চেষ্টা করে দেখতে রাজি ছিলাম, তাই আমি যেতে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। শতভাগ যেতে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। জীবনে প্রথমবারের মতো আমি সত্যিকার অর্থেই যেতে দিলাম।
পরে যা ঘটল তা আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিল। সেই ভয়ানক ব্যথাটা নিমেষেই উধাও হয়ে গেল। তার জায়গায় মনোহর এক সুখ জায়গা করে নিল। আনন্দের ঢেউ একটার পর একটা এসে আমার সারা শরীরকে ভাসিয়ে নিল। আমার মন গভীর প্রশান্তিতে ভরে গেল, এত শান্ত ও উপভোগ্য হলো যে বলার মতো নয়। আমি সহজেই এবং অনায়াসেই ধ্যানে বসলাম। ধ্যানের পরে আমি কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে শুয়ে পড়লাম, আর গভীর ও শান্তির একটা ঘুম দিলাম।
বিহারের দায়িত্ব ও কর্তব্যের জন্য যথাসময়ে যখন ঘুম থেকে জাগলাম, তখন খেয়াল করলাম যে আমার দাঁতে ব্যথা, কিন্তু সেটা গতরাতের তুলনায় কিছুই নয়।
আগের গল্পটাতে, দাঁতের ব্যথার যে ব্যথার ভয় সেই ভয়টাকেই আমি যেতে দিয়েছিলাম। আমি ব্যথাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছিলাম। এটিকে জড়িয়ে ধরে তাকে তার মতোই থাকতে দিয়েছিলাম। এজন্যই এটি চলে গিয়েছিল। আমার বন্ধুদের অনেকেই প্রচন্ড ব্যথার সময়ে এই পদ্ধতি কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছে, কিন্তু কোনো কাজে আসে নি। তারা আমার কাছে এসে অভিযোগ করে বলেছে যে আমার দাঁতের ব্যথা নাকি তাদের ব্যথার তুলনায় কিছু না। সেটা সত্যি নয়। ব্যথা ব্যক্তিগত এবং সেটা মাপা যায় না।
আমি তাদের নিচের তিন শিষ্যের গল্প দিয়ে ব্যাখ্যা করেছিলাম কেন যেতে দেওয়াটা তাদের বেলায় কাজ করেনি।
প্রথমশিষ্য প্রচন্ড ব্যথায় কাতর হয়ে যেতে দেওয়ার চেষ্টা করল। ‘যেতে দাও’ তারা ভদ্রভাবে বলে এবং অপেক্ষা করে।
‘যেতে দাও!’ যখন ব্যথার কোনো পরিবর্তন হচ্ছে না, তখন তারা আবার বলে।
‘শুধু যেতে দাও!’ ‘ওহ, যেতে দাও না!’
‘আমি বলছি, যেতে দাও!’ ‘যেতে দাও!’
মজার মনে হতে পারে, কিন্তু আমরা বেশির ভাগ সময় এমনই করে থাকি। আমরা ভুল জিনিসকে যেতে দিই। আমাদের যেতে দেওয়া উচিত, যে ‘যেতে
দাও’ বলছে তাকেই। আমাদের যেতে দেওয়া উচিত আমাদের মধ্যকার সেই খেপাটে নিয়ন্ত্রণ কারীকে। আমরা সবাই জানি কে সেই খেপাটে নিয়ন্ত্রণকারী।
যেতে দেওয়া মানে হচ্ছে ‘কোনো নিয়ন্ত্রণকারী নেই’।
দ্বিতীয় শিষ্য, ভয়ানক ব্যথায় এই উপদেশ স্মরণ করে নিয়ন্ত্রণকারীকে যেতে দিল। তারা ব্যথা সহ্য করেও বসে রইল, ধরে নিল যে তারা যেতে দিচ্ছে। দশ মিনিট পরে সেই একই ব্যথা। তাই তারা অভিযোগ করে যে যেতে দেওয়াতে কোনো কাজ হয় না। আমি তাদের বলি যে যেতে দেওয়াটা কোনো ব্যথার কবল থেকে মুক্ত হওয়ার পদ্ধতি নয়; বরং ব্যথা থেকে স্বাধীন হওয়ার পদ্ধতি। দ্বিতীয় শিষ্যটা ব্যথার সাথে একটা চুক্তি করার চেষ্টা করেছিল : ‘আমি দশ মিনিট ধরে যেতে দেব; আর হে ব্যথা, তুমি চলে যাবে, বুঝেছ?’
এটা ব্যথাকে যেতে দেওয়া নয়, ব্যথার কবল থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা।
তৃতীয় শিষ্য, ভয়ানক ব্যথায় জর্জরিত হয়ে ব্যথাকে এরূপ বলে : ‘হে ব্যথা, আমার হৃদয়ের দরজা তোমার জন্য খোলা, তুমি আমাকে যা কিছুই করো না
কেন। এসো, ভেতরে এসো।’
তৃতীয় শিষ্যটি ব্যথাকে যতক্ষণ ইচ্ছে ততক্ষণ থাকার অনুমতি দিয়েছিল, এমনকি সারা জীবন হলে সারা জীবন, আরও বেশি হয় হোক। তারা ব্যথাকে
স্বাধীনতা দিয়েছিল। তারা এটাকে নিয়ন্ত্রন করার চেষ্টা ত্যাগ করেছিল, অর্থাৎ যেতে দিয়েছিল। ব্যথা থাকল কি গেল, সেটা এখন তাদের কাছে একই জিনিস। কেবল তখনই ব্যথা চলে যায়।
আমাদের ভিক্ষুসংঘের একজনের দাঁত খুব খারাপ ছিল। তার অনেকগুলো দাঁত তুলে ফেলার প্রয়োজন হয়েছিল; কিন্তু এনেসথেশিয়া দিতে দেবে না সে কিছুতেই। অবশেষে অস্ট্রেলিয়ার পার্থ শহরে একজন ডেন্টাল সার্জন খুঁজে পাওয়া গেল যে এনেসথেশিয়া ছাড়াই তার দাঁতগুলো তুলে দেবে। সে কয়েকবার ওই ডাক্তারের কাছে গিয়েছিল দাঁত তুলতে, কোনোবারই সমস্যা হয় নি।
এনেসথেশিয়া ছাড়া দাঁত তুলতে দেওয়াটা বেশ সাহসের বটে, কিন্তু আরেক ব্যক্তি ছিল এর থেকে এক ডিগ্রি উপরে। সে নিজেই নিজের দাঁত তুলে ফেলেছিল কোনো এনেসথেশিয়া ছাড়া।
আমরা তাকে দেখেছিলাম আমাদের বিহারের যন্ত্রপাতির ঘরের বাইরে, প্লায়ার্সে তখন ধরা আছে তার রক্তমাখা দাঁত। কোনো সমস্যাই হয় নি। সে প্লায়ার্সটা ধুয়ে মুছে আবার যন্ত্রপাতির ঘরে রেখে দিয়েছিল।
আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সে কী করে এমন জিনিস করতে পারল।
সে যা বলল, তা থেকেই ব্যাখ্যা পাওয়া যায় কেন ভয় ব্যথার একটা প্রধান উপকরণ হিসেবে থাকে। সে বলল, ‘যখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম, দাঁতটা নিজেই তুলব, কেননা ডেন্টিস্টের কাছে যাওয়ার অনেক ঝক্কি ঝামেলা, সেই মুহূর্তে কোনো ব্যথা লাগে নি। যখন আমি প্লায়ার্সটা হাতে তুলে নিলাম, তখনো ব্যথা লাগে নি। যখন আমি প্লায়ার্স দিয়ে দাঁতটা ধরলাম শক্ত করে, তখনো ব্যথা লাগল না। যখন আমি প্লায়ার্সে মোচড় দিলাম এবং টান দিলাম, তখন ব্যথা লাগল, কিন্তু সেটা কয়েক সেকেন্ড মাত্র। যখন দাঁতটা বের করলাম, সেটা আর মোটেও এত ব্যথা করল না। পাঁচ সেকেন্ডের ব্যথা, এই আর কি!’
প্রিয় পাঠক, এই সত্যি ঘটনা পড়ে হয়তো ভয়ে মুখ বিকৃত করে ফেলেছেন।
সে যতটা না ব্যথা পেয়েছে, আপনি সম্ভবত তার থেকেও বেশি ব্যথা অনুভব করেছেন। যদি এমন কাজে আপনি চেষ্টা করতেন, তাহলে ভয়ানক ব্যথা লাগত। হয়তো যন্ত্রপাতির ঘরে গিয়ে প্লায়ার্স হাতে নেওয়ার আগেই আপনি ব্যথায় কাতর হয়ে পড়তেন। আশঙ্কা, ভয়-ব্যথার প্রধান উপাদান।
নিয়ন্ত্রণকারীকে যেতে দেওয়া, বর্তমান মুহূর্তের সাথে থাকা এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার প্রতি যা হয় হবে এমন খোলা একটা মনমানসিকতা নিয়ে থাকা আমাদের ভয়ের কারাগার থেকে মুক্তি দেয়। এটা আমাদের জীবনের চ্যালেঞ্জগুলোকে আমাদের নিজস্ব প্রজ্ঞা দিয়ে মোকাবেলা করতে শেখায় এবং অনেক অস্বস্তিকর অবস্থা থেকে বের করে নিয়ে যায় নিরাপদে।
শ্রীলঙ্কায় চমৎকার একটা ভ্রমণ শেষে সিঙ্গাপুর হয়ে অস্ট্রেলিয়া ফেরার সময় পার্থের বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনের ছয়টা লাইনের একটাতে দাঁড়িয়েছিলাম আমি। লাইনটা শম্বুক গতিতে এগোচ্ছিল, তার মানে খুব ভালোমতো চেক করা হচ্ছে সবাইকে।
একজন পুলিশ অফিসার কোত্থেকে উদয় হলো, সাথে আছে মাদকদ্রব্য ধরার জন্য প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছোট্ট একটা কুকুর। অফিসারটিকে কুকুর নিয়ে আসতে দেখে লাইনের লোকজন নার্ভাস ভঙ্গিতে হাসি হাসি মুখ করল, যদিও তাদের কাছে কোনো মাদকদ্রব্য ছিল না। কুকুরটি তাদের শোঁকার পরে যখন পরের জনের কাছে যাচ্ছিল, আপনি নিশ্চিতভাবেই তাদের দেখে বুঝতে পারবেন যে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে তারা। এতক্ষণ কী টেনশনই না করেছে!
যখন সেই সুন্দর ছোট্ট কুকুরটা আমার কাছে এসে শুঁকল, এটি থেমে দাঁড়াল। এটি তার নাকটা আমার কোমরের কাছে চীবরের ভেতর গুঁজে দিল এবং দ্রুত বড় বড় করে লেজ নাড়তে লাগল। কাস্টমস অফিসারটি কোনোমতে টেনেহিঁচড়ে কুকুরটিকে সরিয়ে নিয়ে গেল। লাইনে আমার সামনের লোকজন যারা এতক্ষণ বেশ বন্ধুভাবাপন্ন ছিল, এখন তারা এক পা দূরে সরে গেল। আমি নিশ্চিত, আমার পিছনের জুটিও এক পা পিছনে সরে গেল।
পাঁচ মিনিট পরে, আমি কাউন্টারের বেশ সামনে চলে আসলাম। তারা আবার শোঁক শোঁক করা কুকুরটাকে নিয়ে আসল। কুকুরটিকে প্রত্যেক লাইনের
সামনে থেকে পেছনে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। লাইনের প্রত্যেককে একটু করে শুঁকে আবার সামনে এগোল কুকুরটি। আমার কাছে এসে এটি আবার
থামল। এটি আমার চীবরে নাক গুঁজে দিয়ে প্রচন্ডভাবে লেজ নাড়তে শুরু করল। আবারও কাস্টমস অফিসারটিকে জোর করে কুকুরটিকে সরিয়ে নিতে হলো। আমি অনুভব করলাম, সবার চোখ এখন আমার দিকে। যদিও অনেকেই এ পর্যায়ে এসে কিছুটা উদ্বিগ্ন হতে পারত, আমি ছিলাম পুরোপুরি রিলাক্সড। যদি আমাকে জেলে যেতে হয়, তো ভালো। আমার সেখানে অনেক বন্ধু। আর তারা বিহারের চেয়েও ভালো করে খাওয়াবে আমাকে।
যখন আমি কাস্টমস চেক পয়েন্টে আসলাম, তারা আমাকে তন্ন তন্ন করে তল্লাশি করল। আমার কোনো ড্রাগস ছিল না। ভিক্ষুরা এমনকি মদও খায় না, ড্রাগ তো দূরের কথা। তারা অবশ্য আমাকে ন্যাংটা করে সার্চ করেনি। কারণটা, আমার মনে হয়, আমি কোনো ভয় পাওয়ার বা ঘাবড়ে যাওয়ার চিহ্ন দেখাই নি। তারা কেবল জিজ্ঞেস করেছিল, আমার কী মনে হয়, কেন কুকুরটি কেবল আমার কাছে এসে থেমে গেল। আমি বললাম যে ভিক্ষুরা প্রাণীদের প্রতি অত্যন্ত স্নেহপ্রবণ। হয়তো আমাকে শুঁকে কুকুরটি সেটাই বুঝেছে। অথবা হতে পারে, কুকুরটি অতীত জন্মে কোনো ভিক্ষু ছিল। তারা অতঃপর আমাকে ছেড়ে দিল।
আমি একবার খুব ক্রুদ্ধ ও অর্ধমাতাল এক বিশালদেহী আমেরিকানের ঘুষি খাওয়ার খুব কাছাকাছি চলে গিয়েছিলাম। নির্ভীক মনোভাব সেদিন আমাকে ও আমার নাকটাকে বাঁচিয়েছিল।
আমরা সবেমাত্র আমাদের নতুন শহরের বিহারে চলে এসেছি, পার্থ শহরের সামান্য উত্তরে। নতুন বিহারের জমকালো উদ্বোধন করতে যাচ্ছি আমরা। অবাক করা খুশির খবর এই যে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার তৎকালীন গভর্নর স্যার গর্ডন রীড ও তার স্ত্রী আমাদের অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছেন।
আমাকে উঠোনের সাজসজ্জা এবং অতিথি ও ভিআইপিদের চেয়ারগুলো ম্যানেজ করার দায়িত্ব দেওয়া হলো। আমাদের কোষাধ্যক্ষ পই পই করে বলে দিলেন সবচেয়ে ভালো জিনিসপত্র জোগাড় করতে। আমরা খুব ভালো একটা বিহার উদ্বোধনী অনুষ্ঠান করতে চাই।
সামান্য খোঁজাখুঁজির পর খুব ব্যয়বহুল একটা কোম্পানিকে খুঁজে পেলাম আমি। এটা পার্থের পশ্চিমে ধনী আবাসিক এলাকায় অবস্থিত। তারা
কোটিপতিদের বাগানে পার্টির জন্য সাজসজ্জা ভাড়া দিয়ে থাকে। আমি তাদের বললাম, আমি কী চাই এবং কেন এটা খুব ভালো হতে হবে। আমি যে মহিলার সাথে কথা বলেছিলাম, সে বলল যে সে সবকিছু বুঝেছে, তাই অর্ডারটা তাদেরই দেওয়া হলো।
শুক্রবার বিকেলে যখন সাজসজ্জা ও চেয়ারগুলো পৌঁছাল, আমি তখন আমাদের নতুন বিহারের পেছনে একজনকে সাহায্য করছিলাম। যখন মালপত্রগুলো দেখতে আসলাম, তখন ডেলিভারি দিতে আসা ট্রাক ও লোকজন সব চলে গেছে।
আমি সাজসজ্জার বেহাল দশা দেখে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। সেগুলো লাল লাল ধুলোয় ঢাকা পড়ে আছে। আমি অসন্তুষ্ট হয়ে গেলাম, তবে সমস্যাটা ঠিক করা যাবে। আমরা সাজসজ্জাগুলো সাজিয়ে রাখতে শুরু করলাম। এরপর আমি অতিথিদের চেয়ারগুলো চেক করলাম। সেগুলোর অবস্থাও তথৈবচ।
চেয়ারের ফুটো দিয়ে ভেতরের ফোম, ছেঁড়া ন্যাকড়া সব বেরিয়ে এসেছে। আমার অমূল্য ভলান্টিয়াররা সেগুলোর প্রত্যেকটিকে পরিষ্কার করতে শুরু করল। অবশেষে আমি ভিআইপিদের জন্য আনা স্পেশাল চেয়ারগুলো দেখলাম।
সেগুলো ছিল আসলেই স্পেশাল। একটা চেয়ারেরও পাগুলো সমান ছিল না! সবগুলো চেয়ার ছিল নড়বড়ে, প্রচুর নড়বড়ে, একটাও ঠিকমতো বসে না।
অবিশ্বাস্য কান্ড! খুব বাড়াবাড়ি হয়ে গেছে এটা। আমি ফোনের কাছে দৌঁড় গেলাম। সেই ভাড়াটে কোম্পানিকে ফোন করলাম এবং সেই মহিলাকে পেলাম,
যে সাপ্তাহিক ছুটিতে চলে যাওয়ার প্রস্ত্ততি নিচ্ছিল। আমি অবস্থাটা ব্যাখ্যা করলাম। জোর গলায় বললাম যে অনুষ্ঠান চলাকালে আমরা পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার গভর্নরকে এমন নড়বড়ে চেয়ারে দুলতে দিতে পারি না। যদি তিনি পড়ে যান, তো কী হবে? সে ব্যাপারটা বুঝল, ক্ষমা চাইল এবং আশ্বস্ত করল যে ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই সে চেয়ারগুলো পাল্টানোর ব্যবস্থা করবে।
এবার আমি ডেলিভারি ট্রাকের অপেক্ষায় রইলাম। আমি সেটাকে মোড় ঘুরে আসতে দেখলাম। অর্ধেক পথও পেরোয় নি, বিহার থেকে প্রায় ষাট মিটার দূরে থাকতেই, ট্রাকটা তখনো বেশ দ্রুতগতিতে চলছিল, সেই অবস্থাতেই তাদের একজন ট্রাক থেকে লাফিয়ে নামল এবং আমার দিকে ঘুষি উঁচিয়ে তেড়ে আসল।
সে চিৎকার করল, ‘এখানকার দায়িত্বে আছে কোন ব্যাটা? আমি সেই ব্যাটাকে দেখতে চাই।’
পরে আমি জেনেছিলাম যে আমাদের প্রথমঅর্ডারটা ছিল তাদের জন্য সপ্তাহের শেষ ডেলিভারি। আমাদের মাল ডেলিভারি দেওয়ার পরে তাদের
লোকেরা বাক্স পেটরা গুছিয়ে মদের দোকানে ঢুকে সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতে শুরু করে দিয়েছিল। তাদের মদ্যপান নিশ্চয়ই অনেক দূর এগিয়েছিল, যখন কোম্পানির ম্যানেজার এসে তাদের আবার কাজে ফেরার নির্দেশ দিল। বুড্ডিস্টদের চেয়ারগুলো বদলে দিতে হবে।
আমি সেই লোকটার কাছে এগিয়ে গেলাম এবং ভদ্রভাবে বললাম, ‘আমিই এখানকার দায়িত্বে থাকা ব্যাটা ছেলে। কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’
সে তার মুখটা আমার কাছে নিয়ে এলো, তার ডান হাতের ঘুষি তখনো উদ্যত, আমার নাকের ডগা থেকে সামান্য দূরে। তার চোখগুলো রাগে জ্বলছিল। কয়েক ইঞ্চি দূরে থাকা তার মুখ থেকে বিয়ারের তীব্র গন্ধ ভেসে এলো। আমি শুধু রিলাক্সড ছিলাম।
আমার সেই তথাকথিত বন্ধুরা চেয়ার পরিষ্কারের কাজ ফেলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল শুধু। তাদের একজনও আমাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো না। অনেক ধন্যবাদ, বন্ধুরা! আমাদের এই মুখোমুখি থাকাটা কয়েক মিনিট স্থায়ী হলো। যা ঘটছিল তাতে আমি মুগ্ধ হয়ে গেলাম। সেই রাগী কর্মচারীটা আমার নির্বিকার প্রতিক্রিয়ার সামনে একেবারে ঠান্ডা হয়ে গেল। তার চিরাচরিত অভ্যাস শুধু ভয় পেতে বা রুখে দাঁড়াতে দেখতে অভ্যস্ত ছিল। তার মস্তিষ্ক জানত না এমন একজন ব্যক্তির প্রতি কীভাবে সাড়া দেবে যে তার নাকের সামনে উদ্যত ঘুষি দেখেও নির্বিকার থাকে। আমি জানতাম, সে আমাকে ঘুষিও মারতে পারবে না, সরে যেতেও পারবে না। আমার নির্ভীকতা তাকে হতবুদ্ধি করে তুলেছিল। এই কয়েক মিনিটে ট্রাকটা পার্ক করে তার বস আমাদের দিকে এগিয়ে গেল। সে তার জমে যাওয়া কর্মচারীর কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘এসো, চেয়ারগুলো নামাই।’ এতে অচলাবস্থা ভাঙলো, উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার একটা পথ তৈরি হলো তার জন্য।
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, আমিও আপনাদের সাহায্য করব।’ আর আমরা একসাথে চেয়ারগুলো নামালাম।