ষষ্ঠ অধ্যায়

কঠিন সমস্যা ও মৈত্রীময় সমাধান

কর্ম নিয়ম

বেশির ভাগ পশ্চিমা লোক কর্ম নিয়মটাকে ভুলভাবে বোঝে। তারা এটাকে অদৃষ্টবাদের সাথে ভুল করে, যারা মনে করে কোনো ব্যক্তি তার ভুলে যাওয়া অতীত জন্মের কোনো অজানা অপরাধের জন্য নিশ্চিত শাস্তি পাবে। ব্যাপারটা যে সেরকম নয়, তা আমরা নিচের গল্প থেকে বুঝতে পারি।

 

দুজন মহিলা প্রত্যেকেই একটা করে কেক বানাচ্ছিল।

প্রথম মহিলার মালমশলা ছিল খুব খারাপ মানের। তার সাদা পুরনো ময়দা থেকে সবুজ ছত্রাকের টুকরোগুলো বেছে নিয়ে ফেলে দিতে হলো।

কোলেস্টেরলে ভরা মাখন পঁচে দুর্গন্ধ হয়ে গেছে। সাদা চিনির দানাগুলো থেকে বাদামী দলাগুলো ফেলে দিতে হলো (কারণ, কেউ ওখানে কফির চামচ ডুবিয়েছিল)। আর তার ফলমূল বলতে ছিল পুরনো হয়ে যাওয়া কিসমিস, সেগুলো এমন শক্ত হয়ে গিয়েছিল যেন ক্ষয় হয়ে যাওয়া ইউরেনিয়ামের অবশিষ্ট অংশ। আর তার রান্নাঘরের সরঞ্জামগুলোও ছিল বিশ্বযুদ্ধের আগের আমলের স্টাইলের; তবে সেটা কোন বিশ্বযুদ্ধ, তা অবশ্য তর্কের বিষয়।

 

দ্বিতীয় মহিলাটির সব মালমশলা ছিল সবচেয়ে ভালোটা। তার ছিল প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো সম্পূর্ণ খাঁটি এবং গ্যারান্টিযুক্ত গমের ময়দা। মাখন হিসেবে ছিল কোলেস্টেরলমুক্ত মাজারিন। সাথে ছিল কাঁচা চিনি, আর নিজস্ব বাগানে জন্মানো রসালো ফল। তার রান্নাঘরটাও ছিল অত্যাধুনিক সব সরঞ্জাম দিয়ে সাজানো।

 

কোন মহিলা সবচেয়ে ভালো কেক বানিয়েছিল? যার মালমশলা ভালো, সে প্রায়ই ভালো কেক প্রস্তুতকারী হয় না। কেক বানানোতে মালমশলার চেয়েও

বেশি কিছু লাগে। মাঝে মাঝে এমন হয়, খারাপ মালমশলা হলেও কেক প্রস্তুতকারী সেগুলোর সাথে এত শ্রম, যত্ন ও ভালোবাসা ঢেলে দেয় যে, তার

কেকগুলোই সবচেয়ে সুস্বাদু হয়। মালমশলা দিয়ে আমরা কী করি, সেটাই এর কারণ।

 

আমার কয়েকজন বন্ধু আছে যাদের জীবনের মালমশলাগুলো ছিল খুব শোচনীয়। তারা দারিদ্রের মধ্যে জন্ম নিয়েছিল, শিশু হিসেবে নির্যাতিত হয়েছিল,

স্কুলে তেমন চালাক চতুর ছিল না, হয়তো বিকলাঙ্গ এবং খেলাধুলাও করতে পারত না। কিন্তু কয়েকটা গুণ - যা তাদের মধ্যে ছিল - তারা সেগুলোকে

এমনভাবে কাজে লাগিয়েছে যে, তারা সত্যিই তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো একটা কেক বানিয়েছে। আমি তাদের খুব প্রশংসা করি। আপনি কি এমন

লোকদের চেনেন?

 

আমার অন্যান্য বন্ধুরাও আছে যাদের জীবনের জন্য চমৎকার মালমশলা ছিল। তাদের জন্ম হয়েছিল সম্ভ্রান্ত ও ধনী পরিবারে, স্কুলে তারা ছিল খুব বুদ্ধিমান, খেলাধুলায় তুখোড়, চেহারাও সুন্দর, সবার কাছে জনপ্রিয়; কিন্তু তাদের তরুণ জীবন তারা নষ্ট করেছে নেশা বা মদে। আপনি কি এমন কাউকে

চেনেন?

 

কর্মের অর্ধেকটা হচ্ছে সেই মালমশলাগুলো, যেগুলো দিয়ে আমাদের কাজ করতে হয়। আর বাকি অর্ধেকটা, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশটা হচ্ছে, সেগুলো নিয়ে আমরা কী করি এই জীবনে।

 

বেরোবার কোনো পথ না থাকলে চা খান

আমাদের দিনের মালমশলাগুলো নিয়ে আমরা সব সময়ই কিছু না কিছু করতে পারি, তা যদি হয় শুধু বসে থাকা, আর শেষ চায়ের কাপে চুমুক দেওয়া, তাও আমরা করতে পারি। নিচের গল্পটা আমার স্কুল টিচার থাকাকালীন আমাকে বলেছিল এক সহকর্মী শিক্ষক, যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ আর্মিতে কাজ করেছিল।

 

সে তখন বার্মার জঙ্গলে তার দলের সাথে ঘুরে ঘুরে শত্রুর গতিবিধি অনুসন্ধান করছিল। তখন সে ছিল বয়সে তরুণ, বাড়ি থেকে অনেক দূরে, আর খুব ভীত। তার দলের স্কাউট তাদের ক্যাপ্টেনকে একটা সাংঘাতিক খবর দিল। তাদের ছোট্ট অনুসন্ধানী সেনাদল বিশাল সংখ্যক জাপানি সেনার মুখে পড়েছে। জাপানি সৈন্যদের সংখ্যার তুলনায় তাদের ছোট্ট দলটা কিছুই নয়, তদুপরি আবার চারদিক থেকে ঘেরাও হয়ে পড়েছে। তরুণ ব্রিটিশ সৈন্য নিজেকে নিশ্চিত মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত করল।

 

সে আশা করেছিল, তাদের ক্যাপ্টেন তার লোকদের লড়াই করে এই ঘেরাও অবস্থা থেকে বেরোবার একটা পথ বানাতে বলবে, সেটাই বীরত্বের কাজ। তাতে অন্তত কেউ কেউ বেরিয়ে যেতে পারবে। যদি না হয়, তো ঠিক আছে। মরার সময় কয়েকজন শত্রুসেনাকে নিয়ে মরবে। সেটাই তো সৈন্যরা করে।

কিন্তু ক্যাপ্টেন এমন সৈন্য ছিল না। সে তার লোকদের চুপ করে বসে থাকতে বলল, আর এক কাপ করে চা বানাতে বলল। এত কিছু সত্তেও - তারা ব্রিটিশ সৈন্য কিনা!

 

তরুণ সৈন্যটি ভাবল, তার কমান্ডিং অফিসারের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। শত্রু চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে, পালাবার কোনো পথ নেই, মরতে বসেছে, এমন অবস্থায় কীভাবে কোনো লোক এক কাপ চায়ের কথা ভাবতে পারে? আর্মিতে, বিশেষ করে যুদ্ধের সময়, অর্ডার মানতে হয়। তারা সবাই তাদের শেষ চা বানাল এক কাপ করে। চা খেয়ে শেষ করার আগেই স্কাউট আবার ফিরে এলো, আর ক্যাপ্টেনের কানে কানে ফিস ফিস করল। ক্যাপ্টেন তার লোকদের দৃষ্টি আকষর্ণ করে বলল, ‘শত্রুরা সরে গেছে। বেরোনোর একটা পথ পাওয়া গেছে। তোমাদের জিনিসপত্র গুছাও তাড়াতাড়ি এবং নিঃশব্দে। এবার চলো, যাওয়া যাক!’ তারা সবাই নিরাপদে বেরিয়ে এলো। এ কারণেই সে বহু বছর পরে এই গল্পটা আমাকে বলতে পেরেছিল। সে বলেছিল যে তার জীবন তার ক্যাপ্টেনের প্রজ্ঞার কাছে ঋণী, কেবল সেই বার্মার যুদ্ধে নয়, তখন থেকে আরও অনেকবার। তার জীবনে অনেক বার এমন হয়েছে যেন সে চারদিক থেকে শত্রু দ্বারা বেষ্টিত, তাদের সংখ্যা অনেক, বেরোবার কোনো পথ নেই, মরণ সন্নিকটে। শত্রু বলতে সে বুঝিয়েছিল মারাত্মক কোনো অসুস্থতা, ঘোর বিপদ এবং নিদারুণ শোক, আপাতদৃষ্টিতে যার মাঝখান থেকে বের হওয়ার কোনো পথ নেই। বার্মার অভিজ্ঞতা না হলে, সে এসব সমস্যার সাথে লড়াই করে বেরোবার চেষ্টা করত। কিন্তু কোনো সন্দেহ নেই, সমস্যাটা তখন আরও জটিল হয়ে উঠত। তার বদলে মৃত্যু বা মারাত্মক ঝামেলা এসে যখন তাকে ঘিরে ধরেছে, সে তখন বসে বসে এক কাপ চা বানিয়েছে।

 

এই পৃথিবী সব সময় বদলে যাচ্ছে। জীবন নিয়ত প্রবহমান। সে তার চা খেয়েছে, তার শক্তিগুলোকে সুসংহত করেছে, আর সঠিক সময়ের জন্য অপেক্ষা করেছে, যা সব সময়ই এসেছে। তখন সে কার্যকর কিছু একটা করেছে, যেমন, পালিয়েছে।

 

যারা চা পান করেন না, তারা এই প্রবাদটা মনে রাখুন : ‘যখন করার কিছু নেই, তখন কিছুই করো না।’

এটা হয়তো খুব সরল মনে হতে পারে। কিন্তু এটা হয়তো আপনার জীবনকে বাঁচাতে পারে।

 

স্রোতের সাথে চলা

একজন জ্ঞানী ভিক্ষুকে আমি অনেক বছর ধরে চিনি। সে একবার তার এক পুরনো দোস্তকে নিয়ে কোনো বৈচিত্র্যময় জঙ্গলে ঘুরতে বেরিয়েছিল। পড়ন্ত বিকেলে তারা একটা নির্জন সাগরতীরে পৌঁছল। যদিও ভিক্ষুদের নিয়ম আছে, মজা বা উপভোগের জন্য সাঁতার কাটা যাবে না। কিন্তু নীল সাগর যেন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল। জঙ্গলে এতক্ষণ ধরে হাঁটাহাঁটি করে এখন তার দরকার ছিল শরীরটাকে জুড়ানো। তাই সে কাপড়চোপড় খুলে সাঁতার কাটতে নেমে গেল। ভিক্ষু হওয়ার আগে, তরুণ বয়সে, সে ছিল একজন দক্ষ সাঁতারু। অনেক বছর হলো সে ভিক্ষু হয়েছে, সর্বশেষ সাঁতার কেটেছে সেই কোন আমলে। ঢেউয়ের মাঝে দুএক মিনিট সাঁতার কাটার পরে সে একটা চোরা স্রোতের কবলে পড়ল। সেই স্রোত তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে শুরু করল সাগরের দিকে।

 

সে পরে আমাকে বলেছিল যে, এটা ছিল খুব বিপদজনক একটা সৈকত, কেননা এর স্রোতগুলো ছিল সাংঘাতিক।

প্রথমে ভিক্ষুটি স্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটার চেষ্টা করল। কিন্তু শীঘ্রই সে বুঝতে পারল, স্রোতের শক্তির সাথে পেরে ওঠা তার পক্ষে অসম্ভব। ভিক্ষুর

ট্রেনিং এখন তাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলো। সে রিল্যাক্সড হলো, আর স্রোতের সাথে ভেসে গেল। এমন পরিস্থিতিতে রিল্যাক্সড হয়ে সাগরে ভেসে যাওয়াটা ছিল রীতিমতো দুঃসাহসিক ব্যাপার, বিশেষ করে যখন সে দেখছিল যে সাগরের তীর দূর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। বহু শত মিটার ভাসিয়ে নিয়ে তবেই জোয়ারের স্রোত মিলিয়ে গেল। কেবল তখনই সে জোয়ারের স্রোত থেকে দূরে সরে গিয়ে তীরের দিকে সাঁতরাতে শুরু করল।

 

সে আমাকে বলেছিল যে, সাঁতার কেটে তীরে ফিরে আসতে তাকে শক্তির প্রতিটি বিন্দু খরচ করতে হয়েছিল। সে তীরে এসে পৌঁছাল পুরো বিধ্বস্ত হয়ে।

সে নিশ্চিত ছিল যে, স্রোতের বিরুদ্ধে লড়াই করলে নির্ঘাত পরাজিত হতো সে।

 

সে সাগরে গিয়ে পড়তই; কিন্তু লড়াই করে শক্তিহীন হওয়াতে আর তীরে ফিরে আসা সম্ভব হতো না তার। যদি সে যেতে না দিয়ে, স্রোতের সাথে ভেসে না

যেত, তাহলে নিশ্চিতভাবেই ডুবে মরত।

 

এমন ঘটনা সেই প্রবাদটিকে মনে করিয়ে দেয়, ‘যেখানে কিছু করার থাকে না, সেখানে কিছুই করো না।’ এটা কোনো কাল্পনিক তত্ত্ব নয়, বরং বিপদের সময় জীবন বাঁচানোর মতো প্রজ্ঞার জন্ম দেয়। যখন স্রোত আপনার চেয়ে শক্তিশালী হয়, তখনই স্রোতের সাথে চলার সময়। যখন আপনি কাজ করতে সক্ষম, তখনই আপনার প্রচেষ্টা চালানোর সময়।

 

বাঘ ও সাপের মাঝে আটকে পড়া

একটা প্রাচীন বৌদ্ধ কাহিনী আছে যা জীবন-মরণের সংকট থেকে আমরা কীভাবে উদ্ধার পেতে পারি, তার শিক্ষা দেয়।

কোনো এক জঙ্গলে এক ব্যক্তিকে একটি বাঘ তাড়া করছিল। বাঘ মানুষের চেয়ে দ্রুত দৌঁড়াতে পারে, আর তারা মানুষ খায়। বাঘটি যেহেতু ক্ষুধার্ত ছিল, তাই লোকটি বেশ বিপদে পড়ে গেল। বাঘটি তাকে প্রায় ধরে ফেলেছে, এ সময় সে দেখল পথের পাশে একটা কুয়ো। সাত-পাঁচ না ভেবে সে দিল কুয়াতে লাফ। কিন্তু লাফ দেয়ার আগ মুহূর্তে দেখল কত বড় ভুল করল সে। কুয়োটি ছিল শুকনো, আর তার তলায় কুন্ডলী পাকিয়ে ছিল বিশাল এক কালো সাপ।

নিজের অজান্তেই সে হাত দিয়ে কুয়োর দেয়াল ধরে পতন রোধের চেষ্টা করল। এ সময় তার হাতে ঠেকল একটা গাছের শেকড়। শেকড়টা ধরে সে

কোনোমতে কুয়োর তলায় পড়ে যাওয়াটা রোধ করল। একটু পরে ধাতস্থ হয়ে নিচে তাকিয়ে দেখল, সাপটি তার ফণা তুলে তার পায়ে ছোবল দেয়ার চেষ্টা করছে; কিন্তু একটুর জন্য নাগাল পাচ্ছে না।

উপরে তাকিয়ে দেখল বাঘটি কুয়োর ভেতরে ঝুঁকে থাবা চালিয়ে তাকে ধরার চেষ্টা করছে; কিন্তু একটুর জন্য নাগাল পাচ্ছে না। এই চরম বিপদের মুহূর্তে সে দেখল একটা গর্ত থেকে একটা কালো ও একটা সাদা রঙের ইঁদুর বের হয়ে সে যে শেকড়টা ধরে আছে, সেটাকে কামড়ানো শুরু করেছে।

 

বাঘটি যখন কুয়োর ভেতর থাবা চালিয়ে লোকটিকে ধরার চেষ্টা করছিল, তখন তার শরীরটা ঘষা খাচ্ছিল কুয়োর পাড়ের একটা ছোট গাছের সাথে। ফলে গাছটি ঝাঁকুনি খাচ্ছিল একটু একটু। সেই গাছের একটা ডাল কুয়োর উপরে ঝুলে ছিল, যাতে ছিল একটা মৌচাক। ঝাঁকুনির ফলে বিন্দু বিন্দু মধু পড়ছিল কুয়োর মধ্যে। লোকটি জিহবা বের করে কয়েক ফোঁটা চেতে দেখল।

 

‘উম্ম! দারুণ স্বাদ তো!’ সে মনে মনে ভাবল এবং হাসল।

 

এই গল্পের এখানেই শেষ। এজন্যই এটা আমাদের জীবনেও সত্যি। আমাদের জীবনেরও কোনো সুস্পষ্ট পরিসমাপ্তি নেই। বরং এই সমাপ্তির

প্রক্রিয়াটি অনন্তকাল ধরে প্রবহমান।

 

অধিকন্তু আমাদের জীবনটা যেন ক্ষুধার্ত বাঘ ও বিশাল কালো সাপের মাঝে আটকা পড়ে আছে। মৃত্যু এবং তার চেয়েও খারাপ কিছুর মধ্যে। যেখানে রাত ও দিন (ইঁদুর দুটি) আমাদের জীবনের আয়ুকে চিবিয়ে খেয়ে ফেলছে প্রতিনিয়ত। এমন চরম সংকটেও সব সময় কিছু মধু ঝরে পড়ে ফোঁটায় ফোঁটায়।

 

আমরা জ্ঞানী হলে আমাদের জিহবা বের করে সেই মধুর স্বাদ কিছুটা নিতে পারি। কেন নয়? করার যখন কিছু নেই, তখন কিছুই করবেন না। বরং জীবনের মধুর স্বাদ কিছুটা উপভোগ করুন।

 

গল্পটা বৌদ্ধ ঐতিহ্যমতে এখানেই শেষ। তবে আরও অর্থবহ করে তোলার জন্য আমি সাধারণত এর একটা সত্যিকারের পরিসমাপ্তি টেনে দিই। পরে যা ঘটে তা এ রকম : লোকটা যখন মধুর স্বাদ আস্বাদনে ব্যস্ত ইঁদুরগুলো দাঁত দিয়ে কেটে কেটে শেকড়টাকে আরও পাতলা করছে, সাপটি ফণা উচিয়ে

লোকটির পায়ের আরও কাছাকাছি চলে আসছে, বাঘটি আরও ঝুঁকে পড়ছে, আরেকটু হলেই লোকটির নাগাল পেয়ে যাবে। কিন্তু বাঘটা একটু বেশিই ঝুঁকল, ফলে এটি কুয়োর মধ্যে পড়ে গেল। লোকটাকে নাগালে না পেয়ে সে সোজা সাপটির উপর পড়ে গিয়ে নিজেও মরল, সাপটিকেও মেরে ফেলল।

 

জ্বি হ্যাঁ, এমনটা ঘটতেই পারে! সাধারণত অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাই ঘটে থাকে জীবনে। আমাদের জীবনটা এমনই। তাই মধুর ক্ষণগুলোকে কেন নষ্ট করা, এমনকি দিশেহারা কোনো বিপদের সময়েও? ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। আমরা কখনোই নিশ্চিত নই, এর পরে কী আসছে!

 

জীবনের জন্য উপদেশ

উপরের গল্পে বাঘ ও সাপ যখন উভয়েই মরে গেল, এখন লোকটার কিছু একটা করার সময়। সে মধু উপভোগ করা থামিয়ে, চেষ্টা চালিয়ে কুয়োর উপরে উঠে এলো, আর নিরাপদে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে এলো। জীবনটা যে সব সময় শুধু কিছু না করে মধু উপভোগ করার, তাও নয়।

 

সিডনির একজন তরুণ আমাকে বলেছিল যে, সে একবার থাইল্যান্ডে গিয়ে আমার গুরু আজান চাহ-র সাথে দেখা করেছিল, আর জীবনের সেরা উপদেশটি লাভ করেছিল তার কাছ থেকে। বৌদ্ধধর্মে আগ্রহী অনেক পশ্চিমা তরুণ ১৯৮০ সালের দিকে আজান চাহ-র নাম শুনেছিল। এই তরুণটি থাইল্যান্ডে একটা লম্বা ভ্রমণের সিদ্ধান্ত নিল। উদ্দেশ্য একটাই, সেই মহান ভিক্ষুর সাথে দেখা করবে, এবং তাকে কিছু প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে।

 

এটা ছিল দীর্ঘ সফর। সিডনি থেকে ব্যাংককে পৌঁছাতে তার আট ঘণ্টা লাগল। সেখান থেকে রাতের ট্রেনে আরও দশ ঘণ্টা লাগল উবন শহরে

পৌঁছাতে। সেখানে পৌঁছে সে আজান চাহ-র বিহার ওয়াট পাহ্ পং-এ যাওয়ার জন্য একটা ট্যাক্সি ভাড়া করল। ক্লান্ত কিন্তু উজ্জীবিত, সে অবশেষে আজান চাহ-র কুটিরে পৌঁছল।

 

গুরু হিসেবে আজান চাহ্ ছিলেন বিখ্যাত। তিনি বরাবরের মতোই তার কুটিরে বসে ছিলেন। তার চারপাশে ঘিরে ছিল অনেক ভিক্ষু ও জেনারেল, গরিব কৃষক ও ধনী ব্যবসায়ী, গ্রামের ছেঁড়া কাপড় পরা মেয়ে ও ব্যাংককের সুন্দর পোশাকের মহিলা, সবাই পাশাপাশি বসা। আজান চাহ-র কুটিরে কোনো ভেদাভেদ নেই।

 

অস্ট্রেলিয়ান যুবকটা সেই বিরাট জনতার একধারে বসে পড়ল। দু ঘণ্টা কেটে গেল। আজান চাহ্ তাকে খেয়ালও করেন নি। তার সামনে আরও অনেক

লোক। হতাশ হয়ে সে উঠে চলে গেল সেখান থেকে।

 

বিহারের প্রধান গেটে যাওয়ার সময় সে দেখল ঘণ্টা বাজানোর মন্দিরে কিছু ভিক্ষু উঠোন ঝাড়ু দিচ্ছে। গেটে তাকে নিতে আসবে যে ট্যাক্সিটা, সেটা আসতে আরও ঘণ্টাখানেক বাকি। তাই সেও হাতে একটা ঝাড়ু তুলে নিল এই ভেবে যে, অন্তত কিছু পুণ্যকর্ম করে যাই।

 

প্রায় আধ ঘণ্টা পরে, সে যখন ঝাড়ু দিতে ব্যস্ত অনুভব করল যে কেউ একজন তার কাঁধে হাত রাখল। সে ঘুরে দাঁড়িয়ে অবাক ও যারপরনাই খুশি হয়ে

দেখল যে হাতের মালিক আজান চাহ্ তার সামনে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছেন। আজান চাহ্ এই পশ্চিমা তরুণটিকে দেখেছিলেন আগেই, কিন্তু তাকে সেটা বলার কোনো সুযোগ তখন ছিল না। এখন তিনি আরেকটা কাজে বিহারের বাইরে চলে যাচ্ছেন। তাই তিনি এত কষ্ট করে সিডনি থেকে আসা এই তরুণের সামনে একটু দাঁড়ালেন তাকে একটা উপহার দেওয়ার জন্য। তিনি থাই ভাষায় দ্রুত কিছু একটা বলে তার কাজে চলে গেলেন।

 

এক অনুবাদক ভিক্ষু তাকে বলে দিল, ‘আজান চাহ্ বলেছেন যে, যদি তুমি ঝাড়ু দাও, তো তোমার যা কিছু আছে, তার সবকিছু নিয়েই ঝাড়ু দাও।’ এরপর

সেই অনুবাদক ভিক্ষুও গিয়ে আজান চাহ-র সাথে যোগ দিল।

 

তরুণটি অস্ট্রেলিয়া ফেরার দীর্ঘ যাত্রায় সেই ছোট্ট শিক্ষাটা নিয়ে ভাবল। সে নিশ্চিত বুঝতে পারল যে, আজান চাহ্ তাকে শুধু কীভাবে ঝাড়ু দিতে হয় তা

শেখান নি; বরং এর থেকে ঢের বেশি শেখাতে চেয়েছেন। এর অর্থটা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল।

 

‘তুমি যা-ই করো না কেন, তোমার সবকিছু নিয়েই সেটি করো।’

 

সে অস্ট্রেলিয়া ফেরার কয়েক বছর পরে আমাকে বলেছিল যে, এই ‘জীবনের জন্য উপদেশ’ ছিল এমন শতবার দীর্ঘ সফরের মূল্যের সমান। এটাই এখন সে মেনে চলে, এবং এটা তাকে সুখ ও সফলতা এনে দিয়েছে। যখন সে কাজ করত, সে তার সবকিছু ঢেলে দিত তার কাজে। সে যখন বিশ্রাম নিত,

তার সবকিছু নিয়েই সে বিশ্রাম নিত। যখন সে সামাজিক কাজে ব্যস্ত থাকত, সে তার সবকিছু সমাজের কাজে ঢেলে দিত। এটা ছিল সফলতার মন্ত্র।আর আরেকটা কথা, যখন সে কিছুই করত না, সে তার যা কিছু আছে, কোনো কিছুই সেখানে দিত না।

 

কোন সমস্যা?

ফরাসি দার্শনিক গণিতজ্ঞ ব্লেইস প্যাসকেল (১৬২৩-৬২) একবার বলেছিলেন :

‘মানুষের যত ঝামেলা আসে কীভাবে শান্ত হয়ে বসে থাকতে হয় তা না জানা থেকে।’

 

আমি এর সাথে আরও যোগ করব : ‘... আর কখন শান্ত হয়ে বসে থাকতে হয় তা না জানা থেকে।’

 

১৯৬৭ সালে ইসরায়েল তখন মিসর, সিরিয়া ও জর্ডানের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত।

 

সেই যুদ্ধ, যা পরবর্তীকালে ‘ছয় দিনের যুদ্ধ’ নামে পরিচিতি লাভ করে, তার মাঝামাঝি সময়ে এক সাংবাদিক প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড ম্যাকমিলানকে জিজ্ঞেস করেছিল যে মধ্যপ্রাচ্যের সমস্যাটা সম্পর্কে তিনি কী ভাবেন।

 

কোনো ইতস্তত ছাড়াই, এই বয়োবৃদ্ধ রাজনীতিক উত্তর দিলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে কোনো সমস্যা নেই।’ সাংবাদিক তো হতভম্ভ ‘মধ্যপ্রাচ্যে কোনো সমস্যা নেই মানে কী বলতে চান আপনি?’ সে জানতে চাইল। ‘আপনি কী জানেন না সেখানে এখন ঘোরতর যুদ্ধ চলছে? আপনি কী বুঝতে পারছেন না, এই যে আমরা কথা বলছি, ঠিক এ সময়ে সেখানে আকাশ থেকে বোমা পড়ছে, ট্যাঙ্কগুলো বোমা মেরে একটা আরেকটাকে উড়িয়ে দিচ্ছে, সৈন্যরা গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে যাচ্ছে? ইতিমধ্যে অনেক লোক হতাহত হয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে কোনো সমস্যা নেই বলতে আপনি কী বুঝাতে চান?’

 

অভিজ্ঞ রাজনীতিক ধৈর্যসহকারে ব্যাখ্যা করলেন, ‘স্যার, সমস্যা হচ্ছে এমন একটা কিছু, যার সমাধান আছে। মধ্যপ্রাচ্যের কোনো সমাধান নেই। অতএব এটা কোনো সমস্যাই হতে পারে না।’

 

আমাদের জীবনে আমরা কত সময় নষ্ট করি সেসব জিনিসের কথা ভেবে ভেবে, যেগুলোর আসলে সেই মুহূর্তে কোনো সমাধান নেই, তাই সেগুলো

কোনো সমস্যাই নয়?

 

সিদ্ধান্ত নেওয়া

সমাধান আছে এমন সমস্যার ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হয়। কিন্তু আমাদের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো আমরা কীভাবে নিই?

সাধারণত আমরা আমাদের কঠিন সিদ্ধান্তগুলো অন্য কাউকে দিয়ে নেওয়ানোর চেষ্টা করি। যদি কোনো ঝামেলা হয়, তখন দোষারোপ করার জন্য একজনকে পাই। আমার বন্ধুদের মধ্যে কয়েকজন আমাকে এমন ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করে, যাতে তাদের সিদ্ধান্তগুলো আমিই নিয়ে দিই; কিন্তু আমি দেব না। আমি যা করি তা হলো, কীভাবে তারা বিজ্ঞতার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে পারে তা দেখিয়ে দেব।

 

যখন আমরা কোনো চৌরাস্তার মোড়ে এসে দ্বিধায় ভুগি কোন দিকে যাব, তখন আমাদের গাড়িটা একপাশে থামানো উচিত, আর একটু বিশ্রাম নিয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করা উচিত। শীঘ্রই, সাধারণত আমরা যখন এর আশা করি না তখন, একটা বাস আসে। বাসের সামনে বড় বড় করে লেখা থাকে এটি

কোথায় যাচ্ছে। যদি সেই গন্তব্য আপনার উপযোগী হয়, তবে উঠে পড়ুন সেই বাসে, না-হলে অপেক্ষা করুন। পিছনে সব সময় আরও বাস থাকে।

 

অন্য কথায়, যখন আমাদের একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রয়োজন হয়, আর আমরা সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে দোটানায় পড়ে যাই, তখন আমাদের দরকার একপাশে গিয়ে একটু অপেক্ষা করা। শীঘ্রই, যখন আপনি এর আশা করছেন না তখন একটা সমাধান আসবে। প্রত্যেক সমাধানের একটা নির্দিষ্ট গন্তব্য থাকে। যদি সেই গন্তব্য আমাদের উপযোগী হয়, তাহলে আমরা সেটা নিই, না-হলে আরও অপেক্ষা করি। এর পেছনে সব সময়ই আরেকটা সমাধান থাকে।

 

এভাবেই আমি সিদ্ধান্ত নিই। আমি সব তথ্য-উপাত্ত জড়ো করি, আর সমাধানের অপেক্ষায় থাকি। ভালো কোনো সিদ্ধান্ত সব সময়ই আসবে, যদি আমি ধৈর্যশীল হই। এটা সাধারণত অপ্রত্যাশিতভাবে আসে, যখন আমি এটা নিয়ে ভাবছি না তখন।

 

অন্যদের দোষারোপ করা

গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার সময় আপনি আগের গল্পে উক্ত নিয়মটা প্রয়োগ করে দেখতে পারেন। কিন্তু এমন নয় যে এই পদ্ধতিটাই আপনাকে অনুসরণ করতে হবে। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তো আপনারই হাতে। তাই এটা যদি কাজে না দেয়, আমাকে দোষ দেবেন না যেন।

 

এক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী আমাদের এক ভিক্ষুর সাথে দেখা করতে এলো। সেই ছাত্রীটির এর পরের দিন খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা পরীক্ষা ছিল। আর তাই সে চাচ্ছিল যেন ভিক্ষুটি তার জন্য মঙ্গলসূত্র পাঠ করে দেয়, যাতে তার সৌভাগ্য আসে। ভিক্ষুটি সদয় সম্মতি দিল এই ভেবে যে এতে হয়তো ছাত্রীটি আত্মবিশ্বাস ফিরে পাবে। এটি ছিল বিনামূল্যে। ছাত্রীটি কোনো কিছু দান করে নি।

 

আমরা আর সেই তরুণীটিকে দেখি নি। কিন্তু তার বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে শুনলাম, সে নাকি বলে বেড়াচ্ছে যে আমাদের বিহারের ভিক্ষুরা কোনো কাজের নয়। তারা মঙ্গলসূত্রও ভালোমতো পাঠ করতে জানে না। সে তার পরীক্ষায় ফেল করেছিল। তার বন্ধুবান্ধবরা আমাদের বলেছে যে সে ফেল করেছে। কারণ, সে বলতে গেলে কোনো পড়াশোনাই করে নি। সে ছিল একজন পার্টি গার্ল অর্থাৎ খাও দাও ফূর্তি করো টাইপের মেয়ে। সে আশা করেছিল যে, বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে তার জন্য কম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে পড়াশোনা, আর সেটা ভিক্ষুরা দেখবে।

 

জীবনে কোনো কিছু ভুল হয়ে গেলে অন্যকে দোষারোপ করে হয়তো সাময়িক স্বস্তি মেলে; কিন্তু তাতে সমস্যার সমাধান হয় কদাচিৎ।

এক ব্যক্তির চুলকানি ছিল পাছায়, সে চুলকাল মাথা। তাই তার চুলকানি কখনোই গেল না। অন্যকে দোষারোপ করার ব্যাপারটাকে আজান চাহ্ এভাবেই বলেছেন। এটা যেন চুলকানি আপনার পাছায়, আপনি চুলকাচ্ছেন মাথায়।

 

সম্রাটের তিনটা প্রশ্ন

আমি পার্থের একটি শিক্ষা সম্পর্কিত আলোচনা সভায় মূল বক্তা হিসেবে বক্তৃতা দেওয়ার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। আমি একটু অবাক হলাম। পরে যখন সভাস্থলে পৌঁছলাম, এক মহিলা, যার নাম লেখা ব্যাজ দেখে বুঝা গেল, সে-ই এই সেমিনারের উদ্যোক্তা, সে আমাকে দেখে স্বাগত জানাতে এগিয়ে এলো। ‘আমাকে মনে আছে আপনার?’ সে জিজ্ঞেস করল।

 

উত্তর দেওয়ার জন্য চূড়ান্ত রকম বিপদজনক প্রশ্নগুলোর মধ্যে এটি একটি। আমি সোজাসাপটা উত্তর দিতে মনস্থির করে বললাম, ‘না।’

সে হেসে আমাকে বলল যে, সাত বছর আগে আমি একটা স্কুলে বক্তৃতা দিয়েছিলাম। সে ছিল সেই স্কুলের অধ্যক্ষ। তার স্কুলে আমি একটা গল্প বলেছিলাম যা তার জীবনের গতিপথকে বদলে দিয়েছিল। সে অধ্যক্ষের পদ থেকে ইস্তফা দিল। এর পরে সে নিরন্তর পরিশ্রম করে গেল ঝরে পড়া শিশুদের জন্য একটা কর্মসূচি তৈরি করার কাজে। সেই বাচ্চারা, যারা প্রথাগত শিক্ষাব্যবস্থা থেকে ঝরে পড়েছে, রাস্তার টোকাইদের দল, অপ্রাপ্তবয়স্ক যৌনকর্মী,

নেশাখোর; তাদের জীবনের আরেকটা সুযোগ দেওয়ার জন্য, তাদের উপযোগী করে একটা কর্মসূচি হাতে নিল সে। সে আমাকে বলল যে, তার এই কর্মসূচির মূল দর্শনই হচ্ছে আমার বলা গল্পটা। গল্পটা ছিল লিও টলস্টয়ের ছোট গল্পের একটা বই থেকে ধার করা। আমি সেটা ছাত্র থাকার সময়ে পড়েছিলাম।

 

অনেক আগে, এক সম্রাট জীবনের একটা দর্শন খুঁজতে লাগলেন। রাজ্যশাসন আর নিজেকে শাসন, এই উভয় কাজেই তার দরকার ছিল প্রজ্ঞাময় দিকনির্দেশনা। সমসাময়িক ধর্ম ও দর্শন তাকে সন্তুষ্ট করতে পারল না। তাই তিনি জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তার দর্শন হাতড়ে বেড়ালেন।

অবশেষে তিনি উপলব্ধি করলেন যে, তার কেবল তিনটা মৌলিক প্রশ্নের উত্তর দরকার। এগুলোর উত্তর পেলে তিনি তার প্রজ্ঞাময় দিকনির্দেশনা পেয়ে যাবেন। সেই তিনটি প্রশ্ন ছিল এ রকম :

 

১. কখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়?

২. কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি?

৩. কোন জিনিসটা করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ?

 

মূল গল্পের প্রায় সবটুকু জুড়ে ছিল এই তিনটা প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানের দীর্ঘ কাহিনী। অবশেষে তিনি এক সন্ন্যাসীর কাছে গিয়ে সেই তিনটি উত্তর পেয়ে

গেলেন। উত্তরগুলো কী ছিল বলে আপনার মনে হয়? দয়া করে প্রশ্নগুলো আরেকবার দেখুন। আবার পড়া শুরু করার আগে একটু বিরতি নিয়ে ভাবুন।

প্রথমপ্রশ্নের উত্তর আমরা সবাই জানি; কিন্তু বেশির ভাগ সময় ভুলে যাই। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টি অবশ্যই ‘এখন’। একমাত্র এই সময়টাই আমাদের কাছে আছে। তাই আপনি যদি আপনার বাবা-মাকে বলতে চান, আপনি তাদের সত্যিই কতখানি ভালোবাসেন, তাদের বাবা-মা হিসেবে পেয়ে আপনি কতখানি কৃতজ্ঞ, এখুনি বলে ফেলুন সেটি। আগামীকাল নয়। পাঁচ মিনিট পরে নয়। এখনই। পাঁচ মিনিট হয়তো অনেক দেরি হয়ে যাবে।

যদি সঙ্গী বা সঙ্গিনীর কাছে দুঃখ প্রকাশের কোনো কিছু থাকে, তো এত দিন কেন করেন নি, তার অজুহাতের তালিকা নিয়ে ভাবতে বসবেন না যেন। অজুহাত বাদ দিয়ে এক্ষুনি তা প্রকাশ করুন। সুযোগ আর নাও মিলতে পারে। এই মুহূর্তকে ধরে ফেলুন।

 

দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরটা খুবই গভীর। খুব কম লোকই সঠিক উত্তরটা ধরতে পারে। যখন আমি ছাত্র অবস্থায় উত্তরটা পড়েছিলাম, এটি অনেক দিন ধরে আমার মাথায় ঘুরপাক খেয়েছিল। আমি কল্পনাও করি নি, এই প্রশ্নের উত্তরটা এত গভীর হবে। উত্তরটা হচ্ছে, আপনি যার সাথে আছেন সেই ব্যক্তিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।

 

আমার মনে পড়ে, আমি কলেজের প্রফেসরদের অনেক প্রশ্ন করেছি, কিন্তু আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনে নি কেউই। তারা বাইরে শোনার ভাব

দেখাচ্ছিল বটে; কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা চাচ্ছিল আমি যেন চলে যাই। নিজেকে তখন খুব পঁচা মনে হয়েছিল। আমার আরও মনে পড়ে, সাহস নিয়ে এক বিখ্যাত লেকচারারকে প্রশ্ন করতে গিয়েছিলাম, তাকে একটা ব্যক্তিগত প্রশ্ন করার জন্য। রীতিমতো অবাক ও খুশি হয়ে দেখলাম যে, তিনি আমার প্রতি তার পুরো মনোযোগ ঢেলে দিয়েছেন। অন্য প্রফেসরেরা তার সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছিলেন, আর আমি ছিলাম লম্বা ঝাঁকড়া চুলের সামান্য এক ছাত্র। অথচ তিনি আমাকেই গুরুত্বপূর্ণ ভাবতে দিলেন। পার্থক্যটা ছিল বিশাল।

 

যোগাযোগ ও ভালোবাসা ভাগাভাগি করা যায় কেবল তখনই, যখন সেই মুহূর্তের জন্য আপনার সাথে থাকা ব্যক্তি, সে যে-ই হোক না কেন, সারা পৃথিবীতে আপনার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হয়ে ওঠে। তারা এটা অনুভব করে। তারা এটা জানে। তারা এতে সাড়া দেয়।

 

বিবাহিত দম্পতিরা প্রায়ই অভিযোগ করে যে তাদের সঙ্গী বা সঙ্গিনী তাদের কথা আর মনোযোগ দিয়ে শুনছে না। তারা যা বুঝাতে চায় তা হলো, তাদের সঙ্গীরা আর তাদের গুরুত্বপূর্ণ হওয়ার অনুভূতিটা এনে দেয় না। পারস্পরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রত্যেকেরই সম্রাটের দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরটা স্মরণ রাখা উচিত, আর সেটাকে কাজে লাগানো উচিত। আমরা যতই ক্লান্ত বা ব্যস্ত থাকি না কেন, যখন আমরা সঙ্গী বা সঙ্গিনীর সাথে থাকি, তখন তাদের সাথে এমন আচরণ করা উচিত, যেন সেই মুহূর্তে তারাই আমাদের কাছে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। প্রত্যেকেই যদি এমন করত, তাহলে বিবাহবিচ্ছেদের উকিলদের তাদের উকিলগিরি বাদ দিয়ে অন্য পেশা দেখতে হতো।

 

ব্যবসাতে যখন আমরা কোনো সম্ভাব্য ক্রেতার সাথে থাকি, তখন যদি আমরা তাদের সাথে সেই সময়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে ব্যবহার করি,

তাহলে আমাদের বিক্রি আরও বাড়বে, সেই সাথে বাড়বে আমাদের বেতনও। মূল গল্পে সম্রাট সেই সন্ন্যাসীর সাথে দেখা করতে যাওয়ার পথে, একটা

ছোট্ট বালকের উপদেশ মনোযোগ দিয়ে শুনে আততায়ীর হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন। এমন পরাক্রমশালী সম্রাট যখন একজন সামান্য বালকের সাথে

থাকেন, সেই বালক তখন তার জন্য জগতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আর সেটাই সম্রাটের জীবন বাঁচিয়েছিল। যখন দীর্ঘদিন পরে বন্ধুরা তাদের সমস্যাগুলো বলার জন্য আমার কাছে আসে, আমি সম্রাটের দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরটা স্মরণ করি, আর তাদের পূর্ণ গুরুত্ব দিই। এটাই নিঃস্বার্থতা। দয়া ও

মৈত্রী এতে শক্তি যোগায় এবং এতে কাজ হয়।

 

সেই শিক্ষাবিষয়ক সেমিনারের আয়োজক মহিলা, প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে সে যে শিশুদের সাহায্য করতে চাচ্ছিল তাদের সাক্ষাৎকার নিয়েছিল, আর চর্চা করেছিল সেই নীতি : ‘সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে সেই ব্যক্তি, আপনি এখন যার সাথে আছেন।’ সেই শিশুদের অনেকের জন্য সেটাই ছিল প্রথমবার, যখন তারা নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেছে, বিশেষ করে তাও একজন প্রভাবশালী প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির সামনে।

 

তাদের গুরুত্বের সাথে নিয়ে সে তখন পুরোপুরি তাদের কথা শুনেছিল। তাদের বিচার করছিল না। শিশুদের কথা শোনা হলো। এবার পুরো কর্মসূচিটা তাদের উপযোগী করে গড়ে তোলা হলো। শিশুরা নিজেদের সম্মানিত ভাবল, আর কর্মসূচিটি সফল হলো। সেই আলোচনা সভায় আমার বক্তৃতাই মূল বক্তৃতা ছিল না। আমার পরে এক শিশু উঠে দাঁড়াল বলার জন্য। সে আমাদের শোনাল তার পরিবারের ঝামেলার কথা, নেশা ও অপরাধজগতের কথা, কীভাবে এই কর্মসূচি তার জীবনের আশা ফিরিয়ে এনেছে তার কথা। আর জানাল কীভাবে সে শীঘ্রই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যাচ্ছে। শেষের দিকে আমার চোখ ভিজে গিয়েছিল। ছেলেটার বক্তৃতাই হয়েছিল মূল বক্তৃতা।

 

আপনার জীবনের বেশির ভাগ সময় আপনি নিজেকে নিয়েই থাকেন। অতএব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, যার সাথে আপনি থাকেন, সেটা হচ্ছে আপনি নিজে। আপনার নিজেকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রচুর সময় আছে। সকালে ঘুম থেকে জেগে প্রথম কাকে নিয়ে আপনি সচেতন হন? আপনার নিজেকে! আপনি কি কখনো বলেন, ‘শুভ সকাল আমি! ভালো একটা দিন কাটুক!’? আমি কিন্তু বলি। ঘুমাতে যাওয়ার সময় কে সেই সর্বশেষ ব্যক্তি যার বিষয়ে আপনি সচেতন থাকেন? সে তো আপনিই! আমি নিজেকে নিজে শুভরাত্রি জানাই। আমি আমার দিনের অনেক ব্যক্তিগত সময়ে নিজেকে গুরুত্ব দিই। এটা কাজে দেয়।

 

সম্রাটের তৃতীয় প্রশ্ন ছিল, ‘কোন জিনিসটা করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ’ এর উত্তর হচ্ছে যত্ন নেওয়া। যত্ন নেওয়া মানে হচ্ছে, সতর্ক হওয়া আর যত্নশীল হওয়া। উত্তরটা বুঝিয়ে দেয় যে, আমাদের কাজের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা আসছে কোথা থেকে, সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যত্ন নেওয়ার মানেটা কয়েকটা গল্পের মাধ্যমে বুঝিয়ে বলার আগে আমি সম্রাটের তিনটি প্রশ্নোত্তর একসাথে সংক্ষিপ্তাকারে লিখে নেব :

 

১. কখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়?- এখন।

২. কে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি?- আপনি যার সাথে আছেন সেই

ব্যক্তি।

৩. কোন জিনিসটি করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ - যত্ন নেওয়া।

 

যে গরুটি কেঁদেছিল

নিরাপত্তা ব্যবস্থা অত কড়াকড়ি নয়, এমন একটা জেলখানায় আমি বেশ আগেভাগে পৌঁছে গেলাম ধ্যানের ক্লাস করানোর জন্য। একজন কয়েদি, যাকে আগে কখনো দেখিনি, সে আমার সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছিল। সে ছিল মানুষরূপী দৈত্য, ঝোপঝাড়ের মতো লম্বা চুল দাড়ি আর বাহুতে উল্কি আকা। মুখে প্রচুর কাটাকুটির দাগ আমাকে বলে দিল, এই ব্যক্তি ভয়ংকর মারপিট করে এসেছে অনেকবার। তার চেহারাটা এমন ভয়ংকর ছিল যে, আমি অবাক হলাম কেন সে ধ্যান শিখতে এসেছে। সে তো এ লাইনের লোক নয়। অবশ্যই আমার এমন মনে করাটা ভুল ছিল।

 

সে আমাকে বলল যে, কয়েক দিন আগে একটা ঘটনা ঘটেছে, যাতে তার আত্মারাম খাঁচাছাড়া হওয়ার যোগাড়। কথার শুরুতেই তার আলস্টার এলাকার কথাবার্তা ভঙ্গি ধরা পড়ল আমার কাছে। পটভূমি হিসেবে জানাল, সে বড় হয়েছে বেলফাস্টের নির্মম রাস্তাগুলোর একটাতে। তার প্রথম ছুরিকাঘাতের ঘটনা ঘটে যখন তার বয়স সাত। স্কুলের মাস্তান ছোকরা তার কাছ থেকে দুপুরের খাবারের টাকা দাবি করেছিল। সে না বলে দিল। বয়সে বড় সেই বালকটি একটা লম্বা ছুরি বের করে দ্বিতীয়বারের মতো টাকা চাইল। সে ভাবল মাস্তানটি ধাপ্পা দিচ্ছে মাত্র। তাই সে আবারও না বলল। তৃতীয়বার আর মাস্তানটি জিজ্ঞেস করল না; শুধু ছুরিটা সেই সাত বছরের বালকের হাতে ঢুকিয়ে দিল, বের করে আনল আর হেঁটে চলে গেল।

 

সে আমাকে বলেছিল যে, সে হতভম্ব হয়ে স্কুলের মাঠ থেকে দৌঁড় দিল কাছেই তার বাবার বাড়িতে, হাত বেয়ে তখন রক্ত চুইয়ে পড়ছে । তার বেকার পিতা ক্ষতটার দিকে একবার তাকাল মাত্র, আর তাকে নিয়ে গেল রান্নাঘরে। ক্ষত ব্যান্ডেজ করে দিতে নয়। একটা ড্রয়ার খুলে বড় একটা ছুরি বের করল তার পিতা। সেটি তার ছেলের হাতে দিয়ে স্কুলে ফিরে যেতে এবং মাস্তানটিকে কোপাতে আদেশ দিল। এভাবেই সে বড় হয়েছিল। সে যদি এমন বিশালদেহী ও শক্তিশালী না হতো, অনেক আগেই মরে ভুত হয়ে যেত।

 

এই জেলখানাটা ছিল একটা জেলখানার খামার। এটা ছিল মূলত স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী কয়েদি, যাদের মুক্তির সময় হয়ে এসেছে, তাদের জন্য। তারা এখানে থেকে খামারের কাজ শিখত, খামারের ব্যবসার কাজও শিখত। এখান থেকে উৎপন্ন দ্রব্যাদি পার্থের আশেপাশের জেলখানাগুলোতে কম দামে সরবরাহ করা হতো, এতে করে জেলখানা পরিচালনার খরচ কমত।

 

অস্ট্রেলিয়ান খামারগুলো শুধু গম আর শাকসবজিই নয়; গরু, ভেড়া আর শুকরও পালত এবং জেলখানার খামারেও তা-ই হতো। কিন্তু অন্যান্য খামারগুলো থেকে এটি একটু ভিন্ন ছিল যে, এই খামারে নিজস্ব কসাইখানা ছিল।

 

জেলখানার খামারে প্রত্যেক কয়েদিকে যেকোনো একটা চাকরি করতে হতো। আমি অনেক কয়েদির কাছ থেকে শুনেছি, যে চাকরিগুলো সবচেয়ে

সোজা হতো, সেগুলো হলো কসাইখানার চাকরি। এই চাকরিগুলো বিশেষ করে জনপ্রিয় ছিল নিষ্ঠুর অপরাধীদের মধ্যে। আর সবচেয়ে যে চাকরিটি সোজা হতো, যার জন্য আপনাকে লড়তে হতো, সেটা ছিল কসাইয়ের চাকরি। সেই বিশালদেহী আর ভয়ংকর আইরিশ লোকটিই ছিল কসাই।

 

সে আমাকে কসাইখানার সুন্দর বর্ণনা দিয়েছিল। কসাইখানার প্রবেশ পথটা চওড়া, দুপাশে সুদৃঢ় ইস্পাতের রেলিং। বিল্ডিংয়ের মধ্যে গিয়ে সেই প্রবেশ পথটা আস্তে আস্তে সংকীর্ণ হয়ে গেছে ফানেলের মতো। দুপাশের রেলিংগুলো এমনভাবে পথের উপর চেপে বসেছে যে, পথের শেষমাথায় একবারে কেবল একটা পশু যেতে পারে। পথের শেষ মাথায় একটা পাটাতনের উপর সে দাঁড়িয়ে থাকত, হাতে বৈদ্যুতিক বন্দুক। গরু, শুয়োর অথবা ভেড়ার পালকে কুকুর ও অন্যান্য রাখালদের দিয়ে তাড়িয়ে তাড়িয়ে সেই ইস্পাতের রেলিং ঘেরা পথে ঢোকানো হতো। সে বলেছিল যে তারা সব সময়ই নিজ নিজ স্বরে চিৎকার করত, পালানোর চেষ্টা করত। তারা মৃত্যুর গন্ধ পেত, মৃত্যুর শব্দ শুনত, মৃত্যুকে অনুভব করত। যখন কোনো পশু সেই পথ বেয়ে তার পাটাতনের পাশে আসত, এটি দেহ মোচড়াত, আর তীব্র স্বরে ডেকে উঠত। যদিও এই বৈদ্যুতিক বন্দুক দিয়ে একটা মাত্র গুলিতেই একটা বড়সড় ষাঁড় মারা সম্ভব; কিন্তু সব পশুই এখানে এসে অস্থির হয়ে উঠত, লক্ষ্য স্থির করার সময়টা পর্যন্ত দিত না। তাই তাকে দুবার গুলি করতে হতো, প্রথম গুলিটা স্থির হওয়ার জন্য, দ্বিতীয় গুলিটা মারার জন্য। প্রথমগুলিতে স্থির, দ্বিতীয় গুলিতে মৃত্যু। পশুর পর পশু। দিনের পর দিন।

 

আইরিশ লোকটা এবার আসল ঘটনায় আসল, আর উত্তেজিত হতে শুরু করল। ঘটনাটি ঘটেছিল মাত্র কয়েক দিন আগে, যা তাকে খুব নাড়া দিয়েছিল।

সে শপথ করতে শুরু করল। বার বার সে বলছিল, ‘এটা ঈশ্বরের ... সত্যি’। সে ভেবেছিল, আমি তার কথা বিশ্বাস করব না।

 

সেদিন পার্থের আশেপাশের জেলখানাগুলোতে গরুর মাংস দেওয়ার কথা ছিল। তাই তারা গরু জবাই করছিল। এক গুলিতে গরুটাকে স্থির করে পরের

গুলিতে মেরে ফেলা। অন্যান্য দিনের মতোই স্বাভাবিক নিয়মে গরু জবাইয়ের কাজ চলছিল। একসময় একটা গরু আসল যেটার মতো সে আগে কখনো দেখে নি। গরুটা ছিল নিরব, অন্যান্যদের মতো কোনো দেহ মোচড়ানো নেই, হাম্বা হাম্বা নেই, ফোঁস ফোঁস নেই। এর মাথা নোয়ানো ছিল এমনভাবে যেন এটি উদ্দেশ্যমূলকভাবে, স্বেচ্ছায়, ধীরে ধীরে তার পাটাতনের পাশে এসে দাঁড়াল। এটি দেহ মোচড়াল না, বা পালানোর চেষ্টাও করল না। সেইস্থানে এসে এবার গরুটি মাথা তুলে নিরবে তার ঘাতকের দিকে তাকাল, একদম স্থির হয়ে।

 

আইরিশ লোকটা এমন ব্যাপার তো দূরে থাক, এর কাছাকাছি কোনো ঘটনাও দেখে নি এর আগে। তার মনটা কেমন যেন অসার হয়ে গেল। সে না পারছিল বন্দুকটা তুলে ধরতে, না পারছিল গরুটার চোখগুলো থেকে নিজের চোখকে সরিয়ে নিতে। গরুটা সরাসরি তার ভেতরে তাকিয়েছিল। সে যেন সময়ের অতীত কোনো শূন্যতায় ডুবে গেল। কতক্ষণ এমন ছিল তা সে আমাকে বলতে পারে নি। কিন্তু যখন গরুটা তার চোখে চোখ রাখল, সে যা দেখল, তাতে সে আরও ভীষণ নাড়া খেল। সে দেখল যে গরুটার বাম চোখে, নিচের চোখের পাতার উপরে পানি জমতে শুরু করল। পানির পরিমাণ বাড়তে বাড়তে চোখের পাতা আর ধরে রাখতে পারল না। এটি ধীরে ধীরে গরুটার গাল বেয়ে উজ্জল এক অশ্রুরেখা সৃষ্টি করে গড়িয়ে পড়তে শুরু করল। তার হৃদয়ের

দীর্ঘদিনের বদ্ধ দরজাগুলো যেন খুলে যাচ্ছিল ধীরে ধীরে।

 

অবিশ্বাসের সাথে সে গরুটার ডান চোখে তাকিয়ে দেখল, নিচের চোখের পাতার উপরে পানি জমতে জমতে এখান থেকেও দ্বিতীয় একটা অশ্রুধারা মুখ

বেয়ে গড়িয়ে পড়ল ধীরে ধীরে। লোকটি ভেঙে পড়ল। গরুটা কাঁদছিল।

 

সে আমাকে বলেছিল যে সে তার বন্দুক ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল, আর চিৎকার করে জেলখানার পুলিশ অফিসারদের জানিয়ে দিয়েছিল যে তারা তাকে যা খুশি করতে পারে; কিন্তু এই গরুটাকে কেউ মারতে পারবে না। সে তার কথা শেষ করল এই বলে যে, সে এখন নিরামিষভোজী।

 

গল্পটা সত্যি ছিল। জেলখানার অন্যান্য কয়েদিরাও আমাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। যে গরুটি কেঁদেছিল, সে সবচেয়ে নিষ্ঠুর লোকটিকে শিখিয়েছিল যত্ন

নেওয়া মানে কী।

 

ছোট্ট মেয়েটি ও তার বন্ধু

আমি দক্ষিন অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিন-পশ্চিমের একটা গ্রাম্য শহরে এক দল বয়স্ক লোকের কাছে যে গরুটি কেঁদেছিল তার গল্প বলেছিলাম। তাদের মধ্যে এক বুড়ো লোক আমাকে এমন একটা গল্প শোনাল। সেটি তার তরুণ বয়সের ঘটনা। গত শতাব্দীর প্রথমদিকের সময়কাল।

 

তার বন্ধুর কন্যার বয়স ছিল তখন চার কি পাঁচ বছর। এক সকালে সে তার মায়ের কাছে ছোট্ট পিরিচে করে দুধ চাইল। তার ব্যস্ত মা তো খুশি, তার মেয়ে

দুধ খেতে চাচ্ছে। তাই সে খুব একটা ভাবল না, কেন সে দুধ চাচ্ছে পিরিচে করে, কোনো গ্লাসে নয়।

 

পরের দিনও একই সময়ে ছোট্ট মেয়েটি আবার এক পিরিচ দুধ চাইল। মাও খুশি মনে দিয়ে দিল। বাচ্চারা এমনিতেই তাদের খাবার নিয়ে খেলতে পছন্দ করে। মা শুধু খুশি যে তার মেয়েটি স্বাস্থ্যকর কোনো কিছু খেতে চাচ্ছে। পরের কয়েক দিনও একই ব্যাপার ঘটল, একই সময়ে। মা আসলে কখনোই দেখে নি যে তার মেয়েটা পিরিচে করে দুধ খাচ্ছে, তাই সে ভেবে কুলকিনারা পেল না, বাচ্চাটা কী নিয়ে মেতেছে। সে চুপিচুপি মেয়েটাকে অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিল।

 

তখনকার দিনে প্রায় সব ঘরই বানানো হতো খুঁটির উপরে, মাটি থেকে উপরে। ছোট্ট মেয়েটি ঘরের বাইরে গেল, ঘরের পাশে হাঁটু গেড়ে বসল, আর

দুধের পিরিচটি নামিয়ে রেখে ঘরের নিচের অন্ধকার জায়গাটা লক্ষ করে নরম সুরে ডাকল। কয়েক মুহূর্ত পরে বিশাল এক কালো সাপ বেরিয়ে এলো। এটি পিরিচ থেকে দুধ খেতে শুরু করল, মেয়েটির হাসিমাখা মুখ থেকে মাত্র কয়েক ইঞ্চি দূরে। তার মা কিছুই করতে পারল না। কারণ, বাচ্চাটি সাপটির খুব কাছাকাছি ছিল। বুকভরা আতঙ্ক নিয়ে তার মা দেখল যে সাপটি দুধ খেয়ে শেষ করে ঘরের নিচে চলে গেল।

 

সেদিন সন্ধ্যায় তার স্বামী কাজ থেকে ঘরে ফিরলে ব্যাপারটা তাকে জানাল। তার স্বামী তাকে বলল, যদি মেয়েটি পরের দিনও এক পিরিচ দুধ চায়, সে

যেন তা দেয়। এর পরের ব্যবস্থা সে করবে।

 

পরের দিন একই সময়ে ছোট্ট মেয়েটি তার মাকে এক পিরিচ দুধ দিতে বলল। সে দুধের পিরিচটি নিয়ে বরাবরের মতোই বাইরে গেল, বাড়ির পাশে নামিয়ে রাখল, আর তার বন্ধুকে ডাকল। বিশাল সেই কালো সাপটা অন্ধকার থেকে দেখা দেওয়া মাত্র বন্দুকের গুলির শব্দ শোনা গেল কাছেই। গুলির আঘাতে সাপটি একটি খুঁটির গায়ে আছড়ে পড়ল। তার মাথাটা দেহ থেকে ছিন্নভিন্ন হয়ে গেল মেয়েটির চোখের সামনে। তার বাবা ঝোপের আড়াল থেকে উঠে দাঁড়াল, আর বন্দুকটা একপাশে রেখে দিল।

 

তখন থেকে ছোট্ট মেয়েটি কোনো কিছু খেতে অস্বীকৃতি জানাল। বৃদ্ধ লোকটির ভাষায়, ‘সে ছটফটানি শুরু করল।’ তার বাবা-মা কিছুতেই কোনো কিছু খাওয়াতে পারল না। অগত্যা জেলা হাসপাতালে ভর্তি করাতে হলো তাকে। কিন্তু তারাও কোনো সাহায্য করতে পারল না। ছোট্ট মেয়েটি মারা গেল।

সেই পিতা যখন তার মেয়ের চোখের সামনে তার বন্ধুকে গুলিতে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছিল, সে যেন গুলি করেছিল তার আপন মেয়েটিকেও।

 

যে বয়স্ক লোকটি আমাকে এই গল্পটা বলেছিল, আমি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, সেই কালো সাপটি ছোট্ট মেয়েটিকে ক্ষতি করবে, এমনটা সে কখনো ভেবেছে কি না?

 

‘সেরকম সম্ভাবনা আমি দেখি নি!’ জবাব দিয়েছিল বুড়ো। আমিও তেমনই ভেবেছি, তবে একটু ভিন্ন সুরে।

 

সাপ, মেয়র এবং ভিক্ষু

আমি থাইল্যান্ডে ভিক্ষু হিসেবে আট বছরেরও বেশি সময় কাটিয়েছি। বেশির ভাগ সময় আমি ছিলাম জঙ্গলের মধ্যে থাকা বিহারগুলোতে, যেখানে বসবাস করতে হতো সাপদের মাঝে।

 

১৯৭৪ সালে আমি সেখানে প্রথম যাই। আমাকে বলা হয়েছিল যে থাইল্যান্ডে একশ জাতের সাপ আছে। তাদের মধ্যে ৯৯টি প্রজাতি বিষধর- তাদের কামড়ে আপনি সোজা মারা যাবেন। আর অন্য একটি সাপ কামড়ায় না, তবে পেঁচিয়ে শ্বাসরুদ্ধ করে মারে।

 

সেই সময়ে প্রায় প্রত্যেক দিন সাপ দেখতাম আমি। একবার আমার কুটিরে ছয় ফুট লম্বা এক সাপের উপর পা দিয়েছিলাম। আমরা উভয়েই চমকে উঠে লাফ দিয়েছিলাম, তবে সৌভাগ্যবশত দুজনে দুদিকে। এমনকি এক সকালে আমি এক সাপের উপরে প্রস্রাব করে দিয়েছিলাম। আমি ভেবেছিলাম ওটা একটা কাঠি। অবশ্যই ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলাম আমি। (সম্ভবত সাপটি ভেবেছিল, তাকে পবিত্র পানি ছিটিয়ে আশীর্বাদ করা হচ্ছে।) একবার এক অনুষ্ঠানে সূত্রপাঠের সময় একটা সাপ আমাদের এক ভিক্ষুর পিঠ বেয়ে উঠতে লাগল। যখন এটি কাঁধের উপরে উঠে গেল, কেবল তখন ভিক্ষুটি ঘাড় ফিরিয়ে দেখল। সাপটিও তার দিকে ফিরে তাকাল। আমি সূত্রপাঠ বন্ধ করে দেখলাম, কয়েকটা সেকেন্ড যেন ভিক্ষু ও সাপটা পরস্পর চোখ পাকিয়ে চেয়ে রইল। এরপর ভিক্ষুটি আস্তে করে তার চীবর ঝাঁকাল। সাপটি নিরবে নেমে গেল, আর আমরা সূত্রপাঠ শুরু করলাম আবার।

 

বনভিক্ষু হিসেবে আমাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল যাতে আমরা সকল প্রাণীর প্রতি মৈত্রী জাগিয়ে তুলি, বিশেষ করে সাপদের প্রতি। আমরা তাদের ভালোমন্দ খেয়াল রাখতাম, যত্ন নিতাম। এ কারণেই সেই দিনগুলোতে কোনো ভিক্ষুকেই সাপে কামড়ায় নি।

 

থাইল্যান্ডে থাকার সময় আমি দুটো বিরাট সাপ দেখেছিলাম। প্রথমটা ছিল কমপক্ষে সাত মিটার লম্বা একটা অজগর, আর দেহটা ছিল আমার উরুর মতো

মোটা। এত বড় আকারের কোনো কিছু দেখলে আপনি অবিশ্বাসে দাঁড়িয়ে যাবেন। কিন্তু এটা ছিল সত্যি। আমি এটাকে আরও কয়েক বছর পরে আরেকবার দেখেছিলাম। বিহারের আরও অনেক ভিক্ষুই সেটাকে দেখেছিল। আমাকে পরে জানানো হয়েছে যে এটি নাকি এখন মরে গেছে। অন্য যে বড় সাপটি দেখেছিলাম, সেটা ছিল শঙ্খচূড়। থাই গ্রীষ্মমন্ডলীয় জঙ্গলে থাকাকালীন যে তিনবার আমি অনুভব করেছিলাম যে, আবহাওয়ায় যেন বিদ্যুৎ বয়ে যাচ্ছে, আমার ঘাড়ের চুল খাড়া হয়ে গেছে, আর আমার ইন্দ্রিয়গুলো তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে, সেই সময়টা ছিল এমনই একটি সময়।

 

জঙ্গলের বুনো পথে মোড় ঘুরতেই চোখে পড়ল একটা কালো সাপ দেড় মিটার চওড়া রাস্তাটা রোধ করে আছে। এর মাথা বা লেজ কোনোটাই দেখা যাচ্ছিল না, দুটোই ছিল ঝোপের আড়ালে। আর এটা সামনে এগোচ্ছিল। এর নড়াচড়া দেখে আমি সাপটার দৈর্ঘ্যকে পথের প্রস্থ দিয়ে গুণলাম। সাত প্রস্থ

গোণার পরে তবেই লেজের দেখা পেলাম। সাপটি ছিল লম্বায় ১০ মিটারেরও বেশি। আমি এটাকে দেখে গ্রামবাসীদের বললাম। তারা আমাকে বলল যে এটি ছিল শঙ্খচূড়, বড় জাতের।

আজান চাহ-র এক থাই শিষ্য, যে এখন নিজ গুণে বিখ্যাত এক আচার্য হয়ে উঠেছে, সে একবার অনেকজন ভিক্ষু সাথে নিয়ে থাইল্যান্ডের জঙ্গলে ধ্যান করছিল। কোনো একটা প্রাণী আসার শব্দ শুনে তারা চোখ খুলতে বাধ্য হলো। তারা দেখল একটা শঙ্খচূড় সাপ তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। থাইল্যান্ডের

কোনো কোনো জায়গায় শঙ্খচূড়কে বলা হয় ‘এক পদক্ষেপের সাপ’। কারণ, এটা আপনাকে কামড়ানোর পরে আপনি কোনোমতে এক পা এগোতে পারবেন, এর পরে নিশ্চিত মৃত্যু! শঙ্খচূড় সোজা সিনিয়র ভিক্ষুটার কাছে এগিয়ে গেল, ভিক্ষুটার মাথার সমান করে তার মাথাটা উঁচু করল, আর ফণা বের করে শব্দ করতে লাগল, ‘হিস্ হিস! হিস্ হিস! ’

 

আপনি তখন কী করতেন? দৌঁড় দেওয়াটা হতো সময়ের অপচয় মাত্র। এই বড় সাপগুলো আপনার থেকে অনেক দ্রুত দৌঁড়াতে পারে। থাই ভিক্ষুটা করল কী, সে হাসল, আস্তে করে ডান হাতটা তুলল এবং শঙ্খচূড়ের মাথায় আলতো করে চাপড় দিয়ে থাই ভাষায় বলল, ‘আমাকে দেখতে আসার জন্য ধন্যবাদ।’ সমস্ত ভিক্ষুরা দেখল ঘটনাটা।

 

এই ভিক্ষুটা ছিল বিশেষ এক ভিক্ষু যার ছিল ব্যতিক্রমী মৈত্রীভাব। শঙ্খচূড় হিস্ হিস্ বন্ধ করল। ফণা গুটিয়ে নিল। মাথাটা মাটিতে নামিয়ে কাছের আরেক ভিক্ষুর কাছে গেল, ‘হিস্ হিস! হিস্ হিস! ’

 

দ্বিতীয় ভিক্ষুটি পরে বলেছিল যে কোনোমতেই সে শঙ্খচূড়ের মাথায় হাত বুলাতে যেত না। সে ভয়ে বরফের মতো জমে গিয়েছিল। নিরবে সে প্রার্থনা করছিল যেন শঙ্খচূড়টা তাড়াতাড়ি চলে যায়, আর অন্য কোনো ভিক্ষুর সাথে দেখা করে।

 

শঙ্খচূড়ের মাথায় চাপড় দেওয়া সেই ভিক্ষুটি অস্ট্রেলিয়ায় আমাদের বিহারে কয়েক মাস ছিল। আমরা সে-সময় আমাদের মূল দেশনালয় নির্মাণ করেছিলাম। আরও কয়েকটা ভবন নির্মাণের প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় স্থানীয় কাউন্সিল অফিসে জমা ছিল। স্থানীয় কাউন্সিলের মেয়র এখানে এসেছিল আমরা কী করছি তা দেখতে।

 

মেয়র নিঃসন্দেহে জেলার সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তি। সে এই এলাকায় বড় হয়েছে, আর সফল একজন কৃষক। সে আবার আমাদের প্রতিবেশীও। সে এসেছিল সুন্দর একটা স্যুট পরে, যা মেয়রের পক্ষেই মানানসই। জ্যাকেটের বোতাম ছিল খোলা। ফলে বড়সড় অস্ট্রেলিয়া মাপের বিশাল ভুঁড়ি বেরিয়ে পড়েছিল। শার্টের বোতামগুলো খুব টানটান হয়ে গিয়েছিল, আর পেটটা তার সেরা প্যান্টের কিনারা ছাপিয়ে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। থাই ভিক্ষুটি এক

ফোঁটা ইংরেজি জানত না। সে মেয়রটির ভুঁড়িটা দেখল। আমি তাকে থামানোর আগেই সে মেয়রের কাছে পৌঁছে গেল, আর ভুঁড়িটাকে চাপড় দিতে শুরু করল। আমি ভাবলাম, ‘সেরেছে! আপনি মেয়রের ভুঁড়িটাকে এভাবে চাপড়াতে পারেন না। আমাদের ভবনের প্রকল্পগুলো আর অনুমোদন পাবে না। আমরা শেষ! আমাদের বিহার নির্মাণের এখানেই ইতি!’

 

সেই থাই ভিক্ষুটি মৃদু হাসি নিয়ে যতই মেয়রের ভুঁড়িটিকে চাপড়ালো আর হাত বুলিয়ে দিল, ততই মেয়র হাসতে শুরু করল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এমন রাশভারি মেয়র শিশুর মতো খিল খিল করে হাসতে লাগল। সে সত্যিই এই অসাধারণ থাই ভিক্ষুর ভুঁড়ি চাপড়ানো ও হাত বুলানোর প্রত্যেকটি মুহূর্তকে উপভোগ করেছিল।

 

আমাদের সবগুলো ভবনের প্ল্যান অনুমোদন হয়ে গেল। মেয়র আমাদের সেরা বন্ধু ও সহায়তাকারীদের একজন হয়ে উঠল। যত্ন নেওয়ার সবচেয়ে প্রয়োজনীয় অংশটা হলো, এর উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা কোত্থেকে আসছে তা দেখা। সেই থাই ভিক্ষুটার প্রতিটি কাজের উৎস ছিল এমন বিশুদ্ধ হৃদয় যে, সে শঙ্খচূড়ের মাথায় চাপড় দিতে পারে, মেয়রের ভুঁড়িতে হাত বুলাতে পারে, আর সবচেয়ে বড় কথা, তারা দুজনেই এটা পছন্দ করেছিল। আমি আপনাকে এমন কিছু করতে যাওয়ার পরামর্শ দেব না, অন্ততপক্ষে যতক্ষণ পর্যন্ত আপনি একজন সাধুসমেত্মর ন্যায় যত্ন নিতে না পারেন, ততক্ষণ পর্যন্ত।

 

খারাপ সাপ

এই বইয়ের সর্বশেষ সাপের গল্পটি বৌদ্ধ জাতক কাহিনী থেকে নেওয়া। এতে দেখা যায় যে, যত্ন নেওয়া মানে সব সময় নম্র, ভদ্র ও ইতিবাচক হওয়া বুঝায় না।

 

কোনো এক গ্রামের বাইরে জঙ্গলে একটি খারাপ সাপ বাস করত। সাপটি ছিল ক্রুর, হিংস্র ও নীচমনা। সে কেবল মজা করার জন্য লোকজনকে কামড়াত। যখন এই খারাপ সাপটি বুড়ো হলো। সে ভাবতে লাগল, মারা গেলে সাপগুলোর কী হয়? তার পুরো হিস্ হিসের জীবনে সে ধর্মকে তাচ্ছিল্যই করেছে। তার মতে ধর্ম হচ্ছে অর্থহীন প্রলাপমাত্র। আর যেসব সাপ এই অর্থহীন প্রলাপের ফাঁদে পড়ে সহজ সরল হয়ে রয়েছে, তাদের সে বোকা বলে উপহাস করেছে। কিন্তু এখন এই বুড়ো বয়সে এসে সে বেশ ধর্মকর্মে আগ্রহী হয়ে উঠল। তার গর্তের অদূরেই পাহাড়ের চূড়ায় বাস করত এক সাধু সাপ। সকল সাধু

লোকজন পাহাড় পর্বতের চূড়ায় বাস করে। এমনকি সাধু সাপও। এটাই চিরাচরিত ঐতিহ্য। আপনি কখনো কোনো সাধু লোক জলাভূমিতে বাস করে বলে শুনবেন না। একদিন খারাপ সাপটা সাধু সাপের সাথে দেখা করবে বলে মনস্থির করল। সে গায়ে একটা রেইনকোট চাপাল, কালো সানগ্লাস পরল, আর টুপি দিয়ে মাথা ঢাকল যাতে তার বন্ধুরা তাকে চিনতে না পারে। এর পরে সে পাহাড় বেয়ে বেয়ে সাধু সাপের বিহারে উঠে গেল। সে পৌঁছল একটা ধর্মদেশনার মাঝামাঝি সময়ে। সাধু সাপটা একটা পাথরের উপর বসে ধর্মদেশনা দিচ্ছিল, আর শত শত সাপ তার দেশনা নিবিড় মনোযোগ দিয়ে শুনছিল। খারাপ সাপটি সেই সমবেত সাপগুলোর একপ্রান্তে দরজার কাছাকাছি গিয়ে দেশনা শুনতে শুরু করল।

 

যতই সে দেশনা শুনল, ততই তা তার কাছে যুক্তিযুক্ত বলে মনে হলো। যুক্তি থেকে বিশ্বাস স্থাপিত হলো, অনুপ্রেরণা এলো, আর শেষে সে পুরো ধর্মান্তরিত হলো। দেশনা শেষে সে সাধু সাপটার কাছে গেল। অশ্রুভরা চোখে সে তার জীবনের অনেক পাপকর্মের কথা স্বীকার করল আর প্রতিজ্ঞা করল, এখন থেকে

সে পুরোপুরি বদলে যাবে। সে সাধু সাপের সামনে শপথ নিল, আর কোনো মানুষকে কামড়াবে না। সে দয়ালু হয়ে যাবে। সে হবে যত্নশীল। সে অন্য সাপদের শিক্ষা দেবে, কীভাবে ভালো হতে হয়। এমনকি যাবার সময় সে দানবাক্সে কিছু দানও করে গেল। (সেটা অবশ্যই যখন সবাই দেখছিল, তখন।) যদিও সাপ সাপের সাথে কথা বলতে পারে, মানুষের কাছে তা হিস্ হিস্ ছাড়া আর কিছুই নয়। খারাপ সাপ, অথবা বলা যায় প্রাক্তন খারাপ সাপ মানুষদের বলতে পারল না যে সে এখন শান্তিকামী। গ্রামবাসীরা এখনো তাকে এড়িয়ে চলে, যদিও তারা অবাক হয়ে ভাবে, সাপের বুকে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ব্যাজ কেন! এরপর একদিন এক গ্রামবাসী ওয়াকম্যানে গান শুনতে শুনতে বেখেয়ালে ঠিক খারাপ সাপের গা ঘেঁষে নাচতে নাচতে চলে

গেল। অথচ খারাপ সাপটি তাকে কামড়াল না। সেটি শুধু ধার্মিক একটা হাসি দিল।

 

তখন থেকে গ্রামবাসীরা বুঝতে পারল যে খারাপ সাপটি আর বিপদজনক নয়। সে যখন তার গর্তের বাইরে কু-লাকার ধারণ করে গোল হয়ে ধ্যানে বসে

থাকত। লোকজন নিশ্চিন্তে তার পাশ ঘেঁষে চলে যেত। এরপর গ্রামের কিছু দুষ্ট বালক তাকে উত্যক্ত করতে এলো। তারা নিরাপদ দূরত্বে থেকে বাক্যবাণ ছুঁড়ে দিল, ‘এই যে, বুকে ভর দিয়ে চলা শুকনো কাঠি! তোমার দাঁত দেখাও দেখি, যদি থাকে। এই বড় পোকা, তুমি তো একটা কাপুরুষ, ননীর দলা! তোমার বংশে তুমি একটা কলঙ্ক!’

 

সে তাকে ‘বুকে ভর দিয়ে চলা শুকনো কাঠি’ ডাকাটা পছন্দ করল না, যদিও কথাতে কিছুটা সত্য আছে। ‘বড় পোকা’ বলাটাও তার পছন্দ হলো না। কিন্তু

সে কীভাবে নিজেকে আত্মরক্ষা করবে? সে তো শপথ নিয়েছে কাউকে কামড়াবে না।

 

সাপটি নিষ্ক্রিয় হয়ে আছে দেখে বালকেরা আরও সাহসী হয়ে উঠল, আর পাথর এবং মাটির ঢেলা নিক্ষেপ করল। একটা পাথর গায়ে লাগাতে পারলে তারা হেসে উঠত। সাপটি জানত, সে বালকগুলোর যে কাউকে দ্রুত ছোবল দিয়ে শেষ করে দিতে পারে, এমনকি আপনি ‘বিশ্ব বন্যপ্রাণী তহবিল’ কথাটা পড়ে শেষ করার আগেই। কিন্তু তার শপথ তাকে এমন করা থেকে বিরত রাখল। এতে করে বালকেরা আরও কাছে এসে এবার লাঠি দিয়ে তার পিঠে মারতে শুরু করল। সাপটি সেই মারের ব্যথা সহ্য করল; কিন্তু সে বুঝল যে এই বাস্তব জীবনে নিজেকে রক্ষা করতে গিয়ে আপনাকে হীন ও ইতর হতে হবে। ধর্ম আসলেই কোনো কাজের নয়। তাই সে গায়ের ব্যথা সহ্য করেও পাহাড় বেয়ে উপরে উঠল সেই ভুয়া সাপের সাথে দেখা করার জন্য, আর তার শপথ

থেকে মুক্তি লাভের জন্য।

 

সাধু সাপ তাকে সারা শরীরে ক্ষত-বিক্ষত অবস্থায় আসতে দেখল আর জিজ্ঞেস করল, ‘কী হয়েছে তোমার?’

 

‘এটা তোমার দোষ।’ খারাপ সাপ তিক্ত স্বরে অভিযোগ করল।

 

‘সব আমার দোষ মানে? কী বলতে চাও তুমি?’ প্রতিবাদ করল সাধু সাপ। ‘তুমি আমাকে না কামড়াতে বলেছিলে। এখন দেখ আমার কী অবস্থা! ধর্ম

হয়তো এই বিহারে চলতে পারে; কিন্তু বাস্তব জগতে...’

 

সাধু সাপ তার কথায় বাধা দিয়ে বলল, ‘ওরে মুর্খ সাপ! ওরে হাঁদা সাপ! ওরে বোকা সাপ! এটা সত্যি যে আমি তোমাকে না কামড়াতে বলেছিলাম। কিন্তু আমি তো কখনোই হিস্ হিস্ করতে না করি নি, করেছি কি?’

 

জীবনে মাঝেমধ্যে দয়ার খাতিরে সাধু সন্তদেরও ‘হিস্ হিস’ করতে হয়।

কিন্তু কারোরই কামড়ানোর প্রয়োজন নেই।