প্রথম অধ্যায়

 

পরিপূর্ণতা ও অপরাধবোধ

 

দুটি খারাপ ইট

১৯৮৩ সালে আমাদের বিহারের জায়গা ক্রয় করার পরে নিঃস্ব হয়ে গেলাম আমরা। আমাদের প্রচুর দেনা হয়ে গেল। বিহারের জায়গাটিতে কোনো ঘরবাড়ি ছিল না। এমনকি কোনো ছাউনিও নয়। প্রথম কয়েক সপ্তাহ আমাদের পুরনো দরজাগুলোর উপরে ঘুমাতে হয়েছিল, যে দরজাগুলো আমরা সস্তায় পুরনো মালপত্রের দোকান থেকে কিনেছিলাম। দু-পাশে ইটের স্তুপ তুলে তার উপরে দরজাগুলো বিছিয়ে চৌকির মতো বানিয়েছিলাম। (সেখানে অবশ্য কোনো তোশক ছিল না, কেননা আমরা ছিলাম বনভিক্ষু।)

 

সবচেয়ে ভালো দরজাটা ছিল বিহারাধ্যক্ষের। সেটা ছিল সমান। আমার দরজাটার মাঝখানে বেশ বড়সড় একটা গর্ত যেখানে আগে দরজার নব লাগানো ছিল। দরজার নবটা তুলে ফেলার কারণে আমি বেশ খুশি, কিন্তু সমস্যা হলো আমার দরজা-বিছানাটায় ঠিক মাঝখানে একটা গর্ত রেখে গেল। আমি ঠাট্টা করে বলতাম, এখন আমার টয়লেটে যেতে আর বিছানা ছেড়ে উঠতে হবে না। হিম শীতল সত্য হলো যে, ছিদ্রটার মধ্য দিয়ে বাতাস আসত। সেই রাতগুলোতে আমি খুব বেশি ঘুমাতাম না।

 

আমরা ছিলাম গরিব ভিক্ষু যাদের ঘরবাড়ির দরকার ছিল। কিন্তু ঘরবাড়ি তোলার জন্য লোক নিয়োগ করার সামর্থ্য আমাদের ছিল না। জিনিসপত্রও ছিল অনেক ব্যয়বহুল। তাই আমাকে শিখতে হয়েছিল কী করে নির্মাণ করতে হয়, কীভাবে ফাউন্ডেশন দিতে হয়, কংক্রিট ও ইট কীভাবে বিছাতে হয়, কীভাবে ছাদ দিতে হয়, কীভাবে পাইপ লাইন বসাতে হয় - সবকিছু। গৃহীজীবনে আমি ছিলাম তাত্ত্বিক পদার্থবিদ এবং এক হাইস্কুলের শিক্ষক। হাতের কাজ করার অভ্যাস আমার ছিল না। কিন্তু কয়েক বছর পরে আমি মিস্ত্রির কাজে বেশ দক্ষ হয়ে উঠলাম। আমার লোকজনকে তখন আমি বলতাম বিবিসি (বুড্ডিস্ট বিল্ডিং কোম্পানি)। শুরুর দিকে আমার সময়টা এমনই কঠিন ছিল।

 

ইট বিছানোটা সহজ মনে হতে পারে, এক দলা মশলা নিচে দিয়ে, ইটের এক কোণায় একটা বাড়ি, আরেক কোণায় এক বাড়ি, ব্যস। যখন আমি ইট বিছানো শুরু করলাম, এক কোণায় বাড়ি দিয়ে সমান করার চেষ্টা করলাম, আরেক কোণা উঁচু হয়ে উঠে গেল। তাই আমি সেই কোণাটায় বাড়ি দিলাম। এতে করে পুরো ইটটাই বেলাইনে চলে গেল। ঠেলেঠুলে এটাকে লাইনে আনলে প্রথম কোণাটি আবার উঁচু হয়ে রইল। আপনি নিজেই করে দেখুন না!

ভিক্ষু হওয়াতে আমার ধৈর্য ও সময় যথেষ্ট ছিল। আমি নিশ্চিত করলাম যেন প্রত্যেকটি ইট সুন্দরভাবে বসানো হয়, যত সময় লাগুক না কেন। অবশেষে আমার প্রথম ইটের দেয়াল বানানো শেষ করে একটু পেছনে গিয়ে প্রশংসার দৃষ্টিতে দেখলাম নিজের সৃষ্টিকে। কেবল তখনই আমার চোখে পড়ল, হায়! হায়! আমি দুটো ইটকে নষ্ট করেছি! সবগুলো ইটই সারিবদ্ধভাবে সাজানো, কেবল এই দুটো ইট বাঁকা হয়ে গেছে। সেগুলোকে দেখতে খুব বিশ্রী দেখাচ্ছিল। তারা পুরো দেয়ালটাকেই নষ্ট করেছে। তারা এর সৌন্দর্যটাকে ধ্বংস করে দিয়েছে।

 

বিহারের অতিথিদের আমাদের নতুন বিহার দেখাতে গিয়ে সব সময় আমি তাদের আমার ইটের দেয়ালের ওদিকে নিয়ে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে চাইতাম। আমার ভুলটা অন্য কেউ দেখুক এটা আমার সহ্য হতো না। এরপর তিন চার মাস পরে বিহারের কাজ শেষ হলে একদিন এক অতিথিকে নিয়ে

বেড়ানোর সময় দেয়ালটা দেখল সে।

‘এটা তো সুন্দর একটা দেয়াল!’ সে মন্তব্য করল।

আমি অবাক হয়ে বললাম, ‘স্যার, আপনি কি আপনার চশমা গাড়িতে ফেলে এসেছেন? আপনার কি চোখের সমস্যা আছে? আপনি কি ওই দুটো খারাপ ইটকে দেখেন নি, যেগুলো পুরো দেয়ালটাকে নষ্ট করেছে?’

 

সে এর উত্তরে যা বলল তা দেয়ালটা সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গিকে পুরোপুরি পাল্টে দিল, নিজের সম্পর্কে ধারণা তো পাল্টালই। জীবনের অন্যান্য দিকগুলোও পাল্টে গেল। সে বলল, ‘হ্যাঁ, আমি ওই খারাপ ইট দুটো দেখেছি, কিন্তু আমি সেই সাথে ৯৯৮টা ভালো ইটও দেখেছি।’

 

আমি হতবাক হয়ে গেলাম। তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে এই প্রথমবার আমি দুটো ভুলের পাশাপাশি অন্যান্য ভালো ইটগুলোকেও দেখলাম। সেই খারাপ ইটগুলোর উপরে, নিচে, বামে, ডানে ছিল ভালো ইট, সুন্দরভাবে সাজানো ইট। তা ছাড়া সুন্দরভাবে সাজানো ইটগুলো ছিল দুটো খারাপ ইটের তুলনায় বহু বহুগুণ বেশি। আগে আমার দৃষ্টি পড়ে থাকত কেবল আমার দুটো ভুলের উপরে, বাকি সব বিষয়ে আমি ছিলাম অন্ধ। অবশ্যই আমি দেয়ালের দিকে তাকাতে পারতাম না, অন্য কাউকেও তা দেখাতে কুণ্ঠিত ছিলাম। এজন্যই আমি দেয়ালটাকে ধ্বংস করে দিতে চেয়েছিলাম। এখন আমি ভালো ইটগুলো

দেখতে পেয়েছি, দেয়ালটা এখন আর অত খারাপ দেখাচ্ছে না। এটা ছিল সেই অতিথির কথায় ‘একটা সুন্দর ইটের দেয়াল’। দেয়ালটা এখনো সেখানে আছে, কিন্তু বিশ বছর পরে আমি এখন ভুলে গেছি, সেই দুটো খারাপ ইট দেয়ালটার ঠিক কোন জায়গায় আছে। আক্ষরিক অর্থেই এখন আর আমি সেই ভুলগুলোকে দেখি না।

কত লোক তাদের সম্পর্ককে শেষ করে দেয় অথবা বিবাহবিচ্ছেদ করে, কারণ তারা শুধুমাত্র তাদের সঙ্গীর ‘দুটো খারাপ ইট’কেই দেখে? আমাদের মধ্যে কতজন হতাশ হয়ে পড়ি, এমনকি আত্মহত্যা করার কথাও ভাবি, কারণ আমরা আমাদের মাঝে কেবল ‘দুটো খারাপ ইট’কেই দেখি? সত্যি কথা হচ্ছে, দোষগুলোর উপরে, নিচে, বামে, ডানে অনেক অনেক ভালো ইট, সাজানো ইট আছে, কিন্তু মাঝে মাঝে আমরা সেগুলোকে দেখি না। তার বদলে প্রতিবার আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় ভুলগুলোর উপরে। আমরা দেখি কেবল ভুলগুলো, ভাবি কেবল সেগুলোরই কথা, তাই আমরা সেগুলোকে ধ্বংস করতে চাই। আর দুঃখের কথা যে, মাঝে মাঝে আমরা সত্যিই এভাবে ‘খুব সুন্দর দেয়াল’কে ধ্বংস করে দিই।

 

আমাদের সবারই দুয়েকটা খারাপ ইট আছে, কিন্তু সুন্দর, সাজানো ইট আছে খারাপগুলোর চেয়ে অনেক, অনেক বেশি। যখন আমরা এভাবে দেখি, তখন কোনো কিছু আর অতটা খারাপ বলে মনে হয় না। এতে করে আমরা আমাদের ত্রুটি দেখেও নিজেদের মেনে নিয়ে শান্তিতে থাকি। শুধু নিজেদের নিয়েই নয়, সঙ্গীদের সাথে থাকাটাও তখন আমরা উপভোগ করি। এটা বিবাহবিচ্ছেদের উকিলদের জন্য খারাপ খবর হতে পারে, কিন্তু আপনার জন্য ভালো খবর।

 

আমি এই গল্পটা অনেকবার বলেছি। একবার এক মিস্ত্রি আমার কাছে তাদের একটা পেশাগত গোপনীয় তথ্য জানাল। সে বলল, ‘আমরা মিস্ত্রিরা সব সময় ভুল করি, কিন্তু আমরা কাস্টমারদের বলি যে এটা একটা নতুন ডিজাইন, যা আশেপাশের কোনো বাড়িতে নেই। আর এর জন্য আমরা তাদের কাছ থেকে আরও অতিরিক্ত কয়েক হাজার ডলার আদায় করি।’

 

কাজেই আপনার বাড়িটার অনন্য ডিজাইনটাই হয়তো একটা ভুল থেকে শুরু হয়েছে। একইভাবে যেটাকে আপনি আপনার ভুল, আপনার সঙ্গীর ভুল বা সাধারণভাবে জীবনের ভুল হিসেবে ভাবছেন, সেটাই হয়তো অনন্য বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠতে পারে, আপনার সময়কে গুরুত্বপূর্ণ করে তুলতে পারে, যখন আপনি ‘শুধুমাত্র তাদের’ দেখা বন্ধ করবেন।

 

বিহারের বাগান

জাপানের বৌদ্ধ বিহারগুলো তাদের বাগানের জন্য বিখ্যাত। অনেক বছর আগে সেখানে এক বিহার ছিল যা তার অসাধারণ সুন্দর বাগানের জন্য গর্ব করত। সারা দেশ থেকে লোকজন আসত শুধুমাত্র এর মনকাড়া সাজসজ্জা ও সুন্দর নান্দনিকতা উপভোগের জন্য।

 

একবার এক বৃদ্ধ ভিক্ষু সেখানে বেড়াতে এলো। সে খুব সকালে এসে পৌঁছল, ভোর হওয়ার পরপরই। সে আবিষ্কার করতে চাইল, কেন এই বাগানটা সবচেয়ে প্রেরণাদায়ী বলে খ্যাত? তাই সে একটা বড় ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রইল, যেখান থেকে পুরো বাগানটা দেখা যায়।

 

সে দেখল এক তরুণ ভিক্ষু বিহার থেকে হাতে দুটো বড় ঝুড়ি নিয়ে বের হলো। পরের তিন ঘণ্টা ধরে বুড়ো ভিক্ষুটি দেখল যে, তরুণ ভিক্ষুটি সাবধানে প্রত্যেকটি পাতা ও ডালপালা কুড়িয়ে নিল যেগুলো বাগানের মাঝে থাকা গাছটি হতে ঝরে পড়েছিল। প্রত্যেকটি পাতা ও ডাল তুলে নিয়ে সে তার কোমল হাতে এটিকে উল্টে পাল্টে দেখল, পরীক্ষা করল, গভীরভাবে এটি নিয়ে ভাবল। পছন্দ হলে সে এটিকে একটি ঝুড়িতে রাখল। পছন্দ না হলে সে সেটি দ্বিতীয় ঝুড়িতে রাখল, যেটি হচ্ছে আবর্জনার ঝুড়ি। প্রত্যেকটি পাতা ও ডাল কুড়িয়ে নিয়ে

সেগুলো নিয়ে চিন্তা ভাবনা করে এরপর সে আবর্জনার ঝুড়িটি বিহারের পিছন দিকে নিয়ে গিয়ে খালি করল, আর একটু থেমে চা পান করল। এরপর সে তার মনকে প্রস্তুত করল পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ ধাপের জন্য।

 

তরুণ ভিক্ষুটি আরও তিন ঘণ্টা ব্যয় করে গভীর মনোযোগ দিয়ে, যত্ন ও দক্ষতার সাথে প্রত্যেকটি পাতা ও ডালকে বাগানের একেবারে সঠিক জায়গায় বসাল। যদি কোনো ডালের অবস্থান তার মনের মতো না হতো, সে এটাকে সামান্য ঘোরাত, অথবা সামান্য সামনের দিকে সরিয়ে দিত, যতক্ষণ না তার মুখে সন্তুষ্টির স্মিত হাসি ফুটে উঠত। এরপর সে পরবর্তী পাতাটার আকার ও রং থেকে বাগানে এর সঠিক জায়গাটা বেছে নিত। খুঁটিনাটি সবকিছুর প্রতিও তার মনোযোগ ছিল অতুলনীয়। রং ও আকারের সাজসজ্জায় তার দক্ষতা ছিল অপুর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে তার ছিল গভীর জ্ঞান। তার কাজ শেষ হলে বাগানটাকে অনিন্দ্য সুন্দর দেখাল।

 

এরপর বুড়ো ভিক্ষুটা বাগানে বেরিয়ে এলো। ভাঙা দাঁতের পিছন থেকে একটা হাসি দিয়ে সে তরুণ ভিক্ষুটিকে অভিনন্দন জানাল, ‘চমৎকার! চমৎকার হয়েছে ভন্তে আমি তোমাকে সারাটা সকাল ধরে লক্ষ করেছি। তোমার অধ্যবসায় সর্বোচ্চ প্রশংসার যোগ্য। আর তোমার বাগান ... হুম! তোমার বাগানটা প্রায় নিখুঁত হয়েছে।’

 

তরুণ ভিক্ষুটির মুখ সাদা হয়ে গেল। তার শরীর শক্ত হয়ে গেল যেন কাঁকড়াবিছে কামড়েছে। তার মুখ থেকে আত্মসন্তুষ্টির হাসি খসে পড়ল, আর সে

যেন শূন্যতার এক গভীর খাদে পড়ে গেল। জাপানে, বুড়ো হাসিখুশি ভিক্ষুদের বিষয়ে আপনি কখনোই নিশ্চিত থাকতে পারবেন না।

 

সে ভয়ে ভয়ে তোতলাতে তোতলাতে বলল, ‘আপনি কী - কী বলতে চান? প্রায় নিখুঁত বলতে আপনি কী - কী বুঝাতে চান?’ আর সে বুড়ো ভিক্ষুটির পায়ে পড়ে গেল। ‘ও প্রভু, ও আমার গুরু, প্লিজ, আপনার দয়া আর মৈত্রী বষর্ণ করুন আমার উপরে। নিশ্চয়ই বুদ্ধ আপনাকে পাঠিয়েছেন আমার বাগানকে কীভাবে আরও নিখুঁত করা যায় তা দেখাতে। আমাকে শিখিয়ে দিন, ও মহাজ্ঞানী, আমাকে পথ দেখান!’

 

‘তুমি কি সত্যিই চাও আমি তোমাকে দেখিয়ে দিই?’ বুড়ো ভিক্ষুটি জিজ্ঞেস করল। তার বয়স্ক চেহারায় সামান্য দুষ্টুমির ছাপ!

 

‘জ্বি হ্যাঁ, দয়া করে দেখান, প্লিজ, মাস্টার!’

 

অতএব বুড়ো ভিক্ষুটি বাগানের মাঝে হেঁটে গেল। সে তার জীর্ণ কিন্তু এখনো সবল দুটো হাত সেই পাতাবহুল গাছটার উপর রাখল। এরপর বিরাট একটা সাধুমার্কা হাসি দিয়ে সে বেচারা গাছটাকে বিশাল একটা ঝাঁকুনি দিল! পাতা, ডালপালা আর বাকল ছড়িয়ে পড়ল সবখানে, কিন্তু সে ঝাঁকাতেই থাকল গাছটাকে। যখন আর ঝরার মতো কোনো পাতা রইল না, তখন সে থামল।

 

তরুণ ভিক্ষুটি স্তব্দ হয়ে গেল। তার বাগান ধ্বংস হয়ে গেল। সারা সকালের কাজ পুরো বরবাদ। বুড়ো ভিক্ষুটিকে মেরে ফেলার ইচ্ছে হলো তার। কিন্তু

বুড়োটি চারপাশে তাকিয়ে নিজের কীর্তি দেখতে ব্যস্ত তারপরে একটা হাসি - যে হাসিতে রাগ গলে যায় - এমন হাসি দিয়ে সে ভদ্রভাবে তরুণ ভিক্ষুটিকে

বলল, ‘এখন তোমার বাগানটি সত্যিই নিখুঁত।’

 

যা করা হয়েছে তা-ই সমাপ্ত

থাইল্যান্ডে বর্ষাকাল হচ্ছে জুলাই থেকে অক্টোবর। এ সময় ভিক্ষুরা বেড়ানো বন্ধ করে, তাদের সব কাজ তুলে রাখে আর পড়াশোনা এবং ধ্যানে নিজেকে ডুবিয়ে রাখে। এই সময়টাকে বলা হয় বর্ষাবাস।

 

থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চলে কয়েক বছর আগে একজন বিখ্যাত ভিক্ষু তার বনবিহারের জন্য একটা নতুন হল বানাচ্ছিল। যখন বর্ষা এলো, সে সব কাজ বন্ধ করল, আর নির্মাণকারীদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিল। তার বিহারে এই সময়টা ছিল নিরবতার সময়।

 

কয়েক দিন পরে এক দর্শনার্থী আসল, অর্ধনির্মিত বিল্ডিংটা দেখল, আর অধ্যক্ষকে জিজ্ঞেস করল, কখন তার বিল্ডিংটা সম্পূর্ণ হবে। ইতস্তত না করেই বুড়ো ভিক্ষুটি বলল, ‘হলটি সমাপ্ত।’

 

‘হলটি সমাপ্ত’ মানে কী বলতে চাচ্ছেন?’ অবাক হয়ে দর্শনার্থী জানতে চাইল। ‘এর ছাদটাও এখনো দেয়া হয় নি। দরজা নেই, জানালা নেই, সারা

ফ্লোর জুড়ে কাঠের টুকরো আর সিমেন্টের বস্তা ছড়িয়ে আছে। আপনি কি এটাকে এভাবেই রেখে দেবেন? আপনি কি পাগল হয়ে গেছেন? হলটি সমাপ্ত -

কথার মানে কী?’

বুড়ো অধ্যক্ষ হেসে ভদ্রভাবে উত্তর দিল, ‘যা করা হয়েছে, তা-ই সমাপ্ত।’ এই বলে সে ধ্যান করতে চলে গেল। এভাবেই কাজের মাঝে একটা ব্রেক নিতে হয়। তা না-হলে আমাদের কাজ কখনোই শেষ হবার নয়।

 

মনের শান্তির জন্য বোকাদের গাইড

আমি এক শুক্রবার পার্থে বহুসংখ্যক শ্রোতার সামনে আগের গল্পটা বলেছিলাম। পরের দিন রোববার এক ক্রুদ্ধ পিতা এসে আমাকে বকা দিল। সে তার কিশোর ছেলেকে নিয়ে শুক্রবারের ওই দেশনাটা শুনেছিল। শনিবার সন্ধ্যায় ছেলেটি বন্ধুদের নিয়ে বাইরে যেতে চাইল। তার পিতা তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘বাবা, তুমি কি তোমার বাড়িকাজগুলো করেছ?’ তার ছেলে জবাব দিল, ‘বাবা, আজান ব্রক্ষ্ম গত রাতে আমাদের যেভাবে শিখিয়েছেন, যা করা হয়েছে, তা-ই সমাপ্ত। পরে দেখা হবে।’

 

পরের সপ্তাহে আমি আরেকটা গল্প বললাম।

 

অস্ট্রেলিয়ার বেশির ভাগ লোকেরই তাদের বাড়িতে একটা করে বাগান আছে। কিন্তু কেবল গুটি কয়েকজন জানে, কী করে তাদের বাগানে শান্তি খুঁজে নিতে হয়। অন্যদের জন্য বাগান হলো কাজ করার জায়গা। তাই আমি সেই বাগানওয়ালাদের কিছুক্ষণ বাগানে কাজ করে এটিকে আরও সুন্দর করে তুলতে উৎসাহিত করি, আর তাদের মনের সৌন্দর্যের জন্য শান্ত হয়ে বাগানে বসে থাকতে বলি, প্রকৃতির উপহারকে উপভোগ করার জন্য বলি।

 

প্রথমবোকা ভাবে, এটা তো খুব ভালো কথা। তাই তারা প্রথমে ছোটখাট কাজগুলো করে ফেলতে মনস্থির করে। এর পরে তারা তাদের বাগানে কয়েক মুহূর্ত শান্তি উপভোগ করতে পারবে। যেহেতু বাগানের ঘাসগুলো ছাঁটা দরকার, ফুলগাছে একটু পানি দিলে ভালো হয়, পাতাগুলো কুড়ালে ভালো হয়, ঝোপগুলো ছোট করা দরকার, পথটা ঝাড়ু দেওয়া দরকার... এই ‘ছোটখাট কাজ’ সমাধা করতেই তাদের পুরো অবসর সময় চলে যায়। তাদের কাজ কখনোই শেষ হয় না। আর তাই তারাও কয়েক মিনিটের জন্য মনে শান্তি পায় না। আপনি কি খেয়াল করেছেন, আমাদের সমাজে কেবল কবরে থাকা লোকেরাই শান্তিতে বিশ্রাম নেয়?

 

দ্বিতীয় বোকারা ভাবে যে তারা প্রথমবোকা থেকে চালাক। তারা ঝাড়ু, পানি দেওয়ার বালতি, সবকিছু দূরে সরিয়ে রেখে বাগানে বসে বসে কোনো একটা ম্যাগাজিন পড়তে থাকে, সম্ভবত বড় বড় ঝকঝকে প্রকৃতির ছবিওয়ালা ম্যাগাজিন। কিন্তু সেটা তো ম্যাগাজিনকে উপভোগ করা, বাগানে শান্তি খুঁজে পাওয়া নয়।

 

তৃতীয় বোকা বাগানের সব যন্ত্রপাতি দূরে ফেলে দেয়, সব ম্যাগাজিন, সংবাদপত্র, রেডিও সবকিছু সরিয়ে রাখে আর বাগানে শুধু শান্তিতে বসে থাকে... মাত্র দু সেকেন্ডের জন্য! এরপর তারা ভাবতে শুরু করে : ‘বাগানের ঘাসগুলো আসলেই ছাঁটা দরকার। আর ওই ঝোপগুলো শীঘ্রই ছাঁটা উচিত। যদি আমি ওই ফুলগুলোতে পানি না দিই, কয়েক দিনের মধ্যেই সেগুলো মারা যেতে পারে। ওই কোণায় একটা সুন্দর গার্ডেনিয়ার ঝোপ লাগালে ভালো হবে। ইয়েস! সামনে ওই পাতাবাহারগুলো হলে দারুণ দেখাবে। আমি নার্সারি থেকে একটা আনতে পারি...’ অর্থাৎ সে উপভোগ করছে চিন্তা ও পরিকল্পনাকে। সেখানে

কোনো মনের শান্তি নেই।

 

চালাক বাগানকারী ভাবে, ‘আমি অনেকক্ষণ কাজ করেছি। এখন আমার কাজের ফল উপভোগের সময়। শান্তির পদধ্বনি শোনার সময়। তাই বাগানের ঘাসগুলো হয়তো ছাঁটার দরকার, ঝরা পাতাগুলো কুড়ানো দরকার... ইত্যাদি ইত্যাদি! কিন্তু সেগুলো এখন নয়।’ এভাবে আমরা বাগানকে উপভোগ করার জ্ঞান অর্জন করতে পারি, যদিও বাগানটা নিখুঁত নয়।

 

সম্ভবত ঝোপের আড়ালেই কোথাও লুকিয়ে আছে সেই বুড়ো জাপানী ভিক্ষুটি, যে ঝাঁপ দিয়ে বাগানে বেরিয়ে আসার জন্য প্রস্তুত এবং সে এটাই বলতে চায় যে আমাদের হযবরল পুরনো বাগানটি সত্যিই নিখুঁত। প্রকৃতপক্ষে আমরা যদি যা কাজ করেছি তার হিসাব করি, যা করা বাকি তাতে মন দেওয়ার বদলে, তখন হয়তো বুঝব যে, যা করা হয়েছে তা সমাপ্ত হয়ে গেছে। কিন্তু যদি আমরা কেবল আমাদের দোষ দেখে থাকি, সেই জিনিসগুলো দেখি যেগুলো ঠিক করা দরকার, যেমনটা আমার বিহারের সেই ইটের দেয়ালের মতো, আমরা কখনোই শান্তি খুঁজে পাব না।

 

বুদ্ধিমান বাগানকারী তাদের পনের মিনিটের শান্তিকে প্রকৃতির নিখুঁত অসম্পূর্ণতার মাঝে উপভোগ করে থাকে। কোনো চিন্তা নেই, কোনো পরিকল্পনা

নেই, নিজেকে দোষী ভাবার নেই। আমরা সবাই ন্যায্যত কিছু শান্তি উপভোগ করার যোগ্য। আর অন্যরা ন্যায্যত আমাদের শান্তিকে তাদের পথের বাইরে রাখতে পারে। অতঃপর আমাদের খুবই গুরুত্বপূর্ণ জীবন বাঁচানো পনের মিনিটের শান্তিকে বের করে নিয়ে আমরা আমাদের বাগানের কাজে আবার হাত দিই।

 

যখন আমরা আমাদের বাগানে কীভাবে শান্তি খোঁজা যায়, তা বুঝতে পারি, তখন যেকোনো সময়ে যেকোনো জায়গায় কী করে শান্তি খুঁজে পেতে হয় তাও

জেনে যাব। বিশেষভাবে আমরা জানব কী করে আমাদের হৃদয়ের বাগানে শান্তি খুঁজে পেতে হয়, যদিও মাঝে মাঝে আমাদের মনে হতে পারে, সবকিছু এত অগোছালো আর কত কী যে করার বাকি রয়ে গেছে এখনো!

 

অপরাধবোধ ও তা থেকে মুক্তি

কয়েক বছর আগে এক অস্ট্রেলিয়ান তরুণী পার্থে আমাদের বিহারে আসল আমার সাথে দেখা করতে। ভিক্ষুদের প্রায়ই খোঁজা হয় লোকজনের সমস্যাগুলো সম্পর্কে পরামর্শ চাওয়ার জন্য, এর কারণ সম্ভবত আমরা খুব সস্তা। আমরা পরামর্শ দিই, কিন্তু বিনিময়ে কোনো ফি দাবি করি না। তো, অপরাধবোধে সেই তরুণীর হৃদয় ভারাক্রান্ত ছিল। ছয় কি সাত মাস আগে, সে পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার উত্তর প্রান্তে একটি প্রত্যন্ত খনি অঞ্চলে কাজ করত। কাজটি পরিশ্রমের হলেও টাকা ভালোই দিত। তবে কাজের সময়ের পরে করার মতো তেমন কিছু থাকত না। তাই সে এক রবিবার বিকেলে তার সেরা বান্ধবী এবং তার বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ডকে বলল, গাড়িতে করে একটু বের হলে কেমন হয়। তার বান্ধবী যেতে চাচ্ছিল না, ছেলেটাও নয়, কিন্তু একা গিয়ে তো আর মজা নেই। যতক্ষণ না তারা রাজি হলো, ততক্ষণ পর্যন্ত সে মিষ্টি কথায় তাদের ভোলানোর চেষ্টা করল, তর্ক করল, আর প্যানপ্যানানি চালিয়ে গেল।

 

কিন্তু যাওয়ার পথে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেল। ঝুরঝুরে নুঁড়ি পাথরে গাড়িটি সিল্প করে গড়িয়ে গেল। তার বান্ধবী মারা গেল, আর বান্ধবীর বয়ফ্রেন্ডটি পঙ্গু হয়ে গেল। বেড়াতে যাওয়ার বুদ্ধিটা ছিল তরুণীটির, কিন্তু তার কিছু হয় নি। সে আমাকে বেদনাভরা চোখে বলল, ‘আমি যদি তাদের যাওয়ার জন্য জোর না করতাম, তাহলে সে এখনো এখানে বেঁচে থাকত। তার বয়ফ্রেন্ডের এখনো পা থাকত। আমার তাদের জোর করা উচিত হয় নি। আমার খুব খারাপ লাগে। আমি নিজেকে এমন অপরাধী বলে বোধ করি।’

 

আমার মনে যে প্রথমচিন্তাটা আসল তা ছিল তাকে আশ্বস্ত করা যে এটা তার দোষ নয়। সে তো আর দুর্ঘটনার পরিকল্পনা করে নি। তার বন্ধুদের আহত করারও কোনো ইচ্ছে তার ছিল না। এমন ঘটনা ঘটে। এটাকে যেতে দাও। নিজেকে অপরাধী ভেবো না। কিন্তু আরেকটা চিন্তা মাথায় আসল, ‘আমি বাজি ধরে বলতে পারি যে এই কথাটা সে এর আগে শতবার শুনেছে, আর দেখে বোঝা যাচ্ছে এতে কাজ হয় নি।’ তাই আমি একটু সময় নিলাম, তার অবস্থাকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করলাম, এরপর আমি তাকে বললাম, ভালো যে তুমি নিজেকে অপরাধী মনে করছ।

তার মুখের চেহারায় বেদনা থেকে বিস্ময় দেখা দিল, আর বিস্ময়ের পরে এলো স্বস্তি। নিজেকে অপরাধী ভাবা উচিত - এমন কথা সে এর আগে শোনেনি। আমার অনুমান ঠিক ছিল। তার অপরাধবোধের জন্য সে নিজেকে অপরাধী ভাবত। অথচ অন্যরা তাকে বলত, নিজেকে অপরাধী ভেবো না। এতে সে দ্বিগুণ ‘অপরাধী’ মনে করত নিজেকে - যার একটা হচ্ছে দুর্ঘটনার জন্য, আরেকটা হচ্ছে নিজেকে অপরাধী ভাবার জন্য। আমাদের জটিল মন এভাবেই কাজ করে।

 

আমরা যখন প্রথম স্তরের অপরাধবোধ নিয়ে কাজ করলাম, আর নিজেকে অপরাধী ভাবাটাই সঠিক বলে মেনে নিলাম, কেবল তখনই সমাধানের দ্বিতীয় ধাপে এগোন গেল। এবার এটা নিয়ে কী করা যায়?

 

একটা বৌদ্ধ প্রবাদ আছে, ‘অন্ধকার নিয়ে অভিযোগ না করে বরং একট মোমবাতি জ্বালাও।’

 

মন খারাপ করার বদলে সব সময়ই আমরা একটা কিছু করতে পারি, সেই একটা কিছু যদি হয় অভিযোগ না করে শুধু শান্তভাবে কিছুক্ষণ বসে থাকা,

সেটাও সঠিক একটা কাজ।

 

অনুশোচনা থেকে অপরাধবোধ যথেষ্ট ভিন্ন আমাদের সংস্কৃতিতে ‘অপরাধী’ হচ্ছে আদালতের বিচারকের দ্বারা শক্ত কাঠের উপরে হাতুড়ির বাড়ি দিয়ে বের করা রায়। আর যদি কেউ আমাদের শাস্তি না দেয়, আমরা নিজেদের শাস্তি দেওয়ার পথ খুঁজি, এক পথে না হয় অন্য পথে। অপরাধবোধ হচ্ছে আমাদের মনের গভীরের শাস্তি।

 

তাই তরুণীটির অপরাধবোধ থেকে মুক্তির জন্য দরকার ছিল প্রায়শ্চিত্ত। ভুলে যেতে বলা আর জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বলাতে কাজ হতো না।

আমি পরামর্শ দিলাম যে সে স্থানীয় হাসপাতালগুলোর পুনর্বাসন শাখায় স্বেচ্ছায় সাহায্য করতে পারে, গাড়ি দুর্ঘটনায় আহতদের চিকিৎসা করতে পারে। আমি চিন্তা করেছিলাম, সেখানে কঠোর শ্রম দিয়ে সে তার অপরাধবোধকে ক্ষয় করতে পারবে। আর সেই সাথে স্বেচ্ছাশ্রমে সাধারণত যেমন হয়, সে যাদের সাহায্য করতে সেখানে কাজ করবে, তারাই উল্টো তাকে নিজেকে ফিরে পেতে বেশি করে সাহায্য করবে।

 

অপরাধীদের অপরাধবোধ

বিহারাধ্যক্ষ হওয়াটা সম্মানের, কিন্তু কাজের চাপ প্রচুর। এই পদটা চাপিয়ে দেওয়ার আগে আমি প্রায়ই পার্থের জেলখানাগুলোতে যেতাম। আমি খুব নিখুঁতভাবে জেলখানায় কত ঘণ্টা সার্ভিস দিয়েছি তার একটা হিসেব রেখেছি। বলা তো যায় না, যদি কখনো জেলখানায় যেতে হয়, তখন তা উপকারে আসতে পারে।

পার্থের বড় জেলখানাটায় প্রথমবার গিয়েছিলাম ধ্যানের উপরে দেশনাত দেওয়ার জন্য। দেশনা শুনতে এত কয়েদি হাজির হয়েছিল যে আমি রীতিমতো অবাক ও মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। রুমটা একেবারে ভরে গিয়েছিল। কয়েদিদের মধ্যে ৯৫% উপস্থিত হয়েছিল ধ্যান শেখার জন্য। আমি যতই কথা বলতে লাগলাম, ততই তাদের উসখুস বাড়তে লাগল। দশ মিনিট যেতে না যেতেই কয়েদিদের একজন, যে ছিল দাগী আসামীদের অন্যতম, সে তার হাত তুলল প্রশ্ন করার জন্য। আমি তাকে জিজ্ঞেস করতে দিলাম। সে বলল, ‘এটা কি সত্যি যে ধ্যানের মাধ্যমে শূন্যে ভাসাটা শেখা যায়?’

 

তখনই আমি জানলাম, কেন এতজন কয়েদি ধ্যান শিখতে চায়। তারা সবাই ধ্যান শেখার প্ল্যান করছে শূন্যে ভেসে ভেসে জেলখানার দেয়াল টপকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি বললাম যে এটা সম্ভব, কিন্তু শুধু অসাধারণ ধ্যানীদের জন্য, আর তাও বহু বছরের ট্রেনিংয়ের পরে। এর পরের বার যখন গেলাম, মাত্র চারজন কয়েদি দেশনা শুনতে হাজির হয়েছিল।


এত বছর জেলখানায় শিক্ষা দেওয়ার সময়ে কয়েকজন কয়েদির সাথে আমার খুব ভালো পরিচয় হয়ে গেছে। একটা বিষয় আমি দেখেছি যে প্রত্যেক অপরাধীই তাদের কৃতকর্মের জন্য মনে মনে অপরাধবোধে ভুগে থাকে। তারা এটা দিনে রাতে অনুভব করে, তাদের মনের গভীরে। তারা এটা প্রকাশ করে শুধু তাদের কাছের বন্ধুদের কাছে। প্রকাশ্যে কিন্তু তারা এটা অস্বীকার করে। কিন্তু যখন আপনি তাদের বিশ্বাসভাজন হবেন, যখন আপনি তাদের আধ্যাত্মিক গুরু হয়ে উঠবেন কিছু সময়ের জন্য, তখন তারা সবকিছু খুলে বলে এবং তাদের করুণ ও বেদনাদায়ক অপরাধকে প্রকাশ করে। আমি প্রায়ই তাদের নিচের গল্পটি শুনিয়ে একটু সাহায্য করি। গল্পটা হচ্ছে বি ক্লাসের বাচ্চাদের গল্প।

 

বি ক্লাসের শিশুরা

অনেক বছর আগে ইংল্যান্ডের কোনো এক স্কুলে গোপনে একটা পরীক্ষা করা হয়েছিল শিক্ষার উপরে। সেখানে একই বয়সের বাচ্চাদের জন্য দুটো ক্লাস ছিল। বছর শেষে একটা পরীক্ষা নেওয়া হলো, যেখান থেকে ছেলেমেয়েদের পরবর্তী ক্লাসে ওঠার জন্য বাছাই করা হলো। কিন্তু সেই পরীক্ষার ফলাফল কখনোই প্রকাশ করা হয়নি। খুব গোপনে, যা শুধু অধ্যক্ষ এবং মনস্তত্ত্ববিদরা জানতেন, যে শিশুটি পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিল, তাকে ফেলে দেওয়া হলো চতুর্থ ও পঞ্চম, অষ্টম ও নবম, বারতম ও তেরতম ইত্যাদি স্থান পাওয়া শিশুদের সাথে।

 

দ্বিতীয়, তৃতীয় হওয়া শিশুদের অন্য ক্লাসে নিয়ে যাওয়া হলো যেখানে আরও ছিল ষষ্ঠ, সপ্তম, দশম ও একাদশ ইত্যাদি স্থানপ্রাপ্ত শিশুরা। অর্থাৎ পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে ছেলেমেয়েদের দুটো ক্লাসে সমান করে ভাগ করে দেওয়া হলো। পরের বছরের জন্য সমান দক্ষতাসম্পন্ন শিক্ষকও নির্বাচন করা হলো খুব সতর্কতার সাথে। দুটো ক্লাসের জন্য শেণ্রী কক্ষগুলোও নির্বাচন করা হলো সমান সুযোগ-সুবিধাসহ। সবকিছুতেই যথাসাধ্য সমতা আনার চেষ্টা করা হলো, শুধু একটা জিনিস বাদে। আর তা হলো, একটা ক্লাসের নাম দেওয়া হলো ‘ক্লাস এ’; অন্যটা ‘ক্লাস বি’।

 

প্রকৃতপক্ষে দুটো ক্লাসেরই শিশুরা ছিল সমান দক্ষতাসম্পন্ন কিন্তু প্রত্যেকের মনে এই ধারণা হলো যে এ ক্লাসের শিশুরা অনেক চালাক। আর বি ক্লাসের শিশুরা অতটা চালাক নয়। এ ক্লাসের শিশুদের মধ্যে কয়েকজনের বাবা-মা তাদের ছেলেমেয়েদের এমন সাফল্যের কথা শুনে রোমাঞ্চিত হলেন এবং তাদের আদর ও প্রশংসা দিয়ে পুরস্কৃত করলেন, যেখানে বি ক্লাসের শিশুদের কয়েকজনের বাবা মা তাদের বাচ্চাদের ভালোমতো পড়াশোনা না করার জন্য বকা দিলেন, আর কিছু সুবিধা তুলে নিলেন। এমনকি শিক্ষকেরাও বি ক্লাসের শিশুদের অন্যভাবে পড়াত। তাদের কাছ থেকে খুব বেশি কিছু আশা করত না। এক বছর ধরে এমনটা চলল। অবশেষে বার্ষিক পরীক্ষা এলো।

 

ফলাফলটা ছিল ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার মতো, যদিও এমনটাই আশা করা হয়েছিল। এ ক্লাসের শিশুরা বি ক্লাসের শিশুদের চেয়ে অনেক ভালো করেছে। এ ক্লাসের বাচ্চারা যেন গত বছরের বার্ষিক পরীক্ষার মেধাতালিকার প্রথম অর্ধেক দল! তারা এখন এ ক্লাসের ছেলেমেয়ে হয়ে গেছে। অন্য ক্লাসের বাচ্চারা, যদিও গত বছর সমানে সমান ছিল, তারা এখন বি ক্লাসের ছেলেমেয়ে হয়ে গেছে। সমান মেধা ও যোগ্যতা থাকা সত্তে ও সারা বছর ধরে তাদের বি ক্লাসের ছাত্রছাত্রী বলা হয়েছে। বি ক্লাসের ছেলেমেয়ে হিসেবেই আচরণ করা হয়েছে তাদের সাথে। আর সেটাই তারা বিশ্বাস করেছে, তারা সেটাই হয়ে গেছে।

 

সুপার মার্কেটের সেই ছেলেটি

আমি আমার ‘কয়েদি বন্ধু’দের বলি তারা যেন নিজেদের অপরাধী না ভাবে। বরং তারা যেন ভাবে তারা সে-ই ব্যক্তি, যে কোনো অপরাধমূলক কাজ করেছে। কারণ, যদি তাদের বলা হয় যে তারা অপরাধী, যদি তাদের সাথে অপরাধীসুলভ আচরণ করা হয়, যদি তারা বিশ্বাস করে যে তারা অপরাধী, তখন তারা অপরাধী হয়ে ওঠে। এভাবেই ব্যাপারটা ঘটে।

 

এক সুপার মার্কেটে জিনিসপত্র কিনতে এসে এক বালকের হাত থেকে দুধের প্যাকেট পড়ে গেল। প্যাকেটটি ফেটে গিয়ে দুধ ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। ‘বোকা ছেলে কোথাকার!’ তার মা তাকে বকা দিল।

 

ঠিক তার পাশের সারিতেই অন্য এক বালকের হাত থেকে এক প্যাকেট মধু পড়ে গেল। প্যাকেটটি ফেটে গিয়ে মধু ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। ‘তুমি একটা

বোকার মতো কাজ করেছ।’ তার মা তাকে বলল।

 

প্রথমবাচ্চাটি সারা জীবনের জন্য বোকাদের দলে পড়ে গেল। অন্য বালকটাকে শুধুমাত্র তার ভুলটা দেখিয়ে দেওয়া হলো। প্রথমজন সম্ভবত বোকা হয়েই বেড়ে উঠবে। অন্যজন বোকার মতো কাজ করা থেকে বিরত থাকতে শিখবে।

 

আমি আমার জেলখানার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করি, তাদের অপরাধের দিনটাতে তারা আরও কী কী করেছিল। সেই বছরের অন্যান্য দিনে তারা কী কী করেছিল? তাদের জীবনের অন্যান্য বছরগুলোতে তারা কী কী করেছিল? এরপর আমি আমার ইটের দেয়ালটার গল্প শোনাই তাদের। দেয়ালের গায়ে অন্যান্য অনেক ইট রয়েছে যেগুলো অপরাধ নয়, বরং জীবনের অন্যান্য ভালো দিকগুলোরও প্রতিনিধিত্ব করে। প্রকৃতপক্ষে খারাপ ইটের চেয়ে ভালো ইটের সংখ্যা সব সময়ই অনেক অনেক বেশি। এখন, আপনি কি একটা খারাপ দেয়াল, যাকে ভেঙে ফেলাই উচিত? নাকি আপনি একটি ভালো দেয়াল, যেখানে বাদবাকি সবার মতোই আপনারও রয়েছে কয়েকটা মাত্র খারাপ ইট?

 

কয়েক মাস পরে বিহারাধ্যক্ষ হওয়াতে আমি জেলখানায় যাওয়া ছেড়ে দিই। পরে একটা ব্যক্তিগত ফোনকল পাই জেলখানার পুলিশ অফিসারদের একজনের কাছ থেকে। সে আমাকে আবার জেলখানায় যাওয়ার আমন্ত্রন জানায়। সে আমাকে এমন একটা প্রশংসাসূচক বাক্য বলে যা আমি সযত্নে মনের মণিকোঠায় সংরক্ষণ করে রেখেছি। সে আমাকে বলেছিল যে, আমার জেলখানার বন্ধুরা, আমার ছাত্ররা, তারা তাদের সাজার মেয়াদ পূর্ণ করে ছাড়া পেয়ে আর কখনোই জেলখানায় ফিরে আসে নি।

 

আমরা সবাই অপরাধী

আগের গল্পে আমি জেলখানায় যাদের নিয়ে কাজ করেছি, তাদের সম্পর্কে বলেছি। কিন্তু এর বার্তা শুধু জেলখানার বন্দীদের জন্য নয়, বরং বিবেকের অপরাধবোধে বন্দী যেকোনো জনের জন্যই এটা প্রযোজ্য। সেই ‘অপরাধ’ যার জন্য আমরা নিজেদের অপরাধী ভাবি - সেটি ছাড়াও সেই দিনে, সেই বছরে,

অন্যান্য বছরগুলোতে আমরা আর কী কী করেছি? আমরা কি দেয়ালের অন্যান্য ইটগুলোও দেখতে পাচ্ছি? আমরা কি সেই বোকার মতো কাজ - যার জন্য আমরা অপরাধবোধে ভুগছি - তার বাইরেও দেখতে পাচ্ছি? আমরা যদি বি ক্লাসের কাজের উপর বেশি মনোযোগ দিই, তাহলে হয়তো বি ক্লাসের লোক হয়ে উঠতে পারি। যার কারণে আমরা আমাদের ভুলগুলো করতেই থাকি, আর অপরাধবোধের পরিমাণ বাড়িয়ে চলি। কিন্তু যখন আমরা জীবনের অন্যান্য অংশকেও দেখি, দেয়ালের অন্যান্য ইটগুলোকেও দেখি, যখন আমরা বাস্তবি দৃষ্টিভঙ্গি লাভ করি, তখন আমাদের মনে একটা চমৎকার অন্তর্দৃষ্টির ফুল ফুটে ওঠে : ‘আমরা ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য।’

অপরাধবোধকে যেতে দেওয়া, চিরদিনের জন্য

অপরাধবোধ থেকে মুক্তির পথে সবচেয়ে কঠিন ধাপটা হচ্ছে আমাদের নিজেদের বুঝানো যে, আমরা ক্ষমা পাওয়ার যোগ্য। এতক্ষণ পর্যন্ত যেসব কাহিনী বলা হলো, এগুলো আমাদের কিছুটা হয়তো সাহায্য করে; কিন্তু এই বন্দীদশা থেকে মুক্তির শেষ ধাপে একাই এগিয়ে যেতে হয়।

 

আমার এক বন্ধু শৈশবে তার এক সেরা বন্ধুর সাথে খেলছিল একটি ঘাটের পাড়ে। মজা করতে গিয়ে সে তার বন্ধুকে ঠেলে দিল পানিতে। তার বন্ধুটি ডুবে মরল। এরপর থেকে অনেক বছর ধরে সেই বন্ধুটি তার মনের মধ্যে কিলবিল করতে থাকা অপরাধবোধ নিয়ে জীবন কাটাল। তাদের বাড়ির পাশেই তার মৃত বন্ধুর বাবা-মা থাকত। সে বড় হয়ে উঠতে লাগল এই অপরাধবোধ নিয়ে যে সে তাদের সন্তানবঞ্চিত করেছে। এরপর এক সকালে, সে যেমনটা আমাকে বলেছে, সে নাকি উপলব্ধি করেছিল যে তার আর নিজেকে দোষী ভাবার কোনো প্রয়োজন নেই। সে তার নিজের তৈরি কারাগার থেকে বেরিয়ে এলো স্বাধীনতার উষ্ণ হাওয়ায়।