নবম অধ্যায়

মূল্যবোধ ও আধ্যাত্মিক জীবন

সবচেয়ে সুন্দর শব্দ

একজন অশিক্ষিত বৃদ্ধ লোক তার জীবনে প্রথমবার শহরে বেড়াতে গিয়েছিল।

 

সে বড় হয়েছিল একটা প্রত্যন্ত পাহাড়ি গ্রামে, কঠোর পরিশ্রম করে তার ছেলেমেয়েদের বড় করেছে। আর এখন সে তার ছেলেমেয়েদের আধুনিক বাড়িতে প্রথমবারের মতো বেড়াতে আসাটা উপভোগ করছে।

 

একদিন, শহরের চারপাশ ঘুরে দেখার সময় বৃদ্ধলোকটির কানে একটি শব্দ এসে বিঁধল। এমন সাংঘাতিক শব্দ সে তার নিরিবিলি পাহাড়ি গ্রামে কখনো

শোনে নি। তাই সে এর কারণ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। সেই কর্কশ শব্দের উৎস খুঁজতে খুঁজতে সে একটি বাড়ির পিছনে একটি রুমে চলে এলো, যেখানে একটি ছোট ছেলে বেহালা বাজানো প্র্যাকটিস করছে।

 

‘ক্রিরিরিচ! ক্রেং!’ বেসুরো শব্দে বেহালা আর্তনাদ করে উঠল।

 

বৃদ্ধ লোকটি যখন শুনল যে এটার নাম বেহালা, সে সিদ্ধান্ত নিলো যে, আর কখনো এমন জঘন্য জিনিসের বাজনা শুনতে চাইবে না।

 

পরের দিন শহরের অন্য এক এলাকায় বৃদ্ধ লোকটি একটা শব্দ শুনল যা মনে হলো তার বুড়ো কানগুলোকে আদর করছে। সে তার পাহাড়ি উপত্যকায় এমন মনোমুগ্ধকর সুর কখনো শোনে নি। তাই সে এর উৎস খুঁজে বের করতে মনস্থ করল। উৎস খুঁজতে খুঁজতে সে একটা বাড়ির সামনে এক রুমে গিয়ে হাজির হলো যেখানে এক বুড়ি বেহালায় একাই সুর তুলছিল।

 

মুহূর্তেই বৃদ্ধ লোকটি তার ভুল বুঝতে পারল। আগের দিন সে যে জঘন্য শব্দ শুনেছিল তা বেহালার দোষে নয়, বালকটির দোষেও নয়। ব্যাপারটা হলো

ছেলেটাকে তার বাদ্যযন্ত্র ভালোমতো বাজাতে শেখাটা আরও শিখতে হবে।

 

সাধারণ লোকের প্রজ্ঞা নিয়ে বৃদ্ধ লোকটি ভাবল, একই ব্যাপার ঘটে ধর্মের ক্ষেত্রেও। কোনো ধর্মীয় ব্যাপারে উৎসাহী ব্যক্তিকে আমরা যখন দেখি সে তার বিশ্বাস নিয়ে অনেক দুর্দশা ভোগ করছে, তখন ধর্মকে দোষ দেওয়া ভুল। ব্যাপারটা এই যে, সেই শিক্ষানবীশের তার ধর্ম সম্বন্ধে জানার এখনো অনেক বাকি আছে। যখন আমরা কোনো সাধুসন্তের সংস্পর্শে আসি যে তার ধর্মে দক্ষ, সেটা এমন দারুণ অভিজ্ঞতা হয়, যা আমাদের অনেক বছর ধরে অনুপ্রাণিত করে, তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস যা-ই হোক না কেন।

 

কিন্তু এতেই এই গল্পের শেষ নয়।

 

তৃতীয় দিন, শহরের অন্য এক প্রান্তে বৃদ্ধটি অন্য একটি শব্দ শুনতে পেল যা সৌন্দর্য ও বিশুদ্ধতায় সেই ওস্তাদ বেহালাবাদক বুড়িকেও ছাপিয়ে গেল। আপনি কী মনে করেন, সেই শব্দটা কী ছিল?

 

এটা ছিল বসন্তে পাহাড় থেকে নেমে আসা জলপপ্রাতের চেয়েও সুন্দর, শরতে বনে বনে বয়ে যাওয়া উচ্ছ্বল হাওয়া থেকেও সুন্দর, অথবা ভারী বষর্ণ শেষে পাহাড়ি পাখিদের গান থেকেও সুন্দর। এটা এমনকি কোনো এক শীতের নিশীথে পর্বতের গুহায় বিরাজমান নিরবতার চেয়েও সুন্দর। সেই শব্দটা কী ছিল যা বৃদ্ধের হৃদয়কে অভূতপূর্ব নাড়া দিয়েছিল?

 

এটা ছিল একটি বড় অর্কেস্ট্রা (বাদকদল) যারা একটি সুর বাজাচ্ছিল। বৃদ্ধের জন্য এটি দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর শব্দ ছিল। কারণ, প্রথমত, এই অর্কেস্ট্রার প্রত্যেকটি সদস্য ছিল আপন আপন বাদ্যযন্ত্র বাজানোতে ওস্তাদ। আর দ্বিতীয়ত, তারা আরও শিখেছিল কীভাবে একসাথে সমান তালে বাজাতে হয়।

বৃদ্ধটি ভাবল, ‘ধর্মের ক্ষেত্রেও এমন হোক! প্রত্যেকেই আমরা যেন জীবনের পাঠশালায় আমাদের বিশ্বাসের কোমল হৃদয়ের শিক্ষা পাই। আমরা প্রত্যেকেই আমাদের ধর্মের মধ্যে মৈত্রীর এক একজন ওস্তাদ হই। আমাদের ধর্মকে ভালোভাবে শিক্ষা করে এবার আসুন আরেকটু এগোই এবং শিখি, অর্কেস্ট্রার সদস্যদের মতো, কীভাবে অন্যান্য ধর্মের সাথে একত্রে একই সুরে বাজাতে হয়।

সেটাই হবে সবচেয়ে সুন্দর শব্দ।

 

নামে কী আছে?

আমাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী যখন কেউ বৌদ্ধ ভিক্ষু হয়, সে একটা নতুন নাম গ্রহণ করে। আমার ভিক্ষু নাম ‘ব্রহ্মবংশ’ (Brahmavamso), যা বেশি লম্বা হওয়ায় আমি সংক্ষেপে বলি ব্রাহম্ (Brahm) এখন প্রত্যেকে আমাকে এই নামে ডাকে। শুধু আমার মা বাদে। সে এখনো আমাকে পিটার নামেই ডাকে। আর আমিও বলি, সেই নামে ডাকার অধিকার তার আছে।

 

একবার বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠীর এক মিলনমেলায় আমন্ত্রণের জন্য আমাকে ফোন করা হলো, আর আমার নামটার বানান জানতে চাওয়া হলো। আমি জানিয়ে দিলাম :

B - হচ্ছে বুড্ডিস্ট

R- হচ্ছে রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টান

A - হচ্ছে অ্যাংলিকান খ্রিস্টান

H - হচ্ছে হিন্দু

M - হচ্ছে মুসলিম।

আমি এতে এমন ভালো সাড়া পেলাম যে এখন সাধারণত আমি আমার নামটা এভাবেই বানান করি। আর নামের অর্থটাও সেটাই।

 

পিরামিড শক্তি

১৯৬৯ সালের গ্রীষ্মকাল। আমার আঠারতম জন্মদিনের পরে প্রথমবারের মতো গ্রীষ্মমন্ডলীয় জঙ্গলে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা উপভোগ করছিলাম আমি। আমি ভ্রমণ করছিলাম গুয়াতেমালার ইউকাটান উপদ্বীপে। গন্তব্য হচ্ছে বিলুপ্ত হয়ে যাওয়া মায়া সভ্যতার কিছু পিরামিড যা সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে। তখনকার দিনে ভ্রমণ ছিল খুব কষ্টকর। গুয়াতেমালা শহর থেকে টিকাল নামের সেই মন্দিরের ধ্বংসস্ত্তপের দূরত্ব কয়েক শ কিলোমিটার। এটুকু পেরোতেই লেগে গেল তিন-চার দিন। আমি রেইনফরেস্টের মাঝ দিয়ে বয়ে চলা ছোট নদীর উজানে পাড়ি দিলাম তেল চিটচিটে মাছ ধরার নৌকায় করে। মালপত্র বোঝাই ট্রাকে করে আকাবাঁকা মেঠো পথ ধরে নেমে গেলাম কোনোমতে। আর ছোট জঙ্গলের পথ পাড়ি দিলাম লক্কর-ঝক্কর রিকশাতে। এটা ছিল প্রত্যন্ত অঞ্চল, দরিদ্র এবং সেখানে তখনো ছিল আদি অকৃত্রিমরূপে।

 

যখন আমি অবশেষে সেই পরিত্যক্ত প্রাচীন মন্দির ও পিরামিডের বিস্তির্ণ এলাকায় এসে হাজির হলাম, তখন আমার সাথে কোনো গাইড ছিল না। গাইড বইও ছিল না, যা আমাকে বলে দেবে আকাশ ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এসব বিশাল বিশাল পাথরের স্থাপনার মানে কী। আশেপাশে কেউই ছিল না। তাই আমি উঁচু পিরামিডগুলোর একটাতে উঠতে শুরু করলাম। চূড়ায় উঠে এই পিরামিডগুলোর মানে এবং আধ্যাত্মিক উদ্দেশ্য হঠাৎ করেই পরিষ্কার হয়ে গেল আমার কাছে।

 

গত তিন দিন ধরে আমি গহীন জঙ্গলের মাঝ দিয়ে ভ্রমণ করেছি। পথঘাট, নদীনালাগুলো ছিল যেন সবুজ বনের আড়ালে থাকা সুড়ঙ্গের মতো। নতুন

কোনো পথ হলেই তার আকাশ তাড়াতাড়ি ঢেকে যেত ডালপালার আড়ালে। আমি আকাশ দেখি নি অনেক দিন। দূরের জিনিস তো দেখতেই পারি নি। আমি ছিলাম জঙ্গলের মধ্যে। পিরামিডের চূড়ায় এসে আমি জঙ্গলে ঢাকা সবুজের চাদরের উপরে উঠে গেলাম। আমার সামনে শুধু যে ম্যাপের মতো ছড়িয়ে থাকা বিশাল বনভূমি দৃষ্টিগোচর হলো তা নয়। বরং এখন আমি সবদিকে দেখতে পেলাম। আমার আর অসীমের মাঝে জঙ্গল আর বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারল না। সেখানে দাঁড়িয়ে মনে হলো যেন পৃথিবীর পিঠে উঠে দাঁড়িয়েছি আমি। আমি কল্পনা করলাম সেই তরুণ মায়ান ইন্ডিয়ানদের কথা যারা জঙ্গলে জন্মেছে, বড় হয়েছে জঙ্গলে, সারা জীবন কাটিয়েছে জঙ্গলে। আমি তাদের কল্পনা করলাম কোনো এক ধর্মীয় অনুষ্ঠানে। তারা একজন বৃদ্ধ জ্ঞানী ও পবিত্র ব্যক্তির হাত ধরে প্রথমবারের মতো এই পিরামিডের চূড়ায় উঠেছে। যখন তারা গাছপালার সীমা ছাড়িয়ে উপরে উঠে এলো, তাদের জংলী পৃথিবী যেন উন্মোচিত হলো চোখের সামনে। তাদের দৃষ্টি তখন সীমানা ছাড়িয়ে দিগন্তের ওপারে প্রসারিত। তারা দেখত তাদের উপরে ও চারপাশে ঘিরে আছে এক মহান শূন্যতা। পিরামিডের সেই চূড়ায় দাঁড়িয়ে পৃথিবী ও আকাশের মাঝখানের দরজায়, সেখানে অন্য কোনো ব্যক্তি নেই, কোনো বস্ত্ত নেই, কোনো শব্দ নেই, চারদিকে শুধু অসীমতা! তাদের মন সেই অবাক করা দৃশ্যে অনুরণিত হতো। সত্য প্রস্ফুটিত হতো আর জ্ঞানের সুবাস ছড়াত। তারা তাদের পৃথিবীতে নিজেদের স্থানকে বুঝে নিত। তারা তখন দেখে নিত সেই অসীমতাকে, সেই মুক্তির শূন্যতাকে, যা সবকিছুকে ঘিরে আছে। তাদের জীবন তখন জীবনের মানে খুঁজে পেত।

 

আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে আছে আধ্যাত্মিক পিরামিড। আমাদের নিজেদের সেই পিরামিডে ওঠার জন্য সময় ও শান্তি যোগানো দরকার। কিছু সময়ের জন্য হলেও যাতে আমরা আমাদের জীবনের জটিলতার জঙ্গলের ঊর্ধ্বে উঠে যেতে পারি।

তখন আমরা আমাদের চারপাশের জগতে নিজেদের অবস্থানটা দেখতে পাব। আমাদের জীবনের গতিপথও দেখতে পারব, আর চারপাশের অসীমকে বিনা বাধায় উপলব্ধি করতে পারব।

 

মূল্যবান পাথর

কয়েক বছর আগে আমেরিকার একটি বিখ্যাত বিজনেস স্কুলে এক প্রফেসর তার গ্রাজুয়েট ক্লাসে সামাজিক অর্থনীতির উপরে এক অসাধারণ লেকচার দিয়েছিলেন। কোনো কিছু না বলে তিনি তার টেবিলে একটি কাচের জগ রাখলেন। এরপর বের করলেন এক ব্যাগ বড় বড় পাথর। পাথরগুলোকে তিনি একটা একটা করে জগে ঢুকাতে লাগলেন। যতক্ষণ পর্যন্ত আর কোনো পাথর ঢুকানো গেল না। তিনি তার ছাত্রদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘জগটি কি পূর্ণ? ’

 

‘হ্যাঁ’ তারা জবাব দিল।

 

প্রফেসর হেসে টেবিলের তলা থেকে দ্বিতীয় ব্যাগটা বের করলেন, ব্যাগে ছিল নুড়ি পাথর। তিনি ছোট ছোট নুড়িগুলোকে ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে ঢুকাতে লাগলেন জগের মধ্যে। সেগুলো বড় বড় পাথরগুলোর মাঝখানের ফাঁক পূর্ণ করল। দ্বিতীয়বারের মতো তিনি তার ছাত্রদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘জগটি কি পূর্ণ? ’

 

‘না’ তারা উত্তর দিল। তারা এবার তার মতলব ধরতে পেরেছে।

 

অবশ্যই তাদের জবাব সঠিক ছিল। কারণ, প্রফেসর এবার বের করলেন এক ব্যাগ বালি। তিনি বড় পাথর ও নুড়িগুলোর মাঝের ফাঁকগুলো বালি দিয়ে ভরতে সক্ষম হলেন। এবার তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘জগটি কি পূর্ণ? ’

 

‘সম্ভবত নয়, স্যার। আপনাকে আমরা জানি তো!’ ছাত্ররা জবাব দিল। তাদের উত্তরে হেসে প্রফেসর এবার বের করে আনলেন একটি ছোট পানির

জগ। তিনি সেই পানি ঢাললেন পাথর , নুড়ি ও বালিতে ভরা জগের মধ্যে। যখন পানিতে পূর্ণ হলো পাথরের জগটা, তিনি পানির জগটা নামিয়ে রেখে ক্লাসের দিকে তাকালেন।

 

তিনি তার ছাত্রদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘তো, এ থেকে কী শিখলে তোমরা?’ একজন ছাত্র বলল, ‘এর মানে হচ্ছে যে আপনার কাজের তালিকায় যতই

ব্যস্ততা থাক, আপনি সব সময়ই তাতে কিছু না কিছু যোগ করতে পারবেন!’ বিজনেস স্কুলে কাজের কথাই তো আসবে!

 

কিন্তু প্রফেসর জোর দিয়ে নাকচ করে দিলেন ছেলেটার কথা, ‘না। এটা তোমাদের দেখাচ্ছে যে যদি তোমরা বড় পাথরগুলো জগে ঢুকাতে চাও, তাহলে

সেগুলোকে আগেভাগেই ঢুকাতে হবে।’

 

এটা ছিল অগ্রাধিকারের শিক্ষা, কাজগুলোকে গুরুত্ব অনুসারে করার শিক্ষা। তো, আপনার জগের বড় পাথরগুলো কী কী? আপনার জীবনের সবচেয়ে

গুরুত্বপূর্ণ কী জিনিস চান আপনি? দয়া করে নিশ্চিত হোন যে সবচেয়ে ‘মূল্যবান পাথরগুলো’ তালিকার প্রথমে রেখে দিয়েছেন। আর তা না-হলে সেগুলোকে আর আপনার দিনের কাজের তালিকায় যোগ করার সুযোগই পাবেন না কখনো।

 

তখনই আমি সুখী হবো

সম্ভবত আগেভাগেই আমাদের জগে যে সবচেয়ে মহামূল্যবান পাথরটি ভরা উচিত তা হচ্ছে অন্তরের সুখ। আমাদের ভেতরে যখন কোনো সুখ থাকে না, অন্যকে দেওয়ার মতো সুখও তখন আমাদের থাকে না। তাহলে কেন বেশির ভাগ লোক সুখটাকে সবচেয়ে কম গুরুত্ব দেয়? একেবারে জীবনের শেষ সীমায় গিয়ে তবেই পেতে চায়? (অথবা একেবারে শেষ সীমা ছাড়িয়ে তবেই সুখ চায়, যেমনটি ঘটেছে নিচের গল্পে)

 

আমার বয়স যখন চৌদ্দ, তখন আমি লন্ডনের এক হাইস্কুলে ও-লেভেল (এসএসসি) পরীক্ষার জন্য পড়াশুনা করছিলাম। আমার বাবা-মা ও শিক্ষকেরা আমাকে সন্ধ্যাবেলা ও সাপ্তাহিক ছুটিগুলোতে খেলা বন্ধ করতে উপদেশ দিলেন। তার চেয়ে আমি যেন বাড়িতে থাকি আর পড়াশুনার পেছনে সময়টা দিই। তারা আমাকে ব্যাখ্যা করলেন ও-লেভেল পরীক্ষাটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ আর তাতে যদি ভালো করি, তাহলে আমিই সুখী হবো।

 

আমি তাদের উপদেশ অনুসরণ করলাম, আর পরীক্ষাতেও খুব ভালো করলাম। কিন্তু এটা আমাকে অতটা সুখী বানাল না, কেননা এই সাফল্যের ফলে আমাকে এর চেয়েও কঠোরভাবে পড়াশুনা করতে হবে আরও দু বছরের জন্য, এ-লেভেল (এইচএসসি) পরীক্ষার প্রস্ত্ততির জন্য।

 

আমার বাবা-মা ও শিক্ষকেরা এবার আমাকে সন্ধ্যায় ও সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতে মেয়েদের পিছনে ছুটতে মানা করলেন। তার চেয়ে আমি যেন সময়টা বাড়িতে পড়াশুনা করে কাটাই। তারা আমাকে বুঝিয়ে বললেন, এ- লেভেল পরীক্ষাটা কতটা গুরুত্বপূর্ণ আর এমন গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাতে যদি আমি ভালো করি, তাহলে আমিই নাকি সুখী হবো।

 

আরেকবার আমি তাদের উপদেশ মাথা পেতে নিলাম, আর পরীক্ষায়ও খুব ভালো করলাম। আরেকবার আমি খুব সুখী হতে পারলাম না। কারণ, এখন আমাকে সবচেয়ে বেশি করে পড়াশোনা করতে হবে, আরও তিনটি দীর্ঘ বছর ধরে ইউনিভার্সিটিতে একটি ডিগ্রির জন্য।

 

আমার মা ও শিক্ষকেরা (বাবা তখন মারা গেছেন) আমাকে মদের দোকান ও কলেজের পার্টি থেকে দূরে থাকার উপদেশ দিলেন। তার বদলে পড়াশোনায় আরও কঠোর শ্রম দিতে বললেন। তারা আমাকে বললেন একটা ইউনিভার্সিটি ডিগ্রি কতটা গুরুত্বপূর্ণ আমি যদি এতে ভালো করি, তাহলে আমি খুব সুখী হবো।

 

এই পর্যায়ে এসে আমার একটু একটু সন্দেহ হতে লাগল। আমি আমার সিনিয়র কয়েকজন বন্ধুকে দেখলাম যারা খুব কঠোর পরিশ্রম করেছে, আর ডিগ্রি জুটিয়েছে। এখন তারা আরও কঠোর পরিশ্রম করছে তাদের প্রথম চাকরিতে। তারা চূড়ান্ত পরিশ্রম করে চলেছে টাকা জমা করার জন্য, যাতে

সেই টাকা দিয়ে তারা কোনো একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস কিনতে পারে, যেমন ধরুন একটা গাড়ি। তারা আমাকে বলত, ‘যখন একটা গাড়ি কেনার মতো যথেষ্ট টাকা হবে, তখন আমি সুখী হবো।’

 

যখন তাদের যথেষ্ট টাকা হয়েছে আর গাড়িও কিনে ফেলেছে, তাতেও তারা সুখী নয়। তখন তারা আরও পরিশ্রম করছে অন্য একটা কিছু কেনার জন্য, যাতে তারা সুখী হবে। অথবা তারা এক জীবনসঙ্গীকে খুঁজতে গিয়ে রোমান্সের ঝড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। তারা বলত, ‘যখন আমি বিয়ে করে কোথাও থিতু হবো, তখনই আমি সুখী হবো।’

 

বিয়ে করেও তারা সুখী হয় নি। তাদের আরও পরিশ্রম করতে হয়েছে, এমনকি অতিরিক্ত কাজও করতে হয়েছে, যাতে তারা কোনো একটা অ্যাপার্টমেন্ট বা ছোট একটা বাড়ি কেনার জন্য যথেষ্ট টাকা জমাতে পারে। তারা বলত, ‘যখন আমাদের নিজস্ব একটা বাড়ি হবে, তখন আমরা সুখী হবো।’

 

দুঃখের বিষয়, বাড়ির লোনের জন্য মাসে মাসে তাদের বেতন থেকে টাকা কেটে রাখা হত, যা তাদের সুখী করল না। তার চেয়েও বড় কথা, এখন তারা একটা পরিবার শুরু করতে যাচ্ছে। এখন তাদের বাচ্চা হবে। বাচ্চারা রাতে তাদের ঘুম থেকে জাগাবে। তাদের জমানো টাকার সবটুকু খরচ হয়ে যাবে বাচ্চাদের পিছনে। আর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বেড়ে যাবে লাফিয়ে লাফিয়ে, সীমা ছাড়িয়ে। এখন তারা যা চায় তা করার জন্য আরও অন্তত বিশ বছর লাগবে। তাই তারা আমাকে বলত, ‘যখন ছেলেমেয়েরা বড় হবে, বাড়ি থেকে বেরোবে, কোথাও থিতু হবে, তখনই আমরা সুখী হবো।’

 

ছেলেমেয়েরা যখন বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়ে, বেশির ভাগ বাবা-মা তখন অবসরের অপেক্ষায় থাকে। তাই তারা তাদের সুখকে আরও পিছিয়ে দেয়, তার বদলে তারা বৃদ্ধ বয়সের জন্য টাকা জমা করতে গিয়ে কঠোর পরিশ্রম করতে থাকে। তারা বলে, ‘যখন আমি অবসরে যাব, তখনই আমি সুখী হবো।’

 

অবসরের পরে তো বটেই, এর আগে থেকেই তারা একটু একটু ধার্মিক হতে থাকে, আর চার্চে যাওয়া শুরু করে দেয়। আপনি কি খেয়াল করেছেন, কতজন বৃদ্ধ লোক চার্চের বেঞ্চিগুলো জুড়ে থাকে? আমি তাদের জিজ্ঞেস করতাম কেন তারা এখন চার্চে যাচ্ছে? তারা আমাকে বলত, ‘কারণ, যখন আমি মরব তখনই আমি সুখী হবো!’

 

যারা এ কথা বিশ্বাস করে যে, ‘যখন আমি এটা পাব, তখনই আমি সখুী হবো’ তাদের সুখ কেবল ভবিষ্যতের স্বপ্ন মাত্র। এটি যেন একটা রংধনুর মতো। মাত্র দুই তিন পা পেরোলেই ধরা ছোঁয়া যাবে এমন। অথচ সেটা থাকে সব সময়ই ধরাছোঁয়ার বাইরে। তারা তাদের জীবনে অথবা এর পরে কখনোই সুখ পাবে না।

 

মেক্সিকান জেলে

এক নিরিবিলি মেক্সিকান জেলেপাড়ায় ছুটি কাটাতে গিয়েছিল এক আমেরিকান। সে এক স্থানীয় জেলেকে দেখছিল যে তার সকালে ধরা মাছগুলো নৌকা থেকে তীরে নামিয়ে রাখছে। আমেরিকানটা ছিল আমেরিকার এক নামী দামী বিজনেস স্কুলের সফল একজন প্রফেসর। সে বেচারা মেক্সিকান জেলেকে বিনামূল্যে কিছু উপদেশ না দিয়ে পারল না।

 

আমেরিকানটা আলাপ শুরু করল, ‘এই যে! এত সকাল সকাল মাছ ধরা শেষ করছ যে?’

 

‘কারণ, আমি যথেষ্ট মাছ ধরেছি, সিনর।’ জবাব দিল অমায়িক মেক্সিকান। ‘এতে আমার পরিবারের খাওয়ার জন্য যথেষ্ট মাছ আছে। বাড়তি সামান্য মাছ আমি বিক্রি করে দেব। এখন আমি আমার স্ত্রীসহ একসাথে দুপুরের খাবার খাব। আর দুপুরে একটা ঘুম দিয়ে বিকেলে বাচ্চাদের সাথে খেলব। এরপর রাতের খাবার খেয়ে নিয়ে একটু পানশালায় যাব। সেখানে বন্ধুদের সাথে সামান্য মদ পান করব আর গিটার বাজাব। এটাই আমার জন্য যথেষ্ট সিনর।’

প্রফেসর বলল, ‘বন্ধু, আমার কথা শোন। তুমি যদি সাগরে বিকেল পর্যন্ত থাক, তাহলে সহজেই দ্বিগুণ মাছ ধরতে পারবে। সেই মাছগুলো বিক্রি করে টাকা জমাতে পারবে। ছয় মাস কি নয় মাসের মধ্যে তুমি সেই জমানো টাকায় এর চেয়ে বড় ও ভালো একটা বোট কিনতে পারবে। সাথে দুয়েকজন লোকও ভাড়া করতে পারবে। তখন তুমি চারগুণ বেশি মাছ ধরতে পারবে। এ থেকে কী পরিমাণ লাভ হবে, একটু ভাবো তো! এক কি দু বছরের মাথায় আরেকটা মাছ ধরার বোট কিনে ফেলার মতো টাকা হয়ে যাবে তোমার। সাথে আরও লোকজন ভাড়া করতে পারবে। তুমি যদি এই ব্যবসার পরিকল্পনা অনুসারে কাজ করো, তাহলে ছয় কি সাত বছরের মাথায় বিরাট একটা নৌকাবহরের মালিক হবে তুমি। একটু কল্পনা করে দেখো না!

 

 

 

তখন তুমি তোমার প্রধান কার্যালয়কে মেক্সিকো সিটি অথবা লস এনজেলসে নিয়ে যাবে। সেখানে তিন চার বছর পরেই তুমি স্টক মার্কেটে তোমার কোম্পানির শেয়ার ছাড়বে। সেই কোম্পানিতে তুমি হবে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও)। তোমার থাকবে মোটা অঙ্কের বেতন, আর শেয়ারের সুবিধা। এবার শোন! আরও কয়েক বছর বাদে তুমি তোমার কোম্পানীর শেয়ারগুলো কিনে ফেলবে ঝটপট, যা তোমাকে কোটিপতি বানিয়ে দেবে! এক্কেবারে গ্যারান্টি দিচ্ছি আমি! আমি আমেরিকার একটি বিজনেস স্কুলের বিখ্যাত প্রফেসর। এসব ব্যাপার আমি ভালোই জানি।’

 

মেক্সিকান জেলে মন দিয়ে শুনল আমেরিকান লোকটার কথা। যখন প্রফেসর তার কথা শেষ করল, তখন সে তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু সিনর প্রফেসর, এত কোটি কোটি ডলার দিয়ে আমি কী করব?’

 

অবাক করার মতো ব্যাপার, আমেরিকান প্রফেসর তার ব্যবসার পরিকল্পনায় এই ব্যাপারটা মাথায় রাখে নি। সে তাড়াতাড়ি ভেবে নিল কোটি কোটি ডলার দিয়ে একজন মানুষ কী করবে।

 

‘এমিগো! (বন্ধু) এত টাকা হলে তুমি তখন অবসর নিতে পারবে। জ্বি হ্যাঁ, সারা জীবনের জন্য আর কাজ করতে হবে না। তুমি ছোট একটা মনের মতো বাড়ি কিনতে পারবে। ছবির মতো সাজানো গোছানো এমন এক জেলে পল্লীতে। সকালে মাছ ধরার জন্য ছোট একটা নৌকাও কিনতে পারবে তুমি। তোমার স্ত্রীর সাথে প্রতিদিন দুপুরের খাবার খেতে পারবে। নির্ভাবনায় দুপুরের ঘুমটা সেরে নিতে পারবে। বিকেলে বাচ্চাদের সাথে দারুণ সময় কাটাতে পারবে। আর সন্ধ্যায় খাওয়ার পরে বন্ধুদের সাথে গিটার বাজাতে পারবে আর মদ্য পান করতে পারবে। জ্বি হ্যাঁ, এত টাকা দিয়ে হে আমার বন্ধু, তুমি কাজ থেকে অবসর নিতে পারবে, আর নিশ্চিন্তে জীবন কাটাতে পারবে।’

 

‘কিন্তু সিনর প্রফেসর, আমি তো এখন এগুলোই করে থাকি।’

 

কেন আমরা বিশ্বাস করি যে সন্তুষ্টি খুঁজে পাওয়ার আগে আমাদের প্রথমে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে আর ধনী হতে হবে? 

যখন আমার সব ইচ্ছে পূর্ণ হবে আমার ধর্মীয় ঐতিহ্য অনুযায়ী বৌদ্ধ ভিক্ষুরা টাকা গ্রহণ, রাখা বা লেনদেন করতে পারে না, তা সে যে ধরনেরই হোক। আমরা এত গরিব যে সরকারের পরিসংখ্যান আমাদের কারণে তালগোল পাকিয়ে যায়। আমরা মিতব্যয়ী হয়ে চলি, গৃহী ভক্তদের কাছ থেকে যে সামান্য দান পাই, তাও আমরা মুখ ফুটে চাইতে পারি না। কালেভদ্রে অবশ্য বিশেষ কিছু দান দেওয়া হয় আমাদের।

 

আমি এক থাই লোককে তার ব্যক্তিগত সমস্যা বিষয়ে সাহায্য করেছিলাম। কৃতজ্ঞতাস্বরূপ সে বলল, ‘স্যার, আমি আপনাকে কিছু একটা দিতে চাই আপনার ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য। পাঁচশ বাথের মধ্যে আমি আপনার জন্য কী কিনে দিতে পারি?’ এমন দান দেওয়ার সময় টাকার অঙ্কটা বলা স্বাভাবিক, এতে করে ভুল বোঝাবুঝি এড়ানো যায়।

 

আমি তৎক্ষণাৎ ভেবে বের করতে পারলাম না আমি কী চাই। সেও বেশ তাড়ার মধ্যে ছিল। তাই আমি বললাম, পরের দিন সকালে আমি তাকে জানাব।

সে রাজি হলো।

 

এই ঘটনার আগে আমি ছিলাম একজন ছোট্ট সুখী সন্ন্যাসী। এখন আমি ভাবতে শুরু করলাম আমি কী চাই। আমি একটা তালিকা তৈরি করলাম। তালিকাটা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হলো। পরে দেখা গেল, পাঁচশ বাথে কুলাচ্ছে না। তালিকা থেকে কিছু একটা যে বাদ দেব, তারও উপায় নেই। চাওয়াগুলো যেন হঠাৎ আবির্ভূত হয়ে প্রয়োজনের রূপ ধরে অনড় হয়ে বসে আছে! তালিকাটা বাড়তেই থাকল। একসময় পাঁচ হাজার বাথেও কুলাল না।

কী হচ্ছে দেখে ছুঁড়ে ফেলে দিলাম তালিকাটা। পরের দিন আমি সেই লোকটিকে বললাম সে যেন পাঁচশ বাথ বৌদ্ধ বিহার উন্নয়নের কাজে অথবা অন্য

কোনো ভালো কাজে দান করে দেয়। আমি ওগুলো চাই না। আমি সবচেয়ে যা চাই তা হলো গতকালের আগের দিন আমার যে সন্তুষ্টি ছিল তা আমি ফিরে

পেতে চাই। যখন আমার কোনো টাকা ছিল না, কোনো কিছু পাওয়ারও উপায় ছিল না, তখনই আমার সব আশা পূর্ণ হয়েছিল।

 

চাওয়ার কোনো শেষ নেই। একশ কোটি বাথেও কুলায় না। কুলায় না একশ কোটি ডলারেও। কিন্তু চাওয়া থেকে মুক্তির একটা শেষ আছে। আপনি যখন কিছুই চান না, তখনই এর শেষ। কেবল সন্তুষ্টির সময়ই আপনি বলতে পারেন, আপনার যথেষ্ট আছে।