রাগ কোনো ভালো প্রতিক্রিয়া নয়। জ্ঞানী লোকেরা সুখী, আর সুখী লোকেরা রাগ করে না। প্রথমত, রাগ করা অযৌক্তিক।
একদিন আমাদের বিহারের গাড়িটা রাস্তায় ট্রাফিক লাইটের লাল সিগন্যালে থেমে গেল। পাশের একটা প্রাইভেট কারের গাড়ির চালক ট্রাফিক লাইটকে এভাবে গালাগালি করছিল : ‘নরকে যাও, হে ট্রাফিক লাইট! তুমি জানতে আমার একটা গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। তুমি জানতে আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। আর সেই তুমি কিনা অন্যান্য গাড়িকে আমার আগে আগে চলে যেতে দিলে, শুয়োর কোথাকার! তোমার এ ধরনের কাজ কিন্তু এটাই প্রথম নয়, আগেও ...’
সে ট্রাফিক লাইটগুলোকে গালি দিচ্ছিল যেন তাদের কোনো কিছু করার আছে। সে ভেবেছিল যে ট্রাফিক লাইট উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তাকে ঝামেলায়
ফেলেছে : ‘আহা, এই যে আসছে সে! আমি জানি তার দেরি হচ্ছে। আমি অন্যান্য গাড়িগুলোকে আগে যেতে দিই। আর ... লাল! থামো! পেয়েছি তাকে!’ ট্রাফিক লাইটগুলোকে হিংসুটে মনে হতে পারে, কিন্তু তারা শুধু ট্রাফিক লাইট মাত্র, আর কিছু না। আপনি ট্রাফিক লাইটের কাছ থেকে আর কীই বা আশা করতে পারেন?
আমি কল্পনা করলাম সে বাসায় দেরি করে পৌঁছেছে এবং তার স্ত্রী তাকে দুষছে, ‘তুমি একটা যাচ্ছেতাই স্বামী! তুমি জানতে আমাদের একটা গুরুত্বপূর্ণ অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে। তুমি জানতে দেরি করা যাবে না। আর তুমি কিনা আমার চেয়ে অন্য কাজগুলোকেই বেশি গুরুত্ব দিলে। শুয়োর কোথাকার! তোমার এ রকম কিন্তু এটাই প্রথমবার নয়...’
সে তার স্বামীকে দুষছে যেন তার স্বামীর কোনো কিছু করার ছিল। সে ভেবেছে তার স্বামী ইচ্ছে করেই তাকে মনে দুঃখ দিয়েছে : ‘আহা, আমার তো
স্ত্রীর সাথে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে! আমি একটু দেরি করে যাব। আমি প্রথমে এই লোকটার সাথে দেখা করব। দেরি হয়ে গেছে? খুব ঠিক হয়েছে!’
স্বামীরা হয়তো হিংসুটে বলে মনে হতে পারে, কিন্তু তারা তো স্বামীই। সেটাই তো সব। স্বামীদের থেকে আপনি আর কীই বা আশা করতে পারেন?
রাগজনক বেশির ভাগ পরিস্থিতির মোকাবেলায় এই গল্পের চরিত্রগুলো পরিস্থিতি অনুযায়ী বদলে নেওয়া যেতে পারে।
রাগ দেখাতে চাইলে প্রথমে সেটা নিজে নিজে বিচার করে দেখতে হবে। আপনার নিজেকে বুঝাতে হবে যে রাগটা ন্যায্য, যথার্থ রাগের এই মানসিক প্রক্রিয়ায় যেন আপনার মনের মধ্যেই একটা বিচার সভা বসে।
এই বিচার সভায় আপনার মনের আদালতের কাঠগড়ায় অভিযুক্ত ব্যক্তিরা দাঁড়ায়। আপনি অভিযোগকারী, আপনি জানেন তারা দোষী। কিন্তু সেটা বিচারকের কাছে, আপনার বিবেকের কাছে আগে প্রমাণ করতে হবে। আপনি আপনার বিরুদ্ধে করা সেই অপরাধের একটা সচিত্র ভিডিও দেখিয়ে দেন।
আপনি অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কাজের পেছনে যে সমস্ত বিদ্বেষ, ছলচাতুরী ও আপাত নিষ্ঠুরতা লুকিয়ে আছে তার সবগুলো তুলে ধরেন। অতীত থেকে খুঁড়ে আনেন তাদের অন্যান্য অপরাধগুলোকেও। আপনার বিবেককে এগুলো দেখিয়ে বুঝিয়ে দেন যে তারা ক্ষমার অযোগ্য।
বাস্তবের আদালতে অভিযুক্ত ব্যক্তির একজন উকিল থাকে, যাকে তার পক্ষ হয়ে নির্দোষ প্রমাণ করার সুযোগ দেওয়া হয়। কিন্তু এই মানসিক বিচারে আপনি আপনার রাগকে ন্যায়সঙ্গত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন। আপনি কোনো মর্মান্তিক অজুহাত শুনতে চান না, অবিশ্বাস্য ব্যাখ্যাও আপনার দরকার নেই, ক্ষমা করে দেওয়ার কাতর মিনতিও আপনি শুনতে চান না। এখানে অভিযুক্তের উকিলকে কথা বলতে দেওয়া হয় না। আপনার একপেশে যুক্তি দিয়ে আপনি বিশ্বাসযোগ্য একটা মামলা সাজান। সেটাই যথেষ্ট। বিবেক তার হাতুড়ি দিয়ে দমাদম বাড়ি দেয়, আর তারা দোষী সাব্যস্ত হয়। এখন তাদের সাথে রাগ করাটা যুক্তিযুক্ত। বহু বছর আগে আমি যখন রেগে যেতাম তখনই আমার মনের মধ্যে এই বিচার প্রক্রিয়াটা ঘটতে দেখতাম। এটা খুবই অন্যায্য দেখাত। তাই পরের বার যখন আমি কারো সাথে রাগ করতে চাইতাম, আমি এক মুহূর্ত থেমে তাদের কী বলার আছে, তা বিবাদী পক্ষের উকিলকে বলতে দিতাম। আমি তাদের আচরণের সম্ভাব্য অজুহাতগুলো এবং যুতসই ব্যাখ্যাগুলো ভেবে ভেবে বের করতাম। আমি ক্ষমার সৌন্দর্যকেই গুরুত্ব দিতাম। আমি দেখতাম যে বিবেক আর অভিযুক্ত ব্যক্তিদের দোষী বলে রায় দিচ্ছে না। অন্যদের আচরণকে বিচার করা আমার পক্ষে অসম্ভব হয়ে গেল। রাগ ন্যায়সঙ্গত না হওয়ায় তার আহার না পেয়ে ধুঁকতে ধুঁকতে মারা গেল।
আমাদের রাগের বেশির ভাগ অংশই জ্বলে ওঠে অন্যায্য আশা থেকে। মাঝে মাঝে আমরা নিজেদের এমনভাবে ঢেলে দিই যে, যখন কোনো কিছু যেমনটা হওয়া উচিত, তেমনটা হয় না, তখন আমরা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠি। সব রকম ‘উচিত’গুলো নির্দেশ করে আশাকে, যা হচ্ছে ভবিষ্যতের অনুমান। আমরা হয়তো এতক্ষণে বুঝে গেছি যে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, অনুমান করে বলার মতো নয়। ভবিষ্যতের আশা বা উচিত-এর উপরে খুব বেশি নির্ভর করা মানে হচ্ছে ঝামেলাকে ডেকে আনা।
অনেক বছর আগে আমি একজন পশ্চিমা বৌদ্ধধর্মাবলম্বীকে চিনতাম যে দূরপ্রাচ্যের কোনো এক দেশে একজন ভিক্ষু হয়েছিল। সে এক দুর্গম পাহাড়ের উপরে অবস্থিত কড়া নিয়মের অধীনে পরিচালিত এক ভাবনাকেন্দ্রে যোগ দিল। প্রতিবছর তারা ষাট দিনের এক ভাবনা কোর্স করত। এটি ছিল কঠিন, কড়া শৃঙ্খলার অধীন এবং দুর্বলমনাদের জন্য নয়।
তারা রাত ৩:০০টায় ঘুম থেকে উঠত। ৩:১০ মিনিটে সবাই ধ্যানে বসে যেত। পুরো দিনের রুটিন ছিল
পঞ্চাশ মিনিট ধ্যান, দশ মিনিট চংক্রমণ, - পঞ্চাশ মিনিট ধ্যান, দশ মিনিট চংক্রমণ - এভাবে চলত। যে হলরুমে বসে তারা ধ্যান করত, সেখানেই খাবার খেয়ে নিতে হতো। কোনো কথাবার্তা চলত না। রাত ১০:০০টায় তারা শুয়ে পড়তে পারত, কিন্তু সেটা সেই হলরুমেই, যেখানে বসে ধ্যান করত ঠিক সে জায়গায়।
৩:০০টায় ঘুম থেকে ওঠা ছিল অপশনাল ব্যাপার, আপনি যদি চান তারও আগে উঠতে পারবেন, কিন্তু তার পরে নয়। মাঝখানে ব্রেক ছিল কেবল তাদের ভয়ংকর গুরুর সাথে প্রশ্নোত্তর পর্বের সময়। আর অবশ্যই ছিল সংক্ষিপ্ত টয়লেট ব্রেক।
তিন দিন পরে পশ্চিমা ওই ভিক্ষুর পা ও পিঠে খুব ব্যথা হলো। সে এভাবে বসে থাকতে অভ্যস্ত ছিল না। একজন পশ্চিমার জন্য এভাবে বসে থাকাটা ছিল খুব অস্বস্তিকর। তা ছাড়াও কোর্স শেষ হওয়ার এখনো আট সপ্তাহ বাকি আছে এখনো। তার সন্দেহ দেখা দিল, এত লম্বা ভাবনা কোর্সে টিকে থাকতে পারবে কি না।
প্রথম সপ্তাহ শেষে অবস্থার কোনো উন্নতি হলো না। এভাবে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থেকে সে প্রায়ই ব্যথায় কাতরাত। যাদের দশ দিনের ভাবনা কোর্সে যোগ
দেওয়ার অভিজ্ঞতা আছে, তারা বুঝবে কেমন ব্যথা লাগে। তাকে আরও সাড়ে সাত সপ্তাহ সহ্য করতে হবে।
এই লোকটা ছিল কঠিন ধাতের। সে তার সবটুকু শক্তি একত্র করল, আর প্রত্যেকটা সেকেন্ড গুণে গুণে সহ্য করল। দু সপ্তাহ শেষে তার মনে হলো, যথেষ্ট হয়েছে। ব্যথা বেড়েছে খুব বেশি। এমন ব্যবস্থায় তার পশ্চিমা দেহ অভ্যস্ত নয়। এটা বৌদ্ধধর্ম নয়। এটা মধ্যপথ নয়। এরপর সে আশেপাশে অন্যান্য এশিয়ান ভিক্ষুদের দেখল, তারাও দাঁত-মুখ খিঁচে বসে আছে। জেদ তাকে আরও দু সপ্তাহ কাটাতে সাহায্য করল। এ সময় তার মনে হলো দেহটা যেন ব্যথার আগুনে সেঁকা হচ্ছে। দম ফেলার ফুরসত মিলত কেবল রাত ১০:০০টার ঘণ্টায়, যখন সে একটু শুয়ে পড়ে তার নির্যাতিত দেহকে একটু বিশ্রাম দিতে পারত। কিন্তু মনে হতো যেন ঘুমিয়ে পড়ার আগেই সকাল ৩:০০টার ঘণ্টা বেজে উঠেছে। আরেকটি নতুন দিনে নিপীড়নে জর্জরিত হওয়ার জন্য সে জেগে উঠত। ত্রিশতম দিনের শেষে যেন নিভু নিভু আশার বাতি জ্বলে উঠল বহু দূরে। সে এখন অর্ধেক পথ পেরিয়ে এসেছে। সে এখন নিজেকে নিজে বুঝাতে পারে, ‘এই তো পৌঁছে গেছি’। দিনগুলো দিন দিন আরও দীর্ঘ হলো, আর তার হাঁটু ও পিঠের ব্যথা তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হলো। মাঝে মাঝে মনে হতো সে কেঁদে ফেলবে। তবু সে ঠেলেঠুলে নিজেকে এগিয়ে নিল। আরও দু সপ্তাহ। আরও এক সপ্তাহ। সেই শেষ সপ্তাহে সময় এমনভাবে টেনে টেনে কাটতে লাগল যেন পানির ধারায় আটকে যাওয়া পিঁপড়ার মতো। যদিও এখন সে ব্যথা সহ্য করতে অভ্যস্ত তবুও তা আগের চাইতে সহজ ছিল না মোটেও। সে ভাবল, এখন হাল ছেড়ে দেওয়া মানেই হলো, এত দিন ধরে এত কষ্ট সে করেছে, তার প্রতি অবিচার করা হবে। সে এটার শেষ দেখেই ছাড়বে, এতে যদি মরতে হয় তো মরবে। মাঝে মাঝে সত্যিই ভাবত সে মারা যাচ্ছে!
ষাটতম দিনে সকাল তিনটার ঘণ্টায় সে জেগে উঠল। প্রায় পৌঁছে গেছে সে। শেষ দিনের ব্যথা ছিল অসহনীয়। এত দিন পর্যন্ত ব্যথা যেন সামান্য মজা করছিল তাকে নিয়ে; কিন্তু এখন এটি কোনো ঘুষিই বাদ রাখছে না। যদিও শেষ হবার আর মাত্র কয়েক ঘণ্টা বাকি, তার সন্দেহ হলো, সে এটা শেষ করতে পারবে কি না। এরপর আসল সর্বশেষ পঞ্চাশ মিনিট। সে এই সর্বশেষ ধ্যান শুরু করল কল্পনা নিয়ে। এক ঘণ্টা পরে ভাবনা কোর্স শেষ হলে সে কী কী করবে, গরম পানিতে একটা লম্বা গোসল, আয়েশি খানা, কথা বলা, গল্পগুজব; কিন্তু ব্যথা এসে তার পরিকল্পনায় বার বার ব্যঘাত ঘটাল, তার মনকে সেদিকে দিতে বাধ্য করল। সে তার চোখ সামান্য খুলে চুপি চুপি কয়েকবার ঘড়ির দিকে তাকাল। সে বিশ্বাসই করতে পারল না সময় কেন এত ধীরে ধীরে যায়। ঘড়ির ব্যাটারিগুলো কি পাল্টানো দরকার নাকি? ভাবনা কোর্স শেষ হওয়ার পাঁচ মিনিট আগেই হয়তো ঘড়িটা বন্ধ হয়ে সেখানেই থেমে যাবে চিরকালের জন্য? শেষ পঞ্চাশ মিনিট যেন পঞ্চাশ যুগ বলে মনে হলো। কিন্তু মহাকালেরও শেষ আছে। আর তাই এটিও শেষ হলো একসময়। মিষ্টি সুরে ভাবনা কোর্সের সমাপ্তিসূচক ঘণ্টা বেজে উঠল।
আনন্দের ঢেউ বয়ে গেল তার সারা শরীর জুড়ে। ব্যথাকে ভাসিয়ে নিয়ে গেল অনেক দূরে। সে পেরেছে। সে এখন নিজেকে একটু পরিচর্যা করবে।
গোসলখানা কই?
ভাবনা গুরু আবার ঘণ্টা বাজিয়ে সকলের দৃষ্টি আকষর্ণ করলেন। তিনি বললেন, ‘একটা ঘোষণা। এটি সত্যিই অসাধারণ একটি ভাবনা কোর্স ছিল। অনেক ভিক্ষুর অগ্রগতি খুব ভালো হয়েছে। আর তাদের কেউ কেউ ব্যক্তিগত প্রশ্নোত্তর পর্বে আমাকে পরামর্শ দিয়েছে যে, ভাবনা কোর্সের মেয়াদ আরও দু সপ্তাহ বাড়ানো উচিত। আমি মনে করি এটা একটা চমৎকার আইডিয়া। ভাবনা কোর্সের মেয়াদ বাড়ানো হলো। ধ্যান করতে থাকো সবাই।’
সব ভিক্ষু আবার তাদের পা ভাঁজ করে নিথর হয়ে ধ্যানে বসে পড়ল, আরও দু সপ্তাহের জন্য। পশ্চিমা ভিক্ষুটি আমাকে বলেছিল যে, সে আর দেহে কোনো ব্যথা অনুভব করছিল না। সে শুধু নির্ণয় করার চেষ্টা করছিল, কারা সেই হতভাগা ভিক্ষু, যারা এই মেয়াদ বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছে; আর ভাবছিল, একবার খুঁজে পেলে সে তাদের নিয়ে কী করবে! সেই অবিবেচক ভিক্ষুদের জন্য সবচেয়ে অভিক্ষুসুলভ বিভিন্ন প্ল্যান করতে লাগল সে।
তার রাগ যেন পুরনো সব ব্যথাকে শুষে নিয়েছিল। সে রাগে জ্বলছিল। সে যেন খুনের নেশায় মাতাল। এমন রাগ তার আগে কখনো হয় নি। এরপর আবার ঘণ্টা বাজল। এটা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে স্বল্পমেয়াদী পনের মিনিট।
গুরু ঘোষণা করলেন, ‘ভাবনা কোর্স সমাপ্ত। তোমাদের সবার জন্য খাবার প্রস্তুত আছে ক্যান্টিনে। সবাই বিশ্রাম নাও। তোমরা এখন কথা বলতে পারো।’
পশ্চিমা ভিক্ষুটি বিমূঢ় হয়ে গেল। আমি তো ভেবেছি আরও দু সপ্তাহ ধ্যান করতে হবে। হচ্ছেটা কী? একজন ইংরেজি জানা সিনিয়র ভিক্ষু তার বিমূঢ় ভাব লক্ষ করে তার দিকে এগিয়ে এলো। হেসে সে পশ্চিমা ভিক্ষুটিকে বলল, ‘চিন্তা করো না, গুরু এ রকম করে থাকেন প্রতিবছর!’
রাগ নিয়ে একটা সমস্যা হলো আমরা রেগে যাওয়াটা উপভোগ করি। রাগ দেখানোর সাথে কেমন জানি একটা মাদকতা জড়ানো থাকে। অন্য ধরনের বন্য আনন্দ কাজ করে। যাতে আনন্দ থাকে, তাকে আমরা উপভোগ করি, তাকে আমরা যেতে দিতে চাই না। তবে রাগ দেখানোতে বিপদও আছে। রাগ
দেখানোর ফল এই আনন্দের চেয়েও ভারী হয়ে চেপে বসে। যদি আমরা রাগের ফল উপলব্ধি করতাম, তাহলেই আমরা রাগকে সানন্দে যেতে দিতে রাজি হতাম।
অনেক অনেক আগে কোনো এক জগতে এক রাজ প্রাসাদে এক দানব প্রবেশ করল। সে সময় রাজা কী একটা কাজে বাইরে ছিলেন। দানবটি দেখতে এমন কুৎসিত, গা থেকে এমন দুর্গন্ধ বের হয়, আর তার কথাবার্তাও এমন বিশ্রী যে রাজপ্রাসাদের সৈন্যসামন্ত কর্মচারী সবাই ভয়ে কাত। এই সুযোগে সে বাইরের রুমগুলো পেরিয়ে রাজদরবারে গিয়ে সোজা রাজসিংহাসনে বসে পড়ল। তাকে সেখানে বসতে দেখে সৈন্যসামন্ত ও অন্যান্যদের হুঁশ ফিরে এলো।
তারা চিৎকার করে বলল, ‘বের হও ওখান থেকে! তোমার জায়গা ওখানে নয়! এখুনি যদি তোমার পাছা ওখান থেকে না সরাও তো তলোয়ার দিয়ে গুঁতিয়ে ওটাকে বের করে দেব আমরা।’
এই কয়েকটি রাগের কথায় দানবটি কয়েক ইঞ্চি বড় হয়ে গেল। তার চেহারা আরও কদাকার হলো। দুর্গন্ধ আরও তীব্র হলো। কথাবার্তা আরও অশস্নীল হয়ে উঠল।
তলোয়ার উঁচিয়ে ধরা হলো। ছোরা বের করা হলো খাপ থেকে। অনেক হুমকি ধামকি দেওয়া হলো। প্রত্যেকটি রাগের কথায়, কাজে, এমনকি প্রত্যেকটি রাগমূলক চিন্তায় দানবটি এক ইঞ্চি করে বাড়ল, আরও বিশ্রী চেহারা হলো, দুর্গন্ধ আরও বাড়ল, কথাবার্তা আরও অশ্রাব্য হয়ে উঠল।
এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর রাজা ফিরলেন। তিনি তার আসনে এক বিশালকায় দানবকে বসে থাকতে দেখলেন। এমন জঘন্য ও কুৎসিত কোনো কিছু আগে কখনো দেখেননি তিনি, এমনকি কোনো ফিল্মেও নয়। দানবটার গায়ের দুর্গন্ধে কৃমিও অসুস্থ হয়ে পড়বে। তার কথাবার্তা শুঁড়িখানার মাতালদের গালিকেও হার মানাবে।
রাজা কিন্তু জ্ঞানী ছিলেন। এজন্যই তো তিনি রাজা। তিনি জানতেন কী করতে হবে। রাজা উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন, ‘স্বাগতম, স্বাগতম আমার প্রাসাদে। আপনাকে কেউ কী পানীয়-টানীয় কিছু দিয়েছে ইতিমধ্যে? অথবা কোনো খাদ্য-ভোজ্য?’
এমন দয়ালু আচরণে দানবটি কয়েক ইঞ্চি ছোট হয়ে গেল, বিশ্রী ভাব একটু কমল, দুর্গন্ধ একটু কমে গেল। কথাবার্তা আগের থেকে কম অশস্নীল শোনাল।
প্রাসাদের লোকজন দ্রুত ব্যাপারটা ধরতে পারল। একজন দানবটিকে জিজ্ঞেস করল, তার এক কাপ চা লাগবে কি না। আমাদের আছে দার্জিলিংয়ের চা, ইংলিশ চা, অথবা আপনি যদি চান তো আর্ল গ্রে চা। নাকি পেপারমিন্ট দেব? এটি আপনার স্বাস্থ্যের জন্য ভালো হবে। আরেকজন ফোনে পিৎজার অর্ডার দিল। যেন তেন পিৎজা নয়, এমন বড় দানবের জন্য বড়সড় ফ্যামিলি সাইজের পিৎজা। অন্যরা স্যান্ড্যুইচ বানিয়ে দিল মাংসের ভুনা দিয়ে। একজন সৈন্য
দানবটির পা মালিশ করে দিল। আরেকজন তার ঘাড়ের আশগুলো চুলকে দিল। ‘উম্ ম্ ম! কী দারুণ!’ ভাবল দানবটা।
প্রত্যেকটি দয়ার কথায়, কাজে ও চিন্তায় সেটি আরও ছোট হলো। আরও কম কুৎসিত হলো। আরও কম দুর্গন্ধ ছড়াল। আরও কম অশস্নীল কথাবার্তা আওড়াল। পিৎজা নিয়ে আসার আগেই সে আগের সাইজে ফিরে আসল। কিন্তু তাই বলে অন্যরা ভালো আচরণ করা বন্ধ করল না। শীঘ্রই দানবটির সাইজ এমন ছোট হয়ে গেল যে তাকে দেখতে পাওয়াই দায়। পরিশেষে আরও একটা দয়ার কাজের পরেই সে পুরোপুরি মিলিয়ে গেল। আমরা এমন দানবকে বলি ‘রাগখেকো দানব’।
আপনার সঙ্গী হয়তো মাঝেমধ্যে এমন রাগখেকো দানবে পরিণত হতে পারে। আপনি তাদের সাথে রাগ করলে তারা আরও খারাপ, আরও কুৎসিত, আরও বেশি দুর্গন্ধ ছড়ায় এবং কথাবার্তা আরও অশ্রাব্য হয়ে ওঠে। প্রত্যেক রাগের কথায় সমস্যাটা আরও বড় হয়, এমনকি রাগের চিন্তা করলেও। বোধহয় এখন আপনি আপনার ভুল বুঝতে পেরেছেন, আর জেনে গেছেন কী করতে হবে।
ব্যথাও আরেকটা রাগখেকো দানব। যখনই আমরা রাগের চোটে ভাবি, ‘ব্যথা! বের হও এখান থেকে! তোমার এখানে কোনো জায়গা নেই!’ তখন ব্যথা আরেকটু বড় হয়, অবস্থা আরেকটু খারাপ হয়। ব্যথার মতো এমন জঘন্য ও বিশ্রী কোনো কিছুর প্রতি দয়া দেখানো কঠিন, কিন্তু জীবনে মাঝে মাঝে এমন সময় আসে যখন আমাদের হাতে অন্য কোনো উপায় থাকে না। আমার দাঁতের ব্যথার গল্পের মতো, যখন আমরা ব্যথাকে সত্যি সত্যিই আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাই, এটি কমতে থাকে। সমস্যা হাল্কা হয়ে ওঠে, আর মাঝে মাঝে পুরোপুরি উধাও হয়ে যায়।
কিছু কিছু ক্যান্সারও রাগখেকো দানবের মতো। কুৎসিত ও বমি উদ্রেককারী এই দানবগুলো আমাদের দেহে, আমাদের সিংহাসনে বাস করে। এটা বলা
স্বাভাবিক, ‘বের হও এখান থেকে! এটা তোমার জায়গা নয়!’ যখন সবকিছু ব্যর্থ অথবা তারও আগে আগে আমরা বলতে পারি : ‘স্বাগতম।’ কিছু কিছু ক্যান্সার আছে যেগুলো দুশ্চিন্তাকে খেয়ে খেয়ে বেড়ে ওঠে, এজন্যই এগুলো ‘রাগখেকো দানব’। এ ধরনের ক্যান্সার ভালো সাড়া দেয় যখন ‘প্রাসাদের রাজা’ সাহসের সাথে বলে, ‘হে ক্যান্সার, আমার হৃদয়ের দরজা তোমার জন্য পুরোপুরি খোলা, তুমি যা-ই করো না কেন। এসো, ভেতরে এসো!’
রাগের আরেকটা ফল আমাদের মনে রাখা উচিত। সেটা হচ্ছে এটি আমাদের সম্পর্ককে ধ্বংস করে, এবং বন্ধুদের কাছ থেকে আমাদের দূরে সরিয়ে দেয়।
কেন এমন হয়? এত বছর একসাথে কাটিয়ে যখন তারা কোনো ভুল করে, আমাদের মনে খুব দুঃখ দেয়, আমরা তখন কেন এমন রেগে যাই যে এত দিনের সম্পর্কটাকে শেষ করে দিই? কত চমৎকার মুহূতর্গুলো আমরা একসাথে কাটিয়েছি (৯৯৮টি ইট) সেগুলো এখন যেন তুচ্ছ ও নগণ্য। আমরা এখন দেখি একটি মাত্র মারাত্মক ভুলকে (২টি খারাপ ইট) আর এতেই পুরো জিনিসটাকে ধ্বংস করে দিই। এটা কেন জানি ন্যায্য বলে মনে হয় না। যদি আপনি একা হতে চান, তবে রাগী হোন।
এক তরুণ কানাডিয়ান দম্পতিকে আমি চিনতাম। তারা পার্থে তাদের কাজ শেষ করেছিল। অস্ট্রেলিয়া থেকে কানাডার টরন্টোতে ফিরে যাওয়ার প্ল্যান করতে গিয়ে তাদের মাথায় একটা বুদ্ধি আসল। তারা সাগর পাড়ি দিয়ে কানাডায় যাবে। তারা ছোট একটা ইয়ট কেনার প্ল্যান করল। তাদের ইয়ট কিনতে সাহায্য করল আরও এক তরুণ দম্পতি। তারাও প্রশান্ত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে কানাডার ভ্যাংকুভারে যেতে চায়। সেখানে তারা ইয়টটাকে বিক্রি করে তাদের টাকাটা তুলে নেবে আর সেই টাকা দিয়ে বাড়ি বানাবে। এটা কেবল অর্থনৈতিকভাবেই লাভজনক ছিল না, বরং একজোড়া তরুণ দম্পতির জন্য এটা ছিল জীবনের একটা রোমাঞ্চকর অভিযান।
নিরাপদে কানাডায় পৌঁছে তারা আমাকে একটা চিঠি লিখে তাদের সেই চমৎকার অভিযানের কথা জানাল। বিশেষ করে তারা একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করল যা থেকে দেখা যায় রেগে গেলে আমরা কেমন বোকা বনে যেতে পারি, আর কেনই বা রাগকে দমন করতে হয় তার কারণ।
ভ্রমণের মাঝপথে প্রশান্ত মহাসাগরের কোনো এক জায়গায় তীর থেকে বহু বহু কিলোমিটার দূরে তাদের ইয়টের ইঞ্জিন বিগড়ে গেল। তরুণ দুজন কাজের
পোশাক পরে নিয়ে ছোট ইঞ্জিন রুমে নেমে গেল, এবং ইঞ্জিনটা সারানোর চেষ্টা করল। তরুণী দুজন ইয়টের ডেকে বসে আরামদায়ক রোদে ম্যাগাজিন পড়তে লাগল।
ইঞ্জিন রুমটা গরম ও খুব ছোট ছিল। ইঞ্জিনটা যেন একগুঁয়ে হয়ে গিয়েছিল, কিছুতেই সারতে চাইছিল না। বড় বড় নাটগুলো যেন কিছুতেই ঘুরতে চাচ্ছিল না। ছোট কিন্তু খুব গুরুত্বপূর্ণ স্ক্রুগুলো পিছলে গিয়ে হাত থেকে পড়ে যাচ্ছিল, আর এমন ফাঁক ফোঁকরের মধ্যে গিয়ে পড়ছিল যে সেখান থেকে সেগুলো খুঁজে পাওয়াও দায়, তুলে আনা তো দূরের কথা। লিকগুলো কিছুতেই বন্ধ হতে চাচ্ছিল না। এমন দিশেহারা অবস্থা রুদ্ররোষের জন্ম দিল। প্রথমে ইঞ্জিনটাকে দুষল তারা, পরে দুষতে শুরু করল পরস্পরকে। এমন রুদ্ররোষ শীঘ্রই পরিণত হলো রাগে। রাগ পরিণত হলো উন্মত্ততায়। একজন রেগেমেগে হাল ছেড়ে দিল। যথেষ্ট হয়েছে তার। সে হাতের রেঞ্চ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চিৎকার করে বলল, ‘ঠিক আছে! অনেক হয়েছে! আমি চলে যাচ্ছি!’
সে রাগে এমন উন্মত্ত হয়ে গেল যে তার কেবিনে ঢুকে সাফসুতরো হয়ে কাপড় বদলে নিয়ে, ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে ইয়টের ডেকে বেরিয়ে এলো। রাগে তখনো ফুঁসছে সে, গায়ে জ্যাকেট, দুহাতে ধরা দুটো ব্যাগ।
মেয়ে দুজন বলেছিল যে তাদের নাকি হাসতে হাসতে বোট থেকে গড়িয়ে পড়ে যাবার মতো অবস্থা। বেচারা তরুণটি চারপাশের অসীম সাগরে চোখ বুলিয়ে নিল, যত দূর দুচোখ যায় তত দূর পর্যন্ত সবখানে। যাওয়ার কোথাও জায়গা ছিল না।
সে এমন বোকা হয়ে গেল যে নিজের ভুল বুঝতে পেরে লজ্জায় লাল হয়ে গেল। তাড়াতাড়ি কেবিনে ফিরে গিয়ে সবকিছু আবার ব্যাগ থেকে বের করল, কাজের পোশাক পরল আবার, আর ইঞ্জিনরুমে ফিরে গেল অন্যজনকে সাহায্য করতে। সে বাধ্য হয়েছিল ফিরে যেতে। যাওয়ার আর কোথাও জায়গা ছিল না যে।
যখন আমাদের উপলব্ধি হয় যে, যাওয়ার কোথাও জায়গা নেই, তখন আমরা পালিয়ে না গিয়ে সমস্যার মোকাবেলা করি। বেশির ভাগ সমস্যার সমাধান আছে, যা আমরা উল্টো দিকে দৌঁড় মারতে গিয়ে খেয়ালই করি না। আগের গল্পে ইয়টের ইঞ্জিনটা ঠিক হয়ে গিয়েছিল, তরুণ দুজন শ্রেষ্ঠ বন্ধু হয়ে গিয়েছিল, আর ভ্রমণের বাকি অংশটা তারা একসাথে দারুণভাবে কাটিয়েছিল।
আমাদের এই জগতে লোকজন যখন একসাথে থাকার জন্য কাছাকাছি চলে আসে, তখন নিজেদের সমস্যাগুলোর সমাধান নিজেদেরই করতে হয়। পালানোর কোনো পথ নেই। আমরা আর বেশি মতপার্থক্য নিয়ে চলতে পারি না।
১৯৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে আমি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছিলাম, কীভাবে একটা দেশের সরকার একটা বড় সংকটের এমন চমৎকার সমাধান খুঁজে পেয়েছিল, যে সংকটটা তাদের দেশের গণতন্ত্রের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছিল।
১৯৭৫ সালে কয়েক দিনের মাথায় দক্ষিণ ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বোডিয়া কমিউনিস্টদের হাতে চলে গেল। পশ্চিমা শক্তিগুলো ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে
থাইল্যান্ড হচ্ছে এর পরবর্তী শিকার। সেই সময় আমি উত্তরপূর্ব থাইল্যান্ডে একজন নবীন ভিক্ষু হয়েছি মাত্র। যে বিহারে আমি থাকতাম, তা হ্যানয়ের যতটা কাছে ছিল, ব্যাংকক থেকে ছিল এর দ্বিগুণ দূরে। আমাদের দূতাবাসে গিয়ে রেজিস্টারে নাম লেখাতে বলা হলো, আর আমাদের সরিয়ে নেওয়ার প্ল্যানও
রেডি করা হলো। বেশির ভাগ পশ্চিমা সরকার অবাক হয়ে গিয়েছিল, যখন তারা দেখল যে থাইল্যান্ড পড়ে যায় নি।
আজান চাহ্ তখন বেশ বিখ্যাত ছিলেন। অনেক উচ্চপদস্থ থাই জেনারেল ও সংসদের সিনিয়র সদস্যরা উপদেশ ও অনুপ্রেরণা নিতে তার বিহারে যেতেন। আমি তখন থাই ভাষা স্বচ্ছন্দে বলতে পারি। লাও ভাষাও বলতে পারি কিছু কিছু। তাই পরিস্থিতির গুরুত্বটা বুঝতে বেগ পেতে হয় নি। থাইল্যান্ডের সামরিক বাহিনী ও সরকার বাইরের কমিউনিস্ট কর্মীদের নিয়ে অতটা উদ্বিগ্ন ছিল না, তাদের যত উদ্বেগ ছিল দেশের ভেতরের কমিউনিস্ট কর্মী ও সমর্থকদের নিয়ে।
অনেক মেধাবী থাই ইউনিভার্সিটির ছাত্র উত্তরপূর্ব থাইল্যান্ডের জঙ্গলে ঢুকে অভ্যন্তরীণ থাই কমিউনিস্ট গেরিলা বাহিনীকে সাহায্য করতে লাগল। বর্ডারের বাইরে থেকে তাদের জন্য অস্ত্র গোলাবারুদ, ও প্রশিক্ষণ দেওয়া হতে লাগল।
সেই অঞ্চলের গ্রামবাসীরাও তাদের খুশিমনে খাদ্য ও প্রয়োজনীয় রসদপত্র যোগাতে লাগল। তাদের ছিল স্থানীয় সমর্থন। তারা হয়ে উঠছিল এক ভয়ংকর হুমকি।
থাই সামরিক বাহিনী ও সরকার এর সমাধান করল তিন ধাপের একটি সমন্বিত কৌশলে।
সামরিক বাহিনী কোনো কমিউনিস্ট ঘাঁটিকে আক্রমণ করল না। যদিও প্রত্যেকটি সৈন্য জানত সেগুলো কোথায়। যখন আমি ১৯৭৯-৮০ সালের দিকে শুধু জঙ্গলে কাটিয়েছি, নির্জনে ধ্যান করার জন্য পাহাড়, পর্বত ও জঙ্গল খুঁজে বেরিয়েছি, তখন মাঝে মাঝে আর্মিদের সাথে দেখা হতো। তারা আমাকে একটা পাহাড় আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিত, এবং ওদিকে যেতে মানা করত, ওখানে কমিউনিস্টদের আস্তানা। তারা অন্য পাহাড় দেখিয়ে দিয়ে বলত ওটা ধ্যান করার জন্য ভালো জায়গা, ওখানে কোনো কমিউনিস্ট নেই। তাদের পরামর্শ আমাকে মানতে হয়েছিল। আমি শুনেছিলাম, সেই বছর কমিউনিস্টরা কয়েকজন ধুতাঙ্গ ভিক্ষুকে জঙ্গলে ধ্যান করার সময় ধরে ফেলে, এবং পরে নির্যাতন করে মেরে ফেলেছিল।
এই বিপদজনক সময়ে সেখানে তখন অঘোষিত যুদ্ধবিরতি চলছিল। যখনই কোনো কমিউনিস্ট বিদ্রোহী আত্মসমপর্ণ করতে চাইত, সে সহজেই অস্ত্র ত্যাগ করে গ্রামে বা ইউনিভার্সিটিতে ফিরে যেতে পারত। তাকে হয়তো চোখে চোখে রাখা হতো, কিন্তু কোনো শাস্তি দেওয়া হতো না। আমি একবার কো ওং জেলার এক গ্রামে পৌঁছলাম যেখানে কয়েক মাস আগে কমিউনিস্টরা এমবুশ করে তাদের গ্রামের বাইরে এক জীপ থাই সৈন্যকে মেরে ফেলেছিল। গ্রামের তরুণেরা বেশির ভাগই কমিউনিস্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল, যদিও তারা সরাসরি কমিউনিস্টদের কাজ করত না। তারা আমাকে বলেছিল যে তাদের হুমকি দেওয়া হয়েছে, হেনস্থা করা হয়েছে, কিন্তু পরে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
সেই বছরগুলোতে আমি দেখতাম নতুন নতুন রাস্তাঘাট তৈরি হচ্ছে। পুরনো পথগুলো পাকা করা হচ্ছে। গ্রামবাসীরা এখন তাদের উৎপাদিত পণ্যগুলো সহজেই শহরে বিক্রির জন্য নিয়ে যেতে পারে। থাইল্যান্ডের রাজা ব্যক্তিগতভাবে শত শত পানি সেচ প্রকল্পের নির্মাণ কাজের খোঁজখবর নিয়েছেন, যাতে গরিব কৃষকরা প্রত্যেক বছর দ্বিতীয়বার ফসল ফলাতে পারে। প্রত্যন্ত অঞ্চলেও বিদ্যুৎ পৌঁছে গিয়েছিল পাড়ায় পাড়ায়। তার সাথে সাথে আসল একটি করে স্কুল ও ক্লিনিক। থাইল্যান্ডের সবচেয়ে দরিদ্র অঞ্চলটাকে ব্যাংককের সরকার দেখাশোনা করছে, যার ফলে গ্রামবাসীরা আগের থেকে উন্নত হয়ে উঠল।
একজন থাই সৈন্য জঙ্গলে টহল দেওয়ার সময় আমাকে এই কথাগুলো বলেছিল :
কমিউনিস্টদের গুলি করার কোনো প্রয়োজন নেই আমাদের। তারা আমাদেরই থাই বন্ধুবান্ধব। তারা পাহাড় থেকে নামার সময় অথবা গ্রাম থেকে রসদ আনতে যাবার সময় যখন তাদের সাথে আমার দেখা হয়, আমরা সবাই পরস্পরকে চিনি। আমি তাদের আমার নতুন হাতঘড়িটা দেখাই, অথবা আমার নতুন রেডিওতে শোনাই একটা থাই গান, তখন তারা কমিউনিস্ট হওয়াটা ত্যাগ করে।
সেটা তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং অন্যান্য সৈন্যদের অভিজ্ঞতাও একই।
থাই কমিউনিস্টরা তাদের সরকারের প্রতি এমন রাগ নিয়ে বিদ্রোহ শুরু করেছিল যে তারা তাদের তরুণ জীবন উৎসর্গ করতেও প্রস্তুত ছিল। কিন্তু সরকারের সংযম প্রদর্শনের ফলে তাদের রাগ খারাপের দিকে গড়ানোর সুযোগ পায় নি। ক্ষমা ও অঘোষিত অস্ত্রবিরতি তাদের নিরাপদ ও সম্মানজনক পথে
বেরিয়ে আসার সুযোগ করে দিয়েছিল। উন্নয়নের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করে গরিব গ্রামবাসীদের অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ করা হয়েছিল। গ্রামবাসীরা কমিউনিস্টদের সাহায্য করার আর কোনো কারণ খুঁজে পেল না। সরকার তাদের যেরূপ উন্নয়ন করে দিয়েছে, তাতে তারা যারপরনাই সন্তুষ্ট। ওদিকে কমিউনিস্টদের মনে নানা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছিল, তারা এটা কী করছে? এই জঙ্গলে ঢাকা পাহাড় পর্বতে এমন কষ্টের মাঝে জীবন কাটাচ্ছে কেন তারা?
একের পর এক তারা অস্ত্র জমা দিয়ে নিজ নিজ পরিবারে, গ্রামে বা ইউনিভার্সিটিতে ফিরে গেল। ১৯৮০ সালের প্রারম্ভে বলতে গেলে আর কোনো বিদ্রোহীই অবশিষ্ট রইল না। অতএব কমিউনিস্টদের লিডাররাও আত্মসমপর্ণ করল। আমি ব্যাংকক পোস্ট নামের একটা সংবাদপত্রে একটা লেখা পড়েছিলাম একজন নবীন উদ্যোক্তাকে নিয়ে, যে থাই টুরিস্টদের জঙ্গলে, গুহায় কমিউনিস্টদের ফেলে যাওয়া আস্তানা দেখিয়ে আনত।
সেই কমিউনিস্ট বিদ্রোহের নেতাদের ভাগ্যে কী ঘটেছিল? সেই একই নিঃশর্ত ক্ষমার প্রস্তাব কি তাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়েছিল? ঠিক সেরকম ঘটে নি। তাদের শাস্তি দেওয়া হয় নি, নির্বাসনও দেওয়া হয় নি। তার বদলে তাদের থাই প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হয়েছিল তাদের নেতৃত্বের
গুণাবলী, কঠোর পরিশ্রমের ক্ষমতা এবং জনগণের প্রতি তাদের চিন্তার স্বীকৃতি হিসেবে। কী কৌশল! এমন সাহসী ও নিবেদিতপ্রাণ যুবসম্পদকে কেন নষ্ট করতে যাওয়া? তার চেয়ে কাজে লাগাও তাদের।
এটি একটি সত্যি ঘটনা যা আমি সেই সময়ের সৈন্য ও গ্রামবাসীদের কাছ থেকে শুনেছি। এটি এমন একটি ঘটনা যা আমি দু চোখে প্রত্যক্ষ করেছি।
দুঃখের বিষয়, এটি পরে কোথাও উল্লেখ করা হয় নি।
এই বই লেখার সময়ে, সেই প্রাক্তন কমিউনিস্ট নেতাদের দুজন তখন থাই জাতীয় সংসদে মন্ত্রী হিসেবে দেশের জন্য কাজ করছিলেন।
যখন কেউ আমাদের আঘাত দেয়, তখন তাকে শাস্তি দেওয়ার কাজটা যে আমাদেরই করতে হবে, এমন নয়। আমরা যদি খ্রিস্টান, মুসলিম বা ইহুদি হই, তাহলে আমরা কি নিশ্চিতভাবেই বিশ্বাস করি না যে, সৃষ্টিকর্তা তাকে যথেষ্ট শাস্তি দেবেন? যদি আমরা বুড্ডিস্ট, হিন্দু বা শিখ হই, আমরা জানব যে, কর্ম নিশ্চয়ই আক্রমণকারীকে তার কর্ম অনুসারে ফল দেবে। আর যদি আপনি আধুনিক মনোবিজ্ঞানের অনুসারী হন, তাহলে তো জানেন যে আক্রমণকারীকে তার অপরাধবোধের চিকিৎসা করতে গিয়ে অনেক ব্যয়বহুল থেরাপি নিতে হবে প্রতিবছর।
তাই ‘তাদের একটা উচিত শিক্ষা দেওয়া’টা কেন আমরা করতে যাব? ভালোমতো বিচার বিবেচনা করলে দেখব যে আমাদের তা করার কোনো দরকার
নেই। যখন আমরা রাগকে যেতে দিই, আর ক্ষমা দিয়ে ঠান্ডা করে দিই, তখনো কিন্তু আমরা জনগণের প্রতি আমাদের কর্তব্যগুলো পালন করে যাই প্রতিনিয়ত।
আমার দুজন পশ্চিমা বন্ধু ভিক্ষু তর্কাতর্কি করছিল। এক ভিক্ষু ছিল প্রাক্তন ইউএস মেরিন সেনা, যে ভিয়েতনামে সম্মুখ যুদ্ধে লড়াই করেছিল এবং গুরুতর আহত হয়েছিল। অন্যজন ছিল খুব সফল একজন ব্যবসায়ী, যে অল্প বয়সেই এত টাকা কামিয়েছিল যে পঁচিশের কোঠায় এসে কাজকর্ম থেকে ‘অবসর’ নিয়েছিল। তারা দুজনই ছিল খুব চালাক, শক্ত সামর্থ অত্যন্ত কঠিন চরিত্রের লোক।
ভিক্ষুদের তর্কাতর্কি করার কথা নয়, কিন্তু তারা করছিল। ভিক্ষুদের ঘুষি মারামারি করার কথা নয়, কিন্তু তারা তা করতে যাচ্ছিল। তাদের একজনের
চোখ আরেকজনের চোখে স্থির, একজনের নাক আরেকজনের নাক স্পর্শ করছে, আগুনঝরা দৃষ্টি দুজনেরই। এমন একটি উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের মাঝখানে প্রাক্তন মেরিন সেনা হঠাৎ করে হাঁটু গেড়ে মাথা নিচু করে পরম শ্রদ্ধার সাথে সালাম করল বিস্মিত প্রাক্তন ব্যবসায়ী ভিক্ষুকে। এর পরে সে মাথা তুলে বলল, ‘আমি দুঃখিত, আমাকে ক্ষমা করো।’
এটি ছিল সেই দুর্লভ সদাচারগুলোর একটি যা আসে সরাসরি হৃদয় থেকে। যা কোনো পরিকল্পনামাফিক নয়, বরং সব সময় স্বতঃস্ফুর্ত ও অনুপ্রেরণাদায়ী। এ ধরনের কাজ দেখামাত্র চেনা যায় আর সেগুলো হয় সম্পূর্ণ অপ্রতিরোধ্য।
প্রাক্তন ব্যবসায়ী ভিক্ষু কেঁদে ফেলল।
কয়েক মিনিট পরে তাদের একসাথে বন্ধু হিসেবে হাঁটতে দেখা গেল। ভিক্ষুদের সেটাই করার কথা।
আমি আপনাদের বলতে শুনি, ক্ষমা দিয়ে হয়তো বৌদ্ধ বিহারে কাজ হতে পারে, কিন্তু বাস্তব জীবনে এমন ক্ষমা দিলে আমাদের কাছ থেকে সুযোগসন্ধানীরা সুবিধা আদায় করে নেবে। লোকজন আমাদের পা দিয়ে মাড়িয়ে চলে যাবে। তারা ভাববে আমরা দুর্বল। আমি এ বিষয়ে একমত। এমন ক্ষমায় কদাচিৎ কাজ হয়। সেই প্রবাদটা আছে না : ‘একটা গালে চড় খেলে যে আরেকটা গাল এগিয়ে দেয়, তাকে একবার নয়, দু দুবার ডেন্টিস্টের কাছে যেতে হয়।’
আগের গল্পে থাই সরকার নিঃশর্ত ক্ষমার মাধ্যমে শুধু ক্ষমা নয়, এর থেকে বেশি কিছু করেছিল। এটি মূল কারণ দারিদ্র্যতাকেও খুঁজে নিয়ে এটিকে দক্ষতার সাথে মোকাবেলা করেছিল। এ কারণেই এমন ক্ষমায় কাজ হয়েছিল।
আমি এমন ক্ষমাকে বলি ‘ইতিবাচক ক্ষমা’। ‘ইতিবাচক’ মানে হচ্ছে, আমরা যে ভালো গুণগুলো দেখতে চাই, সেগুলোকে আরও শক্তিশালী করে তোলা।
‘ক্ষমা’ মানে হচ্ছে, সমস্যার অংশ হিসেবে যে খারাপ গুণগুলো, সেগুলোকে যেতে দেওয়া, সেগুলো নিয়ে পড়ে না থেকে সামনে এগিয়ে যাওয়া। উদাহরণস্বরূপ, বাগানে শুধু আগাছাতে পানি দেওয়া মানে সমস্যাগুলোকে বাড়ানো, পানি না দেওয়া মানে ক্ষমা প্র্যাকটিস করা, শুধুমাত্র ফুলগুলোতে পানি
দেওয়া, কিন্তু আগাছাগুলো বাদে। এটি হচ্ছে ইতিবাচক ক্ষমা।
প্রায় দশ বছর আগে পার্থে এক শুক্রবার সন্ধ্যায় ধর্মদেশনা শেষে একজন মহিলা আমার সাথে কথা বলতে এগিয়ে এলো। আমি যতদূর মনে করতে পারি, আমাদের সবগুলো সাপ্তাহিক দেশনাতেই তার নিয়মিত উপস্থিতি ছিল। কিন্তু এই প্রথম সে আমার সাথে কথা বলল। সে বলল যে, সে একটা বড় ধন্যবাদ দিতে চায়, কেবল আমাকে নয়, আরও অন্যান্য ভিক্ষুদেরও, যারা এই বিহারে দেশনা দিয়েছে। এর পরে সে এর কারণ ব্যাখ্যা করল। সে আমাদের বিহারে আসা শুরু করে সাত বছর আগে থেকে। সে স্বীকার করল যে বৌদ্ধধর্ম বা ধ্যান সম্পর্কে তার মোটেও কোনো আগ্রহ ছিল না। তার এখানে আসার প্রধান কারণ ছিল বাসা থেকে বের হওয়ার একটা অজুহাত দেখানো।
মহিলাটি ভীষণ পারিবারিক নির্যাতনের শিকার ছিল। তার স্বামী তাকে বাসায় প্রচন্ড নির্যাতন করত। সেই সময়ে এ ধরনের পারিবারিক নির্যাতনের শিকার
যারা, তাদের সাহায্য করার মতো কোনো সহায়ক প্রতিষ্ঠান ছিল না। এমন পরিবেশে সে বেরিয়ে আসার কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিল না। তাই সে আমাদের বুড্ডিস্ট সেন্টারে আসত এই ভেবে যে, এখানে দুই ঘণ্টা কাটালে সেই দুই ঘণ্টা অন্তত নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচা যাবে।
আমাদের বিহারে এসে সে যা শুনল, তা তার জীবনটাকে বদলে দিল। সে ভিক্ষুদের কাছ থেকে শুনল ইতিবাচক ক্ষমার কথা। সে এটা তার স্বামীর উপর
চেষ্টা করে দেখার সিদ্ধান্ত নিল। সে আমাকে বলেছিল যে, প্রতিবার যখন তার স্বামী তাকে মারত, সে তাকে ক্ষমা করে যেতে দিত। কীভাবে সে এটা করত,
কেবল সে-ই জানে। প্রত্যেক বারে তার স্বামীর যে কোনো সদয় কাজ ও কথায়, তা যতই নগণ্য হোক না কেন, সে তাকে জড়িয়ে ধরত, চুমু দিত অথবা এমন কোনো ইশারা করে তাকে জানিয়ে দিত এমন দয়া তার কাছে কতটুকু বিশাল।
সে কোনো কিছুকেই নিয়তি বলে মেনে নেয় নি।
সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমাকে বলেছিল যে, দীর্ঘ সাত বছর লেগেছে তার এ কাজে সফল হতে। এ পর্যায়ে তার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে এসেছিল। আমারও চোখ ভিজে গিয়েছিল। সে আমাকে বলেছিল, ‘সাতটি দীর্ঘ বছর। এখন আপনি তাকে চিনতেও পারবেন না। সে সম্পূর্ণ বদলে গেছে। আমাদের মাঝে এখন খুব মূল্যবান ভালোবাসার সম্পর্ক বিরাজ করছে, আর আছে দুটো ফুটফুটে সন্তান।’ তার মুখ সন্ন্যাসীদের মতো আভা ছড়াচ্ছিল। আমার মনে হচ্ছিল হাঁটু গেড়ে তাকে সম্মান জানাই। সে আমাকে থামিয়ে বলল, ‘এই টুলটা দেখেছেন? এই সপ্তাহে সারপ্রাইজ হিসেবে সে আমাকে এই কাঠের টুলটা বানিয়ে দিয়েছে ধ্যান করার জন্য। সাত বছর আগে হলে সে এটা দিয়ে আমাকে পেটাত।’ আমরা একসাথে হেসে উঠলাম।
আমি এই মহিলার প্রশংসা করি। সে তার নিজের সুখ নিজেই অর্জন করেছে, যা তার পরিস্থিতি বিবেচনা করলে অসামান্যই বলতে হয়। সে একটা দানবকে যত্নশীল মানুষে পরিণত করেছে। সে আরেকজন মানুষকে সাহায্য করেছে, দারুণভাবে সাহায্য করেছে। এটা ইতিবাচক ক্ষমার একটা চরম উদাহরণ। যারা সাধুসন্তের পথ ধরেছে, তাদের জন্য আমি এমনই করার সুপারিশ করি। এত কিছু বাদেও, এটি আমাদের দেখিয়ে দেয়, যখন ক্ষমার সাথে ভালো কিছু করার অনুপ্রেরণাও যুক্ত হয়, তখন কী অর্জন করা যায়।