পঞ্চম অধ্যায়

সুখ সৃষ্টি করা

প্রশংসা বাক্য আপনাকে সব জায়গায় নিয়ে যাবে

আমরা সবাই নিজেদের সম্বন্ধে প্রশংসাবাক্য শুনতে চাই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বেশির ভাগ সময় কেবল আমাদের দোষের কথাই শুনি। আমি মনে করি সেটা ন্যায্য পাওনা, কেননা বেশির ভাগ সময় আমরা অন্যের দোষ নিয়েই কথা বলি। প্রশংসাবাক্য উচ্চারণ করি খুব কদাচিৎ। আপনি কথা বলার সময় নিজের কথাগুলো শোনার চেষ্টা করুন।

 

প্রশংসা না পেলে ভালো গুণগুলো সুদৃঢ় হয় না, আর তাতে সেই গুণগুলো ক্ষয় হয়ে হয়ে একসময় মারা যায়। কিন্তু ছোট্ট একটা প্রশংসা সেখানে বিরাট এক উৎসাহের ভিত্তি গড়ে দেয়। আমরা সবাই প্রশংসিত হতে চাই; আর সেই প্রশংসাবাক্য শোনার জন্য আমাদের কী করা উচিত সে বিষয়েও নিশ্চিত হতে চাই।

 

একবার আমি একটা ম্যাগাজিনে একটা চিকিৎসক দল সম্পর্কে পড়েছিলাম, যারা ছোট বাচ্চাদের খাওয়ার সমস্যা দূর করতে ভালো গুণাবলীগুলো সুদৃঢ় করার ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়েছিল। এই বাচ্চারা যখনই কোনো কঠিন খাদ্যবস্ত্ত খেত, সাথে সাথে সেটা বমি করে ফেলে দিত। কোনো বাচ্চা এক মিনিট বা তারও বেশি সময় খাদ্যবস্ত্ত পেটে রাখতে পারলে চিকিৎসকের দলটি তার জন্য একটা পার্টির আয়োজন করত। তাদের বাবা-মারা কাগজের টুপি মাথায় দিয়ে চেয়ারের উপরে দাঁড়িয়ে উল্লাস করত আর হাততালি দিত, নার্সেরা নাচত আর রঙিন কাগজের ফিতে নাচিয়ে বেড়াত। কেউ একজন বাচ্চাদের প্রিয় গানটি বাজিয়ে শোনাত। খাদ্যের সবটুকু পেটের মধ্যে রাখতে পারলে সেই বাচ্চাটিকে নিয়ে বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো।

 

এভাবে বাচ্চারা বেশি বেশি সময় ধরে খাদ্যকে তাদের পেটে ধরে রাখতে সমর্থ হলো। এমন আনন্দ ও উৎসবের কারণ হতে পেরে তাদের স্নায়ুতন্ত্র নতুন করে পুনর্বিন্যস্ত হলো, সেই শিশুরা প্রশংসাকে এতটাই চেয়েছিল। আমরাও তা- ই চাই।

 

যে এই কথা বলেছে, ‘প্রশংসাবাক্যতে কোথাও পৌঁছানো যায় না’ সে একজন... কিন্তু আমি মনে করি তাকে আমাদের ক্ষমা করে দেওয়া উচিত। হে বন্ধু, প্রশংসাবাক্য আপনাকে সবখানে নিয়ে যাবে!

 

কীভাবে একজন ভিআইপি হতে হয়

আমাদের বিহারের প্রথম বছরে আমাকে শিখতে হয়েছিল কীভাবে কোনো কিছু নির্মাণ করতে হয়। প্রথম বড় নির্মাণ কাজ ছিল ছয়টা টয়লেট ও ছয়টা বাথরুম নিয়ে গঠিত গোসলখানার অংশটি। আমাকে পাইপ বসানোর কাজের সবকিছু শিখতে হয়েছিল। আমি বিহারের একটা ডিজাইন নিয়ে একটা দোকানে গেলাম, ডিজাইনটা কাউন্টারে বিছিয়ে বললাম, ‘সাহায্য চাই!’

 

আমার বিল্ডিংয়ে অনেক মাল লাগবে, তাই কাউন্টারের লোকটা, যার নাম ফ্রেড, সে কিছুটা অতিরিক্ত সময় দিতে কোনো কাপর্ণ্য করল না। সামান্য কিছু সময় নিয়ে সে বুঝিয়ে দিল কোন কোন পার্টস লাগবে, কেন সেগুলো লাগবে, কীভাবে সেগুলোকে একসাথে জোড়া দিতে হয়। অবশেষে প্রচুর ধৈর্য, কান্ডজ্ঞান ও ফ্রেডের উপদেশ নিয়ে বর্জ্য পানি নিষ্কাশনের পাইপ বসানোটা শেষ হলো।

 

স্থানীয় কাউন্সিলের স্বাস্থ্যপরিদর্শক আসল, তন্ন তন্ন করে পরীক্ষা করল পুরো পাইপিং সিস্টেমটা। এটি পাস হয়ে গেল। আমি তো খুশিতে ডগমগ।

কয়েক দিন পরে পাইপ ও তার সরঞ্জামগুলোর বিল এসে গেল। আমি বিহারের কোষাধ্যক্ষের কাছ থেকে একটি চেক চেয়ে নিয়ে একটি ধন্যবাদের চিঠি, বিশেষ করে আমাদের বিহারটি শুরু করতে ফ্রেডের সাহায্যের কথা উল্লেখ করে তাদের ঠিকানায় চেকসহ চিঠিটা পাঠিয়ে দিলাম।

 

আমি সেই সময় বুঝি নি যে, দোকানটা একটা বড় একটা পাইপের সরঞ্জাম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান, যার অনেকগুলো শাখা ছড়িয়ে আছে গোটা পার্থ শহর জুড়ে। তাদের আছে আলাদা একটা অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্ট। আমার চিঠিটা ওই ডিপার্টমেন্টের এক কেরানী খুলে পড়ে দেখল। সে এই প্রশংসাসূচক চিঠিটা পেয়ে এমন অবাক হলো যে তারা চিঠিটা তৎক্ষণাৎ অ্যাকাউন্টসের ম্যানেজারের কাছে নিয়ে গেল। সাধারণত অ্যাকাউন্টস সেকশন চেকের সাথে কোনো চিঠি পেলে তা হয় অভিযোগপত্র। অ্যাকাউন্টস ডিপার্টমেন্টের প্রধানও অবাক হয়ে গেল, আর চিঠিটা নিয়ে সোজা কোম্পানির এমডির কাছে গেল। এমডি চিঠিটা পড়ে এমন খুশি হলো যে সে তাদের অনেকগুলো শাখা থেকে খুঁজে খুঁজে যে শাখায় ফ্রেড কাজ করে, সেখানকার কাউন্টারে ফ্রেডকে ফোন করে দেওয়া চিঠিটা সম্পর্কে বলল, যা তখনো এমডির সামনে মেহগনি টেবিলে পড়ে ছিল।

 

‘ঠিক এমন জিনিসই আমরা আমাদের কোম্পানিতে খুঁজছিলাম, ফ্রেড।

ক্রেতাদের সাথে সুন্দর বোঝাপাড়া, সেটাই তো সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ!’ ‘জ্বি স্যার।’

 

‘তুমি খুব চমৎকার একটা কাজ করেছ, ফ্রেড।’ ‘জ্বি স্যার।’

 

‘তোমার মতো আরও অনেক কর্মচারী পেলে ভালো হতো।’ ‘জ্বি স্যার।’

 

‘তোমার বেতন কত এখন? আমরা মনে হয় সেটা আরেকটু ভালো করতে পারি?’

‘জ্বি স্যার।’

‘ভালো কাজ করেছ, ফ্রেড!’ ‘থ্যাঙ্ক ইউ, স্যার।’

 

তো, আমি ঘণ্টা দুয়েক পরে আবার সেই পাইপের সরঞ্জামের দোকানে গেলাম, কী যেন একটা পার্টস বদলাতে। আমার আগেই দুজন অস্ট্রেলিয়ান মিস্ত্রি

দাঁড়িয়েছিল, এক একজনের কাঁধ টয়লেটের টাংকির মতো বিশাল চওড়া। তারা আমার আগে এসে মালের জন্য অপেক্ষা করছিল। কিন্তু ফ্রেড আমাকে দেখল। সে বিশাল একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘ব্রাক্ষ এখানে এসো।’

 

আমাকে ভিআইপি অভ্যর্থনা দেওয়া হলো, নিয়ে যাওয়া হলো দোকানের পিছনের স্টোরে, যেখানে কোনো কাস্টমারের যাওয়ার কথা নয়। সেখান থেকে আমাকে প্রয়োজনমতো যেকোনো পার্টস পছন্দ করতে দেওয়া হলো। কাউন্টারে ফ্রেডের সহকারী আমাকে এমডির ফোনের ব্যাপারটা জানাল।

আমি যে পার্টসটা খুঁজছিলাম, তা পেয়ে গেলাম। তবে যেটা ফেরত দিচ্ছিলাম, তা থেকে এটা ঢের দামী ছিল। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কত দিতে হবে আমার? আগেরটার সাথে এটার দামের পার্থক্য কেমন?’

ফ্রেড একটা একান-ওকান চওড়া হাসি দিয়ে বলল, ‘ব্রাক্ষ তুমি হলে সেটা আমার জন্য কোনো পার্থক্য নয়।’

তাই প্রশংসার ভালো অর্থনৈতিক দিকও আছে।

 

দুই আঙুলের হাসি

প্রশংসা আমাদের টাকা বাঁচিয়ে দেয়, সম্পর্ককে সমৃদ্ধ করে এবং সুখের সৃষ্টি করে। তাই আমাদের প্রশংসার চর্চাকে আরও বেশি করে চারদিকে ছড়িয়ে

দেওয়া উচিত।

 

আমরা যাকে প্রশংসা করতে সবচেয়ে কাপর্ণ্য করি, সে হলো নিজেকে। আমি এই বিশ্বাসের মধ্যে দিয়ে বড় হয়েছিলাম যে, যারা নিজেদের প্রশংসা করে, তারা আসলেই মাথামোটা লোক। ব্যাপারটা সেরকম নয়। তারা বরং মহান হৃদয়ের অধিকারী হয়ে ওঠে। আমাদের ভালো গুণগুলোকে নিজেদের কাছে প্রশংসা করলে এই গুণগুলো আরও সুদৃঢ় হয়ে ওঠে।

 

যখন আমি একজন ছাত্র ছিলাম, আমার প্রথম ধ্যানের শিক্ষক আমাকে বাস্তব কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন। তিনি আমাকে প্রশ্ন করতে লাগলেন, আমি সকালে উঠে সবার আগে কী করি?

 

‘বাথরুমে যাই।’ আমি বললাম।

 

‘তোমাদের বাথরুমে কি আয়না আছে?’ তিনি জিজ্ঞেস করলেন। ‘অবশ্যই আছে।’

 

তিনি বললেন, ‘ভালো, আমি চাই, এখন থেকে প্রত্যেক সকালে দাঁত মাজার আগেই তুমি আয়নায় নিজেকে দেখবে এবং নিজের দিকে তাকিয়ে হাসবে।’

 

আমি প্রতিবাদ জানাতে শুরু করলাম, ‘স্যার, আমি একজন ছাত্র। মাঝে মাঝে অনেক দেরিতে ঘুমাই, আর সকালে উঠে শরীরটা ভালো বোধ করি না।

কোনো কোনো সকালে আয়নায় নিজেকে দেখতেই ভয় পাই, হাসা তো দূরের কথা!’

 

তিনি হাসলেন আর আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘যদি স্বাভাবিক হাসি হাসতে না পারো, তাহলে তোমার তর্জনী দুটো ঠোঁটের দুকোণায় রেখে উপরে

ঠেলে দেবে।’ বলে তিনি আমাকে সেটা করে দেখালেন।

 

তাকে হাস্যকর দেখাচ্ছিল। আমি হেসে উঠলাম। তিনি আমাকে সেটা চেষ্টা করতে বললেন। আমিও তা-ই করলাম।

পরের দিন সকালে আমি বিছানা থেকে নিজেকে টেনে তুললাম, আর টলতে টলতে বাথরুমে ঢুকলাম। সেখানে আয়নায় নিজেকে দেখে ‘উহ! ’ করে আর্তনাদ করে উঠলাম। নিজেকে এমন চেহারায় দেখা কোনো সুখকর দৃশ্য ছিল না। এমন অবস্থায় কোনো স্বাভাবিক হাসি আসে না। তাই আমি তর্জনী উঁচিয়ে দু ঠোঁটের কোণা ধরে উপরে ঠেলে দিলাম। আমি আয়নায় এই বোকা ছাত্রকে দেখলাম উদ্ভট চেহারা করে আছে। তা দেখে আমি আর হাসি চাপতে পারলাম না। স্বাভাবিক হাসি আসাতে এবার দেখলাম আয়নার ছাত্রটা আমাকে দেখে হাসছে। তাই আমি আরও বেশি হাসলাম। আয়নার মানুষটা আরও বেশি হাসল। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমরা পরস্পরকে দেখে হাসিতে ফেটে পড়লাম।

 

আমি দুবছর ধরে প্রত্যেক সকালে এই অভ্যাসটা করেছিলাম। প্রত্যেক সকালে ঘুম থেকে উঠে শরীর যেমন লাগে লাগুক, আমি তাড়াতাড়ি আয়নায় নিজেকে দেখে হাসতাম, সাধারণত দুটো আঙুলের সাহায্য নিয়ে। লোকজন বলে, আমি নাকি ইদানিং প্রচুর হাসি। সম্ভবত আমার মুখের চারপাশের মাংসপেশীগুলো অনেকটা সেই হাস্যকর অবস্থায় আটকে গেছে।

 

আমরা এই দুই আঙুলের কৌশলটা দিনের যেকোনো সময় কাজে লাগাতে পারি। এটা বিশেষ করে কার্যকরী হয় যখন আমরা অসুস্থ ত্যক্ত বিরক্ত অথবা হতাশ বোধ করি। হাসি আমাদের রক্তে অ্যানডোরফিনস্ নিঃসরণ করায় বলে প্রমাণিত হয়েছে, যা আমাদের রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করে এবং আমাদের সুখী হওয়ার অনুভূতি দেয়।

 

এটা আমাদের দেয়ালের ৯৯৮টি ভালো ইট দেখতে সাহায্য করে, কেবল ২টি খারাপ ইট নয়। আর হাসির কারণে আমাদের সুন্দর দেখায়। এজন্যই আমি পার্থে আমাদের বৌদ্ধ বিহারটাকে মাঝে মাঝে বলি, ‘আজান ব্রাহমের সৌন্দর্য সেলুন’।

 

অমূল্য শিক্ষা

আমাকে জানানো হয়েছিল যে হতাশা একটি শত কোটি ডলারের ব্যবসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ব্যাপারটা সত্যিই হতাশার! লোকজনের হতাশাকে পুঁজি করে বড়লোক হওয়াটা ন্যায়সঙ্গত বলে মনে হয় না আমার।

 

আমাদের কট্টরপন্থী ঐতিহ্য অনুযায়ী, ভিক্ষুরা টাকা নিজেদের কাছে রাখতে পারে না। আমরা আমাদের বক্তৃতার জন্য কখনোই কোনো সম্মানী দাবি করি না। পরামর্শ বা অন্য কোনো সহায়তা দিতে গিয়েও কোনো ফি নিই না।

 

একবার এক আমেরিকান মহিলা আমাদের এক সতীর্থ ভিক্ষুকে ফোন করল। ভিক্ষুটি ছিল বিখ্যাত ধ্যান প্রশিক্ষক। মহিলাটি তাকে জিজ্ঞেস করে জানতে চাইল কী করে ধ্যান করতে হয়।

 

‘আমি শুনেছি আপনি ধ্যান করা শেখান।’ সে টেনে টেনে বলে উঠল ফোনে।

 

‘জ্বি ম্যাডাম, শেখাই।’ ভিক্ষুটি নম্রভাবে জবাব দিল।

 

‘কত টাকা নেন আপনি?’ সে এবার আসল কথায় আসল। ‘কিছুই নিই না, ম্যাডাম।’

 

‘তার মানে আপনি ভালো নন।’ এই বলে মহিলাটি ফোন নামিয়ে রাখল। কয়েক বছর আগে আমিও এক পোলিশ-আমেরিকান ভদ্রমহিলার কাছ থেকে

এমন একটা ফোন পেয়েছিলাম।

 

‘আপনার বুড্ডিস্ট সেন্টারে কি আজকে সন্ধ্যায় কোনো দেশনার পালা আছে?’ মহিলা জানতে চাইল।

 

‘হ্যাঁ ম্যাডাম। এটি রাত ৮টায় শুরু হয়।’ আমি তাকে জানিয়ে দিলাম। ‘কত টাকা দিতে হবে আপনাকে?’ সে জিজ্ঞেস করল।

 

‘কিছুই দিতে হবে না, ম্যাডাম। এটি ফ্রী ’ আমি তাকে ব্যাখ্যা করে দিলাম। ওপাশে খানিকক্ষণ নিরবতা।

এর পরে সে জোরে জোরে বলল, ‘আপনি আমার কথা বোঝেন নি। সেই দেশনা শোনার জন্য আপনাকে আমার কত টাকা দিতে হবে?’

 

‘ম্যাডাম, আপনাকে কোনো টাকা দিতে হবে না। এটি ফ্রী ’ আমি তাকে শান্ত করার সুরে বললাম।

 

সে ফোনে চিৎকার করে বলল, ‘শুনুন! আমি ডলারের কথা বলছি, সেন্টের কথা বলছি। ভেতরে আসার জন্য ঠিক কী পরিমাণ ডলার দিতে হবে আমাকে?’

 

‘ম্যাডাম, আপনাকে কোনো কিছুই কেঁশে বের করতে হবে না। আপনি সোজা ভেতরে ঢুকে যাবেন। পেছনে বসবেন। যখন খুশি চলে যাবেন। কেউই আপনার নামধাম পর্যন্ত জিজ্ঞেস করবে না। কোনো লিফলেটও দেওয়া হবে না। দরজায় কোনো চাঁদাও চাওয়া হবে না। এটি সম্পূর্ণ ফ্রী এবার বেশ দীর্ঘক্ষণ বিরতি।

এরপর সে জিজ্ঞেস করল, আন্তরিকভাবেই জানতে চাইল, ‘তো, তাহলে আপনারা এসব করে কী পান?’

 

আমি উত্তর দিলাম, ‘সুখ, ম্যাডাম, সুখ!’

আজকাল যখন কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে, এই শিক্ষার মূল্য কত? আমি কখনোই বলি না এগুলো ফ্রী আমি বলি, এগুলো অমূল্য।

 

এটাও কেটে যাবে

এটি সেই অমূল্য শিক্ষাগুলোর একটি, যেটি হতাশা দূর করতে বেশ কাজের।

 

সেটি আবার অত্যন্ত সহজ শিক্ষাগুলোরও একটি। কিন্তু সহজ শিক্ষাগুলোই ভুল বুঝা হয় বেশি। যখন আমরা হতাশা থেকে মুক্ত, কেবল তখনই আমরা নিচের গল্পটা সত্যিকারভাবে বুঝেছি বলে দাবি করতে পারি।

 

নতুন এক কয়েদি খুব শংকিত ও হতাশাগ্রস্থ তার রুমের পাথরের দেয়াল শুষে নিয়েছে সব উষ্ণতাকে, কঠিন লোহার শিকগুলো যেন মৈত্রীভাবকে ব্যঙ্গ করছে। গেট বন্ধ হওয়ার সময় স্টীলের ঝনঝন শব্দ সব আশাকে ধরাছোঁয়ার বাইরে বন্দী করে রেখেছে। যতই দিন গেল, ততই তার মন হতাশায় ডুবতে লাগল। দেয়ালে, তার বিছানার মাথার দিকে, সে দেখল পাথরের উপরে আকিবুকি করে লেখা : ‘এটাও কেটে যাবে।’

 

এই কথাটা তাকে হতাশার সাগর থেকে টেনে তুলে আনল, যা নিশ্চিত সাহায্য করেছিল আগের বন্দীকেও। যতই কঠিন মনে হোক না কেন, সে এই

খোদাই করা লেখাটার দিকে তাকাত আর ভাবত, ‘এটাও কেটে যাবে।’

 

যখন সে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে পুনর্জীবন লাভ করল, সে কথাটা একটা কাগজে লিখে নিয়ে বিছানার পাশে, তার গাড়িতে এবং কাজের সময় পাশে রেখে দিত। খুব খারাপ সময়েও সে আর কখনোই হতাশ হয় নি। সে শুধু স্মরণ করত, ‘এটাও কেটে যাবে।’ আর কাজে মন দিত। সেই খারাপ সময়গুলো খুব একটা দীর্ঘস্থায়ী বলে মনে হয় নি। যখন ভালো সময় এসেছে, সেগুলোকে সে উপভোগ করেছে, তবে অতটা বেখেয়ালি হয়ে নয়। সেখানেও সে স্মরণ করত, ‘এটাও কেটে যাবে।’ আর কাজে মন দিত। জীবনে সে কোনো কিছুকে চিরস্থায়ী বলে ধরে নেয় নি। ভালো সময়গুলো সব সময়ই অস্বাভাবিক দীর্ঘ সময় ধরে থাকত বলে তার মনে হতো।

 

এমনকি যখন তার ক্যান্সার হয়, ‘এটাও কেটে যাবে’ কথাটা তাকে আশা যুগিয়েছিল। আশা তাকে শক্তি ও ইতিবাচক মনোভাব যুগিয়েছিল, যা রোগটাকে হার মানিয়েছিল। একদিন বিশেষজ্ঞ নিশ্চিত করে জানাল যে, ‘তার ক্যান্সারটাও কেটে গেছে।’

 

তার জীবনের দিনগুলোর শেষে, বিছানায় শুয়ে শুয়ে সে তার প্রিয়জনদের ফিসফিস করে শুনিয়েছিল, ‘এটাও কেটে যাবে।’ আর সহজভাবে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছিল। তার কথাগুলো ছিল তার পরিবার ও বন্ধুদের প্রতি সর্বশেষ ভালোবাসার উপহার।

 

তারা জেনেছিল যে, ‘শোকও একসময় কেটে যাবে।’ হতাশা এমন একটি কারাগার, যা থেকে আমাদের অনেকেই কাটিয়ে উঠেছে।

 

‘এটাও কেটে যাবে’ কথাটা আমাদের উঠে বসতে সহায়তা করে। হতাশার অন্যতম বড় একটা কারণ হচ্ছে, সুখের সময়গুলো চিরদিন থাকবে বলে ধরে

নেওয়া। কিন্তু এই কথাটা এমন ধারণাকে পরিহার করতে সাহায্য করে।

 

বীরত্বপূর্ণ আত্মোৎসর্গ

যখন আমি একজন স্কুলশিক্ষক ছিলাম, তখন ক্লাসের একজন ছাত্রের প্রতি আমার মনোযোগ গেল। বার্ষিক পরীক্ষায় তার রোল নম্বর হয়েছিল ত্রিশ জনের মধ্যে ত্রিশতম। আমি দেখতে পাচ্ছিলাম তার ফলাফলের কারণে সে বেশ হতাশ। তাই আমি তাকে একপাশে ডেকে নিয়ে গেলাম। আমি তাকে বললাম, ‘ত্রিশ জনের একটা ক্লাসে কাউকে না কাউকে রোল নম্বর ত্রিশ হতেই হয়। এই বছর ঘটনাক্রমে সেটা তুমি হয়েছ। এটাকে বলা যায় বীরত্বপূর্ণ আত্মোৎসর্গ। তোমার এই আত্মোৎসর্গের ফলে তোমার বন্ধুদের ক্লাসের সবচেয়ে নিচে থাকার লজ্জা পেতে হচ্ছে না। তুমি আসলেই খুব দয়ালু, অন্যদের প্রতি তোমার দারুণ সহানুভূতি। তোমাকে একটা পদক দেওয়া দরকার।’

 

আমরা উভয়েই জানতাম, আমার কথাগুলো রীতিমতো উদ্ভট। কিন্তু সে হাসল। সে আর এটাকে পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার মতো মারাত্মক ঘটনা বলে মনে করল না। পরের বছর সে অনেক ভালো ফল করল। তার বদলে অন্য আরেকজনের বীরত্বপূর্ণ আত্মোৎসর্গের পালা আসল।

 

এক ট্রাক গোবর

আমরা চাই না এমন অনেক খারাপ জিনিস, যেমনটা হচ্ছে ক্লাসে সবচেয়ে নিচে থাকা, এমন ঘটনা জীবনে ঘটে। প্রত্যেকের জীবনেই ঘটে। সুখী মানুষ ও হতাশ মানুষের মধ্যে এখানে পার্থক্যটা কেবল হচ্ছে তারা এমন দুর্যোগে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখায়।

 

কল্পনা করুন আপনি সাগর সৈকতে এক বন্ধুর সাথে বিকেলটা চমৎকার কাটিয়েছেন। যখন ঘরে ফিরলেন, দেখলেন বিরাট এক ট্রাকে করে এক ট্রাক

গোবর ঢেলে দেওয়া হয়েছে ঠিক আপনার ঘরের দরজার সামনে। এখানে তিনটি বিষয় জানেন আপনি :

 

প্রথমত, আপনি কোনো গোবরের অর্ডার দেন নি। এটা আপনার দোষ নয়।

 

দ্বিতীয়ত, আপনি এটা নিয়ে ঝামেলায় পড়ে গেছেন। কেউই দেখে নি কে এটা ওখানে ঢেলে দিয়ে গেছে। তাই কাউকে ডেকেও এটাকে সরিয়ে নিতে

বলতে পারছেন না।

 

তৃতীয়ত, এমন নোংরা ও দুর্গন্ধযুক্ত সেই গোবর, যার জন্য ঘরে টেকা দায় হয়ে পড়েছে।

 

এই রূপক গল্পে ঘরের সামনের সেই গোবরের স্তুপ হচ্ছে জীবনে আমাদের উপর ঘটে যাওয়া দুঃখজনক ঘটনাগুলো। সেই গোবরের স্ত্তপের মতোই,

 

আমাদের জীবনের দুঃখজনক ঘটনাগুলোতেও তিনটি জিনিস জানা আছে :

 

আমরা এগুলো অর্ডার দিয়ে ডেকে আনি নি। আমরা বলি, ‘আমাকে কেন এত দুঃখ পোহাতে হচ্ছে?’

 

আমরা ঝামেলায় পড়ে গেছি। কেউ না, এমনকি আমাদের সেরা বন্ধুরাও এই ঝামেলাকে দূর করে দিতে পারবে না (যদিও তারা তা চেষ্টা করতে পারে)।

 

এটা এমন জঘন্য ও আমাদের সুখকে এমনভাবে ধ্বংস করে যে, আমাদের সারা জীবনটাকে দুঃখে ভরিয়ে দেয়। এটা সহ্য করাও দায় হয়ে পড়েছে।

 

এমন এক ট্রাক গোবরের ব্যাপারে আমাদের দুটো পথ খোলা আছে। প্রথম পথ হচ্ছে, গোবরটা সাথে করে ঘুরে বেড়ানো। পকেটে কিছু, ব্যাগে কিছু, জামায় কিছু, এমনকি প্যান্টেও কিছু গোবর লাগিয়ে আমরা ঘুরে বেড়াই। আমরা দেখি যে, যখনই আমরা গোবর সাথে নিয়ে ঘুরি, তখন আমরা অনেক বন্ধু হারাই! এমনকি সেরা বন্ধুরাও তখন আশেপাশে কম আনাগোনা করে।

 

গোবর বয়ে নিয়ে বেড়ানো হচ্ছে হতাশা, নাবোধক চিন্তাভাবনা ও ক্রোধে ডুবে যাওয়ার মতো। এটা হচ্ছে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে আমাদের স্বাভাবিক ও

বোধগম্য প্রতিক্রিয়া। কিন্তু আমরা অনেক বন্ধু হারাই। কারণ, এটাও স্বাভাবিক এবং বোধগম্য যে, যখন আমরা হতাশার মধ্যে থাকি, তখন আমাদের বন্ধুরা আমাদের আশেপাশে থাকতে পছন্দ করে না। তা ছাড়া, গোবরের স্তুপ তো কমেই না; বরং যতই দিন যায়, ততই এর দুর্গন্ধ আরও তীব্র হয়।

 

সৌভাগ্যবশত, দ্বিতীয় আরেকটা পথ আছে। যখন এমন ট্রাকভর্তি গোবর আমাদের ঘরের সামনে ফেলে রাখা হয়, তখন কী আর করা! আমরা একটা

দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঠেলাগাড়ি, বেলচা ও কোদাল বের করে কাজে নেমে পড়ি।

 

বেলচা দিয়ে গোবরগুলো ঠেলাগাড়িতে তুলে নিয়ে ঘরের পেছনে যে বাগান আছে, সেখানে পুঁতে ফেলি। ক্লান্তিকর ও পরিশ্রমের একটা কাজ। কিন্তু আমরা জানি, আর কোনো বিকল্প নেই আমাদের। মাঝে মাঝে এমনও হয়, দিনে কোনোমতে অর্ধেক ঠেলাগাড়ি পরিমাণ গোবর সরাতে পারি। আমরা তখন কিন্তু হতাশা নিয়ে অভিযোগ করছি না; বরং সমস্যাটার সমাধানের ব্যাপারে কিছু একটা করছি। দিনের পর দিন আমরা গোবরের স্ত্তপে কোদাল চালিয়ে যাই। দিনের পর দিন গোবরের স্তুপ ছোট থেকে ছোট হতে থাকে। মাঝে মাঝে হয়তো কয়েক বছরও লেগে যায়। কিন্তু কোনো এক সকাল আসে যখন আমরা দেখি যে বাড়ির সামনের গোবরের স্তুপ আর নেই। আর বাড়ির অন্যপাশে তখন যেন জাদুর ছোঁয়া লেগেছে। আমাদের বাগানের ফুলগুলো ঝলমলে রং নিয়ে ফুটেছে সারা এলাকা জুড়ে। তাদের সুগন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে রাস্তায়ও। যাতে প্রতিবেশীরা তো বটেই, রাস্তার পথচারীরাও আনন্দে হেসে উঠছে। বাড়ির কোণাটায় ফলের গাছটা তো ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা, এত ফল ধরেছে সেখানে। আর ফলগুলো এত মিষ্টি। এমনটি আপনি কোথাও কিনতে পাবেন না। এত বেশি ফল ধরেছে যে আমরা সেখান থেকে প্রতিবেশীদেরও দিতে পারি। এমনকি পথচারীরাও এই জাদুর ফলের অপূর্ব স্বাদ নিতে পারে!

‘গোবরের স্ত্তপে কোদাল চালানো’ হচ্ছে দুঃখজনক ও হৃদয়বিদারক ঘটনাগুলোকে জীবনের জন্য সার হিসেবে স্বাগত জানানোর রূপকীয় কথা। এই কাজটা আমাদের একাই করতে হয়। আমাদের সাহায্য করার মতো কেউ নেই এখানে। কিন্তু আমাদের হৃদয়ের বাগানে দিনের পর দিন এটাকে একটু একটু করে পুঁতে ফেলার ফলে দুঃখের বোঝা কমতে থাকে। এতে হয়তো কয়েক বছরও লেগে যায়। কিন্তু কোনো এক সকাল আসে যখন আমরা আমাদের জীবনে আর কোনো দুঃখ দেখি না। আর আমাদের হৃদয় যেন জাদুর ছোঁয়া পায়। তার পুরোটা জুড়ে দয়ার ফুল ফুটে থাকে। নিঃস্বার্থ ভালোবাসার সৌরভ তখন ছড়িয়ে পড়ে রাস্তাতে, প্রতিবেশীদের কাছে। ঘরের কোণায় সেই জ্ঞানের বৃক্ষ নুয়ে পড়ে আমাদের দিকে। জীবনের স্বাভাবিক ঘটনাপ্রবাহে মিশে থাকা মিষ্টি প্রজ্ঞার ফল দিয়ে এটি ভরা থাকে। আমরা সেই সুস্বাদু ফলগুলো মুক্ত হস্তে বিলিয়ে যাই, এমনকি পথচারীদেরও এর ভাগ দিই নির্বিচারে।

যখন আমরা এমন হৃদয়ভাঙা ব্যথাকে জানি, এর থেকে শিক্ষা নিয়ে আমরা আমাদের বাগানকে গড়ে তুলি। তখন আমরা আরও গভীর ব্যথাকে দু হাত বাড়িয়ে আলিঙ্গন করতে পারি, আর নরম সুরে বলতে পারি, ‘আমি জানি।’ তারা উপলব্ধি করে যে আমরা সত্যিই বুঝি। মৈত্রী জেগে ওঠে। আমরা তাদের

ঠেলাগাড়ি, বেলচা ও কোদাল দেখাই, অপরিসীম উৎসাহ দেখাই। আমাদের বাগানকে যদি আমরা এখনো গড়ে না তুলি, তাহলে এমনটি ঘটতে পারবে না।

আমি অনেক ভিক্ষুকে চিনি যারা ধ্যানে অত্যন্ত দক্ষ। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তারা থাকে শান্ত, সংযত এবং অটল। কিন্তু তাদের মধ্যে কেবল কয়েকজনই মহান আচার্য হয়েছে। আমি প্রায়ই অবাক হতাম, কেন এমন হয়!

 

এখন আমার কাছে মনে হয় যে, যেসব ভিক্ষুরা তুলনামূলকভাবে সহজ জীবন কাটিয়েছে, যাদের খোঁড়ার মতো গোবর অল্পই ছিল, তারাই সেসব ভিক্ষু যারা আচার্য হয় নি। যেসব ভিক্ষু অনেক কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছে, কিন্তু নিরবে খুঁড়ে গেছে, তারা সমৃদ্ধশালী এক বাগান গড়েছে, যাতে করে তারা মহান আচার্য হয়ে উঠেছে। তাদের সবারই প্রজ্ঞা, প্রশান্তি ও মৈত্রী ছিল। কিন্তু যাদের গোবর বেশি ছিল, তাদের এই জগতে ভাগাভাগি করার জিনিসও বেশি

ছিল। আমার শিক্ষক আজান চাহ্ যিনি আমার কাছে সবার সেরা আচার্য - তাঁর জীবনের প্রথম দিকে নিশ্চিতই ট্রাক কোম্পানির সমস্ত ট্রাকগুলো লাইন ধরে তাঁর ঘরের দরজায় গোবর ঢেলে দিয়ে এসেছিল।

 

সম্ভবত এই গল্পের উপদেশ হচ্ছে, যদি আপনি এই জগতের কোনো কাজে নিজেকে লাগাতে চান, যদি মৈত্রীর পথ অনুসরণ করতে চান, তাহলে পরের বার আপনার জীবনে কোনো হৃদয়ভাঙা ঘটনা ঘটলে আপনি বলতে পারেন : ‘বাহ! আমার বাগানের জন্য আরও সার!’

 

বেশি আশা করাটা বাড়াবাড়ি

ব্যথাবিহীন জীবন আশা করাটা বাড়াবাড়ি, ব্যথাবিহীন জীবন আশা করাটা ভুল। কারণ, ব্যথা হচ্ছে আমাদের শরীরের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। আমরা যতই ব্যথাকে অপছন্দ করি না কেন, এবং কেউই কিন্তু ব্যথাকে পছন্দ করে না, তবুও ব্যথা খুব গুরুত্বপূর্ণ আর ব্যথার জন্য আমাদের কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত! তা না-হলে কীভাবে জানতাম, আমাদের হাতটা আগুনের কাছ থেকে সরাতে হবে? আঙুলটা সরাতে হবে ব্লেডের কাছ থেকে?

 

তাই ব্যথা খুব গুরুত্বপূর্ণ

আর ব্যথার জন্য আমাদের কৃতজ্ঞ হওয়া উচিত!

তবে একধরনের ব্যথা আছে যা কোনো কাজে লাগে না। তা হচ্ছে দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা।

এটা সেই সম্ভ্রান্ত শেণ্রীর ব্যথা, যা দেহের প্রতিরক্ষার জন্য নয়। এটা একটা আক্রমণকারী শক্তি।

এটা একটা অভ্যন্তরীণ আক্রমণকারী, ব্যক্তিগত সুখের ধ্বংসকারী, ব্যক্তিগত সামর্থ্যের উপর আক্রমণাত্মক হামলাকারী, ব্যক্তিগত সুখের মাঝে এক বিরামহীন অনুপ্রবেশকারী, আর জীবনের জন্য এক অবিরাম উৎপীড়ন!

দীর্ঘস্থায়ী ব্যথা হচ্ছে মনের লাফ দেওয়ার জন্য সবচেয়ে কঠিন বাধা। মাঝে মাঝে লাফ দেওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

তবুও আমাদের অবশ্যই চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। আরও চেষ্টা করতে হবে।

আরও চেষ্টা করতে হবে।

কারণ, তা না করলে এটি ধ্বংস করে ফেলবে আমাদের। আর এই যুদ্ধ থেকে আসবে কিছু ভালো দিক।

ব্যথাকে জয় করার সন্তুষ্টি। সুখ ও শান্তিকে লাভ, জীবনে এটার বিনিময়ে।

এটা একটা বলার মতন অর্জন,

এমন একটা অর্জন, যা খুবই বিশেষ কিছু, খুব ব্যক্তিগত, একটা সতেজ অনুভূতি, ভেতরের একটা শক্তি,

যাকে বুঝতে হলে এমন অভিজ্ঞতা লাভ করতে হবে। তাই ব্যথাকে গ্রহণ করতে হবে সাদরে,

মাঝে মাঝে এমনকি ধ্বংসাত্মক ব্যথাকেও। কারণ, এটা হচ্ছে প্রকৃতির একটা অংশ; আর মন এটার যথাযথ ব্যবস্থা নিতে পারে,

বার বার এরূপ চর্চার মধ্য দিয়ে মন আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে।

-জোনাথন উইলসন ফুলার

 

রচয়িতার সদয় অনুমতি নিয়ে এই কবিতাটি এখানে যোগ করার কারণ হলো, কবিতাটা লেখার সময় জোনাথনের বয়স ছিল মাত্র নয় বছর!

 

ডাস্টবিন হওয়া

আমার কাজের একটা অংশ হলো লোকজনের সমস্যাগুলো শোনা। ভিক্ষুরা সব সময়ই টাকা বাঁচানোর একটা ভালো উপায়। কারণ, তারা বিনিময়ে কোনো কিছুই দাবি করে না। প্রায়ই এমন হয়, যখন আমি জটিলতাগুলোর কথা শুনি, যেগুলো আঠালো আবর্জনার মতো, যাতে কিছু কিছু লোক আটকে যায়, তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাতে গিয়ে আমিও বিষণ্ণ হয়ে পড়ি। কোনো ব্যক্তিকে খাদ থেকে বের করে আনার জন্য আমাকেও মাঝেমধ্যে খাদের মধ্যে ঢুকে পড়তে হয় তাদের বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা ধরার জন্য। কিন্তু আমি সব সময় সাথে করে একটা মই নিয়ে আসি। আলোচনাটার পরে আমি আবার আগের মতো সতেজ হয়ে যাই সব সময়। আমার পরামর্শের কাজ আমার ভেতরে কোনো প্রতিধ্বনি তোলে না, কারণ আমি সেভাবেই প্রশিক্ষেত হয়েছি।

আজান চাহ যিনি থাইল্যান্ডে আমার শিক্ষক ছিলেন, তিনি বলতেন যে ভিক্ষুদের অবশ্যই ডাস্টবিন হতে হবে। ভিক্ষুরা, বিশেষ করে সিনিয়র ভিক্ষুদের বিহারে বসে বসে লোকজনের সমস্যার কথা শুনতে হয়, আর তাদের সব আবর্জনাগুলো গ্রহণ করতে হয়। বিবাহিত জীবনের সমস্যা, পারস্পরিক সম্পর্ক

নিয়ে সমস্যা, উঠতি বয়সের সন্তানদের নিয়ে ঝামেলা, আর্থিক সমস্যা – সব ধরনের সমস্যাই আমাদের শুনতে হয়। আমি জানি না কেন। একজন ব্রহ্ম

ভিক্ষু বিবাহিত জীবনের সমস্যার ব্যাপারে কী জানে? আমরা সংসার ত্যাগ করেছি তো এসব ঝঞ্ঝাট থেকে দূরে থাকার জন্য। কিন্তু দয়া ও মৈত্রী নিয়ে আমরা বসে থাকি, আর তাদের সমস্যার কথা শুনে যাই। আমাদের শান্তির ভাগ দিই তাদের, আর বিনিময়ে আবর্জনাগুলো গ্রহণ করি।

 

আজান চাহ্ একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ উপদেশ দিতেন। তিনি আমাদের একটা ডাস্টবিনের মতো হতে বলতেন যার নিচে একটা ছিদ্র আছে। আমাদের সব আবর্জনা গ্রহণ করতে হবে, কিন্তু রাখা যাবে না একটাও। তাই একজন যথার্থ বন্ধু অথবা পরামর্শদাতা হচ্ছে একটা তলাবিহীন ডাস্টবিনের মতো, যে অন্যদের সমস্যার কথা শুনে শুনে কখনোই পূর্ণ হয় না।

 

হয়তো এটাই ন্যায়সঙ্গত

হতাশায় পড়ে আমরা প্রায়ই ভাবি : ‘এটা তো ন্যায্য হচ্ছে না! আমাকে কেন?’ জীবনটা যদি আরেকটু ন্যায্য হতো, তাহলে হয়তো ব্যাপারগুলো আরেকটু সহজ হতো।

 

জেলখানায় ধ্যানের ক্লাসে এক মধ্যবয়স্ক কয়েদি আমার সাথে ধ্যানের পরে দেখা করতে চাইল। সে কয়েক মাস ধরে ধ্যান চর্চা করছিল, আর তার সাথে

বেশ ভালো পরিচয় হয়ে গিয়েছিল আমার।

সে বলল, ‘ব্রাক্ষ্ম আমি তোমাকে বলতে চেয়েছিলাম, যে অপরাধের জন্য আমি এই জেলখানায় বন্দী, তা কিন্তু আমি করি নি। আমি জানি, অনেক আসামীই এই কথা বলবে, আর তারা খুব সম্ভবত মিথ্যাই বলবে। কিন্তু আমি তোমাকে সত্যি কথাটাই বলছি। আমি তোমাকে মিথ্যা বলব না, ব্রক্ষ্ম অন্তত তোমাকে নয়।’

 

আমি তার কথা বিশ্বাস করেছিলাম। তখনকার অবস্থা ও তার আচরণ আমাকে বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছিল যে, সে সত্যি বলছে। আমি ভাবতে শুরু করলাম ব্যাপারটা কেমন অন্যায়, আর কীভাবে তার এই ভয়ানক অবিচারকে সারিয়ে তোলা যায়। কিন্তু সে আমার চিন্তাতে বাধা দিল।

মুখে এক দুষ্টামির হাসি নিয়ে সে বলল, ‘কিন্তু ব্রক্ষ্ম এমন অনেক অপরাধ আমি করেছি, যেগুলোতে আমি ধরা পড়ি নি। তাই আমার মনে হয়, এটা আমার ন্যায্য পাওনা।’

 

আমি দ্বিগুণ জোরে হেসে উঠলাম। এই ধূর্ত বুড়ো কর্মের নিয়মটা ভালোই বুঝেছে। এমনকি আমার চেনাজানা অনেক ভিক্ষুর চেয়েও ভালো বুঝেছে।

কতবার আমরা এমন ‘অপরাধ’ করি, ঘৃণ্য কোনো কাজ করে বসি; অথচ তার জন্য আমাদের দুঃখ পেতে হয় না? আমরা কি তখন বলি, ‘এটা তো ন্যায্য পাওনা হচ্ছে না! কেন আমি ধরা পড়লাম না?’ আর যখন আমরা দুঃখকষ্ট পাই, আপাতদৃষ্টিতে কোনো কারণ ছাড়াই তখন আমরা কাতর হয়ে বলি, ‘এ তো ন্যায্য নয়! আমাকে কেন?’

বোধ হয় এটাই ন্যায্য। আমার গল্পের সেই কয়েদির মতো, জীবনে আমরা সম্ভবত আরও অনেক অপরাধ করেছি, যেগুলোতে ধরা পড়ি নি। এ কারণেই জীবনটা মনে হয় অবশেষে এই ন্যায্য পাওনাটা দিচ্ছে।