একাদশ অধ্যায়

দুঃখ আর যেতে দেওয়া

কাপড় ধোয়ার চিন্তা

আজকাল লোকজন বেশি ভাবে। যদি তারা তাদের চিন্তাগুলো একটু কমাত, তাহলে আরেকটু সহজ হতো তাদের জীবন।

 

থাইল্যান্ডে আমাদের বৌদ্ধ বিহারে প্রত্যেক সপ্তাহে এক রাত ভিক্ষুরা মূল দেশনালয়ে সারা রাত ধরে ধ্যানে বসে থাকে, ঘুমায় না। এটি আমাদের বনভিক্ষুদের একটা ঐতিহ্য। এটি অতটা কঠিন ছিল না। কারণ, আমরা সব সময় পর দিন সকালে একটা ঘুম দিতে পারতাম।

 

এক সকালে সারা রাত ধরে ধ্যানের পরে যখন আমাদের নিজ নিজ কুটিরে ফিরে গিয়ে একটু ঘুমাবার সময় হয়ে এসেছে, এ সময় অধ্যক্ষ একজন নতুন অস্ট্রেলিয়ান ভিক্ষুকে ডাকলেন। অধ্যক্ষ তাকে একগাদা চীবর দিয়ে সেগুলো তখনি ধুয়ে দিতে বললেন। তরুণ ভিক্ষুটির মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বিশাল এক কাপড়ের স্তুপ কাচতে হবে। আর সেটা হতে হবে বনভিক্ষুদের চিরাচরিত প্রথানুযায়ী। কুয়ো থেকে পানি তুলতে হবে। বিশাল একটি আগুন জ্বেলে সেখানে পানি গরম করতে হবে। দা দিয়ে কাঠাল গাছের কাঠ কুচি কুচি করে কাটতে হবে। কাঠের কুচিগুলো ফুটন্ত পানিতে ছেড়ে দিতে হবে। এ থেকে যে রস বের হবে তা ডিটারজেন্ট বা পরিষ্কারক হিসেবে কাজ করবে। এরপর চীবরগুলো একটা একটা করে তক্তার উপরে হাত দিয়ে কচলাতে ও আছড়াতে হবে, আর সেই ফুটন্ত গরম পানি দিয়ে পরিষ্কার করে ধুয়ে নিতে হবে। এরপর চীবরগুলো রোদে শুকাতে দিতে হবে। সময়ে সময়ে সেগুলোকে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দিতে হবে, যাতে রং চটে না যায়। একটা চীবর ধোয়াও দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ এবং কষ্টকর একটা ব্যাপার ছিল। আর এতগুলো চীবর ধুয়ে নিতে নির্ঘাত আরও অনেক ঘণ্টার কাজ। বেচারা তরুণ ভিক্ষুটি সারা রাত না ঘুমিয়ে কাটিয়েছে। এমনিতেই ক্লান্তি চেপে ধরেছে তাকে। তার জন্য আমার করুণা হলো। আমি ধোয়ার স্থানে তাকে একটু সাহায্য করতে গেলাম। গিয়ে শুনতে পেলাম, সে বৌদ্ধরীতি ভুলে গিয়ে তার জন্মগত ভাষায় শাপ শাপান্ত করছে। সে রাগে গজরাচ্ছিল এই বলে বলে যে, ‘ব্যাপারটা খুব অন্যায় ও নিষ্ঠুর হয়ে গেছে। অধ্যক্ষ কি আগামীকালের জন্যও অপেক্ষা করতে পারতেন না? তিনি কি বোঝেন নি যে আমি সারা রাত ঘুমাই নি? আমি তো এটা করার জন্য ভিক্ষু হইনি।’ সে ঠিক এমন বলছিল না, তবে এগুলোই হচ্ছে সবচেয়ে ছাপার যোগ্য কথা। সেই সময়ে আমি ভিক্ষু হিসেবে কয়েক বছর হয়ে গিয়েছিলাম। আমি বুঝেছিলাম তার কেমন লাগছে, আর এটাও জানতাম কীভাবে সেই সমস্যা

থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। আমি তাকে বললাম, ‘কাজটা করা যত সহজ, সেটা নিয়ে চিন্তা করলে তা করাটা আরও কঠিন হয়ে পড়বে।’

সে চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। কয়েক মুহূর্ত নিরবে থেকে সে তার কাজে মন দিল। আমিও ঘুমাতে গেলাম। সেদিন সে আমাকে ধন্যবাদ জানাতে এলো, কাপড় কাচার কাজে সাহায্য করেছি বলে। সে আবিষ্কার করেছিল যে এটা খুব সত্যি, কাপড় কাচতে হবে - এই চিন্তাটাই সবচেয়ে কঠিন ছিল। যখন সে অভিযোগ অনুযোগ করা থামিয়ে কাপড় ধোয়ার কাজে মন দিল, আর কোনো সমস্যা থাকল না।

 

জীবনে যেকোনো কিছুর সবচেয়ে কঠিন অংশটি হচ্ছে এটা নিয়ে চিন্তা করা।

 

একটা হৃদয় নাড়া দেয়া অভিজ্ঞতা

আমি এই অমূল্য শিক্ষাটা - ‘জীবনের যেকোনো কিছুর সবচেয়ে কঠিন অংশটা হচ্ছে তা নিয়ে চিন্তা করা’- এটা পেয়েছিলাম ভিক্ষুজীবনের প্রথম দিকের বছরগুলোতে, যখন আমি ছিলাম উত্তরপূর্ব থাইল্যান্ডে। আজান চাহ্ তার বৌদ্ধ বিহারের নতুন অনুষ্ঠান হল নির্মাণ করছিলেন। অনেক ভিক্ষু সেই কাজে সাহায্য করছিল। আজান চাহ্ আমাদের পরীক্ষা করার জন্য মন্তব্য করতেন, ‘ভিক্ষুরা একটা বা দুটো পেপসি খেয়েই সারা দিন কঠোর পরিশ্রম করতে পারে, যা শহর থেকে শ্রমিক আনার চেয়ে অনেক সাশ্রয়ী।’ প্রায়ই আমি ভাবতাম, জুনিয়র ভিক্ষুরা মিলে একটা শ্রমিক সংগঠন শুরু করলে কেমন হয়। অনুষ্ঠান হলটা নির্মিত হচ্ছিল ভিক্ষুদের বানানো টিলার উপরে। টিলার অনেক মাটি এদিক সেদিক স্তুপাকারে ছিল। তাই আজান চাহ্ ভিক্ষুদের ডেকে বললেন, এই মাটিগুলোকে সরিয়ে পিছনে নিয়ে যেতে হবে। এর পরের তিন দিন ধরে সকাল দশটা থেকে সন্ধ্যায় আধার না হওয়া পর্যন্ত আমরা একটানা কাজ করে গেলাম। আমরা বেলচা দিয়ে মাটি কেটে ঠেলাগাড়িতে করে সেই বিরাট মাটির স্তুপ কে সরিয়ে নিলাম আজান চাহ্ যেখানে দেখিয়ে দিয়েছিলেন ঠিক সেখানে। কাজটা শেষ হতে দেখে আমি যারপরনাই খুশি। পরের দিন আজান চাহ্ কয়েক দিনের জন্য অন্য একটা বিহারে গেলেন। তার চলে যাওয়ার পরে উপাধ্যক্ষ ভিক্ষুদের ডাকলেন আর বললেন, মাটিটা ভুল জায়গায় ফেলা হয়েছে। ওটা সরাতে হবে। আমি বিরক্ত হলাম। তবে নালিশ করতে থাকা মনকে কোনোমতে শান্ত করে আরও তিন দিন সেই কাঠফাটা গরমে কঠোর পরিশ্রম করলাম।

 

দ্বিতীয়বার সেই মাটির স্তুপ সরানো শেষ করেছি মাত্র, আজান চাহ্ ফিরলেন। তিনি আমাদের ভিক্ষুদের ডেকে বললেন, ‘কেন তোমরা মাটিটা সরালে সেখানে? আমি বলেছিলাম সেটা আগের জায়গাটাতে সরাতে হবে। ওখানে সরাও এটাকে।’

 

আমি রেগে নীল হয়ে গেলাম। ‘এই সিনিয়র ভিক্ষুরা কেন আগে ভাগেই নিজেরা মিলে সিদ্ধান্ত নিতে পারে না? বৌদ্ধধর্ম একটা সুশৃঙ্খল ধর্ম হওয়ার কথা। কিন্তু এই বিহারটা এতই বিশৃঙ্খল যে এই সামান্য মাটিটা কোথায় রাখতে হবে, তাও ঠিক করতে পারে না। আমার উপরে এমন অন্যায় করা তাদের উচিত নয়।’ আরও তিনটি দীর্ঘ ক্লান্তিকর দিন পড়ে আছে আমার সামনে। আমি মাটি বোঝাই ঠেলাগাড়ি ঠেলছিলাম আর রাগে গজগজ করছিলাম ইংরেজিতে, যাতে থাই ভিক্ষুরা বুঝতে না পারে। এটা পুরোপুরি অযৌক্তিক একটা কাজ। এর শেষ হবে কখন?

 

আমি খেয়াল করতে শুরু করলাম, যত রাগছি, ততই ঠেলাগাড়িটা ভারী বোধ হচ্ছে। এক সতীর্থ ভিক্ষু আমাকে রাগে গজ গজ করতে দেখে কাছে এসে বলল, ‘তোমার সমস্যা হচ্ছে তুমি বেশি ভাব।’ সে ছিল অত্যন্ত সঠিক। যখন আমি অভিযোগ অনুযোগ বন্ধ করলাম, ঠেলাগাড়িটা ঠেলতে বেশ হালকা বোধ হলো। আমি আমার শিক্ষা পেয়ে গেলাম। মাটি সরানোর চিন্তাটা ছিল সবচেয়ে কঠিন অংশ। মাটি সরানোটা ছিল সহজ।

 

এখন আমি সন্দেহ করি, আজান চাহ্ ও তার উপাধ্যক্ষ প্রথম থেকেই পরিকল্পনা করে এটি করেছিলেন।

 

বেচারা আমি আর সৌভাগ্যবান তারা

থাইল্যান্ডে জুনিয়র ভিক্ষু হিসেবে আমি যেন খুব বৈষম্যের শিকার! সিনিয়র ভিক্ষুরা সবচেয়ে ভালো খাবার খান, বসেন সবচেয়ে নরম গদিতে, আর তাদের

ঠেলাগাড়িও ঠেলতে হয় না। সেখানে আমার একবেলা খাবার ছিল জঘন্য ধরনের। অনুষ্ঠানগুলোতে আমাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকতে হতো শক্ত কংক্রিটের মেঝেতে (মেঝেটা ছিল উঁচু নিচু, কারণ গ্রামবাসীরা কংক্রিট ঢালাই দিতে জানত না)। আর মাঝে মাঝে আমাকে খুব কঠোর পরিশ্রমের কাজ করতে হতো। আমি কত দুর্ভাগা! আর ওরা, সিনিয়র ভিক্ষুরা কত ভাগ্যবান!

 

আমি নিজের এই অভিযোগগুলো নিয়ে ভেবে ভেবে অনেক ঘণ্টা কাটিয়েছি। সিনিয়র ভিক্ষুরা সম্ভবত আধ্যাত্মিকতার অনেক উপরে পৌঁছে গেছেন। সুস্বাদু খাদ্যগুলো তাদের কী কাজে আসবে? আমাকেই সেই ভালো ভালো খাদ্যগুলো দেওয়া উচিত। সিনিয়র ভিক্ষুরা তো বছরের পর বছর ধরে শক্ত মেঝেতে বসে থাকতে অভ্যস্ত তাই বড়, নরম গদিগুলো পাওয়া উচিত আমারই। তা ছাড়া সিনিয়র ভিক্ষুরা সবাই কম বেশি মোটাসোটা। ভালো ভালো খাবার দাবার খেয়ে তারা আরামেই আছেন, যা দেখলেই বোঝা যায়। তারা শুধু জুনিয়র ভিক্ষুদের কাজ করতে বলেন। নিজেরা কিছুই করেন না। তারা কীভাবে জানবেন বাইরে এত গরম? তারা কীভাবে জানবেন ঠেলাগাড়ি ঠেলা কতটা কষ্টের? বিভিন্ন কাজের পরিকল্পনা তো তাদের মাথা থেকেই বের হয়। সেগুলো তারা নিজেরাই করে না কেন? ‘আমি আসলেই দুর্ভাগা! ওরা কত ভাগ্যবান!’

 

যখন আমি সিনিয়র ভিক্ষু হয়ে উঠলাম, তখন আমি ভালো খাবার খেলাম, নরম গদিতে বসলাম, আর কায়িক পরিশ্রম কমই করলাম। তাতেও জুনিয়র ভিক্ষুদের আমার হিংসে হলো। তাদের তো আর ধর্মদেশনা দিতে হয় না। সারা দিন লোকজনের সমস্যাগুলো শুনতে হয় না। বিহার পরিচালনায় তো আর তাদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা ব্যয় করতে হয় না। তারা দায়িত্বমুক্ত আর নিজের জন্য তাদের আছে অনেক অনেক সময়। আমি নিজেই নিজেকে বলতে শুনলাম,

‘আমি বেচারা দুর্ভাগা! ওরা কত ভাগ্যবান!’

 

পরে আমি বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা। জুনিয়র ভিক্ষুদের আছে ‘জুনিয়র ভিক্ষু হওয়ার দুঃখকষ্ট’। সিনিয়র ভিক্ষুদের আছে ‘সিনিয়র ভিক্ষু হওয়ার

দুঃখকষ্ট’। যখন আমি সিনিয়র ভিক্ষু হলাম, তখন দুঃখকষ্টগুলোর রূপটাই কেবল পাল্টে গিয়েছিল। ঠিক একই ব্যাপার ঘটে যখন ব্যাচেলর লোকেরা বিবাহিত লোকদের হিংসে করে, আর বিবাহিত লোকেরা হিংসে করে ব্যাচেলরদের। আমাদের সবারই এখন জানা উচিত যে, বিয়ে করে আমরা কেবল ব্যাচেলর জীবনের দুঃখকষ্টগুলোর সাথে বিবাহিত জীবনের দুঃখকষ্টগুলো বদলাবদল করছি। আর যখন আমাদের মধ্যে বিবাহবিচ্ছেদ হয়ে যায়, তখন আমরা বিবাহিত জীবনের দুঃখকষ্টগুলোর সাথে একাকী জীবনের দুঃখষ্টগুলোর বদলাবদল করছি মাত্র। এভাবেই এটা চলতে থাকে। বেচারা আমি, ভাগ্যবান তারা!

 

কোনো কিছু হয়ে তবেই আপনি সুখী হবেন এমন ভাবাটা মোহ। অন্য কোনো কিছু হয়ে দুঃখকষ্টের রূপটাই যা পাল্টায়। কিন্তু যখন আপনি এখন যেমন তাতেই সন্তুষ্ট হন, সেটা জুনিয়র বা সিনিয়র, বিবাহিত বা অবিবাহিত, ধনী বা গরিব, যা-ই আপনি হোন না কেন, আপনি তখন দুঃখকষ্ট থেকে মুক্ত। তখন

 

আপনি ভাবতে পারেন, ভাগ্যবান এখন আমি, বেচারা তারা!

 

অসুস্থ হলে তার জন্য উপদেশ

উত্তরপূর্ব থাইল্যান্ডে তখন আমার ভিক্ষু হয়ে অবস্থানের দ্বিতীয় বছর। টাইফাস জ্বরে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে পড়লাম আমি। জ্বর এমন ছিল যে উবনের আঞ্চলিক হাসপাতালে ভিক্ষুদের ওয়ার্ডে ভর্তি করাতে হলো আমাকে। সেই দিনগুলোতে, ১৯৭০ সালের মাঝামাঝি সময়ে উবন ছিল একটা হতদরিদ্র দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল। আমার শরীর তখন খুব দুর্বল ও সারা গায়ে ব্যথা। হাতে এক জায়গায় ক্ষত। এমন অবস্থায় আমি দেখলাম, পুরুষ নার্সটা বিকেল ৬টায় চলে যাচ্ছে। আধ ঘণ্টা পরেও তার বদলে কোনো নার্স এলো না। আমি পাশের বেডের ভিক্ষুকে বললাম, রাতের নার্স তো এখনো এলো না। ব্যাপারটা কাউকে জানানো দরকার। আমাকে তাড়াতাড়ি জানিয়ে দেওয়া হলো ভিক্ষুদের ওয়ার্ডে রাতে কোনো নার্স থাকে না। রাতের বেলায় যদি আপনার খারাপ কিছু হয়ে যায়, সেটা আপনার কর্মফল। অসুস্থ হয়ে এমনিতেই খুব খারাপ লাগছিল আমার। আর এটা জেনে তো রীতিমতো আতঙ্কিত হয়ে গেলাম আমি।

চার সপ্তাহ ধরে আমার পাছায় সকাল বিকেলে এন্টিবায়োটিক ইনজেকশন দিত বুনো মোষের মতো এক পুরুষ নার্স। এটা ছিল তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত

দেশের একটা হাসপাতাল। তাই একই সুঁচ বার বার ব্যবহার করা হতো, যা এমনকি ব্যাংককেও এত বেশিবার ব্যবহার করার অনুমোদন ছিল না। সেই শক্তিশালী হাতের নার্সটা, ইনজেকশন দেওয়ার সময় মাংসে সুঁচ ঢুকাতে গিয়ে আক্ষরিক অর্থেই সজোরে কোপাত আমাকে। ভিক্ষুদের কঠিন ও অসাধারণ সহ্যক্ষমতাসম্পন্ন হিসেবে আশা করা হয়, কিন্তু আমার পাছা এমন ছিল না। সেখানে খুব ব্যথা করত। আমি তখন সেই নার্সটাকে ঘৃণা করতাম। আমার সারা গায়ে ব্যথা, দুর্বল। জীবনে এত দুর্বিষহ ভাব কখনো বোধ করি নি। এমন অবস্থায় এক বিকেলে আজান চাহ্ আসলেন ভিক্ষুদের ওয়ার্ডে আমাকে দেখতে। আমাকে দেখতে! আমি এত খুশি ও মুগ্ধ হলাম, বলার নয়। আনন্দে যেন ভাসছিলাম আমি। এত দারুণ বোধ করছিলাম যতক্ষণ না আজান চাহ্ তার মুখ খুললেন। তিনি যা বললেন, পরে আমি জেনেছি তা তিনি হাসপাতালে অনেক অসুস্থ ভিক্ষুকেই বলেছেন।

 

তিনি আমাকে বললেন, ‘হয় তুমি ভালো হয়ে উঠবে, নয়তো মরবে।’ এই বলে তিনি চলে গেলেন।

আমার আনন্দ ভেঙে খান খান হয়ে গেল। তার আসায় আমার যে খুশি লেগেছিল তা নিমিষেই উধাও হয়ে গেল। সবচেয়ে খারাপ জিনিসটা হলো যে, আপনি কখনোই আজান চাহ-র কথায় ভুল ধরতে পারবেন না। তিনি যা বলে গেলেন তা ছিল খাঁটি সত্য। আমি হয় ভালো হয়ে উঠব, নয় মারা যাব। যা-ই

হোক না কেন, অসুস্থতার বেদনা আর থাকল না । অবাক করা ব্যাপার, সেটা ছিল খুব আশ্বস্ত হওয়ার বিষয়। ফলে যা ঘটল, আমি মরলাম না; বরং ভালো হতে শুরু করলাম। কী দারুণ এক শিক্ষক আজান চাহ!

 

অসুস্থ হওয়াতে সমস্যা কোথায়?

বক্তৃতার সময় আমি প্রায়ই শ্রোতাদের বলি, তারা যদি কখনো অসুস্থ হয়ে থাকে, তাহলে যেন হাত তোলে। প্রায় প্রত্যেকেই তাদের হাত তোলে। (যারা তোলে না, তারা হয় ঘুমিয়েছিল, নয়তো কোনো যৌন কল্পনায় বিভোর ছিল!) আমি তাদের যুক্তি দেখাই, এটাই প্রমাণ করে যে অসুস্থ হওয়াটা স্বাভাবিক। প্রকৃতপক্ষে সময়ে সময়ে অসুস্থ না হওয়াটা খুবই অস্বাভাবিক। তাই আমি বলি, ডাক্তারের সাথে দেখা করার সময় এটা কেন বলেন, ‘আমার কোন সমস্যা হয়েছে, ডাক্তার?’ মাঝেমধ্যে অসুস্থ না হলে সেটাই তো সমস্যা। তাই একজন যুক্তিবাদী মানুষ তার বদলে বলে, ‘আমার সবকিছু ঠিকঠাক চলছে ডাক্তার। আমি আবার অসুস্থ হয়েছি!’

 

অসুস্থতাকে সমস্যা হিসেবে দেখা মানে হচ্ছে খারাপ লাগার সাথে সাথে অপ্রয়োজনীয় উদ্বেগ ও অপরাধবোধ যোগ করা। উনবিংশ শতাব্দীর উপন্যাস ‘আরওন’ এ স্যামুয়েল বাটলার এক সমাজের ছবি আকেন মনে মনে, যেখানে অসুস্থতা হলো একটা অপরাধ, আর বিচারকেরা এটাকে ধারাবাহিক অপরাধ হিসেবেই বিবেচনা করেন। উপন্যাসের একটা অনুচ্ছেদে এমন আছে যে, উপন্যাসের নায়ককে সামান্য সর্দি হওয়ার কারণে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির হতে হয়েছিল। এ সবকিছু হয়েছিল নিজের দোষেই, সে বাইরের খাবার খেয়েছিল। যথেষ্ট ব্যায়াম করে নি, আর উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় ভরা জীবনযাপন করেছে। এজন্য তাকে কয়েক বছরের জেল দেওয়া হয়।

 

যখন আমরা অসুস্থ হই, কতজন নিজেদের দোষী ভাবী বলুন তো? একজন সতীর্থ ভিক্ষু অনেক বছর ধরে এক অজানা রোগে ভুগছিল। সে দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ বিছানায় কাটাত সারা দিন। সে এত দুর্বল ছিল যে রুমের বাইরেও হেঁটে যেতে পারত না। বিহার কতর্পৃক্ষ তার চিকিৎসার কোনো কিছুই বাদ রাখে নি। সাধ্যমতো মেডিকেল থেরাপি, প্রবীণ বৈদ্য ও বিকল্প চিকিৎসা, সবকিছুই করা হয়েছে। কিছুতেই কিছু হয় নি। সে মনে করত একটু ভালো বোধ করছে, আর বাইরে একটু হাঁটতে বেরোত। এরপর আবার সপ্তাহ যাবৎ বিছানায় থাকতে হতো। অনেকবার তারা মনে করেছে যে সে মারা যাবে।

 

একদিন বিহারাধ্যক্ষ সমস্যাটার একটা দারুণ সমাধান খুঁজে পেলেন। তিনি অসুস্থ ভিক্ষুর রুমে গিয়ে হতাশ চোখে চেয়ে রইলেন। তিনি বললেন, ‘আমি এসেছি এই বিহারের ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের পক্ষ থেকে, উপাসক-উপাসিকাদের পক্ষ থেকে। এরা সবাই তোমাকে ভালোবাসে ও যত্ন নেয়। এদের সবার পক্ষ হয়ে আমি তোমাকে মরার অনুমতি দিচ্ছি। তোমার আর সেরে ওঠার দরকার নেই।’

 

এই কথায় ভিক্ষুটি কেঁদে উঠল। সে কত চেষ্টা করেছে ভালো হয়ে ওঠার জন্য। তার বন্ধুরা কত কষ্ট করে তার রোগগ্রস্ত শরীরকে সারিয়ে তোলার চেষ্টা করেছে, সে তাদের মর্মাহত করতে চায় নি। সুস্থ হতে না পেরে সে নিজেকে এমন ব্যর্থ, এমন অপরাধী ভাবছিল যে বলার নয়। অধ্যক্ষের কথা শুনে তখন তার আর অসুস্থ হতে কোনো পিছুটান রইল না। সে এখন মরতে পারে। বন্ধুদের খুশি করার জন্য সুস্থ হওয়ার আর কোনো প্রয়োজন নেই। বিশাল দায়িত্ববোধ থেকে ভারমুক্ত হয়ে পরম স্বস্তিতে সে কেঁদে ফেলল।

 

এর পরে কী হলো বলে আপনার মনে হয়? সেদিন থেকে সে আরোগ্য লাভ করতে শুরু করল।

 

অসুস্থ কোনো রোগীকে দেখতে যাওয়া

হাসপাতালে কাউকে দেখতে গিয়ে আমাদের মধ্যে কতজন বলেন, ‘আজকে কেমন বোধ হচ্ছে?’

শুরুতেই কী বোকার মতো কথা! অবশ্যই তারা জঘন্য বোধ করছে। তা না- হলে তো তারা হাসপাতালেই থাকত না। থাকত কি? তা ছাড়া এই সাধারণ শুভেচ্ছাসূচক কথাটা রোগীকে গভীর মানসিক উদ্বেগের মধ্যে ফেলে দেয়। তারা ভাবে, সত্যি কথাটা বললে হয়তো দর্শনার্থীর মন খারাপ হয়ে যাবে। এত কষ্ট করে মূল্যবান সময় ব্যয় করে হাসপাতালে দেখতে এলো, এমন সহৃদয় লোককে কীভাবে মনে দুঃখ পাওয়ার মতো এমন জবাব দেবে সে? কীভাবে বলবে যে, সে এখন অসহায় বোধ করছে, বাসি হয়ে যাওয়া চা পাতার মতো অচল বোধ করছে? তাই তার বদলে সে মিথ্যা বলতে বাধ্য হয়, ‘মনে হয় আজকে একটু ভালো বোধ করছি।’ আর মনে মনে নিজেকে দোষী ভাবে, সুস্থ হচ্ছে না কেন!

 

দুর্ভাগ্যক্রমে অনেক দর্শনার্থীই রোগীকে আরও অসুস্থ বোধ করতে দেন। তিববতীয় বৌদ্ধধর্মের অনুসারী এক অস্ট্রেলিয়ান ভিক্ষুণী পার্থের এক

হাসপাতালে ক্যান্সারে মারা যাচ্ছিল। আমি তাকে কয়েক বছর ধরে চিনতাম, আর প্রায়ই তাকে হাসপাতালে দেখতে যেতাম। একদিন সে আমার বিহারে

ফোন করে আমাকে অনুরোধ করল তাকে সেদিন দেখতে যাওয়ার জন্য। কারণ, তার মনে হচ্ছিল তার সময় ঘনিয়ে আসছে। তাই আমি কাজ ফেলে দ্রুত একজনকে নিলাম সত্তর কিলোমিটার দূরে সেই হাসাপাতালে আমাকে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। হাসপাতালে অভ্যর্থনা কক্ষের নার্সটা কড়াভাবে শুনিয়ে দিল যে তিববতীয় বৌদ্ধ ভিক্ষুণীর কড়া নির্দেশ, যেন কেউ তাকে দেখতে না যায়।

 

আমি ভদ্র সুরে বললাম, ‘কিন্তু আমি এত দূর থেকে এসেছি শুধু তাকে দেখার জন্য।’

 

নার্সটা খেঁকিয়ে উঠল, ‘আমি দুঃখিত। সে কোনো দর্শনার্থী চায় না, আর আমাদের তার ইচ্ছার প্রতি সম্মান দেখাতে হবে।’

 

আমি প্রতিবাদ করে বললাম, ‘কিন্তু ব্যাপারটা এমন হতেই পারে না। সে দেড় ঘণ্টা আগে আমাকে ফোন করে আসতে বলেছে।’

 

নার্সটি অগ্নিঝরা দৃষ্টিতে আমাকে ভস্ম করার চেষ্টা করে, পরে তাকে অনুসরণ করতে বলল। আমরা সেই অস্ট্রেলিয়ান ভিক্ষুণীর রুমের বাইরে দাঁড়ালাম।

 

নার্সটি বন্ধ দরজার উপরে সাঁটানো বড় বড় করে লেখা কাগজটা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল।

 

‘একদম কোনো দর্শনার্থী নয়।’ ‘দেখলেন তো!’ নার্সটি বলল।

 

একটু ভালো করে দেখতেই সেই লেখাটার নিচে ছোট ছোট অক্ষরে লেখা দেখতে পেলাম, ‘... আজান ব্রাহম্ বাদে।’ তাই আমি ভেতরে গেলাম।

 

আমি ভিক্ষুণীকে জিজ্ঞেস করলাম, এত কড়া করে নোটিশটা টাঙানোর কারণটা কী? সে ব্যাখ্যা করল এভাবে : যখন তার বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনেরা তাকে দেখতে আসে, তারা তাকে মরতে দেখে এতই বিষণ্ণ ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে যে তার আরও খারাপ লাগে। সে বলল, ক্যান্সারে মরাটা এমনিতেই যথেষ্ট খারাপ। কিন্তু তার সাথে সাথে দর্শনার্থীদের আবেগীয় সমস্যাগুলোকেও সামাল দিতে হলে আরও খারাপ লাগে।

 

সে বলল যে, আমিই তার একমাত্র বন্ধু যে তাকে ব্যক্তি হিসেবে দেখে, কোনো মরণাপন্ন হিসেবে নয়, যে তার শোচনীয় অবস্থা দেখেও বিচলিত হয় না। বরং তার বদলে তাকে মজা করে কৌতুক শোনায় আর হাসায়। তাই এক ঘণ্টা ধরে আমি তাকে কৌতুক শোনালাম, আর সে আমাকে শেখাল কীভাবে একজন মৃত্যুপথযাত্রী বন্ধুকে সাহায্য করতে হয়। আমি তার কাছ থেকে শিখলাম যে, যখন আপনি হাসপাতালে কাউকে দেখতে যাবেন, ব্যক্তির সাথে কথা বলুন। অসুস্থতার ব্যাপারটা ডাক্তার ও নার্সদের হাতেই ছেড়ে দিন।

 

সে আমার দেখা করার দুদিন পরে মারা গিয়েছিল।

 

মৃত্যুর হালকা দিক

বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে আমাকে প্রায়ই মৃত্যু সংশ্লিষ্ট কাজ কারবার করতে হয়। আমার কাজের একটা অংশ হলো বৌদ্ধ অন্তেষ্টিক্রিয়াগুলো পরিচালনা করা। ফলে ব্যক্তিগতভাবে পার্থের অনেক অন্তেষ্টিক্রিয়া পরিচালকের সাথে চেনাজানা হয়ে গেছে আমার। তাদের এই কাজে গুরুগম্ভীর ভাব রাখাটা অপরিহার্য। এজন্যই মনে হয় ব্যক্তিগত আলাপকালে তারা দারুণ রসিক। যেমন, একজন অমেত্ম্যষ্টিক্রিয়া পরিচালক আমাকে দক্ষিন অস্ট্রেলিয়ার এক কবরের কথা বলেছিল যা মাটির তৈরি একটি গর্তে অবস্থিত। তারা কয়েকবার এটা ঘটতে দেখেছে যে সেই কবরে কফিন নামানোর পর পরই ঝমঝম বৃষ্টি নামে, পানি বেয়ে জমা হতে থাকে গর্তের মধ্যে। পুরোহিত তার প্রার্থনা বলতে বলতেই কফিনটা গর্ত থেকে পুরোপুরি ভেসে ওঠে! পার্থে একজন যাজক ছিল যে তার কাজের প্রথমেই অসাবধানতাবশত ডেস্কের সবগুলো সুইচের উপর ঝুঁকে পড়েছিল। হঠাৎ করে তার বাইবেল পাঠের মাঝখানে পর্দার আড়ালে থাকা কফিনটা নড়তে শুরু করল। মাইক্রোফোনের সংযোগ কেটে গেল, আর দ্য লাস্ট পোস্টের বিউগলের সুর পুরো গির্জা জুড়ে প্রতিধ্বনিত হলো। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, মৃত ব্যক্তি একজন শান্তিবাদী ছিল।

 

একজন বিশেষ অমেত্ম্যষ্টিক্রিয়া পরিচালকের কৌতুক বলার অভ্যাস ছিল। আমরা শববাহী মিছিলের আগে আগে হাঁটতাম কবরস্থানের দিকে। আর সে আমাকে কৌতুক শোনাত। প্রত্যেকটা কৌতুকের শেষ লাইনে, যেগুলো ছিল খুবই মজার, সে কনুই দিয়ে আমার পাঁজরে খোঁচা মেরে আমাকে হাসানোর চেষ্টা করত। আমি হাসিতে ফেটে পড়া থেকে নিজেকে কোনোমতে সামলে নিতাম। তাই, অনুষ্ঠানস্থলে যাওয়ার সময় আমি তাকে খুব কড়াভাবে এমন দুষ্টামি করতে মানা করতাম, যাতে আমি অনুষ্ঠানস্থলে সবার সামনে একটু মানানসই করে গম্ভীর মুখে থাকতে পারি। কিন্তু তাতে কেবল আরও কৌতুক বলতে উৎসাহিত হতো সে! শয়তান!

 

পরের বছরগুলোতে আমি বৌদ্ধ শেষকৃত্য অনুষ্ঠানগুলোতে নিজেকে হালকা মন নিয়ে উপস্থিত থাকতে শিখলাম। কয়েক বছর আগে প্রথমবারের মতো একটা শেষকৃত্যানুষ্ঠানে কৌতুক বলার মতো সাহস সঞ্চয় করলাম। কৌতুকটি শুরু করার পরে, অনুষ্ঠানের পরিচালক শোকার্ত লোকজনের পিছনে দাঁড়িয়ে বুঝে ফেলল আমি কী করতে যাচ্ছি, আর মুখ দিয়ে নানান ভঙ্গি করে আমাকে নিরস্ত করার চেষ্টা করল। আমি কিন্তু নাছোড়বান্দা। শেষকৃত্য অনুষ্ঠান পরিচালকের চেহারা তার মড়াগুলোর চেয়েও সাদা হয়ে গেল। কৌতুক শেষে গির্জার শোকার্তরা হাসিতে ফেটে পড়ল, আর পরিচালকের উদ্বিগ্ন মুখে স্বস্তির চিহ্ন ফিরে এলো। পরিবার ও বন্ধুরা সবাই পরে আমাকে অভিনন্দন জানাল। তারা বলল যে মৃত ব্যক্তি এমন কৌতুক শুনলে দারুণ উপভোগ করত, আর খুব খুশি হতো যে তার প্রিয় ব্যক্তিরা তাকে হাসিমুখে বিদায় জানিয়েছে। আমি এখন শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে সেই কৌতুকটা প্রায়ই বলে থাকি। কেন নয়?

বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়রা, আপনাদের শেষকৃত্যানুষ্ঠানে আমি যদি একটা কৌতুক বলি, আপনারা কি তা শুনতে পছন্দ করবেন? এই প্রশ্নটা জিজ্ঞেস করলে প্রত্যেকবার আমি উত্তর পেয়েছি ‘হ্যাঁ!’

 

তো, কৌতুকটা কী ছিল?

 

এক বুড়ো দম্পতি দীর্ঘদিন একত্রে সংসার জীবন কাটিয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন মারা যাওয়ার কিছুদিন বাদে অন্যজনও মারা গেল। ফলে তারা দুজনেই একত্রে স্বর্গে গিয়ে হাজির হলো। এক সুন্দর দেবদূত তাদের সাগরপাড়ের মনোমুগ্ধকর এক প্রাসাদে নিয়ে গেল। ইহ জগতে কেবল কোটিপতিরাই এমন অসাধারণ বাড়ির মালিক হতে পারে। দেবদূত ঘোষণা করল যে স্বর্গীয় পুরস্কার হিসেবে এই প্রাসাদটা তাদের দেওয়া হয়েছে।

 

স্বামীটি বেশ বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন লোক ছিল। সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ‘সবকিছুই তো ভালো। কিন্তু আমার মনে হয় না এত বড় সম্পত্তির ট্যাক্স দিতে

পারব প্রতিবছর।’

 

দেবদূত বেশ মিষ্টি করে হেসে বলল যে, স্বর্গে সম্পত্তির উপরে কোনো সরকারি ট্যাক্স দিতে হয় না। এরপর সে তাদের প্রাসাদের রুমগুলো ঘুরিয়ে

দেখাল। প্রত্যেকটা রুম খুব রুচিশীলভাবে সাজানো, আসবাবপত্র সব খুব দামী দামী। ছাদ থেকে বহুমূল্যের ঝাড়বাতি ঝুলছে। প্রত্যেক বাথরুমের ট্যাপগুলোতে সোনার কারুকাজ করা। সেখানে ছিল ডিভিডি সিস্টেমস আর অত্যাধুনিক বড় পর্দার টেলিভিশন। ঘুরিয়ে দেখানো শেষ হলে দেবদূত বলল, কোনো কিছু তাদের অপছন্দের আছে কি না। সেরকম থাকলে তাকে বললেই সে মুহূর্তের মধ্যে সেটা পাল্টিয়ে দেবে। সেটাই তাদের স্বর্গীয় পুরস্কার।

 

স্বামীটি তখন মনে মনে সবকিছুর দাম হিসেব করছিল। সে বলল, ‘এগুলো সবই খুব মূল্যবান জিনিসপত্র। আমার মনে হয় না আমরা সম্পত্তি বীমার কিস্তিগুলো চালাতে পারব।’

 

দেবদূত তার কথা শুনে চোখ পাকাল আর নম্রভাবে বলল যে চোরদের স্বর্গে প্রবেশের অনুমতি নেই, তাই সম্পত্তি বীমারও কোনো দরকার নেই। এর পরে

সে তাদের নিয়ে গেল নিচেরতলার বিশাল গ্যারেজে। সেখানে ছিল নতুন একটি সাভ ফোর-উইল ড্রাইভ। তার পাশেই ছিল রোলস রয়েস ট্যুরিং লিমুজিন। তৃতীয় গাড়িটা ছিল বিশেষ লাল রঙের ফেরারি স্পোর্টস কার, যার ছাদটা ইচ্ছে করলে খোলা বা বন্ধ করা যায়। স্বামীটি ইহ জীবনে একটি শক্তিশালী স্পোর্টস কার চেয়েছিল; কিন্তু তা সে কেবল স্বপ্নেই দেখত।

 

দেবদূত বলল যে, যদি তারা গাড়ির মডেল, রং বদলাতে ইচ্ছে করে, তাকে বললেই হবে। এটা তাদের স্বর্গীয় পুরস্কার।

 

স্বামীটি মনমরা হয়ে বলল, ‘আমরা তো এই গাড়িগুলোর রেজিস্ট্রেশন ফি-ই দিতে পারব না। আর যদি পারিও, এই যুগে স্পোর্টস কার কোন কাজে আসবে? স্পিড বেশি করলেই তো জরিমানা গুণতে গুণতে আমি শেষ।’

 

দেবদূত মাথা নেড়ে তাকে ধৈর্যসহকারে বলল যে স্বর্গে কোনো গাড়ি রেজিস্ট্রেশন ফি নেই। সেখানে কোনো স্পিড ক্যামেরাও নেই। সে তার ফেরারি যত স্পিডে চায়, তত চালাতে পারবে। এরপর সে গ্যারেজের দরজা খুলে দিল। রাস্তার ওপাশে ছিল ১৮টি গতর্ও য়ালা বিরাট গলফ খেলার মাঠ। দেবদূত বলল যে স্বর্গে তারা আগেই জানে, স্বামী কী রকম গলফ খেলা পছন্দ করে। সেই সাথে আরও বলে দিল এই গলফ মাঠের ডিজাইন করেছে টাইগার উডস নিজে। কিন্তু স্বামীটির মুখ তখনো বিষণ্ণ সে বলল, ‘এটা তো খুব ব্যয়বহুল গলফ ক্লাব বলে মনে হচ্ছে। আমার মনে হয় না আমি এই ক্লাবের ফি চালাতে পারব।’

 

দেবদূত ঘোঁত করে উঠল তার কথা শুনে। এর পরে সে দেবদূতসুলভ চেহারা করে স্বামীটিকে বলে দিল যে স্বর্গে কোনো ফি নেই। তা ছাড়া স্বর্গের গলফ কোসর্গুলোতে টি-অফের জন্য লাইন ধরতে হয় না। বলগুলো খাদে পড়ে যায় না। ঘাসগুলো এমনভাবে বিছানো, যেদিকে খুশি মারলেই হবে, বল সোজা গর্তে গিয়ে পড়বে। এটা তাদের স্বর্গীয় পুরস্কার।

দেবদূত চলে যাওয়ার পরে স্বামীটি তার স্ত্রীকে বকা শুরু করল। সে তার উপরে এমন খেপে গিয়েছিল যে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলল। বেচারী স্ত্রী বুঝতেই পারল না কেন এত রাগ তার স্বামীর। মিনতি ঝরল তার কণ্ঠে, ‘তুমি আমার উপরে এত রেগে আছো কেন? আমাদের এমন চমৎকার প্রাসাদ হয়েছে, কত সুন্দর আসবাবপত্র! তুমি তোমার ফেরারি গাড়ি পেয়েছ। রাস্তার ওপাশেই গলফ মাঠ। এত রেগে আছো কেন আমার উপর?’

 

স্বামীটি তিক্ত সুরে বলল, ‘কারণ, হে স্ত্রী, তুমি যদি আমাকে অমন স্বাস্থ্যসম্মত খাবার না দিতে, অনেক বছর আগেই আমি এখানে আসতে পারতাম!’

 

শোক, হারানো এবং জীবনকে উদযাপন করা

আমরা হারানোর সাথে যা যোগ করি, তা-ই হচ্ছে শোক। এটা হচ্ছে শেখানো প্রতিক্রিয়া, যা মাত্র কয়েকটা সংস্কৃতিতে দেখা যায়। শোক অনিবার্য নয়।

আমি এটা জেনেছি আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে, আট বছরেরও বেশি সময় ধরে খাঁটি এশিয়ান বৌদ্ধ সংস্কৃতিতে ডুবে থেকে। সেই সময়ে থাইল্যান্ডের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যেখানকার একটি বৌদ্ধ বনবিহারে আমি ছিলাম, সেখানে পশ্চিমা সংস্কৃতি ছিল সম্পূর্ণ অপরিচিত। আমাদের বিহারটা তখন আশেপাশের গ্রামগুলোর জন্য শব পোড়াবার স্থান হিসেবে কাজ করত। প্রায় প্রতিসপ্তাহে মৃতদেহ পোড়ানো হতো। সেই ১৯৭০ সালের শেষার্ধে শত শত দাহক্রিয়া

দেখেছি আমি; কিন্তু কাউকেই কাঁদতে দেখি নি। পরের দিনগুলোতে মৃত ব্যক্তির আত্মীয়স্বজনদের সাথে কথা বলেছি; কিন্তু তাদের মাঝে কোনো শোকের চিহ্ন দেখি নি। স্বীকার করতেই হবে যে সেখানে কোনো শোক নেই। আমি জেনেছিলাম যে সেই সময়কার উত্তরপূর্ব থাইল্যান্ডে, যেখানে বহু শত বছর ধরে বুদ্ধের শিক্ষা বিরাজমান ছিল, সেখানে মৃত্যুকে সবাই এমনভাবে গ্রহণ করত, যা প্রিয়জন হারানো এবং শোকের পশ্চিমা ধ্যানধারণাগুলোকে অস্বীকার করে।

 

সেই বছরগুলো আমাকে শিখিয়েছিল যে শোকের বিকল্প কিছু আছে। শোক যে ভুল তা নয়; কিন্তু তার অন্য একটা সম্ভাবনা আছে। প্রিয়জন হারানোকে

অন্যভাবেও দেখা যায়, যা দীর্ঘদিন শোকে কাতর হয়ে দুঃখ পাওয়া থেকে মুক্তি দেয়।

 

আমার বাবা মারা গিয়েছিলেন যখন আমার বয়স ষোল। তিনি ছিলেন আমার জন্য মহামানব। তিনিই ছিলেন সেই ব্যক্তি, যিনি তার কথার মাঝে আমাকে ভালোবাসার মানে খুঁজে পেতে সাহায্য করেছিলেন, ‘তুমি জীবনে যা-ই করো না কেন, পুত্র, আমার হৃদয়ের দরজা তোমার জন্য সব সময় খোলা থাকবে।’ যদিও তার জন্য আমার ভালোবাসা ছিল বিশাল, আমি তার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে কাঁদি নি। আমি তার জন্য আর কোনো দিন কাঁদি নি। তার অকালমৃত্যুতে কাঁদতে হবে, এমনটাও কখনো বোধ করি নি। তার মৃত্যুকে ঘিরে আমার এই আবেগকে বুঝে উঠতে অনেক সময় লেগে গিয়েছিল। আমি নিচের গল্পের মাধ্যমে সেটা বুঝেছিলাম, যা আমি এখানে আপনাদের সাথে শেয়ার করছি।

 

তরুণ হিসেবে আমি খুব গান পছন্দ করতাম। রক গান থেকে শুরু করে ক্লাসিক, জ্যাজ হতে ফোক গান, সব। লন্ডন ছিল ১৯৬০ ও ১৯৭০ সালের

গোড়ার দিকে এক অবিশ্বাস্য শহর, বিশেষ করে আপনি যদি গান ভালোবাসেন। আমার মনে পড়ে লেড জেপেলিন ব্যান্ডের প্রথম নার্ভাস গানের মহড়ায় আমিও উপস্থিত ছিলাম, যেটি সোহোর একটি ছোট ক্লাবে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। অন্য এক সময়ে আমরা কয়েকজন উত্তর লন্ডনের ছোট এক মদের দোকানের উপরের এক রুমে একটা রক গ্রুপের সামনে তখনকার সময়ে অখ্যাত রড স্টুয়ার্টকে দেখেছিলাম গান করতে। সেকালের লন্ডনের গানের জগতের কত মূল্যবান স্মৃতি আমার কাছে এখনো রয়ে গেছে।

 

বেশির ভাগ কনসার্টের শেষে অন্যান্যদের সাথে আমিও চেঁচিয়ে উঠতাম, ‘আরেকটা! আরেকটা!’

সাধারণত ব্যান্ড দল বা অর্কেস্ট্রা আরও কিছুক্ষণ বাজাত, যদিও একসময় তারা তাদের যন্ত্রপাতি গুছিয়ে বাড়ি চলে যেত। আমিও চলে আসতাম। আমার

স্মৃতিতে ভাসে যে প্রতিসন্ধ্যায় যখনই আমি ক্লাব, পাব অথবা কনসার্ট হল থেকে ঘরের দিকে হেঁটে ফিরেছি, তখন সব সময়ই বৃষ্টিতে ভিজেছি। লন্ডনের এমন শুকনো টাইপের বৃষ্টির জন্য বিশেষ একটা শব্দ আছে : ড্রিজল বা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। প্রতিবারই কনসার্ট হল থেকে বেরোনোর সময় আমি খেয়াল করতাম যে, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে, চারদিকে ঠান্ডা ও অন্ধকার ভাব।

 

আমি মনের গভীরে জানতাম যে সম্ভবত আর কখনোই তাদের গান শোনার সুযোগ হবে না আমার। তারা আমার জীবন থেকে চলে গেছে চিরকালের জন্য। কিন্তু তাতে আমি একবারও বিষণ্ণতা অনুভব করি নি বা কান্না কান্না ভাব বোধ করি নি। লন্ডনের সেই ঠান্ডা, ভেজা আলো আধারির রাতে বেরিয়ে এসে আমার মনে তখনো বাজতে থাকত তাদের গান। কী অসাধারণ গান! কী দারুণ পারফরম্যান্স! আমি কী সৌভাগ্যবান যে এ সময় আমি কনসার্টে উপস্থিত ছিলাম! দারুণ এসব কনসার্টের পর আমার মনে কোনো শোক অনুভব করিনি।

 

আমার বাবার মৃত্যুর পরও আমি ঠিক এমনটাই অনুভব করেছিলাম। মনে হয়েছিল যেন দারুণ এক কনসার্টের সমাপ্তি ঘটেছে। এটা খুব চমৎকার একটা পারফরম্যান্স ছিল। যখন এটি শেষ পর্যায়ে এসে গিয়েছিল, আমি জোরে জোরে চিৎকার করেছিলাম, ‘আরেকটু! আরেকটু!’ আমার প্রিয় বৃদ্ধ বাবা সত্যিই আরেকটু সময় কাটাতে চেয়েছিলেন আমাদের সাথে। কিন্তু একসময় তাকে তার জিনিসপত্র গুটিয়ে বাড়ি চলে যেতে হলো। তার শেষকৃত্যের পরে আমি মর্টলেকের ক্রেমাটোরিয়াম থেকে লন্ডনের ঠান্ডা গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে বেরিয়ে আসছিলাম। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিটা আমার পরিষ্কার মনে আছে। আমি জানতাম, আর কখনোই তার সাথে দেখা হবে না আমার। তিনি আমার জীবন থেকে চিরকালের জন্য বিদায় নিয়েছেন। তাই বলে আমি বিষণ্ণ বোধ করি নি। আমার কান্নাও আসে নি। আমি শুধু মনে মনে অনুভব করেছিলাম, কী অসাধারণ পিতা ছিলেন তিনি! কী দারুণ অনুপ্রেরণাদায়ী জীবন ছিল তার! আমি কী সৌভাগ্যবান যে তার সাথে থাকতে পেরেছি! কী সৌভাগ্য যে আমি এমন পিতার সন্তান হয়েছি!

 

ভবিষ্যতের দীর্ঘ পথ হাঁটতে গিয়ে আমি যখন মায়ের হাত ধরেছিলাম, ঠিক একই রোমাঞ্চকর অনুভূতি কাজ করছিল আমার মনে, যেমনটা আমার জীবনে ঘটে যাওয়া বিরাট সব কনসার্টের শেষে অনুভব করেছি। আমি এমন অনুভূতি পৃথিবীর বিনিময়েও মিস করতে চাই না। তোমাকে ধন্যবাদ, বাবা।

 

শোক হচ্ছে আপনার কাছ থেকে কী কেড়ে নেওয়া হয়েছে তা দেখা। জীবনের উদযাপন করা হচ্ছে আমরা যা যা পেয়েছি তা দেখে তার জন্য খুব কৃতজ্ঞতা অনুভব করা।

 

ঝরা পাতা

সম্ভবত মৃত্যুর মধ্যে যে মৃত্যুকে মেনে নেওয়া সবচেয়ে কঠিন হয়, তা হচ্ছে কোনো শিশুর মৃত্যু। বিভিন্ন সময়ে কোনো ছোট ছেলে বা মেয়ের শেষকৃত্য অনুষ্ঠান পরিচালনা করার সুযোগ হয়েছে আমার, যাদের জীবনের অভিজ্ঞতাই খুব বেশি দিনের হয় নি। আমার কাজ হচ্ছে শোকে বিহবল পিতামাতাকে, সাথে অন্যান্যদেরও মনের দুঃখ কাটিয়ে ওঠার জন্য পথ দেখাতে সাহায্য করা, আর সেই বদ্ধমূল প্রশ্নটার উত্তর খোঁজার যাতনার ভার লাঘব করা, যে প্রশ্নটি হচ্ছে, ‘কেন?’

 

আমি প্রায়ই নিচের গল্পটি বলি, যা অনেক বছর আগে থাইল্যান্ডে শুনেছিলাম।

 

একজন সাধারণ বনভিক্ষু জঙ্গলের মধ্যে এক পর্ণকুটিরে ধ্যান করছিল। এক সন্ধ্যায় প্রচন্ড বেগে ঝড় বয়ে গেল। বাতাসের গর্জন শোনাল যেন জেট বিমানের ইঞ্জিনের মতো। ভারী বৃষ্টি তার কুটিরে আচড়ে পড়ছিল। রাত যতই বাড়তে লাগল, ঝড় ততই বিক্ষুদ্ধ হয়ে উঠল। প্রথমে গাছের ডালপালা ভেঙে পড়ার শব্দ শোনা গেল। পরে বাতাসের তোড়ে শেকড়সুদ্ধ গাছ উপড়ে এলো, আর বজপ্রাতের শব্দের মতো মাটিতে আছড়ে পড়ল।

ভিক্ষুটি শীঘ্রই বুঝতে পারল যে তার ঘাসের কুটিরটা তাকে রক্ষা করতে পারবে না। কুটিরে যদি কোনো গাছ আছড়ে পড়ে, অথবা নিদেনপক্ষে কোনো বড় ডাল যদি নেমে আসে, তাহলে এটি সোজা কুটিরকে চাপা দিয়ে তাকেও মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলবে।

 

সে সারা রাত ঘুমাল না। সেই রাতে প্রায়ই সে শুনল বড় বড় গাছগুলো হুড়মুড় করে মাটিতে আছড়ে পড়ছে সশব্দে। প্রতিবার এমন শব্দে তার হৃদয়

কেঁপে উঠল। ভোর হওয়ার কিছু আগে, যেমনটি প্রায়ই হয়, ঝড় থেমে গেল। আলো ফুটতেই ভিক্ষুটি বেরিয়ে পড়ল কুটিরের কী হাল হয়েছে দেখতে। অনেক বড় বড় ডালপালা, আর দুটো বড় আকারের গাছ একটুর জন্য কুটিরকে মিস করেছে। এত কিছুর পরেও বেঁচে থাকতে পেরে সে খুব ভাগ্যবান অনুভব করল। হঠাৎ তার দৃষ্টি আকর্ষিত হলো উপড়ে যাওয়া গাছ এবং ছড়ানো ছিটানো ডালপালার দিকে নয়, বরং অসংখ্য পাতার দিকে, যা পুরু হয়ে ছড়িয়ে ছিল জঙ্গলের সবখানে।

 

সে যেমনটা ভেবেছিল, মাটিতে পড়ে থাকা বেশির ভাগ পাতাই হচ্ছে বুড়ো ও বাদামী রঙের পাতা যেগুলো পূর্ণজীবন কাটিয়েছে। সেই বাদামী পাতাগুলোর মাঝে ছিল অনেকগুলো হলদে পাতা। তার সাথে ছিল কিছু সবুজ পাতাও। সেই সবুজ পাতাগুলোর মধ্যে কয়েকটা এমন সতেজ ও উজ্জ্বল সবুজ রঙের পাতা ছিল যে সে দেখেই বুঝতে পারল এগুলো কুঁড়ি থেকে পাতা হয়েছিল ঝরে পড়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে। সেই মুহূর্তে ভিক্ষুটির হৃদয়ে মৃত্যুর স্বভাব প্রকটিত হলো। সে তার অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখা সত্যকে পরখ করে নিতে চাইল। তাই সে উপরে গাছগুলোর ডালপালার দিকে তাকাল। সত্যিই, গাছগুলোতে যে পাতাগুলো রয়ে গেছে, তাদের বেশির ভাগই তরুণ সতেজ সবুজ পাতা, তাদের জীবনের মধ্যগগনে। যদিও অনেক নতুন কচি সবুজ পাতা মাটিতে ঝরে পড়ে আছে, তবুও পুরনো, বুড়ো হয়ে যাওয়া কোঁকড়ানো বাদামী পাতাগুলোও ডালপালাগুলোতে টিকে আছে এখনো। ভিক্ষুটি হাসল। সেদিন থেকে কোনো শিশুর মৃত্যুই তাকে বিচলিত করে নি।

 

যখন আমাদের পরিবারের উপর দিয়ে মৃত্যুর ঝড় বয়ে যায়, সে সাধারণত উড়িয়ে নেয় বৃদ্ধদের, কুঁচকানো বাদামী পাতাগুলোকে। সেই সাথে আরও অনেক মধ্যবয়স্ক লোকদেরও নিয়ে যায়, যেমনটা গাছের হলদে পাতাগুলোর মতো। তরুণরাও মারা যায়, তাদের জীবনের প্রারম্ভেই, ঠিক সবুজ পাতাগুলোর মতো। মাঝে মাঝে মৃত্যু এসে ছোট বাচ্চাদের জীবনও কেড়ে নেয়, ঠিক যেমনটা প্রকৃতির ঝড় এসে ছিড়ে নেয় কুঁড়ি থেকে সদ্য গজানো পাতাগুলোকে। এটাই আমাদের মৃত্যুর অপরিহার্য চরিত্র, ঠিক যেমনটি দেখা যায় বনের মাঝে ঝড়ের চরিত্রটিতে।

 

একজন শিশুর মৃত্যুতে কাউকে দোষ দেওয়া বা কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার কিছু নেই। ঝড়কে কে দোষ দিতে পারে? আর এটিই আমাদের সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে সাহায্য করে, কেন শিশুরা মারা যায়? উত্তরটা হচ্ছে, সেই একই কারণ, যার জন্য ঝড়ে কিছু সংখ্যক সদ্যজাত সবুজ পাতা ঝরে

যায়।

 

মৃত্যুর উত্থান-পতন

বোধ করি সবচেয়ে আবেগময় দৃশ্যের অবতারণা ঘটে যখন শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে কফিনটাকে কবরে নামানো হয় অথবা ক্রেমাটোরিয়ামে কফিনকে ভেতরে নেওয়ার জন্য যখন সুইচ টিপে দেওয়া হয়। এটা যেন প্রিয় ব্যক্তির সর্বশেষ শারীরিক চিহ্নকে শোকার্ত পরিবারের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হচ্ছে চিরকালের জন্য। এমন মুহূর্তে প্রায়ই চোখের পানি ধরে রাখা যায় না। এমন মুহূতর্গুলো আরও কঠিন হয় পার্থের কয়েকটা ক্রেমাটোরিয়ামে। সেখানে সুইচ টিপলে কফিনটি নিচে নেমে যায় যেখানে চুল্লিটি অবস্থিত। এটা অনেকটা কবর দেওয়ার মতো দেখায়। তবে একজন মৃত ব্যক্তির নিচের দিকে নেমে যাওয়াটা অবচেতন মনে অনেকটা নরকে নেমে যাওয়ার মতো লাগে! প্রিয় ব্যক্তিকে হারানো এমনিতেই যথেষ্ট কষ্টের। তার সাথে যমালয়ে নেমে যাওয়ার সাদৃশ্য যোগ হলে তা সহ্য করাটা একটু কঠিন হয়ে পড়ে।

 

অতএব আমি একবার প্রস্তাব দিয়েছিলাম যে এমনভাবে ক্রেমাটোরিয়াম নির্মাণ করা হোক যাতে করে প্রিস্ট যখন মৃতদেহকে দাহ করার জন্য সুইচ টিপবে, কফিনটা ধীরে ধীরে উপরে উঠে যাবে। একটা সাধারণ হাইড্রলিক লিফটই এই কাজটা করতে পারে। কফিনটা ছাদে পৌঁছালে ঘুরন্ত শুকনো বরফের মাঝে হারিয়ে যাবে, এর পরে এটি একটি লুকোনো দরজার মাঝ দিয়ে উপরে উঠে যাবে, তখন বাজতে থাকবে স্বর্গীয় সঙ্গীত। শোকার্তদের মাঝে তা মানসিকভাবে খুব উৎফুল্লকর একটা ছাপ ফেলবে।

 

তবে যারা আমার প্রস্তাব শুনেছে, তাদের কেউ কেউ মন্তব্য করেছে, এতে অনুষ্ঠানের সততা চলে যাবে। বিশেষ করে সবাই যেখানে জানে যে, মৃতব্যক্তি যদি বদমাশ হয়, এমন ব্যক্তি ‘উপরে’ যেতেই পারে না।

 

আমি তাই প্রস্তাবটা একটু রদবদল করে নিলাম। প্রস্তাব করলাম যে সবকিছু কাভার দেওয়ার জন্য তিনটা সুইচ রাখা হোক। ‘উপরে’ সুইচটা হচ্ছে যারা ভালো তাদের জন্য। ‘নিচে’ বাটনটা হচ্ছে গুন্ডাদের জন্য। ‘একপাশে’ বাটনটি হচ্ছে বেশির ভাগ বেওয়ারিশ লোকদের জন্য। এর পরে পশ্চিমা সমাজের গণতান্ত্রিক নীতিকে মান্য করে, আর সাথে সাথে এমন নিরস অনুষ্ঠানে একটু রস মিশিয়ে দেওয়ার জন্য আমরা শোকার্তদের কাছ থেকে হাত তুলে ভোট নিতে পারি, তিনটা সুইচের মধ্যে কোনটা টিপে দেওয়া হবে! এটি শেষকৃত্য অনুষ্ঠানগুলোকে সবচেয়ে স্মরণীয় মুহূর্ত বানিয়ে দেবে, আর এমন অনুষ্ঠানে

যেতে চাওয়ার একটা ভালো কারণ হয়ে উঠবে।

 

এক ব্যক্তি ও তার চার স্ত্রী

জীবনে সফল এক ব্যক্তির চার স্ত্রী ছিল। জীবনের শেষ সময়ে এসে সে তার শয্যাপাশে চতুর্থ স্ত্রীকে ডাকল, সবচেয়ে নতুন ও তরুণী স্ত্রীকে। সে তার সুন্দর ফিগারের দেহে হাত বুলিয়ে বলল, ‘প্রিয়তমা, এক কি দুদিন পরে আমি মারা যাব। মরার পরে, আমি তোমাকে ছাড়া একা হয়ে যাব। তুমি কি আমার সাথে আসবে?’

 

‘কোনোমতেই না!’ ঘোষণা করে দিল সেই লাস্যময়ী সুন্দরী, ‘আমাকে অবশ্যই পিছনে থাকতে হবে। তোমার শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে আমি তোমার প্রশংসার জয়গান গাইব। কিন্তু এর বেশি কিছু করতে পারব না।’ এই বলে সে গটগট করে হেঁটে রুম থেকে বেরিয়ে গেল।

 

তরুণী স্ত্রীর এমন শীতল প্রত্যাখান লোকটির হৃদয়ে যেন একটি ছুরি বসিয়ে দিল। সে তার সব মনোযোগ ঢেলে দিয়েছিল তার এই সবচেয়ে তরুণী স্ত্রীকে।

সে তাকে নিয়ে এমন গর্বিত ছিল যে যেকোনো গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে সে তাকে সাথে করে নিয়ে গেছে। এই সুন্দরী স্ত্রী তাকে বৃদ্ধ বয়সে দারুণ মর্যাদা এনে দিয়েছে। এটা জেনে সে অবাক যে, তার স্ত্রী তাকে ভালোবাসে না, যেমনটা কিন্তু সে তাকে ভালোবাসত।

 

এখনো তার আরও তিনজন স্ত্রী আছে। তাই সে তৃতীয় স্ত্রীকে ডাকল যাকে সে মধ্যবয়সে বিয়ে করেছিল। এই তৃতীয় স্ত্রীর হাত ধরার জন্য তাকে খুব কষ্ট করতে হয়েছিল। তার জীবনে এত আনন্দের উৎস তো তার এই তৃতীয় স্ত্রী। তাই সে তাকে গভীরভাবে ভালোবাসে। তার এই স্ত্রী এমন আকষর্ণীয় ছিল যে অনেকেই তাকে পেতে চাইত। কিন্তু সে সব সময় তার স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ত ছিল। সে তার স্বামীকে দিয়েছিল নিরাপত্তাবোধ। সে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘মিষ্টি সোনা আমার, এক কি দুদিন পরে আমি মারা যাব। মরার পরে, আমি তোমাকে ছাড়া একা হয়ে যাব। তুমি কি আমার সাথে আসবে?’

 

এই সুন্দরী মহিলা ব্যবসায়ীসুলভ ভঙ্গিতে উত্তর দিল, ‘কিছুতেই নয়! এমন জিনিস কখনোই করা হয় নি। আমি তোমাকে জমকালো একটা শেষকৃত্য অনুষ্ঠান করে দেব। কিন্তু এর পরে আমি তোমার সন্তানদের নিয়ে চলে যাব।’

 

তৃতীয় স্ত্রীর এমন অবিশ্বস্ততা তার অন্তঃস্থলকে নাড়া দিল। সে তাকে চলে যেতে বলে দ্বিতীয় স্ত্রীকে ডেকে পাঠাল।

 

সে বড় হয়েছে এই দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে। এই স্ত্রীটি যদিও তেমন আকষর্ণীয় নয়, কিন্তু যেকোনো সমস্যায় সাহায্য করার জন্য আশেপাশে ছিল সে সব সময়। আর যেকোনো সমস্যায় অমূল্য উপদেশ দিত সে। সে ছিল তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু। সে বিশ্বাসের সাথে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘ভালোবাসাময়ী, এক কি দুদিন পরে আমি মারা যাব। মরার পরে, আমি তোমাকে ছাড়া একা হয়ে যাব। তুমি কি আমার সাথে আসবে?’

 

সে ক্ষমার সুরে বলল, ‘আমি দুঃখিত, আমি তোমার সাথে যেতে পারব না। তোমার কবর পর্যন্ত যেতে পারি, কিন্তু এর বেশি নয়।’

 

বৃদ্ধ লোকটি ভেঙে পড়ল। সে তার প্রথমস্ত্রীকে ডাকল, যাকে সে মনে হয় চিরকাল ধরে চেনে। সে সম্প্রতি তাকে অবহেলা করেছে। বিশেষত মন

ভোলানো সেই তৃতীয় স্ত্রীর দেখা পেয়ে আর সবদিক দিয়ে সেরা তার চতুর্থ স্ত্রীকে পেয়ে। কিন্তু তার এই প্রথমস্ত্রীই তার জন্য সত্যিকারের গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

সে আড়াল থেকে কাজ করে গেছে। সে সত্যিই লজ্জা পেল যখন সে তার এই স্ত্রীকে অগোছালো ও শীর্ণ দেহে আসতে দেখল। মিনতি ঝরল লোকটার কণ্ঠে, ‘প্রিয়তমা, এক কি দুদিন পরে আমি মারা যাব। মরার পরে, আমি তোমাকে ছাড়া একা হয়ে যাব। তুমি কি আমার সাথে আসবে?’

 

সে নির্বিকার স্বরে জবাব দিল, ‘অবশ্যই আমি তোমার সাথে যাব। আমি জন্মজন্মান্তরে তোমার সাথে যাব সব সময়।’

 

প্রথমস্ত্রীকে বলা হয় ‘কর্ম । দ্বিতীয় স্ত্রীর নাম হলো ‘পরিবার’। তৃতীয় স্ত্রী ছিল ‘ধনসম্পদ’। চতুর্থ স্ত্রী ছিল ‘যশখ্যাতি’।

 

প্লিজ, গল্পটা আরেকবার পড়ুন, এখন যেহেতু আপনি চারটি স্ত্রীকে জানেন।

কোন স্ত্রীকে সবচেয়ে বেশি যত্ন নেওয়া দরকার? আপনার মৃত্যু হলে কে আপনার সাথে যাবে?

 

ধাক্কা খাওয়া

থাইল্যান্ডে আমার প্রথমবছরে আমাদের ছোট একটা ট্রাকে করে এক বিহার থেকে আরেক বিহারে নিয়ে যাওয়া হতো। সিনিয়র ভিক্ষুরা সামনে ড্রাইভারের পাশে ভালো সিটে বসত। আমরা জুনিয়র ভিক্ষুরা বসতাম ট্রাকের পিছনে, কাঠের বেঞ্চের উপরে। বেঞ্চের উপরে ছিল নিচু লোহার ফ্রেম। তার উপরে

তেরপাল দিয়ে ঢাকা দেওয়া, ধুলো ও বৃষ্টি থেকে রক্ষার জন্য।

 

রাস্তাগুলো ছিল সব কাঁচা, অযত্ন অবহেলায় বেহাল দশা। যখন চাকাগুলো খাদে পড়ত, ট্রাকটা নিচে নামত আর পিছনে ভিক্ষুরা উপরে উঠে যেত। ঠুস! অনেকবার আমার মাথাটা এই শক্ত লোহার ফ্রেমে ধাক্কা খেয়েছে। অধিকন্তু ন্যাড়া মাথার ভিক্ষু হওয়ায় আঘাতের ধাক্কা কমাবার জন্য মাথায় কোনো কিছু

দেওয়ারও উপায় ছিল না। প্রতিবার মাথায় ধাক্কা লাগলে আমি গালাগালি শুরু করতাম, অবশ্যই ইংরেজিতে, যাতে থাই ভিক্ষুরা বুঝতে না পারে। কিন্তু থাই ভিক্ষুরা তাদের মাথায় ধাক্কা লাগলে খালি হাসত। আমি ভেবে কুলকিনারা পেতাম না, মাথায় এমন ব্যথা পেলে হাসি আসে কীভাবে? আমি মনে মনে ভাবতাম, এই থাই ভিক্ষুরা ইতিমধ্যেই মাথায় এত বেশি আঘাত পেয়েছে যে তাদের মাথার স্ক্রু ঢিলে হয়ে গেছে।

 

আমি যেহেতু একজন বিজ্ঞানী ছিলাম, তাই আমি একটা পরীক্ষা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমি হাসার সংকল্প করলাম থাই ভিক্ষুদের মতো। এর পরের বার মাথায় বাড়ি লাগলেই হাসব, দেখব কেমন লাগে। আপনি কি জানেন, আমি কী আবিষ্কার করেছিলাম?

আমি দেখেছিলাম যে মাথায় আঘাত পেলে আপনি যদি হাসেন, তাহলে ব্যথা অনেক কম হয়। হাসির ফলে আপনার রক্তস্রোতে এন্ডোরফিনস নিঃসৃত হয় যা প্রাকৃতিক ব্যথানাশক। এটি আপনার রোগপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকেও সুদৃঢ় করে এবং ইনফেকশন হওয়া থেকে রক্ষা করে। তাই ব্যথা পেলে হাসাটা বেশ কাজের। যদি আপনি এখনো আমার কথা বিশ্বাস না করেন, তাহলে পরের বার মাথায় বাড়ি খেলে হাসার চেষ্টা করুন।

 

অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে যে যখন জীবন ব্যথাময় হয়, তখন যদি আপনি এর মজার দিকগুলো খুঁজে নিয়ে হাসতে পারেন, তাহলে ব্যথা অনেক কম হয়।

 

গুবরে পোকা ও তার আকষর্ণীয় গোবরের স্তুপ

কিছু কিছু লোক ঝামেলা থেকে মুক্ত হতে চায় না। যদি তাদের নিজস্ব কোনো উদ্বিগ্ন হওয়ার ব্যাপার না থাকে, তাহলে তারা টেলিভিশনের কাল্পনিক চরিত্রগুলোর ঝামেলাগুলো নিয়ে মাথা ঘামাতে থাকে। অনেকে উদ্বেগকে প্রেরণাদায়ী মনে করে। মনে করে, যা কষ্টের, তা-ই ভালো, তা-ই মজার। তারা সুখী হতে চায় না। কারণ, তারা তাদের দুঃখের বোঝাগুলো নিয়ে খুব বেশি সংশ্লিষ্ট।

 

দুজন বন্ধু সারা জীবন ধরে খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। মৃত্যুর পরে তাদের একজনস্বর্গে দেবতা হিসেবে, আরেকজন গোবরের স্ত্তপে গুবরে পোকা হিসেবে জন্ম নিল।

দেবতা শীঘ্রই তার বন্ধুর অভাব বোধ করতে লাগল, আর মনে মনে ভাবল কোথায় সে জন্মেছে। সে যে স্বর্গে জন্মেছে, সেখানে কোথাও তার বন্ধুকে খুঁজে

পেল না। তাই সে অন্যান্য স্বগের্ও দিব্যদৃষ্টি নিক্ষেপ করল। কিন্তু তার বন্ধুর দেখা সেখানেও মিলল না। এবারে সে মানবজগতে মানুষদের মাঝে খুঁজে দেখল তার দিব্যদৃষ্টি দিয়ে, কিন্তু সেখানেও তাকে খুঁজে পেল না। নিশ্চয়ই তার বন্ধু পশুপাখির জগতে জন্ম নেয় নি। কিন্তু সে তবুও নিশ্চিত হতে চাইল। তবে সেখানেও তার আগের জন্মের বন্ধুর খোঁজ মিলল না। তাই এবার সেই দেবতা বুকে হেঁটে চলা কীটপতঙ্গের জগতে তার দিব্যদৃষ্টি নিক্ষেপ করল। আর অবাক করা ব্যাপার। তার বন্ধুকে সে খুঁজে পেল দুর্গন্ধযুক্ত এক গোবরের স্ত্তপের মধ্যে গুবরে পোকারূপে! বন্ধুত্বের বাঁধন এত শক্ত যে মরণের পরেও তা টিকে থাকে। দেবতা তার পুরনো বন্ধুকে এমন দুর্ভাগ্যজনক জন্মের কবল থেকে উদ্ধার করবে বলে মনস্থির করল।

 

তাই সে স্বর্গ থেকে নেমে এসে দুর্গন্ধযুক্ত গোবরের স্ত্তপের সামনে এসে ডাক দিল, ‘এই যে, গুবরে পোকা! আমাকে মনে আছে? আমরা অতীত জন্মে দুজন ভিক্ষু ছিলাম, আর তুমি ছিলে আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু। আমি যেখানে সুন্দর স্বর্গে জন্ম নিয়েছি, সেখানে তোমার জন্ম হয়েছে পেট উল্টে আসা এই দুর্গন্ধযুক্ত গোবরের স্ত্তপে। তবে চিন্তা করো না। আমি তোমাকে আমার সাথে করে স্বর্গে নিয়ে যাব। এসো, হে বন্ধু!’ পোকাটা বলল, ‘একটু দাঁড়াও! তুমি যে এই স্বর্গর্লোক সম্পর্কে কিচির মিচির করে জানাচ্ছ, সেখানে এত মজার কী আছে? আমি এখানে পুষ্টিকর গরুর গোবরের সুগন্ধের মধ্যে ভালোই আছি। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।’

 

‘তুমি বুঝছ না।’ দেবতা এবার তাকে স্বর্গের সুখ ও আনন্দজনক বিষয়গুলো তাকে বুঝিয়ে বলল।

 

‘উপরে সেখানে কি তাহলে গোবর আছে?’ পোকাটা মূল বিষয়ে এলো।

 

‘অবশ্যই নয়!’ নাক সিঁটকাল দেবতা।

 

‘তাহলে আমি যাচ্ছি না!’ পোকাটা দৃঢ় গলায় বলল। ‘দূর হও এখান থেকে!’ এই বলে সে হামাগুড়ি দিয়ে গোবরের স্ত্তপের মাঝে ঢুকে গেল।

 

দেবতা ভাবল যে পোকাটাকে ধরে স্বর্গে নিয়ে গিয়ে দেখালে তবেই সে বুঝবে। তাই দেবতা নাক কুঁচকে তার কোমল হাতটা সেই জঘন্য গোবরের স্ত্তপে ঢুকিয়ে পোকাটাকে হাতড়াল। সে তাকে খুঁজে পেয়ে টেনে বের করে আনতে লাগল।

 

‘হেই! আমাকে একা থাকতে দাও!’ পোকাটা চেঁচিয়ে উঠল। ‘বাঁচাও! আমার সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে! আমাকে অপহরণ করা হচ্ছে। বাঁচাও!!’ ছো্ট্ট পিচ্ছিল পোকাটি দেহ বাঁকিয়ে মুচড়ে নিজেকে দেবতার কবল থেকে মুক্ত করল, আর গোবরের স্ত্তপে ঝাঁপ দিয়ে লুকাল।

 

দয়ালু দেবতা আবার তার আঙুলগুলোকে দুর্গন্ধে ভরা সেই গোবরের স্ত্তপে ঢুকিয়ে দিল। পোকাটিকে খুঁজে পেল আর আরেকবার তাকে টেনে বের করার

চেষ্টা চালাল। দেবতা প্রায় তাকে বের করে এনেছিল। কিন্তু পোকাটি নরম গোবরে মাখামাখি হয়ে গিয়েছিল, আর যেতে ইচ্ছুক ছিল না মোটেও। তাই এটি দ্বিতীয়বারের মতো পালাল এবং গোবরের আরও গভীরে গিয়ে লুকাল। গুণে গুণে একশ আটবার দেবতা বেচারা পোকাটাকে সেই জঘন্য গোবরের স্তুপ থেকে বের করার চেষ্টা করল। কিন্তু পোকাটা তার সেই প্রিয় গোবরের প্রতি এমন আসক্ত ছিল যে সে প্রতিবারই দেহ মুচড়ে নিজেকে মুক্ত করে নিয়ে আবার গোবরের মধ্যে ঢুকে গেল!

 

তাই অবশেষে দেবতাকে হাল ছেড়ে দিয়ে স্বর্গে ফিরে যেতে হলো, আর বোকা পোকাটাকে তার প্রিয় গোবরের স্ত্তপে রেখে যেতে হলো। এভাবেই এই বইয়ে একশ আটটি গল্পের পরিসমাপ্তি ঘটল।