যদি দয়াকে একটা সুন্দর পায়রা হিসেবে কল্পনা করা হয়, তাহলে প্রজ্ঞা হচ্ছে তার ডানা। প্রজ্ঞাহীন দয়া কখনোই কাজে আসে না।
একজন বয় স্কাউট দিনের ভালো কাজটা করল একজন বৃদ্ধা মহিলাকে ব্যস্ত সড়ক পার করিয়ে দিয়ে। সমস্যাটা ছিল, বৃদ্ধা মহিলাটি রাস্তা পার হতে চায় নি। কিন্তু লজ্জায় সে তা মুখ ফুটে বলতে পারে নি।
দুর্ভাগ্যক্রমে উপরের গল্পটা আমাদের ভালোভাবে বলে দেয় যে পৃথিবীতে এখন দয়ার নামে এসব কী হচ্ছে। আমরা প্রায়ই ধরে নিই যে অন্যদের কী প্রয়োজন সেটা আমাদের জানা আছে। এক তরুণ, জন্ম থেকে বধির, সে তার নিয়মিত চেক আপের জন্য তার বাবা-মায়ের সাথে এক ডাক্তারের কাছে গেল। ডাক্তার খুব আগ্রহভরে কোনো এক মেডিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত নতুন এক চিকিৎসা পদ্ধতির কথা তার বাবা মাকে জানাল। জন্ম থেকে বধির এমন
লোকদের দশ শতাংশকে একটি সাধারণ, স্বল্পব্যয়ী অপারেশনের মাধ্যমে তাদের পূর্ণ শ্রবণক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়া যায়। সে তরুণটির বাবা-মাকে জিজ্ঞেস করল, তারা এটি চেষ্টা করে দেখবে কি না। তারা তাড়াতাড়ি সায় দিল এই প্রস্তাবে।
সেই তরুণটি ছিল শতকরা দশজনের একজন, যে তার শ্রবণক্ষমতা পুরোপুরি ফিরে পেল। কিন্তু সে তার বাবা-মা ও ডাক্তারের প্রতি অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হয়ে গেল। চেক আপের সময় ডাক্তার ও তার বাবা-মা কী ব্যাপারে আলাপ করেছিল তা সে শোনে নি। সে শুনতে চায় কি না, তাও কেউ জিজ্ঞেস করে নি। এখন সে অভিযোগ করছে যে তাকে সব সময় অপ্রয়োজনীয় শব্দের যন্ত্রণা সহ্য করতে হচ্ছে, যার কোনো মানে হয় না। গোড়া হতেই সে কখনো শুনতে চায় নি।
তার বাবা-মা, ডাক্তার ও আমি নিজে, এই গল্পটি পড়ার আগে, ধরে নিয়েছিলাম যে সবাই শুনতে চায়। আমরা যা জানতাম, ঠিকই জানতাম। এমন ধারণায় পূর্ণ যে দয়া ও মৈত্রী, তা বোকামি ও বিপদজনক। এটা জগতে অনে দুঃখকষ্টের সৃষ্টি করে।
বাবা-মাদের নিয়ে ঝামেলাটা হচ্ছে তারা সব সময় মনে করে তাদের সন্তানের প্রয়োজনটা তারাই সবচেয়ে ভালো জানে। কিন্তু প্রায়ই তারা এখানে ভুল করে। মাঝে মধ্যে তাদেরটা সঠিক হয় বটে, যেমনটা চাইনিজ কবি সু তুং পো (১০৩৬- ১১০১) প্রায় এক হাজার বছর আগে তার এক কবিতায় বলেছিলেন
:আমার সমত্মানের জন্মক্ষণে পরিবারে, যখন একটা শিশুর জন্ম হয়, তারা চায়, সে হবে বুদ্ধিমান।
আমি, এত বুদ্ধিমান হয়ে ধ্বংস করলাম আমার সারাটা জীবন। আমার কেবল একটাই আশা,
শিশুটি প্রমাণ করুক সে মুর্খ ও বোকা। এতে করে সে একটা নিরিবিলি জীবন পাবে, হবে একজন সরকারি মন্ত্রী।
আমি যখন ছাত্র ছিলাম, সেই সময়ে বেশির ভাগ গ্রীষ্মের ছুটিগুলো কাটাতাম স্কটল্যান্ডের পাহাড়ি এলাকায় হেঁটে বেড়িয়ে এবং ক্যাম্পিং করে। স্কটিশ পাহাড়গুলোর নির্জনতা, সৌন্দর্য ও প্রশান্তি আমাকে আনন্দিত করত।
এক স্মরণীয় বিকেলে আমি সাগর পাড় ঘেঁষে চলে যাওয়া এক ছোট্ট রাস্তা ধরে হাঁটছিলাম, যা এঁকেবেঁকে বহু দূরে পাহাড়ের মাঝে হারিয়ে গেছে। উজ্জ্বল সূর্যালোক একটা স্পটলাইটের মতো আমার চারপাশের অসাধারণ সৌন্দর্যকে দৃশ্যমান করে তুলেছে। দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ জুড়ে ছেয়ে আছে বসন্তের কোমল সতেজ সবুজ ঘাস। খাড়া পাহাড়ের ঢালগুলো যেন সাগর ফুঁড়ে উঠে যাওয়া গির্জার চূড়া, পড়ন্ত বিকেলে সাগর তখন নীল, এটি যেন সূর্যরশ্মিতে ঝিকিমিকি
করে ওঠা তারার মেলা। ছোট ছোট সবুজ ও বাদামী পাথরের দ্বীপগুলো দিগন্তের পাড়ে হারিয়ে যাওয়া ঢেউয়ের সাথে খেলায় মেতেছে। সী-গাল এবং টার্ন নামের সামুদ্রিক পাখিগুলোও উড়ছে আর ডিগবাজি খাচ্ছে, সেটা যে তুমুল খুশিতে, এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। এটি ছিল এক রোদেলা দিনে আমাদের এই পৃথিবীর সেরা দর্শনীয় জায়গাগুলোর একটাতে প্রকৃতির অপূর্ব শোভার এক অনুপম প্রদর্শনী। পিঠে আমার ভারী ব্যাকপ্যাক থাকা সত্তেও খুশিতে আমি যেন লাফাচ্ছিলাম।
প্রকৃতির ছোঁয়ায় আমি ছিলাম আনন্দে ভরপুর। আমার সামনে রাস্তার ধারে পার্ক করা ছিল একটা ছোট গাড়ি। আমি কল্পনা করলাম, এর ড্রাইভারও নিশ্চয়ই চারপাশের এমন মনোমুগ্ধকর দৃশ্যে বিমোহিত, তাই গাড়ি থামিয়ে এর সৌন্দর্যসুধা পানে ব্যস্ত একটু কাছে গিয়ে আসল ব্যাপার দেখে আমি মনে মনে ক্ষুদ্ধ হয়ে উঠলাম। গাড়িটার একজন মাত্র যাত্রী, সে একটা সংবাদপত্র পড়ছে।
সংবাদপত্রটা এত বড় যে এটি তাকে তার চারপাশের দৃশ্য থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে। সাগর, পাহাড়, দ্বীপ ও দিগন্ত বিস্তৃত তৃণভূমির বদলে
লোকটা কেবল দেখছিল যুদ্ধ, রাজনীতি, কেলেঙ্কারি ও খেলাধুলা। সেই সংবাদপত্রটা বড় হতে পারে; কিন্তু খুব পাতলা, মাত্র কয়েক মিলিমিটার পুরু। কালো শুষ্ক নিউজপ্রিন্টের ওপাশে ছড়িয়ে আছে রঙধনুর রঙে ঝলমল করা প্রকৃতির উল্লাস। আমি ভাবলাম, ব্যাগ থেকে কাঁচি বের করে তার কাগজে ছোট একটা ফুটো করে দিলে কেমন হয়, যাতে করে সে দেখতে পারে, অর্থনীত সেই নিবন্ধ, যেটা সে পড়ছিল, তার ওপাশে কী আছে। কিন্তু সে ছিল বড়সড়
লোমশ স্কটসম্যান, আর আমি একজন রোগাপটকা হাড্ডিসার ছাত্র। তাকে জগৎ সম্পর্কে পড়তে দিয়ে আমি নেচে নেচে এগিয়ে গেলাম।
আমাদের বেশির ভাগ অংশই সংবাদপত্রের মতো এমন বিষয় নিয়ে ভর্তি থাকে : সম্পর্কে টানাপোড়েন, পরিবার এবং কাজের ক্ষেত্রে রাজনীতি, ব্যক্তিগত
কেলেঙ্কারি, আর পাশবিক আনন্দের খেলাধুলা। যদি আমরা আমাদের মনের এই সংবাদপত্রটাকে সময়ে সময়ে নামিয়ে রাখতে না জানি, আমরা যদি তা নিয়েই মেতে থাকি, আমরা যদি সেটাই জানি, তাহলে আমরা কখনোই প্রকৃতির সেই অকৃত্রিম ও খাঁটি সুখ-শান্তি উপভোগ করতে পারব না। আমরা কখনোই প্রজ্ঞাকে চিনতে পারব না।
আমার বন্ধুদের মধ্যে কয়েকজন বাইরে খাওয়া পছন্দ করে। কোনো কোনো সন্ধ্যায় তারা খুব দামী কোনো রেস্তোরায় যায়, যেখানে তারা অসাধারণ সব
খাবারের জন্য প্রচুর টাকা ঢালতে প্রস্তুত। কিন্তু খাবারের স্বাদ উপভোগ না করে সঙ্গী-সাথীদের সাথে কথাবার্তায় মন দিয়ে তারা খাবারের মজাটাই নষ্ট করে।
দারুণ কোনো অর্কেস্ট্রা চলাকালে কে কথা বলবে?
আপনার বকবকানি এমন সুমধুর সঙ্গীত উপভোগের পথে একটা বাধা হয়ে দাঁড়াবে, আর খুব সম্ভবত আপনাকে বাইরে বের করে দেবে। এমনকি কোনো
দারুণ মুভি দেখার সময়ও আমরা চাই না কেউ আমাদের বিরক্ত করুক। তাহলে লোকেরা খাওয়ার সময় কেন বাজে আলাপে ব্যস্ত থাকে?
যদি রেস্তোরাটা সাধারণ মানের হয়, তাহলে নিরস খাবার থেকে মন সরিয়ে নেওয়ার জন্য কথাবার্তা শুরু করা একটা ভালো বিকল্প হতে পারে। কিন্তু যখন খাবারটা খুব সুস্বাদু হয় আর খুব দামী হয়, তখন আপনার সঙ্গীকে চুপচাপ থাকতে বলাটা আপনার পুরো টাকাটা উসুল করে নেওয়ার জন্য মঙ্গলদায়ক। নিরবে খাওয়ার সময়ও আমরা প্রায়ই খাওয়ার আনন্দদায়ক মুহূর্তটাকে উপভোগ করতে ব্যর্থ হই। খাবার চিবানোর সময়ে আমাদের মন পড়ে থাকে এর পরে কী খাবো, কোনটা খাবো তা নিয়ে। কেউ কেউ তো পরবর্তী দুই তিন গ্রাসের খাওয়ার প্ল্যান করে বসে থাকে, এক গ্রাস নিজের মুখে, আরেক গ্রাস হাতে ধরা, আরেক গ্রাস তখন প্লেটে রেডি, আর মন তখন ভাবনায় ব্যস্ত তৃতীয় গ্রাসের পরে কী খাবে তা নিয়ে।
আমাদের খাবারের স্বাদ উপভোগের জন্য আর জীবনের পূর্ণতাকে জানতে আমাদের একবারে একেক মুহূর্ত নিরবে উপভোগ করা উচিত। তাহলেই আমরা জীবন নামের এই ফাইভ স্টার হোটেলে টাকার যথাযথ মূল্যের সেবা পেতে পারি।
বৌদ্ধ ভিক্ষু হিসেবে প্রায়ই আমাকে রেডিওতে লাইভ টক শোগুলোতে কথা বলতে হয়। সম্প্রতি এক রেডিও স্টেশন থেকে তাদের রাতের অনুষ্ঠানে কথা বলতে আমাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমার অবশ্য আরেকটু খোঁজখবর নিয়ে আমন্ত্রণটা গ্রহণ করা উচিত ছিল। স্টুডিওতে ঢোকার পরে তবেই আমাকে বলা হলো, আজকের প্রোগ্রামটা হচ্ছে ‘প্রাপ্তবয়স্কদের বিষয়’ নিয়ে। আমাকে সরসরি আজ শ্রোতাদের প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। আমার সাথে থাকবে একজন বেশ নামকরা, পেশাদার যৌন বিশেষজ্ঞ!
বিপত্তি দেখা দিল আমার নামের উচ্চারণ নিয়ে। অবশেষে সমাধান এলো, আমাকে সম্বোধন করা হবে মিস্টার মংক, অর্থাৎ জনাব ভিক্ষু নামে। তো,
অনুষ্ঠানে আমি খুব ভালোভাবে উতরে গেলাম। আমি ব্রহ্মচারী ভিক্ষু। নারী- পুরুষের অন্তরঙ্গ বিষয়গুলো খুব কমই জানি। কিন্তু প্রশ্নকারীদের সমস্যাগুলোর পিছনের কারণগুলো খুব সহজেই বুঝতে পারছিলাম আমি। শীঘ্রই সমস্ত ফোন কলগুলো আমাকে উদ্দেশ্য করে করা হতে লাগল। আর আমি দু ঘণ্টার টকশোর বেশির ভাগ উত্তর দিতে দিতে বেশ হাঁপিয়ে উঠলাম। অথচ মোটা অঙ্কের চেকটা গেল পেশাদার যৌন বিশেষজ্ঞের ঘরে। ভিক্ষু হওয়ায় আমি তো আর টাকা- পয়সা গ্রহণ করতে পারি না। তাই সর্বসাকুল্যে পেলাম একটা চকোলেট বার।
বৌদ্ধ জ্ঞানের আলোয় সমস্যা আরেকবার সমাধান হয়ে গেল। আপনি তো আর চেক খেতে পারবেন না। তাই সুস্বাদু চকোলেট বার খান। সহজ সমাধান। হুম! অন্য একবার রেডিওতে এমন অনুষ্ঠানের সময়ে এক শ্রোতা আমাকে প্রশ্ন করল, ‘আমি বিবাহিত। আরেক মেয়ের সাথে আমার সম্পর্ক আছে যা আমার স্ত্রী জানে না। এটা কি ঠিক?’ আপনি এর উত্তরে কী বলবেন?
আমি জবাব দিলাম, ‘যদি এটা ঠিক হতো, আপনি আমাকে এই প্রশ্ন করার জন্য ফোন করতেন না।’
অনেকেই এমন প্রশ্ন করে বসে। তারা জানে যে তারা যা করছে তা ঠিক নয়। কিন্তু তাদের আশা যে, কোনো ‘বিশেষজ্ঞ’ তাদের বলে দেবে কাজটা ঠিক। মনের গভীরে বেশির ভাগ লোকই জানে কোনটা সঠিক, কোনটা ভুল। তবে কেউ কেউ মন দিয়ে শোনে না।
এক সন্ধ্যায় আমাদের বুড্ডিস্ট সেন্টারের ফোন বেজে উঠল। রাগী গলায় একজন জিজ্ঞেস করল, ‘আজান ব্রাহ্ম আছে?’ ফোন ধরেছিল একজন শ্রদ্ধাবতী এশিয়ান মহিলা। সে জবাব দিল, ‘দুঃখিত, তিনি এখন তার রুমে বিশ্রাম নিচ্ছেন। ত্রিশ মিনিট পরে ফোন করুন, প্লিজ।’
‘গররর! সে ত্রিশ মিনিটের মধ্যে মারা যাবে।’ গর্জে উঠল অন্যজন আর খুট করে ফোন কেটে দিল।
বিশ মিনিট পরে আমি রুম থেকে বের হলাম। প্রৌঢ়া এশিয়ান মহিলাটি তখনো ফ্যাকাসে মুখে চেয়ারে বসে কাঁপছিল। অন্যরা তার চারপাশে জড়ো হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করছিল কী হয়েছে, কিন্তু সে এমন ভয় পেয়েছিল যে কথাও বলতে পারছিল না। আমি একটু মিষ্টি স্বরে তাকে অনুরোধ করতেই সে বলার সাহস পেল, ‘কেউ একজন আপনাকে খুন করতে আসছে!’
আমি অনেক দিন ধরে এক অস্ট্রেলিয়ান যুবককে পরামর্শ দিতাম। তার এইডস রোগ ধরা পড়েছিল। আমি তাকে ধ্যান করা শিখিয়েছিলাম। আরও শিখিয়েছিলাম কী করে বিজ্ঞতার সাথে পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। এখন তার মৃত্যু আসন্ন। আমি গতকালই তাকে দেখতে গিয়েছিলাম, আর তার সঙ্গীর কাছ থেকে যেকোনো সময় একটা ফোনের আশায় ছিলাম। তাই আমি তাড়াতাড়ি বুঝে নিলাম ফোনকলটা কীসের। আমি নই, সেই এইডসে আক্রান্ত তরুণটিই মারা যাবে ত্রিশ মিনিটের মধ্যে।
আমি তার বাড়িতে ছুটলাম, আর মৃত্যুর আগেই তার সাথে দেখা করতে পারলাম। সৌভাগ্যবশত ব্যাপারটা আমি সেই আতঙ্কিত হওয়া এশিয়ান মহিলাটিকেও বুঝিয়ে দিয়েছিলাম, তা না-হলে ভয়ে সে মরেই যেত।
কতবার এমন হয় যে, যা বলা হয় আর আমরা যা শুনি, তা এক নয়?
কয়েক বছর আগে থাই ভিক্ষুদের নিয়ে কয়েকটি কেলেঙ্কারির কথা আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমে দেখা গিয়েছিল। নিয়ম অনুসারে, ভিক্ষুদের কঠোরভাবে ব্রহ্মচর্য পালন করতে হয়। আমি যে ভিক্ষুসংঘের অন্তর্ভুক্ত, তাতে ভিক্ষুরা কোনো মহিলাকে শারীরিক স্পর্শ পর্যন্ত করতে পারে না। কৌমার্যব্রত সম্পর্কে যাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ না থাকে। ভিক্ষুণীদেরও কোনো পুরুষকে স্পর্শ করা নিষিদ্ধ। সংবাদ মাধ্যমে যে সমস্ত কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হয়েছিল সেগুলোতে বলা হয়েছিল যে কিছু কিছু ভিক্ষু তাদের নিয়ম রক্ষা করে নি। তারা ছিল দুষ্ট ভিক্ষু। সংবাদ মাধ্যমগুলো জানত যে, তাদের পাঠকরা দুষ্ট ভিক্ষুদের সম্বন্ধে আগ্রহী। বিরক্তিকর, নিয়ম পালনকারী ভিক্ষুদের সম্বন্ধে নয়।
এসব ঘটনার সময় আমি মনে করলাম, আমার নিজেরও এই বিষয়ে স্বীকারোক্তি দেওয়া উচিত। তাই এক শুক্রবার সন্ধ্যায় পার্থে আমাদের বিহারে প্রায় তিনশত লোকের সামনে, তাদের অনেকেই ছিল আমাদের দীর্ঘদিনের সমর্থক, তাদের সামনে এই সত্যটা তুলে ধরার সাহস সঞ্চয় করলাম।
আমি শুরু করলাম, ‘আমার একটা স্বীকারোক্তি দেওয়া দরকার, যদিও কথাটা সহজ নয়। কয়েক বছর আগে...’ আমি বলতে গিয়ে ইতস্তত করলাম।
‘... কয়েক বছর আগে,’ আমি কোনোমতে বলতে লাগলাম, ‘আমি আমার জীবনের কয়েকটা সবচেয়ে সুখময় মুহূর্ত কাটিয়েছি...’ আমাকে আবার একটু
থামতে হলো, ‘আমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুখময় মুহূতর্গুলো কাটিয়েছিলাম... অন্য এক লোকের স্ত্রীর ভালেবাসাময় আলিঙ্গনের মধ্যে।’ আমি
সেটা বলে ফেললাম। আমি স্বীকারোক্তি দিলাম।
‘আমরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরেছিলাম, আদর দিয়েছিলাম, চুমু দিয়েছিলাম।’ আমি কথা বলা শেষ করে মাথা হেঁট করে কার্পেটের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
আমি শুনতে পাচ্ছিলাম বিস্ময়ে শ্রোতাদের মুখ দিয়ে বাতাস টেনে নেয়ার শব্দ। হতবাক হয়ে যাওয়া মুখে হাত চাপা দেওয়ার অস্ফুট শব্দ। কয়েকটা ফিসফিস কথা শুনলাম, ‘না! না! আজান ব্রাহ্ম হতে পারেন না।’ আমি কল্পনা করলাম অনেক দীর্ঘদিনের সমর্থকও দরজার দিকে হাঁটা ধরেছে, আর কখনো ফিরবে না তারা। গৃহী বৌদ্ধরাও তো অন্যজনের স্ত্রীর সাথে যায় না। এ যে রীতিমতো ব্যভিচার! আমি মাথা তুলে আত্মবিশ্বাস নিয়ে শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলাম।
আমি কেউ দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার আগেই ব্যাখ্যা করলাম, ‘সেই মহিলা, হ্যাঁ সেই মহিলাটি ছিল আমার মা। আমি তখন শিশু ছিলাম।’ আমার
শ্রোতারা হাসিতে ফেটে পড়ল, আর স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
আমি হইহুল্লোড়ের মাঝে মাইক্রোফোনে চিৎকার করলাম, ‘এটা সত্যিই তো!
সে ছিল অন্যজনের স্ত্রী। আমার বাবার স্ত্রী। আমরা একে অপরকে জড়িয়ে ধরেছিলাম, আদর দিয়েছিলাম, চুমু দিয়েছিলাম। সেগুলো ছিল আমার জীবনের কয়েকটা সুখী মুহূর্ত ’
শ্রোতাদের চোখের পানি মোছার পালা শেষ হলে, আর হাসির পর্ব সমাপ্ত হলে আমি দেখিয়ে দিলাম যে, তাদের প্রায় সবাই আমাকে বিচার করেছে, কিন্তু ভুলভাবে বিচার করেছে। যদিও তারা আমার নিজের মুখ থেকেই শুনেছে কথাগুলো। আর কথাগুলো ব্যাখ্যাতীতভাবে সুস্পষ্ট ছিল। তবুও তারা ভুল সিদ্ধান্তটাকেই গ্রহণ করেছিল। সৌভাগ্যবশত, অথবা বলা যায়, খুব প্ল্যান মাফিক বলেছি বলেই, আমি তাদের ভুলটা ধরিয়ে দিতে পেরেছি। আমি তাদের জিজ্ঞেস করেছি, ‘কতবার, কতবার আমাদের এমন সৌভাগ্য হয় নি আর সরাসরি এমন সব উপসংহারে পৌঁছে গেছি, যা পরিস্থিতি দেখে খুব সত্যি বলে মনে হলেও আসলে কেবল ভুল, মারাত্মকভাবে ভুল একটা উপসংহার ছিল?’
‘এটাই সঠিক, বাকি সব ভুল।’ এভাবে সবকিছু বিচার করাটা প্রজ্ঞা নয়।
আমাদের রাজনীতিবিদদের খোলাখুলি হওয়া নিয়ে বেশ খ্যাতি আছে। বিশেষ করে তাদের নাক ও থুতনির মাঝখানের অংশটা খোলাই থাকে। এটা বহু শতাব্দী ধরেই একটা ঐতিহ্য হিসেবে চলে আসছে। বৌদ্ধ জাতক কাহিনী থেকে আমরা নিচে এমন একটা গল্পের নমুনা পাই।
বহু শতাব্দী আগে এক রাজা তার এক মন্ত্রীকে নিয়ে হাফিয়ে উঠেছিলেন। রাজদরবারে যখনই কোনো বিষয়ে আলোচনা শুরু হতো, এই মন্ত্রী সেখানেই তার বক্তৃতা শুরু করে দিত, যা মনে হতো এই জনমেও শেষ হবার নয়। তার কথার মাঝে কেউই কথা বলার সুযোগ পেত না, এমনকি স্বয়ং রাজাও নয়। অধিকন্তু মন্ত্রী যা বলত তা এমন নিরস ছিল যে পিংপং বলের ভেতরটা দেখাও এর থেকে অনেক মজার বলে মনে হতো।
এমন একটা বিফল আলোচনার পরে, রাজা তার রাজদরবার থেকে দূরে শান্তিতে থাকার জন্য একটা বাগানে চলে গেলেন। বাগানের একটা জায়গায় একদল ছোট ছেলেমেয়ে উৎসাহভরে একটা মধ্যবয়স্ক পঙ্গু লোকের চারপাশে জড়ো হয়েছিল। ছেলেমেয়েরা তাকে কয়েকটা পয়সা দিয়ে একটা পাতাবহুল গাছ দেখিয়ে দিয়ে তার কাছ থেকে মুরগী চাইল। লোকটি তার ব্যাগ থেকে গুলতি ও নুড়ি পাথর বের করে গাছটির দিকে গুলতি ছুঁড়তে শুরু করল। সে দ্রত গুলতি ছুঁড়ে গাছের পাতাগুলো ছেঁটে দিয়ে অল্পক্ষণের মধ্যে গাছটিকে দেখতে মুরগীর মতো করে ফেলল। ছেলেমেয়েরা তাকে আরও কয়েকটা পয়সা দিল। একটা বড় ঝোপ দেখিয়ে দিয়ে হাতি চাইল। লোকটি গুলতি ছুঁড়ে দ্রুত ঝোপটিকে হাতির আকৃতি দিয়ে দিল। ছেলেমেয়েরা খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল, আর রাজা একটা আইডিয়া পেয়ে গেলেন।
রাজা পঙ্গু লোকটার কাছে গিয়ে তাকে প্রস্তাব দিলেন, তিনি তাকে স্বপ্নেরও অতীত ধনী বানিয়ে দেবেন যদি সে একটা ছোট্ট বিরক্তিকর সমস্যার সমাধান করে দিতে পারে। রাজা লোকটার কানে কানে ফিসফিস করে বলে দিলেন কী করতে হবে। লোকটি রাজি হয়ে মাথা ঝাঁকাল। রাজার মুখে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে প্রথমবারের মতো হাসি ফুটে উঠল।
পরের দিন সকালে স্বাভাবিক নিয়মেই রাজদরবারের কাজ আরম্ভ হলো। একপাশের দেয়ালে যে নতুন পর্দা ঝোলানো হয়েছে তা কেউ লক্ষ করল না। সরকার করের পরিমাণ বাড়ানোর বিষয়ে আলোচনা করতে চায়। রাজা যেই না আলোচ্য বিষয়টি বলে দিলেন, অমনি সেই মুখ-চালু মন্ত্রী তার একক বক্তব্য শুরু করল। বলার জন্য মুখ খুলতেই সে অনুভব করল ছোট ও নরম কী যেন একটা গলায় ঢুকে গেল, আর পাকস্থলীতে নেমে গেল। সে তার বক্তব্য চালিয়ে গেল। কয়েক সেকেন্ড পরে নরম ও ছোট্ট কী যেন আবার মুখে ঢুকে গেল। সে এটাকে গিলে ফেলে আবার তার বক্তব্য শুরু করল। বক্তব্যের মাঝে মাঝে সে এভাবে বার বার গিলতে বাধ্য হলো; কিন্তু তাতে তার বলা থামল না। আধ ঘণ্টা ঝাড়া বক্তৃতার সময়ে কয়েক সেকেন্ড পর পর কী যেন গিলতে গিলতে সে খুব, খুব বমি বমি ভাব অনুভব করল। কিন্তু এমন একগুঁয়ে ছিল সে, যে তবুও তার বক্তৃতা থামল না। কয়েক মিনিট পরে তার মুখ রোগগ্রস্ত সবুজ রঙের হয়ে উঠল। তার পেট বমির জন্য মোচড় দিয়ে উঠল এবং অবশেষে সে তার বক্তৃতা শেষ করতে বাধ্য হলো। এক হাতে পেট, আরেক হাতে মুখ চেপে ধরে সে ছুটল কাছাকাছি কোনো বাথরুমের খোঁজে।
আনন্দিত রাজা পর্দাটা টেনে দিয়ে পঙ্গু লোকটিকে বের করে আনলেন যে গুলতি ও এক ব্যাগ গোলাবারুদ নিয়ে পর্দার আড়ালে লুকিয়ে ছিল। রাজা সেই বিরাট ও প্রায় খালি ব্যাগটি দেখে অদম্য হাসিতে ফেটে পড়লেন। ব্যাগটা ছিল মুরগীর বিষ্ঠাতে পূর্ণ যা বেচারা মন্ত্রীর খোলা মুখ লক্ষ করে নিখুঁতভাবে গুলতির সাহায্যে ছুঁড়ে মারা হয়েছে পর্দার আড়াল থেকে।
সেই মন্ত্রী দরবারে কয়েক সপ্তাহ ধরে আসল না। তার অবর্তমানে অনেক অসমাপ্ত আলোচনা শেষ করা গেল। যখন সে ফিরল, তখন বলতে গেলে একটা শব্দও বলল না। আর যখন তাকে বলতে হতো, সে সব সময় তার ডান হাতটা মুখের সামনে ধরে রাখত।
সম্ভবত, এই যুগের সংসদগুলোতে এমন নিখুঁত গুলতি নিক্ষেপকারী থাকলে অনেক কাজ হয়ে যেত।
হয়তো আমাদের জীবনের শুরুতেই নিরব থাকতে শেখা উচিত। এটা পরবর্তীকালে অনেক ঝামেলা এড়াতে সাহায্য করতে পারে। যেসব ছেলেমেয়ে আমাদের বিহারে আসে, আমি তাদের নিরব থাকার গুরুত্বটা বুঝাতে গিয়ে নিচের গল্পটা বলি।
অনেক দিন আগের কথা। কোনো এক পাহাড়ের পাদদেশে এক হ্রদে বাস করত এক বাচাল কচ্ছপ। যখনই তার অন্য কোনো প্রাণীর সাথে পরিচয় হতো,
সে তাদের সাথে এত বেশি কথা বলত, আর এত দীর্ঘ সময় ধরে এবং বিরতিহীনভাবে কথা বলত যে, তার শ্রোতারা বিরক্ত হতো, এর পরে অধৈর্য হয়ে
যেত। তারা প্রায়ই অবাক হত, কী করে এই বাচাল কচ্ছপটা কোনো দম না নিয়েই এত দীর্ঘক্ষণ ধরে কথা বলে! তারা ভাবত, সে নিশ্চয়ই কান দিয়ে নিঃশ্বাস নেয়, কেননা সে কখনোই তার কানগুলোকে শোনার জন্য ব্যবহার করে না। সে এমন বাচাল ছিল যে তাকে আসতে দেখলেই খরগোশগুলো তাদের গর্তে ঢুকে যেত, পাখিরা গাছের মাথায় উড়ে যেত, মাছেরা পাথরের আড়ালে লুকিয়ে যেত। তারা জানত যে বাচাল কচ্ছপটা তাদের সাথে কথা বলা শুরু করলে তারা সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে যাবে। বাচাল কচ্ছপটা আসলে কিছুটা একা ছিল।
প্রতিবছর গ্রীষ্মে এক জোড়া রাজহাঁস সেই হ্রদে উড়ে আসত। তারা বেশ দয়ালু ছিল। কারণ, তারা কচ্ছপটাকে তার খুশিমতো কথা বলতে দিত। অথবা তারা জানত যে তারা তো মাত্র কয়েকমাস থাকবে এখানে। বাচাল কচ্ছপটা রাজহাঁসদের সঙ্গ খুব পছন্দ করত। সে তাদের সাথে কথা বলত যতক্ষণ না আকাশের তারারা নিভে যেত, আর রাজহাঁসরা ধৈর্যসহকারে শুনত তার কথা।
যখন গ্রীষ্মকাল শেষ হয়ে এলো, দিনগুলো ঠান্ডা হতে শুরু করল, রাজহাঁসেরা বাড়ি ফিরে যাওয়ার প্রস্ত্ততি নিল। বাচাল কচ্ছপটা কাঁদতে শরু করল, সে শীতকালকে ঘৃণা করত, আর ঘৃণা করত তার বন্ধুদের সঙ্গ হারানোটা।
সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘হায়, আমি যদি তোমাদের সাথে যেতে পারতাম! মাঝে মাঝে যখন পাহাড়ের ঢাল বরফে ঢেকে যায়, এই হ্রদটাও বরফে ছেয়ে যায়, আমার তখন এমন ঠান্ডা ও একা লাগে। আমরা কচ্ছপরা তো আর উড়তে পারি না। আর যদি হাঁটি, তো কিছুটা পথ যাওয়ার পরেই আবার ফিরে আসার সময় হয়ে যাবে, গরমকাল এসে যাবে। কেননা কচ্ছপরা হাঁটে খুব আস্তে ধীরে।’
দরাজ দিলের অধিকারী রাজহাঁসরা কচ্ছপটির এমন বিষণ্ণতায় খুব মর্মাহত হলো। তারা তাকে একটা প্রস্তাব দিল। ‘প্রিয় কচ্ছপ, তুমি কেঁদো না। আমরা
তোমাকে আমাদের সাথে নিয়ে যেতে পারি। তোমাকে কেবল আমাদের একটা কথা রাখতে হবে।’
‘হ্যাঁ, অবশ্যই, আমি কথা দিচ্ছি।’ বাচাল কচ্ছপটা উত্তেজিত হয়ে বলল, যদিও সে তখনো জানত না কী কথা দিতে হবে। ‘ আমরা কচ্ছপরা সব সময় আমাদের কথা রাখি। আসলে আমার মনে আছে, খরগোশদের আমি মাত্র কয়েক দিন আগে কচ্ছপদের বিভিন্ন ধরনের খোলস সম্বন্ধে বলে কথা দিয়েছিলাম যে এবার থেকে নিরব হওয়ার চেষ্টা করব...’
এক ঘণ্টা পরে যখন বাচাল কচ্ছপটা তার কথা শেষ করল, তখন রাজহাঁসরা আবার কথা বলার সুযোগ পেল এবং তারা বলল, ‘কচ্ছপ, তোমাকে অবশ্যই শপথ করতে হবে যে, তুমি তোমার মুখ বন্ধ রাখবে।’
বাচাল কচ্ছপটা বলে উঠল, ‘সহজ ব্যাপার! আসলে আমরা কচ্ছপরা আমাদের মুখ বন্ধ রাখার জন্য বিখ্যাত। আমরা বলতে গেলে কথাবার্তা বলিই না। আমি সেদিন এই কথাটাই একটা মাছকে বুঝাতে চাইছিলাম...’
আরও এক ঘণ্টা পরে যখন বাচাল কচ্ছপটা দম নেওয়ার জন্য থামল, রাজহাঁসরা তাকে একটা লম্বা কাঠির মাঝখানে কামড়ে ধরে থাকতে বলল। আর পই পই করে বলে দিল যেন মুখ বন্ধ রাখে। এরপর রাজহাঁস দুটো কাঠির দুই মাথা ঠোঁট দিয়ে কামড়ে উড়ার জন্য পাখা ঝাপটাল আর ... কিছুই ঘটল না। বাচাল কচ্ছপটা যে খুব ভারী ছিল। যারা বেশি কথা বলে, তারা বেশি খায়। আর কচ্ছপটা এমন মোটা ছিল যে, মাঝেমধ্যে নিজের খোলেও আটতো না। তখন রাজহাঁসরা হাল্কা একটা কাঠি বেছে নিল। কাঠির মাঝখানটা কচ্ছপ কামড়ে ধরল, দুমাথা কামড়ে ধরল দুই রাজহাঁস। তারা এমনভাবে পাখা ঝাপটাল যে জীবনেও এভাবে পাখা ঝাপটায় নি। এভাবে তারা উপরে উঠে গেল। তাদের সাথে উঠল লাঠি। লাঠির সাথে সাথে উপরে উঠে গেল কচ্ছপটাও।
পৃথিবীর ইতিহাসে এই প্রথ মবারের মতো কোনো কচ্ছপ আকাশে উড়ল। তারা উঁচু থেকে উঁচুতে উঠে গেল। বাচাল কচ্ছপের হ্রদটা ছোট থেকে ছোট
দেখাতে লাগল। এমন কি, এত বিশাল পাহাড়টাকেও এত দূর থেকে খুব ছোট বলে মনে হলো। সে এমন দারুণ দৃশ্য দেখছিল, যা দেখা এর আগে কোনো কচ্ছপের ভাগ্যে জোটে নি। সে সবকিছু মনে রাখার চেষ্টা করছিল। কেননা, বাড়ি ফিরলে সবাইকে এই ভ্রমণের কথা শোনাতে হবে তো!
তারা উড়ে গেল পাহাড়ের পর পাহাড়, সমভূমির পর সমভূমি। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল যখন বিকেল প্রায় তিনটার দিকে একটা স্কুলের ছেলেমেয়েরা হঠাৎ বাইরে বেরিয়ে এলো। একজন ছোট্ট ছেলে কী মনে করে উপরে তাকাল।
সে কী দেখল বলে আপনাদের ধারণা? একটা উড়ন্ত কচ্ছপ!
সে চিৎকার করে তার বন্ধুদের ডাকল, ‘হেই! ওই বোকা কচ্ছপটাকে দেখো তো, উড়ে যাচ্ছে!’
কচ্ছপটা আর নিজেকে সামলাতে পারল না। ‘কাকে তুমি বো... কা ... বলছ!’ ধড়াম করে মাটিতে আঁচড়ে পড়ল বাচাল কচ্ছপ। সেটাই ছিল তার অন্তিম বাণী।
বাচাল কচ্ছপটার মৃত্যু হয়েছিল। কারণ, গুরুত্বপূর্ণ সময়ে সে তার মুখ বন্ধ রাখতে পারে নি।
তাই আপনি যদি যথাসময়ে নিরব থাকতে না শেখেন, তাহলে গুরুত্বপূর্ণ সময় আসলেও মুখ বন্ধ রাখতে পারবেন না। আপনি তখন হয়তো বাচাল কচ্ছপের মতো ছিটকে পড়ে দ্বিখণ্ডিত হয়ে যাবেন।
আমি অবাক হয়ে যাই যে, আমাদের এই আধুনিক বাজার-চালিত অর্থনীতিতে কথা এখনো স্বাধীন। এটি অবশ্যই একটি সময়ের ব্যাপার মাত্র যখন টাকা দিয়ে বাঁধা পড়া সরকার কথাকেও একটি পণ্য বলে ভাববে, আর কথার উপর ট্যাক্স বসাবে।
একটু ভেবে দেখলে, আইডিয়াটা মন্দ নয়। নিরবতা তখন আবার দামী হয়ে উঠবে। কিশোর-কিশোরীরা আর কোনো ফোন নিয়ে মেতে থাকবে না। সুপার মার্কেটের লম্বা লাইনগুলো দ্রুত সরে যাবে। বিয়ে টিকবে দীর্ঘদিন, কেননা নবদম্পতি তর্কাতর্কির খরচটা বহন করতে পারবে না। আর এটা বেশ স্বস্তিদায়ক
যে আপনার পরিচিতদের কারো কারো থেকে যথেষ্ট ট্যাক্স উঠবে, যা দিয়ে কানে শোনার যন্ত্র বিনামূল্যে বিতরণ করা যাবে সেই সমস্ত বধিরদের কাছে, যারা এত দিনের কথার আক্রমণে কানে শোনার ক্ষমতা হারিয়েছে। করের বোঝা তখন কঠোর পরিশ্রমীদের বদলে কঠোর বক্তাদের উপর সরে যাবে। এমন দারুণ কর আদায় প্রকল্পের সবচেয়ে মহান করদাতা হবে রাজনীতিবিদরা। তারা যত বেশি সংসদে বক বক করবে, আমাদের হাসপাতাল ও স্কুলগুলোর জন্য তত বেশি টাকা উঠবে। কী স্বস্তিদায়ক চিন্তা!
সবশেষে, যারা এমন কর আদায়ের পরিকল্পনাকে অবাস্তব বলে ভাবতে চায় তাদের বলছি, কে এই প্ল্যানের বিপক্ষে মনেপ্রাণে বিতর্ক করতে চাইবে?