৫। ব্রাহ্মণবর্গ

ব্রহ্মায়ু সূত্র (৯১)

৩৮৩। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-

এক সময় ভগবান পঞ্চশত ভিক্ষু সমন্বিত মহাভিক্ষুসংঘ সহ বিদেহ প্রদেশে ধর্ম প্রচারার্থ বিচরণ করিতেছিলেন। সেই সময় (এক) জীর্ণ, বৃদ্ধ, মহল্লক (বয়স্ক) সময়গত, বয়ঃপ্রাপ্ত, জন্মেতে বিংশত্যধিক শত (১২০) বর্ষীয় ব্রহ্মায়ু নামক ব্রাহ্মণ মিথিলা সমীপে বাস করিতেন। (তিনি) পঞ্চম ইতিহাস, নিঘণ্টু (অভিধান), কেটুভা (কল্প), অক্ষর-প্রভেদ (শিক্ষা-নিরুক্ত) সহিত তিন বেদের পারগূ , পদজ্ঞ (কবি), বৈয়াকরণ, লোকায়ত (শাস্ত্র) আর মহাপুরুষ-লক্ষণে (সামুদ্রিকে) পূর্ণ অধিকারী ছিলেন। ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ শুনিলেন- “শাক্যকুল প্রব্রজিত শাক্যপুত্র শ্রমণ গৌতম পঞ্চশত ভিক্ষু সমন্বিত মহাভিক্ষুসংঘ সহ বিদেহদেশে ধর্ম প্রচারার্থ বিচরণ করিতেছেন। সেই মাননীয় গৌতমের এই প্রকার কল্যাণজনক কীর্তি-শব্দ বিস্তার হইয়াছে- সেই ভগবান অর্হৎ, সম্যক্‌সম্বুদ্ধ, বিদ্যাচরণ-সম্পন্ন, সুগত, লোকবিদূ, অনুত্তর পুরুষদম্য-সারথী, দেব-মানবের শাস্তা, বুদ্ধ ও ভগবান। তিনি দেব, মার, ব্রহ্মাসহ এই লোক; শ্রমণ-ব্রাহ্মণ, দেব-মনুষ্যসহ জনতাকে স্বয়ং অভিজ্ঞাদ্বারা প্রত্যক্ষ করিয়া প্রচার করিতেছেন। তিনি আদি-কল্যাণ, মধ্য-কল্যাণ, অন্ত-কল্যাণজনক ধর্ম উপদেশ করিতেছেন। তিনি অর্থ-ব্যঞ্জনযুক্ত সর্বাঙ্গ পরিপূর্ণ পরিশুদ্ধ ব্রহ্মচর্য প্রকাশ করিতেছেন, তথাবিধ অর্হতের দর্শন মঙ্গলজনক।”

৩৮৪। সেই সময় ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণের উত্তর নামক মাণব (বিদ্যার্থী) অন্তেবাসী ছিল। (সেও) পঞ্চম ইতিহাস, নিঘণ্টু, কেটুভ, অক্ষর-প্রভেদ সহ ত্রিবেদের পারগূ, পদজ্ঞ, বৈয়াকরণ লোকায়ত আর মহাপুরুষ-লক্ষণে পূর্ণ অধিকারী ছিল। তখন ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ উত্তর-মাণবকে আহ্বান করিলেন,- “তাত উত্তর! এই শাক্যকুল প্রব্রজিত শাক্যপুত্র শ্রমণ গৌতম ...... বিদেহে বিচরণ করিতেছেন। সেই মাননীয় গৌতমের এরূপ কল্যাণ কীর্তি-শব্দ বিস্তার হইয়াছে- ‘...... ব্রহ্মচর্য প্রকাশ করিতেছেন। তথাবিধ অর্হতের দর্শন মঙ্গলজনক।’ এস, বৎস উত্তর! শ্রমণ গৌতম যেখানে আছেন সে স্থানে যাও। তথায় গিয়া শ্রমণ গৌতমকে অনুসন্ধান কর যে- ভগবান গৌতমের যথার্থ কীর্তি-শব্দ বিস্তার হইয়াছে কিংবা অযথার্থ? সেই গৌতম কি তাদৃশ কিংবা তাদৃশ নহে? তোমার দ্বারা আমরা সেই মাননীয় গৌতমকে জানিতে পারিব।”

“কি প্রকারে ভো! আমি সেই গৌতমকে জানিব যে মাননীয় গৌতমের কীর্তি-শব্দ যথার্থ বিস্তার হইয়াছে কিংবা অযথার্থ? সে গৌতম তাদৃশ কিংবা নহে?”

“বৎস উত্তর! আমাদের বেদ-মন্ত্রে বত্রিশ মহাপুরুষ-লক্ষণ আসিয়াছে যদ্বারা যুক্ত মহাপুরুষের দ্বিবিধ গতির অন্যতর গতি হইবে- যদি তিনি আগারে বাস করেন, তবে জনপদে স্থিরতা প্রাপ্ত, চতুরান্ত (পর্যন্ত পৃথিবী) বিজয়ী, সপ্তরত্নের অধিকারী, ধার্মিক ধর্মরাজ চক্রবর্তী রাজা হন। তাঁহার এই সপ্তরত্ন থাকে- (১) চক্ররত্ন, (২) হস্তীরত্ন, (৩) অশ্বরত্ন, (৪) মণিরত্ন, (৫) স্ত্রীরত্ন, (৬) গৃহপতিরত্ন আর (৭) সপ্তম পরিণায়ক রত্ন। তাঁহার পরসৈন্য-প্রমর্দক শূর, বীর সহস্রাধিক পুত্র জন্মিয়া থাকেন। তিনি সসাগরা এই পৃথিবীকে বিনাদণ্ডে বিনাঅস্ত্রে ন্যায়-ধর্মে বিজয় করিয়া অধিকার করেন। যদি তিনি আগার হইতে বাহির হইয়া অনাগারিকরূপে প্রব্রজিত হন, তবে আচ্ছাদন উন্মুক্ত অর্হৎ, সম্যক্‌সম্বুদ্ধ হন। বৎস উত্তর! আমি তোমার মন্ত্রের দাতা, আর তুমি মন্ত্রের প্রতিগ্রাহক।”

৩৮৫। “আজ্ঞে হাঁ, প্রভো! (বলিয়া) উত্তর মাণব ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণকে প্রতিশ্রুতি দিল এবং আসন হইতে উঠিয়া ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণকে অভিবাদন ও প্রদক্ষিণ করিয়া বিদেহ প্রদেশে যেখানে ভগবান আছেন তদভিমুখে যাত্রা করিল। সে ক্রমশঃ বিচরণ করিতে করিতে যেখানে ভগবান ছিলেন সেস্থানে গেল। তথায় গিয়া ভগবানের সাথে ...... সম্মোদন করিয়া একপ্রান্তে বসিল। একপ্রান্তে উপবিষ্ট উত্তর মাণব ভগবানের শরীরে বত্রিশ মহাপুরুষ-লক্ষণ অন্বেষণ করিতে লাগিল। উত্তর মাণব ভগবানের শরীরে দুই চিহ্ন ব্যতীত বত্রিশ লক্ষণের অধিকাংশ দেখিতে পাইল। কোষাচ্ছাদিত বস্ত্রগুহ্য (চর্মাবৃত উপস্থ) ও প্রভূতজিহ্বত্ব এই দ্বিবিধ মহাপুরুষ-লক্ষণ সম্বন্ধে সে অনিশ্চিত ও সংশয়মুক্ত-নহে, সুপ্রসন্ন নহে। তখন ভগবানের চিন্তা হইল- ‘এই উত্তর মানব আমার শরীরে দুইটি ব্যতীত বত্রিশ মহাপুরুষ-লক্ষণের অধিকাংশ দেখিতে পাইল, ...... সুপ্রসন্ন নহে।’

তখন ভগবান এতাদৃশ ঋদ্ধি-প্রভাব (যোগবিভূতি) প্রকট করিলেন যাহাতে কেবল উত্তর মাণব কোষ-রক্ষিত উপস্থ দেখিতে পায়। তখন ভগবান জিহ্বা বাহির করিয়া তদ্বারা উভয় কর্ণ-ছিদ্র স্পর্শ করিলেন, পরিস্পর্শ করিলেন; উভয় নাসারন্ধ্র স্পর্শ ...... পরিস্পর্শ করিলেন; জিহ্বাদ্বারা ললাট মণ্ডলের সর্বত্র আচ্ছাদন করিলেন।

তখন উত্তর মাণবের চিন্তা হইল- ‘শ্রমণ গৌতম বত্রিশ মহাপুরুষ-লক্ষণযুক্ত হন। যদি আমি শ্রমণ গৌতমের অনুগমন করি, তবে তাঁহার ঈর্যাপথ ও দেখিতে পাইব।’ তখন উত্তর মাণব সাতমাস পর্যন্ত অপরিত্যাগিনী ছায়ার ন্যায় ভগবানের পিছে পিছে ভ্রমণ করিল।

৩৮৬। সাতমাসের পর উত্তর মাণব বিদেহ প্রদেশে যেস্থানে মিথিলা, সেই দিকে যাত্রা করিল। ক্রমশঃ ভ্রমণ করিতে করিতে যেখানে ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ ছিলেন, তথায় উপনীত হইল। তথায় উপনীত হইয়া ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণকে অভিবাদন করিয়া একপ্রান্তে বসিল। ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ একপ্রান্তে উপবিষ্ট মাণবকে জিজ্ঞাসা করিলেন,- “কেমন, বৎস উত্তর! ভগবান গৌতমের কীর্তি-শব্দ সত্যানুসারে বিস্তৃত হইয়াছে, অন্যথা ত নহে? কেমন সে গৌতম তাদৃশ কি, অন্যথা ত নহে?”

“যথার্থই, ভো গুরুদেব! ভগবান গৌতমের কীর্তি-শব্দ সত্যানুসারে বিস্তৃত হইয়াছে, অন্যথা নহে। সেই মাননীয় গৌতম তদ্রূপই, অন্যপ্রকার নহেন। সেই মাননীয় গৌতম বত্রিশ মহাপুরুষ-লক্ষণ মণ্ডিত হন- (১) সেই মাননীয় গৌতম সুপ্রতিষ্ঠিত পাদ (একসঙ্গে সর্ব পদতল ভূমিতে পড়ে ও উঠে), ইহাও মহাপুরুষ গৌতমের মহাপুরুষ-লক্ষণ। (২) মাননীয় গৌতমের নিু পদতলে সর্বাকারে পরিপূর্ণ নাভি-নেমি সহ সহস্র অর বিশিষ্ট চক্রচিহ্ন বিদ্যমান। (৩) ...... গৌতম আয়ত পার্ষ্ণি (বিস্তৃত পরিপূর্ণ গোড়ালির নিুভাগ) যুক্ত হন। (৪) ...... (ক্রমে সরু) দীর্ঘ অঙ্গুল ......। (৫) ...... (সদ্যজাত শিশুর ন্যায়) মৃদু ও সদা তরুণ হস্ত-পাদ ......। (৬) ...... জাল-হস্ত-পাদ (সমপ্রমাণ অঙ্গুলির রেখাসমূহ জাল সদৃশ) .....। (৭) ...... উৎসঙ্খ পাদ (পায়ের গুল্ফ নরম ও উপরে প্রতিষ্ঠিত) ......। (৮) এণী জঙ্ঘ (মৃগের ন্যায় সমবর্তুলাকার মাংসল জঙ্ঘা) ......। (৯) সোজা দাঁড়াইয়া অবনত না হইয়া সেই মান্য গৌতম উভয় হস্ততল দ্বারা জানুদ্বয় স্পর্শ করেন, মর্দন করেন (আজানুলম্বিত বাহু) ......। (১০) কোষাচ্ছাদিত বস্ত্র-গুহ্য (উপস্থ).....। (১১) সুবর্ণ বর্ণ কাঞ্চনসন্নিভ চর্ম ......। (১২) সূক্ষ্ম ছবি (চর্ম) চর্মের মসৃণতা হেতু দেহে ধূলি-ময়লা লিপ্ত হয় না ......। (১৩) একৈক লোম, প্রতি লোমকূপে এক এক লোম জন্মিয়াছে ......। (১৪) ঊর্ধাগ্র লোমা, (তাঁহার অঞ্জন সদৃশ নীল, দক্ষিণাবর্তে কুণ্ডলিত লোম সমূহের অগ্রভাগ উপরদিকে উঠিয়াছে) ......। (১৫) ব্রহ্মঋজু-গাত্র (দীর্ঘ অকুটিল শরীর) ......। (১৬) সপ্ত উৎসদ (স্ফীত ......। (১৭) সিংহ পূর্বার্ধ কায় (বক্ষ আদি শরীরের উপরিভাগ সিংহের ন্যায়) ......। (১৮) চিতান্তরাংস (উভয় কাঁধের পশ্চাতের মধ্যাংশ চিত বা মাংসপূর্ণ) ......। (১৯) ন্যগ্রোধ পরিমণ্ডল হন,......যত দীর্ঘ শরীর তদনুসারে ব্যাম (প্রস্থ), যত ব্যাম তত দীর্ঘ (চারিহাত) শরীর ......। (২০) সমাবর্ত স্কন্ধ সমপরিমাণ স্কন্ধ ......। (২১) রসগ্রাসাগ্রী (রসগ্রাহী শিরা অগ্রণী)। ...... (২২) সিংহ হনু (সিংহের ন্যায় পূর্ণ হনুবিশিষ্ট) ......। (২৩) চল্লিশ দন্ত ......। (২৪) সমদন্ত ......। (২৫) অবিবর দন্ত.....। (২৬) সুশুভ্র দন্ত ......। (২৭) প্রভূত (বিস্তৃত) জিহ্বা....। (২৮) ব্রহ্মস্বর, করবীক (পক্ষীর ন্যায় মধুর) ভাষী ......। (২৯) অভিনীল নেত্র (অতসী পুষ্পের ন্যায় গাঢ়-নীলাভ চক্ষু বিশিষ্ট) ......। (৩০) গো-পঞ্চম (গরুর নেত্রলোমের ন্যায় চক্ষু লোম) যুক্ত ......। (৩১) মাননীয় গৌতমের ভ্রূ-যুগলের মধ্যে কোমল শ্বেত কার্পাস-সন্নিভ ঊর্ণা (রোমাবর্ত) জন্মিয়াছে ......। (৩২) উষ্ণীষ শীর্ষ (বদ্ধ উষ্ণীষের ন্যায় গোলাকার শীর্ষ) বিশিষ্ট মাননীয় গৌতম ইহাও মহাপুরুষ গৌতমের মহাপুরুষ-লক্ষণ। সেই মাননীয় গৌতম এই বত্রিশ প্রকার মহাপুরুষ-লক্ষণ মণ্ডিত হন।

৩৮৭। সেই প্রভূ গৌতম গমনের সময় প্রথমে দক্ষিণ পদেই অগ্রসর হন। তিনি অতি দূরের জন্য পাদ উত্তোলন করেন না, অতি সমীপে পাদ-নিক্ষেপ করেন না। তিনি অতি দ্রুত গমন করেন না, অতিধীরে গমন করেন না। জানুদ্বারা জানু ঘর্ষণ করিয়া চলেন না, গুল্ফদ্বারা গুল্ফ ঘর্ষণ করিয়া গমন করেন না। গমনের সময় তিনি উরু উন্নত করেন না, উরু অবনত করেন না, উরু সন্নামন বা নীচেরদিকে শক্ত করেন না, উক্ত বিনামন বা ইতস্ততঃ সঞ্চালন করেন না। গমনের সময় প্রভু গৌতমের শুধু অধঃঅঙ্গ সঞ্চালিত হয়। তিনি কায়বলে বা বাহু সঞ্চালনাদি ঘর্মাক্ত কলেবরে গমন করেন না। অবলোকনের সময় প্রভু গৌতম গজেন্দ্র সদৃশ সর্বশরীর ঘুরাইয়া অবলোকন করেন। তিনি নক্ষত্র দেখার ন্যায় উপরদিকে উল্লোকন করেন না, পতিত দ্রব্য অন্বেষণের ন্যায় নিুদিকে অবলোকন করেন না। নানাদিক দেখিতে দেখিতে গমন করেন না। যুগমাত্র (৪॥ হাত) সম্মুখে দেখিয়া থাকেন, তৎপরেও তাঁহার জ্ঞানদর্শন অনাবৃত থাকে।

তিনি গৃহে প্রবেশ করিবার সময় দেহ উন্নত করেন না, দেহ অবনত করেন না, দেহ সন্নমিত ও বিনমিত করেন না। তিনি আসনের অতিদূরে অত্যাসন্নে (দেহ) পরিবর্তন করেন না, হাতে ভারদিয়া আসনে বসেন না, আসনে দেহ নিক্ষেপ করেন না। তিনি গৃহাভ্যন্তরে উপবিষ্ট অবস্থায় হস্তের অসংযমতা প্রদর্শন করেন না, জানুর উপর জানু রাখিয়া বসেন না, গুল্ফের উপর গুল্ফ রাখিয়া বসেন না, হনু বা চোয়াল জড়াইয়া ধরিয়া বসেন না। তিনি গৃহ মধ্যে উপবিষ্ট অবস্থায় ভীত হন না, কম্পিত হন না, বিচলিত হন না, সন্ত্রস্ত হন না। তিনি নির্ভীক, নিষ্কম্প, অচঞ্চল, সন্ত্রাসহীন, রোমাঞ্চরহিত ও বিবেকব্রতী হইয়াই গৃহ-মধ্যে উপবেশন করেন।

তিনি পাত্রে জল গ্রহণের সময় পাত্র উপরে তোলেন না, নীচে নামান না; পাত্র সন্নামন করেন না, বিনামন করেন না। তিনি পাত্রে অত্যধিক কিংবা অত্যল্প জল গ্রহণ করেন না। তিনি ‘কুলু কুলু’ শব্দ করিয়া পাত্র-ধৌত করেন না, পরিবর্তন করিয়া প্রথমে পাত্রের বহির্ভাগ ধৌত করেন না, পাত্র মাটিতে রাখিয়া হাতে ধৌত করেন না; হাত ধৌত করার সঙ্গে সঙ্গে পাত্র ধৌত হয়, পাত্র ধৌত করার সঙ্গে সঙ্গে হস্তদ্বয় বিধৌত হয়। তিনি অতিদূরে কিংবা অতি সমীপে ইতস্ততঃ বিকীরণ করিয়া পাত্রের জল নিক্ষেপ করেন না।

তিনি অন্নগ্রহণের সময় পাত্র উন্নত করেন না, অবনত করেন না, সন্নমিত করেন না, বিনমিত করেন না। তিনি অতিবেশী কিংবা অত্যল্প ভাত গ্রহণ করেন না। সেই মাননীয় গৌতম ব্যঞ্জনও ব্যঞ্জন-মাত্রায় (ভাতের ১৪ অংশ) আহার করেন। ব্যঞ্জনদ্বারা গ্রাসের (পরিমাণ) অতিক্রম করেন না। ...... মুখে গ্রাস চর্বণ করিতে করিতে দুই তিনবার পরিবর্তন করিয়া গলাধঃকরণ করেন। কোন অন্ন-মজ্জা অভিন্ন অবস্থায় তাঁহার দেহে (উদরে) প্রবেশ করেন না। যখন কোন অন্ন-মজ্জা তাঁহার মুখে অবশিষ্ট থাকে না তখন অপর গ্রাস মুখে আনয়ন করেন। প্রভু গৌতম রসানুভব করিতে করিতে খাদ্য আহার করেন, কিন্তু রস-তৃষ্ণাসক্ত হন না।

অষ্টাঙ্গযুক্ত আহারই প্রভু গৌতম আহরণ করিয়া থাকেন- ‘তাহা ক্রীড়ার জন্য নহে, মত্ততার জন্য নহে, মণ্ডন বা দেহ সৌষ্ঠবের জন্য নহে, বিভূষণের জন্য নহে; কেবলমাত্র এই ভৌতিক দেহের স্থিতির নিমিত্ত, জীবন যাপনের নিমিত্ত, ক্ষুধা-যন্ত্রণা উপশমের নিমিত্ত, ব্রহ্মচর্যের সহায়তার নিমিত্ত; এই উপায়ে পুরাতন (ক্ষুধাজনিত) বেদনা নিবারণ করিব, (অমিত ভোজন জনিত) নূতন বেদনা উৎপন্ন হইতে দিব না; আমার নিরবদ্য জীবন-যাত্রা ও সুখ-বিহার হইবে।’

তিনি ভোজন শেষে পাত্রে জল গ্রহণের সময় পাত্র উন্নত করেন না, অবনত করেন না, সন্নমিত করেন না, বিনমিত করেন না। তিনি পাত্রে অত্যধিক বা অত্যল্প জল গ্রহণ করেন না। তিনি ‘কুলু কুলু’ শব্দে পাত্র ধৌত করেন না, পরিবর্তন করিয়া (উল্টাইয়া) পাত্র ধৌত করেন না, পাত্র মাটিতে রাখিয়া হস্ত ধৌত করেন না, হস্ত ধৌতের সময় পাত্র ধৌত হয়, পাত্র ধুইবার সময় হস্ত ধৌত হয়। তিনি পাত্রের জল ইতস্ততঃ বিক্ষেপ না করিয়া অনতিদূরে, অনতি সমীপে ত্যাগ করেন। তিনি ভোজন শেষে পাত্র অনতিদূরে, অনতি আসন্নে ভূমিতে নিক্ষেপ করেন না, পাত্রের প্রতি নিরপেক্ষ হন না, আর দীর্ঘকাল উহার রক্ষায় তৎপর থাকেন না।

ভোজন শেষে তিনি কিছুক্ষণ (মুহুত্তং) মৌনভাবে বসিয়া থাকেন, আর অনুমোদনের সময় অতিক্রম করেন না, ভোজনের পর তিনি ভুক্তানুমোদন (উপদেশ) করেন। সেই ভোজনের নিন্দা করেন না, অন্য ভোজনের প্রত্যাশা রাখেন না, অধিকন্তু ধর্মীয় উপদেশ দ্বারা সেই পরিষদকে সন্দর্শন, সমাদাপন, সমুত্তেজন, সংপ্রহর্ষণ করেন। তিনি সেই পরিষদকে ধর্মোপদেশ দ্বারা ...... সংপ্রহৃষ্ট করিয়া আসন হইতে উঠিয়া প্রস্থান করেন।

তিনি অতিদ্রুত গমন করেন না, অতি ধীরে গমন করেন না এবং মুক্তি ইচ্ছায় (অর্থাৎ সম্মুখস্থকে পশ্চাতে রাখিবার ইচ্ছায়) গমন করেন না। প্রভু গৌতমের দেহে চীবর অতি উপরে উঠে না, অত্যন্ত নীচে ঝুলেনা, শরীরে স্বেদ-সংলগ্ন থাকেনা, দেহ হইতে অধিক অসংলগ্নও থাকে না। মাননীয় গৌতমের শরীর হইতে চীবর বায়ুতে অপসারিত করে না আর প্রভু গৌতমের শরীরে ধুলি-ময়লাও সংলগ্ন হয় না।

তিনি আশ্রমে উপনীত হইয়া সজ্জিত আসনে বসেন, বসিয়া পাদ ধৌত করেন। কিন্তু মাননীয় গৌতম (প্রস্তরাদিতে ঘর্ষণ দ্বারা) পাদ--শোভন ব্রতে তৎপর থাকেন না। তিনি পাদ প্রক্ষালন করিয়া দেহ সোজা বিন্যস্ত করেন এবং স্মৃতি সম্মুখে স্থাপন পূর্বক পদ্মাসনাবদ্ধ হইয়া উপবেশন করেন। তদবস্থায় তিনি আত্ম-পীড়নার্থ চিন্তা করেন না, পর-পীড়নার্থ চিন্তা করেন না, উভয়-পীড়নার্থ চিন্তা করেন না। মাননীয় গৌতম আত্ম-হিত, পর-হিত, উভয়-হিত, নিখিল বিশ্ব-হিতই চিন্তা করিয়া অবস্থান করেন।

আশ্রমে অবস্থান কালে তিনি পরিষদে ধর্মোপদেশ করেন, সেই পরিষদকে উৎসাদন করেন (উপরে তোলেন) না, অপসাদন করেন (নীচে ফেলেন) না; অধিকন্তু ধর্মীয় উপদেশ দ্বারা সেই পরিষদকে সন্দর্শিত, সমাদাপিত, সমুত্তেজিত, সংপ্রহর্ষিত করেন।

প্রভু গৌতমের কণ্ঠ হইতে অষ্টাঙ্গ সমন্বিত ঘোষ উচ্চারিত হয়- (১) বিশ্লিষ্ট (বিমুক্ত), (২) বিজ্ঞেয়, (৩) মঞ্জু (মধুর), (৪) শ্রবণীয়, (৫) বিন্দু (সারযুক্ত), (৬) অবিসারী (অবিকীর্ণ), (৭) গম্ভীর এবং (৮) নিনাদী। মাননীয় গৌতম পরিষদের পরিমাণানুরূপ স্বরে উপদেশ প্রদান করেন, তাঁহার ধ্বনি পরিষদের বাহিরে যায় না। প্রভু গৌতম কর্তৃক ধর্মকথায় সন্দর্শিত ...... সেই শ্রোতাগণ ভগবানকে অবলোকন করিতে করিতে শ্রুত ধর্ম-ভাব ত্যাগ না করিয়াই প্রস্থান করেন ।

ওহে আচার্য! আমরা মাননীয় ভগবানকে গমন করিতে দেখিয়াছি, দাঁড়াইতে দেখিয়াছি, গৃহে প্রবেশ করিতে দেখিয়াছি, গৃহের মধ্যে মৌনভাবে উপবিষ্ট অবস্থায় দেখিয়াছি, ভোজন শেষে ভুক্তানুমোদন করিতে দেখিয়াছি, আরামে (আশ্রমে) যাইতে দেখিয়াছি, আরামের ভিতর তুষ্ণীভাবে উপবিষ্ট দেখিয়াছি, আরামের মধ্যে পরিষদে ধর্মোপদেশ করিতে দেখিয়াছি। সেই ভগবান এতাদৃশ গুণসম্পন্ন, এতদপেক্ষা অধিকতর গুণী হন।

৩৮৮। এই প্রকারে উক্ত হইলে ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ আসন হইতে উঠিয়া উত্তরীয় বস্ত্র একাংসে করিয়া যেদিকে ভগবান আছেন, সেদিকে যুক্তাঞ্জলি প্রণত হইয়া তিনবার উদান উচ্চারণ করিলেন,-

“নমো তস্‌স ভগবতো অরহতো সম্মাসম্বুদ্ধস্‌স।” (৩ বার)

“(সেই ভগবান অর্হৎ সম্যকসম্বুদ্ধকে নমস্কার)।”

“যদি কখন, কোথাও সেই মহাপ্রভু গৌতমের সহিত সঙ্গ করিতে পারি, যদি কোন কথা সংলাপ হয়, তবেই আমার জীবন ধন্য।”

৩৮৯। সেই সময় ভগবান বিদেহে ক্রমশঃ বিচরণ করিতে করিতে মিথিলায় পৌঁছিলেন, তথায় মিথিলাতে ভগবান মঘদেব আম্রবনে বিহার করিতেছেন। মৈথিলী ব্রাহ্মণ-গৃহপতিগণ শুনিলেন,- “শাক্যকুল প্রব্রজিত শাক্য-পুত্র শ্রমণ গৌতম বিদেহ প্রদেশে বিচরণ করিতে করিতে পঞ্চশত ভিক্ষু সমন্বিত মহান্‌ সংঘ সহ মিথিলায় উপনীত হইয়াছেন এবং মিথিলায় মঘদেব আম্রবনে বিহার করিতেছেন। সেই সময় ভগবান গৌতমের এইরূপ কল্যাণ-কীর্তিশব্দ উৎপন্ন হইয়াছে- “সেই ভগবান অর্হৎ ...... তদ্রূপ অর্হতের দর্শন মঙ্গলজনক!”

তখন মৈথিলী ব্রাহ্মণ-গৃহপতিগণ যে স্থানে ভগবান আছেন, সে স্থানে গেলেন; গিয়া কেহ কেহ ভগবানকে অভিবাদন করিয়া একপ্রান্তে বসিলেন ...... কেহ কেহ তুষ্ণীভূত হইয়া একপ্রান্তে উপবেশন করিলেন।

৩৯০। ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ শুনিলেন,- “শাক্যকুল প্রব্রজিত শাক্য-পুত্র শ্রমণ গৌতম ...... মিথিলায় উপনীত হইয়াছেন, এবং মঘদেব আম্রবনে অবস্থান করিতেছেন।” তখন ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ বহু যুবক সঙ্গে লইয়া যেখানে মঘদেব আম্রবন সেখানে উপস্থিত হইলেন। তখন আম্রবনের অদূরে ব্রাহ্মণ ব্রহ্মায়ুর মনে হইল,- “পূর্বে সংবাদ না দিয়া শ্রমণ গৌতমের দর্শনার্থ উপস্থিত হওয়া আমার পক্ষে সমীচীন নহে।” তখন ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ এক যুবককে ডাকিলেন,- “এস, যুবক! যেখানে শ্রমণ গৌতম আছেন সেখানে যাও, গিয়া আমার বাক্যে শ্রমণ গৌতমকে নিরাময়, নিরাতঙ্ক, লঘুভাব (স্ফুর্তি) বল ও সুখ-বিহার সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা কর- ‘ভো গৌতম! ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ প্রভু গৌতমের নিরাময় ...... জিজ্ঞাসা করিতেছেন।’ আর ইহাও বলিও- ‘ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ জীর্ণ, বৃদ্ধ, মহল্লক, অর্ধগত বয়স্ক, জন্মেতে একশবিশ বর্ষীয় হন, তিনি মাননীয় গৌতমের দর্শনেচ্ছা পোষণ করেন’।”

“হাঁ, ভো!” (বলিয়া) সেই যুবক ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণকে উত্তর দিয়া যেখানে ভগবান আছেন সেখানে গেল, গিয়া ভগবানের সহিত সম্মোদন করিয়া ...... একপ্রান্তে দাঁড়াইয়া ভগবানকে বলিল,- “ভো গৌতম! ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ মহাপ্রভু গৌতমের নিরাময় ...... জিজ্ঞাসা করিয়াছেন। ...... ভো গৌতম! ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ ...... একশবিশ বৎসরের বৃদ্ধ। তিনি ...... ত্রিবেদের পারগূ ...... মহাপুরুষ-লক্ষণ সম্বন্ধে পরিপূর্ণ জ্ঞানী হন। মিথিলায় যত ব্রাহ্মণ-গৃহপতি বাস করেন তাঁহাদের মধ্যে ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ ভোগ, মন্ত্র (বেদ), আয়ু আর যশ ...... সকলদিকে অগ্রণী হন, তিনি প্রভু গৌতমকে দর্শন করিতে ইচ্ছুক।”

“মাণবক! ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ আপাততঃ যাহা উচিত মনে করেন তাহা করিতে পারেন।”

তখন সে মাণবক যেখানে ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ ছিলেন, সেখানে গেল, গিয়া ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণকে বলিল, “ভো! শ্রমণ গৌতম আপনাকে অবকাশ দিয়াছেন, এখন আপনি যাহা উচিত করিতে পারেন।”

৩৯১। তখন ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ যেস্থানে ভগবান আছেন, সেস্থানে গেলেন। তথাকার (ব্রাহ্মণ-গৃহপতি) পরিষদ দূর হইতে ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণকে আসিতে দেখিলেন। দেখিয়াই তাঁহার গমনের জন্য বিখ্যাত ও যশস্বীর উপযুক্ত অবকাশ করিলেন। তখন ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ সেই পরিষদকে বলিলেন,- “যথেষ্ট, মহাশয়গণ! আপনারা স্বীয় আসনে বসুন। আমি এখানে শ্রমণ গৌতমের সমীপে বসিব। তখন ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ যেস্থানে ভগবান আছেন সেস্থানে উপনীত হইলেন, গিয়া ভগবানের সাথে- সম্মোদন করিয়া একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ ভগবানের দেহে বত্রিশ মহাপুরুষ-লক্ষণ সমূহ অন্বেষণ করিতে লাগিলেন । ...... দুইটি লক্ষণ সম্বন্ধে তিনি সংশয়াপন্ন হইলেন। তখন ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ ভগবানকে গাথায় বলিলেন,-

“শুনেছি শাস্ত্রের বাণী, যে মহা বত্রিশ আছে পুরুষ-লক্ষণ,

হে গৌতম! তবদেহে, উহাদের দুই চিহ্ন করিনি দর্শন। ১

নরোত্তম! তব জিহ্বা নহে হ্রস্ব? যাতে হয় প্রকটিত,

নারী সহ নর নাম, বস্ত্র-গুহ্য (উপস্থ) হয় তব কোষে আচ্ছাদিত?২

হয় কি প্রশস্ত জিহ্বা তব? যাতে মোরা করি জ্ঞানার্জন,

কিছু তা বাহির করে, ঋষিবর! কর কঙ্খা বিনোদন। ৩

ইহলোকে হিত আর পরলোকে সুখের দরুণ,

যা কিছু প্রার্থিত এবে জিজ্ঞাসিব আদেশ করুন।” ৪

৩৯২। তখন ভগবানের এই চিন্তা হইল, - “এই ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ আমার দেহে বত্রিশ মহাপুরুষ-লক্ষণ অন্বেষণ করিতেছেন, ...... জিহ্বাদ্বারা ললাট-মণ্ডল আচ্ছাদন করিলেন।” তৎপর ভগবান গাথাযোগে ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণকে প্রত্যুত্তর দিলেন,-

“যে বত্রিশ মহাপুরুষ-লক্ষণ করিছ শ্রবণ,

আছে সব মমদেহে সংশয় না কর, হে ব্রাহ্মণ! ১।

অভিজ্ঞেয় অভিজ্ঞাত ভাবিতব্য করেছি ভাবন,

ত্যাজ্য মম ত্যক্ত এবে বুদ্ধ আমি তাইত ব্রাহ্মণ! ২।

ঐহিক হিতের তরে পারত্রিক সুখের দরুণ,

অবকাশ দিনু আমি প্রার্থিত যা’ জিজ্ঞাসা করুন।” ৩।

৩৯৩। সেই সময় ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণের এই চিন্তা হইল,- “শ্রমণ গৌতম অবকাশ দিয়াছেন। ঐহিক কিংবা পারত্রিক হিত সম্বন্ধে আমি তাঁহাকে কি জিজ্ঞাসা করিতে পারি?” তখন ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণের এই ধারণা জন্মিল,- “ঐহিক হিত সম্বন্ধে আমি অভিজ্ঞ, অপরেও ঐহিক হিত সম্বন্ধে আমাকে জিজ্ঞাসা করে। সুতরাং শ্রমণ গৌতমকে আমি পারত্রিক হিত সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিলেই ভাল হয়।” তখন ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ ভগবানকে গাথায় বলিলেন,-

“ওহে! (১) কিরূপে ব্রাহ্মণ হয়? (২) বেদগূ কাহাকে কয়?

ওহে! (৩) ত্রৈবিদ্য কিরূপে হয়? (৪) শ্রোত্রিয় কাহাকে কয়? ১

ওহে! (৫) কিরূপে অর্হৎ হয়? (৬) কাহাকে কেবলী কয়?

ওহে! (৭) মুনিত্ব কিসেতে লভে? (৮) বুদ্ধ কাকে বলা হয়?” ২

৩৯৪। তখন ভগবান ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণকে গাথাদ্বারা (সেই আট প্রশ্নের) উত্তর দিলেন,-

পূর্বজন্ম পরিজ্ঞাত যিনি স্বর্গাপায় করেন দর্শন,

জন্মক্ষয়ে অরহত্ব লাভ মুনি হন অভিজ্ঞা-পূরণ। ১

সর্ব রাগাদি মুক্ত শুদ্ধচিত্ত ব্রাহ্মণের সুবিদিত,

জন্ম-মৃত্যু পরিত্যক্ত পূর্ণ-ব্রহ্মচারী কেবলী কথিত,

সর্বধর্ম পারগামী তাদিগুণী বুদ্ধনামে অভিহিত।” ২

এইরূপ উক্ত হইলে ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ উত্তরীয় বস্ত্র একাংসে করিয়া ভগবানের পদে নতশিরে পতিত হইয়া, ভগবানের পাদপদ্ম মুখে চুম্বন করিতে লাগিলেন, হস্তদ্বারা সম্বাহন করিতে লাগিলেন আর নাম শুনাইলেন,-

“ভো গৌতম! আমি ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ, ভো গৌতম! আমি ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ।”

তখন সেই পরিষদ বিস্মিত ও আশ্চর্যান্বিত হইল,- “ওহে! শ্রমণের মহর্ধিকতা (দিব্য-শক্তি), মহানুভবতা অত্যন্ত আশ্চর্য! অত্যন্ত অদ্ভুত! যাহাতে এমন বিখ্যাত যশস্বী ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ এই প্রকারে পরম সম্মান প্রদর্শন করিতেছেন।”

তখন ভগবান ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণকে বলিলেন,- “যথেষ্ট ব্রাহ্মণ! উঠুন, আপন আসনে বসুন, হাঁ, আমার প্রতি আপনার চিত্ত সুপ্রসন্ন।”

তখন ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ উঠিয়া স্বীয় আসনে বসিলেন।

৩৯৫। তখন ভগবান ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণকে আনুপূর্বিককথা (উপদেশ) কহিলেন- যেমন দান-কথা, শীল-কথা, স্বর্গ-কথা, কাম-বাসনার দুষ্পরিণাম, অপকার, কলুষতা; নিষ্কামভাবের প্রশংসা প্রকাশ করিলেন। ভগবান যখন ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণকে ভব্যচিত্ত, মৃদুচিত্ত, অনাবৃতচিত্ত, আহ্লাদিত চিত্ত ও প্রসন্নচিত্ত দেখিলেন, তখন যাহা বুদ্ধগণের সমুৎকৃষ্ট ধর্মদেশনা সেই দুঃখ, সমুদয়, নিরোধ আর মার্গসত্য প্রকাশ করিলেন। ময়লারহিত শ্বেত-বস্ত্র যেমন উত্তমরূপে রং গ্রহণ করে, সেই প্রকারেই সেই আসনে ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণের বিরজ, বীতমল ধর্ম-চক্ষু- যাহা কিছু সমুদয়ধর্মী (উৎপন্ন পদার্থ) আছে, সেই সমস্ত নিরোধধর্মী (বিনাশশীল)- উৎপন্ন হইল।

তখন ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ দৃষ্ট-ধর্ম, প্রাপ্ত-ধর্ম, বিদিত ধর্ম, পর্যাবগাঢ় (অনুশীলিত) ধর্ম, তীর্ণ বিচিকিৎস (সংশয়মুক্ত), ইহা কি প্রকার? এরূপ প্রশ্নরহিত, বৈশারদ্য-প্রাপ্ত (দক্ষ), শাস্তার শাসনে পর-প্রত্যয়মুক্ত (প্রত্যক্ষদর্শী) হইয়া ভগবানকে ইহা বলিলেন,- “আশ্চর্য, ভো গৌতম! আশ্চর্য, ভো গৌতম! যেমন অধোমুখকে ঊর্ধমুখী করিলেন ...... আজ হইতে আজীবন আমাকে শরণাগত উপাসকরূপে ধারণা করুন। প্রভু গৌতম! ভিক্ষুসংঘের সহিত আগামীকল্যের ভোজন আমার বাড়ীতে গ্রহণ করুন।”

ভগবান মৌনভাবে স্বীকার করিলেন।

তখন ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ ভগবানের স্বীকৃতি অবগত হইয়া আসন হইতে উঠিলেন এবং ভগবানকে অভিবাদন ও প্রদক্ষিণ করিয়া প্রস্থান করিলেন।

তৎপর ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ নিজের গৃহে উত্তম খাদ্য-ভোজ্য প্রস্তুত করিয়া সেই রাত্রি অতিবাহিত হইলে ভগবানকে কাল নিবেদন করিলেন,- “সময় হইয়াছে, ভো গৌতম! ভোজন প্রস্তুত।”

তখন ভগবান পূর্বাহ্ন সময়ে নিবাসন পরিধান করিয়া পাত্র-চীবর ধারণ করিয়া যেস্থানে ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণের গৃহ আছে, সেস্থানে গেলেন। তথায় গিয়া ভিক্ষু-সংঘের সহিত সজ্জিত আসনে উপবেশন করিলেন। তখন ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ স্বহস্তে উত্তম খাদ্য-ভোজ্য দ্বারা সপ্তাহকাল বুদ্ধপ্রমুখ ভিক্ষুসংঘকে সন্তর্পিত (সন্তৃপ্ত) করিলেন, সংপ্রবারিত করিলেন।

ভগবান সেই সপ্তাহ গত হইলে বিদেহ প্রদেশে বিচরণার্থ প্রস্থান করিলেন। ভগবান চলিয়া যাইবার অচিরকাল পরে ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ কালক্রিয়া করিলেন।

তখন কয়েকজন ভিক্ষু যেখানে ভগবান আছেন সেখানে গেলেন, ভগবানকে অভিবাদন করিয়া একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট সেই ভিক্ষুগণ ভগবানকে কহিলেন,- “ভন্তে! ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ কালগত হইয়াছেন, তাঁহার কি গতি, কোন অভিসম্পরায় (পরলোক লাভ) হইল?”

“ভিক্ষুগণ! ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ছিলেন, ধর্মানুকূল আচরণকারী ছিলেন, ধর্মাধিগমে তিনি আমাকে পীড়িত করেন নাই। ভিক্ষুগণ! ব্রহ্মায়ু ব্রাহ্মণ পঞ্চ অধঃভাগীয় সংযোজনের ক্ষয় হেতু ঔপপাতিক (ব্রহ্মা) হইয়াছেন, তথায় (শুদ্ধাবাস ব্রহ্মলোকে) পরিনির্বান লাভ করিবেন। সেই লোক হইতে আর ইহলোকে প্রত্যাবর্তন করিবেন না।”

ভগবান ইহা বলিলেন। সেই ভিক্ষুগণ সন্তুষ্টচিত্তে ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন করিলেন।

॥ ব্রহ্মায়ু সূত্র সমাপ্ত ॥

সেল সূত্র (৯২)

(বুদ্ধ ও ধর্মের গুণ। সেল ব্রাহ্মণের প্রব্রজ্যা)

৩৯৬। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-

এক সময় ভগবান সাড়েবারশত ভিক্ষু সমন্বিত মহাভিক্ষুসংঘ সহ অঙ্গুত্তরাপ জনপদে ধর্ম প্রচারার্থ বিচরণ করিতে করিতে যেখানে ....আপণ নামক নিগম ছিল, সেস্থানে পৌঁছিলেন।

কেণিয় জটিল (তপস্বী) শুনিলেন,- “শাক্যকুল প্রব্রজিত শাক্য-পুত্র গৌতম সাড়েবারশত ভিক্ষুর মহাভিক্ষুসংঘ সহ অঙ্গুত্তরাপে চারিকায় বিচরণ করিতে করিতে আপণে আসিয়াছেন। সেই ভগবান গৌতমের এই প্রকার কল্যাণ-কীর্তিশব্দ বিঘোষিত হইয়াছে- সেই ভগবান অর্হৎ ......। তথাবিধ অর্হতের দর্শন মঙ্গলজনক।”

তখন কেণিয় জটিল যেখানে ভগবান আছেন, সেখানে উপনীত হইলেন। উপস্থিত হইয়া ভগবানের সাথে সম্মোদনের (কুশলাদি জিজ্ঞাসার) পর একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট কেণিয় জটিলকে ভগবান ধর্মোপদেশ দ্বারা সংদর্শন, সমাদাপন, সমুত্তেজন, সংপ্রহর্ষণ করিলেন। ভগবানের ধর্মোপদেশ দ্বারা সন্দর্শিত ...... হইয়া কেণিয় জটিল ভগবানকে কহিলেন,- “মহামান্য গৌতম! ভিক্ষুসংঘ সহ আগামীকল্য আমার বাড়ীতে ভোজন স্বীকার করুন।”

এইরূপ উক্ত হইলে ভগবান কেণিয় জটিলকে বলিলেন,- “কেণিয়! ভিক্ষুসংঘ বৃহৎ, সংঘে সাড়েবারশত ভিক্ষু আছে। তুমিও ব্রাহ্মণদের প্রতি প্রসন্ন।”

দ্বিতীবার, তৃতীয়বার কেণিয় জটিল ভগবানকে কহিলেন, ......।

“ভগবান মৌনভাব সম্মত হইলেন। তখন ভগবানের সম্মতি জ্ঞাত হইয়া কেণিয় জটিল আসন হইতে উঠিয়া যেস্থানে তাঁহার আশ্রম ছিল, সেস্থানে উপনীত হইলেন এবং মিত্র-অমাত্য, জ্ঞাতি-সলোহিতগণকে আহ্বান করিলেন,- “ওহে! মিত্র-অমাত্য, জ্ঞাতি-সলোহিতগণ! আমার বাক্য শুনুন, আমি ভিক্ষুসংঘ সহ শ্রমণ গৌতমকে আগামীকল্য ভোজনের নিমন্ত্রণ করিয়াছি। অতএব আপনারা আমার সাহায্য করিতে পারেন।”

“হাঁ, মহাশয়! (বলিয়া) কেণিয় জটিলকে প্রতিশ্রুতি দিয়া তাঁহার মিত্র-অমাত্য, জ্ঞাতি-সলোহিতদের কেহ কেহ উদ্‌ধ্মান (উনান) খনন করিতে লাগিল, কেহ কেহ জ্বালানি কাষ্ঠ চিড়িতে আরম্ভ করিল, কেহ কেহ ভাজন ধৌত করিতে লাগিল, কেহ কেহ উদকমণি (জল-পাত্র) প্রতিষ্ঠা করিতে লাগিল, কেহ কেহ আসন বিছাইতে লাগিল। কেণিয় জটিল স্বয়ং মণ্ডলমাল (বস্ত্রমণ্ডপ) সজ্জিত করিলেন।

৩৯৭। সেই সময় নিঘণ্ডু, কল্প (কেটুভ), অক্ষর-প্রভেদ সহিত ত্রিবেদ তথা পঞ্চম ইতিহাসে পারগূ, পদক (পদকর্তা), বৈয়াকরণ, লোকায়ত এবং মহাপুরুষ-লক্ষণ (সামুদ্রিক) শাস্ত্রে নিপুণ (অনবয়), শৈল নামক ব্রাহ্মণ আপণে বাস করিতেন আর তিনশত বিদ্যার্থীকে মন্ত্র (বেদ) শিক্ষা দিতেন। শৈলব্রাহ্মণ কেণিয় জটিলের প্রতি অতিশয় প্রসন্ন (শ্রদ্ধাবান) ছিলেন। তখন শৈলব্রাহ্মণ তিনশত শিক্ষার্থী পরিবৃত হইয়া জঙ্ঘা-বিহার বা পদব্রজে ভ্রমণ করিতে করিতে কেণিয় জটিলের আশ্রমে উপনীত হইলেন। শৈলব্রাহ্মণ দেখিলেন যে কেণিয় জটিলের জটিল শিষ্যদের (জটাধারী বানপ্রস্থ শিষ্য) মধ্যে কেহ উদ্‌ধ্মান খনন করিতেছে, ...... এবং কেণিয় জটিল নিজেই মণ্ডলমাল প্রস্তুত করিতেছেন।

ইহা দেখিয়া তিনি কেণিয় জটিলকে কহিলেন,- “কেমন, মাননীয় কেণিয়ের এখানে কি আবাহ কিংবা বিবাহ হইবে, অথবা মহাযজ্ঞ উপস্থিত হইয়াছে, কিংবা বলকায় (সেনা) সহ মগধরাজ শ্রেণিক বিম্বিসার আগামীকল্য ভোজনের নিমিত্ত নিমন্ত্রিত হইয়াছেন?”

“না, হে শৈল! আমার এখানে আবাহ হইবে না, বিবাহও হইবে না, আর বলকায় সহ মগধরাজ শ্রেণিক বিম্বিসারও আগামীকল্য ভোজনের নিমিত্ত নিমন্ত্রিত নহেন, অপিচ আমার এখানে মহাযজ্ঞ উপস্থিত আছে। শাক্যকুল প্রব্রজিত শাক্য-পুত্র শ্রমণ গৌতম সাড়ে বারশত ভিক্ষুসংঘ সমন্বিত মহাভিক্ষুসংঘ সহ অঙ্গুত্তরাপে ধর্ম প্রচারার্থ বিচরণ করিতে করিতে আপণে আসিয়াছেন। সেই ভগবান গৌতমের এইরূপ মঙ্গল-কীর্তিশব্দ বিস্তৃত হইয়াছে- সেই ভগবান অর্হৎ, সম্যকসম্বুদ্ধ, বিদ্যাচরণ সম্পন্ন, সুগত, লোকবিদূ, অনুত্তর পুরুষদম্য সারথী, দেবমানবের শাস্তা, বুদ্ধ ও ভগবান হন। তিনি ভিক্ষুসংঘের সহিত আগামীকল্য ভোজনের নিমিত্ত আমার এখানে নিমন্ত্রিত হইয়াছেন।”

“হে কেণিয়! বুদ্ধ বলিতেছেন?”

“হে শৈল! হাঁ, বুদ্ধ কহিতেছি।”

“ ...... বুদ্ধ বলিতেছেন?”

“ ...... বুদ্ধ কহিতেছি।”

“ ...... বুদ্ধ বলিতেছেন?”

“ ...... বুদ্ধ কহিতেছি।”

৩৯৮। তখন শৈলব্রাহ্মণের এই চিন্তা হইল- ‘বুদ্ধ’ এই ঘোষও জগতে অত্যন্ত দুর্লভ। আমাদের মন্ত্রে বত্রিশ মহাপুরুষ-লক্ষণ বর্ণিত আছে, যাহাতে যুক্ত মহাপুরুষের দ্বিবিধ গতির অন্যতর গতি হয়। যদি তিনি গার্হস্থ্য জীবন যাপন করেন তবে চতুর্দিক বিজয়ী জনপদে স্থায়ি আধিপত্য প্রাপ্ত এবং ধার্মিক ধর্মরাজ চক্রবর্তী রাজা হন ......। তিনি সসাগরা এই পৃথিবী বিনাদণ্ডে, বিনাঅস্ত্রে ধর্মতঃ বিজয় করিয়া শাসন করেন। আর যদি আগার ছাড়িয়া অনাগারিকরূপে প্রব্রজিত হন তবে জগতে আবরণ বিহীন অর্হৎ সম্যকসম্বুদ্ধ হন।

“হে কেণিয়! সেই মহামান্য গৌতম অর্হৎ সম্যক্‌সম্বুদ্ধ সমপ্রতি কোথায় বাস করেন?”

এইরূপ উক্ত হইলে কেণিয় জটিল দক্ষিণবাহু জড়াইয়া ধরিয়া শৈল-ব্রাহ্মণকে কহিলেন,- “হে শৈল! যেখানে ঐ নীল বৃক্ষরাজি বিরাজমান।”

তখন শৈলব্রাহ্মণ তিনশত বিদ্যার্থী সহ যেখানে ভগবান আছেন, সেখানে গেলেন। শৈলব্রাহ্মণ সেই তরুণদিগকে বলিলেন,- তোমরা নিঃশব্দে পাদ পরিমাণে পদক্ষেপ করিয়া আস। একাচারী সিংহের ন্যায় সেই ভগবানদের সঙ্গলাভ অতীব দুর্লভ। আমি যখন শ্রমণ গৌতমের সাথে আলোচনা করিব, তখন তোমরা আমার কথার মাঝখানে কথা উত্থাপন করিও না, আমার আলোচনা সমাপ্তি পর্যন্ত তোমরা অপেক্ষা করিবে।”

তখন শৈলব্রাহ্মণ যেখানে ভগবান আছেন, সেখানে উপনীত হইলেন এবং ভগবানের সাথে সম্মোদন করিয়া ...... একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে বসিয়া শৈলব্রাহ্মণ ভগবানের দেহে বত্রিশ মহাপুরুষ-লক্ষণ অনুসন্ধান করিলেন। শৈলব্রাহ্মাণ বত্রিশ মহাপুরুষ-লক্ষণের মধ্যে দুইটি ব্যতীত অধিকাংশ লক্ষণ ভগবানের দেহে দেখিতে পাইলেন। কোষাচ্ছাদিত গুহ্যেন্দ্রিয় ও প্রশস্তজিহ্বা এই দুই মহাপুরুষ-লক্ষণ সম্বন্ধে সন্দেহ ও বিচিকিৎসা রহিল, স্থির প্রত্যয় ও প্রসাদ জন্মিল না। তখন ভগবান এমন ঋদ্ধি (যোগ-বিভূতি) প্রদর্শন করিলেন, যাহাতে শৈলব্রাহ্মণ তাঁহার কোষাচ্ছাদিত বস্তী-গুহ্য দেখিতে পান; ভগবান জিহ্বা বাহির করিয়া তদ্বারা উভয় কর্ণ স্পর্শ করিলেন ...... , ললাট মণ্ডলের সর্বত্র জিহ্বাদ্বারা আচ্ছাদন করিলেন। তখন শৈলব্রাহ্মণের এই বিচার হইল,- “শ্রমণ গৌতম অপূর্ণ নহেন, পরিপূর্ণ বত্রিশ মহাপুরুষ-লক্ষণ সমন্বিত। কিন্তু জানিতে পারিলাম না,- তিনি বুদ্ধ হন কিনা? বয়োবৃদ্ধ, মহল্লক ব্রাহ্মণ আচার্য-প্রাচার্যদের মুখে শুনিয়াছি- ‘যাঁহারা অর্হৎ সম্যক্‌সম্বুদ্ধ হন তাঁহারা স্বীয়গুণ বর্ণিত হইলে আত্ম-প্রকাশ করিয়া থাকেন। সুতরাং আমি শ্রমণ গৌতমের সম্মুখে উপযুক্ত গাথাদ্বারা স্তুতি করি’।”

৩৯৯। অতঃপর শৈলব্রাহ্মণ ভগবানের সম্মুখে উপযুক্ত গাথাদ্বারা স্তুতি আরম্ভ করিলেন,-

“সুজাত, সুরুচি তুমি, পূর্ণদেহী, সুচারু-দর্শন,

স্বর্ণ-কান্তি, শুক্ল-দন্ত, বীর্যবান হও ভগবন! ১

সুজাত নরের যাহা হয় মহত্বের নিদর্শন,

তব দেহে সে সকল আছে মহাপুরুষ-লক্ষণ। ২

উজ্জ্বল বদন, নির্মল নয়ন, ঋজুদেহ, অতি তেজবান,

শ্রমণ সংঘের মাঝে বিরোচন, হও তুমি আদিত্য-সমান। ৩

কাঞ্চন-সন্নিভ চর্ম, ওহে ভিক্ষু! কল্যাণ-দর্শন,

এমন উত্তম দেহে, শ্রমণত্বে কীবা প্রয়োজন? ৪

রথী-শ্রেষ্ঠ চক্রবর্তী রাজা হওয়ার যোগ্যতর;

দিগ্বিজয়ী বীর হও তুমি জম্বুদ্বীপ-অধীশ্বর। ৫

ক্ষত্রিয় রাজারা তব অনুরক্ত হবে আজ্ঞাধীন,

সার্বভৌম মানবেন্দ্ররূপ রাজ্য শাসহে স্বাধীন!” ৬

“(শৈল!) রাজা আমি অনুত্তর, নিখিল বিশ্বের অধীশ্বর,

‘ধর্মতঃ চালাই চক্র’, প্রতিদ্বন্দী নাই অন্যতর।” ৭

“অনুত্তর ধর্মরাজ বুদ্ধ বলে করিছ জ্ঞাপন,

‘ধর্মতঃ চালাই চক্র’, কহিতেছ ইহা, ভগবন? ৮

শাস্তার শ্রাবকে প্রভু! কোন্‌ সেনাপতি দান্তজন,

তব প্রবর্তিত ধর্মচক্র করিবেন প্রবর্তন?” ৯

“মম প্রবর্তিত চক্র, ওহে শৈল! ধর্মচক্র অনুত্তর,

তথাগত অনুজাত সারীপুত্র প্রবর্তিবে অনন্তর। ১০

অববোধ্য দুঃখ-সত্য, বিদ্যা আর বিমুক্তি উত্তম,

প্রহাতব্য সমুদয়, তাহা আমি করেছি বর্জন।

নিরোধ প্রত্যক্ষযোগ্য, করিয়াছি প্রত্যক্ষ এখন,

ভাবনীয় মার্গ-সত্য, মম চিত্তে করেছি ভাবন;

বুঝি আর্য-সত্য আমি, তাই বুদ্ধ জানিবে ব্রাহ্মণ। ১১

ছাড় কঙ্খা, রাখ শ্রদ্ধা, আমার বিষয়ে, হে ব্রাহ্মণ!

অতীব দুর্লভ লোকে নিরন্তর বুদ্ধ-দরশন। ১২

প্রাদুর্ভাব যাঁহাদের জগতে দুর্লভ নিরন্তর,

হে ব্রাহ্মণ! সে সম্বুদ্ধ আমি শল্য-কর্তা অনুত্তর। ১৩

ব্রহ্মভূত অনুপম মার-সৈন্য করেছি মর্দন,

সর্বরিপু পরিহরি ভয়শুন্য মোদিত জীবন।” ১৪

“শোন, ওহে শিষ্যগণ! চক্ষুষ্মান করেন ভাষণ,

শল্য-কর্তা মহাবীর বলে যথা কেশরী-গর্জন। ১৫

ব্রহ্মভূত নিরুপম মারসৈন্য করেছেন জয়,

নীচকুলে জাত সে, যে দেখে তাঁকে প্রসন্ন না হয়। ১৬

যার ইচ্ছা অনুসর, অনিচ্ছুক করহ প্রস্থান,

লভিব প্রব্রজ্যা আমি জ্ঞানীশ্রেষ্ঠ বুদ্ধ-সন্নিধান। ১৭

ত্রিশত ব্রাহ্মণ এরা, যুক্তাঞ্জলি করিছে যাচন,

ব্রহ্মচর্য আচরিব তব কাছে, ওহে ভগবন!” ১৮

“সুব্যাখ্যাত ব্রহ্মচর্য, এস, শৈল! কর আচরণ,

স্ব-জ্ঞানে প্রত্যক্ষ-যোগ্য, কালাপেক্ষা নহে কদাচন;

সংযম সাধনা জ্ঞানে, শিক্ষাব্রতী প্রমাদ নিধন,

প্রব্রজ্যা অব্যর্থ হয়, ব্রহ্মচর্যে সার্থক জীবন।” ১৯

পরিষদ সহ শৈলব্রাহ্মণ ভগবৎ-সমীপে প্রব্রজ্যা ও উপসম্পদা লাভ করিলেন।

৪০০। তখন কেণিয় জটিল সেই রাত্রি অতিবাহিত হইলে স্বীয় আশ্রমে উৎকৃষ্ট খাদ্য-ভোজ্য প্রস্তুত করিয়া ভগবানকে কাল নিবেদন করিলেন,- “ভো গৌতম সময় হইয়াছে, ভোজন প্রস্তুত।” তখন ভগবান পূর্বাহ্ন সময়ে নিবাসন পরিধান করিয়া পাত্র-চীবর ধারণপূর্বক কেণিয় জটিলের আশ্রমে উপনীত হইলেন এবং ভিক্ষুসংঘ সহ সজ্জিত আসনে উপবেশন করিলেন। কেণিয় জটিল স্বহস্তে বুদ্ধপ্রমুখ ভিক্ষুসংঘকে উৎকৃষ্ট খাদ্য-ভোজ্য দ্বারা সন্তর্পিত (পরিতৃপ্ত) করিলেন; সংপ্রবারিত করিলেন। ভগবান ভোজন শেষ করিয়া পাত্র হইতে হস্ত অপসারণ করিলে কেণিয় জটিল এক নীচ আসন লইয়া একপ্রান্তে বসিলেন, একপ্রান্তে উপবিষ্ট কেণিয় জটিলকে ভগবান এই গাথাদ্বারা অনুমোদন করিলেন,-

“অগ্নি-হোত্র, যজ্ঞে মুখ্য, সাবিত্রী-ছন্দের প্রধান,

মানবের শ্রেষ্ঠরাজা, নদীমাঝে সমুদ্র মহান।

নক্ষত্রের মুখ্য-চন্দ্র, তাপীদের আদিত্য প্রধান,

পুণ্যকামী দাতৃদের, দক্ষিণার্হ সঙ্ঘই মহান।”

ভগবান কেণিয় জটিলকে এই গাথাদ্বারা অনুমোদন করিয়া আসন হইতে উঠিয়া প্রস্থান করিলেন।

তখন আয়ুষ্মান শৈল পরিষদ সহ নির্জনে প্রমাদ রহিত, উদ্যোগযুক্ত সমর্পিত (তন্ময়) চিত্তে অবস্থান করিয়া অচিরে যার জন্য কুলপুত্রগণ আগার হইতে অনাগারিকরূপে প্রব্রজিত হয়, সেই অত্যুত্তম ব্রহ্মচর্যের অবসান (নির্বান) ইহজীবনে স্বয়ং অভিজ্ঞাদ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া, উপলব্ধি করিয়া বিহার করিতে লাগিলেন। তাঁহার জন্ম ক্ষয় হইল, ব্রহ্মচর্যবাস পূর্ণ হইল, করণীয় কৃত হইল, আর এই জীবনের জন্য কিছু করিবার নাই- ইহা তিনি অবগত হইলেন। সপরিষদ আয়ুষ্মান শৈল অর্হতদের অন্যতম হইলেন।

অতঃপর আয়ুষ্মান শৈল শাস্তার সমীপে গিয়া চীবর একাংসে (বামস্কন্ধে) রাখিয়া যেদিকে ভগবান আছেন সেদিকে যুক্তাঞ্জলি হইয়া ভগবানকে গাথাদ্বারা কহিলেন,-

আটদিন গত মাত্র, চক্ষুষ্মান! আসিনু তব শরণে,

সপ্তরাতে ভগবন! আমা সবে দমিলে তব শাসনে। ১

বুদ্ধ তুমি, শাস্তা তুমি, তুমি মুনি মার পরাভবকারী,

ছেদিয়া অনুশয়ে তীর্ণ তুমি, জীবের হও ত্রাণকারী। ২

উপধি তব অতিক্রান্ত, সর্ব আসব তব প্রদলিত,

সিংহসম, প্রনষ্ট ভয়-ভৈরব, উপাদান বিরহিত। ৩

এই ত্রিশত ভিক্ষু হেথায় রহিয়াছে অঞ্জলি করণে,

প্রসার পাদদ্বয় বীর! নাগেরা বন্দে শাস্তার চরণে।” ৪

॥ শৈল সূত্র সমাপ্ত ॥

অস্‌সলায়ণ সূত্র (৯৩)

(বর্ণব্যবস্থার খণ্ডন)

৪০১। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-

এক সময় ভগবান শ্রাবস্তীতে অনাথপিণ্ডিকের জেতবন আরামে বাস করিতেছেন। সেই সময় বিভিন্ন রাজ্যবাসী ব্রাহ্মণদের মধ্যে পঞ্চশত পরিমাণ ব্রাহ্মণ কোন কার্যোপলক্ষে শ্রাবস্তীতে বাস করিতেন। তখন সেই ব্রাহ্মণদের এই চিন্তা উদয় হইল,- “এই শ্রমণ গৌতম চারি বর্ণের শুদ্ধি (চাতুর্বণ্য শুদ্ধি) সম্বন্ধে প্রচার করেন। এ বিষয়ে শ্রমণ গৌতমের সহিত কে প্রতিবাদ (তর্ক) করিতে সমর্থ হইবে?”

সেই সময় শ্রাবস্তীতে অশ্বলায়ন নামক মুণ্ডিত শির তরুণ মাণব (বিদ্যার্থী) বাস করিতেন। তিনি নিঘণ্টু-কেটুভ (কল্প) ও অক্ষর-প্রভেদ (শিক্ষা) সহিত ত্রিবেদ তথা পঞ্চম ইতিহাসে পারগূ, আর পদক (কবি), বৈয়াকরণ, লোকায়ত, মহাপুরুষ-লক্ষণে নিপুণ ছিলেন। তখন সেই ব্রাহ্মণের মনে হইল,- “এই শ্রাবস্তীতে অশ্বলায়ন ...... মাণব বাস করেন, তিনি শ্রমণ গৌতমের সাথে এই বিষয়ে প্রতিবাদ করিতে সমর্থ হইবেন।”

তখন সেই ব্রাহ্মণগণ যেখানে অশ্বলায়ন মাণব থাকেন সেস্থানে গেলেন এবং অশ্বলায়ন মাণবকে বলিলেন,- “অশ্বলায়ন! এই শ্রমণ গৌতম চাতুর্বর্ণ্য শুদ্ধি প্রচার করেন। মাননীয় অশ্বলায়ন! আপনি আসুন, শ্রমণ গৌতমের সহিত এ বিষয়ে প্রতিবাদ করুন।”

এই প্রকার উক্ত হইলে অশ্বলায়ন মাণব সেই ব্রাহ্মণদিগকে কহিলেন,- “ওহে মহাশয়গণ! শ্রমণ গৌতম ধর্ম (যথাভূত) বাদী, ধর্মবাদীরা দুষপ্রতিমন্ত্য- আমাদের মত লোকের প্রতিবাদের আযোগ্য হন। আমি শ্রমণ গৌতমের সহিত এ বিষয়ে প্রতিবাদ করিতে সমর্থ হইব না।”

দ্বিতীয়বারও সেই ব্রাহ্মণেরা তরুণ অশ্বলায়নকে বলিলেন,- “......। মাননীয় অশ্বলায়নের পরিব্রাজক বিধান উত্তমরূপে অভিজ্ঞাত ও আচরিত হইয়াছে।

[দ্বিতীয়বারও অশ্বলায়ন ঐ ভাবে প্রত্যাখ্যান করিলেন।]

তৃতীয়বারও ...... বলিলেন,- “আসুন ...... শ্রমণ গৌতমের সাথে এ বিষয়ে প্রতিবাদ করুন। মাননীয় অশ্বলায়ন পরিব্রাজকের বিধান আচরণ করিতেছেন। মাননীয় অশ্বলায়ন বাক্‌যুদ্ধে পরাজিত না হইয়াই পরাজয় স্বীকার করিবেন না।”

এইরূপ উক্ত হইলে যুবক অশ্বলায়ন সেই ব্রাহ্মণদিগকে কহিলেন,- “মহাশয়গণ! নিশ্চয় আমি জয়লাভ করিব না, শ্রমণ গৌতম ধর্মবাদী। ধর্মবাদীরা প্রতিবাদের অযোগ্য হন। আমি শ্রমণ গৌতমের সহিত এই আলোচনায় প্রতিবাদ করিতে সমর্থ হইব না। তথাপি আপনাদের অনুরোধে আমি যাইব।”

৪০২। তখন অশ্বলায়ন মাণব বৃহৎ ব্রাহ্মণসংঘের সহিত যেখানে ভগবান আছেন সেখানে উপনীত হইলেন এবং ভগবানের সাথে সম্মোদন করিয়া একপ্রান্তে উপবেশন করিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট অশ্বলায়ন মাণব ভগবানকে ইহা বলিলেন,- “ভো গৌতম! ব্রাহ্মণেরা এরূপ বলেন,- ‘ব্রাহ্মণই শ্রেষ্ঠবর্ণ, অন্যবর্ণ হীন। ব্রাহ্মণই শুক্লবর্ণ, অপরবর্ণ কৃষ্ণ। ব্রাহ্মণেরাই শুদ্ধ হন, অব্রাহ্মণেরা নহে। ব্রাহ্মণেরাই ব্রহ্মার ঔরস-পুত্র, মুখ হইতে উৎপন্ন, ব্রহ্মজ, ব্রহ্ম-নির্মিত ব্রহ্মের দায়াদ।’ এ বিষয়ে প্রভু গৌতম কি বলেন?”

“বস্তুতঃ অশ্বলায়ন! ব্রাহ্মণদের ব্রাহ্মণীদিগকে ঋতুমতী হইতে, গর্ভধারণ করিতে, প্রসব করিতে ও স্তন্যপান করাইতে দেখা যায়, তাহারা ব্রাহ্মণীযোনিজ হইয়াই এইরূপ বলে,- ‘ব্রাহ্মণেরাই শ্রেষ্ঠবর্ণ ...... ব্রহ্ম-দায়াদ ’।”

“যদিও প্রভু গৌতম ইহা বলিতেছেন- তথাপি ব্রাহ্মণেরা এ ধারণা পোষণ করেন- ‘ব্রাহ্মণই শ্রেষ্ঠবর্ণ ...... ব্রহ্ম-দায়াদ’।”

৪০৩। “তাহা কি মনে কর, অশ্বলায়ন! তুমি শুনিয়াছ কি? যবন কম্বোজ আর অপর প্রত্যন্ত জনপদ সমূহে আর্য (প্রভু) আর দাস দুইবর্ণই আছে; তথায় আর্য হইয়া দাস হয়, দাস হইয়াও আর্য হইয়া থাকে ।”

“হাঁ, ভো! আমি শুনিয়াছি ......।”

“অশ্বলায়ন! এ বিষয়ে ব্রাহ্মণদের কি বল, কি অধিকার যে তাহারা এরূপ বলিবে,- ‘ব্রাহ্মণই শ্রেষ্ঠবর্ণ, অপরবর্ণ হীন ......’?”

“যদিও প্রভু গৌতম এরূপ বলিতেছেন, তথাপি ব্রাহ্মণেরা এ বিষয়ে এই ধারণাই পোষণ করেন- ‘ব্রাহ্মণই শ্রেষ্ঠবর্ণ ...... ব্রহ্ম-দায়াদ’।”

৪০৪। “তাহা কি মনে কর, অশ্বলায়ন! ক্ষত্রিয়ও যদি প্রাণিহিংসাকারী, চোর, ব্যভিচারী, মিথ্যাবাদী, পিশুনভাষী, কর্কশভাষী, সমপ্রলাপী, অত্যন্ত লোভী, বিদ্বেষ চিত্ত ও মিথ্যাদৃষ্টি (ভ্রান্তধারণা) সম্পন্ন হয়; (তবে) দেহ-ত্যাগে মৃত্যুর পর অপায় দুর্গতি বিনিপাত-নরকে উৎপন্ন হইবে কিংবা হইবে না? ব্রাহ্মণ .... , বৈশ্য ...... , শূদ্র ...... ?”

“ভো গৌতম! ক্ষত্রিয় ...... , ব্রাহ্মণ ...... , বৈশ্য ...... , শূদ্রও ...... চারিবর্ণের সকলেই যদি প্রাণিহিংসাকারী ...... মিথ্যাদৃষ্টি সম্পন্ন হয় তবে ...... নরকে উৎপন্ন হইবে।”

“তবে পুনশ্চ অশ্বলায়ন! ব্রাহ্মণদের কি বল, কোন্‌ আশ্বাস যে তাহারা এইরূপ বলিবে,- ‘ব্রাহ্মণই শ্রেষ্ঠবর্ণ ...... ব্রহ্ম-দায়াদ?”

“ ...... তথাপি ব্রাহ্মণেরা এইরূপই ত বলিয়া থাকেন ......।”

৪০৫। “তাহা কি মনে কর, অশ্বলায়ন! যদি ব্রাহ্মণ প্রাণিহিংসা বিরত হয়, চৌর্য ও ব্যভিচার বিরত হয়, মিথ্যাবাক্য, পিশুনবাক্য, কর্কশবাক্য ও সমপ্রলাপ বিরত হয়, অলোভী, অদ্বেষী ও সম্যক্‌দৃষ্টি সম্পন্ন হয়, তবে সে দেহ-ত্যাগে মৃত্যুর পর সুগতি স্বর্গলোকে উৎপন্ন হয়; কিন্তু ক্ষত্রিয় নহে, বৈশ্য নহে, শূদ্র নহে?”

“না, হে গৌতম! ক্ষত্রিয়ও প্রাণীহিংসা বিরত ...... সম্যক্‌দৃষ্টি সম্পন্ন ...... সুগতি স্বর্গলোকে উৎপন্ন হয়, ব্রাহ্মণও ...... , বৈশ্যও ...... , শূদ্রও ...... ; চারিবর্ণের সকলেই ...... স্বর্গলোকে উৎপন্ন হয়।”

“এ বিষয়ে অশ্বলায়ন! ব্রাহ্মণদের কি বল, কোন্‌ আশ্বাস ...... ?”

৪০৬। “তাহা কি মনে কর, অশ্বলায়ন! কেবল ব্রাহ্মণই কি এই প্রদেশে বৈর-রহিত, বিদ্বেষ-রহিত মৈত্রী-চিত্ত ভাবনা করিতে সমর্থ হয়? কিন্তু তথা ক্ষত্রিয় নহে, বৈশ্য নহে, শূদ্র নহে?”

“না, হে গৌতম! ক্ষত্রিয়ও এই প্রদেশে ...... মৈত্রী-চিত্ত ভাবনা করিতে সমর্থ হয়, ......। চারিবর্ণের সকলেই ...... মৈত্রী-চিত্ত ভাবনা করিতে সমর্থ হয়।”

“এখানে, অশ্বলায়ন! ব্রাহ্মণদের কি বল, কোন্‌ অধিকার ...... ?”

৪০৭। “তাহা কি মনে কর, অশ্বলায়ন! কেমন, কেবল ব্রাহ্মণই সাবান (সোত্তি) ্লানোপকরণ লইয়া নদীতে ধূলি-কর্দ্দম ধৌত করিতে সমর্থ হয়, কিন্তু ক্ষত্রিয় নহে ...... ?”

“না, হে গৌতম! ক্ষত্রিয়ও সমর্থ হয়.......। চারিবর্ণের সকলেই সমর্থ হয়।”

“এখানে, অশ্বলায়ন! ব্রাহ্মণদের কি বল ...... ?”

৪০৮। “অশ্বলায়ন! তাহা কি মনে কর, (যদি) এখানে মূর্ধাভিষিক্ত ক্ষত্রিয় রাজা নানা জাতির শত পুরুষকে সম্মিলিত করেন, (আর উহাদিগকে বলেন)- ‘আসুন, মহাশয়েরা! যাহারা ক্ষত্রিয়কুলে, ব্রাহ্মণকুলে ও রাজন্যকুলে উৎপন্ন হইয়াছেন, শাল, সরল, চন্দন কিংবা পদ্মকাষ্ঠের উত্তরারণী লইয়া অগ্নি উৎপাদিত করুন, তেজ প্রাদুর্ভূত করুন। আর যাহারা চণ্ডালকুলে, নিষাদকুলে, বেণ (ডোম) কুলে, রথকারকুলে, পুক্কুশকুলে উৎপন্ন হইয়াছ, তোমরাও আস; কুকুরের পানদ্রোণী, শূকর-দ্রোণী, রজক-দ্রোণী কিংবা এরণ্ড কাষ্ঠের উত্তরারণী লইয়া অগ্নি উৎপাদন কর, তেজ প্রাদুর্ভূত কর।’ তাহা কি মনে হয়, অশ্বলায়ন! ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, শূদ্রকুলে উৎপন্নদের দ্বারা শাল, সরল, চন্দনকাষ্ঠের উত্তরারণী লইয়া যে অগ্নি উৎপাদিত ও যে তেজ প্রাদুর্ভূত হইয়াছে; কেমন, উহাই কি অর্চিমান, বর্ণবান ও প্রভাস্বর অগ্নি হইবে? সেই অগ্নিদ্বারা অগ্নিকৃত্য সম্পাদন সম্ভব হইবে; আর সেই চণ্ডাল-নিষাদ-বেণ-রথকার-পুক্কুশ কুলোদ্ভবদের দ্বারা শ্বা-পার্নদ্রোণী, শূকর-দ্রোণী এরণ্ডকাষ্ঠের উত্তরারণী লইয়া প্রজ্বলিত অগ্নি প্রাদুর্ভূত যে তেজ উহা অর্চিমান, বর্ণবান ও প্রভাস্বর হইবে না? সেই অগ্নিদ্বারা অগ্নি-কৃত্য কি সম্ভব হইবে না?”

“নিশ্চয় না, ভো গৌতম! ক্ষত্রিয় ...... কুলোদ্ভবদের দ্বারা উৎপাদিত ...... যে অগ্নি আছে, ...... উহাও ...... অর্চিমান ...... অগ্নি হইবে; সে অগ্নিতেও অগ্নি-কৃত্য সম্পাদন সম্ভব; আর সেই চণ্ডাল ...... কুলোৎপন্নদের দ্বারা উৎপাদিত যে অগ্নি আছে, ...... উহাও অর্চিমান ...... অগ্নি হইবে। সেই অগ্নিতেও অগ্নি-কৃত্য করা সম্ভব।”

“এখানে অশ্বলায়ন! ব্রাহ্মণদের কি বল ...... ?”

৪০৯। “তাহা কি মনে কর, অশ্বলায়ন! যদি ক্ষত্রিয়কুমার ব্রাহ্মণকন্যার সহিত সংবাস করে এবং তাহাদের সহবাস হেতু পুত্র উৎপন্ন হয়; তবে সেই ক্ষত্রিয়কুমার দ্বারা ব্রাহ্মণকন্যার গর্ভজাত যে পুত্র হইয়াছে সে মাতারও সমান পিতারও সমান অধিকারী। সুতরাং সে ক্ষত্রিয়-ব্রাহ্মণ নামে অভিহিত হওয়া উচিত নহে কি?”

“ভো গৌতম! ক্ষত্রিয়-ব্রাহ্মণ নামে অভিহিত হওয়া উচিত।”

“অশ্বলায়ন! যদি ব্রাহ্মণকুমার ক্ষত্রিয়কন্যার সহিত সংবাস করে, ...... ব্রাহ্মণ বলা উচিত কি?”

“হাঁ, ব্রাহ্মণ বলা উচিত।”

“ ...... অশ্বলায়ন! যদি ঘোড়াকে গাধাদ্বারা সমপ্রযোগ করা যায়, উহাদের সংযোগ হেতু কিশোর (বাচ্চা) উৎপন্ন হয়। সেই ঘোড়া-গাধার সংযোগে যে কিশোর উৎপন্ন হইল, উহাকে মাতা-পিতার সমানহেতু ঘোড়া-গাধা বলা উচিত কি?

হে গৌতম! বৈশাদৃশ্যহেতুই (বেকুরঞ্জাযহি সো) উহা অশ্বতর হয়। ভো গৌতম! এই মাত্র ইহার নানা কারণ বা প্রভেদ দেখিতে পাই। সেই পূর্বনিয়মানুসারে কিন্তু এই সকল মাণবের মধ্যে কোন নানা কারণ বা প্রভেদ দেখি না।”

“ ...... অশ্বলায়ন! এখানে দুই ব্রাহ্মণকুমার (যমজ) সহোদর ভ্রাতা হয়। তাহাদের একজন অধ্যয়নশীল ও উপনীত (উপনয়ন দ্বারা গুরু সমীপে আগত) অপর অনধ্যয়নশীল ও অনুপনীত। শ্রাদ্ধে, মঙ্গল-কর্মে, যজ্ঞে অথবা আগন্তুক হিসাবে এখানে ব্রাহ্মণেরা কাহাকে প্রথম ভোজন করাইবে?”

“ভো গৌতম! যে মাণব অধ্যয়নশীল ও উপনীত, তাহাকেই প্রথম ভোজন করাইবেন। অনধ্যয়নশীল ও অনুপনীতকে দান দিলে কি মহৎ ফল হইবে?”

“তাহা কি মনেকর, অশ্বলায়ন! এখানে দুই মাণব সহোদর ভাই। একজন অধ্যয়নশীল ও উপনীত, কিন্তু দুঃশীল (দুরাচারী), পাপধর্মা; অপর অনধ্যয়নরত ও অনুপনীত কিন্তু শীলবান কল্যাণধর্মা। ব্রাহ্মণের ইহাদের মধ্যে শ্রাদ্ধে, উপহারে, যজ্ঞে কিংবা আগন্তুক হিসাবে কাহাকে ভোজন করাইবে?”

“ভো গৌতম! যে মাণব অনধ্যয়নরত, অনুপনীত কিন্তু শীলবান কল্যাণধর্মা হয়, তাহাকেই ব্রাহ্মণগণ প্রথম ভোজন করাইবেন। দুঃশীল পাপধর্মাকে দান দিলে কি মহাফল হইবে?”

“অশ্বলায়ন! প্রথমে তুমি জাতিবাদে গিয়াছিলে, জাতিতে গিয়া মন্ত্রে পৌঁছিলে, তৎপর তপস্যায় উপনীত হইলে; অধুনা আমি যাহার উপদেশ করিতেছি- তুমি সেই চাতুর্বণ্যশুদ্ধিতে প্রত্যাবর্তন করিলে।”

এইরূপ কথিত হইলে অশ্বলায়ন মাণব তুষ্ণীম্ভূত, মঙ্কুভূত, পতিতস্কন্ধ, অধোমুখ, চিন্তাযুক্ত ও অপ্রতিভ হইয়া উপবিষ্ট রহিলেন।

৪১০। তখন ভগবান অশ্বলায়ন মাণবকে ...... অপ্রতিভ দেখিয়া কহিলেন,- “পূর্বকালে, অশ্বলায়ন! অরণ্যে পর্ণকুটিরবাসী সাতজন ব্রাহ্মণঋষির এই প্রকার পাপদৃষ্টি উৎপন্ন হইল- ‘ব্রাহ্মণই শ্রেষ্ঠবর্ণ অপরবর্ণ হীন ......।’ অশ্বলায়ন! তখন অসিত (কাল) দেবলঋষি শুনিলেন, ...... সপ্ত, ব্রাহ্মণ-ঋষির এই প্রকার পাপদৃষ্টি উৎপন্ন হইয়াছে ......। তখন অসিতদেবল ঋষি কেশ-শ্মশ্রু মুণ্ডন করিয়া মঞ্জিষ্ঠা বর্ণের বস্ত্র পরিধান করিয়া কাষ্ঠপাদুকায় (অটনিযো উপহানা) আরোহণ পূর্ব্বক স্বর্ণ-রজতের দণ্ড ধারণ করিয়া সপ্ত ব্রাহ্মণ-ঋষির কুটিরাঙ্গণে প্রাদুর্ভূত হইলেন।

অশ্বলায়ন! তখন অসিতদেবল ঋষি সপ্ত ব্রাহ্মণঋষির কুটিরাঙ্গণে পায়চারী করিতে করিতে কহিলেন,- ‘আহা! এই মাননীয় ব্রাহ্মণঋষিরা কোথায় গেলেন?’ অশ্বলায়ন! তখন সেই সপ্ত ব্রাহ্মণঋষির মনে হইল- ‘এ আবার কে? গ্রাম্য বালকের ন্যায় সপ্ত ব্রাহ্মণঋষির কুটিরাঙ্গণে চংক্রমণ করিতে করিতে কহিতেছে- আহা! ...... বেশ, ইহাকে অভিশাপ দিব।’ অশ্বলায়ন! তখন সপ্ত ব্রাহ্মণঋষি অসিতদেবলকে অভিশাপ দিলেন- ‘বৃষল (শূদ্র)! তুমি ভস্মীভূত হও।’ অশ্বলায়ন! সপ্ত ব্রাহ্মণঋষি অসিতদেবল ঋষিকে যেমন যেমন অভিশাপ দিতেছিল, তেমন তেমনই ...... দেবলঋষি অধিকতর সুন্দর, অধিকতর দর্শনীয়, অধিকতর প্রাসাদিক হইতে লাগিলেন। তখন সপ্ত ব্রাহ্মণ-ঋষির চিন্তা হইল- ‘আমাদের তপস্যা ব্যর্থ, ব্রহ্মচর্য নিষ্ফল। আমরা পূর্বে- বৃষল তুমি ভস্মীভূত হও বলিয়া যাহাকে অভিশাপ দিতাম,সে একরকম ভস্মীভূতই হইত। ইহাকে আমরা যেমন শাপ দিতেছি তেমন তেমনই সে অধিকতর রূপবান, দর্শনীয় ও প্রাসাদিক হইতেছে।’ (দেবল কহিলেন) ‘ওহে! আপনাদের তপস্যা ব্যর্থ নহে, ব্রহ্মচর্য নিষ্ফল নহে; আপনারা যে আমার প্রতি মন-প্রদূষিত করিয়াছেন, উহা পরিত্যাগ করুন।’

‘আমাদের যে মন-বিদ্বেষ আছে, তাহা আমরা ত্যাগ করিলাম। আপনি কে?’

‘আপনারা অসিতদেবল ঋষির নাম শুনিয়াছেন?’

‘হাঁ, ভো!’

‘আমি সে-ই হই।’

তখন অশ্বলায়ন! সপ্ত ব্রাহ্মণঋষি অভিবাদন করিবার মানসে অসিতদেবল ঋষির সমীপে গেলেন।

৪১১। তখন অসিতদেবল ঋষি সপ্ত ব্রাহ্মণঋষিকে কহিলেন,- ‘আমি শুনিয়াছি যে ...... অরণ্যের মধ্যে পর্ণকুটিরবাসী সপ্ত ব্রাহ্মণঋষির এই প্রকার পাপ-দৃষ্টি উৎপন্ন হইয়াছে- ব্রাহ্মণই শ্রেষ্ঠবর্ণ ......।’

‘হাঁ, ভো!’

‘জানেন কি আপনাদের জননী মাতা ব্রাহ্মণদেরই সমীপে গিয়াছিলেন, অব্রাহ্মণের নিকট নহে?’

‘না, মহাশয়!’

‘জানেন কি আপনাদের জননী-মাতার মাতা যাবৎ সপ্তম মাতামহী যুগ (পরম্পরা) ব্রাহ্মণেরই নিকট গিয়াছেন, অব্রাহ্মণের নিকট নহে?’

‘না, মহাশয়!’

‘জানেন কি আপনাদের জনক পিতা, ...... পিতামহ যুগ সপ্তম পুরুষ পরম্পরা পর্যন্ত ব্রাহ্মণীর কাছে গিয়াছিলেন, অব্রাহ্মণীর কাছে নহে?’

‘না, মহাশয়!’

‘কি প্রকারে গর্ভাবক্রান্তি হয়, আপনারা জানেন কি?’

‘হাঁ, মহাশয়! আমরা জানি- যেরূপে গর্ভের অবক্রান্তি হয়,- যখন মাতা ঋতুমতী হয়, মাতা-পিতা সম্মিলিত হয়, আর গন্ধর্বও (উৎপদ্যমান সত্ব) উপস্থিত হয়; এইরূপে তিনের (প্রবাহের) সংযোগ হেতু তখন গর্ভের অবক্রান্তি (প্রাদুর্ভাব) হয়।’

‘মহাশয়গণ! আপনারা জানেন কি সেই গন্ধর্ব ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, কিংবা শূদ্র?’

‘না, মহাশয়! আমরা জানি না।’

‘তাহা হইলে মহাশয়েরা জানেন কি আপনারা কে হন?’

‘হাঁ, মহাশয়! তাহা হইলে আমরা কে হই তাহা জানি না।’

“হে অশ্বলায়ন! অসিতদেবল (পঞ্চাভিজ্ঞ) ঋষিদ্বারা স্বীয় জাতিবাদে (গন্ধর্ব প্রশ্ন) অনুসন্ধিত হইয়া, সমনুভাষিত (পর্যালোচিত) হইয়া ও জিজ্ঞাসিত হইয়া সেই সপ্ত ব্রাহ্মণ ঋষিগণ উত্তর দিতে সমর্থ হন নাই। এখন আমা কর্তৃক জিজ্ঞাসিত হইয়া ...... স্বীয় জাতিবাদ সম্বন্ধে তুমি কি উত্তর দিবে? যেহেতু তোমার পাণ্ডিত্যসহ তুমি তাহাদের দর্বী-গ্রাহী পূর্ণের সমানও নও।”

এইরূপ উক্ত হইলে অশ্বলায়ন মাণব ভগবানকে বলিলেন,- “আশ্চর্য, হে গৌতম! আশ্চর্য, হে গৌতম! ...... গৌতম! আজ হইতে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত আমাকে শরণাগত উপাসকরূপে ধারণা করুন।”

॥ অশ্বলায়ন সূত্র সমাপ্ত ॥

ঘোটমুখ সূত্র (৯৪)

(চার প্রকার পুরুষ)

৪১২। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-

এক সময় আয়ুষ্মান উদয়ন বারাণসীতে ক্ষেমীয় আম্রবনে অবস্থান করিতেছেন। সেই সময় ঘোটমুখ ব্রাহ্মণ কোন কার্যোপলক্ষে বারাণসীতে উপস্থিত ছিলেন। তখন ঘোটমুখ ব্রাহ্মণ জঙ্ঘাবিহারার্থ চংক্রমণ ও বিচরণ করিতে করিতে যেখানে ক্ষেমীয় আম্রবন সেখানে পৌঁছিলেন। তখন আয়ুষ্মান উদয়ন খোলাস্থানে চংক্রমণ করিতেছেন।

তখন ঘোটমুখ ব্রাহ্মণ যেখানে আয়ুষ্মান উদয়ন আছেন, সেখানে গেলেন। তথায় গিয়া আয়ুষ্মান উদয়নের সাথে ...... সম্মোদন করিয়া তাঁহার পিছে পিছে চংক্রমণ করিতে করিতে কহিলেন,- “ওহে শ্রমণ! আমার মনে হয় প্রকৃত ধার্মিক প্রব্রজ্যা (সন্ন্যাস) নাই। ভবাদৃশ (মহৎ) গণের কিংবা এখানে যে ধর্মস্বভাব আছে, তাহার অদর্শন হেতু এ সম্বন্ধে আমার এই ধারণা জন্মিয়াছে।”

এই কথা উক্ত হইলে আয়ুষ্মান উদয়ন চংক্রমণ হইতে অবতরণ করিয়া বিহারে (পর্ণকুটিরে) প্রবেশ করিয়া প্রজ্ঞাপ্ত আসনে উপবেশন করিলেন। ঘোটমুখ ব্রাহ্মণও বিহারে প্রবিষ্ট হইয়া একপ্রান্তে দাঁড়াইলেন। একপ্রান্তে দণ্ডায়মান ঘোটমুখ ব্রাহ্মণকে আয়ুষ্মান উদয়ন বলিলেন,- “ব্রাহ্মণ! আসন বিদ্যমান, যদি ইচ্ছা হয় বসিতে পারেন।”

“প্রভু উদয়নের (আদেশের) অপেক্ষায়ই আমরা বসি নাই। আমার মত লোক পূর্বে নিমন্ত্রিত না হইয়া (স্বয়ং) কি প্রকারে আসনে বসা উচিত মনে করিতে পারেন?”

তখন ঘোটমুখ ব্রাহ্মণ নীচ এক আসন লইয়া একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট ঘোটমুখ ব্রাহ্মণ আয়ুষ্মান উদয়নকে কহিলেন,- “অহো শ্রমণ! প্রকৃত ধার্মিক প্রব্রজ্যা নাই, আমার এ ধারণা; তাহাও ভবাদৃশদের কিংবা এখানে যে ধর্মস্বভাব আছে উহার অদর্শন হেতু হইয়াছে।”

“ব্রাহ্মণ! আমার বাক্য যদি সমর্থনীয় হয় তবে আপনি সমর্থন করিবেন। আর যদি খণ্ডনীয় হয় তবে খণ্ডন করিবেন। আমার ভাষণের যে অর্থ না বুঝেন, তৎপরে আমাকে সে সম্বন্ধে পুনরায় জিজ্ঞাসা করিবেন,- ‘ভো উদয়ন! ইহা কি প্রকার, ইহার অর্থ কি?’ এইরূপ করিয়াই এই বিষয়ে আমাদের কথা-সংলাপ হইতে পারে।”

“মাননীয় উদয়নের সমর্থন যোগ্যকে আমি সমর্থন করিব, খণ্ডনীয়কে খণ্ডন করিব। মাননীয় উদয়নের যে কথা আমি বুঝিব না, তাহা আপনাকে পুনঃ জিজ্ঞাসা করিব,- ‘হে উদয়ন! ইহা কি প্রকার, ইহার অর্থ কি?’ এই প্রকারে আমাদের এ সম্বন্ধে কথা-সংলাপ হউক।”

৪১৩। “ব্রাহ্মণ! লোকে চারি প্রকার পুদ্গল (পুরুষ) বিদ্যামান আছে। কোন্‌ চারি? ব্রাহ্মণ! (১) এখানে পুদ্গল আত্মন্তপ, আপনার সন্তাপজনক কর্মে লিপ্ত হয় (২) পরন্তপ..... , (৩) আত্মন্তপ-পরন্তপ ...... , (৪) অনাত্মন্তপ-অপরন্তপ ...... সুখানুভবী ব্রহ্মভূত (বিশুদ্ধ) আত্মায় বিহার করেন । ব্রাহ্মণ! এই চারি পুদ্গলের মধ্যে কোন্‌ প্রকার পুদ্গল আপনার চিত্ত আরাধনা করে?”

“ভো উদয়ন! ...... এই যে অনাত্মন্তপ-অপরন্তপ ...... পুদ্গল তাঁহাকেই ...... আমার পছন্দ হয়।”

“ব্রাহ্মণ! সেই তিন প্রকার পুদ্গল আপনার কেন পছন্দ হয় না?”

“ভো উদয়ন! যিনি ...... ব্রহ্মভূত আত্মায় বিহার করেন, তিনি আমার চিত্ত আরাধনা করেন।”

৪১৪। “ব্রাহ্মণ! এখানে দ্বিবিধ পরিষদ আছে। কোন্‌ দ্বিবিধ? ব্রাহ্মণ! (১) এখানে কোন পরিষদ মণিকুণ্ডলের প্রতি সারক্ত-রক্ত (অত্যন্ত আসক্ত) হইয়া স্ত্রী-পুত্র অন্বেষণ করে, দাস-দাসী ...... , ক্ষেত্র-বাস্তু, স্বর্ণ-রৌপ্য অনুসন্ধান করে,। আর (২) ব্রাহ্মণ! কোন পরিষদ মণিকুণ্ডলাদি বিষয়ের প্রতি সারক্ত-রক্ত না হইয়া স্ত্রী-পুত্র, দাস-দাসী, ক্ষেত্র-বাস্তু, স্বর্ণ-রৌপ্য ত্যাগ করিয়া আগার হইতে অনাগারিক রূপে প্রব্রজিত হয়। ব্রাহ্মণ! এখানে যে পুদ্গল অনাত্মন্তপ-অপরন্তপ হয়, সেই ...... পুদ্গল ইহজীবনেই তৃষ্ণামুক্ত, নির্বান-প্রাপ্ত, শীতল-স্বভাব, সুখানুভবী, স্বয়ং ব্রহ্মভূত হইয়া বিহার করেন। ব্রাহ্মণ! এই দু’য়ের কোন্‌ পুদ্গলকে আপনি কোন্‌ পরিষদে অধিক দেখিতে পাইতেছেন?- যে পরিষদ মণিকুণ্ডলের প্রতি অনুরাগরঞ্জিত হইয়া দারা-পুত্র, দাস-দাসী, ক্ষেত্র-বাস্তু, স্বর্ণ-রৌপ্য অন্বেষণ করে? অথবা যে পরিষদ মণিকুণ্ডলের প্রতি অনুরাগরঞ্জিত না হইয়া দারা-পুত্র ...... স্বর্ণ-রৌপ্য পরিত্যাগ করিয়া আগার হইতে অনাগারিক প্রব্রজিত হয়?”

“ভো উদয়ন! এখানে যে পুদ্গল.....অনাত্মন্তপ-অপরন্তপ হন, ...... তাঁহাকে এই পরিষদে অধিক দেখিতে পাই যে পরিষদ ...... অনুরাগরক্ত না হইয়া ...... অনাগারিক প্রব্রজিত হইয়াছে।”

“ব্রাহ্মণ! এখনই আপনি ভাষণ করিলেন নহে কি? ‘আমার এরূপ মনে হয়- ওহে শ্রমণ! প্রকৃত ধার্মিক প্রব্রজ্যা নাই। এই সম্বন্ধে আমার এ ধারণা হইয়াছে, তাহাও ভবাদৃশগণেরও এখানে যে ধর্মস্বভাব আছে, তাহার অদর্শন হেতু হইয়াছে’?”

“ভো উদয়ন! নিশ্চয় আমার জন্য ইহা অনুগ্রহযুক্ত বাক্য বলা হইয়াছে। ধার্মিক প্রব্রজ্যা আছে, এ সম্বন্ধে আমার এই ধারণা জন্মিয়াছে। প্রভু উদয়ন! আমাকে এইরূপই ধারণা করুন। প্রভু উদয়ন কর্তৃক এই যে চারি পুদ্গল বিস্তৃতভাবে বিভক্ত না হইয়া সংক্ষেপে বর্ণিত হইয়াছে; সাধু, প্রভু উদয়ন! আমার প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শন করিয়া এই চারি পুদ্গলকে বিস্তৃতভাবে বিভাগ করুন।”

“তাহা হইলে ব্রাহ্মণ! শুনুন, সুন্দররূপে মনোযোগ দিন, বলিতেছি।”

“হাঁ, ভো!” (বলিয়া) ঘোটমুখ ব্রাহ্মণ আয়ুষ্মান উদয়নকে উত্তর দিলেন।

৪১৫। আয়ুষ্মান উদয়ন ইহা কহিলেন,- “ব্রাহ্মণ! কোন্‌ পুদ্গল আত্মন্তপ- আপনার সন্তাপকর কর্মে নিযুক্ত হয়? ব্রাহ্মণ! এখানে কোন পুদ্গল অচেলক - আচার বিহীন ...... হয়; এইরূপে অনেক প্রকার কায়িক আতাপন-পরিতাপন ব্যাপারে নিযুক্ত থাকিয়া অবস্থান করে। ব্রাহ্মণ! এই পুদ্গলকে আত্মন্তপ ...... বলা হয়।

৪১৬। ব্রাহ্মণ! কি প্রকার পুদ্গল পরন্তপ ...... হয়?- এখানে কোন পুদ্গল ঔরম্ভিক (ভেড়াঘাতক) ...... হয়, অথবা অপর যত সব নির্দয়-নিষ্ঠুর কর্ম হইতে পারে উহাদের আচরণকারী হয়। ......।

৪১৭। ব্রাহ্মণ! কোন্‌ প্রকার পুদ্গল আত্মন্তপ-পরন্তপ হয়? এখানে কোন পুরুষ মূর্ধাভিষিক্ত ক্ষত্রিয় রাজা হন ...... , তাঁহার দাস-কর্মচারী অশ্রু মুখে রোদন করিতে করিতে কর্ম সম্পাদন করে.....।

৪১৮, ৪১৯, ৪২০। ব্রাহ্মণ! কোন্‌ প্রকার পুদ্গল অনাত্মন্তপ-অপরন্তপ ...... হয়? ব্রাহ্মণ! এখানে লোকে তথাগত ...... চতুর্থ ধ্যান প্রাপ্ত হইয়া বিহার করেন। তিনি এই প্রকার চিত্তের একাগ্র ও পরিশুদ্ধ অবস্থায় ...... ইঁহার নিমিত্ত অপর কোন কর্তব্য অবশেষ নাই- ইহা জানিতে পারেন। ব্রাহ্মণ! তাঁহাকেই বলা হয় অনাত্মন্তপ-অপরন্তপ পুদ্গল ।”

৪২১। এইরূপ উক্ত হইলে ঘোটমুখ ব্রাহ্মণ আয়ুষ্মান উদয়নকে বলিলেন,- “আশ্চর্য, ভো উদয়ন! আশ্চর্য ভো উদয়ন! যেমন অধঃমুখকে ঊর্ধমুখ করে ...... সেইরূপেই প্রভু উদয়ন অনেক প্রকারে ধর্ম প্রকাশ করিয়াছেন। এখানে আমি প্রভু উদয়নের ধর্মের ও সংঘের শরণ গ্রহণ করিতেছি। আজ হইতে প্রভু উদয়ন! যাবজ্জীবন আমাকে শরণাগত উপাসকরূপে ধারণা করুন।”

“ব্রাহ্মণ! আপনি আমার শরণ গ্রহণ করিবেন না, আপনি সেই ভগবানের শরণ গ্রহণ করুন, যাঁহার শরণ আমিও গ্রহণ করিয়াছি।”

“ভো উদয়ন! সেই অর্হৎ সম্যকসম্বুদ্ধ গৌতম এখন কোথায় অবস্থান করেন? ...... তবে নির্বৃত (নির্বানপ্রাপ্ত) সেই মহামান্য গৌতমের, ধর্মের ও ভিক্ষুসংঘের শরণ গ্রহণ করিতেছি। আজ হইতে প্রভু উদয়ন! যাবজ্জীবন আমাকে শরণাগত উপাসকরূপে ধারণা করুন।”

“ভো উদয়ন! আমাকে অঙ্গরাজা দৈনিক নিত্য ভিক্ষা দিয়া থাকেন, তাহা হইতে আমি প্রভু উদয়নকে এক অংশ নিত্য-ভিক্ষা দান করিতেছি।”

“ব্রাহ্মণ! অঙ্গরাজা আপনাকে দৈনিক কত ভিক্ষা দেন?”

“ভো উদয়ন! পঞ্চশত কার্ষাপণ।”

“ব্রাহ্মণ! আমাদের স্বর্ণ-রৌপ্য গ্রহণ করা উচিত নহে।”

“যদি তাহা প্রভু উদয়নের গ্রহণযোগ্য না হয়, তবে উদয়নের নিমিত্ত বিহার নির্মাণ করাইব।”

“যদি ব্রাহ্মণ! আমার নিমিত্ত বিহার নির্মাণ করাইতে ইচ্ছা করেন, তবে পাটলিপুত্রে সংঘের উদ্দেশ্যে উপস্থানশালা (সভাগৃহ) প্রস্তুত করিয়া দেন।”

“প্রভু উদয়নের এই কথায় আমি আরো অধিকমাত্রায় সন্তুষ্ট ও প্রসন্ন হইলাম যে প্রভু উদয়ন আমাকে সংঘে দান দিতে বলিতেছেন। সুতরাং প্রভু উদয়ন! এই নিত্য-ভিক্ষায় আর অপর নিত্য-ভিক্ষায় পাটলিপুত্রে সংঘের নিমিত্ত উপস্থানশালা নির্মাণ করাইব।”

তখন ঘোটমুখ ব্রাহ্মণ এই নিত্য-ভিক্ষা ও অপর নিত্য-ভিক্ষা দ্বারা পাটলিপুত্রে সংঘের উদ্দেশ্যে উপস্থানশালা নির্মাণ করাইলেন। তাহা এখনও ঘোটমুখী নামে কথিত হইয়া থাকে।

॥ ঘোটমুখ সূত্র সমাপ্ত ॥