(বুদ্ধের গুণ, ব্রাহ্মণদের বেদ আর উহার কর্তা, সত্যের রক্ষা ও প্রাপ্তির উপায়)
৪২২। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-
এক সময় ভগবান মহাভিক্ষুসংঘ সহ কোশলে বিচরণ করিতে করিতে যেখানে ওপসাদ নামক কোশলবাসীদের ব্রাহ্মণ গ্রাম, তথায় উপনীত হইলেন। সেখানে ভগবান ওপসাদের উত্তরে দেববন নামক শালবনে অবস্থান করিতেছেন।
সেই সময় চঙ্কী ব্রাহ্মণ বহু জন-সমাকীর্ণ, সতৃণ-কাষ্ঠ-উদক সম্পন্ন, বহু ধান্য সন্নিচয়, রাজ-ভোগ্য রাজা পসেনদি কোশলের প্রদত্ত ব্রহ্মদেয় (ব্রহ্মোত্তর) ওপসাদে রাজ-দায়াদরূপে আধিপত্য করিয়া (স্ব-মর্যাদায়) বাস করিতেন।
ওপসাদবাসী ব্রাহ্মণ-গৃহপতিগণ শুনিলেন- ‘শাক্য-কুল প্রব্রজিত, শাক্যপুত্র শ্রমণ গৌতম কোশলে বিচরণ করিয়া মহাভিক্ষুসংঘ সহ ওপসাদে উপনীত হইয়াছেন, আর ওপসাদের উত্তরে দেববন শালবনে বিহার করিতেছেন। সেই ভগবান গৌতমের এরূপ কল্যাণ-কীর্তিশব্দ উদ্গত হইয়াছে- সেই ভগবান অর্হৎ ......। পরিশুদ্ধ ব্রহ্মচর্য প্রকাশ করিতেছেন; তথাবিধ অর্হতদের দর্শন মঙ্গলজনক।’
৪২৩। তখন ওপসাদবাসী ব্রাহ্মণ-গৃহপতিগণ গ্রাম হইতে বাহির হইয়া দলে দলে শ্রেণীবদ্ধভাবে উত্তরাভিমুখে- যেখানে দেববন শালবন আছে, সেখানে যাইতে লাগিলেন। সেই সময় চঙ্কী ব্রাহ্মণ দিবা-বিশ্রামের নিমিত্ত প্রাসাদের উপরতলে উঠিয়াছিলেন। চঙ্কী ব্রাহ্মণ ওপসাদবাসী ব্রাহ্মণ-গৃহপতিগণকে ওপসাদ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইয়া দলে দলে শ্রেণীবদ্ধভাবে উত্তরাভিমুখে- যেখানে দেববন শালবন, সেখানে যাইতে দেখিলেন। ইহা দেখিয়া তিনি খত্তাকে (প্রতিহারীকে) ডাকিলেন,- “ওরে খত্তা! ওপসাদবাসী ব্রাহ্মণ-গৃহপতিগণ ...... দেববন শালবন অভিমুখে কেন যাইতেছে?”
“হে চঙ্কী! শাক্য-কুল প্রব্রজিত শাক্যপুত্র শ্রমণ গৌতম কোশলে বিচরণ করিতে করিতে মহাভিক্ষুসংঘ সহ ...... দেববন শালবনে অবস্থান করিতেছেন। সেই ভগবান গৌতমের এরূপ কল্যাণ-কীর্তিশব্দ উদ্গত হইয়াছে ...... ইহারা সেই গৌতমকে দর্শনার্থ যাইতেছেন।”
“তাহা হইলে খত্তা! যেখানে ওপসাদক ব্রাহ্মণ-গৃহপতিগণ আছে, সেখানে যাও এবং ...... ব্রাহ্মণ-গৃহপতিদিগকে এইরূপ বল- ‘চঙ্কী ইহা বলিতেছেন- মহাশয়গণ! আপনারা কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন। চঙ্কী ব্রাহ্মণও শ্রমণ গৌতমের দর্শনার্থ যাইবেন’।”
“হাঁ, ভো!” বলিয়া সেই খত্তা চঙ্কী ব্রাহ্মণকে প্রতিশ্রুতি দিয়া যেস্থানে ওপসাদক ব্রাহ্মণ-গৃহপতিরা ছিলেন তথায় গেল এবং বলিল,- “মহাশয়গণ! চঙ্কী ব্রাহ্মণ বলিতেছেন,- ‘আপনারা সকলে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন। চঙ্কী ব্রাহ্মণও শ্রমণ গৌতমকে দর্শনের নিমিত্ত যাত্রা করিবেন’।”
৪২৪। সেই সময় নানা বিদেশী পঞ্চশত ব্রাহ্মণ কোন কার্যোপলক্ষে ওপসাদে বাস করিতেন। তাঁহারা শুনিলেন যে চঙ্কী ব্রাহ্মণ শ্রমণ গৌতমকে দর্শনার্থ গমন করিবেন। তখন সেই ব্রাহ্মণগণ চঙ্কী ব্রাহ্মণের নিকট উপনীত হইলেন। তাঁহারা উপস্থিত হইয়া চঙ্কী ব্রাহ্মণকে কহিলেন,- “সত্যই কি মাননীয় চঙ্কী! আপনি শ্রমণ গৌতমকে দর্শনের নিমিত্ত যাত্রা করিবেন?”
“হাঁ, ভো! আমার সে অভিলাষ হইয়াছে, আমি শ্রমণ গৌতমকে দর্শনের নিমিত্ত গমন করিব।”
“মাননীয় চঙ্কী! আপনি শ্রমণ গৌতমকে দেখিবার জন্য যাইবেন না। শ্রমণ গৌতমকে দেখিবার জন্য আপনার যাওয়া অনুচিত। মাননীয় চঙ্কীকে দর্শনার্থ শ্রমণ গৌতমেরই আগমন যুক্তিসঙ্গত। মাননীয় চঙ্কী! আপনি মাতা-পিতা উভয়পক্ষ হইতে সুজাত (কুলীন) যাবৎ সপ্তম পিতামহ যুগ পরম্পরা বিশুদ্ধ বংশজ (সংসুদ্ধ গহণিক) জাতিবাদ দ্বারা অক্ষিপ্ত (অত্যক্ত), অন্-উপক্লিষ্ট (অ-নিন্দিত); যেহেতু চঙ্কী উভয় পক্ষ হইতে সুজাত হন ...... , সেই কারণেও মাননীয় চঙ্কী শ্রমণ গৌতমকে দর্শনের নিমিত্ত যাইবার যোগ্য নহেন। আপনার দর্শনার্থ শ্রমণ গৌতমেরই আসা উচিত। মাননীয় চঙ্কী আঢ্য, মহাধনী, মহাবিত্তশালী হন, এই কারণেও ......। মাননীয় চঙ্কী ত্রিবেদের পারদর্শী ......। মাননীয় চঙ্কী অভিরূপ, দর্শনীয়, প্রাসাদিক, উত্তম পরিশুদ্ধ বর্ণ-সৌন্দর্য সমন্বিত, ব্রহ্মবর্ণবান, ব্রহ্ম-বর্চস্বী। অতএব আপনার দর্শনের সুযোগ লাভ সকলের পক্ষে সহজ নহে। মাননীয় চঙ্কী শীলবান বৃদ্ধ-শীলী, উন্নত চরিত্রবান হন ......। ...... কল্যাণবাচী, কল্যাণজনক বাক্য-ভাষী, সুমধুর-ভাষী, বিশ্লেষিত, আড়ষ্ট-বিহীন, অর্থ-বিজ্ঞাপক, নাগরিক ভাষায় যুক্ত ......। ...... চঙ্কী বহুজনের আচার্য-প্রাচার্য হন, তিনশত বিদ্যার্থীকে মন্ত্র (বেদ) শিক্ষা দান করেন ......। মাননীয় চঙ্কী রাজা পসেনদি কোশলের দ্বারা সৎকৃত, গৌরবকৃত, সম্মানিত, পূজিত ও সম্পূজিত হন .......। মাননীয় চঙ্কী ব্রাহ্মণ পোক্খরসাতির সৎকৃত ...... সম্পূজিত হন ......। পূজনীয় চঙ্কীই ...... কোশল প্রদত্ত ওপসাদে প্রভুত্ব করিয়া বাস করিতেছেন। এই কারণেও মাননীয় চঙ্কী শ্রমণ গৌতমকে দর্শনের নিমিত্ত গমনের অযোগ্য হন, আর শ্রমণ গৌতমই প্রভু চঙ্কীকে দর্শনের নিমিত্ত আগমনের যোগ্য।”
৪২৫। এইরূপ কথিত হইলে চঙ্কী ব্রাহ্মণ সেই ব্রাহ্মণদিগকে বলিলেন,- “তাহা হইলে মহাশয়গণ! আমার বক্তব্যও একটু শুনুন- যে কারণে আমরাই সেই মহামান্য গৌতমের দর্শনার্থ যাইবার যোগ্য হই, আর সেই প্রভু গৌতম আমাদের দর্শনার্থ আগমনের অযোগ্য হন। ভো মহাশয়গণ! শ্রমণ গৌতম মাতা-পিতা উভয়পক্ষ হইতে সুজাত হন ...... ; এই কারণেও আমরা শ্রমণ গৌতমকে দেখিবার জন্য যাইবার যোগ্য হই, শ্রমণ গৌতম আমাদিগকে দেখিবার জন্য আসিবার অযোগ্য হন। শ্রমণ গৌতম ভূমিস্থ ও আকাশস্থ প্রভূত হিরণ্য-সুবর্ণ পরিত্যাগ করিয়া প্রব্রজিত হইয়াছেন ......। শ্রমণ গৌতম তরুণ গাঢ়-কৃষ্ণকেশ ভদ্রযৌবন সম্পন্ন, প্রথম বয়সেই আগার হইতে অনাগারিকরূপে প্রব্রজিত হইয়াছেন ......। শ্রমণ গৌতম অশ্রুমুখে রোদন পরায়ণ মাতা-পিতার অনিচ্ছা সত্বেও কেশ-শ্মশ্রু মুণ্ডন করিয়া, কাষায়বস্ত্র পরিধান করিয়া, সংসার ছাড়িয়া প্রব্রজিত হইয়াছেন ......। শ্রমণ গৌতম অভিরূপ, দর্শনীয় ...... ব্রহ্ম-বর্চম্বী; তাঁহার দর্শনের নিমিত্ত অবকাশ অনন্য সাধারণ ......। শ্রমণ গৌতম শীলবান, আর্যশীল সম্পন্ন নিস্কলঙ্ক-চরিত্র ...... , কল্যাণ-ভাষী ...... , ...... বহু বিদ্যার্থীর আচার্য-প্রচার্য ...... , ...... ক্ষীণ-কাম-রাগ, চাপল্য-রহিত ......। শ্রমণ গৌতম কর্মবাদী ক্রিয়াবাদী ব্রহ্মজ্ঞ প্রজার অপাপ (লোকোত্তর ধর্মে) পূর্বঙ্গম হন ......। শ্রমণ গৌতম উচ্চকুল-অবিভক্ত ক্ষত্রিয়কুল হইতে প্রব্রজিত হইয়াছেন ......। শ্রমণ গৌতম মহাধন, মহা বিত্তবান কুল হইতে প্রব্রজিত হইয়াছেন ......। দেশের ও রাষ্ট্রের বাহির হইতে জিজ্ঞাসু হইয়া লোক শ্রমণ গৌতম সমীপে আগমন করেন ......। অনেক সহস্র দেবতা আপ্রাণকোটি শ্রমণ গৌতমের শরণ গ্রহণ করিয়াছেন ......। শ্রমণ গৌতমের এরূপ কল্যাণ-কীর্তিশব্দ উদগত হইয়াছে-সেই ভগবান এই কারণে অর্হৎ ......। শ্রমণ গৌতম বত্রিশ মহাপুরুষলক্ষণ সংযুক্ত হন ......। রাজা মাগধ সেনিয় বিম্বিসার, পসেনদি কোশল ও বিখ্যাত ব্রাহ্মণ পোক্খরসাতি শ্রমণ গৌতমের সপুত্র-দার আপ্রাণ শরণাগত ......। ভো মহাশয়গণ! শ্রমণ গৌতম ওপসাদে উপনীত হইয়াছেন, ওপসাদে ...... দেববন শালবনে বিহার করিতেছেন। বিশেষতঃ যে কোন শ্রমণ কিংবা ব্রাহ্মণ আমাদের গ্রাম-ক্ষেত্রে আগমন করেন, তাঁহারাই আমাদের অতিথি; অতিথিগণ আমাদের অভ্যর্থনীয়, গৌরবার্হ, মাননীয় ও পূজারযোগ্য হন। ভো! শ্রমণ গৌতম ওপসাদে উপনীত হইয়াছেন, ওপসাদের উত্তরদিকে দেববন শালবনে অবস্থান করিতেছেন; সুতরাং শ্রমণ গৌতম আমাদেরই অতিথি; অতিথি আমাদের অভ্যর্থনার যোগ্য ...... পূজার্হ হন। এই কারণেও ......। ওহে মহাশয়গণ! আমি সেই প্রভু গৌতমের গুণাবলী এই পরিমাণ জানি, কিন্তু সেই প্রভু গৌতম কেবল এই পরিমাণ গুণের অধিকারী নহেন, সেই প্রভু গৌতম অপরিসীম গুণবান । এই সকলের একাঙ্গযুক্ত হইলেও প্রভু গৌতম আমাদিগকে দর্শন করিবার নিমিত্ত আসার অযোগ্য হন, কিন্তু প্রভু গৌতমকে দর্শনের নিমিত্ত আমাদের তথায় যাওয়া উচিত। সুতরাং চলুন, আমরা সকলে শ্রমণ গৌতমকে দর্শন করিবার নিমিত্ত যাত্রা করি।”
৪২৬। তখন চঙ্কী ব্রাহ্মণ বৃহৎ ব্রাহ্মণ পরিষদের সহিত যেখানে ভগবান আছেন, সেস্থানে উপনীত হইলেন। তথায় গিয়া ভগবানের সহিত সম্মোদন করিয়া ...... একপ্রান্তে বসিলেন। ...... সেই সময় ভগবান বয়োবৃদ্ধ ব্রাহ্মণদের সাথে কিছু স্মরণীয় কথা সমাপ্ত করিয়া উপবিষ্ট ছিলেন।
সেই সময় মুণ্ডিত-শির জন্মে ষোলবর্ষ বয়স্ক ...... ত্রিবেদে পারদর্শী কাপতিক নামক তরুণ ব্রাহ্মণকুমার ...... পরিষদে উপবিষ্ট ছিল। ভগবানের সহিত বয়স্ক বয়স্ক ব্রাহ্মণদের আলোচনার সময় সে মাঝে মাঝে কথা উত্থাপন করে। তখন ভগবান কাপতিক মাণবকে নিবারণ করিলেন,- “আয়ুষ্মান ভারদ্বাজ! বৃদ্ধ বৃদ্ধ ব্রাহ্মণদের সাথে আলোচনার সময় কথা বলিও না। আয়ুষ্মান ভারদ্বাজ! কথা সমাপ্ত হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা কর।”
এইরূপ কথিত হইলে চঙ্কী ব্রাহ্মণ ভগবানকে বলিলেন,- প্রভু গৌতম! কাপতিক মাণবকে নিবারণ করিবেন না। কাপতিক মাণব কুলপুত্র (কুলীন), বহুশ্রুত, পণ্ডিত, সুবক্তা; কাপতিক মাণব প্রভু গৌতমের সহিত এ সম্বন্ধে বাদানুবাদ করিতে সমর্থ।”
তখন ভগবানের এই চিন্তা হইল,- “অবশ্যই কাপতিক মাণবের কথা- ত্রিবেদ প্রবচন সম্বন্ধে হইবে। তজ্জন্যই ব্রাহ্মণেরা তাহাকে সসম্মানে সম্মুখে রাখিয়াছেন।”
তখন কাপতিক মাণবের এই চিন্তা হইল,- “যখন শ্রমণ গৌতম আমার চক্ষুর দিকে দৃষ্টিপাত করিবেন, তখন আমি তাঁহাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিব।”
ভগবান স্বীয় চিত্তদ্বারা কাপতিক মাণবের চিত্ত-বিতর্ক অবগত হইয়া যেদিকে কাপতিক মাণব ছিল সেদিকে দৃষ্টিপাত করিলেন।
৪২৭। তখন কাপতিক মাণব চিন্তা করিল,- “শ্রমণ গৌতম আমাকে দেখিতেছেন। অতএব আমি তাঁহাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করি।” কাপতিক মাণব ভগবানকে কহিল,- “ভো গৌতম! পিটক (আপ্তবাণী) সম্পত্তিযোগে এই এইরূপে শ্রুতি-পরম্পরা আগত, পুরাতন এই যে মন্ত্রপদ আছে, উহার প্রতি ব্রাহ্মণেরা পূর্ণরূপে নিষ্ঠা (শ্রদ্ধা) রাখেন- ‘ইহাই সত্য, অন্যসব মিথ্যা।’ এ সম্বন্ধে প্রভু গৌতম কি বলেন?”
“ভারদ্বাজ! কেমন, ব্রাহ্মণদের মধ্যে একজনও কি আছেন? যিনি এরূপ বলেন,- ‘আমি ইহা অবগত আছি, আমি ইহা প্রত্যক্ষ করিয়াছি- ইহাই সত্য, অন্য মিথ্যা’?”
“না, ভো গৌতম!”
“কেমন, ভারদ্বাজ! ব্রাহ্মণদের এক আচার্যও....., এক আচার্য-প্রাচার্যও, পরম্পরাচার্যদের সপ্তম পুরুষ যুগ পর্যন্ত ....?”
“না, ভো গৌতম!”
“কেমন, ভারদ্বাজ! ব্রাহ্মণদের যে সকল পূর্বজ ঋষিগণ মন্ত্রের কর্তা, মন্ত্রের প্রবক্তা; এই পুরাতন মন্ত্রপদ যাঁহাদের দ্বারা গীত (কণ্ঠস্থ) অধ্যাপিত সংগৃহীত হইয়াছে; আধুনিক ব্রাহ্মণেরা তাহাই অনুগান করে, তদনুভাষণ করে, ভাষণের পুনর্ভাষণ করে, অধ্যয়নের পুনঃ অধ্যাপন করে যথা- অষ্টক, বামক, বামদেব, বিশ্বামিত্র, যমদগ্নি, অঙ্গীরস (অঙ্গিরা?), ভারদ্বাজ, বশিষ্ঠ, কশ্যপ ও ভৃগু ; তাঁহারাও এরূপ বলিয়াছেন- ‘আমরা ইহা জানি, আমরা ইহা দেখি, ইহাই সত্য, অন্য মিথ্যা’?”
“ভো গৌতম! তাহা নহে।”
“এই প্রকারে ভারদ্বাজ! ব্রাহ্মণদের মধ্যে কোন এক ব্রাহ্মণও বিদ্যমান নাই- যিনি প্রত্যক্ষজ্ঞানী ও প্রত্যক্ষদর্শীরূপে বলেন- ‘ইহা সত্য, অন্য মিথ্যা’।”
৪২৮। “ভারদ্বাজ! যেমন পরম্পরা সংসক্ত অন্ধ-প্রবেণি , অগ্রবর্তীও দেখিতে পায় না, মধ্যবর্তীও দেখিতে পায় না, পশ্চাদ্বর্তীও দেখিতে পায় না। সেইরূপই ভারদ্বাজ! ব্রাহ্মণদের ভাষণ পরম্পরা সংসক্ত অন্ধ-প্রবেণি সদৃশ ......। তাহা কি মনেকর, ভারদ্বাজ! এরূপ হইলে ব্রাহ্মণদের শ্রদ্ধা অমূলক প্রতিপন্ন হয় না কি?”
“ভো গৌতম! ব্রাহ্মণেরা কেবল শ্রদ্ধায় উপাসনা করেন না, অনুশ্রব (শ্রুতি) হেতুও তাঁহারা এখানে উপাসনা করেন।”
“ভারদ্বাজ! তুমি পূর্বে শ্রদ্ধায় (নিষ্ঠায়) প্রতিষ্ঠিত ছিলে, এখন অনুশ্রব কহিতেছ। ভারদ্বাজ! এই পঞ্চবিধ ধর্ম ইহজীবনে দুই প্রকার বিপাক (ফল) দিয়া থাকে। সেই পঞ্চ কি?- (১) শ্রদ্ধা, (২) রুচি, (৩) অনুশ্রব, (৪) আকার পরিবিতর্ক, (৫) দৃষ্টি-নিধ্যান-ক্ষান্তি । ভারদ্বাজ! এই পঞ্চধর্ম ইহজীবনে দুই প্রকার ফল প্রদান করে। অপিচ ভারদ্বাজ! যাহা উত্তমরূপে শ্রদ্ধা করা হয়, তাহাও রিক্ত, তুচ্ছ, মিথ্যা প্রতিপন্ন হইতে পারে। যদি উপযুক্ত শ্রদ্ধা পোষিত নাও হয়, তথাপি তাহা ভূত, যথার্থ, তথ্য, অনন্যথা প্রতিপন্ন হইতে পারে। অথচ ভারদ্বাজ! সুরুচিত, সু-অনুশ্রুত, সুপরিকল্পিত ও সুনিধ্যায়িত না হইয়াও তাহা যথার্থ, তথ্য অনন্যথা হইতে পারে। সুতরাং ভারদ্বাজ! সত্যানুরক্ষক বিজ্ঞ পুরুষের পক্ষে ইহাতে একান্তই (ষোল আনা) নিষ্ঠাশীল হওয়া অনুচিত যে ইহাই সত্য, আর সব মিথ্যা।”
৪২৯। “হে গৌতম! কি পরিমাণ সত্যানুরক্ষণ হয়, আর কি পরিমাণ সত্যানুরক্ষা হয়? ভবৎ গৌতমকে আমরা সত্যানুরক্ষণ সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করিতেছি।”
“ভারদ্বাজ! যদি কোন পুরুষের শ্রদ্ধা হয়, আমার শ্রদ্ধা এতাদৃশ; এ প্রকার বাদীর সত্য অনুরক্ষা হয়, কিন্তু ইহার প্রতি একান্তভাবে নিষ্ঠাশীল হয় না- ‘ইহাই সত্য, অন্য (সব) মিথ্যা।’ ভারদ্বাজ! যদি পুরুষের রুচি হয় ...... , অনুশ্রব হয়, আকার পরিকল্পনা হয়, দৃষ্টি-নিধ্যান-ক্ষান্তি হয়; আমার দৃষ্টি-নিধ্যান-ক্ষান্তি এতাদৃশ, এ প্রকার বাদীর সত্যানুরক্ষা হয়; এখনও একান্তভাবে নিষ্ঠা পোষণ করে না- ‘ইহাই সত্য-অন্য মিথ্যা।’ ভারদ্বাজ! এই পরিমাণ সত্যানুরক্ষণ হয়, এই পরিমাণ সত্যানুরক্ষা হয়। আমরা এ পরিমাণ সত্যের অনুরক্ষণ প্রজ্ঞাপিত করিয়া থাকি, কিন্তু সমপ্রতি সত্যানুবোধ জন্মে না।”
৪৩০। “ভো গৌতম! এই পরিমাণ সত্যের অনুরক্ষণ হয়, এই পরিমাণে সত্য অনুরক্ষা হয়, আমরা এই পরিমাণ সত্যানুরক্ষণ প্রত্যক্ষ করি। হে গৌতম! সত্যানুবোধ কি প্রকারে হয়? কি প্রকারে মানুষ সত্যোপলব্ধি করে? ভো গৌতম! সত্যোপলব্ধি সম্বন্ধে আমরা আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতেছি।”
“এখানে ভারদ্বাজ! ভিক্ষু অন্যতর গ্রাম কিংবা নিগম আশ্রয় করিয়া অবস্থান করে, কোন গৃহপতি অথবা গৃহপতি-পুত্র- তাহার সমীপে উপস্থিত হইয়া লোভ, দ্বেষ, মোহ এই তিন ধর্ম সম্বন্ধে তাহার পরীক্ষা করে- কেমন, এই আয়ুষ্মানের তথাবিধ লোভনীয় ধর্ম আছে কি যেরূপ লোভনীয় ধর্মদ্বারা পরিগৃহীত (অধিকৃত) চিত্ত হইয়া না জানিয়াই বলে ‘জানিতেছি’, না দেখিয়াই কহে ‘দেখিতেছি’, অথবা তজ্জন্য পরকে নিয়োজিত করে যাহাতে পরের দীর্ঘকাল অহিত ও দুঃখের নিদান হয়? তাহাকে পরীক্ষা করিয়া সে এরূপ জানে যে এই আয়ুষ্মানের তথাবিধ লোভনীয় ধর্ম নাই যে লোভনীয় ধর্মে পরিগৃহীত চিত্ত হইয়া না জানিয়াই ‘জানিতেছি’ বলে, না দেখিয়াই ‘দেখিতেছি’ কহে; অথবা অপরকেও তজ্জন্য নিয়োজিত করে যাহাতে অপরের দীর্ঘকাল অহিত ও দুঃখের নিদান হয়। এই আয়ুষ্মানের কায়-সমাচার আর বাক্-সমাচার তদ্রূপ যাহা অলোভীর পক্ষে সম্ভব। এই আয়ুষ্মান যে ধর্মোপদেশ করেন তাহা গভীর, দুর্দর্শ, দুর্বোধ্য, শান্ত, প্রণীত (উত্তম), অতর্কাবচর (তর্কদ্বারা অপ্রাপ্য), নিপুণ, পণ্ডিতবেদনীয়। সে ধর্ম লোভীকর্তৃক উপদিষ্ট হওয়া সহজ নহে।
৪৩১। যখন তাহাকে পরীক্ষা করিয়া লোভনীয় ধর্ম হইতে বিশুদ্ধ দেখা যায়, তখন তদুত্তর দ্বেষ সম্বন্ধীয় ধর্মে তাহাকে পরীক্ষা করে- কেমন, এই আয়ুষ্মানের দ্বেষ সম্বন্ধীয় ধর্ম আছে কি ...... ? ...... সেই ধর্ম বিদ্বেষীকর্তৃক উপদিষ্ট হওয়া সহজ-সাধ্য নহে।
৪৩২। যখন পরীক্ষা করিয়া দ্বেষ সম্বন্ধীয় ধর্ম হইতে তাহাকে পরিশুদ্ধ দেখা যায়, তখন তদুত্তর মোহনীয় ধর্ম সম্বন্ধে তাহাকে পরীক্ষা করে- কেমন, এই আয়ুষ্মানের তথাবিধ মোহনীয় ধর্ম বিদ্যমান আছে কি ...... ? ...... সে ধর্ম মূঢ়কর্তৃক উপদিষ্ট হওয়া সহজ সাধ্য নহে।
অনুসন্ধান করিয়া যখন তাহাকে (লোভ-দ্বেষ) মোহনীয় ধর্ম হইতে বিশুদ্ধ দেখা যায়, তখন তাহার প্রতি (লোকে), শ্রদ্ধা সন্নিবেশ করে, শ্রদ্ধাসম্পন্ন হইয়া সমীপে গমন করে, সমীপে গিয়া উপবেশন করে, উপবেশন করিয়া শ্রোত্রাবধান করে, অবহিত শ্রোত্রে ধর্ম দেশনা শ্রবণ করে, ধর্ম শুনিয়া ধারণ করে, ধৃত ধর্মের অর্থ ও কারণ উপপরীক্ষা করে, অর্থের পরীক্ষা করিয়া ধর্ম অবলোকনে সক্ষম হয়, ধর্মদর্শনে ক্ষমতা থাকিলে ছন্দ (করিবার প্রবৃত্তি) উৎপন্ন হয়, ছন্দবলে প্রযত্নশীল হয়, উৎসাহিত হইয়া (অনিত্যাদি হিসাবে) তুলনা বা পরীক্ষা করে, তুলনা করিয়া (মার্গাবহ) উদ্যোগ করে, প্রোষিতাত্ম অবস্থায় সহজাত নাম-কায়ে পরম সত্য (নির্বান) সাক্ষাৎকার করে আর প্রজ্ঞাদ্বারা ক্লেশ প্রতিবিদ্ধ করিয়া (তাহাই বিভূতভাবে) প্রত্যক্ষ করে। ভারদ্বাজ! এই পরিমাণ সত্যানুবোধ হয়, এই পরিমাণেই সত্যোপলব্ধি জন্মে। এ পর্যন্তই আমরা সত্যানুবোধ (মার্গ-বোধ) ঘোষণা করি, কিন্তু এখনও সত্যানুপ্রাপ্তি (ফল-সাক্ষাৎকার) ঘটে নাই।”
৪৩৩। “হে গৌতম! এই পর্যন্ত সত্যানুবোধ হয়, এই পর্যন্ত সত্যানুবোধ জন্মে। আমরাও এ পর্যন্ত সত্যানুবোধ পর্যবেক্ষণ করি। পরন্তু হে গৌতম! কি পরিমাণে সত্যানুপ্রাপ্তি ঘটে, কি পরিমাণে সত্য প্রাপ্ত হওয়া যায়? আমরা ভগবৎ গৌতম সমীপে সত্যানুপ্রাপ্তি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিতেছি।”
“ভারদ্বাজ! সেই সকল (পূর্বোক্ত মার্গযুক্ত দ্বাদশ) ধর্মেরই আসেবন (পুনঃ পুনঃ অভ্যাস) ভাবনা, বহুলী কর্ম প্রভাবে সত্যানুপ্রাপ্তি ঘটে। ভারদ্বাজ! এযাবৎ সত্যানুপ্রাপ্তি হয়, আমরা এযাবৎ সত্যানুপ্রাপ্তি ঘোষণা করি।”
৪৩৪। “এ পর্যন্তই হে গৌতম! সত্যপ্রাপ্তি হয়, ...... আমরাও এ পর্যন্ত সত্যানুপ্রাপ্তি পরিদর্শন করি। হে গৌতম! সত্যানুপ্রাপ্তির পক্ষে কোন্ ধর্ম অধিক উপকারী (বহুকার) হয়? সত্যানুপ্রাপ্তির নিমিত্ত অধিক উপকারী ধর্ম সম্বন্ধে আমরা গৌতমকে জিজ্ঞাসা করিতেছি।”
“ভারদ্বাজ! সত্যানুপ্রাপ্তির পক্ষে বহু উপকারী ধর্ম প্রধান (মার্গাবহ উদ্যোগ), যদি কেহ প্রধান না করে, তবে তাহার সত্যলাভ ঘটেনা। যেহেতু প্রধান করে, তাই সত্যানুপ্রাপ্তি হইয়া থাকে, সুতরাং সত্যপ্রাপ্তির পক্ষে প্রধান বহু উপকারী।”
“হে গৌতম! প্রধানের পক্ষে কোন্ ধর্ম বহু উপকারী? প্রধানের বহু উপকারী ধর্ম সম্বন্ধে আমরা প্রভু গৌতমকে জিজ্ঞাসা করিতেছি।”
“ভারদ্বাজ! প্রধানের বহু উপকারী উত্থান, যদি উত্থান না থাকে তবে প্রধান করা যায় না। যেহেতু উত্থান করে সেই হেতু প্রধান হইয়া থাকে। সুতরাং উত্থান প্রধানের বহু উপকারী। ......। ...... উত্থানের নিমিত্ত তুলনা (অনিত্যাদি বশে বিদর্শন) বহু উপকারী ......। তুলনার উপকারী উৎসাহ, উৎসাহের উপকারী ছন্দ, ছন্দের উপকারী ধর্ম-নিধ্যান-ক্ষান্তি (ধর্মাবলোকনের ক্ষমতা), ধর্ম-নিধ্যান-ক্ষান্তির উপকারী অর্থ-উপপরীক্ষা, অর্থোপপরীক্ষার উপকারী ধর্ম-ধারণ, ...... ধর্ম-শ্রবণ ...... , শ্রোত্রাবধান, পর্যুপাসনা, সমীপে গমন ......। শ্রদ্ধা ......।”
৪৩৫। “সত্যানুরক্ষণ সম্বন্ধে আমরা প্রভু গৌতমকে জিজ্ঞাসা করিলাম, প্রভু গৌতম সত্যানুরক্ষণ সম্বন্ধে আমাদিগকে বর্ণনা করিয়াছেন। তাহা আমাদের রুচি হয়, সহ্যও হয়; উহাতে আমরা সন্তুষ্ট। সত্যানুবোধ সম্বন্ধে আমরা প্রভু গৌতমকে জিজ্ঞাসা করিয়াছি। ...... সত্যপ্রাপ্তি ......। সত্যপ্রাপ্তির বহু উপকারী ধর্ম সম্বন্ধে আমরা প্রভু গৌতমকে জিজ্ঞাসা করিয়াছি। প্রভু গৌতম তাহা আমাদিগকে বর্ণনা করিয়াছেন। উহা আমাদের রুচিকর ও সহ্য হয়, আমরা উহাতে সন্তুষ্ট। যে যে বিষয়ে আমরা প্রভু গৌতমকে জিজ্ঞাসা করিয়াছি সে সে বিষয়ে প্রভু গৌতম বর্ণনা করিয়াছেন। উহাতে আমাদের রুচি ও সমর্থন আছে। আমরা উহাতে সন্তুষ্ট। হে গৌতম! আমরাও পূর্বে এরূপ জানিতাম- মুণ্ডক, শ্রমণক, নীচ (ইভ্যা), কৃষ্ণ, ব্রহ্মার পদপ্রান্তজ কাহারা? আর কাহারাই বা ধর্মের প্রকৃত জ্ঞাতা? প্রভু গৌতম শ্রমণদের প্রতি আমার শ্রমণ-প্রেম, শ্রমণ-প্রসাদ উৎপাদন করিয়াছেন। আশ্চর্য, হে গৌতম! ...... আজ হইতে জীবনের শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আমাকে শরণাগত উপাসকরূপে ধারণা করুন।”
॥ চঙ্কী সূত্র সমাপ্ত ॥
(জাতিভেদ খণ্ডন)
৪৩৬। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-
এক সময় ভগবান শ্রাবস্তীতে অনাথপিণ্ডিকের জেতবন আরামে অবস্থান করিতেছেন। সেই সময় এসুকারী ব্রাহ্মণ ভগবৎ সমীপে উপনীত হইলেন। উপস্থিত হইয়া ভগবানের সাথে ...... সম্মোদন করিয়া একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট এসুকারী ব্রাহ্মণ ভগবানকে বলিলেন,- “ভো গৌতম! ব্রাহ্মণেরা চারি প্রকার পরিচর্যা (সেবা-ব্যবস্থা) বলিয়া থাকেন, ব্রাহ্মণের পরিচর্যা, ক্ষত্রিয়ের পরিচর্যা, বৈশ্যের পরিচর্যা আর শূদ্রের পরিচর্যা বলেন। ইহাতে ভো গৌতম! ব্রাহ্মণেরা ব্রাহ্মণের পরিচর্যা এ প্রকার বলেন- ব্রাহ্মণ ব্রাহ্মণের পরিচর্যা করিবে, ক্ষত্রিয় ব্রাহ্মণের পরিচর্যা করিবে, বৈশ্য ব্রাহ্মণের পরিচর্যা করিবে, শূদ্র ব্রাহ্মণের পরিচর্যা করিবে ......। ...... ক্ষত্রিয়ের পরিচর্যা এ প্রকার বলেন- ক্ষত্রিয় ক্ষত্রিয়ের পরিচর্যা করিবে, বৈশ্য ...... , শূদ্র ক্ষত্রিয়ের পরিচর্যা করিবে। ...... বৈশ্যের পরিচর্যা এই প্রকার বলেন- বৈশ্য বৈশ্যের পরিচর্যা করিবে, আর শূদ্র বৈশ্যের পরিচর্যা করিবে। ...... শূদ্রের পরিচর্যা এই প্রকার বলেন- শূদ্রই শূদ্রের পরিচর্যা করিবে; অপর কেই বা শূদ্রের পরিচর্যা করিবে? ভো গৌতম! ব্রাহ্মণেরা শূদ্রের পরিচর্যা এই প্রকারই জ্ঞাপন করেন। এ বিষয়ে প্রভু গৌতম কি বলেন?”
৪৩৭। “কেমন, ব্রাহ্মণ! সারা বিশ্ববাসী কি ব্রাহ্মণদিগকে ইহা অনুমতি দান করিয়াছে যে ব্রাহ্মণেরা এই চারি প্রকার পরিচর্যা ব্যবস্থা প্রজ্ঞাপিত করিবেন?”
“না, ভো গৌতম!”
“ব্রাহ্মণ! যেমন কোন নিঃস্ব, অনাঢ্য, দরিদ্র-পুরুষ অনিচ্ছুক সত্বেও তাহার জন্য মাংস-ভোগ (বিল) ঝুলাইয়া দেওয়া হয়- ‘ওরে পুরুষ! এখানে তোমার খাইবার নিমিত্ত মাংস রহিল, ইহার মূল্য দিতেই হইবে । সেইরূপ হে ব্রাহ্মণ! অপর শ্রমণ-ব্রাহ্মণের সম্মতি না লইয়া তাহাদের জন্য ব্রাহ্মণেরা স্বেচ্ছাচার বশতঃ চারি প্রকার পরিচর্যা ব্যবস্থা করিয়াছেন। ব্রাহ্মণ! আমি সকলকে পরিচর্যার যোগ্য বলি না, আর পরিচর্যার অযোগ্যও বলি না। ব্রাহ্মণ! যাহার পরিচর্যা হেতু পরিচারকের অহিত হইবে, হিত হইবে না; তাহাকে আমি পরিচর্যার যোগ্য বলি না। অপর পক্ষে ...... যাহার পরিচর্যা হেতু পরিচারকের উপকার হইবে, অপকার হইবে না; তাহাকে আমি পরিচর্যার যোগ্য বলি।
ব্রাহ্মণ! ক্ষত্রিয়কেও যদি এরূপ জিজ্ঞাসা করি- যাহার পরিচর্যার দরুণ পরিচারক হিসাবে তোমার অনিষ্ট হইবে, ইষ্ট নহে; অথবা যাহার পরিচর্যা হেতু পরিচারকরূপে তোমার ইষ্ট হইবে, অনিষ্ট নহে; এখানে (উভয়ের মধ্যে) তুমি কাহাকে পরিচর্যা করিবে? তবে ব্রাহ্মণ! ক্ষত্রিয়ও সত্যকথা প্রকাশ করিবার কালে এরূপ প্রকাশ করিবে- ‘যাহার পরিচর্যা হেতু পরিচারক আমার অহিত হইবে, হিত নহে; আমি তাহাকে পরিচর্যা করিব না। যাহাকে পরিচর্যা করিলে পরিচর্যার দরুণ আমার হিত হইবে, অহিত নহে; তাহাকে আমি পরিচর্যা করিব।’ ব্রাহ্মণ! যদি ব্রাহ্মণকেও জিজ্ঞাসা করি ...... , বৈশ্যকেও জিজ্ঞাসা করি ...... , শূদ্রকেও জিজ্ঞাসা করি ......।
(১) ব্রাহ্মণ! আমি উচ্চ কুলীনত্বের দরুণ শ্রেয়ঃ বলি না, কিন্তু ব্রাহ্মণ! আমি উচ্চ কুলীনত্বের দরুণ অশ্রেয়ঃও বলি না; (২) ব্রাহ্মণ! আমি উদার বর্ণত্ব হেতু শ্রেয়ঃও বলি না, ..... উদার বর্ণত্ব হেতু হীনও বলি না; (৩) ব্রাহ্মণ! আমি উদার ভোগত্ব হেতু শ্রেয়ঃও বলি না, ...... উদার ভোগত্ব হেতু হীনও বলি না।
৪৩৮। ব্রাহ্মণ! উচ্চ কুলীনেরা এখানে কেহ কেহ প্রাণাতিপাতী হয়, অদত্তগ্রাহী হয়, কামে ব্যভিচারী হয়, মিথ্যাবাদী হয়, পিশুন-ভাষী হয়, কর্কশ-ভাষী হয়, সংপ্রলাপী হয়, অভিধ্যালু (লোলুপ) হয়, হিংসুক হয় ও মিথ্যাদৃষ্টি সম্পন্ন হয়। সে কারণে উচ্চ কুলীনত্ব হেতু আমি শ্রেয়ঃ বলি না। ব্রাহ্মণ! উচ্চ কুলীনদেরও এখানে কেহ কেহ প্রাণিহিংসা-বিরত হয়, অদত্তাদান-বিরত হয়, কামে মিথ্যাচার-বিরত হয়, মৃষাবাদ-বিরত হয়, পিশুনবাক্য-বিরত হয়, পরুষবাক্য-বিরত হয়, সংপ্রলাপ-বিরত হয়, অলোলুপ হয়, অহিংসা-পরায়ণ হয় আর সম্যক্দৃষ্টি সম্পন্ন হয়; সুতরাং উচ্চ কুলীনত্ব হেতু আমি পাপিষ্ঠ বলি না।
৪৩৯। ব্রাহ্মণ! উদার বর্ণবান ...... , উদার ভোগবানও কেহ কেহ প্রাণিহিংসাকারী হয়, ......। কেহ কেহ প্রাণিহিংসা-বিরত ...... , সম্যক্দৃষ্টি সম্পন্ন হয়। সে কারণে ব্রাহ্মণ! আমি উদার বর্ণত্ব হেতু ...... উদার ভোগত্ব হেতু শ্রেয়ঃ বা পাপিষ্ঠ বলি না।
ব্রাহ্মণ! আমি সকলকে পরিচর্যার যোগ্য বলি না, আর সকলকে আমি পরিচর্যার অযোগ্যও বলি না। ব্রাহ্মণ! যাহার পরিচর্যা হেতু পরিচারকের শ্রদ্ধা বৃদ্ধি পায়, শীল (সদাচার) বৃদ্ধি পায়, শ্রুত (শিল্পজ্ঞান) বৃদ্ধি পায়, ত্যাগ বৃদ্ধি পায় এবং প্রজ্ঞা বৃদ্ধি পায়; তাহাকে আমি পরিচর্যার যোগ্য বলি।”
৪৪০। এরূপ কথিত হইলে এসুকারী ব্রাহ্মণ ভগবানকে ইহা বলিলেন,- “(১) ভো গৌতম! ব্রাহ্মণেরা চারি প্রকার ধনের বিধান করেন। ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রের স্ব-ধন বিধান করেন। ভো গৌতম! ব্রাহ্মণেরা ভিক্ষাচর্যাকে ব্রাহ্মণের স্ব-ধন বিধান করেন, ব্রাহ্মণ স্ব-ধন ভিক্ষাচর্যাকে অবহেলা করিয়া অদত্তাপহারী গোপালের (রক্ষকের) ন্যায় অকৃত্যকারী হয়। (২) ভো গৌতম! ব্রাহ্মণেরা বলিয়া থাকেন- ধনু-কলাপ (অস্ত্র-বিদ্যা) ক্ষত্রিয়ের স্ব-ধন। ধনু-কলাপরূপ স্ব-ধন অবজ্ঞা করিয়া ক্ষত্রিয় ...... অকৃত্যকারী হয়। (৩) ...... কৃষি-গোরক্ষা (গোপালন) বৈশ্যের স্ব-ধন ......। অসিত-ব্যভঙ্গি (কাস্তে-বাঁক) শূদ্রের স্ব-ধন বলিয়া থাকেন। অসিত-ব্যভঙ্গিরূপ স্ব-ধন অতিক্রমকারী শূদ্র অদত্তগ্রাহী গোপকের ন্যায় অকৃত্যকারী (পাপাচারী) হইয়া থাকেন। ভো গৌতম! ব্রাহ্মণেরা এই চতুর্বিধ ধনের ব্যবস্থা করেন, এ সম্বন্ধে মহানুভব গৌতম কি বলেন?”
৪৪১। “কেমন ব্রাহ্মণ! সমস্ত জগতবাসী ব্রাহ্মণদের প্রতি ইহা অনুজ্ঞা করেন কি- (তাঁহারা) এই চতুর্বিধ ধনের ব্যবস্থা করিবেন?”
“না, ভো গৌতম!”
“যেমন, ব্রাহ্মণ! কোন ...... অনিচ্ছুক দরিদ্র ব্যক্তির জন্য ...... মাংসভাগ ঝুলান হয়, ...... ব্রাহ্মণদের এই ধনের ব্যবস্থা সেইরূপ হইয়াছে।
ব্রাহ্মণ! আমি লোকোত্তর আর্য-ধর্মকেই পুরুষের স্ব-ধন বলিয়া ঘোষণা করি । প্রাচীন মাতা-পিতার কুল-বংশ অনুসরণ হেতু যেখানে যেখানে আত্ম-ভাবের (আপন-সত্বার) অভিব্যক্তি (পুনর্জন্ম) হয়, তদনুসারেই তাহার সংজ্ঞা হইয়া থাকে। যদি ক্ষত্রিয়কুলে আত্মভাবের অভিব্যক্তি ঘটে তবে ‘ক্ষত্রিয়’ এই সংজ্ঞাই লাভ হয়। যদি ব্রাহ্মণ ...... বৈশ্য, ...... শূদ্র-কুলে আত্ম-ভাবের অভিব্যক্তি হয় তবে ইহার ...... শূদ্র-সংজ্ঞা হইয়া থাকে।
যেমন ব্রাহ্মণ! যেই যেই প্রত্যয় (ইন্ধন) অবলম্বন করিয়া অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়, তদনুসারেই উহার নাম লাভ হয়; যদি কাষ্ঠকে আশ্রয় করিয়া অগ্নি জ্বলে তবে ‘কাষ্ঠাগ্নি’ এই নাম লাভ করে। যদি শকলিক (শল্ক, ছাল) ..... , গোময় আশ্রয় করিয়া অগ্নি জ্বলে, তবে ইহার ...... গোময়াগ্নি সংজ্ঞা হইয়া থাকে। সেইরূপ, ব্রাহ্মণ আমি লোকোত্তর আর্য-ধর্মকেই পুরুষের স্ব-ধন বলিয়া ঘোষণা করি। ......।
ব্রাহ্মণ! ক্ষত্রিয় কুল হইতেও যদি কেহ গার্হস্থ্য-আশ্রয় ত্যাগ করিয়া অনাগারিকরূপে প্রব্রজিত হয়, আর সে তথাগত আবিষ্কৃত ধর্ম-বিনয় অনুসারে প্রাণিহিংসা-বিরত হয় ...... সম্যক্দৃষ্টি-পরায়ণ হয়, তবে সে ন্যায় ধর্ম ও কুশলের আরাধনা করিয়া থাকে। ব্রাহ্মণ-কুল ......, বৈশ্য-কুল ...... , শূদ্র-কুল হইতেও ......। তবে সে ন্যায়, ধর্ম ও কুশলের আরাধক হয়।
৪৪২। তাহা কি মনে কর, ব্রাহ্মণ! কেবল ব্রাহ্মণই কি এই প্রদেশে বৈর-রহিত, বিদ্বেষ-রহিত মৈত্রী-চিত্ত ভাবনা করিতে সমর্থ হয়, ক্ষত্রিয় নহে, বৈশ্য নহে, শূদ্র নহে?”
“না, হে গৌতম! ক্ষত্রিয়ও এই প্রদেশে বৈর-রহিত, বিদ্বেষ-রহিত, বিশ্ব-মৈত্রী ভাবনা করিতে সমর্থ। ব্রাহ্মণও ...... বৈশ্যও ...... শূদ্রও ...... ; চারিবর্ণের সকলেই এই প্রদেশে ...... বিশ্বমৈত্রী-চিত্ত ভাবনা করিতে সমর্থ।”
“এই প্রকার ব্রাহ্মণ! ক্ষত্রিয়-কুল হইতেও যদি গৃহ-ত্যাগ করিয়া অনাগারিক প্রব্রজিত হয়, ...... সম্যক্দৃষ্টি সম্পন্ন হয়; তবে সে ন্যায়, ধর্ম ও কুশলের আরাধনা করিয়া থাকে। ব্রাহ্মণ-কুল ...... , বৈশ্য-কুল ...... , শূদ্রকুল হইতে ...... ; তবে সে ন্যায়-ধর্ম-কুশলের আরাধক হয়।”
৪৪৩। “তাহা কি মনে কর, ব্রাহ্মণ! ব্রাহ্মণই কি কেবল ্লানীয়সোত্তি (্লানীয়-চূর্ণপিণ্ড, সাবান বিশেষ) লইয়া নদীতে গিয়া ধূলি-ময়লা ধৌত করিতে সমর্থ হয়, ক্ষত্রিয় নহে, বৈশ্য নহে, শূদ্র নহে?”
“না, হে গৌতম! ক্ষত্রিয় ...... , বৈশ্য ...... , শূদ্রও ্লানীয়-সোত্তি লইয়া নদীতে গিয়া ধূলি-ময়লা ধৌত করিতে সমর্থ। চারিবর্ণের সকলেই ...... সমর্থ হয়।”
“সেইরূপ ব্রাহ্মণ! ক্ষত্রিয়-কুল হইতেও যদি কেহ গৃহ-ত্যাগ করিয়া অনাগারিক প্রব্রজিত হয়, ...... সম্যক্দৃষ্টি সম্পন্ন হয়; তবে সে ন্যায়-ধর্ম-কুশলের আরাধক হয়। যদি ব্রাহ্মণ-কুল ...... , বৈশ্য-কুল ...... , শূদ্র-কুল হইতে ...... , তবে সে ন্যায়-ধর্ম-কুশলের আরাধনা করে।”
৪৪৪। “তাহা কি মনে কর, ব্রাহ্মণ! (যদি) এখানে মূর্ধাভিষিক্ত ক্ষত্রিয়-রাজা নানা জাতির শত পুরুষকে সম্মিলিত করেন, (আর বলেন)- ‘আসুন, মহাশয়গণ! ...... ;’ তবে সেই অগ্নিদ্বারা অগ্নিকরণীয় সাধন করিতে সমর্থ হইবে না?”
“হে গৌতম! তাহা নহে, ক্ষত্রিয় ...... কুলোৎপন্ন দ্বারা ...... যে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়, ...... উহাও অর্চিমান ...... অগ্নি হইবে, সে অগ্নিদ্বারাও অগ্নিকার্য সম্পাদন করা চলিবে, আর চণ্ডাল....কুলোৎপন্ন দ্বারা ...... যে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়,...উহাও অর্চিমান অগ্নি হইবে। সকল অগ্নিদ্বারা অগ্নি-কার্য সমাধা করা সম্ভব।”
“এইরূপই ব্রাহ্মণ! ক্ষত্রিয়-কুল হইতে যদি গৃহ-ত্যাগ করিয়া প্রব্রজিত হয়, ...... সম্যক্দৃষ্টি পরায়ণ হয়; তবে সে ন্যায়, ধর্ম ও কুশলের আরাধনাকারী হইয়া থাকে। ব্রাহ্মণ-কুল, বৈশ্য-কুল, শূদ্র-কুল হইতেও; তবে সে ন্যায়, ধর্ম ও কুশলের আরাধক হয়।”
ইহা উক্ত হইলে এসুকারী ব্রাহ্মণ ভগবানকে কহিলেন,- আশ্চর্য, ভো গৌতম! আশ্চর্য, ভো গৌতম! ...... মহানুভব গৌতম আজ হইতে আমাকে আপ্রাণ শরণাগত উপাসকরূপে ধারণা করুন।
॥ এসুকারী সূত্র সমাপ্ত ॥
৪৪৫। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-
এক সময় ভগবান রাজগৃহে বেণুবন কলন্দক-নিবাপে অবস্থান করিতেছেন। সেই সময় আয়ুষ্মান সারিপুত্র মহাভিক্ষুসংঘের সহিত দক্ষিণাগিরিতে (জনপদে) পরিক্রমা করিতেছেন। তখন কোন ভিক্ষু রাজগৃহে বর্ষাবাস সমাপ্ত করিয়া দক্ষিণাগিরিতে যেখানে আয়ুষ্মান সারিপুত্র আছেন, সেখানে উপস্থিত হইলেন। তথায় আয়ুষ্মান সারিপুত্রের সঙ্গে ...... সম্মোদন করিয়া একপ্রান্তে উপবেশন করিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট সেই ভিক্ষুকে আয়ুষ্মান সারিপুত্র কহিলেন,- “কেমন বন্ধু! ভগবান নীরোগে ও সুস্থ আছেন?”
“হাঁ, বন্ধু! ভগবান নীরোগ ও সুস্থ আছেন।”
“কেমন, বন্ধু! ভিক্ষুসংঘ নীরোগ ও সুস্থ আছেন।”
“হাঁ, বন্ধু! ভিক্ষুসংঘ নীরোগ ও সুস্থ আছেন।”
“বন্ধু! তথায় তণ্ডুল পানদ্বার সমীপে ধনঞ্জানি নামক ব্রাহ্মণ থাকেন। আবুস! ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণ নীরোগ ও সুস্থ আছেন?
“বন্ধু! ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণও নীরোগ এবং সুস্থ আছেন।”
“কেমন, বন্ধু! ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণ অপ্রমত্ত আছেন?”
“কোথায় বন্ধু! আমাদের ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণের অপ্রমাদ? বন্ধু! ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণ রাজাকে আশ্রয় করিয়া ব্রাহ্মণ-গৃহপতিদিগকে লুণ্ঠন করিতেছেন (বিলুম্পতি)। ব্রাহ্মণ-গৃহপতিদিগকে আশ্রয় করিয়া রাজাকে লুণ্ঠন করিতেছেন। শ্রদ্ধাসম্পন্ন কুল হইতে আনীত তাঁহার যেই শ্রদ্ধাবতী ভার্যা ছিল, সেও কালগত হইয়াছে; শ্রদ্ধাহীন কুল হইতে অপর ভার্যা আনা হইয়াছে।”
“বন্ধো! আমরা দুঃশ্রুত (দুঃসংবাদ) শুনিলাম। আমরা নিতান্ত দুঃশ্রুত শুনিলাম! যেহেতু আমরা ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণের প্রমত্ততার সংবাদ শুনিলাম। যদি ক্বচিৎ কদাচিৎ ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণের সহিত সাক্ষাৎ করিতে পারি তবে মঙ্গল, কোন বাক্যালাপ হইলেই ভাল হয়।”
৪৪৬। তখন আয়ুষ্মান সারিপুত্র দক্ষিণাগিরি যথারুচি অবস্থান করিয়া পরিক্রমার্থ রাজ-গৃহাভিমুখে অগ্রসর হইলেন। ক্রমশঃ ধর্মপ্রচারে বিচরণ করিতে করিতে যেখানে রাজগৃহ সেখানে পৌঁছিলেন। তথায় আয়ুষ্মান সারিপুত্র রাজগৃহে বেণুবন কলন্দক-নিবাপে বিহার করিতেছেন।
একদিন আয়ুষ্মান সারিপুত্র পূর্বাহ্ন সময়ে নিবাসন পরিধান করিয়া পাত্র-চীবর ধারণ করিয়া ভিক্ষাচর্যার্থ রাজগৃহে প্রবেশ করিলেন। সেই সময় ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণ নগরের বাহিরে গোষ্ঠে গাভী দোহন করাইতেছিলেন। তখন সারিপুত্র রাজগৃহে পিণ্ডাচরণ করিয়া ভোজনের পর পিণ্ডাচরণ হইতে প্রত্যাবৃত্ত হইয়া যেখানে ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণ আছেন, সেস্থানে উপনীত হইলেন। ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণ দূর হইতে আয়ুষ্মান সারিপুত্রকে আসিতে দেখিলেন। দেখিয়া আয়ুষ্মান সারিপুত্রের সমীপে আসিলেন, সমীপে আসিয়া আয়ুষ্মান সারিপুত্রকে কহিলেন,- “ভো সারিপুত্র! এখানে ধারোষ্ণ দুগ্ধ পান করুন, ততক্ষণে ভোজনের সময় হইবে। (অর্থাৎ এখানেই ভোজন করিবেন।)”
“অলম্ ব্রাহ্মণ! আজকের মত আমার ভোজন-কৃত্য সমাপ্ত হইয়াছে। অমুক বৃক্ষের নীচে আমার দিবা-বিশ্রাম হইবে, তথায় আগমন করুন।”
“হাঁ, ভো!” (বলিয়া) ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণ আয়ুষ্মান সারিপুত্রকে প্রত্যুত্তর দিলেন।
তখন ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণ প্রাতরাশ শেষ করিয়া ভোজনের পর আয়ুষ্মান সারিপুত্র সমীপে গেলেন; তথায় গিয়া আয়ুষ্মান সারিপুত্রের সাথে ...... সম্মোদন করিয়া একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণকে আয়ুষ্মান সারিপুত্র ইহা বলিলেন,- “ধনঞ্জানি! কেমন, অপ্রমত্ত আছেন ত?”
“ভো সারিপুত্র! কোথায় আমাদের ন্যায় গৃহী-লোকের অপ্রমাদ? যেহেতু আমাদের মাতা-পিতার ভরণ-পোষণ করিতে হয়, পুত্র-দারকে লালন-পালন করিতে হয়। দাস-কর্মচারী পুরুষকে পোষণ করিতে হয়, মিত্র অমাত্যদের প্রতি কর্তব্য পালন করিতে হয়, জ্ঞাতি-সলোহিতগণের প্রতি জ্ঞাতি-সলোহিতোচিত কর্তব্য করিতে হয়, অতিথিদের আতিথেয়তা আছে, পূর্ব প্রেতদের নিমিত্ত প্রেত-কৃত্য সম্পাদন করিতে হয়, দেবগণকে দেবকরণীয় করিতে হয়, রাজার প্রতি রাজোচিত কর্তব্য করিতে হয়, আর এই (নিজের) শরীরও পুষ্ট এবং বর্ধিত করিতে হয়।”
৪৪৭। “তাহা কি মনে করেন, ধনাঞ্জনি! জগতে কোন লোক মাতা-পিতার নিমিত্ত অধর্মচারী, বিষমচারী হয়, সেই অধর্মচর্যা, বিষযমচর্যা হেতু তাহাকে নিরয়পালেরা নরকের দিকে আকর্ষণ করে, তখন সে (বলিতে) সুযোগ পাইবে কি?- ‘আমি মাতা-পিতার নিমিত্ত অধর্মচারী, বিষমচারী হইয়াছি। অতএব নিরয়পাল! আমাকে নরকেরদিকে নিও না’। অথবা তাহার মাতা-পিতা বলিতে সমর্থ হইবে কি?- ‘এই ছেলে আমাদের জন্য অধর্মচারী, বিষমচারী হইয়াছে। অতএব নরকপাল! ইহাকে নরকে নিও না’।”
“নিশ্চয় না, সারিপুত্র! বরং উচ্চৈঃস্বরে ক্রন্দন করিলেও নিরয়পালেরা তাহাকে নরকে নিক্ষেপ করিবে।”
“তাহা কি মনে করেন, ধনঞ্জানি! এখানে কেহ পুত্র-দার হেতু অধর্মচারী, বিষমচারী হয়, ......। দাস-কর্মচারী পুরুষের নিমিত্ত ......। মিত্র-অমাত্যের জন্য ......। জ্ঞাতি-সলোহিতের জন্য ......। অতিথিদের নিমিত্ত ......। পূর্ব-প্রেতের জন্য ......। রাজার জন্য ......। স্বীয় দেহের পুষ্টি ও বর্ধনের নিমিত্ত আমি অধর্মচারী, বিষমচারী হইয়াছি। অতএব নরকপাল! আমাকে নিরয়ে আকর্ষণ করিও না; কিংবা অপর কেহ বলিতে সমর্থ হইবে, স্ব-দেহের পুষ্টি ও বর্ধনের নিমিত্ত সে অধর্মচারী, বিষমচারী হইয়াছে। অতএব নিরয়পাল! তাহাকে নরকে নিক্ষেপ করিও না?”
“নিশ্চয় না, ভো সারিপুত্র! বরং উচ্চৈস্বঃরে ক্রন্দন করিলেও নিরয়পালেরা তাহাকে নরকে নিক্ষেপ করিবে।”
৪৪৮। “তাহা কি মনে করেন, ধনঞ্জানি! যে ব্যক্তি মাতা-পিতার নিমিত্ত অধর্মচারী বিষমচারী হয়, আর যে ব্যক্তি মাতা-পিতার নিমিত্ত ধর্মচারী সমচারী হয়, এই উভয়ের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠতর?”
“ভো সারিপুত্র! যে ব্যক্তি মাতা-পিতার নিমিত্ত অধর্মচারী বিষমচারী হয়, সে শ্রেষ্ঠ নহে, আর যে ব্যক্তি মাতা-পিতার নিমিত্ত ধর্মচারী সমচারী হয়, সে-ই এখানে শ্রেষ্ঠ। অধর্মচর্যা, বিষমচর্যা হইতে ধর্মচর্যা, সমচর্যাই শ্রেয়ঃ।”
“ধনঞ্জানি! আরো অনেক সহেতুক (ফলপ্রদ) ধার্মিক কর্মান্ত (বৃত্তি) আছে, যদ্বারা মাতা-পিতার ভরণ-পোষণ, পাপকর্ম না করা ও পুণ্য-মার্গ অবলম্বন করা সম্ভব।”
তাহা কি মনে করেন, ধনঞ্জানি! যে ব্যক্তি পুত্র-দারের নিমিত্ত ..... , দাস-কর্মচারী পুরুষের নিমিত্ত....., মিত্র-অমাত্যের নিমিত্ত ...... , জ্ঞাতি-সলোহিতের নিমিত্ত ...... , অতিথিদের নিমিত্ত ...... , পূর্ব প্রেতের নিমিত্ত ...... , দেবতাদের নিমিত্ত ...... , রাজার নিমিত্ত স্ব-দেহের পরিপুষ্টি ও পরিবর্ধন হেতু অধর্মচারী বিষমচারী হয়, কিংবা যে ব্যক্তি স্ব-দেহের পুষ্টি ও বর্ধন হেতু ধর্মচারী সমচারী হয়, তাহাদের কে শ্রেষ্ঠ?”
“ভো সারিপুত্র! যিনি স্ব-দেহের পুষ্টি ও বর্ধন হেতু অধর্মচারী বিষমচারী হয়, তাহাকে শ্রেষ্ঠ বলিনা! কিন্তু ভো সারিপুত্র! যিনি স্ব-দেহের পুষ্টি ও শ্রীবৃদ্ধিকল্পে ধর্মচারী, সমচারী হয়, তিনিই এখানে শ্রেষ্ঠ। ভো সারিপুত্র! অধর্মচর্যা ও বিষমচর্যা অপেক্ষা ধর্মচর্যা, সমচর্যাই শ্রেষ্ঠ।”
“ধনঞ্জানি! যুক্তিসঙ্গত বহু কর্মান্ত বিদ্যমান, যদ্বারা স্ব-দেহের পুষ্টি ও শ্রীবৃদ্ধি সাধন, পাপকর্ম পরিবর্জন ও পুণ্য-মার্গ অনুসরণ করা সম্ভব।”
৪৪৯। তখন ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণ আয়ুষ্মান সারিপুত্রের ভাষণ অভিনন্দন ও অনুমোদন করিয়া আসন হইতে গাত্রোত্থান পূর্বক প্রস্থান করিলেন। তৎপর ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণ একসময় ব্যাধিগ্রস্ত, দুঃখিত ও সাংঘাতিক পীড়িত হইলেন। তখন ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণ কোন ব্যক্তিকে কহিলেন,- “আস, হে পুরুষ! তুমি ভগবানের নিকট যাও, তথায় গিয়া আমার বাক্যে ভগবানের পাদপদ্মে নতশিরে বন্দনা কর, আর বল- ‘ভন্তে! ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণ ...... সাংঘাতিক পীড়িত, তিনি ভগবানের পাদপদ্মে নতশিরে প্রণাম করিয়াছেন। পুনরায় যেখানে আয়ুষ্মান সারিপুত্র আছেন তথায় যাও, আমার বাক্যে আয়ুষ্মান সারিপুত্রের পদযুগল বন্দনা কর, আর বল- ‘ভন্তে! ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণ ...... সাংঘাতিক পীড়িত, তিনি আয়ুষ্মান সারিপুত্রের পাদযুগল নতশিরে বন্দনা করিতেছেন।’ আর ইহাও বল- ‘ভন্তে! যদি আয়ুষ্মান সারিপুত্র অনুকম্পা পূর্বক ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণের গৃহে উপনীত হন, তবে ভাল হয়।”
“হাঁ, প্রভু!” (বলিয়া সেই ব্যক্তি ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণকে প্রতিশ্রুতি দিয়া ভগবানের নিকট গেল, এবং ভগবানকে অভিবাদন করিয়া একপ্রান্তে বসিল। একপ্রান্তে উপবিষ্ট সে ব্যক্তি ভগবানকে কহিল,- “ভন্তে! ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণ, ...... সাংঘাতিক পীড়িত হন, তিনি ভগবানের পাদপদ্মে নতশিরে প্রণাম করিয়াছেন।” পুনশ্চ যেখানে আয়ুষ্মান সারিপুত্র আছেন, সেস্থানে গেল; আয়ুষ্মান সারিপুত্রকে অভিবাদন করিয়া একপ্রান্তে বসিয়া ...... সারিপুত্রকে কহিল,- “ভন্তে! ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণ ...... সাংঘাতিক পীড়িত হন। যদি ভন্তে আয়ুষ্মান সারিপুত্র! অনুকম্পা পূর্বক ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণের গৃহে উপনীত হন, তবে ভাল হয়।” আয়ুষ্মান সারিপুত্র মৌনভাবে সম্মত হইলেন।
৪৫০। তখন আয়ুষ্মান সারিপুত্র নিবাসন পরিহিত হইয়া পাত্র-চীবর ধারণ করিয়া যেখানে ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণের গৃহ সেস্থানে উপনীত হইয়া সজ্জিত আসনে বসিলেন। তথায় বসিয়া আয়ুষ্মান সারিপুত্র ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণকে কহিলেন,- “ধনঞ্জানি! আপনার রোগ সহনীয় (খমনীয়) কি? কাল যাপনীয় কি? কেমন দুঃখ-বেদনা হ্রাস পাইতেছে (পটিক্কমন্তি), বৃদ্ধি পাইতেছে নহে ত? রোগের প্রত্যাগমন দেখা যায়, অভিগমন নহে ত?”
“ভো সারিপুত্র! আমার রোগ-যন্ত্রণা অসহনীয় হইয়াছে, কালযাপন দুষ্কর হইয়াছে, সাংঘাতিক দুঃখ-বেদনা বাড়িতেছে, কমিতেছেনা, রোগের আগমন দেখা যায়, নির্গমন নহে। যেমন হে সারিপুত্র! কোন বলবান পুরুষ তীক্ষ্ন শিখর (ক্ষুরাগ্র) দ্বারা মস্তকে ছেদন করে তদ্রূপই, ভো সারিপুত্র! অত্যধিক বায়ু আমার মস্তকে আঘাত করিতেছে। ওহে সারিপুত্র! আমার সহ্য হইতেছে না, কালক্ষেপ দুষ্কর হইয়াছে; আমার প্রবল দুঃখ-বেদনা বাড়িতেছে, কিন্তু কমিতেছে না। রোগের বাড়তি দেখা যায়, কমতি নহে। যেমন ভো সারিপুত্র! কোন বলবান পুরুষ বরত্রা-বন্ধনীদ্বারা শির বেষ্টন করিয়া দৃঢ় বন্ধন করে, তদ্রূপই সারিপুত্র! অত্যধিক শির-বেদনা হইয়াছে ...... আমার অসহ্য ......। যেমন সারিপুত্র! দক্ষ গো-ঘাতক বা গো-ঘাতকের অন্তেবাসী ধারাল গো-বিকর্তন অস্ত্রদ্বারা উদর কর্তন করে, সেইরূপই ভো সারিপুত্র! অত্যধিক বায়ু আমার কুক্ষি কর্তন করিতেছে। ...... অসহ্য ......। যেমন ভো সারিপুত্র! দুই জন সবল পুরুষ কোন দুর্বলতর পুরুষকে উভয় বাহুতে ধরিয়া জ্বলন্ত অঙ্গারগর্তে সন্তপ্ত করে, পরিতপ্ত করে; সেইরূপ হে সারিপুত্র! আমার শরীরে অত্যধিক দাহ জন্মিয়াছে। যন্ত্রণা আমার অসহ্য হইয়াছে ......।”
৪৫১। “তাহা কি মনে করেন, ধনঞ্জানি! নরক ও তির্যক যোনির মধ্যে কোন্টা শ্রেয়ঃ?”
“ভো সারিপুত্র! নরক অপেক্ষা তির্যকযোনি শ্রেষ্ঠ।”
“তির্যক ও প্রেতলোকের মধ্যে কোন্টা শ্রেষ্ঠ?”
“ ...... প্রেতলোক ......।”
“প্রেতলোক ও মনুষ্যলোকের মধ্যে কোন্টা শ্রেষ্ঠ?”
“ ...... মনুষ্যলোক ......।”
“মনুষ্য ও চাতুর্মহারাজিক দেবগণের মধ্যে কাহারা শ্রেষ্ঠ?”
“চাতুর্মহারাজিক দেবগণ ......।”
“চাতুর্মহারাজিকদেব ও ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণের মধ্যে কাহারা শ্রেষ্ঠ?”
“ত্রয়স্ত্রিংশ দেবগণ ......।”
“ত্রয়স্ত্রিংশ ও যাম দেবগণের মধ্যে ...... ?”
“যামদেবগণ ......।”
“যামদেব ও তুষিত দেবগণের মধ্যে ...... ?”
“তুষিত দেবগণ ......।”
“তুষিত দেবগণ ও নির্মাণরতি দেবগণের মধ্যে ...... ?”
“নির্মাণরতি দেবগণ ......।”
“নির্মাণরতি ও পরনির্মিত বশবর্তী দেবগণের মধ্যে ...... ?”
“পরনির্মিত বশবর্তী দেবগণ ......।”
“তাহা কি মনে করেন, ধনঞ্জানি! পরনির্মিত বশবর্তী দেবলোক কিংবা ব্রহ্মলোক উভয়ের কোন্টা শ্রেয়ঃ ?”
“মাননীয় সারিপুত্র! ব্রহ্মলোক বলিতেছেন? মাননীয় সারিপুত্র! ব্রহ্মলোক বলিতেছেন?”
তখন আয়ুষ্মান সারিপুত্রের এই চিন্তা হইল,- “সাধারণতঃ এই সকল ব্রাহ্মণেরা ব্রহ্মলোকাধিমুক্তিক (মুক্তি বিশ্বাসী) হন; যদি ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণকে আমি ব্রহ্মাদের সহব্যতার (সারূপ্যের) উপায় উপদেশ করি, তবে ভাল হয়। ধনঞ্জানি! আপনাকে ব্রহ্ম-সহব্যতার উপায় উপদেশ করিব, তাহা শুনুন, উত্তমরূপে মনোযোগ রাখুন, বলিতেছি-”
“হাঁ, ভো!” (বলিয়া) ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণ আয়ুষ্মান সারিপুত্রকে প্রত্যুত্তর দিলেন।
আয়ুষ্মান সারিপুত্র বলিলেন,- “ধনঞ্জানি! ব্রহ্ম-সহব্যতার মার্গ কি?- ধনঞ্জানি! এখানে ভিক্ষু মৈত্রীযুক্ত চিত্তে একদিক পরিপূর্ণ করিয়া বিহার করেন। তথা দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ দিক ......। এই প্রকারে ঊর্ধে অধেঃ পার্শ্বদিকে; সর্বত্র সদিচ্ছা প্রণোদিত হইয়া নিখিল বিশ্ব-প্রাণির প্রতি বৈরীহীন, বিদ্বেষ-রহিত, বিপুল, মহদ্গত, অপরিমাণ মৈত্রীচিত্ত পরিব্যাপ্ত করিয়া বিহার করেন। ধনঞ্জানি! ইহাই ব্রহ্ম-সহব্যতার মার্গ।
৪৫২। পুনশ্চ ধনঞ্জানি! করুণা সহগত চিত্তদ্বারা, মুদিতা সহগত চিত্তদ্বারা, উপেক্ষা (সমদর্শন) সহগত চিত্তদ্বারা একদিক ......। ধনঞ্জানি! ইহাই ব্রহ্ম-সহব্যতার মার্গ।”
“তাহা হইলে, ভো সারিপুত্র! আমার বাক্যে ভগবানের পাদপদ্মে নতশিরে বন্দনা করিবেন, (এবং কহিবেন)- ‘ভন্তে! ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণ ...... সাংঘাতিক পীড়িত, তিনি ভগবানের পাদপদ্মে নতশিরে প্রনাম করিয়াছেন’।”
তখন আয়ুষ্মান সারিপুত্র উত্তরিতর করণীয় বিদ্যমান সত্বেও ধনঞ্জানিকে হীন ব্রহ্মলোকে প্রতিষ্ঠিত করিয়া আসন হইতে গাত্রোত্থান পূর্বক প্রস্থান করিলেন।
অতঃপর আয়ুষ্মান সারিপুত্রের যাত্রার অচিরকাল পরে ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণ দেহত্যাগ করিলেন এবং ব্রহ্মলোকে উৎপন্ন হইলেন।
৪৫৩। সেই সময় ভগবান ভিক্ষুদিগকে আহ্বান করিলেন,- “ভিক্ষুগণ! এই সারিপুত্র উত্তরিতর করণীয় বিদ্যমান সত্বেও ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণকে হীন ব্রহ্মলোকে প্রতিষ্ঠিত করিয়া আসন হইতে উঠিয়া প্রস্থান করিল।”
তখন আয়ুষ্মান সারিপুত্র যেস্থানে ভগবান আছেন সেস্থানে উপনীত হইলেন এবং ভগবানকে অভিবাদন করিয়া একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট আয়ুষ্মান সারিপুত্র ভগবানকে নিবেদন করিলেন,- “ভন্তে! ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণ ...... সাংঘাতিক পীড়িত, তিনি ভগবানের চরণ যুগল নতশিরে বন্দনা করিয়াছেন।”
“কেন, সারিপুত্র! তুমি উত্তরিতর করণীয় বিদ্যমান সত্বে ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণকে হীন ব্রহ্মলোকে প্রতিষ্ঠিত করিয়া আসন হইতে উঠিয়া চলিয়া আসিলে?”
“ভন্তে! আমার এ ধারণা হয়েছিল- সাধারণতঃ এ সকল ব্রাহ্মণ ব্রহ্মলোকের প্রতি শ্রদ্ধাসম্পন্ন। সুতরাং আমি ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণকে ব্রহ্ম-সহব্যতার মার্গ উপদেশ করিলে ভাল হয়।”
“সারিপুত্র! ধনঞ্জানি ব্রাহ্মণ কালগত হইয়াছে, আর ব্রহ্মলোকে উৎপন্ন হইয়াছে।”
॥ ধনঞ্জানি সূত্র সমাপ্ত ॥
(জাতিভেদ প্রথার খণ্ডন)
৪৫৪। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-
এক সময় ভগবান ইচ্ছানঙ্গলে অবস্থান করিতেছেন, ইচ্ছানঙ্গলের বনষণ্ডে (গভীর বনে)। সেই সময় কয়েকজন প্রসিদ্ধ, সম্ভ্রান্ত ব্রাহ্মণ মহাশাল (মহাধনী) যেমন- চংকী ব্রাহ্মণ, তারুক্ষ্য-ব্রাহ্মণ, জানুশ্রোণি-ব্রাহ্মণ, তোদেয়্য-ব্রাহ্মণ এবং অপর অভিজ্ঞাত অভিজ্ঞাত ব্রাহ্মণ মহাশাল ইচ্ছানঙ্গলে বসবাস করিতেন।
তখন জঙ্ঘা বিহারার্থ চংক্রমণ ও বিচরণ করিবার সময় বাশিষ্ঠ ও ভারদ্বাজ মাণব (বিদ্যার্থী) দ্বয়ের মধ্যে এই কথা প্রসঙ্গ উত্থাপিত হইল,- ওহে! কি প্রকারে ব্রাহ্মণ হয়?”
ভারদ্বাজ মাণব কহিল- “ওহে! মাতা আর পিতা উভয় পক্ষ হইতে সুজাত (কুলীন), (মাতা-পিতা) উভয় পক্ষে পিতামহ পরম্পরা সাত পুরুষযুগ পর্যন্ত বিশুদ্ধ বংশাবলী জাতিবাদের দ্বারা অক্ষিপ্ত, অনিন্দিত হয়, ইহাতেই ভো! ব্রাহ্মণ হইয়া থাকে।”
বাশিষ্ঠ মাণব কহিল-“যখন মানুষ শীলবান ও ব্রত সম্পন্ন হয়, তখন তাহাতেই সে ব্রাহ্মণ হইয়া থাকে।”
ভারদ্বাজ মাণব বাশিষ্ঠ মাণবকে বুঝাইতে অসমর্থ হইল, বাশিষ্ঠ মাণবও ভারদ্বাজ মাণবকে বুঝাইতে সমর্থ হইল না। তখন বাশিষ্ঠ মাণব ভারদ্বাজ মাণবকে আহ্বান করিলেন,- “হে ভারদ্বাজ মাণব! শাক্য-কুল প্রব্রজিত এই শ্রমণ শাক্যপুত্র গৌতম ইচ্ছানঙ্গলের বনষণ্ডে বিহার করিতেছেন। সেই মাননীয় গৌতমের এইরূপ কল্যাণ-কীর্তিশব্দ বিঘোষিত হইয়াছে- ‘সেই ভগবান এই কারণে অর্হৎ, ......বুদ্ধ ভগবান হন। চলুন...... হে ভারদ্বাজ! যেখানে শ্রমণ গৌতম আছেন, আমরা সে স্থানে উপনীত হই। আমরা তথায় গিয়া শ্রমণ গৌতমকে এ বিষয় জিজ্ঞাসা করি। শ্রমণ গৌতম আমাদিগকে যেরূপ বর্ণনা করেন, আমরা সেরূপই ধারণ করিব।”
“হাঁ, ভো!” (বলিয়া) ভারদ্বাজ মাণব বাশিষ্ঠ মাণবকে উত্তর দিলেন।
৪৫৫। তখন বাশিষ্ঠ ও ভারদ্বাজ মাণবদ্বয় যেস্থানে ভগবান আছেন, সেস্থানে উপনীত হইলেন, তথায় উপনীত হইয়া ভগবানের সহিত সম্মোদন করিয়া একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট মাণবদ্বয় ভগবানকে গাথাদ্বারা নিবেদন করিলেন,-
“অনুজ্ঞাত, প্রতিজ্ঞাত হই ওহে! আমরা দু’জন,
পোক্খরসাতির আমি, তারুক্খের ইনি শিষ্য হন। (১)
ত্রিবেদীর যাহা খ্যাত তাতে হই কেবলী, বিদ্বান,
পদ হতে ব্যাকরণ, জল্পে মোরা আচার্য সমান। (২)
জাতিবাদে বাক্-বিতর্ক হল মোদের হে গৌতম!
জন্মেতে ব্রাহ্মণ হয় ভারদ্বাজ করেন ভাষণ;
কর্মেতে ব্রাহ্মণ বলি, জান ইহা ওহে ভগবন! (৩)
বুঝাইতে অসমর্থ একে অন্যে আমরা দু’জন,
বিশ্রুতসম্বুদ্ধে আসি এ’প্রশ্ন করিতে জিজ্ঞাসন। (৪)
যুক্তাঞ্জলি কাছে গিয়া পূর্ণচন্দ্রে যথা বন্দমান,
জগতে গৌতমে তথা জনগণ করেন প্রণাম। (৫)
লোকে চক্ষুসমুৎপন্ন গৌতমকে করি জিজ্ঞাসন,
জন্মে হয় কিংবা কর্মে, কিসে হয় যথার্থ ব্রাহ্মণ?
অজ্ঞ মোরা বল নাথ! জানি যেন প্রকৃত ব্রাহ্মণ।” (৬)
৪৫৬। (ভগবান কহিলেন,- বাশিষ্ঠ!)
ক্রমান্বয়ে তোমাদিগে যথাযথ করিব বর্ণন,
প্রাণীদের জাতি ভাগ পরস্পর বিভিন্ন ধরণ। (৭)
দেখ তৃণ-বৃক্ষ-লতা কভু কারে করেনা জ্ঞাপন,
জন্মগত লিঙ্গ (চিহ্ন) তার পরস্পরে জাতি নিদর্শন । (৮)
পতঙ্গাদি ক্ষুদ্র কীট-পিপীলিকা আর জীবগণ,
জন্মগত আকৃতিই ইহাদের নানাত্ব কারণ। (৯)
ছোট বড় চতুষ্পদী আরো দেখ যত জন্তুগণ,
জন্মগত আকৃতিই তাতে জাতিভেদ নিদর্শন। (১০)
দীর্ঘ পৃষ্ঠ পাদোদর দেখ এই উরগ-নিচয়,
জন্মগত আকৃতিতে পরস্পরে ভিন্নজাতি হয়। (১১)
জলে দেখ জলচর মৎস্যাদি আর প্রাণীচয়,
জন্মগত আকৃতিতে পরস্পরে ভিন্নজাতি হয়। (১২)
পক্ষ-যান বিহঙ্গম পক্ষিগণে কর নিরীক্ষণ,
পরস্পর ভিন্নজাতি জন্মগত লিঙ্গের কারণ। (১৩)
এ সব জাতিতে যথা জন্মগত বিভিন্ন গঠন,
মানবের জন্মগত লিঙ্গ তথা নাহি কদাচন। (১৪)
কেশে নহে, শিরে নহে, চক্ষু-কর্ণ ইন্দ্রিয় সকলে,
মুখে নহে, নাকে নহে, নহে ওষ্ঠে কিংবা ভ্রূযুগলে। (১৫)
গ্রীবায় অংসেতে নহে পৃষ্ঠ কিংবা উদর প্রদেশে,
শ্রোণীতে বক্ষেতে নহে, মৈথুনে বা নহে গুহ্যদেশে। (১৬)
হস্তে নহে, পদে নহে, নহে নখে অঙ্গুলি-আকারে,
জংঘায় উরেতে নহে, নহে বর্ণে, নহে কণ্ঠস্বরে;
অন্য-প্রাণি সম জন্মতঃ ভিন্নতা নাহি দেখি নরে। (১৭)
৪৫৭। তথাপি-
মানব শরীরে নিজস্ব বৈষম্য নাহি বিদ্যমান,
ব্যবহার মাত্র মানুষের মাঝে নানাত্ব বিধান। (১৮)
মানুষের কেহ করে গো-রক্ষায় জীবন যাপন,
কৃষক জানিবে তাকে, হে বাশিষ্ঠ! নহে সে ব্রাহ্মণ! (১৯)
যে কেহ মানব মাঝে ভিন্ন শিল্পে করে উপার্জন,
এরূপে জানিবে শিল্পী, হে বাশিষ্ঠ! নহে সে ব্রাহ্মণ। (২০)
যে করে মাণব মাঝে বাণিজ্যেতে জীবন যাপন,
এরূপে বণিক জান, হে বাশিষ্ঠ! নহে সে ব্রাহ্মণ। (২১)
যে কেহ মানব মাঝে প্রেষ্যবৃত্তি করেন গ্রহণ,
হে বাশিষ্ঠ! প্রেষ্যবলে জান তাকে, নহে সে ব্রাহ্মণ। (২২)
যে কেহ মানব মাঝে চৌর্য-বৃত্তি করে আচরণ,
এরূপে জানিবে চোর, হে বাশিষ্ঠ! নহে সে ব্রাহ্মণ। (২৩)
যে কেহ মনুষ্য মধ্যে অস্ত্র-বিদ্যা করেন গ্রহণ,
যোদ্ধাজীব জান তাকে, হে বাশিষ্ঠ! নহে সে ব্রাহ্মণ। (২৪)
যে করে মানব মাঝে পৌরহিত্যে জীবন যাপন,
পুরোহিত জান তাকে, হে বাশিষ্ঠ! নহে সে ব্রাহ্মণ। (২৫)
মানবের যদি কেহ গ্রাম-রাজ্যে অধীশ্বর হন,
এরূপে বাশিষ্ঠ! জান রাজা তিনি, নহেন ব্রাহ্মণ। (২৬)
বলি না ব্রাহ্মণ আমি যোনিজাতে মাতার নন্দন,
‘ভো’ বাদী নামেতে খ্যাত যদ্যপি সে হয় সকিঞ্চন ।
অকিঞ্চন অনাদান, তাকে বলি প্রকৃত ব্রাহ্মণ। (২৭)
৪৫৮। অধিকন্তু
সর্ব সংযোজন পরিহরি যিনি সন্ত্রাস নাশন,
তৃষ্ণামুক্ত বিসংযুক্ত, তাকে বলি যথার্থ ব্রাহ্মণ। (২৮)
বরত্রা সন্ধাম নন্ধি সানুক্রম করিয়া ছেদন,
উক্ষিপ্ত-পরিঘ প্রাজ্ঞ, তাকে বলি প্রকৃত ব্রাহ্মণ। (২৯)
আক্রোশ বন্ধন বধ সহ্য করে যিনি অনুক্ষণ,
ক্ষান্তি-বল অস্ত্র-শক্তি যা’র, তাকে বলি হে ব্রাহ্মণ। (৩০)
ক্রোধহীন ব্রতবান সচ্চরিত্র রাগাদি বারণ,
যে দান্ত অন্তিম দেহী, তাকে আমি বলিব ব্রাহ্মণ। (৩১)
পদ্মপত্রে বারিবিন্দু, সূচী-অগ্রে সর্ষপ যেমন,
কামেতে নির্লিপ্ত যিনি, তাকে বলি প্রকৃত ব্রাহ্মণ। (৩২)
আত্ম-দুঃখ-ক্ষয় যিনি এ জীবনে অভিজ্ঞাত হন,
ভার-মুক্ত, বিসংযুক্ত, তাকে আমি বলিব ব্রাহ্মণ। (৩৩)
মেধাবী, গভীর প্রাজ্ঞ, মার্গামার্গে যিনি বিচক্ষণ,
উত্তমার্থ অনুপ্রাপ্ত, তাকে বলি প্রকৃত ব্রাহ্মণ। (৩৪)
গৃহী বা সন্ন্যাসী সনে উভয়েতে নির্লিপ্ত যেজন,
গৃহ-ত্যাগী অনাগারী তৃষ্ণামুক্তে বলিব ব্রাহ্মণ। (৩৫)
সভয়-নির্ভয় ভূতে যিনি দণ্ড করিয়া বর্জন
হত্যাঘাত নাহি করে, তাকে আমি বলিব ব্রাহ্মণ। (৩৬)
শত্রু-মাঝে মিত্র যিনি, দণ্ডযোগ্য শান্ত যেই জন,
পরিগ্রহে অনাদান, তাকে বলি প্রকৃত ব্রাহ্মণ। (৩৭)
রাগ-দ্বেষ-মান আর ম্রক্ষ যার হয়েছে পতিত,
শরাগ্র-সর্ষপ সম, তাকে বলি ব্রাহ্মণ নিশ্চিত। (৩৮)
৪৫৯। অকর্কশ বিজ্ঞাপক সত্যবাক্য যে করে ভাষণ,
যাতে ক্রোধান্বিত নহে কেহ, তাকে বলিগো ব্রাহ্মণ। (৩৯)
দীর্ঘ-হ্রস্ব, অণু-স্থূল, ভাল-মন্দ দ্রব্য যেই জন,
অদত্ত না লয় লোকে, তাকে আমি বলিগো ব্রাহ্মণ। (৪০)
ইহলোকে পরলোকে আশা যার নাহি বিদ্যমান,
বাসনা-বন্ধন মুক্ত, তাকে আমি বলিগো ব্রাহ্মণ। (৪১)
তৃষ্ণা যার নাহি বিদ্যমান জ্ঞানোদয়ে নিঃসংশয়,
প্রবিষ্ট অমৃত মাঝে, তাকে বলি ব্রাহ্মণ নিশ্চয়। (৪২)
লোকে যিনি অতিক্রমি পাপ-পুণ্য উভয় বন্ধন,
অশোক-নির্মল-শুদ্ধ, তাকে আমি বলিগো ব্রাহ্মণ। (৪৩)
নির্মল চন্দ্রমা সম শুদ্ধ স্বচ্ছ অনাবিল জন,
নন্দী-ভব পরিক্ষীণ, তাকে আমি বলিগো ব্রাহ্মণ। (৪৪)
যিনি দুর্গম সংসার পরিপন্থ মোহাতীত হন,
তীর্ণ, পারগত, ধ্যানী, তৃষ্ণামুক্ত, সংশয় বর্জন;
নির্বাপিত উপাদান ক্ষয়ে, তাকে বলিগো ব্রাহ্মণ। (৪৫)
যিনি কামে পরিহরি গৃহত্যাগী প্রব্রজিত হন,
কাম-ভব পরিক্ষীণ, তাকে আমি বলিগো ব্রাহ্মণ। (৪৬)
যিনি লোকে তৃষ্ণাছাড়ি অনাগারে প্রব্রজিত হন,
তৃষ্ণা-ভব পরিক্ষীণ, তাকে আমি বলিগো ব্রাহ্মণ। (৪৭)
মানবীয়-যোগ ছাড়ি দিব্য-যোগ করি অতিক্রম,
সর্বযোগে বিসংযুক্ত, তাকে বলি প্রকৃত ব্রাহ্মণ। (৪৮)
ছাড়ি রতি অরতিরে শীতিভূত, উপধি-বিহত,
সর্বলোক জয়ী বীর, তাকে বলি ব্রাহ্মণ প্রকৃত । (৪৯)
সত্বদের জন্ম-মৃত্যু সর্বভাবে যিনি জ্ঞাত হন,
নির্লিপ্ত সুগত বুদ্ধ, তাকে বলি প্রকৃত ব্রাহ্মণ। (৫০)
যার গতি নাহি জানে গন্ধর্ব বা নরামরগণ,
ক্ষীণাস্রব, অরহত, তাকে বলি প্রকৃত ব্রাহ্মণ। (৫১)
যার পূর্বাপর মধ্যে কিছুমাত্র নাহিক কিঞ্চন,
অকিঞ্চন, অনাদান, তাকে বলি প্রকৃত ব্রাহ্মণ। (৫২)
ঋষভ, প্রবর বীর, মহাঋষি, বিজেতা প্রধান,
অকলুষ ধৌতপাপ বুদ্ধে বলি প্রকৃত ব্রাহ্মণ। (৫৩)
পূর্বজন্ম যিনি জ্ঞাত, স্বর্গাপায় করেন দর্শন।
পূর্বজন্ম ক্ষয় প্রাপ্ত যিনি, তাকে বলি প্রকৃত ব্রাহ্মণ। (৫৪)
৪৬০। সংজ্ঞামাত্র ইহলোকে নাম-গোত্র মানব-কল্পিত,
জন্মকালে ব্যবহৃত লোকমুখে হয় সমাগত। (৫৫)
বস্তুত ঃ-
জন্মেতে ব্রাহ্মণ নহে, নাহি হয় জন্মে অব্রাহ্মণ,
কর্মেতে ব্রাহ্মণ হয়, কর্মবশে হয় অব্রাহ্মণ। (৫৬)
কৃষক কর্মেতে হয়, শিল্পী হয় কর্মের কারণ,
বণিক কর্মেতে হয়, প্রেষ্য হয় কর্ম-নিবন্ধন। (৫৭)
চোর হয় কর্মহেতু, যোদ্ধা জীব কর্মের কারণ
যাচক কর্মেতে হয়, রাজা হয় কর্ম-নিবন্ধন। (৫৮)
কর্ম আর ফলজ্ঞানী প্রতীত্য-সমুৎপাদ দর্শিগণ,
পণ্ডিতেরা এই কর্ম যথাভূত করে নিরীক্ষণ। (৫৯)
কর্মেতে চলেছে বিশ্ব, কর্মেহেতু ভ্রমে প্রাণিগণ,
আণিবদ্ধ রথচক্র সম ঘুরে কর্মে জীবগণ। (৬০)
তপস্যায়, ব্রহ্মচর্যে, সংযমে ও ইন্দ্রিয়-দমনে,
ইহাতে ব্রাহ্মণ হয়, ব্রাহ্মণ্য উত্তম শুধু গুণে। (৬১)
ত্রিবিদ্যায় সুসমৃদ্ধ পুনর্ভব মুক্ত শান্তজন,
জানিবে বাশিষ্ঠ এরা, বিজ্ঞদের ইন্দ্র-ব্রহ্মা হন।” (৬২)
৪৬১। এইরূপ কথিত হইলে বাশিষ্ঠ ও ভারদ্বাজ বিদ্যার্থীদ্বয় ভগবানকে ইহা বলিলেন,- “আশ্চর্য, ভো গৌতম! চমৎকার, ভো গৌতম! যেমন অধঃমুখ ভাজনকে ঊর্ধমুখ করা হয়,......। এই আমরা প্রভু গৌতমের শরণ গ্রহণ করিতেছি, ধর্মের ও ভিক্ষুসংঘের শরণও গ্রহণ করিতেছি। মহামান্য গৌতম আজ হইতে আজীবন আমাদিগকে শরণাগত উপাসকরূপে ধারণা করুন।”
॥ বাশিষ্ঠ সূত্র সমাপ্ত ॥
(গার্হস্থ্য ও সন্ন্যাস জীবনের তুলনা, ব্রহ্মলোকের মার্গ)
৪৬২। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-
এক সময় ভগবান শ্রাবস্তীতে অনাথপিণ্ডিকের জেতবন আরামে অবস্থান করিতেছেন, সেই সময় তোদেয়পুত্র শুভমাণব কোন কার্যোপলক্ষে শ্রাবস্তীতে (আসিয়া) এক গৃহপতির ঘরে বাস করিতেছেন। তখন তোদেয়পুত্র শুভ যেই গৃহপতির গৃহে বাস করেন, সেই গৃহপতিকে বলিলেন,- “গৃহপতি! আমি ইহা শুনিয়াছি যে- শ্রাবস্তী অর্হতদের দ্বারা বিবিক্ত (নির্জন) নহে। আজ কোন্ শ্রমণ কিংবা ব্রাহ্মণের পর্যুপাসনা (সাহচর্য) করিতে পারি?”
“প্রভু! এই ভগবান শ্রাবস্তীতে অনাথপিণ্ডের জেতবন আরামে অবস্থান করিতেছেন। প্রভু! সেই ভগবানের পর্যুপাসনা করুন।”
তখন শুভমাণব সেই গৃহপতির কথা শুনিয়া যেখানে ভগবান আছেন, সেস্থানে উপনীত হইলেন, উপস্থিত হইয়া ভগবানের সহিত সম্মোদন করিয়া একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট ...... শুভমাণব ভগবানকে কহিলেন,- “ভো গৌতম! ব্রাহ্মণেরা ইহা বলিয়া থাকেন- গৃহস্থই অনবদ্য ন্যায়-ধর্মের (আর্য-মার্গের) আরাধক হয়, প্রব্রজিত ন্যায়-ধর্ম ও কুশলের আরাধক হইতে পারে না। এ সম্বন্ধে মাননীয় গৌতম কি বলেন?”
৪৬৩। “মাণব! এ সম্বন্ধে আমি বিভাজ্যবাদী, ইহাতে আমি একান্তবাদী নহি। মাণব! আমি গৃহীর কিংবা প্রব্রজিতের মিথ্যা প্রতিপত্তি (ভ্রান্ত আচরণ) প্রশংসা করি না। মিথ্যা প্রতিপন্ন ব্যক্তি গৃহী হউক অথবা প্রব্রজিতই হউক মিথ্যা প্রতিপত্তির দরুণ ন্যায়-ধর্ম ও কুশলের আরাধনা করিতে পারে না। মাণব! গৃহীর কিংবা প্রব্রজিতের সম্যক্ প্রতিপত্তিকে আমি প্রশংসা করি। সম্যক্ প্রতিপন্ন গৃহী কিংবা প্রব্রজিত সম্যক্ প্রতিপত্তির দরুণ ন্যায়-ধর্ম ও কুশলের পরিপূরণকারী হয়।”
“ভো গৌতম! ব্রাহ্মণেরা এরূপ বলেন- ‘এই গৃহবাসের (গৃহস্থীর) কর্মস্থান (আদর্শ, ক্ষেত্র) মহার্থ (বহু প্রয়োজন), বহু কর্তব্য, বহু অধিকরণ, বিপুল আড়ম্বরপূর্ণ; সুতরাং ইহা মহা ফলপ্রদ হয়। আর এই প্রব্রজ্যা-কর্মস্থান স্বল্পার্থ, স্বল্প-কৃত্য, স্বল্প-অধিকরণ, সামান্য আড়ম্বরপূর্ণ; সুতরাং ইহা হয় স্বল্প ফলপ্রদ’।”
“মাণব! এ বিষয়েও আমি বিভাজ্যবাদী; ইহাতে আমি একান্তবাদী নহি। (১) মাণব! এমন মহার্থ, মহাকৃত্য, মহাধিকরণ, মহা সমারম্ভযুক্ত কর্মস্থান আছে, যাহা বিপন্ন হইলে স্বল্প ফলপ্রদ হয়। (২) মাণব! মহার্থ, মহাকৃত্য, মহাধিকরণ, মহা সমারম্ভযুক্ত কর্মস্থানও আছে, যাহা সম্পন্ন হইলে মহা ফলপ্রদ হয়। (৩) মাণব! এমন স্বল্পার্থ, অল্প-কৃত্য, অল্প-অধিকরণ ও অল্প সমারম্ভযুক্ত কর্মস্থান আছে; যাহা বিপন্ন হইলে স্বল্প-ফল হয়। মাণব! এমনও অল্পার্থ ...... কর্মস্থান আছে; যাহা সুসম্পন্ন হইলে মহাফল হয়।
মাণব! কোন্ প্রকার কর্মস্থান, (১) মহার্থ, মহাকৃত্য, মহাধিকরণ, মহা সমারম্ভযুক্ত; কিন্তু বিপন্ন হইলে অফল হইয়া থাকে? মাণব! কৃষি এমন কর্মস্থান, যাহা মহার্থ.....মহা সমারম্ভযুক্ত, কিন্তু বিপন্ন হইলে অফল হয়। (২) ...... কোন্ প্রকার কর্মস্থান ...... মহা সমারম্ভযুক্ত ...... কিন্তু সম্পন্ন হইলে মহাফল হয়? মানব! কৃষিই ......। (৩) কোন্ প্রকার কর্মস্থান ...... অল্প সমারম্ভযুক্ত (এবং) বিপন্ন হইলে অফল হয়? মাণব! বাণিজ্য ......। (৪) কোন্ প্রকার কর্মস্থান ...... অল্প সমারম্ভযুক্ত, কিন্তু সম্পন্ন হইলে মহাফল হয়? মাণব! বাণিজ্যই ......।
৪৬৪। যেমন মাণব! কৃষি কর্মস্থান ...... মহা সমারম্ভযুক্ত, বিপন্ন হইলে অফল হয়; তদ্রূপই মাণব! গৃহবাস কর্মস্থান ...... মহা সমারম্ভযুক্ত, কিন্তু বিপন্ন হইলে অফল হয়। যেমন মাণব! কৃষি কর্মস্থানই ...... মহা সমারম্ভযুক্ত, কিন্তু সম্পন্ন হইলে মহা ফলপ্রদ হয। সেইরূপই ...... গৃহবাস ...... কর্মস্থান ......। যেমন ...... বাণিজ্য কর্মস্থান ...... অল্প সমারম্ভযুক্ত; আর বিপন্ন হইলে অফল হয়; সেইরূপই মাণব! প্রব্রজ্যা কর্মস্থান ......। যেমন ...... বাণিজ্য কর্মস্থান ...... অল্প সমারম্ভ হয়, কিন্তু সুসম্পন্ন হইলে মহাফল হয়; তদ্রূপই মাণব! প্রব্রজ্যা কর্মস্থান ......।”
“ভো গৌতম! পুণ্য সম্পাদনের তথা কুশলের আরাধনার নিমিত্ত ব্রাহ্মণগণ পঞ্চধর্ম প্রজ্ঞাপন করেন।”
“মাণব! ব্রাহ্মণেরা পুণ্যের সম্পাদনার্থ ...... যে পঞ্চবিধ ধর্ম প্রজ্ঞাপন করে, যদি বলিতে তোমার গুরুভার (অসুবিধা) না হয়; সাধু, তবে সেই পঞ্চধর্ম এই পরিষদে ভাষণ করিতে পার।”
“ভো গৌতম! আমার কোন গুরুভার নহে; বিশেষতঃ যেখানে আপনি কিংবা আপনার ন্যায় (মহাপুরুষ) উপবিষ্ট আছেন।”
“মাণব! তবে বল।”
“ভো গৌতম! পুণ্য সম্পাদনার্থ তথা কুশলের আরাধনার নিমিত্ত (১) সত্যবাক্য প্রথম ধর্ম, (২) ...... তপশ্চর্যা ...... দ্বিতীয় ধর্ম, (৩) ...... ব্রহ্মচর্য তৃতীয় ধর্ম, (৪) ...... মন্ত্র-অধ্যয়ন ...... চতুর্থ ধর্ম, .....আর (৫) দ্রব্য-ত্যাগ (অপরিগ্রহ) পঞ্চম ধর্ম; যাহা ব্রাহ্মণেরা প্রজ্ঞাপন করেন। ভো গৌতম! ব্রাহ্মণেরা পুণ্য সম্পাদনার্থ এবং কুশলের আরাধনার নিমিত্ত এই পঞ্চধর্ম প্রজ্ঞাপন করেন। এ সম্বন্ধে মাননীয় গৌতম কি বলেন?”
৪৬৫। “কেমন, মাণব! ব্রাহ্মণদের একজনও কি আছেন; যিনি বলিতে পারেন- আমি এই পঞ্চধর্মকে স্বয়ং অভিজ্ঞাদ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া উহার বিপাক প্রকাশ করিতেছি?”
“না, ভো গৌতম।”
“মাণব! কেমন ব্রাহ্মণদের এক আচার্যও, এক আচার্য-প্রাচার্যও, সপ্তম আচার্যমহ যুগ পর্যন্তও কেহ আছেন কি যিনি এরূপ বলিতে পারেন- ‘আমি এই পঞ্চধর্ম ...... প্রকাশ করিতেছি’?”
“না, ভো গৌতম!”
“মাণব! যাহারা মন্ত্র (বেদ) সমূহের কর্তা, মন্ত্রের প্রবক্তা (অধ্যাপক) ব্রাহ্মণদের পূর্বজ ঋষিরা ছিলেন, যাহাদের গীত (গায়িত), সঙ্গীত, প্রোক্ত রাশিকৃত পুরাতন মন্ত্রপদ (বেদ-বাক্য) আজও ব্রাহ্মণগণ তদনুসারে গান করেন, তদনুসারে ভাষণ করেন, (ঋষিদের) ভাষণের অনুভাষণ করেন, বাচনের অনুবাচন করেন; (সেই পূর্বজ ঋষি) যথা- অষ্টক, বামক, বামদেব, বিশ্বামিত্র, যমদগ্নি, অঙ্গিরা, ভারদ্বাজ, বাশিষ্ঠ, কশ্যপ ও ভৃগু। কেমন, উহারা এরূপ বলিয়াছেন,- ‘আমরা এই পঞ্চধর্ম স্বয়ং অভিজ্ঞাদ্বারা প্রত্যক্ষ করিয়া ইহাদের বিপাক প্রকাশ করিতেছি’?”
“না, হে গৌতম!”
“এই প্রকারে, মাণব! ব্রাহ্মণদের কোন একজনও নাই যিনি ইহা কহিতে পারেন- আমি ...... প্রত্যক্ষ করিয়া ইহাদের বিপাক প্রকাশ করিতেছি। ব্রাহ্মণদের ...... সাতপুরুষ আচার্যমহ যুগ পর্যন্তও নাই ......। ব্রাহ্মণদের পূর্বজ ঋষিরা ...... ও বলেন নাই- আমরা ...... প্রত্যক্ষ করিয়া ইহাদের বিপাক প্রকাশ করিতেছি?
“না, ভো গৌতম!”
“যেমন মাণব! পরম্পরা সংসক্ত অন্ধপ্রবেণি, পূর্বজনও দেখে না, মধ্য জনও দেখে না; পরের জনও দেখে না; এইরূপেই মাণব! ব্রাহ্মণ-দেব ভাষণ অন্ধ প্রবেণিতে পরিণত হইল, মনে হয়।- পূর্ববর্তীও দেখে না, মধ্যবর্তীও দেখে না, পরবর্তীও দেখিতে পায় না।”
৪৬৬। এইরূপ উক্ত হইলে তোদেয়পুত্র শুভমাণব ভগবান কর্তৃক পরম্পরা সংসক্ত অন্ধপ্রবেণি উপমা কথিত হওয়ায় কোপিত ও অসন্তুষ্ট-চিত্ত হইয়া ভগবানকেই তিরস্কারেচ্ছায়, ভগবানকেই অপ্রতিভ করিবার অভিলাষে, ভগবানকেই বলিতে গিয়া ‘শ্রমণ গৌতম অজ্ঞভাব প্রাপ্ত হইবেন’ ভাবিয়া ভগবানকে কহিলেন,- ভো গৌতম! সুভগ বণিক (সুভগবনবাসী) উপমণ্য গোত্রীয় পোক্খরসাতি ব্রাহ্মণ এরূপ বলেন- ‘যে সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণ মনুষ্যধর্ম হইতে উত্তরিতর (লোকোত্তর) উত্তম, অলম্ (বিশুদ্ধ) আর্য-জ্ঞানদর্শন বিশেষকে এভাবে অঙ্গীকার করেন, তাহাদের সেই ভাষণ হাস্যকর প্রমাণিত হয়, নামমাত্রে পর্যবসিত হয়, রিক্ত ও তুচ্ছ প্রতিপন্ন হয়। কি প্রকারে সম্ভব মনুষ্যভূত অবস্থায় মনুষ্যোত্তর ধর্ম অলম্ আর্য-জ্ঞানদর্শন বিশেষ জানিবে, দেখিবে কিংবা প্রত্যক্ষ করিবে? ইহা কখনও সম্ভব নহে।”
“কেমন, মাণব! ...... পোক্খরসাতি ব্রাহ্মণ স্বীয় চিত্তদ্বারা সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণেরই চিত্ত পরিজ্ঞাত হইয়া জানেন কি?”
“ভো গৌতম! নিজের দাসী পূর্ণিকার অন্তঃকরণও সুভগবণিক উপমণ্যব পোক্খরসাতি ব্রাহ্মণ স্বচিত্তদ্বারা জানিতে পারেন না; কোথায় সমগ্র ব্রাহ্মণদের অন্তঃকরণ চিত্তদ্বারা পরিজ্ঞাত হইয়া জানিতে পারিবেন?”
“যেমন মাণব! কোন জন্মান্ধ পুরুষ কৃষ্ণ-শুক্ল রূপ (বর্ণ) দেখে না, নীল ........... , পীত ........... , লোহিত ও মঞ্জিঠরূপ দেখে না, সম-বিষমরূপ (ভূমিভাগ) নক্ষত্র-রূপ দেখে না, চন্দ্র-সূর্যকে দেখিতে পায় না; অথচ সে এ প্রকার বলে- কৃষ্ণ-শুক্লরূপ নাই, ‘কৃষ্ণ-শুক্লরূপের দর্শক নাই ...... চন্দ্র-সূর্য নাই, চন্দ্র-সূর্যের দ্রষ্টাও নাই। আমি উহাদিগকে জানিনা, আমি উহাদিগকে দেখিনা। সুতরাং উহারা নাই।’ মাণব! এইরূপ বলিলে সে কি যথার্থ বলিবে?”
“ইহা নিশ্চয় না, ভো গৌতম! কৃষ্ণ-শুক্লরূপ আছে, ...... , চন্দ্র-সূর্য আছে, চন্দ্র-সূর্যের দ্রষ্টাও আছেন। ‘আমি ইহাদিগকে জানিনা, দেখিনা! সুতরাং (ইহারা) নাই।’ এ প্রকার বলিলে সে যুক্তি-সঙ্গত বলিবে না।”
“এইরূপই মাণব! ...... পোক্খরসাতি ব্রাহ্মণ অন্ধ, জ্ঞানচক্ষুহীন, সে যথার্থ উত্তরি-মনুষ্যধর্ম অলম্ আর্য-জ্ঞানদর্শন জানিবে, দেখিবে কিংবা প্রত্যক্ষ করিবে; ইহা কখনও সম্ভব নহে।”
৪৬৭। “তাহা কি মনে কর, মাণব! যে সকল কোশলবাসী ব্রাহ্মণ-মহাশাল আছে, যথা- চঙ্কী ব্রাহ্মণ, তারুক্ষ ব্রাহ্মণ, পোক্খরসাতি ব্রাহ্মণ, জানুশ্রোণি ব্রাহ্মণ আর তোমার পিতা তোদেয়। তাহাদের কোন্ বাক্য শ্রেয়ঃ? তাহারা সংবৃতি (লোকব্যবহার) অনুসারে যাহা বলেন কিংবা যাহা সংবৃতি- বিরুদ্ধ বলেন?”
“হে গৌতম! সংবৃতি অনুসারে যাহা বলেন।”
“তাহাদের কোন্ বাক্য শ্রেয়ঃ- তাহারা মন্ত্রণা (তুলনা) করিয়া যে বাক্য বলেন কিংবা মন্ত্রণা না করিয়া যাহা বলেন?”
“মন্ত্রণা অনুসারে ...... ভো গৌতম!”
“ ...... তাহারা জানিয়া (প্রতিসংখ্যায়) যে বাক্য বলেন কিংবা না জানিয়া যে বাক্য বলেন?”
“জানিয়া, ভো গৌতম!”
“ ...... তাহারা যুক্তি-সঙ্গত যে বাক্য বলেন অথবা যুক্তিহীন যে বাক্য বলেন?”
“যুক্তি-সঙ্গত, ভো গৌতম!”
“তাহা কি মনেকর, মাণব! যদি এরূপ হয় তবে ...... পোক্খরসাতি ব্রাহ্মণ সংবৃতি অনুসারে বাক্য বলিয়াছেন কিংবা সংবৃতি বিরুদ্ধ?”
“সংবৃতি বিরুদ্ধ, ভো গৌতম!”
“ ...... মন্ত্রণা অনুসারে কিংবা মন্ত্রণা বিরুদ্ধ?”
“মন্ত্রণা বিরুদ্ধ, ...... !”
“ ...... জানিয়া কিংবা না জানিয়া?”
“না জানিয়া, ...... !”
“যুক্তি-সঙ্গত কিংবা যুক্তিহীন?”
“যুক্তিহীন, ...... !”
“মাণব! এই পঞ্চ নীবরণ (আবরণ)। কোন্ পঞ্চ? (১) কামচ্ছন্দ (বিষয়ানুরাগ) নীবরণ, (২) ব্যাপাদ (বিদ্বেষ) নীবরণ, (৩) থিন-মিদ্ধ (তন্দ্রালস্য) নীবরণ, (৪) ঔদ্ধত্য-কৌকৃত্য (উদ্ধতভাব ও কুকর্মানুশোচনা) নীবরণ ও (৫) বিচিকিৎসা (সংশয়) নীবরণ। মাণব! এই পঞ্চ নীবরণ আছে। মাণব! পোক্খরসাতি ব্রাহ্মণ এই নীবরণে আবরিত, আচ্ছন্ন, অবরুদ্ধ, পরিবেষ্টিত (চতুর্দিকে আবরিত)। সুতরাং সে উত্তরি-মনুষ্যধর্ম অলম্ আর্য-জ্ঞানদর্শন বিশেষ জানিবে, দেখিবে কিংবা প্রত্যক্ষ করিবে; ইহা কখনও সম্ভব নহে।
৪৬৮। মাণব! এই পঞ্চ কামগুণ (কাম-বন্ধন), কোন্ পঞ্চ? (১) ইষ্ট-কান্ত, মনোজ্ঞ, প্রিয়-রূপ, কাম-সংযুক্ত, রঞ্জনীয় চক্ষু-বিজ্ঞেয় রূপ, (২) ...... শ্রোত্র-বিজ্ঞেয় শব্দ, (৩) ...... ঘ্রাণ-বিজ্ঞেয় গন্ধ। (৪) ...... জিহ্বা-বিজ্ঞেয় রস, (৫) ...... কায়-বিজ্ঞেয় স্পৃষ্টব্য। মাণব! এই পঞ্চ-কামগুণ। ...... পোক্খরসাতি ব্রাহ্মণ এই পঞ্চ কামগুণ দ্বারা গ্রথিত; মূর্চ্ছিত, অধ্যাপন্ন (বিপন্ন) অদোষদর্শী;- নিঃসারণবুদ্ধি না রাখিয়াই- পরিভোগ করিতেছে; সুতরাং সে উত্তরি-মনুষ্য-ধর্ম অলম্ আর্য-জ্ঞানদর্শন বিশেষ জানিবে, দেখিবে কিংবা প্রত্যক্ষ করিবে; ইহা কখনও সম্ভব নহে।
তাহা কি মনে কর, মাণব! তৃণ-কাষ্ঠ অবলম্বন করিয়া যে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়, আর তৃণ-কাষ্ঠ উপাদান বিনা যে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়; উভয়ের কোন্ অগ্নি অধিক অর্চিমান, বর্ণবান ও প্রভাস্বর হইবে?”
“যদি ভো গৌতম! তৃণ-কাষ্ঠ উপাদান বিনা অগ্নি প্রজ্জ্বালন সম্ভব হয়, তবে সেই অগ্নিই হইবে অধিকতর অর্চিমান, বর্ণবান ও প্রভাস্বর।”
“মাণব! ইহা অসম্ভব, ইহার অবকাশ নাই যে ঋদ্ধিমান ব্যতীত তৃণ-কাষ্ঠ উপাদানাহীন অগ্নি অন্য কেহ জ্বালিতে পারে। যেমন মাণব! তৃণ-কাষ্ঠ ইন্ধন আশ্রয় করিয়া অগ্নি জ্বলে; যেই প্রীতি পঞ্চ কামগুণকে অবলম্বন করিয়া উৎপন্ন হয়, সেই প্রীতিকে আমি তাদৃশ বলি। যেমন মাণব! তৃণ-কাষ্ঠ উপাদান আশ্রয় ব্যতীত অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়; মাণব! আমি সেই প্রীতিকে তৎসদৃশ বলি, যেই প্রীতি কাম্য-বস্তুর অবলম্বন বিনা, অকুশল ধর্মের সহায়তা বিনা উৎপন্ন হয়।
মাণব! কোন্ প্রকার প্রীতি কাম্য-বস্তুর আশ্রয় ব্যতীত, অকুশল ধর্মের সহায়তা ভিন্ন উৎপন্ন হয়?- এক্ষেত্রে মাণব! কাম হইতে বিবিক্ত হইয়া ...... প্রথম ধ্যান লাভ করিয়া বিহার করেন। মাণব! এই ধ্যানজ প্রীতিও কাম্য-বস্তুর সংশ্রব ব্যতীত, অকুশল ধর্মের সহায়তা ভিন্ন উৎপন্ন হয়। পুনশ্চ মাণব! ভিক্ষু বিতর্ক-বিচারের উপশম হেতু ...... দ্বিতীয় ধ্যান লাভ করিয়া বিহার করেন। মাণব! এই প্রীতিও কাম ও অকুশল ধর্মের সহায়তা ব্যতীত উৎপন্ন হয় ।
৪৬৯। মাণব! পুণ্য-সম্পাদনের ও কুশল আরাধনার নিমিত্ত ব্রাহ্মণেরা যেই পঞ্চধর্ম প্রজ্ঞাপন করেন; উহাদের কোন্ ধর্মকে তাহারা পুণ্য-ক্রিয়ার তথা কুশল আরাধনার নিমিত্ত সর্বাপেক্ষা মহাফলপ্রদ বলিয়া থাকেন?”
“ভো গৌতম! ...... যে পঞ্চধর্ম ব্রাহ্মণেরা প্রজ্ঞাপন করেন, তন্মধ্যে ত্যাগধর্মকেই তাঁহারা ...... সর্বাপেক্ষা অধিক ফলপ্রদ বলেন।”
“তাহা কি মনে কর, মাণব! এখানে কোন ব্রাহ্মণের গৃহে মহাযজ্ঞ উপস্থিত হইল। ‘অমুক ব্রাহ্মণের মহাযজ্ঞ উপভোগ করিব’ এই ভাবিয়া তখন দুইজন ব্রাহ্মণ আসিলেন, তন্মধ্যে একজনের এরূপ চিন্তা হইল- ‘ভোজন-শালায় (ভত্তগ্গে) প্রথম আসন প্রথম জন তথা প্রথম পিণ্ড আমি পাইতে চাই, অন্য ব্রাহ্মণেরা ভোজন-শালায় অগ্র আসন, জল ও পিণ্ড পাইবে না।’ দৈবাৎ এমন কারণ ঘটিল, মাণব! অপর ব্রাহ্মণই.... প্রথম পিণ্ড পাইল, আর সে-ই ব্রাহ্মণ পাইল না....। তখন ‘আমার প্রথম পিণ্ড লাভ হইল না’ (এই ধারণায়) সে কোপিত হইল, অসন্তুষ্ট হইল। মাণব! ব্রাহ্মণেরা ইহার কি ফল প্রকাশ করেন?”
“ভো গৌতম! এতদ্বারা কেহ কোপিত, অসন্তুষ্ট হউক, এক্ষেত্রে ব্রাহ্মণেরা এরূপ দান কখনও করেন না। কিন্তু এ অবস্থায় অনুকম্পাবশতঃই (অনুকম্পা জাতিক) দান দিয়া থাকেন।”
তাহা হইলে মাণব! ব্রাহ্মণদের জন্য এই অনুকম্পা স্বভাব (অনুগ্রহ বুদ্ধি) ষষ্ঠ পুণ্যক্রিয়া বস্তু হয়।”
“এইরূপ হইলে, ভো গৌতম! ...... এই অনুকম্পা স্বভাব ষষ্ঠ পুণ্য-ক্রিয়া বস্তু হয়।” (সুতরাং পঞ্চবিধ পুণ্যক্রিয়া বস্তু ইহা একান্ত ঠিক নহে।)
“মাণব! পুণ্য-সম্পাদন ও কুশল আরাধনার্থ ব্রাহ্মণেরা পঞ্চধর্ম প্রকাশ করেন, এই পঞ্চধর্ম কাহাদের মধ্যে অধিক দেখা যায়- গৃহস্থদের কিংবা প্রব্রজিতদের মধ্যে?”
“ ...... ভো গৌতম! ...... যে পঞ্চধর্ম ব্রাহ্মণেরা প্রজ্ঞাপন করেন, সেই পঞ্চধর্ম প্রব্রজিতদের মধ্যে অধিক দেখিতে পাই, গৃহস্থদের মধ্যে স্বল্পতর। ভো গৌতম! ...... গৃহস্থ মহার্থ, মহাকৃত্য, মহাধিকরণ, মহা সমারম্ভযুক্ত। সুতরাং সদাসর্বদা সত্যবাদী হইতে পারে না। ......প্রব্রজিত জীবন অল্পার্থ, অল্পকৃত্য, অল্পাধিকরণ, অল্প সমারম্ভযুক্ত। সুতরাং সদাসর্বদা সত্যবাদী হইতে সমর্থ। গৃহস্থ ...... মহা সমারম্ভযুক্ত। সুতরাং সতত নিরন্তর তপস্বী হইতে সমর্থ হয় না ...... , ব্রহ্মচারী হইতে সমর্থ হয় না ...... , স্বাধ্যায়-বহুল হইতে পারে না। অপর পক্ষে ...... প্রব্রজিত জীবন ...... অল্প সমারম্ভযুক্ত হয়; সুতরাং সদাসর্বদা স্বাধ্যায়-বহুল হইতে পারেন। পুণ্য-ক্রিয়া ও কুশল আরাধনার নিমিত্ত ব্রাহ্মণেরা যেই পঞ্চধর্ম প্রজ্ঞাপন করেন, আমি সেই পঞ্চধর্ম প্রব্রজিতদের মধ্যে অধিক দেখিতে পাই, গৃহস্থদের মধ্যে স্বল্পতর।”
“মাণব! পুণ্যের সম্পাদন ও কুশলের আরাধনার নিমিত্ত ব্রাহ্মণেরা যে পঞ্চধর্ম প্রজ্ঞাপন করেন, উহাদিগকে আমি বৈর-রহিত, হিংসা-রহিত মৈত্রী-চিত্ত সমপ্রসারণের নিমিত্ত পরিবার বা সহায়ক বলি।
এক্ষেত্রে মাণব! কোন ভিক্ষু সত্যবাদী হয়, ‘আমি সত্যবাদী হইয়াছি,’ সে এই ধর্ম-বেদ (জ্ঞান) লাভ করে, অর্থ-বেদ লাভ করে, আর ধর্ম-সংযুক্ত প্রামোদ্য লাভ করে। যাহা কুশল সম্পর্কিত প্রামোদ্য, উহাকে আমি বৈর-রহিত, ব্যাপাদ-রহিত সেই মৈত্রী-চিত্তের সমপ্রসারণে পরিবার বলি, ......।” [তপশ্চর্যা, ব্রহ্মচর্য, স্বাধ্যায়-বহুল, ত্যাগ-বহুল; এই ধর্ম সমূহের সমন্বয় এরূপে বর্ণনীয়।]
৪৭০। এরূপ কথিত হইলে শুভমাণব ভগবানকে কহিলেন,- “ভো গৌতম! ইহা শুনা যায় যে শ্রমণ গৌতম ব্রহ্মাগণের সহব্যতার (সারূপ্যের) মার্গ উপদেশ করেন?”
“তাহা কি মনে কর, মাণব! নলকার গ্রাম এস্থান হইতে সমীপে, এস্থান হইতে দূরে নহে?”
“হাঁ, ভো গৌতম! নলকার গ্রাম হইতে সমীপে, দূরে নহে।”
“তবে কি মনে কর, মাণব! এস্থানে- এই নলকার গ্রামে কোন পুরুষ যদি জাত ও বর্ধিত হয়; নলকার গ্রাম হইতে সদ্য-নিষ্ক্রান্ত সেই পুরুষকে (কেহ) নলকার গ্রামের মার্গ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে, তবে মাণব! সেই গ্রামে জাত ও বর্ধিত পুরুষের দ্বিধা কিংবা স্তব্ধ-ভাব হইকে কি?”
“নিশ্চয় না, ভো গৌতম!”
“তার কারণ কি?”
“ভো গৌতম! সে পুরুষ নলকার গ্রামে জাত ও বর্ধিত। সুতরাং নলকার গ্রামের সমস্ত মার্গই তাহার সুবিদিত।”
“ব্রাহ্মণ! নলকার গ্রামে জাত ও বর্ধিত পুরুষের- ঐ গ্রামের মার্গ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হইলে- ক্বচিৎ দ্বিধা ও স্তব্ধ-ভাব হইতে পারে; কিন্তু ব্রহ্ম-লোক বা ব্রহ্মলোকগামী প্রতিপদা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হইলে- তথাগতের কখনও দ্বিধাভাব কিংবা স্তব্ধতা হইবে না। মাণব! আমি ব্রহ্মাদিগকে জানি, ব্রহ্মলোক জানি, আর ব্রহ্মলোকগামী প্রতিপদা জানি, যেরূপে প্রতিপন্ন হইয়া ব্রহ্মারা ব্রহ্মলোকে উৎপন্ন হইয়াছে তাহাও আমি প্রকৃষ্টরূপে অবগত আছি।”
“ভো গৌতম! আমি শুনিয়াছি- শ্রমণ গৌতম ব্রহ্মাগণের সহব্যতার মার্গ দেশনা করেন; সাধু, ভবৎ গৌতম আমাকে ব্রহ্মাগণের সহব্যতার মার্গ উপদেশ করুন।”
“তাহা হইলে, মাণব! শুন, উত্তমরূপে মনোযোগ রাখ, কহিতেছি।”
“হাঁ, ভো! (বলিয়া) শুভমাণব ভগবানকে প্রত্যুত্তর দিলেন।
৪৭১। ভগবান ইহা কহিলেন,- “মাণব! ব্রহ্ম সহব্যতার মার্গ কি?- এক্ষেত্রে মাণব! ভিক্ষু মৈত্রীপূর্ণ চিত্তে একদিক প্রসারিত করিয়া বিহার করে তথা দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ, এই প্রকারে ঊর্ধ, অধঃ, পার্শ্ব বা অনুদিক, সর্বত্র, সমগ্র আত্মবৎ চিন্তায় সর্ব প্রাণীময় বিশ্বে বৈর-রহিত, বিদ্বেষ-রহিত, বিপুল, মহদ্গত, অপ্রমাণ মৈত্রী সমন্বিত চিত্ত প্রসারিত করিয়া বিহার করে। মাণব! এই প্রকারে ভাবিত মৈত্রী চিত্তবিমুক্তি দ্বারা প্রমাণকৃত যে ভাবনাময় কর্ম হয়, সে (কামাবচর) কর্ম রূপাবচর কর্মে স্বীয় অবকাশ করিতে পারে না, সে কর্ম তথায় প্রতিষ্ঠিত থাকে না । যেমন মাণব! শঙ্খধম (শঙ্খবাদক) অল্পায়াসেই চতুর্দিকে বিঘোষিত করে, সেইরূপ মাণব! এই প্রকারে ভাবিত মৈত্রী চিত্তবিমুক্তি দ্বারা যে প্রমাণকৃত কর্ম সম্পাদিত হয়, তাহা তথায় (ফলদানের) অবসর পায় না, তাহা তথায় প্রতিষ্ঠিত থাকে না, মাণব! এই মৈত্রীও ব্রহ্ম-সহব্যতার মার্গ।
পুনরায় মাণব! ভিক্ষু করুণা (পরের দুঃখ মোচন-প্রেরণা) সহগত চিত্তদ্বারা ......, মুদিতা (পরের উন্নতি-অনুমোদন) সংযুক্ত চিত্তদ্বারা ......, উপেক্ষা (সমদর্শন) সংযুক্ত চিত্তদ্বারা সর্বত্র, সমগ্র আত্মবৎ চিন্তায়, সত্ব-সমন্বিত বিশ্ব পরিব্যাপ্ত করিয়া বিহার করে। মাণব! এই প্রকারে ভাবিত উপেক্ষা চিত্তবিমুক্তি দ্বারা যে প্রমাণকৃত কর্ম সম্পাদিত হয়, উহা তথায় সংলগ্ন হয় না, উহা তথায় প্রতিষ্ঠিত থাকে না। হে মাণব! এই উপেক্ষাও ব্রহ্ম সহব্যতার মার্গ।”
৪৭২। এইরূপ উক্ত হইলে তোদেয় পুত্র শুভমাণব ভগবানকে ইহা করিলেন,- “আশ্চর্য, ভো গৌতম! আশ্চর্য, ভো গৌতম! যেমন অধঃমুখকে ঊর্ধমুখ করা হয়, ......। সুতরাং আমি ধর্ম ও ভিক্ষুসংঘের সহিত মহামান্য ভগবানের শরণ গ্রহণ করিতেছি। প্রভু গৌতম! আজ হইতে আমাকে অঞ্জলিবদ্ধ শরণাগত উপাসকরূপে স্বীকার করুন। ভো গৌতম! এখন যাই, আমাদের বহুকৃত্য, বহু করণীয়।”
“মাণব! তুমি এখন যাহা সময়োচিত মনে কর, তাহা করিতে পার।”
তখন ...... শুভমাণব ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন ও অনুমোদন করিয়া আসন হইতে উঠিয়া ভগবানকে অভিবাদন ও প্রদক্ষিণ করিয়া প্রস্থান করিলেন।
সেই সময় জাণুশ্রোণি ব্রাহ্মণ দিবা-দ্বিপ্রহরে সর্বশ্বেত বর্ণের অশ্বরথে আরোহণ করিয়া শ্রাবস্তী হইতে বাহিরে যাইতেছেন। জাণুশ্রোণি ব্রাহ্মণ ...... শুভমাণবকে দূর হইতে আসিতে দেখিলেন এবং শুভ মাণবকে কহিলেন,- “হন্দ, মাননীয় ভারদ্বাজ! দিবা-দ্বিপ্রহরে কোথা হইতে আসিতেছেন?”
“এই এখান হইতেই, ভো! আমি শ্রমণ গৌতমের নিকট হইতে আসিতেছি।”
“মাননীয় ভারদ্বাজ! শ্রমণ গৌতমের প্রজ্ঞা-ব্যক্ততা সম্বন্ধে কেমন মনে করেন, তাঁহাকে পণ্ডিত মনে হয়?”
“ওহে মহাশয়! আমি কে, আর শ্রমণ গৌতমের প্রজ্ঞা-ব্যক্ততার বিষয় জানিতে পারি, কি সাধ্য আমার? যিনি শ্রমণ গৌতমের প্রজ্ঞা-ব্যক্ততার সম্বন্ধে জানেন, তিনিও তাদৃশ হইবেন, নহে কি?”
“মাননীয় ভারদ্বাজ! কিন্তু শ্রমণ গৌতমকে উদার প্রশংসায় প্রশংসা করিতেছেন।”
“মহাশয়! আমি কে, আর শ্রমণ গৌতমকে প্রশংসা করিব, আমার কি সাধ্য? প্রভু গৌতম প্রশংসিত অপেক্ষা প্রশংসিতই, তিনি দেব-মানবের শ্রেষ্ঠ হন। মহাশয়! ব্রাহ্মণেরা পুণ্য সম্পাদনের জন্য ও কুশল আরাধনার জন্য যে পঞ্চধর্ম প্রজ্ঞাপন করেন, শ্রমণ গৌতম উহাদিগকে বৈরীহীন, বিদ্বেষহীন মৈত্রীচিত্তের ভাবনায় পরিবার বা সহায়ক বলেন।”
এইরূপ কথিত হইলে জাণুশ্রোণি ব্রাহ্মণ সর্বশ্বেত অশ্বরথ হইতে অবতরণ করিয়া, উত্তরাসঙ্গ একাংস করিয়া, যে দিকে শ্রমণ গৌতম আছেন, সেদিকে যুক্তাঞ্জলি প্রণাম করিয়া উদান (উল্লাসধ্বনি) উচ্চারণ করিলেন,- “রাজা পসেনদি কোশলের একান্তই সৌভাগ্য, যাহার রাজ্যে তথাগত অর্হৎ সম্যক্সম্বুদ্ধ বিহার করিতেছেন। রাজা পসেনদি কোশলের মহালাভ সুলব্ধ হইয়াছে।”
॥ শুভ সূত্র সমাপ্ত ॥
(বুদ্ধ জীবনী- তপশ্চর্যা)
৪৭৩। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-
এক সময় ভগবান মহা ভিক্ষুসংঘের সহিত কোশল জনপদে চারিকায় (ধর্ম-প্রচারার্থ) বিচরণ করিতেছেন। সেই সময় মণ্ডলকল্প গ্রামে বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের প্রতি অভিপ্রসন্না (শ্রদ্ধাবতী) ধনঞ্জানী নামিকা ব্রাহ্মণী বাস করিতেন। এক সময় ধনঞ্জানী ব্রাহ্মণী অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রক্ষালন করিয়া তিনবার উদান উচ্চারণ করিলেন, -
“নমো তস্স ভগবতো অরহতো সম্মাসম্বুদ্ধস্স।” (৩)
“সেই ভগবান অর্হৎ সম্যক্সম্বুদ্ধকে নমস্কার।”
সেই সময় মণ্ডলকল্পে সঙ্গারব নামক মাণব (তরুণ ব্রাহ্মণ পণ্ডিত) বাস করিতেন। তিনি পঞ্চম ইতিহাস ও চতুর্থ নিঘণ্টু-কেটুভ-অক্ষর-প্রভেদ সহ ত্রিবেদের পারদর্শী, পদজ্ঞ, বৈয়াকরণ, লোকায়ত তথা মহাপুরুষ লক্ষণ-শাস্ত্রে সুনিপুণ ছিলেন। সঙ্গারব মাণব ধনঞ্জানী ব্রাহ্মণীর উক্ত উদানবাণী উচ্চারণ করিতে শুনিলেন এবং ধনঞ্জানী ব্রাহ্মণীকে কহিলেন,- “অমঙ্গলা এই ধনঞ্জানী ব্রাহ্মণী, পরাভূতা (বিনষ্টা); এই ধনঞ্জানী ব্রাহ্মণী ত্রিবিদ্যায় পারদর্শী ব্রাহ্মণেরা বিদ্যমান থাকিতে সেই মুণ্ডক শ্রমণকের প্রশংসা ভাষণ করিতেছে।”
“বৎস ভদ্রমুখ! তুমি সেই ভগবানের শীল ও প্রজ্ঞা সম্বন্ধে কিছু জান না। যদি তাত ভদ্রমুখ! তুমি সেই ভগবানের শীল-প্রজ্ঞা সম্বন্ধে জানিতে পার, তবে তুমি সেই ভগবানকে আক্রোশের যোগ্য ও পরিভাষের যোগ্য মনে করিতে না।”
“তাহা হইলে ভবতি! যখন শ্রমণ গৌতম মণ্ডলকল্পে আগমন করেন, তখন আমাকে জানাইবেন।”
“বেশ, ভদ্রমুখ!” (বলিয়া) ধনঞ্জানী ব্রাহ্মণী সঙ্গারব মাণবকে প্রতিশ্রুতি দিলেন।”
অতঃপর ভগবান কোশল জনপদে ক্রমান্বয়ে চারিকার্থ পরিক্রমা করিয়া মণ্ডলকল্পের দিকে অগ্রসর হইলেন। তথায় মণ্ডলকল্পে ভগবান তোদেয় ব্রাহ্মণদের আম্রবনে বিহার করিতেছেন। ধনঞ্জানী ব্রাহ্মণী শুনিলেন যে ভগবান মণ্ডলকল্পে উপনীত হইয়াছেন; আর ...... তোদেয় ব্রাহ্মণদের আম্রবনে বিহার করিতেছেন। তখন ধনঞ্জানী ব্রাহ্মণী যেখানে সঙ্গারব মাণব থাকেন, সেখানে গেলেন এবং সঙ্গারব মাণবকে কহিলেন,- “তাত ভদ্রমুখ! সেই ভগবান মণ্ডলকল্পে উপনীত হইয়াছেন, আর ...... তোদেয় ব্রাহ্মণদের আম্রবনে বিহার করিতেছেন। এখন বৎস ভদ্রমুখ! তুমি যাহা সময়োচিত মনে কর, (তাহাই-কর)।”
৪৭৪। “হাঁ, ভবতি!” (বলিয়া) সঙ্গারব মাণব ধনঞ্জানী ব্রাহ্মণীকে প্রত্যুত্তর দিয়া যেখানে ভগবান আছেন সেখানে গেলেন, তথায় গিয়া ভগবানের সহিত সম্মোদন করিয়া একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে বসিয়া সঙ্গারব মাণব ভগবানকে কহিলেন,- “ভো গৌতম! কোন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণ দৃষ্টধর্ম অভিজ্ঞাবসান প্রাপ্ত (ইহ জীবনে অভিজ্ঞাদ্বারা সর্ব কর্তব্য অবসানরূপ পরম নির্বান প্রাপ্ত) হইয়া ব্রহ্মচর্যের (ধর্মের) আদি আবিষ্কারকরূপে আপনাদিগকে ঘোষণা করেন। তথায় ভো গৌতম! যে সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণ দৃষ্টধর্মে অভিজ্ঞাবসান পারমী প্রাপ্ত হইয়া ব্রহ্মচর্যের আমি আবিষ্কারক বলিয়া দাবী করেন, তাঁহাদের মধ্যে আপনি কে হন?”
“ভারদ্বাজ! দৃষ্টধর্মে অভিজ্ঞাবসান পারমী প্রাপ্ত হইয়া যাঁহারা ব্রহ্মচর্যের আদি আবিষ্কারক বলিয়া ঘোষণা করেন, তাঁহাদের মধ্যেও আমি ভিন্ন মত পোষণ করি। (১) ভারদ্বাজ! কোন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণেরা আছেন অনুশ্রাবিকা (শ্রুতি অনুসারী), তাঁহারা অনুশ্রবণ দ্বারা দৃষ্টধর্ম অভিজ্ঞাবসান পারমী প্রাপ্ত হইয়া ব্রহ্মচর্যের আদি আবিষ্কারক বলে ঘোষণা করেন; যেমন ত্রৈবিদ্য (ত্রিবেদের অধিকারী) ব্রাহ্মণেরা। (২) ভারদ্বাজ! কোন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণেরা আছেন তাঁহারা কেবল শ্রদ্ধার প্রভাবে দৃষ্টধর্ম অভিজ্ঞাবসান পারমী প্রাপ্ত হইয়া ব্রহ্মচর্যের আদি আবিষ্কারক বলে ঘোষণা করেন; যেমন তার্কিক ও মীমাংসকগণ। (৩) ভারদ্বাজ! কোন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ আছেন, যাঁহারা পূর্বে অননুশ্রুত ধর্ম বিষয়ে স্বয়ংই ধর্ম অভিজ্ঞাত হইয়া দৃষ্টধর্মে অভিজ্ঞাবসান পারমী প্রাপ্ত ব্রহ্মচর্যের আদি আবিষ্কারক বলিয়া ঘোষণা করেন। তাঁহাদের মধ্যে, ভারদ্বাজ! অননুশ্রুত ধর্ম সম্বন্ধে স্বয়ংই ধর্ম অভিজ্ঞাত হইয়া দৃষ্টধর্ম অভিজ্ঞাবসান পারমী প্রাপ্ত হইয়া ব্রহ্মচর্যের আদি আবিষ্কারক বলে আপনাদিগকে ঘোষণা করেন, সেই সকল সম্যক্সম্বুদ্ধের মধ্যে আমিও অন্যতর হই; সুতরাং এই পর্যায়ে ভারদ্বাজ! ইহা তোমার জানা উচিত, যে সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণ পূর্বে অননুশ্রুত ধর্ম বিষয়ে স্বয়ংই ধর্ম অভিজ্ঞাত হইয়া দৃষ্টধর্মে অভিজ্ঞাবসান পারমী প্রাপ্ত হইয়া ব্রহ্মচর্যের আদি আবিষ্কারক বলে ঘোষণা করেন, আমিও তাঁহাদের মধ্যে অন্যতর হই।
৪৭৫-৪৮৪। এক্ষেত্রে, ভারদ্বাজ! আমার সম্বোধি লাভের পূর্বেই অনভিসম্বুদ্ধ ও বোধিসত্ব অবস্থায়- এই ধারণা জন্মিয়াছিল- ‘গৃহবাস সম্বাধ, রজঃমার্গ; প্রব্রজ্যা উন্মুক্ত অবকাশ। এই একান্ত পরিপূর্ণ, একান্ত পরিশুদ্ধ, শঙ্খলিখিত (শঙ্খসন্নিভ উজ্জ্বল) ব্রহ্মচর্য আচরণ করা গৃহীদের পক্ষে সুকর নহে। সাধু, আমি কেশ-শ্মশ্রু-মুণ্ডন করিয়া কাষায় বস্ত্র পরিহিত হইয়া আগার হইতে অনাগারিকরূপে প্রব্রজিত হইব।’ ভারদ্বাজ! সেই আমি অপর সময়ে তরুণ অবস্থায় শিশু-কালকেশ, সুন্দর যৌবন সম্পন্ন প্রথম বয়সে অনিচ্ছুক মাতা-পিতার অশ্রুমুখে রোদনকে উপেক্ষা করিয়া কেশ-শ্মশ্রু-মুণ্ডন পূর্বক কাষায় বস্ত্রে দেহ আচ্ছাদন করিয়া আগার হইতে অনাগারিকরূপে প্রব্রজিত হই।
এই প্রকারে প্রব্রজিত হইয়া ‘কুশল কি’ সন্ধানীরূপে অনুত্তর শান্তিবর পদ অন্বেষণ করিবার সময় যেখানে আলাড়-কালাম ছিলেন, সেস্থানে উপনীত হই এবং আলাড়-কালামকে কহিলাম,- “আবুসো (বন্ধু) কালাম! আমি এই ধর্ম-বিনয়ে ব্রহ্মচর্য আচরণ করিতে ইচ্ছা করি।’ এরূপ কথিত হইলে, ভারদ্বাজ! আলাড়-কালাম আমাকে কহিলেন,- ‘আয়ুষ্মান! অবস্থান করুন।’ ...... ভারদ্বাজ! রাত্রির পশ্চিম যামে আমার এই তৃতীয় বিদ্যা অধিগত হইল, অবিদ্যা বিহত ও বিদ্যা উৎপন্ন হইল; তমঃ বিনষ্ট হইল, আলোক উৎপন্ন হইল।”
৪৮৫। ইহা কথিত হইলে সঙ্গারব মানব ভগবানকে কহিলেন,- “অহো! নিশ্চয় ভবৎ গৌতমের অস্থিত-প্রধান (অনন্যসাধারণ উদ্যম) ছিল। অহো! নিশ্চয় ভবৎ গৌতমের সৎপুরুষ-প্রধান ছিল; যেরূপ অর্হৎ সম্যক্সম্বুদ্ধের থাকা সম্ভব। কেমন, ভো গৌতম! (উৎপত্তি) দেবতা আছেন কি?”
“অবশ্যই ভারদ্বাজ! তাহা আমার বিদিত যে অধিদেব আছেন।”
“কেমন, হে গৌতম! দেবতা আছেন কি?- জিজ্ঞাসিত হইয়া, ‘ভারদ্বাজ! অবশ্যই ইহা আমার বিদিত যে অধিদেব আছেন’ বলিতেছেন। এরূপ (অজ্ঞাত) হইলে ভো গৌতম! (আপনার কথন) কেন তুচ্ছ ও মিথ্যা হইবে না?”
“ভারদ্বাজ! দেবতা আছেন কি?- জিজ্ঞাসিত হইয়া ‘দেবতা আছেন’ বলে যিনি বলেন, আর অবশ্যই বিদিত হইয়া ‘আমার বিদিত আছে’ যিনি এরূপ বলেন; অতঃপর বিজ্ঞপুরুষের এক্ষেত্রে একান্তই নিষ্ঠাবান হওয়া উচিত যে ‘দেবতা আছেন’।”
“কেন, ভবৎ গৌতম! আপনি আমাকে প্রথমেই বর্ণনা করেন নাই?”
“ভারদ্বাজ! ইহা জগতে সুপ্রসিদ্ধ ও সর্বজন সম্মত যে উৎপত্তি দেবতা আছেন।”
৪৮৬। এরূপ উক্ত হইলে সঙ্গারব মাণব ভগবানকে ইহা কহিলেন,- “আশ্চর্য, ভো গৌতম! আশ্চর্য, ভো গৌতম! যেমন হে গৌতম! নিুমুখকে ঊর্ধমুখ করা হয় ......। এখন আমি ভবৎ গৌতম, ধর্ম ও ভিক্ষুসংঘের শরণ গ্রহণ করিতেছি। ভবৎ গৌতম! আজ হইতে জীবনান্ত পর্যন্ত আমাকে শরণাগত উপাসকরূপে ধারণা করুন।”
॥ সঙ্গারব সূত্র সমাপ্ত ॥
॥ পঞ্চম ব্রাহ্মণ বর্গ সমাপ্ত ॥
॥ মধ্যম পঞ্চাশ সমাপ্ত ॥
#########০#########