১৮৫। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-
এক সময় ভগবান বৈশালীর মহাবনে বিহার করিতেছিলেন কূটাগার শালায়। সেই সময় বচ্ছগোত্ত পরিব্রাজক এক পুণ্ডরিক পরিব্রাজকারামে বাস করিতেন। একদিন ভগবান পূর্বাহ্ন সময়ে নিবাসন পরিহিত হইয়া পাত্র-চীবর লইয়া ভিক্ষার্থ বৈশালীতে প্রবেশ করিলেন। তখন ভগবানের এই ধারণা হইল,- ‘এখন বৈশালীতে পিণ্ডাচরণের অতি সকাল বেলা। সুতরাং যেখানে এক পুণ্ডরিক পরিব্রাজকারাম এবং যেখানে বচ্ছগোত্ত পরিব্রাজক আছে তথায় গেলেই ভাল হয়। তখন ভগবান ...... তথায় গেলেন।
বচ্ছগোত্ত পরিব্রাজক দূর হইতে ভগবানকে আসিতে দেখিলেন, দেখিয়া ভগবানকে বলিলেন,- “আসুন ভন্তে ভগবন! ভন্তে! ভগবানের শুভাগমন (স্বাগতং) হউক। ভন্তে ভগবন! চিরদিনের পর এখানে আগমনের সুযোগ গ্রহণ করিলেন। বসুন, ভন্তে ভগবন! এই আসন প্রজ্ঞাপ্ত আছে।”
ভগবান প্রজ্ঞাপ্ত আসনে বসিলেন। বচ্ছগোত্ত পরিব্রাজকও অন্যতর নীচ আসন লইয়া একান্তে বসিলেন, একান্তে উপবিষ্ট বচ্ছগোত্ত পরিব্রাজক ভগবানকে বলিলেন,- “শুনা যায় ভন্তে! শ্রমণ গৌতম সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী, নিখিল জ্ঞানদর্শন অবগত আছেন, চলনে, দাঁড়ানে, সুপ্তে ও জাগরণে সদাসর্বদা তাঁহার জ্ঞানদর্শন উপস্থিত (জাগ্রত) থাকে। ভন্তে! যাহারা এরূপ বলে ...... কেমন তাহারা কি ভগবান সম্বন্ধে যথার্থবাদী? আর ভগবানকে অসত্য দ্বারা নিন্দা করিতেছে নহেত? ধর্মের অনুকূল বর্ণনা করিতেছে ত? ধর্মানুসারে কোন বাদানুবাদ নিন্দার কারণ হইবে না ত?”
“বচ্ছ! যাহারা এরূপ বলেন- ‘শ্রমণ গৌতম সর্বজ্ঞ ......’ তাহারা আমার সম্বন্ধে যথার্থবাদী নহে, অভূত ও অসত্য দ্বারা তাহারা আমার নিন্দা করিতেছে।”
১৮৬। “ভন্তে! কি প্রকারে বর্ণনা করিলে আমরা ভগবানের যথার্থবাদী হইব এবং ভগবানকে অভূত দ্বারা নিন্দা করিব না ...?”
“বচ্ছ! শ্রমণ গৌতম ত্রৈবিদ্য (ত্রিবিদ্যার অধিকারী) হন, এইরূপ বর্ণনাকারী আমার সম্বন্ধে যথার্থবাদী হইবে, .....। বচ্ছ! আমি যখন ইচ্ছা করি তখন (১) অনেকবিধ পূর্বনিবাস (পূর্বজন্ম) অনুস্মরণ করিতে পারি, যেমন- একজন্ম, দুইজন্ম ...... আকার ও উদ্দেশের সহিত অনেক পূর্বজন্ম অনুস্মরণ করিতে পারি। (২) বচ্ছ! আমি যখন ইচ্ছা করি মনুষ্যশক্তির অতীত, বিশুদ্ধ দিব্যচক্ষু দ্বারা সত্বগণকে দেখিতে পারি- চ্যুত হইতে, উৎপন্ন হইতে, হীন-উৎকৃষ্ট, সুবর্ণ-দুর্বর্ণ, সুগতি-দুর্গতি পরায়ণ, স্বীয় কর্মানুসারে গতিপ্রাপ্ত সত্বগণকে দর্শন করিতে সমর্থ। (৩) বচ্ছ! আমি আস্রব সমূহের ক্ষয় করিয়া অনাস্রব চিত্ত-বিমুক্ত, প্রজ্ঞা-বিমুক্ত ইহজীবনে অভিজ্ঞা দ্বারা স্বয়ং প্রত্যক্ষ করিয়া, উপলব্ধি করিয়া অবস্থান করি। .......।”
এইরূপ উক্ত হইলে বচ্ছগোত্ত পরিব্রাজক ভগবানকে ইহা বলিলেন,- “ভো গৌতম! এমন কোন গৃহী আছে কি? যে ব্যক্তি গৃহী-সংযোজন (বন্ধন) প্রহাণ না করিয়া দেহ-ত্যাগ হেতু দুঃখের অন্তঃসাধন করে?”
“নাই, বচ্ছ! এইরূপ কোন গৃহস্থ নাই .......।”
“ভো গৌতম! এমন কোন গৃহী আছে কি? যে গৃহস্থ গৃহীবন্ধন ছেদন না করিয়া দেহত্যাগের পর স্বর্গপরায়ণ হইয়াছে?”
“বচ্ছ! একশত নহে, দুইশত নহে, তিনশত নহে, চারিশত নহে, পাঁচশত নহে- তদপেক্ষা অধিক আছে, যে সকল গৃহী গার্হস্থ্য সংযোজন প্রহাণ না করিয়া মৃত্যুর পর স্বর্গপরায়ণ হইয়াছে।”
“হে গৌতম! এমন কোন আজীবক আছেন কি যিনি দেহত্যাগের দ্বারা দুঃখের অন্তঃসাধন করেন?”
“নাই, বচ্ছ!”
“হে গৌতম! কোন আজীবক দেহত্যাগের পর স্বর্গপরায়ণ আছে কি?”
“বচ্ছ! এখন হইতে একান্নব্বই কল্প পর্যন্ত যাহা আমি স্মরণ করিতেছি, ইতিমধ্যে স্বর্গপরায়ণ কোন আজীবককে জানিনা কেবল একজন ব্যতীত। তিনিও কর্মবাদী, ক্রিয়াবাদী ছিলেন।”
“এইরূপ হইলে হে গৌতম! এই যে তীর্থায়তন (পন্থা) তাহা শূন্য? অন্ততঃ স্বর্গগামীর দ্বারাও শূন্য?”
“হাঁ, বচ্ছ! এই আজীবক পন্থা শূন্য ......।”
ভগবান ইহা বলিলেন। বচ্ছগোত্ত পরিব্্রাজক সন্তুষ্টচিত্তে ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন করিলেন।
॥ তেবিজ্জ সূত্র সমাপ্ত ॥
১৮৭। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-
এক সময় ভগবান শ্রাবস্তীতে অনাথপিণ্ডিকের আরাম জেতবনে বিহার করিতেছেন।
তখন বচ্ছগোত্ত পরিব্রাজক যেখানে ভগবান ছিলেন তথায় গেলেন, উপনীত হইয়া ভগবানের সাথে সম্মোদন (কুশল প্রশ্ন) করিয়া একপ্রান্তে বসিলেন, একান্তে উপবিষ্ট বচ্ছগোত্ত পরিব্রাজক ভগবানকে বলিলেন,-
(১) “ভো গৌতম! লোক শাশ্বত (নিত্য)- ইহাই সত্য, অন্য সব মোঘ (মিথ্যা); গৌতম! আপনি কি এই মতবাদী?”
“বচ্ছ! আমি এরূপ মতবাদী নহি- ‘লোক শাশ্বত,- ইহাই সত্য অন্য সব মিথ্যা’।”
(২) “ভো গৌতম! লোক অশাশ্বত- ইহাই সত্য, অন্য সব মিথ্যা; গৌতম! আপনি এই মতবাদী কি?”
“বচ্ছ! আমি এই মতবাদীও নহি- ‘লোক অশাশ্বত,- ইহাই সত্য, অন্য সব মিথ্যা’।”
(৩) “ভো গৌতম! লোক অন্তবান ...... মতবাদী?”
“বচ্ছ! ... ... নহি- ‘লোক অন্তবান, ... ... মিথ্যা’।”
(৪) “ভো গৌতম! লোক অনন্তবান ... ... মতবাদী?”
“বচ্ছ! ... ... নহি- ‘লোক অনন্তবান ... ... মিথ্যা’।”
(৫) “ভো গৌতম! যেই জীব সেই শরীর ... ... মতবাদী?”
“বচ্ছ! ... ... নহি- ‘যেই জীব সেই শরীর ... ... মিথ্যা’।”
(৬) “ভো গৌতম! জীব এক শরীর অন্য ... ... মতবাদী?”
“বচ্ছ! ... ... নহি- ‘জীব এক শরীর অন্য, ... .... মিথ্যা।
(৭) “ভো গৌতম! তথাগত মৃত্যুর পর থাকে ... ... মতবাদী?”
“বচ্ছ! ... ... নহি- ‘তথাগত মৃত্যুর থাকে, ... ... মিথ্যা’।”
(৮) “ভো গৌতম! তথাগত মৃত্যুর পর না থাকে .... মতবাদী?”
“বচ্ছ! ... ... নহি- ‘তথাগত মৃত্যুর পর না থাকে, .... মিথ্যা’।”
(৯) “ভো গৌতম! তথাগত মৃত্যুর পর থাকেও, না থাকেও ...... মতবাদী?”
“বচ্ছ! ..... নহি- তথাগত মৃত্যুর পর থাকেও, না থাকেও, ....... মিথ্যা’।”
(১০) “ভো গৌতম! তথাগত মৃত্যুর পর থাকেও না, না থাকেও না, ...... মতবাদী?”
“বচ্ছ! ...... নহি- ‘তথাগত মৃত্যুর পর থাকেও না, না থাকেও না; ...... মিথ্যা’।”
১৮৮। “কেমন হে গৌতম! (১) লোক শাশ্বত- ইহাই সত্য, অন্য সব মিথ্যা; গৌতম! আপনি কি এই মতবাদী?- ইহা জিজ্ঞাসিত হইয়া ‘বচ্ছ! আমি এই মতবাদী নহি’ ইহাই বলিতেছেন। ...... (১০) তথাগত মৃত্যুর পর থাকেও না, না থাকেও না- ইহাই সত্য, অন্য সব মিথ্যা; কেমন গৌতম! আপনি এই মতবাদী কি?- ইহা জিজ্ঞাসিত হইয়াও ‘বচ্ছ! আমি এই মতবাদী নহি’ ইহাই বলিতেছেন। কি আদীনব (দোষ) দর্শন করিয়া হে গৌতম! আপনি এ সকল দৃষ্টি বা মতবাদ সমূহ স্বীকার করেন না?”
১৮৯। “বচ্ছ! লোক শাশ্বত- ইহা দৃষ্টি-গত (মতমাত্র), দৃষ্টি-গহণ (দুর্গম, গভীর), দৃষ্টি-কান্তার, দৃষ্টি-বিশূক (কাঁটা), দৃষ্টি-বিস্ফন্দন (চঞ্চলতা), দৃষ্টি-সংযোজন বিশেষ; ইহা ভয়ঙ্কর দুঃখময়, আঘাতময়, উপায়াসময় ও পরিদাহময়। ইহা নির্বেদ বা বিদর্শন সাধনায়, বিরাগ বা আর্য মার্গের, দুঃখ নিরোধের, ক্লেশ উপশমের, আর্য সত্যের, অভিজ্ঞতা অর্জনের, সম্বোধি লাভের ও নির্বান-মুক্তির জন্য সংবর্তিত হয় না, সহায়তা করে না। ...... সুতরাং বচ্ছ! এবম্বিধ দোষ দেখিয়াই আমি এই সমস্ত (দশবিধ) ভ্রান্ত-দৃষ্টি (মতবাদ) গ্রহণ করি নাই।”
“মাননীয় গৌতম! আপনার কোন দৃষ্টি-গত (মতবাদ গৃহীত) আছে কি ?”
“বচ্ছ! তথাগতের এই দৃষ্টি-গত অপসৃত হইয়াছে। বচ্ছ! তথাগতের প্রজ্ঞায় ইহা দৃষ্ট (সাক্ষাৎকৃত) হইয়াছে,- ‘এই প্রকার রূপস্কন্ধ, ইহা রূপের সমুদয় (কারণ), ইহাই রূপের অন্তঃসাধন। ইহা বেদনাস্কন্ধ, ইহা বেদনার সমুদয়, ইহাই বেদনার অন্তঃসাধন। ইহা সংজ্ঞাস্কন্ধ ......। ইহা সংস্কারস্কন্ধ ......। ইহা বিজ্ঞানস্কন্ধ ......। সেই কারণে (পঞ্চস্কন্ধের উদয়-বিলয় জানা হেতু) তথাগত সর্ববিধ (তৃষ্ণা, দৃষ্টি, মানবশে) মননের, সর্ববিধ মথিতের, যাবতীয় অহঙ্কার (দৃষ্টি)- মমকার (তৃষ্ণা) ও মানানুশয়ের ক্ষয়, বিরাগ, নিরোধ, ত্যাগ ও পরিবর্জন হেতু উপাদান রহিত হইয়া বিমুক্ত’,- ইহাই বলিতেছি।”
১৯০। “ভো গৌতম! এ প্রকারে বিমুক্ত-চিত্ত ভিক্ষু কোথায় উৎপন্ন হয়?”
“বচ্ছ! ‘উৎপন্ন হয়’- ইহা বলা চলে না।”
“তবে হে গৌতম! উৎপন্ন হয় না?”
“বচ্ছ! ‘উৎপন্ন হয় না’- ইহাও বলা চলে না।”
“তবে হে গৌতম! উৎপন্ন হয়, নাও হয়?”
“বচ্ছ! ‘উৎপন্ন হয়, নাও হয়’- ইহাও বলা চলে না।”
“তবে হে গৌতম! উৎপন্ন হয় না, নাও হয় না?”
“বচ্ছ! ‘উৎপন্ন হয় না, নাও হয় না’- ইহাও বলা চলে না।”
“ভো গৌতম! এ প্রকারে বিমুক্তচিত্ত ভিক্ষু কোথায় উৎপন্ন হয়? জিজ্ঞাসিত হইয়া ‘বচ্ছ! উৎপন্ন হয়, বলা চলে না’- বলিতেছেন। তবে ...... বলিতেছেন। হে গৌতম! আমি বুঝিলাম না, ইহাতে আমি সম্মোহিত হইলাম। পূর্ব আলোচনায় মাননীয় গৌতম সম্বন্ধে আমার যাহা প্রসাদ (শ্রদ্ধা) মাত্র ছিল, ইদানিং আমার তাহাও অন্তর্হিত হইল।”
“বচ্ছ! নিশ্চয় তোমার অজ্ঞানের সম্ভাবনা আছে, সম্মোহিত হওয়া স্বাভাবিক। কারণ বচ্ছ! এই প্রত্যয়াকার (কার্য-কারণ) ধর্ম গম্ভীর, দুর্দর্শ, দুরানুবোধ্য, শান্ত, প্রণীত (উত্তম), তর্কাতীত, নিপুণ (সুক্ষ্ম), পণ্ডিত-বেদনীয়। সুতরাং তোমার ন্যায় অন্যমতাবলম্বী, অন্যমত সহিষ্ণু, ভিন্ন রুচি-সম্পন্ন, অন্যত্র প্রয়োগী (অনুশীলনকারী), মিথ্যা প্রতিপন্ন ও অন্য (অকার্য কারণবাদী) আচার্যে অনুগামীর পক্ষে সে ধর্ম জানা দুষ্কর।”
১৯১। “তাহা হইলে বচ্ছ! এ বিষয়ে তোমাকেই জিজ্ঞাসা করিব, তোমার যেরূপ অভিরুচি সেরূপ উহার উত্তর দিও। তাহা কি মনে কর? বচ্ছ! যদি তোমার সম্মুখে অগ্নি জলে, তুমি জানিতে পারিবে কি আমার সম্মুখে অগ্নি জ্বলিতেছে?”
“হে গৌতম! যদি আমার সম্মুখে অগ্নি জ্বলে তবে এই অগ্নি আমার সম্মুখে জ্বলিতেছে, ইহা আমি বলিতে পারিব।”
“যদি বচ্ছ! তোমাকে এরূপ জিজ্ঞাসা করা হয়,- এই যে তোমার সম্মুখে অগ্নি জ্বলিতেছে, তাহা কি কারণে জ্বলিতেছে? উহা এরূপ জিজ্ঞাসিত হইয়া তুমি কি উত্তর দিবে?”
“এরূপ জিজ্ঞাসিত হইলে হে গৌতম! আমি উত্তর দিব- এই যে আমার সম্মুখে অগ্নি জ্বলিতেছে, তৃণ-কাষ্ঠ উপাদান হেতুই জ্বলিতেছে।”
“যদি বচ্ছ! তোমার সম্মুখে সে অগ্নি নিভিয়া যায়, তুমি জানিতে পারিবে কি এই অগ্নি নির্বাপিত হইয়াছে?”
“হে গৌতম! যদি আমার সম্মুখে সে অগ্নি নির্বাপিত হয়, তবে আমি জানিব- আমার সম্মুখে এই অগ্নি নির্বাপিত হইয়াছে।”
“যদি বচ্ছ! তোমাকে এরূপ জিজ্ঞাসা করা হয়,- তোমার সম্মুখে যে অগ্নি নির্বাপিত, সে অগ্নি এস্থান হইতে পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর বা দক্ষিণ কোন্ দিকে গেল? এরূপ জিজ্ঞাসিত হইয়া তুমি কি উত্তর দিবে?”
“ভো গৌতম! ‘গেল’ একথা বলা চলে না। যে তৃণ-কাষ্ঠ উপাদান অবলম্বনে (ইন্ধনের সাহায্যে) সে অগ্নি জ্বলিয়াছিল, তাহার (উপাদানের) অবসান হেতু এবং অন্য উপাদান আহরিত না হওয়াই অনাহার বা ইন্ধনহীন হইয়া নিভিয়া গিয়াছে, ইহাই বলা চলে।”
১৯২। “এইরূপেই বচ্ছ! তথাগতকে (সত্ব) বিজ্ঞাপিত করিবার সময় যে রূপ দ্বারা (জড়দেহ), যে বেদনা, যে সংজ্ঞা, যে সংস্কার, যে বিজ্ঞান দ্বারা (রূপী ...... বিজ্ঞানী বলিয়া) বিজ্ঞাপিত করা যায়; সেই রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান (তৎপ্রতিবদ্ধ সংযোজন প্রহাণহেতু ক্ষীণাস্রব) তথাগতের প্রহীণ, উচ্ছিন্নমূল, শিরছিন্ন তালকাণ্ডবৎ ক্রমে অভাব প্রাপ্ত, ভবিষ্যতে অনুৎপত্তি স্বভাব হইয়াছে। বচ্ছ! তথাগত....বিজ্ঞান-সংখ্যা (ব্যবহার) বিমুক্ত হইয়াছে মহাসমুদ্রের ন্যায় গুণগম্ভীর অপরিমেয় ও দুরাবগাহ হইয়াছে। সুতরাং ‘উৎপন্ন হয়’ বলা চলে না। ...... উৎপন্ন হয় না, নাও হয় না’ বলা চলে না। (মুক্তপুরুষ পরিনির্বানের সঙ্গে চতুষ্কোটি বিনিমুক্ত হইয়া যায়)।”
এইরূপ উক্ত হইলে বচ্ছগোত্ত পরিব্রাজক ভগবানকে বলিলেন,- “ভো গৌতম! যেমন গ্রাম বা নগরের অদূরে বৃহৎ শালবৃক্ষ থাকে, অনিত্য ধর্মের প্রভাবে উহার শাখা-পত্র বিনষ্ট হয়, ত্বক-পর্পটিকাদি নষ্ট হয়, বাকল (আঁশ) বিনষ্ট হয়; সেই বৃক্ষ অপর সময়ে অপগত শাখা-পত্র, অপগত ত্বক-পর্পটিকা, অপগত বাকল শুদ্ধ ও সারে প্রতিষ্ঠিত হয়, সেইরূপ হে গৌতম! আপনার প্রাবচন (ধর্মশাস্ত্র) শাখা-পলাশ, ত্বক-পর্পটিকা, আঁশ রহিত হইয়া বিশুদ্ধ সারে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে।”
“অতি সুন্দর, ভো গৌতম! অতি চমৎকার, হে গৌতম! যেমন হে গৌতম! অধঃমুখ পাত্রকে ঊর্ধমুখ করিলেন, প্রতিচ্ছন্নকে বিবৃত করিলেন। দিকভ্রষ্টকে মার্গ প্রদর্শন করিলেন, চক্ষুষ্মান রূপ (দৃশ্য) দেখিবার নিমিত্ত অন্ধকারে তৈল-প্রদীপ ধারণ করিলেন। মাননীয় গৌতম কর্তৃক এরূপে বিবিধ পর্যায়ে ধর্ম প্রকাশিত হইল। এই আমি মাননীয় গৌতম, ধর্ম্ম ও ভিক্ষুসংঘের শরণ গ্রহণ করিতেছি। মাননীয় গৌতম! আজ হইতে আজীবন আমাকে শরণাগত উপাসকরূপে ধারণ করুন।”
॥ অগ্গিবচ্ছ সূত্র সমাপ্ত ॥
১৯৩। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-
এক সময় ভগবান রাজগৃহে বেণুবন কলন্দক নিবাপে বিহার করিতেছেন। তখন বচ্ছগোত্ত পরিব্রাজক যেখানে ভগবান আছেন সেখানে গেলেন, গিয়া ভগবানের সহিত সম্মোদন করিলেন। ...... একান্তে বসিলেন, একান্তে উপবিষ্ট বচ্ছগোত্ত পরিব্রাজক ভগবানকে বলিলেন,- “দীর্ঘদিন হইল আমি মাননীয় গৌতমের সহিত বাক্যালাপ করিয়াছি। সাধু, মাননীয় গৌতম! আমাকে সংক্ষেপে কুশলাকুশল (ভাল-মন্দ) সম্বন্ধে উপদেশ করুন।”
“বচ্ছ! আমি সংক্ষেপেও তোমাকে কুশলাকুশল উপদেশ করিতে পারি, বিস্তৃতভাবেও তোমাকে কুশলাকুশল উপদেশ করিতে পারি। কিন্তু (প্রথমতঃ) বচ্ছ! তোমাকে সংক্ষেপে কুশলাকুশল উপদেশ করিব। তাহা শ্রবণ কর, সুষ্ঠুভাবে মনোনিবেশ কর, ভাষণ করিব।”
“হাঁ, ভদন্ত!” (বলিয়া) বচ্ছগোত্ত পরিব্রাজক ভগবানকে উত্তর দিলেন।
১৯৪। ভগবান এরূপ বলিলেন,- “বচ্ছ! লোভ অকুশল, আর অলোভ কুশল। বচ্ছ! দ্বেষ অকুশল, অদ্বেষ কুশল। বচ্ছ! মোহ অকুশল, অমোহ কুশল। এই প্রকারে বচ্ছ! এই তিন ধর্ম (মনোবৃত্তি) অকুশল আর তিন ধর্ম কুশল।”
“বচ্ছ! প্রাণাতিপাত (হিংসা) অকুশল, আর প্রাণাতিপাত হইতে বিরতি কুশল। অদত্তাদান (চুরি) অকুশল, অদত্তাদান বিরতি কুশল। কামে মিথ্যাচার অকুশল, কামে মিথ্যাচার বিরতি কুশল। মৃষাবাদ অকুশল, মৃষাবাদ বিরতি কুশল। পিশুনবাক্য অকুশল, পিশুনবাক্য বিরতি কুশল। পরুষবচন অকুশল, পরুষবচন বিরতি কুশল। সমপ্রলাপ অকুশল, সমপ্রলাপ বিরতি কুশল। অভিধ্যা (লোভ) অকুশল, অন্-অভিধ্যা কুশল। ব্যাপাদ অকুশল, অব্যাপাদ (করুণা) কুশল। মিথ্যাদৃষ্টি (ভ্রান্ত ধারণা) অকুশল, সম্যক্দৃষ্টি কুশল। বচ্ছ! এই দশ ধর্ম (আচার) অকুশল, আর দশ বিরতি ধর্ম কুশল।”
“বচ্ছ! যখন কোন ভিক্ষুর তৃষ্ণা উচ্ছিন্নমূল, তালকাণ্ডবৎ, অভাব প্রাপ্ত ও ভবিষ্যতে অনুৎপত্তি স্বভাব হইয়া প্রহীণ হয়, তখন সে ভিক্ষু অর্হৎ, ক্ষীণাস্রব, ব্রহ্মচর্যবাস পূর্ণ, কৃত-কৃত্য, পরিত্যক্ত স্কন্ধভার, সদর্থ অনুপ্রাপ্ত, পরিক্ষীণ ভবসংযোজন ও অর্হত্ব প্রজ্ঞাদ্বারা সম্যক্ জানিয়া বিমুক্ত হয়।”
১৯৫। “মাননীয় গৌতমের কথা থাকুক। গৌতম! আপনার এক ভিক্ষুশ্রাবকও আছেন কি? যিনি আস্রবরাশির ক্ষয় করিয়া অনাস্রব চিত্ত-বিমুক্তি ও প্রজ্ঞা-বিমুক্তি ইহ-জীবনেই প্রত্যক্ষ করিয়া, লাভ করিয়া বিহার করেন ?”
“বচ্ছ! একশত নহে, দুই, তিন, চার, পাঁচশত নহে তদপেক্ষা অধিক সংখ্যকই আমার ভিক্ষুশ্রাবক আছে, যাহারা আস্রব ক্ষয় করিয়া অনাস্রব চিত্ত-বিমুক্তি ও প্রজ্ঞা-বিমুক্তি এই জীবনে স্বীয় অভিজ্ঞাদ্বারা প্রত্যক্ষ ও উপলব্ধি করিয়া বিহার করে।”
“থাকুন মাননীয় গৌতম, রেখে দেন ভিক্ষুগণ, হে গৌতম! আপনার কোন ভিক্ষুণীশিষ্যা আছেন কি? যিনি আস্রবরাশির সম্পূর্ণ ক্ষয় করিয়া অনাস্রব চিত্ত-বিমুক্তি ও প্রজ্ঞা-বিমুক্তি ...... প্রত্যক্ষ ও উপলব্ধি করিয়া বিহার করেন?”
“বচ্ছ! একশত নহে ...... অধিক সংখ্যক ...... উপলব্ধি করিয়া বিহার করে।”
“থাকুন মাননীয় গৌতম, থাকুন ভিক্ষুগণ, থাকুন ভিক্ষুণীসংঘ, মাননীয় গৌতমের এমন কোন গৃহস্থশিষ্য শ্বেতাম্বরধারী ব্রহ্মচারী উপাসক আছেন কি? যিনি পঞ্চবিধ অধঃভাগীয় সংযোজন সম্পূর্ণ ক্ষয়সাধন হেতু অযোনি-সম্ভবা দেবতা হইয়া তথায় (শুদ্ধাবাস বৃহ্মলোকে) পরিনির্বান লাভী ও সেই ব্রহ্মলোক হইতে অনাবর্তন স্বভাব হইয়াছেন?”
“বচ্ছ! ...... বহুসংখ্যক ...... ?”
“থাকুন মাননীয় গৌতম, থাকুন ভিক্ষুগণ, থাকুন ভিক্ষুণীসংঘ, থাকুন ব্রহ্মচারী শ্রাবক গৃহী উপাসকগণ, গৌতম! আপনার একজন গৃহী উপাসক ও শ্বেতবস্ত্রধারী কামভোগী (বিষয়-ভোগী) শাসনকারী (ধর্মানুসারী), উপদেশানুসারী, সংশয়োত্তীর্ণ (ইহা কি প্রকার? এই সন্দেহ উত্তীর্ণ), জিজ্ঞাসাতীত, বৈশারদ্য প্রাপ্ত এবং শাস্তার ধর্মমতে পর-প্রত্যয় রহিত (প্রত্যক্ষদর্শী) হইয়া অবস্থান করেন?”
“বচ্ছ! একশত নহে ...... বহুসংখ্যক......।”
“থাকুন গৌতম! আপনি ...... থাকুন গৃহী শ্বেতবসনধারী উপাসক .....; একজনও গৃহস্থ শ্বেতবসনা ব্রহ্মচারিণী শ্রাবিকা উপাসিকা আছে কি? যিনি পাঁচ প্রকার অধঃভাগীয় সংযোজন সম্পূর্ণ ক্ষয় হেতু ...... সেই ব্রহ্মলোক হইতে অনাবর্তন স্বভাব প্রাপ্ত হইয়াছেন?”
“বচ্ছ! একশ নহে ...... বহু অধিক সংখ্যক ......।”
“থাকুন গৌতম! আপনি, থাকুন আপনার ...... গৃহী শ্বেতবসনা ব্রহ্মচারিণী উপাসিকা; কেমন আপনার একজনও শ্বেতবসনা, বিষয়-ভোগিনী, শাসন-কারিণী, উপদেশানুসারিণী, সংশয়োত্তীর্ণা, বিগত সন্দেহা, বৈশারদ্য প্রাপ্ত এবং শাস্তার ধর্মে পর-প্রত্যয় রহিতা হইয়া অবস্থান করেন এমন উপাসিকা আছেন কি?”
“বচ্ছ! একশ নহে ...... অধিক সংখ্যক ......।”
১৯৬। “ভো গৌতম! যদি আপনিই আপনার ধর্মের আরাধক (পরিপূরক) হইতেন আর ভিক্ষুরা সম্পাদক না হইতেন তবে এই ব্রহ্মচর্য সেই অংশে অপূর্ণ থাকিত। যেহেতু ভো গৌতম! এই ধর্মের আপনিও আরাধক আর ভিক্ষুরাও আরাধক। সুতরাং এই ব্রহ্মচর্য সে অংশে পরিপূর্ণ আছে। ...... ভিক্ষুণীসংঘও আরাধিকা। ...... পূ ...... শ্বেতবসনা ব্রহ্মচারিণী গৃহী উপাসিকারাও আরাধিকা। ...... পূ ...... শ্বেতবসনধারী কামভোগী গৃহী উপাসকেরাও আরাধক। ...... পূ ...... শ্বেতবসনধারী কামভোগী গৃহী উপাসিকারাও আরাধিকা। সুতরাং এই ব্রহ্মচর্য সে অংশে সর্বাঙ্গ পরিপূর্ণ আছে।”
১৯৭। “যেমন ভো গৌতম! গঙ্গানদী সমুদ্র-নিুা (সমুদ্রের দিকে গতিশীলা), সমুদ্র-প্রবণা, সমুদ্রাবনতা, সমুদ্রকেই প্রাপ্ত হইয়া থাকে; সেইরূপ মহানুভব গৌতমের সগৃহস্থ প্রব্রজিত পারিষদ নির্বান-নিু, নির্বান প্রবণ, নির্বানাবনত, নির্বান-সংলগ্ন হইয়াই স্থিত আছে। অতি সুন্দর, হে গৌতম! অতি চমৎকার, ভো গৌতম! যেমন হে গৌতম! অধঃমুখকে ঊর্ধমুখ করিলেন, আচ্ছন্নকে বিবৃত করিলেন, ভ্রান্তকে মার্গ দেখাইলেন, চক্ষুষ্মান বস্তু দেখিবার নিমিত্ত তৈল-প্রদীপ ধারণ করিলেন; সেইরূপ মহানুভব গৌতম কর্তৃক অনেক প্রকারে ধর্ম প্রকাশিত হইল। সুতরাং আমি মহানুভব গৌতম, ধর্ম ও ভিক্ষুসংঘের শরণ গ্রহণ করিতেছি। গৌতমের নিকট আমি প্রব্রজ্যা লাভ করিতে চাই, উপসম্পদা প্রত্যাশা করি।”
“বচ্ছ! যে কোন ভূতপূর্ব অন্যতির্থিক এই ধর্ম-বিনয়ে প্রব্রজ্যা ও উপসম্পদা আকাঙ্খা করে তাহাকে চারিমাস যাবৎ পরিবাস করিতে হয়, ...... (পরীক্ষা মূলক) চারিমাস গত হইলে সন্তুষ্ট-চিত্ত ভিক্ষুগণ তাহাকে প্রব্রজ্যা ও ভিক্ষুভাবে উপসম্পদা দিয়া থাকেন। অথচ এক্ষেত্রে পুদ্গল নানাত্বও আমার সুুবিদিত।”
“যদি ভন্তে! এই ধর্ম-বিনয়ে প্রব্রজ্যা ও উপসম্পদা প্রত্যাশী ভূতপূর্ব অন্যতির্থিয়কে চারিমাস পরিবাস করিতে হয় এবং চারিমাস পর সন্তুষ্ট-চিত্ত ভিক্ষুগণ প্রব্রজ্যা ও ভিক্ষুভাবে উপসম্পদা দেন; প্রয়োজন হইলে আমি চারিবর্ষ-ব্যাপী পরিবাস করিব।”
...... বচ্ছগোত্ত পরিব্রাজক ভগবান সমীপে প্রব্রজ্যা লাভ করিলেন, উপসম্পদা লাভ করিলেন।
অচির উপসম্পন্ন আয়ুষ্মান বচ্ছগোত্ত অর্ধমাস পর ভগবানের নিকট উপস্থিত হইয়া অভিবাদন পূর্বক একান্তে বসিলেন এবং ভগবানকে বলিলেন,- “ভন্তে! শৈক্ষ্য (অনাগামী শিক্ষাব্রতী) জ্ঞান, শৈক্ষ্যবিদ্যা দ্বারা যাহা প্রাপ্য আমি তাহা প্রাপ্ত হইয়াছি। এখন ভগবান আমাকে তদুত্তর ধর্ম উপদেশ করুন।”
“তাহা হইলে বচ্ছ! তুমি শমথ (সমাধি) ও বিদর্শন (প্রজ্ঞা) এই দুই ধর্ম ভাবনা ও বর্ধন কর। বচ্ছ! তোমার শমথ ও বিদর্শন এই দুই ধর্ম অধিকতর ভাবিত হইলে নানা ধাতু প্রতিবেধের নিমিত্ত (শমথে পঞ্চ ও বিদর্শনে এক, এই ষড় অভিজ্ঞা লাভের নিমিত্ত) প্রবর্তিত হইবে।
১৯৮। “সে অবস্থায় বচ্ছ! তুমি যে পর্যন্ত আকাঙ্খা করিবে,- ‘আমি অনেক প্রকার ঋদ্ধি অধিগত হই, যথা- এক হইয়াও বহুধা হইব, বহুবিধ হইয়াও এক হইব, আবির্ভাব, তিরোভাব (অন্তর্ধান), তিরোকুড্য (অন্তর্ধান হইয়া দেওয়াল ভেদ করা), তিরঃ প্রাকার (প্রাকার ভেদ করা), তিরঃ পর্বত, আকাশের ন্যায় অসংলগ্ন ভাবে গমন করিব; জলের মত পৃথিবীতেও উম্মজ্জন-নিমজ্জন করিব, মাটির ন্যায় জলে অনাদ্রভাবে গমন করিব, পক্ষী-শকুনের ন্যায় পর্য্যাঙ্কাবদ্ধ (বীরাসন) হইয়া আকাশে ভ্রমণ করিব; এরূপ মহাঋদ্ধি ও মহা অনুভব সম্পন্ন এই চন্দ্র-সূর্যকে হস্তদ্বারা স্পর্শ করিব, পরিমর্দন করিব, যাবৎ ব্রহ্মলোক পর্যন্ত আপন কায়ে বশীভূত করিব।’ স্মরণের প্রয়োজন বোধ হইলে তথায় তথায়ই তুমি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা অর্জন করিবে।” (১)
“বচ্ছ! তুমি যতবার পর্যন্ত আশা করিবে,- ‘আমি মনুষ্যশক্তির অতীত, বিশুদ্ধ, দিব্য শ্রোত্রধাতু দ্বারা দূরস্থ ও সমীপস্থ দিব্য ও মনুষ্য উভয় শব্দ শুনিব।’ স্মরণের প্রয়োজন উপস্থিত হইলেই তুমি তাহাতে তাহাতেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা লাভ করিবে।” (২)
“বচ্ছ! তুমি যে পর্যন্ত ইচ্ছা করিবে,- ‘আমি পরসত্ব ও পর পুদ্গলের চিত্ত স্বচিত্তে পরীক্ষা করিয়া জানিব, সরাগ চিত্তকে সরাগ চিত্ত হিসাবে জানিব, বীতরাগ চিত্তকে বীতরাগ চিত্ত হিসাবে জানিব, সদ্বেষ চিত্তকে ......, বীতদ্বেষ চিত্তকে ...... , সম্মোহ চিত্তকে ...... , বীতমোহ চিত্তকে ...... , বিক্ষিপ্ত চিত্তকে ...... , সংক্ষিপ্ত চিত্তকে (একাগ্র-চিত্তকে) ...... , মহদ্গত চিত্তকে ...... , অমহদ্গত চিত্তকে ...... , সউত্তর (যার উত্তর আছে) চিত্তকে ...... , অনুত্তর চিত্তকে...., সমাহিত চিত্তকে ...... , অসমাহিত চিত্তকে ...... , বিমুক্ত চিত্তকে বিমুক্ত চিত্তরূপে জানিব, অথবা অবিমুক্ত চিত্তকে অবিমুক্ত চিত্তরূপে জানিব।’ কারণ উপস্থিত হইলে তুমি তাহাতে তাহাতেই প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা প্রাপ্ত হইবে।” (৩)
“বচ্ছ! তুমি যত আকাঙ্খা করিবে,- ‘আমি অনেকবিধ পূর্বনিবাস (পূর্বজন্ম) অনুস্মরণ করি, যেমন- একজন্ম, দুইজন্ম ...... এরূপে আকার ও উদ্দেশ সহিত অনেক প্রকার পূর্বনিবাস স্মরণ করি।’ ......।” (৪)
“বচ্ছ! তুমি যতবার আকাঙ্খা করিবে,- ‘আমি মনুষ্যশক্তির অতীত বিশুদ্ধ দিব্যচক্ষু দ্বারা চ্যুতির সময়, উৎপত্তির সময়, হীন-উৎকৃষ্ট, সুরূপ-কুরূপ, সুগত-দুর্গত সত্বগণকে দর্শন করিব, যথাকর্মানুরূপ গতিপ্রাপ্ত সত্বগণকে জানিব- এই সকল সত্ব কায়-দুশ্চরিত, বাক্-দুশ্চরিত, মনো-দুশ্চরিত। আর্যদিগের নিন্দুক, মিথ্যাদৃষ্টি সম্পন্ন, মিথ্যাদৃষ্টি কর্ম সম্পাদনকারী; তাহারা দেহত্যাগে মৃত্যুর পর অপায়, দুর্গতি, বিনিপাত ও নিরয়ে উৎপন্ন হইয়াছে। এই সকল সত্ব কায়-সুচরিত, বাক্-সুচরিত, মনো-সুচরিত ...... সুগতি স্বর্গলোকে উৎপন্ন হইয়াছে।’ এরূপ মনুষ্যশক্তির অতীত বিশুদ্ধ দিব্যচক্ষু দ্বারা ...... কর্মানুসারে গতিপ্রাপ্ত সত্বগণকে জানিবে।” (৫)
“বচ্ছ! তুমি যতবার ইচ্ছা কর,- আমি আস্রব সমূহের ক্ষয়ে অনাস্রব চিত্ত-বিমুক্তি ও প্রজ্ঞা-বিমুক্তি ইহ-জীবনে স্বয়ং অভিজ্ঞাদ্বারা প্রত্যক্ষ করিয়া ও লাভ করিয়া বিহার করিব।’ ......।” (৬)
১৯৯। তখন আয়ুষ্মান বচ্ছগোত্ত ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন ও অনুমোদন করিয়া আসন হইতে উঠিলেন এবং ভগবানকে অভিবাদন ও প্রদক্ষিণ করিয়া প্রস্থান করিলেন।
তৎপর আয়ুষ্মান বচ্ছগোত্ত একাকী ধ্যানপরায়ণ, অপ্রমত্ত, বীর্যবান ও তদ্গত চিত্তে বিহার করিয়া অচিরেই যার জন্য কুলপুত্রগণ সম্যক্রূপে আগার হইতে অনাগারিক প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন, সেই অনুত্তর ব্রহ্মচর্যাবসান (অর্হত্ব) প্রত্যক্ষ জীবনে স্বয়ং অভিজ্ঞাদ্বারা সাক্ষাৎ করিয়া, প্রাপ্ত হইয়া বাস করিতে লাগিলেন; জন্মক্ষীণ, ব্রহ্মচর্যব্রত উদ্যাপিত, করণীয় কৃত এবং ইহার জন্য আর অন্য কোন করণীয় নাই- বুঝিতে পারিলেন। আয়ুষ্মান বচ্ছগোত্ত অর্হৎদের অন্যতর হইলেন।
২০০। সেই সময় বহুভিক্ষু ভগবানকে দেখিবার জন্য যাইতেছিলেন। আয়ুষ্মান বচ্ছগোত্ত দূর হইতে সে ভিক্ষুগণকে যাইতে দেখিলেন এবং তাঁহাদের নিকট গিয়া বলিলেন,- “সমপ্রতি আয়ুষ্মানগণ! আপনারা কোথায় যাইতেছেন?”
“বন্ধু! আমরা ভগবানকে দেখিবার নিমিত্ত যাইতেছি।”
“তাহা হইলে আয়ুষ্মানগণ! আমার বাক্যে ভগবানকে নতশিরে বন্দনা করিবেন- ‘ভন্তে! বচ্ছগোত্ত ভিক্ষু ভগবানের পাদে নতশিরে বন্দনা করিতেছে’- বলিবেন, আর ইহাও বলিবেন,- ‘ভগবান আমার (অর্হত্ব মার্গে) পরিচিত, সুগত আমার পরিচিত’।”
“হাঁ, বন্ধু!” (বলিয়া) সে ভিক্ষুগণ বচ্ছগোত্ত ভিক্ষুকে প্রতিশ্রুতি দিলেন।
অতঃপর সে ভিক্ষুগণ ভগবানের নিকট উপস্থিত হইলেন এবং ভগবানকে অভিবাদন করিয়া একান্তে বসিলেন। একান্তে উপবিষ্ট সেই ভিক্ষুগণ ভগবানকে বলিলেন,- “ভন্তে! আয়ুষ্মান বচ্ছগোত্ত ভগবানকে নতশিরে বন্দনা করিয়াছেন এবং বলিয়াছেন,- “ভগবান আমার পরিচিত, সুগত আমার পরিচিত হইয়াছেন’।”
“ভিক্ষুগণ! পূর্বেই আমার চিত্তদ্বারা বচ্ছগোত্তের চিত্ত পরীক্ষা করিয়া বিদিত হইয়াছি,- ‘বচ্ছগোত্ত ভিক্ষু ত্রৈবিদ্য, মহাঋদ্ধিমান ও মহাপ্রভাবশালী হইয়াছে।’ দেবতারাও আমাকে একথা বলিয়াছিল,- ‘ভন্তে! বচ্ছগোত্ত ভিক্ষু ত্রৈবিদ্য, মহাঋদ্ধিমান ও মহানুভবশালী হইয়াছেন’।”
ভগবান ইহা বলিলেন। সে ভিক্ষুগণ ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন করিলেন।
॥ মহাবচ্ছ সূত্র সমাপ্ত ॥
২০১। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-
এক সময় ভগবান রাজগৃহে গৃধ্রকূট পর্বতের উপর শূকর খতায় (খণিত-গুহায়) বাস করিতেছেন। তখন দীঘনখ পরিব্রাজক যেখানে ভগবান ছিলেন তথায় গেলেন, গিয়া ভগবানের সাথে সম্মোদন করিলেন, সম্মোদন ও স্মরণীয় কর্তব্য সমাপ্ত করিয়া একপ্রান্তে দাঁড়াইলেন, একপ্রান্তে স্থিত দীঘনখ পরিব্রাজক ভগবানকে ইহা বলিলেন,- “ভো গৌতম! আমি এই দৃষ্টিসম্পন্ন ও এই মতবাদী হই,- ‘সর্ববিধ (পুনরুৎপত্তি ) আমার পছন্দ বা মনোনীত নহে’।”
“অগ্গিবেশ্মন ! এই যে তোমার দৃষ্টি- ‘সর্ব আমার মনোনীত নহে’, তোমার এই দৃষ্টিও কি অমনোনীত?”
“ভো গৌতম! যদি এই দৃষ্টি আমার পছন্দ হয়, তবে তাহাও তাদৃশ হইবে- তাহাও হইবে তথৈবচ।”
“এই কারণেই, অগ্গিবেশ্মন! জগতে ইহাদের (মত ত্যাগী) অপেক্ষা তাহাদের সংখ্যাই বহু হইতে বহুতর হয়, যাহারা এরূপ বলে,- ‘তাহাও তদ্রূপ হইবে, তাহাও হইবে তথৈবচ।’ কিন্তু তাহারা সেই পূর্বদৃষ্টিও ত্যাগ করে না, বরং অপর নূতন মতবাদও গ্রহণ করিয়া বসে। অগ্গিবেশ্মন! ইহাদের (অত্যাগী) অপেক্ষা এরূপ লোকেরাই জগতে অল্প হইতে স্বল্পতর; যাহারা বলে,- ‘তাহাও তাদৃশই হয়, তাহাও হয় তথৈবচ।’ কিন্তু তাহারা সেই মূলদৃষ্টিও ত্যাগ করে না এবং অন্য নবদৃষ্টিও গ্রহণ করে না। অগ্গিবেশ্মন! কোন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ এই মতবাদী ও এই দৃষ্টিসম্পন্ন, (১) ‘সর্ব আমার পছন্দ হয়।’ ...... কোন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ ...... দৃষ্টিসম্পন্ন আছে- যাহারা বলে (২) ‘সমস্ত আমার পছন্দ নহে।’ অগ্গিবেশ্মন! কোন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ এই মতবাদী ও এই দৃষ্টিসম্পন্ন আছে- (৩) ‘কিছু আমার পছন্দ আর কিছু অপছন্দ’।”
“অগ্গিবেশ্মন! তথায় যে সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণ এই মতবাদী ও এই দৃষ্টিসম্পন্ন- ‘সর্বমত আমার পছন্দ হয়’ তাহাদের এই দৃষ্টি (ধর্ম-বিশ্বাস) সরাগাবস্থার (রাগবশে সংসারাবর্তে অনুরক্ত হইবার) সমীপে, সংযোগের সমীপে, অভিনন্দনের সমীপে, অধ্যবসান বা প্রার্থনার সমীপে, উপাদান বা দৃঢ়-গ্রহণের সমীপে অগ্রসর হয়। তাহাতে অগ্গিবেশ্মন! যে সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণ ...... এই দৃষ্টি মান্য করে,- ‘সর্বমত আমার মনপূত নহে,’ তাহাদের এই দৃষ্টি অ-সরাগ, অসংযোগ, অনভিনন্দন, অনধ্যবসান ও অনুপাদানের সমীপবর্তী হয়।”
২০২। এইরূপ উক্ত হইলে দীঘনখ পরিব্রাজক ভগবানকে বলিলেন,- “মাননীয় গৌতম আমার দৃষ্টিকে (মতবাদকে) উৎকর্ষণ (প্রশংসা) ও সমুৎকর্ষণ করিতেছেন।”
“অগ্গিবেশ্মন! তাহাতে যে সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণ আছে এরূপবাদী ও দৃষ্টিসম্পন্ন- ‘সমস্ত আমার পছন্দ হয়।’ এ সম্বন্ধে বিজ্ঞ-পুরুষ এই প্রকার বিচার করেন- এই যে আমার দৃষ্টি- ‘সমস্ত আমার পছন্দ হয়’, এই দৃষ্টিকে যদি আমি শক্তভাবে পরামর্ষণ করিয়া (জড়িত হইয়া) আগ্রহ সহকারে ব্যবহার করি- ‘ইহাই সত্য অন্য সব মিথ্যা’, তবে দুই মতবাদীর সহিত আমার বিগ্রহ (কলহ) হইবে,- (১) যে সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণ এই মতবাদী ও দৃষ্টিসম্পন্ন,- ‘সমস্ত আমার পছন্দ নহে।’ আর (২) যে সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণ এই মতবাদী ও দৃষ্টিসম্পন্ন- ‘একাংশ আমার পছন্দ, একাংশ অপছন্দ হয়।’ এই দুইজনের সাথে আমার বিগ্রহ হইবে। বিগ্রহ হইলে বিবাদ হইবে, বিবাদ হইলে বিঘাত (মনকষ্ট) হইবে, বিঘাত হইলে বিদ্বেষ হইবে। এই কারণে সে নিজের মধ্যে বিগ্রহ, বিবাদ, বিঘাত ও বিদ্বেষের সম্ভাবনা দর্শন করিয়া সেই প্রাক্তন দৃষ্টিকেই পরিত্যাগ করে এবং অন্য নূতন দৃষ্টিও গ্রহণ করে না। এ প্রকারে এই সকল দৃষ্টির পরিত্যাগ হয়।”
২০৩। “অগ্গিবেশ্মন! যে সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণ ...... দৃষ্টিসম্পন্ন- ‘সমস্ত আমার মনপূত নহে’, তৎসম্বন্ধে বিজ্ঞব্যক্তি এরূপ বিচার করেন- এই যে আমার দৃষ্টি- ‘আমার সমস্ত পছন্দ নহে’, যদি আমি সাগ্রহে এই দৃষ্টি ব্যবহার করি, তবে দুইজনের সাথে আমার বিগ্রহ হইবে,- (১) যে এই দৃষ্টি মানে,- ‘আমার সমস্ত পছন্দ হয়’, তাহার সহিত; (২) আর যে এই দৃষ্টি মানে,- ‘আমার কিছু পছন্দ, কিছু অপছন্দ হয়, তাহার সাথে। এই দুইজনের সাথে আমার বিগ্রহ হইবে ......। এ প্রকারে এই সকল দৃষ্টির পরিত্যাগ হয়।”
২০৪। “অগ্গিবেশ্মন! এই বিষয়ে যে সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণ ..... এই দৃষ্টি মান্য করে- আমার কিছু পছন্দ, কিছু অপছন্দ।’ এসম্বন্ধে বিজ্ঞব্যক্তি এই বিবেচনা করেন- এই যে আমার দৃষ্টি- ‘আমার কিছু পছন্দ, কিছু অপছন্দ ......। তবে দুইজনের সাথে আমার বিগ্রহ হইবে- (১) ...... ‘আমার সমস্ত পছন্দ হয়’, আর (২) ...... ‘আমার সমস্ত পছন্দ নহে।’ এই দুইজনের সাথে আমার বিগ্রহ হইবে ......। এই প্রকারে এ সকল দৃষ্টির পরিত্যাগ হয়।”
২০৫। “অগ্গিবেশ্মন! এই দেহ রূপীয় (জড়) চারি মহাভূতময়, মাতৃপিতৃ সম্ভূত (মাতা-পিতা হইতে উৎপন্ন), অন্ন-ব্যঞ্জন বর্ধিত, অনিত্য-উৎসাদন (বিনাশন)-ভেদন-বিধ্বংসন স্বভাব; ইহাকে অনিত্যভাবে দুঃখ, রোগ, গণ্ড, শল্য, অঘ (পাপ), ব্যাধি, পরকীয়, শূন্য ও অনাত্মভাবে সন্দর্শন করা উচিত। এই দেহকে অনিত্যভাবে ...... ও অনাত্মভাবে সন্দর্শনকারী ব্যক্তির দেহের প্রতি যে দেহানুরাগ, দৈহিক ্লেহ, দেহান্বয়তা (সম্বন্ধভাব) তাহা প্রহীণ হয়।”
“অগ্গিবেশ্মন! এই ত্রিবিধ বেদনা (অনুভূতি) (১) সুখ-বেদনা, (২) দুঃখ-বেদনা ও (৩) অদুঃখ-অসুখ বেদনা। অগ্গিবেশ্মন! যখন জীবের সুখ-বেদনা অনুভূত হয় তখন দুঃখ-বেদনা ও অদুঃখ-অসুখ বেদনা অনুভূত হয় না। সেই সময় কেবল সুখ-বেদনাই অনুভূত হইয়া থাকে। অগ্গিবেশ্মন! (জীব) যে সময় দুঃখ-বেদনা অনুভব করে ......। যে সময় অদুঃখ-অসুখ বেদনা অনুভব করে, সে সময় তাহার অপর (দুই) বেদনা অনুভূত হয় না। সুতরাং অগ্গিবেশ্মন! সুখ-বেদনাও অনিত্য, সংস্কৃত, প্রতীত্য-সমুৎপন্ন (কারণ-জাত), ক্ষয়ধর্মী, ব্যয়ধর্মী বিরাগধর্মী, নিরোধধর্মী হয়। দুঃখ-বেদনা এবং অদুঃখ-অসুখ বেদনাও তদ্রূপ অনিত্য ...... ও নিরোধধর্মী হয়।”
“অগ্গিবেশ্মন! এ প্রকারে দর্শন করিয়া শ্রুতবান আর্যশ্রাবক সুখ-বেদনার প্রতিও নির্বেদ প্রাপ্ত (উদাসীন) হয়, দুঃখ-বেদনার প্রতিও ......। অদুঃখ-অসুখ বেদনার প্রতিও নির্বেদ প্রাপ্ত হয়। নির্বেদ প্রাপ্ত হইয়া বিরক্ত হয়, বিরাগ হেতু বিমুক্ত হয়, বিমুক্ত হইলে (আমি) ‘বিমুক্ত’ এই জ্ঞানোদয় হয়, জন্মক্ষয় হয়, ব্রহ্মচর্য পূর্ণ হয়, করণীয় কৃত হয়, এখন ইহার (মুক্তির) নিমিত্ত অপর কর্তব্য নাই জানিতে পারে। অগ্গিবেশ্মন! এ প্রকারে বিমুক্তচিত্ত ভিক্ষু কাহারও সহিত সংবাদ করে না, কাহারও সহিত বিবাদ করে না; জগতে যাহা কথিত হয়, অপরামর্ষ (নিরাসক্ত) ভাবে শুধু তদ্বারাই সে ভিক্ষু ব্যবহার করে।”
২০৬। সেই সময় আয়ুষ্মান সারিপুত্র ভগবানকে পাখা করিতে করিতে ভগবানের পশ্চাতে স্থিত ছিলেন। তখন আয়ুষ্মান সারিপুত্রের ইহা মনে হইল,- ‘ভগবান আমাদিগকে অভিজ্ঞা দ্বারা সেই সেই (আস্রব) ধর্মের ত্যাগ বলিলেন, সুগত আমাদিগকে অভিজ্ঞা দ্বারা জ্ঞাত হইয়া সেই সেই আস্রব ধর্মের প্রহাণ বলিলেন।’ এ প্রকারে ইহা প্রত্যবেক্ষণ করিতে করিতে আয়ুষ্মান সারিপুত্রের চিত্ত উপাদানহীন (অনুৎপাদ নিরোধে নিরুদ্ধ) হইয়া আস্রবরাশি হইতে মুক্ত হইল। আর তথায় দীঘনখ পরিব্রাজকের বিরজ, বিমল ধর্ম-চক্ষু (স্রোতাপত্তি জ্ঞান) উৎপন্ন হইল,- ‘যাহা কিছু সমুদয় ধর্ম, তৎসমস্ত নিরোধ স্বভাব হয়’।
অতঃপর দীঘনখ পরিব্রাজক দৃষ্ট-ধর্ম, প্রাপ্ত-ধর্ম, বিদিত-ধর্ম, অবগাহিত ধর্ম, উত্তীর্ণ-সংশয়, বিগত-সন্দেহ, বৈশারদ্য-প্রাপ্ত, শাস্তার শাসনে পর-প্রত্যয়হীন (প্রত্যক্ষদর্শী) হইয়া ভগবানকে ইহা বলিলেন,- “আশ্চর্য, ভো গৌতম! অতি চমৎকার, ভো গৌতম! যেমন হে গৌতম! অধঃমুখকে ঊর্ধমুখ করে ...... চক্ষুষ্মানেরা রূপ দর্শনের নিমিত্ত তৈল-প্রদীপ ধারণ করে, সেইরূপ মাননীয় গৌতম দ্বারা অনেক পর্যায়ে ধর্ম প্রকাশিত হইয়াছে। আমি মাননীয় গৌতমের শরণ গ্রহণ করিতেছি, ধর্মেরও সংঘেরও ......। আজ হইতে মাননীয় গৌতম আমাকে আজীবন শরণাগত উপাসকরূপে ধারণা করুন।”
॥ দীঘনখ সূত্র সমাপ্ত ॥