ভূমিকা

বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রের সূত্র পিটক পাঁচ নিকায় বা ভাগে বিভক্ত। উহার দ্বিতীয় বা মধ্যম নিকায়ের দ্বিতীয় অংশে পঞ্চাশটি সূত্র সন্নিবিষ্ট হইয়াছে। মহাস্থবির ধর্মাধার ভিক্ষু দ্বিতীয় অংশের বঙ্গানুবাদ করিয়া বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করিয়াছেন।

মধ্যম নিকায়ের বিশেষত্ব এই যে, ইহাতে দর্শন ও সাধনমার্গের বিশদ ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ পাওয়া যায়। এই নিকায়ের সূত্রাবলী সুপ্রাচীন ও ভগবান বুদ্ধের সমসাময়িক রচনা। মনে হয় ভগবান বুদ্ধ শ্রাবস্তী ও রাজগৃহেই অধিকাংশ সময় অবস্থান করিতেন। ধর্ম দেশনার উদ্দেশ্যে তিনি পর্যটন করিয়াছেন নানা দেশ- পূর্বে অঙ্গদেশে চম্পা (ভাগলপুর), পশ্চিমে অবন্তীদেশে উজ্জয়িনীর নিকটবর্ত্তী মথুরা এবং উত্তরে কুরুদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল তাঁহার পরিক্রমণ পথ। তাঁহার পঞ্চাশটি সূত্রের মধ্যে আঠারটি কোশলে, এগারটি মগধে, চৌদ্দটি অঙ্গদেশে এবং দুইটি করিয়া কাশী ও কুরুদেশে ও একটি করিয়া ভর্গদেশ, কোশাম্বী ও অবন্তীতে দেশিত হইয়াছিল। যাঁহাদের উদ্দেশ্যে ভগবান বুদ্ধ এই সূত্রগুলি দেশনা করিয়াছিলেন তাঁহারা নানা শ্রেণীর মানুষ- কেহ রাজা, কেহ গৃহপতি, কেহ ব্রাহ্মণ, কেহ ভিক্ষু ও কেহ বা পরিব্রাজক। তাঁহাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য- (১) রাজা প্রসেনজিৎ ও তাঁহার রাণী মল্লিকা এবং ভর্গদেশের বোধিরাজকুমার; (২) গৃহপতি জীবক, উপালি ও পঞ্চকঙ্গস্থপতি; (৩) পরিব্রাজক অগ্নিবৎস, দীর্ঘনখ ও বৈখানস্‌; (৪) ভিক্ষু সারিপুত্র, উদায়ী, অশ্বজিৎ, মালুঙ্ক্যপুত্র ও রাহুল; (৫) ব্রহ্মায়ু কৈনেয়জটিল, অশ্বলায়ণ ও বসিষ্ঠ। এই বিশিষ্ট ব্যক্তিদের বা শ্রোতৃবর্গকে উদ্দেশ্য করিয়াই ভগবান বুদ্ধের উক্ত পঞ্চাশটি সূত্রের অধ্যায় ভাগ ও নামকরণ হইয়াছে, যথা- গৃহপতি, ভিক্ষু, পরিব্রাজক, রাজা ও ব্রাহ্মণ।

ভগবান যে সময়ে ধর্মপ্রচার আরম্ভ করেন সে সময়ে মগধে ও কোশলে অনেক প্রকার ধর্মমত প্রচলিত ছিল। উহা লক্ষ্য করিয়া ‘অরিয়পরিয়সেনা সুত্তে’ এই উক্তি আছে “পাতুরহোসি মগধেসু পূব্বে ধম্মো অসুদ্ধো সমলেহি চিন্তিতো”। এই সব প্রচলিত ধর্মমত হইতে বৌদ্ধ ধর্মমতের কি পার্থক্য ও বিশেষত্ব তাহাই গৌতম বুদ্ধকে তাঁহার ধর্মপ্রচারের প্রথমাবস্থায় বুঝাইতে হইয়াছে। এই সব ধর্মাবলম্বীরাও অনেক সময় বুদ্ধদেবের সঙ্গে তাঁহাদের ধর্মমত লইয়া আলোচনা করিতেন।

অবৌদ্ধ ধর্মমত

ভগবান বুদ্ধের কয়েকটি দেশনায় অবৌদ্ধ ধর্মমতের ও সাধন প্রক্রিয়ার অসারতাই দেখানো হইয়াছে। কয়েকজন পরিব্রাজক ভগবান বুদ্ধকে প্রশ্ন করেন,- জগৎ শাশ্বত, না অশাশ্বত? আত্মা ও শরীর এক, না পৃথক? নির্বানের পর বুদ্ধের অস্তিত্ব থাকে কিনা? ইতাদি। ভগবান বুদ্ধ প্রশ্নগুলির কোন উত্তর দেন না- প্রশ্নগুলির অবাস্তবতাই অব্যাকৃতির কারণ। প্রশ্নকর্তারা যেন আকাশকুসুমের রঙ্‌ বুঝিতে চাহেন। জানিতে চাহেন, তাহাদের গন্ধ আছে কিনা। আত্মার অস্তিত্ব বা নাস্তিত্ব সম্বন্ধে বৌদ্ধমত হইতেছে যে, উহা একেবারে অবাস্তব- আকাশকুসুমের ন্যায়। জগৎ বিকল্প মাত্র। উহার নিত্যতা বা অনিত্যতার প্রশ্ন উঠে না। সেইজন্য এই ধরণের প্রশ্নকে তিনি “অব্যাকৃত” বলিয়া ক্ষান্ত হইয়াছেন। ভগবান বুদ্ধের মতে এই ধরণের প্রশ্নের সমাধানে প্রশ্নকর্তা মুক্তি পায় না। তাঁহার মেধাশক্তির অপব্যয় হয় মাত্র।

শুধু পরিব্রাজক নয়, বিভিন্ন ধর্মাচার্যগণও অনুরূপ প্রশ্নের অবতারণা করিতেন। তাঁহাদের মধ্যে ছিলেন, অজিৎ কেশকম্বলী, প্রকুধকাত্যায়ন, পূর্ণকাশ্যপ, মস্করিন্‌ গোশালপুত্র, সঞ্জয় বৈরট্টপুত্র ও নির্গন্থ নাথপুত্র। ইহাদের মধ্যে প্রথম তিনজন ছিলেন- ঘোর জড়বাদী, চতুর্থ আচার্য ছিলেন নিয়তিবাদী। এই চার আচার্যের দার্শনিক মতাবলম্বীদের বুদ্ধদেব আখ্যা দিয়াছিলেন ‘অব্রহ্মচর্যাবাসী’ পঞ্চম আচার্য ছিলেন সঠিক জ্ঞানাভাববাদী- এঁরই শিষ্য ছিলেন সারিপুত্র ও মৌদ্গল্যায়ন। ষষ্ঠ আচার্য হইতেছেন- সুবিখ্যাত জৈনধর্ম প্রতিষ্ঠাতা মহাবীর।

জৈনধর্মে শীলরক্ষা কর্মবাদ ও পুনর্জন্মবাদ গৃহীত হইয়াছে। সেইজন্য ভগবান বুদ্ধ এই ধর্মমতকে পৃথকভাবে আলোচনা করিয়াছেন। গৃহপতি উপালী ও অভয়রাজকুমার জৈনধর্মাবলম্বী ছিলেন। দেবদত্তও মনে হয় জৈনধর্মের দ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়া বুদ্ধ বিদ্বেষী হইয়াছিলেন।

পূর্বোক্ত প্রথম পাঁচটি দার্শনিক মত সম্বন্ধে গৌতম বুদ্ধের বিশেষ আপত্তি ছিল। কারণ জৈনদর্শন ব্যতীত অন্যান্য মতবাদগুলিতে পাপ ও পুণ্যের স্থান নাই। ইঁহারা কর্মফলে ও পুনর্জন্মে বিশ্বাস করিতেন না। বৌদ্ধ, জৈন ও ব্রাহ্মণ্য ধর্মাদিতে কর্মফল ও পুনর্জন্মের অস্তিত্ব বহু প্রমাণাদির দ্বারা নিরুপিত হইয়াছে। প্রাণীহত্যায় পাপ নাই, দয়া ও দানে পুণ্য নাই- আধ্যাত্মিক ও বাহ্যিকভাবে পরীক্ষা করিয়া এই ধারণাকে ভগবান বুদ্ধ অমূলক বলিয়া দেখাইয়াছেন।

জৈন ধর্মমত

জৈনধর্ম সম্বন্ধে উপালি গৃহপতি সঙ্গে বুদ্ধের যে কথোপকথন হয় তাহাতে দেখা যায়, জৈনমতে মানসিক কর্ম অপেক্ষা কায়িক কর্মে বেশী গুরুত্ব আরোপ করা হইয়াছে। কারণ জৈন দার্শনিকদের মতে প্রাণীহত্যায় যত পাপ, প্রাণীহত্যার চিন্তায় তত পাপ নাই। বুদ্ধদেব তাঁহাদের সঙ্গে একমত হইতে পারেন নাই। কারণ অনেক সময় মানুষের অনিচ্ছাকৃত প্রাণীহত্যাও সংঘটিত হইতে পারে এবং সেইজন্য হত্যাকারীকে পাপী বলা যায় না। “মনোপুব্বংগমা ধম্মা মনোসেট্‌ঠা মনোময়া” এই উক্তি দ্বারা বুদ্ধদেব বলেন যে, সমস্ত কার্য করিবার পূর্বে মন ক্রিয়াশীল হয়। সুতরাং মানসিক কর্মকে সর্বাপেক্ষা গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এই মনোভাব লইয়াই বুদ্ধদেব ভিক্ষুদের মাংসভক্ষণ পর্যন্ত নিষিদ্ধ করেন নাই। তিনি নির্দেশ দিয়াছেন যে, যদি ভিক্ষুরা অদৃষ্ট, অশ্রুত, অচিন্তিত ও অনুুদ্দিষ্ট মাংস ভক্ষণ করেন তাহাতে আপত্তি নাই। এই গ্রন্থে পঞ্চান্ন সংখ্যক সূত্রে উপাসক জীবক এই প্রশ্ন উত্থাপন করিয়াছিলেন। ইহার উত্তরে বুদ্ধদেব বলিয়াছিলেন যে, তাঁহার শিষ্যেরা সকলেই মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষা এই চারিটি ব্রহ্মবিহারের সাধনা করেন। সুতরাং তাঁহাদের পক্ষে প্রাণীহত্যা করিয়া তাহার মাংস ভক্ষণ অসম্ভব। “মনোকম্ম”কে প্রধান্য দেওয়াতে বুদ্ধদেব জৈন মতবাদকে গ্রহণ করেন নাই। এই কায়কর্ম্মের উপর গুরুত্ব আরোপ করায় জৈন আচার্যেরা কায়িক সংযমের জন্য যে প্রক্রিয়ার ব্যবস্থা দিয়াছেন। তাহা অতি কঠোর এবং বুদ্ধদেবের মতে নিষ্ফল। কয়েকটি সূত্রে জৈন ও অন্যান্য সমপ্রদায়ের সন্ন্যাসীদের মধ্যে কায়িক সংযমের জন্য যে সমস্ত কঠোর ব্যবস্থা ছিল তাহার নমুনা স্বরূপ তালিকা কয়েকটি সূত্রে দেওয়া আছে। এই তালিকা হইতে বেশ প্রতীয়মান হয় যে, সন্ন্যাসীরা কঠোর সাধনাদ্বারা এই জন্মে কষ্ট পায় এবং পরজন্মেও তাহার দরুণ কোন সুফল হয় না। বুদ্ধদেব ইহাই লক্ষ্য করিয়া তাঁহার “মধ্যপথের” নির্দেশ দিয়াছিলেন। তাঁহার মতে চিত্তকে নিষ্কলুষ না করিয়া কেবলমাত্র শারীরিক সংযমে কোন সুফল হয় না। ঊর্ধবাহু বা কণ্টকশয্যাশায়ী সন্ন্যাসীর চিত্তে যদি অনুরাগ, হিংসা ও মোহ থাকে তাহা হইলে তাহার কৃচ্ছ্রসাধনার কোন ফল নাই। অনর্থক শারীরিক কষ্ট সহ্য করা মাত্র। ভগবান বুদ্ধ নিজে এই কৃচ্ছ্র সাধনার চরমে গিয়াছিলেন এবং উহাতে তিনি সিদ্ধিলাভ করিতে পারেন নাই। সেইজন্য তিনি ‘মধ্যপথের’ নির্দেশ দিয়াছিলেন।

ব্রাহ্মণ্য ধর্ম

ব্রাহ্মণ্য দর্শনের প্রতিবাদ পালিশাস্ত্রে প্রায় বিরল। কেবল যাগযজ্ঞের নিরর্থকতা, যজ্ঞে পশুবলির নির্মমতা ও জাতিভেদে ব্রাহ্মণের প্রাধান্যের অযৌক্তিকতা পুনঃ পুনঃ উল্লিখিত হইয়াছে।

কোন কোন সূত্রে বেদের অপৌরুষেয়তার প্রতিবাদ আছে। ভগবান বুদ্ধ বলেন যে, ঋক্‌বেদের মন্ত্রগুলি কায়েকজন সু-ব্রাহ্মণ মহর্ষি দ্বারা রচিত। এই মহর্ষিরা কোনদিনই ঈশ্বরকে স্বচক্ষে সাক্ষাৎ করেন নাই এবং করিয়াছেন বলিয়াও কোন উক্তি নাই। সেইজন্য বেদ পুরুষকৃত, অপৌরুষেয় নয়।

জাতিভেদের অযৌক্তিকতা কয়েকটি সূত্রে আলোচিত হইয়াছে। ভগবান বুদ্ধ বলেন, সদ্‌বংশজাত ব্রাহ্মণদের মধ্যে যদি কেহ শিক্ষা ও চর্চায় ব্যাপৃত থাকে ও শুচিভাবে জীবনযাপন করে, আর যদি কেহ প্রাণীহত্যা ও চৌর্যবৃত্তি অবলম্বন করে- তাহা হইলে এই দুই প্রকার ব্র্রাহ্মণদের কি এক পর্যায়ে স্থান দেওয়া উচিত? তিনি আরও বলেন, যদি কেহ নিকৃষ্ট বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াও দয়াশীল ও শীলবান হয় ও পুণ্যকার্যে ব্যাপৃত থাকে- তাহা হইলে তিনি দুঃশ্চরিত্র ও পাপকার্যে লিপ্ত ব্রাহ্মণ অপেক্ষাও উচ্চস্থান অধিকার করিবে না, কে ইহার মধ্যে নির্বান বা মুক্তি লাভ করিবে? মানুষের জন্ম ও মৃত্যুতে কোন পার্থক্য নাই, তাহাদের পার্থক্য হয় কর্মেতে। সেইজন্য জাতিভেদে বিশ্বাস অযৌক্তিক।

অবৌদ্ধমত লইয়া যে সমস্ত আলোচনা এই গ্রন্থে নিবদ্ধ হইয়াছে তাহার সামান্য আভাষ দিলাম। এইবার বৌদ্ধধর্ম ও সাধনা সম্বন্ধে যে সমস্ত উক্তি আছে তাহার ইঙ্গিত দিতে চেষ্টা করিব।

বৌদ্ধধর্ম ও সাধনার মার্গ

এই গ্রন্থের প্রায় প্রত্যেক সূত্রে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সাধনার নির্দেশ আছে। সাধনার আনুপূর্বিক ধারাও কোন কোন সূত্রে লিপিবদ্ধ হইয়াছে। তবে প্রত্যেক ভিক্ষুকে যে সেই একই ধারা অবলম্বন করিতে হইবে এইরূপ কোন বিধান নাই। যে সমস্ত সাধনার নির্দেশ এই গ্রন্থে আছে তাহার মর্ম এইরূপ ঃ-

(১) ব্রহ্মচর্য পালন বা সাত্ত্বিকভাবে জীবনযাপন। পালিভাষায় বলে “সিক্‌খাসাজীবসমাপন্নো” অর্থাৎ শীলচর্চ্চা ও দৈনিক জীবনযাপনে আত্মসংযম। যে সমস্ত অকুশল কর্ম হইতে ভিক্ষুদের বিরত হইতে হইবে তাহা এই ঃ-

(ক) জীবহিংসা, অদত্তদ্রব্য গ্রহণ, অব্রহ্মচর্য, মিথ্যাবচন বা হিংসাসূচক অনর্থক বচনাদি, বীজ ও বৃক্ষের অনিষ্ট সাধন।

(খ) নৃত্যগীতবাদ্য-উপভোগ, মালা-গন্ধ-বিলেপন ব্যবহার, স্বর্ণরৌপ্য গ্রহণ, অরন্ধিত ধান্য ও মাংস গ্রহণ, স্ত্রী-পুরুষ-কুমারী-দাস-দাসী বা পর্শ্বাদি গ্রহণ।

(গ) দৌত্যকার্য, বাণিজ্য, বন্ধনাদি।

(ঘ) মধ্যাহ্নের পর আহার, চীবরাদি পছন্দ করা, ইত্যাদি।

মোটের উপর ভিক্ষুদের প্রয়োজন অল্পাহার, যৎসামান্য চীবর, শয্যা, আসন ইত্যাদির ব্যবহার অর্থাৎ যাহাতে শরীর সুস্থ ও সবল থাকে। লোভ ও আকাঙ্খা সম্পূর্ণরূপে ত্যাগ করিয়া বিহারে বাস ও চিত্ত স্থির করিবার প্রয়াস। বিহারে বাস করার নিয়মাদি পালন।

(২) ত্রয়োদশ ধুতাঙ্গ। যদিও ভগবান বুদ্ধ কৃচ্ছ্র সাধনার পক্ষপাতী ছিলেন না তবুও যে সমস্ত ভিক্ষুদের চিত্ত কৃচ্ছ্র সাধনার দিকে আকৃষ্ট হইত তাঁহাদের জন্য তের রকম কঠোর সাধনের ব্যবস্থা দিয়াছিলেন, যেমন সদাসর্বদা অরণ্যে বাস, ভিক্ষোপলব্ধ আহারই একমাত্র উপজীবিকা, শ্মশানে বাস, ছিন্ন ও ত্যক্ত বস্ত্রখণ্ড হইতে চীবর ব্যবহার ইত্যাদি।

(৩) ইন্দ্রিয় সংযম। ইন্দ্রিয় সংযমের উপর ভগবান বুদ্ধ বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করিয়াছেন। পঞ্চিন্দ্রিয়ের দ্বারা উপলব্ধ বিষয়াদির প্রতি চিত্তকে নিরপেক্ষ রাখা। ইহাকে পালিভাষায় বলে “পঞ্চকামগুণা” হইতে বিরতি। জগতে সর্ববিষয় সম্বন্ধে নির্লিপ্ত ও নির্বিকার মনোভাব পোষণ করা এবং ঐ উদ্দেশ্যে সদাসর্বদা সচেতন থাকা। আহারাদির পর নির্জনে চিত্তস্থির করার প্রয়াস।

(৪) চৈতসিক ক্লেশ ও উপক্লেশাদি বর্জন। আধ্যাত্মিক উন্নতি ও নির্বানমার্গে অগ্রসর হইবার একমাত্র উপায় চিত্তের বিশুদ্ধতা, অর্থাৎ চিত্তের উপক্লেশাদিকে নির্মূল করা। উপক্লেশাদি অনেক প্রকার, তন্মধ্যে উল্লেখ্য অতি- লোভ, হিংসা, অলসতা, ঔদ্ধত্য, সন্দিগ্ধতা, আত্মা বা জগতের অস্তিত্বে বিশ্বাস, ত্রিরত্নে শ্রদ্ধাভাব, ব্রত ও আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকলাপের সার্থকতায় আস্থা স্থাপন, ইত্যাদি।

(৫) নির্বানমার্গের উচ্চতর সাধনা।

পূর্বোক্ত বিধানগুলি সাধারণভাবে সকল ভিক্ষুকে পালন করিতে হয়। তবে উচ্চস্তরে যে সমস্ত সাধনার ব্যবস্থা আছে তাহাদের মধ্যে বিশেষ সাধনপথকে সাধকেরা স্ব স্ব শরীর ও মনোভাব অনুযায়ী বাছিয়া লইতে পারেন। ভগবান বুদ্ধ তাঁহার শিষ্যদের মনোভাব পরীক্ষা করিয়া সাধনামার্গ নির্দেশ করিয়া দিতেন। কোন ভিক্ষুকে হয়ত শ্মশানে শব সাধনা করিতে দিতেন, আবার কাহাকেও বা মনোরম ফুলের বাগানে সুন্দর ফুল বা গন্ধকে ধ্যানের বিষয় করিতে বলিতেন। কাহাকেও চতুর্থধ্যান বা অষ্টধ্যান বা চতুর্ব্রহ্মবিহার ইত্যাদি সাধনা করিতে বলিতেন। আবার কাহাকেও কেবলমাত্র শাস্ত্রাভ্যাসের জন্য নির্দেশ দিতেন এবং উহার দ্বারা তাহার চিত্তের স্থৈর্যেরমার্গ দেখাইয়া দিতেন। সেইজন্য পালিশাস্ত্রে সাইত্রিশটি বোধিপক্ষীয় ধর্মের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই সাইত্রিশটি ধর্মের যে কোনও একটি বা দুইটি সাধনার দ্বারা মোক্ষ লাভ হইতে পারে। এই ধর্মগুলির ব্যাখ্যা এই গ্রন্থের অনেক সূত্রে আছে। ধর্মগুলির একটি তালিকা দিয়াই ক্ষান্ত হইলাম ঃ-

(ক) চার প্রকার উদ্যম (প্রধান)। যেমন, চিত্তে অকুশল চিন্তা আসিতে না দেওয়া ইত্যাদি।

(খ) চার প্রকার অত্যুদ্যম (ঋদ্ধিপাদ)। যেমন, সমাধির জন্য ব্যগ্রতা, বীর্যপ্রয়োগ ইত্যাদি।

(গ) পাঁচরকম চিত্তপ্রয়োগ (ইন্দ্রিয়)। যথা- শ্রদ্ধা, বীর্য, স্মৃতি ইত্যাদি বৃদ্ধির জন্য মানসিক প্রযত্ন।

(ঘ) পাঁচরকম চিত্তশক্তি অর্জন। যেমন, শ্রদ্ধাশক্তি, স্মৃতিশক্তি ইত্যাদি।

(ঙ) সাতরকম বোধিজ্ঞানলাভের অঙ্গবিশেষ। যেমন, ধর্মবিশ্লেষণ, চিত্তের প্রীতি ও প্রশমতা, উপেক্ষা ইত্যাদি লাভ।

(চ) অষ্টপর্যায় মার্গ। যেমন, বৌদ্ধ দার্শনিক মত গ্রহণ (সম্যকদৃষ্টি), কায়িক ও বাচনিক সংযম ও চিত্তের স্থৈর্য।

(ছ) চারপ্রকার স্মৃতিমান হওয়ার উপায়। কায়িক কর্মাদির প্রত্যবেক্ষণ, সুখ, দুঃখ, অদুঃখাসুখ ভাবাদির অনুধাবন, চৈতসিক ক্রিয়াদি ও সাধনার ক্রমোন্নতি লাভের দিকে দৃষ্টি।

(৬) ধ্যান ও সমাধি। বৌদ্ধ সাধনার মার্গে ধ্যান ও সমাধি ব্যতীত আধ্যাত্মিক উন্নতি হইতে পারে না। সেইজন্য সকল সাধককে প্রথম চারটি ধ্যানে সর্বাঙ্গীন পূর্ণতা লাভ করিতে হইবে। তারপর যাঁহারা সক্ষম হইবেন তাঁহারা আরও চারিটি সমাপত্তির সাধনা করিবেন। প্রথম চারটি ধ্যান চিত্তে উপেক্ষাভাবজনিত হয় ও দ্বিতীয় চারিটি সমাপত্তিতে জগতের জীব ও বস্তু সম্বন্ধে একপ্রকার ভাব জ্ঞান হয়।

(৭) স্মৃত্যপস্থান। ভগবান বুদ্ধ কোন কোন সূত্রে বলিয়াছেন যে, একমাত্র স্মৃত্যুপস্থান ভাবনার দ্বারা মুক্তিলাভ হয়। চারপ্রকার স্মৃত্যুপস্থানের কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে এবং গ্রন্থে বিশদভাবে ব্যাখ্যা করা আছে।

(৮) ব্রহ্মবিহার। বিশ্বের সর্বজীবের প্রতি মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষাচিত্ত হওয়ার জন্য ভগবান বুদ্ধ কোন কোন সাধকের জন্য বিশেষ ব্যবস্থাও দিয়াছেন। বিশেষতঃ গৃহী বা বোধিসত্ত্বদের জন্য। এই চারিটি সাধনার মধ্যে “মুদিতা” সাধনা বিশেষ কঠিন। কারণ সাধকের মনোভাব এমনি করিতে হয় যে, সাধক তাহার নিজের ক্ষতি স্বীকার করিয়াও শত্রুর উন্নতি সাধনে প্রীতিলাভ করিবেন। এই গ্রন্থের মাঝে মাঝে দার্শনিক মতের আলোচনাও আছে। যেমন, মহারাহুলোবাদ সূত্রে ভগবান বুদ্ধ বলিয়াছেন যে, জীব চিত্ত ও চারি মহাভূতের সমষ্টি। এই চিত্ত বা মহাভূতের স্বকীয় সত্ত্বা নাই এবং উহাকে নিত্য আত্মা বলিয়া গ্রহণ করা ভূল। উহার অনিত্যতা ও অনাত্মতা উপলব্ধিতে সম্যক্‌ জ্ঞানলাভ হয় এবং তাহাতেই মুক্তি পাওয়া যায়।

দুই রকম সাধনার পথে ক্রমোন্নতির স্তর

এই গ্রন্থে ভিক্ষুদের সাধনার পথে ক্রমোন্নতির স্তরগুলি সম্বন্ধে কয়েকটি উক্তি আছে। সাধারণতঃ চারিটি কিম্বা আটটি স্তরের কথা প্রচলিত আছে; যেমন, স্রোতাপত্তিমার্গস্থ ও ফলস্থ, সকৃদাগামীমার্গস্থ ও ফলস্থ, অনাগামীমার্গস্থ ও ফলস্থ এবং অর্হত্বমার্গস্থ ও ফলস্থ। এই চার বা আট স্তরের মধ্যে অনেক অনুস্তর নির্ণীত হইয়াছে। যেমন কায়সাক্ষী, দৃষ্টিপ্রাপ্ত, শ্রদ্ধাবিমুক্তধর্মানুসারী, শ্রদ্ধানুসারী, উভতোভাগোবিমুক্ত (৮৫ পৃঃ) প্রজ্ঞাবিমুক্তি (১১১ পৃঃ) ইত্যাদি। অনুস্তরের বিবৃতি হইতে জানা যায় যে, সাধকদের কেহ শ্রদ্ধামার্গ এবং কেহ বা প্রজ্ঞামার্গ গ্রহণ করেন। এই দুই মার্গই নির্বানপ্রাপ্তির পথ।

নির্বান

নির্বান যে কি তাহা ভগবান বুদ্ধ পরিষ্কার করিয়া বলেন নাই। তাহার কারণ নির্বানের বিবৃতি দেওয়া যায় না; উহা কেবলমাত্র উপলব্ধির বিষয়। মহামালুঙ্ক্য সূত্রে এই মাত্র বলা হইয়াছে যে, নির্বান শান্ত, শ্রেষ্ঠ তৃষ্ণাক্ষয়, সর্বসংস্কারের সমতা। সর্বজাগতিক বিষয় বর্জন ও তাহার বিরাগ ও নিরোধ। এক কথায় নির্বান অনির্বচনীয় পরমার্থ চিত্তবিমুক্তি ও পুনর্জন্মনিঃশেষ।

এই গ্রন্থের কয়েকটি সূত্রে ভগবান বুদ্ধের পূর্বজন্ম ও জীবনীর উল্লেখ আছে। আর কয়েকটি সূত্রে আছে তাঁহার কয়েকজন বিশিষ্ট শিষ্যের জীবনী- যেমন, রাষ্ট্রপাল, অঙ্গুলিমাল। এই সঙ্গে অশ্বজিৎ, পুনর্বসু ও রাহুলের জন্য ধর্মদেশনা এবং রাজা প্রসেনজিৎ ও তাঁহার কর্মচারী পঞ্চকঙ্গস্থপতির সহিত কথোপকথন- বৌদ্ধ সাহিত্য ও ধর্মজীবনে ইহার মূল্য অপরিমেয়।

অনুবাদক মহাস্থবির ধর্মাধার ভিক্ষু এই অমূল্যগ্রন্থের অনুবাদ করিয়া দেশের ও দশের বহু উপকার সাধন করিলেন এবং নিজেরও সাধনায় এক স্তর উপরে উঠিলেন। ভগবান তথাগতের বাণী প্রকাশনায় ও তাহার পঠন ও পাঠনে পুণ্য ও সার্থকতা অনেক। আশা করি এই গ্রন্থের দ্বারা তাহা সাধিত হইবে।
ইতি-

নলিনাক্ষ দত্ত

পালি বিভাগের অধ্যক্ষ ও অধ্যাপক

কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়

বৈশাখী পূর্ণিমা, ১৩৬৫ বঙ্গাব্দ।