মধ্যম-নিকায় (২য় খন্ড)
মধ্যম পঞ্চাশ সূত্র
আমি এইরূপ শুনিয়াছি ঃ-
১। এক সময় ভগবান মহাভিক্ষুসংঘের সহিত চম্পানগর সমীপে অবস্থান করিতেছিলেন,- গগ্গরা পুষ্করিণী-তীরে চম্পক-বনে। তখন হস্ত্যারোহী (মাহুত) পুত্র পেস্স ও পরিব্রাজক কন্দরক ভগবত সমীপে উপস্থিত হইলেন। উপস্থিত হইয়া হস্ত্যারোহী-পুত্র পেস্স ভগবানকে অভিবাদন পূর্বক একান্তে উপবেশন করিলেন। পরিব্রাজক কন্দরক ভগবানের সহিত প্রীতি-সম্ভাষণ করিলেন, সম্মোদনীয় ও স্মরণীয় কথা শেষ করিয়া এক প্রান্তে দাঁড়াইলেন। এক প্রান্তে স্থিত পরিব্রাজক কন্দরক তুষ্ণীভূত ভিক্ষুসংঘের দিকে অবলোকন করিয়া ভগবানকে বলিলেন ঃ-
“আশ্চর্য, ভো গৌতম! অদ্ভুত, ভো গৌতম! ভগবান গৌতম কর্তৃক ভিক্ষুসংঘ এতদূর সম্যক্ প্রতিপাদিত (উত্তমরূপে নিয়ন্ত্রিত)। ভো গৌতম! অতীতকালে যে সকল অর্হৎ সম্যক্সম্বুদ্ধ ছিলেন, সেই সম্যক্সম্বুদ্ধগণও ভিক্ষুসংঘকে এই পরিমাণই সুনিয়ন্ত্রণ করিয়াছিলেন, যেমন অধুনা ভিক্ষুসংঘ ভগবান গৌতম কর্তৃক সুনিয়ন্ত্রিত। ভো গৌতম! অনাগতে যাঁহারা সম্যকসম্বুদ্ধ হইবেন, সেই ভগবানগণও ভিক্ষুসংঘকে এই পরিমাণ সম্যক্ প্রতিপন্ন করিবেন; আধুনিক ভিক্ষুসংঘ ভগবান গৌতম কর্তৃক যেরূপ সুনিয়ন্ত্রিত।”
২। “কন্দরক! তাহা সত্যই, তাহা যথার্থই। হে কন্দরক! যাঁহারা অতীতকালে অর্হৎ সম্যক্সম্বুদ্ধ ছিলেন, সেই সকল ভগবানও ভিক্ষুসংঘকে এই পরিমাণই সম্যক্ প্রতিপাদিত করিয়াছিলেন; যেমন অধুনা আমা কর্তৃক ভিক্ষুসংঘ সম্যক্ প্রতিপাদিত। কন্দরক! অনাগতে যে সকল অর্হৎ সম্যক্সম্বুদ্ধ হইবেন, তাঁহারাও ভিক্ষুসংঘকে এই পরিমাণ সম্যক্ প্রতিপাদন করিবেন, যেমন অধুনা আমা কর্তৃক ভিক্ষুসংঘ সম্যক্ প্রতিপাদিত। কন্দরক! এই ভিক্ষুসংঘে ক্ষীণাস্রব ব্রহ্মচর্যব্রত-উদ্যাপিত, কৃত-করণীয়, অপনীত-ভার, সদর্থ-অনুপ্রাপ্ত, ভব-সংযোজন পরিক্ষীণ, সম্যক্জ্ঞান দ্বারা বিমুক্ত অনেক অর্হৎ ভিক্ষু বিদ্যমান আছে। কন্দরক! এই ভিক্ষু-সংঘে সন্তত (সতত) শীল, সন্তত বৃত্তি, প্রজ্ঞাবান, প্রজ্ঞাজীবী, শৈক্ষ্য (শিক্ষাব্রতী) বহু ভিক্ষু আছে যাহারা চতুর্বিধ স্মৃত্যুপস্থানে সুপ্রতিষ্টিত চিত্ত হইয়া অবস্থান করে। কোন্ চতুর্বিধ স্মৃতুপস্থানে? কন্দরক! এই শাসনে বীর্যবান, সমপ্রজ্ঞান, স্মৃতিমান ভিক্ষু লোকে (উপাদানস্কন্ধে) অভিধ্যা (লোভ), দৌর্মনস্য (দ্বেষ) বিনোদন পূর্বক রূপ-কায়ে কায়ানুদর্শী...... , বেদনাসমূহে বেদনানুদর্শী...... , চিত্তে চিত্তানুদর্শী...... ও ধর্মে ধর্মানুদর্শী হইয়া অবস্থান করে ।
৩। এইরূপ উক্ত হইলে হস্ত্যাচার্য্য-পুত্র পেস্স ভগবানকে বলিল, “অতি চমৎকার ভন্তে! অতি অদ্ভুত ভন্তে! সত্ত্বগণের বিশুদ্ধির নিমিত্ত, শোক-পরিদেবনের সম্যক্ অতিক্রমের নিমিত্ত, দুঃখ দৌর্মনস্যের অন্তসাধনের নিমিত্ত, জ্ঞানের (আর্য-মার্গের) অধিগমের জন্য এবং নির্বান সাক্ষাৎকারের জন্য ভগবান কর্তৃক এই চতুর্বিধ স্মৃতি-উপস্থান এমন সুন্দররূপে দেশিত হইয়াছে। প্রভো! শ্বেতবসনধারী আমরা গৃহীরাও সময় সময় এই চতুর্বিধ স্মৃতি-উপস্থানে সুপ্রতিষ্ঠিত চিত্ত হইয়া অবস্থান করি। ভন্তে! আমরা অভিধ্যা দৌর্মনস্য দমন পূর্বক বীর্যবান, প্রজ্ঞাবান ও স্মৃতিমান হইয়া কায়ে কায়ানুদর্শী......, বেদনা সমূহে বেদনানুদর্শী......., চিত্তে চিত্তানুদর্শী......, ধর্মে ধর্মানুদর্শীরূপে অবস্থান করি।
“অতি আশ্চর্য, ভন্তে! অতিশয় অদ্ভুত, ভন্তে! এইরূপ মনুষ্য-গাম্ভীর্য , মনুষ্য-কলুষ ও মনুষ্য-শঠতা বিদ্যমান সত্ত্বেও ভন্তে ভগবন! সত্ত্বগণের হিতাহিত মার্গ পরিজ্ঞাত আছেন। ভন্তে! মানুষেরা গভীর, পশুরা অগভীর। ভন্তে! যতক্ষণের মধ্যে হস্তীগুলি (হস্তীশালা হইতে) চম্পানগরে যাতায়াত করিবে এবং যে সমস্ত শঠতা , কূটতা , বঙ্কতা ও জিহ্মভাব (চতুর্বিধ শারীরিক ক্রিয়া) প্রদর্শন করিবে, আমি সেই সকল হস্তী-চরিত্র স্মরণ করাইতে সমর্থ। প্রভু! আমাদের দাস, প্রেস্য (ভৃত্য) ও কর্মচারীগণ শারীরিক একপ্রকার আচরণ করে, বাচনিক একপ্রকার আচরণ করে, অথচ তাহাদের চিত্ত ভিন্নরূপে থাকে। আশ্চর্য ভন্তে! অদ্ভুত ভন্তে! এইরূপ মনুষ্য-গাম্ভীর্য, এইরূপ মনুষ্য-কলুষ, এইরূপ মনুষ্য-শঠতা বিদ্যমান সত্বেও সত্ত্বগণের হিতাহিত (প্রতিপদা) এতদূর অবগত আছেন। ভন্তে! মানুষেরা অতিগভীর, পশুরা অগভীর (স্থূলবুদ্ধি, সরল)।”
৪। “উহা সেইরূপই পেস্স! উহা তদ্রূপই পেস্স! ইহারাই গভীর যথা মানুষেরা, ইহারা অগভীর যথা পশুরা। পেস্স! জগতে চারিপ্রকার পুদ্গল (ব্যক্তি) বিদ্যমান দেখা যায়; চারি প্রকার কি কি? (১) এখানে এক প্রকার পুদ্গল আত্মন্তপী ও আত্মপরিতাপানুযোগে (পরিতাপানুষ্ঠানে) নিযুক্ত, (২) একপ্রকার পুদ্গল পরন্তপ হয় ও পর পরিতাপানুযোগে নিয়োজিত, (৩) কোন ব্যক্তি আত্মপরন্তপ ও আত্ম-পরতাপানুযোগে নিযুক্ত থাকে, (৪) আর কোন ব্যক্তি আত্মন্তপ নহে আত্মন্তপানুযোগে নিযুক্ত নহে, পরন্তপও নহে পরন্তপানুযোগে নিযুক্তও নহে; সেই অনাত্মন্তপ অপরন্তপ মহাপুরুষই ইহ জীবনে তৃষ্ণা-মুক্ত, নিবৃত, শীতিভূত (তৃষ্ণাশীতল) সুখ অনুভব করিতে করিতে স্বয়ং ব্রহ্মভূত হইয়া অবস্থান করে। পেস্স! এই চতুর্বিধ পুদ্গলের মধ্যে কোন্ প্রকার পুদ্গল তোমার চিত্ত আরাধিত করে?”
“ভন্তে! যে ব্যক্তি আত্মন্তপ, আত্ম-পরিতাপানুযোগে নিযুক্ত, সে আমার চিত্ত আরাধিত করে না। ভন্তে! যে ব্যক্তি পরন্তপ, পরপরিতাপানুযোগে নিযুক্ত, এই ব্যক্তিও আমার চিত্ত আরাধিত করে না। আর ভন্তে! যে ব্যক্তি আত্মন্তপ আত্মপরিতাপানুযোগে নিযুক্ত ও পরন্তপ পরপরিতাপানুযোগে নিযুক্ত সেও আমার চিত্ত আরাধিত করে না; পরন্তু ভন্তে! যে ব্যক্তি আত্মন্তপ ও আত্মপরিতাপানুযোগে নিযুক্ত নহেন এবং পরন্তপ ও পরপরিতাপানুযোগে নিযুক্তও নহেন, সেই অনাত্মন্তপ ও অপরন্তপ পুরুষই যিনি ইহ জীবনে তৃষ্ণাহীন, নিবৃত, (শান্তিপ্রাপ্ত), শীতলীভূত, সুখানুভবকারী ও স্বয়ং ব্রহ্মভূত হইয়া অবস্থান করেন; তিনিই আমার চিত্ত আরাধিত করেন।”
৫। “কেন পেস্স! এই ত্রিবিধ পুদ্গল তোমার চিত্ত আরাধিত করে না?”
“ভন্তে! যে ব্যক্তি আত্মন্তপ ও আত্মন্তপানুযোগে নিযুক্ত, সে দুঃখবিরোধী সুখকামী নিজকে সন্তপ্ত করে, পরিতপ্ত করে; সেই কারণে এই ব্যক্তি আমার চিত্ত আরাধিত করিতে পারে না। ভন্তে! যে ব্যক্তি পরন্তপ ও পরপরিতাপানুযোগে নিযুক্ত, সে সুখকামী দুঃখবিরোধী পরকে সন্তপ্ত করে, পরিতপ্ত করে; সে কারণে এই ব্যক্তিও আমার চিত্ত আরাধিত করে না। এবং যে ব্যক্তি আত্মন্তপ আত্মপরিতাপানুযোগে নিযুক্ত ও পরন্তপ, পরপরিতাপানুযোগে নিযুক্ত, সে সুখকামী ও দুঃখ ঘৃণাকারী নিজকে এবং পরকে সন্তপ্ত করে, পরিতপ্ত করে; সে কারণে সেই ব্যক্তিও আমার চিত্ত আরাধিত করে না। অপিচ ভন্তে! যে ব্যক্তি আত্মন্তপ নহেন, আত্মতাপানুযোগে নিযুক্ত নহেন এবং পরন্তপ নহেন, পরপরিতাপানুযোগে নিযুক্ত নহেন; সেই অনাত্মন্তপ ও অপরন্তপ পুরুষই ইহ জীবনে তৃষ্ণামুক্ত, নিবৃত, শীতলীভূত, সুখ প্রতিসংবেদী ও স্বয়ং ব্রহ্মভূত হইয়া অবস্থান করেন। সেই কারণেই তিনি আমার চিত্ত আরাধিত করেন। উত্তম ভন্তে! এখন আমরা যাই, আমাদের বহু কৃত্য বহু করণীয়।”
“হাঁ, পেস্স! এখন তুমি যাহা উচিত মনে কর।” অতঃপর হস্ত্যাচার্য-পুত্র পেস্স ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন ও অনুমোদন করিয়া আসন হইতে উঠিল এবং ভগবানকে অভিবাদন পূর্বক প্রদক্ষিণ করিয়া প্রস্থান করিল।
৬। তখন হস্ত্যাচার্য-পুত্র পেস্স প্রস্থান করিলে অনতিবিলম্বে ভগবান ভিক্ষুদিগকে আহ্বান করিলেন,-
“ভিক্ষুগণ! হস্ত্যাচার্য-পুত্র পেস্স পণ্ডিত, ভিক্ষুগণ! মহাপ্রাজ্ঞ হস্ত্যাচার্য-পুত্র পেস্স। ভিক্ষুগণ! আমি এই চতুর্বিধ ব্যক্তি সম্বন্ধে বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করা পর্যন্ত যদি পেস্স মুহুর্তকাল অবস্থান করিত তবে তাহার মহৎ অর্থ (স্রোতাপত্তি ফল) সংযুক্ত (লাভ) হইত । অথচ ইহাতেও হস্ত্যাচার্য পুত্র পেস্স মহৎ অর্থের (সংঘে প্রসাদ ও স্মৃতি-উপস্থানে কৌশল্যের) অধিকারী হইল।”
“ভগবান! এই চতুর্বিধ পুদ্গল সম্বন্ধে বিস্তৃতভাবে বিভাগ করুন। ভগবান! উহার এই কাল; সুগত! এই উপযুক্ত সময়। ভগবানের ধর্মোপদেশ শ্রবণ করিয়া ভিক্ষুরা ধারণ করিবেন।”
“তাহা হইলে ভিক্ষুগণ! শ্রবণ কর, উত্তমরূপে মনে রাখ, আমি বর্ণনা করিব।”
“হাঁ, ভন্তে!” বলিয়া ভিক্ষুগণ ভগবানকে প্রতিশ্রুতি জ্ঞাপন করিলেন। ভগবান এই প্রকারে বলিলেন-
৭। “ ভিক্ষুগণ! কোন্ ব্যক্তি আত্মন্তপ, আত্মপরিতাপানুযোগে নিযুক্ত?
ভিক্ষুগণ! জগতে কোন কোন ব্যক্তি অচেলক (দিগম্বর), আচার-মুক্ত, হস্তাবলেহী হয়; ‘আসুন, ভদন্ত!’ বলিলে আসে না, ‘তিষ্ঠ, ভদন্ত!’ বলিলে দাঁড়ায় না, পূর্বাহরিত, [তাহার] উদ্দেশ্যে সজ্জিত ভিক্ষা ও নিমন্ত্রণ গ্রহণ করে না। সে কুম্ভী (কলস) মুখে [প্রদত্ত ভিক্ষা] গ্রহণ করে না, খড়োপি (খল্লিকা, খোলা?) মুখে প্রদত্ত ভিক্ষা গ্রহণ করে না; ফলকান্তর (তক্তার অন্তরাল হইতে প্রদত্ত), দণ্ডান্তর, মুসলান্তর, ভোজন পরায়ণ দুইজনের, গর্ভিণীর, স্তন্যদায়িনীর, পুরুষান্তর-গতা স্ত্রীর ও সংকীর্তিত (ভেরি-বিঘোষিত) ভিক্ষা গ্রহণ করে না। যেখানে কুকুর উপস্থিত থাকে এবং যেখানে মক্ষিকা দলবদ্ধভাবে বিচরণ করে তথায় ভিক্ষান্ন গ্রহণ করে না। মৎস্য-মাংস ভোজন করে না, সুরা, মৈরেয় ও থুসোদক (কাঁজি?) পান করে না; সেই ব্যক্তি এক গৃহে ভিক্ষা করে, এক গ্রাস মাত্র ভোজন করে; দুই গৃহে ভিক্ষা করে, দুই গ্রাসে যাপন করে, সপ্ত গৃহে ভিক্ষা করে, সপ্ত গ্রাস ভোজী হয়। এক দত্তি (পাত্র বিশেষ) দ্বারা যাপন করে, দুই দত্তি দ্বারা যাপন করে, সপ্ত দত্তি দ্বারা যাপন করে। একদিন অন্তর আহার গ্রহণ করে, দুইদিন অন্তর আহার গ্রহণ করে, সপ্তাহ অন্তর আহার গ্রহণ করে। এইরূপে এমন কি অর্ধমাস অন্তর পর্যায়ক্রমে অন্ন-ভোজন-ব্রতে নিরত থাকিয়া অবস্থান করে। শাক ভোজী হয়, শ্যামাক (কাঁচাশাক) ভোজী হয়, নীবার (বন্য ধান) ভোজী হয়, দর্দুর (চর্মকার ত্যক্ত ময়লা) ভোজী হয়, শৈবাল ভোজী হয়, কণ্ (তণ্ডুলাংশ) ভোজী হয়, আচাম (দগ্ধান্ন) ভোজী হয়, পিনাক (তিলকল্ক) ভোজী হয়, তৃণ ভোজন করে, অথবা গোময় ভক্ষণ করে। বন-ফল-মূল আহার করে ও স্বয়ং পতিত ফল ভোজন করিয়া যাপন করে। সে শণ-বস্ত্র পরিধান করে, মশান-বস্ত্র পরিধান করে, শব-বস্ত্র পরিধান করে, পাংশুকূল (ধূলি মিশ্র বস্ত্র) ধারণ করে, তিরীট (বৃক্ষছাল) ধারণ করে, মৃগচর্ম পরিধান করে, চর্ম নির্মিত পোষাক ব্যবহার করে, কুশচীর ধারণ করে, বল্কল বস্ত্র পরিধান করে, (কাষ্ঠ) ফলক-বস্ত্র পরিধান করে, কেশ কম্বল ব্যবহার করে, বাল কম্বল ধারণ করে এবং উলুক পালক ধারণ করে। কেশ-শ্মশ্রু মুণ্ডিত হয়, কেশ-শ্মশ্রু মুণ্ডণ-ব্রতে নিযুক্ত থাকে, আসন পরিত্যাগ করিয়া ঊর্ধস্থিত বা দণ্ডায়মান থাকে। উৎকুটিক হয়, উৎকুটিক যোগাসনে তৎপর থাকে। কণ্টকশায়ী হয়, কণ্টক শয্যায় শয়ন করে। সন্ধ্যা পর্যন্ত তিনবার উদকে অবগাহন করে, উদকাবগাহন-ব্রতে নিযুক্ত থাকে। এইরূপে বিবিধ কায়িক আতাপন পরিতাপন ব্রত অনুষ্ঠানে তৎপর থাকিয়া অবস্থান করে। ভিক্ষুগণ! এই ব্যক্তিই আত্মন্তপ, আত্মপরিতাপ ব্রতানুষ্ঠানে নিয়োজিত। (১)
৮। “ভিক্ষুগণ! কোন ব্যক্তি পরসন্তাপী, পর সন্তাপজনক কার্যে নিরত? ভিক্ষুগণ! এখানে কোন ব্যক্তি মেষ (উরম্ভ) ঘাতী, শূকর ঘাতক, পক্ষীহন্তা, মৃগ-শিকারী, ব্যাধ, মৎস্যঘাতী, চোর, চোর-ঘাতক ও কারাগার রক্ষী হয়, অথবা যাহারা অপর কোন নিষ্ঠুর কর্মে নিরত থাকে। ভিক্ষুগণ! এই ব্যক্তিই পরন্তপ, পরসন্তাপ জনক কার্যে নিরত।” (২)
৯। “ভিক্ষুগণ! কোন্ ব্যক্তি আত্মন্তপ- আত্মপরিতাপ জনক কার্যে নিযুক্ত ও পরন্তপ- পরিতাপানুযোগে নিযুক্ত? ভিক্ষুগণ! জগতে কোন কোন ব্যক্তি মূর্ধাভিষিক্ত (মুকুটাভিষিক্ত) ক্ষত্রিয়রাজা কিংবা মহাশাল ব্রাহ্মণ হন, তিনি নগরের পূর্বদিকে অভিনব যজ্ঞশালা (সন্থাগার) নির্মাণ করিয়া, কেশ শ্মশ্রু মুণ্ডন করিয়া সখুর মৃগচর্ম পরিধান করেন, ঘৃত ও তৈল দ্বারা শরীর মর্দন (সংবাহন) করেন, মৃগ-শৃঙ্গ দ্বারা পৃষ্ঠদেশ কণ্ডুয়ণ করিতে করিতে (স্বীয়) মহিষী ও পুরোহিত ব্রাহ্মণ সহ যজ্ঞশালায় প্রবেশ করেন। তিনি অন্তর (বিছানা) হীন ভূমিতে সবুজতৃণে শয্যা রচনা করেন। সমবর্ণ বৎসবতী এক গাভীর প্রথম স্তনে যে দুধ হয়, তদ্বারা রাজা দিন যাপন করেন। দ্বিতীয় স্তনের দুধ দ্বারা মহিষী যাপন করেন, তৃতীয় স্তনের দুধ দ্বারা পুরোহিত ব্রাহ্মণ যাপন করেন ও চতুর্থ স্তনের দুধ দ্বারা (তাঁহারা) অগ্নি-হোম (জুহন) করেন। অবশিষ্ট ক্ষীরদ্বারা বাছুর জীবন ধারণ করে। সে রাজা আদেশ করেন, ‘যজ্ঞের নিমিত্ত এতগুলি বৃষ ...... এতগুলি বাছুর (বৎসতর) ...... , বৎসতরী ...... , ভেড়া হত্যা করা (বলি দেওয়া) হউক। যূপ-কাষ্ঠের জন্য এত সংখ্যক বৃক্ষ ও যজ্ঞ-ভূমির ঘেরা ও আচ্ছাদনের নিমিত্ত এই পরিমাণ দর্ভ (কুশ) তৃণ ছেদন করা হউক।’ যে সকল দাস, ভৃত্য, কর্মচারী তথায় থাকে; তাহারাও দণ্ড-তর্জ্জিত ভয়-তর্জ্জিত সাশ্রুনয়নে রোদন করিতে করিতে ইহার আয়োজন করে। ভিক্ষুগণ! এই ব্যক্তিই আত্মন্তপ- আত্মপীড়া জনক ব্রতানুষ্ঠানে নিরত এবং পরন্তপ- পরদুঃখজনক কর্মানুষ্ঠানে নিয়োজিত।” (৩)
১০। “ভিক্ষুগণ! কোন্ ব্যক্তি আত্মন্তপ নহে- আত্মন্তপজনক কার্যেও নিয়োজিত নহে এবং পরন্তপ নহে- পরন্তপ জনক কার্যেও নিয়োজিত নহে? কে সেই অনাত্মন্তপ- অপরন্তপ ব্যক্তি যে ইহজীবনে তৃষ্ণামুক্ত, নির্বাপিত, শীতি-ভূত স্বয়ং সংভোগ করিতে করিতে ব্রহ্মভূত হইয়া অবস্থান করে?” (৪)
“ভিক্ষুগণ! ইহ জগতে তথাগত উৎপন্ন হন, যিনি অর্হৎ, সম্যক্সম্বুদ্ধ, বিদ্যাচরণ-সম্পন্ন, সুগত, লোকবিদ্, দম্য-পুরুষের অনুত্তর সারথি, দেব-মানুষের শাস্তা (শিক্ষাদাতা), বুদ্ধ ভগবান; তিনি দেব, মার, ব্রহ্মা, শ্রমণ-ব্রাহ্মণ সহ জীবলোককে স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা প্রত্যক্ষ করিয়া [উহাদের স্বরূপ] জ্ঞাপন করেন। তিনি ধর্ম প্রচার করেন- যাহার আদিতে কল্যাণ, মধ্যে কল্যাণ, অন্তে কল্যাণ এবং যাহা অর্থ ও ব্যঞ্জনযুক্ত। তিনি সর্বাঙ্গ পরিপূর্ণ ও পরিশুদ্ধ ব্রহ্মচর্য প্রকাশ করেন। কোন গৃহপতি, গৃহপতি পুত্র কিংবা অন্যতর নীচকুলোদ্ভব কোন লোক সেই ধর্ম শ্রবণ করে, সে সেই ধর্ম শ্রবণ করিয়া তথাগতের প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধান্বিত হয়। সে সেই শ্রদ্ধাসম্পদে যুক্ত হইয়া এইরূপ বিচার করে, ‘গার্হস্থ্য জীবন বাধাবহুল (সম্বাধ) রজঃপথ, প্রব্রজ্যা উন্মুক্ত আকাশবৎ প্রশস্ত; গার্হস্থ্য জীবনে অবস্থান করিয়া একান্ত পরিপূর্ণ শুভ্র-শঙ্খ সন্নিভ সর্বাঙ্গ পরিশুদ্ধ ব্রহ্মচর্য আচরণ সহজ নহে। অতএব আমার পক্ষে কেশ-শ্মশ্রু মুণ্ডন করিয়া কাষায় বস্ত্র পরিধান পূর্বক আগার হইতে নিষ্ক্রমণ এবং অনাগারিক প্রব্রজ্যা গ্রহণ করাই উত্তম’। অতঃপর সে অল্প ভোগৈশ্বর্য এবং অল্প জ্ঞাতিসঙ্ঘ কিংবা বিশাল জ্ঞাতিসঙ্ঘ পরিত্যাগ করিয়া কেশ-শ্মশ্রু মুণ্ডন পূর্বক কাষায়বসন পরিধান করে এবং আগার হইতে অনাগারিকরূপে প্রব্রজিত হয়।”
১১। “এই প্রকারে প্রব্রজিত অবস্থায় সে ভিক্ষুজনোচিত শিক্ষা ও জীবিকা পরায়ণ হইয়া প্রাণী-হত্যা চেতনা পরিহার পূর্বক প্রাণীহিংসা হইতে প্রতিনিবৃত্ত হয়, দণ্ড বিরহিত, অস্ত্রবিরহিত, হিংসায় লজ্জাশীল, জীবের প্রতি দয়া পরায়ণ, সর্বপ্রাণী ও সর্বভূতের হিতানুকম্পী হইয়া জীবন যাপন করে। অদত্তাদান (চৌর্য) পরিহার করিয়া অদত্তাপহরণ হইতে প্রতিবিরত হয়; শুধু দত্ত-গ্রাহী ও দত্ত-প্রত্যাশী হইয়া সে অচৌর্যে পবিত্রান্তঃকরণে জীবন যাপন করে। অব্রহ্মচর্য পরিহার পূর্বক সে ব্রহ্মচারী হয়, গ্রাম্যাচার মৈথুন হইতে দূরে থাকে, সম্পূর্ণ বিরত হয়। মৃষাবাদ পরিহার করিয়া মিথ্যা বলা হইতে প্রতিবিরত হয়, সে সত্যবাদী, সত্যসন্ধ, সত্যেস্থিত, লোকের বিশ্বস্ত ও অবিসংবাদী হয়। পিশুন (ভেদ) বাক্য পরিত্যাগ করিয়া সে পিশুন-বাক্যে বিরত হয়, এখানে শুনিয়া ইহাদের ভেদের নিমিত্ত অন্যত্র বলে না, অন্যত্র শুনিয়া উহাদের ভেদ সংঘটনের জন্য এখানে বলে না। এইরূপে সে বিচ্ছিন্নের মিলন কর্তা, সম্মিলিতদের উৎসাহদাতা, সমগ্রারাম, সমগ্ররত, সমগ্রানন্দ ও ঐক্যকর বাক্য ভাষণ করে। পরুষ (কর্কশ) বাক্য পরিত্যাগ করিয়া পরুষ-বাক্য-বিরত হয়, যে সকল বাক্য নির্দোষ, শ্রুতি-মধুর, প্রীতিজনক, হৃদয়গ্রাহী, নাগরিক (পৌরী), বহুজন প্রিয়, বহুজন সন্তোষজনক, তাদৃশ বাক্য ভাষণ করে। সমপ্রলাপ পরিত্যাগ করিয়া সে বৃথা-বাক্যে বিরত হয়, কালবাদী, ভূতবাদী, অর্থ-বাদী, বিনয়-বাদী যথাসময় যুক্তি উপমা সহ নিধানযোগ্য বাক্য বলে, যাহা পরিচ্ছদ যুক্ত ও অর্থসমন্বিত। সে বীজগ্রাম ভূত-গ্রাম গ্রহণ হইতে প্রতিবিরত হয়। সে বিকাল-ভোজন বিরত রাত্রি উপবাসী, দৈনিক একবার ভোজন করে। নৃত্য-গীত-বাদ্য-উৎসব (বিসূক)- দর্শনে বিরত হয়। মালা-গন্ধ-বিলেপন ধারণ-মণ্ডণ-বিভূষণস্থানীয় দ্রব্য ব্যবহারে প্রতিবিরত হয়। উচ্চ শয্যা-মহাশয্যা প্রতিবিরত হয়। জাত-রূপ-রজত গ্রহণে প্রতিবিরত হয়; আমক (কাঁচা) ধান্য গ্রহণে বিরত হয়; কাঁচা মাংস গ্রহণে প্রতিবিরত হয়; স্ত্রী-কুমারী গ্রহণে প্রতিনিবৃত্ত হয়; দাস-দাসী গ্রহণে প্রতিনিবৃত্ত হয়; ছাগল-ভেড়া গ্রহণে প্রতিবিরত হয়’ কুক্কুট-শূকর গ্রহণে প্রতিবিরত হয়; হস্তী-গো-অশ্ব-বড়বা (অশ্বতরী) গ্রহণে প্রতিবিরত হয়; ক্ষেত্র-বাস্তু প্রতিগ্রহণে বিরত হয়; দৌত্যকর্মে প্রেরণ-গ্রহণের উদ্যোগ হইতে প্রতিবিরত হয়; ক্রয়-বিক্রয় হইতে প্রতিবিরত হয়; তুলাকূট -কাংস্যকূট (আঢ়ক)-পরিমাণ কূট হইতে প্রতিবিরত হয়; উৎকোচ্ গ্রহণ-প্রবঞ্চনা-মায়া-কুহক হইতে প্রতিবিরত হয়; ছেদন-বধ-বন্ধন-বিপর্যয়-বিলোপসাধন-দুঃসাহসিক (ডাকাতি) কার্য হইতে প্রতিবিরত হয়। সে দেহরক্ষার উপযোগী চীবর ও ক্ষুন্নিবৃত্তির উপযোগী ভিক্ষান্নে সন্তুষ্ট থাকে। যেদিকে যায় সমুদয় লইয়াই প্রস্থান করে, যেমন- পক্ষী শকুন যেখানে যায় স্ব-পক্ষ ভারেই উড়িয়া যায়; সেইরূপ এই ভিক্ষু দেহরক্ষার উপযোগী চীবর ও ক্ষুন্নিবৃত্তির উপযোগী ভিক্ষান্ন দ্বারা সন্তুষ্ট থাকে আর যেখানে যায় সমস্ত লইয়াই প্রস্থান করে। সে এইরূপে আর্যশীলস্কন্ধে সমন্বিত হইয়া আধ্যাত্মিক অনবদ্য সুখ অনুভব করে।”
১২। “সে চক্ষুদ্বারা রূপ (দৃশ্য) দর্শন করিয়া নিমিত্ত-গ্রাহী ও অনুব্যঞ্জন-গ্রাহী হয় না, যে কারণে চক্ষু-ইন্দ্রিয় অসংযত বিহারীর অভিধ্যা, দৌর্মনস্যাদি পাপ অকুশল-ধর্ম (বৃত্তি) সমূহ অনুস্রাবিত হয়। সে উহার সংযমের নিমিত্ত প্রতিপন্ন হয়; চক্ষু-ইন্দ্রিয় রক্ষা করে, চক্ষু-ইন্দ্রিয়ে সংযত হয়। শ্রোত্রদ্বারা শব্দ শ্রবণ করিয়া ? পূঃ ? , ঘ্রাণদ্বারা গন্ধ আঘ্রাণ করিয়া ? পূঃ ? , জিহ্বাদ্বারা রস আস্বাদন করিয়া ? পূ ? , কায়দ্বারা স্পৃষ্টব্য স্পর্শ করিয়া ? পূঃ ? , মনদ্বারা ধর্ম বিজ্ঞাত হইয়া নিমিত্তগ্রাহী ও অনুব্যঞ্জন গ্রাহী হয় না; যে কারণে মনেন্দ্রিয় অসংযত বিহারীর অভিধ্যা, দৌর্মনস্য প্রভৃতি পাপ অকুশল ধর্ম অনুস্রাবিত হয়; উহার সংযমার্থ প্রতিপন্ন হয়, মনেন্দ্রিয় রক্ষা করে, মনেন্দ্রিয়ে সংযত হয়, সে এই আর্য ইন্দ্রিয় সংবরে সংযত হইয়া আধ্যাত্মিক অব্যাসেক (নির্লিপ্ত) সুখ অনুভব করে।”
“সে অভিগমনে, প্রত্যাগমনে সমপ্রজ্ঞান অনুশীলন করে; অবলোকনে, বিলোকনে সমপ্রজ্ঞান অনুশীলন করে; সঙ্কোচনে, প্রসারণে সমপ্রজ্ঞান অনুশীলন করে; সংঘাটি-পাত্র-চীবর ধারণে সমপ্রজ্ঞান অনুশীলন করে; ভোজনে, পানে, খাদনে, আস্বাদনে সমপ্রজ্ঞান অনুশীলন করে, মল-মূত্র ত্যাগে সমপ্রজ্ঞান অনুশীলন করে; গতিতে, স্থিতিতে, উপবেশনে, শয়নে, জাগরণে, ভাষণে, তুষ্ণীভাবে সমপ্রজ্ঞান অনুশীলন করে।”
১৩। “সে এই আর্য শীলস্কন্ধ দ্বারা (এই আর্য সন্তুষ্টিদ্বারা) সমন্বিত, এই আর্য ইন্দ্রিয় সংবরে সমন্বিত এবং এই আর্য স্মৃতি-সমপ্রজ্ঞান দ্বারা সংযুক্ত হইয়া অরণ্যে, বৃক্ষমূলে, পর্বতে, কন্দরে (গর্তে), গিরিগুহায়, শ্মশানে, বনপ্রান্তে, উন্মুক্তস্থানে ও পলালপুঞ্জে (শস্যহীন তৃণরাশিতে) নির্জন-শয়ন-স্থান আশ্রয় (ভজনা) করে।”
“সে ভিক্ষান্ন সংগ্রহ হইতে প্রত্যাবর্ত্তন করিয়া ভোজনের পর দেহকে সোজা সন্নিবেশ করে এবং পরিমুখে (লক্ষ্যাভিমুখে) স্মৃতি উপস্থাপিত করিয়া পর্যঙ্কাবদ্ধ হইয়া (পদ্মাসনে) উপবেশন করে। সে লোকে অভিধ্যা পরিহারপূর্বক বিগতাভিধ্য-চিত্তে অবস্থান করে, অভিধ্যা হইতে চিত্ত পরিশুদ্ধ করে। ব্যাপাদ-বিদ্বেষ পরিহারপূর্বক অহিংসা চিত্তে সর্বপ্রাণী-ভূত-হিতানুকম্পী হইয়া অবস্থান করে, ব্যাপাদ-বিদ্বেষ হইতে চিত্তকে পরিশুদ্ধ রাখে। স্ত্যান-মিদ্ধ (তন্দ্রালস্য) পরিহার পূর্বক তিনি স্ত্যান-মিদ্ধহীন, আলোক-সংজ্ঞায় উদ্বুদ্ধ, স্মৃতিমান ও সমপ্রজ্ঞানী হইয়া অবস্থান করে; তন্দ্রালস্য হইতে চিত্ত পরিশুদ্ধ করে। ঔদ্ধত্য-কৌকৃত্য পরিহার করিয়া অনুদ্ধত, আধ্যাত্মিক উপশান্ত চিত্তে অবস্থান করে; ঔদ্ধত্য-কৌকৃত্য হইতে চিত্ত পরিশুদ্ধ করে। বিচিকিৎসা (সংশয়) পরিহারপূর্বক সে উত্তীর্ণ বিচিকিৎসা ও কুশল ধর্ম সমূহে অসন্দিগ্ধ (অকথংকথী) হইয়া অবস্থান করে, বিচিকিৎসা হইতে চিত্ত পরিশুদ্ধ রাখে।”
“সে চিত্তের উপক্লেশ ও প্রজ্ঞার দুর্বলকারী এই পঞ্চবিধ নীবরণ পরিহার করিয়া যাবতীয় কামসম্পর্ক হইতে বিবিক্ত হইয়া ও অকুশল চিন্তা হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া সবিতর্ক, সবিচার এবং বিবেকজ প্রীতি-সুখমণ্ডিত প্রথম ধ্যান লাভ করিয়া অবস্থান করে। বিতর্ক-বিচারের উপশমে আধ্যাত্মিক সমপ্রসাদী, চিত্তের একীভাব আনয়নকারী বিতর্ক-বিচারাতীত সমাধিজ প্রীতি-সুখমণ্ডিত দ্বিতীয় ধ্যান অধিগত করিয়া অবস্থান করে। প্রীতির প্রতিও বিরাগী হইয়া উপেক্ষার ভাবে অবস্থান করে, স্মৃতিমান ও সমপ্রজ্ঞাত হইয়া স্বচিত্তে (প্রীতি নিরপেক্ষ) সুখ অনুভব করে; যেই অবস্থাকে আর্যগণ ‘উপেক্ষাসম্পন্ন, স্মৃতিমান ও সুখবিহারী’ আখ্যা দেন সেই তৃতীয় ধ্যান অধিগত করিয়া বিচরণ করে। সর্ববিধ দৈহিক সুখ-দুঃখ পরিত্যাগ করিয়া, পূর্বেই সৌমনস্য-দৌর্মনস্য (মনের হর্ষ-বিষাদ) অস্তমিত করিয়া, নাদুঃখ-নাসুখ, উপেক্ষা ও স্মৃতি দ্বারা পরিশুদ্ধ চিত্তে চতুর্থ ধ্যান লাভ করিয়া অবস্থান করে।”
১৪। “এইরূপে তাহার চিত্ত সমাহিত, পরিশুদ্ধ, পর্যবদাত (পরিষ্কৃত), অনঞ্জন (নিরঞ্জন), উপক্লেশ বিগত, মৃদুভূত, কর্মক্ষম, স্থিত (স্থির) ও আনেঞ্জা প্রাপ্ত (নিষ্কম্প) অবস্থায় সে জাতিস্মর-জ্ঞানাভিমুখে চিত্ত অভিনমিত (নিয়োজিত) করে। সে নানা প্রকারে বহুজন্ম অনুস্মরণ করে, যথা ঃ- একজন্ম, দুইজন্ম, তিনজন্ম, চারিজন্ম, পাঁচজন্ম, দশজন্ম, বিশজন্ম, ত্রিশজন্ম, চল্লিশজন্ম, পঞ্চাশজন্ম, শতজন্ম, সহস্রজন্ম, এমন কি শত-সহস্র জন্ম; অনেক সংবর্ত্তকল্পে, অনেক বিবর্ত্তকল্পে এমন কি অনেক সংবর্ত্ত-বিবর্ত্তকল্পে ঐ স্থানে ছিলাম, এই ছিল আমার নাম, এই গোত্র, এই আমার জাতি-বর্ণ, এই আমার আহার, এইরূপ আমার সুখ-দুঃখ অনুভূতি, এ পর্যন্ত আমার পরমায়ু; সেই আমি তথা হইতে চ্যুত হইয়া ঐ স্থানে উৎপন্ন হই, তথায়ও আমার এই নাম ছিল, এই গোত্র, এই বর্ণ, এই আহার, এই সুখ-দুঃখানুভূতি, এই পর্যন্ত আমার পরমায়ু; সেই আমি তথা হইতে চ্যুত হইয়া এখানে উৎপন্ন হইয়াছি। এইরূপে সে আকার ও উদ্দেশ সহিত নানাধিক পূর্ব-নিবাস অনুস্মরণ করে।”
১৫। “সে এইরূপে সমাহিত ? পূঃ ? অপর সত্ত্বগণের চ্যুতি-উৎপত্তি জ্ঞানের (জন্ম-মৃত্যু রহস্য উদ্ঘাটনের) নিমিত্ত চিত্ত নিয়োজিত করে। সে বিশুদ্ধ মনুষ্যাতীত দিব্যচক্ষু দ্বারা মরণোন্মুখ ও উৎপদ্যমান হীন-উৎকৃষ্ট, সুরূপ-কুরূপ ও সুগতি-দুর্গতি পরায়ণ সত্ত্বগণকে দেখিতে পায়; যথাকর্মানুগ সত্ত্বদিগকে জানিতে পারে, এই (মহানুভব) সত্ত্বগণ কায়দুশ্চরিত যুক্ত, বাক্দুশ্চরিত যুক্ত ও মনোদুশ্চরিত যুক্ত এবং আর্যগণের উপবাদক (নিন্দুক), মিথ্যাদৃষ্টি পরায়ণ ও মিথ্যাদৃষ্টি কর্ম সম্পাদনকারী, ইহারা দেহত্যাগে-মৃত্যুর পর অপায়-দুর্গতি-বিনিপাত-নিরয়ে উৎপন্ন হইয়াছে। অথবা এই সকল মহানুভব জীব কায়-বাক্-মনো সুচরিতযুক্ত, আর্যগণের প্রশংসক, সম্যকদৃষ্টি পরায়ণ ও সম্যকদৃষ্টি প্রণোদিত কর্ম পরিগ্রাহী, ইহারা দেহত্যাগে-মৃত্যুর পর সুগতি-স্বর্গলোকে উৎপন্ন হইয়াছে। এইরূপে সে মনুষ্যাতীত, বিশুদ্ধ, দিব্যচক্ষু দ্বারা ? পূঃ ? যথাকর্মানুগ সত্ত্বগণকে জানিতে পারে।”
১৬। “এইরূপে চিত্ত সমাহিত হইলে ? পূঃ ? সে আস্রব সমূহের ক্ষয়কর জ্ঞানের নিমিত্ত চিত্ত নিয়োজিত করে। সে ইহা দুঃখ সত্য বলিয়া যথার্থরূপে জানে; ইহা দুঃখ সমুদয় সত্য বলিয়া যথার্থরূপে জানে, ইহা দুঃখ নিরোধ সত্য বলিয়া যথার্থরূপে জানে, ইহা দুঃখ নিরোধ গামিনী প্রতিপদা আর্যসত্য বলিয়া যথার্থরূপে জানে; ইহারা আস্রব বলিয়া যথাভূতরূপে জানে, ইহা আস্রব উৎপত্তির কারণ বলিয়া যথাভূতরূপে জানে, ইহা আস্রব নিরোধ বলিয়া যথাভূতরূপে জানে, ইহা আস্রব-নিরোধের উপায় বলিয়া যথাভূতরূপে জানে। এই প্রকারে (আর্যসত্য) জানিবার ও দেখিবার ফলে কামাস্রব হইতে তাহার চিত্ত বিমুক্ত হয়, ভবাস্রব হইতেও চিত্ত বিমুক্ত হয়, দৃষ্টি-আস্রব হইতেও চিত্ত বিমুক্ত হয় এবং অবিদ্যাস্রব হইতেও চিত্ত বিমুক্ত হয়। ‘বিমুক্তিতে বিমুক্ত’ তাহার এই জ্ঞানোদয় হয়; পুনর্জন্ম ক্ষয়, ব্রহ্মচর্যব্রত উদ্যাপিত ও করণীয় সমাপ্ত হয় এবং এ জীবনের (আস্রব ক্ষয়ের) নিমিত্ত আর অপর কর্ত্তব্য নাই, ইহা উপলব্ধি করে।”
“ভিক্ষুগণ! এই ব্যক্তিই আত্মন্তপ নহে, আত্মসন্তাপজনক কার্যে নিযুক্ত নহে এবং পরন্তপ নহে, পরসন্তাপজনক কার্যে নিযুক্ত নহে। সেই অনাত্মন্তপ-অপরন্তপ পরম-পুরুষই প্রত্যক্ষ-জীবনে তৃষ্ণামুক্ত, নিবৃত, শীতিভূত, সুখ অনুভবকারী, স্বয়ং ব্রহ্মভূত হইয়া অবস্থান করে।”
ভগবান ইহা বিবৃত করিলেন, সেই ভিক্ষুগণ সন্তুষ্টচিত্তে ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন করিলেন।
॥ কন্দরক সূত্র সমাপ্ত ॥
১৭। আমি এইরূপ শুনিয়াছি-
এক সময় আয়ুষ্মান আনন্দ বৈশালী নগর সমীপে বেলুব (বেণু) গ্রামে বাস করিতেছিলেন। সেই সময় অট্টক নগরবাসী দশম গৃহপতি পাটলীপুত্রে উপস্থিত হইলেন কোন কার্যোপলক্ষে। অতঃপর অট্টক নাগরীক দশম গৃহপতি স্থানীয় কুক্কুটারামে অন্যতর ভিক্ষুর নিকট উপনীত হইলেন; উপস্থিত হইয়া সেই ভিক্ষুকে অভিবাদনপূর্ব্বক একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট দশম গৃহপতি সেই ভিক্ষুকে জিজ্ঞাসা করিলেন,-
“ভন্তে! এখন আয়ুষ্মান আনন্দ কোথায় বাস করেন? আমরা আয়ুষ্মান আনন্দকে দেখিতে চাই।”
“গৃহপতি! আয়ুষ্মান আনন্দ বৈশালীর বেলুব গ্রামে অবস্থান করিতেছেন।”
অতঃপর দশম গৃহপতি পাটলীপুত্রে সে কার্য সমাধা করিয়া বৈশালীর বেলুব গ্রামে যথায় আয়ুষ্মান আনন্দ অবস্থান করেন তথায় উপস্থিত হইলেন। উপস্থিত হইয়া আয়ুষ্মান আনন্দকে অভিবাদন করিয়া একপ্রান্তে বসিলেন।
১৮। একপ্রান্তে উপবিষ্ট দশম গৃহপতি আয়ুষ্মান আনন্দকে প্রশ্ন করিলেন,-
“ভন্তে আনন্দ! সেই ভগবান সর্বজ্ঞ সর্ব্বদর্শী অর্হৎ সম্যকসম্বুদ্ধ কর্তৃক ভাষিত কোন ধর্মতত্ত্ব আছে কি যাহাতে অপ্রমত্ত, বীর্যবান অভিনিবিষ্ট চিত্ত হইয়া অবস্থানকারী ভিক্ষুর অবিমুক্ত চিত্ত বিমুক্ত হয়, অপরিক্ষীণ আস্রবরাশি পরিক্ষীণ হয় এবং অনুপলব্ধ অনুত্তর যোগক্ষেম (নিব্বান) ক্রমে উপলব্ধি হয়?”
“নিশ্চয় আছে, হে গৃহপতি! সেই ভগবান সর্বজ্ঞ সর্বদর্শী অর্হৎ সম্যক্সম্বুদ্ধ কর্তৃক ভাষিত এক ধর্মমার্গ, যাহাতে অপ্রমত্ত বীর্যবান তৎপর হইয়া অবস্থানকারী ভিক্ষুর অবিমুক্ত চিত্ত বিমুক্ত হয়, ? পূঃ ? অনুত্তর যোগক্ষেম উপলব্ধি হয়।”
“ভন্তে আনন্দ! ? পূঃ ? সেই একধর্ম কি, যাহাতে ? পূঃ ? অনুত্তর যোগক্ষেম প্রাপ্ত হয়?”
১৯। “এখানে গৃহপতি! কোন ভিক্ষু যাবতীয় কামবাসনা পরিহার করিয়া, অকুশলবৃত্তি হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া সবিতর্ক সবিচার বিবেকজ প্রীতি-সুখমণ্ডিত প্রথম ধ্যান লাভ করিয়া অবস্থান করেন। তদবস্থায় তিনি এই চিন্তা করেন, ‘এই প্রথম ধ্যানও অভিসংস্কৃত-উদ্ভাবিত। যাহা কিছু সংস্কৃত ও উদ্ভাবিত, তাহা অনিত্য-নিরোধধর্মী (ধ্বংসশীল)’ ইহা বুঝিতে পারেন। তিনি তদবস্থায় (শমথ-বিদর্শনে) স্থির থাকিয়া আস্রব সমূহের ক্ষয় সাধন করেন। যদি আস্রবের সম্পূর্ণ ক্ষয় সাধন করিতে অসমর্থ হন, তাহা হইলে তিনি সেই শমথ-ধর্মানুরাগ ও বিদর্শন-ধর্মানন্দ দ্বারা পঞ্চবিধ অবরভাগীয় (নিুস্তরের) সংযোজন ক্ষয় করিয়া উপপাতিক (অ-যোনিসম্ভব) হন, তথায় (শুদ্ধাবাস ব্রহ্মলোকে) পরিনিব্বান লাভ করেন, সেই লোক হইতে তাঁহাকে আর পুনরাবর্ত্তন করিতে হয় না।”
“গৃহপতি! সেই ভগবান সর্বজ্ঞ সর্বদর্শী অর্হৎ সম্যক্সম্বুদ্ধ এই ধর্মও উপদেশ করিয়াছেন, যাহাতে অপ্রমত্ত, বীর্যবান ও নিব্বান-প্রবণ চিত্ত (পহিতত্ত, প্রেষিতাত্ম) হইয়া অবস্থানকারী ভিক্ষুর অমুক্তচিত্ত বিমুক্ত হয়, অপরিক্ষীণ আস্রব পরিক্ষীণ হয় এবং অপ্রাপ্ত অনুত্তর যোগক্ষেম অধিগত হয়।” (১)
২০। “গৃহপতি! পুনরায় সেই ভিক্ষু বিতর্ক-বিচারের উপশম করিয়া চিত্তের আধ্যাত্মিক সমপ্রসাদজনক দ্বিতীয় ধ্যান লাভ করিয়া অবস্থান করেন, ...... পূ ......।” (২)
পুনরায় গৃহপতি! সেই ভিক্ষু প্রীতির প্রতিও বিরাগ হেতু তৃতীয় ধ্যান লাভ করিয়া অবস্থান করেন। ...... পূ ......।” (৩)
“গৃহপতি! পুনরায় সুখের প্রহাণ হেতু কোন ভিক্ষু যাবতীয় কামবাসনা পরিহার করিয়া, অকুশলবৃত্তি হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া সবিতর্ক সবিচার বিবেকজ প্রীতি-সুখমণ্ডিত চতুর্থ ধ্যান লাভ করিয়া অবস্থান করেন। ...... পূ ......।” (৪)
“গৃহপতি! সেই ভিক্ষু পুনঃ মৈত্রী-সহগত চিত্ত দ্বারা একদিক বিস্ফারিত করিয়া বিহার করে। সেইরূপ দুইদিক, তিনদিক, চারিদিক, এই প্রকারে ঊর্ধ-অধঃ তির্যকক্রমে সর্বথা সর্বস্থান ব্যাপিয়া সর্বলোক মৈত্রী সহগত, বিপুল, মহদ্গত, অপ্রমেয়, অবৈর ও অহিংস চিত্তদ্বারা বিস্ফারিত করিয়া অবস্থান করেন। করুণা সহগত, মুদিতা সহগত, উপেক্ষা সহগত চিত্ত সম্বন্ধেও এইরূপ।” (৫-৬-৭-৮)
“গৃহপতি! পুনঃ সেই ভিক্ষু সর্বতোভাবে রূপ-সংজ্ঞার অতিক্রম করিয়া, প্রতিঘ (হিংসা) সংজ্ঞার অন্তসাধন করিয়া, নানাত্ব সংজ্ঞার প্রতি মনোনিবেশ না দিয়া ‘অনন্ত আকাশ’ রূপে আকাশানন্ত আয়তন (ধ্যান) লাভ করিয়া অবস্থান করেন। ...... পূ ......।” (৯)
“গৃহপতি! পুনঃ সেই ভিক্ষু সর্বতোভাবে আকাশানন্তায়তন অতিক্রম করিয়া ‘অনন্ত বিজ্ঞান’ রূপে বিজ্ঞান অনন্তায়তন (ধ্যান) লাভ করিয়া অবস্থান করেন। ...... পূ ......।” (১০)
“গৃহপতি! পুনরায় সেই ভিক্ষু সর্বতোভাবে বিজ্ঞান অনন্তায়তন অতিক্রম করিয়া ‘নাস্তিকিঞ্চি রূপে আকিঞ্চন্যায়তন (ধ্যান) লাভ করিয়া অবস্থান করেন। তিনি এইরূপ চিন্তা করেন, ‘এই আকিঞ্চন্যায়তন সমাপত্তিও অভিসংস্কৃত-উদ্ভাবিত।’ যাহা কিছু সংস্কৃত ও উদ্ভাবিত তাহাই অনিত্য, নিরোধ স্বভাব; ইহা অবগত হন। তিনি সেই অবস্থাতেই আস্রব-ক্ষয়জ্ঞান লাভ করেন। যদি আস্রব ক্ষয় করিতে অসমর্থ হন, সেই ধর্মানুরাগ ও ধর্মানন্দ দ্বারা পঞ্চবিধ অধঃভাগীয় (নিুস্তরের) সংযোজন ক্ষয় করিয়া উপপাতিক (অযোনিজ দেব) হন, তথায় (শুদ্ধাবাসে) পরিনির্ব্বানলাভী সেই লোক হইতে অপুনরাবর্তনশীল হন।”
গৃহপতি! সেই ভগবান সর্বজ্ঞ সর্বদর্শী অর্হৎ সম্যক্সম্বুদ্ধ কর্তৃক দেশিত ইহাও এক ধর্মমার্গ, যাহাতে অপ্রমত্ত, বীর্যবান, প্রেষিতাত্ম হইয়া অবস্থানকারী ভিক্ষুর অবিমুক্ত চিত্ত বিমুক্ত হয়, অপরিক্ষীণ আস্রব পরিক্ষয় হয় এবং অপ্রাপ্ত অনুত্তর যোগক্ষেম অধিগত হয়।” (১১)
২১। এইরূপ উক্ত হইলে অট্টক নাগর দশম গৃহপতি আয়ুষ্মান আনন্দকে বলিলেন,-
“প্রভু আনন্দ! যেমন কোন ব্যক্তি এক নিধিমুখ (কুম্ভ) অন্বেষণ করিতে গিয়া একইবারে একাদশ নিধিমুখ লাভ করে, সেইরূপ ভন্তে! আমি এক অমৃতদ্বার অন্বেষণ করিতে গিয়া একইবারে একাদশ অমৃতদ্বারের সন্ধান পাইলাম। ভন্তে! যেমন কোন ব্যক্তির গৃহ একাদশ দ্বার বিশিষ্ট, সেই গৃহে আগুন লাগিলে সে প্রত্যেক দ্বারের সাহায্যেই নিজকে রক্ষা করিতে পারে, সেইরূপ ভন্তে! আমি এই একাদশ অমৃতদ্বারের যে কোন দ্বারের সাহায্যেই নিজকে স্বস্তি (নিরাপদ) করিতে সমর্থ হইব। এই সকল ভন্তে! অন্য তির্থীয় (মতাবলম্বী) গণও আচার্যের [পূজার] নিমিত্ত আচার্য-ধন (অন্বেষণ করিয়া) আয়োজন করিয়া থাকে; আর আমি আয়ুষ্মান আনন্দকে কেন পূজা করিব না”?
অতঃপর দশম গৃহপতি পাটলিপুত্র ও বৈশালীর ভিক্ষু সংঘকে সম্মিলিত করিয়া স্বহস্তে উত্তম খাদ্য-ভোজ্য দ্বারা সন্তৃপ্ত ও সমপ্রবারিত করিলেন। এক এক ভিক্ষুকে এক এক চীবরযুগলে আচ্ছাদন করিলেন। আর আয়ুষ্মান আনন্দকে ত্রিচীবরে আচ্ছাদন করিলেন এবং আয়ুষ্মান আনন্দের জন্য পঞ্চ শতার্হ বিহার নির্মাণ করাইলেন।
॥ অট্টক নাগর সূত্র সমাপ্ত ॥
২২। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-
এক সময় ভগবান শাক্যদের মধ্যে অবস্থান করিতেছিলেন, কপিলবাস্তুর নিগ্রোধারামে। সেই সময় কপিলবাস্তুবাসী শাক্যগণের নিমিত্ত অভিনব সন্থাগার সদ্যঃ নির্মিত হইয়াছে- যাহা এখনও কোন শ্রমণ, ব্রাহ্মণ কিংবা মনুষ্যজাতির অব্যবহৃত। অতঃপর কপিলবাস্তুর শাক্যগণ যেখানে ভগবান আছেন তথায় উপস্থিত হইলেন। উপস্থিত হইয়া ভগবানকে অভিবাদন করিয়া একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট কপিলবাস্তুর শাক্যগণ ভগবানকে এইরূপ বলিলেন,-
“ভন্তে! এখানে কপিলবাস্তুর শাক্যগণের এক অভিনব সন্থাগার অধুনা নির্মিত হইয়াছে, উহা এখনও কোন শ্রমণ, ব্রাহ্মণ কিংবা মনুষ্যজাতির ব্যবহৃত নহে। ভন্তে, ভগবন! আপনি উহা প্রথম ব্যবহার করুন। ভগবান কর্তৃক সর্বপ্রথম ব্যবহৃত হইলে পরে কপিলবাস্তুর শাক্যেরা উহা ব্যবহার করিবেন। ইহা শাক্যগণের পক্ষে দীর্ঘকাল হিত-সুখের নিদান হইবে।”
ভগবান তুষ্ণীভাবে সম্মত হইলেন।
অতঃপর ভগবানের সম্মতি অবগত হইয়া কপিলবাস্তুর শাক্যগণ আসন হইতে উঠিলেন, এবং ভগবানকে অভিবাদনপূর্বক প্রদক্ষিণ করিয়া যেখানে সন্থাগার সেখানে উপস্থিত হইলেন। উপস্থিত হইয়া সন্থাগারের সর্বত্র বিছানা পাতিয়া আসন সমূহ স্থাপন করিলেন, উদকভাণ্ড স্থাপিত করিলেন, তৈল-প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করিলেন এবং ভগবানের নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে অভিবাদনপূর্বক একপ্রান্তে দাঁড়াইলেন। একপ্রান্তে দণ্ডায়মান শাক্যগণ ভগবানকে নিবেদন করিলেন-
“ভন্তে! সন্থাগারের সর্বত্র নানা আস্তরণে সজ্জিত, আসন সমূহ পাতা হইয়াছে, উদকমাণিক স্থাপিত ও তৈল-প্রদীপ আরোপিত হইয়াছে। ভন্তে ভগবন! এখন যাহা কাল মনে করেন তাহা করিতে পারেন।”
তখন ভগবান নিবাসন (অন্তর্বাস-উত্তরাসঙ্গ) পরিধান করিয়া পাত্র-চীবর (সংঘাটি) লইয়া সন্থাগারে উপস্থিত হইলেন। উপস্থিত হইয়া পাদ ধৌত করিয়া সন্থাগারে প্রবেশ করিলেন এবং মধ্যম স্তম্ভ আশ্রয় করিয়া পূর্বাভিমুখে উপবেশন করিলেন। ভিক্ষুসংঘও পাদধৌত করিয়া সন্থাগারে প্রবেশপূর্বক পশ্চিম প্রাচীর আশ্রয় করিয়া পূর্বাভিমুখে, ভগবানকে সম্মুখে রাখিয়াই বসিলেন। কপিলবাস্তুর শাক্যগণ পাদধৌত করিয়া সন্থাগারে প্রবেশপূর্বক পশ্চিমমুখী হইয়া, ভগবানকে সম্মুখে রাখিয়াই পূর্বভিত্তির আশ্রয়ে উপবেশন করিলেন।
তখন ভগবান অধিকরাত্রি (বারটা) পর্যন্ত কপিলবাস্তুর শাক্যগণকে ধর্মোপদেশদ্বারা (ঐহিক-পারত্রিক হিত) প্রদর্শন করিয়া, (কুশল-ধর্ম) গ্রহণ করাইয়া, (উহাতে) উৎসাহিত ও হর্ষোৎফুল্ল করিয়া আয়ুষ্মান আনন্দকে আহ্বান করিলেন-
“আনন্দ! কপিলবাস্তুর শাক্যদিগকে শৈক্ষ্য-প্রতিপদা সম্বন্ধে উপদেশ প্রদান কর। আমার পৃষ্ঠদেশ ক্লান্ত হইয়াছে, সুতরাং আমি বিশ্রাম করিব।”
“হাঁ প্রভু!” (বলিয়া) আয়ুষ্মান আনন্দ ভগবানকে প্রত্যুত্তর প্রদান করিলেন। তৎপর ভগবান চতুর্গুণ সংঘাটি বিছাইয়া পাদে পাদ স্থাপন করিয়া, স্মৃতিমান ও সমপ্রজ্ঞানী হইয়া, যথা সময়ে উত্থান-সংজ্ঞা মনে রাখিয়া দক্ষিণ পার্শ্বে সিংহ শয্যায় শয়ন করিলেন।
২৩। অতঃপর তখন আয়ুষ্মান আনন্দ মহানাম শাক্যকে আহ্বান করিলেন-
“মহানাম! যখন আর্যশ্রাবক শীলসম্পন্ন হন ইন্দ্রিয়ে গুপ্তদ্বার (সংযত) হন, ভোজনে মাত্রাজ্ঞ হন, জাগরণে তৎপর থাকেন, এবং সপ্তবিধ সদ্ধর্মে সুশোভিত হন; তখন তিনি ইহ জীবনে সুখবিহারের উপযোগী চতুর্বিধ আধ্যাত্মিক ধ্যানের যথেচ্ছ লাভী, অনায়াস লাভী ও অপরিমেয় লাভী হন।”
২৪। “মহানাম! কি প্রকারে আর্যশ্রাবক শীলসম্পন্ন হন? এ শাসনে মহানাম! আর্যশ্রাবক শীলবান হন, প্রাতিমোক্ষ সংবরে সংযত, আচার-গোচর সম্পন্ন, অণুমাত্র নিন্দনীয় আচরণেও ভয়দর্শী হইয়া অবস্থান করেন। শিক্ষাপদ (সদাচার নীতি) সমূহ গ্রহণ করিয়া চরিত্র গঠন করেন। এইরূপে মহানাম! আর্যশ্রাবক শীল-সম্পন্ন হন।”
“কি প্রকারে মহানাম! ইন্দ্রিয়ে গুপ্তদ্বার হন?- মহানাম! আর্যশ্রাবক যখন চক্ষুদ্বারা রূপ (দৃশ্য) দর্শন করিয়া নিমিত্ত গ্রাহী হন না, অনুব্যঞ্জন গ্রাহী হন না; যে বিষয়ে এই চক্ষু ইন্দ্রিয় অসংযত বিহারীর অভিধ্যা, দৌর্মনস্যকর পাপ অকুশলধর্ম সমূহ অনুস্রাবিত হয়, তিনি উহার সংবরের জন্য অগ্রসর হন, চক্ষু-ইন্দ্রিয় রক্ষা করেন, চক্ষু ইন্দ্রিয়ে সংযত হন। শ্রোত্রদ্বারা শব্দ শুনিয়া ...... পূ ......। ঘ্রাণদ্বারা গন্ধ আঘ্রাণ করিয়া ...... পূ ......। জিহ্বাদ্বারা রসাস্বাদন করিয়া ...... পূ ......। কায়দ্বারা স্পৃষ্টব্য স্পর্শ করিয়া ...... পূ ......। মনদ্বারা ধর্ম (চিন্তনীয় বিষয়) জ্ঞাত হইয়া নিমিত্ত গ্রাহী হন না, অনুব্যঞ্জন গ্রাহী হন না; যে কারণে মনেন্দ্রিয় অসংযত বিহারীর অভিধ্যা-দৌর্মনস্যরূপ পাপ অকুশলধর্ম সমূহ অনুস্রাবিত হয়, তিনি উহার সংযমের জন্য অগ্রসর হন, মনেন্দ্রিয় রক্ষা করেন, মনেন্দ্রিয়ে সংযত হন।”
“মহানাম! কি প্রকারে আর্যশ্রাবক ভোজনে মাত্রাভিজ্ঞ হন?- মহানাম! আর্যশ্রাবক যথার্থ জ্ঞানপূর্বক আহার গ্রহণ করেন,- দাবার (ক্রীড়ার) জন্য নহে, মত্ততার জন্যও নহে, মণ্ডন ও বিভূষণের জন্যও নহে। ইহা শুধু শরীর স্থিতির নিমিত্ত, জীবন যাপনের নিমিত্ত, জিঘাংসা নিবারণার্থ (ক্ষুধা-যন্ত্রণার উপশমের জন্য) এবং মার্গ-ব্রহ্মচর্যের সহায়তার নিমিত্ত। এইরূপে পুরাতন ক্ষুধা-বেদনার উপশম করিব, (অমিত ভোজনজনিত) নূতন বেদনা উৎপন্ন করিব না, যাহাতে আমার জীবনযাত্রা নির্দোষ ও স্বচ্ছন্দ-বিহার হইবে। এই প্রকারে মহানাম! আর্যশ্রাবক ভোজনে মাত্রাভিজ্ঞ হন।”
“মহানাম! কি প্রকারে আর্যশ্রাবক জাগরণে নিয়োজিত থাকেন? মহানাম! শাসনে আর্যশ্রাবক দিবসে চংক্রমণ ও উপবেশন দ্বারা আবরণীয় ধর্ম হইতে চিত্তকে পরিশুদ্ধ করেন, রাত্রির প্রথম যামে চংক্রমণ ও উপবেশন দ্বারা আবরণীয় ধর্ম হইতে চিত্তকে পরিশুদ্ধ করেন, রাত্রির মধ্যম যামে পায়ের উপর পা (ডান পায়ের উপর বাম পা) রাখিয়া, স্মৃতি সমপ্রজ্ঞানের সহিত যথা সময় গাত্রোত্থান ধারণা মনে রাখিয়া দক্ষিণ পার্শ্বে সিংহ শয্যায় শয়ন করেন। রাত্রির শেষ যামে প্রত্যুত্থান করিয়া চংক্রমণ ও ধ্যানাসনে উপবেশন দ্বারা আবরণীয় ধর্ম হইতে চিত্ত পরিশুদ্ধ করেন। এই প্রকারে মহানাম! আর্যশ্রাবক জাগরণে নিয়োজিত হন।”
২৫। “মহানাম! কি প্রকারে আর্যশ্রাবক সপ্তবিধ সদ্ধর্মে সমন্বিত হন? মহানাম! আর্যশ্রাবক (১) শ্রদ্ধাবান হন, তথাগতের বোধিকে (পরম জ্ঞানকে) শ্রদ্ধা করেন,- এই কারণে সেই ভগবান অর্হৎ, সম্যক্সম্বুদ্ধ, বিদ্যাচরণসম্পন্ন, সুগত, লোকবিদ্, অনু্ত্তর দম্য-পুরুষ-সারথি, দেব-মনুষ্যদের শাস্তা, বুদ্ধ ও ভগবান। (২) লজ্জাশীল হন,-কায়-দুশ্চরিত, বাক্-দুশ্চরিত ও মনো-দুশ্চরিতকে লজ্জা করেন, পাপ-অকুশল কর্ম সম্পাদনে লজ্জা বোধ করেন। (৩) অপত্রপী (সঙ্কোচী) হন,- কায়-দুশ্চরিত, বাক্-দুশ্চরিত ও মনো দুশ্চরিত হইতে সঙ্কোচিত হন, পাপ-অকুশল কর্ম সম্পাদনে ভীত হন। (৪) বহুশ্রুত, শ্রুতধর ও শ্রুতসঞ্চয়ী হন,- যে সকল ধর্ম আদি-কল্যাণ, মধ্য-কল্যাণ, পর্যবসান-কল্যাণ, সার্থক, স-ব্যঞ্জন, যাহা কেবল পরিপূর্ণ, পরিশুদ্ধ ব্রহ্মচর্য্যের ঘোষণা করে, তথাবিধ বহু ধর্মোপদেশ তাঁহার শ্রুত, ধৃত, বাক্যদ্বারা পরিচিত (কণ্ঠস্থ), মনের দ্বারা প্রত্যক্ষ কৃত ও দৃষ্টি (দর্শন) দ্বারা উত্তমরূপে প্রতিবিদ্ধ হইয়াছে। (৫) আরব্ধবীর্য (উদ্যোগী) হন,- অকুশল ধর্মের প্রহাণের জন্য, কুশল ধর্মের অর্জনের জন্য শক্তিমান, দৃঢ়-পরাক্রমী এবং কুশল ধর্মসমূহে লক্ষ্যভ্রষ্ট না হইয়া অবস্থান করেন। (৬) স্মৃতিমান হন- পরম স্মৃতি-নৈপুণ্যে প্রতিমণ্ডিত হন, চিরকালের কৃত ও চিরকালের ভাষিত বিষয় স্মরণ করিতে ও অনুস্মরণ করিতে সমর্থ হন। (৭) প্রজ্ঞাবান হন- পঞ্চস্কন্ধের উদয় ও বিলয় প্রতিবেধ সমর্থ প্রজ্ঞায় যুক্ত হন, সম্যক্দুঃখ-ক্ষয়গামিনী আর্য বিশুদ্ধ লক্ষ্য-ভেদী (নির্বেধিকা) প্রজ্ঞায় সংযুক্ত হন। এই প্রকারেই মহানাম! আর্যশ্রাবক সপ্তবিধ সদ্ধর্মে সমন্বিত হন।”
২৬। “মহানাম! আর্যশ্রাবক কি প্রকারে দৃষ্টধর্মে সুখবিহারস্বরূপ চতুর্বিধ অভিচিত্তাশ্রিত ধ্যানের যথেচ্ছলাভী, অনায়াসলাভী, অপরিমেয়লাভী হন?”
“মহানাম ! এখানে আর্যশ্রাবক কামবাসনা হইতে পৃথক হইয়া অকুশলধর্ম পরিহার করিয়া সবিতর্ক, সবিচার, বিবেকজ ও প্রীতি-সুখ-মণ্ডিত প্রথম ধ্যান লাভ করিয়া অবস্থান করেন। বিতর্ক-বিচারের উপশম করিয়া আধ্যাত্মিক প্রসাদজনক, চিত্তের একাগ্রতা সাধক বিতর্ক-বিচার রহিত সমাধিজ প্রীতি-সুখ মণ্ডিত দ্বিতীয় ধ্যান অধিগত হইয়া ...... পূ ...... তৃতীয় ধ্যান ও চতুর্থ ধ্যান অধিগত হইয়া অবস্থান করেন। মহানাম! এই প্রকারেই আর্যশ্রাবক দৃষ্টধর্ম সুখবিহার স্বরূপ চতুর্বিধ অভিচিত্তাশ্রিত ধ্যানের যথেচ্ছলাভী, অনায়াসলাভী ও অক্লেশলাভী হন।”
২৭। “মহানাম! আর্যশ্রাবক যখন এই প্রকার শীলসম্পন্ন হন, এই প্রকার ইন্দ্রিয়ে গুপ্তদ্বার হন, ভোজনে মাত্রাভিজ্ঞ হন, এই প্রকারে জাগরণে নিয়োজিত হন, সপ্তবিধ সদ্ধর্মে প্রতিমণ্ডিত হন, দৃষ্টধর্ম সুখবিহার স্বরূপ অভিচিত্তাশ্রিত চতুর্বিধ ধ্যানের যথেচ্ছলাভী, অনায়াসলাভী, অক্লেশলাভী হন; মহানাম! তখন এই আর্যশ্রাবক শৈক্ষ্য-প্রতিপদায় প্রতিপন্ন অ-পূতি (অবিকৃত) অণ্ডত্বে পরিণত, অভিনির্ভেদের (বিদারণের) যোগ্য সম্বোধির উপযুক্ত ও অনুত্তর যোগক্ষেম অধিগমের অধিকারী বলিয়া উক্ত হন।”
“যেমন মহানাম! কোন কুক্কুটির আট, দশ কিংবা বারটি ডিম আছে, সেগুলি কুক্কুটিদ্বারা সম্যক্ উপরিশায়িত, উত্তমরূপে পরিস্বেদিত, সম্যক্ পরিভাবিত (ভাবরা প্রদত্ত) হয়। যদিও সেই কুক্কুটির এই প্রকার ইচ্ছা উৎপন্ন নাও হয়- ‘অহো! এই কুক্কুট শাবকগুলি পাদনখশিখা কিংবা মুখতুণ্ডদ্বারা ডিম্বকোষ বিদীর্ণ করিয়া নিরাপদে বহির্গত হউক’। তথাপি যথাসময় সেই কুক্কুট শাবকগুলি পাদনখশিখা কিংবা মুখতুণ্ডদ্বারা অণ্ডকোষ প্রদালন করিয়া নিরাপদে বহির্গত হইতে সমর্থ হয়। তেমন ভাবেই মহানাম! যখন আর্যশ্রাবক এই প্রকারে শীলসম্পন্ন হন, এই প্রকারে ইন্দ্রিয়ে গুপ্তদ্বার হন, এইরূপে ভোজনে মাত্রাভিজ্ঞ হন, এইরূপে জাগরণে নিয়োজিত হন, এইরূপে সপ্তবিধ সদ্ধর্মে অনুপ্রাণিত হন, এইরূপে বাস্তব জীবনে সুখ-বিহার স্বরূপ অভিচিত্তাশ্রিত চতুর্বিধ ধ্যানের যথেচ্ছলাভী, অনায়াসলাভী অনল্পলাভী হন। মহানাম! এই আর্যশ্রাবকই উক্ত হন,- শৈক্ষ্য-প্রতিপদায় অগ্রসর, অবিকৃত অণ্ডত্বে পরিণত, অভিনির্ভিদার যোগ্য, সম্বোধির বা আর্যমার্গের উপযোগী এবং অনুত্তর যোগক্ষেম অধিগমের অধিকারী।”
২৮। “মহানাম! তিনিই সেই আর্যশ্রাবক যিনি এই উত্তম (চতুর্থ ধ্যানজ) উপেক্ষা ও পরিশুদ্ধ স্মৃতি সহকারে বহুবিধ পূর্বজন্ম বৃত্তান্ত অনুস্মরণ করেন,- যথা একজন্ম, দুইজন্ম, ...... পূ ...... আকার ও উদ্দেশ সহিত নানাবিধ পূর্বনিবাস অনুস্মরণ করেন। অণ্ডকোষ হইতে কুক্কুট শাবকের ন্যায় ইহাই হয় তাঁহার প্রথম (জ্ঞানভেদ) অভিনিষ্ক্রমণ।”
“মহানাম! তিনিই সেই আর্যশ্রাবক যিনি এই অনুত্তর উপেক্ষা ও পরিশুদ্ধ স্মৃতি সহায়ে মনুষ্যোত্তর বিশুদ্ধ দিব্যচক্ষুদ্বারা চ্যুতি-উৎপত্তির সময় হীনোৎকৃষ্ট, সুবর্ণ-দুর্বর্ণ, সুগতি-দুর্গতি পরায়ণ সত্ত্বগণকে দেখিতে পান, যথাকর্মানুগ প্রাণিগণকে বিশেষরূপে জানিতে পারেন। ইহাই তাঁহার দ্বিতীয় অভিনিষ্ক্রমণ, ডিম্বকোষ হইতে কুক্কুট শাবকের ন্যায়।”
“মহানাম! তিনিই সেই আর্যশ্রাবক যিনি অনুত্তর উপেক্ষা ও স্মৃতি পরিশুদ্ধির সাহায্যে আস্রব সমূহ ক্ষয় করিয়া অনাস্রব চিত্তবিমুক্তি (শমথ) ও প্রজ্ঞাবিমুক্তি (বিদর্শন) ইহ জীবনেই স্বয়ং অভিজ্ঞাদ্বারা সাক্ষাৎ করিয়া, অধিগত হইয়া অবস্থান করেন। কুক্কুট শাবকের ডিম্বকোষ হইতে বাহির হওয়ার ন্যায় ইহা তাঁহার তৃতীয় অভিনিষ্ক্রমণ।”
২৯। “মহানাম! আর্যশ্রাবক যে শীলসম্পন্ন হন, উহাই তাঁহার আচরণের অন্তর্গত। তিনি যে ইন্দ্রিয়ে গুপ্ত-দ্বার, ভোজনে মাত্রাভিজ্ঞ, জাগরণে নিয়োজিত, সপ্তবিধ আর্যধর্মে অনুপ্রাণিত ও চতুর্বিধ ধ্যানলাভী হন, উহারা তাঁহার (পঞ্চদশ) আচরণের অন্তর্গত।”
“মহানাম! আর্যশ্রাবক যে নানা প্রকার পূর্বনিবাস অনুস্মরণ করেন,- যথা একজন্ম, দুইজন্ম, ...... পূ ...... সাকার সউদ্দেশ নানাবিধ পূর্বনিবাস অনুস্মরণ করেন, ইহা তাঁহার বিদ্যার অন্তর্গত। তিনি যে চ্যুতি-উৎপত্তির সময় হীন-উৎকৃষ্ট, সুবর্ণ-দুর্বর্ণ, সুগতি-দুর্গতি পরায়ণ যথাকর্মানুগ সত্ত্বগণকে মনুষ্যোত্তর বিশুদ্ধ দিব্যচক্ষুদ্বারা দর্শন করেন, ইহাও তাঁহার বিদ্যার অন্তর্গত এবং তিনি যে আস্রব সমূহ ক্ষয় করিয়া অনাস্রব চিত্তবিমুক্তি ও প্রজ্ঞাবিমুক্তি ইহ-জীবনে স্বয়ং অভিজ্ঞাদ্বারা সাক্ষাৎ করিয়া, অধিগত হইয়া অবস্থান করেন, ইহাও তাঁহার (ত্রিবিধ) বিদ্যার অন্তর্গত।”
“মহানাম! এই আর্যশ্রাবককেই বিদ্যাসম্পন্ন ও এই প্রকারে আচরণ সম্পন্ন বলা হয়, সুতরাং একারণে তিনি বিদ্যাচরণ সম্পন্ন হইয়া থাকেন।
মহানাম! ব্রহ্মা সনৎকুমার ও এই গাথা ভাষণ করিয়াছেন,-
৩০। ‘গোত্র অনুগামী জনতার মাঝে
ক্ষত্রিয় সবারোত্তম।
বিদ্যাচার-ধর্মী দেব-নর মাঝে
তিনি হন শ্রেষ্ঠতম’ ॥”
“মহানাম! এই যে গাথা যাহা ব্রহ্মা সনংকুমার কর্তৃক ভাষিত, উহা সুভাষিত-দুর্ভাষিত নহে, অর্থসংযুক্ত,-অনর্থ সংযুক্ত নহে, ভগবানের অনুমোদিত।”
অতঃপর ভগবান গাত্রোত্থান করিয়া আয়ুষ্মান আনন্দকে আহ্বান করিলেন,- “সাধু সাধু আনন্দ! সাধু আনন্দ! কপিলবাস্তুবাসী শাক্যগণকে শৈক্ষ্য-প্রতিপদা সম্বন্ধে উপদেশ দিয়াছ।”
আয়ুষ্মান আনন্দ ইহা ভাষণ করিলেন, শাস্তা সন্তুষ্ট হইলেন, কপিলবাস্তুর শাক্যগণ প্রসন্ন মনে আয়ুষ্মান আনন্দের ভাষণ অভিনন্দন করিলেন।
॥ শৈক্ষ্য সূত্র সমাপ্ত ॥
৩১। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-
এক সময় ভগবান অঙ্গুত্তরাপ জনপদে অবস্থান করিতেছিলেন, অঙ্গুত্তরাপবাসীদের আপণ নামক নগরে (নগর সমীপে নদীতীরে)। তখন ভগবান পূর্বাহ্ন সময়ে (চীবর) পরিধান করিয়া পাত্র-চীবর (সংঘাটি) লইয়া ভিক্ষান্ন সংগ্রহের জন্য আপণে প্রবেশ করিলেন। আপণে ভিক্ষান্ন সংগ্রহ করিয়া ভোজন শেষে ভিক্ষাচর্যা হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়া এক গভীর বনে উপস্থিত হইলেন- দিবা বিহারের নিমিত্ত। সেই গভীর বনে প্রবেশ করিয়া এক বৃক্ষমূলে দিবা বিহারে উপবেশন করিলেন।
পোতলিয় গৃহপতিও নিবাসন (ধুতি), প্রাবরণ (উত্তরীয়) পরিধান করিয়া, ছত্র ধারণ ও পাদুকা পরিহিত হইয়া জঙ্ঘা বিহার (পায়চারী) করিতে করিতে যথায় সেই গভীর বন তথায় উপনীত হইলেন, গভীর বনে প্রবেশ করিয়া যেখানে ভগবান আছেন তথায় পৌঁছিলেন, উপস্থিত হইয়া ভগবানের সহিত প্রীতি সম্ভাষণ করিলেন এবং সম্মোদনীয় ও স্মরণীয় আলাপ শেষ করিয়া এক প্রান্তে দাঁড়াইলেন। একপ্রান্তে স্থিত গৃহপতি পোতলিয়কে ভগবান বলিলেন,-
“গৃহপতি! আসন বিদ্যমান আছে, যদি ইচ্ছা হয় বসিতে পার।”
এইরূপ উক্ত হইলে পোতলিয় গৃহপতি- “শ্রমণ গৌতম আমাকে গৃহপতি (গৃহস্থ, বৈশ্য) রূপে ব্যবহার করিতেছেন,”- ক্রোধান্বিত ও অপ্রসন্ন মনে নীরব রহিলেন।
দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বারও ...... এইরূপ কথিত হইলে,- “শ্রমণ গৌতম আমাকে গৃহপতিরূপে ব্যবহার করিতেছেন”- কোপিত ও অসন্তুষ্ট হইয়া পোতলিয় গৃহপতি ভগবানকে বলিলেন,-
“ভো গৌতম! ইহা অনুচিত, ইহা অপ্রতিরূপ, যেহেতু আপনি আমাকে গৃহপতি বলিয়া ব্যবহার করিলেন।”
“গৃহপতি! যাহাতে গৃহপতি হয়, তোমার সেই আকার, সেই লিঙ্গ ও সেই নিমিত্ত বিদ্যমান (তজ্জন্যই এই ব্যবহার করিতেছি)।”
“তথাপি ভো গৌতম! আমাকর্তৃক যাবতীয় গৃহী-কর্মান্ত পরিত্যক্ত, যাবতীয় গৃহী-ব্যবহার (ব্যবসা-বাণিজ্য) সমুচ্ছিন্ন।”
“গৃহপতি! তাহা কি প্রকার, যাহা তোমার সর্বগৃহী-কর্মান্ত পরিত্যক্ত, যাবতীয় গৃহী-ব্যবহার সমুচ্ছিন্ন?”
“ভো গৌতম! আমার নিকট যাহা কিছু ধন, ধান্য, রজত-জাতরূপ (সোনা-রূপা) ছিল, আমি সমস্ত পুত্রদিগকে উত্তরাধিকার সূত্রে সমর্পণ করিয়াছি। সেই সম্বন্ধে আমি আদেশ কিম্বা উপদেশ করিনা, শুধু গ্রাসাচ্ছাদন (খাওয়া-পরা) মাত্রেই অবস্থান করি; (তদপেক্ষা কোন প্রত্যাশা নাই)। এই কারণে ভো গৌতম! আমি যাবতীয় গৃহী-কর্মান্ত পরিত্যাগ ও গৃহী-ব্যবহার সমুচ্ছিন্ন করিয়াছি।”
“গৃহপতি! তুমি অন্যথা ব্যবহার সমুচ্ছেদ বলিতেছ। কিন্তু আর্য-বিনয়ে ব্যবহার সমুচ্ছেদ অন্যপ্রকার।”
“ভন্তে! আর্য-বিনয়ে ব্যবহার-সমুচ্ছেদ কি প্রকারে হয়? বেশ, ভগবন! আমাকে তদ্রূপ ধর্মোপদেশ করুন, যে প্রকারে আর্য-বিনয়ে ব্যবহার সমুচ্ছেদ হয়।”
“তবে গৃহপতি! শ্রবণ কর, উত্তমরূপে মনোযোগ দাও, আমি উপদেশ করিব।”
“হাঁ, ভদন্ত!” (বলিয়া) পোতলিয় গৃহপতি ভগবানকে প্রতিশ্রুতি দিলেন। ভগবান বলিলেন,-
৩২। “গৃহপতি! এই অষ্টবিধ-ধর্ম আর্য-বিনয়ে ব্যবহার সমুচ্ছেদের জন্য প্রবর্তিত হয়, সেই অষ্টবিধ কি কি? (১) হিংসা বিরতি চেতনা আশ্রয় করিয়া প্রাণী-হিংসা পরিত্যাগ করা উচিত। (২) চৌর্য বিরতি চেতনা আশ্রয় করিয়া চৌর্য পরিত্যাগ করা উচিত। (৩) সত্য-বাক্য আশ্রয় করিয়া মিথ্যা-বাক্য পরিত্যাগ করা উচিত। (৪) পিশুন-বিরতি চেতনা আশ্রয় করিয়া পিশুন-বাক্য পরিত্যাগ করা উচিত। (৫) গৃধ্নু-লোভ প্রহাণ চেতনা আশ্রয় করিয়া গৃধ্নু-লোভ পরিবর্জন করা উচিত। (৬) নিন্দা-রোষ প্রহাণ চেতনা আশ্রয় করিয়া নিন্দা-রোষ প্রহাতব্য। (৭) ক্রোধোপায়াস (হতাশা) প্রহাণ চেতনা আশ্রয় করিয়া ক্রোধোপায়াস পরিবর্জন করা উচিত। (৮) অভিমান প্রহাণ চেতনা আশ্রয় করিয়া অভিমান পরিত্যাজ্য। গৃহপতি! এই অষ্টবিধ ধর্ম্ম,- যাহা সংক্ষেপে উক্ত হইল বিস্তৃত ভাবে অবিভক্ত- ইহারাই আর্য-বিনয়ে ব্যবহার সমুচ্ছেদার্থ প্রযুক্ত হয়।”
[এখানে প্রথম চারিটি বিরমিতব্য, শেষের চারিটি প্রহাতব্য।]
“সাধু ভন্তে! ভগবান কর্তৃক বিস্তৃত ভাবে অবিভক্ত যেই অষ্টধর্ম উক্ত হইল যাহা আর্য-বিনয়ে ব্যবহার সমুচ্ছেদে প্রবর্তিত হয়। অনুগ্রহ পূর্বক ভগবন! আমাকে সেই অষ্টবিধ ধর্ম বিস্তৃতভাবে বর্ণনা করুন।”
“তবে হে গৃহপতি! শ্রবণ কর, সুন্দররূপে মনোযোগ দাও, আমি বর্ণনা করিব।”
“হাঁ, ভন্তে!” পোতলিয় গৃহপতি ভগবানকে প্রত্যুত্তর দিলেন।
ভগবান এইরূপ বলিলেন,-
৩৩। “প্রাণীহত্যা বিরতি চেতনা আশ্রয়ে প্রাণীহত্যা ত্যাগ করা উচিত- এই যে বলা হইল, কি কারণে বলা হইল? গৃহপতি! আর্যশ্রাবক এ বিষয়ে এই চিন্তা করেন- আমি যে সকল সংযোজনের দরুণ প্রাণীহত্যাকারী হইতে পারি, সেই সমস্ত সংযোজন প্রহাণের জন্য ও সমুচ্ছেদের জন্য অগ্রসর হইতেছি। এমতাবস্থায় যদি আমিই প্রাণীহত্যাকারী হই, তবে আত্মাও (স্বচিত্ত) আমাকে প্রাণীহত্যার দরুণ নিন্দা করিবে। অপর বিজ্ঞগণও পরীক্ষা করিয়া প্রাণীহত্যার দরুণ আমাকে ধিক্কার দিতে পারেন। প্রাণীহত্যার দরুণ দেহত্যাগে মৃত্যুরপর দুর্গতিই প্রত্যাশা করিতে হইবে। এই যে প্রাণীহত্যা ইহাই সংযোজন , ইহাই নীবরণ; প্রাণীহত্যার দরুণ যে সকল আস্রব , বিঘাত ও পরিদাহ উৎপন্ন হইবার সম্ভাবনা, প্রাণীহত্যা হইতে বিরত ব্যক্তির সেই সমুদয় আস্রব, ক্লেশ ও বিপাকজনিত বিঘাত এবং পরিদাহ উৎপন্ন হয় না। সুতরাং হিংসার বিরতি চেতনা আশ্রয়ে প্রাণীহিংসা পরিত্যাজ্য বলিয়া যাহা উক্ত হইয়াছে তাহা এই কারণেই বলা হইল।” (১)
৩৪। “ অচৌর্যের আশ্রয়ে চৌর্যত্যাগ করা উচিত- এই যে বলা হইল, কি কারণে বলা হইল? গৃহপতি! আর্যশ্রাবক এ বিষয়ে এই প্রকার চিন্তা করেন- আমি যে সকল সংযোজনের কারণে চৌর্যকর্ম করিতে পারি, সেই সমুদয় সংযোজনের প্রহাণের জন্য ও সমুচ্ছেদের জন্য অগ্রসর হইতেছি। এমতাবস্থায়......।” (২)
৩৫। “সত্য বাক্য আশ্রয় করিয়া মিথ্যা পরিত্যাগ করা উচিত- এই যে বলা হইল, কি কারণে বলা হইল? গৃহপতি! আর্যশ্রাবক এ বিষয়ে এই প্রকার চিন্তা করেন- আমি যে সকল সংযোজনের কারণে মিথ্যাবাক্য বলিতে পারি, সেই সমুদয় সংযোজনের প্রহাণের জন্য ও সমুচ্ছেদের জন্য অগ্রসর হইতেছি। ......।” (৩)
৩৬। “অপিশুন বাক্যের আশ্রয়ে পিশুন বাক্য পরিত্যাগ করা উচিত- এই যে বলা হইল, কি কারণে বলা হইল? গৃহপতি! আর্যশ্রাবক এ বিষয়ে এই প্রকার চিন্তা করেন- আমি যে সকল সংযোজনের কারণে পিশুনবাক্য বলিতে পারি, সেই সমুদয় সংযোজনের প্রহাণের জন্য ও সমুচ্ছেদের জন্য অগ্রসর হইতেছি। ......।” (৪)
৩৭। “অগৃধ্নু-লোভ আশ্রয় করিয়া গৃধ্ন-লোভ পরিত্যাগ করা উচিত- এই যে বলা হইল, কি কারণে বলা হইল? গৃহপতি! আর্যশ্রাবক এ বিষয়ে এই প্রকার চিন্তা করেন- আমি যে সকল সংযোজনের কারণে গৃধ্নু লোভী হইতে পারি, সেই সমুদয় সংযোজনের প্রহাণের জন্য ও সমুচ্ছেদের জন্য অগ্রসর হইতেছি। ......।” (৫)
৩৮। “অনিন্দা-রোষ আশ্রয় করিয়া নিন্দা-রোষ প্রহাতব্য- এই যে বলা হইল, কি কারণে বলা হইল? গৃহপতি! আর্যশ্রাবক এ বিষয়ে এই প্রকার চিন্তা করেন- আমি যে সকল সংযোজনের কারণে নিন্দা-রোষকারী হইতে পারি, সেই সমুদয় সংযোজনের প্রহাণের জন্য ও সমুচ্ছেদের জন্য অগ্রসর হইতেছি। ......।” (৬)
৩৯। “অক্রোধোপায়াসের আশ্রয়ে ক্রোধোপায়াস প্রহাতব্য- এই যে বলা হইল, কি কারণে বলা হইল? গৃহপতি! আর্যশ্রাবক এ বিষয়ে এই প্রকার চিন্তা করেন- আমি যে সকল সংযোজনের কারণে ক্রোধোপায়াস হইতে পারি, সেই সমুদয় সংযোজনের প্রহাণের জন্য ও সমুচ্ছেদের জন্য অগ্রসর হইতেছি। ......।” (৭)
৪০। “অনভিমানের আশ্রয়ে অভিমান পরিত্যাজ্য- এই যে বলা হইল, কি কারণে বলা হইল? গৃহপতি! আর্যশ্রাবক এ বিষয়ে এই প্রকার চিন্তা করেন- আমি যে সকল সংযোজনের কারণে অভিমানী হইতে পারি, সেই সমুদয় সংযোজনের প্রহাণের জন্য ও সমুচ্ছেদের জন্য অগ্রসর হইতেছি। ......।” (৮)
৪১। “গৃহপতি! সংক্ষেপে উক্ত ও বিস্তৃত ভাবে বিভক্ত এই অষ্টবিধ ধর্ম, যাহা আর্য-বিনয়ে ব্যবহার সমুচ্ছেদার্থ প্রবর্তিত হয়। তথাপি আর্য-বিনয়ে কেবল এই পর্যন্ত সর্বেসর্বা ও সর্বথা ব্যবহার সমুচ্ছেদ নহে।”
“ভন্তে! আর্য-বিনয়ে সর্বেসর্বা ও সর্বথা সর্বস্বরূপে ব্যবহার সমুচ্ছেদ কি প্রকারে হয়? উত্তম, হে প্রভু ভগবন! যে প্রকারে আর্য-বিনয়ে সর্বেসর্বা ও সর্বথা সর্বস্বরূপে ব্যবহার সমুচ্ছেদ হয় সেই প্রকার ধর্মোপদেশ করুন।”
“গৃহপতি! তাহা হইলে শ্রবণ কর, উত্তমরূপে মনোযোগ দাও, আমি বর্ণনা করিব।”
“হাঁ ভদন্ত!” (বলিয়া) পোতলিয় গৃহপতি ভগবানকে প্রত্যুত্তর দিলেন। ভগবান বলিলেন-
৪২। “গৃহপতি! যেমন কোন ক্ষুধাদৌর্বল্য-প্রপীড়িত কুকুর সূণায় (মাংস বিক্রয় স্থানে) উপস্থিত হয়; দক্ষ গো-ঘাতক অথবা গো-ঘাতকের অন্তেবাসী উত্তমরূপে তক্ষণকৃত বা সু-পরিষ্কৃত, মাংসহীন, রক্তমাখা অস্থি-কঙ্কাল উহার দিকে নিক্ষেপ করে। গৃহপতি! তাহা কি মনে কর? সেই কুকুর সুচ্ছিন্ন, পরিষ্কৃত মাংসহীন ও রক্তমিশ্র ঐ অস্থিকঙ্কাল লেহন করিয়া ক্ষুধা-দৌর্বল্য বিনোদন করিতে সমর্থ হইবে?”
“ভন্তে! ইহা কখনও সম্ভব নহে। ইহার কারণ এই যে ভন্তে! ঐ অস্থিকঙ্কাল উত্তমরূপে পরিষ্কৃত, মাংসহীন শুধু লোহিত-মিশ্রিত; সেই কুকুর শুধু ক্লান্ত হইবে ও বিঘাতের ভাগী হইবে।”
“এইরূপে গৃহপতি! সেই আর্যশ্রাবক এই প্রকার প্রত্যবেক্ষণ করে,- ‘ভগবান কর্তৃক বলা হইয়াছে, কাম অস্থিকঙ্কাল সদৃশ ইহা বহু দুঃখের আকর, বহু উপায়াসময়, ইহাতে অধিকতর আদীনব (দোষ) বিদ্যমান।’ এইরূপে যথাভূত ভাবে সম্যক্ প্রজ্ঞাদ্বারা দর্শন করিয়া যেই (পঞ্চ কাম-বিষয়ক) উপেক্ষা নানা স্বভাববিশিষ্ট ও নানা আরম্মণাশ্রিত উহাকে বিশেষরূপে বর্জন করিয়া, যেই (চতুর্থধ্যানজ) উপেক্ষা এক স্বভাব ও একারম্মণাশ্রিত, যাহাতে সর্বতোভাবে লোকামিষ ও উপাদান (গাঢ়তৃষ্ণা) সমূহ নিরবশেষে নিরুদ্ধ হয়, (লোকামিষ ও উপাদানের প্রতিপক্ষভূত) সেই উপেক্ষাকেই বৃদ্ধি করেন।”
৪৩। “গৃহপতি! যেমন নাকি কোন গৃধ্র, কাক অথবা কুলাল (শ্যেনজাতীয় পক্ষী) একখণ্ড মাংসপেশী লইয়া উড়িয়া যায়, তাহাকে অপর গৃধ্রেরা, কাকেরা কিম্বা কুলালেরা পশ্চাদ্ধাবন করিয়া যদি মুখতুণ্ডদ্বারা দংশন করে, পাদনখদ্বারা আক্রমণ করে; গৃহপতি! ইহা কি মনে কর- যদি সেই গৃধ্র, কাক অথবা কুলাল ঐ মাংসপেশী যথা সম্ভব সত্বর দূরে নিক্ষেপ না করে, তবে তন্নিবন্ধন তাহার মরণ সংঘটিত হইতে পারে, অথবা মরণান্ত দুঃখ হইতেও পারে?”
“হাঁ, ভন্তে! হইবেই।”
“এই প্রকারই গৃহপতি! আর্যশ্রাবক এইরূপ প্রত্যবেক্ষণ করেন- ‘ভগবান কর্তৃক কামসমূহ মাংসপেশীবৎ উক্ত হইয়াছে, ইহাতে বহু দুঃখ, বহু উপায়াস, আর আদীনবও অত্যধিক।’ এইরূপে ইহা সম্যক্ প্রজ্ঞাদ্বারা যথাভূত দর্শন করিয়া যেই উপেক্ষা নানা স্বভাব, নানা অবলম্বনাশ্রিত তাহা সম্পূর্ণ বর্জন করিয়া যেই উপেক্ষা এক স্বভাব ও একারম্মণাশ্রিত এবং যাহাতে সর্বতোভাবে লোকামিষ ও উপাদান নিরবশেষে নিরুদ্ধ হয়- সেই উপেক্ষার অভিবৃদ্ধি সাধন করেন।”
৪৪। “যেমন গৃহপতি! কোন পুরুষ প্রজ্বলিত তৃণোল্কা লইয়া বায়ুর প্রতিকূলে গমন করে, গৃহপতি! তাহা কি মনে কর- যদি সেই ব্যক্তি ঐ প্রজ্বলিত তৃণোল্কা শীঘ্র শীঘ্র পরিবর্জন না করে, তবে উহা তাহার হস্ত, বাহু অথবা অন্যতর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দগ্ধ করিতে পারে, তন্নিবন্ধন তাহার মরণ কিম্বা মরণান্ত দুঃখ হইতে পারে?”
“হাঁ, নিশ্চয় ভন্তে!”
“গৃহপতি! এইরূপেই আর্যশ্রাবক ......।”
৪৫। “গৃহপতি! যেমন কোন স্থানে ধূম ও শিখাহীন প্রদীপ্ত অঙ্গারপূর্ণ এক পুরুষের (৪ হাত) অধিক পরিমিত অঙ্গারগর্ত আছে, যখন তথায় জীবনেচ্ছু, অমরণেচ্ছু সুখকামী, দুঃখবিরোধী কোন ব্যক্তি আসে, তাহাকে দুইজন বলবান পুরুষ বাহুযুগলে সজোরে ধরিয়া নির্দয় ভাবে অঙ্গারগর্তের দিকে আকর্ষণ করে, গৃহপতি! তাহা কি মনে কর- তখন সেই ব্যক্তি ইতস্ততঃ দেহ নমিত করিবে নহে কি?”
“হাঁ, নিশ্চয় করিবে ভন্তে!
“উহা করিবার কারণ কি?”
“ভন্তে! সেই পুরুষের ইহা সুবিদিত ‘যদি আমি এই অঙ্গারগর্তে পড়ি, তবে তন্নিবন্ধন আমার মৃত্যু ঘটিতে পারে, অথবা মরণান্ত দুঃখভোগ হইতে পারে’।”
৪৬। “গৃহপতি! যেমন কোন লোক স্বপ্নযোগে রমণীয় উদ্যান, রমণীয় বন, রমণীয় ভূমিভাগ ও রমণীয় পুষ্করিণী দর্শন করে। কিন্তু জাগ্রত অবস্থায় তাহা কিছু দেখিতে পায় না। এই প্রকারেই হে গৃহপতি! আর্যশ্রাবক ইহা প্রত্যবেক্ষণ করেন- ‘ভগবান কর্তৃক কামসমূহ স্বপ্নোপম উক্ত হইয়াছে। ... ...।”
৪৭। “গৃহপতি! যেমন কোন ব্যক্তি যাচিত (ঋণকৃত) ভোগ্যবস্তু, মানুষের যোগ্য যান, বিবিধ উৎকৃষ্ট মণিকুণ্ডল প্রভৃতি ধার করে এবং সেই যাচিত ভোগ্যবস্তু সমূহে পুরস্কৃত ও পরিবৃত হইয়া নগর মধ্যে উপস্থিত হয়। তখন জনসাধারণ তাহাকে দেখিয়া বলে যে, ‘ওহে! এই ব্যক্তি নিশ্চয় ধনবান। এইরূপেই ধনবানেরা ধন সম্পদ ভোগ করেন।’ কিন্তু স্বামীরা (মহাজন) তাহাকে যেখানেই দেখিতে পায় সেখানেই স্বীয় বস্তু সমূহ গ্রহণ করেন। গৃহপতি! তুমি কি মনে কর, সেই পুরুষের পক্ষে অন্যথা (প্রতিকূল) ভাব সঙ্গত নহে কি?”
“হাঁ, ভন্তে!”
“তাঁহার কারণ কি?”
“ভন্তে! স্বামীরা নিশ্চয়ই স্বীয় সম্পত্তি আহরণ করিবেন।”
“এই প্রকারেই হে গৃহপতি! আর্যশ্রাবক ইহা প্রত্যবেক্ষণ করেন- ‘ভগবান কর্তৃক উক্ত হইয়াছে কাম সমূহ যাচিত (ধারে গৃহীত) সম্পত্তি সদৃশ ... ...।”
৪৮। “গৃহপতি! যেমন নাকি কোন গ্রাম বা নগরের অদূরে অধিক গভীর বন আছে, তথায় বৃক্ষ সকল সুমিষ্ট ফল দেয় ও বহু ফলবা; কিন্তু কোন ফল ভূমিতে পতিত থাকে না। তখন কোন ফলার্থী ফলান্বেষী পুরুষ ফল অন্বেষণে বিচরণ করিতে করিতে (ঘটনাক্রমে) তথায় উপস্থিত হয়। সে সেই গভীর বনে প্রবেশ করিয়া ঐ সুমিষ্ট ফল ও বহু ফলন্ত বৃক্ষ দেখিতে পায়। তখন তাহার এইরূপ চিন্তা হয়- ‘এই বৃক্ষ সুমিষ্ট ফলবিশিষ্ট ও বহু ফলবান, অথচ কোন ফল ভূমিতে পড়ে নাই। আমি বৃক্ষে আরোহণ করিতে জানি। সুতরাং এই বৃক্ষে আরোহণ করিয়া যদি ইচ্ছানুরূপ ফল খাইতে পারি ও উৎসঙ্গ পূর্ণ করিতে পারি তবেই উত্তম।’ সে ঐ বৃক্ষে উঠিয়া ইচ্ছানুরূপ ফল খায় ও উৎসঙ্গ পূর্ণ করে।”
“তখন দ্বিতীয় ব্যক্তি ফলার্থী ও ফলান্বেষী হইয়া ফলান্বেষণে বিচরণ করিতে করিতে সুতীক্ষ্ন কুঠারী লইয়া তথায় উপস্থিত হয়। সে ঐ গভীর বনে প্রবেশ করিয়া সেই সুস্বাদু ফল ও বহু ফলন্তবৃক্ষ দেখিতে পায়। তখন তাহার এই ধারণা জন্মে- ‘এই বৃক্ষ সুস্বাদুফল বিশিষ্ট ও বহু ফলবান। অথচ কোন ফল ভূমিতে পতিত হয় নাই। আমিও বৃক্ষে আরোহণ করিতে জানিনা। কাজেই এই বৃক্ষের মূল ছেদন করিয়া প্রয়োজনানুসারে ফল খাইলে ও উৎসঙ্গ পূর্ণ করিলেই ভাল হয়।’ তখন সে ঐ বৃক্ষ-ছেদন আরম্ভ করে। তাহা কি মনে কর, গৃহপতি! যেই পুরুষ প্রথম বৃক্ষে আরোহণ করিয়াছে, যদি সত্বর সে বৃক্ষ হইতে অবতরণ না করে, বৃক্ষপতন সময়ে ঐ ব্যক্তির হাত ব্যক্তির হাত ভাঙ্গিতে পারে, পা ভাঙ্গিতে পারে অথবা অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভাঙ্গিতে পারে; তন্নিমিত্ত তাহার মরণ কিংবা মরণান্ত দুঃখ-ভোগও হইতে পারে?”
“হাঁ, ভন্তে!”
“এইরূপেই, হে গৃহপতি! আর্যশ্রাবক চিন্তা করেন যে ‘কামসমূহ বৃক্ষ ও ফল সদৃশ, ইহা ভগবান কর্তৃক উক্ত হইয়াছে...।”
৪৯। “গৃহপতি! এই সেই আর্যশ্রাবক, যিনি এই অনুত্তর উপেক্ষা ও পরিশুদ্ধ স্মৃতিতে আশ্রয় করিয়া বহুবিধ পূর্নজন্ম সম্বন্ধে স্মরণ করেন। যেমন- একজন্ম, দুইজন্ম, তিনজন্ম ......।” আকার ও উদ্দেশ সহিত নানাবিধ পূর্বনিবাস স্মরণ করেন।”
“গৃহপতি! ইনিই সেই আর্যশ্রাবক যিনি এই অনুত্তর উপেক্ষা ও পরিশুদ্ধ স্মৃতি আশ্রয় করিয়া মানুষোত্তর, বিশুদ্ধ, দিব্য-চক্ষুদ্বারা চ্যুতির সময়, উৎপত্তির সময় হীনোৎকৃষ্ট অবস্থায় সুগতি-দুর্গতি পরায়ণ অপর সত্ত্বগণকে দর্শন করেন। ... ... যথাকর্ম গতিপ্রাপ্ত সত্ত্বগণকে প্রকৃষ্টরূপে জানেন।”
“গৃহপতি! সেই আর্যশ্রাবক এই অনুত্তর উপেক্ষা ও পরিশুদ্ধ স্মৃতিকে অবলম্বণ করিয়া আস্রবরাশির ক্ষয় করিয়া অনাস্রব চিত্তবিমুক্তি ও প্রজ্ঞাবিমুক্তি ইহজীবনে স্বীয় অভিজ্ঞা দ্বারা প্রত্যক্ষ করিয়া, অধিগত হইয়া অবস্থান করেন। গৃহপতি! এই পর্যন্তই আর্যবিনয়ে সর্বতসর্ব ও সর্বথা সর্বভাবে ব্যবহার-সমুচ্ছেদ হয়।”
৫০। “গৃহপতি! তোমার ধারণা কি? যেই প্রকারে আর্যবিনয়ে সর্বতসর্ব ও সর্বথা সর্বভাবে ব্যবহার-সমুচ্ছেদ হয়। তুমি তদ্রূপ ব্যবহার-সমুচ্ছেদ নিজের মধ্যে দেখিতেছ কি?”
“কোথায় ভন্তে! আমি, আর কোথায় আর্যবিনয়ে সর্বতসর্ব ও সর্বথা সর্বভাবে ব্যবহার-সমুচ্ছেদ। ভন্তে, আর্যবিনয়ের সর্বতসর্ব ও সর্বথা সর্বভাবে ব্যবহার-সমুচ্ছেদ হইতে (আকাশ পাতালবৎ) আমি অন্তরালে--অতিশয় দূরে। ভন্তে! আমরা পূর্বে অন্যতৈর্থিক পরিব্রাজকগণকে (গৃহী ব্যবহার-সমুচ্ছেদ সম্বন্ধে) অনভিজ্ঞ অবস্থায় অভিজ্ঞ বলিয়া ধারণা করিয়াছি, অনভিজ্ঞ অবস্থায় অভিজ্ঞের ভোগ্য ভোজন দিয়াছি, অনভিজ্ঞ অবস্থাতে অভিজ্ঞের স্থানে রাখিয়াছি। কিন্তু ভন্তে! এখন আমরা অন্যতৈর্থিক পরিব্রাজকদিগকে অনভিজ্ঞ অবস্থায় অনভিজ্ঞরূপে জানিব, অনভিজ্ঞ অবস্থায় অনভিজ্ঞের যোগ্য ভোজন দান করিব, অনভিজ্ঞ অবস্থায় অনভিজ্ঞ স্থানে রাখিব। ভন্তে! আমরা ভিক্ষুদিগকে অভিজ্ঞ অবস্থায় অভিজ্ঞ রূপে জানিব, অভিজ্ঞ অবস্থায় অভিজ্ঞের যোগ্য ভোজন দান করিব, অভিজ্ঞ অবস্থায় অভিজ্ঞস্থানে স্থাপন করিব। ভন্তে ভগবন! আপনি শ্রমণদের প্রতি আমার শ্রমণপ্রেম, শ্রমণদের প্রতি শ্রমণপ্রসাদ, শ্রমণদের প্রতি শ্রমণ গৌরব জন্মাইয়াছেন। অতি আশ্চর্য ভন্তে! অতি শ্রমণদের প্রতি শ্রমণ গৌরব জন্মাইয়াছেন। অতি আশ্চর্য ভন্তে! অতি অদ্ভুত ভন্তে! ......।”
॥ পোতলিয় সূত্র সমাপ্ত ॥