২০৭। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-
এক সময় ভগবান কুরুজনপদের কম্মাস্সদম্ম নামক কুরুবাসীদের নগরে ভারদ্বাজগোত্র ব্রাহ্মণের অগ্নি-আগারে (যজ্ঞশালায়) তৃণ বিছানায় বিহার করিতেছেন।
তখন ভগবান পূর্বাহ্ন সময়ে নিবাসন পরিধান করিয়া পাত্র-চীবর লইয়া কম্মাস্সদম্মে (কল্মাষদম্মে) ভিক্ষার নিমিত্ত প্রবেশ করিলেন। কম্মাস্সদম্মে পিণ্ডাচরণ করিয়া ভোজনের পর ভিক্ষা হইতে প্রত্যাবৃত্ত হইয়া দিবা বিহারের নিমিত্ত তিনি যেখানে অন্যতর বনগহন তথায় উপস্থিত হইলেন। সেই গভীর বনে প্রবিষ্ট হইয়া এক বৃক্ষমূলে দিবা বিহারে উপবেশন করিলেন।
তখন মাগন্দিয় পরিব্রাজক জংঘা বিহার বা পদব্রজে ভ্রমণ ও বিচরণ (পরিক্রমা) করিতে করিতে ভারদ্বাজগোত্র ব্রাহ্মণের যজ্ঞশালায় উপনীত হইলেন। মাগন্দিয় পরিব্রাজক ভারদ্বাজগোত্র ব্রাহ্মণের যজ্ঞশালায় তৃণ বিছানা প্রজ্ঞাপ্ত দেখিলেন, দেখিয়া ভারদ্বাজগোত্র ব্রাহ্মণকে বলিলেন,- “মাননীয় ভারদ্বাজের অগ্নিশালায় কাহার তৃণ-আসন সজ্জিত আছে, শ্রমণযোগ্য শয্যাই মনে হইতেছে?”
“ভো মাগন্দিয়! শাক্যপুত্র, শাক্যকুল হইতে প্রব্রজিত শ্রমণ-গৌতম আছেন, সেই ভগবান গৌতমের এরূপ কল্যাণ-কীর্তি শব্দ উদ্গত হইয়াছে,- ‘সেই ভগবান এই কারণে অর্হৎ, সম্যক্সম্বুদ্ধ, বিদ্যাচরণ সম্পন্ন, সুগত, লোকবিদ্, দম্য পুরুষ দমনে অনুত্তর সারথি, দেব-মনুষ্যদের শাস্তা, বুদ্ধ ও ভগবান হন’, সেই মাননীয় গৌতমের শয্যাই সজ্জিত আছে।”
“ভো ভারদ্বাজ! আমরা দুদৃশ্য দর্শন করিলাম, যেহেতু আমরা সেই ভূণহুর (অপুষ্ট ইন্দ্রিয়ের) শয্যা দেখিলাম।”
“মাগন্দিয়! এই কথা রাখিয়া দাও, মাগন্দিয়! এই বাক্য সংযত কর। সেই মাননীয় গৌতমের প্রতি বহু সংখ্যক ক্ষত্রিয় পণ্ডিত, ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, গৃহপতি পণ্ডিত ও শ্রমণ পণ্ডিত সুপ্রসন্ন এবং আর্য (পরিশুদ্ধ) ন্যায় কুশল (নির্দোষ) ধর্মে বিনীত হইয়াছেন।”
“ভো ভারদ্বাজ! যদি আমরা সেই মাননীয় গৌতমকে সম্মুখে দেখি, তবে সম্মুখেও তাঁহাকে বলিতাম- ‘শ্রমণ গৌতম ভূণহু’। ইহার কারণ কি? যেহেতু আমাদের সূত্রে (বেদে) এইরূপই আসিয়াছে।”
“যদি মাননীয় মাগন্দিয়ের গুরুভার মনে না হয় তবে আমরা শ্রমণ গৌতমকে ইহা বলিতে পারি।”
“ভারদ্বাজ! নিরুদ্বেগ চিত্তে আপনি তাঁহাকে আমার কথাই বলিতে পারেন।”
২০৮। ভগবান মনুষ্যাতীত, বিশুদ্ধ, দিব্যকর্ণ দ্বারা মাগন্দিয় পরিব্রাজকের সহিত ভারদ্বাজ ব্রাহ্মণের এই বাক্যালাপ শুনিতে পাইলেন। তখন ভগবান সায়ংকালীন ফল সমাপত্তি হইতে উঠিয়া যেখানে ভারদ্বাজগোত্র ব্রাহ্মণের অগ্নিশালা তথায় উপনীত হইলেন, উপস্থিত হইয়া আস্তৃত তৃণ শয্যাতেই বসিলেন। তখন ভারদ্বাজগোত্র ব্রাহ্মণ ভগবান সমীপে উপস্থিত হইলেন, ভগবানের সহিত সম্মোদন করিলেন, সম্মোদনীয় কথা শেষ করিয়া একান্তে বসিলেন; একান্তে উপবিষ্ট ভারদ্বাজগোত্র ব্রাহ্মণকে ভগবান বলিলেন,- “ভারদ্বাজ! এই তৃণ-আসন সম্বন্ধে তোমার ও মাগন্দিয় পরিব্্রাজকের মধ্যে কোন বাক্যালাপ হইয়াছে?”
এরূপ উক্ত হইলে ভারদ্বাজগোত্র ব্রাহ্মণ সংবিগ্ন (প্রীতি-উৎফুল্ল) লোমহর্ষ হইয়া ভগবানকে বলিলেন,- “ইহাই আমরা মাননীয় গৌতমকে বলিতে ইচ্ছুক, অথচ মাননীয় গৌতম ইহাই অনাখ্যান করিলেন- বলিতে দিলেন না।”
২০৯। ভারদ্বাজগোত্র ব্রাহ্মণের সহিত ভগবানের এই কথাই চলিতেছিল। তখন মাগন্দিয় পরিব্রাজক পদব্রজে ভ্রমণ ও বিচরণ করিতে করিতে যথায় ভারদ্বাজের অগ্নিশালা এবং ভগবান আছেন তথায় পৌঁছিলেন, পৌঁছিয়া ভগবানের সহিত প্রীতি-সম্মোদন ও স্মরণীয় কথা শেষ করিয়া একান্তে বসিলেন, একান্তে উপবিষ্ট মাগন্দিয় পরিব্রাজককে ভগবান বলিলেন,- “মাগন্দিয়! চক্ষু রূপারাম, (রূপ ইহার আরাম বা বাসস্থান) রূপে রত, রূপ-সম্মোদিত হয়, তথাগতের সে চক্ষু দান্ত, গুপ্ত, রক্ষিত, সংবৃত এবং সংযমের নিমিত্ত তিনি ধর্মদেশনা করেন। মাগন্দিয়! এই উদ্দেশ্যে তুমি বলিয়াছ নহে কি শ্রমণ গৌতম ভূণহু হন?”
“ভো গৌতম! এই উদ্দেশ্যেই আমাকর্তৃক বর্ণিত হইয়াছে- ‘শ্রমণ গৌতম ভূণহু হন। তাহার কারণ আমাদের সূত্রে এরূপই আসিয়াছে।”
“মাগন্দিয়! শ্রোত্র শব্দারাম ....। ঘ্রাণ গন্ধারাম ....। জিহ্বা রসারাম ....। কায়া স্পৃষ্টব্যারাম .....। মন ধর্মারাম ....।”
২১০। “তাহা কি মনে কর, মাগন্দিয়! এক্ষেত্রে কোন (পুরুষ) পূর্বে চক্ষু-বিজ্ঞেয় ইষ্ট, কান্ত, মনোরম, প্রিয়-স্বভাব, কাম-সংযুক্ত ও রমণীয় রূপের দ্বারা অভিরমিত হইয়াছে; সে অপর সময়ে সেই রূপেরই সমুদয় অস্তগমন, আস্বাদ, আদীনব (দৈন্য) ও নিঃসরণ (নির্গমনোপায়) যথাভূত অবগত হইয়া, রূপ তৃষ্ণা প্রহাণ করিয়া, রূপ-পরিদাহ বিনোদন করিয়া, বিগত-পিপাসা ও আধ্যাত্মিক উপশান্ত চিত্ত হইয়া বাস করে। তাহার সম্বন্ধে তোমার কি বক্তব্য আছে?”
“কিছু নাই, ভো গৌতম!”
“ইহা কি মনে কর, মাগন্দিয়! ...... শ্রোত্র-বিজ্ঞেয় শব্দভোগে অভিরমিত ......। ..... ঘ্রাণ-বিজ্ঞেয় গন্ধভোগে অভিরমিত ......। ...... জিহ্বা-বিজ্ঞেয় রসভোগে অভিরমিত ......। ...... কায়-বিজ্ঞেয় স্পৃষ্টব্যভোগে অভিরমিত ...... অপর সময়ে সে যথাভূত জ্ঞাত হইয়া বিহার করে। ...... তৎসম্বন্ধে তোমার বক্তব্য কি?”
“কিছু নাই, ভো গৌতম!”
২১১। “মাগন্দিয়! পূর্বে গৃহী অবস্থায় আমি পঞ্চকামগুণে সমর্পিত সমঙ্গীভূত হইয়া চক্ষু-বিজ্ঞেয় ইষ্ট, কান্ত, মনোরম, প্রিয়স্বভাব, কামসংযুক্ত ও রমনীয় রূপ দ্বারা পরিচিত হইয়াছি। শ্রোত্র-বিজ্ঞেয় শব্দদ্বারা ...... , ঘ্রাণ বিজ্ঞেয় গন্ধদ্বারা ...... , জিহ্বা-বিজ্ঞেয় রসদ্বারা ......, কায়-বিজ্ঞেয় স্পৃষ্টব্য দ্বারা ......। মাগন্দিয়! তখন আমার তিনখানি প্রাসাদ ছিল- এক বর্ষাকালিক, এক হৈমন্তিক এবং এক গ্রীষ্মকালীন। আমি বর্ষাঋতুর চারি মাস বর্ষাকালিক প্রাসাদে পুরুষহীন (স্ত্রী) তূর্যদ্বারা পরিচারিত (সেবিত) হইয়া নিু প্রাসাদে অবতরণ করি নাই। সেই আমি অপর সময়ে কাম সমূহেরই (বিষয়ভোগের) সমুদয়, অস্তগমন, আস্বাদ, আদীনব ও নিঃসরণ যথাভূত অবগত হইয়া, কাম-তৃষ্ণা ত্যাগ করিয়া, কাম-পরিদাহ দমন করিয়া, কাম-পিপাসা রহিত ও আধ্যাত্মিক উপশান্ত চিত্ত হইয়া বিহার করি। (যখন) আমি অপর সত্বগণকে কামে অবীতরাগ, কামতৃষ্ণা দ্বারা উপদ্রুত, কামানলে প্রজ্বলিত হইয়াও কাম পরিভোগ করিতে দর্শন করি, তখন আমি তাহাদিগকে স্পৃহা করি না, তাহাতে অভিরমিত হই না। তাহার কারণ কি? মাগন্দিয়! বিষয়ভোগ হইতে স্বতন্ত্র, অকুশল ধর্ম হইতে পৃথক- এই যে (ধ্যান ও ফল সমাপত্তি জনিত) রতি বিদ্যমান, তাহা দিব্যসুখকে অধিগ্রহিত বা পরাভূত করিয়া স্থিত আছে। সেই রতিতে রমিত হইয়া আমি হীন রতিকে আর স্পৃহা করি না, উহাতে অভিরমিত হই না।”
২১২। “যেমন মাগন্দিয়! কোন আঢ্য, মহাধনী, মহাভোগ সম্পন্ন গৃহপতি বা গৃহপতি পুত্র পঞ্চকামগুণ- চক্ষুদ্বারা জ্ঞেয় ইষ্ট, কান্ত, মনোরম, প্রিয়, কমনীয় ও রঞ্জনীয় রূপ ...... শব্দ ...... গন্ধ ...... রস ...... স্পৃষ্টব্য দ্বারা সমর্পিত, সমঙ্গীভূত (সংযুক্ত) হইয়া বিহার করেন। তিনি কায়দ্বারা সুচরিত আচরণ করিয়া, বাক্যদ্বারা সুচরিত আচরণ করিয়া এবং মনোদ্বারা সুচরিত আচরণ করিয়া দেহত্যাগে মৃত্যুর পর সুগতি স্বর্গলোকে ত্রয়োস্ত্রিংশবাসী দেবগণের সারূপ্যে উৎপন্ন হন। তিনি তথায় নন্দনবনে অপ্সরা সমূহ দ্বারা পরিবৃত হইয়া দিব্য পঞ্চকামগুণ দ্বারা সমর্পিত সমঙ্গীভূত হইয়া পরিভোগ করেন। তিনি কোন গৃহপতি বা গৃহপতিপুত্রকে পঞ্চকামগুণে সমর্পিত ও সমঙ্গীভূত হইয়া ভোগ করিতে দেখেন। তাহা কি মনে কর, মাগন্দিয়! কেমন নন্দনবনে অপ্সরা সমূহ পরিবৃত হইয়া পঞ্চ দিব্য কামগুণ দ্বারা সমর্পিত ও সমঙ্গীভূত হইয়া কামভোগের সময় সে দেবপুত্র কি অমুক গৃহপতি বা গৃহপতি পুত্রের কিংবা মানুষের ভোগ্য পঞ্চ কামগুণের স্পৃহা করিবেন? অথবা মনুষ্য কামের প্রতি পুনরাগমন করিবেন? প্রলুব্ধ হইবেন?”
“ইহা কখনও সম্ভব নহে, ভো গৌতম!”
“ইহার কারণ কি?”
“ভো গৌতম! মনুষ্য কাম হইতে দিব্য কামরাশি অতিক্রান্ত (উচ্চ) তর, উৎকৃষ্টতর।”
“এরূপই মাগন্দিয়! পূর্বে গৃহী অবস্থায় আমি ......। মাগন্দিয়! যে রতি দিব্যসুখকে পরাভূত করিয়া স্থিত আছে, সে রতি দ্বারা রমিত হইবার সময় আর হীন রতির প্রতি স্পৃহা করি নাই, তাহাতে অভিরমিত হই নাই।”
২১৩। “যেমন মাগন্দিয়! কোন কুষ্ঠরোগী পুরুষ ক্ষত শরীর, পক্ক (গলিত) দেহ, ক্রিমিদ্বারা ভক্ষিত অবস্থায়- নখে কণ্ডুয়ণ করিতে করিতে ব্রণমুখ (ঘা) ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করিয়া অঙ্গারগর্তে শরীর উত্তপ্ত করিতে থাকে। তাহার মিত্র-অমাত্য, জ্ঞাতি-সলোহিতগণ একজন শল্যকর্তা ভিষককে উপস্থিত করিল। সেই শল্যকর্তা ভিষক তাহাকে ঔষধ প্রয়োগ করে, সে সেই ভৈষজ্য প্রভাবে কুষ্ঠরোগ হইতে মুক্ত, নীরোগ, সুখী, স্বাধীন, স্বয়ংবশী ও যথেচ্ছা গমনশীল হইল। এমন সময় সে অপর ...... ক্ষতশরীর ...... জ্বলন্ত অঙ্গারগর্তে শরীর তপ্ত করিতে এক কুষ্ঠরোগীকে দেখিল। ইহা কি মনে কর, মাগন্দিয়! সেই নীরোগ ব্যক্তি কি অমুক কুষ্ঠরোগীর, অঙ্গারগর্তের কিংবা ঔষধ প্রয়োগের স্পৃহা করিবে?”
“নিশ্চয় না, ভো গৌতম!”
“ইহার কারণ কি?”
“ভো গৌতম! রোগ থাকিলেই’ত ঔষধের প্রয়োজন, রোগ না থাকিলে ঔষধের প্রয়োজন আর থাকে না।”
“এইরূপই মাগন্দিয়! পূর্বে গৃহী অবস্থায় আমি ...... এখন তাহাতে অভিরমিত হইনা।”
২১৪। “যেমন মাগন্দিয়! ক্ষতশরীর ...... কুষ্ঠরোগী ...... চিকিৎসা দ্বারা কুষ্ঠ হইতে মুক্ত হইয়া যায়। (তখন) বলবান দুই পুরুষ.....দুই বাহু ধরিয়া তাহাকে অঙ্গারগর্তের দিকে সজোরে আকর্ষণ করে, তাহা কি মনে কর মাগন্দিয়! সে ব্যক্তি (না যাইবার জন্য) ইতস্ততঃ শরীর নমিত করিবে নহে কি?”
“নিশ্চয়, ভো গৌতম!”
“তার কারণ কি?”
“ভো গৌতম! সেই অগ্নি মহাতাপ, ভীষণ-দাহ ও দুঃখ-সংস্পর্শ।”
“ইহা কি মনে কর, মাগন্দিয়! এখনই কি সে অগ্নি মহাতাপ, ভীষণ-দাহ ও দুঃখ-সংস্পর্শ? অথবা পূর্বে (রোগের সময়ে)ও সে অগ্নি ...... দুঃখ-সংস্পর্শ ছিল?”
“ভো গৌতম! এখনও সে অগ্নি ...... দুঃখ-সংস্পর্শ, আর পূর্বেও ...... দুঃখ-সংস্পর্শই ছিল। কিন্তু ভো গৌতম! পূর্বে সে ক্ষতশরীর ...... উপহতেন্দ্রিয় (বিক্ষত-চর্ম) কুষ্ঠরোগী অগ্নির দুঃখ-সংস্পর্শতেই- ‘সুখে আছে’- এই ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করিয়াছিল।”
এইরূপই মাগন্দিয়! কাম (বিষয়-ভোগ) অতীতকালেও মহাতাপ, ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক ও দুঃখ-সংস্পর্শই ছিল; ভবিষ্যতকালেও বর্তমান সময়েও তাহা মহাতাপ, ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক ও দুঃখ-সংস্পর্শ জনক। মাগন্দিয়! যাহারা কামে অবীতরাগ, কাম-তৃষ্ণা দ্বারা উপদ্রুত, কাম পরিদাহে দগ্ধ অবস্থায় ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়ে সেই প্রাণিগণ এই দুঃখ-সংস্পর্শ কামেতে- ‘সুখ আছে’- এই ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করিয়া থাকে।”
২১৫। “যেমন মাগন্দিয়! ক্ষতশরীর ...... কুষ্ঠরোগী অঙ্গারগর্তে শরীর তপ্ত করে। মাগন্দিয়! যে যে ভাবে কোন কুষ্ঠরোগী ...... কৃমি উপদ্রুত শরীরকে চুলকাইবে, তপ্ত করিবে; সেই সেই পরিমাণেই সে ক্ষত-মুখে অধিকতর অশুচি, অধিকতর দুর্গন্ধ ও অধিকতর পূঁয আসিবে। ব্রণমুখ কণ্ডুয়ণ হেতু ক্ষণকালের তরে সামান্য রস, সামান্য আস্বাদ মনে হইয়া থাকে। এই প্রকারেই মাগন্দিয়! কামভোগে অবীত-রাগ হেতু, কাম-তৃষ্ণা দ্বারা উপদ্রুত অবস্থায়, কামানলে প্রজ্বলিত অবস্থায় প্রাণিগণ কামসমূহ সেবন করিয়া থাকে। মাগন্দিয়! কাম-বিষয়ে অবীতরাগ ...... প্রাণিগণ যেই পরিমাণ কাম সেবন করিবে, সেই পরিমাণেই সেই-প্রাণিদের কাম-তৃষ্ণা বৃদ্ধি পাইবে, কামানল প্রজ্বলিত হইবে; পঞ্চকামগুণ সেবায় ক্ষণিকের তরে তাহাদের সামান্য রস-বোধ ও আস্বাদের ভাণ হইতে পারে।”
“মাগন্দিয়! তাহা কি মনে কর, তুমি কোথাও দেখিয়াছ কিংবা শুনিয়াছ কি যে পঞ্চবিধ কামগুণে সমর্পিত ও সংযুক্ত হইয়া কোন রাজা কিংবা রাজার প্রধান মন্ত্রী- কাম-তৃষ্ণা পরিত্যাগ না করিয়া, কামানল না নিভাইয়া, পিপাসামুক্ত ও আধ্যাত্মিক উপশান্ত চিত্ত হইয়া বাস করিয়াছেন, বাস করেন বা বাস করিবেন?”
“কখনই না, হে গৌতম!”
“সাধু, মাগন্দিয়! আমিও তাহা দেখি নাই শুনিও নাই যে ...... কোন রাজা বা রাজ মহামাত্য- কাম-তৃষ্ণা পরিত্যাগ না করিয়া ...... বাস করিবেন। কিন্তু মাগন্দিয়! যে সকল শ্রমণ বা ব্রাহ্মণ কাম পিপাসা রহিত হইয়াছেন, আপনার মধ্যে উপশান্ত চিত্ত হইয়া বিহার করিয়াছেন, করিতেছেন কিংবা করিবেন; তাঁহারা সকলে সমস্ত কামেরই সমুদয়, অস্তগমন, আস্বাদ, আদীনব ও নিঃসরণ যথাভূত বিদিত হইয়া, কাম-তৃষ্ণা ত্যাগ করিয়া, কাম-পরিদাহ বিনোদন করিয়া, কাম-পিপাসা রহিত হইয়া, আপনার ভিতরে উপশান্ত চিত্ত হইয়া বিহার করিয়াছেন, করিতেছেন বা করিবেন।”
অতঃপর ভগবান সেই সময় এই উদান উচ্চারণ করিলেন,-
“আরোগ্য পরম লাভ, নির্বান পরম সুখ,
অমৃতগামীর মার্গ- অষ্টাঙ্গ পরম ক্ষেম।”
২১৬। এইরূপ উক্ত হইলে মাগন্দিয় পরিব্রাজক ভগবানকে বলিলেন,- “আশ্চর্য, ভো গৗতম! অদ্ভুত, ভো গৌতম! মাননীয় গৌতম দ্বারা কেমন সুভাষিত হইল- ‘আরোগ্য পরম লাভ, নির্বান পরম সুখ।’ আমিও, হে গৌতম! আমার পূর্ব পরিব্রাজক আচার্য-প্রাচার্যদের ভাষণে শুনিয়াছি- ‘আরোগ্য পরম লাভ, নির্বান পরম সুখ’। উহার সহিত ইহা বেশ সামঞ্জস্য হইতেছে।”
“মাগন্দিয়! তুমি যে পূর্ব পরিব্রাজক আচার্য-প্রাচার্যদের ভাষণ শুনিয়াছ- ‘আরোগ্য ...... পরম সুখ’, উহাতে আরোগ্য কি প্রকার, আর নির্বানই বা কি প্রকার?”
এইরূপই উক্ত হইলে মাগন্দিয় পরিব্রাজক কেবল স্বীয় দেহ হস্তদ্বারা মার্জনা করিতে করিতে (বলিলেন),- “ভো গৌতম! ইহাই আরোগ্য, ইহাই নির্বান , আমি এখন নিরোগ ও সুখী হই; কারণ আমার কোন ব্যাধি নাই।”
২১৭। “যেমন মাগন্দিয়! জন্মান্ধ পুরুষ, সে না দেখে কাল-সাদা রূপ (দৃশ্য), না দেখে নীল রূপ, না দেখে পীত রূপ, না দেখে লোহিত রূপ, না দেখে মঞ্জিষ্ঠ রংএর রূপ, না দেখে সম-বিষম ভূমি, না দেখে (আকাশের) নক্ষত্ররাজি এবং না দেখে চন্দ্র-সূর্যকে। সে চক্ষুষ্মানের ভাষণে শুনিতে পায় যে- শ্বেতবস্ত্রই অতি স্বচ্ছ (উত্তম), সুন্দর, নির্মল ও শুচি। সে শ্বেতের সন্ধানে চলিল। তাহাকে কোন পুরুষ তৈল-মসীসিক্ত গাঢ় কাল বস্ত্রদ্বারা বঞ্চিত করিল- ‘হে পুরুষ! ইহাই তোমার অভিপ্রেত শ্বেতবস্ত্র- সুন্দর, নির্মল ও শুচি।’ সে তাহাই গ্রহণ করে, গ্রহণ করিয়া পরিধান করে, পরিধান করিয়া সন্তুষ্ট চিত্তে সন্তোষকর বাক্য উচ্চারণ করে- ‘অহো! শ্বেতবস্ত্র কেমন স্বচ্ছ, সুন্দর, নির্মল ও শুচি!’ তাহা কি মনে কর, মাগন্দিয়! কেমন সে জন্মান্ধ পুরুষ জানিয়া, দেখিয়া তৈল-মসীকৃত ঘন-কাল কাপড় গ্রহণ করে, পরিধান করে; ...... পরিধান করিয়া ...... সন্তোষকর বাক্য উচ্চারণ করে- ‘অহো! শ্বেতবস্ত্র ...... , অথবা চক্ষুষ্মানের প্রতি শ্রদ্ধাবশতঃ?”
“ভো গৌতম! সে জন্মান্ধ পুরুষ না জানিয়া না দেখিয়াই সেই তৈল-মসীলিপ্ত ...... গ্রহণ করে, চক্ষুষ্মানের প্রতি শ্রদ্ধাবশতঃ।
“এইরূপই মাগন্দিয়! অন্ধ নেত্রহীন অন্যতৈর্থিক (ভিন্ন মতালম্বী) পরিব্রাজকগণ আরোগ্য জানে নাই, নির্বান দেখে নাই, তথাপি এই গাথা বলিয়া থাকে- ‘আরোগ্য পরম লাভ, নির্বান পরম সুখ।’ মাগন্দিয়! পূর্বের অর্হৎ সম্যক্ সম্বুদ্ধগণ এই গাথা ভাষণ করিয়াছেন-
‘পার্থিব লাভের মাঝে সুস্থতা প্রধান,
উপশান্ত সুখ হয় পরম নির্বান;
মার্গ মধ্যে অষ্টাঙ্গিক সবার উত্তম,
অমৃতগামীর তরে ক্ষেম অনুপম’।”
২১৮। “সে গাথা (অংশ) বর্তমানে ধীরে ধীরে প্রাকৃত জনের মধ্যে প্রচলিত হইয়া রহিয়াছে। মাগন্দিয়! এই শরীর রোগময়, গণ্ডময়, শল্যময়, অঘময় ও ব্যাধি মন্দির। তুমিই এই রোগময় ...... ব্যাধি মন্দির দেহকে বলিতেছ- ‘ভো গৌতম! ইহাই আরোগ্য, ইহাই নির্বান।’ সুতরাং মাগন্দিয়! তোমার সেই আর্যচক্ষু (পরিশুদ্ধ বিদর্শনজ্ঞান ও মার্গজ্ঞান) নাই, যেই আর্যচক্ষু দ্বারা তুমি আরোগ্য জানিতে পার ও নির্বান দেখিতে পার।”
“মাননীয় গৌতমের প্রতি আমি এমনই শ্রদ্ধা রাখি যে তিনি আমাকে তদ্রূপ ধর্মোপদেশ করিতে সমর্থ হইবেন, যে প্রকারে আমি আরোগ্য জানিতে পারি এবং নির্বান দেখিতে সক্ষম হই।”
২১৯। “যেমন মাগন্দিয়! কোন জন্মান্ধ পুরুষ শ্বেত-কাল, নীল-পীত, লোহিত-মঞ্জিষ্ঠ রূপ (বর্ণ) দেখে না; সম-বিষম দেখে না; নক্ষত্র-রূপ দেখে না ও চন্দ্র ও সূর্যকে দেখে না। তাহার মিত্রামাত্য, জ্ঞাতি সলোহিতগণ একজন শল্যকর্তা ভিষককে আহ্বান করিল। সেই শল্যকর্তা ভিষক তাহাকে ঔষধ প্রয়োগ (চিকিৎসা) করেন। সেই ভৈষজ্য প্রয়োগে তাহার চক্ষু উৎপাদন করিতে সমর্থ হইল না, চক্ষু বিশুদ্ধ হইল না। ইহা কি মনে কর, মাগন্দিয়! কেমন সে চিকিৎসক কেবল ক্লান্তি ও বিঘাত বা দুঃখের ভাগী হইবে নহে কি?”
“হাঁ, ভো গৌতম!”
“এইরূপ মাগন্দিয়! যদি আমি তোমাকে ধর্মোপদেশ করি যে ‘ইহা আরোগ্য, ইহা নির্বান,’ আর তুমি সেই আরোগ্য জানিতে না পার, নির্বান দেখিতে অসমর্থ হও; তবে তাহা হইবে আমার ক্লান্তি, তাহা হইবে আমার বিঘাত।”
“মাননীয় গৌতমের প্রতি আমি এরূপ প্রসন্ন যে মাননীয় গৌতম আমাকে তথাবিধ ধর্মোপদেশ করিতে সমর্থ ...... যাহাতে আমি নির্বান দর্শনে সক্ষম হই।”
২২০। “যেমন মাগন্দিয়! জন্মান্ধ পুরুষ ...... চন্দ্র সূর্যকে দেখেনা, অথচ সে চক্ষুষ্মানের ভাষণে শুনিতে পায়, ......। সে তাহা গ্রহণ করে ...... পরিধান করে। অপর সময় তাহার মিত্রামাত্য ও জ্ঞাতি সলোহিতগণ কোন শল্যকর্তা ভিষককে আহ্বান করে। তিনি ...... চিকিৎসার্থ ঊর্ধ বিরেচন, অধঃ বিরেচন, অঞ্জন, প্রত্যঞ্জন, নস্যকর্ম (নাকে ভৈষজ্য প্রদান) করেন। তিনি ভৈষজ্য প্রদান করিয়া চক্ষু উৎপাদন করেন, চক্ষুদ্বার বিশোধন করেন। তাহার চক্ষু উৎপাদনের সাথে সাথেই সেই তৈল-মসীকৃত, কাল-ঘন বস্ত্রের (কাল ভেড়ার লোম নির্মিত বস্ত্রের) প্রতি তাহার যে ছন্দ-রাগ ছিল, উহা পরিত্যক্ত হয়। আর সে সেই বঞ্চক পুরুষকে অমিত্র মনে করে, প্রত্যর্থি বা শত্রু বলিয়া ধারণা করে। অথচ তাহার জীবন-নাশের প্রয়োজনও অনুভব করে, আহা! দীর্ঘদিন যাবৎ এই পুরুষ কর্তৃক তৈল-মসীলিপ্ত কাল-ঘন বস্ত্রদ্বারা আমি প্রতারিত, বঞ্চিত হইয়াছি যে- ‘হে পুরুষ ইহা তোমার অভিপ্রেত, অতিস্বচ্ছ, সুন্দর, নির্মল ও শুচি শ্বেতবস্ত্র’।”
“এইরূপই মাগন্দিয়! আমি যদি তোমাকে ধর্মোপদেশ করি- ‘ইহা আরোগ্য, ইহা নির্বান’, আর তুমি আরোগ্য জানিতে পার, নির্বান দেখিতে পার; তবে তোমার চক্ষু উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গেই পঞ্চ উপাদান স্কন্ধের প্রতি তোমার যে ছন্দ-রাগ আছে, তাহা প্রহীণ হইবে। তোমার এ ধারণা জন্মিবে ‘আহা! দীর্ঘকাল যাবৎ এই (সংসারাবর্ত অনুগত) চিত্তই আমাকে বঞ্চিত, বিকৃত ও প্রতারিত করিয়াছে। আমি রূপকেই (আপন বলিয়া) গ্রহণ (উপাদান) করিয়াছি, বেদনা ...... , সংজ্ঞা ...... , সংস্কার ...... , বিজ্ঞানকে (আপন বলিয়া) গ্রহণ করিয়াছি। আমার সেই উপাদান প্রত্যয় হইতে ভব (কর্ম), ভব-প্রত্যয় হইতে জাতি (জন্ম), জাতি-প্রত্যয় হইতে জরা-মরণ-শোক-পরিদেবন (ক্রন্দন)-দুঃখ-দৌর্মনস্য উপায়াস (মনস্তাপ) উৎপন্ন হইয়াছে।’ এইরূপে কেবল অশেষ দুঃখ-স্কন্ধের (পুঞ্জের) সমুদয় (উৎপত্তি) হইতেছে।”
“আমি মান্য গৌতমের প্রতি এরূপ শ্রদ্ধা রাখিয়া গৌতমের অধিকার আছে যে আমাকে এ প্রকার ধর্মোপদেশ করিবেন যাহাতে আমি এই আসনেই জ্ঞানচক্ষু লাভ করিয়া উঠিতে পারি।”
২২১। “তবে মাগন্দিয়! তুমি সৎপুরুষদিগকে সেবা করিও। যখন তুমি সৎপুরুষদের ভজন করিবে তখন তুমি সদ্ধর্ম শুনিতে পাইবে। যখন তুমি সদ্ধর্ম শুনিবে তখন হইতে তুমি ধর্মানুসারে আচরণ করিবে। যখন তুমি ধর্মানুকুল আচরণ করিবে তখন হইতে স্বয়ংই জানিবে- ইহারা (পঞ্চোপাদান স্কন্ধ) রোগ, গণ্ড, শল্য; এ অবস্থায় যাবতীয় রোগ, গণ্ড, শল্য নিঃশেষে নিরুদ্ধ হয় (পঞ্চস্কন্ধের স্বরূপ ও পরিণাম অবগত হইলে তৎপ্রতি উপাদান বা গ্রহণেচ্ছা কমিয়া যায়)। তখন তোমার উপাদান নিরোধ হেতু ভব নিরোধ হইবে, ভব নিরোধ হেতু জাতি নিরোধ হইবে, জাতি বা জন্ম নিরোধ হেতু জরা-মরণ-শোক-রোদন-দুঃখ-দৌর্মনস্য-উপায়াস প্রভৃতি নিরুদ্ধ হইবে; এ প্রকারে কেবল এই দুঃখপুঞ্জের নিরোধ সংঘটিত হইয়া থাকে।”
২২২। এ প্রকার উপদিষ্ট হইলে মাগন্দিয় পরিব্রাজক ভগবানকে বলিলেন,- “আশ্চর্য, ভো গৌতম! অতি উত্তম, ভো গৌতম! যেমন অধঃমুখকে ঊর্ধমুখ করিলেন ......। আমি ভগবান গৌতমের শরণ লইলাম ধর্ম এবং ভিক্ষুসংঘেরও। ভন্তে! ভগবৎ সমীপে আমি প্রব্রজ্যা লাভ করিতে চাই, উপসম্পদা প্রার্থনা করি।”
“মাগন্দিয়! যে কোন ভূতপূর্ব অন্যতৈর্থিক এই ধর্ম-বিনয়ে প্রব্রজ্যা ও উপসম্পদা প্রত্যাশা করে তাহাকে চারিমাস যাবৎ পরিবাস করিতে হয়।”
“যদি ভন্তে! ...... পরিবাস করিতে (প্রয়োজন) হয়, ...... তবে আমি চারি বৎসরও পরিবাস করিব।”
মাগন্দিয় পরিব্রাজক ভগবানের সমীপে প্রব্রজ্যা ও উপসম্পদা লাভ করিলেন।
উপসম্পদা লাভের অচিরকাল পরে আয়ুষ্মান মাগন্দিয় একাকী নির্জন-বিহারী ...... আত্ম সংযমী হইয়া বিহার করিতে করিতে অনতিবিলম্বেই ...... অনুত্তর ব্রহ্মচর্যের অন্তিম (অর্হত্ব) ফল ইহজীবনে উপলব্ধি করিয়া বিহার করিতে লাগিলেন। ...... আয়ুষ্মান মাগন্দিয় অর্হৎদের অন্যতর হইলেন।
॥ মাগন্দিয় সূত্র সমাপ্ত ॥
২২৩। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-
এক সময় ভগবান কৌসম্বীতে ঘোষিতারামে বাস করিতেছেন। সেই সময় পঞ্চশত পরিব্রাজকের মহৎ পরিব্রাজক পরিষদের সহিত সন্দর পরিব্রাজক প্রক্ষগুহায় বাস করিতেছিলেন। তখন আয়ুষ্মান আনন্দ সায়ংকালীন ধ্যান হইতে উঠিয়া ভিক্ষুদিগকে আহ্বান করিলেন,- “বন্ধুগণ! চলুন, যেখানে দেবকৃত-শ্বভ্র আছে, গুহা দর্শনার্থ আমরা তথায় যাই।”
“হাঁ, বন্ধু! (বলিয়া) সে ভিক্ষুগণ আয়ুষ্মান আনন্দকে সম্মতি জ্ঞাপন করিলেন।
তখন আয়ুষ্মান আনন্দ বহু ভিক্ষুর সহিত যেখানে দেবকৃত-শ্বভ্র, তথায় উপস্থিত হইলেন।
সেই সময় সন্দক পরিব্রাজক বৃহৎ পরিব্রাজক পরিষদের মধ্যে বহুবিধ নিরর্থক কথায়, যথা- রাজ-কথা, চোর-কথা, মহামাত্য-কথা, সেনা-কথা, ভয়-কথা, যুদ্ধ-কথা, অন্ন-কথা, পান-কথা, বস্ত্র-কথা, শয়ন-কথা, মালা-কথা, গন্ধ-কথা, জ্ঞাতি-কথা, যান-কথা, গ্রাম-কথা, নিগম-কথা, নগর-কথা, জনপদ-কথা, স্ত্রী-কথা, শূর-কথা, বিশিখা (রাস্তাবাসীদের)-কথা, কুম্ভস্থান (জলঘাটে কুম্ভবাসীদের)-কথা, পূর্বপ্রেত (অতীত-জ্ঞাতি)-কথা, নানাত্ব-কথা, লোক-আখ্যায়িকা, সমুদ্র-আখ্যায়িকা ইতি ষড়বিধ ভবাভব (এরূপ হইয়াছে বা এরূপ হয় নাই)-কথা আদিতে উচ্চনাদ, উচ্চশব্দ, মহাকোলাহলে নিরত অবস্থায় উপবিষ্ট ছিলেন। সন্দক পরিব্রাজক দূর হইতেই আয়ুষ্মান আনন্দকে আসিতে দেখিলেন, দেখিয়া আপন পরিষদকে বলিলেন- “আপনারা সকলে নীরব হউন, শব্দ করিবেন না। এই যে শ্রমণ গৌতমের শিষ্য শ্রমণ আনন্দ আসিতেছেন। শ্রমণ গৌতমের যে সকল শ্রাবক কৌশাম্বীতে বাস করেন তাঁহাদের অন্যতর এ শ্রমণ আনন্দ। এই আয়ুষ্মানগণ নিঃশব্দকামী, নীরব বুদ্ধদ্বারা বিনীত ও অল্পশব্দের প্রশংসাকারী হন।” পরিষদ অল্পশব্দ জানিয়া সম্ভবতঃ তিনি এখানে আসার ইচ্ছা করিতে পারেন। তখন সে পরিব্রাজকগণ মৌনাবলম্বন করিলেন।
২২৪। তখন আয়ুষ্মান আনন্দ যেখানে সন্দক পরিব্রাজক আছেন, তথায় গেলেন। সন্দক পরিব্রাজক আয়ুষ্মান আনন্দকে বলিলেন,- “আনন্দ! আপনি আসুন, স্বাগতম্ মাননীয় আনন্দের। চিরকাল পর মাননীয় আনন্দ এদিকে আগমনের সুযোগ করিলেন। বসুন, মহানুভব আনন্দ! এই যে আসন সজ্জিত।”
আয়ুষ্মান আনন্দ সজ্জিত আসনে উপবেশন করিলেন। সন্দক পরিব্রাজকও এক নীচ-আসন লইয়া একান্তে বসিলেন।
আয়ুষ্মান আনন্দ একান্তে উপবিষ্ট সন্দক পরিব্রাজককে কহিলেন,- “সন্দক! এখানে কি আলোচনায় (আপনারা) উপবিষ্ট ছিলেন? ইতিমধ্যে আপনাদের কি কথাই বা মাঝখানে অসম্পূর্ণ রহিল?”
“রেখে দিন (থাক) সে কথা, ভো আনন্দ! যে কথায় আমরা এখানে বসিয়াছিলাম পরেও ওকথা মাননীয় আনন্দের পক্ষে শ্রবণ করা দুর্লভ হইবে না। সাধু (বেশ), স্বীয় আচার্যমতের ধর্মকথা মহানুভব আনন্দের প্রতিভাত হউক।”
“তাহা হইলে, সন্দক! শুনুন, উত্তমরূপে মনে রাখুন, আমি ভাষণ করিব।”
“ভাল কথা” (বলিয়া) সন্দক পরিব্রাজক আয়ুষ্মান আনন্দকে উত্তর দিলেন।
আয়ুষ্মান আনন্দ বলিলেন,- “সেই ভগবান সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী, অর্হৎ, সম্যক্সম্বুদ্ধ চারি প্রকার অব্রহ্মচর্যবাস বর্ণনা করিয়াছেন, আর চারি আশ্বাস (ভরসা) রহিত ব্রহ্মচর্যবাস (সন্যাস) বলিয়াছেন যাহাতে বিজ্ঞ-পুরুষ নিশ্চয় ব্রহ্মচর্যবাস করেন না। বাস করিলেও ন্যায় (নির্বান) কুশল (নিরবদ্য) ধর্ম আরাধনা করিতে সমর্থ হন না।”
“হে আনন্দ! সেই ভগবান ...... কোন্ চারি প্রকার অব্রহ্মচর্যবাস ...... বর্ণনা করিয়াছেন?”
২২৫। “সন্দক! জগতে কোন শাস্তা (গুরু, পন্থা-চালক) এরূপ মতবাদী ও এরূপ দৃষ্টি সম্পন্ন হন - ‘দানের ফল নাই, যজ্ঞের ফল নাই, হবণের ফল নাই, সুকৃত-দুষ্কৃত কর্মের ফল-বিপাক নাই, পরলোকস্থের ইহলোক নাই, ইহলোকস্থের পরলোক নাই, মাতৃ-কর্তব্যের ফল নাই, পিতৃ-কর্তব্যের ফল নাই, উপপাতিক (মৃত্যুর পর উৎপন্ন হইবার মত) সত্ব নাই। এমন কোন সম্যক্গত ও সম্যক্ প্রতিপন্ন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ নাই যাঁহারা ইহলোক ও পরলোক স্বয়ং অভিজ্ঞাদ্বারা প্রত্যক্ষ করিয়া (পরকে) প্রকাশ করেন। এই পুরুষ চতুর্মহাভূতময়। যখন মৃত্যু হয়- (দেহের) পৃথিবী (বাহিরের) পৃথিবী কায়ে উপনীত হয়; মিশিয়া যায়; আপ আপ-কায়ে ...... মিশিয়া যায়; তেজ তেজ-কায়ে ...... মিশিয়া যায়; বায় বায়ু-কায়ে ...... মিশিয়া যায়। ইন্দ্রিয় সমূহ আকাশে সংক্রমণ করে, পুরুষেরা মঞ্চে করিয়া মৃতদেহ লইয়া যায়, শ্মশানে দাহ পর্যন্ত পদসমূহ (গুণ-দোষ বা পদচিহ্ন) জানা যায়। অস্থিগুলি কপোত-শুভ্র হয়। দানাদি আহুতিরাশি ভস্মে পর্যবসিত হয়। দান ধূর্তের নির্দেশ, যাঁহারা কিছু আস্তিকবাদ বলেন তাঁহাদের বাক্য তুচ্ছ, মিথ্যা-বিলাপ । মূর্খ বা পণ্ডিত দেহ-ত্যাগের পর (সকলেই) উচ্ছিন্ন হইয়া যায়, বিনষ্ট হইয়া যায়, মৃত্যুর পর কেহ থাকে না।’ সন্দক! এই সম্বন্ধে বিজ্ঞ-পুরুষ এই প্রকার বিচার করেন- এই মাননীয় শাস্তা (শিক্ষাদাতা) এরূপ বাদী, এরূপ দৃষ্টিসম্পন্ন- ‘দান ফল নাই ......। যদি এই শাস্তার বাক্য সত্য হয়, তবে (পুণ্য) না করিলেও এই মতে আমার কৃত হইয়াছে, (ব্রহ্মচর্য) বাস না করিয়াও আমার ব্রহ্মচর্য পূর্ণ হইয়াছে। এই শ্রমণধর্মে (নাস্তিকগুরু আর আমি) আমরা উভয়ে সমসম শ্রামণ্য প্রাপ্ত হইয়াছি। আমি বলিনা যে আমরা দুইজনই দেহ-ত্যাগে উচ্ছিন্ন হইব, বিনাশ হইব, মৃত্যুর পর আর থাকিব না। তবে এই মাননীয় শাস্তার এই যে নগ্নতা, মুণ্ডতা, উৎকট তপস্যা (উক্কুটিকপ্পধান) ও কেশ-শ্মশ্রু লুঞ্চন (ছেদন) নিরর্থক (নিষপ্রয়োজন), যেহেতু আমি যখন পুত্র-সম্বাধ শয্যায় (গৃহে) বাস করিয়া, কাশীজাত চন্দন চর্চিত হইয়া, মালা-সুগন্ধ-বিলেপন ধারণ করিয়া, সোনা-চাঁদি গ্রহণ করিয়াও মৃত্যুর পর এই মান্য শাস্তার সহিত সমগতি প্রাপ্ত হইব। তখন আমি কি বুঝিয়া, কি দেখিয়া এই (নাস্তিকবাদী) শাস্তার সমীপে ব্রহ্মচর্য আচরণ করিব? (এই প্রকারে) ইহা অব্রহ্মচর্যবাস বিদিত হইয়া সে উদাসীন হয়, সেই ব্রহ্মচর্য হইতে চলিয়া যায়।’ সন্দক! ইহাই সেই ...... ভগবান প্রথম অব্রহ্মচর্যবাস বলিয়াছেন যাহাতে বিজ্ঞ-পুরুষ ......।” (১)
২২৬। “পুনরায় সন্দক! জগতে কোন শাস্তা এরূপ বাদী ও এরূপ দৃষ্টি-সম্পন্ন হন - ‘(স্বহস্তে পাপ) করিলে, (আদেশ দ্বারা) করাইলে, (অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ) ছেদন করিলে- করাইলে, পরকে-দণ্ডাঘাত করিলে- করাইলে, শোকার্ত করাইলে, কষ্ট দেওয়াইলে, দলন করিলে- করাইলে, প্রাণীহত্যা করিলে- করাইলে, চুরি করিলে- করাইলে, সন্ধিচ্ছেদ করিলে, গ্রাম লুণ্ঠন করিলে, এক ঘর লুট করিলে, পথে ডাকাতি করিলে, পরদার গমন করিলে, মিথ্যা বলিলে, পাপ ইচ্ছায় করিলেও তাহাতে পাপ হয় না। ক্ষুরসম ধারাল চক্রদ্বারা যদি কেহ এই পৃথিবীর প্রাণিগণকে এক মাংসরাশি, এক মাংসপুঞ্জ করে, তাহার দরুণ পাপ হইবে না, পাপের আগমন হইবে না। যদি হত্যা করিতে করিতে, আঘাত করিতে করিতে, ছেদন করিতে করিতে, ছেদন করাইতে করাইতে, তাড়ন করিতে করিতে ও করাইতে করাইতে গঙ্গার দক্ষিণতীরে যায়, তথাপি তদ্দরুণ পাপ নাই- পাপের আগমন নাই। আবার দান দিতে দিতে ও দেওয়াইতে দেওয়াইতে, যজ্ঞ করিতে করিতে ও করাইতে করাইতে যদি গঙ্গার উত্তরতীরেও যায় তদ্দরুণ পুণ্য হয় না- পুণ্যের আগমনও হয় না। দান, (ইন্দ্রিয়) দম, সংযম, সত্য দ্বারা পুণ্য নাই- পুণ্যের আগমন নাই।’ সন্দক! তৎসম্বন্ধে বিজ্ঞ-পুরুষ এ প্রকার চিন্তা করেন- এই মান্য শাস্তা এই মতবাদী, এই দৃষ্টিসম্পন্ন হন- ‘করিলে ও করাইলে ......। যদি এই শাস্তার বাণী সত্য হয় ......। তবে আমরা উভয়েই সমান শ্রামণ্য (সমভাব) প্রাপ্ত হইয়াছি। ...... দুইজনেরই করিবার সময় পাপ হয় না। ...... তবে এই শাস্তার নগ্নতা ...... নিরর্থক। ......।’ ইহাই সন্দক! সেই ...... ভগবান দ্বিতীয় অব্রহ্মচর্যবাস বলিয়াছেন ......।” (২)
২২৭। “পুনশ্চ সন্দক! জগতে কোন শাস্তা এরূপবাদী ও এরূপ দৃষ্টি-সম্পন্ন হন- ‘সত্বদের সংক্লেশের নিমিত্ত কোন হেতু নাই, প্রত্যয় নাই। অহেতু অপ্রত্যয়াৎ সত্বগণ সংক্লেশ (চিত্ত-মালিন্য) প্রাপ্ত হয়। সত্বদের চিত্ত-বিশুদ্ধির কোন হেতু নাই, প্রত্যয় নাই। হেতু ও প্রত্যয় ব্যতীত প্রাণীরা বিশুদ্ধ হয়। (তন্নিমিত্ত) বল নাই, বীর্য নাই, পুরুষের স্থাম বা দৃঢ়তা নাই, পুরুষ পরাক্রমের প্রয়োজন নাই। সর্বসত্ব, সর্বপ্রাণী, সর্বভূত ও সর্বজীব অবশী (অস্বাধীন), বল-বীর্যহীন, নিয়তি-সঙ্গতি স্বভাবে বিভিন্নরূপে পরিণত হইয়া ষড়বিধ জাতিতে সুখ-দুঃখ ভোগ করিতে থাকে। ...... যদি ...... এই শাস্তার বাণী সত্য হয় ......। তবে আমরা উভয়েই হেতু-প্রত্যয় বিনাই শুদ্ধ হইয়া যাইব। ......।’ ইহাই সন্দক! সেই ...... ভগবান তৃতীয় অব্রহ্মচর্যবাস বলিয়াছেন। ...... ”(৩)
২২৮। পুনশ্চ সন্দক! লোকে কোন শাস্তা এরূপবাদী ও এরূপ দৃষ্টিসম্পন্ন হন- ‘এই সপ্তকায় অকৃত, অকৃত-বিধান, অনির্মিত অনির্মাপিত, বন্ধ্যা (অফল), কূটস্থ (পর্বত কূটবৎ স্থিত), ঐশিকস্তম্ভবৎ স্থির থাকে; তাহারা বিচলিত হয় না, বিকার প্রাপ্ত হয় না, একে অন্যের বাধা সৃষ্টি করে না, পরস্পরের সুখ, দুঃখ কিংবা সুখ-দুঃখের নিমিত্ত হইতে সমর্থ নহে। সেই সপ্তকায় কি?- পৃথিবী-কায় (সমূহ), আপ-কায়, তেজ-কায়, বায়ু-কায়, সুখ, দুঃখ ও জীব- এই সপ্ত। এই সপ্তকায় অকৃত ..... সুখ-দুঃখের নিমিত্ত হইতে সমর্থ নহে। তথায় হন্তা (হত্যাকারী) নাই কিংবা ঘাতয়িতা (হত্যার আদেশদাতা) নাই, শ্রোতা নাই, বক্তা নাই, বিজ্ঞাত নাই, বিজ্ঞাপক নাই। যাহারা তীক্ষ্ন শস্ত্রদ্বারা শিরচ্ছেদও করে (তথাপি) কেহ কাহারও জীবন নাশ করে না। সপ্তবিধ কায়ার অভ্যন্তরে বিবরে (খালিস্থানে) শস্ত্র পতিত হয় বা প্রবেশ করে। ইহারাই প্রধান যোনি- চৌদ্দশত-সহস্র, (অপর) ষাটশত, ছয়শত ও পঞ্চশত কর্ম, পঞ্চ ও তিন কর্ম, এক কর্ম ও অর্ধ কর্ম, বাষট্টি প্রতিপদ, বাষট্টি অন্তরকল্প, ছয় অভিজাতি, আট পুরুষ ভূমি , ঊনপঞ্চাশ আজীব শত, একূন পঞ্চাশ পরিব্রাজক শত, ঊনপঞ্চাশ শত নাগের আবাস, বিংশ শত ইন্দ্রিয়, ত্রিংশ শত নিরয়, ছত্রিশ রজোধাতু, সপ্ত সংজ্ঞাপন (পশু) গর্ভ, সপ্ত অসংজ্ঞাবান (শম্য) গর্ভ, সপ্ত (ইক্ষু আদি) গ্রন্থ জাত গর্ভ, সপ্তদেব, সপ্ত মনুষ্য, সাত পিশাচ, সাত সরোবর, সপ্ত গ্রন্থি (পমুটা), সপ্ত মহাপ্রপাত, সাতশ ক্ষুদ্র প্রপাত, সাত মহাস্বপ্ন, সাতাশ ক্ষুদ্র স্বপ্ন- (ইহাতে) চুরাশি শত সহস্র মহাকল্প পর্যন্ত সন্ধাবন ও সংসরণ করিয়া মূর্খ আর পণ্ডিত (সকলে) দুঃখের অন্তসাধন করিবে। তথায় ইহা নাই- আমি এই শীল, ব্রত, তপ বা ব্রহ্মচর্য দ্বারা অপরিপক্ক কর্মকে পরিপাক করিব পরিপক্ক কর্ম ভোগ করিয়া শেষ করিব। সুখ-দুঃখকে দ্রোণদ্বারা পরিমাণ করা যায় না, সংসারের হানি-বৃদ্ধি ও উৎকর্ষাপকর্ষ নাই, যেমন সূতার গুলি নিক্ষিপ্ত হইলে সূত্র পরিমাণেই নিঃশেষে খুলিয়া বিস্তৃত হয়, এইরূপেই মূর্খ আর পণ্ডিত (সকলেই) সন্ধাবন, সংসরণ করিয়াই দুঃখের অন্ত করিবেন।’ এই সম্বন্ধে সন্দক! বিজ্ঞ-পুরুষ এই চিন্তা করেন- ‘এখানে এই যে শাস্তা এরূপবাদী ও দৃষ্টিসম্পন্ন হন ......। যেমন সূতার গুলি ......। যদি এই শাস্তার বাক্য সত্য হয় তবে এক্ষেত্রে না করিয়াও আমরা কর্ম করিলাম.....। সুতরাং এখানে শাস্তার নগ্নতা ......।’ ইহাই সন্দক! সেই ...... ভগবান চতুর্থ অব্রহ্মচর্যবাস বলিয়াছেন ......।” (৪)
“সন্দক! সেই ...... ভগবান এই চতুর্বিধ অব্রহ্মচর্যবাস বলিয়াছেন।”
“আশ্চর্য, ভো আনন্দ! অদ্ভুত, ভো আনন্দ! ......। ভগবান এই চারি অব্রহ্মচর্যবাস বলিয়াছেন ......। কিন্তু হে আনন্দ! সেই ...... ভগবান কোন্ চারি অনাশ্বাসিক ব্রহ্মচর্যবাস বলিয়াছেন ...... ?”
২২৯। “সন্দক! এখানে কোন শাস্তা সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী, অশেষ জ্ঞানদর্শন জানার দাবী করেন - ‘চলনে, দাঁড়ানে, সুপ্ত ও জাগ্রত অবস্থায় সদাসর্বদা আমার জ্ঞানদর্শন উপস্থিত (পচ্চুপটিতং) থাকে।’ তথাপি তিনি শূন্য গৃহেও প্রবেশ করেন, (তথায়) ভিক্ষাও লাভ করেন না, কুকুরও দংশন করে, চণ্ডহস্তিরও সম্মুখীন হন, চণ্ড অশ্বের সম্মুখেও পড়েন, প্রচণ্ড গরুর সম্মুখেও পড়েন; (সর্বজ্ঞ হইয়াও) স্ত্রী-পুরুষের নাম-গোত্রও জিজ্ঞাসা করেন, গ্রাম-নিগমের নাম ও রাস্তা জিজ্ঞাসা করেন। (আপনি সর্বজ্ঞ হইয়া) এই কি (করিতেছেন)? জিজ্ঞাসিত হইলে- ‘শূন্য গৃহে প্রবেশে আমার নিয়তি ছিল, তাই প্রবেশ করিলাম, ভিক্ষা না পাইবার নিয়তি ছিল, তাই পাইলাম না, কুকুর দংশনের নিয়তি ছিল, তাই দংশিত হইলাম, হাতীর সহিত মিলনের ছিল ......।’ তথায় সন্দক! বিজ্ঞ-পুরুষ এরূপ চিন্তা করেন- এই শাস্তা যখন সর্বজ্ঞের দাবী করিতেছেন ...... (তখন) তিনি ‘এই ব্রহ্মচর্য (পন্থা) আশ্বাসজনক নহে’ ইহা জ্ঞাত হইয়া সেই ব্রহ্মচর্য হইতে উদ্বিগ্ন হইয়া প্রস্থান করেন। ইহাই সন্দক! সেই ...... ভগবান প্রথম অনাশ্বাসিক ব্রহ্মচর্যবাস বলিয়াছেন ......।” (১)
২৩০। “পুনশ্চ সন্দক! এখানে কোন শাস্তা আনুশ্রাবিক (অনুশ্রবাশ্রিত) অনুশ্রব (শ্রুতিকে) সত্যরূপে মান্য করে। তিনি ‘(শ্রুতিতে) এরূপ’, ‘(স্মৃতিতে) এরূপ’ অনুশ্রব দ্বারা পরম্পরায় পিটক বা শাস্ত্র প্রমাণ দ্বারা ধর্মোপদেশ করেন। সন্দক! আনুশ্রাবিক- অনুশ্রবকে সত্য মান্যকারী শাস্তার অনুশ্রব অনুশ্রুতও হইতে পারে, দুঃশ্রুতও হইতে পারে। তদ্রূপ (যথার্থ)ও হইতে পারে, অন্যথাও হইতে পারে। তথায় সন্দক! বিজ্ঞ-পুরুষ ইহা চিন্তা করেন- এই শাস্তা অনুশ্রাবিক ......। তিনি- ‘এই ব্রহ্মচর্য আশ্বাসজনক নহে’ ইহা জ্ঞাত হইয়া ......। দ্বিতীয় অনাশ্বাসিক ব্রহ্মচর্যবাস বলিয়াছেন ......।” (২)
২৩১। “পুনশ্চ সন্দক! এখানে কোন শাস্তা তার্কিক (তর্ক বা ন্যায় শাস্ত্রজ্ঞ) মীমাংসক হন। তিনি তর্কাহরিত ও মীমাংসানুচরিত স্বীয় প্রতিভালব্ধ ধর্মের উপদেশ করেন। সন্দক! তার্কিক ও মীমাংসক শাস্তার বিচার সুতর্কিতও হইতে পারে, দুঃতর্কিতও হইতে পারে। তথাও হইতে পারে, অন্যথাও হইতে পারে। ...... তৃতীয় অনাশ্বাসিক ব্রহ্মচর্যবাস বলা হইয়াছে ......।” (৩)
২৩২। “পুনশ্চ সন্দক! এখানে কোন শাস্তা মন্দবুদ্ধি- অতিমূঢ় হন। তিনি মন্দবুদ্ধি ও মূঢ়তা হেতু তথা তথা প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইয়া বাক্য বিক্ষেপ- অমর-বিক্ষেপ প্রাপ্ত হন- ‘এরূপও আমার মত নহে, তদ্রূপও আমার মত নহে, অন্যথাও আমার মত নহে, নহেও আমার মত নহে, না-নহেও আমার মত নহে।’ তথায় সন্দক! বিজ্ঞ-পুরুষ এই চিন্তা করেন .... চতুর্থ অনাশ্বাসিক ব্রহ্মচর্যবাস বলা হইয়াছে ....।” (৪)
“সন্দক! সেই ...... ভগবান এই চারি প্রকার অনাশ্বাসিক ব্রহ্মচর্যবাস বলিয়াছেন ......।”
“আশ্চর্য, ভো আনন্দ! অদ্ভুত, হে আনন্দ! এযাবৎ সে ভগবান চারি প্রকার অনাশ্বাসিক ব্রহ্মচর্য বলিয়াছেন। কিন্তু ভো আনন্দ! সেই যে শাস্তা তিনি কি মতবাদী, কি উপদেশ করেন, যাহাতে বিজ্ঞপুরুষ নিশ্চিতরূপে ব্রহ্মচর্যবাস করেন; বাস করিয়া ন্যায় ও কুশলধর্মের আরাধনা করিতে সমর্থ হন?”
২৩৩। “সন্দক! এক্ষেত্রে তথাগত অর্হৎ, সম্যক্ সম্বুদ্ধ, বিদ্যা-আচরণ সম্পন্ন, সুগত, লোকবিদ্, অনুত্তর-পুরুষ-দম্য সারথী, দেব-মনুষ্যদের শাস্তা, বুদ্ধ, ভগবান লোকে উৎপন্ন হইয়াছেন। তিনি দেব-নর সহিত এই লোক স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎ করিয়া প্রকাশ করেন। ...... ব্রহ্মচর্য প্রকাশ করেন। সেই ধর্ম গৃহপতি বা গৃহপতিপুত্র শ্রবণ করেন ......। তিনি সংশয় ত্যাগ করিয়া সংশয় রহিত হন।”
সন্দক! তিনি চিত্তের (সমাধির) উপক্লেশ ও প্রজ্ঞার দুর্বলকারী এই পঞ্চ নীবরণকে পরিত্যাগ করিয়া কাম ও অকুশলধর্ম হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া সবিতর্ক-সবিচার বিবেকজ প্রীতি-সুখ সমন্বিত প্রথম ধ্যান লাভ করিয়া বিহার করেন। সন্দক! যে শাস্তার সান্নিধ্যে শ্রাবক এবম্বিধ উদার বিশেষ অধিগত হয়, তাঁহার সমীপে বিজ্ঞ-পুরুষ নিশ্চয় ব্রহ্মচর্যবাস করিবেন; বাস করিয়াই ন্যায় ও কুশলধর্মের আরাধনা করিতে সমর্থ হইবেন।”
“পুনশ্চ সন্দক! ...... ভিক্ষু দ্বিতীয় ধ্যান প্রাপ্ত হইয়া বিহার করেন। ...... তৃতীয় ধ্যান ......। চতুর্থ ধ্যান ......। ...... পূর্বজন্ম স্মরণ করেন, ......। কর্মানুসার জন্মগ্রহণ করিতে সত্বগণকে দেখিতে পান। ...... আস্রব সমূহ হইতে তাঁহার চিত্ত বিমুক্ত হয়, বিমুক্তিতে ‘বিমুক্ত’ এই জ্ঞান হয়, জন্ম ক্ষীণ হয়, ব্রহ্মচর্য সমাপ্ত হয়। করণীয় কৃত, ইহার নিমিত্ত অপর কর্তব্য নাই- জানিতে পারেন। ......।”
২৩৪। “হে আনন্দ! যে ভিক্ষু অর্হৎ, ক্ষীণাস্রব, অবসিতবান, কৃত-করণীয়, পরিত্যক্ত ভার, সদর্থপ্রাপ্ত, পরিক্ষীণ ভব সংযোজন- সম্যক্ জ্ঞাত হইয়া বিমুক্ত; তিনি কাম ভোগ করেন কি?”
“সন্দক! যে ভিক্ষু অর্হৎ ...... বিমুক্ত হন, তিনি পঞ্চবিধ অপকর্ম আচরণ করিতে অসমর্থ হন। ক্ষীণাস্রব ভিক্ষু (১) জ্ঞাতসারে প্রাণীহত্যা করিতে অসমর্থ হন, (২) চুরি করিতে অসমর্থ হন, (৩) ...... মৈথুন সেবন করিতে অসমর্থ হন, (৪) জ্ঞানপূর্বক মিথ্যা ভাষণ করিতে অসমর্থ হন, (৫) ক্ষীণাস্রব ভিক্ষু পূর্বে গৃহী অবস্থার ন্যায় ভোগ্যবস্তু সমূহ সঞ্চিত রাখিয়া পরিভোগ করিতে অসমর্থ হন। ......।”
২৩৫। “ভো আনন্দ! যে ভিক্ষু অর্হৎ ক্ষীণাস্রব ...... বিমুক্ত হন, ...... তাঁহার চলনে, উপবেশনে, শয়নে, জাগরণে সদাসর্বদা জ্ঞানদর্শন উপস্থিত থাকে কি- ‘আমার আস্রব ক্ষয় হইয়াছে’?”
“তাহা হইলে সন্দক! তোমাকে উপমা প্রদান করিতেছি। এ ক্ষেত্রে উপমা দ্বারাও কোন কোন বিজ্ঞ-পুরুষেরা ভাষণের অর্থ হৃদয়ঙ্গম করিতে পারে। সন্দক! যেমন কোন ব্যক্তির হস্ত পদ ছিন্ন হইয়াছে। তাহার চলনে, উপবেশনে, শয়নে ও জাগরণে সদাসর্বদা তাহার হস্ত-পদ ছিন্ন। সুতরাং তাহা প্রত্যবেক্ষণ করা মাত্রই জানিতে পারে- ‘আমার হস্ত-পদ ছিন্ন হইয়াছে’। সেইরূপই সন্দক! যিনি ক্ষীণাস্রব ...... মুক্ত হইয়াছেন, ...... তাঁহার আস্রব সমূহ সদাসর্বদা ক্ষীণই থাকে। সুতরাং তাহা প্রত্যবেক্ষণ করিবার সময় তিনি জানিতে পারেন- ‘আমার আস্রব ক্ষীণ হইয়াছে’।”
২৩৬। “ভো আনন্দ! এই ধর্ম-বিনয়ে কত বহু মার্গ-দর্শক (নিয্যাতা) আছেন?”
“সন্দক! একশ, দুইশ, তিনশ, চার-পাঁচশ নহেন, পরন্তু তদপেক্ষাও অধিক নিয্যাতা এই ধর্ম-বিনয়ে বিদ্যমান।”
“আশ্চর্য, ভো আনন্দ! অদ্ভুত, হে আনন্দ! স্ব-ধর্মকে উকর্ষ করা কিংবা পরধর্মকে নিন্দা করা হইবে না। অথচ যথাস্থানে (বিস্তৃত ভাবে) ধর্মদেশনা হইবে। আর এত অধিকতর নিয্যাতাও প্রদর্শিত হইল। এই মৃতবৎসারপুত্র আজীবকগণ নিজকেই উৎকর্ষ করে, পরকে করে অপকর্ষ; তিনজনকে মার্গ-দর্শক বলিয়া থাকে, যথা ঃ- নন্দবাৎস্য, কৃশ-সাংকৃত্য ও মক্খলি গোশালকে।”
তখন সন্দক পরিব্রাজক আপন পরিষদকে আমন্ত্রণ করিলেন- আপনারা সকলে শ্রমণ গৌতম সমীপেই ব্রহ্মচর্যবাস করুন, তথায় প্রকৃত ব্রহ্মচর্য আছে। আমার পক্ষে লাভ-সৎকার প্রশংসা ত্যাগ করা আপাততঃ সহজ নহে। এ প্রকারেই সন্দক পরিব্রাজক স্বীয় পরিষদকে ভগবৎ সমীপে ব্রহ্মচর্য-বাসের নিমিত্ত নিয়োজিত করিলেন ।”
॥ সন্দক সূত্র সমাপ্ত ॥
২৩৭। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-
এক সময় ভগবান রাজগৃহে বেণুবন-কলন্দক নিবাপে বিহার করিতেছেন। সেই সময় কতিপয় প্রসিদ্ধ প্রসিদ্ধ পরিব্রাজক মোর-নিবাপে পরিব্রাজক আরামে বাস করিতেন, যেমন- অন্নভার, ববধর আর সকুল-উদায়ি পরিব্রাজক তথা অপর অভিজ্ঞাত পরিব্রাজকগণ।
তখন ভগবান পূর্বাহ্ন সময়ে (অন্তর্বাস) পরিধান পূর্বক পাত্র-চীবর ধারণ করিয়া রাজগৃহে ভিক্ষার্থ প্রবেশ করিলেন। ভগবানের মনে হইল- “রাজগৃহে পিণ্ডাচরণ করিতে এখনও অতি সকাল। সুতরাং যেখানে মোর-নিবাপ পরিব্রাজক-আরাম, যেখানে সকুল-উদায়ি পরিব্রাজক আসেন, তথায় গেলেই ভাল হয়।” তখন ভগবান যেখানে মোর-নিবাপ পরিব্রাজকারাম, তথায় গেলেন। সেই সময় সকুল-উদায়ি পরিব্রাজক ...... মহতী পরিব্রাজক পরিষদের সহিত উপবিষ্ট ছিলেন, সকুল-উদায়ি পরিব্রাজক দূর হইতেই ভগবানকে আসিতে দেখিলেন, দেখিয়া স্বীয় পরিষদকে বলিলেন, ...... ভগবান সকুল-উদায়ি পরিব্রাজক সমীপে উপনীত হইলেন। সকুল-উদায়ি পরিব্রাজক ভগবানকে বলিলেন,- “আসুন, ভন্তে ভগবন! ভন্তে ভগবানের স্বাগতম। ভন্তে ভগবন! চিরকাল পর এখানে আগমনের সুযোগ করিলেন। ভন্তে ভগবন! বসুন, এই যে আসন সজ্জিত।”
২৩৮। ভগবান সজ্জিত আসনে বসিলেন। সকুল-উদায়ি পরিব্রাজকও এক নীচ আসন লইয়া একান্তে বসিলেন। একান্তে উপবিষ্ট সকুল-উদায়ি পরিব্রাজককে ভগবান বলিলেন,- “উদায়ি! এখন তোমরা কি কথায় বসিয়াছিলে, তোমাদের মধ্যে কি কথা হইতেছিল?”
“রেখেদিন, ভন্তে! সে কথা, যে কথায় এখন আমরা বসিয়াছিলাম। ভন্তে! একথা পরেও শ্রবণ করা ভগবানের পক্ষে দুর্লভ হইবে না। ভন্তে! পূর্ব পূর্বতর দিনে কুতুহল শালায় উপবিষ্ট ও সম্মিলিত নানা তীর্থিক (সমপ্রদায়ের) শ্রমণ-ব্রাহ্মণদের মধ্যে এই কথা প্রসঙ্গ উৎপন্ন হয়- ‘ওহে! অঙ্গ-মগধবাসীর একান্তই লাভ, অঙ্গ-মগধবাসীর মহালাভ সুলব্ধ হইল; যেহেতু রাজগৃহে এই শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণ সংঘপতি, গণী, গণাচার্য, জ্ঞাত, যশস্বী, বহুজনের সুসম্মানিত তীর্থঙ্কর (পন্থা-স্থাপক) বর্ষাবাসে প্রবৃত হইয়াছেন। এই যে পূরাণকশ্যপ সংঘী, গণী, গণাচার্য, জ্ঞাত, যশস্বী, বহুজন সুসম্মানিত তীর্থঙ্কর হন, তিনিও রাজগৃহে বর্ষাবাসের নিমিত্ত আসিয়াছেন। ...... এই যে মক্খলি গোশাল ......। অজিত কেশকম্বল ......। ...... পকুধ কাত্যায়ণ ......। ...... সঞ্জয়বেলট্ঠিপুত্ত ......। ...... নিগণ্ঠ নাতপুত্ত ......। এই যে শ্রমণ গৌতমও সংঘী ......। তিনিও রাজগৃহে বর্ষাবাসের নিমিত্ত উপস্থিত আছেন। এই সকল ভাগ্যবান ...... বহুজনের সুসম্মানিত শ্রমণ-ব্রাহ্মণের মধ্যে কে শ্রাবকদের দ্বারা সৎকৃত, গৌরবকৃত, সম্মানিত ও পূজিত হন? শ্রাবকগণ কাহাকে অধিকতর সম্মান ও গৌরব করিয়া আশ্রয়ে বিহার করেন?”
২৩৯। তথায় কেহ কেহ এইরূপ বলিলেন,- “এই যে পূরণকশ্যপ সংঘী ...... হন, ...... তিনি শ্রাবকদের সৎকৃত ...... পূজিত নহেন। পূরণ-কশ্যপকে শ্রাবকগণ সৎকার, গৌরব, সম্মান, পূজা করিয়া আশ্রয়ে বিহার করেন না। অতীতে (এক সময়) পূরণকশ্যপ অনেক শত পরিসায় (পরিষদে) ধর্মোপদেশ করিতেছিলেন। তথায় পূরণকশ্যপের এক শ্রাবক শব্দ করিলেন- ‘মহাশয়গণ! পূরণকশ্যপকে এই সম্বন্ধে (এতমত্থং) জিজ্ঞাসা করিবেন না। তিনি ইহা জানেন না। আমরা ইহা জানি। আমাদিগকে এই সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করুন। আমরা ইহা আপনাদিগকে বর্ণনা করিব।’ সেই সময় পূরণকশ্যপ বাহু জড়াইয়া চীৎকার করিতে থাকেন (কদন্তো)- মহাশয়গণ! চুপ করুন, আপনারা শব্দ করিবেন না। এ সকল লোক আপনাদিগকে কিছু জিজ্ঞাসা করেন নাই। আমাদিগকে ইঁহারা জিজ্ঞাসা করিতেছেন। সুতরাং আমরা ইহার উত্তর দিব।’ কিন্তু (চুপ করাইতে) পারিলেন না। পূরণকশ্যপের বহু শ্রাবক বিবাদ বা দোষারোপ করিয়া তথা হইতে প্রস্থান করিল- ‘তুমি এ ধর্ম-বিনয় জান না, আমি এ ধর্ম-বিনয় জানি। কিরূপে তুমি এ ধর্ম-বিনয় জানিবে? তুমি মিথ্যা প্রতিপন্ন হও, আমি সত্যারূঢ় (সম্যক্ প্রতিপন্ন) হই। আমার বচন (সার্থক), তোমার নিরর্থক হয়। পূর্বের বচনীয় তুমি পরে বল, পরের বচনীয় পূর্বে বল। অনভ্যস্থকে (অবিচীর্ণকে) তুমি বিপর্যস্থ করিতেছ। তোমার বাদে নিগ্রহ আরোপিত হইয়াছে। বাদ (দোষ) মোচনার্থ যত্ন কর, অথবা যদি সমর্থ হও তবে গ্রন্থি খোল।’ এ প্রকারে পূরণকশ্যপ শ্রাবকদের দ্বারা সৎকৃত হন না এবং পূজিত হন না। ...... অধিকন্তু পূরণকশ্যপ স্বাভাবিক আক্রোশে আক্রোশিত হইয়াছেন।”
[মক্খলি গোশাল, অজিত কেশকম্বলী, পকুধ কাত্যায়ণ, সঞ্জয় বেলট্ঠিপুত্ত ও নিগণ্ঠ নাতপুত্ত সম্বন্ধেও এরূপ মন্তব্য।]
২৪০। কেহ কেহ বলিলেন,- “এই শ্রমণ গৌতম ...... সংঘী ...... হন। আর তিনি শ্রাবকদের ...... পূজিত হন ......। শ্রাবকগণ শ্রমণ গৌতমকে সৎকার, গৌরব সহকারে আশ্রয় লইয়া বিহার করেন। পূর্বে এক সময় শ্রমণ গৌতম অনেক শত সভাতে ধর্মোপদেশ করিতেছেন। তথায় শ্রমণ গৌতমের শ্রাবকদের একজন কাশিলেন। অপর সব্রহ্মচারী জানুতে স্পর্শ করিয়া সংক্ষেত করিলেন- ‘আয়ুষ্মান নীরব হউন, আয়ুষ্মান শব্দ করিবেন না। শাস্তা আমাদিগকে ধর্মোপদেশ করিতেছেন।’ যে সময়ে শ্রমণ গৌতম অনেক শত পরিষদে ধর্মোপদেশ করেন, সেই সময়ে শ্রমণ গৌতমের শ্রাবকদের হাঁচি বা কাশির শব্দ পর্যন্তও হয় না। তাঁহার প্রতি জনতা প্রত্যাশানুরূপে (মনোযোগ সহকারে) প্রস্তুত থাকে যে ভগবান আমাদিগকে যে ধর্ম ভাষণ করিবেন তাহা আমরা শুনিব। যেমন কোন ব্যক্তি চারি মহাপথের সংযোগ স্থলে ক্ষুদ্র মক্ষিকা-সঞ্চিত নির্দোষ মধু প্রদান করে, তাহাতে বৃহৎ জনতা প্রত্যাশানুরূপ উপস্থিত থাকে। সেইরূপ যখন শ্রমণ গৌতম অনেক শত পরিষদে ধর্মোপদেশ করেন, তখন বৃহৎ জনতা আশানুুরূপ ধর্ম শ্রবণ করেন।”
“শ্রমণ গৌতমের যে সব শ্রাবক সব্রহ্মচারীদের সাথে সামান্য বিবাদ করিয়া (ভিক্ষু) শিক্ষা ত্যাগ করে ও হীন (গৃহস্থ) আশ্রমে ফিরিয়া যায়, তাহারাও শাস্তার প্রশংসক হয়, ধর্ম-প্রশংসক হয় এবং সংঘ-প্রশংসক হয়; পর নিন্দুক নহে, আত্ম নিন্দুকই হয়- ‘আমরাই এ ক্ষেত্রে হতভাগ্য, পুণ্যহীন যেহেতু এমন স্বাখ্যাত ধর্ম-বিনয়ে প্রব্রজিত হইয়াও আমরা যাবজ্জীবন পরিপূর্ণ পরিশুদ্ধ ব্রহ্মচর্য আচরণ করিতে সমর্থ হইলাম না।’ তাহারা আরামিক (আরাম-সেবক) কিংবা গৃহস্থ (উপাসক) হইয়া পঞ্চবিধ শিক্ষাপদ (নীতি) গ্রহণ ও পালন করিয়া জীবন যাপন করে। এ প্রকারে শ্রমণ গৌতম শ্রাবকদের ...... পূজিত হন। শ্রমণ গৌতমকে শ্রাবকগণ সৎকার, গৌরব সহকারে আশ্রয় লইয়া বিহার করেন।”
২৪১। “উদায়ি! তুমি আমাতে কত ধর্ম (গুণ) দেখিতেছ, যে কারণে শ্রাবকগণ আমাকে ...... পূজা করে ...... ?”
“ভন্তে! ভগবানে আমি পঞ্চধর্ম দেখিতেছি, যদ্ধেতু ভগবানকে শ্রাবকগণ ...... পূজা করেন ......। সেই পঞ্চ কি? ভন্তে! ভগবান! (১) অল্পাহারী এবং অল্প আহারের প্রশংসাকারী, ভন্তে! ভগবান যে অল্পাহারী, অল্পাহারের প্রশংসক হন। ইহাই আমি ভন্তে! ভগবানে প্রথম ধর্ম দেখিতেছি, যে কারণে ভগবানের শ্রাবকগণ ......।
(২) ভগবান ভাল-মন্দ চীবর দ্বারাই সন্তুষ্ট থাকেন এবং ইতরিতর চীবরে সন্তুষ্টতার প্রশংসক ......।
(৩) যেমন-তেমন পিণ্ডপাত দ্বারা সন্তুষ্ট এবং ...... সন্তুষ্টতার প্রশংসক...।
(৪) ...... শয়নাসনের দ্বারা সন্তুষ্ট এবং ...... সন্তুষ্টতার প্রশংসক ......।
(৫) ...... নির্জনবাসী এবং....নির্জন বাসের প্রশংসক ......।
ভন্তে! ভগবানের নিকট এই পঞ্চধর্ম দেখিতেছি ......।”
২৪২। “উদায়ি! ‘শ্রমণ গৌতম অল্পাহারী, অল্পাহার প্রশংসক হন’, ইহাতে যদি শ্রাবকগণ আমাকে ...... পূজা করে ...... আশ্রয় করিয়া বিহার করে; তবে উদায়ি! আমার শ্রাবকেরা কোষক (ভাজন) আহারী, অর্ধ কোষকাহারী, বেল পরিমাণ ভোজী এবং অর্ধবেল পরিমাণ ভোজীও আছে। উদায়ি! আমি কদাচিৎ এই পাত্রের সম পরিমাণও ভোজন করি, অধিকও ভোজন করি। যদি ...... ‘অল্পভোজী ও অল্পাহার প্রশংসক হন’ এই হেতু ...... পূজা করে ......; তবে উদায়ি! আমার যে সব শ্রাবক.... অর্ধবেল পরিমাণ ভোজী তাহারা এই ব্যবহারের (অল্পাহারতার) দরুণ আমাকে সৎকার করিত না ....।” (১)
“উদায়ি! ...... ‘যেমন-তেমন চীবর দ্বারা সন্তুষ্ট, সন্তুষ্টতার প্রশংসক হন’, ইহাতে যদি শ্রাবকগণ আমাকে পূজা করে ...... ; তবে উদায়ি! আমার শ্রাবকেরা পাংশুকুলিক, লূখ (বিশ্রী) চীবরধারী আছে, তাহারা শ্মশান, আবর্জনা স্তূপ হইতে এবং বিপণির ছিন্ন অন্ত (পার) হীন বস্ত্রখণ্ড সঞ্চয় করিয়া সংঘাটী তৈরী ও ধারণ করে, উদায়ি! আমি কখন কখন দৃঢ়, শস্ত্র-লুখ, অলাবু লোমবৎ সুক্ষ্ম, গৃহপতি প্রদত্ত চীবরও পরিধান করি .....।” (২)
“উদায়ি! ...... ‘যেমন-তেমন পিণ্ডপাত দ্বারা সন্তুষ্ট, সন্তুষ্টতার প্রশংসক হন’, এই কারণে যদি আমাকে শ্রাবকেরা পূজা করে ..... ; তবে উদায়ি! আমার শ্রাবকগণ পিণ্ডপাতিক (ভিক্ষাজীবী) সপদানচারী (ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে ভিক্ষাচরণকারী) উঞ্ছব্রতে রতও আছে, তাহারা গ্রামে প্রবিষ্ট অবস্থায় আসনে নিমন্ত্রিত হইলেও গ্রহণ করে না। আমি নাকি উদায়ি! কখন কখন নিমন্ত্রিত শালিধানের কালিমাহীন ভাত, অনেক সূপ, অনেক ব্যঞ্জনও ভোজন করি ......।”(৩)
“উদায়ি! ‘যেমন-তেমন শয়নাসনে সন্তুষ্ট, সন্তুষ্টতার প্রশংসক হন’, ইহাতে যদি আমাকে শ্রাবকেরা...... পূজা করে .....; তবে উদায়ি! আমার শ্রাবকেরা বৃক্ষমূলিক ও অব্ভোকাসিক (বৃক্ষের নীচে ও উন্মুক্ত স্থানে বাসের) ধূতাঙ্গ ব্রতধারীও আছে। তাহারা আটমাস (চীবর রক্ষার্থ বর্ষা চারমাস ব্যতীত) আচ্ছাদনের নীচে যায় না। আমি তো উদায়ি! কখন কখন উল্লিপ্ত-অবলিপ্ত বায়ুরহিত দরজা-জানালাবদ্ধ কূটাগারে (প্রাসাদোপরিও) বিহার করি....।” (৪)
“উদায়ি! ...... ‘নির্জনবাসী ...... নির্জন প্রশংসক হন’, ইহাতে যদি আমাকে শ্রাবকেরা পূজা করে ...... ; তবে উদায়ি! আমার শ্রাবকেরা আরণ্যক (সতত অরণ্যবাসী) প্রান্তবর্তী শয়নাসন (গ্রাম হইতে দূরে) বিহারী আছে। (তাহারা) অরণ্যে বন-পন্থ প্রান্তবর্তী শয়নাসনে প্রবেশ করিয়া বিহার করে। তাহারা প্রত্যেক অর্ধমাসে প্রাতিমোক্ষ উদ্দেশের নিমিত্ত সংঘমধ্যে আসিয়া থাকে। অথচ উদায়ি! আমি কোন কোন সময় ভিক্ষু, ভিক্ষুণী, উপাসক, উপাসিকা, রাজা, রাজ-মহামাত্য, তীর্থঙ্কর এবং তীর্থঙ্কর শ্রাবকের দ্বারা আকীর্ণ হইয়া বিহার করি ......। এই প্রকারে উদায়ি! আমাকে শ্রাবকগণ এই পঞ্চধর্ম (গুণ) হেতু ...... পূজা করে ......।” (৫)
২৪৩। “উদায়ি! অপর পাঁচধর্ম আছে, যদ্বারা শ্রাবকগণ আমাকে ...... পূজা করে ......। সেই পাঁচ কি? এখানে উদায়ি! শ্রাবকগণ আমার অধিশীল (অনন্য সাধারণ চরিত্র) হেতু ...... সম্মান করে- ‘শ্রমণ গৌতম শীলবান হন, পরম শীলস্কন্ধ (সদাচার সমূহ) দ্বারা সংযুক্ত হন।’ উদায়ি! যে সকল শ্রাবক আমার শীলে বিশ্বাস করে .... ; ইহাই উদায়ি! প্রথম ধর্ম, যে কারণে ...... শ্রাবকগণ আমাকে পূজা করে।” (১)
২৪৪। “পুনশ্চ উদায়ি! শ্রাবকগণ আমার অভিক্রান্ত-জ্ঞানদর্শনকেই (সর্বজ্ঞতা জ্ঞানকেই) সম্মানিত করে- জানিয়াই শ্রমণ গৌতম বলেন- ‘আমি জানি’, দেখিয়াই শ্রমণ গৌতম বলেন- ‘আমি দেখি’। অভিজ্ঞাত হইয়াই শ্রমণ গৌতম ধর্মোপদেশ করেন, অভিজ্ঞাত না হইয়া নহে। সনিদান (কারণ সহিত) শ্রমণ গৌতম ধর্মোপদেশ করেন, অনিদান নহে। (দেশনাবিলাস) যুক্ত ...... ধর্মোপদেশ করেন, প্রতিহার্য্য রহিত নহে; ......।” (২)
২৪৫। “পুনরায় উদায়ি! শ্রাবকেরা আমাকে অধিপ্রজ্ঞার (প্রত্যুৎপন্ন প্রজ্ঞার) দরুণ সম্মানিত করে- ‘প্রজ্ঞাবান শ্রমণ গৌতম, পরম প্রজ্ঞাস্কন্ধ সমন্বিত হন।’ সে কারণে অনাগত বাদ-বিবাদমার্গ দেখা যায় না। (বর্তমানে) উৎপন্ন পর-প্রবাদ ন্যায় ধর্মানুসারে উত্তমরূপে নিগ্রহ (খণ্ডন) করিবে না, এমন সম্ভাবনা নাই। ইহা কি মনে কর, উদায়ি! কেমন শ্রাবকেরা এই প্রকারে জানিয়া, এই প্রকারে সত্যদর্শী হইয়া আমার উপদেশের সময় মাঝে মাঝে কথা বলিবে?”
“না, ভন্তে!”
“উদায়ি! আমি শ্রাবকদের নিকট অনুশাসন প্রত্যাশা করি না। পরন্তু শ্রাবকেরা আমারই উপদেশের প্রত্যাশা রাখে।(৩)
২৪৬। “পুনশ্চ উদায়ি! আমার শ্রাবকেরা যে দুঃখ দ্বারা দুঃখাবতীর্ণ, দুঃখ-নিমজ্জিত (অভিভূত) হয়, তাহারা আমার নিকট আসিয়া দুঃখ-আর্যসত্য সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে। এরূপে জিজ্ঞাসিত হইয়া আমি তাহাদিগকে দুঃখ-আর্যসত্য বর্ণনা করি, প্রশ্নোত্তর দ্বারা আমি তাহাদের চিত্ত সন্তুষ্ট করি। তাহারা আসিয়া আমাকে দুঃখ-সমুদয় আর্যসত্য, দুঃখ-নিরোধ আর্যসত্য ও দুঃখ-নিরোধগামিনী-প্রতিপদা আর্যসত্য সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করে ......।” (৪)
২৪৭। “পুনশ্চ উদায়ি! আমি শ্রাবকদিগকে প্রতিপদা বা মার্গ বলিয়াছি যেভাবে প্রতিপন্ন হইয়া শ্রাবকগণ চতুর্বিধ স্মৃতি-উপস্থান ভাবনা করিতে পারে। এখানে বীর্যবান, সমপ্রজ্ঞানী ও স্মৃতিমান ভিক্ষু লোকে (বিষয়ে) অভিধ্যা দৌর্মনস্যকে দমন করিয়া কায়ে কায়ানুদর্শী হইয়া বিহার করে; বেদনা সমূহে বেদনানুদর্শী ...... , চিত্তে চিত্তানুদর্শী ...... ও ধর্মে ধর্মানুদর্শী হইয়া বিহার করে। আর সেই বিষয়ে আমার বহু শ্রাবক অভিজ্ঞতার অবসান ও পরমোৎকর্ষত্ব (অর্হত্ব) প্রাপ্ত হইয়া বিহার করে।” (৫)
“পুনশ্চ উদায়ি! আমি শ্রাবকগণকে সেই প্রতিপদা বলিয়াছি যাহাতে প্রতিপন্ন হইয়া আমার শ্রাবকেরা চতুর্বিধ সম্যক্ প্রধান বৃদ্ধি করিতে পারে। উদায়ি! এখানে ভিক্ষু (১) অনুৎপন্ন পাপ-অকুশলধর্ম অনুৎপত্তির নিমিত্ত ছন্দ (রুচি) জন্মায়, প্রচেষ্টা করে, বীর্য-প্রবর্তন করে, চিত্ত নিয়োজিত করে, উপায় উদ্ভাবন করে। (২) উৎপন্ন পাপ-অকুশলধমের্র প্রহাণের নিমিত্ত ...। (৩) অনুৎপন্ন কুশলধর্মের উৎপত্তির নিমিত্ত ......। (৪) উৎপন্ন কুশলধর্মের স্থিতি, (অসম্মোসায) অভিবৃদ্ধির বা বিপুলতার নিমিত্ত, ভাবনায় পরিপূর্ণতার নিমিত্ত ছন্দ উৎপন্ন করে, ......। তথায়ও আমার বহু শ্রাবক অভিজ্ঞার অবসান-পরমোৎকর্ষ প্রাপ্ত হইয়া বিহার করে।”
“পুনশ্চ উদায়ি! শ্রাবকদিগকে আমাদ্বারা সেই মার্গ কথিত হইয়াছে, যাহাতে প্রতিপন্ন হইয়া আমার শ্রাবকেরা চতুর্বিধ ঋদ্ধিপাদ ভাবনা করিতে পারে। উদায়ি! এখানে (১) ছন্দ-সমাধি প্রধান সংস্কারযুক্ত ঋদ্ধিপাদের ভাবনা করে। (২) বীর্য-সমাধি প্রধান সংস্কারযুক্ত ঋদ্ধিপাদের ভাবনা করে। (৩) চিত্ত-সমাধি ......। (৪) বীমাংসা (পরীক্ষা মূলক জ্ঞান) সমাধি ......। তথায়ও আমার বহু শ্রাবক অর্হত্ব প্রাপ্ত হইয়া বিহার করে।”
“পুনরায় উদায়ি! ...... যাহাতে প্রতিপন্ন হইয়া আমার শ্রাবকেরা পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের ভাবনা করিতে পারে। উদায়ি! এখানে ভিক্ষু উপশমগামী ও সমাধিগামী (মার্গগামী) (১) শ্রদ্ধা-ইন্দ্রিয়ের ভাবনা করে। (২) বীর্য-ইন্দ্রিয়ের ......। (৩) স্মৃতি-ইন্দ্রিয়ের ......। (৪) সমাধি-ইন্দ্রিয়ের ......। (৫) প্রজ্ঞা-ইন্দ্রিয়ের ......।”
“পুনশ্চ উদায়ি! ...... পঞ্চবলের ভাবনা করে। ...... (১) শ্রদ্ধা-বলের ......। (২) বীর্য-বলের ......। (৩) স্মৃতি-বলের ......। (৪) সমাধি-বলের ......। (৫) প্রজ্ঞা-বলের ......।”
“পুনশ্চ উদায়ি! ...... সপ্তবোধি-অঙ্গের ভাবনা করে। এখানে উদায়ি! ভিক্ষু বিবেক-আশ্রিত, বিরাগ-আশ্রিত, নিরোধ-আশ্রিত, বিসর্জন-পরিণামী (১) স্মৃতি-সম্বোধি অঙ্গ ......। (২) ধর্ম-বিচয় সম্বোধি অঙ্গ ......। (৩) বীর্য-সম্বোধি অঙ্গ ......। (৪) প্রীতি-সম্বোধি অঙ্গ ......। (৫) প্রশান্তি-সম্বোধি অঙ্গ ......। (৬) সমাধি-সম্বোধি অঙ্গ ......। (৭) উপেক্ষা-সম্বোধি অঙ্গ ......।”
“পুনশ্চ উদায়ি! ...... আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গের ভাবনা করে। উদায়ি! এখানে ভিক্ষু সম্যক্-দৃষ্টি, সম্যক্-সঙ্কল্প, সম্যক্-বাক্য, সম্যক্-কর্মান্ত, সম্যক্-আজীব, সম্যক্-ব্যায়াম, সম্যক্-স্মৃতি ও সম্যক্-সমাধি ভাবনা করে। ......।”
২৪৮। “পুনরায় উদায়ি!......আট বিমোক্ষের ভাবনা করে (১) রূপী (স্বীয় কেশাদি নিমিত্তে উৎপন্ন রূপধ্যানী ধ্যানচক্ষু দ্বারা) রূপ সমূহ (বাহ্যিক নীল কৃৎ্লাদি) দর্শন করে, ইহা প্রথম বিমোক্ষ । (২) অধ্যাত্ম অরূপ-সংজ্ঞী (স্বীয় কেশাদিতে অনুৎপাদিত রূপধ্যানী) বাহ্যিক রূপ সমূহ (নীলাদি আরম্মণ) দর্শন করে, ইহা দ্বিতীয় বিমোক্ষ । (৩) শুভরূপেই বিশ্বাস (অধিমুক্তি) হয় (নীলাদি বর্ণ কৃৎ্ল বিশুদ্ধ হইলে ধ্যানও বিশুদ্ধ হয়), ইহা তৃতীয় বিমোক্ষ। (৪) সর্বথা রূপ-সংজ্ঞার সমতিক্রম করিয়া প্রতিঘ-সংজ্ঞার অস্তগমন হেতু নানাত্ব সংজ্ঞার অমনসিকার হেতু ‘আকাশ অনন্ত’ এই আকাশ-অনন্ত-আয়তন প্রাপ্ত হইয়া বিহার করে, ইহা চতুর্থ বিমোক্ষ। (৫) সর্বতোভাবে আকাশানন্তায়তন অতিক্রম করিয়া ‘বিজ্ঞান অনন্ত’ এই ‘বিজ্ঞান-অনন্ত-আয়তন প্রাপ্ত হইয়া বিহার করে, ......। (৬) সর্বথা বিজ্ঞান-অনন্ত-আয়তনকে অতিক্রম করিয়া ‘কিছু নাই’ এই আকিঞ্চনায়তন প্রাপ্ত হইয়া বিহার করে, ......। (৭) সর্বথা আকিঞ্চনায়তনকে অতিক্রম করিয়া নৈব-সংজ্ঞা-ন-অসংজ্ঞা-আয়তন (যে সমাধির অবস্থাকে চেতন কিংবা অচেতন বলা যায় না) প্রাপ্ত হইয়া বিহার করে, ......। (৮) সর্বথা নৈব-সংজ্ঞা-ন-অসংজ্ঞা-আয়তনকে অতিক্রম করিয়া সংজ্ঞা বেদয়িত (বেদনা) নিরোধ (যাবতীয় চেতনের নিরোধ) প্রাপ্ত হইয়া বিহার করে, ইহা অষ্টম বিমোক্ষ। ইহাতেও আমার বহু শ্রাবক ...... অর্হত্ব প্রাপ্ত হইয়া বিহার করে।”
২৪৯। “পুনশ্চ উদায়ি! ...... আট অভিভূ-আয়তন ভাবনা করিয়া থাকে। (১) যোগাবচর শরীর অভ্যন্তরে (অধ্যাত্ম) রূপ-সংজ্ঞী (রূপ আলম্বন করিয়া ধ্যানলাভী)- বাহিরে সুবর্ণ-দুর্বর্ণ সামান্য রূপরাশি দর্শন করে, তাহাদিগকে অভিভূত করিয়া ‘জানি, দেখি’ এরূপ সংজ্ঞা বা ধারণা পোষণকারী হয়, ইহা প্রথম অভিভূ-আয়তন। (২) কেহ আধ্যাত্মিক রূপ-সংজ্ঞী- বাহিরে সুবর্ণ দুর্বর্ণ অপ্রমাণ- (বহুপরিমাণ) রূপরাশি র্দশন করে, সেই সমুদয় অভিভূত করিয়া ‘জানি, দেখি’ এরূপ সংজ্ঞা সম্পন্ন হয়, ......। (৩) কেহ আধ্যাত্মিক অরূপ-সংজ্ঞী- বাহিরে সামান্য সুবর্ণ-দুর্বর্ণ দর্শন করে, সেই সমুদয় অভিভূত করিয়া ‘জানি, দেখি’ এরূপ সংজ্ঞাবলম্বী হয়, ......। (৪) কেহ আধ্যাত্মিক অরূপ-সংজ্ঞী,- বাহ্যিক সুবর্ণ-দুর্বর্ণ অপ্রমাণ রূপকে দর্শন করে, ......। (৫) কেহ আধ্যাত্মিক অরূপ-সংজ্ঞী- বাহ্যিক নীল, নীলবর্ণ, নীল-নিদর্শন, নীল-নিভাস রূপরাশি দর্শন করে। যেমন ঊমাপুষ্প (অপরাজিতা?) নীল, নীলবর্ণ, নীল-নিদর্শন, নীল-নিভাস; অথবা যেমন উভয়দিক হইতে বিমৃষ্ট (কোমল, মসৃণ,) নীল ...... বারাণসীজাত বস্ত্র, এই প্রকারেই কেহ আধ্যাত্মিক অরূপ-সংজ্ঞী বাহ্যিক নীল ...... রূপকে দর্শন করে, উহাদিগকে অভিভূত করিয়া ‘জানি, দেখি’ এই সংজ্ঞী হয়। ......। (৬) আধ্যাত্মিক অরূপ-সংজ্ঞী- বাহ্যিক রূপ পীত, পীতবর্ণ, পীত-নিদর্শন, পীত-নিভাস রূপ সমূহ দর্শন করে। যেমন পীত ...... কর্ণিকার সদৃশ ...... পীত বারাণসীজাত বস্ত্র ...। (৭) আধ্যাত্মিক অরূপ-সংজ্ঞী- কেহ বাহ্যিক লোহিত, লোহিত বর্ণ, লোহিত-নিদর্শন, লোহিত-নিভাস সম্পন্ন রূপরাশি দর্শন করে। যেমন.....বন্ধুজীবক পুষ্প, অথবা যেমন লাল বারাণসীজাত বস্ত্র .....। (৮) আধ্যাত্মিক অরূপ-সংজ্ঞী- কেহ বাহ্যিক অবদাত (শ্বেত), অবদাত বর্ণ....অবদাত রূপকে দর্শন করে। যেমন অবদাত শুকতারা (ওষধিতারা), অথবা যেমন বারাণসীজাত শ্বেতবস্ত্র....। এই অষ্টবিধ অভিভূ আয়তনের বশীভাব প্রাপ্ত বহু শ্রাবক আছে, ...।”
২৫০। “পুনশ্চ উদায়ি! দশ কৃৎ্ল-আয়তনের (কাসিনায়তনের) ভাবনা করিয়া থাকে। (১) কেহ ঊর্ধ, অধঃ চতুর্দিকে অদ্বিতীয় অপ্রমাণ পৃথিবীকৃৎ্ল (সমস্ত পৃথিবীকে) জানে। (২) আপকৃৎ্ল (সমস্ত জলকে) জানে। (৩) তেজঃকৃৎ্ল (সমস্ত তাপকে) জানে। (৪) বায়ুকৃৎ্ল (সমস্ত বায়ুকে) জানে। (৫) নীলকৃৎ্ল (সমস্ত নীল রংকে) জানে। (৬) পীতকৃৎ্ল (সমস্ত পীত রংকে) জানে। (৭) লোহিতকৃৎ্ল (সমস্ত লাল রংকে) জানে। (৮) অবদাতকৃৎ্ল (সমস্ত শ্বেত রংকে জানে। (৯) আকাশকৃৎ্ল (সমস্ত আকাশকে) জানে। (১০) বিজ্ঞানকৃৎ্ল (সমস্ত চেতনাময় চিন্মাত্রকে) জানে।”
২৫১। “পুনশ্চ উদায়ি! ...... চতুর্বিধ ধ্যান ভাবনা করিয়া থাকে। উদায়ি! ভিক্ষু কাম হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া, অকুশল ধর্ম হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া বিতর্ক-বিচার সহিত বিবেকজ প্রীতি-সুখ সমন্বিত প্রথম ধ্যান প্রাপ্ত হইয়া বিহার করে। সে এই শরীরকেই বিবেকজ প্রীতি-সুখ দ্বারা প্লাবিত, (চতুর্দিক) পরিপ্লাবিত করে, পরিপূর্ণ ও পরিস্ফুরিত করে। তাঁহার সর্ব শরীরের কোনও অংশ বিবেকজ প্রীতি-সুখ দ্বারা অস্ফুট থাকে না। যেমন উদায়ি! দক্ষ (চতুর) ্লাপক (নহাপিত) কিংবা ্লাপকের অন্তেবাসী কাঁসের থালায় ্লানীয়-চূর্ণ নিক্ষেপ করিয়া জল সিঞ্চনপূর্বক মর্দন ও পিণ্ড করে, সেই ্লানীয়-পিণ্ড শুভ (স্বচ্ছতা) অনুগত, শুভ-পরিগত ও অন্তর-বাহির সমভাবে শুভদ্বারা স্পর্শিত ও সিক্ত হয়। সেইরূপ উদায়ি! এই দেহ বিবেকজ প্রীতি-সুখ দ্বারা প্লাবিত, পরিপ্লাবিত করে, পরিপূর্ণ ও পরিস্ফুরিত করে ......।”
“পুনরায় উদায়ি! ভিক্ষু বিতর্ক-বিচারের উপশম হেতু ...... দ্বিতীয় ধ্যান প্রাপ্ত হইয়া বিহার করে। সে এই শরীরকে সমাধিজ প্রীতি-সুখ দ্বারা প্লাবিত, পরিপ্লাবিত করে, পরিপূর্ণ ও পরিস্ফুরিত করে। তাহার সর্বব্যাপি কায়ের কোন অংশ সমাধিজ প্রীতি-সুখ দ্বারা অস্ফুট থাকে না। যেমন উদায়ি! উদকোৎস স্ফীত উদক-হ্রদ, উহার পূর্বদিকে জল আগমনের মার্গ নাই, পশ্চিমদিকে জল আগমনের মার্গ নাই, দক্ষিণদিকে জল আগমনের মার্গ নাই এবং উত্তরদিকেও জল আগমনের মার্গ নাই। সময়ে সময়ে মেঘও বৃষ্টিধারা বর্ষণ করে না। তথাপি সেই উদক-হ্রদ হইতে সুশীতল বারিধারা উচ্ছ্বসিত হইয়া সে উদক-হ্রদকে শীতল জল দ্বারা প্লাবিত ও সর্বথা প্লাবিত করে, পরিপূর্ণ ও পরিস্ফুরণ করে। এই সর্বব্যাপি উদক-হ্রদের কোনও অংশ শীতল জলে অস্ফুট থাকে না। এইরূপই উদায়ি! এই শরীরে সর্বত্র সমাধিজ প্রীতি-সুখ দ্বারা ......।”
“পুনরায় উদায়ি! ভিক্ষু প্রীতির বিরাগ হেতু তৃতীয় ধ্যান প্রাপ্ত হইয়া বিহার করে। সে এই শরীর প্রীতিহীন সুখদ্বারা প্লাবিত পরিপ্লাবিত করে ......। যেমন উদায়ি! উৎপল, পদ্ম, পুণ্ডরীকিণীর মধ্যে কোন কোন উৎপল, পদ্ম ও পুণ্ডরীক জলে উৎপন্ন, উদকে সংবর্ধিত উদকানুদ্গত (উপরে অনুত্থিত) অভ্যন্তরে নিমগ্ন ও পোষিত, মূল হইতে অগ্র পর্যন্ত শীতল জল দ্বারা প্লাবিত, নিমর্জিত ...... থাকে। সেইরূপ উদায়ি! ভিক্ষু এই কায়কে নিষপ্রীতিক সুখদ্বারা ......।”
“পুনরায় উদায়ি! ভিক্ষু সুখ ও দুঃখের প্রহাণ হেতু, পূর্বেই সৌমনস্য-দৌর্মনস্যের অস্তগমন হেতু অদুঃখ-অসুখ উপেক্ষা স্মৃতি-পারিশুদ্ধি চতুর্থ ধ্যান প্রাপ্ত হইয়া বিহার করে। সে এই শরীরকে পরিশুদ্ধ (উপক্লেশ রহিত) পর্যাবদাত (প্রভাস্বর) চিত্তদ্বারা বিস্তারিত করিয়া বিহার করে। যেমন উদায়ি! কোন পুরুষ শ্বেতবস্ত্র দ্বারা সকীর্ষ আচ্ছাদন করিয়া বসিয়া থাকে। সেইরূপই উদায়ি! ভিক্ষু এই শরীর .......। তথায়ও আমার বহু শ্রাবক অভিজ্ঞার অবসান প্রাপ্ত (অর্হত্ব মার্গ প্রাপ্ত) ও অভিজ্ঞার পারমী প্রাপ্ত (অর্হত্ব ফল প্রাপ্ত) হইয়া বিহার করে।”
২৫২। “পুনশ্চ উদায়ি! আমি শ্রাবকদিগকে সেই মার্গ বলিয়াছি, যথা প্রতিপন্ন আমার শ্রাবকগণ এরূপ জানিতে পারে- ‘আমার এই শরীর রূপবান, চাতুর্মহাভৌতিক, মাতৃ-পিতৃ সম্ভূত, অন্ন-ব্যঞ্জন সঞ্চয়, অনিত্য-উৎসাদন, পরিমর্দন-ভেদন-বিধ্বংসন স্বভাব; আর আমার এই বিজ্ঞান (চেতনাংশ) ইহাতে (চাতুর্মহাভৌতিক দেহে) আশ্রিত, ইহাতে প্রতিবদ্ধ।’ যেমন উদায়ি! সুন্দর উত্তম জাতীয় অষ্টাংশ, সুমসৃণ, স্বচ্ছ, বিপ্রসন্ন, সর্ব আকারযুক্ত বৈদুর্যমণি (হীরা), তাহাতে নীল, পীত, লোহিত, অবদাতসূত্র বা পাণ্ডুসূত্র গ্রথিত হয়, উহাকে চক্ষুষ্মান পুুরুষ হস্তে লইয়া প্রত্যবেক্ষণ করে- ‘ইহা সুন্দর ...... বৈদুর্যমণি, ...... সূত্র-গ্রথিত।’ এইরূপেই উদায়ি! আমি ...... বলিয়া দিয়াছি ......। তাহাতেও আমার বহু শ্রাবক ......।”
২৫৩। “পুনশ্চ উদায়ি! ...... সেই মার্গ বলা হইয়াছে, যাহাতে প্রতিপন্ন হইয়া আমার শ্রাবকগণ এই দেহ হইতে মনোময়, সর্বাঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমন্বিত, অবিকল-ইন্দ্রিয়, অন্য জরদেহ নির্মাণ করিতে পারে। যেমন উদায়ি! মুঞ্জতৃণ হইতে ঈষীকা (শীর্ষ) উৎপাটন করা হয়। উহার এই ধারণা হয়- ‘ইহা মুঞ্জ, ইহা শীর্ষ। মুঞ্জ অন্য, শীর্ষ অন্য। মুঞ্জ হইতেই শীর্ষ উৎপাটিত।’ যেমন উদায়ি! কোন পুরুষ কোষ হইতে অসি বাহির করে, তাহার এই ধারণা হয়- ‘এই অসি, এই কোষ। অসি স্বতন্ত্র, কোষ স্বতন্ত্র। কোষ হইতেই অসি বাহির করা হইয়াছে।’ যেমন উদায়ি! করণ্ড হইতে সর্প বাহির করা হয়। ......। এইরূপেই উদায়ি! ...... মার্গ বলা হইয়াছে।”
২৫৪। “পুনশ্চ উদায়ি! ...... সেই মার্গ বলা হইয়াছে যেই মার্গারূঢ় হইয়া আমার শ্রাবকগণ অনেক প্রকারের ঋদ্ধি-বিধ (যোগ-বিভূতি) অনুভব করে- ‘এক হইয়াও বহুবিধ হয়, বহুবিধ হইয়াও এক হয়, আবির্ভাব ও তিরোভাব (করে), যেমন দেওয়ালের বাহিরে, প্রাকারের বাহিরে, পর্বতের বাহিরে আকাশের ন্যায় অসংলগ্নভাবে পার হইয়া যায়; জলের ন্যায় মাটিতেও ডুব দেয়, ভাসিয়া উঠে; মাটির ন্যায় জলেও অনার্দ্রভাবে গমন করে; পক্ষী-শকুনের ন্যায় আসনাবদ্ধভাবে আকাশেও সঞ্চরণ করে; এমন মহাঋদ্ধি মহানুভব সম্পন্ন এই চন্দ্র-সূর্যকেও হস্তদ্বারা স্পর্শ করে, পরিমর্দন করে এবং যাবৎ ব্রহ্মলোক পর্যন্ত কায়দ্বারা বশে রাখে।’ যেমন উদায়ি! দক্ষ কুম্ভকার বা কুম্ভকারান্তেবাসী সুমর্দিত মৃত্তিকা দ্বারা যে যে ভাজন বিকৃতি (বিশেষ) আকাঙক্ষা করে তাহা তাহাই নির্মাণ করে, নিষ্পাদন করে। অথবা যেমন উদায়ি! দন্তকার (হস্তিদন্তের শিল্পী) বা দন্তকারের শিষ্য সুমসৃণ দন্ত হইতে যে যে দন্ত-বিকৃতি (দন্ত নির্মিত বস্তু) ইচ্ছা করে তাহাই নির্মাণ করে, নিষ্পাদন করে। অথবা যেমন উদায়ি! দক্ষ স্বর্ণকার বা স্বর্ণকারের শিষ্য সংশোধিত সুবর্ণ হইতে যে যে স্বর্ণ-বিকৃতি ইচ্ছা করে তাহাই নির্মাণ করে ......। এইরূপেই উদায়ি! ......।”
২৫৫। “পুনশ্চ উদায়ি! ...... যে মার্গে প্রতিপন্ন হইয়া আমার শ্রাবকগণ বিশুদ্ধ অ-মানুষ, দিব্য-শ্রোত্রধাতু (কর্ণ) দ্বারা দিব্য ও মনুষ্য, দূরবর্তী ও সমীপবর্তী উভয়বিধ শব্দ শ্রবণ করে। যেমন উদায়ি! বলবান শঙ্খ-ধমক (শাঁখ বাদক) অল্প প্রয়াসেই (অনায়াসেই) চতুর্দিকে বিজ্ঞাপন করিয়া থাকে সেইরূপই উদায়ি! ......।”
২৫৬। “পুনশ্চ উদায়ি! ...... যথামার্গ প্রতিপন্ন হইয়া আমার শ্রাবকগণ অপর সত্ব, অপর পুদ্গলের চিত্ত স্ব-চিত্তদ্বারা সর্বথা জানিতে পারে; সরাগ চিত্তকে সরাগ চিত্তরূপে জানিতে পারে; বীতরাগ চিত্তকে বীতরাগ চিত্তরূপে জানিতে পারে; সদ্বেষ চিত্তকে সদ্বেষ চিত্তরূপে, বীতদ্বেষ চিত্তকে বীতদ্বেষ চিত্তরূপে জানিতে পারে; সমোহ চিত্তকে ......; বীতমোহ চিত্তকে ......; সংক্ষিপ্ত চিত্তকে ......; বিক্ষিপ্ত চিত্তকে ......; মহদ্গত (বিশাল) চিত্তকে ......; অমহদ্গত চিত্তকে ......; স-উত্তর (যাহা হইতে বড়ও আছে) চিত্তকে ......; অনুত্তর চিত্তকে ......; সমাহিত চিত্তকে ......; অসমাহিত চিত্তকে ......; বিমুক্ত চিত্তকে ......; অবিমুক্ত চিত্তকে ......। যেমন উদায়ি! কোন বিলাসী স্ত্রী কিংবা পুুরুষ, তরুণ, যুবক পরিশুদ্ধ-পর্যবদাত দর্পণে বা স্বচ্ছ জলপূর্ণ পাত্রে মুখ স্বীয় নিমিত্ত (মুখাবয়ব) দেখিতে গিয়া সকণিক (ব্রণদুষ্ট) অঙ্গকে সকণিক অঙ্গরূপে জানিতে পারে; অকণিকাঙ্গকে অকণিকাঙ্গরূপে জানিতে পারে। এইরূপেই উদায়ি!.....!”
২৫৭। “পুনশ্চ উদায়ি!.....যে মার্গে আরূঢ় হইয়া আমার শ্রাবকেরা অনেক প্রকারে পূর্বনিবাসকে (পূর্বজন্মকে) জানিতে পারে। যেমন উদায়ি! এক জাতি (জন্ম), দুই, তিন, চার, পাঁচ, বিশ, ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ, শত, সহস্র জাতি ও অনেক সংবর্তকল্প (মহাপ্রলয়), অনেক বিবর্তকল্প (সৃষ্টি), অনেক সংবর্ত-বিবর্তকল্পকেও জানিতে পারে- ‘আমি তথায় এই নাম, এই গোত্র, এই বর্ণ, এই আহারী ছিলাম; এরূপ সুখ-দুঃখ অনুভবকারী, এত আয়ু পর্যন্ত ছিলাম; সেই আমি তথা হইতে চ্যুত হইয়া অমুকস্থানে উৎপন্ন হইয়াছি; তথায়ও এত আয়ু পর্যন্ত ছিলাম। সেই আমি তথা হইতে চ্যুত হইয়া এখানে উৎপন্ন হইয়াছি।’ এ প্রকারে স-আকার (আকৃতি সহিত) স-উদ্দেশ (নাম সহিত) অনেক প্রকার পূর্ব-নিবাস অনুস্মরণ করিয়া থাকে। যেমন উদায়ি! কোন লোক নিজের গ্রাম হইতে অন্য গ্রামে গমন করে, সে গ্রাম হইতেও অন্য গ্রামে যায়, সে গ্রাম হইতে স্বগ্রামে পুনঃ প্রত্যাবর্তন করে। তাহার এরূপ হয়- ‘আমি স্বীয় গ্রাম হইতে অমুক গ্রামে গিয়াছিলাম, তথায় এরূপে দাঁড়াইয়াছি, এরূপে বসিয়াছি, এরূপ ভাষণ করিয়াছি, এরূপ মৌন ছিলাম। সে গ্রাম হইতে অমুক গ্রামে গিয়াছি, তথায়ও এরূপে দাঁড়াইয়াছি, ......।”
২৫৮। “পুনশ্চ উদায়ি!....যথামার্গে প্রতিপন্ন হইয়া আমার শ্রাবকগণ বিশুদ্ধ অ-মানুষ, দিব্য চক্ষুদ্বারা হীন-প্রণীত, সুবর্ণ-দুর্বর্ণ, সুগত-দুর্গত সত্বকে চ্যুতির সময় ও উৎপত্তির সময় দেখিতে পারে। কর্মানুসারে গতি প্রাপ্ত সত্বগণকে জানিতে পারে- ‘এই সত্ব কায়-দুশ্চরিত যুক্ত, বাক্-দুশ্চরিত্র যুক্ত, মনো-দুশ্চরিত্র যুক্ত, আর্যদের নিন্দুক, মিথ্যাদৃষ্টি সম্পন্ন, মিথ্যাদৃষ্টি কর্ম সম্পাদনকারী ছিল; সে দেহত্যাগে মৃত্যুর পর অপায়-দুর্গতি বিনিপাত নিরয়ে উৎপন্ন হইয়াছে। আর এই সকল সত্ব কায়-সুচরিত, বাক্-সুচরিত ...... আর্যদের অনুপবাদক (অনিন্দুক), সম্যক্দৃষ্টি সম্পন্ন, সম্যক্ দৃষ্টিকর্ম সম্পাদনকারী ছিল; তাহারা দেহত্যাগে মৃত্যুর পর সুগতি স্বর্গলোকে উৎপন্ন হইয়াছে। এই প্রকারে ...... দিব্যচক্ষু দ্বারা দর্শন করে।’ যেমন উদায়ি! সমান দ্বার বিশিষ্ট দুইখানি ঘর, তথায় চক্ষুষ্মান পুরুষ মধ্যস্থানে দাঁড়াইয়া মানুষদিগকে ঘরে প্রবেশ করিতেও, বাহির হইতেও, সঞ্চরণ করিতেও বিচরণ করিতেও দেখিতে পায়। সেইরূপেই উদায়ি! ......।
২৫৯। “পুনশ্চ উদায়ি! ...... যে মার্গে আরূঢ় হইয়া আমার শ্রাবকেরা আস্রব রাশির ক্ষয় করিয়া অনাস্রব চিত্ত-বিমুক্তি, প্রজ্ঞা-বিমুক্তি, ইহজীবনে স্বয়ং প্রত্যক্ষ করিয়া, সাক্ষাৎকার করিয়া, লাভ করিয়া বিহার করে। যেমন উদায়ি! পর্বতশীর্ষে স্বচ্ছ, বিপ্রসন্ন, অনাবিল জলাশয় থাকে; চক্ষুষ্মান পুরুষ তীরে স্থিত হইয়া তথায় শুক্তি (?) শামুক, কাঁকর-পাথর, চলনে ও দাঁড়ান অবস্থায় মৎস্যগুম্বকে দেখিতে পায়। সেইরূপই উদায়ি! ......।”
“উদায়ি! ইহারাই সেই পঞ্চবিধ ধর্ম, যে কারণে শ্রাবকগণ আমাকে সৎকার করে, গৌরব করে, সম্মান করে ও পূজা করে; সৎকার ও গৌরব করিয়া আমার আশ্রয়ে বাস করে।”
ভগবান ইহা বলিলেন, সন্তুষ্ট চিত্তে সকুলদায়ি পরিব্রাজক ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন করিলেন।
॥ মহা-সকুলদায়ি সূত্র সমাপ্ত ॥
২৬০। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-
এক সময় ভগবান শ্রাবস্তীতে অনাথপিণ্ডিকের আরাম জেতবন বিহারে বাস করিতেছিলেন।
সেই সময় উগ্রাহমান (শিক্ষায় সমর্থ) পরিব্রাজক সমণ মুণ্ডিকাপুত্ত সাতশ পরিব্রাজকের মহৎ পরিব্রাজক পরিষদের সহিত সময়-প্রবাদক (স্বীয় ধর্মমত প্রকাশক) তিন্দুকাচীর একশালক (নামক) মল্লিকা (দেবীর নির্মিত) আরামে বাস করিতেছিলেন।
তখন পঞ্চকংগ স্থপতি দিবা দ্বিপ্রহরে ভগবানকে দর্শনের নিমিত্ত শ্রাবস্তী হইতে বাহির হইলেন। তখন পঞ্চকংগ স্থপতির এই মনে হইল,- “ভগবানকে দর্শনের এখন সময় নহে, ভগবান ধ্যানে নিবিষ্ট থাকিবেন। মনো-ভাবনায় নিরত ভিক্ষুদিগকে দর্শনেরও ইহা অসময়। মনো-ভাবনাকারী ভিক্ষুগণও ধ্যানে নিবিষ্ট থাকিবেন। সুতরাং আমি যেখানে সময়-প্রবাদক ...... মল্লিকারাম আছে, যেখানে উগ্রাহমান পরিব্রাজক আছেন তথায় যাই।” তখন পঞ্চকংগ স্থপতি যেখানে সময়-প্রবাদক ...... মল্লিকারাম ছিল, যেখানে উগ্রাহমান পরিব্রাজক ছিলেন তথায় গেলেন।
সেই সময় উগ্রাহমান পরিব্রাজক ...... বৃহৎ পরিব্রাজক পরিষদের মধ্যে বহুবিধ নিরর্থক কথায় উচ্চনাদ, উচ্চশব্দ, মহাকোলাহলে নিরত অবস্থায় উপবিষ্ট ছিলেন। উগ্রাহমান পরিব্রাজক দূর হইতে পঞ্চকংগ স্থপতিকে আসিতে দেখিলেন, দেখিয়া আপন পরিষদকে নির্দ্দেশ দিলেন,- “আপনারা সকলে নীরব হউন, আপনারা শব্দ করিবেন না। এই শ্রমণ গৌতমের শ্রাবক পঞ্চকংগ স্থপতি আসিতেছেন। শ্রমণ গৌতমের যে সকল শ্বেতবসনধারী গৃহস্থ শ্রাবক শ্রাবস্তীতে বাস করেন, এই পঞ্চকংগ স্থপতি তাঁহাদেরই একজন। সেই আয়ুষ্মানগণ স্বয়ং অল্পশব্দ (নীরব), অল্পশব্দে-বিনীত, নিঃশব্দ প্রশংসাকারী হন। পরিষদকে নিঃশব্দ দেখিয়া সম্ভবতঃ এখানে আসিতেও পারেন।”
তখন সেই পরিব্রাজকগণ নীরব হইলেন।
২৬১। তখন পঞ্চকংগ স্থপতি যেখানে উগ্রাহমান পরিব্রাজক ছিলেন তথায় গেলেন, গিয়া উগ্রাহমান পরিব্রাজকের সাথে ...... সম্মোদন করিয়া একপ্রান্তে বসিলেন। একান্তে উপবিষ্ট পঞ্চকংগ স্থপতিকে উগ্রাহমান পরিব্রাজক বলিলেন,- “স্থপতি! চতুর্বিধ ধর্মে সংযুক্ত পুরুষ পুদ্গলকে আমি পরিপূর্ণ কুশল, পরম কুশল, উত্তম পুণ্যপ্রাপ্ত, শ্রমণ ও অ-যোধ্য (বাক্ যুদ্ধদ্বারা বিচলিত করার অযোগ্য, স্থির) বলিয়া জ্ঞাপন করি। সেই চারি কি?- এখানে স্থপতি! (১) (যিনি) কায়দ্বারা পাপকর্ম করেন না, (২) পাপজনক বাক্য বলেন না, (৩) পাপ সঙ্কল্প চিন্তা করেন না, (৪) পাপজীবিকায় জীবন যাপন করেন না। স্থপতি! আমি এই চারি ধর্মে সজ্জিতকে ...... অ-যোধ্য বলিয়া জ্ঞাপন করি।”
তখন পঞ্চকংগ স্থপতি উগ্রাহমান পরিব্রাজকের ভাষণ অভিনন্দনও করিলেন না, খণ্ডনও করিলেন না। অভিনন্দন ও খণ্ডন না করিয়া- ‘ভগবানের নিকট এই ভাষণের অর্থ জিজ্ঞাসা করিব’- (ভাবিয়া) আসন হইতে উঠিয়া প্রস্থান করিলেন। তখন পঞ্চকংগ স্থপতি যেখানে ভগবান আছেন তথায় গেলেন, তথায় উপস্থিত হইয়া ভগবানকে অভিবাদন করিয়া একান্তে বসিলেন। একান্তে উপবিষ্ট পঞ্চকংগ স্থপতি উগ্রাহমান পরিব্রাজকের সাথে যাহা কিছু আলাপ আলোচনা হইয়াছে, সেই সমস্ত ভগবানকে নিবেদন করিলেন।
২৬২। ইহা উক্ত হইলে ভগবান পঞ্চকংগ স্থপতিকে এরূপ বলিলেন,- “স্থপতি! তাহা হইলে উগ্রাহমান পরিব্রাজকের বাক্যানুসারে উত্থানশায়ী অবোধ শিশু পরিপূর্ণ কুশল, পরম কুশল, উত্তম পুণ্য প্রাপ্ত ও অ-যোধ্য শ্রমণ হইবে। কারণ স্থপতি! ...... অবোধ শিশুর কেবল সঞ্চালন ব্যতীত স্ব-পর কায়া বলিয়া ধারণাই নাই, সে কি প্রকারে কায়দ্বারা পাপকর্ম করিবে? স্থপতি! ...... অবোধ শিশুর কেবল ক্রন্দন ব্যতীত বাক্যের ধারণা নাই, সে কি প্রকারে পাপজনক বাক্য উচ্চারণ করিবে? স্থপতি! ...... অবোধ শিশুর কেবল হাসি ব্যতীত কোন সঙ্কল্পই নাই, সে কি প্রকারে পাপ সঙ্কল্প চিন্তা করিবে? স্থপতি! ...... অবোধ শিশুর কেবল মাতৃস্তন্যের অতিরিক্ত জীবিকা বলিয়া ধারণা নাই, সে কি প্রকারে পাপ জীবিকায় জীবনযাপন করিবে? তাহা হইলে ত উগ্রাহমান পরিব্রাজকের বাক্যানুসারে অবোধ শিশুই ...... অ-যোধ্য শ্রমণ হইবে।”
২৬৩। “স্থপতি! আমি এই চারি ধর্মযুক্ত পুরুষ পুদ্গলকে সম্পন্ন কুশল, পরম কুশল, উত্তম প্রাপ্তি প্রাপ্ত, অ-যোধ্য শ্রমণ বলিয়া প্রজ্ঞাপিত করি না; কিন্তু ইহা উত্তানশায়ী মন্দ বুদ্ধি শিশুকে বিশেষরূপে অধিকার করিয়া স্থিত থাকে। কোন্ চারি? স্থপতি! (১) যে কায়দ্বারা পাপকর্ম করেনা ...... (৪) পাপ জীবিকায় জীবনযাপন করে না ......।”
“স্থপতি! আমি দশ ধর্মযুক্ত পুরুষ পুদ্গলকে সম্পন্ন কুশল, পরম কুশল ...... অ-যোধ্য শ্রমণ বলিয়া থাকি। স্থপতি! (১) এই সকল অকুশল-শীল (দুরাচার), তাহা বিদিতব্য (জানা উচিত) আমি বলিতেছি। (২) এস্থান হইতে অকুশল-শীল সমুত্থিত হয়, আমি তাহা জ্ঞাতব্য বলিতেছি। (৩) এখানে অকুশল-শীল নিঃশেষে নিরুদ্ধ হয়, আমি তাহা জ্ঞাতব্য বলিতেছি। (৪) স্থপতি! এই প্রকারে প্রতিপন্ন অকুশল-শীল সমূহের নিরোধার্থ প্রতিপন্ন হয়, আমি তাহা জ্ঞাতব্য বলিতেছি। (৫) স্থপতি! এই সকল কুশল-শীল (সদাচার), আমি তাহা জ্ঞাতব্য বলিতেছি। (৬) এস্থান হইতে কুশল-শীল সমুত্থিত হয়, আমি তাহা জ্ঞাতব্য বলিতেছি। (৭) এখানে কুশল-শীল নিঃশেষে নিরুদ্ধ হয়, তাহা আমি জ্ঞাতব্য বলিতেছি। (৮) স্থপতি! এই প্রকারে প্রতিপন্ন ব্যক্তি কুশল-শীলের নিরোধার্থ প্রতিপন্ন হয়, তাহা আমি জ্ঞাতব্য বলিতেছি। (৯) স্থপতি! এই সকল অকুশল-সঙ্কল্প, আমি তাহা জানা উচিত বলিতেছি। (১০) এস্থান হইতে অকুশল-সঙ্কল্প সমুত্থিত হয়, তাহা আমি জানা উচিত বলিতেছি। (১১) এখানে অকুশল-সঙ্কল্প নিচয় নিঃশেষে নিরুদ্ধ হয়, আমি তাহা জানা উচিত বলিতেছি। (১২) এরূপে প্রতিপন্ন অকুশল-সঙ্কল্প নিরোধের নিমিত্ত প্রতিপন্ন হয়, আমি তাহা জানা উচিত বলিতেছি। (১৩) এই সকল কুশল-সঙ্কল্প, আমি তাহা জানা উচিত বলিতেছি। (১৪) এখান হইতে কুশল-সঙ্কল্প উৎপন্ন হয়, ইহা জানা উচিত বলিতেছি। (১৫) এখানে কুশল-সঙ্কল্প নিঃশেষে নিরুদ্ধ হয়, ইহা জানা উচিত বলিতেছি। (১৬) এরূপে প্রতিপন্ন ব্যক্তি কুশল-সঙ্কল্পের নিরোধার্থ প্রতিপন্ন হয়, তাহা জানা উচিত বলিতেছি।”
২৬৪। “(১) স্থপতি! অকুশল-শীল কি? অকুশল কায়কর্ম, অকুশল বাক্কর্ম পাপ জীবিকা- ইহাদিগকে অকুশল-শীল বলা হয়। (২) স্থপতি! এই অকুশল-শীল কোথায় উৎপন্ন হয়? ...... ইহাদের সমুত্থানও উক্ত হইয়াছে; ...... চিত্ত হইতে উৎপন্ন বলা যায়। কোন্ চিত্ত? চিত্তও বহু, নানাবিধ, অনেক প্রকার- যেই চিত্ত স-রাগ, স-দ্বেষ, স-মোহ হয়। এখানে (রাগ-দ্বেষ-মোহযুক্ত দ্বাদশ অকুশল চিত্ত হইতে) অকুশল-শীল (আচার) সমূহ উৎপন্ন হয়। (৩) স্থপতি! এই অকুশল-শীল কোথায় নিঃশেষে নিরুদ্ধ হয়? ইহাদের নিরোধও উক্ত হইয়াছে। এখানে স্থপতি! ভিক্ষু কায়-দুশ্চরিত ত্যাগ করিয়া কায়-সুচরিত ভাবনা (অভ্যাস বৃদ্ধি) করে, বাক্-দুশ্চরিত ত্যাগ করিয়া বাক্-সুচরিত ভাবনা করে। মনো-দুশ্চরিত ত্যাগ করিয় মনো-সুচরিত ভাবনা করে। মিথ্যা-জীবিকা ত্যাগ করিয়া সম্যক্-জীবিকা দ্বারা জীবনযাপন করে, এখানে (স্রোতাপত্তিফলে) এই সকল অকুশল-শীল নিঃশেষে নিরুদ্ধ হয়। (৪) স্থপতি! কি প্রকারে প্রতিপন্ন হইলে অকুশল-শীল সমূহের নিরোধের নিমিত্ত প্রতিপন্ন হয়? স্থপতি! এক্ষেত্রে ভিক্ষু পাপ অকুশল ধর্মের অনুৎপাদনার্থ ছন্দ (রুচি) জন্মায়, উদ্যোগ করে, বীর্য-আরম্ভ করে, চিত্তকে প্রগ্রহ করে, উৎসাহিত করে। উৎপন্ন পাপ ...... ধর্মের প্রহাণের নিমিত্ত ...... ছন্দ জন্মায়, চিত্তকে প্রগ্রহ করে, উৎসাহিত করে। অনুৎপন্ন কুশল ধর্মের উৎপত্তির নিমিত্ত ছন্দ জন্মায় ......। উৎপন্ন কুশল ধর্মের স্থিতি অবিস্মৃতি, বৃদ্ধিভাব, বিপুলতা, ভাবনা ও পরিপূর্ণতার নিমিত্ত ছন্দ জন্মায় ......। স্থপতি! এই প্রকারে প্রতিপন্ন হইলে অকুশল-শীল নিরোধের নিমিত্ত প্রতিপন্ন হয়।”
২৬৫। “(৫) স্থপতি! কুশল-শীল কি? কুশল কায়-কর্ম, কুশল বাক্-কর্ম এবং আজীব পরিশুদ্ধিকেই আমি শীলের অন্তর্গত বলি, ইহাদিগকেই কুশল-শীল বলা হয়। (৬) এই কুশল-শীল কোথা হইতে উৎপন্ন হয়? ইহাদের সমুত্থানও উক্ত হইয়াছে, ইহাদিগকে চিত্তোৎপন্ন বলা হয়। কোন্ প্রকার চিত্ত? চিত্তও বহু, নানাবিধ, অনেক প্রকারের হয়। যেই চিত্ত বীত-রাগ, বীত-দ্বেষ, বীত-মোহ (মোহ-রহিত) হয়, তাহা হইতেই কুশল-শীল উৎপন্ন হয়। (৭) এই সকল কুশল-শীল কোথায় নিঃশেষে নিরুদ্ধ হয়? ইহাদের নিরোধও উক্ত হইয়াছে। স্থপতি! এক্ষেত্রে ভিক্ষু শীল-সম্পন্ন হয়, কিন্তু শীল-সময় (অভিমানী) নহে; যেখানে (অর্হত্ব ফলে) সেই কুশল-শীল নিঃশেষে নিরুদ্ধ হয় সেই চিত্ত-বিমুক্তি ও প্রজ্ঞা বিমুক্তি যথাভূত জানে। (৮) স্থপতি! কি প্রকারে প্রতিপন্ন হইলে, কুশল-শীলের নিরোধের নিমিত্ত প্রতিপন্ন হয়? স্থপতি! এখানে ভিক্ষু অনুৎপন্ন পাপের ...... অনুৎপাদনের নিমিত্ত ছন্দ জন্মায়, ...... চিত্তকে প্রগ্রহ করে, উৎসাহিত করে। উৎপন্ন পাপের প্রহাণের নিমিত্ত ......। অনুৎপন্ন কুশলের উৎপত্তির নিমিত্ত ......। উৎপন্ন কুশলের স্থিতি ...... পূর্ণতার নিমিত্ত ......। স্থপতি! এই প্রকারে প্রতিপন্ন হইলে ......।”
২৬৬। “(১) স্থপতি! অকুশল-সঙ্কল্প কি? কাম-সঙ্কল্প, ব্যাপাদ-সঙ্কল্প ও বিহিংসা-সঙ্কল্প; ইহাদিগকেই অকুশল-সঙ্কল্প বলা হয়। (২) এই অকুশল-সঙ্কল্প কোথা হইতে উৎপন্ন হয়? ইহাদের সমুত্থানও বলা হইয়াছে, ইহাদিগকে সংজ্ঞাজ বলা হয়। সংজ্ঞা (ধারণা) কি? সংজ্ঞাও বহু, নানাবিধ, অনেক প্রকারের, (যথা)- কাম-সংজ্ঞা, ব্যাপাদ-সংজ্ঞা ও বিহিংসা-সংজ্ঞা, যাহা হইতে অকুশল-সঙ্কল্প উৎপন্ন হয়। (৩) স্থপতি! এই সমস্ত অকুশল-সঙ্কল্প কোথায় নিঃশেষে নিরুদ্ধ হয়? ইহাদের নিরোধও উক্ত হইয়াছে। স্থপতি! এক্ষেত্রে ভিক্ষু কাম হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া ...... প্রথম ধ্যান লাভ করিয়া বিহার করে। এখানে (প্রথমধ্যান অনাগামী ফলে) যাবতীয় অকুশল-সঙ্কল্প নিঃশেষে নিরুদ্ধ হয়। (৪) কি প্রকার আচরণ করিলে অকুশল-সঙ্কল্পের প্রহাণের নিমিত্ত প্রতিপন্ন হয়? এখানে স্থপতি! ভিক্ষু অনুৎপন্ন পাপ-অকুশল ধর্মের অনুৎপাদনের নিমিত্ত ......। উৎপন্ন অকুশলের প্রহাণের নিমিত্ত ......। অনুৎপন্ন কুশল ধর্মের উৎপত্তির নিমিত্ত ......। উৎপন্ন কুশল-ধর্মের স্থিতি ...... পূর্ণতার নিমিত্ত ......। স্থপতি! এই প্রকারে প্রতিপন্ন হইলে অকুশল-সঙ্কল্পের প্রহাণের নিমিত্ত প্রতিপন্ন হইয়া থাকে।”
২৬৭। “স্থপতি! (৫) কুশল-সঙ্কল্প কি? নৈষ্কাম্য (কাম-রহিত হইবার) সঙ্কল্প, অব্যাপাদ-সঙ্কল্প ও অবিহিংসা-সঙ্কল্প; ইহারা কুশল-সঙ্কল্প। (২) এই সকল কুশল-সঙ্কল্প কোথা হইতে উৎপন্ন হয়? ইহাদের সমুত্থানও উক্ত হইয়াছে; ইহারা সংজ্ঞা হইতে উৎপন্ন বলা চলে। সংজ্ঞা কি? সংজ্ঞাও বহু, নানাবিধ, অনেক প্রকারের, (যথা)- নৈষ্কাম্য-সংজ্ঞা, অব্যাপাদ-সংজ্ঞা ও অবিহিংসা-সংজ্ঞা। এখান হইতে কুশল-সঙ্কল্প উৎপন্ন হইয়া থাকে। (৩) স্থপতি! এই সব কুশল-সংজ্ঞা কোথায় সম্পূর্ণ নিরুদ্ধ হয়? ইহাদের নিরোধও উক্ত হইয়াছে। স্থপতি! এখানে ভিক্ষু বিতর্ক-বিচারের উপশম হইলে ...... দ্বিতীয় ধ্যান লাভ করিয়া বিহার করে। এখানেই যাবতীয় কুশল-সঙ্কল্প অপরিশেষে নিরুদ্ধ হয়। (৪) স্থপতি! কিরূপে প্রতিপন্ন হইলে কুশল-সঙ্কল্পের নিরোধার্থ প্রতিপন্ন হয়? এখানে স্থপতি! অনুৎপন্ন পাপ অকুশল ধর্মের অনুৎপাদনের নিমিত্ত ......। উৎপন্ন অকুশল ধর্মের প্রহাণের নিমিত্ত ......। অনুৎপন্ন কুশল ধর্মের উৎপত্তির নিমিত্ত ......। উৎপন্ন কুশল ধর্মের স্থিতি ...... পূর্ণতার নিমিত্ত ......। স্থপতি! এই প্রকারে প্রতিপন্ন ব্যক্তি কুশল-সঙ্কল্পের নিরোধের নিমিত্ত প্রতিপন্ন হইয়া থাকে।”
২৬৮। “স্থপতি! কোন্ দশবিধ ধর্ম সমন্বিত পুরুষ পুদ্গলকে আমি সম্পন্ন কুশল, পরম কুশল, উত্তম পুণ্য প্রাপ্ত, অ-যোধ্য (স্থির) শ্রমণ বলিতেছি? স্থপতি! জগতে কোন ভিক্ষু (১) অশৈক্ষ্য (অর্হত্বের) সম্যক্-দৃষ্টি দ্বারা যুক্ত হয়, (২) অশৈক্ষ্য সম্যক্-সঙ্কল্প ...... , (৩) অশৈক্ষ্য সম্যক্-বাক্য ...... , (৪) অশৈক্ষ্য সম্যক্-কর্মান্ত ...... , (৫) অশৈক্ষ্য সম্যক্-আজীব ...... , (৬) অশৈক্ষ্য সম্যক্-ব্যায়াম..... , (৭) অশৈক্ষ্য সম্যক্-স্মৃতি ...... , (৮) অশৈক্ষ্য সম্যক্-সমাধি ..... , (৯) অশৈক্ষ্য সম্যক্-জ্ঞান ..... , ও (১০) অশৈক্ষ্য সম্যক্-বিমুক্তি দ্বারা যুক্ত হইয়া থাকে। স্থপতি! এই দশ ধর্মযুক্ত পুরুষ পুদ্গলকে আমি সম্যক্-কুশল ...... বলিতেছি।”
ভগবান ইহা বলিলেন। সন্তুষ্ট চিত্তে পঞ্চকংগ স্থপতি ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন করিলেন।
॥ সমণ মূণ্ডিত সূত্র সমাপ্ত ॥
২৬৯। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-
এক সময় ভগবান রাজগৃহে বেণুবন কলন্দক নিবাপে বাস করিতেছিলেন। সেই সময় সকুলুদায়ি পরিব্রাজক মহতী পরিষদের সাথে পরিব্রাজকারামে বাস করিতেন।
ভগবান পূর্বাহ্ন সময়ে ...... । যেখান সকুলুদায়ি পরিব্রাজক ছিলেন, তথায় গেলেন। তখন সকুলুদায়ি পরিব্রাজক ভগবানকে বলিলেন,- “আসুন, ভন্তে ভগবন! ......।”
২৭০। ...... ভগবান সজ্জিত আসনে বসিলেন। ...... “উদায়ি! কি কথায় ......।”
“রেখে দিন ভন্তে! সে কথা, ......। ভন্তে! যখন আমি এই পরিষদে উপস্থিত না থাকি, তখন এই পরিষদ অনেক প্রকার ব্যর্থ-কথায় (তিরচ্ছান কথায়) উপবিষ্ট থাকে। আর যখন ভন্তে! আমি এই পরিষদে উপস্থিত থাকি, তখন পরিষদ আমারই মুখ তাকাইয়া বসিয়া থাকে- ‘শ্রমণ উদায়ি যে ধর্মকথা বলিবেন আমরা তাহাই শুনিব।’ যখন ভগবন! আপনি এই পরিষদে উপস্থিত আছেন তখন আমি এবং এই পরিষদ ভগবানের মুখ দেখিয়া বসিয়া আছি- ‘ভগবান আমাদিগকে যে ধর্মোপদেশ করিবেন উহাই আমরা শুনিব’।”
২৭১। “তাহা হইলে উদায়ি! এখানে তুমি যাহা নির্বাচন কর, তাহাই আমি বলিতে পারি।”
“প্রাচীন কালে এক সময় ভন্তে! (যিনি) সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী, নিখিল জ্ঞান-দর্শন- আমার চলন, দাঁড়ান, সুপ্ত ও জাগ্রত অবস্থায় সদা সর্বদা উপস্থিত বলিয়া প্রতি-জ্ঞাপন করিতেন; তিনি আমাকর্তৃক পূর্বান্ত সম্বন্ধে প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইলে বাহিরের কথায় অবতরণ করেন, অন্যথা আচরণ করেন। কোপ, বিদ্বেষ ও অপ্রত্যয় (অবিশ্বাস) প্রকট করেন। তখন ভন্তে! ভগবানের সম্বন্ধে আমার স্মৃতি উৎপন্ন হইল,- ‘অহো! ভগবান নহে কি, অহো! সুগত নহে কি যিনি এই সকল ধর্ম সুকুশল’?”
“উদায়ি! কে সেই সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী ...... , যিনি পূর্বান্ত সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হইয়া বাহিরের কথায় যাইতে লাগিলেন, ...... অপ্রত্যয় প্রকট করিলেন?”
“ভন্তে! নিগণ্ঠ নাতপুত্ত।”
“উদায়ি! যিনি অনেক প্রকারের পূর্বজন্ম অনুস্মরণ করিতে পারেন, একজন্ম ...... ; তিনি আমাকে পূর্বান্ত বিষয়ক প্রশ্ন করিতে পারেন। আমিও তাঁহাকে পূর্বান্ত বিষয়ক প্রশ্ন করিতে পারি। তিনি পূর্বান্ত সম্বন্ধে প্রশ্নোত্তর দ্বারা আমার চিত্ত সন্তুষ্ট করিবেন। আমিও পূর্বান্ত সম্বন্ধে প্রশ্নোত্তর দ্বারা তাঁহার চিত্ত আরাধনা করিব। উদায়ি! যিনি দিব্যচক্ষু দ্বারা যথাকর্মানুগ সত্বদিগকে চ্যুত হইতে, উৎপন্ন হইতে দেখিয়া থাকেন; তিনি আমাকে অপরান্ত বিষয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে পারেন। তাঁহাকে আমিও অপরান্ত সম্বন্ধে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে পারি। তিনি অপরান্ত (পরবর্তী) বিষয়ে প্রশ্নোত্তর দ্বারা আমার চিত্ত আরাধনা করিবেন। আমিও অপরান্ত বিষয়ে প্রশ্নোত্তরে তাঁহার চিত্ত আরাধনা করিব। উদায়ি! রেখে দাও পূর্বান্ত (অতীত), রেখে দাও অপরান্ত (ভবিষ্যত)। তোমাকে ধর্মোপদেশ করিব- ‘উহা (কারণ) থাকিলে ইহা (কার্য) হয়। উহার উৎপত্তিতে ইহা উৎপন্ন হয়। উহা না থাকিলে ইহা হয় না। উহার নিরোধ হেতু ইহা নিরুদ্ধ হয়’।”
“ভন্তে! আমি যাহা কিছু এই শরীর দ্বারা অনুভব করিয়াছি তাহাও আকার-উদ্দেশ সহিত স্মরণ করিতে সমর্থ নহি। কোথা হইতে ভন্তে! ভগবানের ন্যায় আমি অনেকবিধ পূর্বনিবাস অনুস্মরণ করিব ...... ? ভন্তে! আমি বর্তমানে পাংশু-পিশাচকেও দেখিতে পাই না। কোথায় ভন্তে! ভগবানের ন্যায় আমি দিব্যচক্ষু দ্বারা কর্মানুগ সত্বদিগকে চ্যুতি ও উৎপত্তির সময় দেখিতে পাইব? অথচ ভন্তে! ভগবান যে আমাকে বলিয়াছেন- ‘রেখে দাও উদায়ি! পূর্বান্ত, রেখে দাও অপরান্ত ...... উহার নিরোধে ইহা নিরোধ হয়।’ তাহাও আমার বিশেষভাবে হৃদয়ঙ্গম হয় না। ভন্তে! আমি স্বীয় আচার্য মতানুসারে প্রশ্নোত্তর দিয়া ভগবানের চিত্ত কি প্রকারে সন্তুষ্ট করিব?”
২৭২। “উদায়ি! তোমার নিজস্ব মতানুসারে কি ধারণা হয়?”
“ভন্তে! আমাদের স্বীয় আচার্যমতে এরূপ আছে- ‘ইহা পরম বর্ণ (জ্যোতিঃ?), ইহা পরম বর্ণ’।”
“উদায়ি! যাহা তোমার আচার্যমতে এরূপ বর্ণিত আছে- ‘ইহা পরম বর্ণ, ইহা পরম বর্ণ’, উহা কি প্রকার পরম বর্ণ?”
“ভন্তে! যে বর্ণ হইতে উত্তরিতর বা প্রণীততর (উত্তমতর) অপর বর্ণ নাই, উহাই পরম বর্ণ।”
“উদায়ি! সে বর্ণ কি প্রকার যাহা হইতে উত্তমতর অপর বর্ণ নাই?”
“ভন্তে! যে বর্ণ অপেক্ষা প্রণীততর (অধিক উত্তম) অপর বর্ণ নাই, তাহাই পরম বর্ণ।”
“উদায়ি! তোমার এই কথা দীর্ঘকাল যাবৎ চলিবে- ‘যে বর্ণ অপেক্ষা প্রণীততর অপর বর্ণ নাই,’ তবুও তুমি সেই বর্ণকে প্রজ্ঞাপিত করিতে পারিতেছ না। যেমন উদায়ি! (কোন) পুরুষ এরূপ বলে- ‘এই জনপদে (প্রদেশে) যে জনপদকল্যাণী (সুন্দরীদের রাণী) আছে, আমি তাহাকে পাইতে চাই, তাহাকে কামনা করি’ তাহাকে যদি এরূপ বলি- ‘ওহে পুরুষ! তুমি যেই জনপদকল্যাণীকে ইচ্ছা কর, কামনা কর সেই জনপদকল্যাণী ক্ষত্রিয়াণী, ব্রাহ্মণী, বৈশ্যাণী কিংবা শূদ্রাণী তাহাকে তুমি জান কি?’ এরূপ জিজ্ঞাসিত হইয়া বলে ‘না’। যদি তাহাকে এরূপ বলা হয়- ‘হে পুরুষ! তুমি যে জনপদকল্যাণীকে ইচ্ছা ও কামনা করিতেছ তাহার নাম, গোত্র কিংবা দীর্ঘ, হ্রস্ব, মধ্যস্থ আকারের; কাল শ্যাম, রক্তবর্ণ কি? কোন্ গ্রামে, নগরে কিংবা নিগমে জান কি?’ জিজ্ঞাসিত হইয়া বলে ‘না’। তাহাকে এরূপ বলা চলে- ‘হে পুরুষ! তুমি যাহাকে জান নাই, দেখ নাই তাহাকে তুমি ইচ্ছা ও কামনা করিতেছ?’ এরূপ জিজ্ঞাসিত হইয়া ‘হাঁ’ বলে। উদায়ি! তাহাকে কি বলিবে? এরূপ হইলে তাহার ভাষণ নিরর্থক প্রমাণিত হইবে, নহে কি?”
“অবশ্যই ভন্তে! তাহা হইলে তাহার বাক্য নিরর্থক হইবে।”
“এই প্রকার উদায়ি! যে বর্ণ অপেক্ষা প্রণীততর বর্ণ নাই, ‘উহাই পরম বর্ণ’ বলিতেছ, কিন্তু ঐ বর্ণকে প্রতিপাদিত করিতে পারিতেছ না।”
“যেমন ভন্তে! শুভ, উত্তম জাতীয়, অষ্টাংশ, মসৃণকৃত বৈদুর্যমণি (হীরা), পাণ্ডু (রক্ত) কম্বলে রাখিলে উজ্বল দেখায়, দীপ্তিময় ও বিরোচিত হয়; মৃত্যুর পর আত্মা এরূপ বর্ণ সম্পন্ন ও অরোগ (অবিনাশী) হইয়া থাকে।”
২৭৩। “তাহা কি মনে কর উদায়ি! শুভ্র ...... বৈদুর্যমণি আর রাত্রির ঘনান্ধকারে কীট-খদ্যোত প্রাণী, ইহাদের উভয় বর্ণের মধ্যে কোন্ বর্ণ উজ্জ্বলতর ও উত্তমতর?”
“ভন্তে! রাত্রির ঘনান্ধকারে যে জোনাকীপোকা, ইহাই উভয়ের মধ্যে অধিক উজ্জ্বলতর ...... হয়।”
“তাহা কি মনে কর উদায়ি! রাত্রির ঘনান্ধকারে যে জোনাকীপোকা আর রাত্রির ঘনান্ধকারে তৈল-প্রদীপ, এই উভয় বর্ণের মধ্যে কোন্টা উজ্জ্বলতর ও উত্তমতর?”
“ভন্তে! সেই রাত্রির ঘনান্ধকারে তৈল-প্রদীপই ......।”
‘‘তাহা কি মনে কর উদায়ি! রাত্রির অন্ধকারে তৈল-প্রদীপ আর রাত্রির অন্ধকারে বৃহৎ অগ্নিস্কন্ধ, উভয়ের মধ্যে কোন্টা অধিকতর উজ্বল?”
“ভন্তে! ...... অগ্নিস্কন্ধ ......।”
“উদায়ি! অন্ধকার রাত্রে অগ্নিস্কন্ধ ও রাত্রি প্রত্যুষে মেঘহীন স্বচ্ছ আকাশে ওষধিতারা (শুকতারা), এই উভয় বর্ণের মধ্যে কোন্টা উজ্বলতর?”
“ভন্তে! সেই ওষধিতারা ...... !”
“উদায়ি! ...... সেই ওষধিতারা ...... ও মেঘরহিত স্বচ্ছ আকাশে অর্ধরাত্রি সময়ে পঞ্চদশীর পূর্ণচন্দ্র, এই উভয়ের মধ্যে কাহার বর্ণ উজ্বলতর?”
“ভন্তে! সেই পঞ্চদশীর পূর্ণচন্দ্রের ......।”
“উদায়ি! এই যে পূর্ণচন্দ্র ও বর্ষার অন্তিম মাসে শারদ সময়ে মেঘরহিত স্বচ্ছ আকাশে মধ্যাহ্ন বেলার সূর্য, এই উভয়ের মধ্যে কে উজ্বলতর?”
“ভন্তে! মধ্যাহ্ন সূর্য ......।”
“উদায়ি! ইহাদের অপেক্ষা বহু হইতে বহুতর দেবতাদিগকে আমি জানি যাহারা এই চন্দ্র-সূর্যের আভা ব্যবহার করে না (স্বীয় দেহ-জ্যোতিঃতে জ্যোতির্ময় হইয়া বিহার করেন)। তথাপি আমি বলি না যে- ‘সেই বর্ণ অপেক্ষা অন্য বর্ণ উত্তরিতর ও উত্তমতর আর নাই।’ অথচ উদায়ি! তুমি যে বর্ণ কীট-জোনাকীপোকা অপেক্ষাও হীনতর ও নিকৃষ্টতর, তাহা ‘পরম বর্ণ’, বলিতেছ, সেই বর্ণের প্রমাণ করিতেছ না।”
“ভগবান কথা ছেদন করিলেন। সুগত কথা খণ্ডন করিলেন।”
“উদায়ি! কি কারণে তুমি বলিতেছ- ভগবান কথা ছেদন করিলেন ......।”
“ভন্তে! আমাদের স্বীয় আচার্যমতে এরূপ আছে- ‘ইহা পরম বর্ণ, ইহা পরম বর্ণ।’ ভন্তে! ভগবান কর্তৃক আমাদের নিজস্ব আচার্যমত অনুসন্ধিত হইলে, জিজ্ঞাসিত হইলে, সমনুভাসিত (সমন্বয় সাধিত) হইলে উহা রিক্ত, তুচ্ছ, অপরাদ্ধ (অসিদ্ধ) প্রমাণিত হয়।”
২৭৪।“কেমন উদায়ি! একান্ত সুখ-লোক আছে কি? একান্ত সুখময় লোকের সাক্ষাৎকারের নিমিত্ত স্বরূপত (আকারবতী) কোন প্রতিপদা আছে কি?”
“ভন্তে! আপনাদের স্বীয় আচার্যমতে এরূপ আছে,- ‘একান্ত সুখ-লোক আছে, আর একান্ত সুখ-লোকের সাক্ষাৎকারের নিমিত্ত আকারবতী প্রতিপদাও আছে’।”
“উদায়ি! ...... সেই আকারবতী প্রতিপদা কি প্রকার?”
“ভন্তে! এখানে কেহ প্রাণীহত্যা ত্যাগ করিয়া প্রাণীহিংসা-বিরত হয়। অদত্তাদান ত্যাগ করিয়া অদত্তাদান-বিরত হয়। ...... কাম মিথ্যাচার-বিরত হয়। ...... মিথ্যাবাদ-বিরত হয়। কোন এক তপোগুণ (নেশাপান-বিরতি) গ্রহণ করিয়া আচরণ করে। ভন্তে! ইহাই আকারবতী প্রতিপদা ......।”
“তাহা কি মনে কর উদায়ি! যে সময় প্রাণাতিপাত-বিরত হয়, কেমন সে সময় আত্মা একান্ত সুখী হয়, অথবা সুখ-দুঃখী?”
“সুখ-দুঃখী, ভন্তে!”
“তাহা কি মনে কর উদয়ি! যে সময় অদত্তাদান, কামমিথ্যাচার, মিথ্যাবাদ-বিরত ও কোন এক তপোগুণযুক্ত হয়; তখন আত্মা একান্ত সুখী হয় বা সুখ-দুঃখী হয়?”
“সুখ-দুঃখী, ভন্তে!”
“উদায়ি! তাহা কি মনে কর, কেমন সুখ-দুঃখ মিশ্রিত প্রতিপদা অবলম্বন করিয়া একান্ত সুখ লোকের সাক্ষাৎকার হয় কি?”
“ভগবান বাদ-ছেদন করিয়াছেন, সুগত মতবাদ খণ্ডন করিয়াছেন।”
“উদায়ি! কেন তুমি ঐরূপ বলিতেছ?- ‘ভগবান বাদ-ছেদন করিয়াছেন ......।”
“ভন্তে! আমাদের স্বীয় আচার্যমতে এরূপ আছে,- ‘একান্ত সুখ-লোক আছে, উহার সাক্ষাৎকারের নিমিত্ত একান্ত সুখ প্রতিপদাও আছে। কিন্তু ভন্তে! ভগবানের ...... অনুসন্ধানে, জিজ্ঞাসায় ও সামঞ্জস্য বিধানে তাহা তুচ্ছ ...... প্রতিপন্ন হইল।”
২৭৫। “ভন্তে! একান্ত সুখ-লোক আছে কি? উহা সাক্ষাৎকারের আকারবতী প্রতিপদা আছে কি?”
“আছে, উদায়ি! একান্ত সুখ-লোক, আছে একান্ত সুখ-লোক সাক্ষাৎকারের নিমিত্ত আকারবতী প্রতিপদা।”
“ভন্তে! একান্ত সুখ-লোকের সাক্ষাৎকারের নিমিত্ত আকারবতী প্রতিপদা কোন্ প্রকার?”
“এখানে উদায়ি! ভিক্ষু ...... প্রথম ধ্যান, দ্বিতীয় ধ্যান, তৃতীয় ধ্যান প্রাপ্ত হইয়া বিহার করেন। ইহাই উদায়ি! আকারবতী প্রতিপদা ......।”
“ভন্তে! একান্ত সুখ-লোকের সাক্ষাৎকারের নিমিত্ত উহাই আকারবতী প্রতিপদা এবং উহাতেই ভন্তে! একান্ত সুখ-লোকের সাক্ষাৎকার হইয়া থাকে কি?”
“উদায়ি! উহাতেই একান্ত সুখ-লোকের সাক্ষাৎকার হয় না। উহা একান্ত সুখ-লোক সাক্ষাৎকারের আকারবতী প্রতিপদা (উপায়) মাত্র।”
এরূপ আলোচনার পর সকুলুদায়ি পরিব্রাজকের পরিষদ উন্মাদিনী উচ্চশব্দ, মহাশব্দ করিতে লাগিল,- ‘এখানে আচার্যমত সহ আমরা নষ্ট হইলাম, এক্ষেত্রে আচার্যমত সহ আমরা প্রনষ্ট হইলাম। ইহা অপেক্ষা অধিকতর উত্তরিতর আমরা জানি না।’ অতঃপর সকুল-উদায়ি পরিব্রাজক সেই পরিব্রাজকদিগকে নীরব করিয়া ভগবানকে ইহা বলিলেন,- ‘ভন্তে! কি প্রকারে একান্ত সুখ-লোক সাক্ষাৎকার হয়?”
“এখানে উদায়ি! ভিক্ষু সুখেরও প্রহাণ হেতু ...... চতুর্থ ধ্যান প্রাপ্ত হইয়া বিহার করে। (তখন) যে সকল দেবতা একান্ত সুখ-লোকে উৎপন্ন হয়, সেই দেবতাদের সহিত স্থিত হয়, আলাপ করে, আলোচনায় যোগদান করে। ইহাতেই উদায়ি! উহার একান্ত সুখ-লোক সাক্ষাৎকৃত (প্রত্যক্ষ) হইয়া থাকে।”
২৭৬। “ভন্তে! এই একান্ত সুখ-লোকের সাক্ষাৎকার হেতু ভিক্ষুগণ ভগবৎ সমীপে ব্রহ্মচর্য আচরণ করেন কি?”
“উদায়ি! ইহার নিমিত্ত ভিক্ষুগণ আমার সমীপে ব্রহ্মচর্য পালন করে না। উদায়ি! (ইহা হইতে) অপর প্রণীততর, উত্তরিতর ধর্ম বিদ্যমান, যাহাদের সাক্ষাৎকারের জন্য ভিক্ষুগণ আমার নিকট ব্রহ্মচর্য পালন করে।”
“ভন্তে! সেই উত্তরিতর ধর্ম কি প্রকার ...... ?”
“এখানে উদায়ি! লোকে তথাগত উৎপন্ন হন, ...... বুদ্ধ, ভগবান ......। তিনি চিত্তের (সমাধির) উপক্লেশ, প্রজ্ঞার দুর্বলকারী এই পঞ্চ নীবরণ বিষ্কম্ভণ প্রহাণ করিয়া কাম হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়াই ...... প্রথম ধ্যান লাভ করিয়া বিহার করেন। উদায়ি! ইহাই উত্তরিতর ...... ধর্ম ......। দ্বিতীয় ধ্যান ......। তৃতীয় ধ্যান ......। চতুর্থ ধ্যান লাভ করিয়া বিহার করেন। উদায়ি! ইহাও উত্তরিতর, প্রণীততর ধর্ম যাহার সাক্ষাৎকারের নিমিত্ত ভিক্ষুগণ আমার নিকট ব্রহ্মচর্য আচরণ করে। তিনি এরূপ সমাহিত চিত্তে ...... অনেক প্রকার পূর্বনিবাস অনুস্মরণ করেন ......। চ্যুত ও উৎপন্ন হইবার সময় প্রাণিগণকে জানিতে পারেন ......। দুঃখ নিরোধগামিনী প্রতিপদা, আস্রব নিরোধগামিনী প্রতিপদাকে যথার্থভাবে জানিতে পারেন। এইরূপ জানিয়া, এইরূপ দেখিয়া কামাস্রব, ভবাস্রব, অবিদ্যাস্রব হইতে তাহার চিত্ত বিমুক্ত হয়, বিমুক্তিতে ‘বিমুক্ত’ এই জ্ঞানোদয় হয়; জন্ম ক্ষয়, পরিপূর্ণ ব্রহ্মচর্যবাস, করণীয় কৃত, এই কামলোকে দেহ ধারণের আর কর্তব্য নাই, ইহা জানিতে পারেন। উদায়ি! ইহাই উত্তরিতর প্রণীততর ধর্ম যাহার জন্য ভিক্ষুগণ আমার নিকট ব্রহ্মচর্য পালন করিয়া থাকে।”
২৭৭। এইরূপ উক্ত হইলে সকুল-উদায়ি পরিব্রাজক ভগবানকে ইহা বলিলেন,- “অতি আশ্চর্য ভন্তে! ......। ভন্তে! আমি ভগবৎ সমীপে প্রব্রজ্যা ও উপসম্পদা লাভ করিতে চাই।”
ইহা উক্ত হইলে সকুলুদায়ির পরিব্রাজক পরিষদ তাঁহাকে কহিলেন,- “উদায়ি! আপনি ভগবান গৌতম সমীপে ব্রহ্মচর্য পালন করিবেন না। উদায়ি! আপনি উদক-মণিকের দ্রোণি (মগ) হওয়ার ন্যায় আচার্য হইয়া অন্তেবাসীরূপে বাস করিবেন না। এই প্রকারে সকুল-উদায়ির পরিষদ ভগবৎ সমীপে তাঁহার ব্রহ্মচর্য বাসের অন্তরায় করিলেন ।
॥ চূল সকুল-উদায়ি সূত্র সমাপ্ত ॥
২৭৮। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-
এক সময় ভগবান শ্রাবস্তীতে অনাথপিণ্ডিকের আরামে জেতবনে বিহার করিতেছেন।
তখন বেখণস পরিব্রাজক যেখানে ভগবান ছিলেন তথায় গেলেন, উপস্থিত হইয়া ভগবানের সহিত সম্মোদন করিলেন। সম্মোদনীয় কথা সমাপ্ত করিয়া একপ্রান্তে দাঁড়াইলেন, একান্তে দাঁড়াইয়া বেখণস পরিব্রাজক ভগবানের নিকট এই উদান (আনন্দোল্লাসে উচ্চারিত বাক্যাবলী) গান করিলেন,- ‘ইহাই পরম বর্ণ’ ......।”
২৭৯। “সেই পরম বর্ণ কি প্রকার?”
“ভো গৌতম! যে বর্ণ অপেক্ষা অন্য উত্তরিতর বা প্রণীততর বর্ণ নাই, তাহাই পরম বর্ণ।”
“কাত্যায়ণ ! তাহা কি প্রকার বর্ণ, যে বর্ণ অপেক্ষা উত্তরিতর বা প্রণীততর বর্ণ নাই?”
“ভো গৌতম! যে বর্ণ অপেক্ষা অন্য উত্তরিতর বা প্রণীততর বর্ণ নাই, তাহাই পরম বর্ণ।”
“কাত্যায়ণ! তোমার এই বাক্য দীর্ঘ-বিস্তার হইতেছে,- ‘ভো গৌতম! যে বর্ণ অপেক্ষা ...... তাহাই পরম বর্ণ।’ কিন্তু তোমার সে বাক্যকে প্রতিপাদন করিতেছ না। যেমন কাত্যায়ণ! কোন পুরুষ এরূপ বলে,- ‘এই জনপদে যে জনপদকল্যাণী (দেশে সুন্দরীদের রাণী) আছে আমি তাহাকে চাই, তাহাকেই কামনা করি।’ তাহাকে যদি (লোকে) এরূপ জিজ্ঞাসা করে,- ‘হে পুরুষ! যে জনপদকল্যাণীকে তুমি চাইতেছ, কামনা করিতেছ, তাহাকে জান কি সে ক্ষত্রিয়ানী, ব্রাহ্মণী, বৈশ্যানী কিংবা শূদ্রানী হয়?’ ইহা জিজ্ঞাসা করিলে ‘না’ বলে। তখন তাহাকে যদি জিজ্ঞাসা করে,- ‘হে পুরুষ! তুমি যে জনপদকল্যাণীকে চাহিতেছ (সে) কোন্ নামের, কোন্ গোত্রের হয়? দীর্ঘ, হ্রস্ব বা মধ্যমাকার হয়? কাল, শ্যামা বা মংগুর (রক্ত) বর্ণের হয়? কোন্ গ্রাম, নিগম বা নগরে থাকে?’ এরূপ জিজ্ঞাসা করিলে ‘জানি না’ বলে। তখন তাহাকে যদি ইহা জিজ্ঞাসা করে,- ‘হে পুরুষ! যাহাকে তুমি জান না, যাহাকে তুমি দেখ নাই, তাহাকে তুমি চাহিতেছ, তাহাকে তুমি কামনা করিতেছ?’ এরূপ জিজ্ঞাসা করিলে ‘হাঁ’ বলে। তাহা কি মনে কর কাত্যায়ণ! এইরূপ বলিলে সে পুরুষের বাক্য অর্থহীন হয় নহে কি?”
“নিশ্চয় ভো গৌতম! এরূপ বলিলে সে পুরুষের বাক্য অর্থহীন হইয়া থাকে।”
“কাত্যায়ণ! তুমি তদ্রূপই বলিতেছ,- ‘ভো গৌতম! যে বর্ণ অপেক্ষা ...... উহা পরম বর্ণ।’ কিন্তু সে বর্ণকে প্রতিপাদন করিতেছ না।”
“যেমন হে গৌতম! শুভ্র, উত্তমজাতীয়, অষ্টাংশ, মসৃণকৃত, বৈদুর্যমণি (হীরা) ...... ।”
“ ...... অথচ কাত্যায়ণ! তুমি যাহা জোনাকীপোকার চেয়ে হীনতর, নিকৃষ্টতর বর্ণ, উহাকেই পরম বর্ণ বলিতেছ; কিন্তু সে বর্ণ প্রমাণ করিতেছ না।”
২৮০। কাত্যায়ণ! এই পঞ্চ কামগুণ (বিষয় ভোগ)। কোন্ পঞ্চ? (১) ইষ্ট, কান্ত ...... চক্ষুদ্বারা বিজ্ঞেয় রূপ, (২) ...... শ্রোত্র বিজ্ঞেয় শব্দ, (৩) ...... ঘ্রাণ বিজ্ঞেয় গন্ধ, (৪) ...... জিহ্বা বিজ্ঞেয় রস, (৫) ...... কায় বিজ্ঞেয় স্পৃষ্টব্য। কাত্যায়ণ! এই পঞ্চ কামগুণ। এই পঞ্চ কামগুণ সংস্রবে যে সুখ-সৌমনস্য উৎপন্ন হয়, উহাকে কাম-সুখ বলে। এই প্রকারে কাম হইতে কাম-সুখ, কাম-সুখ হইতে কাম-অগ্র সুখই এখানে শ্রেষ্ঠ বলা যায়।”
এরূপ উক্ত হইলে বেখণস পরিব্রাজক ভগবানকে বলিলেন,- “আশ্চর্য ভো গৌতম! অদ্ভুত ভো গৌতম! মাননীয় গৌতমের কেমন সুভাষিত বাক্য,- ‘কাম হইতে কাম-সুখ আর কাম-সুখ হইতে কামাগ্র-সুখ শ্রেষ্ঠ বলা যায়’।”
“কাত্যায়ণ! তোমার ন্যায় অন্য দৃষ্টিক (অন্য মতাবলম্বী), অন্য ক্ষান্তিক, অন্য রুচিক, অন্যত্রযোগী, অন্যথা আচার্যক (ভিন্ন জ্ঞানীর) পক্ষে কাম, কাম-সুখ কামাগ্র-সুখ- ইহা জানা দুষ্কর। কাত্যায়ণ! যে সকল ভিক্ষু অর্হৎ, ক্ষীণাস্রব, পরিপূর্ণ ব্রহ্মচারী, কৃতকৃত্য, ভারমুক্ত, অনুপ্রাপ্ত সদর্থ, পরিক্ষীণ ভব সংযোজন, সম্যক্জ্ঞান দ্বারা বিমুক্ত তাহারাই ইহা কাম, কাম-সুখ এবং কামাগ্র-সুখ বলিয়া জানিতে সমর্থ।”
২৮১। এইরূপ উক্ত হইলে বেখণস পরব্রিাজক কোপিত অসন্তুষ্ট চিত্ত হইয়া ভগবানকেই ভৎর্সনা মানসে ভগবানের প্রতি আক্রোশ বশতঃ ভগবানকেই বলিবার ইচ্ছায় ‘শ্রমণ গৌতমই (অজ্ঞতা) প্রাপ্ত হইবে’ (ভাবিয়া) ভগবানকে ইহা বলিলেন,- “এই প্রকারই এক্ষেত্রে কোন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ পূর্বান্ত (আরম্ভ) না জানিয়া, অপরান্ত (শেষ) না দেখিয়াই এই প্রকার অঙ্গীকার (দাবী) করে- ‘জন্ম ক্ষীণ হইয়াছে, ব্রহ্মচর্যবাস সমাপ্ত হইয়াছে, কর্তব্য করা হইয়াছে, ইহার জন্য আর কর্তব্য নাই, ইহা আমরা জানি।’ তাহাদের এই ভাষণ হর্ষকরই (হাস্যজনক) প্রতিপন্ন হয়, নিরর্থক, রিক্ত ও তুচ্ছই প্রতিপন্ন হয়।”
“কাত্যায়ণ! যে সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণ পূর্বান্ত না জানিয়া, অপরান্ত না দেখিয়া এই অঙ্গীকার করে যে- ‘জন্ম ক্ষীণ হইয়াছে ...... ইহা আমরা জানি।’ উহাদের ইহা ধার্মিক নিগ্রহ হইয়া থাকে। কাত্যায়ণ! থাক পূর্বান্ত (পূর্বনিবাসানুস্মৃতি), থাক অপরান্ত (দিব্যচক্ষু),- অ-শঠ, অ-মায়াবী, কোন সরল বিজ্ঞপুরুষ আসুক; আমি তাহাকে অনুশাসন করি, ধর্মোপদেশ করি। (আমার) অনুশাসনানুরূপ আচরণ করিলে অচিরেই নিজে উপলব্ধি করিবে, স্বয়ং প্রত্যক্ষ করিবে,- ‘অবিদ্যা বন্ধন হইতে এই প্রকারেই সম্যক্ বন্ধন-মুক্ত হইয়া থাকে।’ যেমন কাত্যায়ণ! উত্তানশায়ী অবোধ অল্পবয়স্ক শিশুর (দুই হস্ত, দুই পাদ) আর পঞ্চম স্থানীয় কণ্ঠে সূত্র-বন্ধনে আবদ্ধ থাকে, উহার বয়ঃবৃদ্ধির পর ইন্দ্রিয় (জ্ঞান) পরিপক্ক হইলে সেই বন্ধন সমূহ ছিন্ন হয়। সে ‘মুক্ত হইয়াছি, বন্ধন আর নাই’ ইহা জানিতে পারে। এই প্রকারেই কাত্যায়ণ! ...... কোন বিজ্ঞপুরুষ আসুক ...... স্বয়ং প্রত্যক্ষ করিবে- এই প্রকারে অবিদ্যা বন্ধন হইতে মুক্ত হইয়া থাকে।”
এরূপ উক্ত হইলে বেখণস পরিব্রাজক ভগবানকে ইহা বলিলেন,- “আশ্চর্য ভো গৌতম! অতি চমৎকার ভো গৌতম! ...... মাননীয় গৌতম! আজ হইতে আমাকে আজীবন শরণাগত উপাসকরূপে ধারণা করুন।”
॥ বেখণস সূত্র সমাপ্ত ॥
॥ তৃতীয় পরিব্রাজক বর্গ সমাপ্ত ॥