জীবক সূত্র (৫৫)

৫১। আমি এইরূপ শুনিয়াছি-

এক সময় ভগবান রাজগৃহ সমীপে কোমারভচ্চ (কুমার পোষিত) জীবকের আম্রবনে অবস্থান করিতেছিলেন। সেই সময় জীবক কোমারভচ্চ যেখানে ভগবান আছেন তথায় উপস্থিত হইলেন। উপস্থিত হইয়া ভগবানকে অভিবাদন করিয়া একপ্রান্তে উপবেশন করিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট জীবক ভগবানকে বলিলেন,-

“ভন্তে! শোনা যায়- ‘শ্রমণ গৌতমোদ্দেশ্যে জীবহত্যা হয়, আর শ্রমণ গৌতম সজ্ঞানে সেই উদ্দেশ্যকৃত মাংস ভোজন করেন, নিমিত্তকর্মের ভাগী হন।’ ভন্তে! যাহারা এরূপ বলে- ‘শ্রমণ গৌতমের উদ্দেশ্যে জীবহত্যা হয়, আর শ্রমণ গৌতম সেই উদ্দেশ্যকৃত মাংস ভোজন করেন, নিমিত্তকর্মের ভাগী হন।’ কেমন ভন্তে! তাহারা ভগবান সম্বন্ধে সত্যবাদী, ভগবানকে মিথ্যা দোষারোপ করে না, যুক্তি-ধর্মানুরূপ ঘোষণা করে এবং আপনার যুক্তিসঙ্গত কোন বাদানুবাদ (বিজ্ঞদের) নিন্দার কারণ নহেত?”

৫২। “জীবক! যাহারা এইরূপ বলে- ‘শ্রমণ গৌতমের উদ্দেশ্যে (লোকে) প্রাণীহত্যা করে, আর শ্রমণ গৌতম সজ্ঞানে সেই উদ্দেশ্যকৃত মাংস পরিভোগ করেন, নিমিত্তকর্মের ভাগী হন।’ তাহারা আমার সম্বন্ধে সত্যবাদী নহে, তাহারা অসত্য, অভূত কারণে আমাকে অপবাদ করে। জীবক! আমি তিন কারণে মাংস অপরিভোগ্য বলি, যথা- দৃষ্ট, শ্রুত ও পরিশঙ্কিত । জীবক! এই ত্রিবিধ কারণে আমি মাংস অপরিভোগ্য বলি। জীবক! ত্রিবিধ কারণে আমি মাংস পরিভোগ্য বলে বর্ণনা করি, যথা- অ-দৃষ্ট, অ-শ্রুত, ও অ-পরিশঙ্কিত। জীবক! এই ত্রিবিধ কারণে আমি মাংস পরিভোগ্য বলি।”

৫৩। “জীবক! কোন ভিক্ষু গ্রাম অথবা নগর আশ্রয়ে বাস করে। সে মৈত্রীসংযুক্ত চিত্তে একদিক বিস্ফুরিত করিয়া বাস করে, তথা দ্বিতীয় দিক, তৃতীয় দিক ও চতুর্থদিক। এইরূপে ঊর্ধ, অধঃ তির্যক (চতুষ্কোণে), সর্বদিকে, সর্বত্র, সমগ্র জগত বৈরী ও বিদ্বেষ বিহীন বিপুল, মহদ্গত, অপ্রমাণ মৈত্রী-সহগত চিত্তে বিস্ফুরিত করিয়া বাস করে। কোন গৃহপতি বা গৃহপতিপুত্র তাহার নিকট গিয়া আগামী কল্যের জন্য ভোজনের নিমন্ত্রণ করে। জীবক! ভিক্ষু আকাঙ্খা করিলে নিমন্ত্রণ স্বীকার করিতে পারে। সে রাত্রি অবসানে পূর্বাহ্ন সময়ে সেই ভিক্ষু উত্তরীয় পরিধান পূর্বক পাত্র-চীবর লইয়া যেখানে সেই গৃহপতি বা গৃহপতিপুত্রের নিবাস, তথায় উপস্থিত হয়, সুসজ্জিত আসনে উপবেশন করে। তাহাকে সেই গৃহপতি বা গৃহপতিপুত্র উত্তম পিণ্ডপাত (খাদ্য ভোজ্য) পরিবেশন করে। তখন তাহার এই ইচ্ছা হয় না- ‘সাধু, বেশ! এই গৃহপতি বা গৃহপতিপুত্র আমাকে উত্তম পিণ্ডপাত পরিবেশন করুন। অহো! এই গৃহপতি বা গৃহপতিপুত্র আমাকে ভবিষ্যতেও এইরূপ উত্তম পিণ্ডপাত পরিবেশন করুন’ এই ইচ্ছাও তাহার হয় না। সে অ-লুব্ধ, অ-মূর্চ্ছিত হইয়া অনাসক্তভাবে প্রতিকূল বা পরিণামদর্শী হইয়া নিঃসরণ (মুক্তি) জ্ঞানে বিচারপূর্বক সেই পিণ্ডপাত ভোজন করে। তবে জীবক! তুমি কি মনে কর- তখন কি সে ভিক্ষু আত্ম-নিপীড়নার্থ চিন্তা করে, পর-নিপীড়নার্থ চিন্তা করে, অথবা আত্ম-পর উভয় নিপীড়নার্থ চিন্তা করিতে পারে?”

“তাহা অসম্ভব, ভন্তে!”

“তখন সে ভিক্ষু অনবদ্য আহার গ্রহণ করে নহে কি?”

“হাঁ, ভন্তে! আমি পূর্বে শুনিয়াছি ভন্তে! ‘ব্রহ্মাই মৈত্রীবিহারী (সতত সকলকেই মিত্ররূপে দেখেন)’। প্রভু! ভগবানকেই আজ সাক্ষাৎ স্বরূপে দেখিলাম। প্রভু! ভগবানই যথার্থ মৈত্রীবিহারী।”

“জীবক! যেই রাগ, দ্বেষ, মোহের দরুণ ব্যাপাদ বা হিংসার উদয় হয় সেই রাগ, দ্বেষ, মোহ তথাগতের পরিত্যক্ত; ছিন্নমূল তালবৃক্ষবৎ কৃত, ক্রমে অভাব কৃত এবং ভবিষ্যতে অনুৎপত্তি স্বভাব হইয়াছে। জীবক! যদি তুমি এই কারণে বলিয়া থাক, তবে তোমার অভিমত সমর্থন করি।”

“হাঁ, ভন্তে! এই কারণেই আমি ইহা বলিয়াছি।”

৫৪। “জীবক! এখানে কোন ভিক্ষু অন্যতর গ্রাম বা নগরাশ্রয়ে অবস্থান করেন। তিনি করুণা সহগত চিত্তে- মুদিতা সহগত চিত্তে- উপেক্ষা সহগত চিত্তে একদিক বিস্ফুরিত করিয়া বাস করেন, তথা দ্বিতীয় দিক ...... পূ ...... জ্ঞানে বিচারপূর্বক সেই পিণ্ডপাত ভোজন করেন। তিনি আত্ম-নিপীড়নার্থ, পর-নিপীড়নার্থ অথবা আত্ম-পর উভয় নিপীড়নার্থ চিন্তা করিতে পারেন না। যেই রাগ, দ্বেষ ও মোহের দরুণ লোকের মনে হিংসার উদয় হয় সেই রাগ, দ্বেষ ও মোহ তথাগতের পরিত্যক্ত, ...... পূ ...... ভবিষ্যতে অনুৎপত্তি স্বভাব হইয়াছে।”

৫৫। “জীবক! যে ব্যক্তি তথাগতের কিংবা তথাগতশ্রাবকদের উদ্দেশ্যে জীব হত্যা করে, সে পঞ্চ কারণেই বহু অপুণ্য অর্জন করে। যেমন- (১) সে যখন এইরূপ বলে- ‘তোমরা যাও, অমুক প্রাণীকে বধের জন্য লইয়া আস।’ এই আদেশ মাত্রই সে প্রথম কারণে বহু অপুণ্য সঞ্চয় করে। (২) যখন সেই প্রাণী রজ্জুবদ্ধগলে, কম্পিত কলেবরে টানিয়া আনিবার সময় যে দুঃখ-দৌর্মনস্য ভোগ করে, তখন সে দ্বিতীয় কারণে বহু অপুণ্য প্রসব করে। (৩) যখন সে এইরূপ আদেশ করে- ‘যাও, এই জীবকে হত্যা কর।’ তখন সে তৃতীয় কারণে বহু অপুণ্য প্রসব করে। (৪) যখন সেই প্রাণীহত্যার সময় দুঃখ-দৌর্মনস্য (সন্তাপ) অনুভব করে, তখন সে চতুর্থ কারণে বহু অপুণ্য প্রসব করে। (৫) যখন সে এই অকপ্পিয় (অ-বিহিত) বস্তু (মাংস) দ্বারা তথাগতকে কিংবা তথাগতশ্রাবককে আ-সাদন (অপ্রস্তুত) বা অপবাদ করে, তখন সে এই পঞ্চ কারণে বহু অপুণ্য প্রসব করে। জীবক! যে কেহ তথাগত কিম্বা তথাগতশ্রাবকের উদ্দেশ্যে প্রাণী-হিংসা করে সে নিশ্চিত এই পঞ্চ কারণে বহু অপুণ্য সঞ্চয় করে।”

॥ জীবক সূত্র সমাপ্ত ॥

উপালি সূত্র (৫৬)

৫৬। আমি এইরূপ শুনিয়াছি-

এক সময় ভগবান নালন্দায় অবস্থান করিতেছিলেন, পাবারিক শ্রেষ্ঠির আম্রবনে। সেই সময় নাতপুত্র নিগণ্ঠ মহৎ নিগণ্ঠ পরিষদ সহ নালন্দায় বাস করিতেছিলেন। তখন দীর্ঘতপস্বী নিগণ্ঠ নালন্দায় পিণ্ডচর্যা (ভিক্ষান্ন সংগ্রহ) করিয়া ভোজনের পর পিণ্ডচর্যা হইতে প্রত্যাবর্তন পূর্বক যেস্থানে পাবারিকাম্র-কানন, যেস্থানে ভগবান আছেন সেস্থানে উপনীত হইলেন। উপস্থিত হইয়া ভগবানের সহিত প্রীতি সম্ভাষণ করিলেন, সম্মোদনীয় ও স্মরণীয় কথা সমাপন করিয়া একপ্রান্তে দাঁড়াইলেন, একপ্রান্তে স্থিত দীর্ঘতপস্বী নিগণ্ঠকে ভগবান বলিলেন,-

“হে তপস্বি! আসন বিদ্যমান, যদি ইচ্ছা হয় বসিতে পার।”

এইরূপ উক্ত হইলে দীর্ঘতপস্বী নিগণ্ঠ অন্যতর নীচ আসন গ্রহণ করিয়া একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট নিগণ্ঠকে ভগবান এইরূপ বলিলেন,-

“তপস্বি! পাপকর্ম সম্পাদনের নিমিত্ত, পাপকর্ম প্রবর্তনের নিমিত্ত নাতপুত্র নিগণ্ঠ কত প্রকার কর্ম প্রদর্শন করেন?”

“বন্ধু গৌতম! নাতপুত্র নিগণ্ঠের ‘কর্ম’ ‘কর্ম’ বলিয়া প্রদর্শন করিবার অভ্যাস নাই। বন্ধু গৌতম! নাতপুত্র নিগণ্ঠের ‘দণ্ড’ ‘দণ্ড’ বলিয়া নির্দেশ করিবার অভ্যাস আছে।”

“তবে তপস্বি! পাপকর্ম সম্পাদনের ও পাপকর্ম প্রবর্তনের জন্য নাতপুত্র নিগণ্ঠ কত প্রকার দণ্ড নির্দেশ করেন?”

“পাপকর্ম সম্পাদনের জন্য ও পাপকর্ম প্রবর্তনের জন্য নাতপুত্র নিগণ্ঠ ত্রিবিধ দণ্ড নির্দেশ করেন, যথা- কায়দণ্ড, বাক্‌দণ্ড ও মনোদণ্ড।”

“তপস্বি! তবে কি কায়দণ্ড অন্য, বাক্‌দণ্ড অন্য এবং মনোদণ্ড অন্য?”

“হাঁ, বন্ধু গৌতম! কায়দণ্ড অন্য, বাক্‌দণ্ড অন্য ও মনোদণ্ড অন্য।”

“তপস্বি! এইরূপে বিভক্ত, এইরূপে বিশিষ্ট ত্রিবিধ দণ্ডের মধ্যে নাতপুত্র নিগণ্ঠ কোন্‌ প্রকার দণ্ডকে পাপকর্ম সম্পাদনের নিমিত্ত, পাপকর্ম প্রবর্তনের নিমিত্ত মহাসাবদ্যতর (অধিকতর দোষাবহ) মনে করেন- কায়দণ্ড, বাক্‌দণ্ড অথবা মনোদণ্ড?”

“বন্ধু গৌতম! এইরূপে বিভক্ত, এইরূপে বিশিষ্ট ত্রিবিধ দণ্ডের মধ্যে নাতপুত্র নিগণ্ঠ কায়দণ্ডকেই মহাসাবদ্যতর বলিয়া নির্দেশ করেন, পাপকর্ম সম্পাদনের নিমিত্ত, পাপকর্মের প্রবর্তনের নিমিত্ত; তদ্রূপ বাক্‌দণ্ডও নহে- মনোদণ্ডও নহে।

“তপস্বি! কায়দণ্ডই বলিতেছ?”

“হাঁ, বন্ধু গৌতম! কায়দণ্ডই বলিতেছি।”

“তপস্বি! কায়দণ্ডই বলিতেছ?”

“হাঁ, বন্ধু গৌতম! কায়দণ্ডই বলিতেছি।”

“কায়দণ্ডই বলিতেছ? তপস্বি!”

“হাঁ, বন্ধু গৌতম! কায়দণ্ডই বলিতেছি।”

এইরূপেই ভগবান এই কথা প্রসঙ্গে দীর্ঘতপস্বী নিগণ্ঠকে তিনবার প্রতিষ্ঠিত করিলেন।

৫৭। এইরূপ উক্ত হইলে দীর্ঘতপস্বী নিগণ্ঠ ভগবানকে বলিলেন,-

“বন্ধু গৌতম! আপনি কত প্রকার দণ্ড নির্দেশ করেন পাপকর্ম সম্পাদনের নিমিত্ত, পাপকর্ম প্রবর্তনের নিমিত্ত?”

“তপস্বি! দণ্ড, দণ্ড নামে নির্দেশ করা তথাগতের অভ্যস্ত নহে। তপস্বি! কর্ম, কর্ম নির্দেশ করাই তথাগতের অভ্যস্ত।”

“বন্ধু গৌতম! আপনি কত প্রকার কর্ম নির্দেশ করেন পাপকর্ম সম্পাদনের ও পাপকর্মের প্রবর্তনের জন্য? ...... পূ .....।”

অতঃপর দীর্ঘতপস্বী নিগণ্ঠ নাতপুত্র নিগণ্ঠের নিকট গেলেন।

৫৮। সেই সময় নাতপুত্র নিগণ্ঠ বালক লোণকার গ্রামবাসী উপালি প্রমুখ মহা-গৃহীপরিষদের সহিত উপবিষ্ট ছিলেন। তখন নাতপুত্র নিগণ্ঠ দীর্ঘতপস্বী নিগণ্ঠকে দূর হইতে আসিতে দেখিলেন, দেখিয়া দীর্ঘতপস্বী নিগণ্ঠকে বলিলেন,-

“সত্যই তপস্বি! তুমি দিবা দ্বিপ্রহরে কোথা হইতে আসিতেছ?”

“ওখান হইতে, প্রভু! শ্রমণ গৌতমের নিকট হইতে আসিতেছি।”

“শ্রমণ গৌতমের সহিত তোমার কোন বাক্যালাপ হইয়াছে কি?”

“প্রভু! শ্রমণ গৌতমের সহিত আমার কিছু বাক্যালাপ হইয়াছে।”

“তপস্বি! শ্রমণ গৌতমের সহিত তোমার কি কথা আলোচনা হইয়াছে?”

“অতঃপর দীর্ঘতপস্বী নিগণ্ঠ শ্রমণ গৌতমের সহিত যে সমস্ত বাক্যালাপ হইয়াছিল, তৎসমুদয় নাতপুত্র নিগণ্ঠকে বলিলেন। এইরূপ উক্ত হইলে নিগণ্ঠ নাতপুত্র দীর্ঘতপস্বীকে কহিলেন,-

“সাধু, সাধু তপস্বি! যেমন একজন বহুশ্রুত উত্তমরূপে স্বীয় শাস্তার শাসনাভিজ্ঞ শ্রাবকের দ্বারা যাহা সম্ভব, সেইরূপ দীর্ঘতপস্বী কর্তৃক শ্রমণ গৌতমকে তাহা প্রকাশ করা হইয়াছে। এই উদার কায়দণ্ডের সাম্‌নে নিকৃষ্ট (ছবো) মনোদণ্ড কি প্রকারে শোভা পায়? অতএব কায়দণ্ডই মহাসাবদ্যতর পাপকর্ম সম্পাদনে ও পাপকর্ম প্রবর্তনে। তদ্রূপ বাক্‌দণ্ডও নহে আর তদ্রূপ মনোদণ্ডও নহে।”

৫৯। এইরূপ উক্ত হইলে উপালি গৃহপতি নাতপুত্র নিগণ্ঠকে ইহা বলিলেন,-

“ধন্য! ধন্য!! ভন্তে তপস্বি! (উত্তম কার্যই করিয়াছেন)। যেমন কোন বহুশ্রুত, স্বীয় শাস্তার শাসনে সম্যকরূপে অভিজ্ঞ শ্রাবকদ্বারা যাহা সম্ভব, তদ্রূপই ভদন্ত তপস্বী কর্তৃক শ্রমণ গৌতমকে ব্যক্ত করা হইয়াছে। নিকৃষ্ট মনোদণ্ড এইরূপ মহৎ কায়দণ্ডের সাক্ষাতে কি প্রকারে শোভনীয় হয়? অতএব কায়দণ্ডই মহাসাবদ্যতর, পাপকর্মের সম্পাদনে, পাপকর্মের প্রবর্তনে; তদ্রূপ বাক্‌দণ্ডও নহে, মনোদণ্ডও নহে। ভন্তে! এখন আমি যাই, এই কথাপ্রসঙ্গে শ্রমণ গৌতমের সাথে নিশ্চয় বাদ-বিবাদ (অভিযোগ) করিব। ভদন্ত তপস্বী কর্তৃক যেখানে প্রতিষ্ঠিত, যদি শ্রমণ গৌতম আমার সামনে তথায় প্রতিষ্ঠিত থাকে তবে যেমন কোন বলবান পুরুষ দীর্ঘলোমী ভেড়াকে লোমে ধরিয়া আকর্ষণ করে, পরিকর্ষণ করে, সম্পরিকর্ষণ করে, তদ্রূপ আমিও বাদী শ্রমণ গৌতমকে বাক্যদ্বারা আকর্ষণ করিব, পরিকর্ষণ করিব, সম্পরিকর্ষণ করিব। যেমন কোন বলবান শৌণ্ডিক-কর্মচারী বৃহৎ শৌণ্ডিক কিলঞ্জ (চাটাই) গভীর জলাশয়ে নিক্ষেপ করিয়া কর্র্ণে (কোনায়) দৃঢ়রূপে ধরিয়া টানে, আকর্ষণ করে, পরিকর্ষণ করে, সম্পরিকর্ষণ করে; এই প্রকারেই আমি বাদী শ্রমণ গৌতমকে বাক্যদ্বারা আকর্ষণ করিব, পরিকর্ষণ করিব, সম্পরিকর্ষণ করিব। যেমন নাকি বলবান শৌণ্ডিক ধূর্ত কেশ-কম্বলের কোণে ধরিয়া দোলায়, দোলায়, আছাড় দেয়; এই প্রকারেই বাদী শ্রমণ গৌতমকে বাক্যদ্বারা আকর্ষণ করিব, পরিকর্ষণ করিব, সম্পরিকর্ষণ করিব। অথবা যেমন ষাটি বৎসর বয়স্ক হাতী গভীর পুষ্করিণীতে অবগাহন করিয়া ‘শণ ধোবন’ নামক ক্রীড়া খেলে সেইরূপ আমি শ্রমণ গৌতমকে ‘শণ ধোবণের’ ন্যায় ক্রীড়া করিব। সত্যই ভন্তে! এখন আমি যাই, শ্রমণ গৌতমকে এই আলোচ্য কথাপ্রসঙ্গে বাদারোপ করিব।”

“গৃহপতি! যাও তুমি , শ্রমণ গৌতমকে এই আলোচ্য কথা প্রসঙ্গে বাদারোপ কর। গৃহপতি! শ্রমণ গৌতমকে এ আলোচনায় বাদারোপ করিবার সামর্থ্য আমার আছে, দীর্ঘতপস্বীর আছে, আর তোমার আছে। গৃহপতি! শ্রমণ গৌতমকে বাদারোপ করিতে কেবল আমি, দীর্ঘতপস্বী ও তুমি সমর্থ।”

৬০। এই প্রকারে উক্ত হইলে দীর্ঘতপস্বী নিগণ্ঠ নাতপুত্র নিগণ্ঠকে বলিলেন,-

“প্রভু! উপালি গৃহপতি শ্রমণ গৌতমকে বাদারোপ করুক ইহা আমার অভিপ্রেত নহে। কারণ, ভন্তে! শ্রমণ গৌতম মায়াবী, এমন (মত) পরিবর্তনী মায়া জানেন যদ্বারা অন্য তীর্থিয়দের শ্রাবকগণকে (নিজের মতে) আবর্তন করেন।”

“তপস্বি! ইহা অসম্ভব। ইহার কোন সুযোগ নাই যে উপালি গৃহপতি শ্রমণ গৌতমের শিষ্যত্ব স্বীকার করিতে পারে। বরঞ্চ ইহাই সম্ভব যে শ্রমণ গৌতমই উপালি গৃহপতির শিষ্যত্ব গ্রহণ করিতে পারেন। তুমি যাও, হে গৃহপতি! শ্রমণ গৌতমকে এই আলোচ্য বিষয়ে বাদারোপ কর। শ্রমণ গৌতমের সহিত বাদারোপ করিতে সমর্থ আমি, দীর্ঘতপস্বী ও তুমি। দ্বিতীয়বার ... পূ ...। তৃতীয়বার ... পূ ...।”

“হাঁ, ভন্তে!” (বলিয়া) উপালি গৃহপতি নিগণ্ঠ নাতপুত্রকে প্রত্যুত্তর দিলেন এবং আসন হইতে উঠিয়া নাতপুত্র নিগণ্ঠকে অভিবাদন ও প্রদক্ষিণ করিয়া যথায় পাবারিকাম্রকানন এবং যথায় ভগবান আছেন, তথায় উপস্থিত হইলেন। উপস্থিত হইয়া ভগবানকে অভিবাদন পূর্বক একপ্রান্তে উপবেশন করিলেন, একপ্রান্তে উপবিষ্ট উপালি গৃহপতি ভগবানকে বলিলেন,-

“ভন্তে! দীর্ঘতপস্বী নিগণ্ঠ এখানে আসিয়াছিলেন কি?”

“হাঁ, গৃহপতি! দীর্ঘতপস্বী নিগণ্ঠ আসিয়াছিল।’

“ভন্তে! দীর্ঘতপস্বী নিগণ্ঠের সহিত আপনার কোন বিষয়ে আলোচনা হইয়াছিল কি?”

“গৃহপতি! দীর্ঘতপস্বী নিগণ্ঠের সহিত আমার কিছু আলোচনা হইয়াছিল।”

“ভন্তে! দীর্ঘতপস্বী নিগণ্ঠের সহিত আপনার কি প্রকার আলোচনা হইয়াছিল?”

তখন ভগবান দীর্ঘতপস্বী নিগণ্ঠের সহিত যাহা আলোচনা হইয়াছিল তৎসমুদয় উপালি গৃহপতিকে বর্ণনা করিলেন।

৬১। এই প্রকার উক্ত হইলে উপালি গৃহপতি ভগবানকে বলিলেন,-

“ভন্তে! দীর্ঘতপস্বী সাধু, সাধু - ধন্যবাদের যোগ্য। স্বীয় শাস্তার শাসন সম্বন্ধে অভিজ্ঞ, বহুশ্রুত শ্রাবকের ন্যায় দীর্ঘতপস্বী নিগণ্ঠ কর্তৃক ভগবানের নিকট যথাযথ বিবৃত করা হইয়াছে। তুচ্ছ মনোদণ্ড এবম্বিধ মহৎ কায়দণ্ডের সাক্ষাতে কি প্রকারে শোভিত হয়? অতএব পাপকর্মের সম্পাদনে ও পাপকর্মের প্রবর্তনে কায়দণ্ডই মহাসাবদ্যতর, তদ্রূপ বাক্‌দণ্ড ও মনোদণ্ড নহে।”

“গৃহপতি! যদি তুমি সত্যে প্রতিষ্ঠিত থাকিয়া মন্ত্রণা কর, তবে এ বিষয়ে আমাদের মধ্যে আলোচনা হইতে পারে।”

“ভন্তে! আমি সত্যে প্রতিষ্ঠিত হইয়া মন্ত্রণা করিব, এ বিষয়ে আমাদের আলোচনা হউক।”

৬২। “গৃহপতি! তাহা কি মনে কর, এখানে কোন নিগণ্ঠ ব্যাধিগ্রস্থ, দুঃখিত, সাঙ্ঘাতিক রোগাক্রান্ত, শীতলজল ত্যাগী ও উষ্ণজল সেবী হয়। সে শীতল জল না পাওয়ার দরুণ দৈবাৎ কালক্রিয়া করে। গৃহপতি! নাতপুত্র নিগণ্ঠ এই ব্যক্তির উৎপত্তি (পুনর্জন্ম) কোথায় নির্দেশ করেন?”

“ভন্তে! মনোসত্তা (মনাসক্ত) নামক দেবতারা আছেন, এই ব্যক্তি তাহাদের মধ্যে উৎপন্ন (জন্ম) হয়। কারণ কি? ভন্তে! এই ব্যক্তি মনোপ্রতিবন্ধ অবস্থায় কালক্রিয়া করিয়াছে।”

“গৃহপতি! স্মরণ কর, গৃহপতি! স্মরণ করিয়াই বল। গৃহপতি! তোমার পূর্বের সহিত পরের এবং পরের সহিত পূর্বের সামঞ্জস্য হইতেছে না। গৃহপতি! তোমা কর্তৃক ইহা ঘোষিত হইয়াছে যে ‘ভন্তে! সত্যে প্রতিষ্ঠিত হইয়া আমি মন্ত্রণা করিব। সুতরাং আমাদের মধ্যে এ বিষয়ে বাক্যালাপ হউক’।”

“যদিও ভন্তে ভগবান এইরূপ বলিতেছেন, তথাপি কায়দণ্ডই মহাসাবদ্যতর পাপকর্মের সম্পাদনে ও পাপকর্মের প্রবর্তনে; তদ্রূপ বাকদণ্ডও নহে, মনোদণ্ডও নহে।”

৬৩। “তাহা কি মনে কর, গৃহপতি! এখানে কোন নিগণ্ঠ চতুর্যাম সংবরে সংযত , সমস্ত শীতলজল-বারিত, সর্বপাপ নিবারণে তৎপর, সর্বপাপ-বারি বিধৌত, সর্বপাপ নিবারণে স্পৃষ্ট হয়; অথচ সে অভিগমনে, প্রত্যাগমনে বহুবিধ ক্ষুদ্রপ্রাণী হত্যা করে। গৃহপতি! নিগণ্ঠ নাতপুত্র এই ব্যক্তির কি বিপাক (পরিণাম) নির্দেশ করেন?”

“ভন্তে! নিগণ্ঠ নাতপুত্র (জৈনসাধু) সংচেতনা বিহীন কর্মকে মহাসাবদ্য বা অধিক দোষাবহ মনে করেন না।”

“যদি গৃহপতি! চেতনা থাকে?”

“ভন্তে! তবে মহাসাবদ্য হয়।”

“গৃহপতি! নিগণ্ঠ নাতপুত্র চেতনাকে কিসের অন্তর্ভুক্ত করে?”

“ভন্তে! মনোদণ্ডের।”

“স্মরণ কর, গৃহপতি! স্মরণ রাখিয়া বিবৃত কর। তোমার পূর্বের সহিত পরের এবং পরের সহিত পূর্বের সামঞ্জস্য হইতেছে না। তোমা কর্তৃক একথা বলা হইয়াছে যে ‘আমি সত্যে প্রতিষ্ঠিত হইয়া মন্ত্রণা করিব, সুতরাং এ বিষয়ে আমাদের আলোচনা হউক’।”

“যদিও ভগবান ইহা বলিতেছেন, তথাপি কায়দণ্ডই মহাসাবদ্যতর পাপকর্মের সম্পাদনে ও পাপকর্মের প্রবর্তনে; তদ্রূপ বাক্‌দণ্ড কিংবা মনোদণ্ড নহে।”

৬৪। “গৃহপতি! এই নালন্দা সমৃদ্ধা, স্ফীতা, জন-বহুলা ও মনুষ্য-সমাকুলা মনে কর কি?”

“হাঁ, প্রভু! এই নালন্দা সমৃদ্ধা, স্ফীতা, জন-বহুলা ও মনুষ্য-সমাকুলা।”

“তাহা কি মনে কর, গৃহপতি! এখানে যদি উন্মুক্ত অসি লইয়া কোন পুরুষ আসে এবং সে ইহা ঘোষণা করে যে,- এই নালন্দায় যত প্রাণী বিদ্যমান, আমি এক ক্ষণে, এক মুহুর্তে তাহাদিগকে এক মাংস স্তূপ, এক মাংস পুঞ্জ করিব।’ কি মনে কর গৃহপতি! এই নালন্দায় যে সমস্ত প্রাণী বিদ্যমান সে উহাদিগকে এক ক্ষণে, এক মুহুর্তে এক মাংস স্তূপ, এবং মাংস পুঞ্জ করিতে সমর্থ হইবে কি?”

“প্রভু! এমন কি দশ, বিশ, ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ পুরুষ ও ...... পূ ...... করিতে সমর্থ হইবে না; সামান্য একমাত্র পুরুষের পক্ষে ইহা কি সম্ভব?”

“গৃহপতি! কি মনে কর, যদি এখানে ঋদ্ধিমান, চিত্ত-বশীপ্রাপ্ত কোন শ্রমণ কিংবা ব্রাহ্মণ আসে এবং সে বলে যে,- ‘আমি এই নালন্দাকে এক মনোবিদ্বেষে (মানসিক অভিশাপে) ভষ্ম করিব।’ গৃহপতি! কি মনে কর, সেই ঋদ্ধিমান চিত্ত-বশীপ্রাপ্ত শ্রমণ কিংবা ব্রাহ্মণ এক মনোবিদ্বেষ দ্বারা তাহা করিতে পারিবে?”

“প্রভু! সেই ঋদ্ধিমান, বশীভূত চিত্ত শ্রমণ বা ব্রাহ্মণ এক অভিশাপ দ্বারা দশ, বিশ, ত্রিশ, চল্লিশ, এমন কি পঞ্চাশ নালন্দাকেও ভষ্ম করিতে সমর্থ; সামান্য এক নালন্দার কথাই বা কি?”

“গৃহপতি! স্মরণ কর, গৃহপতি! স্মরণ করিয়া কথা বল, তোমার পূর্বের সহিত পরের আর পরের সহিত পূর্বের সামঞ্জস্য হইতেছে না। গৃহপতি! তোমা কর্তৃক এই বাক্য উক্ত হইয়াছে যে- ‘প্রভু! আমি সত্যে প্রতিষ্ঠিত হইয়া মন্ত্রণা করিব। অতএব এ বিষয়ে আমাদের আলোচনা হউক’।”

“যদিও বা ভদন্ত ভগবান এইরূপ বলিতেছেন তথাপি পাপকর্মের সম্পাদনে ও প্রবর্তনের জন্য কায়দণ্ডই অধিকতর দোষাবহ, তদ্রূপ বাক্‌দণ্ড ও মনোদণ্ড নহে।”

৬৫। “কি মনে কর, গৃহপতি! দণ্ডকারণ্য কালিঙ্গারণ্য, মেধ্যারণ্য ও মাতঙ্গারণ্য এই চারি অরণ্য মহারণ্যে পরিণত হইয়াছে, তুমি শুনিয়াছ কি?”

“হাঁ, প্রভু! দণ্ডকারণ্য, কালিঙ্গারণ্য, মেধ্যারণ্য ও মাতঙ্গারণ্য এই চারি অরণ্য মহারণ্যে পরিণত হইয়াছে, ইহা আমি শুনিয়াছি?”

“গৃহপতি! তাহা কি মনে কর, কাহার দ্বারা সেই দণ্ডকারণ্য, কালিঙ্গারণ্য, মেধ্যারণ্য ও মাতঙ্গারণ্য এই চারি অরণ্য মহারণ্যে পরিণত হইয়াছে, শুনিয়াছ কি?”

“প্রভু! ইহা জনশ্রুতি যে ঋষিগণের মনোবিদ্বেষের ফলে সেই দণ্ডকারণ্য, কালিঙ্গারণ্য, মেধ্যারণ্য ও মাতঙ্গারণ্য মহারণ্যে পরিণত হইয়াছে।”

“গৃহপতি! স্মরণ কর, গৃহপতি! মনে করিয়া বাক্য উচ্চারণ করিও, তোমার পূর্বের সহিত পরের এবং পরের সহিত পূর্বের সামঞ্জস্য হইতেছে না।”

“গৃহপতি! তোমা কর্তৃক এই কথা ঘোষিত হইয়াছে যে ‘ভন্তে! আমি সত্যে প্রতিষ্ঠিত হইয়া মন্ত্রণা করিব। এ বিষয়ে আমাদের আলাপ-আলোচনা হউক’।”

৬৬। “প্রভু! ভগবানের প্রথম উপমাতেই আমি সন্তুষ্ট ও পরিতৃপ্ত হইয়াছি। অথচ আমি ভগবানের বিচিত্র প্রশ্ন-সমাধান শুনিবার ইচ্ছায় ভগবানের প্রতিদ্বন্দিতা করিবার সাহস করিলাম। আশ্চর্য ভন্তে! অতি আশ্চর্য ভন্তে! যেমন হে প্রভু! কেহ উল্টাকে সোজা, আবৃতকে অনাবৃত, ভ্রান্ত পথিককে পথ প্রদর্শন করে অথবা অন্ধকারে তৈলপ্রদীপ ধারণ করে যাহাতে চক্ষুষ্মান রূপ (দৃশ্যবস্তু) দেখিতে পায়; এইরূপে ভগবান কর্তৃক বিবিধ পর্যায়ে ধর্ম প্রকাশিত হইয়াছে। ভন্তে! আমি ভগবানের শরণ গ্রহণ করিতেছি, ধর্মের ও ভিক্ষুসংঘের শরণও। আজ হইতে জীবনের শেষ সীমা পর্যন্ত আমাকে শরণাগত উপাসকরূপে ধারণা করুন।”

৬৭। “হে গৃহপতি! চিন্তা করিয়া কর্তব্য নির্ধারণ কর। তোমাদের ন্যায় বিখ্যাত লোকের বিচার করিয়া কর্তব্য নির্ধারণ করা উত্তম ও সমীচীন।”

“প্রভু! এই কারণেও আমি ভগবানের প্রতি অধিকতর সুপ্রসন্ন ও সন্তুষ্ট। যেহেতু ভগবান আমাকে এইরূপ বলিলেন- ‘গৃহপতি! বিবেচনা পূর্বক কর্তব্য নির্ধারণ কর, তোমার মত বিখ্যাত লোকদের বিচার পূর্বক কর্তব্য নির্ধারণ করা উত্তম ও সমীচীন।’ প্রভু! অন্য তীর্থিকগণ আমাকে শ্রাবকরূপে লাভ করিলে নালন্দার সর্বত্র পতাকা উত্তোলন করিতেন- ‘উপালি গৃহপতি আমাদের শ্রাবক হইয়াছেন,’ এই ঘোষণা করিয়া বেড়াইতেন। অথচ সে ক্ষেত্রে ভগবান আমাকে বলিতেছেন,- ‘গৃহপতি! বিচার-বিবেচনা পূর্বক কর্তব্য নির্ধারণ কর, তোমার মত প্রসিদ্ধ লোকদের বিচার-বিবেচণা পূর্বক কর্তব্য নির্ধারণ করা উচিত।’ প্রভু! এইজন্য আমি দ্বিতীয়বার ভগবানের, ধর্মের ও ভিক্ষুসংঘের শরণ গ্রহণ করিতেছি। আজ হইতে যাবজ্জীবন আমাকে শরণাগত উপাসকরূপে ধারণা করুন।”

৬৮। “গৃহপতি! দীর্ঘকাল থেকে তোমার আবাস নিগণ্ঠদের সজ্জিত উৎস স্বরূপ ছিল, যখন তাহারা উপস্থিত হয়, তাহাদিগকে পিণ্ডদান করা কর্তব্য মনি করিও।”

“প্রভু! এই কারণেও আমি ভগবানের প্রতি অধিকতর সুপ্রসন্ন ও সন্তুষ্ট। যেহেতু ভগবান আমাকে বলিতেছেন,- ‘গৃহপতি! দীর্ঘদিন পর্যন্ত তোমার গৃহ নিগণ্ঠগণের জলোৎস সদৃশ, যখন তাহারা উপস্থিত হয় তাহাদিগকে পিণ্ডদান করা কর্তব্য মনে করিও।’ আমি নিগণ্ঠদের নিকট শুনিয়াছি, শ্রমণ গৌতম এইরূপ বলেন,- ‘আমাকেই দান দিবে, অন্যকে দিবে না; আমার শ্রাবকগণকেই দান দিবে, অন্য শ্রাবকগণকে দিবে না। আমাকে প্রদত্ত দান শ্রাবকগণকেই দান দিবে, অন্য শ্রাবকগণকে দিবে না। আমাকে প্রদত্ত দান মহাফলপ্রদ, অন্যকে প্রদত্ত দান মহাফলপ্রদ নহে; আমার শ্রাবকগণকে প্রদত্ত দান মহাফলপ্রদ, অন্যের শ্রাবকগণকে প্রদত্ত দান মহাফলপ্রদ নহে।’ আর এখন ভগবান আমাকে নিগণ্ঠদিগকে দান দিতে বলিতেছেন। প্রভু! এ বিষয়ে আমরাই কালানুরূপ ব্যবস্থা করিব। প্রভু! আমি এই তৃতীয়বারও ভগবানের, ধর্মের ও ভিক্ষুসংঘের শরণ গ্রহণ করিতেছি। ভগবন! আমাকে জীবনের শেষ সীমা পর্যন্ত শরণাগত উপাসকরূপে ধারণা করুণ।”

৬৯। তখন ভগবান উপালি গৃহপতিকে আনুপূর্বিক কথা উপদেশ করিলেন, যথা- দানকথা, শীলকথা, স্বর্গকথা, কামের দুর্দশা, নীচতা, সংক্লেশ এবং নিষ্কামের প্রশংসা করিলেন। যখন ভগবান উপালিকে জানিলেন যে সত্য গ্রহণে উৎসুক-চিত্ত, মৃদু-চিত্ত, বিনীবরণ-চিত্ত, উদগ্র-চিত্ত এবং প্রসন্ন-চিত্ত হইয়াছে; তখন বুদ্ধগণের যাহা সমুৎকৃষ্ট ধর্মোপদেশ ‘দুঃখ, সমুদয়, নিরোধ ও মার্গ’ তাহা প্রকাশ করিলেন। যেমন শুদ্ধ, নির্মল বস্ত্র সম্যকরূপে রং গ্রহণ করে, সেরূপ উপালি গৃহপতির সেই আসনেই বিরজঃ বীতমল ধর্ম-চক্ষু (সপ্রতিসম্ভিদা স্রোতাপত্তি ফল) উৎপন্ন হইল- “যাহা কিছু সমুদয় ধর্ম (উৎপন্ন পদার্থ) তৎসমস্ত নিরোধ ধর্ম (বিনাশ শীল)।”

তখন উপালি গৃহপতি দৃষ্টধর্ম, প্রাপ্তধর্ম, বিদিতধর্ম, অবগাহিত বা নিমর্জিত ধর্ম, উত্তীর্ণ বিচিকিৎসা, বিগত সংশয়, বৈশারদ্য প্রাপ্ত, শাস্তার শাসনে পর-প্রত্যয়হীন (প্রত্যক্ষদর্শী) হইয়া ভগবানকে কহিলেন,-

“প্রভু! আমার বহু কৃত্য, বহু করণীয়। সুতরাং এখন যাইতে চাই।”

“গৃহপতি! এখন তোমার সময়ানুরূপ কাজ করিতে পার।”

৭০। অতঃপর উপালি গৃহপতি ভগবানের উপদেশ অভিনন্দন করিয়া, অনুমোদন করিয়া আসন হইতে উত্থান পূর্বক ভগবানকে অভিবাদন ও প্রদক্ষিণ করিয়া স্বীয় গৃহাভিমুখে প্রস্থান করিলেন। গৃহে উপস্থিত হইয়া দ্বারপালকে আহ্বান করিলেন,-

“বন্ধু দ্বারপাল! অদ্য হইতে নিগণ্ঠ ও নিগণ্ঠিদের জন্য আমার দ্বার রুদ্ধ হইল। আর ভগবান, ভিক্ষু-ভিক্ষুণী ও উপাসক-উপাসিকাদের জন্য আমার দ্বার উন্মুক্ত হইল। যদি কোন নিগণ্ঠ আসে তাহাকে তুমি এইরূপ বলিও,- ‘প্রভু! দাঁড়ান, প্রবেশ করিবেন না। আজ হইতে উপালি গৃহপতি শ্রমণ গৌতমের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়াছেন। সুতরাং নিগণ্ঠ ও নিগণ্ঠিদের জন্য সদরদ্বার বন্ধ। ভগবানের, ভিক্ষু-ভিক্ষুণিগণের ও উপাসক-উপাসিকাদের জন্য দ্বার উন্মুক্ত। যদি প্রভু! আপনার খাদ্যের প্রয়োজন থাকে অপেক্ষা করুন, আপনার পিণ্ড এখানে আহরিত হইবে’।”

“যে আজ্ঞা, প্রভু!” বলিয়া দ্বারপাল উপালি গৃহপতিকে প্রতিশ্রুতি দিল।

৭১। দীর্ঘতপস্বীনিগণ শুনিতে পাইলেন যে উপালি গৃহপতি শ্রমণ গৌতমের শ্রাবকত্ব গ্রহণ করিয়াছেন। অতঃপর দীর্ঘতপস্বী নিগণ্ঠ নাতপুত্র নিগণ্ঠের নিকট উপস্থিত হইলেন। উপস্থিত হইয়া নিগণ্ঠ নাতপুত্রকে বলিলেন,-

“প্রভু! আমি শুনিয়াছি- উপালি গৃহপতি শ্রমণ গৌতমের শ্রাবকত্ব গ্রহণ করিয়াছেন।”

“তপস্বি! উপালি গৃহপতি শ্রমণ গৌতমের শ্রাবকত্ব গ্রহণ করিবেন স্বীকার করিবেন, ইহা অসম্ভব ও অসঙ্গত। বরং শ্রমণ গৌতম উপালি গৃহপতির শ্রাবকত্ব স্বীকার করিবেন, ইহা সম্ভব ও সঙ্গত।”

দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বারও তাহাদের মধ্যে এইরূপ কথা হইল।

“উত্তম, প্রভু! আমি এখন চলিলাম, উপালি গৃহপতি শ্রমণ গৌতমের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়াছেন কিনা জানিয়া আসি।”

“যাও, হে তপস্বি! তুমি উপালি গৃহপতি শ্রমণ গৌতমের শিষ্য হইয়াছেন কিনা জানিয়া আস।”

৭২। তৎপর দীর্ঘতপস্বী নিগণ্ঠ উপালি গৃহপতির নিবাসে উপস্থিত হইলেন। দ্বারপাল দীর্ঘতপস্বী নিগণ্ঠকে বহুদূর হইতে আসিতে দেখিল। দেখিয়া দীর্ঘতপস্বী নিগণ্ঠকে এইরূপ বলিল,-

“দাঁড়ান, প্রভু! প্রবেশ করিবেন না। আজ হইতে উপালি গৃহপতি শ্রমণ গৌতমের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়াছেন। নিগণ্ঠ ও নিগণ্ঠিদের জন্য তাঁহার দ্বার আবৃত। ভগবান, ভিক্ষু-ভিক্ষুণী ও উপাসক-উপাসিকাদের জন্য তাঁহার দ্বার উন্মুক্ত। যদি প্রভু! ভিক্ষার প্রয়োজন হয়, এস্থানে অপেক্ষা করুন, এখানে আপনার ভিক্ষা আহরিত হইবে।”

“বন্ধু! আমার ভিক্ষার প্রয়োজন নাই।” এই বলিয়া দীর্ঘতপস্বী তথা হইতে প্রত্যাবর্তন করিয়া নিগণ্ঠ নাতপুত্রের নিকট উপস্থিত হইলেন। উপস্থিত হইয়া নিগণ্ঠ নাতপুত্রকে বলিলেন,-

“প্রভূ! সত্যই, উপালি গৃহপতি শ্রমণ গৌতমের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়াছেন। প্রভু! পূর্বে ইহা আমি আপনাকে বুঝাইতে সমর্থ হয় নাই। আমার সমর্থন ছিল না যে উপালি গৃহপতি শ্রমণ গৌতমের সহিত বাদানুবাদ করুক। শ্রমণ গৌতম মায়াবী, আকর্ষণী মায়া জানেন যদ্বারা অন্য তীর্থিয় শ্রাবকগণকে স্বমতে আকর্ষণ করেন। শ্রমণ গৌতমের আকর্ষণী মায়ায় আপনার গৃহপতি আবর্তিত হইয়াছেন।”

“তপস্বি! ইহা অসম্ভব এবং অনবকাশ যে উপালি গৃহপতি শ্রমণ গৌতমের শ্রাবকত্ব স্বীকার করিবেন। ইহা সম্ভব যে শ্রমণ গৌতম উপালি গৃহপতির শ্রাবকত্ব স্বীকার করিবেন।”

দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বারও দীর্ঘতপস্বী নিগণ্ঠ নাতপুত্র নিগণ্ঠকে বলিলেন,-

“সত্যই প্রভু! উপালি গৃহপতি শ্রমণ গৌতমের শ্রাবকত্ব গ্রহণ করিয়াছেন।”

“তপস্বি! আমি নিজেই তথায় যাইতেছি। উপালি গৃহপতি শ্রমণ গৌতমের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়াছেন কিনা? স্বয়ং জানিতে চাই।”

তখন নিগণ্ঠ নাতপুত্র মহতী নিগণ্ঠ পরিষদের সহিত যথায় উপালি গৃহপতির নিবাস তথায় উপস্থিত হইলেন। দ্বারপাল নিগণ্ঠ নাতপুত্রকে দূর হইতে আসিতে দেখিল। দেখিয়া নিগণ্ঠ নাতপুত্রকে বলিলেন,-

“দাঁড়ান, প্রভূ! প্রবেশ করিবেন না। আজ হইতে উপালি গৃহপতি শ্রমণ গৌতমের শিষ্যত্ব গ্রহণ করিয়াছেন। নিগণ্ঠ ও নিগণ্ঠিদের জন্য তাঁহার দ্বার আবৃত। ভগবানের, ভিক্ষু-ভিক্ষুণী ও উপাসক-উপাসিকাদের জন্য দ্বার উন্মুক্ত। যদি প্রভু! আপনার ভিক্ষার প্রয়োজন থাকে, এখানে অপেক্ষা করুন। আপনার জন্য এখানে ভিক্ষা আহরিত হইবে।”

“বন্ধু দ্বারপাল! তাহা হইলে উপালি গৃহপতির নিকট যাও, তাঁহাকে বল,- ‘মহাশয়! নিগণ্ঠ নাতপুত্র মহতী নিগন্ঠ পরিষদের সহিত বর্হিদ্বারে উপস্থিত। তিনি আপনার দর্শন ইচ্ছুক’।”

“হাঁ, প্রভু!” বলিয়া দ্বারপাল নিগণ্ঠ নাতপুত্রকে প্রতিশ্রুতি দিয়া উপালি গৃহপতির নিকট উপস্থিত হইল। উপস্থিত হইয়া উপালি গৃহপতিকে ইহা বলিল,-

“প্রভু! নিগণ্ঠ নাতপুত্র মহতী নিগণ্ঠ পরিষদের সহিত বর্হি-সিংহদ্বারে উপস্থিত। তিনি আপনার দর্শনাকাঙ্খী।”

“দ্বারপাল! তাহা হইলে মধ্যম দ্বার-শালায় আসন সজ্জিত কর।”

“যে আজ্ঞা, প্রভু!” বলিয়া দ্বারপাল উপালি গৃহপতির নিকট প্রতিশ্রুত হইয়া মধ্যম দ্বার-শালায় আসন সজ্জিত করিয়া উপালি গৃহপতিকে নিবেদন করিল,-

“প্রভু! মধ্যম দ্বার-শালায় আসন সজ্জিত, এখন যাহা মনে করেন।”

৭৩। তখন উপালি গৃহপতি মধ্যম দ্বার-শালায় উপস্থিত হইলেন এবং তথায় যে আসন অগ্র, শ্রেষ্ঠ, উত্তম ও প্রণীত তথায় বসিয়া দ্বারপালকে আদেশ করিলেন,-

“দ্বারপাল! নিগণ্ঠ নাতপুত্রের নিকট গিয়া বল যে উপালি গৃহপতি বলিয়াছেন, যদি ইচ্ছা করেন প্রবেশ করিতে পারেন।”

“যে আজ্ঞা প্রভু!” বলিয়া দ্বারপাল উপালি গৃহপতিকে প্রত্যুত্তর করিয়া নিগণ্ঠ নাতপুত্রের নিকট উপস্থিত হইল এবং বলিল,-

“প্রভু! গৃহপতি বলিয়াছেন, যদি ইচ্ছা করেন গৃহে প্রবেশ করিতে পারেন।”

তখন নিগণ্ঠ নাতপুত্র মহতী নিগণ্ঠ পরিষদের সহিত মধ্যম দ্বার-শালায় উপনীত হইলেন। পূর্বে যখনই নিগণ্ঠ নাতপুত্রকে দূর হইতে আসিতে দেখিতেন, উপালি গৃহপতি তখনই প্রত্যুৎগমন পূর্বক তথায় যেই আসন অগ্র, শ্রেষ্ঠ, উত্তম ও প্রণীত তাহা উত্তরীয় বস্ত্রে সর্ম্মাজন করিয়া সমাদরে বসাইতেন। আর এখন সেই উপালি গৃহপতি তথায় যাহা অগ্র, শ্রেষ্ঠ, উত্তম ও প্রণীত আসন তাহাতে স্বয়ং বসিয়া নিগণ্ঠ নাতপুত্রকে বলিলেন,-

“মহাশয়! আসন বিদ্যমান আছে, যদি ইচ্ছা হয়, বসিতে পারেন।”

ইহা শুনিয়া নিগণ্ঠ নাতপুত্র বলিলেন,-

“গৃহপতি! উন্মত্ত হইয়াছ! জড়বুদ্ধি হইয়াছ?”

“প্রভু! আমি শ্রমণ গৌতমের সহিত বাদানুবাদ করিব বলিয়া, গিয়া বৃহৎ বাদজালে আবদ্ধ হইয়া ফিরিয়াছি?”

“গৃহপতি! যেমন কোন ডিম্ব আহরণকারী পুরুষ ডিম্ব পরিত্যাগ করিয়া আসে, যেমন কোন পাশাক্রীড়ক বিনা পাশায় আসে, গৃহপতি! তুমিও সেইরূপ,- ‘আমি শ্রমণ গৌতমের সহিত বাদারোপ করিতে যাই’ এই বলিয়া গিয়া বৃহৎ বাদাভিযানে অধিগৃহীত হইয়া আসিয়াছ। তুমি শ্রমণ গৌতমের আবর্তনী-মায়ায় আবর্তিত হইয়াছ?”

৭৪। “প্রভু! আবর্তনী-মায়া মঙ্গলদায়ক, আবর্তনী-মায়া কল্যাণজনক। প্রভু! আমার প্রিয় আত্মীয়-স্বজনকে এই আবর্তনী-মায়ায় আবর্তিত করিতে পারিলেই মঙ্গল। ইহা আমার প্রিয় আত্মীয়-স্বজনগণের দীর্ঘকাল হিত-সুখের নিদান হইবে। যদি সমস্ত ক্ষত্রিয়গণকে এই আবর্তনী-মায়ায় আবর্তন করিতে পারি সমস্ত ক্ষত্রিয়ের দীর্ঘকাল হিত-সুখের কারণ হইবে। সমস্ত ব্রাহ্মণ, বৈশ্য এবং শূদ্রদিগকে যদি আবর্তন করিতে পারি তবে সকলের হিত-সুখের কারণ হইবে। প্রভু! দেব-মার-ব্রহ্মা সহ জগত এবং শ্রমণ-ব্রাহ্মণ প্রজা সহ দেব-মনুষ্যগণ যদি আবর্তনী-মায়ায় আবর্তিত হয় তবে দেব-মার-ব্রহ্মা সহ এই জগতের, শ্রমণ-ব্রাহ্মণ প্রজা সহ দেব-মনুষ্যের দীর্ঘকাল হিত-সুখের কারণ হইবে। প্রভু! তাহা হইলে আপনাকে উপমা প্রদান করিব, জগতে উপমা দ্বারাও কোন কোন বিজ্ঞলোক ভাষণের অর্থ হৃদয়ঙ্গম করেন।”

৭৫। “প্রভু! পূর্বকালে কোন জীর্ণ বৃদ্ধ ও অথর্ব ব্রাহ্মণের যুবতী তরুণী ভার্যা ছিল। সে ছিল গর্ভিনী ও আসন্ন প্রসবা। সে যুবতী একদিন ব্রাহ্মণকে বলিল,- ‘আপনি যান, দোকান হইতে একটি মর্কট শাবক (পুতুল) ক্রয় করিয়া আনুন। তাহা আমার ভাবী কুমারের খেলার সাথী হইবে’। প্রভু! সে ব্রাহ্মণ যুবতীকে বলিল,- ভদ্রে! প্রসবকাল পর্যন্ত অপেক্ষ কর। যদি তুমি পুত্র প্রসব কর, তোমার পুত্রের জন্য আমি দোকান হইতে মর্কট বাছুর ক্রয় করিয়া আনিব, যাহা তোমার পুত্রের ক্রীড়ণক হইবে। আর যদি তুমি কন্যা প্রসব কর, তোমার কন্যার জন্য আমি দোকান হইতে মর্কট বাছুরী ক্রয় করিয়া আনিব, যাহা তোমার কন্যার ক্রীড়নক হইবে’।”

দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বারও এরূপ বলিল।

“অতঃপর প্রভু! সে ব্রাহ্মণ তাহার তরুণী ভার্যার প্রতি আসক্ত ও প্রতিবদ্ধ চিত্ত হেতু দোকান হইতে মর্কট কিনিয়া আনিয়া ভার্যাকে বলিল,- ‘ভদ্রে! এই লও মর্কট শাবক, যাহা তোমার ভাবী পুত্রের ক্রীড়ণক হইবে।’ ইহা শুনিয়া তরুণী ব্রাহ্মণকে বলিল,-‘ব্রাহ্মণ! এই মর্কট বৎস লইয়া আপনি রজকপুত্র রক্তপাণির নিকট যান এবং তাহাকে বলুন যে- বন্ধু রক্তপাণি! এই মর্কট বৎসকে গভীর পীতা লেপনে রঞ্জন, পুনঃপুন ঘর্ষণ ও উভয়দিকে বিমর্দন করিতে ইচ্ছা করি’।”

“প্রভু! ব্রাহ্মণ সেই তরুণীর প্রতি আসক্ত ও প্রতিবদ্ধ চিত্ত হেতু মর্কট বৎস লইয়া রক্তপাণির নিকট উপনীত হইল এবং বলিল,- ‘বন্ধু! এই মর্কট বৎস গাঢ় পীতবর্ণে রঞ্জিত, পুনঃপুন ঘর্ষিত ও উভয়দিকে বিমর্দিত কর।’ ইহা শুনিয়া রক্তপাণি রজকপুত্র ব্রাহ্মণকে বলিল,- ‘মহাশয়! আপনার মর্কট বৎস রঞ্জনের যোগ্য, কিন্তু পুনঃপুন ঘর্ষণ ও উভয়দিকে বিমর্দনের অযোগ্য’। সেইরূপ প্রভু! অজ্ঞ নিগণ্ঠদের মতবাদ (সিদ্ধান্ত) অজ্ঞগণেরই রঞ্জনযোগ্য, পণ্ডিতগণের রঞ্জনক্ষম নহে, ইহা গবেষণার যোগ্য নহে, বিচার্যও নহে।”

“তবে প্রভু! সেই ব্রাহ্মণ অন্য সময় একজোড়া নববস্ত্র লইয়া রজকপুত্র রক্তপাণির নিকট উপনীত হইল। তথায় গিয়া ব্রাহ্মণ রক্তপাণিকে বলিল,- ‘সৌম্য রক্তপাণি! আমি এই নববস্ত্র যুগল গভীর পীত-রঞ্জিত, পুনঃপুন ঘর্ষিত ও উভয়দিকে মর্দিত করিতে চাই’। ইহা শুনিয়া রক্তপাণি বলিল,- ‘মহাশয়! আপনার এই নূতন বস্ত্রযুগল রংয়ের যোগ্য, পুনঃপুন ঘর্ষণ ও উভয়দিকে মর্দন-যোগ্য’।”

“তদ্রূপই প্রভু! সেই ভগাবন অর্হৎ সম্যক্‌ সম্বুদ্ধের মতবাদ (সিদ্ধান্ত) পণ্ডিতগণের অনুরঞ্জনীয়। গবেষণায়ও বিচার্য, কিন্তু অজ্ঞগণের নহে।”

“গৃহপতি! রাজা সহ সভাসদগণ জানেন যে উপালি গৃহপতি নাতপুত্র নিগণ্ঠের শ্রাবক। এখন তোমাকে কাহার শিষ্য বলিয়া ধারণা করিতে পারি?”

তখন উপালি গৃহপতি আসন হইতে উঠিয়া উত্তরীয় বস্ত্র একাংশ করিয়া যেদিকে ভগবান আছেন, সেইদিকে যুক্তাঞ্জলি প্রণামপূর্বক নাতপুত্র নিগণ্ঠকে বলিলেন,-

“তাহা হইলে প্রভু! আমি যাঁহার শিষ্য তাঁহার সম্বন্ধে শুনুন,-

৭৬। (১) ‘যিনি ধীর মোহাতীত মারজয়ী ছিন্ন কঠোরতা ,

দুঃখ-মুক্ত সাম্যবাদী শীলপূর্ণ প্রজ্ঞা-সুশোভন;

ক্লেশোত্তীর্ণ সুনির্মল- সে বুদ্ধের শিষ্য হই আমি।

(২) মুদিতা-বিহারী তৃপ্ত অসংশয় বন্ত-কামগুণ,

শ্রামণ্যের নিষ্ঠাপ্রাপ্ত শেষদেহী মনুজনায়ক;

নিরুপম রজঃহীন- সে বুদ্ধের শিষ্য হই আমি।

(৩) অসংশয় সুকুশল বিনায়ক সারথি প্রধান,

অনুত্তর শুচিধর্মা প্রভাস্বর আকাঙক্ষা-বিহীন;

মান-ছিন্ন মহাবীর- সে বুদ্ধের শিষ্য হই আমি।

(৪) অসদৃশ অপ্রমেয় জ্ঞান-প্রাপ্ত গুণে সুগভীর,

ক্ষেমঙ্কর বেদযুক্ত ধর্মেস্থিত সংযত-জীবন;

সঙ্গাতিগ মুক্ত যিনি- সে বুদ্ধের শিষ্য হই আমি।

(৫) বনপ্রান্ত শয্যাসন মুক্তনাগ ছিন্ন সংযোজন,

মন্ত্রণা প্রজ্ঞায়-যুক্ত ধূতক্লেশ মুক্ত-অহংকার;

নিষপ্রপঞ্চ বীতরাগ দান্ত যিনি- শিষ্য আমি তাঁর।

(৬) অকুহক ত্রিবিদ্বান ব্রহ্ম-প্রাপ্ত ঋষির উত্তম,

্লাতক বিদিতবেদ পদকর্তা প্রশান্ত-হৃদয়;

পুরন্দদ সুসমর্থ- সে বুদ্ধের শিষ্য হই আমি।

(৭) সুভাবিত-চিত্ত আর্য গুণান্বিত অর্থ-প্রকাশক,

স্মৃতিমান বিদর্শক অরহত হিংসা বিরহিত;

ক্ষীণ-তৃষ্ণ বশীপ্রাপ্ত- সে বুদ্ধের শিষ্য হই আমি।

(৮) সমুদ্গত শুদ্ধ ধ্যানী ক্লেশমুক্ত নির্মল-অন্তর,

অনাসক্ত হিতকারী অগ্রপ্রাপ্ত বিবেক-বিহারী;

উত্তীর্ণ তারক যিনি- সে বুদ্ধের শিষ্য হই আমি।

(৯) শান্তমূর্তি মহাপ্রাজ্ঞ লোভ-মুক্ত ভূরিপ্রজ্ঞাযুত,

অসম সুগত যিনি তথাগত প্রতিদ্বন্দ্বীহীন;

বিশারদ সুনিপুণ- সে বুদ্ধের শিষ্য হই আমি।

(১০) তৃষ্ণা-সমুচ্ছিন্ন বুদ্ধ ধূম্রহীন নির্লিপ্ত-জীবন,

ঋদ্ধিমান আহ্বানীয় অনুপম উত্তম-পুরুষ;

মহান যশাগ্র প্রাপ্ত- সে বুদ্ধের শিষ্য হই আমি।’

৭৭। “গৃহপতি! শ্রমণ গৌতমের এত গুণাবলী তুমি কখন সঞ্চয় করিলে?”

“প্রভু! যেমন কোথাও নানা পুষ্পের বৃহৎ পুঞ্জ বিদ্যমান, কোন দক্ষ মালাকর বা মালাকর অন্তেবাসী তথা হইতে বিচিত্র মালা গাঁথে; সেরূপ প্রভু! সেই ভগবান বহু গুণের অধিকারী, অনেকশত গুণবিশিষ্ট। সেই প্রশংসার্হের প্রশংসা কে না করিবে?”

তখন ভগবানের সৎকার-সম্মান সহ্য করিতে না পারিয়া সেস্থানেই নাতপুত্র নিগণ্ঠের মুখ হইতে উষ্ণ-লোহিত বমন হইল ।

॥ উপালি সূত্র সমাপ্ত ॥

কুক্কুরবতিক সূত্র (৫৭)

৭৮। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-

এক সময় ভগবান কোলিয়দেশে বাস করিতেছিলেন, হরিদ্রাবসন নামক কোলিয় নগরে। তখন গোব্রতিক নগ্ন কোলিয়পুত্র পুণ্ন এবং কুকুরব্রতিক অচেল সেনিয় ভগবানের নিকট উপনীত হইল। গোব্রতিক নগ্ন পুণ্ন ভগবানকে অভিবাদন করিয়া একপ্রান্তে বসিল। কুকুরব্রতিক অচেল সেনিয় ভগবানের সহিত সম্মোদন করিল, সম্মোদনীয় ও স্মরণীয় কথা শেষ করিয়া কুকুরের ন্যায় হস্তপদ গুটাইয়া একান্তে বসিল। একপ্রান্তে উপবিষ্ট নগ্ন গোব্রতিক পুণ্ন ভগবানকে বলিল,-

“প্রভু! এই উলঙ্গ কুকুরব্রতিক দুষ্কর-কারক (কৃচ্ছ্র সাধক) সেনিয় মাটিতে নিক্ষিপ্ত ভোজন করে। তাহার সেই কুকুরব্রত দীর্ঘদিন গৃহীত ও আচরিত হইয়াছে। তাহার কি গতি? পারলৌকিক অবস্থাই বা কি?”

“নিরর্থক, পুণ্ন! রাখিয়া দাও, উহা আমাকে জিজ্ঞাসা করিও না।”

দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বারও ঐরূপ প্রশ্ন করা হইল।

৭৯। পুণ্ন! সত্যই তোমাকে বুঝাইতে পারিলাম না যে উহা নিরর্থক। ইহা থাক, আমাকে জিজ্ঞাসা করিও না। বেশ, তথাপি তোমাকে বর্ণনা করিব,-

পুণ্ন! যখন কেহ পরিপূর্ণ কুকুরব্রত নিরন্তর ভাবনা (অভ্যাস) করে, পরিপূর্ণ কুকুর আচার নিরন্তর আচরণ করে, পরিপূর্ণ কুকুরচিত্ত নিরন্তর গঠন করে, পরিপূর্ণ কুকুরভঙ্গী নিরন্তর অভ্যাস করে; সে পরিপূর্ণ কুকুরব্রত-আচার-চিত্তভঙ্গী ভাবনা করিয়া দেহত্যাগে মৃত্যুর পর কুকুর যোনিতে জন্ম হয়। যদি তাহার এই ধারণা থাকে যে আমি এই শীল, ব্রত, তপশ্চর্যা ও ব্রহ্মচর্যা দ্বারা দেবতা হইব, কিংবা দেবতাদের অন্যতর হইব, তবে উহা তাহার মিথ্যাদৃষ্টি (ভ্রান্ত ধারণা)। পুণ্ন! মিথ্যাদৃষ্টিকের পক্ষে নিরয় ও তির্যক (পশু) যোনি এই দ্বিবিধ গতির অন্যতর গতিই (লভ্য) বলিতেছি। পুণ্ন! এই প্রকারে সম্পাদিত কুকুরব্রত কুকুরদিগের সাহচর্যে কিংবা বিপর্যস্ত হইলে নরকে নিয়া যায়।”

উহা উক্ত হইলে কুকুরব্রতিক অচেল সেনিয় রোদন আরম্ভ করিল, অশ্রুমোচন করিতে লাগিল।

ভগবান গোব্রতিক পুণ্ন কোলিয় পুত্রকে বলিলেন,-

“পুণ্ন! আমি তোমাকে নিরস্ত করিতে পারিলাম না যে ইহা নিরর্থক, স্থগিত রাখ- ইহা আমাকে জিজ্ঞাসা করিও না।”

কুকুরব্রতিক সেনিয় বলিল,-

“ভগবান আমাকে ইহা বলিয়াছেন, তজ্জন্য রোদন করিতেছি না। অথচ প্রভু! আমার এই কুকুরব্রত দীর্ঘদিন যাবৎ গৃহীত ও আচরিত। প্রভু! ইহার পরিণাম ভাবিয়া রোদন করিতেছি। প্রভু! আমার বন্ধু কোলিয়পুত্র গোব্রতিক। তাহার সেই গোব্রত দীর্ঘকাল যাবৎ গৃহীত ও আচরিত। তাহার গতি এবং পারলৌকিক অবস্থা কি?”

“নিরর্থক সেনিয়! উহা স্থগিত রাখ, উহা আমাকে জিজ্ঞাসা করিও না।”

দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বারও প্রশ্ন করা হইল।

৮০। “সেনিয়! প্রকৃত পক্ষে তোমাকে বুঝাইতে পারিলাম না। সুতরাং তোমাকে বলিব,-

“সেনিয়! কেহ কেহ পরিপূর্ণ গোব্রত অবিচ্ছিন্নভাবে ভাবনা করে, পরিপূর্ণ গোশীল আচরণ করে, পরিপূর্ণ গোচিত্ত গঠন করে ও পরিপূর্ণ আকল্প (ভঙ্গী) অভ্যাস করে, সে এই সমুদয় আচরণ করিয়া দেহত্যাগে মৃত্যুর পর গরু যোনিতে উৎপন্ন হয়। যদি তাহার এই ধারণা হয় যে আমি এই শীল, ব্রত, তপস্যা ও ব্রহ্মচর্যা দ্বারা দেবরাজ কিংবা দেবতাদের অন্যতর হইব, তবে উহা তাহার মিথ্যাদৃষ্টি। সেনিয়! মিথ্যাদৃষ্টিকদের নিরয় ও তিরচ্ছান (পশু-পক্ষী) যোনি এই দ্বিবিধ গতির অন্যতর গতি লভ্য, বলিতেছি। এইরূপেই আচরিত গোব্রত গরুদের সাহচর্যে, বিপর্যস্ত হইলে নিরয়ে উপনীত করে।”

ইহা উক্ত হইলে কোলিয়পুত্র গোব্রতীক পুণ্ন রোদন আরম্ভ করিল ও অশ্রু মোচন করিতে লাগিল।

ভগবান কুকুরব্রতিক নগ্ন সেনিয়কে বলিলেন,-

“সেনিয়! আমি তোমাকে বিরত করিতে পারিলাম না যে ইহা অনর্থক, স্থগিত রাখ- ইহা আমাকে জিজ্ঞাসা করিও না।”

“ভগবান আমাকে ইহা বলিয়াছেন, তজ্জন্য আমি রোদন করিতেছি না। অথচ আমার এই গোব্রত দীর্ঘদিন গৃহীত ও আচরিত হইয়াছে।”

“ভন্তে! আমি ভগবানের প্রতি প্রসন্ন হইব, যদি ভগবান ধর্ম-দেশনা করেন যাহাতে আমি এই গোব্রত পরিত্যাগ করিতে পারি এবং কুকুরব্রতিক উলঙ্গ সেনিয়ও কুকুরব্রত পরিত্যাগ করিতে পারে।”

“তাহা হইলে পুণ্ন! শ্রবণ কর, উত্তমরূপে মনোযোগ দাও, আমি ভাষণ করিব।”

“হাঁ, প্রভু!” বলিয়া কোলিয়পুত্র পুণ্ন ভগবানকে প্রত্যুত্তর দিলেন। ভগবান বলিলেন,-

৮১। “পুণ্ন! চতুর্বিধ কর্ম স্বীয় অভিজ্ঞা দ্বারা প্রত্যক্ষ করিয়া আমা কর্তৃক ঘোষিত হইয়াছে। সে চারিটি কি? পুণ্ন! (১) কোন কর্ম আছে কৃষ্ণ (মন্দ) এবং কৃষ্ণবিপাক। (২) কোন কর্ম আছে শুক্ল (ভাল) এবং শুক্লবিপাক । (৩) কোন কর্ম আছে কৃষ্ণ-শুক্ল এবং কৃষ্ণ-শুক্লবিপাক । (৪) কোন কর্ম আছে অকৃষ্ণ-অশুক্ল এবং অকৃষ্ণ-অশুক্লবিপাক , যে কর্ম যাবতীয় কর্মক্ষয়ের নিমিত্ত পরিচালিত হয়।”

“পুণ্ন! দুঃখ-ফলপ্রদ মন্দ কর্ম কি? পুণ্ন! জগতে কোন ব্যক্তি ব্যাপাদ (হিংসা) যুক্ত কায়িক কর্ম সম্পাদন করে, ব্যাপাদযুক্ত বাচনিক কর্ম সম্পাদন করে, ব্যাপাদযুক্ত মানসিক কর্ম সঞ্চয় করে। সে সব্যাপাদ (সহিংস) কায়, বাক্‌ ও মনোকর্ম সঞ্চয় করিয়া দুঃখ-বহুল যোনিতে উৎপন্ন হয়। দুঃখ-বহুল যোনিতে উৎপন্ন অবস্থায় তাহার দুঃখজনক স্পৃশ্য (বিপাক সমূহ) ভোগ করিতে হয়। সে দুঃখজনক স্পৃশ্যে স্পর্শিত হইয়া নিরয়বাসী সত্বগণের ন্যায় নিরন্তর দুঃখজনক সহিংস বেদনা অনুভব করে। এইরূপে হে পুণ্ন! যথাভূত কর্ম হইতে তথাভূত সত্বের উৎপত্তি হয়। (জীব) যে কর্ম করে তদ্বারাই জন্ম হয়। উৎপন্ন হইয়া সদৃৃশ স্পৃশ্য স্পর্শ করে। পুণ্ন! আমি এই কারণেও বলি ‘সত্ত্বগণ কর্মের উত্তরাধিকারী’। পুণ্ন! ইহাকেই দুঃখ-ফলপ্রদ মন্দ কর্ম বলা হয়।” (১)

পুণ্ন! সুখ-ফলপ্রদ শুক্লকর্ম কি? পুণ্ন! জগতে কোন ব্যক্তি অব্যাপাদযুক্ত কায়কর্ম সঞ্চয় করে, অব্যাপাদযুক্ত বাক্‌কর্ম সঞ্চয় করে, অব্যাপাদযুক্ত মনোকর্ম সঞ্চয় করে। সে অহিংস কায়, বাক্‌ ও মনোকর্ম সঞ্চয় করিয়া দেহত্যাগে মৃত্যুর পর দুঃখহীন লোকে পুনরুৎপন্ন হয়, উৎপন্ন অবস্থায় অনুরূপ স্পৃশ্য স্পর্শ করে। এইরূপেও আমি বলিতেছি যে প্রাণিগণ স্বীয় কর্মের উত্তরাধিকারী। পুণ্ন! ইহাকে বলা হয়, সুখ-ফলপ্রদ শুক্লকর্ম।” (২)

পুণ্ন! কৃষ্ণ-শুক্ল বিপাকপ্রদ কৃষ্ণ-শুক্লকর্ম কি? পুণ্ন! জগতে কোন ব্যক্তি সব্যাপাদযুক্ত ও অব্যাপাদযুক্ত কায়কর্ম করে, বাক্‌কর্ম করে ও মনোকর্ম সঞ্চয় করে। সে সহিংস-অহিংস কায়, বাক্‌ ও মনোকর্ম সঞ্চয় করিয়া দুঃখ-সুখময় লোকে উৎপন্ন হয়, উৎপন্ন অবস্থায় সদুঃখ-অদুঃখজনক স্পৃশ্য স্পর্শ করে। সে সদুঃখ-অদুঃখজনক স্পৃশ্যদ্বারা স্পর্শিত হইয়া সুখ-দুঃখ মিশ্রিত বেদনা অনুভব করে, যেমন- মানুষ, কোন কোন দেবতা এবং কোন কোন বিনিপাতিক প্রেতগণ। এইরূপে হে পুণ্ন! ভূত হইতে ভূতের উৎপত্তি। (জীব) যাহা করে তদ্বারা উৎপন্ন হয় এবং উৎপন্ন অবস্থায় অনুরূপ ফল ভোগ করে। এই কারণেও আমি বলি, ‘প্রাণিগণ কর্মের উত্তরাধিকারী’। পুণ্ন! ইহা ভাল-মন্দ বিপাকপ্রদ মিশ্রকর্ম।” (৩)

“পুণ্ন! অদুঃখ-অসুখ বিপাকপ্রদ অকৃষ্ণ- অশুক্ল কর্ম, যাহা কর্মক্ষয়ে সংবর্তিত হয়, তাহা কি? উক্ত ত্রিবিধ কর্মের মধ্যে হে পুণ্ন! যাহা মন্দ-ফলপ্রদ কৃষ্ণকর্ম উহার প্রহাণের জন্য যেই চেতনা, যাহা শুভ-ফলপ্রদ শুক্লকর্ম উহার প্রহাণের জন্য যেই চেতনা এবং যাহা ভাল-মন্দ মিশ্রফলপ্রদ কর্ম উহারও প্রহাণের জন্য যেই চেতনা, তাহাই পুণ্ন! অকৃষ্ণ-অশুক্ল বিপাকপ্রদ কর্ম বলা হয়- যাহা যাবতীয় কর্মক্ষয়ে সংবর্তিত।” (৪)

“পুণ্ন! এই চতুর্বিধ কর্ম স্বীয় অভিজ্ঞা দ্বারা প্রত্যক্ষ করিয়া আমা কর্তৃক ঘোষিত হইয়াছে।”

৮২। ইহা উক্ত হইলে গো-ব্রতী কোলিয়পুত্র পুণ্ন ভগবানকে বলিল,-

“অতি আশ্চর্য প্রভু! অতি অদ্ভুত প্রভু! যেমন হে প্রভু! ...... পূ ......। প্রভু ভগবন্‌! আজ হইতে যাবজ্জীবন আমাকে শরণাগত উপাসকরূপে ধারণা করুন।”

কুকুরব্রতিক উলঙ্গ সেনিয় ভগবানকে বলিল,-

“অত্যাশ্চর্য প্রভু! অতি অদ্ভুত প্রভু! যেমন অধোমুখকে ঊর্ধমুখ করে, প্রতিচ্ছন্নকে বিবৃত করে, পথভ্রষ্টকে পথ প্রদর্শন করে, চক্ষুষ্মান রূপ (দৃশ্য) দর্শনের নিমিত্ত অন্ধকারে তৈল প্রদীপ ধারণ করে- সেই প্রকারেই ভগবান কর্তৃক অনেক পর্যায়ে ধর্ম ঘোষিত হইয়াছে। প্রভু! আমি ভগবানের, ধর্মের ও ভিক্ষুসংঘের শরণাপন্ন হইতেছি। প্রভু! আমি ভগবানের নিকট প্রব্রজ্যা ও উপসম্পদা লাভের প্রত্যাশী।”

“সেনিয়! যদি কোন ভূতপূর্ব অন্যতীর্থিয় (মতাবলম্বী) এই ধর্ম বিনয়ে প্রব্রজ্যা ও উপসম্পদা লাভ করিতে ইচ্ছুক হয়, তবে তাহাকে চারি মাস পর্যন্ত পরিবাস (ব্রত পূরণার্থ বাস) করিতে হয়। চারি মাসের পর সন্তুষ্টচিত্ত ভিক্ষুগণ তাহাকে প্রব্রজ্যা ও ভিক্ষুভাবে উপসম্পদা প্রদান করে। অথচ এখানে আমার ব্যক্তিবিশেষের বিভিন্নতাও সুবিদিত।”

“প্রভু! যদি তদ্রূপ করিতে হয়, ...... পূ ...... আমি চারিবর্ষ ব্যাপি পরিবাস করিতে প্রস্তুত। চারি বৎসরের পর সন্তুষ্টচিত্ত ভিক্ষুগণ আমাকে প্রব্রজ্যা ও ভিক্ষুভাবে উপসম্পদা প্রদান করুন।”

উলঙ্গ কুকুরব্রতীক সেনিয় ভগবানের নিকট প্রব্রজ্যা ও উপসম্পদা লাভ করিল। অচির উপসম্পন্ন আয়ুষ্মান সেনিয় একাকী বিষয়-বাসনামুক্ত, অপ্রমত্ত, বীর্যবান ও নির্বান প্রবণ চিত্ত হইয়া অবস্থান পূর্বক- যার জন্য কুলপুত্রগণ আগার হইতে অনাগারিক প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন- অচিরেই সেই অনুত্তর ব্রহ্মচর্যের অবসান অর্হত্ব ইহজীবনে স্বয়ং অভিজ্ঞাদ্বারা প্রত্যক্ষ ও উপলব্ধি করিয়া বাস করেন। চিরতরে জন্মবীজ ক্ষীণ, ব্রহ্মচর্যব্রত উদ্‌যাপিত, করণীয় কৃত এবং এ জীবনের জন্য আর তাঁহার কর্তব্য নাই,- তিনি ইহা উত্তমরূপে জানিলেন। আয়ুষ্মান সেনিয় অর্হতদের অন্যতম হইলেন।

॥ কুক্কুরবতিক সূত্র সমাপ্ত ॥

অভয় রাজকুমার সূত্র (৫৮)

৮৩। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-

এক সময় ভগবান রাজগৃহে বেণুবনে কলন্দক নিবাপে বাস করিতেছেন। তখন রাজকুমার অভয় নিগণ্ঠ নাতপুত্রের নিকট উপস্থিত হইলেন। উপস্থিত হইয়া নিগণ্ঠ নাতপুত্রকে অভিবাদন পূর্বক একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট রাজকুমার অভয়কে নাতপুত্র নিগণ্ঠ বলিলেন,-

“আসুন, রাজকুমার! আপনি শ্রমণ গৌতমের সাথে বাদারোপ করুন। ইহাতে আপনার কল্যাণ-কীর্তি শব্দ বিঘোষিত হইবে যে রাজকুমার অভয় কর্তৃক এমন মহাঋদ্ধি ও মহানুভব সম্পন্ন শ্রমণ গৌতমের বিরুদ্ধে বাদারোপিত হইয়াছে।”

“প্রভু! আমি কিরূপে শ্রমণ গৌতমের বিরুদ্ধে বাদারোপ করিব?”

“আসুন, রাজকুমার! যেখানে শ্রমণ গৌতম তথায় যান। সে স্থানে উপস্থিত হইয়া শ্রমণ গৌতমকে জিজ্ঞাসা করুন,- প্রভু! তথাগত ঈদৃশ বাক্য বলেন কি যাহা পরের অপ্রিয় ও অমনোজ্ঞ? যদি শ্রমণ গৌতম জিজ্ঞাসিত হইয়া বলেন- রাজকুমার! তথাগত তদ্রূপ বাক্য বলেন, যাহা পরের অপ্রিয় ও অমনোজ্ঞ। তবে আপনি বলিবেন,- প্রভু! প্রাকৃতজনের সহিত আপনার বিশেষত্ব কি? প্রাকৃতজনও সেরূপ বাক্য বলে, যাহা পরের অপ্রিয় ও অমনোজ্ঞ। যদি এইরূপ জিজ্ঞাসিত হইয়া শ্রমণ গৌতম আপনাকে প্রকাশ করেন যে- রাজকুমার! তথাগত এইরূপ বাক্য ভাষণ করেন না, যাহা পরের অপ্রিয় ও অমনোজ্ঞ। তবে আপনি বলিবেন,- প্রভু! অপায়িক দেবদত্ত, নৈরয়িক দেবদত্ত, কল্পস্থায়ী দেবদত্ত, অচিকিৎস দেবদত্ত বলিয়া আপনি কিরূপে ঘোষণা করিলেন? আপনার এই বাক্য দ্বারা দেবদত্ত কোপিত ও অসন্তুষ্ট হইয়াছিল। রাজকুমার! আপনার এই উভয় কোটিক (সমস্যাজনক) প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইয়া শ্রমণ গৌতম উদ্গীরণ বা অধোকরণ (গলাধঃকরণ) কোনটাই করিতে সমর্থ হইবে না। যেমন কোন ব্যক্তির লৌহ শৃংগাটক (বড়শী?) কণ্ঠলগ্ন হয়, সে তাহা উদ্গীরণ কিম্বা গলাধঃকরণ করিতে অসমর্থ হয়; সেইরূপ রাজকুমার! আপনার উভয় কোটিক প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইয়া শ্রমণ গৌতম উদ্গীরণ কিম্বা গলাধঃকরণ করিতে সমর্থ হইবেন না।”

“যে আজ্ঞা প্রভু!” বলিয়া রাজকুমার অভয় নিগণ্ঠ নাতপুত্রকে প্রতিশ্রুতি দিয়া আসন হইতে উঠিলেন এবং নিগণ্ঠ নাতপুত্রকে অভিবাদন পূর্বক প্রদক্ষিণ করিয়া ভগবানের নিকট উপনীত হইলেন। তথায় ভগবানকে অভিবাদন করিয়া একপ্রান্তে বসিলেন।

৮৪। রাজকুমার অভয় সূর্য্য (সময়) দেখিয়া চিন্তা করিলেন,- “আজ ভগবানের সহিত বাদারোপের উপযুক্ত সময় নহে। আগামী কল্য আমার প্রাসাদে ভগবানের সহিত বাদারোপ করিব।” আর ভগবানকে বলিলেন,-

“ভন্তে ভগবন! আগামী কল্য আপনি সহ চারিজন ভিক্ষুর নিমন্ত্রণ গ্রহণ করুন।” ভগবান মৌনভাবে স্বীকার করিলেন।

রাজকুমার অভয় ভগবানের স্বীকৃতি অবগত হইয়া আসন হইতে উঠিলেন এবং ভগবানকে অভিবাদন ও প্রদক্ষিণ করিয়া প্রস্থান করিলেন।

সেই রাত্রি অবসানে পূর্বাহ্ন সময়ে ভগবান চীবর পরিধান পূর্বক পাত্র-চীবর লইয়া তিনজন ভিক্ষু সহ রাজকুমার অভয়ের প্রাসাদে উপনীত হইলেন এবং সজ্জিত আসনে উপবেশন করিলেন। অভয় রাজকুমার স্বহস্তে উৎকৃষ্ট খাদ্য-ভোজ্য দ্বারা ভগবানকে সন্তর্পিত করিলেন, সমপ্রবারিত করিলেন। তখন ভোজন শেষে ভগবান পাত্র হইতে হস্ত অপনীত করিলে রাজকুমার অভয় নীচ আসন লইয়া এক প্রান্তে বসিলেন।

৮৫। এক প্রান্তে বসিয়া অভয় রাজকুমার ভগবানকে বলিলেন,-

“প্রভু! তথাগত তাদৃশ বাক্য বলিতে পারেন কি যাহা পরের অপ্রিয় ও অমনোরম?”

“রাজকুমার! এই প্রশ্নের একাংশে (নিশ্চিত রূপে) উত্তর হয় না।”

“প্রভু! এখানেই নিগণ্ঠগণ বিনষ্ট হইল।”

“রাজকুমার! কেন তুমি একথা বলিতেছ যে এখানেই নিগণ্ঠগণ বিনষ্ট হইল?”

“প্রভু! অধুনা আমি নিগণ্ঠ নাতপুত্রের নিকট গিয়াছিলাম। তথায় গিয়া নিগণ্ঠ নাতপুত্রকে অভিবাদন করিয়া বসিলাম। তখন নাতপুত্র নিগণ্ঠ আমাকে বলিলেন,- ‘আসুন রাজকুমার! ...... পূ ...... উদ্গীরণ কিম্বা গলাধঃকরণ করিতে সমর্থ হইবে না’।”

৮৬। সেই সময় উত্তানশায়ী অবোধ শিশু-কুমার অভয় রাজকুমারের অঙ্কে উপবিষ্ট ছিল। ভগবান রাজকুমার অভয়কে বলিলেন,-

“তাহা কি মনে কর, রাজকুমার! তোমার কিম্বা ধাত্রীর প্রমাদবশতঃ যদি এই শিশু কাষ্ঠ কিংবা কাঁকর মুখে পূরিয়া দেয় তখন তুমি কি করিবে?”

“আমি তাহা বাহির করিব, ভন্তে! যদি প্রথমতঃ তাহা বাহির করিতে না পারি তবে বামহস্তে শিশুর মস্তক ধরিয়া দক্ষিণ হস্তে অঙ্গুলি বক্র করিয়া রক্তস্রাব হইলেও তাহা বাহির করিব। কারণ ভন্তে! শিশুর প্রতি আমার যথেষ্ট করুণা আছে।”

“তদ্রূপই রাজকুমার! যেই বাক্য অভূত, অসত্য, অনর্থসংযুক্ত বলিয়া তথাগত জানেন, আর সেই বাক্য, পরের অপ্রিয় ও অমনোরম হয়, তথাগত তাদৃশ বাক্য বলেন না। যেই বাক্য ভূত, সত্য, অনর্থসংযুক্ত বলিয়া তথাগত জানেন, আর সেই বাক্য যদি পরের অপ্রিয় ও অমনোরম হয়, তথাগত সেই বাক্যও ভাষণ করেন না। যাহা তথাগত জানেন যে ভূত, সত্য ও অর্থসংযুক্ত এবং তাহা পরের অপ্রিয় ও অমনোজ্ঞ, তথাগত সেই বাক্য প্রকাশের নিমিত্তও কাল বিচার করেন। যেই বাক্য অভূত, অসত্য, অনর্থযুক্ত এবং তাহা পরের প্রিয় ও মনোরম হয়, তথাগত তাহাও ভাষণ করেন না। যেই বাক্য তথাগত জানেন যে সত্য, ভূত, অর্থযুক্ত এবং তাহা পরের প্রিয় ও মনোরম, সেই বাক্য ভাষণেও তথাগত কালজ্ঞ হন। তাহার কারণ এই, রাজকুমার! জীবগণের প্রতি তথাগতের অসীম করুণা আছে।”

৮৭। “ভন্তে! যে সকল ক্ষত্রিয় পণ্ডিত, ব্রাহ্মণ পণ্ডিত, গৃহপতি পণ্ডিত এবং শ্রমণ পণ্ডিত প্রশ্ন প্রস্তুত করিয়া তথাগতের নিকট আসিয়া জিজ্ঞাসা করেন; প্রভু! পূর্বেই কি ইহা ভগবানের চিত্তে পরিকল্পিত হয় যে যাহারা আসিয়া এইরূপ জিজ্ঞাসা করিবে তাহাদিগকে আমি এই উত্তর দিব অথবা স্থান ভেদে কি তথাগতের উপস্থিত বুদ্ধিতে ইহা প্রতিভাত হয়?”

“রাজকুমার! তোমাকেই এই বিষয় জিজ্ঞাসা করিব, তোমার অভিরুচি অনুসারে উত্তর করিবে। রাজকুমার! রথের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্বন্ধে তুমি অভিজ্ঞ কি?”

“হাঁ, প্রভু! আমি রথের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্বন্ধে অভিজ্ঞ।”

“বেশ, যদি কেহ আসিয়া তোমাকে জিজ্ঞাসা করে, ইহা রথের কোন্‌ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ? ইহা কি পূর্বেই তোমার চিন্তিত ছিল যে যাহারা আমার নিকট জিজ্ঞাসা করিবে আমি তাহাদিগকে এই উত্তর দিব অথবা ইহা কি স্থানোচিত রূপেই তোমার প্রতিভাত হইবে?”

“প্রভু! আমি রথের মালিক, রথের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সম্বন্ধে বিখ্যাত ও দক্ষ। রথের সমুদয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই আমার সুবিদিত। সুতরাং স্থানোচিত জ্ঞানেই ইহা আমার প্রতিভাত হইবে।”

“রাজকুমার! তদ্রূপই যে সকল ক্ষত্রিয় পণ্ডিত, ... ... স্থানোচিত (প্রত্যুৎপন্ন) জ্ঞানেই আমার প্রতিভাত হয়। তাহার কারণ কি? রাজকুমার! তথাগতের সেই ধর্মধাতু (সর্বজ্ঞতা) সুপ্রতিবিদ্ধ (সুপরিজ্ঞাত) হইয়াছে, যেই ধর্মধাতুর সুপ্রতিবিদ্ধতা হেতু স্থানোচিত ভাবেই তথাগতের যাবতীয় প্রশ্নের সমাধান প্রতিভাত হয়।”

এইরূপ উক্ত হইলে অভয় রাজকুমার ভগবানকে বলিলেন,- “আশ্চর্য ভন্তে! ...... পূ ...... আজ হইতে যাবজ্জীবন আমাকে শরণাগত উপাসকরূপে ধারণা করুন।”

॥ অভয় রাজকুমার সূত্র সমাপ্ত ॥

বহু বেদনীয় সূত্র (৫৯)

৮৮। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-

এক সময় ভগবান শ্রাবস্তীতে অনাথ পিণ্ডিকের আরাম জেতবনে বাস করিতেছিলেন। তখন পঞ্চকংগ স্থপতি (সূত্রধর) যেখানে আয়ুষ্মান উদায়ী থাকেন, তথায় উপনীত হইলেন। তথায় উপস্থিত হইয়া আয়ুষ্মান উদায়ীকে অভিবাদন করিয়া একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট পঞ্চকংগ স্থপতি আয়ুষ্মান উদায়ীকে বলিলেন,- “ভন্তে উদায়ি! ভগবান বেদনা কয় প্রকার বলিয়াছেন?”

“স্থপতি! (১) সুখ-বেদনা, (২) দুঃখ-বেদনা, (৩) অদুঃখ-অসুখ বেদনা- ভগবান এই তিন প্রকার বেদনা বলিয়াছেন। ... ...।”

“ভন্তে উদায়ি! ভগবান তিন প্রকার বেদনা বলেন নাই, দুই প্রকার বেদনা বলিয়াছেন,- সুখ-বেদনা ও দুঃখ-বেদনা। ভন্তে! এই যে অদুঃখ-অসুখ বেদনা আছে, উহাকে ভগবান শান্ত, উত্তম সুখের অন্তর্গত বলিয়াছেন।”

দ্বিতীয়বারও আয়ুষ্মান উদায়ী পঞ্চকংগ স্থপতিকে বলিলেন,- “স্থপতি! ভগবান দুই প্রকার বেদনা বলেন নাই। ভগবান তিন প্রকার বেদনা বলিয়াছেন ... ...।”

দ্বিতীয়বারও পঞ্চকংগ স্থপতি আয়ুষ্মান উদায়ীকে বলিলেন,- “নহে, ভন্তে উদায়ি! ...... পূ ...... শান্ত, উত্তম সুখের অন্তর্গত বলিয়াছেন।”

তৃতীয়বারও আয়ুষ্মান উদায়ী ...... পূ ......।”

তৃতীয়বারও পঞ্চকংগ স্থপতি ...... পূ ......।

আয়ুষ্মান উদায়ী পঞ্চকংগ স্থপতিকে বুঝাইতে পারিলেন না, পঞ্চকংগ স্থপতিও আয়ুষ্মান উদায়ীকে বুঝাইতে পারিলেন না।

৮৯। পঞ্চকংগ স্থপতির সহিত আয়ুষ্মান উদায়ীর এই আলোচনা আয়ুষ্মান আনন্দ শুনিতে পাইলেন। তখন আয়ুষ্মান আনন্দ যেখানে ভগবান তথায় গেলেন এবং ভগবানকে অভিবাদন করিয়া একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট আয়ুষ্মান আনন্দ পঞ্চকংগের সহিত আয়ুষ্মান উদায়ীর যাহা কিছু আলোচনা হইয়াছে সেই সমস্ত ভগবানকে নিবেদন করিলেন। ইহা বলা হইলে ভগবান আয়ুষ্মান আনন্দকে বলিলেন,- “আনন্দ পর্যায় (কারণ) থাকা সত্ত্বেও পঞ্চকংগ স্থপতি উদায়ীর ভাষণ অনুমোদন করিল না, আর পর্যায় (কারণ) থাকা সত্ত্বেও উদায়ী পঞ্চকংগ স্থপতির ভাষণ অনুমোদন করিল না। আনন্দ! আমি পর্যায় বশতঃ (কারণ ভেদে) বেদনা দুই প্রকার বলিয়াছি, তিন প্রকার, পাঁচ প্রকার, ছয় প্রকার, অষ্টাদশ প্রকার, ছয়ত্রিশ প্রকার, একশ আট প্রকারও বলিয়াছি। আনন্দ! এইরূপে পর্যায়ক্রমে আমি ধর্মোপদেশ করিয়াছি। আনন্দ! আমার পর্যায়ক্রমে উপদিষ্ট ধর্মে যাহারা পরস্পরের সুভাষিত, সুকথিত বাণীকে (ধর্মকে) স্বীকার করিবে না, মানিবে না, অনুমোদন করিবে না, তাহাদের পক্ষে ইহাই প্রত্যাশিত যে (সম্ভব যে) তাহারা ভণ্ডণজাত, কলহজাত, বিবাদাপন্ন হইয়া একে অন্যকে মুখ-শক্তি দ্বারা বিদ্ধ করিতে করিতে বাস করিবে। আনন্দ! এইরূপে আমাকর্তৃক ধর্ম পর্যায়ক্রমে দেশিত। আনন্দ! আমার পর্যায়ক্রমে দেশিত ধর্মে যাহারা পরস্পরের সুভাষিত, সুকথিত বাক্যকে উত্তমরূপে স্বীকার করিবে, মনন করিবে ও অনুমোদন করিবে তাহাদের ইহাই প্রত্যাশিত যে তাহারা সমগ্রভাবে........ সম্মোদন করিতে করিতে বিবাদ রহিত হইয়া ক্ষীরোদকভূত অবস্থায় একে অন্যকে প্রিয়নেত্রে দেখিয়া বাস করিবে।”

৯০। “আনন্দ! এই পঞ্চ কামগুণ (ভোগ)। কি কি পঞ্চ? ইষ্ট, কান্ত, মনোহর, প্রিয়স্বরূপ কামসংযুক্ত মনোরঞ্জন চক্ষু-বিজ্ঞেয় রূপ; ...... পূ ...... শ্রোত-বিজ্ঞেয় শব্দ; ...... পূ ...... ঘ্রাণ-বিজ্ঞেয় গন্ধ; ...... পূ ...... জিহ্বা-বিজ্ঞেয় রস; ...... পূ ...... কায়-বিজ্ঞেয় স্পৃষ্টব্য। আনন্দ! এই পঞ্চ কামগুণ। আনন্দ! এই পঞ্চ কামগুণের সংস্রবে যে সুখ-সৌমনস্য উৎপন্ন হয়, তাহাকেই কামসুখ বলা হয়।”

“আনন্দ! যদি কেহ এইরূপ বলে,- প্রাণিগণ এই পর্যন্তই চরম সুখ-সৌমনস্য ভোগ করে, তাহার এই মত (সিদ্ধান্ত) আমি সমর্থন করি না। ইহার কারণ কি? আনন্দ! এই সুখ হইতে আরও সুন্দরতর ও উন্নততর (বিপুলতর) অপর সুখ আছে। আনন্দ! অন্য কোন্‌ সুখ এই সুখ হইতে উজ্জ্বলতর ও উন্নততর?- এখানে আনন্দ! ভিক্ষু ...... পূ ...... প্রথম ধ্যান লাভ করিয়া বাস করে। ইহাই আনন্দ! সে সুখ হইতে উজ্জ্বলতর ও উন্নততর অপর সুখ।”

“আনন্দ! যদি কেহ বলে...পূ...আমি সমর্থন করি না। .... পূ ..... দ্বিতীয় ধ্যান লাভ করিয়া বাস করে। ...... পূ ......।”

“আনন্দ! যদি কেহ বলে ...... পূ ...... তাহার এই মতও আমি সমর্থন করি না। ...... পূ ...... তৃতীয় ধ্যান লাভ করিয়া বাস করে। ...... পূ ......।”

“আনন্দ! যদি কেহ ইহা বলে ...... পূ ...... আমি সমর্থন করি না। ...... পূ ...... চতুর্থ ধ্যান লাভ করিয়া বাস করে। ...... পূ ......।”

“এইরূপে আনন্দ! ...... পূ ...... আকাশানন্তায়তন লাভ করিয়া বাস করে। ...... পূ ......। ...... পূ ...... বিজ্ঞানানন্তায়তন লাভ করিয়া বাস করে। ...... পূ ...... । ...... পূ ...... আকিঞ্চন্যায়তন লাভ করিয়া বাস করে। ...... পূ ......। ...... পূ ...... নৈবসংজ্ঞা-নাসংজ্ঞায়তন লাভ করিয়া বাস করে। ...... পূ ......। আনন্দ! এখানে নৈবসংজ্ঞা-নাসংজ্ঞায়তন সর্বতোভাবে অতিক্রমন পূর্বক সংজ্ঞাবেদয়িত নিরোধকে অধিগত হইয়া বাস করে। ইহাই আনন্দ! সে সুখ হইতে উজ্জ্বলতম ও উন্নততম-অপর সুখ।”

৯১। “আনন্দ! সম্ভবতঃ অন্যতীর্থিয় পরিব্রাজকগণ বলিতে পারেন, ‘শ্রমণ গৌতম সংজ্ঞা বেদয়িত নিরোধ সম্বন্ধে বলেন, তাহাও সুখময় বলিয়া থাকেন। উহা কি? উহা কি প্রকার?’ এইরূপবাদী অন্যতীর্থিয়গণকে ইহা বলা উচিত,- ‘বন্ধুগণ! ভগবান সুখ-বেদনা সম্পর্কেই উহাকে সুখময় বলেন নাই। কিন্তু বন্ধুগণ! যেখানে যেখানে (বেদয়িত বা অবেদয়িত) সুখ উপলব্ধ হয়, তথায় তাহাকেই তথাগত সুখান্তর্গত বলিয়া থাকেন’ ।”

ভগবান ইহা বলিলেন, আয়ুষ্মান আনন্দ সন্তুষ্টচিত্তে ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন করিলেন।

॥ বহু বেদনীয় সূত্র সমাপ্ত ॥

অপণ্নক সূত্র (৬০)

৯২। আমি এইরূপ শুনিয়াছি-

এক সময় ভগবান মহাভিক্ষুসংঘের সহিত কোশল জনপদে ধর্ম প্রচারার্থ বিচরণ করিতে করিতে যেখানে কোশলের শালা নামক ব্রাহ্মণ গ্রাম, সেখানে পৌঁছিলেন।

শালার ব্রাহ্মণ গৃহপতিগণ শুনিলেন- “শ্রমণ শাক্যপুত্র গৌতম শাক্যকুল হইতে প্রব্রজিত হইয়া মহাভিক্ষুসংঘের সহিত বিচরণ করিতে করিতে শালায় উপনীত হইয়াছেন। সেই ভগবান গৌতমের এইরূপ কল্যাণ কীর্ত্তি-শব্দ বিঘোষিত হইয়াছে যে- সেই ভগবান অর্হত, সম্যক্‌সম্বুদ্ধ, বিদ্যাচরণ-সম্পন্ন, সুগত, লোকিবিদ্‌, দম্যপুরুষের অনুত্তর সারথি, দেব-মনুষ্যদের শাস্তা, বুদ্ধ ও ভগবান। তিনি দেব, মার, ব্রহ্ম, শ্রমণ-ব্রাহ্মণ প্রজা ও দেব-মনুষ্যের সহিত এই সত্ত্বলোক স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা প্রত্যক্ষ করিয়া প্রচার করেন। তিনি আদি কল্যাণ, মধ্য কল্যাণ, অন্ত্য কল্যাণ, অর্থ ও ব্যঞ্জনযুক্ত ধর্ম প্রচার করেন এবং সর্বতোভাবে পরিপূর্ণ পরিশুদ্ধ (মার্গ) ব্রহ্মচর্য প্রকাশ করেন। তথাবিধ অর্হতের দর্শন আমাদের মঙ্গলজনক।”

তখন শালার ব্রাহ্মণ গৃহপতিগণ ভগবানের নিকট উপস্থিত হইলেন এবং কেহ কেহ ভগবানকে অভিবাদনপূর্বক একপ্রান্তে বসিলেন। কেহ কেহ ভগবানের সহিত প্রীতি সম্ভাষণ করিলেন, প্রীতি সম্ভাষণ শেষ করিয়া একপ্রান্তে বসিলেন। কেহ কেহ ভগবানের দিকে যুক্তাঞ্জলি প্রণাম করিয়া একপ্রান্তে বসিলেন। কেহ কেহ ভগবানের নিকট নাম-গোত্র প্রকাশ করিয়া একপ্রান্তে বসিলেন। কেহ কেহ মৌনাবলম্বন করিয়া একপ্রান্তে বসিলেন।

৯৩। ভগবান শালা ব্রাহ্মণ গৃহপতিগণকে বলিলেন,- “গৃহপতিগণ! তোমাদের কোন প্রিয় শাস্তা আছে কি যাহার প্রতি তোমাদের সহেতুক শ্রদ্ধা বিদ্যমান?”

“ভন্তে! আমাদের এমন কোন প্রিয় শাস্তা নাই যাঁহার প্রতি আমাদের সহেতুক শ্রদ্ধা বিদ্যমান।”

হে গৃহপতিগণ! যাহাদের প্রিয় শাস্তা লাভ হয় নাই তাহাদের পক্ষে এই অপণ্নকধর্ম (অদ্বৈতগামী মার্গ) গ্রহণ করিয়া আচরণ করা উচিত। গৃহপতিগণ! অপণ্নকধর্ম গৃহীত ও আচরিত হইলে উহা তোমাদের চিরকাল হিত-সুখের নিদান হইবে। গৃহপতিগণ! অপণ্নকধর্ম কি?”

৯৪। “গৃহপতিগণ! কোন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ আছে তাহারা এইরূপ দৃষ্টিসম্পন্ন ও এইরূপ মতবাদী,- “দানফল নাই, যজ্ঞফল নাই, আহুতিফল নাই, সুকৃত-দুষ্কৃত কর্মের ফল-বিপাক নাই, ইহলোক -পরলোক নাই,

মাতা নাই, পিতা নাই, ঔপপাতিক সত্ত্ব (অযোনিস সম্ভবা দেবতা) নাই, সম্যক্‌গত ও সম্যক্‌ প্রতিপন্ন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ নাই যাঁহারা ইহলোক-পরলোক অভিজ্ঞাদ্বারা স্বয়ং প্রত্যক্ষ করিয়া প্রকাশ করেন।’ গৃহপতিগণ! কোন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ সেই শ্রমণ-ব্রাহ্মণদের সোজা বিরুদ্ধবাদী (উজুবিপচ্চনিক)। তাহারা বলে,- ‘দানফল আছে, যজ্ঞফল আছে, আহুতিফল আছে, সুকৃত-দুষ্কৃত কর্মের ফল-বিপাক আছে ...... পূ ......।’ ইহা কি মনে কর গৃহপতিগণ! এই সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণ একে অন্যের সোজা বিরুদ্ধবাদী নহে কি?”

“সত্যই ভন্তে!”

৯৫। (১) “গৃহপতিগণ! তাহাতে যে সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণ এইরূপ বাদী ও এইরূপ দৃষ্টিসম্পন্ন,- ‘দান নাই, যজ্ঞ নাই, ...... পূ ......।’ তাহাদের পক্ষে ইহাই কাম্য যাহা কায়-সুচরিত, বাক্‌-সুচরিত ও মনো-সুচরিত এই ত্রিবিধ কুশলধর্মকে পরিবর্জন করিয়া যাহা কায়-দুশ্চরিত, বাক্‌-দুশ্চরিত ও মনো-দুশ্চরিত এই ত্রিবিধ ত্রিবিধ অকুশলধর্মকে গ্রহণ পূর্বক আচরণ করিবে। ইহার কারণ কি? যেহেতু সেই শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণ অকুশল ধর্ম সমূহের আদীনব, অবকার (নীচতা) ও সংক্লেশ এবং পক্ষান্তরে কুশল ধর্ম সমূহের আনিসংশ (পুরষ্কার) এবং নিষ্কামের বিশুদ্ধি পক্ষ দেখিতে পায় না। পরলোক বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও তাহাদের পরলোক নাই বলিয়া দৃষ্টি (ধারণা) জন্মে, উহাই তাহাদের মিথ্যাদৃষ্টি। পরলোক বিদ্যমান সত্ত্বেও উহা নাই বলিয়া সঙ্কল্প করে, উহা তাহাদের মিথ্যাসঙ্কল্প। বিদ্যমান সত্ত্বেও পরলোক নাই বলিয়া বাক্য ভাষণ করে, উহা তাহাদের মিথ্যাবাক্য। বিদ্যমান সত্ত্বেও পরলোক নাই বলিয়া বলে; যাহারা অভিজ্ঞ লোকবিদ্‌ ও অর্হৎ এ ব্যক্তি তাহাদের বিরোধিতা করে। পরলোক বিদ্যমান সত্ত্বেও পরলোক নাই, ইহা পরকে জ্ঞাপন করে, উহা তাহার অসদ্ধর্ম (মিথ্যা ধর্ম) সংজ্ঞাপন। সেই অসদ্ধর্ম সংজ্ঞাপন দ্বারা সে নিজকে উৎকৃষ্ট ও পরকে নিকৃষ্ট মনে করে। এই প্রকারে পূর্বেই তাহার সুশীলতা পরিত্যক্ত ও দুঃশীলতা উপস্থিত হয়। এই মিথ্যাদৃষ্টি, মিথ্যাসঙ্কল্প, মিথ্যাবাক্য, আর্যগণ বিরোধিতা, অসদ্ধর্ম সংজ্ঞাপন, আত্মোৎকর্ষণ ও পরাবকর্ষণ প্রভৃতি ভ্রান্ত ধারণাবশতঃ তাহার অনেক পাপ অকুশলধর্ম সম্ভূত হয়.......। গৃহপতিগণ! তাহাতে বিজ্ঞপুরুষ এই বিচার করে- যদি পরলোক না থাকে, তবে এই ভদ্র পুরুষ-মানুষ (পুদ্গল) দেহত্যাগের পর স্বয়ং স্বস্তি লাভ করিবে। যদি পরলোক থাকে, তবে এই ব্যক্তি দেহত্যাগে মৃত্যুর পর অপায় দুর্গতি বিনিপাত ও নিরয়ে উৎপন্ন হইবে। যদি প্রকৃতপক্ষে পরলোক না থাকে এবং এই সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণদের বাক্য সত্যই হয়, তথাপি এই ব্যক্তি বাস্তব জীবনে বিজ্ঞগণের নিন্দার্হ ‘এই পুরুষ-মানুষ দুঃশীল মিথ্যাদৃষ্টিক ও নাস্তিকবাদী’। যদি পরলোক থাকে, তবে এই ব্যক্তির উভয়ত্র পরাজয় এবং ইহজীবনে বিজ্ঞগণের নিন্দার্হ আর দেহত্যাগে মৃত্যুর পর অপায় দুর্গতি বিনিপাত ও নিরয়ে উৎপত্তি হয়। এইরূপেই তাহার দুর্গ্রহণে গৃহীত এই অপণ্নকধর্ম একান্ত (স্বীয় মত) স্ফুরণ করিয়া থাকে, কুশলের হেতু বর্জন করে।”

৯৬। (২) “গৃহপতিগণ! তথায় যে সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণ এরূপবাদী ও এরূপ দৃষ্টিসম্পন্ন,- ‘দান ফল আছে, যজ্ঞফল আছে, আহুতিফল আছে, সুকৃত-দুষ্কৃত কর্মের ফল-বিপাক আছে, ইহলোক-পরলোক আছে, মাতৃ-পিতৃ সেবার ফল আছে, ঔপপাতিক সত্ত্ব আছে, আর সম্যক্‌গত (সত্যাবগত) ও সম্যক্‌ প্রতিপন্ন (সত্যারূঢ়) শ্রমণ-ব্রাহ্মণ আছেন যাঁহারা ইহলোক-পরলোক স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎ ও প্রত্যক্ষ করিয়া প্রকাশ করেন’। তাঁহাদের ইহাই আকাঙক্ষ্য যে কায়-দুশ্চরিত, বাক্‌-দুশ্চরিত ও মনো-দুশ্চরিত এই ত্রিবিধ অকুশলধর্ম পরিবর্জন করিয়া যাহা কায়-সুচরিত, বাক্‌-সুচরিত ও মনোসুচরিত এই ত্রিবিধ কুশলধর্মকে গ্রহণ পূর্বক আচরণ করিবে’। ইহার কারণ কি? এই শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণ অকুশল ধর্মসমূহের আদীনব, অপকার, সংক্লেশ আর কুশল ধর্মসমূহের নিষ্কাম ভাব, পুরস্কার ও বিশুদ্ধি পক্ষ দর্শন করেন। বিদ্যমান পরলোক সম্বন্ধে পরলোক আছে তাহার যে দৃষ্টি হয়, উহা তাঁহার সম্যক্‌-দৃষ্টি। বিদ্যমান পরলোক সম্বন্ধে পরলোক আছে বলিয়া এই যে সঙ্কল্প করেন, উহা তাঁহার সম্যক্‌-সঙ্কল্প। বিদ্যমান পরলোক সম্বন্ধে পরলোক আছে বলিয়া যে বাক্য ভাষণ করেন, উহা তাঁহার সম্যক্‌-বাক্য। বিদ্যমান পরলোক সম্বন্ধে পরলোক আছে, বলেন; যাঁহারা অর্হৎ পরলোক-বিদ্‌ তাঁহাদের সহিত তিনি বিরোধিতা করেন না। বিদ্যমান পরলোক সম্বন্ধে ‘পরলোক আছে’ বলিয়া পরকে জ্ঞাপন করেন, উহা তাঁহার পক্ষে সত্যধর্ম জ্ঞাপন করা হয়। সেই সত্যধর্ম জ্ঞাপন দ্বারা তিনি নিজকে উৎকৃষ্ট মনে করেন না, পরকেও নিকৃষ্ট ভাবেন না। এই প্রকারে পূর্বেই তাঁহার দুঃশীলতা পরিত্যক্ত হয়, সুশীলতা উপস্থিত হয়। এই সম্যক্‌-দৃষ্টি, সম্যক্‌-সঙ্কল্প, সম্যক-বাক্য, আর্যগণের অবিরোধিতা, সত্যধর্ম জ্ঞাপন, অনাত্মোৎকর্ষণ, অপরাবকর্ষণ প্রভৃতি তাঁহার বহুবিধ কুশলধর্ম উৎপন্ন হয়, সম্যক্‌ দৃষ্টির কারণে। গৃহপতিগণ! এ বিষয়ে বিজ্ঞব্যক্তি এই চিন্তা করেন,- ‘যদি পরলোক থাকে, তবে এই পুরুষ-পুদ্গল দেহত্যাগে মৃত্যুর পর সুগতি স্বর্গলোকে উৎপন্ন হইবে। একান্তই যদি পরলোক না থাকে, এই শ্রমণ-ব্রাহ্মণদের বাক্য যদি সত্যই হয়, তথাপি এই ব্যক্তি ইহ-জীবনে বিজ্ঞগণের প্রশংসা-ভাজন ‘এই পুরুষ শীলবান, সম্যক-দৃষ্টি সম্পন্ন, আস্তিকবাদী’। যদি পরলোক থাকে, তবে এই ব্যক্তির উভয়ত্র জয়লাভ, ইহলোকে বিজ্ঞগণের প্রশংসা লাভ আর কায়ভেদে মৃত্যুর পর সুগতি স্বর্গলোকে উৎপন্ন হয়। এইরূপে তাহার এই অপণ্নকধর্ম সুগ্রহণে গৃহীত হইয়া উভয়ান্ত (ইহ-পরলোক) স্ফুরণ করিয়া থাকে এবং অকুশলের কারণ বর্জ্জন করে।”

৯৭। (৩) “গৃহপতিগণ! কোন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ আছেন তাঁহারা এইরূপ বাদী ও এইরূপ দৃষ্টি সম্পন্ন,- ‘অন্যায় করিলে ও করাইলে, (স্বহস্তে বা আদেশে) ছেদন করিলে ও করাইলে, দণ্ডাঘাত করিলে ও করাইলে, শোকার্ত্ত করিলে, কষ্ট দিলে, বিচলিত করিলে ও করাইলে, প্রাণীহত্যা করিলে, চুরি করিলে, সন্ধিচ্ছেদ করিলে, গ্রাম লুণ্ঠন করিলে, ঘর বিলুণ্ঠন করিলে, পথে পথিকদের লুণ্ঠন করিলে, পরদার গমন করিলে, মিথ্যা বলিলে পাপ ধারণায় করিলেও পাপ করা হয় না। ধারাল ক্ষুরান্ত চক্রদ্বারা যদি কেহ এই পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীকে (মারিয়া) এক মাংস-রাশি, এক মাংস-পুঞ্জ করে, তবে সে কারণে তাহার কোন পাপ নাই; পাপের আগমন হয় না। যদি কেহ হত্যা, আঘাত, ছেদন, বেত্রাঘাত করিতে করিতে গঙ্গার দক্ষিণ তীর পর্যন্ত যায় তথাপি উহার দরুণ তাহার কোন পাপ নাই, পাপের আগমন হয় না। যদি কেহ দান দিয়া, দান করাইয়া, যজ্ঞ করিয়া, যজ্ঞ করাইয়া গঙ্গার উত্তর তীর পর্যন্ত পৌঁছে, তথাপি তজ্জন্য পুণ্য নাই, পুণ্যের আগমন হয় না’।”

(৪) “গৃহপতিগণ! তাহাদেরও সোজা বিরুদ্ধবাদী কোন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ আছে যাহারা বলে অন্যায় করিলে ও করাইলে ...... পূ ...... পাপ হইবে। ...... পূ ...... দান দিলে ও দেওয়াইলে ...... পূ ...... তাহার পুণ্য হইবে। ...... দান, দম, সংযম ও সত্যবাক্য দ্বারা পুণ্য হয় ও পুণ্যের আগম হয়। তোমরা কি মনে কর গৃহপতিগণ! এই সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণ পরস্পরের সোজা বিরুদ্ধবাদী নহে কি?”

“সত্যই ভন্তে।”

৯৮। (৫) “গৃহপতিগণ! যে সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণ এ কথা বলে ...... পূ ...... পাপ অকুশলধর্ম সম্ভূত হয় মিথ্যাদৃষ্টির কারণ। গৃহপতিগণ! বিজ্ঞপুুরুষ এই বিষয়ে চিন্তা করেন,- ‘যদি ক্রিয়ার ফল না থাকে তবে এই ব্যক্তি দেহত্যাগের পর নিজে স্বস্তি লাভ করিবে। যদি ক্রিয়ার ফল থাকে তবে এই পুরুষ দেহত্যাগে মরণের পর অপায় বিনিপাত নিরয়ে উৎপন্ন হইবে। বস্তুতঃ যদি ক্রিয়ার ফল না থাকে- এই সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণদের বাক্য সত্যই হয়, তথাপি এই ব্যক্তি ইহ-জীবনে দুঃশীল, মিথ্যাদৃষ্টি ও অক্রিয়াবাদী বলিয়া বিজ্ঞগণের নিন্দার্হ হয়। আর যদি ক্রিয়ার ফল নিশ্চয়ই থাকে তবে এই ব্যক্তির উভয়ত্র পরাজয়, যথা- ইহজীবনে বিজ্ঞগণের নিন্দা এবং দেহত্যাগে মরণের পর অপায় দুর্গতি ......।’ এই প্রকারে তাহার অপণ্নকধর্ম দুর্গ্রহণে গৃহীত, সে একাংশ স্ফুরণ করিয়া থাকে, কুশলের কারণ বর্জিত হয়।”

৯৯। (৬) “গৃহপতিগণ! যে সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণ এই মতবাদী ও এই দৃষ্টিসম্পন্ন- ন্যায় করিলে ও করাইলে ...... পূ ...... সম্যক্‌ দৃষ্টির প্রভাবে অনেক কুশলধর্ম সম্ভব হয়।”

(৭) “গৃহপতিগণ! এ বিষয়ে বিজ্ঞব্যক্তি চিন্তা করেন,- ‘যদি ক্রিয়ার ফল থাকে তবে এই ব্যক্তি দেহত্যাগে মরণের পর সুগতি স্বর্গলোকে উৎপন্ন হইবে। বস্তুতঃ ক্রিয়া যদি নাও থাকে এবং সেই সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণের বাক্য সত্যই বা হয়, তথাপি এই ব্যক্তি ইহ-জীবনে বিজ্ঞগণের প্রশংসনীয় হন- শীলবান, সম্যক্‌দৃষ্টি সম্পন্ন ও ক্রিয়াবাদী পুরুষ। এই প্রকারে এই ব্যক্তির ইহলোক-পরলোক উভয়ত্র জয়লাভ, যথা- ইহ জীবনে বিজ্ঞগণের প্রশংসা লাভ এবং দেহত্যাগে মরণের পর সুগতি স্বর্গলোকে উৎপত্তি।’ এই প্রকারে তাহার অপণ্নকধর্ম সুগ্রহণে গৃহীত, সে উভয়াংশ স্ফুরণ করিয়া থাকে, অকুশল-কারণ বর্জিত হয়।”

১০০। (৮) ‘গৃহপতিগণ! কোন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ এইরূপ বাদী ও দৃষ্টিসম্পন্ন,- ‘সত্ত্বগণের সংক্লেশের নিমিত্ত কোন হেতু এবং প্রত্যয় নাই। অহেতু-অপ্রত্যয়ে সত্ত্বগণ সংক্লিষ্ট হয়। সত্ত্বগণের বিশুদ্ধির নিমিত্ত কোন হেতু-প্রত্যয় নাই। অহেতু-অপ্রত্যয়ে সত্ত্বগণ বিশুদ্ধ হয়। (সত্ত্বগণের সংক্লেশ ও বিশুদ্ধির জন্য) বল নাই, বীর্য নাই, পুরুষাকার ও পুরুষ পরাক্রম কিছুই নাই। নিখিল সত্ত্ব, প্রাণী, ভূত, জীব (বীজ), অবশী, (অস্বাধীন), অবলী ও বীর্যহীন। নিয়তি (ভবিতব্যতা) সঙ্গতি স্বভাবে (বিভিন্ন রূপে) পরিণত হইয়া ষড়বিধ জাতিতে সুখ-দুঃখ ভোগ করিতে থাকে ......।’ গৃহপতিগণ! কোন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ ইহাদের সম্পূর্ণ বিরুদ্ধবাদী। তাহারা এইরূপ বলে,- ‘সত্ত্বগণের সংক্লেশের নিমিত্ত হেতু আছে, প্রত্যয় আছে। সহেতু-সপ্রত্যয়ে সত্ত্বগণ সংক্লিষ্ট হয়। সত্ত্বগণের বিশুদ্ধির নিমিত্ত হেতু ও প্রত্যয় আছে এবং সহেতু-সপ্রত্যয়ে সত্ত্বগণ বিশুদ্ধ হয়। উপযোগী বল, বীর্য, পুরুষাকার ও পুরুষ পরাক্রম আছে; সর্ব সত্ত্ব, প্রাণী, ভূত, জীব অবশী নহে, অবল নহে ও বীর্যহীন নহে; নিয়তি সঙ্গতি স্বভাবে বিবিধ আকারে পরিণত হইয়া সুখ-দুঃখ ভোগ করে না’। তোমরা কি মনে কর, গৃহপতিগণ! এই সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণেরা পরস্পর সোজা বিরুদ্ধবাদী নহে কি?”

“হাঁ, ভন্তে!”

১০১। (৯) “গৃহপতিগণ! এ বিষয়ে যাহারা বলে,- ‘সত্ত্বগণের সংক্লেশের কোন হেতু নাই ...... পূ ...... ছয় প্রকার জাতিতে সুখ-দুঃখ অনুভব করে; তাহাদের পক্ষে ইহা প্রত্যাশিত যে ...... পূ ...... তাহারা ত্রিবিধ অকুশলধর্ম গ্রহণ করিয়া আচরণ করিবে।’ তাহার কারণ কি? সেই শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণ অকুশলধর্ম সমূহের আদীনব (দোষ), অপকৃষ্টতা ও সংক্লেশ আর কুশলধর্ম সমূহের নিষ্কামে আনিসংশ (পুরস্কার) ও পবিত্রতা দেখিতে পায় না। ...... পূ ...... হেতু নাই, তাহার এই দৃষ্টি হয়, উহাতে তাহার মিথ্যাদৃষ্টি ...... পূ ...... এইরূপে অনেক অকুশলধর্ম সম্ভব হয় মিথ্যাদৃষ্টির দরুণ। গৃহপতিগণ! বিজ্ঞপুরুষ এ সম্বন্ধে চিন্তা করেন,- ‘যদি হেতু নাও থাকে ...... পূ ...... কুশল হেতু বর্জিত হয়’।”

১০২। (১০) “গৃহপতিগণ! কোন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ এই মতবাদী ও এই দৃষ্টিসম্পন্ন,- ‘সত্ত্বদের সংক্লেশের হেতু আছে ...... পূ ...... ছয় প্রকার জাতিতে সুখ-দুঃখ অনুভব করে না ...... পূ ...... তাহাদের পক্ষে এই আশা পোষণ করা উচিত যে তাহারা ...... পূ ...... কুশলধর্ম গ্রহণ করিয়া আচরণ করিবে’। ইহার কারণ? ...... পূ ...... হেতু আছে। তাহার এই দৃষ্টি হয়, আর উহা তাহার সম্যক্‌ দৃষ্টি ......পূ ...... এইরূপে অনেক কুশলধর্মের সম্ভব হয় সম্যক্‌ দৃষ্টির কারণ। গৃহপতিগণ! সেই বিষয়ে বিজ্ঞপুরুষ এই চিন্তা করে,- ‘যদি হেতু থাকে ...... পূ ...... অকুশল কারণ বর্জিত হয়’।”

১০৩। (১১) “গৃহপতিগণ! কোন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ এই বাদী ও এই দৃষ্টি সম্পন্ন হইয়া থাকে,- ‘অরূপ (নিরাকার) ব্রহ্মলোক সর্বতোভাবে নাই।’ গৃহপতিগণ! কোন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ তাহাদেরও সোজা বিরুদ্ধবাদী। তাহারা এইরূপ বলে,- ‘অরূপ ব্রহ্মলোক সর্বথা বিদ্যমান।’ তাহা কি মনে কর, গৃহপতিগণ! এই সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণ একে অন্যের সোজা বিরুদ্ধবাদী নহে কি?”

“হাঁ, ভন্তে!”

(১২) “গৃহপতিগণ! তথায় বিজ্ঞপুরুষ এই চিন্তা করেন,- ‘যে সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণ এইরূপ বাদী ও এইরূপ দৃষ্টিসম্পন্ন- অরূপ ব্রহ্মলোক সর্বথা বিদ্যমান নাই, ইহা আমার অদৃষ্ট। আর যে সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণ এইরূপ বাদী ও এইরূপ দৃষ্টি সম্পন্ন- অরূপ ব্রহ্মলোক সর্বথা বিদ্যমান আছে, ইহাও আমার অবিদিত। যদি আমি না জানিয়া না দেখিয়া একান্ত ধারণায় ব্যবহার করি- ইহাই সত্য, মিথ্যা অন্য- উহা আমার পক্ষে প্রতিরূপ (সঙ্গত) নহে। যে সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণ এইরূপ বাদী ও এইরূপ দৃষ্টি সম্পন্ন হয়- অরূপ ব্রহ্মলোক সর্বথা নাই। যদি তাহাদের সে কথা সত্য হয় তবে এই কারণ থাকিতে পারে যে, যে সকল দেবতা রূপবান, ধ্যানমনোময়, তথায় আমার অপণ্নক (দ্বিবিধা রহিত ভাবে) উৎপত্তি হইবে। যে সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণ এইরূপ বাদী ও এইরূপ দৃষ্টি সম্পন্ন হয়- আরূপ্য সর্বথা আছে। যদি তাহাদের এই বাক্য সত্য হয়, তবে এই কারণ থাকিতে পারে যে, যে সকল দেবতা রূপহীন (অজড়) ধ্যানসংজ্ঞাময়, উহাতে আমার অপণ্নক উৎপত্তি হইবে। তাহা রূপের নিমিত্ত (রূপনিবন্ধন) দণ্ড গ্রহণ, শস্ত্র গ্রহণ, কলহ, বিগ্রহ, বিবাদ, তুমি-তুমি (আমি-আমি), পিশুন ও মিথ্যাবাক্য প্রভৃতি দেখা যায়। কিন্তু আরূপ্যে উহা সর্বথা থাকে না।’ এই চিন্তা করিয়া সে যাবতীয় রূপের নির্বেদের জন্য, অনুরাগ ত্যাগের জন্য ও নিরোধের নিমিত্ত প্রতিপন্ন হয়।”

১০৪। (১৩) ‘গৃহপতিগণ! কোন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ এইরূপ মতবাদী ...... পূ ...... হয়,- ‘ভবনিরোধ (জন্ম-মৃত্যুর অন্ত, নির্বান) সর্বথা নাই।’ গৃহপতিগণ! সেই সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণদের কোন কোন ঋজু বিপরীত বাদীরা এইরূপ বলে,- ‘ভবনিরোধ সর্বথা (অবশ্যই) আছে।’ তাহা কি মনে কর, গৃহপতিগণ! তাহারা একে অন্যের সোজা বিরুদ্ধবাদী নহে কি?”

“নিশ্চয়, ভন্তে!”

“তাহাতে, গৃহপতিগণ! বিজ্ঞপুরুষ এই বিচার করে,- ‘ভবনিরোধ ...... সর্বথা নাই, অপর পক্ষে ভবনিরোধ সর্বথা আছে; উভয় পক্ষ আমার অদৃষ্ট ও অজ্ঞাত, ...... পূ ...... যদি আমি না জানিয়া না দেখিয়া- ইহাই সত্য, উহা মিথ্যা- একান্তভাবে গ্রহণ করিয়া ব্যবহার করি, তবে তাহা আমার উচিত হইবে না। যে সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণ এইরূপ মতবাদী ও এইরূপ দৃষ্টি সম্পন্ন-সর্বতোভাবে ভবনিরোধ নাই। যদি সেই শ্রমণ-ব্রাহ্মণদের বাক্য সত্য হয়; এই কারণ থাকিতে পারে যে, যে সকল নিরাকার (অরূপ) দেবতা অরূপ ধ্যানসংজ্ঞা দ্বারা সংজ্ঞাময়, তথায় আমার অপণ্নক বা অবিরুদ্ধ উৎপত্তি হইবে। আর যে সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণ এইরূপ মতবাদী ও এইরূপ মতাবলম্বী- সর্বতোভাবে ভবনিরোধ (নির্বান) আছে। যদি সেই সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণদের বাক্য সত্য হয়, তবে ইহার সম্ভাবনা বিদ্যমান যে ইহ-জীবনেই পরিনির্বান প্রাপ্ত হইব। যে সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণ এইরূপ মতবাদী ও এইরূপ দৃষ্টি অবলম্বী- সর্বতোভাবে ভবনিরোধ (নির্বান) নাই। তাহাদের এই দৃষ্টি বা ধারণা সংসারাবর্তে অনুরাগের নিকট, সংযোজনের সমীপে, অভিনন্দনের সমীপে, প্রার্থনার (কামনার) সমীপে ও উপাদান বা গ্রহণের সমীপে (লইয়া যাইয়া) সহায়তা করে। কিন্তু যে সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণ এরূপ বাদী ও এরূপ মতাবলম্বী- সর্বতোভাবে ভবনিরোধ আছে। তাহাদের সেই সিদ্ধান্ত সংসারাবর্তের প্রতি বিরাগের, সংযোজন ক্ষয়ের, অভিনন্দন রহিতের ও অপ্রণিধির নিকটে অনুপাদানের সমীপস্থ (হইয়া অনুপ্রেরণা দেয়)। সুতরাং সে ইহা বুঝিতে পারিয়া যাবতীয় ভবেরই (জন্ম-মৃত্যুর) নির্বেদ, বিরাগ এবং নিরোধের নিমিত্ত আত্মনিয়োগ করে।”

১০৫। “গৃহপতি! লোকে এই চারি প্রকার পুরুষ (পুদ্গল) বিদ্যমান। সেই চারি কি কি? গৃহপতিগণ! কোন কোন ব্যক্তি আত্মন্তপ, আত্মপরিতাপানুয়োগে নিযুক্ত। কোন কোন ব্যক্তি পরসন্তাপী, পর সন্তাপজনক কার্যে নিযুক্ত। কোন কোন ব্যক্তি আত্মন্তপ, আত্মপরিতাপানুযোগে নিযুক্ত এবং পরন্তপ, পর পরিতাপানুযোগে নিযুক্ত। কোন কোন ব্যক্তি আত্মন্তপ নহে, আত্মন্তপ কার্যেও নিয়োজিত নহে এবং পরন্তপ নহে, পর পরন্তপজনক কার্যেও নিয়োজিত নহে। সেই অনাত্মন্তপ, অপরন্তপ ব্যক্তি ইহ-জীবনে তৃষ্ণামুক্ত, নির্বাপিত, শীতিভূত, স্বয়ং সুখ সংভোগ করিতে করিতে ব্রহ্মভূত হইয়া অবস্থান করে।”

১০৬। “গৃহপতি! কোন্‌ ব্যক্তি আত্মন্তপ, আত্মপরিতাপানুযোগে নিযুক্ত?” [কন্দরক সূত্রে ৭নং দ্রষ্টব্য]।

“গৃহপতি! কোন্‌ ব্যক্তি পরসন্তাপী, পর সন্তাপজনক কার্যে নিযুক্ত?” [কন্দরক সূত্রে ৮নং দ্রষ্টব্য]।

“গৃহপতি! কোন্‌ ব্যক্তি আত্মন্তপ, আত্মপরিতাপানুযোগে নিযুক্ত এবং পরন্তপ, পর পরিতাপানুযোগে নিযুক্ত?” [কন্দরক সূত্রে ৯নং দ্রষ্টব্য]।

“গৃহপতি! কোন্‌ ব্যক্তি আত্মন্তপ নহে, আত্মন্তপ কার্যেও নিয়োজিত নহে এবং পরন্তপ নহে, পর পরন্তপজনক কার্যেও নিয়োজিত নহে? কে সেই অনাত্মন্তপ, অপরন্তপ যে ইহজীবনে তৃষ্ণামুক্ত, নির্বাপিত, শীতিভূত, স্বয়ং সুখ-সংভোগ করিতে করিতে ব্রহ্মভূত হইয়া অবস্থান করে?” [কন্দরক সূত্রে ১০ নম্বরে-‘স্বয়ং ব্রহ্মভূত হইয়া অবস্থান করেন’ পর্যন্ত দ্রষ্টব্য]।

এইরূপে উক্ত হইলে শালানিবাসী ব্রাহ্মণ গৃহপতিগণ ভগবানকে বলিলেন,- “আশ্চর্য, হে গৌতম! অতি চমৎকার, হে গৌতম! ...... পূ ...... আজ হইতে আমাদিগকে শরণাগত উপসাকরূপে গ্রহণ করুন।”

॥ অপণ্নক সূত্র সমাপ্ত ॥

॥ প্রথম গৃহপতিবর্গ সমাপ্ত ॥