(ত্যাগময় গৃহস্থ-জীবন)
২৮২। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-
এক সময় ভগবান মহৎ ভিক্ষুসংঘের সহিত কোশল জনপদে চারিকায় (ধর্ম প্রচারার্থ) ভ্রমণ করিতেছেন।
তখন ভগবান মার্গ হইতে সরিয়া একস্থানে (দাঁড়াইয়া) স্মিত-হাসি প্রকাশ করিলেন।
তখন আয়ুষ্মান আনন্দের মনে হইল,- “কি হেতু, কি প্রত্যয় ভগবানের স্মিত-হাসি প্রকাশের? তথাগতগণ অকারণে স্মিত-হাসি প্রকাশ করেন না।”
তখন আয়ুষ্মান আনন্দ এক অংসে (বামস্কন্ধে) চীবর রাখিয়া যেদিকে ভগবান ছিলেন সেদিকে যুক্তাঞ্জলি প্রণামপূর্বক ভগবানকে বলিলেন,- “ভন্তে! ভগবানের স্মিত-হাসি প্রকাশের কি হেতু, কি প্রত্যয়? ভন্তে! তথাগতগণ অকারণে মৃদু হাসেন ন।”
“আনন্দ! পূর্বকালে এই প্রদেশে সমৃদ্ধ, স্ফীত বহু জনমানবাকীর্ণ বেহলিঙ্গ নামক গ্রাম-নিগম ছিল। বেহলিঙ্গ গ্রাম-নিগমের সমীপে ভগবান কশ্যপ অর্হৎ সম্যক্সম্বুদ্ধ বিহার করিতেন। আনন্দ! এখানে তাঁহার আরাম ছিল এবং এখানে ভগবান কশ্যপ অর্হৎ সম্যক্সম্বুদ্ধ উপবেশন করিয়া ধর্মোপদেশ করিয়াছেন।”
তখন আয়ুষ্মান আনন্দ চতুর্গুণ (করিয়া) সংঘাটি বিছাইয়া ভগবানকে বলিলেন,- “তাহা হইলে প্রভূ! ভগবান এস্থানে বসুন, এই প্রকারে এই স্থান দুই মহৎ সম্যক্সম্বুদ্ধের ব্যবহৃত হইবে।”
ভগবান প্রজ্ঞাপ্ত আসনে বসিলেন, বসিয়া ভগবান আয়ুষ্মান আনন্দকে আহ্বান করিলেন,- “আনন্দ! অতীতকালে ...... এই প্রদেশে বেহলিঙ্গ নামক ...... গ্রাম-নিগম ছিল। বেহলিঙ্গ সমীপে ভগবান কশ্যপ অর্হৎ সম্যক্সম্বুদ্ধের আরাম ছিল। এখানেই আনন্দ! কশ্যপ সম্যক্সম্বুদ্ধ বসিয়া ভিক্ষুসংঘকে উপদেশ দিতেন।”
২৮৩। “আনন্দ! বেহলিঙ্গ গ্রাম-নিগমে ঘটিকার নামক কুম্ভকার ভগবান কশ্যপের উপাসক (সেবক) ছিল; অগ্র উপস্থাতা (প্রধান সেবক) ছিল। ঘটিকার কুম্ভকারের জ্যোতিপাল নামক মাণবক (ব্রাহ্মণ কুমার) সহায় ছিল, প্রিয় সহায়। তখন আনন্দ! ঘটিকার কুম্ভকার জ্যোতিপাল মাণবককে আহ্বান করিল,- ‘সৌম্য জ্যোতিপাল! চল আমরা ভগবান কশ্যপকে দর্শনার্থ গমন করি। সেই ভগবান অর্হৎ সম্যক্সম্বুদ্ধের দর্শন সাধু সম্মত।’
এরূপ উক্ত হইলে আনন্দ! জ্যোতিপাল মাণবক ঘটিকার কুম্ভকারকে ইহা বলিল,- ‘অপ্রয়োজন সৌম্য ঘটিকার! সেই মুণ্ডক শ্রমণকে দর্শনের কি ফল?’
দ্বিতীয়বার তৃতীয়বারও এই আলোচনা হইল।
‘ ...... তাহা হইলে চলুন জ্যোতিপাল! ্লানীয় সোত্তি লইয়া আমরা ্লান করিবার জন্য নদীতে গমন করিব।’
‘ভাল, সৌম্য!’ (বলিয়া) জ্যোতিপাল মাণবক ঘটিকার কুম্ভকারকে প্রত্যুত্তর দিল।
তখন আনন্দ! ঘটিকার কুম্ভকার ও জ্যোতিপাল মাণবক ্লানীয় সোত্তি লইয়া ্লানের নিমিত্ত নদীতে গেল।”
২৮৪। “তখন আনন্দ! ঘটিকার কুম্ভকার জ্যোতিপাল মাণবককে বলিল,- ‘সৌম্য জ্যোতিপাল! এই সমীপেই ভগবান কশ্যপের আরাম, চল সৌম্য জ্যোতিপাল! ...... সেই ভগবানের.....দর্শন সাধু সম্মত।’
ইহা উক্ত হইলে আনন্দ! জ্যোতিপাল মাণবক ঘটিকার কুম্ভকারকে বলিল,- ‘রাখিয়া দাও সৌম্য ঘটিকার! ......।’
দ্বিতীয়বার তৃতীয়বারও ......।
তখন আনন্দ! ঘটিকার কুম্ভকার জ্যোতিপাল মাণবককে কাপড়ে বেষ্টন করিয়া বলিল,- ‘সৌম্য জ্যোতিপাল! এই যে পার্শ্বেই ভগবান কশ্যপের আরাম, চল সৌম্য জ্যোতিপাল! ...... সেই ভগবানের দর্শন সাধু সম্মত।’
তখন আনন্দ! জ্যোতিপাল মাণবক কাপড়ের বেষ্টন খুলিয়া ঘটিকার কুম্ভকারকে বলিল,- ‘অপ্রয়োজন সৌম্য ঘটিকার!...।’
তখন আনন্দ! ঘটিকার কুম্ভকার সশীর্ষ ্লাত জ্যোতিপাল মাণবককে কেশে স্পর্শ করিয়া বলিল,- ‘সৌম্য জ্যোতিপাল! এই যে সমীপে ভগবান কশ্যপের আরাম, ...... দর্শন সাধু সম্মত।’
তখন আনন্দ! জ্যোতিপাল মাণবকের এই চিন্তা হইল,- ‘একান্তই আশ্চর্য, ভো! একান্তই অদ্ভুত, ভো! যেখানে ঘটিকার কুম্ভকার ইতর (নীচ) জাতি হইয়াও সশীর্ষ ্লাত আমার কেশে স্পর্শ করিবার সাহস করিয়াছে। বোধ হয় ইহা নিতান্ত তুচ্ছ বিষয় না হইবে।’ ঘটিকার কুম্ভকারকে বলিল,- ‘বেশ, এ পর্যন্ত বন্ধু ঘটিকার?’
‘হাঁ, এ পর্যন্ত বন্ধু জ্যোতিপাল সেই ভগবানের দর্শন সাধু সম্মত হয়।’
‘তাহা হইলে বন্ধু ঘটিকার! ছাড়, চল যাইব’।”
২৮৫। “তখন আনন্দ! ঘটিকার কুম্ভকার ও জ্যোতিপাল মাণবক যেখানে ভগবান কশ্যপ অর্হৎ সম্যক্সম্বুদ্ধ আছেন তথায় উপনীত হইলেন, উপস্থিত হইয়া ঘটিকার কুম্ভকার কশ্যপ ...... ভগবানকে অভিবাদন করিয়া একান্তে বসিল। জ্যোতিপাল মাণবকও কশ্যপ ...... ভগবানের সহিত সম্মোদন করিয়া ...... একান্তে বসিল।
আনন্দ! একপ্রান্তে উপবিষ্ট ঘটিকার কুম্ভকার কশ্যপ ভগবানকে বলিল,- ‘ভন্তে! এই জ্যোতিপাল মাণবক আমার সহায়, প্রিয় সহায়। তাহাকে ভগবন! ধর্মোপদেশ করুন।’
তখন আনন্দ! ভগবান কশ্যপ ...... ঘটিকার কুম্ভকার ও জ্যোতিপাল মাণবককে ধার্মিক কথা দ্বারা সন্দর্শিত , সমাদাপিত , সমুত্তেজিত , সমপ্রহর্ষিত করিলেন।
তখন আনন্দ! ঘটিকার কুম্ভকার ও জ্যোতিপাল মাণবক কশ্যপ ভগবানের ধর্মীয় কথা দ্বারা ...... সমপ্রহর্ষিত হইয়া কশ্যপ ...... ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন ও অনুমোদন করিল এবং আসন হইতে উঠিয়া ভগবান কশ্যপকে অভিবাদন ও প্রদক্ষিণ করিয়া প্রস্থান করিল।”
২৮৬। “তখন আনন্দ! জ্যোতিপাল মাণবক ঘটিকার কুম্ভকারকে বলিল,- ‘আহা, বন্ধু ঘটিকার! ধর্ম শুনিয়াও তুমি আগার হইতে অনাগারিক প্রব্রজিত হইলে না।’
‘কেন, সৌম্য জ্যোতিপাল! তুমি কি আমাকে জান না? অন্ধ বৃদ্ধ মাতা-পিতাকে আমি যে ভরণ-পোষণ করি?’
‘তবে সৌম্য ঘটিকার! আমি আগার ছাড়িয়া অনাগারিক প্রব্রজিত হইব।’
আনন্দ! তখন ঘটিকার কুম্ভকার ও জ্যোতিপাল মাণবক যেখানে ভগবান কশ্যপ আছেন তথায় গেলেন, উপনীত হইয়া...। একপ্রান্তে উপবিষ্ট ঘটিকার কুম্ভকার ভগবান কশ্যপকে নিবেদন করিলেন,- ‘এই যে ভন্তে! আমার প্রিয় সহায় জ্যোতিপাল মাণবক, ভগবন! তাহাকে প্রব্রজিত করুন।’
আনন্দ! জ্যোতিপাল মাণবক ভগবান কশ্যপ সমীপে প্রব্রজ্যা ও উপসম্পদা লাভ করিল ।”
২৮৭। “তখন আনন্দ! জ্যোতিপালের উপসম্পদার (ভিক্ষু হইবার) অল্প-সময়- অর্ধমাস পর ভগবান কশ্যপ বেহলিঙ্গে অভিরুচি অনুযায়ী বাস করিয়া বারাণসীর দিকে যাত্রা করিলেন, ক্রমশঃ বিচরণ করিতে করিতে যেখানে বারাণসী তথায় পৌঁছিলেন। তথায় আনন্দ! কশ্যপ ভগবান বারাণসীর ঋষিপতন মৃগদাবে বিহার করিতেছেন।
আনন্দ! কাশীরাজ কিকী শুনিলেন যে ভগবান কশ্যপ বারাণসীর ঋষিপতন মৃগদাবে বিহার করিতেছেন। তখন কাশীরাজ কিকী উত্তমোত্তম যান (রথ) সাজাইয়া স্বয়ং এক উত্তম যানে আরোহণ করিয়া উত্তম যান সঙ্গে লইয়া কশ্যপ ভগবানকে দর্শনার্থ মহৎ রাজানুভাবে বারাণসী হইতে বাহির হইলেন। যতদূর যানের রাস্তা ছিল ততদূর যানে গিয়া পুনঃ যান হইতে অবতরণ পূর্বক পদব্রজে যেখানে ভগবান কশ্যপ ছিলেন সেখানে গেলেন, উপস্থিত হইয়া ভগবান কশ্যপকে অভিবাদন পূর্বক একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট কাশীরাজ কিকীকে ভগবান কশ্যপবুদ্ধ ধর্মকথায় সমুত্তেজিত, প্রহর্ষিত করিলেন। তখন ভগবান কশ্যপ দ্বারা প্রহর্ষিত হইয়া কাশীরাজ কিকী ভগবানকে বলিলেন,- ‘ভন্তে! ভিক্ষুসংঘ সহ আগামীকালের জন্য আমার (বাড়ীতে) ভোজন গ্রহণ করুন।’ ভগবান কশ্যপ তুষ্ণীভাবে নিমন্ত্রণ স্বীকার করিলেন।
আনন্দ! তখন কাশীরাজ কিকী ভগবান কশ্যপের স্বীকৃতি অবগত হইয়া আসন হইতে উঠিয়া ভগবান কশ্যপকে অভিবাদন ও প্রদক্ষিণ করিয়া প্রস্থান করিলেন।
তৎপর আনন্দ! কাশীরাজ কিকী সেই রাত্রি প্রভাত হইলে স্বীয় প্রাসাদে উৎকৃষ্ট খাদ্য-ভোজ্য সজ্জিত করিয়া কালিমা-রহিত পান্তমুটিক (লাল ধানের ভাত, বিনীভাত?) শালির উৎকৃষ্ট খাদ্য-ভোজ্য ও অনেক ব্যঞ্জন সজ্জিত করাইয়া ভগবান কশ্যপকে (ভোজনের) কাল নিবেদন করিলেন,- ‘ভন্তে! এখন ভোজনের সময়, অন্ন প্রস্তুত হইয়াছে’।”
২৮৮। “অতঃপর আনন্দ! কশ্যপ ভগবান পূর্বাহ্ন সময়ে নিবাসন পরিধান করিয়া পাত্র-চীবর ধারণ করিয়া ভিক্ষুসংঘ সহ কাশীরাজ কিকীর প্রাসাদে উপস্থিত হইলেন এবং প্রজ্ঞাপ্ত আসনে উপবেশন করিলেন। আনন্দ! তখন, কাশীরাজ কিকী বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষুসংঘকে স্বহস্তে উৎকৃষ্ট খাদ্য-ভোজ্য দ্বারা সন্তর্পিত (সন্তৃপ্ত) ও সমপ্রবারিত করিলেন।
তখন আনন্দ! ভগবান কশ্যপ ভোজন সমাপ্ত করিয়া হাত পাত্র হইতে অপনীত করিলে কাশীরাজ কিকী এক নীচ আসন লইয়া একপ্রান্তে বসিলেন, একপ্রান্তে উপবিষ্ট কাশীরাজ কিকী ভগবান কশ্যপকে বলিলেন,- ‘ভন্তে! বারাণসীতে বর্ষাবাস স্বীকার করুন। এই প্রকারে (আমাদের পক্ষে) সংঘ সেবার সুযোগ হইবে।’
‘না, মহারাজ! আমার বর্ষাবাস স্বীকৃত হইয়াছে।’
দ্বিতীয়বার তৃতীয়বারও ......।
তখন আনন্দ! ‘ভগবান কশ্যপ বারাণসীতে বর্ষাবাসের নিমন্ত্রণ স্বীকার করিতেছেন না’- এই চিন্তায় কাশীরাজ কিকীর দুঃখ হইল, দৌর্মনস্য হইল।
তখন আনন্দ! কাশীরাজ কিকী ভগবান কশ্যপকে বলিলেন,- ‘কেমন ভন্তে! আমা অপেক্ষাও আপনার কোন উত্তম সেবক আছে কি?’
‘মহারাজ! বেহলিঙ্গ নামক গ্রাম-নিগম আছে, তথায় ঘটিকার নামক কুম্ভকার বাস করে, সে আমার অগ্র-উপস্থাতা। মহারাজ!- ভগবান বারাণসীতে বর্ষাবাসার্থ আমার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করিলেন না- এই চিন্তায় আপনার অন্যথা ভাব ও দৌর্মনস্য হইয়া থাকিবে। কিন্তু ঘটিকার কুম্ভকারের ইহা হয় না, হইবেও না। মহারাজ! ঘটিকার কুম্ভকার বুদ্ধের শরণাগত হইয়াছে, ধর্মের শরণাগত হইয়াছে, সংঘের শরণাগত হইয়াছে। মহারাজ! ঘটিকার কুম্ভকার প্রাণাতিপাত (হিংসা) হইতে বিরত, অদত্তাদান (চুরি) হইতে বিরত, কামে মিথ্যাচার হইতে বিরত, মৃষাবাদ হইতে বিরত, সুরা মেরেয়-মদ্য-প্রমাদস্থান (নেশার-বস্তু) হইতে বিরত আছে। মহারাজ! ঘটিকার কুম্ভকার বুদ্ধের প্রতি অতীব শ্রদ্ধাযুক্ত, ধর্মের প্রতি ও সংঘের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাযুক্ত; আর্য-কান্তশীল (সুন্দর সদাচার) যুক্ত। মহারাজ! ঘটিকার কুম্ভকার দুঃখসত্যে নিঃসংশয়, দুঃখসমুদয়ে নিঃসংশয়, দুঃখনিরোধে নিঃসংশয়, দুঃখনিরোধগামিনী প্রতিপদায় সংশয় রহিত। ...... একাহারী, ব্রহ্মচারী, শীলবান, কল্যাণধর্ম (পুণ্যাত্মা)। মহারাজ! ঘটিকার কুম্ভকার মণি-সুবর্ণ ত্যাগী, জাত-রূপ-রজত গ্রহণ বিরহিত। মহারাজ! ঘটিকার কুম্ভকার মুষল (মাটিকাটা বা খননের যন্ত্র) ত্যাগী, স্বহস্তে পৃথিবী খনন করে না। তাহার গৃহাশ্রিত (কুলুপলগ্ন) মুষিক বা কুকুর যাহা আছে, তাহাদের খাদ্য সংগ্রহ করিয়া ভাজনে রাখিয়া এরূপ বলে,- এখানে পরিশুদ্ধ তণ্ডুল, মুগ বা মটর ছাড়িয়া অবশিষ্ট যার যাহা ইচ্ছা হয় তাহা নিয়া যাও। মহারাজ! ঘটিকার কুম্ভকার অন্ধ ও বয়ঃবৃদ্ধ পিতা-মাতাকে পোষণ করে। মহারাজ! ঘটিকার কুম্ভকার পঞ্চবিধ অধঃভাগীয় সংযোজনের ক্ষয় করিয়া উপপাতিক বা ব্রহ্মপরায়ণ হইয়াছে, সেই ব্রহ্মলোক হইতে পুনরাবর্তন করিবে না; তথায় সে পরিনির্বান লাভী হইয়াছেন।”
২৮৯। “মহারাজ! এক সময় আমি বেহলিঙ্গে বিহার করিতেছি। তখন আমি পূর্বাহ্ন সময়ে নিবাসন পরিয়া পাত্র-চীবর ধারণ করিয়া যেখানে ঘটিকার কুম্ভকারের মাতা-পিতা আছে, তথায় পৌঁছিলাম এবং কুম্ভকারের মাতা-পিতাকে বলিলাম,- ‘ওহে! এই ভার্গব কোথায় গিয়াছে?’
‘ভন্তে! আপনার সেবক বাহিরে গিয়াছে, এই কুম্ভী (পাতিল) হইতে অন্ন ও পরিযোগ (তেলানী) হইতে সূপ (ডাল, ব্যঞ্জন) লইয়া ভোজন করুন।’
তখন মহারাজ! আমি কুম্ভী হইতে ভাত আর পরিযোগ হইতে তরকারী গ্রহণ করিয়া ভোজন শেষে আসন ছাড়িয়া চলিয়া আসিলাম। মহারাজ! তৎপর ঘটিকার কুম্ভকার তাহার মাতা-পিতার নিকট উপস্থিত হইল এবং তাহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিল,- ‘কে কুম্ভী হইতে ভাত ও পরিযোগ হইতে সূপ খাইয়া গেল?’
‘তাত! কশ্যপ অর্হৎ সম্যক্সম্বুদ্ধ ......।’
তখন মহারাজ! ঘটিকার কুম্ভকারের মনে এই হইল,- আমার বড়ই সৌভাগ্য, আমার একান্তই সুলাভ; কেননা আমার উপর ভগবান কশ্যপের এতদূর অনুগ্রহ আছে।’ তখন সেই প্রীতি-সুখ অর্ধমাস যাবৎ কুম্ভকারকে ও সপ্তাহ যাবৎ মাতা-পিতাকে নিরন্তর সুপ্রসন্ন রাখিল।”
২৯০। “মহারাজ! একবার আমি সেই বেহলিঙ্গ গ্রাম-নিগমে বাস করিতেছি। তখন পূর্বাহ্ন সময়ে নিবাসন পরিধান করিয়া পাত্র-চীবর লইয়া ঘটিকারের মাতা-পিতার নিকট গিয়াছিলাম, গিয়া তাহাদিগকে বলিলাম,- ‘ওহে! এই ভার্গব কোথায় গিয়াছে?’ ...... ।
তখন মহারাজ! আমি কলোপি (ভোজন) হইতে কুল্মাষ (কাঞ্জিকা?) ও পরিযোগ হইতে সূপ লইয়া ভোজন করিয়া চলিয়া আসিলাম ......। এই প্রীতি-সুখ কুম্ভকারের এক পক্ষ, মাতা-পিতার সপ্তাহকাল নিরন্তর ছিল।”
২৯১। “একদিন মহারাজ! সেই বেহলিঙ্গ গ্রাম-নিগমে বাস করিতেছি। সেই সময় (আমার) গন্ধকুটি ভিজিয়া গেল। তখন আমি ভিক্ষুদিগকে আহ্বান করিলাম,- ‘ভিক্ষুগণ! ঘটিকারের গৃহে শণতৃণ অন্বেষণ কর।’ ইহা বলিলে তাহারা আমাকে বলিল যে ‘ভন্তে! কুম্ভকারের গৃহে তৃণ নাই। অথচ তাহার সদ্য তৃণ-আচ্ছাদিত আবেসন (কর্মশালা) আছে।’ ‘যাও, ভিক্ষুগণ! ঘটিকারের আবেসন তৃণমুক্ত কর।’ তখন মহারাজ! ভিক্ষুরা গিয়া কুম্ভকারের সদ্য আচ্ছাদিত আবেসন তৃণহীন করিতেছে। এমন সময় ঘটিকার কুম্ভকারের মাতা-পিতা ভিক্ষুদিগকে জিজ্ঞাসা করিল,- ‘কাঁহারা ঘরের আচ্ছাদন খুলিতেছেন?’ ভিক্ষুগণ,- ভগিনি! ভগবান কশ্যপের গন্ধকুটি ভিজিয়া গিয়াছে।’ ‘নিয়া যান, ভন্তে! নিয়া যান, ভদ্রমুখগণ!’
তখন মহারাজ! ঘটিকার কুম্ভকার মাতা-পিতার নিকট আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল,- ‘কে আবেসন তৃণশূন্য (ছানিহীন) করিল?’
‘ভিক্ষুগণ, বৎস! ভগবান কশ্যপের ...... গন্ধকুটি ভিজিয়া গিয়াছে।’
তখন মহারাজ! ঘটিকার কুম্ভকারের এরূপ হইল,- ‘বড়ই সৌভাগ্য আমার,..... মাতা-পিতার সপ্তাহ ব্যাপি নিরন্তর....।
অতঃপর মহারাজ! সে কুম্ভকারশালা সারা তিনমাস আকাশাচ্ছন্ন ছিল, কিন্তু ভিজিল না। মহারাজ! এই প্রকারের ঘটিকার কুম্ভকার।”
“ভন্তে! ঘটিকার কুম্ভকারের লাভ, সুলাভ, মহাসৌভাগ্য লাভ হইয়াছে, যাহার প্রতি ভগবান এতই সুপ্রসন্ন (সদয়)।”
২৯২। “অতঃপর আনন্দ! কিকী কাশীরাজ ঘটিকার কুম্ভকার সমীপে পান্তমুটিক শালির চাউল-বাহী পঞ্চশত শকট আর তদনুরূপ সূপের বস্তু পাঠাইলেন। তখন আনন্দ! রাজ কর্মচারীগণ ঘটিকার কুম্ভকারের নিকট গিয়া বলিল,- ‘মহাত্মন্! এই পাঁচশত (শকট-বাহ্য) বাহ পান্তমুটিকের তণ্ডুল আর উহার অনুরূপ সূপের উপকরণ কাশীরাজ কিকী আপনার নিকট পাঠাইয়াছেন। আপনি এ সমস্ত গ্রহণ করুন’।”
“রাজার বহুকৃত্য, বহু করণীয় আছে; (তাহা) রাজারই হউক, আমার প্রয়োজন নাই।”
“আনন্দ! তোমার কি এইরূপ মনে হইল,- সেই সময় জ্যোতিপাল মাণবক অপর কেহ হইবে? আনন্দ! সে ধারণা করিবে না, আমিই সেই জ্যোতিপাল মাণবক ছিলাম।”
ভগবান ইহা বলিলেন, আয়ুষ্মান আনন্দ সন্তুষ্ট চিত্তে ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন করিলেন।
॥ ঘটিকার সূত্র সমাপ্ত ॥
(ভোগের অসারতা, ত্যাগময় ভিক্ষুজীবন)
২৯৩। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-
এক সময় ভগবান মহাভিক্ষুসংঘের সহিত কুরুপ্রদেশে (ধর্ম প্রচারার্থ) বিচরণ করিতে করিতে যেখানে থুল্লকোট্টিত নামক কুরুদের নিগম তথায় পৌঁছিলেন।
থুল্লকোট্টিত (স্থূল কোষ্টিত) বাসী ব্রাহ্মণ-গৃহপতিগণ শুনিলেন যে,- ‘শাক্যপুত্র ...... শ্রমণ গৌতম থুল্লকোট্টিতে উপস্থিত হইয়াছেন। ...... তদ্রূপ অর্হতের দর্শন সাধু (ভাল) হয়।’ তখন থুল্লকোট্টিতের ব্রাহ্মণ-গৃহপতিরা যেখানে ভগবান আছেন তথায় গেলেন, গিয়া কেহ কেহ ভগবানকে অভিবাদন পূর্বক একপ্রান্তে বসিলেন। ...... কেহ কেহ নীরবে একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট থুল্লকোট্টিতবাসী ব্রাহ্মণ-গৃহপতিদিগকে ভগবান ধর্মকথা দ্বারা সন্দর্শিত, সমাদাপিত, সমুত্তেজিত, সংপ্রহর্ষিত করিলেন।
২৯৪। সেই সময় থুল্লকোট্টিতের অগ্রকুলিকের পুত্র রাষ্ট্রপাল সেই পরিষদে উপবিষ্ট ছিলেন। তখন তাঁহার মনে এই হইল- ‘যে প্রকারে ভগবান ধর্মদেশনা করিতেছেন, এই একান্ত পরিপূর্ণ, অত্যন্ত পরিশুদ্ধ, লিখিত শঙ্খ-শুভ্র ব্রহ্মচর্য পালন করা গৃহীর পক্ষে সুকর নহে। সুতরাং আমি কেশ-শ্মশ্রু মুণ্ডন করিয়া, কাষায়-বস্ত্র পরিধান পূর্বক আগার হইতে অনাগারিক প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিনা কেন?’ তখন থুল্লকোট্টিতবাসী ব্রাহ্মণ-গৃহপতিগণ ভগবান কর্তৃক ...... সমুত্তেজিত ...... প্রহৃষ্ট হইয়া ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন, অনুমোদন করিয়া আসন হইতে উঠিলেন এবং ভগবানকে অভিবাদন ও প্রদক্ষিণ করিয়া প্রস্থান করিলেন। তখন ...... ব্রাহ্মণ-কুলপুত্রদের চলিয়া যাইবার অনন্তর পর রাষ্ট্রপাল কুলপুত্র যেখানে ভগবান আছেন তথায় গেলেন, গিয়া ভগবানকে অভিবাদন পূর্বক একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট রাষ্ট্রপাল ভগবানকে বলিলেন,- “ভন্তে! ভগবান কর্তৃক দেশিত ধর্মকে আমি যে যে ভাবে অবগত হইয়াছি, এই ...... শঙ্খ-শুভ্র ব্রহ্মচর্য পালন করা গৃহবাসীর পক্ষে সহজ নহে। অতএব ভন্তে! আমি ভগবানের নিকট প্রব্রজ্যা প্রার্থনা করি, উপসম্পদা প্রার্থনা করি।”
“রাষ্ট্রপাল! তুমি আগার হইতে অনাগারিক প্রব্রজ্যার জন্য মাতা-পিতা হইতে অনুমতি পাইয়াছ কি?”
“ভন্তে! অনুমতি পাই নাই।”
“রাষ্ট্রপাল! তথাগতগণ মাতা-পিতার অনুমতি বিনা কাহাকেও প্রব্রজ্যা দেন না।”
“ভন্তে! আমি তাহাই করিব, যাহাতে মাতা-পিতা আমাকে প্রব্রজ্যার নিমিত্ত অনুমতি দেন।”
২৯৫। তখন রাষ্ট্রপাল কুলপুত্র আসন হইতে উঠিয়া ভগবানকে অভিবাদন ও প্রদক্ষিণ করিয়া যেখানে মাতা-পিতা ছিলেন তথায় গেলেন, গিয়া মাতা-পিতাকে বলিলেন,- “অম্মা তাত! আমি ভগবানের উপদিষ্ট ধর্মকে যে যে ভাবে বুঝিয়াছি, এই ...... শঙ্খলিখিত (মর্দিত শঙ্খের ন্যায় নির্মল শুভ্র) ব্রহ্মচর্য পালন করা গৃহবাসীর পক্ষে সুকর নহে। সুতরাং আমি প্রব্রজিত হইতে চাই। আগার হইতে অনাগারিক প্রব্রজ্যার নিমিত্ত আমাকে অনুমতি দিন।”
ইহা উক্ত হইলে রাষ্ট্রপাল কুলপুত্রের মাতা-পিতা তাঁহাকে কহিলেন,- “তাত রাষ্ট্রপাল! তুমি আমাদের প্রিয়, মনাপ, সুখে-বর্ধিত, সুখে পরিপোষিত একমাত্র পুত্র। তাত রাষ্ট্রপাল! তুমি কিছুমাত্র দুঃখ জান না। আস, রাষ্ট্রপাল! খাও, পান কর আর বিচরণ কর; খাইয়া, পান করিয়া, বিচরণ করিয়া, কাম (বিষয়) ভোগ করিয়া, পুণ্য করিয়া অভিরমিত হও। আমরা তোমাকে ...... প্রব্রজ্যার অনুমতি দিব না, মৃত্যুতেও তোমা হইতে আমরা অনিচ্ছাসত্বে বিচ্ছেদ হইব। কি প্রকারে আমরা জীবদ্দশায় তোমাকে আগার হইতে অনাগারিক প্রব্রজ্যায় অনুমতি দিব?”
দ্বিতীয়বার ......। তৃতীয়বার ......।
২৯৬। তৎপর রাষ্ট্রপাল কুলপুত্র মাতা-পিতার নিকট প্রব্রজ্যার অনুমতি লাভ না করায় সে স্থানেই অন্তর (বিছানা) রহিত ভূমিতে শয়ন করিলেন- “এখানেই আমার মরণ কিংবা প্রব্রজ্যা হইবে।”
তখন ...... মাতা-পিতা রাষ্ট্রপালকে ...... বলিলেন,- “তাত রাষ্ট্রপাল! তুমি আমাদের একমাত্র প্রিয়পুত্র ......।”
ইহা বলিলেও রাষ্ট্রপাল কুলপুত্র নীরব রহিলেন।
...... দ্বিতীয়বারও। তৃতীয়বারও ...... রাষ্ট্রপাল কুলপুত্র নীরব রহিলেন।
তখন রাষ্ট্রপালের মাতা-পিতা তাঁহার সহায়দের নিকট উপস্থিত হইলেন ...... এবং বলিলেন,- “বাবাগণ! রাষ্ট্রপাল কুলপুত্র শয্যাহীন মাটিতে পড়িয়া রহিয়াছে,- ‘ওখানেই মরণ কিংবা প্রব্রজ্যা হইবে।’ আস, বৎসগণ! যেখানে রাষ্ট্রপাল তথায় যাও, তোমরা গিয়া রাষ্ট্রপালকে বল,- ‘সৌম্য রাষ্ট্রপাল! তুমি মাতা-পিতার একমাত্র পুত্র ...... ’।”
২৯৭। তখন রাষ্ট্রপালের মিত্রগণ তাঁহার মাতা-পিতার নিকট প্রতিশ্রুত হইয়া রাষ্ট্রপালের নিকট উপস্থিত হইল এবং ...... তাঁহাকে বলিলেন,- সৌম্য রাষ্ট্রপাল! আপনি মাতা-পিতার একমাত্র প্রিয় সন্তান ......। উঠুন সৌম্য রাষ্ট্রপাল ভোজন করুন, পান করুন, বিচরণ করুন ...... অভিরমিত হউন।”
ইহা বলিলেও রাষ্ট্রপাল নীরব রহিলেন ......।
দ্বিতীয়বার ......। তৃতীয়বার ......।
২৯৮। তখন রাষ্ট্রপালের মিত্রগণ রাষ্ট্রপালের মাতা-পিতাকে বলিলেন,- “অম্মা তাত! এই রাষ্ট্রপাল ঐ স্থানে বিছানাহীন ধরণীতে পড়িয়া রহিয়াছেন,- ‘এখানেই আমার মরণ কিংবা প্রব্রজ্যা হইবে।’ যদি আপনারা রাষ্ট্রপালকে অনুমতি না দেন, তবে তথায়ই তাঁহার মৃত্যু অবশ্যাম্ভাবি। যদি আপনারা অনুমতি দেন, তবে প্রব্রজিত হইলেও তাঁহাকে দেখিতে পাইবেন। যদি রাষ্ট্রপাল প্রব্রজ্যায় অভিরমিত না হন তাহা হইলে তাঁহার আর কি গতি হইবে? এখানেই প্রত্যাগমন করিবেন। সুতরাং রাষ্ট্রপালকে প্রব্রজ্যার অনুমতি প্রদান করুন।”
“বৎসগণ! রাষ্ট্রপালকে অনাগারিক প্রব্রজ্যার অনুমতি দিতেছি, কিন্তু এই সর্ত রহিল, প্রব্রজিত হইয়া মাতা-পিতাকে দর্শন দিতে হইবে।”
তখন রাষ্ট্রপালের সহায়গণ... গিয়া তাঁহাকে বলিলেন,- “সৌম্য রাষ্ট্রপাল! আপনি মাতা-পিতার একমাত্র প্রিয় পুত্র...। প্রব্রজ্যার নিমিত্ত মাতা-পিতার আদেশ পাইলেন, কিন্তু (সর্ত রহিল) প্রব্রজিত হইয়া মাতা-পিতাকে দর্শন দিতে হইবে।”
২৯৯। তখন রাষ্ট্রপাল ...... উঠিয়া, বল সঞ্চয় করিয়া, ভগবানের সমীপে উপনীত হইলেন, উপস্থিত হইয়া ভগবানকে অভিবাদন করিয়া ও একপ্রান্তে বসিয়া বলিলেন,- “ভন্তে! আমি মাতা-পিতা হইতে প্রব্রজ্যার অনুমতি পাইয়াছি। ভগবন! আমাকে প্রব্রজিত করুন।”
রাষ্ট্রপাল ভগবানের কাছে প্রব্রজ্যা ও উপসম্পদা লাভ করিলেন।
তখন ভগবান রাষ্টপালের উপসম্পদার (ভিক্ষু হইবার) অল্পদিন বা অর্ধমাস পরে থুল্লকোট্টিতে যথেচ্ছা বিহার করিয়া যে দিকে শ্রাবস্তী তদভিমুখে চারিকায় প্রস্থান করিলেন। ক্রমান্বয়ে চারিকায় বিচরণ করিয়া শ্রাবস্তীতে পৌঁছিলেন। তথায় ভগবান শ্রাবস্তীতে অনাথপিণ্ডিকের জেতবন বিহারে অবস্থান করিতেছেন। তখন আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপাল ...... আত্মসংযমী রূপে বিহার করিয়া অচিরেই যার জন্য কুলপুত্রগণ সম্যক্ভাবে আগার হইতে অনাগারিক প্রব্রজিত হন, সেই সর্বোত্তম ব্রহ্মচর্যের চরম-লক্ষ্য ইহজীবনেই স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া, উপলব্ধি করিয়া বিহার করিতে লাগিলেন, ‘(তাঁহার) জন্ম ক্ষয় হইল, ব্রহ্মচর্যবাস পূর্ণ হইল, করণীয় কৃত হইল, আর এই জীবনের জন্য অপর কত্তব্য নাই’- ইহা তিনি অবগত হইলেন। আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপাল অর্হতদের অন্যতর হইলেন।
অতঃপর রাষ্ট্রপাল যেখানে ভগবান তথায় উপনীত হইলেন, গিয়া ভগবানকে অভিবাদন পূর্বক একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট রাষ্ট্রপাল ভগবানকে বলিলেন,-“ভন্তে! যদি আমাকে ভগবান অনুমতি প্রদান করেন তবে আমি মাতা-পিতাকে দর্শন দিতে ইচ্ছা করি।”
তখন ভগবান স্বচিত্ত দ্বারা রাষ্ট্রপালের চিত্ত-বিতর্ক চিন্তা করিলেন। যখন ভগবান জানিলেন যে রাষ্ট্রপাল কুলপুত্রের পক্ষে (ভিক্ষু)-শিক্ষা ত্যাগ করিয়া হীন (গৃহী) অবস্থায় ফিরিয়া যাওয়া অসম্ভব, তখন ভগবান আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপালকে বলিলেন,- “রাষ্ট্রপাল! এখন তুমি যাহা সময় বিবেচনা কর (তাহা কর)।”
তখন আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপাল আসন হইতে উঠিয়া ভগবানকে অভিবাদন ও প্রদক্ষিণ করিয়া শয়নাসনের ব্যবস্থা করিয়া, পাত্র-চীবর লইয়া থুল্লকোট্টিতের উদ্দেশে যাত্রা করিলেন। ক্রমান্বয়ে বিচরণ করিতে করিতে যেখানে থুল্লকোট্টিত তথায় অগ্রসর হইলেন। তথায় আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপাল থুল্লকোট্টিতে রাজা কৌরব্যের মিগাচীরে (তন্নামক উদ্যানে) বিহার করিতেছেন।
তখন (দ্বিতীয় দিনে) আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপাল পূর্বাহ্ন সময়ে নিবাসন পরিধান করিয়া পাত্র-চীবর লইয়া ভিক্ষার্থ থুল্লকোট্টিতে প্রবেশ করিলেন। থুল্লকোট্টিতে ক্রমান্বয়ে (সপদান) পিণ্ডাচরণ করিতে করিতে স্বীয় পিত্রালয়ে পৌঁছিলেন। সেই সময় রাষ্ট্রপালের পিতা মধ্যম দ্বারশালায় (নাপিতের দ্বারা) কেশচ্ছেদন করাইতেছেন। আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপালের পিতা দূর হইতে রাষ্ট্রপালকে আসিতে দেখিলেন, দেখিয়া (স্বগত) বলিলেন,- ‘এই মুণ্ডক শ্রমণেরাই আমাদের প্রিয়, মনাপ একমাত্র সন্তানকে প্রব্রজিত করিয়া নিয়াছে।’ তখন আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপাল স্বীয় পিতৃ-নিবাসে দান কিংবা প্রত্যাখ্যান কিছুই পাইলেন না। অধিকন্তু আক্রোশই লাভ করিলেন।
সে সময় আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপালের জ্ঞাতি-দাসী অভিদোষিক (বাসি) কুল্মাস (দাল) পরিত্যাগেচ্ছু হইল। তখন আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপাল সেই জ্ঞাতি-দাসীকে বলিলেন,- ‘ভগ্নি! যদি সেই অভিদোষিক কুল্মাস ত্যাগেচ্ছু হও, তবে এখানে- আমার পাত্রে ঢাল।’
তখন ...... জ্ঞাতি-দাসী সেই বাসি কুল্মাস আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপালের পাত্রে ঢালিবার সময় হস্ত, পদ ও স্বরের নিমিত্ত (আকার) লক্ষ্য করিল।
৩০০। তখন ...... জ্ঞাতি-দাসী যেখানে আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপালের মাতা আছেন তথায় গেল, গিয়া তাঁহাকে কহিল,- “ওহে আর্যে! জানেন কি আর্যপুত্র রাষ্ট্রপাল আসিয়াছেন?”
“অরে! যদি সত্য বল, তবে তুমি দাসীত্ব-মুক্ত হইবে।”
তখন আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপালের মাতা রাষ্ট্রপালের পিতার নিকট গিয়া বলিলেন,- “ওহে গৃহপতি! জানেন কি রাষ্ট্রপাল নাকি আসিয়াছে?”
সেই সময় আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপাল কোন (ধর্মশালার) দেওয়াল সমীপে (বসিয়া) সেই বাসি কুল্মাস ভোজন করিতেছেন। আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপালের পিতা তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া বলিলেন,- ‘তাত রাষ্ট্রপাল! (আমাদের ধন) আছে, তুমি বাসি কুল্মাস খাইতেছ! তার চেয়ে তোমার নিজের গৃহে যাওয়া উচিত নহে কি?”
“গৃহপতি! গৃহত্যাগী প্রব্রজিতদের আবার ঘর কোথায়? গৃহপতি! আমরা গৃহ-ছাড়া। আপনার গৃহে গিয়াছিলাম তথায় না দান পাইলাম, না প্রত্যাখ্যান। অধিকন্তু আক্রোশই লাভ করিলাম।”
“এস বৎস রাষ্ট্রপাল! চল ঘরে যাই।”
“প্রয়োজন নাই গৃহপতি! অদ্যকার মত আমার ভোজন-কৃত্য সমাপ্ত।”
“তা হইলে বৎস রাষ্ট্রপাল! আগামী কালের ভোজন স্বীকার কর।”
আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপাল মৌনভাবে স্বীকার করিলেন।
তখন আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপালের পিতা রাষ্ট্রপালের স্বীকৃতি অবগত হইয়া আপনার ঘরে গিয়া ...... হিরণ্য ও সুবর্ণের মহৎ দুই পুঞ্জ করাইয়া কিলিঞ্জক (মাদুর) দ্বারা তাহা আচ্ছাদন করাইয়া রাষ্ট্রপালের পুরাতন দুই ভার্যাকে ডাকিয়া বলিলেন,- “বৌমাগণ! আস, তোমরা যে অলঙ্কারে অলঙ্কৃত হইয়া পূর্বে তোমরা রাষ্ট্রপালের প্রিয়, মনাপ হইয়াছিলে সেই অলঙ্কারে সজ্জিত হও।”
৩০১। তখন আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপালের পিতা সে রাত্রির পর আপনার গৃহে উত্তম খাদ্য-ভোজ্য তৈয়ার করাইয়া রাষ্ট্রপালকে সময় জানাইলেন,- ‘সময় হইয়াছে, তাত রাষ্ট্রপাল! ভোজন সজ্জিত।’
তখন আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপাল নিবাসন পড়িয়া পাত্র-চীবর লইয়া তাঁহার পিত্রালয়ে উপনীত হইলেন, গিয়া সজ্জিত আসনে বসিলেন।
তখন রাষ্ট্রপালের পিতা হিরণ্য ও সুবর্ণ পুঞ্জের আচ্ছাদন খুলিয়া আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপালকে বলিলেন,- “তাত রাষ্ট্রপাল! ইহা তোমার মাতৃক (মাতার যৌতক) ধন, পিতৃ-পিতামহের স্বতন্ত্র। তাত রাষ্ট্রপাল! বিষয় ভোগ করিতে ও পুণ্য করিতে সমর্থ হইবে। এস তাত রাষ্ট্রপাল! (ভিক্ষু) শিক্ষা (দীক্ষা) প্রত্যাখ্যান করিয়া গৃহস্থ হইয়া বিষয় ভোগ কর, আর পুণ্যও সম্পাদন কর।”
“গৃহপতি! যদি আপনি আমার কথা গ্রহণ করেন, তবে এই হিরণ্য ও সুবর্ণ পুঞ্জকে শকট সমূহে তুলিয়া বহন করিয়া নিয়া গঙ্গানদীর মধ্য-স্রোতে ডুবাইয়া দেন। যেহেতু গৃহপতি! এই ধনের নিমিত্তই আপনার শোক-পরিদেব, দুঃখ-দৌর্মনস্য-উপায়াস উৎপন্ন (বর্ধিত) হইবে।”
তখন আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপালের পুরাণ ভার্যাদ্বয় প্রত্যেকে তাঁহার পায়ে ধরিয়া তাঁহাকে বলিল,- “আর্যপুত্র! সেই অপ্সরাগণ কি প্রকার, যাহাদের জন্য আপনি ব্রহ্মচর্য পালন করিতেছেন?”
“ভগ্নিগণ! আমরা অপ্সরার জন্য ব্রহ্মচর্য পালন করি না।”
‘ভগ্নিগণ বলিয়া আর্যপুত্র রাষ্ট্রপাল আমাদিগকে ব্যবহার করিতেছেন’ (হতাশায়) তাহারা তখন মুর্চ্ছিত হইয়া পড়িয়া গেল।
তখন আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপাল পিতাকে বলিলেন,- “যদি গৃহপতি! ভোজন দিতে হয় তবে দেন, নচেৎ (কামিনী-কাঞ্চনে প্রলুব্ধ করিয়া) আর আমাকে কষ্ট দিবেন না।”
“ভোজন কর, বাবা রাষ্ট্রপাল! ভোজন তৈয়ার।”
তখন রাষ্ট্রপালের পিতা উত্তম খাদ্য-ভোজ্য দ্বারা স্বহস্তে রাষ্ট্রপালকে সন্তর্পিত (তৃপ্ত) করিলেন, সংপ্রবারিত করিলেন।
৩০২। অতঃপর তখন আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপাল ভোজন শেষে পাত্র হইতে হাত সরাইয়া, দণ্ডায়মান অবস্থাতেই এই গাথা (শ্লোক) গুলি বলিলেন,-
“বিচিত্র শরীর দেখ ব্রণপূর্ণ সমুন্নত,
আতুর কল্পনা বহু যাহা নহে ধ্রুব-স্থিত । (১)
অলঙ্কৃত রূপ দেখ মণিকুণ্ডলে সজ্জিত,
অস্থি-চর্মাবৃত দেহ বস্ত্রে-গন্ধে সুশোভিত। (২)
অলক্ত-রঞ্জিত পাদ মুখ চুর্ণ-বিমণ্ডিত,
বাল-জন মোহনীয় পারগামী অমোহিত। (৩)
বেণী-বদ্ধ কেশদাম নয়ন কাজলাঙ্কিত,
অজ্ঞ-জন সম্মোহন পারগামী অমোহিত। (৪)
নবাঞ্জন চিত্র যথা পূতি-দেহ অলঙ্কৃত,
অজ্ঞ-জন মোহনীয়, পারগামী অমোহিত। (৫)
শিকারী বসাল ফাঁদ অনাবদ্ধ মৃগ তায়।
কাঁদিলে শিকারী তবু চারা খেয়ে চলে যায়।” (৬)
অতঃপর আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপাল স্থিত অবস্থায় গাথাগুলি ভাষণ করিয়া যেখানে রাজা কৌরব্যের মিগাচীর উদ্যান ঋষিবলে আকাশমার্গে তথায় উপস্থিত হইলেন, এবং অন্যতর বৃক্ষমূলে দিবা বিহারে বসিলেন।
৩০৩। তখন রাজা কৌরব্য মিগবকে (তন্নামক মালীকে) আদেশ করিলেন,- “সৌম্য মিগব! মিগাচীর সংস্কার ও সুসজ্জিত কর। উদ্যান ভূমির সুভূমি (সৌন্দর্য) দর্শনার্থ যাইব।”
রাজা কৌরব্যকে ‘হাঁ, দেব!’ বলিয়া প্রতিশ্রুতি দিয়া মিগব চলিয়া গেল। মিগাচীর সংস্কার ও সুসজ্জিত করিবার সময় মালী এক বৃক্ষমূলে দিবা-বিহারে উপবিষ্ট আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপালকে দেখিতে পাইল, দেখিয়া যেখানে রাজা কৌরব্য আছেন তথায় গেল এবং রাজাকে বলিল,- “দেব! মিগাচীর সংস্কার ও সুসজ্জিত হইয়াছে আর তথায় এই থুল্লকোট্টিতের অগ্রকুলিকের রাষ্ট্রপাল নামক কুলপুত্র- যাঁহার সম্বন্ধে আপনি সতত প্রশংসা করেন- তিনি এক বৃক্ষমূলে দিবা বিহারার্থ বসিয়াছেন।”
“তবে সৌম্য মিগব! আজ সেই উদ্যান-ভূমি রাখিয়া দাও, এখন আমরা মাননীয় রাষ্ট্রপালের নিকট উপস্থিত হইব।"
তখন রাজা কৌরব্য ‘যে কিছু খাদ্য-ভোজ্য প্রস্তুত আছে সমস্ত দাও’ বলিয়া ভাল ভাল যান (রথ) যোজনা করিয়া, (এক) ভদ্র যানে আরোহন পূর্বক ভদ্র ভদ্র যানের সহিত মহা রাজপ্রভাবে আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপালকে দর্শনার্থ থুল্লকোট্টিত হইতে যাত্রা করিলেন। যে পর্যন্ত যানের ভূমি ছিল, সেই পর্যন্ত গিয়া (পুনঃ) যান হইতে অবতরণ করিয়া পদব্রজেই উন্নত উন্নত পরিষদের সহিত যেখানে আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপাল ছিলেন তথায় গেলেন, গিয়া আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপালের সঙ্গে ...... সম্মোদন করিলেন। ...... (এবং) একপ্রান্তে দাঁড়াইলেন। একপ্রান্তে স্থিত হইয়া রাজা কৌরব্য আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপালকে বলিলেন,- “মাননীয় রাষ্ট্রপাল! এখানে গালিচায় (হস্ত্যাস্তরণে) বসুন।”
“না মহারাজ! আপনি বসুন, আমি স্বীয় আসনে উপবিষ্ট আছি।”
৩০৪। রাজা কৌরব্য প্রজ্ঞাপ্ত আসনে বসিলেন, বসিয়া আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপালকে বলিলেন,- “ভো রাষ্ট্রপাল! চতুর্বিধ পরিহানি (পরিজুঞ) আছে, যেই পরিহানিযুক্ত কোন কোন পুরুষ কেশ-শ্মশ্রু মুণ্ডন করিয়া কাষায় বস্ত্র পরিধান পূর্বক আগার হইতে অনাগারিক রূপে প্রব্রজিত হন। সেই চারি কি? জরা পরিহানি, ব্যাধি পরিহানি, ভোগ পরিহানি, জ্ঞাতি পরিহানি।
হে রাষ্ট্রপাল! জরা পরিহানি কি? হে রাষ্ট্রপাল! কোন (ব্যক্তি) জরাজীর্ণ, বয়োবৃদ্ধ, প্রাচীন বয়স্ক, বয়স অর্ধগত, পশ্চিম বয়ঃপ্রাপ্ত হন, তিনি এরূপ চিন্তা করেন,- ‘আমি এখন জরাজীর্ণ বৃদ্ধ হইয়াছি, আমার পক্ষে অনধিগত (অলব্ধ) ভোগ লাভ করা কিংবা অধিগত ভোগ বৃদ্ধি করা সুকর নহে। সুতরাং আমি কেশ-শ্মশ্রু মুণ্ডন করিয়া, কাষায়বস্ত্র পরিধান করিয়া, ...... প্রব্রজিত হইয়া যাই।’ তিনি জরা পরিহানিযুক্ত হইয়া ...... প্রব্রজিত হইয়া থাকেন। হে রাষ্ট্রপাল! উহাকে জরা পরিহানি বলা হয়। আপনি এখন তরুণ, কালকেশ সম্পন্ন, প্রথম বয়সের সুন্দর যৌবনযুক্ত, মাননীয় রাষ্ট্রপালের জরা পরিহানি নাই। রাষ্ট্রপাল! আপনি কি বুঝিয়া, কি দেখিয়া কিংবা কি শুনিয়া আগার হইতে অনাগারিক প্রব্রজিত হইলেন? (১)
হে রাষ্ট্রপাল! ব্যাধি পরিহানি কি? হে রাষ্ট্রপাল! কোন (ব্যক্তি) রোগী, দুঃখিত ও শক্ত রোগাতুর হন, তিনি এরূপ চিন্তা করেন,- ‘আমি এখন রোগী, দুঃখী ও শক্ত রোগ পীড়িত হই। বর্তমানে আমার পক্ষে অপ্রাপ্ত ভোগ লাভ করা ......।’ ইহাকে ব্যাধি পরিহানি বলা হয়। কিন্তু রাষ্ট্রপাল! আপনি বর্তমানে ব্যাধিরহিত, আতঙ্করহিত, ন-অতিশীত, ন-অতিউষ্ণ, সমবিপক্ককারী পাচনশক্তি (গ্রহণী) দ্বারা যুক্ত; মাননীয় রাষ্ট্রপালের ইদানীং ব্যাধি পরিহানি নাই ...... ? (২)
হে রাষ্ট্রপাল! ভোগ পরিহানি কি? রাষ্ট্রপাল! কোন (ব্যক্তি) আঢ্য, মহাধনী ও মহা ভোগবান হন, তাঁহার সে ভোগ ক্রমশঃ পরিক্ষয় হয়। তিনি এরূপ চিন্তা করেন,- ‘আমি পূর্বে আঢ্য ...... ছিলাম, আমার সে ভোগ ক্রমশঃ ক্ষয় হইয়াছে। এখন আমার পক্ষে অপ্রাপ্ত ভোগ লাভ করা ......।’ রাষ্ট্রপাল! আপনি’ত এই থুল্লকোট্টিতে অগ্রকুলের পুত্র। মাননীয় রাষ্ট্রপালের’ত ভোগহানি হয় নাই, ...... ? (৩)
হে রাষ্ট্রপাল! জ্ঞাতি পরিহানি কি? রাষ্ট্রপাল! কোন (ব্যক্তির) বহু জ্ঞাতি, মিত্র, অমাত্য, জ্ঞাতি-সলোহিত (রক্ত-সম্বন্ধীয়) আছে। তাঁহার সেই জ্ঞাতিগণ ক্রমশঃ পরিক্ষয় হইতেছে। তিনি এরূপ চিন্তা করেন,- পূর্বে আমার বহু মিত্র, অমাত্য, জ্ঞাতি-সলোহিত ছিল। আমার সেই জ্ঞাতিগণ ক্রমশঃ পরিক্ষয় হইয়াছে। এখন আমার পক্ষে অপ্রাপ্ত ভোগ লাভ করা ......।’ কিন্তু এখন রাষ্ট্রপালের ত এই থুল্লকোট্টিতে বহু মিত্র, অমাত্য, জ্ঞাতি-সলোহিত বর্তমান। সুতরাং রাষ্ট্রপালের জ্ঞাতি পরিহানি নাই। রাষ্ট্রপাল! আপনি কি জানিয়া, কি দেখিয়া কিংবা কি শুনিয়া গৃহত্যাগ করিয়া, প্রব্রজিত হইলেন? (৪)
রাষ্ট্রপাল! এই চারি পরিহানি, যেই পরিহানিযুক্ত কোন কোন পুরুষ কেশ-শ্মশ্রু মুণ্ডন করিয়া, কাষায়বস্ত্র পরিহিত হইয়া আগার হইতে অনাগারিক প্রব্রজিত হয়। তাহা মাননীয় রাষ্ট্রপালের নাই। মান্য রাষ্ট্রপাল! কি জানিয়া, কি দেখিয়া কিংবা কি শুনিয়া আগার হইতে অনাগারিক প্রব্রজিত হইলেন?”
৩০৫। “মহারাজ! সেই ভগবান সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী, অর্হৎ, সম্যক্সম্বুদ্ধ চারিধর্ম উদ্দেশ করিয়াছেন, যাহা আমি জানিয়া দেখিয়া ও শুনিয়া আগার হইতে অনাগারিক প্রব্রজিত হইয়াছি। সেই চারি কি?
মহারাজ! (১) লোক (সংসার) অধ্রুব, (জরা-মরণে) উপনীত হইতেছে; ইহা সেই ভগবানের প্রথম ধর্ম-উদ্দেশ যাহা জানিয়া ...... আমি প্রব্রজিত হইয়াছি। (২) লোক ত্রাণরহিত, আশ্বাস (ভরসা) রহিত ......। (৩) লোক নিজস্ব নহে, সমস্ত ত্যাগ করিয়া যাইতে হইবে ......। (৪) লোক, ঊন, অতৃপ্ত, বাসনার দাস ......। মহারাজ! সেই ভগবান এই চারিধর্ম উদ্দেশ উপদেশ করিয়াছেন যাহা জানিয়া ...... আমি প্রব্রজিত হইয়াছি।”
৩০৬। “লোক অধ্রুব ...... উপনীত হইতেছে, মাননীয় রাষ্ট্রপাল! এই কথার অর্থ কি প্রকারে জানা উচিত?”
“তাহা কি মনে করেন, মহারাজ! আপনি (কখনও) বিশ বর্ষ বয়স্ক ও পঁচিশ বর্ষ বয়স্ক ছিলেন কি? (যখন আপনি) সংগ্রামে হস্তী চালনায় দক্ষ, অশ্ব চালনায় দক্ষ, রথ চালনায় দক্ষ, ধনু চালনায় দক্ষ, অস্ত্র চালনায় দক্ষ, উরুবল সম্পন্ন, বাহুবল সম্পন্ন ছিলেন?”
“কিন্তু হে রাষ্ট্রপাল! এক সময় আমি ঋদ্ধিমান সদৃশ হইয়া আপন বলের সমান (কাহারও) দেখি নাই।”
“তাহা কি মনে করেন, মহারাজ! সেইরূপ আপনি বর্তমানেও সংগ্রামে উরু-বলী, বাহু-বলী সামর্থ্যযুক্ত হন?”
“না, হে রাষ্ট্রপাল! এখন আমি জীর্ণ-বৃদ্ধ ...... হইয়াছি। আশী বৎসর আমার বয়স হইল। অধিকন্তু কোন সময়, ভো রাষ্ট্রপাল! এখানে পদ রাখিব মনে করি আর অন্যত্রই পদ রাখিতে বাধ্য হই।”
“মহারাজ! সেই ভগবান ইহা চিন্তা করিয়াই বলিয়াছেন,- ‘লোক অধ্রুব, ...... উপনীত হইতেছে’ যাহা জানিয়া ...... আমি প্রব্রজিত হইয়াছি।”
“আশ্চর্য, হে রাষ্ট্রপাল! অদ্ভুত, হে রাষ্ট্রপাল! ইহা সেই ভগবানের কেমন সুভাষিত- লোক অধ্রুব ...... উপনীত হইতেছে (লইয়া যাইতেছে)। (১)
হে রাষ্ট্রপাল! এই রাজকুলে হস্তী-কায় (সমূহ), অশ্ব-কায়, রথ-কায়, পদাতিক-কায়ও আছে যাহা আমাদের বিদ্রোহ-বিপদাদি দমনার্থ প্রয়োজনে আসিবে। ‘লোক ত্রাণরহিত, আশ্বাস রহিত’ রাষ্ট্রপাল! আপনি যে বলিলেন। রাষ্ট্রপাল! এই ভাষণের অর্থ কি প্রকারে জানা উচিত?”
“মহারাজ! তাহা কি মনে করেন, আপনার কোন আনুশায়িকা (পুরাতন) ব্যাধি আছে কি?”
“হে রাষ্ট্রপাল! আমার আনুশায়িক বাতরোগ আছে। একেকবার’ত আমার মিত্র, অমাত্য, জ্ঞাতি-সলোহিতগণ আমাকে ঘেরিয়া দাঁড়াইয়া থাকে,- ‘এখন রাজা কৌরব্য মরিবে, এখন রাজা কৌরব্য মরিবে’।”
“তাহা কি মনে করেন, মহারাজ! আপনার মিত্র, অমাত্য, জ্ঞাতি-সলোহিতদের মধ্যে কাহাকেও পাবেন কি?- ‘আসুন, আপনারা আমার মিত্র, অমাত্য, জ্ঞাতি-সলোহিতগণ, সকলে থাকিয়া আমার এই রোগ-যন্ত্রণাকে বিভাগ করিয়া লউন, যাহাতে আমি লঘু ও কম বেদনা অনুভব করি।’ অথবা আপনি একাই সেই যন্ত্রণা ভোগ করেন কি?”
“রাষ্ট্রপাল! সেই মিত্র, অমাত্যদের.....মধ্যে কাহাকেও পাই না ...... , অধিকন্তু আমি নিজেই সেই যন্ত্রণা সহ্য করিয়া থাকি।”
“মহারাজ! ইহা চিন্তা করিয়াই সেই ভগবান ......।”
“আশ্চর্য, হে রাষ্ট্রপাল! অদ্ভুত, হে রাষ্ট্রপাল! (২)
ভো রাষ্ট্রপাল! এই রাজকুলে ভূমিস্থ ও আকাশস্থ বহু হিরণ্য-সুবর্ণ বিদ্যমান। ‘অ-স্বকীয় লোক সমস্ত ছাড়িয়া যাইতে হইবে ...... ’ মাননীয় রাষ্ট্রপাল বলিলেন। হে রাষ্ট্রপাল! এ কথার অর্থ কি ভাবে জানা উচিত?”
“মহারাজ! তাহা কি মনে করেন, বর্তমানে আপনি যেমন পঞ্চ কামগুণে যুক্ত, সমঙ্গীভূত হইয়া পরিভোগ করিতেছেন, পরলোকেও (জন্মান্তরেও) আপনি পাইবেন কি যে ‘এইরূপেই আমি এই পঞ্চ কামগুণেই নিমজ্জিত ও সংযুুক্ত হইয়া পরিভোগ করিব?’ অথবা অপরে এই বিষয়-সম্পত্তি পরিভোগ করিবে, আপনি কর্মানুসারে চলিয়া যাইবেন?”
রাষ্ট্রপাল! যেমন আমি এই সময় পঞ্চ কামগুণে নিমজ্জিত ও সংযুক্ত হইয়া ...... পরিভোগ করিতেছি, পরলোকে (জন্মান্তরে) ও এই প্রকারেই এই পঞ্চ কামে নিমজ্জিত ও সংযুক্ত ভাবে পরিভোগ করিতে সমর্থ হইব না। অধিকন্তু অপরে এই ভোগ-সম্পত্তি অধিকার করিবে, আমি স্বীয় কর্মানুসারে চলিয়া যাইব।”
“মহারাজ! এই সম্পর্কেই (সন্ধায) সেই ভগবান ...... বলিয়াছেন ......।”
“আশ্চর্য, হে রাষ্ট্রপাল! অদ্ভুত, হে রাষ্ট্রপাল! (৩)
লোক ঊন, অতৃপ্ত, তৃষ্ণার দাস, মাননীয় রাষ্ট্রপাল ইহা বলিয়াছেন। ভো রাষ্ট্রপাল! এই ভাষণের অর্থ কি ভাবে জানা উচিত?”
“মহারাজ! তাহা কি মনে করেন, সমৃদ্ধ কুরুরাজ্যে আধিপত্য করিতেছেন ত?”
“হাঁ, ভো রাষ্ট্রপাল! সমৃদ্ধ কুরুরাজ্যে আধিপত্য করিতেছি।”
“তাহা কি মনে করেন, মহারাজ! আপনার এক বিশ্বস্ত ও প্রত্যয়ভাজন পুরুষ পূর্বদিক হইতে আসে, আর সে আপনার নিকট এরূপ বলে,- ‘হে (যগ্ঘে) মহারাজ! জানেন কি? আমি পূর্বদিক হইতে আসিতেছি। সেই দিকে আমি বহু সমৃদ্ধ..... স্ফীত জনবহুল, মানবাকীর্ণ বৃহৎ জনপদ দেখিলাম। তথায় বহু হস্তী-কায়, অশ্ব-কায়, রথ-কায়, পদাতিক সমূহ আছে। তথায় বহু হস্তী-দন্ত, মৃগ-চর্ম; তথায় অনির্মিত-নির্মিত (কৃতাকৃত), বহু হিরণ্য-সুবর্ণ আর তথায় বহু স্ত্রী-পরিগ্রহ বিদ্যমান। উহা সামান্য সৈন্য দ্বারা (অনায়াসে) জয় করা সম্ভব। সুতরাং মহারাজ! তাহা জয় করুন।’ ইহাতে আপনি কি করিবেন?”
“হে রাষ্ট্রপাল! তাহাও জয় করিয়া আমার আধিপত্য বিস্তার করিব।”
“তাহা কি মনে করেন, মহারাজ! আপনার বিশ্বস্থ মানুষ দক্ষিণদিক হইতে আসে ......।”
“হে রাষ্ট্রপাল! তাহাও ......।”
“ ...... পশ্চিমদিক হইতে ......।”
“হে রাষ্ট্রপাল! তাহাও........।”
“ ...... উত্তরদিক হইতে ......।”
“হে রাষ্ট্রপাল! তাহাও .....।”
“মহারাজ! এই কারণে ভগবান বলিয়াছেন ......।”
“আশ্চর্য, রাষ্ট্রপাল! অদ্ভুত, রাষ্ট্রপাল!”
“সেই ভগবান সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী, অর্হৎ, সম্যক্সম্বুদ্ধের অতি চমৎকার ভাষণ,- ‘লোক ঊন (অভাব-গ্রস্থ), অতৃপ্ত, তৃষ্ণার দাস’।”
“হে রাষ্ট্রপাল! প্রকৃতই লোক ঊন, অতৃপ্ত, তৃষ্ণার দাস’।” (৪)
৩০৭। আয়ুষ্মান রাষ্ট্রপাল ইহা বলিলেন। ইহা বলিয়া অতঃপর এইরূপ কহিলেন,-
“সধন মনুষ্য দেখি এ ভব মাঝারে,
বিত্তলাভী মোহবশে দান নাহি করে।
লোভীগণ ধনরত্ন সঞ্চয় যা করে,
তথোধিক কাম্যবস্তু প্রার্থনা অন্তরে। (১)
বাহুবলে পৃথিবীজয় করিয়া রাজন,
সসাগরা ধরণীর অধীশ্বর হন।
সমুদ্রের এপারেতে তৃপ্ত নহে মন,
পরপার জিনিবারে করে আকিঞ্চন। (২)
রাজাসম অন্য বহু মানুষের মাঝে,
অতৃপ্ত-বাসনা সহ মরণে উপজে।
অভাব পোষিয়া হৃদে দেহ-ত্যাগ করে,
কাম-ভোগে তৃপ্তি নাই জগত মাঝারে। (৩)
আলু-তালু কেশে জ্ঞাতি করয়ে রোদন,
আহা! আহা! মরে গেল আপনার জন।
বস্ত্রাবৃত দেহ তার করিয়া বহন,
সজ্জিত চিতায় তাকে দেয় হুতাশন। (৪)
সম্পত্তি ছাড়িয়া এক বস্ত্রে আচ্ছাদিত,
শূলবিদ্ধ ক্ষত-অঙ্গ হয় ভস্মীভূত।
মৃয়মান মানবের রক্ষার কারণ,
জ্ঞাতি-মিত্র কিংবা নহে কোন বন্ধুজন। (৫)
তার ধনে অধিকারী হয় বংশাবলী,
যথাধর্ম সত্ব কিন্তু যায় কোথা চলি।
কোন ধন অনুগামী না হয় তাহার,
দারা-পুত্র রাজ্য-ধন (স্বীয় দেহ আর)। (৬)
ধনদ্বারা আয়ুদীর্ঘ কভু নাহি হয়,
বিত্তের প্রভাবে জরা রুদ্ধ কভু নয়।
স্বল্পক্ষণ এজীবন বলে ধীরগণ,
অনিত্য-ভঙ্গুর ধর্ম (জড় ও চেতন)। (৭)
মৃত্যুস্পর্শে দুঃখ পায় সধন নিধন,
সমভাবে মৃত্যুলভে অজ্ঞ-বিজ্ঞজন।
অজ্ঞতা-বাধিত মুর্খ লভয়ে শয়ন,
মৃত্যু-স্পর্শে বিচলিত নহে বিজ্ঞজন। (৮)
ধনাপেক্ষা প্রজ্ঞা শ্রেষ্ঠ হয় যে কারণ,
যাতে হয় ইহ-লোকে ভব নিঃসরণ।
অমুক্ত বিধায় জীব ভ্রমি জন্মান্তর,
মোহবশে পাপকর্ম করে নিরন্তর। (৯)
সংসার প্রবাহে পড়ি ক্রমে সত্বচয়,
গর্ভে আর পরলোকে উপনীত হয়।
তথাবিধ প্রজ্ঞাহীন তীব্র শ্রদ্ধাবান,
গর্ভে আর পরলোকে করেন প্রয়াণ। (১০)
সন্ধি-মুখে পাপীচোর হইলে গৃহীত,
স্বকর্মেতে হয় যথা হত (নিপীড়িত)।
সেইরূপ পাপীজন পরলোক গত,
স্বকর্মেতে পাপাচারী হয় নির্যাতিত। (১১)
বিচিত্র-মধুর লাগে কাম-মনোহর,
বিরূপেতে প্রমথিত চিত্ত নিরন্তর।
ভোগ-সুখে দোষ, রাজ! করিয়া দর্শন,
প্রব্রজিত হই আমি তাহারি কারণ। (১২)
বৃক্ষ-ফল তুল্য সদা ঝরে জীবগণ,
দেহ-ত্যাগে যুবা-বৃদ্ধ লভয়ে মরণ।
এই দৃশ্য দেখি রাজ! প্রব্রজ্যা-জীবন,
নৈর্বানিক শ্রামণ্য ধর্ম করিনু বরণ। (১৩)
॥ রাষ্ট্রপাল সূত্র সমাপ্ত ॥
(কল্যাণ-মার্গ)
৩০৮। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-
এক সময় ভগবান মিথিলায় মঘদেব আম্রবনে বিহার করিতেছিলেন।
ভগবান একস্থানে মৃদু হাসিলেন। তখন আয়ুষ্মান আনন্দের এরূপ চিন্তা হইল,- ‘ভগবানের মৃদু হাসি প্রকাশের কি হেতু, কি কারণ? তথাগত কারণ বিনা মৃদু হাসি প্রকাশ করেন না।’ তখন আয়ুষ্মান আনন্দ চীবর একাংশ করিয়া যেদিকে ভগবান, ...... সেই দিকে অঞ্জলিবদ্ধ করিয়া ভগবানকে বলিলেন,- “ভন্তে! ভগবানের স্মিতহাস্য প্রকাশের কারণ কি.... ?”
“আনন্দ! অতীতকালে এই মিথিলাতে মঘদেব নামক ধার্মিক ধর্মরাজা ছিলেন। (তিনি) ধর্মে (দশ কুশল কর্মপথে) স্থিত মহারাজা, ব্রাহ্মণ গৃহপতিদের প্রতি, নিগমবাসীদের প্রতি এবং জনপদবাসীদের প্রতিও সম-আচরণ করিতেন। চতুর্দশী (অমাবস্যা), পঞ্চদশী (পূর্ণিমা) এবং পক্ষের অষ্টমী তিথিতে উপোসথ (উপবাস ব্রত) পালন করিতেন।
তখন আনন্দ! রাজা মঘদেব বহু বর্ষের ...... পর নাপিতকে বলিলেন,- ‘সৌম্য কল্পক! যখন আমার মস্তকে পক্ককেশ দেখিবে তখন আমাকে বলিবে।’
তখন আনন্দ! বহু বর্ষের ...... পর নাপিত তাহা দেখিল এবং রাজাকে বলিল।
‘তাহা হইলে সৌম্য নাপিত! সাঁড়াশী দ্বারা সযত্নে তুলিয়া পক্ককেশগুলি আমার হাতে দাও।’
নাপিত তাহা ...... রাজার হস্তে দিল।
৩০৯। তখন আনন্দ! রাজা মঘদেব নাপিতকে শ্রেষ্ঠ গ্রাম উপহার দিয়া জ্যেষ্ঠপুত্র কুমারকে ...... ডাকাইয়া ইহা বলিলেন,- “তাত কুমার! আমার দেব (মৃত্যু) দূত প্রাদুর্ভূত হইয়াছে, শিরে পক্ককেশ দেখা দিয়াছে। আমার মনুষ্য-কাম ভোগ হইয়াছে, এখন দিব্য-কাম অন্বেষণের সময়। এস, তাত কুমার! তুমি এই রাজ্যভার গ্রহণ কর। আমি কেশ-শ্মশ্রু মুণ্ডন করিয়া, কাষায়বস্ত্র পরিহিত হইয়া আগার হইতে অনাগারিক প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিব। তাত! তুমিও যখন শিরে পক্ককেশ দেখিতে পাও তখন নাপিতকে উপহার দিয়া জ্যেষ্ঠপুত্র কুমারকে ...... রাজ্যভার অর্পণ করিয়া...প্রব্রজিত হইও। আমার স্থাপিত এই কল্যাণব্রত অনুবর্তন করিও। তুমি কখনও অন্তিম পুরুষ হইও না। একবংশ সম্ভূত যেই পুরুষের বিদ্যমানে এতাদৃশ কল্যাণব্রতের সমুচ্ছেদ হয়, সে-ই তাহাদের অন্তিম পুরুষ। তাত কুমার! তোমাকে তাহা হইতে বলি না ......।’
অতঃপর আনন্দ! রাজা মঘদেব নাপিতকে এক উত্তম গ্রাম উপহার দিয়া, জ্যেষ্ঠপুত্র কুমারকে সুন্দরভাবে রাজত্বের অনুশাসন করিলেন এবং এই মঘদেব আম্রবনে....প্রব্রজিত হইলেন। তিনি তথায় মৈত্রী, করুণা, মুদিতা ও উপেক্ষা সহগত চিত্ত দ্বারা সকলদিক বিস্ফারিত করিয়া বাস করিতেন। ...... তিনি চতুর্বিধ ব্রহ্মবিহার ভাবনা করিয়া ব্রহ্মলোকে উৎপন্ন হইলেন।
৩১০-৩১১। আনন্দ! রাজা মঘদেবের পুত্র নেমী ...... , রাজা মঘদেবের পরম্পরাতে পুত্র-পৌত্রাদি এই মঘদেব ...... আম্রবনে কেশ-শ্মশ্রু মুণ্ডন করিয়া ...... প্রব্রজিত ও ব্রহ্মলোক পরায়ণ হইয়াছেন।
৩১২। আনন্দ! পুরাকালে সুধর্মা নামক সভাতে সম্মিলিত দেবগণের মধ্যে এই প্রসঙ্গ উৎপন্ন হইল,- ‘আহা! বিদেহবাসীদের একান্তই লাভ, যাহাদের নেমীর ন্যায় ধার্মিক ধর্মরাজা, ধর্মেস্থিত। মহারাজা আছেন; ......।’
আনন্দ! দেবেন্দ্র শক্র তাবস্ত্রিংশবাসী দেবতাদিগকে আহ্বান করিলেন,- ‘মারিসগণ! তোমরা রাজা নেমীকে দেখিতে চাও কি? ...... আজ রাজা পঞ্চদশীর উপোসথ গ্রহণ করিয়া প্রাসাদোপরে উপবিষ্ট আছেন। ......।’ তখন দেবরাজ শক্র রাজা নেমীর নিকট উপস্থিত হইলেন। ...... ‘মহারাজ! তাবস্ত্রিংশ স্বর্গবাসী দেবগণ আপনাকে দেখিতে ইচ্ছুক। মহারাজ! আপনার জন্য আমি সহস্র অশ্বযুক্ত শ্রেষ্ঠ রথ পাঠাইয়া দিব। আপনি অকম্পিত হৃদয়ে আরোহণ করিবেন।’ নেমীরাজের স্বীকৃতি অবগত হইয়া দেবরাজ দেবলীলায় তাবস্ত্রিংশ দেবলোকে চলিয়া গেলেন।
৩১৩। তৎপর দেবেন্দ্র শক্র সেবক মাতলীকে বলিলেন,- ‘সৌম্য মাতলি! রথ লইয়া রাজা নেমীকে লইয়া আস।’ ‘হাঁ, দেব!’ বলিয়া মাতলী ...... নেমী রাজার নিকট গিয়া বলিলেন,- ‘মহারাজ! আপনাকে কোন্ পথে নিব? পাপীর পাপফল ভোগের পথে কিংবা পুণ্যাত্মার পুণ্যফল ভোগের পথে?’
‘মাতলি! উভয়দিক দেখাইয়া আমাকে নিয়া যান।’
...... , আনন্দ! মাতলী নেমীরাজকে সুধর্মা সভায় পৌঁছাইলেন। দেবরাজ তাঁহাকে স্বাগত সম্ভাষণ জানাইলেন। ...... ‘মহারাজ! দেবগণের সঙ্গে দেবানুভাবে আপনি অভিরমিত হউন।
৩১৪। ‘না, মারিস! আমাকে মিথিলাতেই পুনঃ পাঠাইয়া দেন।’ ...... নেমীরাজকে মিথিলাতেই পাঠানো হইল।
৩১৫। আনন্দ! নেমীও এই মঘদেব আম্রবনে প্রব্রজিত হইয়াছিলেন। আনন্দ! রাজা নেমীর কলার-জনক নামক পুত্র ছিলেন। তিনি প্রব্রজিত হন নাই, কল্যাণব্রত সমুচ্ছেদ করিলেন এবং তিনিই ছিলেন তাঁহাদের অন্তিম পুরুষ ......।
৩১৬। আনন্দ! হয়ত তোমার মনে হইতে পারে সেই সময় অপর কেহ রাজা মঘদেব ছিলেন, যিনি এই কল্যাণব্রত প্রতিষ্ঠা করেন। আনন্দ! তাহা তদ্রূপ মনে করিও না, আমিই তখন মঘদেব রাজা ছিলাম, আর কল্যাণব্রত প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলাম। আমার প্রতিষ্ঠিত কল্যাণব্রতের পশ্চিম জনতা অনুবর্তন করিয়াছে। কিন্তু আনন্দ! সেই কল্যাণব্রত নির্বেদ, বিরাগ, নিরোধ, উপশম, অভিজ্ঞা, সম্বোধি কিংবা নির্বাণের নিমিত্ত সংবর্তিত হয় নাই, তাহা কেবলমাত্র ব্রহ্মলোকে উৎপত্তির উপায়।
আনন্দ! এই সময় আমি যে কল্যাণব্রত প্রতিষ্ঠা করিয়াছি, তাহা একান্ত নির্বেদ...... নির্বানার্থ সংবর্তিত হয়। আনন্দ! বর্তমানে আমার প্রতিষ্ঠিত কল্যাণব্রত কি যাহা...... নির্বানের উপায় হয়? এই আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গই, যথা- সম্যক্-দৃষ্টি, সঙ্কল্প, বাক্য, কর্ম, আজীব, বীর্য, স্মৃতি ও সমাধি! ইহাই আনন্দ! কল্যাণব্রত যাহা আমি স্থাপন করিয়াছি। আনন্দ! তোমাদিগকে আমি নিশ্চিত বলিতেছি- আমার প্রতিষ্ঠিত এই কল্যাণব্রতের অনুবর্তন কর। তোমরা আমার অন্তিম পুরুষ হইওনা।”
ভগবান ইহা বলিলেন। আয়ুষ্মান আনন্দ ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন করিলেন।
॥ মঘদেব সূত্র সমাপ্ত ॥
(বর্ণ-ব্যবস্থার খণ্ডন)
৩১৭। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-
এক সময় ভগবান আয়ুষ্মান মহাকাত্যায়ণ (উত্তর) মধুরায় (মথুরায়) গুন্দাবনে বিহার করিতেছেন।
মাথুররাজ অবন্তিপুত্র শুনিলেন যে শ্রমণ কাত্যায়ণ মথুরায় গুন্দাবনে বিহার করিতেছেন। সেই মাননীয় কাত্যায়ণের এরূপ কল্যাণকীর্তি-শব্দ উদ্গত হইয়াছে, ‘তিনি পণ্ডিত, ব্যক্ত, মেধাবী, বহুশ্রুত, বিচিত্রকথী, কল্যাণ-প্রতিভাবান, বৃদ্ধ আর অর্হৎ হন। তথাবিধ অর্হতদের দর্শন সাধু হয়।’
তখন রাজামাথুর অবন্তিপুত্র উত্তমোত্তম যান সজ্জিত করিয়া ...... আয়ুষ্মান মহাকাত্যায়ণকে দর্শনার্থ মথুরা হইতে বাহির হইলেন। যে পর্যন্ত যানের রাস্তা ছিল, সে পর্যন্ত যানে গিয়া (পুনঃ) যান হইতে অবতরণ করিয়া পদব্রজেই যেখানে আয়ুষ্মান মহাকাত্যায়ণ ছিলেন, তথায় ...... যাইয়া আয়ুষ্মান মহাকাত্যায়ণের সহিত ...... সম্মোদন করিয়া একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে বসিয়া রাজা অবন্তিপুত্র আয়ুষ্মান মহাকাত্যায়ণকে বলিলেন,- “ভো কাত্যায়ণ! ব্রাহ্মণেরা বলিয়া থাকেন,- ‘ব্রাহ্মণই উত্তমবর্ণ, অপরবর্ণ হীন; ব্রাহ্মণই শুক্লবর্ণ, অপরবর্ণ কৃষ্ণ; ব্রাহ্মণই শুদ্ধ হয়, অব্রাহ্মণেরা নহে; ব্রাহ্মণেরাই ব্রহ্মার ঔরস-পুত্র, মুখ-জাত, ব্রহ্মজ, ব্রহ্ম-নির্মিত ও ব্রহ্মের দায়াদ হন।’ এ সম্বন্ধে মাননীয় কাত্যায়ণ কি বলেন?”
“মহারাজ! ইহা জগতে ঘোষণা (ব্যবহার) মাত্র ......। তাহাও মহারাজ! পর্যায়ানুসারে জানিতে হইবে যে জগতে যে কিংবদন্তি আছে ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ অন্যবর্ণ হীণ ......।
৩১৮। তাহা কি মনে করেন, মহারাজ! যদি ক্ষত্রিয় ধন, ধান্য, স্বর্ণ কিংবা রৌপ্য দ্বারা সমৃদ্ধ হয়; তবে তাহার পূর্বে উত্থানশীল, পশ্চাতশায়ী (মালিকের পূর্বে উত্থানশীল ও পশ্চাতে শয়নকারী), কিংকর্তব্য-জিজ্ঞাসু, মনাপচারী (মনের মত আচরণকারী), প্রিয়ভাষী অপর ক্ষত্রিয়ও চাকর হইবে নহে কি? ব্রাহ্মণও ...... ? বৈশ্যও ...... ? শূদ্রও ...... ?”
“হে কাত্যায়ণ! যদি ক্ষত্রিয়ও.....সমৃদ্ধ হয়, তবে অপর ক্ষত্রিয়ও তাঁহার ...... প্রিয়বাদী ও বাধ্য হইবে; ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, শূদ্রও হইবে।”
“তাহা কি মনে করেন, মহারাজ! ব্রাহ্মণ যদি ধন ...... দ্বারা সমৃদ্ধ হয়, তবে ব্রাহ্মণও তাঁহার মত ...... প্রিয়বাদী হইবে নহে কি? বৈশ্য, শূদ্র, ক্ষত্রিয়ও ...... হইবে নহে কি?”
“হে কাত্যায়ণ! যদি ব্রাহ্মণও... সমৃদ্ধ হয়, তবে অপর ব্রাহ্মণও তাঁহার.... প্রিয়বাদী হইবে। বৈশ্য, শূদ্র, ক্ষত্রিয়ও...।”
“মহারাজ! বৈশ্য যদি ...... সমৃদ্ধ হয় ...... ?”
“হে কাত্যায়ণ! যদি বৈশ্যও......সমৃদ্ধ হয়, তবে অপর বৈশ্যও তাঁহার ...... প্রিয়বাদী হইবে। শূদ্র, ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণও......।”
“মহারাজ! শূদ্র যদি ...... সমৃদ্ধ হয় ......?”
“হে কাত্যায়ণ! যদি শূদ্রও ...... সমৃদ্ধ হয়, তবে অপর শূদ্রও তাঁহার ...... প্রিয়বাদী হইবে। ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, বৈশ্যও হইবে।”
“তাহা কি মনে করেন, মহারাজ! যদি এরূপ হয়, তবে এই চারিবর্ণ সম-সম হয় অথবা নহে? এ সম্বন্ধে আপনার কি অভিমত?”
“নিশ্চয় হে কাত্যায়ণ! এরূপ হইলে এই চারিবর্ণ সম-সম। আমি ইহাতে কোন প্রভেদ দেখিতেছিনা।”
“মহারাজ! এই কারণেই আপনার জানা উচিত ‘ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠ, অন্যবর্ণ হীন ...... দায়াদ, ইহা জগতে প্রবাদ মাত্র।”
৩১৯। “তাহা কি মনে করেন, মহারাজ! এখানে ক্ষত্রিয় প্রাণিহিংসুক, চোর, ব্যভিচারী, মিথ্যাবাদী, পিশুনভাষী, কর্কশভাষী, সমপ্রলাপী অভিধ্যালু, বিদ্বেষ-চিত্ত ও মিথ্যাদৃষ্টি সম্পন্ন হয়, তবে দেহত্যাগে মৃত্যুর পর ...... নরকে উৎপন্ন হইবে কিংবা না হইবে?” ইহাতে আপনার কি অভিমত?”
“হে কাত্যায়ণ! ক্ষত্রিয়ও যদি প্রাণিহিংসুক হয়, তবে সে ...... নরকে উৎপন্ন হইবে। ইহা আমার অভিমত, অথচ ইহা আমি অর্হতদের নিকটও শুনিয়াছি।”
“সাধু! সাধু! (ঠিক) মহারাজ! এ সম্বন্ধে আপনার অভিমত ঠিক, আর আপনি অর্হৎগণ হইতে ঠিকই শুনিয়াছেন।”
তাহা কি মনে করেন, মহারাজ! এখানে ব্রাহ্মণ প্রাণিহিংসুক ......। বৈশ্য প্রাণিহিংসুক ......। শূদ্র প্রাণিহিংসুক.....হয়, তবে সে নরকে উৎপন্ন হইবে কিংবা হইবে না? ইহাতে আপনার কি অভিমত?”
“হে কাত্যায়ণ! ...... শূদ্রও যদি প্রাণিহিংসুক হয়, তবে সে নরকে উৎপন্ন হইবে; ইহাই আমার অভিমত, অর্হতদের কাছেও আমি এরূপ শুনিয়াছি।”
“সাধু, সাধু, মহারাজ! ঠিকই আপনার অভিমত, আর অর্হতদের কাছেও ইহা ঠিকই শুনিয়াছেন।”
“কি মনে করেন, মহারাজ! এরূপ হইলে এখানে চারিবর্ণ সম-সম হয় কি না হয়? এ সম্বন্ধে আপনার মত কি?”
“নিশ্চয়, হে কাত্যায়ণ! এরূপ হইলে এক্ষেত্রে চারিবর্ণ সম-সম, এখানে আমি কোন প্রভেদ দেখি না।”
“এ কারণেও মহারাজ! আপনার বুঝা উচিত যে ইহা প্রবাদ মাত্র,- ‘ব্রাহ্মণই শ্রেষ্ঠবর্ণ ...... ব্রহ্মার দায়াদ’।”
৩২০। “তাহা কি মনে করেন, মহারাজ! এখানে কোন ক্ষত্রিয় প্রাণিহিংসা হইতে বিরত হয়, চুরি হইতে, কাম মিথ্যাচার হইতে, মিথ্যাবাদ হইতে, পিশুন, কর্কশ, সমপ্রলাপ হইতে বিরত হয়; অলোভ, অদ্বেষ ও সম্যক্দৃষ্টি সম্পন্ন (সত্য-মতাবলম্বী) হয়, তবে (সে) দেহত্যাগে মৃত্যুরপর সুগতি স্বর্গলোকে উৎপন্ন হইবে কিংবা হইবে না? ইহাতে আপনার কি মত?”
“হে কাত্যায়ণ! ক্ষত্রিয়ও যদি প্রাণিহিংসা হইতে বিরত হয় ...... সম্যক্দৃষ্টি সম্পন্ন হয়, তবে স্বর্গলোকে উৎপন্ন হইবে। ইহাই আমার মত, অর্হতদের নিকটও আমি ইহা শুনিয়াছি।”
“সাধু, সাধু, মহারাজ! ...... আপনি অর্হতদের নিকট ঠিকই শুনিয়াছেন।
তাহা কি মনে করেন, মহারাজ! এখানে কোন ব্রাহ্মণ ...... , বৈশ্য ......, শূদ্র ...... প্রাণিহিংসা হইতে বিরত হয় ...... সম্যক্দৃষ্টি সম্পন্ন হয়, তবে স্বর্গলোকে উৎপন্ন হইবে কি না হইবে?”
“ ...... উৎপন্ন হইবে ......।”
“মহারাজ! এরূপ হইলে চারিবর্ণ সম-সম কি নহে? ...... ?”
“নিশ্চয়, ভো কাত্যায়ণ!”
“এই কারণেও মহারাজ! আপনার বুঝা উচিত যে জগতে ইহা প্রবাদ মাত্র- ‘ব্রাহ্মণ শ্রেষ্ঠবর্ণ ...... ব্রহ্মার দায়াদ’।”
৩২১। “তাহা কি মনে করেন, মহারাজ! কোন ক্ষত্রিয় সন্ধিচ্ছেদ করে (সিঁধ কাটে), গ্রাম লুণ্ঠন করে, ডাকাতি করে, দস্যুবৃত্তি করে, পরস্ত্রী-গমন করে। রাজপুরুষেরা তাহাকে ধরিয়া আপনাকে দেখায়,- ‘দেব! এই ব্যক্তিই আপনার অপরাধী চোর, ইহার সমুচিত দণ্ড বিধান করুন।’ তখন আপনি উহার কি করিবেন?”
“হে কাত্যায়ণ! আমি উহাকে প্রাণদণ্ড, বন্ধনাগার কিংবা নির্বাসন দণ্ড বিধান করিব অথবা যথাপরাধ শাস্তি ঘোষণা করিব। ইহার কারণ কি? হে কাত্যায়ণ! পূর্বে তাহার যে ক্ষত্রিয় সংজ্ঞা ছিল, উহা এখন অন্তর্হিত হইয়াছে। এখন চোরই তাহার সংজ্ঞা।”
“কি মনে করেন, মহারাজ! কোন ব্রাহ্মণ ...... , বৈশ্য ...... , শূদ্র ...... সন্ধিচ্ছেদ করে ...... তবে আপনি তাহাকে কি করিবেন?”
“হে কাত্যায়ণ! আমি তাহাকে দণ্ড দিব, ...... চোরই তাহার নাম।”
“কি মনে করেন, মহারাজ! এরূপ হইলে চারিবর্ণ সম-সম হয় কিংবা হয় না?”
“নিশ্চয়, হে কাত্যায়ণ! সম-সম হয়।”
“এই কারণেই মহারাজ! আপনার বুঝা উচিত যে জগতে ইহা প্রবাদ মাত্র- ‘ব্রাহ্মণই শ্রেষ্ঠবর্ণ ...... ব্রহ্মার দায়াদ’।”
৩২২। “তাহা কি মনে করেন, মহারাজ! এখানে কোন ক্ষত্রিয় কেশ-শ্মশ্রু মুণ্ডন করিয়া কাষায় বসন পরিধান পূর্বক আগার হইতে অনাগারিক ভাবে প্রব্রজিত হয়। সে প্রাণিহিংসা হইতে বিরত, অদত্তদান ...... মৃষাবাদ হইতে বিরত হয়, একাহারী, ব্রহ্মচারী, শীলবান (সদাচারী), কল্যাণধর্মা হয়, তবে তাহার সাথে আপনি কি ব্যবহার করিবেন?”
“হে কাত্যায়ণ! অভিবাদন, প্রত্যুত্থান করিব; আসন দ্বারা নিমন্ত্রণ করিব, চীবর-পিণ্ডপাত (ভিক্ষা), শয়ন-আসন, গিলান-প্রত্যয় (রোগে পথ্য ও ভৈষজ্য) প্রদান করিব, তাঁহার ধার্মিক রক্ষাবরণ-গুপ্তির সংবিধান করিব। কারণ কি? হে কাত্যায়ণ! পূর্বে যে উহার ক্ষত্রিয় সংজ্ঞা ছিল এখন তাহা অন্তর্হিত হইয়াছে। এখন শ্রমণই তাঁহার সংজ্ঞা।”
“মহারাজ! কোন ব্রাহ্মণ ...... , বৈশ্য ...... , শূদ্র কেশ-শ্মশ্রু মুণ্ডন করিয়া....প্রব্রজিত হয়, ...... কল্যাণধর্মা (পুণ্যাত্মা) হয়, তবে তাহাকে কি করিবেন?”
“হে কাত্যায়ণ! অভিবাদন ...... করিব, তাঁহাদের ধার্মিক রক্ষা ...... সম্পাদন করিব। কারণ কি? হে কাত্যায়ণ! পূর্বে তাঁহাদের যে ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, শূদ্র সংজ্ঞা ছিল, উহা এখন অন্তর্হিত হইয়াছে। আজ শ্রমণই তাঁহাদের সংজ্ঞা।”
“কি মনে করেন, মহারাজ! এরূপ হইলে চারিবর্ণ সম-সম হয় কিংবা নহে? ...... ?”
“নিশ্চয়, হে কাত্যায়ণ!”
“এই প্রকারেও মহারাজ! আপনার বুঝা উচিত যে জগতে ইহা প্রবাদ মাত্র- ‘ব্রাহ্মণই শ্রেষ্ঠবর্ণ ...... ব্রহ্মার দায়াদ’।”
৩২৩। এইরূপ উক্ত হইলে ...... রাজা অবন্তিপুত্র আয়ুষ্মান মহাকাত্যায়ণকে বলিলেন,- “আশ্চর্য, হে কাত্যায়ণ! অতি চমৎকার, হে কাত্যায়ণ! যেমন অধঃমুখকে ঊর্ধ করিলেন ...... এই প্রকারেই মাননীয় কাত্যায়ণ! অনেক প্রকারে ধর্ম প্রকাশ করিলেন, এই আমি মাননীয় কাত্যায়ণের শরণ লইলাম, ধর্ম ও ভিক্ষুসংঘেরও। মাননীয় কাত্যায়ণ! আজ হইতে আমাকে অঞ্জলিবদ্ধ শরণাগত উপাসক রূপে স্বীকার করুন।”
“মহারাজ! আপনি আমার শরণ গ্রহণ করিবেন না। আপনি সেই ভগবানেরই শরণ গ্রহণ করুন, যাঁহার শরণ আমিও গ্রহণ করিয়াছি।”
“হে কাত্যায়ণ! সেই ভগবান অর্হৎ সম্যক্সম্বুদ্ধ বর্তমানে কোথায় বাস করিতেছেন?”
“মহারাজ! সেই অর্হৎ সম্যক্সম্বুদ্ধ বর্তমানে পরিনির্বাপিত।”
“হে কাত্যায়ণ! যদি আমরা শুনিতাম সেই ভগবান অর্হৎ সম্যক্সম্বুদ্ধ দশ যোজন দূরে আছেন, তবে আমরা সেই ভগবান অর্হৎ সম্যক্সম্বুদ্ধের দর্শনার্থ দশ যোজনও যাইতাম, বিশ, ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশ, শতযোজনও ...... যাইতাম। যেহেতু হে কাত্যায়ণ! সেই ভগবান মহাপরিনির্বাপিত হইয়াছেন। তথাপি আমরা নির্বান প্রাপ্ত সেই ভগবানের শরণ লইলাম, ধর্ম ও ভিক্ষুসংঘেরও। আজ হইতে মাননীয় কাত্যায়ণ! ...... আমাকে আজীবন শরণাগত উপাসকরূপে ধারণা করুন।”
॥ মধুর সূত্র সমাপ্ত ॥