বোধি রাজকুমার সূত্র (৮৫)

বুদ্ধ জীবনী (গৃহত্যাগ হইতে বুদ্ধত্ব প্রাপ্তি পর্যন্ত)

৩২৪। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-

এক সময় ভগবান ভর্গদেশে সুংসুমারগিরির ভেস-কলাবন মৃগদাবে বিহার করিতেছেন।

সেই সময় বোধি রাজকুমারের কোকনদ নামক প্রাসাদ অচিরে নির্মিত হইয়াছে, এখনও কোন শ্রমণ, ব্রাহ্মণ কিংবা কোন মনুষ্যজাতির অব্যবহৃত। তখন বোধি রাজকুমার সঞ্জিকাপুত্র মাণবককে আহ্বান করিলেন,- “এস তুমি, সৌম্য সঞ্জিকাপুত্র! যেখানে ভগবান আছেন, তথায় যাও; গিয়া আমার বচনে ভগবানের পায়ে নতশিরে বন্দনা কর। আরোগ্য, অনাতঙ্ক, লঘুস্থান (শারীরিক কার্যক্ষমতা), বল ও সুখ-বিহার জিজ্ঞাসা কর,- ‘ভন্তে! রাজকুমার বোধি ভগবানের চরণে নতশিরে বন্দনা করিয়া আরোগ্য ...... জিজ্ঞাসা করিয়াছেন’।”

“হা, প্রভু!” বলিয়া প্রতিশ্রুত হইয়া সঞ্জিকাপুত্র মাণবক যেখানে ভগবান আছেন, তথায় গেলেন; গিয়া ভগবানের সহিত সম্মোদন করিলেন ...... (কুশল প্রশ্ন) ...... জিজ্ঞাসা করিয়া একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট সঞ্জিকাপুত্র মাণবক ভগবানকে বলিলেন,- “ভো গৌতম! বোধি রাজকুমার আপনার চরণে ......। বোধি রাজকুমারের গৃহে আগামী কল্যের ভোজন স্বীকার করুন।”

ভগবান মৌনভাবে স্বীকার করিলেন।

তখন সঞ্জিকাপুত্র মাণবক ভগবানের স্বীকৃতি অবগত হইয়া আসন হইতে উঠিয়া যেখানে বোধি রাজকুমার ছিলেন তথায় গেলেন, গিয়া বোধি রাজকুমারকে বলিলেন,- “আপনার বাক্যানুসারে আমি সেই ভগবান গৌতমকে বলিয়াছি- ‘ভো গৌতম! বোধি রাজকুমার আপনার পাদপদ্মে প্রণাম করিয়াছেন ......।’ শ্রমণ গৌতম নিমন্ত্রণ স্বীকার করিয়াছেন।”

৩২৫। তখন বোধি রাজকুমার সেই রাত্রি গত হইলে স্বীয় প্রাসাদে উত্তম খাদ্য-ভোজ্য প্রস্তুত করাইয়া কোকনদ প্রাসাদকে সিঁড়ির নিচে পর্যন্ত বস্ত্রাচ্ছাদিত করাইয়া সঞ্জিকাপুত্র মাণবককে আহ্বান করিলেন,- “এস, সৌম্য সঞ্জিকাপুত্র! ভগবানের নিকট উপস্থিত হও, গিয়া ভগবানকে সময় জ্ঞাপন কর,-- ‘ভন্তে! সময় হইয়াছে, ভাত প্রস্তুত আছে’।”

“হাঁ, প্রভু!” ...... সময় জ্ঞাপন করিলেন ......।

তখন ভগবান পূর্বাহ্ন সময়ে নিবাসন পরিধান করিয়া পাত্র-চীবর ধারণ করিয়া যেখানে বোধি রাজকুমারের নিবাস তথায় উপস্থিত হইলেন। সেই সময় বোধি রাজকুমার ভগবানের আগমন প্রতীক্ষা করিয়া বহির্দ্বার কোষ্ঠকে (নহবৎ খানার বাহিরে) দাঁড়াইলেন। বোধি রাজকুমার দূর হইতে ভগবানকে আসিতে দেখিলেন, দেখিয়া প্রত্যুৎগমন করিলেন, ভগবানকে অভিবাদন করিলেন, এবং ভগবানকে সম্মুখে রাখিয়া যেখানে কোকনদ প্রাসাদ তথায় লইয়া গেলেন। তখন ভগবান নীচে সিঁড়ির পার্শ্বে দাঁড়াইলেন। তখন বোধি রাজকুমার ভগবানকে বলিলেন,- “ভন্তে ভগবন! বস্ত্রে আরোহণ করুন। সুগত! বস্ত্রের উপর দিয়া চলুন। তাহা আমার দীর্ঘকাল হিতসুখের কারণ হউক।”

এরূপ বলিলে ভগবান নীরব রহিলেন।

দ্বিতীয়বার তৃতীয়বারও বোধি রাজকুমার অনুরোধ করিলেন।

৩২৬। অতঃপর ভগবান আয়ুষ্মান আনন্দের দিকে চাহিলেন। আয়ুষ্মান আনন্দ বোধি রাজকুমারকে বলিলেন,- “রাজকুমার! বস্ত্র সমূহ তুলিয়া লউন। ভগবান বস্ত্রখণ্ডের (চেলপতিং) উপর দিয়া যাইবেন না। তথাগত পরবর্তী জনতার প্রতি লক্ষ্য করিতেছেন।”

তখন বোধি রাজকুমার কাপড় সমূহ অপসারণ করাইয়া কোকনদ প্রাসাদের উপর আসন সজ্জিত করাইলেন। ভগবান কোকনদ প্রাসাদে আরোহণ করিয়া ভিক্ষুসংঘের সহিত সজ্জিত আসনে উপবেশন করিলেন। তখন বোধি রাজকুমার বুদ্ধপ্রমুখ ভিক্ষুসংঘকে উত্তম খাদ্য-ভোজ্য দ্বারা সহস্তে সন্তর্পিত করিলেন, সন্তুষ্ট করিলেন। ভোজনের পর ভগবান পাত্র হইতে হস্ত উত্তোলন করিলে বোধি রাজকুমার এক নীচ আসন লইয়া একপ্রান্তে বসিলেন, একপ্রান্তে উপবিষ্ট বোধি রাজকুমার ভগবানকে বলিলেন,- “ভন্তে! আমার এ ধারণা হয় যে ‘সুখ দ্বারা সুখ লাভ হয় না, দুঃখ দ্বারা সুখ লাভ হয়’।”

৩২৭। “রাজকুমার! সম্বোধি লাভের পূর্বে অনভিসম্বুদ্ধ ও বোধিসত্ব অবস্থায় আমারও এই ধারণাই ছিল,- ‘সুখে সুখ অধিগম্য নহে, দুঃখে সুখ অধিগম হয়।’ এই কারণে রাজকুমার! সেই সময় আমি দহর (তরুণ) অবস্থায়ই গাঢ় কালকেশ ভদ্র যৌবন সম্পন্ন প্রথম বয়সে অশ্রুমুখে রোদন পরায়ণ মাতা-পিতার অনিচ্ছা সত্বে কেশ-শ্মশ্রু মুণ্ডন করিয়া কাষায় বস্ত্র আচ্ছাদিত হইয়া আগার হইতে অনাগারিকরূপে প্রব্রজিত হইয়াছি। এই প্রকারে প্রব্রজিত হইয়া ‘কুশল কি?’ তাহার অন্বেষণে এবং অনুত্তর বর শান্তিপদ (নির্বান) অনুসন্ধান মানসে আলাড়কালামের নিকট উপস্থিত হই, উপস্থিত হইয়া আলাড়কালামকে বলিলাম,- ‘বন্ধু কালাম! আপনার এই ধর্মবিনয়ে আমি ব্রহ্মচর্যবাস করিতে ইচ্ছা করি।’ এরূপ বলিলে রাজকুমার! আলাড়কালাম আমাকে বলিলেন,- ‘বিহার করুন আয়ুষ্মান। তাদৃশ এই ধর্মতত্ব, যাহাতে বিজ্ঞপুরুষ অচিরেই স্বীয় আচার্যত্বকে অভিজ্ঞা দ্বারা স্বয়ং সাক্ষাৎকার ও লাভ করিয়া বিহার করিতে পারেন।’

রাজকুমার! অচিরেই, অতি সত্বরই আমি সেই ধর্মবিনয় আয়ত্ত্ব করি। রাজকুমার! তখন আমি ওষ্ঠপ্রহত মাত্রেই ও লপিতালাপন মাত্রেই (ভাষিত ভাষণ মাত্রেই) তৎক্ষণাৎই সেই জ্ঞানবাদ ও স্থবিরবাদ (বৃদ্ধদের সিদ্ধান্ত) বলিতে পারি।, জানিতে পারি, দেখিতে পারি ...... বলিয়া আমি জ্ঞাপন করিলাম, অপরেও তাহা পারে।

রাজকুমার! আমার মনে (এই চিন্তা) হইল,- ‘আলাড়কালাম এই ধর্মকে কেবল বিশ্বাসের উপর নহে- স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া, অধিগত হইয়া, বিহার করিতেছি- বলিয়া প্রকাশ করেন। নিশ্চয় আলাড়কালাম এই ধর্ম জানিয়া, দেখিয়া উহাতে বিহার করিতেছেন।’ অনন্তর আমি যেখানে আলাড়কালাম ছিলেন তথায়, দেখিয়া উহাতে বিহার করিতেছেন।’ অনন্তর আমি যেখানে আলাড়কালাম ছিলেন তথায় উপনীত হই, উপনীত হইয়া আলাড়কালামকে জিজ্ঞাসা করি- ‘আবুস কালাম! আপনি সাধনার কোন্‌ স্তর পর্যন্ত (কিত্তাবতা) এই ধর্ম স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া, প্রাপ্ত হইয়া প্রকাশ করিতেছেন?’ ইহা জিজ্ঞাসিত হইলে, রাজকুমার! আলাড়কালাম ‘আকিঞ্চণ্যায়তন (স্তর)’ প্রকাশ করিলেন।

রাজকুমার! তখন আমার এ ধারণা জন্মিল,- ‘কেবল আলাড়কালামের শ্রদ্ধা, বীর্য, স্মৃতি, সমাধি ও প্রজ্ঞা আছে এমন নহে; আমারও আছে। সুতরাং যে ধর্ম আলাড়কালাম স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া, প্রাপ্ত হইয়া বিহার করিতেছেন বলিয়া প্রকাশ করেন সেই ধর্মের সাক্ষাৎকারের নিমিত্ত আমিও উদ্যম করিব।’ রাজকুমার! আমি অচিরে, অতি সত্বর স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা তাহা প্রত্যক্ষ করিয়া, প্রাপ্ত হইয়া অবস্থান করিলাম। রাজকুমার! তখন আমি আলাড়কালামের নিকট গিয়া তাঁহাকে বলিলাম,- ‘আবুস কালাম! এপর্যন্ত নহে কি, আপনি এই ধর্ম স্বয়ং জানিয়া, প্রাপ্ত হইয়া অবস্থান করেন বলিয়া প্রকাশ করিতেছেন?’

‘হাঁ, আবুস! আমি এপর্যন্ত এই ধর্ম স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা প্রত্যক্ষ করিয়া, প্রাপ্ত হইয়া উপদেশ করি।’

‘আবুস! এপর্যন্ত ত আমিও এই ধর্মকে স্বয়ং জানিয়া, উপলব্ধি করিয়া অবস্থান করিতে পারি।’

‘আবুস! আমাদের লাভ, আমাদের সুলাভ হইয়াছে। যেহেতু আমরা আপনার ন্যায় আয়ুষ্মানকে সব্রহ্মচারী (গুরুভাই) রূপে দেখিতে পাইলাম। যে ধর্ম আমি স্বয়ং ...... জ্ঞাত হইয়া ...... উপদেশ করি, আপনিও সে ধর্ম স্বয়ং ...... জ্ঞাত হইয়া ...... বিহার করিতেছেন; আপনি যে ধর্মকে স্বয়ং জ্ঞাত হইয়াছেন ...... , আমিও সে ধর্মকে ...... জ্ঞাত হইয়া ...... উপদেশ করি। এই প্রকারে আমি যে ধর্ম জানি সে ধর্ম আপনিও জানেন। যে ধর্ম আপনি জানেন ঠিক সে ধর্ম আমিও জানি। এইরূপে যাদৃশ আমি তাদৃশ আপনি, যাদৃশ আপনি তাদৃশ আমি। অতএব আসুন, বন্ধু! এখন হইতে আমরা উভয়ে একসঙ্গে এই শিষ্যগণকে পরিচালনা করি।’ রাজকুমার! এই প্রকারে আলাড়কালাম আমার আচার্য (শিক্ষাগুরু) হইয়াও অন্তেবাসী আমাকে তাঁহার সমস্থানে স্থাপন করিলেন, উদার পূজায় আমাকে সম্মান করিলেন। তখন আমার এই ধারণা জন্মিল- ‘এই ধর্ম নির্বেদের (উদাসীনতার) জন্য, বৈরাগ্যের জন্য, নিরোধের নিমিত্ত, উপশমের (শান্তির) নিমিত্ত নহে; অভিজ্ঞার (দিব্য শক্তির) নিমিত্ত, সম্বোধির জন্য, নির্বানার্থও সংবর্তিত হয় না; মাত্র আকিঞ্চণ্যায়তন উৎপত্তি পর্যন্তই।’ রাজকুমার! তখন আমি সেই ধর্মকে পর্যাপ্ত মনে না করিয়া নিরপেক্ষভাবে তথা হইতে প্রস্থান করি।

৩২৮। রাজকুমার! তখন আমি ‘কুশল কি?’ ইহা অন্বেষণে সর্বোত্তম শান্তিপদ অনুসন্ধান করিতে করিতে যেখানে উদ্দক-রামপুত্র ছিলেন তথায় উপনীত হই। তথায় উপস্থিত হইয়া উদ্দক-রামপুত্রকে বলিলাম,- ‘আবুস! আমি আপনার ধর্মবিনয়ে ব্রহ্মচর্য আচরণ করিতে ইচ্ছা করি।’ এরূপ উক্ত হইলে, রাজকুমার! উদ্দক-রামপুত্র আমাকে বলিলেন,- ‘এখানে বিহার করুন, আয়ুষ্মান! ইহা তাদৃশ ধর্ম, যাহাতে বিজ্ঞপুরুষ অচিরেই স্বীয় আচার্যত্বকে স্বয়ং জানিয়া সাক্ষাৎকার করিয়া, প্রাপ্ত হইয়া বিহার করিতে পারেন।’ রাজকুমার! সেই আমি অচিরেই, অতিশীঘ্রই সেই ধর্মকে পরিপূর্ণ আয়ত্ত করিলাম। তখন আমি ওষ্ঠসঞ্চালন মাত্রই, ভাষিত ভাষণ মাত্রেই তৎক্ষণাৎ সেই জ্ঞানবাদ আর স্থবিরবাদ বলিতে পারি, জানিতে পারি, দেখিতে পারি বলিয়া জ্ঞাপন করিলাম। আর অপরেও তাহা করিল।

তখন আমার মনে এই চিন্তার উদয় হইল,- ‘রামপুত্র কেবল শ্রদ্ধার উপর নির্ভর করিয়া নহে- এই ধর্ম স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া, প্রাপ্ত হইয়া বিহার করিতেছি বলিয়া প্রকাশ করেন। নিশ্চয় রামপুত্র এই ধর্ম স্বয়ং জানিয়া দেখিয়া উহাতে বিহার করেন।’ তৎপর হে রাজকুমার! যেখানে উদ্দক-রামপুত্র আছেন আমি তথায় উপস্থিত হইলাম, উপনীত হইয়া তাঁহাকে ইহা কহিলাম,- ‘আবুস রামপুত্র! আপনি এই ধর্ম কি পরিমাণ স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া, প্রাপ্ত হইয়া উপদেশ করিতেছেন?’ এরূপ জিজ্ঞাসিত হইলে উদ্দক-রামপুত্র ‘নৈবসংজ্ঞা-নাসংজ্ঞায়তন’ নামক অরূপ ব্রহ্মধ্যান পর্যন্ত ঘোষণা করিলেন।

তখন রাজকুমার! আমার মনে এই চিন্তা হইল,- ‘কেবল যে রামপুত্রের শ্রদ্ধা আছে এমন নহে, আমার নিকটও শ্রদ্ধা আছে; কেবল যে রামপুত্রের বীর্য, স্মৃতি, সমাধি ও প্রজ্ঞা আছে এমন নহে, আমারও তাহা আছে। অতএব যে ধর্ম রামপুত্র- স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎ করিয়া, প্রাপ্ত হইয়া বিহার করিতেছি বলিয়া ঘোষণা করিতেছেন আমি সে ধর্ম প্রত্যক্ষ করিবার নিমিত্ত উদ্যোগ করিব।’

রাজকুমার! তখন আমি অচিরে, অতি সত্বরই সে ধর্ম স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া, প্রাপ্ত হইয়া বিহার করিলাম। এইরূপে আমার আচার্য হইয়াও উদ্দক-রামপুত্র অন্তেবাসী আমাকে তাঁহার সমস্থানে স্থাপন করিলেন......। .....সে কারণে আমি নিরপেক্ষভাবে সে ধর্ম হইতে চলিয়া আসিলাম।

৩২৯। রাজকুমার! ‘কুশল কি?’ ইহার গবেষণাকারী রূপে অনুত্তর বর শান্তিপদের সন্ধান মানসে আমি মগধ প্রদেশে ক্রমান্বয়ে বিচরণ করিতে করিতে যেখানে উরুবেলা সেনানী নিগম তদভিমুখে অগ্রসর হইলাম। তথায় আমি দেখিতে পাইলাম এক রমণীয় ভূমিভাগ, মনোহর বনষণ্ড (গভীরবন) ও অদূরে স্বচ্ছসলিলা সুতীর্থযুক্তা নদী প্রবাহমানা এবং চতুর্দিকে রমণীয় গোচরগ্রাম । তখন আমার মনে এই চিন্তার উদয় হইল,- আহা! একান্তই রমণীয় ভূভাগ ...... প্রসাদজনক বনষণ্ড স্বচ্ছসলিলা শ্বেত সুতীর্থযুক্তা রমণীয়া নদী প্রবাহিতা; চতুর্দিকে গোচরগ্রাম। সাধনাপ্রয়াসী কুলপুত্রের পক্ষে সাধনার নিমিত্ত ইহাই ত উপযুক্ত স্থান।’ রাজকুমার! ইহাই সাধনার উপযুক্ত মনে করিয়া আমি সে স্থানেই ধ্যানে নিবিষ্ট হইলাম।

রাজকুমার! তখন আমার নিকট তিনটি অশ্রুতপূর্ব অত্যাশ্চর্য উপমা প্রতিভাত হয়- (১) যেমন ক্ষীরযুক্ত (স্লেহ) আর্দ্রকাষ্ঠ জলে নিক্ষিপ্ত হইল। তৎপর কোন পুরুষ ‘অগ্নি প্রজ্বলিত করিব, তেজ প্রাদুর্ভূত করিব’ এই চিন্তা করিয়া যদি উত্তরারণি লইয়া তথায় আসে,- রাজকুমার! কি মনে করেন, সেই ব্যক্তি ্লেহযুক্ত জলে নিক্ষিপ্ত সেই আর্দ্রকাষ্ঠকে উত্তরারণি লইয়া মন্থন করিলে অগ্নি উৎপাদন করিতে, তেজ প্রাদুর্ভূত করিতে পারিবে কি?”

“না ভন্তে! তাহা কখনও সম্ভব নহে।”

“ইহার কারণ কি? যেহেতু সেই কাষ্ঠ ্লেহযুক্ত ও আর্দ্র, তদুপরি তাহা জলে নিক্ষিপ্ত। সুতরাং যে ব্যক্তি তাহাতে কেবল শ্রম-ক্লান্তি ও মনোকষ্টেরই ভাগী হইবে।

সেইরূপ হে রাজকুমার! যে কোন শ্রমণ কিংবা ব্রাহ্মণ দৈহিক কামভোগে নিবৃত্ত না হইয়া অবস্থান করেন তাঁহাদের মধ্যে যাঁহারা কামভোগের প্রতি যে কামচ্ছন্দ, কামরুচি, কামমুর্চ্ছা, কামপিপাসা ও কাম পরিদাহ বিদ্যমান, উহা যদি ভিতর থেকে সুপ্রহীণ না হয়, সু-উপশান্ত না হয় তবে উপক্রমকারী সেই সকল মাননীয় শ্রমণ-ব্রাহ্মণেরা তীব্র কঠোর দুঃখ-বেদনা অনুভব করেন। তাঁহাদের পক্ষে অনুত্তর জ্ঞান-দর্শন ও সম্বোধি (লোকোত্তর মার্গ) লাভ অসম্ভব। যদিও সে সকল মাননীয় শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণ উপক্রমজনিত তীব্র কঠোর দুঃখ-বেদনা অনুভব না করেন, তথাপি তাঁহারা অনুত্তর জ্ঞানদর্শন ও সম্বোধি লাভের অযোগ্যই। রাজকুমার! ইহাই আমার অশ্রুতপূর্ব অত্যাশ্চর্য প্রথম উপমা প্রতিভাত হইয়াছিল।

৩৩০। (২) রাজকুমার! অপরও এক অশ্রুতপূর্ব অত্যাশ্চর্য দ্বিতীয় উপমা আমার নিকট প্রতিভাত হইয়াছিল। যেমন রাজকুমার! ্লেহযুক্ত আর্দ্রকাষ্ঠ জল হইতে দূরে স্থলে নিক্ষিপ্ত হইল। কোন ব্যক্তি ‘অগ্নি প্রজ্বলিত করিব, তেজ উৎপাদন করিব’ এই উদ্দেশ্যে উত্তরারণি লইয়া তথায় আসিল। তাহা কি মনে করেন, রাজকুমার! তবে সেই ব্যক্তি অগ্নি প্রজ্বলিত করিতে, তেজ উৎপাদন করিতে সমর্থ হইবে কি?”

“না ভন্তে! কখন ও সম্ভব নহে।”

“ইহার কারণ কি?”

“যেহেতু ভন্তে! যদিও সেই কাষ্ঠ ...... জল হইতে দূরে স্থলে নিক্ষিপ্ত তবুও তাহা আর্দ্র ও ্লেহযুক্ত। সে ব্যক্তি শুধু শ্রম-ক্লান্তি ও বিঘাতের ভাগী হইবে।”

“সেইরূপই রাজকুমার! যে কোন শ্রমণ কিম্বা ব্রাহ্মণ দৈহিক কামভোগে লিপ্ত থাকে ...... কামের প্রতি তাঁহাদের যে কামচ্ছন্দ, কামলালসা ...... বিদ্যমান, ...... তাহা সু-উপশান্ত না হয়, তাঁহারা ...... অযোগ্যই। রাজকুমার! এই অশ্রুতপূর্ব অত্যাশ্চর্য দ্বিতীয় উপমাও আমার নিকট প্রতিভাত হইয়াছিল।

৩৩১। (৩) রাজকুমার! অপর এক অশ্রুতপূর্ব অত্যাশ্চর্য তৃতীয় উপমাও আমার নিকট প্রতিভাত হইয়াছিল। যেমন রাজকুমার! নীরস শুষ্ককাষ্ঠ জল হইতে দূরে স্থলে নিক্ষিপ্ত হয়। অনন্তর কোন ব্যক্তি অগ্নি উৎপাদন করিব, তেজ প্রজ্বলিত করিব’ এই উদ্দেশ্য করিয়া উত্তরারণি লইয়া আসিল। তবে ...... সে ব্যক্তি নীরস শুষ্ক, জল হইতে দূরে স্থলে নিক্ষিপ্ত কাষ্ঠকে উত্তরারণিতে ঘর্ষণ করিয়া অগ্নি উৎপাদন করিতে, তেজ প্রকাশ করিতে সমর্থ হইবে কি?

“হাঁ, ভন্তে! নিশ্চয় সমর্থ হইবে।”

“ইহার কারণ কি?”

যেহেতু ভন্তে! সেই শুষ্ককাষ্ঠ নীরস, আর জল হইতে দূরে স্থলে নিক্ষিপ্ত হইয়াছে।”

“এইরূপই রাজকুমার! যে কোন শ্রমণ কিংবা ব্রাহ্মণ কায়দ্বারা ভোগবাসনা হইতে নির্লিপ্ত হইয়া অবস্থান করেন এবং কাম্যবস্তুর প্রতি তাঁহাদের যে কামচ্ছন্দ ...... কাম পরিদাহ আছে, তাহা অধ্যাত্মে সুপ্রহীণ ও সু-উপশমিত হয়। তবে সেই পরাক্রমশালী মহানুভব শ্রমণ-ব্রাহ্মণেরা তীব্র কঠোর দুঃখ-বেদনা অনুভব করিলেও তাঁহাদের পক্ষে অনুত্তর জ্ঞানদর্শন ও সম্বোধিলাভ সম্ভব হয়। যদি সেই মহানুভব শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণ উপক্রমজনিত তীব্র কঠোর দুঃখ-বেদনা ভোগ নাও করেন, তথাপি তাঁহারা অনুত্তর জ্ঞানদর্শন ও সম্বোধি লাভের যোগ্য পাত্রই হন। রাজকুমার এই অশ্রুতপূর্ব অত্যাশ্চর্য তৃতীয় উপমা তখন আমার প্রতিভাত হইয়াছিল।

৩৩২। রাজকুমার! তখন আমার এই চিন্তা হইয়াছিল,- ‘দন্তের উপর দন্ত স্থাপন করিয়া, জিহ্বাদ্বারা তালু চাপিয়া, কুশলচিত্ত দ্বারা অকুশলচিত্তকে অভিনিগৃহীত করিয়া অভিনিপীড়িত ও অভিসন্তপ্ত করি।’ ...... তাহা করিবার সময় আমার কক্ষ (বগল) হইতে ঘর্ম নির্গত হয়। ...... যেমন কোন বলবান পুরুষ অপর দুর্বল পুরুষকে শিরে কিংবা ঘারে ধরিয়া অভিনিগৃহীত, অভিনিপাড়িত ও অভিসন্তপ্ত করে, তেমন রাজকুমার! আমার দন্তদ্বারা দন্ত চাপিয়া, জিহ্বাদ্বারা তালু স্পর্শ করিয়া চিত্তদ্বারা চিত্তকে অভিনিগৃহীত, অভিনিপীড়িত ও অভিসন্তপ্ত করিবার সময় আমার কক্ষ হইতে স্বেদ নির্গত হয়। আমার অশিথিল বীর্য আরব্ধ হয়, নির্ভুল স্মৃতি উপস্থাপিত থাকে, আর সেই কঠোর সাধনা-উদ্যোগ দ্বারাই প্রধানাহত (উদ্যোগ প্রপীড়িত) অবস্থাতে ও আমার দেহ ক্লান্ত হইয়াছে, প্রকৃত পক্ষে উপশান্ত হয় নাই।

৩৩৩। রাজকুমার! তখন আমার মনে এই চিন্তার উদয় হয়,- ‘এখন আমি অপ্রাণক (নিশ্বাসরহিত) ধ্যান সাধনা করিয়া দেখি।’ সে সময় আমি মুখ ও নাসিকায় আশ্বাস-প্রশ্বাস রুদ্ধ করি। রাজকুমার! আমার মুখ ও নাসিকায় আশ্বাস-প্রশ্বাস রুদ্ধ হইলে কর্ণছিদ্র দিয়া নিষ্ক্রান্ত বায়ুর অধিকমাত্রায় শব্দ হইতে থাকে। কর্মকারের ভস্ত্রা হইতে বায়ু নির্গত হইবার সময় যেমন অধিক শব্দ হয়, তেমন আমার মুখ ও নাসিকায় আশ্বাস-প্রশ্বাস রুদ্ধ হইলে কর্ণছিদ্র দিয়া নিষ্ক্রান্ত বায়ুর অধিক মাত্রায় শব্দ হইতে লাগিল। রাজকুমার! তথাপি আমার অদম্য উৎসাহ আরব্ধ হইল, অভ্রান্ত স্মৃতি উপস্থাপিত হইল; সেই কঠোর ধ্যানোদ্যগের দ্বারা উদ্যোগাহত হওয়া অবস্থাতে আমার দেহ ক্লান্ত হইয়াছে, কিন্তু প্রকৃত উপশান্ত হয় নাই।

রাজকুমার! তখন আমার এই চিন্তা হইল,- ‘এখন আমি শুধু আশ্বাস-প্রশ্বাস নিরোধের ধ্যানই সাধনা করি।’ তখন আমি মুখে, নাসিকায় ও কর্ণে আশ্বাস-প্রশ্বাস নিরুদ্ধ করিলাম। রাজকুমার! মুখে, নাসিকায় ও কর্ণে আশ্বাস-প্রশ্বাস রুদ্ধ করিলে বায়ু অধিক মাত্রায় মাথায় আঘাত করিতে থাকে। যেমন বলবান পুরুষ তীক্ষ্ন শিখরদ্বারা শিরে আঘাত করে তেমন রাজকুমার! আমার ......।

তখন রাজকুমার! আমার চিন্তা হইল,- ‘এখন আমি কেবল অপ্রাণক ধ্যানই অভ্যাস করি।’ আমি নাকে, মুখে ও কর্ণে আশ্বাস-প্রশ্বাস রুদ্ধ করিলাম। .....আশ্বাস-প্রশ্বাস রুদ্ধ করিলে আমার শিরে অধিক মাত্রায় শিরঃ বেদনা উৎপন্ন হয়। ......।

রাজকুমার! তখন আমার মনে হইল,- ‘এখন আমি পুনরায় অপ্রাণক ধ্যানই সাধনা করি।’ অনন্তর আমি মুখে, নাকে ও কর্ণে আশ্বাস-প্রশ্বাস রুদ্ধ করিলাম। ...... আমার আশ্বাস-প্রশ্বাস রুদ্ধ হইলে বায়ু অধিক মাত্রায় আমার কুক্ষি কর্তন করিতে থাকে। যেমন কোন গো-ঘাতক ছুরিকা দ্বারা গরুর-কুক্ষি পরিকর্তন করে, সেইরূপ...... আমার অদম্য উৎসাহ আরব্ধ হয়.... দেহ ক্লান্ত হইয়াছে, কিন্তু উপশান্ত হয় নাই।

রাজকুমার! তখন আমার মনে হইল,- ‘এখন আমি অপ্রাণক ধ্যান অনুশীলন করিব।’ তখন আমি মুখে, নাসিকায় ও কর্ণে আশ্বাস-প্রশ্বাস রুদ্ধ করিলাম। তাহা রুদ্ধ করিলে অধিক মাত্রায় দেহে দাহ উৎপন্ন হয়। যেমন দুইজন বলবান পুরুষ কোন দুর্বলতর পুরুষের উভয় বাহুতে ধরিয়া জ্বলন্ত অঙ্গারগর্তে সন্তপ্ত করে, সম্পরিতপ্ত করে, তেমন ভাবেই ...... আশ্বাস-প্রশ্বাস রুদ্ধ হইলে অধিক মাত্রায় আমার দেহে দাহ উৎপন্ন হয়। রাজকুমার! তখন আমার অদম্য উৎসাহ আরব্ধ হয়, অসংমূঢ় স্মৃতি উপস্থাপিত হয়, সেই দুঃখজনক উদ্যোগদ্বারা উদ্যোগাহত হইয়া আমার দেহ ক্লান্ত হইয়াছে, কিন্তু উপশান্ত হয় নাই।

রাজকুমার! কোন কোন (অধিষ্ঠাত্রী) দেবতা (এ অবস্থায়) আমাকে দেখিয়া বলিয়া উঠিল, ‘শ্রমণ গৌতম বুঝি কালগত হইয়াছেন । কোন কোন ...... দেবতা বলিলেন,- ‘শ্রমণ গৌতম মরেন নাই, অথচ মরণোম্মুখ হইয়াছেন।’ কোন কোন ...... দেবতা বলিলেন,- ‘শ্রমণ গৌতম মরেন নাই, মরণোম্মুখও নহেন। তিনি যে অর্হৎ, অর্হৎগণের ধ্যান-বিহার এরূপই হইয়া থাকে।’

৩৩৪। তখন আমার এই চিন্তা হইল,- ‘এখন আমি সর্বতোভাবে আহার-উপচ্ছেদ (অনশন) ব্রত অবলম্বন করি।’ তখন দেবতারা আমার নিকট আসিয়া বলিলেন,- ‘মারিস! আপনি সর্বাংশে আহার-উপচ্ছেদার্থ অগ্রসর হইবেন না। আমরা আপনার লোমকূপ দিয়া দিব্য ওজঃ প্রবেশ করাইয়া দিব- যাহাতে আপনি যাপন করিবেন।’ ...... তখন আমার চিন্তা হইল,- ‘যদি আমি সর্বতোভাবে অনশন ব্রত গ্রহণ করি এবং এই সকল দেবতা আমার লোমকূপ দিয়া দিব্য ওজঃ প্রবেশ করাইয়া দেন যদ্বারা আমি যাপন করিতে পারি; তাহা হইলে আমার সে ব্রত মিথ্যা প্রতিপন্ন হইবে।’ আমি দেবতাদিগকে বলিলাম,- ‘তোমরা এরূপ করিও না।’

রাজকুমার! তখন আমার মনে হইল,- ‘এখন আমি অল্প অল্প প্রসৃতি (করকোষ) পরিমাণ আহার গ্রহণ করিব, তাহা মুগের যূষই হউক, কুলত্থের যূষই হউক, কলাইয়ের যূষই হউক অথবা অরহরের যূষই হউক।’ তখন হইতে আমি ...... প্রসূতি পরিমাণ আহার করিতে আরম্ভ করি ......। তাহা করিতে গিয়া আমার শরীর অধিক মাত্রায় কৃশতার চরম সীমায় পৌঁছিল। অসিতিক বা কাল-লতার গ্রন্থির সন্ধিস্থানে ম্লান হইয়া মধ্যে উন্নতাবনত হয়। সেই স্বল্পাহারের দরুণ আমার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ উন্নতাবনত হয়, সেই স্বল্পাহারের হেতু আমার গুহ্যদ্বার উষ্ট্রপাদের ন্যায় মধ্যে গভীর হইয়াছিল। সেই অল্পাহারত্বের হেতু আমার পৃষ্ঠকণ্টক রজ্জুবুনার আবর্তাবলীর ন্যায় উন্নতাবনত হইয়াছিল। যেমন জীর্ণ গৃহের বর্‌গাগুলি (গোপানসী) অবলগ্ন-বিলগ্ন (এলোমেলো) হয় তেমন সেই অল্পাহার হেতু আমার বক্ষপঞ্জরগুলি অবলগ্ন-বিলগ্ন হইয়াছিল। যেমন গভীর জলকূপে (উদপানে) উদকতারা (জলচন্দ্র) গভীরে বহুদূরে প্রবিষ্ট দেখা যায়, সেই প্রকার ...... আমার অক্ষিকূপে অক্ষিতারা বহু গভীরে অনুপ্রবিষ্ট দেখা যাইত। যেমন তিক্ত অলাবু কঁচি অবস্থায় ছিন্ন হইলে বাতাতপ সম্পৃক্ত হইয়া শুষ্ক ও ম্লান হয়, সেইরূপ অল্পাহার হেতু আমার শিরঃচর্ম শুষ্ক ও সংম্লান হইয়াছে।

রাজকুমার! তখন সেই অল্পাহারজনিত দুষ্কর চর্যা এত কঠোর হইয়া আমার উদরচর্ম পৃষ্ঠকণ্টকে সংলগ্ন হইয়াছিল যে আমি উদরচর্ম স্পর্শ করিতে গিয়া তৎসঙ্গে পৃষ্ঠকণ্টক ধরিতাম; পৃষ্ঠকণ্টক স্পর্শ করিতে গিয়া সঙ্গে সঙ্গে উদরচর্মই ধরিতাম। ...... পায়খানা প্রস্রাব করিতে গিয়া সে স্থানেই কুব্জ হইয়া ভূপতিত হইতাম।

আমি শরীর আশ্বস্থ করিবার মানসে হস্তদ্বারা এইদেহ পরিমার্জনা করি ......। তখন আমার দেহ পরিমার্জনা করিবার সময় সেই অল্পাহার হেতু পূতিমূল লোমরাশি অঙ্গ হইতে স্খলিত হইয়া পড়ে। রাজকুমার! তখন লোকেরা আমাকে দেখিয়া বলিত,- ‘শ্রমণ গৌতম কালো হইয়া গিয়াছেন।’ কেহ কেহ বলিত,- ‘শ্রমণ গৌতম কাল হন নাই, তিনি শ্যামবর্ণ হইয়াছেন।’ কেহ কেহ বলিত,- ‘শ্রমণ গৌতম কালো কিংবা শ্যামবর্ণ হন নাই, তাঁহার চর্মরঙ্‌ মঙ্গুলবর্ণ (মঞ্জুলবর্ণ?) হইয়াছে।’ রাজকুমার! আমার এমন পরিশুদ্ধ পরিষ্কৃত চেহারা সেই অল্পাহার হেতু এতই বিনষ্ট হইয়াছিল।

৩৩৫। রাজকুমার! তখন আমার মনে হইল,- ‘অতীতকালে যে সকল শ্রমণ-ব্রাহ্মণ সাধনোদ্যোগজনিত তীব্র কঠোর দুঃখ-বেদনা সহ্য করিয়াছিলেন তাহা এই পরিমাণ, ইহার অধিক নহে। অনাগত ও বর্তমানকালেও ...... ইহার অধিক নহে। কিন্তু হে রাজকুমার! আমি কঠোর দুষ্কর ক্রিয়া দ্বারা উত্তর-মনুষ্যধর্ম ও সর্বোত্তম (অসম) আর্য-জ্ঞানদর্শন-বিশেষ অধিগত হইতে পারি নাই। (চিন্তা হইল) তবে কি বোধিলাভের নিমিত্ত অন্য কোন উপায় আছে?

রাজকুমার! তখন আমার মনে এই চিন্তা হইল,- ‘আমি বেশ জানি পিতা শুদ্ধোদন শাক্যের কৃষিক্ষেত্রে হলকর্ষণোৎসবে জম্বুবৃক্ষের সুশীতল ছায়ায় উপবিষ্ট অবস্থায় কাম ও অকুশল ধর্ম হইতে বিবিক্ত হইয়া ...... প্রথম ধ্যান লাভ করিয়া উহাতে অবস্থান করি। তবে কি ইহা (এই আণাপান প্রথম ধ্যান) বোধিলাভের মার্গ হইবে?’ রাজকুমার! তখন আমার এই স্মৃতি অনুগামী জ্ঞান উৎপন্ন হইল- ‘ইহাই সত্যোপলব্ধির মার্গ।’ তখন আমার মনে এই চিন্তার উদয় হইল,- ‘যেই ধ্যান-সুখ কাম ও অকুশল ধর্ম হইতে স্বতন্ত্র আমি কি সেই সুখকে ভয় করি?’ আমার মনে হইল,- ‘ ...... আমি সেই ধ্যান-সুখকে ভয় করি না।’

রাজকুমার! তখন আমার মনে হইল,- ‘এইরূপ অধিকমাত্রায় জীর্ণশীর্ণ দেহে সেই সুখ অর্জন করা সুকর নহে। অতএব আমি স্থূল আহার অন্ন-ব্যঞ্জন ভোজন করি।’ রাজকুমার! এই ভাবিয়া আমি স্থূল আহার ভাত-তরকারী ভোজন করিতে আরম্ভ করিলাম।

সেই সময় যেই পঞ্চভিক্ষু আমার সেবায় নিযুক্ত ছিলেন (তাঁহাদের আশা) শ্রমণ গৌতম যে ধর্ম আবিষ্কার (অধিগম) করিবেন তাহা তিনি আমাদিগকে উপদেশ করিবেন। কিন্তু যখন আমি স্থূল আহার অন্ন-ব্যঞ্জন ভোজন করিতে আরম্ভ করিলাম তখন সেই পঞ্চভিক্ষু ‘প্রত্যয়-বহুল ও সাধনা-বিমুখ শ্রমণ গৌতম বাহুল্যে প্রত্যাবৃত হইয়াছেন,’ (ভাবিয়া) উদাসীনভাবে প্রস্থান করিলেন ।

৩৩৬। রাজকুমার! আমি স্থূল আহার গ্রহণে বল সঞ্চয়পূর্বক কামভোগে নির্লিপ্ত হইয়া, অকুশল ধর্ম হইতে পৃথক হইয়া.... প্রথম ধ্যান লাভ করিয়া উহাতে অবস্থান করি। বিতর্ক-বিচারের উপশম হেতু ...... দ্বিতীয় ধ্যান, তৃতীয় ধ্যান, চতুর্থ ধ্যান লাভ করিয়া তাহাতে বিহার করি।

(১) এই প্রকারে পরিশুদ্ধ, পর্যাবদাত, অঙ্গনরহিত, উপক্লেশ মুক্ত, মৃদুভূত, কর্মক্ষম, স্থির ও অচঞ্চল অবস্থায় আমার চিত্ত সমাহিত (ধ্যান নিবিষ্ট) হইলে জাতিস্মর জ্ঞানাভিমুখে চিত্তকে অভিনমিত করি। তখন আমি বহুবিধ পূর্বনির্বাস (জন্ম) অনুস্মরণ করি, যথা- একজন্মও, দুইজন্মও ......। এইরূপে আকার উদ্দেশ সহিত (স্বরূপ ও গতি সহ) অনেক প্রকার পূর্বজন্ম অনুস্মরণ করি। রাজকুমার! অপ্রমত্ত, বীর্যবান, সাধনায় দেহ-প্রাণ সমর্পিত যোগীর ন্যায় রাত্রির প্রথম যামে আমার এই প্রথম বিদ্যা (জাতিস্মর জ্ঞান) অধিগত; (জন্মান্তর প্রতিচ্ছাদক) অবিদ্যা বিহত, বিদ্যা উৎপন্ন; তমঃ বিহত, আলোক উৎপন্ন হয়।

(২) এই প্রকারে ...... আমার চিত্ত অচঞ্চল অবস্থায় সমাহিত হইলে অপর সত্ত্বগণের চ্যুতি-উৎপত্তি জ্ঞানের (জন্ম-মৃত্যু রহস্য উদ্‌ঘাটনের) নিমিত্ত আমার চিত্তকে নিয়োজিত করি। তখন বিশুদ্ধ, মনুষ্য-চক্ষুর বহির্ভূত দিব্যচক্ষু দ্বারা আমি হীনোৎকৃষ্ট, উত্তম-অধমবর্ণের স্ব স্ব কর্মানুসারে সুগতি প্রাপ্ত, দুর্গতি প্রাপ্ত সত্ত্বগণকে চ্যুতি ও উৎপত্তির সময় দেখিতে পাই; যেমন কর্ম তেমন গতিপ্রাপ্ত সত্ত্বগণকে প্রকৃষ্টরূপে জানিতে পারি। রাজকুমার! রাত্রির মধ্যম যামে অপ্রমত্ত, আতাপী, সাধনায় দেহ-প্রাণ সমর্পিত আমার এই দ্বিতীয় বিদ্যা অধিগত হয়; (সত্ত্বগণের চ্যুতি-প্রতিসন্ধি আচ্ছাদক) অবিদ্যা বিহত, বিদ্যা (দিব্যচক্ষু) উৎপন্ন; অন্ধকার বিহত, আলোক উৎপন্ন হয়।

(৩) এই প্রকারে ...... আস্রবরাশির ক্ষয় (অর্হৎ মার্গ) জ্ঞানের নিমিত্ত (বিদর্শনে) আমার চিত্ত নিয়োজিত করি। তখন আমি ‘ইহা দুঃখ আর্যসত্যপ্রকৃষ্টরূপে জানিতে পারি, ‘ইহা দুঃখ সমুদয় (উৎপত্তির কারণ) আর্যসত্য’ যথার্থরূপে জানিতে পারি, ‘ইহা দুঃখ নিরোধ আর্যসত্য’ যথার্থরূপে জানিতে পারি, ‘ইহা দুঃখ নিরোধগামিনী প্রতিপদা আর্যসত্য’ ইহা যথাভূত অভিজ্ঞাত হই। ‘এ সকল আস্রব, ইহা আস্রব সমুদয়, ইহা আস্রব নিরোধ, ইহা আস্রব নিরোধের প্রতিপদা বা উপায়’ যথাভূত অভিজ্ঞাত হই। এই প্রকারে জানিবার ও দেখিবার (মার্গকৃত্যের) ফলে আমার চিত্ত কামাস্রব হইতে বিমুক্ত হইল, ভবাস্রব হইতে বিমুক্ত হইল এবং অবিদ্যা আস্রব হইতে বিমুক্ত হইল। ‘বিমুক্তিতে বিমুক্ত’ এই জ্ঞানের উদয় হইল। তদ্বারা অভিজ্ঞাত হইলাম,- ‘জন্ম ক্ষীণ হইয়াছেব্রহ্মচর্য ব্রত উদ্‌যাপিত হইয়াছে, কর্তব্য কৃত হইয়াছে। এখন এতদ্ভাবের জন্য অপর করণীয় নাই।’ রাজকুমার! রাত্রির পশ্চিম যামে ইহাই অপ্রমত্ত, আতাপী দেহ-প্রাণ সমর্পিত করিয়া অবস্থানকারী আমার তৃতীয় বিদ্যা অধিগত হইল; অবিদ্যা বিহত, বিদ্যা উৎপন্ন হইল; তমঃ বিহত, আলোক উৎপন্ন হইল।

৩৩৭। তখন (বুদ্ধত্ব লাভের অষ্টম সপ্তাহের কথা) রাজকুমার! আমার এই চিন্তা হইল,- ‘আমার গভীর, দুর্দর্শ , দুরানুবোধ্য, শান্ত, উত্তম, অতর্কাবচর (-গম্য), নিপুণ (সূক্ষ্ম), পণ্ডিত বেদনীয় এই ধর্ম (আর্যসত্য) অধিগত হইয়াছে। এই জনসাধারণ আলয়ারাম (কামতৃষ্ণায় রমিত), আলয়ে রত (পঞ্চ কামভোগে লিপ্ত), আলয়ে প্রমোদিত। আলয়ারাম, আলয়রত, আলয় প্রমোদিত জনসাধারণের এই তত্ব যেমন এই কার্য-কারণ ভাব সমন্বিত প্রতীত্যসমুৎপাদ দর্শন করা দুষ্কর, তাহাদের পক্ষে এই তত্বও তেমন সর্বসংস্কার শমথ, সর্ব উপাধি বর্জিত, তৃষ্ণাক্ষয়, বিরাগ, নিরোধরূপ নির্বান প্রত্যক্ষ করাও দুষ্কর। যদি আমি এই ধর্ম উপদেশ করি এবং অপরে ইহা বুঝিতে না পারে, তবে তাহা আমার পক্ষে ক্লান্তি ও কষ্টের কারণ হইবে।’

রাজকুমার! তখন আমার এই অশ্রুতপূর্ব, অত্যাশ্চর্য গাথাবলী প্রতিভাত হইল,-

‘বহু কষ্টে অধিগত এধর্ম আমার,

এখন প্রকাশে কারো নাই উপকার।

রাগ-দ্বেষে অভিভূত ভ্রান্ত জনগণ,

বুঝিবে না যথাযথ ধর্ম সনাতন।

প্রতি-স্রোতগামী ধর্ম নিবৃত্তি-প্রবণ,

গভীর দুর্দর্শ অণু, স্বচ্ছ সুমহান।

তমোস্কন্ধে আবরিত রাগাসক্ত জন,

প্রকৃত সদ্ধর্ম রূপ দেখেনা তখন।’

রাজকুমার! এই চিন্তার দরুণ অনুৎসুক্যের দিকে আমার চিত্ত নমিত হইল, ধর্ম দেশনার প্রতি নহে।

৩৩৮। অনন্তর রাজকুমার! আমার মনোভাব অবগত হইয়া সোহংপতি ব্রহ্মার এই চিন্তা হইল,- ‘আহা! জগৎ নষ্ট হইল, জগৎ বিনষ্ট হইল। যেহেতু তথাগত অর্হৎ সম্যক্‌সম্বুদ্ধের চিত্ত ধর্ম প্রচারের প্রতি নমিত না হইয়া অনুৎসুক্যের দিকে নমিত হইল।’ রাজকুমার! তখন বলবান পুরুষ যেমন (অনায়াসে) সঙ্কুচিত বাহু প্রসারিত করে, প্রসারিত বাহু সঙ্কুচিত করে তেমন ভাবেই সোহংপতি ব্রহ্মা ব্রহ্মলোকে অন্তর্হিত হইয়া আমার সম্মুখে আবির্ভূত হইলেন। তিনি একাংসে উত্তরাসঙ্গ (উত্তরীয়) স্থাপন করিয়া আমার প্রতি কমলাঞ্জলি প্রণত হইয়া আমাকে কহিলেন,- ‘প্রভো ভগবন! ধর্ম উপদেশ করুন, সুগত! আপনি ধর্ম প্রচার করুন। স্বল্প রজঃজাতীয় সত্বেরা আছে, যাহারা ধর্মের অশ্রবণতা হেতু পরিহীণ হইবে। ধর্মের যথার্থ জ্ঞাতা অবশ্যই হইবে।’ ইহা বলিয়া অতঃপর গাথায় স্তুতি করিয়া বলিলেন,-

‘মগধ প্রদেশে পূর্বে ছিল প্রতিষ্ঠিত,

অবিশুদ্ধ ধর্ম যাহা সমল-কল্পিত।

অমৃতের দ্বার এবে কর উদ্‌ঘাটন,

বিমল-প্রত্যক্ষ ধর্ম শুনুন সুজন। (১)

শৈলস্থিত কোন লোক পর্বত শিখরে,

নিুে যথা চারিদিকে দেখে জনতারে।

সেইরূপ হে সুমেধ! করি আরোহণ,

ধর্মময় প্রাসাদেতে সামন্ত নয়ন!

বীতশোক! চেয়ে দেখ, শোকাকুল জনে,

জন্ম-জরা প্রপীড়িতে প্রজ্ঞার নয়নে। (২)

উঠ বীর! ঋণমুক্ত, বিজিত সমর,

সার্থবাহ সর্বলোকে বিচরণ কর।

সদ্ধর্ম প্রচার কর করুণা নিধান!

নিশ্চয় মিলিবে শ্রোতা বহু জ্ঞানবান।’ (৩)

৩৩৯। তখন আমি মহাব্রহ্মা সোহংপতির আরাধনা বিদিত হইয়া জীবগণের প্রতি করুণা বশতঃ বুদ্ধ চক্ষুদ্বারা জীব-জগৎ বিলোকন করি। বুদ্ধ-দৃষ্টিতে বিশ্ব বিলোকন করিয়া আমি স্বল্পরজঃ, মহারজঃ, তীক্ষ্নিন্দ্রিয়, মৃদু ইন্দ্রিয়, সু-আকারবান, সুবোধ এবং পরলোক ও দোষের প্রতি ভয়দর্শী হইয়া অবস্থানকারী কোন কোন সত্বগণকে দেখিতে পাইলাম। যেমন উৎপল (নীলকমল), পদ্ম (রক্তকমল) অথবা পুণ্ডরীক (শ্বেতকমল) সমূহের মধ্যে কোন কোন উৎপল, পদ্ম কিংবা পুণ্ডরীক জলে সঞ্জাত, জলে সংবর্ধিত, জলাভ্যন্তরগত, জলাভ্যন্তরে পোষিত হয়; অপর কোন কোন উৎপল, পদ্ম অথবা পুণ্ডরীক জলে উৎপন্ন, জলে সংবর্ধিত ও জলসম স্থিত থাকে; আবার কোন কোনটি উদকে জাত, উদকে সংবর্ধিত, জল হইতে উচ্চে উত্থিত হইয়া, জল দ্বারা উপলিপ্ত না হইয়া দাঁড়াইয়া থাকে; তেমন ভাবেই হে রাজকুমার! আমি বুদ্ধ-চক্ষুতে বিশ্ব বিলোকন করিতে গিয়া অল্পরজঃ, মহারজঃ, তীক্ষ্নিন্দ্রিয়, মৃদু ইন্দ্রিয়, সু-আকার বিশিষ্ট, সুবোধ, আর পরলোক ও পাপের প্রতি ভয়দর্শী হইয়া অবস্থানকারী কোন কোন সত্বগণকে দেখিতে পাইলাম। অনন্তর রাজকুমার! আমি গাথাযোগে সোহংপতি মহাব্রহ্মাকে প্রত্যুত্তর প্রদান করি-

‘উন্মুক্ত তাদের তরে অমৃতের পুরদ্বার,

স্রোতা যারা প্রসারিয়া শ্রদ্ধা হোক আগুসার।

পণ্ডশ্রম ভাবি মনে আমি করিনি প্রচার,

উত্তম সুজ্ঞাত ধর্ম ব্রহ্মে! মানব মাঝার।’

৩৪০। রাজকুমার! অনন্তর সোহংপতি ব্রহ্মা ‘ভগবান ধর্মপ্রচারার্থ অবসর করিলেন’ বুঝিয়া আমাকে অভিবাদন ও প্রদক্ষিণ করিয়া তথায় অন্তর্হিত হইলেন।

অতঃপর আমার এই (ধর্মদেশনা সংক্রান্ত) চিন্তা উদয় হইল,- ‘কাহাকে আমি প্রথম ধর্মোপদেশ করিব? কে এই ধর্ম সত্বর বুঝিতে পারিবে?’ তখন আমার স্মরণ হইল- আলাড়কালামই সুপণ্ডিত, দক্ষ, মেধাবী এবং দীর্ঘকাল (সমাপত্তি বিষ্কম্ভিত হেতু) অল্প রজঃজাতীয় পুরুষ। যদি আলাড়কালামকে প্রথম ধর্মোপদেশ করি, তবে তিনি এই ধর্ম শীঘ্রই উপলব্ধি করিবেন। তখন জনৈক দেবতা আমার নিকট আসিয়া জানাইল,- ‘ভন্তে! সপ্তাহকাল পূর্বে আলাড়কালাম দেহ-ত্যাগ করিয়াছেন।’ আমরাও জ্ঞানদর্শন উৎপন্ন হইল,- ‘সপ্তাহকাল পূর্বে আলাড়কালাম কালগত হইয়াছে।’ তখন আমার চিন্তা হইল,- ‘মহা ক্ষতিগ্রস্থ (জানিয়) আলাড়কালাম। যদি তিনি এই ধর্মোপদেশ শুনিতেন, তবে শীঘ্রই উপলব্ধি করিতেন।’

রাজকুমার! তখন আমার মনে প্রশ্ন জাগিল,- ‘কাহাকে আমি প্রথম ধর্ম উপদেশ করি? কে এই ধর্ম সত্বর জানিতে পারিবে?’ আমার মনে হইল,- এই উদ্দক-রামপুত্র পণ্ডিত, চতুর, মেধাবী চিরকাল অমলিন চিত্ত, যদি আমি তাঁহাকে প্রথম ধর্মোপদেশ করি তবে তিনি শীঘ্রই বুঝিতে পারিবেন।’ তখন দেবতা আসিয়া বলিল,- ‘ভন্তে! অভিদোষে (গত রাত্রির অর্ধ সময়ে) উদ্দক-রামপুত্র কালগত হইয়াছেন।’ আমারও জ্ঞানদর্শন উৎপন্ন হইল......।

৩৪১। ...... রাজকুমার! পুনশ্চ! আমার মনে হইল,- ‘পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষু আমার বহু উপকারী, যাঁহারা দেহ-প্রাণ সমর্পণ করিয়া কঠোর সাধনা করিবার সময় আমাকে সেবা করিয়াছেন। অতএব আমি সেই পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুদিগকে প্রথম ধর্মদেশনা করিব।’ তখন আমার চিন্তা হইল,- ‘পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুগণ এখন কোথায় অবস্থান করেন?’ আমি বিশুদ্ধ অ-মানুষ দিব্য-চক্ষুদ্বারা দেখিলাম- পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুগণ বারাণসীর সমীপে ঋষিপতনে মৃগদায়ে অবস্থান করিতেছেন। অনন্তর রাজকুমার! উরুবেলায় যথারুচি বাস করিয়া আমি বারাণসী অভিমুখে যাত্রা করি।

রাজকুমার! উপক নামক আজীবক আমাকে দেখিতে পাইল যে আমি দীর্ঘ পথ-যাত্রী হইয়া বোধিদ্রুম ও গয়ার মধ্যবর্তী স্থানে উপনীত হইয়াছি। আমাকে দেখিয়া উপক কহিল,- ‘বন্ধু! আপনার ইন্দ্রিয়-গ্রাম প্রসন্ন, দেহকান্তি (চর্মরঙ্‌) পরিশুদ্ধ ও পরিশোভিত হইয়াছে। আপনি কাঁহার উদ্দেশে প্রব্রজিত হইয়াছেন? কেই বা আপনার শাস্তা (গুরু)? কাঁহার ধর্মে আপনার রুচি?’ তদুত্তরে আমি উপক আজীবককে গাথাযোগে বলিলাম,-

‘অভিভূত সর্বরিপু, পরিজ্ঞাত জ্ঞেয় সমুদয়,

নির্লিপ্ত লালসা পঙ্কে সর্বত্যাগী আমি মহাশয়।

তৃষ্ণাক্ষয়ে মুক্ত ভবে স্বীয় লোকুত্তর প্রতিভায়,

কাঁহাকে উদ্দেশি গুরু? শাস্তা কেবা আছে এ ধরায়?

আচার্য নাহিক মম সমকক্ষ নাহি বসুধায়,

সদেব-মানব মাঝে প্রতিপক্ষ না দেখি কোথায়।

অর্হৎ আমি যে বিশ্বে আমি হই শাস্তা অনুত্তর,

একাই সম্বুদ্ধ আমি শীতিভূত প্রশান্ত অন্তর।

অন্ধভূত বিশ্বমাঝে বাজাইয়া অমৃতের ভেরী,

ধর্ম-চক্র প্রবর্তিতে চলিলাম কাশীদের পুরী।’

‘বন্ধু! আপনি যে ভাবে জ্ঞাপন করিতেছেন তাহাতে আপনি অনন্ত জিন হইবার যোগ্য।’

(তখন পুনরায় উত্তরে কহিলাম),-

‘মাদৃশ জনেরা হয় জিন, যাঁরা প্রাপ্ত তৃষ্ণাক্ষয়,

জিন আমি হে উপক! রিপুজয়ী দিনু পরিচয়।’

এরূপ উক্ত হইলে রাজকুমার! আজীবক উপক- ‘হইতেও পারে বন্ধু!’ বলিয়া শির সঞ্চালন করিয়া ভিন্ন পথে প্রস্থান করিল।

৩৪২। অতঃপর রাজকুমার! আমি ক্রমান্বয়ে পর্যটন করিতে করিতে বারাণসী সমীপে মৃগদাবে যেখানে পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুগণ ছিল, তথায় উপনীত হই। পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুগণ দূর হইতে আমাকে আসিতে দেখিল, দেখিয়া তাহারা পরস্পরের মধ্যে স্থির করিল (সণ্ঠপেসুং)- ‘এই যে দ্রব্য-বহুল, সাধনা-ভ্রষ্ট, বাহুল্যে-প্রবৃত্ত শ্রমণ গৌতম আসিতেছেন। তাঁহাকে অভিবাদন করা হইবে না, সম্মানার্থ গাত্রোত্থান করা হইবে না, আর অগ্রসর হইয়া তাঁহারা পাত্র-চীবরও গ্রহণ করা হইবে না। কেবলমাত্র আসন সজ্জিত রাখা হইবে; যদি তিনি ইচ্ছা করেন, বসিতে পারেন।’

রাজকুমার! ক্রমে যতই আমি পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুদের সমীপবর্তী হইলাম, ততই তাহারা নিজেদের প্রতিজ্ঞায় স্থির থাকিতে অসমর্থ হইল। একজন আমার দিকে অগ্রসর হইয়া আমার পাত্র-চীবর গ্রহণ করিল, কেহ আসন সজ্জিত করিল, একজন পাদ ধৌত করিবার জল উপস্থিত করিল। তাহারা আমাকে বন্ধু ও স্বনামে সম্বোধন করিতে লাগিল। এই ভাবে কথা বলিতে দেখিয়া আমি পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুদিগকে কহিলাম,- ‘ভিক্ষুগণ! তথাগতকে বন্ধু বলিয়া ও স্বনাম ধরিয়া সম্ভাষণ করিও না। ভিক্ষুগণ! তথাগত অর্হৎ সম্যক্‌-সম্বুদ্ধ হইয়াছেন। তোমরা শ্রোতাবধান কর, অমৃত অধিগত হইয়াছে, আমি অনুশাসন করিতেছি, ধর্মোপদেশ দিতেছি। যেরূপ উপদিষ্ট হইবে তদনুরূপ আচরণ করিলে তোমরা অচিরেই যার জন্য কুলপুত্রগণ সম্যক্‌ভাবে আগার হইতে অনাগারিক রূপে প্রব্রজিত হয়, সেই অনুত্তর ব্রহ্মচর্যাবসান (অর্হৎ ফল) দৃষ্টধর্মে (প্রত্যক্ষ-জীবনেই) স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া অধিগত হইয়া তাহাতে বিহার করিতে পারিবে। ইহা বিবৃত হইলে পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুগণ আমাকে বলিল,- ‘বন্ধু গৌতম! সেই দুষ্কর জীবন-যাপন, সেই কঠোর সাধনা, সেই দুষ্কর তপশ্চর্যারত আপনি মনুষ্য হইতে উত্তরিতর সর্বোত্তম আর্য-জ্ঞান-দর্শন-বিশেষ অধিগত করিতে সমর্থ হন নাই, আর এখন দ্রব্য-বহুল, সাধনা-ভ্রষ্ট এবং বাহুল্যে প্রবৃত্ত হইয়া মনুষ্যধর্মোত্তর, উত্তম আর্য-জ্ঞানদর্শন-বিশেষ অধিকার করিলেন?’

এই প্রকারে উক্ত হইলে, রাজকুমার! তখন আমি পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুদিগকে কহিলাম,- ‘ভিক্ষুগণ! তথাগত বাহুলিক নহে, সাধনাভ্রষ্ট নহে, বাহুল্যে প্রবৃত্তও নহে। ভিক্ষুগণ! তথাগত অর্হৎ সম্যক্‌সম্বুদ্ধ; ...... অধিগত হইয়া বিহার করিতে পারিবে।’

দ্বিতীয়বার তৃতীয়বারও এইরূপ কথোপকথন হইল।

ইহা বিবৃত হইলে আমি পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুদিগকে বলিলাম,- ‘ভিক্ষুগণ! ইতিপূর্বে কি আমি কখনও তোমাদিগকে এই প্রকারে ইহা বলিয়াছি? স্মরণ হয় কি?’

‘নিশ্চয় না, ভন্তে!’

‘ভিক্ষুগণ! তথাগত অর্হৎ ...... বিহার করিতে পারিবে।’

রাজকুমার! এখন আমি পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুদিগকে বিষয়টি বুঝাইতে সমর্থ হইলাম।

তাহাদের দুইজনকে আমি ধর্মোপদেশ দিতে থাকিলে অপর তিনজন ভিক্ষু ভিক্ষান্ন সংগ্রহে বাহির হয়। তিনজন বিচরণ করিয়া যাহা ভিক্ষান্ন আহরণ করে তদ্বারা ছয়জনেই দিন যাপন করি। যখন তিনজনকে উপদেশ দান করি তখন দুইজন ভিক্ষান্ন সংগ্রহে বিচরণ করে, দুইজন ভিক্ষু ভিক্ষা করিয়া যাহা আহরণ করে তদ্বারা ছয়জনেই দিন যাপন করি।

৩৪৩। অনন্তর পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষু আমাকর্তৃক এ প্রকারে উপদিষ্ট ও অনুশাসিত হইয়া অচিরেই যার জন্য কুলপুত্রগণ আগার হইতে অনাগারিক রূপে প্রব্রজিত হয়, সেই অনুত্তর ব্রহ্মচর্যাবসান (অর্হৎ ফল) ইহ-জীবনে স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া, অধিগত হইয়া বিহার করিতে লাগিল।”

এইরূপ বিবৃত হইলে বোধি রাজকুমার ভগবানকে ইহা বলিলেন,- “ভন্তে! তথাগতকে বিনায়ক লাভ করিয়া কত গৌণে ভিক্ষু, যার জন্য কুলপুত্রগণ সম্যক্‌ভাবে আগার হইতে অনাগারিক রূপে প্রব্রজিত হন, সেই অনুত্তর ব্রহ্মচর্যের পর্যাবসান ইহ-জীবনেই সাক্ষাৎকার ও উপলব্ধি করিয়া বিহার করিতে পারেন?”

“তাহা হইলে, রাজকুমার! আপনাকেই এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা করিব, আপনার যাহা অভিমত তাহা যথাযথই প্রকাশ করিবেন।”

“রাজকুমার! হস্ত্যারোহণ অঙ্কুশধারণ শিল্পে আপনি দক্ষ কিনা?

“হাঁ, ভন্তে! আমি ...... অঙ্কুশধারণে দক্ষ।”

“তবে রাজকুমার! যদি কোন ব্যক্তি- ‘বোধি রাজকুমার হস্ত্যারোহী অঙ্কুশগ্রাহী শিল্প জানেন, তাঁহার নিকট আমি হস্ত্যারোহ অঙ্কুশগ্রাহ শিল্প শিক্ষা করিব’ মনে করিয়া আসে, আর সে শ্রদ্ধারহিত হয়, শ্রদ্ধাবানের দ্বারা যাহা লাভ করা সম্ভব, তাহা সে পাইবে না; সে হয় রোগ বহুল, যাহা নীরোগীর পক্ষে সম্ভব তাহা সে পাইবে না; সে হয় শঠ-মায়াবী ...... অশঠ-অমায়াবীর প্রাপ্য ...... সে পাইবে না; সে হয় অলস, ...... আরব্ধ বীর্যবানের প্রাপ্য ...... সে পাইবে না; সে হয় প্রজ্ঞাহীন, ...... প্রজ্ঞাবান যাহা শিক্ষা করিবে সে তাহা পারিবে না। তাহা কি মনে হয়, রাজকুমার! সে ব্যক্তি আপনার নিকট হস্ত্যারোহ অঙ্কুশগ্রাহ শিল্প শিক্ষা করিবে কি?”

“ভন্তে! একদোষযুক্ত ব্যক্তি আমার নিকট হস্ত্যারোহ অঙ্কুশগ্রাহ শিল্প শিক্ষা করিতে সমর্থ হইবে না, পাঁচ দোষযুক্তের কথাই বা কি?”

৩৪৪। “রাজকুমার! তাহা কি মনে করেন? যদি কোন ব্যক্তি- ‘বোধি রাজকুমার হস্ত্যারোহ শিল্প জানেন ...... শিল্প শিক্ষা করিব,’ এই মানসে আসে, সে হয় শ্রদ্ধাবান, নীরোগী, অশঠ-অমায়াবী, নিরলস, প্রতিভাবান ......। তবে সে ব্যক্তি আপনার নিকট হস্ত্যারোহ ...... শিল্প শিক্ষা করিতে সমর্থ হইবে কি?”

“ভন্তে! একগুণযুক্ত পুরুষও আমার নিকট ...... শিল্প শিক্ষা করিতে সক্ষম হইবে।”

“এই প্রকারই রাজকুমার! নির্বান সাধনার পাঁচ অঙ্গ আছে। সে পাঁচ কি? (১) ভিক্ষু শ্রদ্ধাবান হয়। তথাগতের বোধিকে (লোকোত্তর জ্ঞানকে) বিশ্বাস করে- ‘সেই ভগবান অর্হৎ সম্যক্‌সম্বুদ্ধ, বিদ্যাচরণ সম্পন্ন, সুগত, লোকবিদ্‌। অনুত্তর, পুরুষদম্য-সারথী। দেব-মনুষ্যদের শাস্তা, বুদ্ধ ও ভগবান হন।’ (২) নীরোগ, নিরাতঙ্ক হয়- ‘নাতিশীত, নাতিউষ্ণ, সমপরিপাকী, সাধনাক্ষম, মধ্যস্থ গ্রহণী (প্রকৃতি-কর্মজ তেজধাতু) বিশিষ্ট হয়।’ (৩) অশঠ-অমায়াবী হয়- ‘শাস্তা (গুরু) কিংবা বিজ্ঞ-সব্রহ্মচারীদের নিকট স্বীয় দোষগুণ যথাযথ প্রকাশ করে।’ (৪) অকুশল ধর্মের প্রহাণের নিমিত্ত- ‘কুশলধর্ম উৎপত্তির নিমিত্ত শক্তিমান দৃঢ় পরাক্রমী, কুশলধর্মে অনিক্ষিপ্ত ধুর (নিয়ত কুশলে তৎপর) ও আরব্ধবীর্য হইয়া বিহার করে।’ (৫) প্রজ্ঞাবান হয়- ‘আর্য (নির্বেদিক) প্রতিবিদ্ধ করিতে সমর্থ, সম্যক্‌ প্রকারে দুঃখ-ক্ষয়গামিনী উদয়-ব্যয় পরিচ্ছেদক বিদর্শন প্রজ্ঞায় সংযুক্ত হয়।’ রাজকুমার! সাধনোদ্যমের এই পঞ্চবিধ অঙ্গ।

৩৪৫। রাজকুমার! এই পঞ্চাঙ্গ সাধনোদ্যমযুক্ত ভিক্ষু তথাগতকে বিনায়ক (পরিচালক) রূপে লাভ করিলে যার জন্য কুলপুত্রগণ সম্যক্‌রূপে আগার হইতে অনাগারিক প্রব্রজিত হয়, সেই অনুত্তর ব্রহ্মচর্য-পরিণাম (ফল) ইহ-জীবনেই সাত বৎসরের মধ্যে স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎকার এবং উপলব্ধি করিয়া বিহার করিতে পারে।

রাজকুমার! থাক সাত বৎসর, এই পঞ্চ প্রধানীয় (সাধনীয়) অঙ্গযুক্ত ভিক্ষু ...... ছয় বর্ষে, পাঁচ বর্ষে, তিন বর্ষে, দুই বর্ষে, এক বর্ষে, সাত মাসে, ছয় মাসে, পাঁচ মাসে, চার মাসে, তিন মাসে, দুই মাসে, এক মাসে, অর্ধ মাসে, সাত, ছয়, পাঁচ, চার, তিন, দুই, এক রাত্রিদিনে।

থাক রাজকুমার! এক রাত্রিদিন, এই পঞ্চ প্রধানীয় অঙ্গযুক্ত ভিক্ষু তথাগতকে বিনায়ক লাভ করিয়া সন্ধ্যায় অনুশাসিত হইয়া প্রাতঃকালে বিশেষ অর্হত্ব অধিগত হইবে। প্রাতঃকালে উপদিষ্ট হইয়া সন্ধ্যায় বিশেষ অধিগত হইবে।

ইহা বিতৃত হইলে বোধি রাজকুমার ভগবানকে বলিলেন,- “অহো বুদ্ধ! অহো ধর্ম! অহো ধর্মের স্বাখ্যাততা (উত্তম বর্ণনা)! আশ্চর্য যে যাহা সন্ধ্যায় অনুশাসিত হইয়া প্রাতে বিশেষ অধিগত হইবে, প্রাতে অনুশাসিত হইয়া সন্ধ্যায় বিশেষ উপলব্ধি করিতে সক্ষম হইবে।

৩৪৬। এইরূপে বলিলে সঞ্জিকাপুত্র মাণবক বোধি রাজকুমারকে বলিলেন,- “হে ভগবান বোধি! ইহা এরূপই- ‘অহো! বুদ্ধ! অহো ধর্ম! আর অহো ধর্মের উত্তম বর্ণনা!’ বলিতেছেন, অথচ সেই মাননীয় গৌতমের, ধর্ম ও ভিক্ষুসংঘের শরণ গ্রহণ করেন না।”

“সৌম্য সঞ্জিকাপুত্র! এরূপ বলিবেন না। সৌম্য সঞ্জিকাপুত্র! এরূপ বলিবেন না। সৌম্য সঞ্জিকাপুত্র! আমি আর্যার (মাতার) স্বমুখ হইতে ইহা শুনিয়াছি, স্বমুখ হইতে গ্রহণ করিয়াছি। সৌম্য সঞ্জিকাপুত্র! এক সময় ভগবান কৌশাম্বীর ঘোষিতারামে বিহার করিতেছেন। তখন আমার গর্ভবতী আর্যা যেখানে ভগবান ছিলেন তথায় উপস্থিত হইলেন, উপস্থিত হইয়া ভগবানকে অভিবাদন পূর্বক একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট আমার আর্যা ভগবানকে নিবেদন করিলেন- ‘ভন্তে! আমার কুক্ষিগত যে কুমার কিংবা কুমারী আছে, সে ভগবান, ধর্ম এবং ভিক্ষুসংঘের শরণ গ্রহণ করিতেছে। আজ হইতে ভগবান জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাহাকে শরণাগত উপাসক কিংবা উপাসিকারূপে ধারণা করুন’।”

সৌম্য সঞ্জিকাপুত্র! এক সময় ভগবান এই ভর্গপ্রদেশেই সুংসুমার গিরীর ভেষকলা বনে মৃগদাবে বিহার করিতেছিলেন। তখন আমার ধাত্রী আমাকে অঙ্কে লইয়া যেখানে ভগবান ছিলেন সেখানে গিয়াছিল, গিয়া ভগবানকে অভিবাদন করিয়া একপ্রান্তে দাঁড়াইল। একপ্রান্তে দাঁড়াইয়া আমার ধাত্রী ভগবানকে বলিল,- ‘ভন্তে! এই বোধি রাজকুমার ভগবানের, ধর্মের ও ভিক্ষুসংঘের শরণ গ্রহণ করিতেছেন, ......।’

সৌম্য সঞ্জিকাপুত্র! আমি এই তৃতীয়বারও ভগবানের, ধর্মের ও ভিক্ষুসংঘের শরণ গ্রহণ করিতেছি। ভগবান আজ হইতে আমাকে আপ্রাণকোটী শরণাগত উপাসকরূপে স্বীকার করুন।”

॥ বোধি রাজকুমার সূত্র সমাপ্ত ॥

অঙ্গুলিমাল সূত্র (৮৬)

অঙ্গুলিমালের জীবন পরিবর্তন (পূর্বে প্রমত্তে, শেষে মার্গে)।

৩৪৭। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-

এক সময় ভগবান শ্রাবস্তীতে অনাথপিণ্ডিকের আরাম জেতবনে বিহার করিতেছেন।

সেই সময় রাজা পসেনদি কোশলের রাজ্যে নিষ্ঠুর, লোহিত-পাণি, হত্যা-প্রহত্যায় নিবিষ্ট, প্রাণী-ভূতদের প্রতি দয়াহীন অঙ্গুলিমাল নামক দস্যু ছিল। সে গ্রাম, নিগম, জনপদ ধ্বংস করিতে লাগিল। সে মানুষদিগকে বধ করিয়া অঙ্গুলির মালা ধারণ করিত। তখন ভগবান পূর্বাহ্ন সময়ে নিবাসন পরিধান করিয়া পাত্র-চীবর ধারণ পূর্বক ভিক্ষান্ন সংগ্রহের জন্য শ্রাবস্তীতে প্রবেশ করিলেন। ভগবান শ্রাবস্তীতে ভিক্ষান্ন সংগ্রহ করিয়া, পিণ্ডাচরণ হইতে প্রত্যাবৃত্ত হইয়া, ভোজনের পর শয্যাসন শামলাইয়া, পাত্র-চীবর গ্রহণ করিয়া যেখানে চোর অঙ্গুলিমাল ছিল, তদভিমুখে দীর্ঘপথের যাত্রী হইলেন। তখন গো-পাল, পশুপাল, কৃষক ও পথিকগণ যেদিকে ডাকাত অঙ্গুলিমাল আছে সেদিকে দীর্ঘপথের যাত্রীরূপে ভগবানকে দেখিতে পাইল। তাহারা ভগবানকে বলিল,- “শ্রমণ! ওপথে যাইবেন না। শ্রমণ! ওপথে অঙ্গুলিমাল নামক দস্যু আছে। ...... সে গ্রাম ...... ধ্বংস করিতেছে। সে মানুষদিগকে বধ করিয়া অঙ্গুলির মালা ধারণ করে। শ্রমণ! ঐ পথে (যদি) বিশ, ত্রিশ, চল্লিশ, পঞ্চাশজন পর্যন্ত দলবদ্ধ হইয়া গমন করে; তাহারাও চোর অঙ্গুলিমালের হস্তে হত হয়।”

এইরূপ উক্ত হইলেও ভগবান তুষ্ণীভাবে চলিতে লাগিলেন।

দ্বিতীয়বার, তৃতীয়বার ও পূর্ববৎ বলা হইল।

৩৪৮। দস্যু অঙ্গুলিমাল ভগবানকে দূর হইতে আসিতে দেখিল, দেখিয়া তাহার এই মনে হইল,- “ওহে! আশ্চর্যের বিষয়! অদ্ভুত ব্যাপার! এই পথে দশ পুরুষ ...... পঞ্চাশ পুরুষও দলবদ্ধ হইয়া চলে, তাহারাও আমার হাতে হত হয়; অথচ এই শ্রমণ একাকী- অদ্বিতীয় সাহস পূর্বক যেন আসিতেছেন। যদি আমি এই শ্রমণের জীবননাশ করি, তবে ভাল হয়।” তৎপর দস্যু অঙ্গুলিমাল ঢাল-তলোয়ার (অসি-চর্ম) লইয়া, তীর-ধনু সংযোজিত করিয়া ভগবানের পশ্চাৎ পশ্চাৎ ধাবিত হইল। তখন ভগবান এই প্রকার ঋদ্ধি অভিসংস্কার সংস্করণ (যোগ-বিভূতি) করিলেন যে, যাহাতে দস্যু অঙ্গুলিমাল সর্বশক্তিতে দৌঁড়াইয়াও স্বাভাবিক গতিতে গমনশীল ভগবানকে ধরিতে সমর্থ না হয়। তখন দস্যু অঙ্গুলিমালের এই মনে হইল,- “ওহে! বড়ই আশ্চর্যের বিষয়! বড়ই অদ্ভুত ব্যাপার! যে আমি পশ্চাদ্ধাবন করিয়া ধাবমান হস্তীকে ধরিয়াছি, ...... ধাবমান অশ্বকে, ...... ধাবমান রথকে, ...... ধাবমান মৃগকে ধরিয়াছি। অথচ এখন স্বাভাবিক ভঙ্গিতে গতিশীল এই শ্রমণকে সর্বশক্তিতে দৌঁড়াইয়াও আমি ধরিতে সমর্থ হইলাম না।” সে স্থিত অবস্থায় ভগবানকে বলিল,- “স্থির হও, শ্রমণ! স্থির হও।”

“অঙ্গুলিমাল! আমি স্থির আছি, তুমি স্থির হও।”

তখন দস্যু অঙ্গুলিমালের এরূপ মনে হইল,- “এই সকল শাক্যপুত্র শ্রমণগণ সত্যবাদী ও সত্যপ্রতিজ্ঞ। অথচ এই শ্রমণ গতিশীল অবস্থায় বলিতেছেন, ‘অঙ্গুলিমাল! আমি স্থির আছি, তুমি স্থির হও।’ ইহার তাৎপর্য এই শ্রমণকে জিজ্ঞাসা করিতে পারি কি?”

৩৪৯। তখন অঙ্গুলিমাল গাথাদ্বারা ভগবানকে বলিলেন,-

“চলিছ শ্রমণ তবু বল আছি স্থির,

সুস্থির আমাকে কহ রহেছি অস্থির।

জিজ্ঞাসি তোমায় ইহা বল হে শ্রমণ!

তুমি স্থির, আমি হই অস্থির কেমন?” (১)

“নিখিল বিশ্বের প্রতি হে অঙ্গুলিমাল!

দণ্ড-ত্যজি স্থির আছি আমি সর্বকাল।

প্রাণীদের প্রতি হও তুমি অসংযত,

তাইত অস্থির তুমি আমি সুসংযত।” (২)

“বহুকাল গত মম মহর্ষি-পূজিত,

মহাবনে সত্যবাদী আজি উপনীত।

ধর্মময় গাথা তব করিয়া শ্রবণ,

পাপপরিহরি আমি যাপিব জীবন ।” (৩)

এবে দস্যু অসি আর আয়ুধ যা ছিল,

প্রপাতে নালায় গর্তে নিক্ষেপ করিল।

সুগতের পাদপদ্মে করিয়া বন্দনা,

তাঁর কাছে প্রব্রজ্যার জানাল প্রার্থনা। (৪)

যিনি বুদ্ধ মহাঋষি করুণা নিধান,

দেব সহ এলোকের শাস্তা সুমহান।

তিনি তাকে ‘এস ভিক্ষু’ বলিল যখন,

ইহাতে হইল তাঁর ভিক্ষুত্ব অর্জন। (৫)

৩৫০। অতঃপর ভগবান অনুগামী শ্রমণরূপে আয়ুষ্মান অঙ্গুলিমাল সহ যেদিকে শ্রাবস্তী তদভিমুখে যাত্রা করিলেন। তিনি ক্রমশঃ চারিকায় (ধর্ম প্রচারার্থ) পরিক্রমা করিতে করিতে শ্রাবস্তীতে উপনীত হইলেন। তথায় শ্রাবস্তীতে ভগবান অনাথপিণ্ডিকের জেতবন বিহারে বাস করিতেছেন। সেই সময় রাজা পসেনদি কোশলের অন্তঃপুর-দ্বারে মহা জনমণ্ডলী সম্মিলিত হইয়া উচ্চশব্দ মহাশব্দ করিতেছিল,- “দেব! আপনার রাজ্যে লোহিত-হস্ত, শিকারী, হত-প্রহতে নিবিষ্ট, প্রাণীদের প্রতি দয়াহীন অঙ্গুলিমাল নামক দস্যু আসিয়াছে; সে গ্রাম, নগর, জনপদ ধ্বংস করিতেছে। সে নরহত্যা করিয়া অঙ্গুলির মালা ধারণ করে। দেব! তাহাকে দমন করুন।”

তখন রাজা পসেনদি কোশল পাঁচশত অশ্বারোহী সৈন্য লইয়া দিবা-দ্বিপ্রহরে শ্রাবস্তী হইতে বাহির হইলেন এবং যেখানে জেতবন আরাম ছিল সেই দিকে যাত্রা করিলেন। যে পর্যন্ত যানে যাইবার জায়গা ছিল, ততদূর যানে গিয়া যান হইতে অবতরণ করিয়া পদব্রজেই তিনি যেখানে ভগবান আছেন, সেখানে গেলেন। রাজা তথায় উপনীত হইয়া ভগবানকে অভিবাদন পূর্বক একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট রাজা পসেনদি কোশলকে ভগবান বলিলেন,- “কেমন মহারাজ! আপনার উপর রাজা মাগধ সেনিয় বিম্বিসার, বৈশালীবাসী লিচ্ছবী কিংবা অপর কোন বিরোধী রাজা কি কোপিত হইয়াছেন?”

“না, হে ভন্তে! আমার উপর রাজা মাগধ ...... কোপিত হন নাই। ভন্তে! আমার রাজ্যে ...... অঙ্গুলিমাল নামক ...... দস্যু আসিয়াছে, ভন্তে! তাহাকে আমি দমন করিব।”

“যদি মহারাজ! আপনি অঙ্গুলিমালকে কেশ-শ্মশ্রু মুণ্ডিত, কাষায় বস্ত্র পরিহিত, আগার হইতে অনাগারিক প্রব্রজিত, প্রাণিহিংসা-বিরত, অদত্তাদান-বিরত, মৃষাবাদ-বিরত, একাহারী, ব্রহ্মচারী, শীলবান কল্যাণ-ধর্মা রূপে দেখিতে পান, তবে তাহাকে কি করিবেন?”

“ভন্তে! আমরা তাঁহাকে অভিবাদন করিব, প্রত্যুত্থান করিব, আসনদ্বারা সম্মান করিব; চীবর, পিণ্ডপাত, শয়নাসন, গ্লান-প্রত্যয়, ভৈষজ্য পরিষ্কার (দ্রব্য) দ্বারা তাঁহাকে নিমন্ত্রণ করিব; আর তাঁহার নিমিত্ত ধার্মিক রক্ষাবরণ-গুপ্তির সংবিধান করিব। কিন্তু ভন্তে! দুঃশীল পাপ-ধর্মীর পক্ষে এরূপ শীল-সংযম কোথায় হইবে?”

সেই সময় আয়ুষ্মান অঙ্গুলিমাল ভগবানের অদূরে উপবিষ্ট ছিলেন। তখন ভগবান তাঁহার দক্ষিণ বাহু ধরিয়া রাজা পসেনদি কোশলকে বলিলেন,- “মহারাজ! এই যে অঙ্গুলিমাল।”

তখন রাজা পসেনদির ভয় হইল, স্তব্ধতা হইল, শরীরে রোমঞ্চ হইল। তখন ভগবান...... সন্ত্রস্থ রাজা পসেনদি কোশলকে বলিলেন,- “ভয় করিবেন না, মহারাজ! ইহা হইতে আপনার কোন ভয় নাই।” তখন রাজা পসেনদির যাহা ভয়...... ছিল তাহা উপশম হইল।

তৎপর রাজা পসেনদি কোশল যেখানে আয়ুষ্মান অঙ্গুলিমাল আছেন তথায় গেলেন। সেখানে গিয়া রাজা আয়ুষ্মান অঙ্গুলিমালকে বলিলেন,- “আর্য! আমাদের ভন্তে, অঙ্গুলিমাল?”

“হাঁ, মহারাজ!”

“ভন্তে, আপনার পিতা কোন্‌ গোত্রের, আর মাতা কোন্‌ গোত্রের?”

“মহারাজ! আমার পিতা গার্গ, মাতা মৈত্রায়ণী।”

“ভন্তে! আর্য গার্গ-মৈত্রায়ণীপুত্র শাসনে অভিরমিত হউন, আমি আর্য গার্গ-মৈত্রায়ণীপুত্রের চীবর, পিণ্ডপাত, শয়নাসন, গ্লান-প্রত্যয়, ভৈষজ্য পরিষ্কার ব্যবস্থার উদ্যেগ করিব।”

৩৫১। সেই সময় আয়ুষ্মান অঙ্গুলিমাল আরণ্যক, পাংশুকূলিক, ত্রৈচীবরিক ধূতাঙ্গ-ব্রতধারী ছিলেন। সুতরাং আয়ুষ্মান অঙ্গুলিমাল রাজা পসেনদি কোশলকে বলিলেন,- “যথেষ্ট, মহারাজ! আমার ত্রিচীবর পরিপূর্ণ আছে।”

তখন রাজা পসেনদি কোশল যেখানে ভগবান আছেন, সেখানে গেলেন। আর ভগবানকে অভিবাদন পূর্বক একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট ...... রাজা ভগবানকে বলিলেন,- “বড়ই আশ্চর্য, ভন্তে! বড়ই অদ্ভুত, ভন্তে! ভন্তে! ভগবান অদান্তের এমন দমনকারী, অশান্তের শমনকারী, অপরিনির্বৃত্তদের নির্বাপনকারী। যাহাকে ভন্তে! আমরা দণ্ডদ্বারা ও অস্ত্রদ্বারা দমন করিতে সমর্থ হই নাই; ভন্তে! আপনি তাহাকে বিনাদণ্ডে বিনাঅস্ত্রে দমন করিলেন। বেশ, ভন্তে! এখন আমরা যাই। আমাদের বহুকৃত্য বহু করণীয়।”

“মহারাজ! আপনি যাহা উচিত মনে করেন তাহা করিতে পারেন।”

তখন রাজা পসেনদি কোশল আসন হইতে উঠিয়া ভগবানকে অভিবাদন ও প্রদক্ষিণ করিয়া প্রস্থান করিলেন।

তৎপর একদিন আয়ুষ্মান অঙ্গুলিমাল পূর্বাহ্ন সময়ে নিবাসন পরিহিত হইয়া পাত্র-চীবর ধারণ করিয়া শ্রাবস্তীতে ভিক্ষার্থ প্রবেশ করিলেন। তিনি শ্রাবস্তীতে সপদান (ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে ক্রমান্বয়ে) ভিক্ষাচরণ করিবার সময় গর্ভ বিপর্যস্ত, গর্ভযন্ত্রণা কাতর এক স্ত্রীলোককে দেখিতে পাইলেন; দেখিয়া তাঁহার এই চিন্তা হইল,- “অহো! প্রাণিগণ দুঃখ পাইতেছে। অহো! প্রাণিগণ যন্ত্রণা ভোগ করিতেছে।”

অতঃপর আয়ুষ্মান অঙ্গুলিমাল শ্রাবস্তীতে পিণ্ডাচরণ সমাপ্ত করিয়া- ভিক্ষাচর্যা হইতে প্রত্যাবৃত হইয়া ভোজনের পর- যেখানে ভগবান ছিলেন, তথায় গেলেন এবং ভগবানকে অভিবাদন পূর্বক একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট আয়ুষ্মান অঙ্গুলিমাল ভগবানকে নিবেদন করিলেন,- “ভন্তে! আমি পূর্বাহ্ন সময়ে নিবাসন পরিহিত হইয়া পাত্র-চীবর ধারণ করিয়া এই শ্রাবস্তীতে ভিক্ষাচর্যার্থ প্রবেশ করিয়াছিলাম। তথায় আমি ...... গর্ভ-বিপর্যস্ত, গর্ভযন্ত্রণা কাতর এক স্ত্রীলোককে দেখিতে পাইলাম। ...... ‘অহো! প্রাণিগণ দুঃখ পাইতেছে, ...... যন্ত্রণা ভোগ করিতেছে’।”

“অঙ্গুলিমাল! তাহা হইলে তুমি সেই স্ত্রীলোকের নিকট পুনরায় যাও, তথায় গিয়া তাহাকে বল,- ‘ভগিনি! যখন হইতে আমি জন্মগ্রহণ করিয়াছি, তখন হইতে স্বেচ্ছায় কোন প্রাণিহিংসা করিয়াছি বলিয়া জানি না। সে সত্যদ্বারা তোমার স্বস্তি হউক, তোমার গর্ভেরও মঙ্গল হউক’।”

“ভন্তে! উহা আমার সজ্ঞানে মিথ্যাভাষণ হইবে নহে কি? ভন্তে! আমাকর্ত্তৃক সজ্ঞানে অনেক প্রাণীর জীবননাশ হইয়াছে।”

“তাহা হইলে, অঙ্গুলিমাল! যেখানে সেই স্ত্রীলোক আছে, সেখানে উপস্থিত হও, আর তাহাকে এরূপ বল,- ‘যখন হইতে ভগিনি! আমি আর্য-গোত্রে জন্মগ্রহণ করিয়াছি তখন হইতে স্বেচ্ছায় কোন প্রাণিহিংসা করিয়াছি বলিয়া আমি জানি না। সে সত্যদ্বারা ...... মঙ্গল হউক’।”

“হাঁ, ভন্তে!” (বলিয়া) আয়ুষ্মান অঙ্গুলিমাল ভগবানকে প্রতিশ্রুতি দিয়া যেখানে সে স্ত্রীলোক আছে, সেখানে উপস্থিত হইলেন ...... এবং তাহাকে বলিলেন,-

“যে হ’তে ভগিনি! আমি আর্য-গোত্রে লভিনু জনম,

সে হ’তে স্বেচ্ছায় কোন প্রাণীবধ করিনি কখন;

এই সত্যে শুভ তব সুখী হোক গর্ভের নন্দন।”

তখন সেই স্ত্রীর ও তাহার গর্ভের স্বস্তি হইয়াছিল ।

সেই সময় আয়ুষ্মান অঙ্গুলিমাল একাকী, বিবেকযুক্ত, অপ্রমত্ত, উদ্যোগী ও সংযত জীবনযাপন করিয়া অচিরেই- ‘যার জন্য কুলপুত্রগণ ...... প্রব্রজিত হয়, সেই অনুত্তর ব্রহ্মচর্যের অবসান-ফল (অর্হত্ব) ইহ-জীবনেই স্বয়ং অভিজ্ঞাদ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া, উপলব্ধি করিয়া অবস্থান করিতে লাগিলেন। তাঁহার জন্ম ক্ষয় হইয়াছে, ব্রহ্মচর্যবাস পরিপূর্ণ হইয়াছে, করণীয় কৃত হইয়াছে। এখন এই জীবনের নিমিত্ত অপর কর্তব্য নাই, তিনি ইহা জ্ঞাত হইলেন। আয়ুষ্মান অঙ্গুলিমাল অর্হতদের অন্যতর হইলেন।

৩৫২। তৎপর একদিন আয়ুষ্মান অঙ্গুলিমাল পূর্বাহ্ন সময়ে নিবাসন পরিধান ও পাত্র-চীবর ধারণ পূর্বক ভিক্ষাচর্যার নিমিত্ত শ্রাবস্তীতে প্রবেশ করিলেন। সেই সময় অন্যকারণে নিক্ষিপ্ত ঢিল আয়ুষ্মান অঙ্গুলিমালের দেহে নিপতিত হইল। অন্যকারণে নিক্ষিপ্ত দণ্ড কঙ্কর আয়ুষ্মান অঙ্গুলিমালের দেহে নিপতিত হইল। তখন আয়ুষ্মান অঙ্গুলিমাল বিদীর্ণ-শিরে বিগলিত শোণিত-ধারায় ভগ্ন-পাত্র ও ছিন্ন-সংঘাটি সহ যেখানে ভগবান ছিলেন সেখানে গেলেন। ভগবান দূর হইতেই আয়ুষ্মান অঙ্গুলিমালকে আসিতে দেখিলেন, দেখিয়া আয়ুষ্মান অঙ্গুলিমালকে বলিলেন,- “ব্রাহ্মণ! তুমি ধৈর্য-ধারণ কর, ব্রাহ্মণ! তুমি সহিষ্ণুতা অবলম্বন কর। যে কর্মফলে, ব্রাহ্মণ! তোমাকে বহুবর্ষ, বহুশতবর্ষ, বহু সহস্রবর্ষ নরকে পঁচিতে হইত, ব্রাহ্মণ! সেই কর্মফল তুমি ইহ-জীবনেই ভোগ করিলে।”

যখন আয়ুষ্মান অঙ্গুলিমাল নিভৃতস্থানে ফলসমাপত্তি ধ্যান-লীন হইয়া বিমুক্তি-সুখ উপলব্ধি করিলেন, তখন এই উদান (আনন্দোচ্ছ্বাস) উচ্চারণ করিলেন,-

“প্রমাদে থাকিয়া পূর্বে পরে হন অপ্রমত্ত যিনি,

মেঘমুক্ত চন্দ্রতুল্য লোক করে আলোকিত তিনি। (১)

যারকৃত পাপকর্ম কুশলেতে হয় দূরীকৃত,

মেঘমুক্ত চন্দ্রতুল্য বিশ্ব তিনি করে আলোকিত। (২)

হলেও তরুণভিক্ষু বুদ্ধ-ধর্মে যিনি নিয়োজিত,

মেঘমুক্ত চন্দ্রতুল্য বিশ্ব তিনি করে প্রভাসিত। (৩)

“শত্রুরা শুনুক মম সদ্ধর্ম-ভাষণ,

শত্রুরা হউক মম ধর্মে নিমগন।

শত্রুরা হউক লিপ্ত তাঁদের সেবায়,

যারা শান্ত সদ্ধর্মের প্রেরণা যোগায়। (৪)

ক্ষান্তি-বাদী মৈত্রী-প্রশংসীর ধর্ম সনাতন,

শুনুন শত্রুরা মম কালে করুক পালন। (৫)

মোরে কিংবা অন্যকারে কভু কেহ হিংসা না করুন,

লভিয়া পরম শান্তি ভীতাভীতে নির্বিঘ্নে রাখুন। (৬)

চালায় চালক যথা জল- ইষুকার শর সোজাকরে,

বর্ধকীরা ঋজুকরে কাঠ- তথা ধীর দমে আপনারে। (৭)

অঙ্কুশে কশায় দণ্ডে কেহ অদান্তকে করেন দমন,

অস্ত্র-দণ্ডবিনা অদান্ত আমায় দমিলেন ভগবন! (৮)

অহিংসক নাম মম হিংসুকের পূরব জীবনে,

সার্থক হইল আজি হিংসা আর নাহি কোন জনে। (৯)

অঙ্গুলিমাল নামেতে পূর্বে ছিনু দস্যু সুবিখ্যাত,

বুদ্ধের শরণ লই যবে মহাস্রোতে নিমজ্জিত। (১০)

রক্ত-পাণি পূর্বে আমি বিখ্যাত অঙ্গুলিমাল,

শরণাগমনে দেখ সমুচ্ছিন্ন ভবজাল। (১১)

তাদৃশ দুর্গতি-গামী বহুকর্ম করি সম্পাদন,

কর্ম-ক্ষয়ী মার্গ-স্পর্শে করিতেছি অঋণী-ভোজন। ১২)

প্রমাদে নিমগ্ন থাকে দুর্মেধ অজ্ঞানী জন,

অপ্রমাদ রক্ষে ধীর শ্রেষ্ঠ ধনের মতন। (১৩)

হওনা প্রমাদে রত করিওনা কাম-রতি ভোগ,

অপ্রমত্ত ধ্যানশীল লভে নির্বান বিপুল সুখ। (১৪)

স্বাগত হয়েছে মম নহে দূরাগত,

মন্ত্রণা প্রব্রজ্যা লাভে অতীব সঙ্গত।

সুবিভক্ত বুদ্ধ-ধর্মে শ্রেষ্ঠ যে নির্বান,

লভিনু তাহাতে আমি অপরোক্ষ জ্ঞান। (১৫)

স্বাগত হয়েছে মম নহে দূরাগত,

মন্ত্রণা প্রব্রজ্যা লাভে অতীব সঙ্গত।

ত্রিবিদ্যা অর্জিত মম হইল এখন,

বুদ্ধের শাসনে কৃত্য হল সমাপন।” (১৬)

॥ অঙ্গুলিমাল সূত্র সমাপ্ত ॥

প্রিয়জাতিক সূত্র (৮৭)

‘প্রিয় হ’তে শোক-দুঃখের উদয়’

৩৫৩। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-

এক সময় ভগবান শ্রাবস্তীতে অনাথপিণ্ডিকের জেতবন আরামে বাস করিতেছেন। সেই সময় অন্যতর গৃহপতির (বৈশ্যের) প্রিয়, মনোহর একমাত্র পুত্র কালগত হইল। তাহার কালক্রিয়ার দরুণ (গৃহপতির) ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রবৃত্তি হয় না, ভোজনে রুচি জন্মে না। সে শ্মশানে গিয়া কেবল ক্রন্দন করিতে থাকে,- “কোথায় (আমার) একমাত্র পুত্র? কোথায় একমাত্র পুত্র?” তখন সে গৃহপতি যেখানে ভগবান ছিলেন সেখানে গেল এবং ভগবানকে অভিবাদন পূর্বক একপ্রান্তে বসিল। একপ্রান্তে উপবিষ্ট সেই গৃহপতিকে ভগবান বলিলেন,- “গৃহপতি! তোমার ইন্দ্রিয়-গ্রাম স্বীয় দীপ্তিতে স্থির নাই, তোমার ইন্দ্রিয়সমূহের অন্যথাভাব আছে কি?”

“ভন্তে! কেন আমার ইন্দ্রিয়-গ্রাম অন্যথাভাব না হইবে? ভন্তে! আমার প্রিয়, মনোরম একমাত্র পুত্র কালগত হইয়াছে। উহার মরণের দরুণ আমার কাজকর্মে প্রবৃত্তি হয় না, আহারে রুচি জন্মে না। সুতরাং আমি শ্মশানে গিয়া ক্রন্দন করি- ‘কোথায় আমার একমাত্র পুত্র, কোথায় একমাত্র পুত্র?’?”

“গৃহপতি! ইহা এইরূপ, ইহা এইরূপই; যাহা কিছু শোক, রোদন, দুঃখ, দৌর্মনস্য; সকলই প্রিয়জ, প্রিয় হইতে সম্ভূত হয়।”

“ভন্তে! ইহা কাহার প্রত্যয় হইবে যে- ‘যাহা কিছু শোক, রোদন, দুঃখ, দৌর্মনস্য সকলই প্রিয়জ, প্রিয়-সম্ভূত?’ ভন্তে! যাহা কিছু আনন্দ, সৌমনস্য সকলই প্রিয়জ, প্রিয়-সম্ভূত।”

তখন সে গৃহপতি ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন না করিয়া- নিন্দা করিয়া আসন হইতে উঠিয়া প্রস্থান করিল।

৩৫৪। সেই সময় কয়েক জন অক্ষধূর্ত (জুয়াড়ী) ভগবানের অদূরে পাশা-খেলা করিতেছিল। তখন সে গৃহপতি যেখানে ঐ অক্ষধূর্তেরা ছিল, সেস্থানে গেল। তথায় গিয়া সে সেই জুয়াড়িগণকে বলিল,- “মহাশয়গণ! আমি যেখানে শ্রমণ গৌতম আছেন সেস্থানে গিয়াছিলাম, গিয়া শ্রমণ গৌতমকে অভিবাদন পূর্বক একপ্রান্তে বসিলাম। একপ্রান্তে উপবিষ্ট আমাকে শ্রমণ গৌতম ইহা কহিলেন,- ‘গৃহপতি! তোমার ইন্দ্রিয়-গ্রাম স্বীয় দীপ্তিতে স্থির নাই ...... (উভয়ের কথোপকথন বিবৃত হইল) ......।’ তখন আমি মাননীয় শ্রমণ গৌতমের ভাষণ অভিনন্দন না করিয়া- নিন্দা করিয়া আসন হইতে উঠিয়া চলিয়া আসিলাম।”

“গৃহপতি! তাহা তদ্রূপই, তাহা তদ্রূপই। যাহা কিছু আনন্দ, সৌমনস্য তাহা প্রিয়জ, প্রিয়-সম্ভূত।” তখন সে গৃহপতি ‘অক্ষধূর্তেরা আমার সহিত একমত’ এই চিন্তা করিয়া তথা হইতে চলিয়া গেল।

তৎপর সেই কথা-প্রসঙ্গ ক্রমশঃ রাজান্তঃপুরে প্রবেশ করিল।

৩৫৫। তখন রাজা পসেনদি কোশল মল্লিকাদেবীকে আহ্বান করিলেন,- “মল্লিকে! শুনিয়াছ? তোমাদের শ্রমণ গৌতম এই ভাষণ দিয়াছেন,- ‘যাহা কিছু শোক, রোদন, দুঃখ, দৌর্মনস্য সমস্তই প্রিয়জ, প্রিয় হইতে সম্ভূত’।”

“যদি মহারাজ! ভগবান এই ভাষণ দিয়া থাকেন, তবে তাহা তদ্রূপই।”

“ইহাই হইয়া থাকে, মল্লিকে! শ্রমণ গৌতম যাহাই ভাষণ করুন না কেন, সেই সমস্তই তুমি অনুমোদন কর ‘যদি মহারাজ! তাহা ভগবানের ভাষিত, তাহা সেইরূপই হয়।’ যেমন নাকি আচার্য অন্তেবাসীকে যাহাই বলুক না কেন,- ‘আচার্য! তাহা তথৈবচ’ বলিয়া অন্তেবাসী তাহাই অনুমোদন করে। সেইরূপই, মল্লিকে! শ্রমণ গৌতম যাহাই ভাষণ করেন, তুমি তৎসমস্তই অনুমোদন করিয়া থাক- ‘যদি মহারাজ! ...... তদ্রূপই হয়। যাও বর্হিমুখে, মল্লিকে! (এখান থেকে) দূর হও।”

তখন মল্লিকাদেবী নালীজংঘ নামক ব্রাহ্মণকে আহ্বান করিলেন,- “আস তুমি, হে ব্রাহ্মণ! যেখানে ভগবান আছেন, সেস্থানে যাও, গিয়া আমার বাক্যে ভগবানের চরণে নতশিরে প্রণাম কর, ...... (কুশল সমাচার) জিজ্ঞাসা কর, আর ইহাও বল যে- ‘ভগবান একথা বলিয়াছেন কি- শোক ...... উপায়াস প্রিয়জ, প্রিয়-সম্ভূত?’ ভগবান তোমাকে যেরূপ বিবৃত করেন তাহা উত্তমরূপে শিক্ষা করিয়া আমাকে বলিবে। তথাগতেরা কখনও বিতথ-বাক্য বলেন না।”

“আজ্ঞে হাঁ, ভবতি।” ...... নালীজংঘ ব্রাহ্মণ ...... যেখানে ভগবান থাকেন, সেস্থানে ...... গিয়া, ভগবানের সহিত সম্মোদন করিয়া একপ্রান্তে বসিল। একপ্রান্তে উপবিষ্ট নালীজংঘ ব্রাহ্মণ ভগবানকে বলিল,- “ভো গৌতম! মল্লিকাদেবী ভবৎ গৌতমের চরণে নতশিরে বন্দনা করিয়াছেন, ......। আর ইহা জিজ্ঞাসা করিয়াছেন- কেমন ভন্তে! ভগবান কি এই কথা বলিয়াছেন- ‘যাহা কিছু শোক, ...... উপায়াস, সমস্তই প্রিয়জ, প্রিয়-সম্ভূত’?”

৩৫৬। ব্রাহ্মণ! তাহা সেইরূপই, তাহা সেইরূপই; ব্রাহ্মণ! যাহা কিছু শোক ...... উপায়াস তাহা প্রিয়জ, প্রিয় সম্ভূত। ব্রাহ্মণ! ইহাকে এই পর্যায়েও জানা উচিত যে, কি প্রকারে শোক ...... উপায়াস প্রিয়জ, প্রিয়-সম্ভূত? অতীতে এক সময়, ব্রাহ্মণ! এই শ্রাবস্তীর এক স্ত্রীলোকের মাতার মৃত্যু হয়, সে মাতার মৃত্যুতে উন্মত্তা ও বিক্ষিপ্ত-চিত্তা হইয়া রাস্তা হইতে রাস্তায়, শৃঙ্গাট (চৌরাস্তা) হইতে শৃঙ্গাটে উপনীত হইয়া এইরূপ বলে-‘ওহে! আপনারা আমার মাতাকে দেখিয়াছেন? ওহে! আপনারা আমার মাতাকে দেখিয়াছেন?’ এই পর্যায়েও, ব্রাহ্মণ! ইহা জানা উচিত যে- শোক ...... প্রিয়জ, প্রিয়-সম্ভূত। পুরাকালে ব্রাহ্মণ! এই শ্রাবস্তীতে এক স্ত্রীলোকের পিতার মৃত্যু হয় ......। ...... ভ্রাতার মৃত্যু হয় ......। ...... ভগ্নির মৃত্যু হয় ......। ...... পুত্রের মৃত্যু হয় ......। ...... দুহিতার মৃত্যু হয় ......। ...... পতির মৃত্যু হয় ......।”

পূর্বকালে ব্রাহ্মণ! ...... এক পুরুষের ...... মাতার, ...... ভার্যার মৃত্যু হয় ......।”

“পুরাকালে, ব্রাহ্মণ! এই শ্রাবস্তীতে এক স্ত্রী তাহার জ্ঞাতিকুলে গিয়াছিল। আত্মীয়গণ উহাকে বর্তমান স্বামী হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া অন্যপাত্রে সমর্পণ করিতে অভিলাষী, কিন্তু সে তাহাতে রাজি নহে। তখন সে রমণী তাহার পতিকে এ বিষয় জানাইল-‘আর্যপুত্র! এই আত্মীয়গণ আমাকে আপনা হইতে বিচ্ছিন্ন করিয়া অন্য পাত্রে সমর্পণ করিতে ইচ্ছুক, কিন্তু আমি তাহা পছন্দ করি না।’ তখন সে পুরুষ ‘আমরা উভয়ে মৃত্যুর পর সম্মিলিত হইব’ এই চিন্তা করিয়া সেই স্ত্রীকে দ্বিধা ছেদন করিল এবং আপন উদর ছেদন করিয়া উভয়ে মৃত্যু বরণ করিল। এই পর্যায়ে ব্রাহ্মণ! জানা উচিত- ‘প্রিয় হইতে শোক ......দুঃখের উদয় হয়’।”

৩৫৭। তখন নালিজংঘ ব্রাহ্মণ ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন করিয়া, অনুমোদন করিয়া, আসন হইতে উঠিয়া যেখানে মল্লিকাদেবী ছিলেন সেস্থানে গেল, গিয়া ভগবানের সহিত যাহা কথা সংলাপ (আলাপ আলোচনা) হইয়াছিল, সে সমস্তই মল্লিকাদেবীকে নিবেদন করিল। তখন মল্লিকাদেবী রাজা পসেনদি কোশল সমীপে গেলেন এবং রাজাকে বলিলেন,- “তাহা কি মনে করেন, মহারাজ! বজিরী (বজ্রিনী) কুমারী আপনার প্রিয়া কিনা?”

“হাঁ, মল্লিকে! বজিরী কুমারী আমার প্রিয়া।”

“তখন কি মনে করেন , মহারাজ! আপনার বজিরী কুমারীর বিপরিণাম ও অন্যথাভাব হেতু আপনার শোক, রোদন, দৌর্মনস্য উপায়াস উৎপন্ন হইবে কি?”

“মল্লিকে! বজিরী কুমারীর বিপরিণাম ও অন্যথাভাবে আমার জীবনেরও অন্যথাত্ব ঘটিতে পারে, শোক ...... উপায়াস কেন উৎপন্ন না হইবে?”

“মহারাজ! সেই ভগবান সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী, অর্হৎ সম্যক্‌সম্বুদ্ধ এই কারণেই বলিয়াছেন- ‘প্রিয়জ শোক.....উপায়াস প্রিয়-সম্ভূত ...... ’।”

“ ...... মহারাজ! বাসবক্ষত্রিয়া আপনার প্রিয়া কিনা?”

“হাঁ, মল্লিকে! বাসবক্ষত্রিয়া আমার প্রিয়া।”

“ ...... মহারাজ! বাসবক্ষত্রিয়ার বিপরিণাম, অন্যথাভাব হেতু আপনার শোক ...... উপায়াস উৎপন্ন হইবে কি?”

“মল্লিকে! আমার জীবনেরও অন্যথাভাব হইতে পারে ......।”

“মহারাজ! এই কারণেই সেই ভগবান ...... বলিয়াছেন ......।”

“মহারাজ! বিড়ুঢ়ভ সেনাপতি আপনার প্রিয় কিনা? ......।”

“কেমন মনে করেন, মহারাজ! আমি আপনার প্রিয়া কিনা? ......।”

“হাঁ, মল্লিকে! তুমি আমার প্রিয়া।”

“যদি মহারাজ! আমার কোন বিপরিণাম, অন্যথাভাব ঘটে, তবে আপনার শোক ...... উপায়াস উৎপন্ন হইবে?”

“মল্লিকে! ...... আমার জীবনেরও অন্যথাভাব ঘটিতে পারে ......।”

“মহারাজ! ...... ভগবান এই কারণেই বলিয়াছেন- ‘প্রিয়জ শোক, ...... উপায়াস প্রিয়-সম্ভূত’।”

“ইহা কি মনে করেন, মহারাজ! কাশী ও কোশলবাসী (প্রজাপুঞ্জ) আপনার প্রিয় কিনা?”

“হাঁ, মল্লিকে! কাশী-কোশলবাসী আমার প্রিয়। কাশী-কোশলবাসীর অনুভাবেই (রাজস্বাদিতেই) ত আমরা কাশিকচন্দন পরিভোগ করি, মালা-গন্ধ-বিলেপন ধারণ করি।”

“তবে মহারাজ! কাশী-কোশলবাসীর বিপরিণাম (হস্তান্তর) অন্যথাভাবে (সঙ্কটে) আপনার শোক... উৎপন্ন হইবে কি?”

“ ...... আমার জীবনেরও অন্যথা বিপর্যয় হইতে পারে......।”

“মহারাজ! ...... সেই ভগবান ...... এই কারণেই বলিয়াছেন- প্রিয়জাতিক শোক ...... প্রিয়-সম্ভূত।”

“বড়ই আশ্চর্য, মল্লিকে! বড়ই অদ্ভুত, মল্লিকে! এতদূর পর্যন্তও সেই ভগবান প্রজ্ঞায় প্রতিবিদ্ধ করিয়াই যেন দেখিয়া থাকেন। এস, মল্লিকে! চল আমরা আগমন করি তৎপর রাজা পসেনদি কোশল আসন হইতে উঠিয়া উত্তরিয়-বস্ত্র একাংস করিয়া যেদিকে ভগবান আছেন তদভিমুখে যুক্তাঞ্জলি প্রণাম করিয়া তিনবার আন্দোচ্ছ্বাস করিলেন,-

“নমো তস্‌স ভগবতো অরহতো সম্মা সম্বুদ্ধস্‌স”

(সেই ভগবান অর্হৎ সম্যক্‌ সম্বুদ্ধকে নমস্কার)।

॥ প্রিয়জাতিক সূত্র সমাপ্ত ॥

বাহিতিক সূত্র (৮৮)

৩৫৮। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-

এক সময় ভগবান শ্রাবস্তীর ...... জেতবনে অবস্থান করিতেছেন। তখন আয়ুষ্মান আনন্দ নিবাসন পরিধান করিয়া, পাত্র-চীবর ধারণ পূর্বক শ্রাবস্তীতে ...... পিণ্ডাচরণ করিলেন, এবং ...... দিবা বিহারের নিমিত্ত যেখানে মৃগার-মাতার প্রাসাদ পূর্বারাম ছিল, তথায় উপনীত হইলেন। সেই সময় রাজা পসেনদি কোশল ...... এক পুণ্ডরিক নাগের (হস্তীর) উপর আরোহণ করিয়া মধ্যাহ্ন সময়ে শ্রাবস্তী হইতে বাহিরে যাইতেছিলেন। রাজা পসেনদি কোশল ...... দূর হইতে আনন্দকে দেখিতে পাইলেন, দেখিয়া তিনি সিরিবড্‌ঢ (শ্রীবর্ধ) মহামাত্যকে আহ্বান করিলেন,- “সৌম্য সিরিবড্‌ঢ! ইনি আয়ুষ্মান আনন্দ নহেন কি?”

হাঁ, মহারাজ! আয়ুষ্মান আনন্দ।”

তখন রাজা এক ব্যক্তিকে ডাকিলেন,- “আস, হে পুরুষ! যেখানে আয়ুষ্মান আনন্দ আছেন, তুমি তথায় যাও। তথায় গিয়া আমার বাক্যে আয়ুষ্মান আনন্দের পাদপদ্মে নতশিরে বন্দনা কর, আর বল যে- ‘ভন্তে! যদি আয়ুষ্মান আনন্দের অত্যাবশ্যকীয় কোন কাজ না থাকে, তবে ভন্তে আয়ুষ্মান আনন্দ! অনুগ্রহ পূর্বক মুহুর্তকাল অপেক্ষা করিতে পারেন’।” !

“হাঁ, দেব! ......।”

আয়ুষ্মান আনন্দ মৌনভাবে স্বীকার করিলেন।

তখন রাজা পসেনদি কোশল যতদূর হস্তী যাইবার যোগ্যভূমি ততদূর হস্তীতে যাইয়া, হস্তী হইতে অবতরণ পূর্বক পদব্রজেই ...... গিয়া ...... অভিবাদন পূর্বক একপ্রান্তে দাঁড়াইলেন ...... আর আয়ুষ্মান আনন্দকে বলিলেন,- “ভন্তে! যদি আয়ুষ্মান আনন্দের কোন অত্যাবশ্যকীয় কাজ না থাকে, তবে ভন্তে! যেখানে অচিরবতী নদীর তীর, অনুগ্রহ পূর্বক সেখানে চলুন।”

আয়ুষ্মান আনন্দ মৌনভাবে স্বীকার করিলেন।

৩৫৯। তখন আয়ুষ্মান আনন্দ ......অচিরবতী নদীর তীরে ..... গেলেন, গিয়া এক বৃক্ষের নীচে সজ্জিত আসনে বসিলেন। তখন রাজা পসেনদি কোশলও ...... গিয়া ...... অভিবাদন পূর্বক একপ্রান্তে দাঁড়াইলেন। একপ্রান্তে স্থিত রাজা ...... বলিলেন,- “ভন্তে আয়ুষ্মান আনন্দ! এখানে হস্ত্যাস্তরণে বসুন।”

“না, মহারাজ! আপনি বসুন, আমি নিজের আসনে বসিয়াছি।”

রাজা পসেনদি ...... সজ্জিত আসনে বসিলেন; বসিয়া আয়ুষ্মান আনন্দকে বলিলেন, “ভন্তে! সেই ভগবান এরূপ কায়িক সমাচার আচরণ করিতে সমর্থ কি যে কায়িক সমাচার শ্রমণ, ব্রাহ্মণ ও বিজ্ঞদের নিন্দনীয় (=উপারম্ভ্য)?”

“না, মহারাজ ! ......।

(বাক্‌ সমাচার, মনো সমাচার সম্বন্ধেও এইরূপ বর্ণনীয়।)

“আশ্চর্য, ভন্তে ! অদ্ভুত, ভন্তে! যে তথ্য আমরা প্রশ্ন করিয়া (অন্য শ্রমণ হইতে) পুরিপূর্ণ করিতে পারি নাই, তাহা ভন্তে আয়ুষ্মান আনন্দ! প্রশ্নোত্তর দ্বারা পরিপূর্ণ করিলেন। ভন্তে! যে সকল বাল =অব্যক্ত (মূর্খ) যথার্থ অবগত না হইয়া, গভীর অনুসন্ধান না করিয়া, পরের প্রশংসা কিংবা অপ্রশংসা ভাষণ করে উহাকে আমরা সত্য হিসাবে বিশ্বাস করি না। আর ভন্তে! যে সকল পণ্ডিত, ব্যক্ত, মেধাবী যথার্থ অবগত হইয়া, গভীর সন্ধান করিয়া অপরের প্রশংসা বা অপ্রশংসা বর্ণনা করেন, উহা আমরা সত্য হিসাবে স্বীকার করি।”

৩৬০। “ভন্তে আনন্দ! কোন্‌ কায়িক সমাচার শ্রমণ, ব্রাহ্মণ ও বিজ্ঞদের নিন্দনীয়?”

“ মহারাজ ! যে কায়িক সমাচার অকুশল (মন্দ)।”

“ ভন্তে ! অকুশল কায়িক সমাচার কি?”

“ মহারাজ ! যে কায়িক আচরণ সাবদ্য (সদোষ)।”

“ ...... সাবদ্য কি?” “ ...... যাহা ...... সব্যাপাদ্য (হিংসাযুক্ত)।”

“ ...... সব্যাপাদ্য কি?” “ ...... যাহা ...... দুঃখ-বিপাক (যাহার পরিনাম দুঃখপ্রদ)।”

“ ...... দুঃখ-বিপাক কি?”

“ মহারাজ! যাহা আত্ম-পীড়ার কারণ হয়, পর-পীড়ার কারণ হয়, উভয়ের পীড়ার কারণ হয়। যাহা হইতে অকুশল পাপধর্ম বৃদ্ধি পায়, কুশলধর্ম হ্রাস হয়। মহারাজ! এই প্রকার কায়িক সমাচার ...... নিন্দনীয়।

(বাচনিক ও মানসিক সমাচার সম্বন্ধেও সে কথা।)

“ ভন্তে আনন্দ ! সেই ভগবান কি সর্ববিধ অকুশলধর্মেরই প্রহাণ বর্ণনা করেন?”

“ মহারাজ! তথাগতের সর্ববিধ অকুশলধর্ম পরিত্যাক্ত ও কুশলধর্ম সংযুক্ত হইয়াছে।”

৩৬১। “ভন্তে আনন্দ! কোন্‌ কায়িক আচার (কায়-সমাচার) শ্রমণ, ব্রাহ্মণ ও বিজ্ঞদের অনিন্দনীয় ?”

“ মহারাজ ! যে কায়িক আচার কুশল। ...... অনবদ্য, অব্যাপাদ্য ...... , সুখ-বিপাক ......। ...... যাহা আত্ম-পীড়ার কারণ হয় না; পর-পীড়ার কারণ হয় না, উভয়ের পীড়ার কারণ হয় না; যাহা হইতে অকুশলধর্ম হ্রাস হয়, কুশলধর্ম বৃদ্ধি পায়।”

“ ভন্তে আনন্দ! সেই ভগবান সর্ববিধ কুশলধর্মেরই উপার্জন প্রশংসা করেন কি?”

“মহারাজ! তথাগতের সর্ববিধ অকুশলধর্ম প্রহীণ ও কুশলধর্ম উপার্জন হইয়াছে।”

৩৬২। “ আশ্চর্য, ভন্তে ! অদ্ভুত ভন্তে! আযুষ্মান আনন্দ কর্তৃক ইহা এতই সুভাষিত হইল। ভন্তে! আয়ুষ্মান আনন্দের সুভাষণ দ্বারা আমরা সন্তুষ্ট ও পরম প্রসন্ন হইলাম। ভন্তে ! আয়ুষ্মান আনন্দের সুভাষণ দ্বারা আমরা এইরূপ সন্তুষ্ট ও প্রসন্ন হইয়াছি যে যদি আয়ুষ্মান আনন্দের গ্রহণযোগ্য হয়, তবে আমরা আয়ুষ্মান আনন্দকে হস্তিরত্নও উপহার দিতে পারি; অশ্বরত্ন (শ্রেষ্ঠ ঘোড়া) ...... , বর গ্রামও ...... দিতে পারি। কিন্তু ভন্তে আনন্দ! আমরাও উহা জানি- ইহা আয়ুষ্মান আনন্দের গ্রহণযোগ্য নহে। ভন্তে! আমার নিকট রাজা মাগধ অজাতশত্রু বৈদেহীপুত্রের প্রেরিত সাধারণ বস্ত্র মাপে দীর্ঘ সম-ষোলহাত, প্রস্থ সম-আটহাত বিশিষ্ট এই বাহিতিয় (বস্ত্র) আছে, অনুগ্রহ পূর্বক আয়ুষ্মান আনন্দ! তাহাই গ্রহণ করুন।”

“যথেষ্ট (অলং), মহারাজ! আমার ত্রিচীবর পরিপূর্ণ আছে।”

“ভন্তে! এই অচিরবতী নদীকে আয়ুষ্মান আনন্দও দেখিয়াছেন, আমরাও দেখিয়াছি- যখন পর্বতোপরে মহামেঘের প্রবল বর্ষণ হয়, তখন এই অচিরবতী নদী দুইকুল প্লাবিত করিয়া প্রবাহিত হয়; সেইরূপ ভন্তে আয়ুষ্মান আনন্দ! এই বাহিতিক বস্ত্রদ্বারা নিজের চীবর করিবেন। আয়ুষ্মান আনন্দের যে পুরাতন চীবর আছে, তাহা সব্রহ্মচারীরা ভাগ করিয়া লইবেন। এই প্রকারে আমাদের শ্রদ্ধাদান (দক্‌খিণা) মহাপ্লাবনের ন্যায় (সংবিস্যন্দন্তী মঞ্‌ঞে) চলিয়া যাইবে। ভন্তে আয়ুষ্মান আনন্দ! বাহিতিয় বস্ত্র গ্রহণ করুন।”

আয়ুষ্মান আনন্দ বাহিতিক গ্রহণ করিলেন।

তখন রাজা পসেনদি কোশল আয়ুষ্মান আনন্দকে বলিলেন,- “উত্তম, ভন্তে! এখন আমরা যাই, আমাদের বহুকৃত্য, বহু করণীয় আছে।”

“মহারাজ! এখন আপনি যাহা সময় মনে করেন।”

তখন রাজা পসেনদি ...... আয়ুষ্মান আনন্দের ভাষণ অভিনন্দন করিয়া, অনুমোদন করিয়া, আসন হইতে উঠিলেন এবং ...... অভিবাদন পূর্বক প্রদক্ষিণ করিয়া প্রস্থান করিলেন।

৩৬৩। রাজা পসেনদি চলিয়া যাইবার অচিরকাল পরে আয়ুষ্মান আনন্দ যেস্থানে ভগবান আছেন, সেখানে গেলেন, তথায় একপ্রান্তে বসিয়া আয়ুষ্মান আনন্দ রাজা পসেনদির সহিত যাহা কিছু কথোপকথন হইয়াছিল, সেই সমস্ত ভগবানকে শুনাইলেন, আর সেই বাহিতিক (বস্ত্র)ও ভগবানকে সমর্পণ করিলেন।

তখন ভগবান ভিক্ষুদিগকে আহ্বান করিলেন,- “ভিক্ষুগণ! রাজা পসেনদির লাভ হইল, মহালাভ হইল। যেহেতু রাজা পসেনদি কোশল আনন্দের দর্শন ও সেবার সুযোগ পাইলেন।”

ভগবান ইহা বলিলেন। সন্তুষ্ট চিত্তে সেই ভিক্ষুগণ ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন করিলেন।

॥ বাহিতিক সূত্র সমাপ্ত ॥

ধর্মচেতিয় সূত্র (৮৯)

ভোগের দুষ্পরিণাম, বুদ্ধের প্রজ্ঞা

৩৬৪। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-

এক সময় ভগবান শাক্যদেশে মেদালুপ নামক শাক্যদের নিগমে বাস করিতেছিলেন। সেই সময় রাজা পসেনদি কোশল কোন কার্যোপলক্ষে নগরে উপনীত হইয়াছিলেন। তখন রাজা পসেনদি কোশল দীর্ঘকারায়ণকে আহ্বান করিলেন,- “সৌম্য কারায়ণ! উত্তম যান সমূহ সাজাও, সুভূমি দর্শনার্থ আমি উদ্যান ভ্রমণে যাইব।”

“হাঁ, দেব! ...... ।” দেব! সুন্দর সুন্দর যান সজ্জিত হইয়াছে, এখন যাহা সময় মনে করেন।”

তখন রাজা পসেনদি কোশল ...... উত্তম যানে আরোহণ করিয়া ভদ্র ভদ্র যান সহ মহা রাজমহিমায় নগর হইতে বাহির হইলেন এবং যেদিকে আরাম ছিল, সেদিকে যাত্রা করিলেন। যতদূর যানের ভূমি ছিল, ততদূর যানে গিয়া, যান হইতে অবতরণ করিয়া পদব্রজেই আরামে প্রবেশ করিলেন। রাজা পসেনদি চংক্রমণ ও বিচরণ করিতে করিতে আরামে শব্দ-রহিত, ঘোষ-রহিত, জন-বাত-বিরল, মানুষের গুপ্ত-মন্ত্রণার যোগ্য, সাধনানুকূল, প্রসাদজনক, মনোহর বৃক্ষমূল সমূহ দেখিতে পাইলেন। রাজার ইহা দর্শনে ভগবানেরই স্মৃতি জাগ্রত হইল,-

“এই সমস্ত এমন ...... মনোহর বৃক্ষমূল, যাহাতে আমরা ভগবান ...... সম্যক্‌সম্বুদ্ধের সেবার উপনীত হইয়াছি।”

৩৬৫। তখন রাজা দীর্ঘকারায়ণকে জিজ্ঞাসা করিলেন,- “সৌম্য কারায়ণ! এখানে ...... মনোহর বৃক্ষমূল আছে, যাহাতে আমরা ...... উপনীত হইয়াছি। সৌম্য কারায়ণ! এই সময় সেই ভগবান ...... কোথায় অবস্থান করেন?”

“মহারাজ! শাক্যগণের মেদালুপ নামক নিগম আছে, সেই ভগবান ...... তথায় বিহার করিতেছেন।”

“সৌম্য কারায়ণ! নগর হইতে কতদূরে শাক্যদের সেই-মেদালুপ নিগম?”

“মহারাজ! বেশীদূরে নহে, মাত্র তিন যোজন; দিনের অবশিষ্ট সময়ে তথায় পৌঁছা সম্ভব।”

“তাহা হইলে, সৌম্য কারায়ণ! ভদ্র যানগুলি সজ্জিত কর, ভগবানের দর্শনার্থ আমরা তথায় যাইব।”

“হাঁ, মহারাজ! ......।”

“...... তখন রাজা পসেনদি উত্তম যানে আরোহণ করিয়া, নগর হইতে বাহির হইলেন এবং ...... সেই দিনের অবশিষ্ট সময়ে শাক্যদের নিগম মেদালুপে পৌঁছিলেন। যেখানে আরাম, সেখানে গেলেন। যতদূর যানের ভূমি ততদূর যানে গিয়ে, যান হইতে অবতরণ পূর্বক (নিগমের বাহিরে স্কন্ধাবার সন্নিবেশ করিয়া কারায়ণ সহ) পদব্রজেই আরামে প্রবেশ করিলেন।”

৩৬৬। সেই সময় কতিপয় ভিক্ষু উন্মুক্ত স্থানে চংক্রমণ করিতেছিলেন ......। রাজা পসেনদি কোশল সেই ভিক্ষুদিগকে বলিলেন,- “ভন্তে! এখন ভগবান ...... কোথায় অবস্থান করেন? আমরা তাঁহাকে দর্শন করিতে ইচ্ছুক।”

“মহারাজ! এই রুদ্ধদ্বার (গন্ধকূটি) বিহার। নিঃশব্দে তথায় উপনীত হইয়া, ধীরে সম্মুখ অলিন্দে (বারাণ্ডায়) প্রবেশ পূর্বক কাশিয়া (নখাগ্রে) কবাটে মৃদু আঘাত করুন। ভগবান আপনার জন্য দ্বার খুলিবেন।”

তখন রাজা পসেনদি কোশল অসি ও উষ্ণীষ সেই স্থানেই দীর্ঘকারায়ণকে প্রদান করিলেন। তখন দীর্ঘকারায়ণ চিন্তা করিল,- “রাজা এখন গুপ্তপরামর্শ করিতেছেন, সুতরাং আমাকে এখানেই থাকিতে হইবে ।”

তখন রাজা ...... যেখানে রুদ্ধদ্বার বিহার ছিল, সেখানে ...... নিঃশব্দে উপনীত হইয়া ...... কবাটে ...... আঘাত করিলেন। ভগবান দ্বার খুলিয়া দিলেন। রাজা বিহারে প্রবেশ করিলেন, ভগবানের পাদপদ্মে মাথা রাখিয়া, ভগবানের পদযুগল মুখে চুম্বন ও হস্তদ্বয়ে সংবাহন করিতে করিতে স্বীয় নাম প্রকাশ করিলেন,- “ভন্তে! আমি রাজা পসেনদি কোশল। ভন্তে! আমি রাজা পসেনদি কোশল।”

৩৬৭। “মহারাজ! কোন্‌ উদ্দেশ্যে প্রণোদিত হইয়া আপনি এই (জীর্ণ) শরীরে এমন পরম গৌরব করিতেছেন, মিত্র-উপহার (সম্মান) প্রদর্শন করিতেছেন।”

“ভন্তে! ভগবানের প্রতি আমার ধর্মান্বয় (প্রত্যক্ষ জ্ঞান) আছে- ‘ভগবান সম্যক্‌সম্বুদ্ধ হন, ভগবান কর্তৃক ধর্ম সুব্যাখ্যাত, ভগবানের শ্রাবক-সংঘ সত্যমার্গে প্রতিপন্ন।’ ভন্তে! এখানে আমি কোন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণকে দশ, বিশ, ত্রিশ ও চল্লিশ বর্ষ পর্যন্ত গত (কাল-সীমা নির্দিষ্ট) ব্রহ্মচর্য পালন করিতে দেখিয়া থাকি। অন্য সময়ে তাঁহারা সু্লাত, সু-বিলেপিত, কর্তিত-কেশদাম, মুণ্ডিত-শ্মশ্রু পঞ্চ কামগুণ দ্বারা সমর্পিত অধিকৃত (সমঙ্গীভূত) হইয়া পরিচর্যা করেন। কিন্তু ভন্তে! এখানে আমি ভিক্ষুদিগকে যাবজ্জীবন, আপ্রাণকোটিক, পরিপূর্ণ, পরিশুদ্ধ ব্রহ্মচর্য পালন করিতে দেখিতে পাই। ইহার বাহিরে অন্যত্র কোথাও এমন পরিপূর্ণ পরিশুদ্ধ ব্রহ্মচর্য আর আমি দেখি নাই। ভন্তে! ভগবানের প্রতি ইহাও আমার ধর্মান্বয় হয়- ‘ভগবান সম্যক্‌সম্বুদ্ধ হন, ভগবান কর্তৃক ধর্ম সুব্যাখ্যাত, ভগবানের শ্রাবকসংঘ সুপ্রতিপন্ন’।”

৩৬৮। পুনরায়, ভন্তে! রাজারাও রাজাদের সাথে বিবাদ করেন, ক্ষত্রিয়েরাও ক্ষত্রিয়দের সাথে বিবাদ করেন, ব্রাহ্মণেরাও ব্রাহ্মণদের সাথে বিবাদ করেন, গৃহপতিরাও গৃহপতিদের সাথে বিবাদ করে, মাতাও পুত্রের সাথে ...... , পুত্র মাতার সাথে ......, পিতা পুত্রের সাথে ......, পুত্র পিতার সাথে ......; ভাইও ভাইয়ের সাথে ....., ভগ্নীও ভাইয়ের সাথে ......, মিত্রও মিত্রের সাথে বিবাদ করে। কিন্তু ভন্তে! এখানে আমি ভিক্ষুদিগকে দেখিতে পাই,- ‘সমগ্র, সংমোদমান (পরস্পরে মোদিত), বিবাদ-রহিত ক্ষীরোদকীভূত হইয়া একে অন্যকে প্রিয়চক্ষে দর্শন করিয়া বিহার করিতেছেন।’ ভন্তে! আমি এই ধর্ম হইতে অন্যত্র (কোথাও) এই প্রকার সমগ্র, সংহত-পরিষদ আর দেখি নাই। ইহাও ভন্তে! ভগবানের প্রতি আমার ধর্মান্বয়- ‘ভগবান সম্যক্‌সম্বুদ্ধ হন, ভগবান কর্তৃক ধর্ম সুব্যাখ্যাত, ভগবানের শ্রাবকসংঘ সুপ্রতিপন্ন’।”

৩৬৯। পুনশ্চ, ভন্তে! আমি আরাম হইতে আরামে, উদ্যান হইতে উদ্যানে পায়চারী করি, পরিভ্রমণ করি; তথায় আমি দেখিতে পাই- কোন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ কৃশ, রুক্ষ, দুবর্ণ উপরে পাণ্ডু-পাণ্ডু বর্ণজাত, ধমনী-সন্তৃত গাত্র। বোধ হয় জন-দর্শনার্থ তাঁহারা আর চক্ষু বন্ধ করেন না। তখন ভন্তে! আমার এই মনে হয়- ‘নিশ্চয় এই আয়ুষ্মানগণ অনভিরত হইয়া ব্রহ্মচর্য পালন করিতেছেন, কিংবা তাঁহারা গোপনে কোন পাপকর্ম করিয়াছেন; যাহার দরুণ এই আয়ুষ্মানগণ কৃশ ...... ধমনী-সন্তৃত গাত্র হইয়াছেন।’ আমি তাঁহাদের নিকট গিয়া এপ্রকার জিজ্ঞাসা করি- ‘আয়ুষ্মানগণ! কেন আপনারা কৃশ.... ?’ তাঁহারা আমাকে বলেন- ‘আমাদের বন্ধুক (বংশগত) রোগ আছে, মহারাজ!’ কিন্তু ভন্তে! আমি এখানে ভিক্ষুদিগকে দেখিতে পাই- হৃষ্ট-প্রহৃষ্ট, উদগ্র-উদগ্র, অভিরত-রূপ, প্রসন্নেন্দ্রিয়, ঔৎসুক্য-রহিত, রোমাঞ্চ-রহিত, পরদ-বৃত্তিক, মৃগ-ভূত চিত্ত হইয়া বিহার করিতেছেন। ইহাও ভন্তে! ......।”

৩৭০। “পুনশ্চ, ভন্তে! আমি মূর্ধাভিষিক্ত ক্ষত্রিয় রাজা হই, প্রাণদণ্ডের যোগ্যকে প্রাণদণ্ড বিধান করিতে পারি, অর্থদণ্ডের যোগ্যকে জরিমানা করিতে পারি, নির্বাসন যোগ্যকে নির্বাসন বিধান করিতে পারি। এতদ্‌সত্বেও, ভন্তে! আমার বিচারালয়ে উপবিষ্ট থাকা অবস্থায় (লোকে) মধ্যে মধ্যে কথা বলে। ‘বিচারালয়ে উপবিষ্ট মহাশয়গণ! আমার মধ্যে মধ্যে কথা বলিবেন না,’ কিন্তু (তাহাদিগকে) আমি নিরস্ত করিতে পারি না। ‘আমার কথা সমাপ্ত হওয়া পর্যন্ত আপনারা অপেক্ষা করুন।’ তথাপি তাহারা আমার কথায় মাঝে মাঝে কথা বলিয়া থাকে। কিন্তু, ভন্তে! এখানে আমি ভিক্ষুদিগকে লক্ষ্য করিলাম- যেই সময় ভগবান অনেক শত পরিষদে ধর্মোপদেশ করেন; সেই সময় ভগবানের শ্রাবকদের মধ্যে হাঁচির শব্দ কিংবা কাশির শব্দ পর্যন্ত হয় না। ভন্তে! এক সময় ভগবান অনেক শত পরিষদে ধর্মোপদেশ করিতেছিলেন; সেই সময় ভগবানের এক শ্রাবক (শিষ্য) কাশিলেন, অন্যতর সব্রহ্মচারী জানুদ্বারা তাঁহাকে নাড়া (ঘট্টন) দিলেন- ‘আয়ুষ্মান! নিঃশব্দ হউন, আয়ুষ্মান! শব্দ করিবেন না; শাস্তা আমাদিগকে ধর্মোপদেশ করিতেছেন।’ তখন ভন্তে! আমার এই চিন্তা হইল- ‘ওহে! একান্তই আশ্চর্য! ওহে একান্তই অদ্ভুত! ওহে! নিতান্তই বিনাদণ্ডে, বিনা অস্ত্রে পরিষদ এই প্রকারে সুবিনীত হইল!’ ইহার বাহিরে, ভন্তে! এই রূপ সুবিনীত পরিষদ আর আমি দেখি নাই, ইহাও ভন্তে! ......।”

৩৭১। “পুনশ্চ, ভন্তে! দক্ষ-পরপ্রবাদ (প্রৌঢ় শাস্ত্রার্থীর) বাল-বেধী (চুলছেড়া) রূপে নিপুণ কোন কোন ক্ষত্রিয় পণ্ডিতকে আমি দেখিতে পাই, তাঁহারা স্বীয় প্রজ্ঞাদ্বারা (যুক্তিবলে) পরের ভ্রান্ত মতবাদকে ছেদন-বেধন করিয়া বিচরণ করেন। তাঁহারা শুনেন যে মাননীয় শ্রমণ গৌতম অমুক গ্রামে বা নিগমে আসিবেন। তাঁহারা প্রশ্ন সংকলন করিতে থাকেন- ‘আমরা শ্রমণ গৌতম সমীপে উপনীত হইয়া এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিব, এইরূপে জিজ্ঞাসিত আমাদের প্রশ্নের যদি এরূপ উত্তর দেন তবে আমরা তাঁহাকে এরূপ বাদারোপ (দোষারোপ) করিব।’ তাঁহারা শুনিয়া থাকেন- ‘শ্রমণ ভগবৎ গৌতম অমুক গ্রামে বা নিগমে আসিয়াছেন, তাঁহারা ভগবানের সমীপে উপস্থিত হন। ভগবান তাঁহাদিগকে ধর্ম-সম্বন্ধীয় কথাদ্বারা সংদর্শিত করেন, অনুপ্রাণিত করেন, সমুত্তেজিত করেন, সংপ্রহর্ষিত করেন। তাঁহারা ভগবানের ধর্মোপদেশে সংদর্শিত, অনুপ্রাণিত, সমুত্তেজিত ও সংপ্রহর্ষিত হইয়া ভগবানকে আর প্রশ্ন করিতে পারেন না, কোথায় বাদারোপ করিবেন? অধিকন্তু তাঁহারা ভগবানের শিষ্যত্বই স্বীকার করেন। ইহাও ভন্তে!......।”

(ব্রাহ্মণপণ্ডিত, গৃহপতিপণ্ডিত সম্বন্ধেও এইরূপ।)

৩৭২। “...... শ্রমণপণ্ডিত ......। ...... ভগবানকে প্রশ্নও জিজ্ঞাসা করেন না, কিরূপে বাদারোপ করিবেন? অধিকন্তু ভগবৎ সমীপেই অবসর প্রার্থনা করেন- আগার হইতে অনাগারিক প্রব্রজ্যার জন্য। ভগবান তাঁহাদিগকে প্রব্রজিত করেন, তাঁহারা এই প্রকারে প্রব্রজিত হইয়া- একাকী, বিবেক-যুক্ত, অপ্রমত্ত, বীর্যবান, সাধনায় আত্মনিয়োগ করিয়া- অচিরেই যার জন্য কুলপুত্রগণ সম্যক্‌রূপেই আগার হইতে অনাগারিকরূপে প্রব্রজিত হন, সেই অনুত্তর, ব্রহ্মচর্যের চরম-লক্ষ্য (অর্হত্ব) ইহজীবনেই স্বয়ং অভিজ্ঞাদ্বারা সাক্ষাৎকার করিয়া, উপলব্ধি করিয়া বিহার করেন। তখন তাঁহারা বলেন,- ‘ওহে! আমরা নিশ্চয় নষ্ট হইতেছিলাম, নিশ্চয় আমরা প্রনষ্ট হইতেছিলাম। আমরাই পূর্বে অশ্রমণ অবস্থায় শ্রমণ বলিয়া প্রকাশ করিয়াছি, অব্রাহ্মণ অবস্থায় ব্রাহ্মণত্বের দাবী করিয়াছি, অর্হৎ না হইয়াই অর্হত্বের অঙ্গীকার করিয়াছি। এখনই আমরা প্রকৃত শ্রমণ, এখনই আমরা ব্রাহ্মণ আর এখনই আমরা অর্হৎ হইয়াছি।’ ইহাও, ভন্তে! ......।”

৩৭৩। “পুনশ্চ, ভন্তে! এই যে ঋষিদত্ত ও পুরাণ স্থপতিদ্বয় আমার ভাতে ভাতী, আমার যানে যানী । আমিই তাহাদের জীবিকার প্রদাতা, সৌভাগ্যের অনুষ্ঠাতা; অথচ (তাহারা) আমার প্রতি তেমন সম্মান করে না, যেমন করে ভগবানের প্রতি। পূর্বে একবার ভন্তে! অভিযানে সেনা পরিচালনার সময় এই ঋষিদত্ত ও পুরাণ স্থপতিদেরই অন্বেষিত এক অপ্রশস্থ আবাসথে (ধর্মশালায়) রাত্রিবাস করিয়াছিলাম। তখন ভন্তে! এই ঋষিদত্ত ও পুরাণ স্থপতিদ্বয় বহুরাত্রি পর্যন্ত ধর্মালোচনায় অতিবাহিত করিয়া যে দিকে ভগবান আছেন (শুনিল), সেই দিকে শির স্থাপন করিয়া আমাকে পায়ের দিকে রাখিয়া তাহারা শয়ন করিল । তখন ভন্তে! আমার এই মনে হইল,- ‘অহো, বড়ই আশ্চর্য! অহো, বড়ই অদ্ভুত! এই ঋষিদত্ত ও পুরাণ স্থপতিগণ আমার ভাতে, আমার যানে মানুষ, আমি তাহাদের জীবিকার দাতা, যশের অনুষ্ঠাতা। অথচ আমার প্রতি তেমন সম্মান প্রদর্শন করে না, যেমন করে ভগবানের প্রতি। এই সকল আয়ুষ্মানেরা সেই ভগবানের সাসনে পূর্বাপর কোন মহিমান্বিত বিশেষত্ব (লোকোত্তর ফল) অবশ্যই জানিয়া থাকিবেন।’ ইহাও ভন্তে! ......।”

৩৭৪। “পুনশ্চ, ভন্তে! ভগবানও ক্ষত্রিয় হন, আমিও ক্ষত্রিয় হই, ভগবানও কোশলবাসী, আমিও কোশলবাসী, ভগবান অশীতি বর্ষীয়, আমিও অশীতি বর্ষীয়, এই কারণেও ভন্তে! আমি ভগবানের পরম সম্মান ও মিত্র-উপহার প্রদর্শন করিবার যোগ্য পাত্র হই। বেশ, ভন্তে! এখন আমরা যাই, আমাদের বহুকৃত্য, বহু করণীয়।”

“মহারাজ! আপনি যাহা সময় মনে করেন, (তাহা করিতে পারেন)।” তখন রাজা পসেনদি কোশল আসন হইতে উঠিয়া ভগবানকে অভিবাদন ও প্রদক্ষিণ করিয়া প্রস্থান করিলেন ।

রাজা চলিয়া যাইবার অচিরকাল পরে ভগবান ভিক্ষুদিগকে আহ্বান করিলেন, “ভিক্ষুগণ! এই রাজা পসেনদি কোশল ধর্ম-ছিত্রকর বাণী (ধর্ম প্রশংসক বাক্যাবলী) ভাষণ করিয়া আসন হইতে উঠিয়া চলিয়া গেলেন। ভিক্ষুগণ! তোমরা ধর্ম-চিত্রকর বাণী শিক্ষা কর, ধর্ম-চিত্রকর বাণী অধ্যয়ন কর, ধর্ম-চিত্রকর বাণী ধারণ কর। ভিক্ষুগণ! ধর্ম-চিত্রকর বাণী অর্থসংযুক্ত ও আদি (মার্গ) ব্রহ্মচর্যের সহায়ক।”

ভগবান ইহা বলিলেন, সেই ভিক্ষুগণ সন্তুষ্ট চিত্তে ভগবানের ভাষণ অভিবাদন করিলেন।

॥ ধর্মচেতিয় সূত্র সমাপ্ত ॥

কণ্নকত্থল সূত্র (৯০)

(সদা-সর্বদা সর্বজ্ঞতা অসম্ভব। বর্ণব্যবস্থা খণ্ডণ। দেব-ব্রহ্মা)

৩৭৫। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-

এক সময় ভগবান উজুকা নগর সমীপে কণ্নকত্থলে (কর্ণকস্থানে) মৃগদায়ে অবস্থান করিতেছেন। সেই সময় রাজা পসেনদি কোশল কোন কার্যোপলক্ষে উজুকায় আসিয়াছিলেন। তিনি কোন এক ব্যক্তিকে আহ্বান করিলেন,- “হে পুরুষ! আস, যেখানে ভগবান আছেন, তুমি সেখানে যাও। তথায় গিয়া আমার বাক্যে ভগবানের পাদযুগলে নতশিরে বন্দনা কর, অল্পাবাধ (নীরোগ), অল্পাতঙ্ক, লঘুত্থান (=স্ফুর্তী), বল, স্বচ্ছন্দ-বিহার সম্বন্ধে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা কর, (বল)- ‘ভন্তে! রাজা পসেনদি কোশল ভগবানের পাদপদ্মে নতশিরে বন্দনা করিয়াছেন ......।’ আর ইহাও বলিও- ‘ভন্তে! আজ প্রাতরাশ ভোজনের পর রাজা পসেনদি কোশল ভগবানকে দর্শনার্থ আসিবেন’।”

“হাঁ, দেব! ......।” (সে আদেশ পালন করিল)।

“দুই ভগ্নি সোমা ও সকুলা (উভয়ে) শুনিলেন যে- ‘আজ রাজা ...... ভগবানকে দর্শনার্থ যাইবেন।’ তখন সোমা ও সকুলা উভয় মহেষী ভোজনস্থানে রাজা পসেনদি কোশল সমীপে উপস্থিত হইয়া বলিলেন- ‘মহারাজ! আমাদের বাক্যে ভগবানের পাদপদ্মে নতশিরে বন্দনা করিবেন। অল্পাবাধ, অল্পাতঙ্ক ...... জিজ্ঞাসা করিবেন’।”

৩৭৬। তখন রাজা পসেনদি কোশল প্রাতরাশ ভোজনের পর যেখানে ভগবান আছেন সেস্থানে উপনীত হইলেন। তথায় গিয়া ভগবানকে অভিবাদন করিয়া রাজা এক প্রান্তে বসিলেন, এবং ভগবানকে বলিলেন,- “ভন্তে! সোমা ও সকুলা উভয় ভগ্নি ভগবানের পাদপদ্মে নতশিরে বন্দনা করিয়াছে, ...... ।”

“কেমন, মহারাজ! সোমা ও সকুলা ভগ্নিদ্বয়ের অপর কোন দূত মিলিল না?”

“ভন্তে! সোমা আর সকুলা দুই ভগ্নি যখন শুনিল যে রাজা ...... ভগবানকে দর্শনার্থ যাইবেন ......। তখন আসিয়া তাহারা আমাকে ইহা বলিল ......।”

“সুখী হউক, মহারাজ! সোমা ও সকুলা দুই সহোদরা ......।”

৩৭৭। তখন রাজা পসেনদি কোশল ভগবানকে বলিলেন- “ভন্তে! আমি এইরূপ শুনিয়াছি যে শ্রমণ গৌতম এই প্রকার বলেন- ‘এমন কোন শ্রমণ কিংবা ব্রাহ্মণ নাই যিনি সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী, নিরবশেষ জ্ঞান-দর্শন জানিবেন, ইহা সম্ভব নহে।’ যাঁহারা এরূপ বলেন, ...... ভন্তে! তাঁহারা কি ভগবান সম্বন্ধে সত্যকথা বলেন? অসত্যদ্বারা ভগবানের অপবাদ করিতেছেন কি? ধর্মানুকূল বলিতেছেন ত? এবং ধর্মানুসারে কোন বাদানুবাদ নিন্দার কারণ হইতেছে না ত?”

“মহারাজ! যাহারা এরূপ বলে- ‘শ্রমণ গৌতম বলিয়াছেন- এমন কোন শ্রমণ কিংবা ব্রাহ্মণ নাই যিনি সর্বজ্ঞ, সর্বদর্শী, অপরিশেষ জ্ঞান-দর্শন জানিবেন, ইহা সম্ভব নহে।’ তাহারা আমার সম্বন্ধে সত্যবাদী নহে; অভূত ও অসত্যদ্বারা তাহারা আমার অপবাদ প্রচার করিতেছে মাত্র।”

৩৭৮। তখন রাজা পসেনদি কোশল বিড়ুঢ়ভ সেনাপতিকে আহ্বান করিলেন,- “সেনাপতি! আজ রাজান্তঃপুরে এই কথা-প্রসঙ্গ কে উত্থাপন করিয়াছিল?”

“মহারাজ! আকাশগোত্র সঞ্জয়ব্রাহ্মণ।”

তখন রাজা পসেনদি কোশল ...... এক ব্যক্তিকে ডাকিলেন,- “হে পুরুষ! যাও, আমার বাক্যে সঞ্জয়ব্রাহ্মণকে বল- ‘মহাশয়! আপনাকে রাজা পসেনদি কোশল আহ্বান করিয়াছেন’।”

“হাঁ, দেব!” (আদেশ কার্যে পরিণত হইল।)

তখন রাজা পসেনদি ভগবানকে বলিলেন,- “সম্ভবতঃ, ভন্তে! ভগবান অন্য উপলক্ষে কিছু বাক্য ভাষণ করিয়াছেন, তাহা জনসাধারণ অন্যথা বুঝিয়া থাকিবে। ভন্তে! ভগবান যে বাক্য বলিয়াছেন, তাহা কি প্রকার জানেন?”

“মহারাজ! যে বাক্য আমি বলিয়াছি, তাহা আমি জানি। মহারাজ! আমি যে বাণী ঘোষণা করিয়াছি, তাহা এইরূপ- ‘এমন কোন শ্রমণ কিংবা ব্রাহ্মণ নাই- যিনি একই বারে (=সকিদেব) সমস্ত জানিবেন, সমস্ত দেখিবেন, ইহা সম্ভব নহে’।”

“ভন্তে! ভগবান যুক্তি-সঙ্গত (হেতুরূপ) বলিয়াছেন, ভন্তে! ভগবান সুযুক্তি-সঙ্গত বলিয়াছেন,- ‘তেমন শ্রমণ কিংবা ব্রাহ্মণ নাই, যিনি একই বারে যুগপৎ সমস্ত জানিবেন, সমস্ত দেখিবেন, ইহা সম্ভব নহে।’ ভন্তে! এই চতুর্বিধ বর্ণ- ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, বৈশ্য ও শূদ্র। ভন্তে! এই চারিবর্ণের মধ্যে কোন বিশেষত্ব আছে কি- কোন নানাকরণ আছে কি?”

“মহারাজ! চারিবর্ণের মধ্যে অভিবাদন, প্রত্যুত্থান, অঞ্জলিকর্ম ও সমীচীন-কর্মে দুইবর্ণ অগ্র (শ্রেষ্ঠ) বলা হইয়া থাকে- ক্ষত্রিয় আর ব্রাহ্মণ।”

“ভন্তে! আমি ভগবানকে ইহলোক (দৃষ্টধর্ম) সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করি নাই, আমি ...... পরলোক (সাংপরায়িক) সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিতেছি ......। ভন্তে! এই চারিবর্ণের মধ্যে পারলৌকিক কোন বিশেষত্ব কিংবা নানাকরণ আছে কি?”

৩৭৯। “মহারাজ! এই পঞ্চ প্রধানীয় অঙ্গ, কোন্‌ পঞ্চ? (১) মহারাজ! ভিক্ষু শ্রদ্ধাবান হয়, তথাগতের বোধির প্রতি শ্রদ্ধা করে- এই প্রকারে সেই ভগবান অর্হৎ ......। (২) অল্পাবাধ, নিরাতঙ্ক, অতিশীত-অতিউষ্ণ রহিত মধ্যম সাধনাক্ষম সমপরিপাচক শক্তিযুক্ত হয়। (৩) শঠ ও মায়াবী না হইয়া শাস্তা কিংবা সব্রহ্মচারীদের কাছে যথাভূতভাবে আপনাকে প্রকাশ করে। (৪) আরব্ধ-বীর্য হয়- অকুশলধর্মের প্রহাণ ও কুশলধর্মের উৎপাদনের জন্য শক্তিমান, দৃঢ়পরাক্রমশালী, কুশলধর্মে ধূরনিক্ষেপ না করিয়া (লক্ষ্যভ্রষ্ট না হইয়া) বিহার করেন। (৫) প্রজ্ঞাবান হয়- উদয়াস্তগামিনী আর্য, নির্বেধিক সম্যক্‌ দুঃখ-ক্ষয়গামিনী, প্রজ্ঞাযুক্ত হয়। মহারাজ! এই পঞ্চ প্রধানীয় (ধ্যানোদ্যোগের) অঙ্গ। যদি মহারাজ! ...... চারিবর্ণ এই পঞ্চ প্রধানীয় অঙ্গ সংযুক্ত হয়, তবে উহা তাহাদের দীর্ঘকালের হিত-সুখের নিদান হইবে।

“ভন্তে! চারিবর্ণ যদি এই পঞ্চ প্রধানীয় অঙ্গযুক্ত হয়, তবে ভন্তে! উহাদের মধ্যে কোন ভেদ, কোন নানাকরণ হইবে কি?”

মহারাজ! এক্ষেত্রেও আমি তাহাদের প্রধান (=উদ্যোগ) নানাত্বই বলিতেছি, যেমন মহারাজ! দুই দম্যহস্তী দম্যঅশ্ব বা দম্যগরু সুদান্ত ও সুবিনীত (সুশিক্ষিত) হয়; আর দুই দম্যহস্তী দম্যঅশ্ব বা দম্যগরু অদান্ত ও অবিনীত হয়। তবে মহারাজ! তাহা কি মনে করেন, ...... যাহারা সুদান্ত ও সুবিনীত হয়, তাহারা দান্ত হইয়াই দান্ত অধিকার প্রাপ্ত হইবে, দান্ত হইয়াই দান্ত-প্রাপ্যভূমি প্রাপ্ত হইবে?”

“হাঁ, ভন্তে!”

“মহারাজ! ...... যাহারা অদান্ত, অবিনীত হয়, কেমন, তাহারা অদান্ত হইয়া দান্ত-অধিকার পাইতে পারে, অদান্ত হইয়া দান্ত-প্রাপ্যভূতি লাভ করিতে পারে?”

“নিশ্চয় না, ভন্তে!”

“সেই প্রকারই, মহারাজ! শ্রদ্ধাবান নীরোগ (সুস্থ), অশঠ, অমায়াবী, আরব্ধ-বীর্য ও প্রজ্ঞাবানের যাহা প্রাপ্য; তাহা নিতান্ত অশ্রদ্ধ, বহুরোগী, শঠ, মায়াবী, অলস ও প্রজ্ঞাহীন ব্যক্তি লাভ করিবে, ইহা সম্ভব নহে।”

৩৮০। “ভন্তে! ভগবান যুক্তি-সঙ্গতই বলিয়াছেন, সুযুক্তি-সঙ্গতই বলিয়াছেন। ভন্তে! ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, বৈশ্য, শূদ্র, এই চারিবর্ণ; যদি তাহারা এই পঞ্চ প্রধানীয় অঙ্গ সংযুক্ত হয়, সম্যক্‌ প্রধানশীল হয়, তবে ভন্তে! এক্ষেত্রে তাহাদের কিছু তারতম্য ও নানাকরণ হইবে না?”

মহারাজ! এক্ষেত্রে উহাদের একের বিমুক্তির সহিত অপরের বিমুক্তির কিছুমাত্র নানাকরণ বলি না। যেমন মহারাজ! কোন পুরুষ শুষ্ক শাক-তরু-কাষ্ঠ লইয়া অগ্নি প্রজ্বলিত করে, তেজ প্রাদুর্ভূত করে; অপর পুরুষ শুষ্ক শালকাষ্ঠ.... আম্রকাষ্ঠ....; আর ...... উদম্বর (ডুমুর) কাষ্ঠ লইয়া অগ্নি প্রজ্বলিত করে, ......। মহারাজ! তাহা কি মনে করেন, নানা কাষ্ঠ (ইন্ধন) হইতে উৎপন্ন অগ্নি সমূহের কোন নানাকরণ- শিখা হইতে শিখায়, রং হইতে রংএ, আভা হইতে আভায়- কোন পার্থক্য হইবে?”

“নিশ্চয় না, ভন্তে!”

“এইরূপই মহারাজ! যেই তেজ (অগ্নি, মুক্তি) বীর্য-নির্মথিত, প্রধান; (তাহা উদ্যোগের পরে উৎপন্ন)। সুতরাং তাহাতে- যেমন একের বিমুক্তির সহিত অপরের বিমুক্তিতে- আমি কিছু নানাকরণ বা প্রভেদ বলি না।”

“ভন্তে! ভগবান যুক্তি-সঙ্গত বলিয়াছেন, সুযুক্তি-সঙ্গত বলিয়াছেন। কেমন, ভন্তে! দেবতা আছেন কি?”

“মহারাজ! আপনি (কি জানেন না?) কেন এরূপ বলিতেছেন- ‘ভন্তে! দেবতা আছেন কি’?”

“যদিও ভন্তে! দেবতা আছেন, তাঁহারা ইহলোকে (মানবজন্মে) আগমন করেন কি? অথবা মানবজন্মে তাঁহারা আগমন করেন না?”

“মহারাজ! যে সকল দেবতা সব্যাপাদ বা সহিংস তাহারা এই মানবজন্মে আগমনকারী; আর যে সকল দেবতা হিংসামুক্ত তাহারা ইহলোকে অনাগমনকারী।”

৩৮১। এইরূপ উক্ত হইলে বিড়ুঢ়ভ সেনাপতি ভগবানকে জিজ্ঞাসা করিলেন,- “ভন্তে! যে সকল দেবতা হিংসা পরায়ণ ও ইহলোকে আগমনকারী আর যে সকল দেবতা অহিংসা পরায়ণ ও ইহলোকে অনাগমনকারী তাঁহাদিগকে তদবস্থা হইতে চ্যুত কিংবা অপসারণ করিতে পারেন কি?”

তখন আয়ুষ্মান আনন্দের এই চিন্তা হইল- ‘এই সেনাপতি বিড়ুঢ়ভ রাজা পসেনদি কোশলের পুত্র, আমিও ভগবানের পুত্র; সুতরাং পুত্র পুত্রের সহিত মন্ত্রণা করিবার ইহাই উপযুক্ত সময়।’ তখন আয়ুষ্মান আনন্দ বিড়ুঢ়ভ সেনাপতিকে আহ্বান করিলেন,- “সেনাপতি! তাহা হইলে আমি আপনাকেই এস্থলে জিজ্ঞাসা করিব, আপনার যাহা অভিপ্রেত তাহাই বিবৃত করিবেন। সেনাপতি! তাহা কি মনে করেন, রাজা পসেনদি কোশলের রাজ্য (বিজিত) যতদূর আছে, যাহার উপর রাজা পসেনদি কোশল প্রভুত্ব, আধিপত্য ও রাজত্ব করেন; তথায় রাজা ...... শ্রমণ বা ব্রাহ্মণ, পুণ্যবান বা অপুণ্যবান, ব্রহ্মচারী বা অব্রহ্মচারীকে তদবস্থা হইতে পদচ্যুত করিতে কিংবা নির্বাসন করিতে সমর্থ হন কি?”

“হাঁ, ভন্তে! সমর্থ হন।”

“তবে কি মনে করেন, সেনাপতি! যতদূর রাজা পসেনদি কোশল রাজ্যের বাহিরে, যাহার উপর তাঁহার প্রভুত্ব, আধিপত্য ও রাজত্ব নাই ...... সেস্থান হইতে কাহাকেও পদচ্যুত কিংবা নির্বাসন করিতে সমর্থ হন কি?”

“হাঁ, ভন্তে! সমর্থ হন না।”

“সেনাপতি! তাহা কি মনে হয়, আপনি ত্রয়ত্রিংশবাসী দেবতাদের সম্বন্ধে শুনিয়াছেন কি?”

“হাঁ, ভন্তে! ত্রয়ত্রিংশবাসী দেবতাদের সম্বন্ধে আমি শুনিয়াছি, এখানে মহামান্য রাজা প্রসেনদি কোশলও শুনিয়াছেন।”

“সেনাপতি! আপনার কেমন মনে হয়, রাজা পসেনদি কোশল সেই দেবতাদিগকে তথা হইতে অপসারণ কিংবা নির্বাসন করিতে পারিবেন কি?”

“মহামান্য রাজা পসেনদি কোশল ...... ত্রয়ত্রিংশবাসী দেবতাদিগকে দর্শন করিতেও সমর্থ হইবেন না, কি প্রকারে উঁহাদিগকে স্থানচ্যুত কিংবা নির্বাসিত করিবেন?”

“সেনাপতি! তদ্রূপই যে সকল দেবতা সব্যাপাদ (কাম-রাগ, হিংসাধীন) ও মানবজন্মে আসিতে বাধ্য সেই সকল দেবতা, আর যাহারা অব্যাপাদ ও মানবজন্মে আগমন করিতে বাধ্য নহে, তাহাদিগকে দর্শন করিতেও অক্ষম, কি প্রকারে সেস্থান হইতে তাহাদিগকে অপসারণ কিংবা নির্বাসন করিবেন?”

৩৮২। তখন রাজা পসেনদি ভগবানকে কহিলেন,- “ভন্তে! এই ভিক্ষুর নাম কি?”

“আনন্দ! মহারাজ! ইহাই নাম।”

“অহো! একান্তই আনন্দ হন!! অহো! একান্তই আনন্দ স্বরূপ হন!! ভন্তে! আয়ুষ্মান আনন্দ যুক্তি-সঙ্গত উত্তর দিয়াছেন। ....... সুবুক্তি-সঙ্গত উত্তর করিয়াছেন। কেমন ভন্তে! ব্রহ্মা আছেন কি?”

“কেন, মহারাজ! আপনি এরূপ কহিতেছেন- ‘কেমন ভন্তে! ব্রহ্মা আছেন কি’?”

“ভন্তে! কেমন সে ব্রহ্মা মনুষ্যজন্মে আগমন করেন কিংবা মনুষ্যলোকে আগমন করেন না?”

“মহারাজ! যে ব্রহ্মা সব্যাপাদ হন, ...... , তিনি আগমন করেন; আর যিনি ব্যাপাদমুক্ত তিনি আগমন করেন না।”

তখন একব্যক্তি রাজা পসেনদি কোশলকে বলিলেন,- “মহারাজ! আকাশ-গোত্র সঞ্জয়ব্রাহ্মণ আসিয়াছেন।”

তখন রাজা ...... সঞ্জয়ব্রাহ্মণকে কহিলেন,- “ব্রাহ্মণ! রাজান্তঃপুরে কে এই কথা প্রসঙ্গ উত্থাপন করিয়াছে ......?”

“মহারাজ! সেনাপতি বিড়ুঢ়ভ।”

সেনাপতি বিঢ়ুঢ়ভ কহিলেন,- “মহারাজ! আকাশগোত্র সঞ্জয়ব্রাহ্মণ।”

তখন এক ব্যক্তি রাজা পসেনদি কোশলকে নিবেদন করিল,- “যাবার সময় হইয়াছে, মহারাজ!”

তখন রাজা পসেনদি কোশল ভগবানকে ইহা বলিলেন,- “ভন্তে! আমরা ভগবানকে সর্বজ্ঞতা সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিয়াছি, ভগবান সর্বজ্ঞতা সম্বন্ধে বর্ণনা করিয়াছেন, উহা আমাদের রুচিকর ও মনোপূত হইয়াছে; তাহাতে আমরা সন্তুষ্ট। চাতুর্বর্ণ্য শুদ্ধি ...... অধিদেব ...... , অধিব্রহ্মা ...... । যে যে প্রশ্নই আমরা ভগবানকে জিজ্ঞাসা করিয়াছি, তাহাই ভগবান সদুত্তর করিয়াছেন; উহা আমাদের রুচিকর, মনোমুগ্ধকর হইয়াছে; আর উহাতে আমরা সন্তুষ্ট হইয়াছি। তবে ভন্তে! এখন আমরা যাই, আমাদের বহু কৃত্য, বহু করণীয় আছে।”

“মহারাজ! আপনি যাহা উচিত মনে করেন।”

তখন রাজা পসেনদি কোশল ...... ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন ও অনুমোদন করিয়া, আসন হইতে উঠিয়া ভগবানকে অভিবাদন পূর্বক প্রদক্ষিণ করিয়া প্রস্থান করিলেন।

॥ কণ্নকত্থল সূত্র সমাপ্ত ॥