২। ভিক্ষুবর্গ

অম্ব-লট্‌ঠিক রাহুলোবাদ সূত্র (৬১)

১০৭। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-

এক সময় ভগবান রাজগৃহের বেণুবন কলন্দকনিবাপে বাস করিতেছেন। সেই সময় আয়ুষ্মান রাহুল অম্ব-লট্‌ঠিকায় বসবাস করেন। তখন ভগবান সায়ংকালীন (ফল সমাপত্তি) ধ্যান হইতে উঠিয়া অম্ব-লট্‌ঠিকবনে যেখানে আয়ুষ্মান রাহুল আছেন, তথায় উপস্থিত হইলেন। আয়ুষ্মান রাহুল দূর হইতেই ভগবানকে আসিতে দেখিলেন, দেখিয়া আসন, পদধৌত করিবার জল এবং পাদান স্থাপন করিলেন। ভগবান প্রজ্ঞাপ্ত আসনে বসিলেন, বসিয়াই পদধৌত করিলেন। আয়ুষ্মান রাহুলও ভগবানকে অভিবাদন করিয়া একপ্রান্তে বসিলেন।

১০৮। তখন ভগবান উদকভাজনে স্বল্পমাত্র জলাবশেষ রাখিয়া আয়ুষ্মান রাহুলকে আমন্ত্রণ করিলেন,- “রাহুল! ভাজনে স্থাপিত অবশিষ্ট এই স্বল্পমাত্র জল দেখিতেছ কি?”

“হাঁ, ভন্তে!”

“রাহুল! যাহাদের সজ্ঞানে মিথ্যা কথনে লজ্জা নাই, তাহাদের শ্রামণ্য (শ্রমণধর্ম) এইরূপ স্বল্পমাত্র।”

তখন ভগবান সেই স্বল্পজল ত্যাগ করিয়া আয়ুষ্মান রাহুলকে ডাকিলেন,- “রাহুল! সেই স্বল্পজল পরিত্যক্ত হইয়াছে, দেখিতেছ কি?”

“হাঁ, ভন্তে!”

“রাহুল! এইরূপ পরিত্যক্ত তাহাদের শ্রামণ্য, যাহাদের সজ্ঞানে মিথ্যা কথনে লজ্জা নাই।”

তখন ভগবান সেই ভাজন অধঃমুখী করিয়া রাহুলকে ডাকিলেন,- “রাহুল! তুমি এই ভাজনকে অধঃমুখে দেখিতেছ কি?”

“হাঁ, ভন্তে!”

“রাহুল! এইরূপই অধঃমুখী তাহাদের শ্রামণ্য, যাহাদের সজ্ঞানে মিথ্যা ভাষণে লজ্জা নাই।”

তখন ভগবান সেই ভাজন ঊর্দ্ধমুখ করিয়া আয়ুষ্মান রাহুলকে ডাকিলেন,- “রাহুল! এই ভাজন রিক্ত, শূন্য দেখিতেছ কি?”

“হাঁ, ভন্তে!”

“রাহুল! এইরূপ রিক্ত, শূন্য তাহাদের শ্রামণ্য, যাহাদের সজ্ঞানে মিথ্যা কথনে লজ্জা নাই; যেমন- রাহুল! ঈশাদন্ত, উচ্চ, আরোহণযোগ্য, (সুন্দর জাতীয়) অভিজাত সংগ্রাম কুশল রাজহস্তী সংগ্রামে গেলে সে সম্মুখ পদদ্বারা (সংগ্রাম) কর্ম করে, পশ্চাৎ পাদেও কর্ম করে, শরীরের অগ্রভাগেও কর্ম করে, পশ্চাৎ ভাগেও কর্ম করে, মস্তকদ্বারাও কর্ম করে, কানদ্বারা কর্ম করে, দন্তদ্বারা কর্ম করে, লেজদ্বারাও কর্ম করে, কিন্তু শুণ্ডকেই সযত্নে রক্ষা করে। ইহাতে হস্ত্যারোহীর এই (ধারণা) হয়,- ‘রাজার এই নাগ ...... পূ ...... যদি শুণ্ড সন্তর্পণে রক্ষা করে, তবে রাজার এই হস্তীর জীবন অপরিত্যক্তই হয়।’ কিন্তু যদি রাহুল! ঈশার ন্যায় দন্তবান, উচ্চ আরোহণ যোগ্য, অভিজাত সংগ্রামচর নাগ ...... পূ ...... লাঙ্গুলদ্বারা কর্ম করে, শুণ্ডদ্বারাও কর্ম করে, তখন হস্ত্যারোহীর এই চিন্তা হয়,- ‘রাজার এই নাগ ...... পূ ...... লাঙ্গুলদ্বারা কর্ম করে, শুণ্ডদ্বারাও কর্ম করে। সুতরাং রাজার নাগের জীবন বিসর্জিত হইয়াছে। এখন আর রাজার নাগের কোন কর্তব্য নাই’। সেইরূপই রাহুল! যাহার সজ্ঞানে মিথ্যা ভাষণে লজ্জা নাই, তাহার পক্ষে কোন পাপকর্ম অকরণীয়- ইহা আমি বলি নাই। সেই কারণে রাহুল! ‘হাসি-ঠাট্টাচ্ছলেও মিথ্যা বলিব না’ ইহাই তোমার শিক্ষা করা উচিত।”

১০৯। “তুমি কি মনে কর রাহুল! দর্পণ কোন্‌ প্রয়োজনে লাগে?”

“ভন্তে! অবলোকনের জন্য।”

“এইরূপই রাহুল! দেখিয়া দেখিয়া কায়-কর্ম করা উচিত, দেখিয়া দেখিয়া বাক্‌-কর্ম করা উচিত এবং প্রত্যবেক্ষণ করিয়া করিয়া মনো-কর্ম করা উচিত। যখনই রাহুল! তুমি কায়দ্বারা কোন কর্ম করিতে ইচ্ছুক হও, তখনই তোমার কায়-কর্ম প্রত্যবেক্ষণ (বিচার) করা উচিত,- ‘আমি যে কর্ম করিতে ইচ্ছুক হইয়াছি, আমার এই কায়-কর্ম নিজের জন্য পীড়াদায়ক হইবে কি? পরের জন্য পীড়াদায়ক হইবে কি? অথবা উভয়ের জন্য পীড়াদায়ক হইবে কি?’ এই কায়-কর্ম দুঃখোদ্রেককর, দুঃখ বিপাকজনক অকুশল কি?’ যদি রাহুল! তুমি এইরূপে প্রত্যবেক্ষণ করিয়া এরূপ জানিতে পার যে আমি কায়দ্বারা যে কর্ম করিতে ইচ্ছুক, আমার এই কায়কর্ম আত্মপীড়নের কারণ হইতে পারে, পর পীড়নেরও কারণ হইতে পারে, আত্ম-পর উভয় পীড়নেরও কারণ হইতে পারে। এই কায় কর্ম অকুশল দুঃখোদ্রেককর, দুঃখবিপাক জনক। তবে রাহুল! তোমার কায়দ্বারা এরূপ কর্ম একান্তই (সসক্কং ) অকরণীয়। যদি রাহুল! তুমি প্রত্যবেক্ষণ করিয়া ইহা বুঝিতে পার যে আমি কায়দ্বারা যে কর্ম করিতে ইচ্ছুক, আমার এই কায়-কর্ম আত্মপীড়াদায়ক হইবে না, পরপীড়াদায়ক হইবে না, উভয় পীড়াদায়ক হইবে না এবং এই কায়-কর্ম সুখোদ্রেককর ও সুখ বিপাকজনক হইবে। তবে, রাহুল! এরূপ কায়-কর্ম তোমার করণীয়। রাহুল! কায়দ্বারা কর্ম করিবার সময়ই তোমার সে কায়-কর্ম প্রত্যবেক্ষণ করা উচিত,- ‘এখন আমি কায়দ্বারা যে কর্ম করিতেছি, তাহা নিজের পক্ষে পীড়াদায়ক ...... পূ ......।’ যদি রাহুল! প্রত্যবেক্ষণ করিয়া এইরূপ জান যে ...... পূ ...... এই কায়-কর্ম অকুশল। তবে রাহুল! তুমি তথাবিধ কায়-কর্ম সংবরণ করিবে, আর করিবে না। ...... পূ ...... যদি জান, এই কায়-কর্ম কুশল, তবে এইরূপ কর্ম পুনঃপুনঃ করিবে। কায়দ্বারা কর্ম করিয়াও রাহুল! তোমার সেই কায়-কর্ম প্রত্যবেক্ষণ করা উচিত,- ‘আমি এই যে কায়-কর্ম করিলাম, আমার এই কায়-কর্ম নিজের পীড়াজনক হইবে, ...... এই কায়-কর্ম অকুশল ...... পূ ......। ...... পূ ...... যদি জান যে ...... পূ ...... তাহা অকুশল’। তবে রাহুল! এপ্রকার কায়-কর্ম সম্বন্ধে শাস্তার নিকট কিংবা বিজ্ঞ গুরু-ভাইদের (সব্রহ্মচারীদের) নিকট বলা উচিত, প্রকাশ করা উচিত, বর্ণনা করা উচিত। ইহা দেশনা ও বিবৃত করিয়া ভবিষ্যতের জন্য সংযম অবলম্বন করা উচিত। যদি রাহুল! তুমি প্রত্যবেক্ষণ করিয়া জান যে ...... পূ ...... এই কায়-কর্ম সুখজনক, সুখবিপাক জনক কুশলকর্ম; তবে রাহুল! সারা দিবা-রাত্রি কুশলধর্মে (শীল সম্পাদনে) শিক্ষাব্রতী হইয়া তুমি সেই প্রীতি-প্রমোদ্যে নিমগ্ন থাকিবে।”

১১০। “যদিও রাহুল! তুমি বাক্য দ্বারা কর্ম করিতে ইচ্ছুক হও ...... পূ ......। ...... পূ ...... কুশল বাক্‌-কর্ম ...... পূ ...... করা উচিত। ...... পূ ...... বার বার করা উচিত। ...... পূ ...... সেই প্রীতি-প্রমোদ্যে নিমগ্ন থাকিবে।” [কায়-কর্মের ন্যায় বিস্তার করিবে।]

১১১। “যদি রাহুল! তুমি মানস-কর্ম করিতে ইচ্ছুক হও ...... পূ ...... অকুশল মনো-কর্ম একান্তই না করা উচিত। ...... পূ ...... তবে কুশল মনো-কর্ম করা উচিত ...... পূ ...... বার বার করা উচিত, করিবার সময় ...... অকুশল ...... তুমি সংহরণ (সংযত) করিবে। ...... পূ ...... মনো-কর্ম করিয়াও ...... পূ ...... তোমার এই মনো-কর্ম অকুশল ...... পূ ......। তবে রাহুল! এতাদৃশ মনো-কর্মে লজ্জিত হওয়া উচিত, ঘৃণা করা উচিত, ক্ষুণ্ন হইয়া, লজ্জা করিয়া, ঘৃণা করিয়া ভবিষ্যতের জন্য সংযম অবলম্বন করা উচিত। যদি জান ...... পূ ...... উহা কুশল; তবে রাহুল! কুশলধর্ম সমূহে (শীল-সমাধিতে) শিক্ষাব্রতী হইয়া সারা দিন-রাত্রি সেই প্রীতি ও প্রমোদ্যে নিমগ্ন থাকিবে। রাহুল! যে সকল শ্রমণ (বুদ্ধ) ও ব্রাহ্মণ (প্রত্যেক বুদ্ধ) অতীতকালে কায়-কর্ম ও বাক্‌-কর্ম ও মনো-কর্ম পরিশুদ্ধ করিয়াছেন, তাঁহারা সকলেই এই প্রকার প্রত্যবেক্ষণ করিয়া করিয়া কায়-বাক্‌-মনোকর্ম পরিশুদ্ধ করিয়াছিলেন। রাহুল! কোন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ ভবিষ্যতকালে কায়-কর্ম, বাক্‌-কর্ম ও মনো-কর্ম পরিশুদ্ধ করিবেন তাঁহারাও এই প্রকারে পরিশুদ্ধ করিবেন। যে কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ বর্তমানকালেও কায়-কর্ম, বাক্‌-কর্ম ও মনো-কর্ম পরিশুদ্ধ করিতে ইচ্ছা করেন, তাঁহারাও এই প্রকারে পরিশুদ্ধ করিবেন। ...... পূ ......। সেই কারণে রাহুল! তোমার ইহা শিক্ষা করা উচিত যে,- ‘আমি প্রত্যবেক্ষণ করিয়াই কায়-কর্ম, বাক্‌-কর্ম ও মনো-কর্ম পরিশোধন করিব’।”

ভগবান ইহা বলিলেন। আয়ুষ্মান রাহুল ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন করিলেন।

॥ অম্ব-লট্‌ঠিক রাহুলোবাদ সূত্র সমাপ্ত ॥

মহারাহুলোবাদ সূত্র (৬২)

১১৩। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-

এক সময় ভগবান শ্রাবস্তীতে অনাথপিণ্ডিকের আরাম জেতবনে বাস করিতেছেন। তখন ভগবান পূর্বাহ্ন সময়ে নিবাসন পরিধান করিয়া পাত্র-চীবর লইয়া ভিক্ষার নিমিত্ত শ্রাবস্তীতে প্রবেশ করিলেন। আয়ুষ্মান রাহুলও পূর্বাহ্ন সময়ে নিবাসন পরিধান করিয়া পাত্র-চীবর লইয়া ভগবানের পদাঙ্ক অনুসরণ করিলেন। তখন ভগবান পশ্চাদ্দিকে ফিরিয়া আয়ুষ্মান রাহুলকে ডাকিলেন,- “রাহুল! যাহা কিছু রূপ আছে- ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমানের, শরীরাভ্যন্তরে বা বাহিরে, স্থূল বা সূক্ষ্ম, হীন বা উৎকৃষ্ট, দূরের কিংবা সমীপের- যাবতীয় রূপ সম্বন্ধে ‘ইহা আমার নহে, আমি উহাতে (অবস্থিত) নহি, উহা আমার আত্মা নহে, এইরূপেই সম্যক্‌ প্রজ্ঞাদ্বারা যথাভূত দর্শন করা উচিত।”

“কেবল রূপই কি? ভগবন! রূপই কি? সুগত!”

“রূপও, রাহুল! বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার, বিজ্ঞান (স্কন্ধ) ও।”

তখন আয়ুষ্মান রাহুল ভগবানের সম্মুখে উপদিষ্ট হইয়া ‘আজ আর কে ভিক্ষার্থ গ্রামে প্রবেশ করিবে?’ (চিন্তা করিয়া) তথা হইতে ফিরিয়া এক বৃক্ষের নীচে পদ্মাসন করিয়া শরীরকে সোজা রাখিয়া স্মৃতি পরিমুখে নিবদ্ধ করিয়া (ধ্যানাসনে) বসিলেন।

অতঃপর আয়ুষ্মান সারিপুত্র আয়ুষ্মান রাহুলকে ...... পূ ...... বৃক্ষের নীচে ঐ অবস্থায় উপবিষ্ট দেখিলেন, দেখিয়া আয়ুষ্মান রাহুলকে বলিলেন,- “রাহুল! আনাপান (আন+অপান) স্মৃতি ভাবনা (ধ্যান) কর। রাহুল! আনাপান স্মৃতি ভাবিত হইলে মহৎফলদায়ক ও মহা আনিসংশদায়ক হয়।

১১৪। অতঃপর আয়ুষ্মান রাহুল সায়ংকালীন বিবেকবিহার (ধ্যান) হইতে উঠিয়া ভাবনা-বিধান জানিবার জন্য ভগবানের সমীপে উপস্থিত হইলেন। উপস্থিত হইয়া ভগবানকে অভিবাদন পূর্ব্বক একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট আয়ুষ্মান রাহুল ভগবানকে বলিলেন,- “ভন্তে! আনাপান স্মৃতি কি প্রকারে ভাবিত ও বহুলীকৃত (বৃদ্ধিকৃত) হইলে মহৎফলদায়ক ও মহা উপকারদায়ক হয়?”

“রাহুল! আপন শরীরে (অধ্যাত্ম) ব্যক্তিগত (পচ্চত্তং) যে কিছু কর্কশ, কঠিন, উপাদিন্ন (কর্মজনিত) যেমন- কেশ, লোম, নখ, দন্ত, ত্বক, মাংস, ্লায়ু, অস্থি, অস্থিমজ্জা, বক্ষ, হৃদয়, যকৃৎ, ক্লোম, প্লীহা, ফুস্‌ফুস্‌, অন্ত্র, অন্ত্রগুণ (অন্ত্রবন্ধনী), উদরস্থ খাদ্য, মস্তিষ্ক ও বিষ্ঠা অথবা অন্যও যাহা কিছু অধ্যাত্ম প্রত্যাত্ম শরীরে কর্কশ, কঠিন উপাদিন্ন রূপ আছে, রাহুল! ইহাই আধ্যাত্মিক পৃথিবীধাতু। যাহা আধ্যাত্মিক পৃথিবীধাতু এবং যাহা বাহিরের পৃথিবীধাতু, ইহারা পৃথিবীধাতুই। এই পৃথিবীধাতুকে- ‘ইহা আমার নহে, আমি ইহাতে অবস্থিত নহি, ইহা আমার আত্মা নহে।’ এইরূপ সম্যক্‌ প্রজ্ঞাদ্বারা ইহা যথার্থরূপে দর্শন করা উচিত। এইরূপে সম্যক্‌ প্রজ্ঞাদ্বারা ইহা যথার্থরূপে দেখিয়া (ভিক্ষু) পৃথিবীধাতু হইতে উদাসীন হয়, পৃথিবীধাতু হইতে চিত্ত বিরত করে।”

১১৫। “রাহুল! আপধাতু কি প্রকার? আপধাতু আধ্যাত্মিক ও বাহ্যিক দ্বিবিধ। রাহুল! আধ্যাত্মিক আপধাতু কি? যাহা অধ্যাত্ম প্রত্যাত্ম আপ (জল), আপজাতীয় উপাদিন্ন যেমন- পিত্ত, শ্লেষ্মা, পুঁজ, লোহিত, স্বেদ, মেদ, অশ্রু, বশা, থুথু, সিঙ্ঘনিকা, লসিকা ও মুত্র ...... পূ ......।” [পৃথিবীধাতুর ন্যায় আপধাতুকে বিস্তার করিতে হইবে।]

১১৬। “রাহুল! তেজধাতু কি? তেজধাতু আধ্যাত্মিক ও বাহ্যিক ভেদে দ্বিবিধ। আধ্যাত্মিক তেজধাতু কি? যাহা অধ্যাত্ম প্রত্যাত্ম তেজ, তেজ-জাতীয় শরীরস্থ যেমন- যদ্বারা সন্তপ্ত হয়, জীর্ণ হয়, পরিদাহ হয় এবং যদ্বারা অশীত-পীত-খাদিত-আস্বাদিত বস্তু উত্তমরূপে জীর্ণ হয়। ...... পূ ......।”

১১৭। “রাহুল! বায়ুধাতু কি? ...... পূ ...... যেমন- ঊর্ধগামী বায়ু, অধঃগামী বায়ু, কুক্ষিশায়ী বায়ু, কোষ্ঠাশয় বায়ু, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গানুসারী বায়ু এবং আশ্বাস প্রশ্বাস বায়ু। ...... পূ ......।”

১১৮। “রাহুল! আকাশধাতু কি? আকাশধাতু আধ্যাত্মিক ও বাহ্যিক আছে। রাহুল! আধ্যাত্মিক আকাশধাতু কি? ...... পূ ...... যেমন- কর্ণছিদ্র, নাসাছিদ্র, মুখদ্বার অশীত-পীত-খাদিত-স্বাদিত (অন্নপান-খাদন-আস্বাদন) আহার্য ভিতরে প্রবেশ করে, যে স্থানে অন্নপানীয়-খাদ্য-ভোজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়; আর যদ্বারা ইহার অধঃভাগ দিয়া বাহির হয়। অথবা শরীরে, প্রতিশরীরে অপরও যে কিছু আকাশ, আকাশস্বরূপ শরীরে আছে, রাহুল! ইহাকে আধ্যাত্মিক আকাশধাতু বলা হয়। আধ্যাত্মিক-বাহ্যিক উভয়বিধ আকাশধাতু- ধাতু মাত্রই ‘ইহা আমার নহে, উহাতে আমি অবস্থিত নহি, উহা আমার আত্মা নহে’ এই প্রকারে ইহা সম্যক্‌ প্রজ্ঞাদ্বারা যথাভূত দর্শন করা উচিত। এইরূপ দেখিয়া যোগী আকাশধাতুর প্রতি উদ্বিগ্ন হয়, আকাশ-ধাতু হইতে চিত্ত নিবৃত্ত করে।”

১১৯। “রাহুল! (নিজকে) পৃথিবীসম ভাবনা বর্ধিত (ধ্যান) কর। পৃথিবীসম রাহুল! ভাবনা ভাবিলে উৎপন্ন মনোরম স্পর্শ তোমার চিত্তকে অধিকার করিয়া থাকিবে না (ছন্দ-রাগ উৎপন্ন হইতে পারিবে না), যেমন- রাহুল! পৃথিবীতে শুচিও (পবিত্র বস্তুও) নিক্ষেপ করা যায়, অশুচিও নিক্ষেপ করা যায়, পায়খানা, প্রস্রাব, কফ, পুঁজ, রক্তও নিক্ষেপ করা যায়; উহাতে পৃথিবী দুঃখিত হয় না, গ্লানি বা ঘৃণা করে না। এই প্রকারেই রাহুল! তুমি (নিজকে) পৃথিবীসম ভাবনা (ধারণা) বর্ধন (গঠন) কর। রাহুল! পৃথিবীসম ধারণা পোষণ করিলেও উৎপন্ন মনোরম-অমনোরম সংস্পর্শ (বিষয় ও ইন্দ্রিয় সম্মেলন) তোমার চিত্তকে অধিকার করিয়া থাকিবে না।”

“রাহুল! আপ (জল) সম ...... পূ ...... যেমন রাহুল! জলে শুচি অশুচি ধৌত করা যায় ...... পূ ......।”

“রাহুল! তেজ (অগ্নি) সম ...... পূ ...... যেমন রাহুল! তেজ শুচিকেও অশুচিকেও দগ্ধ করে ...... পূ ......।”

“রাহুল! বায়ুসম ...... পূ ...... যেমন রাহুল! বায়ু শুচিকেও প্রবাহিত করে, অশুচিকেও প্রবাহিত করে ...... পূ ......।”

“রাহুল! আকাশসম ...... পূ ...... যেমন রাহুল! আকাশ কোথাও প্রতিষ্ঠিত (লিপ্ত) নহে, সেই প্রকার তুমি নিজকে আকাশসম ধারণা পোষণ কর। রাহুল! আকাশসম ভাবনা পোষণ করিলে উৎপন্ন মনোরম-অমনোরম স্পর্শ তোমার চিত্তকে অধিকার করিয়া থাকিবে না।”

১২০। রাহুল! মৈত্রী (সকলের প্রতি মিত্রভাব) ভাবনা পোষণ কর, মৈত্রীভাবনা পোষণ করিলে (উপচার, অর্পণা সমাধি প্রাপ্ত হইলে) তোমার যে ব্যাপাদ (বিদ্বেষ), উহা প্রহীণ হইয়া যাইবে।”

“রাহুল! করুণা (সর্ব জীবে দয়া) ভাবনা পোষণ কর। করুণা ভাবনা ভাবিত হইলে (উপচার অর্পণা সমাধিতে) তোমার যে বিহিংসা (পরপীড়ন প্রবৃত্তি) আছে, তাহা প্রহীণ হইবে।”

“রাহুল! মুদিতা (সুখীর প্রতি প্রসন্নতা) ভাবনা গঠন কর। মুদিতা ভাবনা বৃদ্ধি করিলে তোমার যে অরতি (অপ্রসাদ) আছে, তাহা প্রহীণ হইবে।”

“রাহুল! উপেক্ষা ভাবনা পোষণ কর। উপেক্ষা ভাবনা করিলে তোমার যে প্রতিঘ (প্রতিহিংসাবৃত্তি) আছে, তাহা প্রহীণ হইবে।”

“রাহুল! অশুভ (ভোগের অশুচিতা) ভাবনা সাধন কর, তোমার যে ভোগানুরাগ আছে ইহার দ্বারা তাহা প্রহীন হইয়া...... যাইবে।”

“রাহুল! অনিত্য (সকল পদার্থ পরিবর্তনশীল) ভাবনা বৃদ্ধি কর। ...... পূ ...... তোমার যে অস্মিমান (অহঙ্কার) আছে, তাহা প্রহীণ হইবে।”

১২১। “রাহুল! আনাপান স্মৃতি ভাবনা অভ্যাস কর। আনাপান স্মৃতি অভ্যাস ও বর্ধন করিলে মহাফলপ্রদ ও মহা উপকারদায়ক হয়। রাহুল! কি প্রকারে ভাবিত ও বহুলীকৃত আনাপান স্মৃতি মহাফলপ্রদ ও মহা উপকারদায়ক হয়? রাহুল! ভিক্ষু অরণ্যে, বৃক্ষমূলে কিংবা শূন্যাগারে গিয়া শরীর সোজা বিন্যস্ত করিয়া, স্মৃতি পরিমুখে স্থাপন করিয়া, পদ্মাসন বদ্ধ হইয়া ধ্যানাসনে বসে। সে স্মৃতিমান হইয়া শ্বাস গ্রহণ করে, স্মৃতিমান হইয়া প্রশ্বাস ত্যাগ করে। যেমন- (১) দীর্ঘশ্বাস গ্রহণের সময় দীর্ঘশ্বাস গ্রহণ করিতেছি বলিয়া জানে এবং দীর্ঘপ্রশ্বাস ত্যাগের সময় দীর্ঘপ্রশ্বাস ত্যাগ করিতেছি বলিয়া জানে। (২) হ্রস্বশ্বাস গ্রহণের সময় হ্রস্বশ্বাস গ্রহণ করিতেছি বলিয়া জানে এবং হ্রস্বশ্বাস ত্যাগ করিবার...... সময় হ্রস্বশ্বাস ত্যাগ করিতেছি বলিয়া জানে। (৩) ‘সর্বকায় (শ্বাস) অনুভব (প্রতিসংবেদন) করিয়া শ্বাস গ্রহণ করিব’ এরূপ শিক্ষা করে এবং ‘সর্বকায় অনুভব করিয়া প্রশ্বাস ত্যাগ করিব’ এরূপ শিক্ষা করে। (৪) ‘কায়সংস্কার (শ্বাস-প্রশ্বাস) প্রশমিত করিয়া শ্বাস গ্রহণ ও প্রশ্বাস ত্যাগ করিব’ শিক্ষা করে। (৫) ‘(ধ্যানজ) প্রীতি জ্ঞাত হইয়া শ্বাস গ্রহণ ও প্রশ্বাস ত্যাগ করিব’ শিক্ষা করে। (৬) ‘সুখ (বেদনা) অবগত হইয়া শ্বাস গ্রহণ ও প্রশ্বাস ত্যাগ করিব’ শিক্ষা করে। (৭) ‘চিত্ত-সংস্কার (সংজ্ঞা-বেদনা) অনুভব করিতে করিতে শ্বাস গ্রহণ ও প্রশ্বাস ত্যাগ করিব’ শিক্ষা করে। (৮) ‘স্থূল চিত্তসংস্কার প্রশমিত করিয়া শ্বাস গ্রহণ ও প্রশ্বাস ত্যাগ করিব’ অভ্যাস করে। (৯) ‘চিত্ত প্রতিসংবেদী হইয়া শ্বাস গ্রহণ ও প্রশ্বাস ত্যাগ করিব’ অভ্যাস করে। (১০) (সমাধি ও বিদর্শন ভেদে) ‘চিত্ত প্রমোদিত করিয়া শ্বাস গ্রহণ ও প্রশ্বাস ত্যাগ করিব’ অভ্যাস করে। (১১) (প্রথম ধ্যানাদি ভেদে আলম্বনে) ‘চিত্ত সম্যক্‌রূপে স্থাপন করিয়া শ্বাস গ্রহণ ও প্রশ্বাস ত্যাগ করিব’ প্রচেষ্টা করে। (১২) (নীবরণ ও স্থূল ধ্যানাঙ্গ হইতে) ‘চিত্ত বিমোচন করিয়া শ্বাস গ্রহণ করিব ও প্রশ্বাস ত্যাগ করিব’ অভ্যাস করে। (১৩) ‘(পঞ্চস্কন্ধের) অনিত্যানুদর্শী হইয়া (নিত্য সংজ্ঞামুক্ত অবস্থায়) শ্বাস গ্রহণ করিব ও প্রশ্বাস ত্যাগ করিব’ অভ্যাস করে। (১৪) (ক্ষয় ও অত্যন্ত বিরাগ ভেদে দ্বিবিধ) ‘বিরাগানুদর্শী (রাগমুক্ত) হইয়া শ্বাস গ্রহণ ও প্রশ্বাস ত্যাগ করিব’ অভ্যাস করে। (১৫) ‘নিরোধানুদর্শী (সমুদয় মুক্ত) হইয়া শ্বাস গ্রহণ ও প্রশ্বাস ত্যাগ করিব’ এরূপ অভ্যাস করে। (১৬) (পরিত্যাগ ও প্রধাবন দ্বিবিধ) ‘প্রতিবিসর্জনানুদর্শী (আদানমুক্ত চিত্ত) হইয়া শ্বাস গ্রহণ ও প্রশ্বাস ত্যাগ করিব’ এরূপ অভ্যাস করে।”

“রাহুল! এই ষোল প্রকারে ভাবিত ও বহুলীকৃত আনাপান স্মৃতি (ঐহিক) মহাফলপ্রদ ও (পারত্রিক) অভিলাষিত বিপাকপ্রদ হয়। রাহুল! এই প্রকারে ভাবিত ও বৃদ্ধিকৃত আনাপান স্মৃতিদ্বারা যে সকল অন্তিম শ্বাস গ্রহণ ও প্রশ্বাস ত্যাগ হয়, ইহারাও জ্ঞাতসারেই নিরুদ্ধ হয়- অজ্ঞাতসারে নহে।”

ভগবান ইহা বলিলেন, আয়ুষ্মান রাহুল ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন করিলেন।

॥ মহারাহুলোবাদ সূত্র সমাপ্ত ॥

চূল মালুঙ্ক্য সূত্র (৬৩)

১২২। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-

এক সময় ভগবান শ্রাবস্তীতে অনাথপিণ্ডিকের জেতবন আরামে বাস করিতেছেন। তখন নির্জনে চিন্তামগ্ন (প্রতিসংলীন) অবস্থায় আয়ুষ্মান মালুঙ্ক্যপুত্রের চিত্তে এইরূপ পরিবিতর্ক উদয় হইল,- “ভগবান যে সকল দৃষ্টিগত (মতবাদ) অব্যাকৃত (অব্যাখ্যাত), স্থাপিত ও প্রতিক্ষিপ্ত রাখিয়াছেন, যথা ঃ-

(১)লোক শাশ্বত?

(২)লোক অশাশ্বত?

(৩)লোক অন্তবান?

(৪)লোক অনন্তবান?

(৫)যেই জীব সেই শরীর?

(৬)জীব অন্য শরীর অন্য?

(৭)মৃত্যুর পর তথাগত (সত্ত্ব) থাকে?

(৮)মৃত্যুর পর তথাগত থাকে না?

(৯)মৃত্যুর পর তথাগত থাকে, নাও থাকে? এবং

(১০)মৃত্যুর পর তথাগত থাকেও না- না থাকেও না ।

এই সকল (মতবাদ) ভগবান আমাকে বর্ণনা করেন না। ভগবান আমাকে যাহা বর্ণনা করেন না তাহা আমার রুচিকর নহে, তাহা আমার পছন্দও নহে। সুতরাং আমি ভগবৎ সমীপে উপস্থিত হইয়া এ সম্বন্ধে জিজ্ঞাসা করিব। যদি ভগবান আমাকে বলেন,- (১) ‘লোক শাশ্বত, ...... পূ ...... অথবা (১০) মরণের পর তথাগত থাকেও না, না থাকেও না; তাহা হইলে আমি ভগবানের নিকট ব্রহ্মচর্য আচরণ করিব’। যদি ভগবান তাহা আমাকে না বলেন- (১) ‘...... পূ ...... (১০); তবে আমি শিক্ষা (ভিক্ষুত্ব) প্রত্যাখ্যান করিয়া হীনাবস্থায় (গৃহস্থ আশ্রমে) ফিরিয়া যাইব’।”

১২৩। তখন আয়ুষ্মান মালুঙ্ক্যপুত্র সায়ংকালীন নিভৃত চিন্তা হইতে উঠিয়া ভগবানের নিকট উপস্থিত হইলেন, উপস্থিত হইয়া ভগবানকে অভিবাদন পূর্বক একপ্রান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে বসিয়া আয়ুষ্মান মালুঙ্ক্যপুত্র ভগবানকে ইহা বলিলেন,-

১২৪। “ভন্তে! এখানে ...... পূ ...... আমার চিত্ত এরূপ পরিবিতর্ক উৎপন্ন হইয়াছে,- ‘ভগবান কর্তৃক যে সকল দৃষ্টি (মতবাদ) অব্যাকৃত, স্থাপিত ও পরিত্যক্ত হইয়াছে, ...... পূ ...... তবে আমি শিক্ষা পরিত্যাগ করিয়া হীনাবস্থায় ফিরিয়া যাইব।’ যদি ভগবান জানেন যে (১) ‘লোক শাশ্বত’ তবে ভগবান আমাকে বলুন লোক শাশ্বত’ (২) যদি ভগবান জানেন যে ‘লোক অশাশ্বত’ তবে ভগবান আমাকে বলুন ‘লোক অশাশ্বত’ ...... পূ ...... যদি ভগবান না জানেন যে লোক শাশ্বত কি...... অশাশ্বত, তবে অনভিজ্ঞ ও অদর্শকের (অজ্ঞানীর) পক্ষে ইহাই সোজা উত্তর হয়, তিনি স্পষ্ট বলিয়া দিবেন- ‘উহা আমি জানি না, উহা আমার অজ্ঞাত’।”

“...... পূ ...... যদি ভগবান জানেন (৯) ‘মৃত্যুর পর তথাগত থাকে, নাও থাকে’ তবে ভগবান আমাকে বলুন,- ‘মৃত্যুর পর ...... পূ ......।’ যদি ভগবান জানে (১০) ‘মৃত্যুর পর তথাগত থাকেও না- না থাকেও না’ তবে ভগবান আমাকে বলুন ...... পূ ...... না থাকেও না। যদি ভগবান না জানেন- ‘থাকেও, না থাকেও’ অথবা ‘না থাকেও, না থাকেও না’ তবে অনভিজ্ঞ ও অদর্শকের পক্ষে ইহাই- সোজা উত্তর যে- তিনি স্পষ্ট বলিয়া দিবেন- ‘আমি উহা জানি না, উহা আমার অপরিজ্ঞাত’।”

১২৫। “কেন, মালুঙ্ক্যপুত্র! আমি কি তোমাকে প্রতিশ্রুতি দিয়াছি,- ‘এস মালুঙ্ক্যপুত্র! আমার সাথে ব্রহ্মচর্য আচরণ কর, আমি তোমাকে বর্ণনা করিব যে (১) লোক শাশ্বত ...... পূ ...... (১০) মরণের পর তথাগত থাকে না, না থাকেও না’?”

“একান্তই না, ভন্তে!”

“তুমিও কি আমাকে এরূপ বলিয়াছ?- তবেই আমি ভগবানের নিকট ব্রহ্মচর্য আচরণ করিব, যদি ভগবান আমাকে বলেন যে, (১) লোক শ্বাশ্বত ...... পূ ...... (১০) মরণের পর তথাগত থাকে না, না থাকেও না?”

“না ভন্তে!”

“এই প্রকারে মালুঙ্ক্যপুত্র! আমিও তোমাকে পূর্বে বলি নাই ...... পূ ...... (১০) মরণের পর তথাগত থাকে না, না থাকেও না। তুমিও আমাকে পূর্বে বল নাই, ‘ভন্তে! (১) ...... পূ ...... (১০) ...... পূ ......।’ তাহা হইলে মোঘ (ব্যর্থ) পুরুষ! তুমি কোন্‌ অবস্থায় কাহাকে পুনঃ অভিযোগ করিতেছ?”

১২৬। “মালুঙ্ক্যপুত্র! যে ব্যক্তি এইরূপ বলে,- ‘আমি তাবৎ ভগবানের নিকট ব্রহ্মচর্য আচরণ করিব না যাবৎ ভগবান আমাকে তাহা বর্ণনা না করেন যে (১) লোক শাশ্বত, ...... পূ ...... (১০) না থাকে, না থাকেও না’। মালুঙ্ক্যপুত্র! উহা তথাগতের অব্যাকৃতই থাকিবে। আর ইতিমধ্যে সে ব্যক্তির মৃত্যুও ঘটিতে পারে।”

“যেমন মালুঙ্ক্যপুত্র! কোন ব্যক্তি গাঢ়লিপ্ত বিষযুক্ত শল্য (বানফলা) দ্বারা বিদ্ধ হইল। তাহার মিত্র-সূহৃদ-জ্ঞাতি-সলোহিতগণ কোন বিজ্ঞ শল্যকর্তা ভিষককে উপস্থিত করিল। তখন সেই আহত ব্যক্তি বলে যে- ততক্ষণ পর্যন্ত আমি এই শল্য উৎপাটন করিতে দিব না, যদ্বারা শল্যবিদ্ধ হইয়াছি সে ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, বৈশ্য কিংবা শূদ্র? তাহাকে না জানা পর্যন্ত আমার শল্য উৎপাটন করিতে দিব না। ...... আমি তখন পর্যন্ত এই শল্য উৎপাটন করিতে দিব না, ...... যতক্ষণ না জানি যে- সে পুরুষ অমুক নামের, অমুক গোত্রের? ...... সে পুরুষ দীর্ঘ, হ্রস্ব কিংবা মধ্যম? ...... সে পুরুষ কাল, শ্যাম অথবা মঞ্জুরবর্ণ বিশিষ্ট? ...... সে পুরুষ কোন্‌ গ্রামে, নিগমে, থানায় বা নগরে বাস করে? ...... আমি ততক্ষণ এই শল্য উৎপাটন করিতে দিব না যতক্ষণ পর্যন্ত সেই বেধক ধনু না জানি যে উহা চাপ কিংবা কোদণ্ড? ...... ধনুর গুণ না জানি- উহা কি অর্কের, বল্কলের, সণ্ঠের (বংশ লতার?), ্লায়ুর, মরুবার (লতায়) কিংবা ক্ষীরপর্ণির (লতা বিশেষ)? ...... যে কাণ্ড বা শর দ্বারা বিদ্ধ হইয়াছি, তাহা না জানি যে উহা কচ্ছের (পর্বত গাত্রে বা জলাশয়ের তটে স্বয়ং জাত তুঁদ বৃক্ষের) অথবা রোপিত (কৃষিজাত) তুঁদের? ...... তীর না জানা পর্যন্ত- যাহার পালক দ্বারা নির্মিত- যদি গৃধের (পালক), কঙ্ক, কুলাল, ময়ূর কিংবা শিথিলহনু পক্ষী বিশেষের পালক? ...... যদ্বারা আমি বিদ্ধ হইয়াছি যদি সেই তীর না জানি যে উহা কাহার ্লায়ুদ্বারা পরিক্ষিপ্ত- তাহা কি গাভীর, মহিষের, কৃষ্ণসার-মৃগ বিশেষের অথবা বানরের? ...... পূ ...... যে শল্যে বিদ্ধ হইয়াছি তাহা না জানা পর্যন্ত- উহা কি শল্য ক্ষুরপ্র (ক্ষুরের ন্যায় ধারাল), বেকণ্ডে, নারাচে, বৎস দন্ত (বাচ্চার দাঁতের ন্যায়), অথবা করবী পত্র সদৃশ তীক্ষ্ন?”

“(তাহা হইলে) মালুঙ্ক্যপুত্র! সে ব্যক্তির উহা অজ্ঞাতই থাকিবে। আর ইত্যবসরে তাহার মৃত্যুও ঘটিতে পারে। সেইরূপ মালুঙ্ক্যপুত্র! যে এই কথা বলে,- ‘ততক্ষণ আমি ভগবানের নিকট ব্রহ্মচর্য আচরণ করিব না যতক্ষণ ভগবান আমাকে ব্যাখ্যা না করিবেন যে (১) লোক কি শাশ্বত, কি অশ্বাশ্বত? ...... পূ ...... (১০) তথাগত মৃত্যুর পর না থাকে, না থাকেও না’?”

“মালুঙ্ক্যপুত্র! তাহা তথাগতের অব্যাকৃতই থাকিয়া যাইবে, অথচ ইতিমধ্যে সে ব্যক্তির মৃত্যুও ঘটিতে পারে।”

১২৭। “মালুঙ্ক্যপুত্র! (১-২) ‘লোক শাশ্বত’ এই দৃষ্টি থাকিলে ব্রহ্মচর্য বাস হইবে- ইহা নহে। ‘লোক অশাশ্বত’ এই দৃষ্টি থাকিলেও ব্রহ্মচর্য বাস হইবে- ইহাও নহে। কিন্তু মালুঙ্ক্যপুত্র! ‘লোক শাশ্বত’ এই দৃষ্টি থাকিলে কিংবা ‘লোক অশাশ্বত’ এই দৃষ্টি না থাকিলেও জন্ম আছেই, জরা-মরণ আছেই, শোক-রোদন-দুঃখ-দৌর্মনস্য ও উপায়াস বিদ্যমান থাকিবেই; আমি ইহ-জীবনে যাহাদের বিনাশোপায় প্রজ্ঞাপন করিতেছি ...... পূ ......।”

“মালুঙ্ক্যপুত্র! (৯-১০) ‘মৃত্যুর পর তথাগত থাকিবেও, না থাকিবেও’ এই দৃষ্টি থাকিলে ...... পূ ...... কিংবা ...... পূ ...... ‘না থাকিবে, না থাকিবেও না’- এই দৃষ্টি থাকিলেও জন্ম আছেই, আছে জরা-মরণ-শোক-রোদন দুঃখ-দৌর্মনস্য উপায়াস; ইহ-জন্মেই যাহাদের বিনাশের উপায় আমি ঘোষণা করি। (আমার শিষ্যগণ এই সব বাহ্য বিষয়ে নিমগ্ন না হইয়া এই জীবনেই নির্বান প্রাপ্ত হউক, ইহাই অভিপ্রেত।)”

১২৮। “এই কারণে মালুঙ্ক্যপুত্র! আমার অব্যাকৃতকে অব্যাকৃত হিসাবেই ধারণ কর এবং আমার ব্যাকৃতকে ব্যাকৃত হিসাবেই ধারণ কর।”

“মালুঙ্ক্যপুত্র! আমার অব্যাকৃত কি? (১) ‘লোক শাশ্বত’ ইহা আমার অব্যাকৃত, ...... পূ ...... (১০) ‘না থাকে, না থাকেও না’ ইহা আমার অব্যাকৃত। মালুঙ্ক্যপুত্র! কি কারণে ইহাদিগকে অব্যাকৃত বলিয়াছি? মালুঙ্ক্যপুত্র! ইহা (এই দৃষ্টি ও ইহাদের ব্যাকরণ) অর্থ সংহিত নহে, আদি ব্রহ্মচর্যের (শীল সংযমের) উপকারী নহে, আর ইহা (সংসারাবর্তে) নির্বেদের, বৈরাগ্যের, নিরোধের, ক্লেশ উপশমের, অভিজ্ঞতার, (চারি লোকোত্তর মার্গরূপ) সম্বোধির ও অসংখত নির্বানধাতু সাক্ষাৎকারের নিমিত্ত সংবর্তিত হয় না; এই কারণেই আমি ইহাদিগকে অব্যাকৃত রাখিয়াছি।”

“মালুঙ্ক্যপুত্র! আমার ব্যাকৃত কি? (১) ইহা দুঃখ, ইহাকে আমি ব্যাকৃত করিয়াছি। (২) ইহা দুঃখসমুদয় (দুঃখের কারণ), ইহাকে আমি ব্যাকৃত করিয়াছি। (৩) ইহা দুঃখ নিরোধ ও (৪) ইহা দুঃখ নিরোধগামিণী প্রতিপদা এই চারি আর্যসত্যকে আমি ব্যাকৃত করিয়াছি। মালুঙ্ক্যপুত্র! কেন আমি এই আর্যসত্য ব্যাকৃত করিয়াছি? মালুঙ্ক্যপুত্র! ইহা অর্থ সংহিত, ইহা ব্রহ্মচর্যের আদিভূত নিদান; (আর) ইহা নির্বেদ, বিরাগ ...... পূ ...... নির্বানের নিমিত্ত আবশ্যকীয়। এই কারণে আমি আর্যসত্য সর্বতোভাবে ব্যাকৃত করিয়াছি। তজ্জন্য মালুঙ্ক্যপুত্র! আমার অব্যাকৃতকে অব্যাকৃত হিসাবে ধারণ কর, আর আমার ব্যাকৃতকে ব্যাকৃত হিসাবে ধারণ কর।”

ভগবান ইহা বলিলেন। সন্তুষ্টচিত্তে আয়ুষ্মান মালুঙ্ক্যপুত্র ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন করিলেন।

॥ চূল মালুঙ্ক্য সূত্র সমাপ্ত ॥

মহামালুঙ্ক্য সূত্র (৬৪)

১২৯। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-

এক সময় ভগবান শ্রাবস্তীতে অনাথপিণ্ডিকের জেতবন আরামে বাস করিতেছিলেন, তথায় ভগবান ভিক্ষুদিগকে আহ্বান করিলেন, “ভিক্ষুগণ!”

“ভদন্ত!” বলিয়া সেই ভিক্ষুগণ ভগবানকে প্রত্যুত্তর দিলেন। ভগবান বলিলেন,- “ভিক্ষুগণ! ভগবানকে আমার উপদিষ্ট পঞ্চ অধঃভাগীয় সংযোজনগুলি তোমরা ধারণ কর কি?”

এইরূপ উক্ত হইলে আয়ুষ্মান মালুঙ্ক্যপুত্র ভগবানকে ইহা বলিলেন,- “ভন্তে! ভগবান কর্তৃক উপদিষ্ট পঞ্চ অধঃভাগীয় সংযোজন আমি ধারণ করি।

“মালুঙ্ক্যপুত্র! আমার উপদিষ্ট পঞ্চ অধঃভাগীয় সংযোজন তুমি কি প্রকারে ধারণ কর?”

“ভন্তে! (১) স্বকায়দৃষ্টিকে (নিত্য আত্মবাদকে) ভগবানের উপদিষ্ট অধঃভাগীয় সংযোজনরূপে আমি ধারণ করি। (২) বিচিকিৎসাকে (সংশয়কে) ...... পূ ......। (৩) শীলব্রত পরামর্শকে (শীল ও ব্রতকে দৃঢ়রূপে গ্রহণকে) ...... পূ ......। (৪) কামচ্ছন্দকে (ভোগানুরাগকে) ...... পূ ......। (৫) ব্যাপাদকে (বিদ্বেষকে) ...... পূ ......।”

“মালুঙ্ক্যপুত্র! এই প্রকার পঞ্চ অধঃভাগীয় সংযোজন আমি কাহাকে উপদেশ দিতে তুমি শুনিয়াছ? মালুঙ্ক্যপুত্র! অন্য মতাবলম্বী (অঞ্‌ঞতিত্থিযা) পরিব্রাজকগণ এই তরুণোপমায় উপহাস (উপারম্ভ) করিবে, নহে কি? মালুঙ্ক্যপুত্র! উত্থানশায়ী অবোধ অল্পবয়স্ক শিশুর ‘ইহা স্বকায় (আত্মবাদ)’ এই ধারণাই জন্মে না, তবে কোথা হইতে তাহার স্বকায়দৃষ্টি উৎপন্ন হইবে? (অবশ্য অপ্রহীণ হেতু)) স্বকায়দৃষ্টি উহার (চিত্ত সন্ততিতে) অনুশায়িত বা সুপ্ত থাকে। ...... পূ ......। অল্পবয়স্ক শিশুর ‘ইহা ধর্ম (মানস বিচার্য বিষয়)’ এই ধারণা জন্মে না। কোথা হইতে তাহার ধর্ম সম্বন্ধে সংশয় উৎপন্ন হইবে? (অবশ্য) সংশয়ানুশয় উহার মনে অনুশায়িত থাকে। ...... পূ ...... অল্পবয়স্ক শিশুর ‘ইহা শীল (সদাচার)’ এই ধারণা জন্মে না। কোথা হইতে উহার শীলে শীলব্রত পরামর্শ হইবে? শীলব্রত পরামর্শ অনুশয়রূপে থাকিয়াই থাকে ...... পূ ......। ...... পূ ...... অল্পবয়স্ক শিশুর ‘ইহা কাম’ এ ধারণা জন্মে না, কোথা হইতে তাহার কাম্য বস্তুর প্রতি কামচ্ছন্দ উৎপন্ন হইবে? ...... পূ ...... (অবশ্য) কামচ্ছন্দ অনুশয়ও থাকিয়াই যায়..... পূ .....। ...... পূ ...... অবোধ শিশুর ‘সত্ব (প্রাণী)’ ধারণাও জন্মে না, কোথা হইতে তাহার ব্যাপাদ (সত্ব পীড়নেচ্ছা) উৎপন্ন হইবে? (অবশ্য) ব্যাপাদ উহার চিত্তমধ্যে সুপ্ত অবস্থায় থাকিয়া যায়, (পরে প্রত্যয় পাইলে ইহারা জাগ্রত হয়)। মালুঙ্ক্যপুত্র! অন্য মতাবলম্বী পরিব্রাজকগণ এই বালকোপমায় উপহাস করিবে, নহে কি?”

এইরূপ উক্ত হইলে আয়ুষ্মান আনন্দ ভগবানকে বলিলেন,- “ভগবন! ইহার কাল হইয়াছে, সুগত! ইহার সময় হইয়াছে যে ভগবান পাঁচ অধঃভাগীয় সংযোজন সম্বন্ধে উপদেশ করুন। ভগবানের নিকট শুনিয়া ভিক্ষুগণ ধারণ করিবেন।”

“তাহা হইলে শুন আনন্দ! উত্তমরূপে মনে রাখ, আমি ভাষণ করিতেছি।”

“হাঁ, ভন্তে!” (বলিয়া) আয়ুষ্মান আনন্দ ভগবানকে উত্তর দিলেন। ভগবান ইহা বলিলেন,-

১৩০। “এখানে আনন্দ! জ্ঞাননেত্রে আর্যগণের অদর্শনকারী স্মৃত্যুপস্থানাদি আর্যধর্মে অনভিজ্ঞ, আর্যধর্মে অবিনীত, যাহারা সৎপুরুষগণের অদর্শনকারী, সৎপুরুষধর্মে অনভিজ্ঞ, সৎপুরুষধর্মে অবিনীত, অশ্রুতবান, পৃথকজন (প্রাকৃতজন) স্বকায়দৃষ্টি অভিভূত, স্বকায়দৃষ্টি পরিব্যাপ্ত চিত্তে অবস্থান করে এবং সে উৎপন্ন স্বকায়দৃষ্টি পরিব্যাপ্ত চিত্তে অবস্থান করে এবং সে উৎপন্ন স্বকায়দৃষ্টি হইতে নিঃসরণের উপায় যথাভূত জানে না, তাহার সেই অনপসারিত, দৃঢ়তা প্রাপ্ত স্বকায়দৃষ্টিই অধঃভাগীয় সংযোজন। সে বিচিকিৎসাভিভূত, বিচিকিৎসা পরিবৃত চিত্তে বাসকরে এবং সে উৎপন্ন বিচিকিৎসা হইতে নিঃসরণ উপায় যথাভূত জানে না, তাহার সেই অনপসারিত দৃঢ়তা প্রাপ্ত বিচিকিৎসাই অধঃভাগীয় সংযোজন। (শীলব্রত পরামর্শ, কামরাগ ও ব্যাপাদ বারেও উক্তরূপে বিস্তার করিবে)।”

১৩১। “অপর পক্ষে আনন্দ! জ্ঞাননেত্রে আর্যদের দর্শনকারী স্মৃত্যুপস্থানাদি আর্যধর্মে অভিজ্ঞ, আর্যধর্মে সুবিনীত (সুশিক্ষিত); সৎপুরুষদের দর্শনকারী, সৎপুরুষধর্মে অভিজ্ঞ, সৎপুরুষধর্মে সুদক্ষ, সৎপুরুষধর্মে সুবিনীত, শ্রুতবান আর্যশ্রাবক স্বকায়দৃষ্টি অভিভূত ও স্বকায়দৃষ্টি পরিবৃত চিত্ত না হইয়া অবস্থান করেন। তিনি উৎপন্ন স্বকায়দৃষ্টি হইতে নিঃসরণ যথাভূত জানেন; (সে কারণে) তাঁহার অনুশয় শক্তি সমন্বিত স্বকায়দৃষ্টি সংযোজন প্রহীণ হইবে। (বিচিকিৎসা শীলব্রত পরামর্শ, কামচ্ছন্দ ও ব্যাপাদ সম্বন্ধেও এরূপ)।”

১৩২। “আনন্দ! পঞ্চবিধ অধঃভাগীয় সংযোজন প্রহাণের নিমিত্ত যেই মার্গ ও যেই প্রতিপদা বিদ্যমান সেই মার্গ ও সেই প্রতিপদা অবলম্বন ব্যতীত পঞ্চবিধ অধঃভাগীয় সংযোজনকে জানিবে, বিচার করিবে ও পরিত্যাগ করিবে; ইহা কখনও সম্ভব নহে। যেমন আনন্দ! স্থির সারবান মহাবৃক্ষের ত্বক ছেদন না করিয়া, বাকল ছেদন না করিয়া, সারচ্ছেদ করিতে সমর্থ হইবে, ইহার কোন হেতু নাই। সেইরূপ আনন্দ! পঞ্চবিধ অধঃভাগীয় সংযোজন প্রহাণের নিমিত্ত যেই মার্গ, যেই প্রতিপদা বিদ্যমান তাহা অবলম্বন না করিয়া পঞ্চবিধ অধঃভাগীয় সংযোজন জানিবে, বিচার করিবে বা পরিহার করিবে; ইহার কোন হেতু বিদ্যমান নাই।”

“অপর পক্ষে আনন্দ! যেই মার্গ ও যেই প্রতিপদা পঞ্চবিধ অধঃভাগীয় সংযোজন প্রহাণের নিমিত্ত বিদ্যমান সে মার্গ ও সেই প্রতিপদা অবলম্বন করিয়াই পঞ্চবিধ অধঃভাগীয় সংযোজন জানিবে, বিচার করিবে, পরিহার করিবে; ইহার হেতু বিদ্যমান আছে। যেমন আনন্দ! দণ্ডায়মান সারবান মহাবৃক্ষের ত্বক ও বাকল ছেদন করিয়া সারচ্ছেদ সম্ভব, ইহার হেতু বিদ্যমান।”

“সেইরূপ আনন্দ! ...... পূ ......। যেমন আনন্দ! গঙ্গানদী কানায় কানায় জলপূর্ণ কাকপেয়্য (তীরে বসিয়া কাকের পানের যোগ্য) হয়, তখন কোন দুর্বল পুরুষ (ইহা বলিতে) আসে,- আমি সেই গঙ্গানদীর প্রবাহকে বাহুদ্বারা তির্যকভাবে (কাটিয়া) স্বস্তিতে পরপারে যাইব।’ সে গঙ্গানদীর প্রবাহকে বহুদ্বারা তির্যক কাটিয়া স্বস্তিতে...... পরপারে যাইতে সমর্থ হইবে না। সেইরূপই আনন্দ! স্বকায় নিরোধের জন্য ধর্ম-উপদেশ করিবার সময় যাহার চিত্ত উৎসাহিত হয় না, প্রসন্ন হয় না, স্থির হয় না, বিমুক্ত হয় না, তাহাকে দুর্বল পুরুষের ন্যায় জানা উচিত। যেমন আনন্দ! গঙ্গানদী তীরসম জলপূর্ণ ও কাকপেয়্য হয়, তখন কোন বলবান পুরুষ (এই বলিতে) আসে- ‘আমি এই গঙ্গানদীর স্রোত বাহুদ্বারা তির্যক কাটিয়া স্বস্তিতে পরপারে গমন করিব।’ সে গঙ্গানদীর স্রোত বাহুদ্বারা তির্যক কাটিয়া স্বস্তির সহিত পরপারে যাইতে সমর্থ হইবে। সেইরূপ আনন্দ! কাহাকেও স্বকায়দৃষ্টি নিরোধের নিমিত্ত ধর্ম-উপদেশ করিবার সময় যাহার চিত্ত উৎসাহিত হয়, প্রসন্ন হয়, স্থির হয়, বিমুক্ত হয়, ...... পূ ...... তাহাকে বলবান পুরুষের ন্যায় বিবেচনা করিবে।”

১৩৩। “আনন্দ! পঞ্চ অধঃভাগীয় সংযোজন প্রহাণের নিমিত্ত মার্গ কি? প্রতিপদা কি? এখানে আনন্দ! ভিক্ষু উপাধিবিবেক বা পঞ্চ কামগুণে আসক্তি ত্যাগ দ্বারা, অকুশল নীবরণধর্ম প্রহাণ দ্বারা সর্বতোভাবে তন্দ্রালস্য প্রভৃতি কায়িক দৌর্বল্য প্রশান্ত করিয়া, কাম হইতে পৃথক এবং অকুশল ধর্ম হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া সবিতর্ক সবিচার বিবেকজাত প্রীতি-সুখ সমন্বিত প্রথম ধ্যান প্রাপ্ত হইয়া অবস্থান করেন। তথায় সমাপত্তিক্ষণে তিনি যে সকল রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞানস্কন্ধ জাতীয় ধর্ম (পদার্থ) আছে, তিনি সেই সকল ধর্মকে অনিত্য; দুঃখ, রোগ, গণ্ড, শল্য, অঘময়, আবাধ; পরস্ব, বিনাসশীল, শূন্য ও অনাত্মা হিসাবে (অনিত্য-দুঃখ-অনাত্ম এই ত্রিলক্ষণ আরোপ করিয়া) সম্যকরূপে দর্শন করেন। তিনি এবম্বিধ লক্ষণযুক্ত স্কন্ধ ধর্মসমূহ হইতে (বিষ্কম্ভন ভাবে) অপসারিত করেন। তিনি সেই ধর্মসমূহ হইতে চিত্তকে অপনীত করিয়া সর্বসংস্কারের সাম্যাবস্থা, সর্বোপাধি বর্জিত, তৃষ্ণাক্ষয়, বিরাগ ও নিরোধ স্বরূপ যে নির্বান আছে- ইহা শান্ত, ইহা উত্তম- বিদর্শন জ্ঞানে বুঝিয়া চিত্তকে সেই অমৃতধাতুর অভিমুখী করেন তিনি সেই বিদর্শনে স্থিত হইয়া (চতুর্বিধ মার্গানুক্রমে) আস্রব সমূহের ক্ষয় সাধন করেন। যদি তিনি আস্রব সমূহের সম্পূর্ণ ক্ষয় সাধন করিতে না পারেন, তবে সেই শমথ-বিদর্শন ধর্ম্মানুরক্তি ও সেই ধর্মানন্দ দ্বারা পঞ্চবিধ অধঃভাগীয় সংযোজন সম্পূর্ণ ক্ষয় করিয়া তিনি ঔপপাতিক (অযোনি সম্ভব) হন। তিনি তথায় শুদ্ধাবাস ব্রহ্মলোকে পরিনির্বান লাভ করেন, সেই লোক হইতে তাঁহাকে আর পুনরাবর্তন করিতে হয় না। আনন্দ! ইহাই মার্গ আর ইহাই পন্থা, পঞ্চবিধ অধঃভাগীয় সংযোজনের প্রহাণের নিমিত্ত।”

“পুনরায় আনন্দ! ভিক্ষু ...... পূ ......।” (দ্বিতীয় ধ্যান, তৃতীয় ধ্যান ও চতুর্থ ধ্যান সম্বন্ধেও তদ্রূপ বিস্তার করিতে হইবে।)

“পুনরায় আনন্দ! ভিক্ষু সর্বতোভাবে রূপসংজ্ঞা অতিক্রম ও প্রতিঘসংজ্ঞা অস্তগমন দ্বারা, নানাত্ব সংজ্ঞার অমনোনিবেশ হেতু অনন্ত আকাশরূপে আকাশানন্তায়তন ধ্যান লাভ করিয়া অবস্থান করেন। তদবস্থায় যে বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞানস্কন্ধ ধর্ম উৎপন্ন হয় ...... পূ ......।” (বিজ্ঞানানন্তায়তন, আকিঞ্চনায়তন ও নৈবসংজ্ঞানাসংজ্ঞায়তন ধ্যান সম্বন্ধেও তদ্রূপ বিস্তার করিতে হইবে।)

“ভন্তে! যদি পঞ্চবিধ অধঃভাগীয় সংযোজন প্রহাণের নিমিত্ত ইহাই মার্গ- ইহাই পন্থা হয়, তবে কেন ইহাতে কোন কোন ভিক্ষু চিত্তবিমুক্ত এবং কোন কোন ভিক্ষু প্রজ্ঞাবিমুক্ত হন?”

আনন্দ! আমি তাঁহাদের ইন্দ্রিয় নানাত্বই ইহার কারণ বলিয়া বলি।

ভগবান ইহা বলিলেন। আয়ুষ্মান আনন্দ ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন করিলেন।

॥ মহামালুঙ্ক্যপুত্র সূত্র সমাপ্ত ॥

ভদ্দালি সূত্র (৬৫)

১৩৪। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-

এক সময় ভগবান শ্রাবস্তীতে অনাথপিণ্ডিকের জেতবন আরামে বাস করিতেছিলেন। তথায় ভগবান ভিক্ষুদিগকে আহ্বান করিলেন,- “ভিক্ষুগণ!”

“ভদন্ত!” (বলিয়া) সেই ভিক্ষুগণ ভগবানকে প্রত্যুত্তর দিলেন।

“ভগবান বলিলেন,- “ভিক্ষুগণ! আমি একাসন-ভোজন আহার করি। ভিক্ষুগণ! আমি একাসন-ভোজন গ্রহণ করিয়া নিরোগতা, নিরাতঙ্ক, শরীরের লঘুভাব, বল ও সুখবিহার অনুভব করি। এস, ভিক্ষুগণ! তোমরাও একাসন-ভোজন আহার কর। একাসন-ভোজন আহার করিয়া তোমরাও নিরোগতা, নিরাতঙ্ক, শরীরের লঘুভাব ..... পূ ...... সুখবিহার অনুভব কর।”

এইরূপ বলিলে আয়ুষ্মান ভদ্দালি ভগবানকে কহিলেন,- “ভন্তে! আমি একাসন-ভোজন আহার করিতে উৎসাহ বোধ করি না। কারণ একাসন-ভোজন আহার করিলে আমার সংশয় ও বিপ্রতিসার হইতে পারে।”

“তাহা হইলে ভদ্দালি! তুমি যেখানে নিমন্ত্রিত হও তথায় (খাদ্যের) একাংশ ভোজন করিয়া অপরাংশ নিয়া আসিয়া দ্বিতীয়বার ভোজন করিতে পার। এই প্রকারে ভোজন করিয়াও ভদ্দালি! তুমি জীবন যাপন করিতে পারিবে।”

“ভন্তে! এই প্রকারেও আমার সংশয় ও বিপ্রতিসার জন্মিতে পারে।”

তখন ভগবান শিক্ষাপদ প্রজ্ঞাপিত করিলেন, ভিক্ষুসংঘ সেই শিক্ষাপদ গ্রহণ ও পালন করিলেও আয়ুষ্মান ভদ্দালি তৎপ্রতি উৎসাহ বোধ করিলেন না। তখন আয়ুষ্মান ভদ্দালি সেই সারা তিনমাস লজ্জাবশতঃ ভগবানকে প্রত্যক্ষ দর্শন দিলেন না। কেননা, তিনি গুরুর উপদেশ ও শিক্ষার পরিপূর্ণ পালনকারী ছিলেন না।

১৩৫। সেই সময় বহুভিক্ষু ভগবানের চীবর (সেলাই) কার্য করিতেছিলেন। কারণ চীবর প্রস্তুত হইলে- তিনমাস পর ভগবান ধর্ম প্রচারার্থ পর্যটনে বাহির হইবেন। তখন আয়ুষ্মান ভদ্দালি সেই ভিক্ষুদের নিকট উপস্থিত হইলেন, উপস্থিত হইয়া সেই ভিক্ষুদের সহিত প্রীতি-সংলাপ করিলেন। সম্মোদজনক ও স্মরণীয় কথা শেষ করিয়া একপ্রান্তে বসিলেন। একান্তে উপবিষ্ট আয়ুষ্মান ভদ্দালিকে সেই ভিক্ষুগণ বলিলেন,- “আবুসো ভদ্দালি! এখন ভগবানের চীবর প্রস্তুত করা হইতেছে। চীবর প্রস্তুত হইলে- তিনমাস পর ভগবান পর্যটনে বাহির হইবেন। ভাল, বন্ধু ভদ্দালি! এই আপত্তি (অপরাধ) সম্বন্ধে আপনি উত্তমরূপে অবহিত হউন, অবশেষে উহা আরও দুষ্করতর বা প্রতিকারের অযোগ্য না হউক।”

“হাঁ, বন্ধুগণ!” (বলিয়া) ভিক্ষুদের কাছে প্রতিশ্রুত হইয়া আয়ুষ্মান ভদ্দালি ভগবানের নিকট উপস্থিত হইলেন, উপস্থিত হইয়া ভগবানকে অভিবাদন পূর্বক একান্তে বসিলেন। একপ্রান্তে উপবিষ্ট আয়ুষ্মান ভদ্দালি ভগবানকে বলিলেন,- “ভন্তে! বাল, মূঢ় ও অনভিজ্ঞ জনোচিত আমার অপরাধ সীমা লঙ্ঘন করিয়াছে, যেহেতু ভগবান কর্তৃক শিক্ষাপদ প্রজ্ঞাপিত হইলে এবং ভিক্ষুসংঘ সেই শিক্ষাপদ পালন করিলেও আমি তাহাতে নিরুৎসাহ প্রকাশ করিয়াছি। ভন্তে, ভগবন! ভবিষ্যতে সংবরের জন্য আমার সে অপরাধ ক্ষমা করুন।”

“একান্তই ভদ্দালি! বাল, মূঢ় ও অনভিজ্ঞের ন্যায় তোমার অপরাধ হইয়াছে যে আমাকর্তৃক শিক্ষাপদ প্রজ্ঞাপিত হইলেও এবং ভিক্ষুসংঘ সেই শিক্ষাপদ গ্রহণ করিলেও তুমি তাহাতে নিরুৎসাহ প্রকাশ করিয়াছ। ভদ্দালি! তখন তোমার সুযোগ (সময়) অবিদিত ছিল যে ভগবান শ্রাবস্তীতে বাস করিতেছেন। সুতরাং ভগবানও আমাকে জানিবেন,- ‘ভদ্দালি নামক ভিক্ষু শাস্তার উপদেশে শিক্ষার পরিপূরণকারী নহে।’ এই কারণও ভদ্দালি! তখন তুমি বুঝিতে পার নাই। ভদ্দালি! তোমার এই কারণও অজ্ঞাত ছিল যে বহু ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী শ্রাবস্তীতে বর্ষাবাস করিতেছেন, তাঁহারাও আমাকে জানিবেন,- ‘ভদ্দালি নামক ভিক্ষু শাস্তার শাসনে শিক্ষার পরিপূরণকারী নহে’। এই কারণও ভদ্দালি! তোমার অজ্ঞাত ছিল। ভদ্দালি! এই কারণও তোমার প্রতিভাত হইল না যে বহু উপাসক-উপাসিকা শ্রাবস্তীতে বাস করেন, তাঁহারাও আমাকে জানিবেন,- ‘ভদ্দালি নামক ভিক্ষু শাস্তার উপদেশ পালনকারী নহেন’। ...... পূ ......। ভদ্দালি! এই কারণও তোমার অজ্ঞাত ছিল যে নানা মতাবলম্বী বহু শ্রমণ-ব্রাহ্মণ এই শ্রাবস্তীতে বর্ষাবাস করিতেছেন, তাঁহারাও আমাকে জানিবেন,- শ্রমণ গৌতমের শ্রাবক, থেরদের (বৃদ্ধদের) অন্যতর ভদ্দালি নামক ভিক্ষু শাস্তার উপদেশ শিক্ষায় পরিপূর্ণকারী নহেন’। এই কারণও ভদ্দালি! তখন তুমি বুঝিতে পার নাই।”

“ভন্তে! ...... পূ ...... অজ্ঞজনোচিত আমার অপরাধ ভবিষ্যত সংবরের জন্য ক্ষমা করুন।”

১৩৬। “তাহা কি মনে কর, ভদ্দালি! এখানে কোন ভিক্ষু উভতো-ভাগ বিমুক্ত (অর্হত) ও হয়, তাহাকে আমি বলি যে,- ‘এস, ভিক্ষু! তুমি পঙ্কে সংক্রম (সেতু) হও।’ সে সেতু না হইতে বা অন্যদিকে শরীর বঙ্ক করিতে কিংবা ‘না’ বলিতে পারিবে কি?”

“কখনই না, ভন্তে!”

“তবে কি মনে কর, ভদ্দালি! এখানে কোন ভিক্ষু প্রজ্ঞাবিমুক্তি ...... পূ ......। কায়স্বাক্ষী ...... পূ ...... , দৃষ্টিপ্রাপ্ত ...... পূ ......। শ্রদ্ধাবিমুক্ত ...... পূ ......, ধর্মানুসারী ...... পূ ......, শ্রদ্ধানুসারী ...... পূ ...... হয়; সে ‘না’ বলিতে পারে কি?”

“না, ভন্তে!”

“তাহা কি মনে কর, ভদ্দালি! সেই সময় তুমি উভতো-ভাগ বিমুক্তি প্রজ্ঞাবিমুক্ত ...... পূ ...... , অথবা শ্রদ্ধানুসারী ছিলে কি?”

“না, ভন্তে! তাহা ছিলাম না।”

“ভদ্দালি! সেই সময় তুমি রিক্ত, তুচ্ছ। সুতরাং অপরাধী নহে কি?”

“হাঁ, ভন্তে! ...... পূ ...... ভবিষ্যত সংবরের নিমিত্ত আমার অপরাধ ক্ষমা করুন।”

“ভাল কথা, ভদ্দালি! ...... পূ ...... যেহেতু তুমি অপরাধকে অপরাধ হিসাবে দেখিয়া ধর্মানুসারে প্রতিকার করিতেছ। সে কারণে আমরা তোমাকে ক্ষমা করিলাম। ভদ্দালি! যিনি (স্বীয়) অপরাধকে অপরাধ হিসাবে দেখিয়া যথাধর্ম প্রতিকার করেন, ভবিষ্যতে সংযম অবলম্বন করেন; আর্যবিনয়ে ইহাই তাঁহার পক্ষে অভিবৃদ্ধি।”

১৩৭। “ভদ্দালি! এখানে কোন ভিক্ষু শাস্তার শাসনে শিক্ষার পরিপূর্ণকারী নহে, তাহার এই চিন্তা হয়,- ‘বেশ! আমি নির্জন শয্যাসন আশ্রয় করি- অরণ্য, বৃক্ষমূল, পর্বত, কন্দর, গিরিগুহা, শ্মশান, বনপন্থ, খোলাস্থান কিংবা পলাল (তৃণ) পুঞ্জ; নিশ্চয় আমি মনুষ্যোত্তর ধর্ম, উত্তম আর্য-জ্ঞানদর্শন (লোকোত্তর মার্গ) বিশেষ প্রত্যক্ষ করিব।’ সে নির্জন শয্যাসন আশ্রয় করে- অরণ্য ...... পূ ......। তথা পৃথক অবস্থানকারীকে শাস্তাও নিন্দা করেন, বিজ্ঞ সব্রহ্মচারীগণও বিচার করিয়া নিন্দা করেন, দেবতারাও অপবাদ করেন, সে নিজেও নিজকে ধিক্কার দেয়। সে শাস্তা, বিজ্ঞ-সব্রহ্মচারী, দেবতা ও নিজদ্বারা নিন্দিত ও ধিকৃত হইয়া মনুষ্যধর্ম উত্তরিতর (মানব স্বভাবের উপরে) উত্তম আর্য-জ্ঞানদর্শন বিশেষ প্রত্যক্ষ করিতে পারে না। ইহার কারণ কি? ভদ্দালি! শাস্তার শাসনে শিক্ষার পরিপূর্ণ পালনকারী না হইলে তাহার পক্ষে এইরূপই হইয়া থাকে।”
১৩৮। “কিন্তু ভদ্দালি! কোন ভিক্ষু শাস্তার উপদেশে শিক্ষার পূর্ণ পালনকারী হন, তাঁহার এই চিন্তা হয়,- ‘ভাল, আমি নির্জন শয্যাসন আশ্রয় গ্রহণ করিব ...... পূ ......। এই নির্জন শয্যাসন সেবনকারীকে শাস্তাও অপবাদ করেন না, ...... পূ ...... উত্তম আর্য-জ্ঞানদর্শন বিশেষ তিনি প্রত্যক্ষ করেন। তিনি কাম হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া, অকুশল ধর্ম হইতে পৃথক হইয়া সবিতর্ক-সবিচার বিবেকজ প্রীতি-সুখ সমন্বিত প্রথম ধ্যান লাভ করিয়া বাস করেন। ইহার কারণ কি? ভদ্দালি! যিনি শাস্তার উপদেশে শিক্ষার পূর্ণরূপে পালনকারী হন, তাঁহার এইরূপ হইয়াই থাকে।”

১৩৯। “পুনঃ ভদ্দালি! সে ভিক্ষু বিতর্ক-বিচারের উপশম করিয়া দ্বিতীয় ধ্যান লাভ করেন। পুনঃ ভদ্দালি! সে ভিক্ষু প্রীতির বিরাগ হেতু উপেক্ষক হইয়া বাস করেন, আর স্মৃতিমান ও সংপ্রজ্ঞাত হইয়া মানসিক সুখানুভব করেন, যাহাকে আর্যগণ উপেক্ষক, স্মৃতিমান, সুখবিহারী বলেন সেই তৃতীয় ধ্যান লাভ করিয়া বাস করেন।”

“পুনরায় ভদ্দালি! সে ভিক্ষু সুখ-দুঃখের প্রহাণ হেতু পূর্বেই সৌমনস্য ও দৌর্মনস্যের অস্তগমন হেতু সুখ-দুঃখাতীত উপেক্ষা স্মৃতি- পরিশুদ্ধি নামক চতুর্থধ্যান প্রাপ্ত হইয়া অবস্থান করেন। ...... পূ ......।”

“তিনি এইরূপে সমাহিত চিত্তে পূর্বনিবাস অনুস্মরণ করেন। তিনি এইরূপে সমাহিত চিত্তে দিব্যচক্ষু দ্বারা সত্বগণের চ্যুতি-উৎপত্তি দর্শন করেন। তিনি এইরূপে সমাহিত চিত্তে আস্রব সমূহের ক্ষয়ের নিমিত্ত চিত্ত, অভিনমিত করেন। ...... পূ ......। এখন ইহার নিমিত্ত কিছু অবশিষ্ট নাই, জানিতে পারেন। তাহার কারণ কি? ভদ্দালি! শাস্তার শাসনে শিক্ষার পূর্ণ পালনকারী এই প্রকারই হইয়া থাকে।”

১৪০। ইহা উক্ত হইলে আয়ুষ্মান ভদ্দালি ভগবানকে বলিলেন,- “ভন্তে! ইহার হেতু কি? প্রত্যয় কি? যাহাতে এখানে কোন কোন ভিক্ষুকে বার বার নিগ্রহ করিয়া শিক্ষা দিতে হয়? আবার, ভন্তে! কি হেতু? কি প্রত্যয়? যদ্বারা এখানে কোন কোন ভিক্ষুকে তদ্রূপ বার বার নিগ্রহ করিয়া শিক্ষা দিতে হয় না?”

“ভদ্দালি! এখানে কোন কোন ভিক্ষু নিরন্তর আপত্তি (অপরাধ) করে এবং আপত্তি বহুল হয়। সে ভিক্ষুদের দ্বারা উপদিষ্ট হইলে এক কথা দ্বারা অন্য কথা চাপা দেয়; আলোচ্য বিষয়কে প্রসঙ্গের বাহিরে অপসারিত করে, কোপ, দ্বেষ ও অপ্রত্যয় (অবিশ্বাস) প্রকট করে, (বুদ্ধ উপদেশ) ঠিকভাবে পালন করে না, অনুলোম ব্রত আচরণ করে না, অপরাধ হইতে নিস্তার বা মুক্তি চায় না, যাহাতে সংঘ সন্তুষ্ট হয় ‘তাহা আমি করি’ ইহা বলে না। ইহাতে, ভদ্দালি! ভিক্ষুদের এই চিন্তা হয়,- ‘আবুসো! এই ভিক্ষু নিরন্তর আপত্তিকারী ও আপত্তি বহুল হয়। সে ভিক্ষুদের দ্বারা উপদিষ্ট হইলে ...... পূ ...... ‘তাহা আমি করি’ বলে না। সাধু, বন্ধুগণ! এই ভিক্ষুকে সেইভাবেই উপপরীক্ষা (বিচার) করুন, যেন তাহার এই অধিকরণ শীঘ্র উপশম না হয়।’ ভদ্দালি! ভিক্ষুগণ তদ্রূপই উপপরীক্ষা করেন ও দীর্ঘসূত্রী হন, যাহাতে তাহার এই অধিকরণ সত্বর উপশম না হয়।”

১৪১। “এখানে ভদ্দালি! কোন ভিক্ষু নিরন্তর আপত্তি করে ও আপত্তি বহুল হয়। (কিন্তু) সে ভিক্ষুদের দ্বারা কথিত হইলে কথায় কথা চাপা দেয় না। ...... পূ ......। যাহাতে সংঘ সন্তুষ্ট হয় ‘আমি তাহা করিব’ বলিয়া থাকে। ...... পূ ......। ভদ্দালি! ভিক্ষুগণ তদ্রূপ উপপরীক্ষা করে, যাহাতে তাহার অধিকরণ সত্বর উপশম হয়।”

১৪২। “ভদ্দালি! কোন ভিক্ষু কদাচিৎ আপত্তি করে, আপত্তি বহুল হয় না। ভিক্ষুদের দ্বারা কথিত হইলে সে অন্যথা ভাষণ করে। ...... পূ ......। তাহার এই অধিকরণ সত্বর উপশম হয় না।”

১৪৩। “ভদ্দালি! এখানে কোন ভিক্ষু কদাচিৎ আপত্তি করে, অনাপত্তি বহুল হয়। সে ভিক্ষুদ্বারা কথিত হইলে অন্যথা আচরণ করে না, বহির্দিকে কথা অপসারিত করে না, কোপ, দ্বেষ ও অপ্রত্যয় প্রকাশ করে না। ...... পূ ......। তাহার সে অধিকরণ সত্বর মীমাংসা হয়।”

১৪৪। “ভদ্দালি! এখানে কোন ভিক্ষু আচার্য ও উপাধ্যায়ের প্রতি কেবল শ্রদ্ধা ও প্রেম বশতঃ যাপন করে। এই ক্ষেত্রে ভিক্ষুদের এ ধারণা জন্মে- বন্ধুগণ! এই ভিক্ষু সামান্য শ্রদ্ধা ও প্রেমবশে যাপন করে। যদি আমরা এই ভিক্ষুকে বার বার নিগ্রহ করিয়া শিক্ষাদান করি তবে তাহার যেই শ্রদ্ধা ও প্রেমমাত্র আছে তাহা হইতে সে পরিহীণ হইতেও পারে, তাহা না হউক।’ যেমন ভদ্দালি! কোন পুরুষের এক চক্ষুমাত্র আছে, তাহার মিত্র-অমাত্য ও জ্ঞাতি-স্বলোহিতগণ তাহার একমাত্র চক্ষুকে রক্ষা করে- ‘যেই একমাত্র চক্ষু আছে, তাহার সেই চক্ষু বিনষ্ট না হউক।’ সেইরূপ ভদ্দালি! কোন ভিক্ষু শ্রদ্ধা ও প্রেমমাত্রে যাপন করে। ...... পূ ......। উহাও তাহার কোন প্রকারে নষ্ট না হউক।”

“ভদ্দালি! ইহাই হেতু, ইহাই প্রত্যয় যাহাতে কোন কোন ভিক্ষুকে বার বার নিগ্রহ করিয়া কারণ দেখাইতে হয়। আর ভদ্দালি! ইহাও হেতু, ইহাও প্রত্যয় যাহাতে কোন কোন ভিক্ষুকে বার বার নিগ্রহ করিয়া কারণ প্রদর্শন করিতে হয় না।”

১৪৫। “ভন্তে! ইহার হেতু ও প্রত্যয় কি যে পূর্বে শিক্ষাপদ সমূহ স্বল্পসংখ্যক ছিল, অথচ বহুসংখ্যক ভিক্ষু অর্হত্বে (অঞ্‌ঞায়) প্রতিষ্ঠিত ছিলেন? ভন্তে! ইহারই বা হেতু ও প্রত্যয় কি? বর্তমানে বহুসংখ্যক শিক্ষাপদ, তথাপি স্বল্পসংখ্যক ভিক্ষু অর্হত্বে প্রতিষ্ঠিত হইতেছেন?”
“ভদ্দালি! এইরূপই হইয়া থাকে, যখন সত্বগণ প্রতিপত্তি (আচার) হীন হয়, তখন প্রতিবেধ মূলক সদ্ধর্মেরও অন্তর্ধান ঘটে। এমতাবস্থায় শিক্ষাপদ বহুসংখ্যক হইলেও স্বল্পসংখ্যক ভিক্ষু অর্হত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। ভদ্দালি! শাস্তা (গুরু) ততক্ষণ পর্যন্ত শ্রাবকগণের নিমিত্ত শিক্ষাপদ প্রজ্ঞাপ্ত (বিধান) করেন না যতক্ষণ এখানে সংঘের মধ্যে কোন আস্রবস্থানীয় ধর্ম প্রাদুর্ভূত না হয়। যে সময় হইতে ভদ্দালি! সংঘে আস্রবস্থানীয় আচার প্রকটিত হয়, তখন সেই আস্রবস্থানীয় ধর্মের নিবারণার্থ শাস্তা শ্রাবকদের জন্য শিক্ষাপদ প্রজ্ঞাপ্ত করেন।”

“ভদ্দালি! ততদিন পর্যন্ত কোন আস্রবস্থানীয় ধর্ম সংঘমধ্যে প্রকটিত হয় না যতদিন সংঘ মহত্ব (সংখ্যাধিক্য) প্রাপ্ত হয় না। যখন সংঘ মহত্ব প্রাপ্ত হয়, তখন সংঘে আস্রবস্থানীয় ধর্ম উৎপন্ন হয়। অতঃপর শাস্তা সেই আস্রবস্থানীয় ধর্ম সমূহের নিবারণার্থ শ্রাবকদের নিমিত্ত শিক্ষাপদ প্রজ্ঞাপ্ত করেন। ভদ্দালি! ততদিন সংঘে কোন আস্রবস্থানীয় ধর্ম প্রকটিত হয় না, যতদিন সংঘ লাভাগ্র প্রাপ্ত না হয়, ...... পূ ...... যশাগ্র্র প্রাপ্ত না হয়, বহুশ্রুতত্ব প্রাপ্ত না হয়, রাত্রজ্ঞভাব (চিরকাল অবস্থিতি) প্রাপ্ত না হয়, ...... পূ ......। ভদ্দালি! যখন সংঘ রাত্রজ্ঞভাব প্রাপ্ত হয় তখন সংঘে আস্রবস্থানীয় ধর্ম উৎপন্ন হয়, তখন শাস্তা আস্রবস্থানীয় ধর্ম নিবারণার্থ শ্রাবকগণের জন্য শিক্ষাপদ প্রজ্ঞাপ্ত করেন।”

১৪৬। “ভদ্দালি! তোমরা সেই সময় অল্পসংখ্যক (ভিক্ষু) উপস্থিত ছিলে যখন আমি তোমাদিগকে আজানীয় শিশূপম (উত্তম জাতীয় তরুণাশ্বোপম) ধর্মপর্যায় (সূত্র) উপদেশ দিয়াছিলাম।”

“ভদ্দালি! তোমার স্মরণ আছে কি?”

“না, ভন্তে!”

“ভদ্দালি! এই বিস্মৃতির কারণ কি বিশ্বাস কর?”

“ভন্তে! দীর্ঘকাল আমি শাস্তার শাসনে শিক্ষার পূর্ণকারী ছিলাম না।”

“ভদ্দালি! শুধু ইহাই হেতু, ইহাই একমাত্র প্রত্যয় নহে। অথচ ভদ্দালি! দীর্ঘকাল হইতে আমি চিত্তদ্বারা তোমার চিত্তভাব বিচার করিয়া অবগত হইয়াছি- এই মোঘপুরুষ আমার ধর্মোপদেশের সময় স্থিরভাবে মনোনিবেশ করিয়া, সর্বচিত্ত একাগ্র করিয়া অভহিতশ্রোত্রে ধর্ম শ্রবণ করে না। তথাপি ভদ্দালি! তোমাকে আমি আজানীয় তরুণাশ্ব-উপম ধর্মপর্যায় উপদেশ করিব। তাহা শুন, উত্তমরূপে মনে রাখ, বর্ণনা করিব।”

“হাঁ, ভন্তে!” আয়ুষ্মান ভদ্দালি ভগবানকে প্রতিশ্রুতি দিলেন।

১৪৭। ভগবান ইহা বলিলেন,- “যেমন ভদ্দালি! দক্ষ অশ্বচালক ভদ্র আজানীয়াশ্ব লাভ করিয়া (১) প্রথমেই মুখাধানে (বল্গা বন্ধনাদি) কারণ শিক্ষা দেয়। প্রথমতঃ তাহার মুখাধানে শিক্ষা দিবার জন্য অকৃতপূর্ব সেই কারণ করিবার সময়- উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা, উল্লম্ফনাদি উপদ্রব করিয়া থাকে; নিরন্তর ও ক্রমান্বয়ে শিক্ষার ফলে সেই বিষয়ে সে শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়। (২) ভদ্দালি! নিরন্তর ও ক্রমশঃ শিক্ষাদ্বারা সেই ভদ্র আজানীয়াশ্ব সেই স্থানে যখন উপশান্ত হয়, তখন অশ্বচালক তৎপরবর্তী যুগাধানে (যুগধারণে) শিক্ষা দেয়। অকৃতপূর্ব শিক্ষা প্রথম শিখিবার সময় ...... পূ ......। (৩) ...... পূ ...... যখন উহা শিক্ষাপ্রাপ্ত হয় তখন অশ্বচালক তৎপরবর্তী শিক্ষা হিসাবে ক্রমান্বয়ে মণ্ডল (৪) খুরকাস (৫) ধাবন (৬) রবত্ব (৭) রাজগুণ (৮) রাজবংশ (৯) উত্তম জব (গতি), উত্তম হয় (অশ্ব) উত্তম সাখল্য শিক্ষা দেয়। শিক্ষা করিবার সময় ...... পূ ...... তথায় শান্ত ও শিক্ষাপ্রাপ্ত হয়। তাহাকে অশ্বচালক তৎপরবর্তী (১০) বর্ণিয় ও বলিয় গতিতে প্রবেশ করায়। ভদ্দালি! এই দশবিধ অঙ্গসমন্বিত ভদ্র অশ্বাজানীয় রাজার যোগ্য ও রাজভোগ্য হয়। উহাকে রাজার অঙ্গই বলা যায়। সেইরূপ ভদ্দালি! দশবিধ গুণ সমন্বিত ভিক্ষু আহ্বানীয়, পাহুনীয় (প্রাহ্বানীয়), দাক্ষিণেয়্য, অঞ্জলিকরণীয় এবং লোকের অনুত্তর পুণ্যক্ষেত্র নামে অভিহিত। সেই দশগুণ কি কি? ভদ্দালি! এখানে ভিক্ষু অশৈক্ষ্য (শিক্ষা সমাপ্ত) সম্যকদৃষ্টি দ্বারা যুক্ত হয়, অশৈক্ষ্য সম্যকসঙ্কল্প, সম্যক্‌বাক্য, সম্যক্‌কর্ম, সম্যক্‌জীবিকা, সম্যকব্যায়াম (চেষ্টা), সম্যক্‌স্মৃতি, সম্যক্‌সমাধি, সম্যক্‌জ্ঞান ও সম্যক্‌বিমুক্তি সমন্বিত হয়। ভদ্দালি! এই দশবিধ গুণযুক্ত ভিক্ষু ...... পূ ...... জগতের অনুত্তর পুণ্যক্ষেত্র হয়।”

ভগবান ইহা বলিলেন। আয়ুষ্মান ভদ্দালি ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন করিলেন।

॥ ভদ্দালি সূত্র সমাপ্ত ॥

লকুটিকোপম সূত্র (৬৬)

১৪৮। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-

এক সময় ভগবান অঙ্গুত্তরাপ দেশে আপণ নামক অঙ্গুত্তরাপবাসীদের নিগমে বাস করিতেছেন। তখন ভগবান পূর্বাহ্ন সময়ে নিবাসন পরিধান করিয়া পাত্র-চীবর লইয়া আপণে পিণ্ডাচরণে প্রবেশ করিলেন। আপণে পিণ্ডাচরণ (ভিক্ষা) করিয়া ভোজনের পর পিণ্ডপাত (ভিক্ষাচর্যা) হইতে প্রত্যাবর্তনের সময় দিবা বিহারের নিমিত্ত অন্যতর গহন বনে উপনীত হইলেন, সেই গহন বনে প্রবিষ্ট হইয়া এক বৃক্ষমূলে দিবা বিহারার্থ বসিলেন।

আয়ুষ্মান উদায়ি ও পূর্বাহ্ন সময় নিবাসন পরিধান করিয়া পাত্র-চীবর লইয়া আপণে পিণ্ডাচরণে প্রবিষ্ট হইলেন। তথায় পিণ্ডাচরণ করিয়া ভোজনের পর প্রত্যাবর্তনের সময় যেখানে সেই বন গহন তথায় উপস্থিত হইলেন দিবা বিহারের জন্য। সেই বন গহনে যাইয়া এক বৃক্ষমূলে দিবা বিহারের জন্য বসিলেন। তখন নিভৃতে ধ্যাননিমগ্ন আয়ুষ্মান উদায়ির এইরূপ চিত্তবিতর্ক উৎপন্ন হইল,- “অহো! ভগবান আমাদের বহু দুঃখের অপহারক। অহো! ভগবান আমাদের বহু সুখধর্মের উপহারক। অহো! ভগবান আমাদের বহু অকুশলের অপহারক। অহো! ভগবান আমাদের বহু কুশলের উপহারক।”

১৪৯। তখন আয়ুষ্মান উদায়ি সায়ংকালীন ফলসমাপত্তি ধ্যান হইতে উঠিয়া যেখানে ভগবান আছেন সেখানে গেলেন, গিয়া তাঁহাকে অভিবাদন পূর্বক একান্তে বসিলেন। একান্তে উপবিষ্ট আয়ুষ্মান উদায়ি ভগবানকে ইহা বলিলেন,-

“ভন্তে! আজ নির্জনে ধ্যানাবস্থায় আমার চিত্তে এই পরিবিতর্ক উৎপন্ন হইয়াছে,- ‘অহো! ভগবান আমাদের ...... পূ ..... উপহারক।’ ভন্তে! পূর্বে আমরা সন্ধ্যা, সকাল, দ্বিপ্রহর ও বিকালে ভোজন করিতাম। সেই সময় ভগবান যখন ভিক্ষুদিগকে আহ্বান করিলেন,- ‘ভিক্ষুগণ! তোমরা দ্বিপ্রহরের পর বিকাল ভোজন ত্যাগ কর।’ ভন্তে! সেই সময় আমার চিত্তে অন্যথাভাব ও দৌর্মনস্য সঞ্চার হইয়াছিল। যে সময় শ্রদ্ধাবান গৃহপতিরা মধ্যাহ্নের পর বিকালে যে উৎকৃষ্ট খাদ্য-ভোজ্য দিতেছেন, উহাও ভগবান আমাদিগকে ত্যাগ করিতে বলিলেন, উহাও সুগত আমাদিগকে ছাড়িতে বলিলেন। ভন্তে! তখন আমরা শুধু ভগবানের প্রতি প্রেম, গৌরব, লজ্জা ও সঙ্কোচ বশতঃ দ্বিপ্রহরের পর এইরূপ বিকাল ভোজন ত্যাগ করিয়াছিলাম। ভন্তে! তখন আমরা সন্ধ্যা ও প্রাতে ভোজন করিতাম। অতঃপর এমন সময় আসিল ভগবান ভিক্ষুদিগকে আহ্বান করিলেন,- ‘ভিক্ষুগণ! তোমরা এখন রাত্রের বিকাল ভোজন ত্যাগ কর।’ ভন্তে! আমার চিত্তে অন্যথাভাব হইল, দৌর্মনস্য জন্মিল। এই দ্বিবিধ ভাতের মধ্যে যাহা উৎকৃষ্টতর সজ্জিত ভগবান আমাদিগকে তাহাও ত্যাগ করিতে বলিতেছেন, সুগত তাহারও প্রহাণ বলিতেছেন। পূর্বে (একবার) ভন্তে! কেহ দিবায় সূপযোগ্য বস্তু লাভ করিয়া বলিতেন,- ‘এখন ইহা রাখিয়া দাও, সন্ধ্যাবেলায় আমরা সকলে সমবেত ভাবে ভোগ করিব।’ ভন্তে! যাহা কিছু উত্তম রান্না সংখতিয় তাহা রাত্রিতেই অধিক হয়, দিনে স্বল্পমাত্র। সুতরাং তখন আমরা ভগবানের প্রতি শুধু প্রেম, গৌরব, লজ্জা ও সঙ্কোচ বশতঃ এইরূপ রাত্রির বিকাল ভোজন (অনিচ্ছায়) ছাড়িয়াছিলাম।”

“ভন্তে! পূর্বে ভিক্ষুগণ রাত্রির ঘনান্ধকারে ভিক্ষাচরণ করিতেন, (সেই সময় তাঁহারা) চন্দনিকায় প্রবেশ করিতেন, গর্তে (ওলিগল্ল) পতিত হইতেন, কণ্টকাবর্তে উঠিতেন, সুপ্ত গাভীর উপর আরোহণ করিতেন, কৃতকর্মা (স্বীয় কর্ম যাঁরা করিয়াছেন) ও অকৃতকর্মা চোরের সহিতও তাঁহাদের সম্মিলন ঘটিত, ভ্রষ্টা মাতৃগ্রাম (স্ত্রীজাতি) তাহাদিগকে অসদাচরণের জন্য আহ্বান করিত। পূর্বে এক সময় ভন্তে! রাত্রির ঘনান্ধকারে ভিক্ষাচরণ করিতেছিলাম, এক স্ত্রীলোক ভাজন ধুইবার সময় বিদ্যুতালোকে আমাকে দেখিতে পাইল। আমাকে দেখিয়া সে ভয়ে চীৎকার করিয়া উঠিল,- আমার সর্বনাশ! নিশ্চয় পিশাচ!! আমাকে (অব্‌ভূন্মে পিসাচো বত মং) খাইতে আসিল!!! এইরূপ বলিলে আমি ভন্তে! সে স্ত্রীকে বলিলাম,- ‘ভগিনী! আমি পিশাচ নহি, ভিক্ষার জন্য ভিক্ষু দাঁড়াইয়াছি।’ তখন সে বলিল,- ভিক্ষুর মা মরে, ভিক্ষুর বাপ মরে (আমাদের কি?), ভিক্ষু! বরং তোমার পক্ষে গোহত্যার তীক্ষ্ন ছুরিদ্বারা নিজের পেট কাটাই ভাল, তথাপি রাত্রির ঘনান্ধকারে পেটের দায়ে ভিক্ষা করা উচিত নহে।’ ভন্তে! সে কথা স্মরণ করিতেই আমার মনে হয়,- ‘অহো! ভগবান আমাদের বহু অকুশল ও বহু দুঃখ-ঝঞ্জাটের অপসারণ করিয়াছেন। অহো! ভগবান আমাদের বহুবিধ কুশলের ও সুখ-শান্তির বিধান করিয়াছেন’।”

১৫০। “এইরূপই, উদায়ি! এখানে কোন কোন মোঘপুরুষেরা আমাকর্তৃক ‘ইহা পরিত্যাগ কর’ কথিত হইলে তাহারা বলে,- ‘এ কি? এ সামান্য বিষয়ে, এত তুচ্ছ বিষয়ে এই শ্রমণ অত্যুৎসাহ দেখাইতেছেন? তাহারা ইহাও ত্যাগ করে না। অধিকন্তু আমার প্রতি অসন্তোষ উৎপন্ন করে। কিন্তু উদায়ি! যাহারা শিক্ষাকামী তাহাদের পক্ষে উহা (প্রহীতব্য বিষয়) শক্তবন্ধন, দৃঢ়বন্ধন, স্থিরবন্ধন, অপূতিবন্ধন, স্থূল কলিঙ্গর (পশুর গলায় বাঁধিবার কাষ্ঠখণ্ড) বিশেষ। যেমন উদায়ি! পূতিলতার বন্ধনে আবদ্ধ লাটুকিকা (পক্ষী বিশেষ) পক্ষী, তাহাতেই বধ, বন্ধন বা মরণ প্রাপ্ত হয়। উদায়ি! যে ব্যক্তি এরূপ বলে,- ‘যে পূতিলতা বন্ধনে আবদ্ধ লাটুকিকা পক্ষী তাহাতেই বধ, বন্ধন ও মৃত্যুবরণ করে, তার পক্ষে উহা অবল-বন্ধন, দুর্বল-বন্ধন, পূতি-বন্ধন, অসার-বন্ধনমাত্র।’ কেমন উদায়ি! এরূপ বলিলে সে ঠিক বলিতেছে কি?”

“ঠিক নহে, ভন্তে! যে পূতিলতার বন্ধনে আবদ্ধ লটুকিকা তাহাতেই বধ, বন্ধন ও মৃত্যুমুখে পতিত হইতেছে; তার পক্ষে উহা দুচ্ছেদ্য, শক্ত বন্ধন ...... পূ ...... স্থূল কলিঙ্গর সদৃশ।”

“এইরূপই উদায়ি! কোন কোন মোঘপুরুষেরা আমাকর্তৃক ‘ইহা পরিত্যাগ কর’ কথিত হইলে ... পূ ... স্থূল কলিঙ্গর সদৃশ।”

১৫১। “উদায়ি! কোন কোন কুলপুত্র ‘ইহা ত্যাগ কর’ আমাকর্তৃক উক্ত হইলে তাহারা এরূপ বলে,- এই সামান্য, তুচ্ছ, ত্যাজ্য বিষয়ের কি কথা যাহা ছাড়িবার জন্য ভগবান বলিলেন, যাহার ত্যাগের জন্য ভগবান বলিলেন?’ তাহারা উহাও ত্যাগ করে এবং আমার প্রতি অসন্তোষ পোষণ করে না। যে সকল ভিক্ষু শিক্ষাকামী তাহারা উহা ত্যাগ করিয়া নিরুদ্বেগে পতিত লোমে (নিরাশঙ্ক চিত্তে) পরদবৃত্তি মৃগের সমান (প্রত্যাশাহীন) চিত্তে বসবাস করে। উদায়ি! তাহাদের জন্য উহা অবল-বন্ধন, ...... পূ ...... অসার-বন্ধন।”

“যেমন উদায়ি! ঈশাদন্ত, মহাদেহ, সংগ্রামাবচর, দৃঢ় রজ্জু বন্ধনে আবদ্ধ উত্তম জাতের রাজকীয় হস্তী সামান্য মাত্র শরীর সঞ্চালন করিয়া সেই বন্ধন সমূহ ছিন্ন করে, পদদলিত করে এবং যথেচ্ছা গমন করে। উদায়ি! যে ব্যক্তি এরূপ বলে,- ঈশাদন্ত, ...... পূ ...... হস্তী সামান্য মাত্র শরীর সঞ্চালন দ্বারা সেই বন্ধন ছিন্ন করিয়া ইচ্ছামত চলিয়া যায়। উহা শক্তবন্ধন ...... পূ ...... স্থূল কলিঙ্গর।’ এইরূপ বলিলে উদায়ি! তাহা সে ঠিক বলিতেছে কি?”

“নহে, ভন্তে! রাজকীয় হস্তী সামান্য মাত্র শরীর সঞ্চালন দ্বারা যে বন্ধন ছিন্ন করিয়া চলিয়া যায় ...... পূ ...... তাহার পক্ষে উহা অবল-বন্ধন ...... পূ ...... অসার-বন্ধন।”

১৫২। “যেমন উদায়ি! কোন দরিদ্র, নিঃস্ব, অনাঢ্য পুরুষ, তাহার এক জীর্ণ-শীর্ণ, কাক প্রবেশক্ষম, ছিদ্রযুক্ত, ক্ষুদ্র, পর্ণকুটির আছে; এক উঁচু-নীচু বিশ্রী মঞ্চ আছে, এক কলসীতে ধান্যবৎ নিকৃষ্ট বীজ আছে এবং এক বীভৎস ভার্যা আছে। সে সংঘারামে হস্ত-পদ ধৌত ও মনোজ্ঞ ভোজন গ্রহণের পর শীতল ছায়ায় উপবিষ্ট ধ্যান নিরত ভিক্ষুকে দেখিতে পাইল। তখন তাহার মনে সঙ্কল্প হইল,- ‘অহো! শ্রামণ্যই সুখময়, অহো! শ্রমণভাবই আরোগ্য কর। অহো! কখন আমিও কেশ-শ্মশ্রু মুণ্ডন করিয়া কাষায় বস্ত্র পরিধান পূর্বক আগার হইতে অনাগারিক প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিতে পারিব?’ সে তাহার সেই জীর্ণকুটির, ভগ্নমঞ্চ, সামান্য সঞ্চয় ও কুৎসিত ভার্যা ত্যাগ করিয়া আগার হইতে অনাগারিক প্রব্রজ্যা গ্রহণে সমর্থ হইল না। উদায়ি! যদি কেহ বলে,- ‘যে বন্ধনে আবদ্ধ হইয়া সে প্রব্রজিত হইতে অক্ষম হইল, উহা তাহার পক্ষে অবল-বন্ধন ...... পূ ...... অসার-বন্ধন মাত্র।’ এইরূপ বলিলে সে কি উহা ঠিক কথাই বলিল?”

“নহে, ভন্তে! যেই বন্ধনে আবদ্ধ হইয়া সে সেই জীর্ণকুটির ...... পূ ...... কুৎসীত ভার্যা ত্যাগ করিয়া ...... পূ ...... প্রব্রজিত হইতে অসমর্থ হইল, উহা তাহার পক্ষে শক্তবন্ধন ...... পূ ...... স্থূল কলিঙ্গর।”

“সেইরূপই উদায়ি! কোন কোন মোঘপুরুষ ‘ইহা ছাড়’ বলিলে বিরক্ত হয় ...... পূ ...... অথচ ইহা তাহার পক্ষে দৃঢ়বন্ধন ...... স্থূল কলিঙ্গর স্বরূপ।”

১৫৩। “যেমন উদায়ি! আঢ্য, ধনবান, মহাভোগশালী কোন গৃহপতি বা গৃহপতি পুত্রের বহুসংখ্যক স্বর্ণ-নিষ্কের (মুদ্রার) সঞ্চয় আছে, অনেক সংখ্যক ধান্যশকট, অনেক সংখ্যক ক্ষেত্র, অনেক সংখ্যক দ্রব্য, অনেক সংখ্যক ভার্যা, দাস ও দাসীর সঞ্চয় আছে। সে একদিন সংঘারামে ভিক্ষুকে দেখিতে পাইল যে মনোজ্ঞ ভোজন আহার করিয়া সুধৌত হস্ত-পদে সুশীতল ছায়ায় উপবিষ্ট অবস্থায় ধ্যানে নিরত আছেন। তখন তাহার মনে হইল,- ‘অহো! শ্রামণ্যই সুখময়, অহো! শ্রামণ্যই আরোগ্য কর, ...... পূ ...... কখন আমি আগার হইতে অনাগারিক প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিতে পারি!’ অতঃপর সে বহুসংখ্যক স্বর্ণ মুদ্রার সঞ্চয় ...... পূ ...... দাস ও দাসীর সঞ্চয় ত্যাগ করিয়া কেশ-শ্মশ্রু মুণ্ডন পূর্বক আগার হইতে অনাগারিক...... প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিতে সক্ষম হইল। উদায়ি! তখন যদি কেহ বলে,- ‘যে বন্ধনে সে আবদ্ধ ...... পূ ...... আপনার সেই ধনরাশি ও দাস-দাসী সমূহ ত্যাগ করিয়া প্রব্রজিত হইতে সমর্থ হইল, উহা তাহার শক্তবন্ধন ...... পূ ...... স্থূল কলিঙ্গর।’ এইরূপ বলিলে সে কি উদায়ি! ঠিক বলিবে?”

“না, ভন্তে! সেই গৃহপতি ...... পূ ...... যে বন্ধনে আবদ্ধ ...... পূ ...... আপনার দাস-দাসীর সঞ্চয় ত্যাগ করিয়া প্রব্রজিত হইতে সমর্থ হইল, উহা তাহার পক্ষে অবল-বন্ধন ...... পূ ...... অসার-বন্ধন বিশেষ।”

১৫৪। “উদায়ি! জগতে চারি প্রকার পুরুষ-পুদ্গল বিদ্যমান। সেই চারি পুদ্গল কি কি?- (১) এখানে উদায়ি! কোন পুদ্গল উপধি প্রহাণের নিমিত্ত, উপধি পরিবর্জনের নিমিত্ত প্রতিপন্ন (উদ্যোগী) হয়। উপধি প্রহাণার্থ ও উপধি পরিবর্জনার্থ প্রতিপন্নকে যদি উপধি (সংযুক্ত) সঙ্কল্প (বিতর্ক) রাশি বশীভূত করে, উহাদিগকে সে স্বীকার করে- ত্যাগ করে না, অপসারণ করে না, অন্ত করে না, সমুচ্ছেদ করে না; তবে উদায়ি! আমি বলিব এ ব্যক্তি ক্লেশসংযুক্ত-বিসংযুক্ত নহে। ইহার কারণ কি? উদায়ি! এ ব্যক্তির ইন্দ্রিয় -নানাত্বই কারণ, ইহা আমার সুবিদিত। (২) এখানে উদায়ি! কোন ব্যক্তি উপধি গ্রহণের নিমিত্ত ...... পূ ...... প্রতিপন্ন হয়। কিন্তু তাহাকে উপধি সংযুক্ত সঙ্কল্প বশীভূত করে। সে উহাদিগকে স্বীকার করে না- ত্যাগ করে, অপসারণ করে, বিনাশ করে, সমুচ্ছেদ করে। উদায়ি! এই ব্যক্তিকেও আমি সংযুক্ত বলি বিসংযুক্ত নহে...... ইহার কারণ কি? এই ব্যক্তির মধ্যে ইন্দ্রিয়ের নানাত্ব আছে, ইহা আমার সুবিদিত। (৩) উদায়ি! এখানে ...... পূ ...... স্মৃতি সম্মোহ (বিভ্রম) বশতঃ ক্কচিৎ-কদাচিৎ উপধি অনুগামী সঙ্কল্প তাহাকে বশীভূত করে, ঐ বিষয়ে স্মৃতি ধীরে উৎপন্ন হয়; কিন্তু উহাকে শীঘ্র শীঘ্র ত্যাগ করে, অপসারণ করে, বিনাশ করে, সমুচ্ছেদ করে। যেমন উদায়ি! কোন ব্যক্তি দিনের তাপে সন্তপ্ত লৌহকটাহে দুই বা তিনটি জল বিন্দু নিক্ষেপ করে। উদায়ি! জলবিন্দুর পতন ধীরে ধীরে হয়, অথচ তাহা সত্বর পরিক্ষয় হয়- নিঃশেষে শুকাইয়া যায়। সেইরূপই উদায়ি! এখানে কেহ ক্বচিৎ কদাচিৎ স্মৃতিভ্রম বশতঃ উপধি অনুগামী সঙ্কল্পের বশীভূত হয়, ...... পূ ...... উদায়ি! আমি এই পুদ্গলকে সংযুক্ত বলি- বিসংযুক্ত নহে। ...... পূ ...... ইহা আমার বিদিত। (৪) উদায়ি! এখানে কোন কোন পুদ্গল উপধি (পঞ্চস্কন্ধ) দুঃখের মূল, ইহা বিদিত হইয়া, উপধি সংক্ষয়ে (নির্বানে) বিমুক্ত নিরুপধি (ক্লেশ) বিহীনও হয়। উদায়ি! কেবল এই ব্যক্তিকেই আমি বিসংযুক্ত বলি- সংযুক্ত নহে। তাহার কারণ কি? উদায়ি! তাঁহার ইন্দ্রিয়ের বিভিন্নত্ব আছে, ইহা আমার সুবিদিত।”

১৫৫। “উদায়ি! এই পঞ্চবিধ কামগুণ। কোন্‌ পঞ্চবিধ? চক্ষুবিজ্ঞেয় ইষ্ট, কান্ত, মনোজ্ঞ, প্রিয়জাতি কামসংযুক্ত রঞ্জনীয় রূপ (দৃশ্য); শ্রোতবিজ্ঞেয় শব্দ, ঘ্রাণবিজ্ঞেয় গন্ধ, জিহ্বাবিজ্ঞেয় রস ও কায়বিজ্ঞেয় স্পৃষ্টব্য। উদায়ি! এই পঞ্চবিধ কামগুণ (বন্ধন)। উদায়ি! এই পঞ্চ কামগুণের দরুণ যে সুখ সৌমনস্য উৎপন্ন হয়, ইহাকেই কামসুখ অশুচি (মীঢ়) সুখ, প্রাকৃতজন সেবিত সুখ, অনার্যসুখ বলা হয়। ইহা অসেবনীয়, অভাবনীয় ও বৃদ্ধির অযোগ্য কথিত হয়, এই সুখকে ভয় করা উচিত বলিতেছি।”

১৫৬। উদায়ি! এ ক্ষেত্রে ভিক্ষু কাম হইতে পৃথক হইয়া ...... পূ ...... প্রথম ধ্যান লাভ করিয়া বাস করে। দ্বিতীয় ধ্যান ...... পূ ......। তৃতীয় ধ্যান ...... পূ ......। চতুর্থ ধ্যান লাভ করিয়া বাস করে। ইহাই নৈষ্কাম্যসুখ, প্রবিবেকসুখ, (রাগাদি) উপশমজনিত সুখ, সম্বোধি (লোকোত্তর মার্গ) সুখ নামে কথিত হয়, ইহা সেবনীয়, ভাবনীয় ও বহুল করণীয়। এই সুখ লাভে ভয় না করা উচিত বলিতেছি।”

“এখানে উদায়ি! ভিক্ষু কাম হইতে পৃথক হইয়া ...... পূ ...... প্রথম ধ্যান লাভ করিয়া বিহার করে। উদায়ি! ইহাকেও আমি চঞ্চল বলিতেছি। এখানে চাঞ্চল্যের বিষয় কি? তথায় (প্রথম ধ্যানে) যে বিতর্ক-বিচার অনিরুদ্ধ রহিয়াছে, ইহাই তাহাতে চাঞ্চল্যের কারণ। উদায়ি! ভিক্ষু এখানে ...... দ্বিতীয় ধ্যান লাভ করিয়া বিহার করে। উদায়ি! ইহাও আমি চাঞ্চল্যের বিষয় বলিতেছি। তথায় চাঞ্চল্যের বিষয় কি? তথায় যে প্রীতি-সুখ অনিরুদ্ধ রহিয়াছে, ইহাই চাঞ্চল্যের বিষয়। উদায়ি! এখানে ভিক্ষু প্রীতির প্রতিও বিরাগ হেতু ...... পূ ...... তৃতীয় ধ্যান লাভ করিয়া বাস করে। ইহাও আমি চাঞ্চল্যের বিষয় বলিতেছি। তথায় চাঞ্চল্যের বিষয় কি? তাহাতে যে উপেক্ষা-সুখ অনিরুদ্ধ রহিয়াছে, ইহাই তথায় চাঞ্চল্যের বিষয়। উদায়ি! এখানে সুখ-দুঃখের প্রহীণ হেতু ...... পূ ...... চতুর্থ ধ্যান লাভ করিয়া বিহার করে। উদায়ি! ইহাকেই আমি চাঞ্চল্যহীন বলিতেছি।”

“এখানে উদায়ি! ভিক্ষু প্রথম ধ্যান লাভ করিয়া বাস করে। ইহাকে উদায়ি! আমি অপর্যাপ্ত (অননং) মনে করিতে বলি , ত্যাগ কর বলি, অতিক্রম কর বলি। উহার সমতিক্রম কি? এখানে উদায়ি! ভিক্ষু দ্বিতীয় ধ্যান লাভ করিয়া বাস করে, ইহাই তাহার সমতিক্রম। কিন্তু উদায়ি! ইহাকেও আমি অপর্যাপ্ত বলি, ত্যাগ কর বলি, সমতিক্রম করিয়া যাও বলি। ......পূ ...... তৃতীয় ধ্যান লাভ করিয়া বাস করে। ইহা দ্বিতীয় ধ্যানের সমতিক্রম। ইহাকেও আমি অতিক্রম করিয়া যাও বলি। ইহার সমতিক্রম কি? .... পূ .... চতুর্থ ধ্যান প্রাপ্ত হইয়া বিহার করে। ইহাই তৃতীয় ধ্যানের সমতিক্রম। ইহাকেও ...... পূ ......। .... পূ .... আকাশানন্তায়তন .... পূ ...... বিজ্ঞানানন্তায়তন ...... পূ ......। ...... পূ ...... আকিঞ্চনায়তন ...... পূ ......। .... পূ .... নৈবসংজ্ঞানাসংজ্ঞায়তন ধ্যান প্রাপ্ত হইয়া অবস্থান করে। ইহা উহার সমতিক্রম। উদায়ি! ইহাকেও আমি অপর্যাপ্ত বলিতেছি। ইহার সমতিক্রম কি? এখানে উদায়ি! ভিক্ষু নৈবসংজ্ঞানাসংজ্ঞায়তনকে সর্বথা অতিক্রম করিয়া সংজ্ঞা-বেদয়িত নিরোধকে উপলব্ধি করিয়া বিহার করে। ইহাই উহার সমতিক্রম। এই প্রকারে, উদায়ি! আমি নৈবসংজ্ঞানাসংজ্ঞায়তনেরও প্রহাণ বলিতেছি। উদায়ি! সূক্ষ্ম-স্থূল এমন কোন সংযোজন (বন্ধন) তুমি দেখিতেছ কি আমি যাহার প্রহাণ বলি নাই?”

“না, ভন্তে!”

ভগবান ইহা বলিলেন। সন্তুষ্টচিত্তে আয়ুষ্মান উদায়ি ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন করিলেন।

॥ লকুটিকোপম সূত্র সমাপ্ত ॥

চাতুম সূত্র (৬৭)

১৫৭। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-

এক সময় ভগবান চাতুমায় আমলকী বনে বিহার করিতেছেন। এই সময় ভগবানকে দর্শনার্থ সারিপুত্র, মোগ্গলায়ন প্রমুখ পঞ্চশত ভিক্ষু চাতুমায় উপস্থিত হইলেন। তখন সেই আগন্তুক ভিক্ষুগণ আবাসিক ভিক্ষুদের সহিত সম্মোদন (কুশল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা) করিতে, শয্যাসন স্থাপন করিতে, পাত্র-চীবর সামলাইতে উচ্চশব্দ মহাশব্দ করিলেন। সেই সময় ভগবান আয়ুষ্মান আনন্দকে ডাকিলেন,- “ইহারা কে আনন্দ! মৎস্য বিলোপস্থানে কৈবর্তদের ন্যায় উচ্চশব্দ মহাশব্দ করিতেছে?”

“ভন্তে! সারিপুত্র ও মোগ্গলায়ন প্রমুখ পঞ্চশত ভিক্ষু চাতুমায় উপস্থিত হইয়াছেন ভগবানকে দর্শন মানসে। সেই আগন্তুক ভিক্ষুগণ আবাসিক ভিক্ষুদের সহিত...পূ...মহাশব্দ করিতেছেন।”

“তাহা হইলে আনন্দ! আমার কথায় তাহাদিগকে আহ্বান কর,- ‘শাস্তা আয়ুষ্মানগণকে ডাকিতেছেন’।”

“হাঁ, ভন্তে!” (বলিয়া) আয়ুষ্মান আনন্দ ভগবানকে প্রতিশ্রুতি দিয়া ভিক্ষুদের নিকট উপস্থিত হইলেন, তথায় গিয়া সেই ভিক্ষুগণকে বলিলেন,- ‘শাস্তা আয়ুষ্মানদিগকে ডাকিতেছেন’।

“হাঁ, আবুস (বন্ধু)!” (বলিয়া) সেই ভিক্ষুগণ আয়ুষ্মান আনন্দকে উত্তর দিয়া যেখানে ভগবান তথায় গেলেন। তথায় গিয়া ভগবানকে অভিবাদন করিয়া একপ্রান্তে বসিলেন। একান্তে উপবিষ্ট সেই ভিক্ষুদিগকে ভগবান বলিলেন,- “ভিক্ষুগণ! মৎস্য শিকারে কৈবর্তের ন্যায় কেন তোমরা উচ্চশব্দ মহাশব্দ করিতেছ?”

“ভন্তে! এখানে সারিপুত্র, মোগ্গলায়ন প্রমুখ পঞ্চশত ভিক্ষু ...... পূ ...... পাত্র-চীবর সামলাইতে উচ্চশব্দ, মহাশব্দ করিতেছে।”

“যাও, ভিক্ষুগণ! তোমাদিগকে (প্রণামণ) বহিষ্কার করিতেছি, আমার নিকট তোমরা থাকিও না।”

“হা, ভন্তে!” ভগবানকে উত্তর দিয়া, আসন হইতে উঠিয়া প্রদক্ষিণ করিয়া, শয্যাসন সামলাইয়া, পাত্র-চীবর লইয়া ভিক্ষুরা প্রস্থান করিলেন।”

১৫৮। সেই সময় চাতুমায় শাক্যগণ কোন কার্যোপলক্ষে সংস্থাগারে (প্রজাতন্ত্র ভবনে) সম্মিলিত ছিলেন। চাতুমার শাক্যগণ দূর হইতে সেই ভিক্ষুগণকে আসিতে দেখিলেন, দেখিয়া যেখানে সে ভিক্ষুগণ ছিলেন ...... পূ ...... সেখানে গিয়া তাঁহাদিগকে বলিলেন,- “আয়ুষ্মানগণ! আপনারা (এই মাত্র আসিয়া) কোথায় যাইতেছেন?”

“বন্ধুগণ! ভগবান কর্তৃক ভিক্ষুসংঘ বহিষ্কৃত হইয়াছে।”

“তাহা হইলে ভদন্তগণ! মূহুর্তকাল (এখানে) বসুন, নিশ্চয় আমরা ভগবানকে প্রসন্ন (সম্মত) করিতে পারিব।”

“উত্তম! বন্ধুগণ!” (বলিয়া) সেই ভিক্ষুগণ চাতুমার শাক্যদিগকে উত্তর দিলেন।

তখন চাতুমাবাসী শাক্যগণ যেখানে ভগবান আছেন সেখানে উপস্থিত হইলেন, উপস্থিত হইয়া ভগবানকে অভিবাদন পূর্ব্বক বসিলেন এবং ভগবানকে ইহা নিবেদন করিলেন,-

“ভন্তে ভগবন! ভিক্ষুসংঘকে অভিনন্দন করুন, ভন্তে ভগবন! ভিক্ষুসংঘকে আসিতে আদেশ করুন। ভন্তে! পূর্বে যেমন ভগবান কর্তৃক ভিক্ষুসংঘ অনুগৃহীত হইত, সেভাবে এখনও ভগবান ভিক্ষুসংঘকে অনুগ্রহ করুন। ভন্তে! তথায় (ভিক্ষুসংঘে) এই ধর্মবিনয়ে অধুনাগত অচির প্রব্রজিত নব ভিক্ষুরা আছেন, ভগবানের দর্শন লাভ করিতে না পারিলে তাঁহাদের মনে অন্যথাভাব হইতে পারে, বিপরিবর্তন আসিতে পারে। যেমন, ভন্তে! জলাভাবে তরুণ বীজের (অঙ্কুরের) অন্যথাভাব হয়, বিপরিণাম ঘটে; সেই প্রকার ...... পূ ...... ভগবানের দর্শন না পাইলে তাঁহাদের মনে অন্যথাভাব ও বিপরীতভাব আসিতে পারে। যেমন ভন্তে! মাতাকে না দেখিলে দুগ্ধপায়ী শিশু বৎসদের অন্যথাভাব ও বিপরীতভাব হয়, সে প্রকার ভন্তে! ...... পূ ......। ভন্তে ভগবন! ভিক্ষুসংঘকে অভিনন্দন (আগমন অনুমোদন) করুন, ভন্তে ভগবন! ভিক্ষুসংঘকে প্রত্যাবর্তনের আদেশ করুন ......।”

১৫৯। অতঃপর ব্রহ্মা সহম্পতি (মহাব্রহ্মাণ্ডের স্বামী) স্বীয় চিত্তে ভগবানের চিত্তবিতর্ক জ্ঞাত হইয়া, যেমন বলবান পুরুষ সঙ্কোচিত বাহু (সহসা) প্রসারণ করে ও প্রসারিত বাহু সঙ্কোচন করে, এইরূপেই ব্রহ্মলোক হইতে অন্তর্হিত হইয়া (সহসা) ভগবানের সম্মুখে প্রকট হইলেন। তখন সহম্পতি ব্রহ্মা উত্তরাসঙ্গ (উত্তরীয় বস্ত্র) একাংসে (স্কন্ধে) রাখিয়া ভগবানের প্রতি কৃতাঞ্জলিপুটে প্রণাম পূর্বক ভগবানকে বলিলেন,- “ভন্তে ভগবন! ভিক্ষুসংঘকে অভিনন্দন করুন, আদেশ প্রদান করুন, ...... পূ ...... ছোট অঙ্কুর ও শিশু বৎসদিগকে ...... পূ ...... অনুগৃহীত করুন।”

১৬০। চাতুমাবাসী শাক্যগণ ও ব্রহ্মা সহম্পতি অঙ্কুর উপমায় ও শিশু উপমায় ভগবানকে প্রসন্ন করিতে সমর্থ হইলেন। তখন আয়ুষ্মান মহামোগ্গলায়ন ভিক্ষুদিগকে আহ্বান করিলেন,- “উঠুন, বন্ধুগণ! পাত্র-চীবর গ্রহণ করুন। চাতুমাবাসী শাক্যগণ ও সহম্পতি ব্রহ্মা বীজ ও শিশু উপমায় ভগবানকে প্রসন্ন করিয়াছেন।”

“হাঁ, বন্ধু!” (বলিয়া) আয়ুষ্মান মহামোগ্গলায়নকে প্রত্যুত্তর দিয়া সেই ভিক্ষুগণ আসন হইতে উঠিলেন এবং পাত্র-চীবর লইয়া যেখানে ভগবান সেখানে পহুঁছিলেন, উপস্থিত হইয়া ভগবানকে অভিবাদন করিয়া একান্তে বসিলেন, একান্তে উপবিষ্ট আয়ুষ্মান সারিপুত্রকে ভগবান বলিলেন,- “সারিপুত্র! আমি ভিক্ষুসংঘকে বাহির করিয়া দিলে তোমার কি মনে হইয়াছিল?”

“ভন্তে! ভগবান কর্তৃক ভিক্ষুসংঘ বহিষ্কৃত হইলে আমার মনে হইয়াছিল যে এখন উৎসুকহীন হইয়া ভগবান দৃষ্টধর্ম (ইহজন্মে) সুখবিহারে (ফল সমাপত্তি ধ্যানে) নিবিষ্ট হইয়া বাস করিবেন। আমরাও এখন দৃষ্টধর্ম সুখ-বিহারে নিবিষ্ট হইয়া বাস করিব।”

“থাম তুমি, সারিপুত্র! অপেক্ষা কর তুমি, সারিপুত্র! পুনরায় কখনও তোমার এরূপ চিত্তোৎপাদন করা উচিত নহে।”

তখন ভগবান আয়ুষ্মান মোগ্গলায়নকে আহ্বান করিলেন,- “মোগ্গল্লায়ন! আমি ভিক্ষুসংঘকে বাহির করিয়া দিলে তোমার কি মনে হইয়াছিল?”

“ভন্তে! আমার এইরূপ মনে হইয়াছিল যে ভগবান ভিক্ষুসংঘকে বাহির করিয়া দিলেন, এখন ভগবান অনুৎসুকভাবে দৃষ্টধর্ম সুখবিহারে নিযুক্ত হইয়া অবস্থান করিবেন। এখন আমি ও সারিপুত্র ভিক্ষুসংঘের পরিচালন ভার গ্রহণ করিব।”

“সাধু, সাধু, মোগ্গলায়ন! ভিক্ষুসংঘকে আমি পরিচালনা করিতে পারি, অথবা সারিপুত্র কিংবা মোগ্গলায়ন পারে।”

১৬১। তখন ভগবান ভিক্ষুদিগকে আহ্বান করিলেন,- “ভিক্ষুগণ! জলে অবতরণকারী ব্যক্তির চতুর্বিধ ভয়ের (ক্ষতির) সম্ভাবনা প্রত্যাশা করিতে হয়। কি কি চারি? (১) ঊর্মি (তরঙ্গ) ভয়, (২) কুম্ভীর ভয়, (৩) আবর্ত (ঘুর্ণিপাক) ভয় এবং (৪) শিশুমার (চণ্ডমৎস্য) ভয়। ...... পূ ......। এই প্রকার ভিক্ষুগণ! কোন কোন ভিক্ষু এই ধর্মবিনয়ে আগার হইতে অনাগারিকরূপে প্রব্রজিত হইবার সময় চতুর্বিধ ভয়ের সম্ভাবনা চিন্তা করা উচিৎ। কোন্‌ চারি? (১) ঊর্মিভয়, (২) কুম্ভীর ভয়, (৩) আবর্ত ভয়, (৪) শিশুমার ভয়।”

১৬২। “ভিক্ষুগণ! ঊর্মিভয় কি প্রকার? এখানে কোন কোন কুলপুত্র- ‘আমি জন্ম-জরা-মরণ-শোক-পরিদেবন-দুঃখ-দৌর্মনস্য-উপায়াস দ্বারা প্রপীড়িত, দুঃখে অবতীর্ণ, দুঃখে নিমজ্জিত; ভাল কথা, যদি এই নিরবশেষ দুঃখরাশির অন্তসাধন উদ্ভাবন করিতে পারি’ (এই চিন্তা করিয়া) শ্রদ্ধায় আগার হইতে অনাগারিক প্রব্রজিত হয়। তথা প্রব্রজিত অবস্থায় সব্রহ্মচারীগণ তাঁহাকে উপদেশ দেন, অনুশাসন করেন- ‘এভাবে তোমার অভিগমন করা উচিত, এভাবে প্রতিগমন করা উচিত, এভাবে আলোকন-বিলোকন করা উচিত, এভাবে তোমার (বাহু) সঙ্কোচন-প্রসারণ করা উচিত, এই প্রকারে তোমার সংঘাটি-পাত্র-চীবর ধারণ করা উচিত’। তাহার মনে এরূপ ধারণা হয়- ‘আমরা পূর্বে গৃহী অবস্থায় থাকিতেও অন্যকে উপদেশ দিয়াছি ও অনুশাসন করিয়াছি। ইহারা নাকি আমাদের পুত্র-পৌত্র সদৃশ অথচ আমাদিগকে উপদেশ ও অনুশাসন করিতে চায়।’ সুতরাং সে ভিক্ষু শিক্ষা প্রত্যাখ্যান করিয়া হীন (গৃহী) অবস্থায় ফিরিয়া যায়। ভিক্ষুগণ! ইহাকেই বলা হয় ঊর্মিভয়ে ভীত, শিক্ষা প্রত্যাখ্যান করিয়া পুনঃ হীনাবস্থায় প্রাপ্ত। ভিক্ষুগণ! ঊর্মিভয় এখানে ক্রোধ-হতাশারই নামান্তর।”

১৬৩। “ভিক্ষুগণ! কুম্ভীরভয় কি? এখানে কোন কুলপুত্র ...... পূ ...... শ্রদ্ধায় আগার হইতে অনাগারিক প্রব্রজিত হয় ...... পূ ...... তাহাকে সব্রহ্মচারীগণ উপদেশ দেন, অনুশাসন করেন- ‘ইহা তোমার খাওয়া উচিত, ইহা না খাওয়া উচিত, ইহা তোমার ভোজন করা উচিত, ইহা তোমার ভোজন করা অনুচিত, ...... পূ ...... আস্বাদন ...... পূ ...... অনাস্বাদন ...... পূ ...... পান করা ...... পূ ...... পান না করা ...... পূ ...... , তোমার কপ্পিয় (উপযুক্ত) খাওয়া উচিত, অকপ্পিয় না খাওয়া উচিত, যোগ্য (কপ্পিয়) ভোজন করা উচিত, ‘অযোগ্য ভোজন না করা উচিত, যোগ্য আস্বাদন করা উচিত, অযোগ্য আস্বাদন না করা উচিত, যোগ্য পান করা উচিত, অযোগ্য পান না করা উচিত, তোমার কালে খাওয়া উচিত, বিকালে খাওয়া অনুচিত ...... পূ ...... তোমার কালে পান করা উচিত, বিকালে পান করা অনুচিত।’ তখন তাহার এধারণা হয়,- ‘আমরা পূর্বে গৃহস্থ অবস্থায় যাহা ইচ্ছা করি তাহা খাইতাম, যাহা ইচ্ছা করি নাই তাহা খাইতাম না, ...... পূ ...... যাহা ইচ্ছা করি তাহা পান করিতাম, যাহা ইচ্ছা না করি তাহা পান করিতাম না, যোগ্যও খাইতাম, অযোগ্যও খাইতাম ...... পূ ...... যোগ্যও পান করিতাম, অযোগ্যও পান করিতাম, কালেও খাইতাম, বিকালেও খাইতাম, ...... পূ ...... কালেও পান করিতাম, বিকালেও পান করিতাম। এখন শ্রদ্ধাবান গৃহপতিরা যে সকল উত্তম খাদ্য-ভোজ্য দ্বিপ্রহরের পর বিকালে আমাদিগকে দিয়া থাকেন, তাহাতেও ইঁহারা মুখাবরণের ন্যায় করিতেছেন।’ (এই চিন্তা করিয়া) সে শিক্ষাপদ প্রত্যাখ্যান করে ......পূ ......। ভিক্ষুগণ! ইহাকে বলা হয় যে কুম্ভীরভয়ে ভীত হইয়া শিক্ষার প্রত্যাখ্যান পূর্বক হীনাশ্রমে ফিরিয়া গিয়াছে। ভিক্ষুগণ! কুম্ভীরভয় উদম্ভরিতারই নামান্তর।”

১৬৪। ভিক্ষুগণ! আবর্তভয় কি? এখানে কোন কুলপুত্র ...... শ্রদ্ধায় আগার থেকে অনাগারিক প্রব্রজিত হয়। ...... সে এইরূপে প্রব্রজিত অবস্থায় পূর্বাহ্ন সময়ে নিবাসন পরিহিত হইয়া পাত্র-চীবর লইয়া অসংযত কায়ে, অসংযত বাক্যে, অনুপস্থিত-কায়গত-স্মৃতি হইয়া অসংযত ইন্দ্রিয়ে পিণ্ডাচর্যায় (ভিক্ষার্থ) গ্রামে কিংবা নগরে প্রবেশ করে। সে তথায় গৃহপতি বা গৃহপতিপুত্রকে পঞ্চবিধ কামগুণে (ভোগে) সমর্পিত, সমঙ্গীভূত (সংযুক্ত) হইয়া পরিচারিত হইতে দেখে। তাহার এই চিন্তা হয়- ‘আমরা পূর্বে গৃহী অবস্থায় পঞ্চ কামগুণ দ্বারা সমর্পিত, সমঙ্গীভূত হইয়া নিমগ্ন ছিলাম। আমার গৃহে ভোগও বিদ্যমান। সুতরাং ভোগ্য উপভোগ করিতে ও বহু পুণ্য করিতে সমর্থ হইব।’ (এই চিন্তায়) সে শিক্ষা প্রত্যাখ্যান করিয়া ...... ফিরিয়া যায়। ভিক্ষুগণ! ইহাকে আবর্তভয়ে শিক্ষা প্রত্যাখ্যান পূর্বক হীনাশ্রম প্রাপ্ত বলা হয়। ভিক্ষুগণ! আবর্তভয় এখানে পঞ্চ কামগুণের নামান্তর।

১৬৫। “ভিক্ষুগণ! শিশুমার ভয় কি? এখানে কোন কুলপুত্র ...... শ্রদ্ধায় আগার হইতে অনাগারিক প্রব্রজিত হয় ...... এইরূপে প্রব্রজিত অবস্থায় সে পূর্বাহ্নে ...... গ্রামে কিংবা নগরে প্রবেশ করে। সে তথায় দুরাচ্ছাদিত, দুষ্পরিহিত কোন রমনীকে দেখে। দুরাচ্ছাদিত ও দুষ্পরিহিত রমণীকুল দেখিয়া তাহার চিত্ত কামরাগে প্রপীড়িত হয়, সে রাগবিধ্বস্ত চিত্তের প্রেরণায় শিক্ষা প্রত্যাখ্যান করিয়া গার্হস্থ্যাশ্রমে প্রত্যাবৃত্ত হয়। ভিক্ষুগণ! ইহাকেই বলা হয় শুশুকের ভয়ে শিক্ষা প্রত্যাখ্যান পূর্বক হীনাবস্থায় প্রত্যাবৃত্ত। ভিক্ষুগণ! শুশুকভয় এখানে নারীজাতিরই নামান্তর।”

“ভিক্ষুগণ! এই ধর্মবিনয়ে আগার হইতে অনাগারিক রূপে প্রব্রজিত কোন কোন কুলপুত্রের এই চতুর্বিধ ভয়ের সম্ভাবনা বিদ্যমান, তাহা অপ্রত্যাশিত নহে।”

ভগবান ইহা বলিলেন। সেই ভিক্ষুগণ সন্তুষ্টচিত্তে ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন করিলেন।

॥ চাতুম সূত্র সমাপ্ত ॥

নলকপান সূত্র (৬৮)

১৬৬। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-

এক সময় ভগবান কোশল প্রদেশে, নলকপানের পলাশবনে বাস করিতেছেন। সেই সময় বহু অভিজাত অভিজাত কুলপুত্র ভগবানের উদ্দেশে শ্রদ্ধায় আগার হইতে অনাগারিক প্রব্রজিত হইয়াছেন, যথা- আয়ুষ্মান অনুরুদ্ধ, আয়ুষ্মান নন্দিয়, কিম্বিল, ভণ্ড (ভৃগু), কুণ্ডধান, রেবত, আনন্দ আরও অন্যান্য বহু বিখ্যাত বিখ্যাত কুলপুত্র। সে সময় ভগবান ভিক্ষুসংঘ পরিবৃত হইয়া মুক্ত স্থানে উপবিষ্ট আছেন। তখন ভগবান সেই কুলপুত্রগণকে উপলক্ষ করিয়া ভিক্ষুগণকে আমন্ত্রণ করিলেন,- “ভিক্ষুগণ! যে সকল কুলপুত্র আমাকে উদ্দেশ করিয়া শ্রদ্ধায় ...... প্রব্রজিত হইয়াছে, কেমন তাহারা ব্রহ্মচর্যের প্রতি অনুরক্ত কি?”

এইরূপ উক্ত হইলে ভিক্ষুগণ মৌন রহিলেন। দ্বিতীয় বার, তৃতীয় বার প্রশ্নেও ভিক্ষুরা নীরব রহিলেন।

১৬৭। তখন ভগবানের মনে হইল- “আমি কুলপুত্রগণকে জিজ্ঞাসা না করিলেই ভাল হইত।” তখন ভগবান (ব্যক্তিগত) আয়ুষ্মান অনুরুদ্ধকে আহ্বান করিলেন,- “অনুরুদ্ধ! তোমরা ব্রহ্মচর্যের প্রতি কেমন অনুরক্ত?”

“ভন্তে! আমরা ব্রহ্মচর্যের প্রতি যথেষ্ট অভিরমিত।”

“সাধু, সাধু, অনুরুদ্ধ! তোমাদের মত শ্রদ্ধায় আগার হইতে অনাগারিক প্রব্রজিত কুলপুত্রগণের ইহা প্রতিরূপ (যোগ্য) যে তোমরা ব্রহ্মচর্যের প্রতি অভিরমিত আছ। অনুরুদ্ধ! তোমরা যেই ভদ্র যৌবনসম্পন্ন, কালকেশ ও প্রথম বয়সে কাম পরিভোগ করিতে পারিতে সেই ...... বয়সে প্রব্রজিত হইয়াছ। অনুরুদ্ধ! তোমরা রাজাভিনীত (রাজভয়ে বাধ্য) হইয়া আগার হইতে অনাগারিক প্রব্রজিত হও নাই, চোরের ভয়ে, ঋণেরদায়ে, (অন্যথা) ভয়াতুর হইয়া, জীবিকার সংস্থানকল্পে আগার হইতে অনাগারিক প্রব্রজিত হও নাই। অপিচ ‘আমরা জন্ম-জরা-ব্যাধি-মরণ, শোক, রোদন-ক্রন্দন, দুঃখ, দৌর্মনস্য, উপায়াস প্রপীড়িত, দুঃখে অবতীর্ণ, দুঃখে নিমজ্জিত হইয়াছি। এই সমস্ত দুঃখরাশির অন্তসাধন দেখা গেলে ভাল হয়।’ (এই ভাবিয়া) অনুরুদ্ধ! তোমরা এই প্রকারে শ্রদ্ধায় আগার হইতে অনাগারিক প্রব্রজিত হইয়াছ, নহে কি?”

“হাঁ, ভন্তে!”

“অনুরুদ্ধ! এই প্রকারে প্রব্রজিত কুলপুত্রের করণীয় কি? কাম ও অকুশল ধর্ম (ভবদৃষ্টি ও অবিদ্যা) হইতে বিবিক্ত হইয়া (প্রথম ও দ্বিতীয় ধ্যানজ) প্রীতি-সুখ কিংবা তদপেক্ষা অন্য শান্ততর (উন্নত ধ্যান ও মার্গ) সুখ লাভ হয় না। তাহার চিত্ত অভিধ্যাও অধিকার করিয়া থাকে, ব্যাপাদ তন্দ্রালস্য, ঔদ্ধত্য-কৌকৃত্য, বিচিকিৎসা (সংশয়), অরতি (উৎকণ্ঠা), তন্দ্রী (আলস্য)ও তাহার চিত্ত অধিকার করিয়া থাকে। ...... সুতরাং অনুরুদ্ধ! কাম ও অকুশল ধর্ম হইতে বিবিক্ত হইয়া প্রীতি-সুখ বা তদপেক্ষা শান্ততর অবস্থা যাহার লাভ হয় তাহার চিত্ত অভিধ্যা অধিকার করে না, ব্যাপাদ, ঔদ্ধত্য-কৌকৃত্য, বিচিকিৎসা, অরতি, তন্দ্রা তাহার চিত্তকে ধরিয়া রাখে না। ......।”

১৬৮। “আমার সম্বন্ধে অনুরুদ্ধ! তোমার কি ধারণা হয় যে, যে সকল কলুষজনক পুনর্জন্ম মূলক সভয় (সদরা) ভবিষ্যতে জন্ম-জরা-মরণশীল ও দুঃখফলোৎপাদক আস্রব আছে, তাহা তথাগতের প্রহীণ হয় নাই? সেই কারণে তথাগত জানিয়াই এককে সেবন করেন, জানিয়া এককে গ্রহণ করেন, জানিয়া এককে পরিবর্জন করেন, জানিয়াই একের অপনোদন করেন?”

“ভন্তে! ভগবান সম্বন্ধে আমাদের এই ধারণা হয় না ......। বরং ভন্তে! ভগবান সম্বন্ধে আমাদের এই ধারণা হয়,- ‘যে সকল আস্রব ...... দুঃখফলোৎপাদক ...... তাহা তথাগতের প্রহীণ হইয়াছে। এই কারণে জানিয়া এককে সেবন করেন, গ্রহণ করেন পরিবর্জন করেন ও অপনোদন করেন।”

“সাধু, সাধু, অনুরুদ্ধ! যে সকল আস্রব কলুষজনক ..... দুঃখফলোৎপাদক তাহা তথাগতের প্রহীণ হইয়াছে, উচ্ছিন্ন হইয়াছে, মস্তকহীন তালবৃক্ষবৎ সমুচ্ছেদ হইয়াছে, ভবিষ্যতে অনুৎপত্তি স্বভাব হইয়াছে। যেমন অনুরুদ্ধ! মস্তকছিন্ন তালবৃক্ষ পুনর্বৃদ্ধির অযোগ্য হয়, সেইরূপই অনুরুদ্ধ! তথাগতের যে সব আস্রব ...... দুঃখফলোৎপাদক তাহা ভবিষ্যতে অনুৎপত্তি স্বভাবে প্রহীণ হইয়াছে। সেই কারণে তথাগত বিচার করিয়া একের সেবন করে ...... অপনোদন করে।”

“অনুরুদ্ধ! তাহা কি মনে কর? কি উপকার দেখিয়া তথাগত অতীত, কালগত শ্রাবকদিগের উৎপত্তি সম্বন্ধে বিবৃত করেন,- ‘অমুক অমুক স্থানে উৎপন্ন; অমুক অমুক স্থানে উৎপন্ন?”

“ভন্তে! আমাদের ধর্ম ভগবম্মূলক, ভগবন্নেতৃক, ভগবদ্‌ প্রতিশরণ। সাধু, ভন্তে! এই ভাষিত শব্দের অর্থ ভগবানেরই প্রতিভাত হউক। ভগবানের উপদেশ শ্রবণ করিয়া ভিক্ষুরা ধারণ করিবেন।”

“অনুরুদ্ধ! তথাগত অতীত কালগত শ্রাবকদের উৎপত্তি সম্বন্ধে প্রকাশ করেন,- অমুক অমুক স্থানে উৎপন্ন হইয়াছেন, অমুক অমুক স্থানে উৎপন্ন হইয়াছে।’ ইহা জন-প্রতারণার জন্য নহে, জন-তুষ্টিকর সংলাপের জন্য নহে, লাভ-সৎকার বা কীর্তি-প্রশংসার নিমিত্ত নহে, এভাবে জনসাধারণ আমাকে জানুক- এই খ্যাতির জন্যও নহে। অনুরুদ্ধ! উদার সন্তোষ পরায়ণ, প্রমোদ্য বহুল শ্রদ্ধাবান এমন কুলপুত্রগণ আছে তাহারা এ বিষয় শুনিয়া তাহা লাভের নিমিত্ত চিত্ত নিয়োজিত করে। অনুরুদ্ধ! ইহা তাহাদের দীর্ঘকালের হিত-সুখের নিদান হয়।”

১৬৯। “অনুরুদ্ধ! এখানে কোন ভিক্ষু শুনিতে পাইল যে এই নামের ভিক্ষু কালগত হইয়াছে। সে অর্হত্বে (অঞ্‌ঞায) প্রতিষ্ঠিত বলিয়া ভগবান কর্তৃক ঘোষিত। সেই (মৃত) আয়ুষ্মান তাহার স্বয়ং দৃষ্ট, অথবা জন-পরম্পরা শ্রুত যে সেই আয়ুষ্মান এরূপ শীলবান ছিলেন, এরূপ স্বভাবের ছিলেন, এরূপ প্রজ্ঞাবান, এরূপ ফল-সমাপত্তি বিহারী, এরূপ চিত্ত-বিমুক্ত, প্রজ্ঞা-বিমুক্ত ছিলেন। সে তাঁহার শ্রদ্ধা, শীল, শ্রুত, ত্যাগ এবং প্রজ্ঞা অনুস্মরণ করিতে করিতে তদবস্থা প্রাপ্তির নিমিত্ত চিত্ত নিয়োজিত করে। এইরূপেও অনুরুদ্ধ! সে ভিক্ষুর সুখবিহার হয়।”

“ ...... অনাগামিত্বে, সকৃদাগামিত্বে, স্রোতাপন্নে প্রতিষ্ঠিত ...... এইরূপেও অনুরুদ্ধ! সে ভিক্ষুর সুখবিহার হয়।”

১৭০-১৭২। অনুরুদ্ধ! এখানে কোন ভিক্ষুণী, কোন উপাসক, কোন উপাসিকা ...... এইরূপেও অনিরুদ্ধ! সে ...... উপাসিকার সুখবিহার হয়।”

“অনুরুদ্ধ! এই কারণে তথাগত অতীত কালগত শ্রাবকের পুনরুৎপত্তি সম্বন্ধে ঘোষণা করেন ...... ইহা তাহাদের দীর্ঘকালের হিত-সুখের নিদান হয়।”

ভগবান ইহা বলিলেন। আয়ুষ্মান অনুরুদ্ধ সন্তুষ্টচিত্তে তাহা অভিনন্দন করিলেন।

॥ নলকপান সূত্র সমাপ্ত ॥

গুলিস্‌সনি সূত্র (৬৯)

১৭৩। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-

এক সময় ভগবান রাজগৃহের বেণুবন কলন্দকনিবাপে বাস করিতেছেন। সেই সময় আচার-দুর্বল গুলিস্‌সানি নামক আরণ্যক ভিক্ষু কোন কর্মোপলক্ষে সংঘমধ্যে আহুত হইয়াছিলেন। তথায় আয়ুষ্মান সারিপুত্র গুলিস্‌সানি ভিক্ষুকে উপলক্ষ করিয়া ভিক্ষুদিগকে আহ্বান করিলেন,- “বন্ধু! সংঘে আগত, সংঘে অবস্থিত অরণ্যবাসী ভিক্ষুর পক্ষে সব্রহ্মচারীদের (গুরুভাইদের) প্রতি গৌরবযুক্ত ও সসম্ভ্রম ব্যবহার হওয়া উচিত। যদি বন্ধু! সংঘে আগত ...... আরণ্যক ভিক্ষু সব্রহ্মচারীদের প্রতি গৌরব ও সম্মানহীন হয়, তবে তাহাকে বলিবার লোক থাকে যে- ‘এই আরণ্যক আয়ুষ্মানের একাকী অরণ্যে স্বৈরী (স্বেচ্ছাচারী) বিহারীর কি (ফল)? যখন সেই আয়ুস্মান সব্রহ্মচারীদের প্রতি অগৌরব ও অসম্মানযুক্ত।’ ......ইহার এইরূপ বলিবার লোক থাকে। সেই কারণে সংঘে অবস্থিত অরণ্যবাসী ভিক্ষুর ...... স্বব্রহ্মচারীদের প্রতি গৌরব ও সম্মানযুক্ত হওয়া উচিত।” (১)

“বন্ধু! সংঘে আগত, সংঘে অবস্থিত আরণ্যক, ভিক্ষুর আসন-কুশল (বসায় চতুর) হওয়া উচিত যে স্থবির (বয়োবৃদ্ধ) ভিক্ষুদিগকে ঘেঁসাঘেঁসি করিয়া বসিব না এবং নবভিক্ষুগণকে আসনে বাধা দিব না। যদি আবুসো! সংঘের মধ্যে আরণ্যক ভিক্ষু আসন-কুশল না হয় তবে তাহার সম্বন্ধে বলিবার লোক থাকে,- ‘এই আরণ্যক আয়ুষ্মানের স্বৈরী বিহারে কি (ফল)? যখন এই আয়ুষ্মান অভিসমাচারিক ব্রত-প্রতিব্রত মাত্রও জানে না।’ এইরূপে তাহাকে বলিবার লোক থাকে। সেই কারণে ..... ।” (২)

“আবুসো! আরণ্যক ভিক্ষুর অতি সকালে গ্রামে প্রবেশ না করা উচিত, অতি দিবায় বা গৌণে (গ্রাম হইতে) প্রত্যাবর্তন না করা উচিত। যদি বন্ধু! ......।” (৩)

“আরণ্যক ভিক্ষুর পক্ষে ভোজন সময়ের পূর্বে ও পশ্চাতে (গৃহী) কুলে বিচরণ করা অনুচিত .....। যদি বন্ধু ......।” (৪)

“ ...... আরণ্যক ভিক্ষুর অনুদ্ধত, অচপল হওয়া উচিত। যদি বন্ধু! ......।” (৫)

“ ...... অমুখর অবিকীর্ণভাষী হওয়া উচিত। যদি আবুসো! ......।” (৬)

“ ...... সুবাধ্য (সুবোচ), কল্যাণমিত্র হওয়া উচিত। যদি বন্ধু! ......।” (৭)

“ ...... ইন্দ্রিয় সমূহে গুপ্ত-দ্বার (সংযমী) হওয়া উচিত। যদি বন্ধু ......।” (৮)

“...ভোজনে মাত্রাজ্ঞ (পরিমাণজ্ঞ) হওয়া উচিত। যদি আবুসো!...।” (৯)

“ ...... জাগরণে অনুপ্রাণিত হওয়া উচিত। যদি আবুসো! ......।” (১০)

“ ...... আরদ্ধ বীর্য (উদ্যোগী) হওয়া উচিত। যদি বন্ধু! ......।” (১১)

“ ...... উপস্থিত-স্মৃতি (সাবধান) হওয়া উচিত। যদি বন্ধু! ......।” (১২)

“ ...... সমাহিত (সমাধিযুক্ত) হওয়া উচিত। যদি বন্ধু! ......।” (১৩)

“ ...... প্রজ্ঞাবান (কর্তব্যে উপায়-প্রজ্ঞাযুক্ত) হওয়া উচিত। যদি বন্ধু! ......।” (১৪)

“...... অভিধর্মে, অভিবিনয়ে মনোযোগ দেওয়া উচিত। যদি বন্ধু! ......।” (১৫)

“বন্ধু! আরণ্যক ভিক্ষুকে অভিধর্ম ও অভিবিনয় সম্বন্ধে প্রশ্নকর্তা আছে। যদি বন্ধু! আরণ্যক ভিক্ষু অভিধর্মের ও অভিবিনয়ের সম্বন্ধে প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হইয়া সমাধান করিতে অসমর্থ হয়, তবে তাহার সম্বন্ধে বক্তা থাকে যে- ‘আরণ্যক আয়ুষ্মানের অরণ্যে একাকী স্বৈরী বিহারের কি প্রয়োজন?’ ......।” (১৬)

“রূপকে অতিক্রম করিয়া যে সকল আরুপ্য (অজর, চেতন) শান্তবিমোক্ষ (শমথ ধ্যান) আছে, উহাতে মনোযোগ দেওয়া উচিত। বন্ধু! শান্তবিমোক্ষ সম্বন্ধে প্রশ্নকর্তাও আছে। যদি বন্ধু! ......।” (১৭)

“ ...... উত্তর-মনুষ্যধর্মে (লোকোত্তর মার্গ-ফলে) মনোযোগ দেওয়া উচিত। বন্ধু! উত্তর-মনুষ্যধর্ম সম্বন্ধে অরণ্যবাসীকে প্রশ্ন করিবার লোক আছে। যদি বন্ধু! অরণ্যবাসী ভিক্ষু ...... জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের সন্তোষ জনক উত্তর করিতে অসমর্থ হয়, তবে তাহাকে বলিবার লোক আছে- ‘এই আরণ্যক আয়ুষ্মানের একাকী অরণ্যে স্বতন্ত্র বাসের কি (ফল)? যখন এই আয়ুষ্মান যাহার নিমিত্ত প্রব্রজিত হইয়াছেন, সেই পরমার্থ জানেন না।’ এইরূপে তাহাকে বলার বক্তা থাকিবে। সে কারণে আরণ্যক ভিক্ষুর পক্ষে উত্তর-মনুষ্যধর্ম সম্বন্ধে মনোযোগ দেওয়া কর্তব্য।” (১৮)

এইরূপ উক্ত হইলে আয়ুষ্মান মহামোগ্গলায়ন আয়ুষ্মান সারিপুত্রকে বলিলেন,- “বন্ধু সারিপুত্র! কেবল আরণ্যক ভিক্ষুকেই কি এই ধর্মসমূহ গ্রহণ করিয়া আচরণ করিতে হয়? অথবা গ্রামান্ত বিহারী ভিক্ষুদেরও?”

“আবুসো মোগ্গলায়ন! অরণ্যবাসী ভিক্ষুও এই ধর্মসমূহ গ্রহণ করিয়া পালন করা উচিত, গ্রামান্তবাসী ভিক্ষুদের জন্য কথাই কি?”

॥ গুলিস্‌সানি সূত্র সমাপ্ত ॥

কীটাগিরি সূত্র (৭০)

১৭৪। আমি এইরূপ শুনিয়াছি,-

এক সময় মহাভিক্ষুসংঘের সহিত ভগবান কাশী প্রদেশে চারিকা করিতেছেন। তথায় ভগবান ভিক্ষুদিগকে আমন্ত্রণ করিলেন,- “ভিক্ষুগণ! আমি রাত্রি ভোজনে বিরত হইয়া দিনে ভোজন করি। ...... রাত্রি ভোজন ছাড়িয়া ভোজন করায় আমি নীরোগ, নিরাতঙ্ক, লঘুভাব, বল ও সুখ-বিহার অনুভব করিতেছি। এস, ভিক্ষুগণ! তোমরাও রাত্রি ভোজনে বিরত হইয়া দিনে ভোজন কর, ...... রাত্রি-ভোজন ত্যাগ করিয়া ভোজন করিলে তোমরা ...... সুখ-বিহার অনুভব করিবে।”

“হাঁ, ভন্তে!” (বলিয়া) সেই ভিক্ষুগণ ভগবানের প্রত্যুত্তর দিলেন।

তখন ভগবান কাশীজনপদে ক্রমশঃ পরিক্রমা করিতে করিতে যেখানে কাশীবাসীদের নিগম কীটাগিরি ছিল তথায় উপনীত হইলেন। তথায় কাশীবাসীদের নিগম কীটাগিরিতে ভগবান বাস করিতেছেন।

১৭৫। সেই সময় কীটাগিরিতে অশ্বজিৎ ও পুনর্বসু নামক (দুই বর্গের) ভিক্ষুগণ আবাসিক ছিলেন। তখন বহু ভিক্ষু যেখানে অশ্বজিৎ ও পুনর্বসু বর্গীয় ভিক্ষুগণ ছিলেন তথায় উপনীত হইলেন, উপস্থিত হইয়া ...... বলিলেন,- “বন্ধুগণ! ভগবান ও ভিক্ষুসংঘ রাত্রি ভোজনে বিরত হইয়া ভোজন করেন। রাত্রি ভোজনে বিরত হইয়া ভোজন করায় ...... বল ও স্বস্তিভাব উপভোগ করিতেছেন। আসুন, আপনারাও রাত্রি ভোজনে বিরত হইয়া ভোজন করুন। ...... তাহাতে নীরোগ, নিরাতঙ্ক ...... বল ও সুখ-বিহার উপভোগ করুন।”

ইহা উক্ত হইলে অশ্বজিৎ ও পুনর্বসুক ভিক্ষুগণ তাঁহাদিগকে বলিলেন,- “ভ্রাতাগণ! আমরা সন্ধ্যায় ভোজন করি, প্রাতে, দ্বিপ্রহরে ও বিকালে ভোজন করি। সুতরাং আমরা সন্ধ্যা, প্রাতঃ, দিবা ও বিকালে ভোজন করিয়া আরোগ্য ...... সুখ-বিহার করিতেছি। এমতাবস্থায় আমরা কি প্রত্যক্ষে তাহা ছাড়িয়া অনাগতকালীয় ফলের নিমিত্ত অনুধাবন করিব? আমরা সন্ধ্যায়, প্রাতে, মধ্যাহ্নে ও বিকালে ভোজন করিব।”

যখন সেই সকল ভিক্ষু অশ্বজিৎ ও পুনর্বসু বর্গীয় ভিক্ষুদিগকে বুঝাইতে অসমর্থ হইলেন, তখন তাঁহারা যেখানে ভগবান আছেন সেখানে গেলেন; গিয়া ভগবানকে অভিবাদন করিয়া একপ্রান্তে বসিলেন, একান্তে উপবিষ্ট সে ভিক্ষুগণ ভগবানকে বলিলেন,- “ভন্তে! আমরা ...... অশ্বজিৎ ও পুনর্বসুক ভিক্ষুদের নিকট গিয়া বলিয়াছিলাম,- ‘বন্ধুগণ! ভগবান ও ভিক্ষুসংঘ রাত্রি ভোজনে বিরত ......।’ এইরূপ কথিত হইলে, ভন্তে! অশ্বজিৎ ও পুনর্বসুক ভিক্ষুগণ বলিলেন,- ‘বন্ধু! আমরা সায়াহ্নে ...... ভোজন করি ......।’ আমরা অশ্বজিৎ ও পুনর্বসু বর্গীয় ভিক্ষুদিগকে বুঝাইতে অসমর্থ হইলাম। সুতরাং আমরা তৎসম্বন্ধে ভগবানকে নিবেদন করিতেছি।”

১৭৬। তখন ভগবান অন্যতর ভিক্ষুকে ডাকিলেন,- “এস ভিক্ষু! তুমি আমার আদেশে অশ্বজিৎ ও পুনর্বসুক ভিক্ষুদিগকে বল,- শাস্তা আয়ুষ্মানগণকে ডাকিতেছেন’।”

“হাঁ, ভন্তে!” (বলিয়া) ভগবানকে উত্তর দিয়া সেই ভিক্ষু ..... অশ্বজিৎ ও পুনর্বসুক ভিক্ষুদের নিকট গিয়া ...... বলিলেন,- ‘শাস্তা আয়ুষ্মানগণকে ডাকিতেছেন’।”

“হাঁ, আবুসো!” (বলিয়া) ...... অশ্বজিৎ ও পুনর্বসুক ভিক্ষুরা যেখানে ভগবান আছেন তথায় গেলেন, গিয়া ভগবানকে অভিবাদন পূর্বক একান্তে বসিলেন, একান্তে উপবিষ্ট অশ্বজিৎ ও পুনর্বসুক ভিক্ষুদিগকে ভগবান বলিলেন,- “সত্য কি হে ভিক্ষুগণ! কয়েকজন ভিক্ষু তোমাদের নিকট উপস্থিত হইয়া বলিয়াছিল,- ‘বন্ধুগণ! ভগবান ও ভিক্ষুসংঘ রাত্রি ও বিকাল-ভোজনে বিরত হইয়াছেন ...... ?’ ইহা উক্ত হইলে ভিক্ষুগণ! তোমরা বলিয়াছ ..... ?”

“হাঁ, ভন্তে!”

১৭৭। “ভিক্ষুগণ! তোমরা আমাকে এমন কোন ধর্মোপদেশ করিতে জান কি যে এই পুরুষ-পুদ্গল সুখ, দুঃখ কিংবা অদুঃখ, অসুখ, যাহা কিছু অনুভব করে তাহাতে তাহার অকুশলধর্ম প্রহীণ হইবে, কুশলধর্ম অভিবৃদ্ধি হইবে?

“না, ভন্তে!”

“ভিক্ষুগণ! তোমরা আমাকে এরূপ ধর্মোপদেশ করিতে জান নহে কি?- ‘এখানে কাহারও এরূপ সুখবেদনা অনুভব করিবার সময় অকুশলধর্ম অভিবৃদ্ধি হয় এবং কুশলধর্ম পরিহীন হয়? কিংবা কাহারও এরূপ সুখ-বেদনা অনুভব করিতে করিতে অকুশলধর্ম পরিহীন হয়, কুশলধর্ম অভিবৃদ্ধি হয়? ...... কাহারও দুঃখবেদনা, কাহারও অদুঃখ-অসুখ বেদনা অনুভব করিবার সময় অকুশলধর্ম নষ্ট হয়, কুশলধর্ম বৃদ্ধি হয়?”

“হঁ, ভন্তে!”

১৭৮। “সাধু, ভিক্ষুগণ! যদি ইহা আমার প্রজ্ঞাদ্বারা অজ্ঞাত, অদৃষ্ট, অবিদিত, অপ্রত্যক্ষভুত ও অস্পর্শিত থাকিত যে এখানে কাহারও এরূপ সুখবেদনা ভোগ করিতে করিতে অকুশলধর্ম অভিবৃদ্ধি হয়, কুশলধর্ম নষ্ট হয়, আমি যথার্থ না জানিয়া ‘এরূপ সুখবেদনা পরিত্যাগ কর’ বলিতাম, তবে কি ভিক্ষুগণ! ইহা আমার পক্ষে উচিত হইত?”

“না, ভন্তে!”

“যেহেতু, হে ভিক্ষুগণ! ইহা আমার প্রজ্ঞায় জ্ঞাত, দৃষ্ট, বিদিত, সাক্ষাৎকৃত ও স্পর্শিত ......। সে কারণে আমি বলি,- ‘এরূপ সুখবেদনা পরিহার কর।’ আর যদি আমার প্রজ্ঞায় ইহা- হয় ...... অস্পর্শিত হইত, ইহা না জানিয়া যদি আমি বলিতাম,- ‘এই প্রকার সুখবেদনা লাভ করিয়া বিহার কর’, তবে কি ভিক্ষুগণ! আমার পক্ষে ইহা সমীচীন হইত?”

“না, ভন্তে!”

“যেহেতু ভিক্ষুগণ! ইহা আমার জ্ঞাত, দৃষ্ট, বিদিত, সাক্ষাৎকৃত, প্রজ্ঞায় স্পর্শিত,- ‘এখানে কাহারও ...... অকুশলধর্ম পরিহীন হয়, কুশলধর্মের অভিবৃদ্ধি হয়।’ সেই কারণে আমি বলি,- ‘এই প্রকার সুখবেদনা লাভ করিয়া অবস্থান কর .....।”

১৭৯। [দুঃখবেদনাকেও উক্ত প্রকারে বিস্তার করিতে হইবে।]

১৮০। [অদুঃখ-অসুখ বেদনাকেও উক্ত প্রকারে বিস্তার করিতে হইবে।]

১৮১। “ভিক্ষুগণ! সকল ভিক্ষুর পক্ষে অপ্রমাদে করণীয় আছে, ইহা আমি বলি না। আর সকল ভিক্ষুর পক্ষেই অপ্রমাদে করণীয় নাই, তাহাও বলি না। ভিক্ষুগণ! যে সকল ভিক্ষু অর্হৎ, ক্ষীণাস্রব, মার্গ-ব্রহ্মচর্য যাহাদের পরিপূর্ণ, কৃত করণীয়, স্কন্ধ-ভার মুক্ত, সদর্থ (অর্হত্ব) অনুপ্রাপ্ত, ভব-সংযোজন (বন্ধন) রহিত, সম্যক্‌ জ্ঞাত হইয়া বিমুক্ত হইয়াছে; ভিক্ষুগণ! তথাবিধ ভিক্ষুগণের অপ্রমাদে কর্তব্য আছে, ইহা বলি না। তাহার কারণ কি? ...... তাহাদের অপ্রমাদে করণীয় সমাপ্ত হইয়াছে, আর তাহাদের পক্ষে প্রমত্ততা অসম্ভব। ভিক্ষুগণ! যাহারা শৈক্ষ্য, অপূর্ণ-মানস, অনুত্তর যোগক্ষেম (নির্বান) সন্ধানে নিরত আছে, তথাবিধ ভিক্ষুগণের অপ্রমাদের প্রয়োজন আছে, ইহাই আমি বলিতেছি। তাহার কারণ কি? ...... সম্ভবতঃ এই আয়ুষ্মান ধ্যানানুকূল শয্যা-আসন সেবনে কল্যাণ মিত্রের সাহচর্যে, ইন্দ্রিয় সমূহের সমন্বয় সাধন করিয়া যার জন্য কুলপুত্রগণ আগার হইতে অনাগারে সম্যক্‌রূপে প্রব্রজিত হয়; সেই অনুত্তর ব্রহ্মচর্যের অবসান (অর্হত্ব) প্রত্যক্ষ জীবনে স্বীয় অভিজ্ঞা দ্বারা সাক্ষাৎ ও উপলব্ধি করিয়া অবস্থান করিতে পারে। ভিক্ষুগণ! অপ্রমাদে এই মহৎ ফলের সম্ভাবনা দেখিয়াই আমি সে সকল ভিক্ষুর ‘অপ্রমাদে করণীয় আছে’ ইহা বলি।”

১৮২। “ভিক্ষুগণ! জগতে সাতপ্রকার পুদ্গল বিদ্যমান। সাতজন কে? (১) উভয় ভাগ (দুই দিগ্‌ হইতে) বিমুক্ত, (২) প্রজ্ঞা-বিমুক্ত, (৩) কায়সাক্ষী (৪) দৃষ্টিপ্রাপ্ত, (৫) শ্রদ্ধা-বিমুক্ত, (৬) ধর্মানুসারী ও (৭) শ্রদ্ধানুসারী।”

“ভিক্ষুগণ! উভয় ভাগ বিমুক্ত পুদ্গল কে? ভিক্ষুগণ! এধর্মে রূপকে (সাকার চারি ধ্যান ব্রহ্মকে) অতিক্রম করিয়া যে সব আরুপ্য (নিরাকার ব্রহ্মের) চারি শান্ত-বিমোক্ষ বিদ্যমান, যে ব্যক্তি যে সকল বিমোক্ষ চেতন-দেহে সংস্পর্শ করিয়া বিহার করে এবং যাহার সমস্ত আস্রব প্রজ্ঞাদ্বারা পরিহীন হইয়াছে (অর্থাৎ যে ব্যক্তি শমথ ধ্যানের অরূপ সমাপত্তি দ্বারা জড়দেহ হইতে মুক্ত এবং বিদর্শনমার্গ-প্রজ্ঞায় আস্রব ক্ষয় করিয়া চেতন-দেহ হইতে মুক্ত হইয়াছে) ভিক্ষুগণ! সেই ব্যক্তিই উভয় ভাগ বিমুক্ত নামে অভিহিত হয়। আমি এই ভিক্ষুর ‘অপ্রমাদে করণীয় নাই’ ইহাই বলি। ইহার কারণ কি? ...... তাহার অপ্রমাদে কর্তব্য কৃত হইয়াছে, আর প্রমত্ত হওয়া তাহার পক্ষে অসম্ভব।” (১)

“ভিক্ষুগণ! কোন্‌ পুদ্গল প্রজ্ঞা-বিমুক্ত? ভিক্ষুগণ! এই ধর্মে রূপকে অতিক্রম করিয়া যে সব আরুপ্য শান্ত-বিমোক্ষ বিদ্যমান, যে ব্যক্তি তাহা নামকায়ে (চেতন-দেহে) স্পর্শ করিয়া বিহার করে না, অথচ প্রজ্ঞাদ্বারা দর্শন করিয়া তাহার সকল আস্রব পরিক্ষীণ হইয়াছে, এই পুদ্গল প্রজ্ঞা-বিমুক্ত নামে কথিত হয়। ভিক্ষুগণ! এই ভিক্ষুরও অপ্রমাদের করণীয় নাই, ইহা বলি। ইহার কারণ কি? তাহারও অপ্রমাদের কর্তব্য শেষ হইয়াছে, তাহার পক্ষে আর প্রমত্ত হওয়া অসম্ভব।” (২)

“ভিক্ষুগণ! কোন্‌ পুদ্গল কায়সাক্ষী? ভিক্ষুগণ! এখানে কোন পুদ্গল ...... সেই শান্ত-বিমোক্ষকে স্পর্শ করিয়া বিহার করে না, অথচ মার্গ-প্রজ্ঞায় দেখিয়া তাহার (মার্গানুরূপ) কোন কোন আস্রব পরিক্ষীণ হইয়াছে, ভিক্ষুগণ! এই ব্যক্তি কায়সাক্ষী নামে কথিত হয়। ভিক্ষুগণ! এই ভিক্ষুর এখনও অপ্রমাদে করণীয় আছে, ইহা বলিতেছি। তাহার হেতু কি? সম্ভবতঃ এই আয়ুষ্মান অনুকূল শয্যা .....সেই অনুত্তর ব্রহ্মচর্যের অবসান ইহ-জীবনে লাভ করিয়া বিহার করিবে। ...।”(৩)

“ভিক্ষুগণ! দৃষ্টি-প্রাপ্ত পুদ্গল কে? ভিক্ষুগণ!......কায়দ্বারা স্পর্শ করিয়া বিহার করে না ...... অথচ কোন কোন আস্রব প্রহীণ হইয়াছে। ...... তথাগতের বিদিত ও বর্ণিত ধর্ম তাহার মার্গ-প্রজ্ঞা দ্বারা সুদৃষ্ট ও সুপ্রতিভাত হয়। ভিক্ষুগণ! সে দৃষ্টি-প্রাপ্ত নামে কথিত হয়। ......।” (৪)

“ভিক্ষুগণ! কোন্‌ পুদ্গল শ্রদ্ধা-বিমুক্ত? ...... প্রজ্ঞাদ্বারা কোন কোন আস্রব প্রহীণ হইয়াছে। ....... তথাগতের প্রতি তাহার উপযুক্ত শ্রদ্ধা প্রতিষ্ঠিত, মূলীভূত ও নিবিষ্ট হয়। ...... সে শ্রদ্ধা-বিমুক্ত ......।” (৫)

“ভিক্ষুগণ! কোন্‌ পুদ্গল ধর্মানুসারী ? ভিক্ষুগণ! এখানে কোন কোন পুদ্গল যে সকল শান্ত রূপারূপ অষ্ট বিমোক্ষ বিদ্যমান, সেই সব (সহজাত) নাম-কায়ে স্পর্শ করিয়া বিহার করে না। তাহার প্রজ্ঞাদ্বারা আর্যসত্য দর্শন করিয়া আস্রব পরিক্ষীণ হয় নাই। অথচ তথাগত প্রবর্তিত সত্যধর্ম তাহার প্রজ্ঞাদ্বারা স্বল্প পরিমাণে নিধ্যান বা দর্শন করিতে সমর্থ হয়, আর তাহার এই পঞ্চ ইন্দ্রিয়ধর্ম প্রাদুর্ভূত হয়, যথা- শ্রদ্ধেন্দ্রিয়, বীর্যেন্দ্রিয়, স্মৃতীন্দ্রিয়, সমাধীন্দ্রিয় ও প্রজ্ঞেন্দ্রিয়। ভিক্ষুগণ! সে ব্যক্তিই ধর্মানুসারী নামে কথিত হয়।” (৬)

“ভিক্ষুগণ! কোন্‌ পুদ্গল শ্রদ্ধানুসারী ? ....তথাগতের প্রতি তাহার শ্রদ্ধামাত্র ও প্রেমমাত্র জাগ্রত হয়, আর এই সকল ইন্দ্রিয়ধর্ম প্রাদুর্ভূত হয়, যথা- শ্রদ্ধা-ইন্দ্রিয়, বীর্য-ইন্দ্রিয়, স্মৃতি-ইন্দ্রিয়, সমাধি-ইন্দ্রিয় ও প্রজ্ঞা-ইন্দ্রিয়। ভিক্ষুগণ! ইহাতেই বলা হয় শ্রদ্ধানুসারী (শ্রদ্ধাপূর্বক মার্গ ভাবনাকারী)।” [তৃতীয় হইতে সপ্তম পর্যন্ত এই পাঁচজনের অপ্রমাদে করণীয় বিদ্যমান।](৭)

১৮৩। ভিক্ষুগণ! আমি প্রথমেই (মণ্ডূকাপ্লুত ন্যায়েই) অর্হত্বে প্রতিষ্ঠা (অঞ্‌ঞারাধনা) বলি না। অপিচ আনুপূর্বিক (ক্রমশঃ) শিক্ষা, আনুপূর্বিক ক্রিয়া ও আনুপূর্বিক প্রতিপদা দ্বারাই অর্হত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়। ভিক্ষুগণ! ...... আনুপূর্বিক প্রতিপদা দ্বারা কিরূপে অর্হত্বে প্রতিষ্ঠা হয়? ভিক্ষুগণ! এখানে বিশ্বস্ত শ্রাবক গুরু সমীপে উপনীত হয়, উপনীত হইয়া উপাসনা করে, শুশ্রূষা করিয়া শ্রোত্রাবহিত হয় (কর্ণপাত করে), অবহিত শ্রোত্রে ধর্ম শ্রবণ করে, ধর্ম শুনিয়া (প্রগুণভাবে) ধারণ করে, ধৃত ধর্মরাজির অর্থ পরীক্ষা করে, অর্থ পরীক্ষা করিয়া ধর্ম চিন্তা করিতে সক্ষম হয়, ধর্ম চিন্তায় সক্ষম হইলে ধর্মের প্রতি ছন্দ বা আগ্রহ জন্মে, জাত-ছন্দ উৎসাহিত হয়, উৎসাহিত হইয়া (ত্রিলক্ষণে) তুলনা (নির্ধারণ) করে, তুলনা করিয়া বীর্যারম্ভ করে, সেই আরব্ধবীর্য এই নাম-কায় দ্বারা পরম সত্য নির্বান সাক্ষাৎকার করে এবং (নাম-কায় সংযুক্ত) মার্গ-প্রজ্ঞা দ্বারা প্রতিবেধ করিয়া উহা প্রত্যক্ষ করে।”

“ভিক্ষুগণ! সেই শ্রদ্ধা যদি না থাকে তাহা হইলে উপসংক্রমণ হয় না, ....সেই বীর্য-আরম্ভও হয় না....। সুতরাং ভিক্ষুগণ! উম্মার্গ প্রতিপন্ন ও মিথ্যা-মার্গ অবলম্বন হেতু এই সকল মোঘপুরুষ এই ধর্মবিনয় হইতে কতদূরে অপসৃত হইয়াছে।”

১৮৪। “ভিক্ষুগণ! চারিপদ (আর্যসত্য) প্রকাশিত আছে, যাহার উদ্দেশ মাত্রেই বিজ্ঞপুরুষ অচিরেই প্রজ্ঞাদ্বারা অর্থ হৃদয়ঙ্গম করিতে পারে। ভিক্ষুগণ! তোমাদিগকে উদ্দেশ করিব, উদ্দিষ্টের অর্থ তোমরা জানিতে পার কি?”

“ভন্তে! আমরা কোথায়? আর ধর্মের জ্ঞাতারাই বা কোথায়?”

“ভিক্ষুগণ! যে শাস্তা আমিষ-গুরু (লুব্ধ), আমিষ দায়াদ, আমিষ সংশ্লিষ্ট হইয়া বিহার করে তাহারও এতাদৃশ পণ্যাপণ্যবৎ (দাম কষাকষির ন্যায়) ব্যবহার করা উচিত নহে,- ‘আমাদের এরূপ হউক, তখন আমরা ইহা করিতে পারি। আমাদের এরূপ না হইলে আমরা ইহা করিতে পারি না।’ ভিক্ষুগণ! যিনি সর্বথা আমিষ নির্লিপ্ত হইয়া বিহার করেন, সেই তথাগত সম্বন্ধে কি বক্তব্য?”

“ভিক্ষুগণ! শাস্তার শাসন শিরোধার্য করিয়া একাকী গ্রহণকারী অনুগত শ্রাবকের এই আদর্শ স্বভাব হওয়া উচিত- ‘ভগবান আমার শাস্তা (শিক্ষাদাতা), আমি শ্রাবক (শিষ্য) হই; ভগবান (এক আহার ভোজনের) সুফল জানেন, আমি তাহা জানি না।’ ভিক্ষুগণ! গুরু-উপদেশ শিরোধার্য করিয়া অনুবর্তনকারী বিশ্বস্ত শিষ্যের নিমিত্ত শাস্তার শাসন ওজঃবন্ত (সরস) ও বিরূঢ়নীয় (বর্ধনীয়) হয়। ভিক্ষুগণ! গুরু-উপদেশ শিরোধার্য বা জীবন-মরণ পণ করিয়া আচরণকারী শিষ্যের ইহাই অনুধর্মতা,- একান্তই ত্বক, ্লায়ু ও অস্থি অবশিষ্ট থাকুক, শরীরের সমস্ত রক্ত-মাংস শুষ্ক হউক তথাপি পুরুষশক্তি পুরুষবীর্য পুরুষপরাক্রমে যাহা প্রাপ্তব্য, তাহা প্রাপ্ত না হইয়া বীর্যের সংস্থান হইবে না।’ ভিক্ষুগণ! গুরু-উপদেশ জীবন-মরণ পণ করিয়া আচরণকারী শ্রদ্ধাবান শিষ্যের ইহজীবনে অর্হত্ব অথবা উপাদান অবশিষ্ট থাকিলেও অনাগামিত্ব- এই দ্বিবিধ ফলের অন্যতর নিশ্চয় প্রত্যাশা করা যায়।”

ভগবান ইহা বলিলেন। সেই ভিক্ষুগণ সন্তুষ্টচিত্তে তথাগতের ভাষণ অভিনন্দন করিলেন।

॥ কীটাগিরি সূত্র সমাপ্ত ॥

॥ দ্বিতীয় ভিক্ষুবর্গ সমাপ্ত ॥