৫৫.ভদ্দিয় বর্গ

১.লকুণ্ডক ভদ্দিয় স্থবির অপদান

এই স্থবিরও অতীত বুদ্ধগণের নিকট বিবিধপুণ্যকর্ম করে জন্মজন্মান্তরে সুখদপুণ্যসঞ্চয় করতে করতে পদুমুত্তর ভগবানের সময় এক কুলিন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। একদিন তিনি শাস্তার ধর্মদেশনা শুনতে গেলেন। তখন শাস্তা এক ভিক্ষুকে মধুরভাষী ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠপদে স্থাপন করছিলেন। তা দেখে তিনি নিজেও সেই শ্রেষ্ঠপদ লাভের ইচ্ছায় বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষুসংকে ঘি, গুড়, প্রভৃতি মধুররসসিক্তবস্তু দান করে প্রার্থনা করলেন, ‘ভন্তে, আমিও যাতে ভবিষ্যতে এই ভিক্ষুর ন্যায় কোনো এক বুদ্ধের শাসনেমধুরভাষী ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠপদ লাভ করি।’ ভগবান তোমার প্রার্থনা পূর্ণ হবে বলে চলে গেলেন।

তারপর তিনি আজীবন পুণ্যকর্ম করে দেবমনুষ্যলোকে বিচরণকালে উভয় সম্পত্তিভোগ করে ফুশ্য ভগবানের সময় চিত্রকোকিল হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। একসময় কোকিল রাজ্যেদ্যান হতে মধুর আম্রফল ঠোঁটে করে নিচ্ছিল, এমন সময় ভগবানকে দেখতে পেল। তখন তার প্রসন্ন মনে আম্র দানের ইচ্ছা উৎপন্ন হলো। ভগবান তার মনোভাব জ্ঞাত হয়ে পাত্র হাতে নিয়ে বসে রইলেন। কোকিল দশবলের পাত্রে পাকা আম্র দান করল। ভগবান কোকিল দেখে মতো করে সেই আম্রটি খেলেন। কোকিল তা দেখে সপ্তাহকাল প্রীতিসুখে অতিবাহিত করল। সেই পুণ্যফলেই সে মধুরভাষী হয়েছিল।

কাশ্যপ ভগবানের সময় তিনি এক কারিগর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এক কারিগর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দক্ষকারিগর হিসেবে বেশ খ্যাতি অর্জন করেন। কাশ্যপ ভগবান পরিনির্বাণ লাভের পর তাঁর উদ্দেশে একটি সাতযোজন মন্দির নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়। তখন তিনি বলেন, এত বড় মন্দির তৈরি করা কষ্টকর হবে। তার থেকে ছোট মন্দির তুললে ভালো হয়। তার কথায় সবাই একবাক্যে সম্মত হলো। অপ্রমাণ বুদ্ধের প্রমাণ ছোট করার কারণে তিনি জন্মে জন্মে অন্যান্য লোক হতে ছোট হযে জন্মগ্রহণ করতেন।

আমাদের গৌতম বুদ্ধের সময় তিনি শ্রাবস্তীর এক মহাধনাঢ্য কুলে জন্মগ্রহণ করেন। তার নাম রাখা হলো ‘ভদ্দিয়’ । লম্বায় অতিশয় খাট ছিলেন বিধায় তিনি ‘লকুণ্ডক ভদ্দিয়’ তথা বামন ভদ্দিয়’ নামে পরিচিত হন। পরবর্তী সময়ে তিনি ভগবানের ধর্মদেশনা শুনে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বহুশ্রুত ও ধর্মকথিক। তাই তিনি মধুর স্বরেধর্মদেশনা দিতেন।

একসময় উৎসবের দিনে একজন ব্রাহ্মণের সাথে তিনি রথে চড়ে যাচ্ছিলেন। তখন এক গণিকা স্থবিরকে দেখে দাঁত দেখিয়ে হাসতে লাগল। স্থবির তার দাঁত দেখেই ‘অস্থিসংজ্ঞা’ লাভ করলেন। সেই অস্থিসংজ্ঞায় ভাবনা করে তিনি অনাগামী লাভ করলেন।

তিনি সব সময় কায়াগতানুস্মৃতি ভাবনা করতেন। একসময় তিনি ধর্মসেনাপতির উপদেশ শুনে অর্হত্ত্ব লাভ করলেন। কিছু কিছু ভিক্ষু-শ্রামণ ‘সে যে অর্হৎ হয়েছে’ তা না জেনে তার কানে ধরতেন, বাহুতে, মাথায়, হাতে, পায়ে ধরে মজা করতেন। তা শুনে ভগবান বললেন, ‘হে ভিক্ষগণ, আমার পুত্রকে আর দুঃখ দিওনা।’ তারপর থেকে তারা তাকে ‘অর্হৎ বলে জানলেন এবং আর কোনদিন দুঃখদেননি।

অর্হত্ত্ব লাভের পর তিনি আনন্দিত মনে নিজের পূর্বজীবনের কাহিনি প্রকাশ করতে গিয়ে ‘পদুমুত্তর জিন’ প্রভৃতি গাথা বলেছিলেন।

১.আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে পৃথিবীতে সর্ববিধ ধর্মে চক্ষুষ্মান, নায়ক পদুমুত্তর জিন উৎপন্ন হয়েছিলেন।

২.তখন হংসবতী নগরে মহাধনী শ্রেষ্ঠীপুত্র হয়ে জন্মেছিলাম। একদিন হাঁটতে হাঁটতে আমি সংঘারামে গিয়েছিলাম।

৩.তখন লোকপ্রদ্যোৎ নায়ক বুদ্ধ ধর্ম দেশনা করছিলেন এবংতাঁর এক শ্রাবককে মধুরভাষী ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে ভূয়শী প্রশংসা করছিলেন।

৪.তা শুনে আমি অত্যন্ত খুশী হয়েছিলাম। তারপর আমি মহর্ষি বুদ্ধের উদ্দেশ্যে মহাদান দিয়ে পদবন্দনা করে সেই শ্রেষ্ঠপদ প্রার্থনা করেছিলাম।

৫.তখন বিনায়ক বুদ্ধ সংঘমধ্যে বলেছিলেন, ‘এই ব্যক্তি ভবিষ্যতে দীর্ঘকাল পরে সফল মনোরথ হবে।’

৬.আজ থেকে লক্ষকল্প পরে ওক্কাকুকুলে গৌতম নামে এক শাস্তা পৃথিবীতে উৎপন্ন হবেন।

৭.তাঁর ধর্মে ধর্মৌরসজাত উত্তরাধিকারী হয়ে ভদ্দিয় নামে শাস্তাশ্রাবক হবে।

৮.সেই সুকতৃ কর্মের ফলে ও প্রার্থনা অনুসারে মনুষ্যদেহ ত্যাগ করে আমি তাবতিংস স্বর্গে জন্মেছিলাম।

৯.আজ থেকে বিরানব্বই কল্প আগে পৃথিবীতে অনাসক্ত, অপরাজেয়, সর্বলোকের উত্তমজিন, নায়কফুষ্যবুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন।

১০.তিনি বিদ্যাচরণ সম্পন্ন মহান, ঋজু, প্রতাপশালী, সকল সত্ত্বে পরম হিতৈষী। তিনি বহু সত্ত্বকে সংসার বন্ধন হতে মুক্ত করেছিলেন।

১১.আমি তারই পাশে নন্দারাম বনে এক কোকিল হয়ে জন্মেছিলাম। আমি গন্ধকুটির খুব কাছে এক আম্রবৃক্ষে বাস করতাম।

১২.সেই সময় পরম দাক্ষিণেয়্য জিনোত্তম বুদ্ধ পিণ্ডার্থে যাচ্ছিলেন। তা দেখে আমি অতীব প্রসন্নচিত্ত হয়ে মধুর স্বরে কূজন করছিলাম।

১৩.তখন আমি তৎক্ষণাৎ রাজোদ্যানে গিয়ে একটি সুপক্ক আম নিয়ে এসে সম্বুদ্ধের কাছে উপনীত হয়েছিলাম।

১৪.তখন মহাকারুণিক জিন আমার মনোভাব জ্ঞাত হয়ে উপস্থায়ক তথা সেবকের হাত থেকে নিজে পাত্রটি হাতে নিয়েছিলেন।

১৫-১৬. তারপর আমি অতীব হৃষ্টচিত্তে মহামুনি বুদ্ধকে সেই সুপক্ক আমিটি দান করেছিলাম। পাখা দিয়ে ঝাপটিয়ে পাত্রে দিয়েছিলাম। তারপর আমার পাখা দুটি অঞ্জলিবদ্ধ করে আমি মধুর স্বরে কূজন করে বুদ্ধকে প্রনাম নিবেদন করেছিলাম। বুদ্ধপুজা করার পর আমি অতীব খুশী মন নিয়ে নিন্দ্র যাবার জন্যে শায়িত হয়েছিলাম।

১৭.তখন বুদ্ধ প্রমে েমসগুল, খুশী মন নিয়ে ঘুমন্ত আমাকে এক শকুন পাখিএসে প্রদুষ্টমনে হত্যা করেছিল।

১৮.মৃত্যুর পর আমি তুষিত স্বর্গে মহাসুখ ভোগ করেছিলাম। তারপর সেই কৃতপুণ্যের ফলে আমি মনুষ্যযোনিতে এসেছিলাম।

১৯.এই ভদ্রকল্পে ব্রহ্মবন্ধু, মহাযশস্বী, শ্রেষ্ঠ গুনধর কাশ্যপ ভগবান উৎপন্ন হয়েছিলাম।

২০.তিনি শাসনকে উজ্জ্বলতা দান করে, অন্যতীর্ িদের দমন করে এবং বিনয়নকারীদের বিনীত করে সশিষ্যে পরিনির্বাপিত হয়েছিলেন।

২১.লোকাগ্র বুদ্ধ পরিনির্বাণ লাভের পর লোকেরা তাঁকে পূজা করার মানসে অতীব প্রসন্ন মনে শাস্তার উদ্দেশে একটি স্তূপ তৈরি করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

২২.তারা পরামর্শ করছিল যে, আমরা মহর্ষি বুদ্ধের জন্যে সপ্তবিধ রত্নে বিভূষিত সাত যোজনবিশিষ্ট একটি বিশাল স্তূপ তৈরি করব।

২৩.তখন আমি কি কি নামক কাশিরাজের সেনানায়ক ছিলাম। তখন আমি অপ্রমাণ বুদ্ধের জন্যে প্রমাণ তথা ছোট চৈত্য তৈরি করার পরামর্শ দিয়েছিলাম।

২৪.তারা আমার কথায় নরবীর বুদ্ধের জন্যে নানাবিধ নত্নে বিভূষিত ছোট একটি চৈত্য তৈরি করেছিল।

২৫.সেই কর্মের ফলে ও প্রার্থনা অনুসারে মনুষ্যদেহ ত্যাগ করে আমি তাবতিংস দেবলোকে জন্মনিয়েছিলাম।

২৬.এখন আমি শেষ জন্মে শ্রাবস্তীর এক ঋদ্ধ, সমৃদ্ধ, মহাধনাঢ্য, শ্রেষ্ঠীপরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি।

২৭.শ্রাবস্তীর নগরে প্রবেশ করলে পরে আমি বিস্ময় নেত্রে সুগতকে দেখেছি এবং অচিরেই প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে অর্হত্ত্ব লাভ করেছি।

২৮.অতীতে আমি যে চৈত্যের প্রমাণ কমিয়ে ছোট করে দিয়েছিলাম সেই কর্মের ফলে আমি এই শেষ জন্মে বামন শরীর হয়ে জন্মগ্রহণ করেছি।

২৯.ঋষিশ্রেষ্ঠ বুদ্ধকে মধুরস্বরে পূজা করে আমি মধুর ভাষী ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ আসন লাভ করেছি।

৩০.বুদ্ধকে ফল দান করারপ্রভাবে ও বুদ্ধগুণ স্মরণ করার ফলে এখন আমি শ্রামণ্যফলের অধিকারী হয়ে ও সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

৩১.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায়

সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

৩২.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

৩৩.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মান ভদ্দিয়স্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন।

[ভদ্দিয় স্থবির অপদান প্রথম সমাপ্ত]

২.কঙ্খারেবত স্থবির অপদান

৩৪.আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে পৃথিবীতে সর্বধর্মে চক্ষুষ্মান নায়ক পদুমুত্তর জিন উৎপন্ন হয়েছিলেন।

৩৫-৩৬. তিনি ছিলেন সিংহহনু, ব্রহ্মস্বরবিশিষ্ট, হংসদুন্দুভি স্বরবিশিষ্ট, নাগের ন্যায় নির্ভীকগামী, চন্দ্রসূর্যের ন্যায় স্নিগ্ধ ও প্রভাস্বর, মহামতি, মহাবীর, মহাধ্যানী, মহাবলশালী, মহাকারুণিক, নাথ ও মহান অন্ধকার বিধ্বংসকারী।

৩৭.সেই ত্রিলোকশ্রেষ্ঠ, সত্ত্বগণের বিষয়ে অভিজ্ঞ মুনি সম্বদ্ধ বহু লোককে বিনীত করেছিলেন এবং ধর্মদেশনা করেছিলেন।

৩৮.একদিন সেই জিন পরিষদে ধ্যানী, ধ্যানরত, বীর, উপশান্ত ও অনাবিল এক ভিক্ষুকে ভূয়শী প্রশংসা করে জনতাকে তুষ্ট করেছিলেন।

৩৯.তখন আমি হংসবতি নগরে এক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মেছিলাম। আমি তাঁর ধর্মকথা শুনে ভীষণভাবে খুশী হয়েছিলাম। আমি সেই শ্রেষ্ঠপদ লাভের প্রার্থনা করেছিলাম।

৪০.তখন বিনায়ক জিন সংঘমধ্যে আমাকে লক্ষ করে বলেছিলেন, হে ব্রাহ্মণ, তুমি খুশী হও। তোমার মনোরথ পূর্ণহবে।

৪১.আজ থেকে লক্ষ কল্প পরে ওক্কাকুকুলে গৌতম নামে শাস্তাৃপিথবীতে উৎপন্ন হবেন।

৪২.তাঁর ধর্মে সে ধর্মৌরসজাত উত্তরাধিকারী হয়ে রেবত নামে শাস্তাশ্রাবক হবে।

৪৩.সেই সুকৃত কর্মের ফলে ও প্রার্থনা অনুসারে মনুষ্যদেহ ত্যাগ করে আমি তাবতিংস দেবলোকে জন্ম নিয়েছিলাম।

৪৪.এখন আমি শেষ জন্মেও কোকিল নগরে ঋদ্ধ, সমৃদ্ধ, মহাধনাঢ্য ক্ষত্রিয় পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি।

৪৫.সুগত বুদ্ধ কপিলাবস্তুতে ধর্মদেশনা করার সময় তারপ্রতি প্রসন্ন হয়ে আমি অনাগারিক প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছিলাম।

৪৬.কল্পে কল্পে, জন্মে জন্মে আমি অত্যন্ত সন্দেহবাতিকগ্রস্ত ছিলাম। বুদ্ধই একমাত্র উত্তম ধর্ম দেশনা করে সেই সমস্ত সন্দেহ দূর করেছেন।

৪৭.তাই আমি সকল সন্দেহ-উত্তীর্ণ, ও নিয়ত ধ্যানসুখে রত হয়ে অবস্থান করছি। তখন বুদ্ধ আমাকে দেখে এই কথা বলেছিলেন:

৪৮.নিজের ও পরের সম্বন্ধে অথবা ইহকাল ও পরকাল সম্বন্ধে যে সমস্ত সন্দেহ আছে সেসব সন্দেহসকল যেসব ধ্যানী পরিত্যাগ করেন, তারাই বীর্যবান ব্রহ্মচর্যা অনুশীলনকারী।

৪৯.আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে আমার কৃতকর্ম এইশেষজন্মে এসেও ফল প্রদান করছে। এখন আমি সম্পূর্নমুক্ত এবং তীরের গতিতে আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ করেছি।

৫০.এভাবে ধ্যানরত দেখে লোকবিদ মুনিমহামুতি বুদ্ধ আমাকে ধ্যানী ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠপদে বসালেন।

৫১.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

৫২.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

৫৩.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মানকঙ্খারেবত স্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন। [কঙ্খারেবত স্থবির অপদান দ্বিতীয় সমাপ্ত]

৩. সীবলী স্থবির অপদান

এই স্থবিরও অতীত বুদ্ধগণের নিকট বিবিধপুণ্যকর্ম করে জন্মজন্মান্তরে সুখদপুণ্যসঞ্চয় করতে করতে পদুমুত্তর ভগবানের সময় এক কুলিন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। একদিন তিনি বিহারে গিয়ে শ্রোতামণ্ডলীর শেষপ্রান্তে বসে ধর্মশ্রবণ করেন। তখন শাস্তা এক ভিক্ষুকে লাভী ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠপদে প্রতিষ্ঠিত করছিলেন। তা দেখে তিনিও সেই লাভী শ্রেষ্ঠপদ লাভের আশায় সাতদিন যাবৎ বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষুসংঘকে মহাদান দিয়েবললেন, ‘ভন্তে, আমি দানের ফলে অন্য কোনো পদ প্রার্থনা করিনা। আমি লাভী শ্রেষ্ঠপদই প্রার্থনা করি।’ ভগবান বললেন, ‘তুমি ভবিষ্যতে গৌতম বুদ্ধের সময়ে লাভীশ্রেষ্ঠপদ লাভ করবে।’

তারপর তিনি আজীবন কুশল কর্ম করে দেবমনুষ্যলোকে উভয় সম্পত্তি ভোগ করে বিপশ্বী ভগবানের সময় বন্ধুমতি নগরের অদূরে এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তখন তিনি বন্ধুমতি নগরের উপসকেরা রাজার সাথে পরামর্শ করে দশবল বুদ্ধকে দান দিতেছিলেন।

একদিন তারা সবাই একত্র হয়ে দান দিবার সময় ‘আমাদের এই দানযজ্ঞে কী কী নেই’ পরীক্ষা করে দেখলেন যে, মধু, গুড় ও দধি এই তিনটি বস্তুর অভাব। তারপর তারা নগরের প্রবেশদ্বারে লোক বসিয়ে দিলেন। ঠিক সেই সময় এই কুলপুত্র গুড় ও দধি নিয়ে নগরে আসছিলেন। পথিমধ্যে মুখ ধোয়ার জন্যে গিয়ে এক দণ্ড মধুও লাভ করলেন। সেই সময় চৌকিদারেরা তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ আপনি এই মধু, গুড় ও দধি কার জন্যে নিয়ে যাচ্ছেন?’ তিনি বললেন, ‘কারো জন্যে নয়। বিক্রির জন্যেই নিচ্ছি।’ তারা বলল, ‘তাহলে এক টাকার বিনিময়ে এগুলো আমাদের দিন।’

তখন তিনি ভাবলেন, ‘এগুলো এত দামী জিনিস নয়। তবে এরা কেন এত বেশি টাকা দিয়ে কিনতে চাচ্ছেন! একটু পরীক্ষা করে দেখতে হবে।’ এই ভেবে তিনি বললেন, ‘না, আমি মাত্র এক টাকায় এগুলো দেব না।’ ‘তাহলে এই নাও দুই টাকা। তারপর ও গুলো আমাদের দাও।’ ‘দুই টাকা দিলেও আমি দেব না।’ এভাবে টাকার অঙ্কটা বাড়তে বাড়তে হাজার টাকায় পৌঁছাল। তখন তিনি ভাবলেন, ‘আর মূল্য বৃদ্ধি করা উচিত হবে ।’না এর স্বল্প মূল্যের জিনিস অনেক বেশি টাকার বিনিময়ে নিতে চাচ্ছেন। এর কারণ কী আমাকে অবশ্যই জানতে হবে।’ অতঃপর তিনি তাদের বললেন, ‘এত দাম দিয়ে নিতে চাচ্ছেন। এর কারণ কী?’ ‘মহাশয়, নগরবাসীরা রাজার সাথে প্রতিযোগীতা করে বিপশ্বী বুদ্ধকে দান দিচ্ছেন। অথচ এই জিনিসগুলোর অভাব আছে। যদি এগুলো দেওয়া সম্ভব না হয়, তবে নগরবাসীরা পরাজিত হবে। সে কারণেই আমি দাম বেশি হলেও নিতে চাচ্ছি।’ ‘এই দান কি শুধু নগর বাসীরাই করবে না অন্য কেইও করতে পারবে ?’ ‘এই দান সকলেই করতে পারবে। এই দান সকলের জন্যেই উন্মুক্ত।’ ‘এই দানযজ্ঞে একদিনে হাজার টাকার দাতা কেই আছে কি ?’ ‘না বন্ধু, নেই।’ ‘তা-ই যদি হয় আপনারা এখন নগর বাসীদের কাছে গিয়ে বলুন যে, এক লোক মূল্য না নিয়ে নিজ হাতে দান করতে চায়। এত অন্য কিছু ভাববেন না।’ ‘আপনিও আমাদের এই দানযজ্ঞে অংশীদার হোন!’ এই বলে তারা চলে গেল।

এদিকে এই কুলপুত্র বাড়ি হতে বাজার করার জন্যে যে এক মাসা এনেছিলেন, সেই এক মাসা দিয়ে পঞ্চকটু নিয়ে চূর্ণ করলেন। মধুপটল পিষে এক পদ্মপত্রে মধু নিয়ে ঞ্চকটুপ চূর্ণ মিশালেন এবং ছাকলেন। তারপর বুদ্ধের কাছে গিয়ে বললেন, ‘ভন্তে, গরীবের এই দান অনুকম্পা করে গ্রহণ করুন।’ শাস্তা তার প্রতি অনুকম্পা পরবশ হয়ে চারিমহারাজ প্রদত্ত পাত্রে ওই মধু নিয়ে এই বলে অধিষ্ঠান করলেন, ‘এই মধু আটষট্টি লক্ষ ভিক্ষুকে দিলে নিঃশেষ না হোক।’

সেই কুলপুত্র বুদ্ধের ভোজনশষে তাঁর নিকট গিয়ে বন্দনা করে একপার্শ্বে বসে বললেন, ‘ভন্তে ভগবান, আজ আমি বন্ধুমতি নগরবাসীদের দান নিজ চোখে দেখলাম। ভন্তে, আমি যে দান করেছি, এই দানের ফলে যে লাভ-যশের ভাগী হতে পারি।’ ভগবান ‘তা-ই হোক কুলপুত্র!’ বলে আশীর্ব দ করলেন। অতঃপর শাস্তা তারও নগরবাসীদের দান অনুমোদন করে চলে গেলেন। তিনি আজীবন পুণ্যকর্ম করে দেবমনুষ্যলোকে বিচরণ করে এই গৌতম বুদ্ধের সময়ে রাজকন্যা সুপ্রবাসার গর্ভে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করেন। প্রতিসন্ধি গ্রহণের পর থেকে সকাল-সন্ধ্যা পাঁচশত উপহার দান দিতেন। নাজকন্যার পুণ্যপ্রভাবে সমস্ত কিছুই অফুরন্ত হয়েছিল। তিনি যা স্পর্শ করতেন, তা-ই আর নিঃশেষ হত না। এভাবে সাত বৎসর যাবৎ গর্ভধারণ করতে হয়েছিল।

তারপর গর্ভ পরিপূর্ণ হলে প্রসবকালীন সাত বছর সাত দন িযাবৎ মহাদুঃখ ভোগ করলেন। তখন স্বামীকে ডেকে বললেন, ‘আমার মৃত্যুর আগে আমি দান দিতে চাই। আপনি ভগবানের নিকট গিয়ে তা ব্যক্ত করুন।’ রাজা ভগবানকে সুপ্রবাসার প্রণতি জানালে পরে ভগবান বললেন, ‘সুপ্রবাসা সুখী হোক! সুপ্রবাসা নিরাপদে প্রসব করুক!’ রাজা এই সংবাদ নিয়ে গ্রামেরদিকে আসছিলেন। এদিকে তাঁর আগমনের আগেই সুপ্রবাসা বিনাকষ্ঠে প্রসব করলেন। এদিকে অশ্রুপূর্ণজ্ঞাতিগণ খুশিতে টকবক করতে লাগলেন। এই শুভসংবাদ রাজাকে জানানোর জন্যে লোক পাঠানো হলো। পথে তাদের সাথে সাক্ষাৎ হলে পরে রাজা তাদের দেখে ভাবলেন, ‘মনে হয় বুদ্ধের আর্শীবাদেই সুপ্রসব হয়েছে।’ রাজা বাড়িতে এসে বুদ্ধের আর্শীবাদের কথা বললেন।

রাজকন্যা বললেন, ‘আপনার জীবিতক্রিয়ার নিমন্ত্রণ মঙ্গল-নিমন্ত্রণে পরিণত হবে। ভালো কথা, এখনই গিয়ে সাত দিনের জন্যে বুদ্ধকে নিমন্ত্রণ করে আসুন।’ রাজা তা-ই করলেন। সুপ্রবাসা সাত দিন পর্যন্ত মহাদান দিলেন। পুণ্যবান শিশু সকলের সন্তপ্ত চিত্তকে শীতল করে ভূমিষ্ঠ হয়েছে বিধায় তাঁর নাম নাখা হলো ‘সীবলী’। বালক সাত বৎসর গর্ভে ছিলেন বলে জন্মের পর

থেকেই সকল কাজে পটুহয়েছিলেন। ধর্মসেনাপতি সারিপুত্রস্থবির সাতদিন শেষে তার সাথে আলাপ করলেন। শাস্তাও এই গাথাটি ভাষণ করলেন:

“বন্ধুর, কর্দমময় এই সংসরণ মোহ অতিক্রমি’রুদ্ধ করেছে যেজন, উত্তীর্ণ হইয়া যিনি পরপার গত,

যিনি ধ্যানী, বীততৃঞ্চ, সংশয়-অতীত, উপাদানহীন আর নিবৃত যেজন, তাঁহাকেই বলি আমি প্রকৃত ব্রাহ্মণ।”

অতঃপর স্থবির তাকে বললেন, ‘এত দীর্ঘসময় মহাদুঃখ ভোগ করে তোমার প্রব্রজ্যা গ্রহণ করা উচিত নয় কি?’ ‘ভন্তে, যদি প্রব্রজ্যা দেন, আমি গ্রহণ করব।’ সুপ্রবাসা বালককে ধর্মসেনাপতির সাথে আলাপ করতে দেখে জিজ্ঞেস করলেন, ভন্তে, আমার ছেলে আপনার সাথে কী আলাপ করতেছে?’

‘উপাসিকে, গর্ভদুঃখ সম্বন্ধেই আলাপ করতেছে। আপনি অনুমতি দিলেন সে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করবে।’

‘সাধু ভন্তে, সাধু। আপনি আমার ছেলেকে প্রব্রজ্যা প্রদান করুন।’ স্থবির বালককে বিহারে এনে ‘ত্বকপঞ্চক’ কর্মস্থানের সাথে প্রব্রজ্যা দিয়ে বললেন, ‘দেখ সীবলী, তোমাকে অন্য উপদেশ দেওয়ার প্রয়োজন নেই। তুমি সাত বৎসর যে মহাদুঃখ ভোগ করেছিলে, কেবল তা-ই প্রত্যক্ষ কর।’

‘ভন্তে, প্রব্রজ্যা দেওয়া আপনার দায়িত্ব। আমাকে যা করতে বলা হবে, আমি মনেপ্রাণে তা-ই করব।’ তাঁর কেশ চ্ছেদনের সময় ক্ষরের প্রথম টানে স্রোতাপত্তি, দ্বিতীয় টানে সকৃদাগামী, তৃতীয় টানে অনাগামী ও চতুর্থ টানে অর্হত্ত্বফল লাভ হলো।

অতঃপর ভিক্ষুসংঘেরমধ্যে কথা উঠল যে, ‘অহো, কী আশ্চর্য! এমন পুণ্যবান স্থবিরকে পর্যন্ত সাত বৎসর সাতমাস সাত দিনের অধিক সময় গর্ভে বাস করতে হয়েছিল।’ শাস্তা সেখানে এসে ভিক্ষুদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে ভিক্ষুগণ, তোমরা এখানে একত্র হয়ে কী কথা বলছ ?’ তখন ‘ভন্তে, আমরা এই কথাই বলছি’ বললে ভগবান ‘হে ভিক্ষুগণ, ইহা এই কুলপুত্রের এই জন্মের কর্ম নয়’ বলে অতীতের কথা শুরু করলেন।

হে ভিক্ষুগণ, অতীতে বুদ্ধ উৎপন্ন হওয়ার কিছুকালআগে এই কুলপুত্র রাণসীরবা রাজকুলে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার মৃত্যুর পর সে সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। তিনি মহাধনী বলে খ্যাতিমান হন। তখন এক প্রত্যন্ত রাজা ‘রাজ্য দখল করব’ ভেবে সেখানে এসে নগরকে ঘিরে সেনাশিবির করে অবস্থান নিল। অতঃপর রাজা মায়ের পরামর্শে যেই নগরে সেনাশিবিরটি ছিল সেই নগরের চৌদিকের সমস্ত দরজা (সপ্তাহকাল) বন্ধ করে রাখলেন। লোকেরা সেই নগরে আর ঢুকতে পারল না এবং সেই নগর হতে বের ও হতে পারল না। অতঃপর রাজা শুনতে পেলেন যে, মৃগদায় বিহারে পচ্চেকবুদ্ধগণ নগরে ঢুকে পড়েছেন। রাজা তাও বন্ধ করে দিলেন। কিছুদিন পর প্রত্যন্ত রাজারা পলায়ন করল। সেই কর্মের ফলে সে দীর্ঘকাল নরকে অশেষ দুঃখ ভোগ করে এই গৌতম বুদ্ধের সময়ে রাজাকুলে নজ্মগ্রহণ করেও মায়ের সাথে এমন দুঃখ ভোগ করেছে। এই কুলপুত্র প্রব্রজ্যা নেওয়ার পর থেকে ভিক্ষুসংঘের প্রভূত পরিমণে চতুপ্রত্যয় উৎপন্ন হয়েছিল।

পরবর্তীকালে শাস্তা শ্রাবস্তীতে আসলে পরে স্থবির ভগবানের অনুমতি নিয়ে পাঁচশত ভিক্ষুকে নিয়ে আসতে গেলেন। এভাবে তিনি নিজের লাভ-সৎকার লাভের পুণ্যবিভূতি ভিক্ষুসংঘকে দেখালেন। অতঃপর একদিন শাস্তা তাকে সংঘমধ্যে উপবিষ্ট হয়ে লাভীশ্রেষ্ঠ পদে বসালেন।

আয়ুষ্মান সীবলী অর্হত্ত্ব লাভের পর নিজের পূর্বকৃত কর্ম স্মরণ করে আনন্দিত মনে নিজের পূর্র্র্র্র্র্বকৃত কর্ম স্মরণ করে আনন্দিত মনে নিজের পুর্বজীবনের কাহিনি প্রকাশ করতে গিয়ে ‘পদুমুত্তর জিন’ প্রভৃতি গাথা বলেছিলেন।

৫৪.আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে পৃথিবীতে সর্ববিধ ধর্মে চক্ষুষ্মান নায়ক জিন পদুমুত্তর বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন।

৫৫.তাঁর শীল ছিল সংখ্যয়, সমাধি বজ্রোপম, জ্ঞান অপ্রমেয় ও বিমুক্তি ছিল অতুলনীয়।

৫৬.তিনি মানুষ, নাগ ও ব্রহ্মাদের সমগমে শ্রমণ-ব্রাহ্মণে আকীর্ণ সভায় ধর্মদেশনা করতেন।

৫৭.একসময় তিনি পরিষদে বসে তার এক মহালাভী, পুণ্যবান, জ্যোতিমর্য় শিষ্যকে লাভীশ্রেষ্ঠ পদে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

৫৮-৫৯. তখন আমি হংসবতি নগরে একজন ক্ষত্রিয় রাজা ছিলাম। পদুমুত্তর জিনের মুখে সেই শিষ্যের বহু গুণের কথা শুনে আমি ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। তারপর বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষুসংঘকে নিমন্ত্রণ করে সপ্তাহকাল ভোজন করিয়ে ও মহাদানদিয়ে সেই শ্রেষ্ঠপদ প্রার্থনা করেছিলাম।

৬০.তখন পুরুষশ্রেষ্ঠ মহাবীর পদুমুত্তর বুদ্ধ আমাকেতাঁর পদমূলে নতশিরেদেখে মধুর স্বরে এই কথা বলেছিলেন:

৬১-৬২. তখন পদুমুত্তর জিনের কথা শ্রবণেরইচ্ছায় বহুজনতা, দেবতা, দানব, গন্ধর্ব, ব্রহ্মা ও ঋদ্ধিমান শ্রমণ-ব্রাহ্মণ কৃতাঞ্জলি হয়ে এই বলে নমস্কার! হেপুরুষ শ্রেষ্ঠ, আপনাকে, নমস্কার! হে পুরুষোত্তম, আপনাকে নমস্কার!’

৬৩.সপ্তাহ কালব্যাপী ক্ষত্রিয় রাজা আপনাকে মহাদান দিয়েছেন। সেই মহাদনের ফল সম্বন্ধে শোনার জন্যে সবাই উন্মুখ হয়ে আছে। হে মহামুনি, আপনি ব্যাখ্যা করুন!

৬৪-৬৫. অতঃপর ভগবান বলেছিলেন, তাহলে আমার কথা শোন। তার দান অপ্রমেয় বুদ্ধ ও সংঘে সুপ্রতিষ্ঠিত। সেই দানের ফল কে ব্যাখ্যা করবে? সেই দানের ফল যে অপ্রমেয়! তাই সে মহাধনাঢ্য হবে। সে লাভীশ্রেষ্ঠ পদ প্রাথর্না করছে।

৬৬.সে লাভীশ্রেষ্ঠপদ লাভের প্রার্থনা করেছে। ভবিষ্যতে দীর্ঘকাল পরে সে সেই শ্রেষ্ঠপদ লাভ করবে।

৬৭.আজ থেকে লক্ষ কল্প পরে ওক্কাকুকুলে গৌতম নামে এক শাস্তা পৃথিবীতে উৎপন্ন হবেন।

৬৮.তার ধর্মে সে ধর্মৌরসজা উত্তরাধিকারী হয়ে সীবলী নামে শাস্তা শ্রাবক হবে।

৬৯.সেই সুকৃত কর্মের ফলে ও প্রার্থনা অনুসারে মনুষ্যদেহ ত্যাগ করোমি অতাবতিংস দেবলোকে জন্মেছিলাম।

৭০.আজ থেকে একানব্বই কল্প আগে পৃথিবী চারুদর্শন, সর্ববিধ ধর্মের যথাভীত দর্শকারী লোকনায়ক বিপশ্বী ভগবান উৎপন্ন হয়েছিলেন।

৭১.তখন আমি বন্ধুমতি নগরে এক জনৈক পরিবারে জন্ম নিয়েছিলাম। তখন আমি ছিলাম সকলের প্রিয় ও মনোজ্ঞ এক কর্মী।

৭২.তখন বন্ধুমতি নগর বাসীরা সবাই মিলে মহর্ষিবিপশ্বী ভগবানের উদ্দেশে এক মহতি বিশ্ববিশ্রুত দানযজ্ঞের আয়োজন করেছিল।

৭৩.সেই মহতি দানযজ্ঞের আয়োজন প্রায় শেষ পর্যায়ে একটু পরখ করে দেখতে গিয়ে খেয়াল হয়েছিল যে, এই মহতি দানযজ্ঞে মধু, গুড় ও দধি নেই।

৭৪.তারা সেগুলো হাজার টাকা দিয়ে হলে নিতে চেয়েছিল। আমি কোনোভাবেই দিতে চাইনি। তখন আমি ভেবেছিলাম, ‘এগুলোর মূল্য কোনোভাবেই এতটুকু কম নয়।’

৭৬.আমি আরো ভেবেছিলাম, এই লোকেরা যেভাবে তথাগতকে পূজা-সৎকার করছেন, আমিও সেভাবে লোকনায়ক বুদ্ধ প্রমুখ অনুত্তর ভিক্ষুসংঘকে-পূজাসৎকার করব।

৭৭.এভাবে চিন্তা করার পর আমি দধি ও মধু মিশিয়ে পিষে লোকনাথ বুদ্ধ প্রমুখ অনুত্তর সংঘকে দান করেছিলাম।

৭৮.সেই সুকৃত কর্মের ফলেও প্রার্থনা অনুসারে মনুষ্যদেহ ত্যাগ করে আমি তাবতিংস দেবলোকে জন্মেছিলাম।

৭৯.পুনরায় আমি বারাণসীর রাজা হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলাম। তখন আমি প্রদুষ্ট মনে সাতদিন যাবৎ নগরদ্বার বন্ধ রেখেছিলাম।

৮০.তখন নগরদ্বার সম্পূর্ণ বন্ধ করায় তপস্বী পচ্চেকবুদ্ধগণ ও রুদ্ধ হয়ে পড়েছিল। সেই কর্মের বিপাক আমাকে সুদীর্ঘকাল নিরয়ে দগ্ধ করেছিল।

৮১.আজ এই শেষ জন্মে আমি কোলিয় নগরে জন্মগ্রহণ করেছি। আমার মায়ের নাম সুপ্রবাসা। আর পিতার নাম লিচ্ছবী মহালি।

৮২.পূর্বর্কতপুণ্যবলে আমি ক্ষত্রিয় রাজকুলে জন্মেছি। আর নগরদ্বার রুদ্ধকরে দেওয়ার ফলে আমাকে মাতৃগর্ভে মহাদুঃখের সাথে সাতবৎসর পর্যন্ত বাস করতে হয়েছে।

৮৩.মাতৃগর্ভহতে ভূমিষ্ঠ হবার আগে আমি মহাদুঃখে সমর্পিত হয়ে প্তাহকালস ছটফট করেছি। আমার মাও আমাকে পরামর্শ দেওয়ার কারণে একইভাবে মহাদ:খে ছটফট করেছে।

৮৪.বুদ্ধের অশেষ অনুকম্পায় আমি মাতৃগর্ভ হতে বেশ সুখেই ভূমিষ্ঠ ।হয়েছিভূমিষ্ঠ হওয়ার দিনেই আমি অনাগারিক প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছি।

৮৫.আমার উপাধ্যায় সারিপুত্রস্থবির। মহাঋদ্ধিধর মোদ্গল্লায়ন স্থবির যখন আমার মাথা থেকে কেশচ্ছেদন করছেন তখন মহামতি সারিপুত্রস্থবির আমাকে অনুশাসন করেছেন।

৮৬.কেশচ্ছেদনের সময়ই আমি অর্হত্ত্ব লাভ করেছি। তারপর দেবতা, নাগ ও মানুষেরা আমাকে পূজা করার জন্যে আমার কাছে আসে।

৮৭.ঠিক যেভাবে আমি পদুমুত্তর নাথকে ও বিনায়ক বিপশ্বী বুদ্ধকে চতুর্প্রত্যয় দিয়ে বিশেষভাবে প্রসন্নমনে পূজা করেছিলাম।

৮৮.আমার সেই পূর্বকৃত বিশেষ কর্মের ফলে আমি বনে, গ্রামে, জলে স্থলে সর্বত্রই বিপুল লাভ সৎকার লাভ করি।

৮৯-৯০. লোকাগ্রনায়ক, বিনায়ক বুদ্ধ যখন ত্রিশ হাজার ভিক্ষুকে সঙ্গেনিয়ে রেবত স্থবিরকে দেখতে যাচ্ছিলেন, তখন অসংখ্য দেবতা আমার উদ্দেশে উত্তম উত্তম খাদ্য-ভোজ্য দিয়ে লোকনায়ক বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষুসংঘকে পরিতৃপ্ত করেছিলাম।

৯১.আমার দ্বারা সেবিত-পূজিত হয়ে মহামতি বুদ্ধ রেবতস্থবিরবে দেখতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে জেতবনে ফিরে এসে আমাকে লাভীশ্রেষ্ঠ পদে বসিয়েছিলেন এই বলে:

৯২.হে ভিক্ষগণ, আমার শিষ্যদের মধ্যে লাভীশ্রেষ্ঠ হচ্ছে সীবলী। সর্বলোকের হিতের জন্যে শাস্তা সেই পরিষদে আমার ভূয়শী প্রশংসা করেছিলেন।

৯৩.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

৯৪.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

৯৫.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি। ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মানসীবলী স্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন।

[সীবলী স্থবির অপদান তৃতীয়সমাপ্ত]

৪. বঙ্গীশ স্থবির অপদান

এই স্থবিরও অতীত বুদ্ধগণের নিকট বিবিধপুণ্যকর্ম করে জন্মজন্মান্তরে সুখদপুণ্যসঞ্চয় করতে করতে পদুমুত্তরভগবানের সময় হংবতী নগরে এক মহাধনাঢ্য জন্মগ্রহণ করেন। একদিন তিনি নগর বাসীদের সাথে বিহারে গিয়ে ধর্মশ্রবণ করেন। তখন শাস্তা এক ভিক্ষুকে বিচিত্রকথক ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রষ্ঠপদ প্েরাথর্না করলেন। তারপর থেকে তিনি আজীবন কুশলকর্ম করে দেবমনুষ্য লোকে বিচরণ করে এই গৌতম বুদ্ধের সময় শ্রাবস্তীতেএক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার নাম হলো ‘বঙ্গীশ’। তিনি ত্রিবেদে পারদর্শী ছিলেন। এক আর্চাযের নিকটে ‘মৃতশির মন্ত্র’ শিক্ষাকরেন। মৃত ব্যক্তি মাথায় নখ দিয়ে আঘাত করলেই তিনি ‘এই ব্যক্তি অমুক যোনিতে জন্মগ্রহণ করেছে’ বলে দিতে পারতেন।

ব্রাহ্মণেরা ‘ইহাই আমাদের জীবন জীবিকার উপায়’ ভেবে বঙ্গীশকেনিয়ে দেশ-বিদেশ ভ্রমণ করতে লাগলেন। বঙ্গীশ তিন বৎসরের মৃতশির দেখেও জন্মলাভ বিবরণ বলে দিতে পারতেন। সে কারণে তিনি সাদারণের অতি শ্রদ্ধাভাজন হলেন। কেই একশত, কেই হাজার টাকা তাকে দিতে লাগলেন একসময় বঙ্গীশ বুদ্ধগুণের কথা শুনে শাস্তার কাছে গমনেচ্ছু হলেন। তখন ব্রাহ্মণরা ‘শ্রমণ গৌতম মায়াবলে তোমার আবর্তন করবে’ এই বলে যেতে নিষেধ করলেন।

বঙ্গীশ তাদের কথা গ্রাহ্য না করে শাস্তার কাছে গিয়ে সেীজন্য আলাপ করে একপার্শ্বে বসলেন। শাস্তা তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বঙ্গীশ, তুমি কোনো শিল্প জান কি?’ ‘হাঁ, মাননীয় গৌতম, আমি মৃতশির মন্ত্র জানি।’ অতঃপর ভগবান নিরয় মনুষ্যলোক ও নির্বাণগত তিনটি মৃতশির আনিয়ে পরীক্ষার জন্যে তাকে দিলেন। তিনি নিরয়গত ও মনুষ্যজন্মপ্রাপ্ত দুটি শির পরীক্ষা করে তাদের গতি বলে দিলেন। কিন্তু নিবাণগত ব্যক্তির শির পরীক্ষা করে আদি-অন্ত কিছুই জানতে পারলেন না। তিনি ঘেমে গেলেন। তখন বুদ্ধ বললেন, ‘কি হে বঙ্গীশ, তুমি বোধ হয় তৃতীয় ব্যক্তির মৃত শিরের কথা বলতে পারবে না।’ ‘না ভন্তে, ‘আমি এই মৃতশিরের কথাও জানি, অন্যান্য সমস্ত শিরের কথাও জানি!’ বলে ভগবান এ গাথাদ্বয় বললেন:

“চ্যুতি-জন্ম সত্ত্বদের যেইজন জানে, এখানে সেখানে কিংবা যেই কোনো স্থানে; যেবা অনাসক্ত, যিনি সুখস্থান গত,

সেই বুদ্ধে বলি আমি ব্রাহ্মণ প্রকৃত।”

“যার গতি নাহি জানে দেবতা-গর্ন্ধব-নর, সে অর্হৎ ক্ষীণাসবে বলিব ব্রাহ্মণবর।”

অতঃপর বঙ্গীশ মিনতির সুরে বললেন, ‘ভগবান, তাহলে অনুগ্রহকরে আমাকে আপনার সেই মন্ত্র প্রদান করুন।’ ‘আমার ন্যায় মুণ্ডিত মস্তক হয়ে চীবর ধারণ করলেই কেবল শিক্ষা দিব।’ তখন বঙ্গীশ ভাবলেন, ‘যে কোন উপায়ে এই মন্ত্র শিক্ষা করে আমি জম্বুতদীপে সর্বশ্রেষ্ঠ হবো।’ তিনি ব্রাহ্মণদের কাছে গিয়ে বললেন, ‘আপনারা চিন্তা করবেন না। ইহাতে আমার বহু মঙ্গল সাধিত হবে।’

বঙ্গীশ যখন বুদ্ধের নিকটে প্রব্রজ্যা প্রাথর্না করলেন তখনস্থবির নিগ্রোধকল্প ও শাস্তার নিকটে দাঁড়িয়ে ছিলেন। শাস্তার তাকে প্রব্রজ্যা দিতে স্থবিরকে আদেশ দিলেন। তিনি প্রব্রজ্যা গ্রহণের পর শাস্তার নিকটে মন্ত্রস্বরূপ বত্রিশ অশুচিভাবনা ও বিদর্শন কর্মস্থান গ্রহণ করলেন। তিনি ভাবনা করছেন এমন সময় ব্রাহ্মণেরা এসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কেমন হে বঙ্গীশ, শ্রমণ গৌতমের নিকটে মন্ত্র শিখেছ কি?’ ‘হ্যা শিখেছি তো!’ ‘তাহলে এসো আমরা চলে যাই।’ ‘শিল্প শিক্ষার কী প্রয়োজন? তোমরা চলে যাও। তোমাদের সাথে আমার কোনো কাজ নেই।’ তখন ব্রাহ্মণেরা বললেন, ‘বঙ্গীশ, তুমি শ্রামণ গৌতমের মায়ায় পড়েছ। আমরা তোমার আশপাশেই থাকব।’ এই বলে চলে গেলেন। তিনি তাদের চলে যাবার পর অচিরেই অর্হত্ত্ব লাভ করলেন।

এভাবে অহর্ত্ত্ব লাভের পর স্থবির নিজের পূর্বকৃত কর্ম স্মরণ করে আনন্দিত মনে নিজের পূর্বজীবনের কাহিনি প্রকাশ করতে গিয়ে‘পদুমুত্তর জিন’ প্রভৃতি গাথা বলেছিলেন।

৯৬.আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে পৃথিবীতে সর্ববিধ ধর্মে চক্ষুষমান য়কনা পদুমুত্তরজিন উৎপন্ন হয়েছিলেন।

৯৭.ঊর্মিমালা যেমন সাগরে, তারকারা যেমন আকাশে, ঠিক সেভাবেই আপনার উপদেশবানী অর্হৎদের দ্বারা চিত্রিত হয়েছে।

৯৮.দেবমনুষ্য, নাগ অসুর পরিবেষ্টিত হয়ে ও শ্রমণ-ব্রাহ্মণে আকীর্ণ বিশাল জনসভায় জিনুত্তম বুদ্ধ উপবিষ্ট হয়েছিলেন।

৯৯.তিনি পৃথিবীতে জ্ঞানপ্রভায় জ্বল জ্বল করতে থাকা লোকবিদ জিন। তিনি উপদেশ প্রদানের মাধ্যমে অজ্ঞদের বোধ উৎপন্ন করতেন।

১০০.তিনি চারি বৈশারদ্যপাপ্ত, পুরুষোত্তম, সম্পূর্ণ ভয়ভীতিহীন, নির্বাণ প্রাপ্ত ও বিশারদ।

১০১.লোকাগ্র বুদ্ধ কেবল মহান ও শ্রেষ্ঠস্থান বুদ্ধভূমিই অনুমোদন করেন, অ ্যকিছু নয়।

১০২.তিনি যখন বজ্রকন্ঠে সিংহনাদ করেন তখন দেব, মানব বা কেউই প্রত্যাবর্তন করেন না।

১০৩.চারি পরিষদে বিশারদ বুদ্ধ শ্রেষ্ঠ ধর্মদেশনা করার মধ্যদিয়ে দেবমনুষ্যদের সংসারসাগর তীর্ণ করিয়েই ধর্মচক্র প্রবর্তন করেন।

১০৪.তখন তিনি তার এক সাধুসম্মত শ্রাবকের ভূয়শী প্রশংসা করে বিচিত্রকথক শ্রেষ্ঠপদে প্রতিষ্ঠিত করেন।

১০৫.তখন আমি হংবতী নগরে এক সর্ববিধ বেদজ্ঞ, বচনবাগীশ, তার্কিক, সাধুসম্মত ব্রাহ্মণ ছিলাম।

১০৬.এক সময় আমি সেই মহাবীর বুদ্ধের কাছে গিয়ে ধর্মদেশনা শুনে সেই শ্রাবকের গুণরাশি দেখে ভীষণ রকম প্রীতি লাভ করেছিলাম।

১০৭.তাঁরপর আমি লোকনন্দন সুগত প্রমুখ সংঘকে নিমন্ত্রণ করে সাতদিন যাবৎভোজন দান করে ত্রিচীবর দান করে দান করেছিলাম।

১০৮.অতঃপর আমি তার রাতুর চরণে মাথা ঠেকিয়ে কৃতাঞ্জলি হয়ে একপার্শ্বেদাঁড়িয়ে আনন্দিত মনে জিনুত্তম বুদ্ধের ভূয়শী প্রশংসা করেছিলাম।

১০৯.হে বাদিমর্দন, আপনাকে নমস্কার। হে পুরুষোত্তম, আপনাকে নমস্কার। হে সর্বলোকাগ্র, আপনাকে নমস্কার। হে অয়ঙ্কর, আপনাকে নমস্কার।

১১০.হে মারজয়ী, আপনাকে নমস্কার। হে দৃষ্টিবিনাশী, আপনাকে নমস্কার। হে শান্তিসুখদায়ক, আপনাকে নমস্কার। হে শরণঙ্কর, আপনাকে নমস্কার।

১১১.হে ভগবান, আপনি হচ্ছেন অনাথের নাথ, ভীতুদের অভয়স্থান, ক্লান্তদের বিশ্রামভূমি ও শরণার্থীদের পরম আশ্রয়।

১১২.আমি এভাবে বহুপ্রকারে সম্বুদ্ধের মহাগুণের ভূয়শী প্রশংসা করে বলেছিলাম, ‘আমি সেই বিচিত্রকথক ভিক্ষুর ন্যায় হতে চাই।’

১১৩-১১৪. তখন অনন্তজ্ঞানী ভগবান বলেছিলেন, যে ব্যক্তি বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষুসংঘকে সপ্তাহকাল ভোজন করিয়েছে, আর যে ব্যক্তি আমার গুণকীর্তন করল, সে বিচিত্রকথক ভিক্ষুর ন্যায় শ্রেষ্ঠপদ লাভের প্রাথর্না করছে।

১১৫.ভবিষ্যতে সুদীর্ঘকাল পরে তার সেই মনোরথ পূরণ হবে। সে অপ্রমেয় দেবমনুষ্যসম্পত্তি ভোগ করবে।

১১৬.আজ থেকে লক্ষ কল্প পরে ওক্কাকুকুলে গৌতম নামক শাস্তা পৃথিবীতে উৎপন্ন হবেন।

১১৭.তাঁর ধমে সে ধর্মৌরসজাত উত্তরাধিাকারী হয়ে বঙ্গীশ নামে এক শাস্তাশ্রাবক হবে।

১১৮.তা শুনে আমি ভীষণ রকম হয়েছিলাম। তখন আমি আজীবন মৈত্রীতদ্গত চিত্তে তথাগত জিনকে চতুপ্রত্যয় দিয়ে সেবাপূজা করেছিলাম।

১১৯.সেই সুকৃত কর্মের ফলে ও প্রার্থনা অনুসারে মনুষ্যদেহ ত্যাগ করে আমি তুষিত স্বর্গে জন্মেছিলাম।

১২০.আজ এই শেষ জন্মে আমি এক পরিব্রাজক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি। আমি জন্মের মাত্র সাতবৎসর বয়সে পরিব্রাজকেত্বে উপনীত হয়েছি।

১২১.বঙ্গে সর্ববিধ বেদজ্ঞ, তর্কশাস্ত্র বিশারদ, বিচিত্রকথা ও পরবাদ খণ্ডনকারী।

১২২.বঙ্গে জাত অর্থে ‘বঙ্গীশ’ অথবা কথায় বিশেষ পারদর্শী এই অর্থে ‘বঙ্গীশ’। এই ‘বঙ্গীশ’ নামেই আমি সবিশেষ পরিচিত হয়েছি।

১২৩.প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর প্রথম যৌবনে পদার্পন করলে পরে আমি রমনীয় রাজগৃহ নগরে সারিপুত্রস্থবিরকে দেখতে পেয়েছি।

[পঁচিশতম ভাণবার সমাপ্ত]

১২৪.তিনি পাত্রহাতে সুসংযত হয়ে পিণ্ডার্ ে বিচরণ করছিলেন। তিনি আনতচক্ষু, স্বল্পভাষী, ও যুগমাত্র দর্শনকারী।

১২৫.তাকে দেখে আমি প্রথমে বিস্ময়াবিষ্ট হয়েছিলাম। তারপর আমি চিত্তের উপযুক্ত একটি গাথা বলেছিলাম।

১২৬.তিনি আমাকে লোকনায়ক শাস্তা সম্বুদ্ধের কথা বলেছিলেন। তখন সেই পণ্ডিতবীর সারিপুত্রস্থবির আমাকে আরও কিছু উপদেশ দিয়েছিলেন।

১২৭.তিনি তার স্বভাবসুলভ জ্ঞানমূলক ও বিরাগমূলক সুদর্শণ উত্তম উপদেশকারী শুনিয়ে আমাকে তুষ্ট করেছিলেন।

১২৮.তারপর আমি পায়ে মাথা ঠেকালে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘প্রব্রজ্যা গ্রহণ করো।’ তারপর সেই মহাপ্রজ্ঞ আমাকে বুদ্ধশ্রেষ্ঠের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন।

১২৯.আমি ভগবানের রাতুল চরণে মাথা ঠেকিয়ে বন্দনা করে শাস্তার কাছে বসেছিলাম। তখন তিনি আমাকে বললেন, ‘বঙ্গীশ, তুমি কিছু জান কি?’

১৩০.আমি বললাম, ভন্তে, আমি সামান্য একটা শিল্প জানি। আর তা হচ্ছে, মৃতশির বিদ্যা। বার বৎসরের মৃত হলেওবলে দিতে পারি।’ তখন ভগবান বললেন, ‘সত্যই যদি তোমার ওই বিদ্যা জানা থাকে, তবে এখন আমাকে বলতে পারবে কি?’

১৩১.আমি তাঁর কথায় সম্মত হলে পরে তিনি আমাকে তিনটি মৃতশির দেখালেন। সঙ্গে সঙ্গে আমি বলেদিলাম, একজ নিরয়ে, এজন মনুষ্যলোকে এ একজন দেবলোকে উৎপন্ন হয়েছে।

১৩২.তারপর তিনি আমাকে একজন ক্ষীণাসব অর্হতের শির দেখালেন। তখন আমি বলে দিতে ব্যর্ হলাম। আমি প্রব্রজ্যা প্রার্থনা করলাম।

১৩৩.প্রব্রজ্যা গ্রহণের পর আমি সুগতকে এখানে-ওখানে যত্রত্র ভূয়শী প্রশংসা করছিলাম। তাই ভিক্ষুগণ আমাকে ‘দক্ষ কবি’ বলে নিন্দা করছিলেন।

১৩৪.তারপর বিনায়ক বুদ্ধতা মীমাংসার জন্যে আমাকে বললেন, ‘তুমি কি এই তর্কমূলক গাথাগুলো প্রত্যক্ষ জ্ঞানে বলছ?’

১৩৫.আমি বললাম, ‘হে বীর, আমি দক্ষ কবি নই। তবে আমি আমার প্রত্যক্ষ জ্ঞানেই সেগুলো বলছি।’ ভগবান বললেন, ‘তাহলে হে বঙ্গীশ, এখন আমার সামনে একটু বলে দেখ তো ?’

১৩৬.তখন আমি গাথাযোগে ঋষিশ্রষ্ঠ পুরুষোত্তমবীরবুদ্ধকে ভূয়শী প্রশংসা করলাম। জিনশ্রেষ্ঠ আমার গাথা মুনে ভীষণরকম খুশী হলেন এবং আমি বিচিত্রকথক শ্রেষ্ঠপদে বসালেন।

১৩৭.আমি আমার প্রতিভাণ চিত্ত দিয়ে অন্যের সবকিছু জানতে পারি শুনে অন্যভিক্ষুরা সংবিগ্ন হলেন। আমি অর্হত্ত্ব লাভ করেছিলাম।

১৩৮.ভগবান বললেন, হে ভিক্ষুগণ, এই বঙ্গীশ ভিক্ষুই বিচিত্রকথক ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ। এবিষয়ে অন্য কেউ তার সমতুল্য নেই।

১৩৯.আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে কৃত কর্ম এই জন্মেও আমাকে ফল দিচ্ছে। আমি এখন সুমুক্ত। তীরের গতিতে আমি আমার সমস্ত ক্লেশকে দগ্ধ করেছি।

১৪০.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

১৪১.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

১৪২.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মানবঙ্গীশ স্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন। [বঙ্গীশ স্থবির অপদান চতুথসমাপ্তর্]

৫.নন্দক স্থবির অপদান

১৪৩.আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে পৃথিবীতে সর্ববিধ ধর্মে চক্ষষ্মান নায়ক পদুমুত্তর জিন উৎপন্ন হয়েছিলেন।

১৪৪.সর্বসত্ত্বগণের হিত, সুখ ওমঙ্গলের জন্যেই এই পুরুষশ্রেষ্ঠ বুদ্ধ সদেবলোকে প্রতিপন্ন হয়েছিলেন।

১৪৫.তিনি শ্রেষ্ঠ যশস্বী, শ্রীমান, কীর্তিমান, জিন, সর্বলোকে পূজিত ও সর্বদিকে বিশ্ববিশ্রুত ছিলেন।

১৪৬.তিনি সম্পূর্ণ বিচিকিৎসামুক্ত, সন্দেহোত্তীর্ণ, পরিপূর্ণ সংকল্প ও উত্তম সম্বোধিপাপ্ত।

১৪৭.নরোত্তম বুদ্ধ উৎপন্ন মার্গের উৎপন্নকারী, অব্যাখ্যাতের ব্যাখ্যাদানকারী ও অসংঞ্জাতের সঞ্জাতকারী।

১৪৮.মার্গজ্ঞ, মার্গবিদ ও মার্গকথক নরশ্রেষ্ঠ বুুদ্ধ তিনি মার্গকুশল শাস্তা ও সারথিশ্রেষ্ঠ।

১৪৯.তখন মহাকারুণিক নায়ক বুদ্ধ ধর্মদেশনা করতেন এবং কামপঙ্কে নিমগ্নপ্রাণিদের উদ্ধার করতেন।

১৫০.মহামুনি বুদ্ধ একদিন তার এক শ্রাবককেভিক্ষুণীদের উপদেষ্টা ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠপদে প্রতিষ্ঠিত করছিলেন।

১৫১.তা শুনে আমি ভীষণ রকম খুশি হয়েছিলাম। তারপর আমি তথাগত প্রমুখ সংঘকে নিমন্ত্রণ করে ভোজন করিয়ে সেই শ্রেষ্ঠপদ প্রার্থনা করেছিলাম।

১৫২.তখন মহাঋষি নাথ বুদ্ধ অত্যন্ত খুশি হয়ে আমাকে বলেছিলেন, ‘তুমি সুখি হও, দীর্ঘায়ু হও। ভবিষ্যতে তোমার সেই মনোরথ পূর্ন হবে।’

১৫৩.আজ থেকে লক্ষ কল্প পরে ওক্কাকুকুলে গৌতম নামে এক শাস্তা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করবেন।

১৫৪.তাঁর ধর্মে সে ধর্মৌরসজাত উত্তরাধিকারী হয়ে নন্দক নামক এক শাস্তাশ্রাবক হবে।

১৫৫.সেই সুকৃত কর্মের ফলে ওপ্রার্থনা অনুসারেমনুষ্যদেহ ত্যাগ করে আমি তাবতিংস দেবলোকে জন্মেছিলাম।

১৫৬.আজ আমি এই শেষ জন্মে শ্রাবস্তী নগরে এক মহাধনাঢ্য শ্রেষ্ঠী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি।

১৫৭.শ্রাবস্তী নগরে সুগত প্রবেশ করলে পরে আমি তাকে বিস্ময়নেত্রে দেকেছিলাম। তারপর আমি জেতবনরামে গিয়ে অনাগারিক প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছিলাম।

১৫৮.অচিরেই আমি অর্হত্ত্ব লাভ করলাম। তারপর আমি সর্বদশী বুদ্ধ কর্তৃক অনুশাসিত হয়ে তীর্ণসংসার হয়েছি।

১৫৯.একদিন ভিক্ষুণীদের ধর্মদেশনা করতে গিয়ে আমি তাদের প্রতিপ্রশ্ন করেছিলাম। আমার দ্বারা অনুশাসিত, উপবিষ্ট হয়ে তারা সবাই অনাসক্ত হয়েছিল।

১৬০.তাতে প্রায় পাঁচশত ভিক্ষুণীআমার প্রতি প্রসন্নচিত্ত হয়েছিল। তাই বুদ্ধ আমাকে ভিক্ষুণী উপদেষ্টা ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠপদে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

১৬১.আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে কৃতকর্ম এই জন্মেও আমাকে ফল দিচ্ছে। আমি এখন আমি সুমক্ত। তীরের গতিতে আমি আমার সমস্ত ক্লেশকে দগ্ধ করেছি।

১৬২.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

১৬৩.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

১৬৪.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি। ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মাননন্দক স্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন।

[নন্দক স্থবির অপদান পঞ্চম সমাপ্ত]

৬. কালুদায়ীস্থবির অপদান

এই স্থবিরও অতীত বুদ্ধগণের নিকট বিবিধপুণ্যকর্ম করে জন্মজন্মান্তরে সুখদপুণ্যসঞ্চয় করতে করতে পদুমুত্তর ভগবানের সময় হংসবতী নগরে এক মহাধনাঢ্য জন্মগ্রহণ করেন। একদিন তিনি শাস্তার ধর্মদেশনা শুনতে গেলেন। তখন শাস্তা এক ভিক্ষুকে কুলপ্রসাদক ভিক্ষুদের মধ্যেশ্রেষ্ঠপদে প্রতিষ্ঠিত করছিলেন। তা দেখে তিনিও সেই শ্রেষ্ঠপদ লাভের প্রাথর্না করলেন। শাস্তা তার প্রাথর্না অনুমোদন করলেন।

সেই থেকে তিনি আজীবন কুশলকর্ম করে দেবমনুষ্যলোকে সঞ্চরণ করে আমাদের বোধিসত্ত্বের মাতৃগর্ভে জনগ্রহণ্ম করেন। তিনি বোধিসত্ত্বের জন্মদিনেই ভূমিষ্ঠ হন। তখন তাকে একখানি শ্বেতবস্ত্রে শয়ন করিয়ে বোধিসত্ত্বের সহজাত বোধিবৃক্ষ, রাহুলমাতা, চারিনিধিকুম,্ভ আরোহনীয় হস্তি, কন্থক অশ্ব, ছন্ন সারথি ও কালুদায়ী অমাত্য-এই সাতটিও ছিল। কালুদায়ীর জন্মগ্রহণে সমস্ত নগরবাসী উন্নতমনা হয়েছিল বলে তার নাম নাখা হলো ‘উদায়ি’। শরীরের বর্ণ ঈষৎ কালো বিধায় ‘কালুদায়ি’ নামে পরিচিত। তিনি বোধিসত্ত্বের বাল্যবন্ধু ছিলেন। বোধিসত্ত্বের সঙ্গে খেলা করতে করতেই তিনি বেড়ে উঠেছিলেন।

পরবর্তীকালে বোধিসত্ত্ব মহাভিনিষ্ক্রমণ করে অনুক্রমে সর্বজ্ঞতাজ্ঞান লাভ করেন এবং ধর্মচক্র প্রবর্তনের পর রাজগৃহের বেণুবনে অবস্থান করেন। তখন রাজা শেুাদ্ধোধন এই সংবাদ পেয়ে বুদ্ধকে নিয়ে আসার জন্যে হাজারো পুরুষের সাথে জনৈক অমাত্যকে পাঠালেন। সেই অমাত্য বুদ্ধের ধর্মদেশনায় সময় সেখানে উপস্থিত হন। বুদ্ধের ধর্মদেশনা শুনে সেই অমাত্য সপরিষদ অর্হত্ত্ব লাভ করেন। সবাই বুদ্ধের কাছে ঋদ্ধিময় উপসম্পদা লাভ করেন। অর্হত্ত্ব লাভের পর রাজার প্রেরিত সংবাদ দশবল বুদ্ধকে আর বলেননি। এদিকে রাজা তাদের কোনো খবর না পেয়ে পুনরায় হাজারো পুরুষের সাথে অন্য একজন অমাত্যকে পাঠালেন। তারাও পূর্বানুরূপ অর্হত্ত্ব লাভ করলেন এবং ঋদ্ধিময় উপস্পদা লাভ করলেন। কিন্তু তাদের কেউই রাজার সংবাদ বুদ্ধকে বলেননি।

অতঃপর রাজা ভাবলেন, ‘ বোধ হয় এতজন লোকের দয়া আমার উপর না থাকায় দশবল বুদ্ধকে এখানে আমার কথা কেউই বলেনি। এই উদায়ি দশবল বুদ্ধের সমবয়সী, বাল্যবন্ধু, খেলার সাথী; আমার প্রতি তার স্নেহও যথেষ্ট। কাজেই একেই পাঠাব।’ এই ভেবে রাজা তাকে ডেকে বললেন, ‘তুমি একহাজার লোক নিয়ে রাজগৃহে গিয়ে দশবল বুদ্ধকে নিয়ে আস।’ তিনি বললেন, ‘রাজন, আমি যদি প্রব্রজ্যা লাভ করতে পারি, তবেই ভগবানকে এখানে নিয়ে আসব।’ রাজা বললেন, ‘তুমি যা-ই কর না কেন, আমার পুত্রকে এখনে এসে আমাকে দেখাও।’ তিনিও বেণুবনে গিয়ে সপরিষদ বুদ্ধের ধর্মদেশনা শুনে অর্হত্ত্ব লাভ করলেন এবং ঋদ্ধিময় উপসম্পদা লাভ করলেন। অতঃপর তিনি চিন্তা করলেন, ‘এখন ভগবানের কপিলাবস্তু নগরে যাওয়ার উপযুক্ত সময় নয়। যখন বসন্ত সমাগমে বৃক্ষ-লতাদি পুষ্পিত হবে, মাঠ হরিদ্বর্ণ তৃনে সমাচ্ছন্ন হবে; তখন যাওয়ার উপযুক্ত সময় হবে।’ তাই তিনি কিছুকাল অপেক্ষা করে বসন্ত সমাগমে কপিলাবস্তু নগরে গমনের জন্যে ভগবানকে প্রাকৃতিক অবস্থাবর্ণনা প্রসঙ্গে মোট ষাটটি গাথা ভাষণ করলেন। ভগবান ‘কালুদায়ি আমার কপিলাবস্তুতে গমণ ইচ্ছা করছে। আমি তার ইচ্ছা পূরণ করে দেব।’ ভেবে বিশ হাজার ক্ষীণাসব অর্হৎ ভিক্ষু পরিবেষ্টিত হয়ে রাজগৃহে হতে কপিলাবস্তুর উদ্দেশে যাত্রা করলেন। অনুক্রমে কপিলাবস্তুতেপৌঁছালে ভগবান বুদ্ধ রাজাকে ঋদ্ধিযোগে বুদ্ধবংশ দেশনা করেন। তারপর রাজার উদ্দেশে এই দুটি গাথা বলে ধর্মদেশনা প্রদান করেন :

“উঠো হ’ওনা প্রমত্ত, সুচরিত ধর্মঅনুসর, ধর্মচারী সুখে থাকে সদা, উভয়’লোকে ইহ-পর।” “চর সুচরিত ধর্মে, দুশ্চরিত কর্ম পরিহর, ধর্মচারী সুখে থাকে সদা, উভ’লোকে ইহ-পর।”

সঙ্গে সঙ্গেই রাজা স্রোতাপত্তিফলে প্রতিষ্ঠিত হলেন। তারপর রাজা বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষুসংঘকে নিমন্ত্রণ করে রাজঘরে ভোজন করিয়ে পরিতৃপ্ত কলালেন। ভোজন শেষে ভগবান বুদ্ধ ধর্মপাল জাতক দেশনা করলেন। তা শুনে রাজা সপরিষদ অনাগামিফলে প্রতিষ্ঠিত হলেন। পরবর্তীকালে রাজা একদম শেষ বয়সে শ্বেতছত্রের নিচে মৃত্যুশয্যায় শায়িত অবস্থায় অর্হত্ত্ব লাভ করে পরিনির্বাপিত হন।

অতঃপর ভগবান রাহুল মাতার ঘরে গিয়ে তাকে ধর্মদেশনা করে তার শোক দূর করেন।

তারপর চন্দকিন্নরী জাতক দেশনা করে তার চিত্তে প্রসাদ উৎপন্ন করিয়ে দিয়ে নিগ্রোধারামে চলে যাচ্ছিলেন। এমন সময় রাহুলমাতা পুত্র রাহুলকে বললেন, ‘বাবা, যাও তোমার পিতার কাছে যাও। পিতৃধনখোঁজো।’ কুমার রাহুল বুদ্ধের কাছে গিয়ে পিতৃধন চাইলেন। এভাবে পিতৃধন চাইতে চাইতে বুদ্ধের পিছে পিছে যেতে লাগলেন। ভগবান তাকে নিগ্রোধারামে নিয়ে গিয়ে ‘রাহুল, লোকোত্তর পিতৃধন নাও’ বলে তাকে প্রব্রজ্যা প্রদান করালেন।

পরবর্তীকালে ভগবান আর্যসংঘের মাঝে বসে এই বলে কালুদায়ুকে শ্রেষ্ঠপদে বসালেন : ‘হে ভিক্ষুগণ, আমার শ্রাবক কুলপ্রাসাদক ভিক্ষুদের মধ্যে কালুদায়িই শ্রেষ্ঠ।’

অর্হত্ত্ব লাভের পর একদিন কালুদায়িস্থবির নিজের পূর্বকৃত কর্ম স্বরণ করে আনন্দিত মনে নিজের পূর্বজীবনের কাহিনি প্রকাশ করতে গিয়ে ‘পদুমুত্তর জিন’ প্রভৃতি গাথা বলেছিলেন।

১৬৫.আজ লক্ষ কল্প আগে পৃথিবীতে সর্ববিধ ধর্মে চক্ষুষ্মান নায়ক পদুমুত্তর জিন উৎপন্ন হয়েছিলেন।

১৬৬.তিনি নায়কদের শ্রেষ্ঠশাস্তা, গুণাগুণে অভিজ্ঞ জিন, কৃতজ্ঞ, কৃতবেদী ওপ্রাণিদের নিবার্ণতীর্থে যুক্ত করেন।

১৬৭.অনন্ত গুণের আদার বুদ্ধ সর্বজ্ঞতাজ্ঞান দিয়ে দয়াযোগ্য বিষয় বিচার-বিবেচনা করে শ্রেষ্ঠ ধর্ম দেশন করেন।

১৬৮.কখনো, কখনো সেই মহাবীর অনন্ত জনসংঘে চর্তুসত্যবিষয়ক মধুর ধর্মদেশনা করেন।

১৬৯.আদি-মধ্য-অন্তকল্যাণময় সেই মধুর ও শ্রেষ্ঠ ধর্ম শুনে লাখোপ্রাণির ধর্মজ্ঞান উৎপন্ন হয়েছিল।

১৭০.তখন সমগ্র ভূমি নিনাদিত হয়েছিল। হ্রদ, সরোবরগুলো গর্জে উঠেছিল। আর দেবতা, ব্রহ্মা, মনুষ্য ও অসুরেরা সমসুরে সাধুবাদ জানিয়েছিল।

১৭১.তারা বলে উঠেছিল, অহো, কারুণিক শাস্ত! অহো, সদ্ধর্মদেশনা! অহো, ভবসমদ্রে নিমগ্ন লোকজনকে উদ্ধারকারী জিন!

১৭২.এমন দেব-নর-ব্রহ্মা-অসুর পরিবেষ্ঠিত জনসভায় পদুমুত্তর জিন তার এক শ্রাবকের- যিনি কুলপ্রসাদকশ্রেষ্ঠ -ভূয়শী প্রশংসা করেছিলেন।

১৭৩.তখন আমি হংসবতী নগরে এক অমাত্য পরিবারে জন্মেছিলাম। আমি ছিলাম প্রাসাদিক, দর্শনীয় ও প্রভূত বিত্তবৈভবের অধিকারী।

১৭৪.বিহারে গিয়ে তথাগত বুদ্ধকে বন্দনা করে তার মুখ থেকে মধুর ধর্ম শ্রবণ করেছিলাম।

১৭৫-১৭৭. আমি তার পদমূলেনিপতিত হয়ে এই কথা নিবেদন করেছিলাম: ‘আপনি যাকে কুলপ্রাসাদক শ্রেষ্ঠবলে ভূয়শী প্রশংসা করলেন, আমি কোনো এক বুদ্ধের শাসনে তার মতো কুলপ্রসাদক শ্রেষ্ঠ হতে চাই।’ তখন মহাকারুণিক বুদ্ধ আমার উপর আশীষবারি সিঞ্চন করে আমাকে বললেন, ‘পুত্র, উঠো তেমার মনোরথ পূর্ণ হবে। জিনশ্রেষ্ঠ বুদ্ধকে মহাদান দিয়ে তোমার প্রাথর্না কীভাবে বিফলে যাবে?’

১৭৮.আজ থেকে লক্ষ কল্প পরে ওক্কাকুকুলে গৌতম নামক এক শাস্তা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করবেন।

১৭৯.তার ধর্মে সে ধর্মৌরসজাত উত্তরাধিকারী উদায়ি নামে এক শাস্তাশ্রাবক হবে।

১৮০.তা শুনে আমি ভীষণভাবে খুশি হয়েছিলাম। তারপর থেকে আজীবন আমি মৈত্রীতদ্গতচিত্তে বিনায়ক জিনকে চতুর্প্রত্যয় দিয়ে সেবা-পূজা করেছিলাম।

১৮১.সেই সুকৃত কর্মের ফলে ও প্রার্থনা অনুসারে মনুষ্যদেহত্যাগ করে আমি তাবতিংস স্বর্গে জন্মেছিলাম।

১৮২.আজ এই শেষ জন্মে আমি রমনীয় কপিলাবস্তু নগরে শুদ্ধোদন রাজার মহামত্য পরিবারে জন্মেছি।

১৮৩.ঠিক সেই সময় সর্বলোকের হিতসুখের জন্যে নরশ্রেষ্ঠ সির্দ্ধাথ শিশু রমনীয় লুম্বিনী কাননে জন্মগ্রহণ করেন।

১৮৪.একই দিনে আমিও জন্মেছি এবং তার সাথেই বেড়ে উঠেছি। আমি ছিলাম তার বিদ্ধান, পণ্ডিত, নীতিকোবিদ প্রিয় বন্ধু।

১৮৫.তিনি উনিশ বৎসর বয়সে সংসার ত্যাগ করেছিলেন। ছয়বৎসর কঠোর সাধনা করার পর বিনায়ক বুদ্ধ হয়েছিলেন।

১৮৬.তিনি সসৈন্যমারকে পরাজিত করে, আসবসমূহকেনিঃশেষে ক্ষয় করে, ভবসাগর পার হয়ে সদেবলোকে বুদ্ধ হয়েছিলেন।

১৮৭.তারপর তিনি ঋষিপতন মৃগদাবে গিয়ে পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুদের বিনীত করেছিলেন। সেখান থেকে বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে ভগবান বহুসত্ত্বকে বিনীত করেছিলেন।

১৮৮.এভাবে দুর্বিনীদের বিনীত করতে করতে দেবমনুষ্যদের শিক্ষা দিতে দিতে জিনশ্রেষ্ঠগৌতম মগধরাজ্যে গিয়ে অবস্থান করতে লাগলেন।

১৮৯.তখন আমাকে শুদ্ধোধন রাজা আমাকে তাঁর কাছে পাঠালেন। আমি দশবল বুদ্ধের কাছে গিয়ে অর্হত্ত্ব লাভ করলাম।

১৯০.তখন আমি মহর্ষি বুদ্ধকে প্রার্থনা করে কপিলাবস্তু নগরে নিয়ে গেলাম। কপিলাবস্তু নগরে গিয়ে আমি আমার জ্ঞাতিকুলকে আনন্দিত করেছি।

১৯১.আমার সেই গুনে খুশি হয়ে জিনশ্রেষ্ঠ বিনায়ক বুদ্ধ মাকেআ মহাপরিষদে কুলপ্রসাদক শ্রেষ্ঠপদে বসালেন।

১৯২.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

১৯৩.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্যহয়েছি।

১৯৪. চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি। ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মানকালুদায়িস্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন।

[কালুদায়িস্থবির অপদান ষষ্ঠ সমাপ্ত]

৭. অভয় স্থবির অপদান

এই স্থবিরও অতীত বুদ্ধগণের নিকট বিবিধপুণ্যকর্ম করে জন্মজন্মান্তরে সুখদপুণ্যসঞ্চয় করতে করতে পদুমুত্তর ভগবানের সময় হংসবতী নগরে একএক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন ত্রিবেদজ্ঞ ও কালজ্ঞ। একদিন তিনি শাস্তার ধর্মদেশনা শুনে প্রসন্নমনে প্রশান্তিমূলক একটি গাথায় ভগবানের প্রশংসা করলেন।

তিনি আজীবন এভাবে পুণ্যকর্ম করে মৃত্যুর পর দেবলোকে জনগ্রহণ্ম করেন। পরবর্তীকালে অপরাপর সুগতি স্বর্গলোকে বিচরণ করে এই গৌতম বুদ্ধের সময়ে রাজগৃহে বিম্বিসার রাজার পুত্রহয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তার নাম রাখা হলো ‘অভয়’। যৌবনে পদার্পন করলে তিনি নির্গ্রন্ঠ নাথপুত্রের গৃহীশিষ্য হয়ে বিচরণ করেন। একদিন নির্গ্রন্ঠ নাথপুত্র তাকে বুদ্ধের সাথে বাদানুবাদের জন্যে পাঠালেন। তিনি বুদ্ধকে নিপুন কিছু প্রশ্ন করে যথার্ উত্তর পেলেন এবং সন্তুষ্ট হয়ে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। অতঃপর চরিতানুযায়ী কর্মস্থান ভাবনা করে অচিরেই অর্হত্ত্ব লাভ করেন।

অর্হত্ত্ব লাভের পর তিনি নিজের পূর্বকৃত কর্ম স্মরণ করে আনন্দিত মনে নিজের পূর্বজীবনের কাহিনি প্রকাশ করতে গিয়ে ‘পদুমুত্তর জিন’ প্রভৃতি গাথা বলেছিলেন।

১৯৫.আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে পৃথিবীতে সর্ববিধ ধর্মে চক্ষুষ্মান নায়ক পদুমুত্তর জিন উৎপন্ন হয়েছিলেন।

১৯৬.তথাগত বুদ্ধ কাউকে কাউকে ত্রিশরণেদীক্ষিত করেন। আবার কাউকে কাউকে দশবিধ কুশল কর্মপথে শীলে নিয়োজিত করেন।

১৯৭.সেই বীর কাউকে কাউকে শ্রামণ্যফল দেন। তিনি কাউকে অষ্টসমাপত্তি, আবার কাউকে কাউকে ত্রিবিদ্যা প্রদান করেন।

১৯৮.নরোত্তম বুদ্ধ কাউকে কাউকে ষড়াভিজ্ঞায় যুক্ত করেন। সেই নাথ আবার কাউকে কাউকে চারি প্রতিসমিদা্ভ প্রদান করেন।

১৯৯.নরসারথি বুদ্ধ অসংখ্যেয়্য যোজন দূরে হলেও যেখানেই ধর্মজ্ঞান লাভের উপযুক্ত সত্ত্ব দেখতে পান, মুহূর্তের মধ্যেই সেখানে গিয়ে তাকে ধর্মজ্ঞান দিয়ে আসেন।

২০০-২০১. তখন আমি হংসবতি নগরে একজন ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মেছিলাম। তখন আমি ছিলাম সর্ববেদজ্ঞ, ব্যাকরণবিদ, নিরুক্তিকুশল, অভিজ্ঞ বিশ্লেষক, পদবিষয়ে অভিজ্ঞ ও ছন্দবিশেষজ্ঞ।

২০২. একদিন আমি হাটতে হাটতে বিহারে গিয়ে পৌঁছলাম। সেখানে মহাজনতা পরিবেষ্ঠিত হয়ে বরশ্রেষ্ঠ বুদ্ধকে উপবিষ্ট অবস্থায় দেখতেপেলাম।

২০৩.তখন তিনি মহাজনতার উদ্দেশে বিরজ ধর্মদেশনার করছিলেন। তখন আমি ছিলাম বিরুদ্ধবাদী। আমি কাছে গিয়ে তার বিমল কল্যাণকর ধর্মদেশনা শোনার চেষ্টা করলাম।

২০৪.আমি সেই মুনির কথার মধ্যে কোনো নিরর্ ক অপলাপ দেখতেপেলাম না। তারপর আমি তার কাছে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছিলাম।

২০৫.অচিরেই আমি সর্বসত্ত্ববিশারদ নিপুণ বুদ্ধের কথার গুণমুগ্ধক্ত ভহয়ে গিয়েছিলাম।

২০৬.তখন আমি সুব্যঞ্জনাবিশিষ্ট চারিটি গাথা গ্রন্থিত করে ত্রিলোকাগ্র বুদ্ধের ভূয়শী প্রশংসা করেছিলাম।

২০৭.হে মহাবীর, সংসারে ভয়কে জয় করে আপনি এখন সম্পূর্ণ নিরাতঙ্ক। আপনি করুণায় পরিপূর্ণ তাই মহাকারুণিক মুনি।

২০৮.আপনি পৃথকজন প্রশমনকারী, ক্লেশানুবর্তী নন, সম্প্রজ্ঞানীও স্মৃতিযুক্ত। তাই আপনি বড়ই অচিন্তনীয়!

২০৯.চিত্তের নিভৃতে সুপ্ত থাকা দুর্বল ক্লেশগুলোকেও আপনি জ্ঞানাগ্নিতে দগ্ধ করেছেন। সেগুলো আপনাকে গ্রাস করতে পারেনি।

২১০.যিনি সর্বলোকের গুরু, তদ্রুপ সত্ত্বগণেরও গুরু, তাই তিনি লোকাচার্য। সমস্ত লোকই তাঁর অনুগামী, অনুসারী।

২১১.এভাবেই আমি সম্যকসম্বুদ্ধ ওতাঁর ধর্মদেশনার ভূয়শী প্রশংসা করেছিলাম। আজীবন পুণ্যকর্ম করে মৃত্যুর পর আমি সুগতি স্বর্গলোক জন্মেছিলাম।

২১২.আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে আমি বুদ্ধের গুণকীর্তন করেছিলাম, সেই থেকে একবারও আমাকে অপায় দুর্গতিতে পড়তে হয়নি। ইহা আমার গুণকীর্তনেরই ফল।

২১৩.দেবলোকে আমি কাঞ্চনতুলে মহারাজ্য লাভ করেছিলাম। বহুবার আমি মনুষ্যলোকে চক্রবর্তী রাজত্ব উপবোগ করেছিলাম।

২১৪.আমি দেবলোকে ও মনুষ্যলোকে এই ভবে মাত্র জন্মগ্রহণ করেছি। আমার অন্যগতি হয়েছে বলে আমার জানা নেই। ইহা আমার গুণকীর্তনেরই ফল।

২১৫.আমি ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণ এই দুই কুলে মাত্র জন্মগ্রহণ করেছি। কখনো নীচ কুলে মাত্র জন্মগ্রহণ করেছি। কখনো নীচ কুলে জন্মেছি বলে আমার জানা নেই। ইহা আমার গুণকীর্তনেরই ফল।

২১৬.আজ আমি এই শেষ জন্মে রাজগৃহ নগরে বিম্বিসার রাজার পুত্র হয়ে জন্মেছি। আমার নাম হচ্ছে ‘অভয়’।

২১৭.আমি পাপমিত্র সংসর্গ করায় নির্গ্রন্ঠ নাথপুত্রের ভক্ত অনরাগী হয়েছিলাম। একদিন নির্গ্রন্ঠ নাথপুত্র আমাকে বুদ্ধের কাছে পাঠালেন আমি বুদ্ধের কাছে গিয়েছিলাম।

২১৮.আমি বুদ্ধকে নিপুণ কিছুপ্রশ্ন করলে তিনি আমার যথার্ উত্তর দিয়েছিলেন। আমি তাঁর প্রতি চিত্তপ্রসন্ন হয়ে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছিলাম এবং অচিরেই অর্হত্ত্ব লাভ করেছিলাম।

২১৯.অতীত জন্মে বুদ্ধের গুণকীর্তন করার ফলে আমিওসব সময় প্রশংসিত হই। আমি সুগন্ধময় দেহের অধিকারী ও সুখী হয়েছি।

২২০.সেই কর্মের ফলে আমি সদা হাস্যময়, তীক্ষ্নপ্রাজ্ঞ, মহাপ্রাজ্ঞ ও বিচিত্র ধর্মকথিক হয়েছি।

২২১.সয়মূ্ভ পদুমুত্তর বুদ্ধকে প্রসন্নচিত্তে ভূয়শী প্রশংসা করে আমি লক্ষকল্প পর্যন্ত অপায় ভূমিতে জন্মাইনি।

২২২.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

২২৩.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

২২৪.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মান অভয়স্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন। [অভয় স্থবির অপদান সপ্তম সমাপ্ত]

৮. লোমসকঙ্গিয় স্থবির অপদান

এই স্থবিরও অতীত বুদ্ধগণের নিকট বিবিধপুণ্যকর্ম করে জন্মজন্মান্তরে সুখদপুণ্যসঞ্চয় করতে করতে কাশ্যপ ভগবানের সময় এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন শ্রদ্ধাবান ও প্রসন্নচিত্ত। তার চন্দন নামে এক বন্ধু ছিল। তারা দুই বুন্ধু মিলে শাস্তার ধর্মদেশনা শুনে প্রসন্ন হয়ে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। তারা অজীবন পরিশুদ্ধভাবে শীল পালন করেন। মৃত্যুর পর দেবলোকে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানে এক বুদ্ধান্তর কল্প পর্যন্ত দিব্যসুখ ভোগ করেন।

তাদের দুজনের মধ্যে এই ব্যক্তি এই গৌতম বুদ্ধের সময়ে শাক্যকুলে জন্মগ্রহণ করেন। আর চন্দন নামের ওই ব্যক্তি দেবপুত্র হয়ে তাবতিংস দেবলোকে জন্মগ্রহণ করেন। অত;পর একদিন শাস্তা শাক্যকুলের প্রসন্নতা উৎপাদনের জন্যে ও শাক্যরাজার মান বাঙার জন্যে বেশ্বান্তর জাতক দেশনা করলেন, বিবিধ ঋদ্ধিপ্রতিহার্য দেখালেন। তা দেখে তিনি প্রসন্নমনে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। মধ্যমনিকায়ে উক্ত ভদ্দেকরত্ত সুত্তন্ত দেশনা শুনে তিনি তদনুযায়ী জ্ঞানকে প্রসারিত করে কর্মস্থান ভাবনায় মনোনিবেশ করেন এবং অচিরেই অর্হত্ত্ব লাভ করেন।

অর্হত্ত্ব লাভের পর তিনি নিজের পূর্বকৃত কর্ম স্মরণ করতে গিয়ে আনন্দিত মনে নিজের পূর্বজীবনের কাহিনি প্রাকাশ করতে গিয়ে‘এই ভদ্রকল্পে’ প্রভৃতি গাথা বরেছিলেন।

২২৫.এই ভদ্রকল্পে ব্রহ্মবন্ধু, মহাযশস্বী কাশ্যপ বুদ্ধ জগতে উৎপন্ন হয়েছিলেন।

২২৬.তখন আমি এবং চন্দন নামে আমার এক বন্ধু দুজনেতাঁর শাসােন প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছিলাম। আমরা আমৃত্যু কাল বুদ্ধশাসনে ধর্মাচরণ করেছিলাম।

২২৭.মৃত্যুর পর আমরা উভয়েই দেবলোবে উৎপন্ন হয়েছিলাম। সেখানে আমরা দিব্য নাচ, গান, বাদ্য-বাজনায় আমোদিত হয়েছিলাম।

২২৮.আমরা সেখানে রূপাদি দশবিধ অঙ্গে অভিভূত হয়ে আজীবন বাস করে শেষতক মহাসুখ ভোগ করেছিলাম।

২২৯.সেখানে থেকে চ্যুত হয়ে আমার বুন্ধু চন্দন তাবতিংস দেবলোকে উৎপন্ন হয়েছিল। আর আমি কপিলাবস্তুতে শাক্যকুলে জন্ম নিয়েছিলাম।

২৩০.লোকনায়ক বুদ্ধ যখন উদায়ি স্থবিরের প্রার্থনায় শাক্যদের প্রতি অনুকম্পা পরবশহয়ে কপিলাবস্তুতে উপনীত হয়েছিলেন।

২৩১.তখন জাত্যাভিমানী শাক্যগণ বুদ্ধগুণের কথা জানত না। তারা তখন জাত্যাভিমান বশে ও অশ্রদ্ধাবশে সম্বুদ্ধকে প্রণাম পর্যন্ত করেনি।

২৩২.শাক্যদের মনোভাব জ্ঞাত হয়ে লোকনায়ক জিন তখন আকাশে চংক্রমণ করেছিলেন’ ঘনমেঘের ন্যায় ধর্মবারি বর্ষণ করেছিলেন এবং অগ্নিরাশির ন্যায় প্রজ্বলিত হয়েছিলেন।

২৩৩. তিনি তার অতুলনীয় রূপ প্রদর্শন করে আবার অন্তর্হিত হতেন এবং একাই সহস্রজনে রূপান্তরিত হয়ে আবার এক হয়ে যেতেন।

২৩৪.তিনি সমস্ত অন্ধকারকে আলোকিত করে দিতেন। এভাবে বহুপ্রকারে ঋদ্ধিপ্রতিহার্য দেখিয়ে মহামুনিবুদ্ধ নিজ জ্ঞাতিদের বিনীত করেছিলেন।

২৩৫.সঙ্গে সঙ্গে চারি দীপের মহামেঘ প্রবল বারি বর্ষণ শুরু করেছিল। তখন বুদ্ধ বেশ্বান্তর জাতক দেশনা করেছিলেন।

২৩৬-২৩৭. তখন ক্ষত্রিয়রা সবাই নিজেদের জাত্যাভিমান ত্যাগ করে বুদ্ধের শরণ গ্রহণ করেছিল। যখন সমগ্র পৃথিবী কম্পিত হয়েছিল। তখন শুদ্ধোদন রাজা বলেছিলেন, হে ভূরিপ্রাজ্ঞ, হে সামন্তচক্ষু, আপনার পায়ে, এই আমার তৃতীয়বারের মতো বন্দনা।

২৩৮.বুদ্ধের এমন প্রভাব, এমন শক্তিমত্তা দেখে আমিবিস্ময়াভিভূত হয়েছিলাম। তখনি আমি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছিলাম এবং মাতৃপূজায় মনযোগী হয়ে বাস করছিলাম।

২৩৯.তখন আমার পুরনো বন্ধু চন্দন দেবপুত্র আমার কাছে এসে ভদ্দেকরত্তের সংক্ষিপ্ত ও বিস্তারিত বর্ণনা জিজ্ঞেস করেছিলেন।

২৪০.তার কাছে প্রণোদনা পেয়ে আমি নরনায়ক বুদ্ধের কাছে গিয়েছিলাম। তারপর বুদ্ধের মুখ থেকে ভদ্দেকরত্ত বিষয়ে শুনে সংবেগ প্রাপ্ত হয়ে বনবাসী হয়ে যেতে চেয়েছিলাম।

২৪১.তখন আমি আমার মাকে বলেছিলাম, ‘আমি বনে একাকী বসবাস করতে চাই।’ অতঃপর মা আমাকে এই বলে বারণ করেছিলেন, ‘বাবা, তুমি সুকুমার, কোমল দেহের অধিকারী। তুমি বনে একা থাকতে পারবে না।’

২৪২.তখন আমি মাকে বলেছিলাম, আমি দুটা, সকন্টক বৃক্ষ, উশীর, মুঞ্জ, বব্বজ তৃণ প্রভৃতি বুক দিয়ে সরিয়ে দিয়ে সেই দুঃখ সহ্য করব, পায়ের কথাই-বা কী! তারপরও আমি কায়বিবেক, চিত্তবিবেক ও চিত্তবিবেক ও উপধিবিবেককে অবলম্বন করব।

২৪৩.এই বলে আমি বনে প্রবেশ করেছিলাম। ভদ্দেকরত্ত বিষয়ে বুদ্ধের উপদেশ স্মরণ করে আমি অর্হত্ত্ব লাভ করেছিলাম।

২৪৪.যার অতীতের আক্ষেপ নেই, ভবিষ্যতের প্রপঞ্চ নেই এবং যেভাবে যে, যা কিছু অতীত তা তো এখন প্রহীণ ও ভবিষ্যৎও এখনো অলব্ধ।

২৪৫.আর যে ব্যক্তি বর্তমান বিষয়ে বিশেষভাবে দৃষ্টি রাখেন, তিনিই অবিচলিত, অকম্পিত। বিদ্বান ব্যক্তি তাকেই অনুসরণ করেন।

২৪৬.আজই আমাকে করনীয় কৃত্য সম্পাদনে তৎপর হতে পবে। কে জানে আমার মরণ আগামীকালও হতে পারে। সেই মহাসেন মৃত্যুর সাথে কোনো পাঞ্জা লড়তে নেই।

২৪৭.আমি এভাবেই বীর্যবান হয়ে অহোরাত্র অতন্দ্রভাবে অবস্থান করেছিলাম। আর তা-ই হচ্ছে মহামুনি-ভাষিত ‘ভদ্দেকরত্ত’।

২৪৮.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

২৪৯.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

২৫০.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মানলোমসকঙ্গিয় স্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন। [লোমসকঙ্গিয় স্থবির অপদান অষ্টম সমাপ্ত]

৯. বনবচ্ছ স্থবির অপদান

এই স্থবিরও অতীত বুদ্ধগণের নিকট বিবিধপুণ্যকর্ম করে জন্মজন্মান্তরে সুখদপুণ্যসঞ্চয় করতে করতে কাশ্যপ ভগবানের সময় এক কুলীন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। একদিন তিনি শাস্তার ধর্মদেশনা শুনে শ্রদ্ধায় প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। তখন পরিশুদ্ধভাবে ব্রহ্মচর্যা আচরণ করে মৃত্যুর পর দেবলোকে জন্মগ্রহণ করেন। সেখান থে কে চ্যুত হয়ে তিনি অরন্যের মাঝে এক ভিক্ষুর সমীপে কবুতর হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। সেই ভিক্ষুর মুখ থেকে মৈত্রীতদ্গত চিত্তে ধর্ম শ্রবণ করে মৃত্যুর পর দেবমনুষ্যলোকে বিচরণ করে এই গৌতম বুদ্ধের সময়ে কপিলাবস্তু নগরে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।

পরিপূর্ণ গর্ভা মাতার অরণ্য দর্শনের ইচ্ছা উৎপন্ন হলে পরে তনি একসময় অরন্যে গিয়ে বিচরণ করতে লাগলেন, এমন সময় প্রসব বেদনা উৎপন্ন হলো। তখনি পর্দা দিয়ে ঘিরে ধরলে তিনি ধন্যপুণ্যলক্ষণসম্পন্ন এক পুত্র প্রসব করলেন। এই বালক বোধিসত্ত্বের বাল্যবন্ধু ছিল। অতঃপর বোধিসত্ত্ব মহাভিনিষ্ক্রমণের পর প্রব্রজ্যা নিয়ে ছয় বৎসর কঠোর দুস্করচর্যা অনুশীলন করে বুদ্ধত্ত্বলাভ করেন। পরে একসময় তিনি মহাকাশ্যপ স্থবিরের কাছে গিয়ে তার উপদেশ শুনে প্রসন্ন হন। তার মুখ থেকে বুদ্ধ উৎপন্নহয়েছেন শুনে তিনি শাস্তার কাছে গিয়ে ধর্মশ্রবন করেন। তারপর প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে অচিরেই তিনি ষড়াভিজ্ঞাসহ অর্হত্ত্ব লাভ করেন।

অর্হত্ত্ব লাভের পর তিনি নিজের পূর্বকৃত কর্ম স্মরণ করে ানন্দিতঅ মনে নিজের পূর্বজীবনের কাহিনি প্রকাশ করতে গিয়ে ‘এই ভদ্রকল্পে’ প্রভৃতি গাথা বলেছিলেন।

২৫১. এই ভদ্রকল্পে ব্রহ্মবন্ধু মহাযশস্বী কাশ্যপ ভগবান পৃথিবীতে উৎপন্ন হয়েছিলেন।

২৫২-২৫৩. সেই কাশ্যপ বুদ্ধের শাসনে পালন করেছিলাম। মৃত্যুর পর আমি সেই সুকৃত কর্মের ফলে ও প্রার্থনা অনুযায়ী মনুষ্যদেহ ত্যাগ করে তাবতিংস দেবলোকে জন্মেছিলাম।

২৫৪.সেখান থেকে চ্যুত হয়ে আমি অরন্যে এক কবুতর হয়ে জন্মেছিলাম। সেই অরন্যে এক গুণবান ধ্যানী ভিক্ষুবাস করতেন।

২৫৫.তিনি ছিলেন মৈত্রীপরায়ণ, কারুণিক, আনন্দিতমন, উপেক্ষক, মহাবীর ও অপ্রমাদে অভিজ্ঞ।

২৫৬.অচিরেই আমি সেই বিনীবরণসংকল্পের অধিকারী ও সকল সত্ত্বগণের হিতকাঙক্ষী সুগতশ্রাবকের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে গিয়েছিলাম।

২৫৭.তখন আমি তার আশ্রমে গিয়ে তার পদমূলে গিয়ে পড়েছিলাম। তিনি আমাকে কখনো কিছু খাদ্য দিতেন, আবার কখনো ধর্মদেশনা করতেন।

২৫৮.তখন আমি বিপুল আনন্দ নিয়ে জিনশ্রাবককে বন্দনা করেছিলাম। ফলে মৃত্যুর পর আমি নিজ ঘরে ফিরে যাবার ন্যায় স্বর্গে জন্মেছিলাম।

২৫৯.পূর্বকৃতপুণ্যপ্রভাবে স্বর্গ থেকে চ্যুত হয়ে মনুষ্যলোকে জন্মেছিলাম। আমি গৃহত্যাগ করে প্রব্রজ্যা নিয়েছিলাম।

২৬০.আমি একজন শ্রমণ, তপস্বী, পরিব্রাজকের ন্যায় গভীর অরন্যে কোনো কুটির ছাড়াই বসবাস করেছিলাম।

২৬১.আজ এই শেষ জন্মে আমি রমনীয় কপিলাবস্তু নগরে বচ্ছগোত্রে এক কন্যার গর্ভে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করেছিলাম।

২৬২.গর্ভে আমি তির্যকভাবে শুয়ে থাকলে পরে ভূমিস্ট হবার সময়ে আমার মায়ের অরন্যবাসের প্রবল ইচ্ছা জেগেছিল।

২৬৩.তারপর মা আমাকে রমণীয় বনে গিয়ে প্রসব করেছিলেন। প্রসবের পর পরই আমাকে বস্ত্রাবৃত করা হয়েছিল।

২৬৪.সেই সময় শাক্যবংশের রাজপরিবারে সিদ্ধার্থ কুমারও জন্ম নিয়েছিলেন। আমি সির্দ্ধাথ কুমারের প্রিয় ও অত্যন্ত বিশ্বস্ত বন্ধু ছিলাম।

২৬৫.সংসারকে অসার হিসেবে দেখায় বিপুল যশ ত্যাগ করে আমি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে হিমালয়ে চলে গিয়েছিলাম।

২৬৬.আমি বনবাসী, ধুতাঙ্গধারী মাননীয় মহাকাশ্যপ স্থবিরকে দেখে তার মুখ থেকে বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছেন শুনে নরসারথি বুদ্ধের কাছে গিয়েছিলাম।

২৬৭.তিনি আমাকে ধর্মদেশনা করেছিলেন। তিনি সকল প্রকারে তার ধর্ম প্রকাশ করেছিলেন। তার পর আমি প্রব্রজ্যা নিয়ে পুনরায় আমি বনে চলে গিয়েছিলাম।

২৬৮.সেখানে আমি অপ্রমত্তভাবে অবস্থান করে ষড়াভিজ্ঞা লাভ করেছিলাম। অহো, কল্যাণমিত্রের অনুকম্পায় আমার পরম লাভই হয়েছে!

২৬৯.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

২৭০.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

২৭১.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মানবনবচ্ছ স্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন। [বনবচ্ছ স্থবির অপদান নবম সমাপ্ত]

১০. চূলসুগন্ধস্থবির অপদান

এই স্থবিরও অতীত বুদ্ধগণের নিকট বিবিধপুণ্যকর্ম করে জন্মজন্মান্তরে সুখদপুণ্যসঞ্চয় করতে করতে কাশ্যপ সম্যকসম্বুদ্ধেরসময় বারাণসীর এক এক ধনাঢ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। একদিন তিনি শাস্তার ধর্মদেশনা শুনে শ্রদ্ধায় প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। একদিন তিনি শাস্তার ধর্মদেশনা শুনে প্রত্যহ বন্দনা করতেন এবং মহাদান দিতেন। তিনি মাসে সাতবার বগবানের গন্ধকুটিতে চার ধরনের সুগন্ধি মেখে দিতেন। তিনি প্রাথর্না করতেন, এই দানের ফলে যেন জন্মে জন্মে আমার শরীর হতে সুগন্ধি বের হয়।’ ভগবান তার প্রাথর্না পূরণ হবে বলে জানালেন।

তিনি আজীবন এভাবে পুণ্যকর্ম করে মৃত্যুর পর দেবলোকে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানে তার শরীর থেকে সব সময় সুগন্ধ ছড়াত। তাই তিনি সুগন্ধ দেবপুত্র নামে পরিচিত হলেন। তিনি সেখানে সময়ে এক মহাধনাঢ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মাতৃগর্ভে প্রতিসন্ধিগ্রহণের পর তার মায়ের শরীল থেকে প্রতিনিয়ত সুগন্ধি ছড়াত। সেই সুগ্ধ ক্রমেঘরময় ও নগরময় ছড়িয়ে পড়ল। তার জন্মের পর সমস্ত শ্রাবস্তী নগর যেন একটি সুগন্ধিবাস্কে পরিণত হলো। তাই নাম রাখা হলো সুগন্ধ। ক্রমে তিনি বড় হলেন। তখন শাস্তা শ্রাবস্তীতে এসে জেতবন মহাবিহারটি দান গ্রহণ করলেন। তা দেখে তিনি প্রসন্নমনে ভগবানের কাছে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করলেন এবং বিদর্শন ভাবনা করে অচিরেই প্রতিসম্ভিদাসহ অর্হত্ত্ব লাভ করলেন। তার জন্মে পর থেকে পরিনির্বাণের আগ পর্যন্ত তিনি যেখানেই বসতেন, দাড়াতেন, বাস করতেন- সর্বত্রই সুগন্ধি প্রবাহিত হতো। দেবতারাও দিব্যচূর্ণ ও দিব্যসুগন্ধি পুষ্প ছিটাতেন।

অর্হত্ত্ব লাভের পর তিনি নিজের পূর্বকৃত কর্ম স্মরণ করে আনন্দিত মনে নিজের পূর্বজীবনের কাহিনি প্রকাশ করতে গিয়ে ‘এই ভদ্রকল্পে’ প্রভৃতি গাথা বলেছিলেন।

২৭২.এই ভদ্রকল্পে ব্রহ্মবন্ধু, মহাযশস্বী কাশ্যপ বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন।

২৭৩.তিনি অনুব্যঞ্জনসম্পন্ন, বত্রিশ মহাপুরুষলক্ষণবিশিষ্ট, ব্যামপ্রভা-বিমণ্ডিত ও বুদ্ধরশ্মিতে উদাসিত।্ভ

২৭৪.তিনি চাঁদের ন্যায় স্নিগ্ধ, সূর্যের ন্যায় প্রবাকর, মহামেঘের নির্বাপক ও সাগরের ন্যায় গুণের আকর।

২৭৫. তিনি শীলে ধরনীসদৃশ, সমাধিতে হিমালয় সদৃশ ও প্রজ্ঞাময় সুনীল আকাশসম।

২৭৬. তখন আমি বারাণসীতে প্রভৃত ধনসম্পত্তি ও নানা প্রকার রত্নের মালিক এক মহাধনাঢ্য পরিবারে জন্মেছিলাম।

২৭৭. তখন লোকনায়ক বুদ্ধ বিশাল পরিষদ পরিবেষ্টিত হয়ে উপবিষ্ট ছিলেন। আমি তার কাছে গিয়ে অমৃতোপম মনোরঞ্জক ধর্ম শ্রবণ করেছিলাম।

২৭৮-২৮৭. তিনি বত্রিশ মহাপুরুষলক্ষণ সম্পন্ন, সুনক্ষত্র চন্দ্রতুল্য, অনুব্যঞ্জন সম্পন্ন, সুপষ্পিত শাল বৃক্ষতুল্য, বৃদ্ধরশ্মিতে উদ্ভাসিত, সুবর্ণের ন্যায় প্রদীপ্ত, ব্যামপ্রভাময়, শতরশ্মি দিবাকর তুল্য, সুবণবর্ণ জিনবার, রমনীয় শিলাময় পর্বত তুল্য, করুণাপরায়ণ, সাগরের ন্যায় গুণধর, পৃথিবীব্যপি যশ-কীর্তির অধিকারী, সিনেরুতুল্য নাগোত্তম, যশস্বী বীর, আকাশসম মুনি, বায়ুর ন্যায় সর্ববিষয়েইঅলগ্নচিত্ত নায়ক, পৃথিবীর ন্যায় সর্বসত্ত্বের প্রতিষ্ঠিতা মুনিশ্রেষ্ঠ, পদ্মের ন্যায় লোকে অলিপ্তস্বভাব, কুমতি উচ্ছেদ সাধনে অগ্নিস্কন্ধের ন্যায় শোভমান, ক্লেশ বিনাশে সর্বৌষুধের ন্যায়, গন্ধমাদন পর্বতের ন্যায় গুণগন্ধে বিভূষিত, অনন্তগুণের আকরবীর, রত্নের সাগর, বনরাজির ক্লেশমল বিধেীতে সিন্ধুসম, মারসেনা দমনে মহান যুদ্ধজয়ী, চক্রবর্তী রাজার ন্যায় বোজ্ঝাঙ্গ রত্নের অধিকারী, দ্বেষব্যাধি চিকিৎসায় মহান চিকিৎসক তুল্য ও দৃষ্টিরূপ বিষফোঁড়া উৎপাঁনে দক্ষ শল্য চিকিৎসক।

২৮৮.তখন সেই লোকপ্রদ্যোৎ, দেবনরপূজিত, পরিষদে নরাদিত্য জিন ধর্মদেশনা করতেন।

২৮৯.দান দিয়ে মহাভোগসম্পত্তির মালিক হওয়া যায়, শীল পালন করে সুগতিতে জন্মহওয়া যায়, আর ভাবনার দ্বারা নির্বাণ লাভ করা যায়, তিনি এই বলে পরিষদে উপদেশ দিয়েছিলেন।

২৯০.মহাস্বাদযুক্ত অমৃতোপম রসসিক্ত ও আদি-মধ্য-অন্তকল্যাণ সম্পন্ন সেই দেশনা সেই পরিষদের সকলেই শ্রবণ করেছিলেন।

২৯১.সুমধুর ধর্মদেশনা শুনে আমি জিনশাসনে প্রসন্ন হয়েছিলাম এবং সুগতশরণনিয়ে আজীবন তাকে নমস্কার করেছিলাম।

২৯২.তখন আমি মাসে আটবার মুনিশ্রেষ্ঠ বুদ্ধের সমস্ত গন্ধকুটিতে চার ধরনের সুগন্ধি লেপন করতাম।

২৯৩.আমি প্রার্থনা করেছিলাম, সেই সুগন্ধি দানের ফলে আমার শরীর হতেসব সময় যেন সুগন্ধি ছড়ায়। তখন জিনশ্রেষ্ঠ বুদ্ধ আমার মনস্কার পূর্ণ হবে বলে বলেছিলেন।

২৯৪-২৯৫. তিনি কলেছিলেন, যেই ব্যক্তি আমার গন্ধকুটিতে গন্ধোদক মেখে দিয়েছে, সে সেই কর্মের ফলে যেখানে যেখানে উৎপন্ন হবে সর্বত্রই সুগন্ধময় দেহের অধিকারীহবে। গন্ধযুক্ত হয়ে অবশেষে সম্পূর্ণ অনাসক্ত হযে পরিনির্বাপিত হবে।

২৯৬.সেই সুকৃত কর্মের ফলে ও প্রার্থনা অনুযায়ী মনুষ্যদেহ ত্যাগ আমিকরে তাবতিংস দেবলোকে জন্মেছিলাম।

২৯৭.আজ এই শেষ জন্মে আমি এক কুলীন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি। আমি প্রতিসন্ধি গ্রহণের সাথে সাথে আমার মায়ের শরীর থেকে সুগন্ধি ছড়াত।

২৯৮.আমি যখন ভূমিষ্ঠ হলাম তখন সমস্ত শ্রাবস্তী সগরীই সুগন্ধীময় হয়েছিল।

২৯৯.তখন মনোরম দিব্যপুষ্পগন্ধ ও সৌরভছড়াচ্ছিল এবং মহার্ঘ মূল্যের ধূপগুলো সুগন্ধি ছড়াচ্ছিল।

৩০০.আমি যেই ঘরে জন্ম নিয়েছিলাম, সেই ঘরে দেবতারা সর্ববিধ ধূপ ও পুষ্পের সুগন্ধি নিয়ে বাস করেছিল।

৩০১.আমি যখন যৌবনে পদার্পণ করলাম তখন নরসারথি বিশাল পরিষদেকে বিনীত করেছিলেন।

৩০২.নরসারথি বুদ্ধ সেই পরিষদ পরিবেষ্টিতহয়ে শ্রাবস্তী নগরীতে এসেছিলেন। আমি তাঁর বুদ্ধানুভাব তথা প্রভাব দেখে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছিলাম।

৩০৩.আমি শী, সমাধি, প্রজ্ঞা ও অনুত্তর বিমুক্তি এই চারটি বিষয় ভাবিত ও বর্ধিত করে আসবক্ষয় জ্ঞান লাভ করেছিলাম।

৩০৪.আমি যখন প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছিলাম, যখন অর্হত্ত্ব লাভ করেছিলাম, আর ভবিষ্যতে যখন পরিনির্বাণ লাভ করবে, তখন সুগন্ধি বর্ষিত হয়েছিল ও হবে।

৩০৫.আমার শরীর থেকে সব সময় মহার্ঘ চন্দন, চম্পক ও উৎপলগন্ধের ন্যায় সুগন্ধি প্রবাহিত হয়। এমনকি অন্য সকল গন্ধকে ছাড়িয়ে এখানে-ওখানে সর্বত্রই আমার শরীরে সুগন্ধ প্রবাহিত হয়।

৩০৬.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

৩০৭.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

৩০৮.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি। ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মানচূলসুগন্ধস্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন।

[চূলসুগন্ধস্থবির অপদান নবম সমাপ্ত]

[ভদ্দিয় বর্গ পঞ্চন্নতম সমাপ্ত]

স্মারক-গাথা

ভদ্দিয়, রেবত স্থবির ও মহালাভী সীবলী বঙ্গীস, নন্দক, কালুদায়ী ও অভয়স্থবির; লোমশ, বনবচ্ছ, সুগন্ধস্থবির দশম,

মোট তিনশত আটটি গাথায় এই বর্গ সমাপ্ত। অতঃপর বর্গসমূহের স্মারক-গাথা :

কণিকার বর্গ, ফলদায়ক ও তৃণদায়ক বর্গ,

কচ্চান ও ভদ্দিয় বর্গ এই পাঁচটি বর্গে মোট নয়শত চুরাশিটি গাথা উল্লিখিত। এ পর্যন্ত মোট পাঁচশত পঞ্চাশটি অপদান হয়েছে প্রকাশিত এবং সেই সাথে মোট স্মারক-গাথা ছয় হাজার দুশত আঠারটি হয়েছে বর্ণিত।