৫৬.যশ বর্গ

১.যশ স্থবির অপদান

এই স্থবিরও অতীত বুদ্ধগণের নিকট বিবিধপুণ্যকর্ম করে জন্মজন্মান্তরে সুখদপুণ্যসঞ্চয় করতে করতে সুমেধ ভগবানেরসময় এক মনানুভব নাগরাজ হয়েজন্মগ্রহণ করেন। তিনি বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষুসংঘকে নিজ নাগভবনে নিয়ে ভগবানকে বহুমূল্য ত্রিচীবর ও প্রত্যেক ভিক্ষুকে দুটি করে চীবর দান করেন। সেই পুণ্যপ্রভাবে তিনি দেবমনুষ্য লোবে বিচরণ করে সির্দ্ধাথ ভগবানের

সময় এক শ্রেষ্ঠীপুত্র হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। মহাবোধি মণ্ডপকে সপ্তরত্নে পূজা করেন। কাশ্যপ ভগবানের সময় তিনি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে শ্রমণধর্ম পালন করেন।

তিনি এভাবে সুগতি স্বর্গলোকে বিচরণ করে আমাদের এই গৌতম ভগবানের সময়ে বারাণসীতে এক মহাধনবান শ্রেষ্ঠীর পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি সুজাতা নামী যেই শ্রেষ্ঠকন্যা ভগবানকে ক্ষীরপায়স দান করেন তার গর্ভেই জন্মগ্রহণ করেন। তার নাম রাখা হলো ‘যশ’। তার শরীর ছিল অতিশয় সুকোমল। তার জন্য তিনটি প্রাসাদ নির্মিত হয়েছিল। তন্মধ্য একটি হেমন্ত ঋতুর জন্যে। তিনি ঋতু অনুযায়ী উপযুক্ত প্রাসাদে বসবাস করতেন। তিনি রাত্রিকালে পরিজনবর্গের বিশ্রী শয্যা দেখে সংবেগপ্রাপ্ত হন। তখন তিনি ভাবলেন, ‘অহো, আমি উপদ্রুত হচ্ছি।’

অতঃপর যশ কুলপুত্র সুবর্ণপাদুকা পড়ে গৃহ হতে বের হতে চাইলে দেবগণ দরজা খুলে দেন। যশ কুলপুত্র সগরদ্বারে গেলে দেবগণ নগরদ্বারওখুলে দেন। তারপর তিনি ঋষিপতন মৃগদাবে উপস্থিত হন।

সেই সময় ভগবান খুব ভোরের দিকে খোলা-মেলা জায়গায় চংক্রমণ করছিলেন। তিনি দূর

থেকেই যশ কুলপুত্রকে আসতে দেখলেন। তার পর তিনি চংক্রমণ ছেড়ে নির্দিষ্ট আসনে গিয়ে বসলেন। ভগবানের অদূরে যশপুত্র বলে উঠলেন, ‘অহো, আমি উপদ্রুত হচ্ছি।’ তখন ভগবান যশ কুলপুত্রকে উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘যশ, এসো, এইস্থান উপদ্রবহীন, এখানে কোনো উপসর্গ নেই। এসো যশ, বসো, আমি তোমাকে ধর্মদেশনা করব।’

তিনি ভগবানের কথা শুনে অতিশয় আনন্দিত হলেন এবং তৎক্ষণাৎ পাদুকা ত্যাগ করে বুদ্ধের কাছে উপস্থিত হলেন।

ভগবানকে অভিবাদন করে একপার্শ্বে বসলেন। তারপর ভগবান তাকে আনুপূর্বিক ধর্মদেশনা প্রদান করলেন। ধর্মদেশনা শুনে তখনই তিনি স্রোতাপন্ন হলেন।

এদিকে যশ কুলপুত্রের মাতা প্রাসাদে গিয়ে যশকে না দেখে তুড়গড়ি করে যশের বাবার কাছে গেলেন। গিয়ে গৃহপতিকেবললেন, ‘গৃহপতি, আমি তো আপনার পুত্র যশকে কোথাও দেখছিনা।’ তারপর যশের বাবা এদিক-সেদিক বুহুখোঁজা-খুঁজির পর একসময় মৃগদায়ে গিয়ে পৌঁছলেন। তখন বুদ্ধেরধর্মদেশনা শুনে যশের বাবা স্রোতাপন্ন হলেন এবং যশ অর্হত্ত্ব লাভ করলেন। তারপর ভগবান যশকে ‘এহি ভিক্‌খু’ বলে উপসম্পদাপ্রদান করলেন।

অর্হত্ত্ব লাভের পর আনন্দিত মনে নিজের পূর্বজীবনের কাহিনিপ্রকাশ করতে গিয়ে তিনি ‘মহাসমুদ্রের মাঝে’ প্রভৃতি গাথা বলেছিলেন।

১. মহাসমুদ্রের মাঝে আমার একটি সুনির্মিত নাগভবন ছিল। তার চারপাশে নানা পাকপাখালির কূজনে মুখরিত সুনির্মিত পুষ্করিণী। ছিল

২-৫. সেই পুষ্করিণীটি ছিল মন্দারক, পদ্ম ও উৎপল্ল পুষ্পে সমাকীর্ণ এবং তার পাশ দিয়ে স্বচ্ছ সলিলা স্রোতাস্বিনী নদী প্রবাহিত হতো। নদীটি ছিল সুন্দর স্নানঘাটসম্পন্ন, মৎস্য-কচ্ছপে ভরা, নানা জাতীয় পাকপাখালিতে পরিপূর্ণ, ময়ূরক্রোঞ্চ, কোকিল প্রভৃতিতে সমাকীর্ণ। নদীচর চক্রবক, রবিহাঁস, তিত্তির, শালিকসহ প্রভৃতি পাখি সেই নদীকে আশ্রয় করে জীবন ধারণ করত। হাঁস, ক্রোঞ্চ, কোশিয়, পিঙ্গলী পিঙ্গল প্রভৃতি পাখির কূজনে মুখরিত থাকত সেই নদীটি। আমার সেই প্রাসাদটি ছিল সপ্তবিধ নত্নও মণি-মুক্তা- প্রবালাদিতে পরিপূর্ণ।

৬.নানা পন্ধে ভরপর স্বর্ণময় সেই বৃক্ষগুলো রাতদিন সব সময় আমার নাগভবকে আলোকিত করত।

৭.সকার-সন্ধ্যা সব সময় ষাট হাজার তূর্য-বাদ্য বাজানো হতো এবং ষোল হাজার স্ত্রীলোক নিত্য আমায় পরিবেষ্টিত করে থাকত।

৮.আমি আমার নাগভবন থেকে বের হয়ে এসে প্রসন্নমনে মহাযশস্বী লোকনায়ক সুমেধ ভগবানকে বন্দনা করেছিলাম।

৯.অভিবাদন করার পর আমি বুদ্ধ প্রমুখ সংঘকে নিমন্ত্রণ করেছিলাম। ধীর লোকনায়ক সুমেধ বুদ্ধ আমার সেই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন।

১০.মহামুনি ধর্মকথা বলে আমাকে বিদেয় দিয়েছিলেন। তারপর আমি সম্বুদ্ধকে অভিবাদন করে আমার নাগভবনে চলে গিয়েছিলাম।

১১-১২. তখন আমি আমার জ্ঞাতি-পরিজনকে ডেকে বলেছিলাম, ‘আগামীকাল পূর্বাহ্ন সময়ে বুদ্ধ আমার ভবনে আসতেন। ইহা আমাদের পক্ষে পরম লাভ যে আমরা তাঁর কাছে বসবাস করতে পারব। তখন আমরা বুদ্ধশ্রেষ্ঠ শাস্তাকে পূজা করব।’

১৩.অন্ন-পানীয় সবকিছু তৈরি করা শেষ হলে পরে আমি বুদ্ধকে সময় জ্ঞাপন করেছিলাম। তারপর লোকনায়ক বুদ্ধ লাখো অর্হৎ পরিবেষ্টিত হয়ে আমার ভবনে উপস্থিত হয়েছিলেন।

১৪.তাঁর আগমনে আমি পঞ্চাঙ্গ তূর্যবাজিয়ে অভিনন্দিত করেছিলাম। পুরুষোত্তম বুদ্ধ সম্পূর্ণ স্বর্ণময় আসনে উপবেশন করেছিলেন।

১৫.তখন তাঁদের মাথার উপর স্বর্গময় আচ্ছাদনী (শামিয়ানা) টাঙানো ছিল এবং অনুত্তর ভিক্ষুসংঘকে বাতাস করা হয়েছিলাম।

১৬.আমি প্রভূত অন্ন-পানীয় দিয়ে ভিক্ষুসংঘকে পরিতৃপ্ত করেছিলাম এবং ভিক্ষুসংঘের প্রত্যেকে দুটি করে বস্ত্র দান করেছিলাম।

১৭.পরম পূজনীয় সুমেধ বুদ্ধ ভিক্ষুসংঘের মাঝে বসে এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলাম।

১৮.যে ব্যক্তি আমাকে ও ভিক্ষুসংঘকে অন্ন-পানীয় দিয়ে পরিতৃপ্ত করেছে, এখন আমি তার ভূয়শী প্রশংসা করব। তোমরা মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ কর।

১৯.সে আঠার শত কল্প দেবলোকে রমিত হবে এবং এই পৃথিবীতে হাজার বার চক্রবর্তী রাজা হবে।

২০.সে দেবলোকে অথবা মনুষ্যলোকে যেই যোনিতেই জন্মগ্রহণ করুক না কেন, তার মাথার উপর সব সময় সম্পূর্ণ স্বর্ণময় আচ্ছাদনী টাঙানো থাকবে।

২১.আজ থেকে ত্রিশ হাজার কল্প পরে ওক্কাকুকুলে গৌতম নামে এক শাস্তা পৃথিবীতে উৎপন্ন হবেন।

২২.সে তার ধর্মে ধর্মৌরসজাত উত্তরাধিকারী হয়ে পরিজ্ঞা দ্বারা সর্বাসব ক্ষয় করে সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে পরিনির্বাপিত হবে।

২৩.সে ভিক্ষসংঘের মাঝে উপবিষ্ট হয়ে এই বলে সিংহনাদ করবে: ‘যারা শ্মশানে ছাতা ধারণ করে, তারা ছাতার নিচেই দগ্ধ হোক !’

২৪.আমি শ্রামণ্যফল লাভ করেছি। আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে। আমি মণ্ডপে বা বৃক্ষমূলেযেখানেই বাস করি না কেন, আমার মধ্যে কোনো ধরণের ভয়-ভীতি নেই।

২৫.আজ থেকে ত্রিশ হাজার কল্প আগে আমি যেই বসার আসন দান করেছিলাম, সেই থেকে একবারও আমাকে অপায় দুর্গতিতে পড়তে হয়নি। ইহা আমার সর্বদানেরই দানেরই ফল।

২৬.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

২৭.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

২৮.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মান যশ স্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন। [যশ স্থবির অপদান প্রথম সমাপ্ত]

২. নদীকাশ্যপ স্থবির অপদান

এই স্থবিরও অতীত বুদ্ধগণের নিকট বিবিধপুণ্যকর্ম করে জন্মজন্মান্তরে সুখদপুণ্যসঞ্চয় করতে করতে পদুমুত্তরভগবানের সময় এক এক কুলিন পরিবারেজন্মগ্রহণ করেন। একদিন তিনি শাস্তাকে পিণ্ডচারণ করতে দেখে প্রসন্নমনে নিজের রোপিত বাগান হতে মনোশিলাবর্ণ একটি আম্রফর দান করেন।

সেই পুণ্যের ফলে দেবমনুষ্যলোকে বিচরণ করে এই গৌতম বুদ্ধের সময়ে মগধরাষ্ট্রে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে উরুবেলা কাশ্যপের ভাইরুপে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর গৃহত্যাগ করে তাপসপ্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। নৈরঞ্জনা নদীর তীরে আশ্রম নির্মাণ করে তিনশত শিষ্যকে সাথে করে বসবাস করেন। নদীতীরে বাস ও কাশ্যপ গোত্রে জন্ম বিধায় তিনি নদীকাশ্যপ নামে পরিচিতি হন। ভগবান তাকে সপরিষদ ঋদ্ধিময় উপস্মপদা প্রদান করেন। তিনি গয়াশীর্ষে আদিত্যপর্যায় সূত্র শ্রবণ করে অর্হত্ত্ব লাভ করেন। [বিস্তারিত মহাবর্গ দ্রষ্টব্য]

অর্হত্ত্ব লাভের পর তিনি আনন্দিত মনে নিজের পূর্বজীবনের কাহিনি প্রকাশ করতে গিয়ে ‘পদুমুত্তর ভগবান’ প্রভৃতি গাথা বরেছিলেন।

২৯.আমি লোকশ্রেষ্ঠ, যশস্বী পদুমুত্তর ভগবানকে পিণ্ডচারণ করতে দেখে একটি ম্রফলআ দান করেছিলাম।

৩০.দেবেন্দ্র, লোকশ্রেষ্ঠ, নরোত্তম বুদ্ধকে সেই দান করার ফলে আজআমি সর্বতোভাবে জয়-পরাজয় ত্যাগ করে অচলাস্থান নির্বাণ লাভ করেছি।

৩১.আজ থেকে ত্রিশ হাজার কল্প আগে আমি যেই বসার আসন দান করেছিলাম, সেই থেকে একবারও আমাকে অপায় দুর্গতিতে পড়তে হয়নি। ইহা আমার সর্বদানেরই দানেরই ফল।

৩২.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

৩৩.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

৩৪.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মাননদীকাশ্যপ স্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন। [নদীকাশ্যপ স্থবির অপদান দ্বিতীয় সমাপ্ত]

৩. গয়াকাশ্যপ স্থবির অপদান

এই স্থবিরও অতীত বুদ্ধগণের নিকট বিবিধপুণ্যকর্ম করে জন্মজন্মান্তরে সুখদপুণ্যসঞ্চয় করতে করতে আজ থেকে একত্রিশ কল্প আগে শিখী বুদ্ধের সময়েএক কুলিন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তিনি গৃহত্যাগ করে তাপস প্রব্রজ্যা গ্রহণপূর্বক অরণ্যাশ্রমে বাস করেন। তিনি তথায় বনজ ফরমূল খেয়েই জীবন ধারণ করতেন।

তখন ভগবান একাকী তার আশ্রমের নিকটবর্তী রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন। তিনি ভগবানকে দেখে প্রসন্নমনে বন্দনা নিবেদন করলেন এবং সময়ের দিকে লক্ষ করে মনোহর কোলফল দান করলেন।

সেই পুণ্যপ্রভাবে তিনি দেবমনুষ্যলোকে বিচরণ করে এই গৌতম ভগবানের সময়ে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করে তাপস প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন এবং দুইশত শিষ্যের সাথে গয়াতে বসবাস করেন। গয়ায় বান ও কাশ্যপ নামে পরিচিত হন। তিনি সপরিষদ ভগবানের নিকটে ঋদ্ধিময় উপস্পদা লাভ করেন এবং আদিত্য পর্যায় সূত্র শুনে অর্হত্ত্ব লাভ করেন। অর্হত্ত্ব লাভের পর তিনি নিজের পূর্বকৃত কর্মস্মরণ করে আনন্দিত মনেনিজের পূর্বজীবনের কাহিনি প্রাকাশ করতে গিয়ে ‘আমি মৃগচর্মধারী ছিলাম’ প্রভৃতি গাথা বলেছিলেন।

৩৫.আমি তখন মৃগচর্মের বস্ত্রধারী ছিলাম। আমার হাতে লাঠি থাকত। তখন আমার আশ্রমে প্রচুর কোলাফল ছিল।

৩৬.ভগবান তখন একাকী সর্বদিকে জ্যোতি ছড়িয়ে আমার আশ্রমের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন।

৩৭.তাকে দেখে আমি প্রসন্নচিত্তে অভিবাদন করেছিলাম। তারপর দুহাতে কোলফল নিয়ে বুদ্ধকে দান করেছিলাম।

৩৮.আজ থেকে একত্রিশ কল্প আগে আমি যেই ফল দান করেছিলাম, সেই থেকে একবারও আমাকে অপায় দুর্গতিতে পড়তে হয়নি। ইহা আমার ফল দানেরই সুফল।

৩৯.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

৪০.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

৪১.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মান গয়াকাশ্যপস্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন। [গয়াকাশ্যপ স্থবির অপদান তৃতীয়সমাপ্ত]

৪. কিমিল স্থবির অপদান

এই স্থবিরও অতীত বুদ্ধগণেরনিকট বিবিধ পুণ্যকর্ম অনুষ্টানের মাধ্যমে জন্মজন্মান্তরে সুখদ পুণ্যসঞ্চয় করতে করতে ককুসন্ধ ভগবানের সময়েএক কুলিন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তিনি ভগবানের পরিনির্বাপিত চৈত্যে শালপুষ্পমাল্য দিয়ে পূজা করেন।

সেই পুণ্যপ্রভাবে তিনি তাবতিংস দেবলোবে জন্মগ্রহণ করেন। তারপর অপরাপর দেবমনুষ্যলোকে বিচরণ করে এই গৌতম ভগবানের সময়ে কপিলাবস্তু নগরে ঐশ্বর্যভোগে মত্ত হলেন। একসময় ভগবান তার জ্ঞান পরিপক্ক হয়েছে জেনে সংবেগ উৎপাদনের জন্যে অনুপ্রিয় বন হতে ঋদ্ধি প্রদর্শন করলেন।

ভগবান প্রথমে একটি পরমা সুন্দরী তরুণীকে তার সামনে রাখলেন। আস্তে আস্তে সেই সুন্দরীরমনী জরাজীর্ণ হলো, রোগে তার দেহ শীর্ণ হলো। তিনি রমনীয় এই পরিণতি দেখে সংবেগপ্রাপ্ত হয়ে নিজের সংবেগ প্রকাশ করলেন ভগবানের সামনে। ভগবানের কাছে উপযুক্ত উপদেশ পেয়ে অচিরেই অর্হত্ত্ব লাভ করেন।

অর্হত্ত্ব লাভের পর তিনি আনন্দিত মনে নিজের পূর্বজীবনের কাহিনি প্রকাশ করতে গিয়ে ‘ককুসন্ধ বুদ্ধ পরিনির্বাপিত হলে পরে’ প্রভৃতি গাথা বলেছিলেন।

৪২.বশীভূত ব্রাহ্মণ ককুসন্ধ বুদ্ধ পরিাপির্তনব হলে পরে আমি তার উদ্দেশে মণ্ডপ তৈরি করে শালপুষ্পমাল্য দিয়ে পুজা করেছিলাম।

৪৩.তার ফলে আমি তাবতিংস দেবলোকে জন্মেছিলাম। তাতে আমি উজ্জ্বল ব্যামপ্রভা লাভ করেছিলাম। আমি অন্য দেবতাদের বলতাম, ইহা আমার পুণ্যকর্মেরই ফল।

৪৪.আমি রাতে বা দিনে যখনি যখনি চংক্রমণ করতাম ও দাঁড়াতাম ও দাঁড়াতাম তখন আমার উপর শালপুষ্পের আচ্ছাদনী ধারণ করা হতো। ইহা আমার পুণ্যকর্মেরই ফল।

৪৫.এই ভদ্রকল্পেই আমি যেই বুদ্ধপূজা করেছিলাম, সেই থেকে একবারও আমাকে অপায় দুর্গতিতে পড়তে হয়নি। ইহা আমার বুদ্ধপূজারই ফল।

৪৬.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

৪৭.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

৪৮.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মান কিমিলস্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন। [কিমিল স্থবির অপদান চতুর্থ সমাপ্ত]

৫. বজ্জীপুত্রস্থবির অপদান

এই স্থবিরও অতীত বুদ্ধগণের নিকট বিবিধপুণ্যকর্ম অনুষ্টানের মাধ্যমে জন্মজন্মান্তরে সুখদ পুণ্যসঞ্চয় করতে করতে আজ থেকে চুরানব্বই কল্প আগে একজন পচ্চেকবুদ্ধকে ভিক্ষার জন্যে যাচ্ছেন দেখে প্রসন্নমনে কলা দান করেন। সেই পুণ্যপ্রভাবে তিনি দেবমনুষ্যলোকে বিচরণ করে এই গৌতমবুদ্ধে সময়ে বৈশালীর লিচ্ছবী রাজকুমার হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। বজ্জীপুত্র হওয়ার তার নাম রাখা হলো ‘বজ্জীপুত্র’।

তিনি বাল্যকালে হস্তিশিল্প শিক্ষাকরতেন। পূর্বকৃতপুণ্যপ্রভাবে একদিন তার বিরাগভাব জাগ্রত হলো। তৎপর বুদ্ধের ধর্ম শ্রবণ করে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন এবং বিদর্শন ভাবনা করে অচিরেই ষড়াভিজ্ঞা অর্হৎ হন। তাঁর ষড়াভিক্ষা হওয়ার পরেই ভগবান পরিনির্বাণ লাভ করেন। তিনি একদিন আনন্দ স্থবিরকে স্রোতাপন্ন অবস্থায় মহাপরিষদে ধর্র্মদেশনা করতে দেখে উচ্চতর মার্গ লাভের জন্যে উৎসাহ দান করতে এই গাথাটি ভাষণ করেন।

“হে গৌতম গোত্রভূত আনন্দ, বৃক্ষের ছায়ায় গিয়ে হৃদয়ে নির্বাণকে স্থাপন কর। ধ্যানকর, প্রমত্ত হইও না। কেন শুধুশুধু বিচলিত হয়ে অনর্ ক সময় নষ্ট করবে?”

তা শুনে আয়ুষ্মান আনন্দ বহুপ্রাত্ন-প্রয়াস চালিয়ে অর্হত্ত্ব লাভ করেন।

পরবর্তীকালে বজ্জীপুত্রস্থবির আনন্দিত মনে নিজের পূর্বজীবনের কাহিনি প্রকাশ করতে গিয়ে ‘শতরশ্মি ভগবান’ প্রভৃতি গাথা বলেছিলেন।

৪৯.সয়মূ্ভ অপরাজিত শতরশ্মি ভগবান ধ্যান হতে উঠে ভিক্ষার জন্যে বের হয়েছিলেন।

৫০.তখন আমি নরশ্রেষ্ঠ ভগবানকে দেখতে পেয়েছিলাম। আমার হাতে তখন কলা ছিল। আমি প্রসন্নমনে বৃন্তসহ একটি কলা দান করেছিলাম।

৫১.আজ থেকে চুরানব্বই কল্প আগে আমি যেই ফল দান করেছিলাম, সেই থেকে একবারও আমাকে অপায় দুর্গতিতে পড়তে হয়নি। ইহা আমার ফল দানেরই সুফল।

৫২.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

৫৩.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

৫৪.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মানবজ্জীপুত্রস্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন। [বজ্জীপুত্রস্থবির অপদান পঞ্চম সমাপ্ত]

৬. উত্তর স্থবির অপদান

এই স্থবিরও অতীত বুদ্ধগণের নিকট বিবিধপুণ্যকর্ম অনুষ্টানের মাধ্যমে জন্মজন্মান্তরে সুখদ পুণ্যসঞ্চয় করতে করতে সুমেধভগবানের সময় এক বিদ্যাধর হয়ে জন ্মগ্রহণ করেন। তিনি আকাশে বিচরণ করতেন। সেই সময় ভগবান তার প্রতি সদয় হয়ে বনে প্রবেশ করে এক বৃক্ষমূলে বসলেন। তখন শাস্তার দেহ হতে ষড়রশ্মি নির্গত হচ্ছিল। তিনি অন্তরীক্ষ হতে

বুদ্ধদর্শন করে অত্যন্ত প্রীত হলেন এবং কণিকার পুষ্প দিয়ে বুদ্ধকে পূজা করলেন। বুদ্ধপ্রভাবে পুষ্পগুলো ছাতা আকারে স্থিরভাবে রইল। উহা দেখে তিনি অতিশয় আপ্যায়িত হলেন। তারপর মরণান্তে তাবতিংস দেবলোকে মহৎ দিব্যসম্পদ লাভ করলেন। পরে গৌতম বুদ্ধের সময় রাজগৃহে মহাধনী ব্রাহ্মণের পুত্ররুপে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ব্রাহ্মণবিদ্যায় সুদক্কছিলেন। কুলে, গুনে, রূপে ও সদাচারে তিনি সকলের পূজ্যপাত্র হয়েছিলেন।

বর্ষাকার ব্রাহ্মণ তার গুণে মুগ্ধ হয়ে স্বীয় কন্যার সাথে বিবাহ দিতে ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। পূর্বকৃত পুন্যে সংসারেরপ্রতি তার বিরাগভাব উৎপন্ন হলো। সময়ে সময়ে ধর্মসেনাপতির নিকট উপস্থিত হয়ে ধর্মশ্রবণ করতেন। পরে তার নিকট প্রব্রজ্যা গ্রহণ করলেন এবং সেই থেকে স্থবিরের সেবা করতেন।

সেই সময় স্থবির রোগাক্রান্ত হন। তার ওষুধেরজন্যে উত্তর শ্রামণের প্রাতেই পাত্রচীবর নিয়ে বিহার হতে বের হলেন। পথিমধ্যে এক তড়াগের তটে পাত্রটি রেখে জলে মুখ ধুচ্ছিলেন। এমন সময় কয়েকজন রাজপুরুষ এক চোরকে তাড়া করছিল। চোর কোনো উপায় না দেখে

রত্নভাণ্ডটি শ্রামণের পাত্রে ফেলে রেখে পালিয়ে গেল। শ্রামণে মুখ ধুয়ে পাত্রের কাছে এসেছে, এমন সময়, রাজপুরুষেরা ও চোরতাড়া করতে করতে সেখানে এসে উপস্থিত হলো। তারা পাত্রে স্বর্ণভাণ্ড দেখে সন্দেহ করল, ‘এই শ্রামণের চোর। এই ব্যক্তিই চুরি করেছে।’ তারা তাকে বেধেঁ বর্ষাকার ব্রাহ্মণের নিকট হাজির করল। তখন বর্ষাকার রাজার বিচারক চিলেন এবং বধ-বন্ধনের হুকুম দিতেন। বর্ষাকার ব্রাহ্মণ বললেন, ‘এই ব্যক্তি পূর্বে আমার কথা শোনেনি। শুদ্ধ পাষাণ্ডদলে প্রব্রজ্জিত হয়েছে।’ তার উপর জাতক্রোধ থাকায় তিনি আর বিচার করলেন না। তাকে জীবিতাবস্থায় শূলে দেয়ালেন।

ভগবান দিব্যচক্ষে তাঁর জ্ঞান পরিপক্ক হয়েছে দেখে সেখানে উপস্থিত হলেন এবং সুকোমল হাতখানি উত্তরের মাথায় রেখে বললেন, ‘উত্তর, ইহা তোমার পূর্বজন্মার্জিত কর্মফল। অবিচলিত চিত্তে তা সহ্য কর।’ তখন তার চিত্তানুরূপ ধর্মোপদেশ দিলেন। ভগবান যখন তার হাতটি তার মাথায় রাখলেন তখন তার অতিশয় প্রীতি উৎপন্ন হয়েছিল। সেই প্রীতিতে শুলাগ্রেই ভাবনা করে তিনি ষড়াভিজ্ঞ হলেন। ষড়াভিজ্ঞ হয়ে সত্ত্বগণের প্রতি সদয় হয়ে আকাশে উঠে নানা ধরণের ঋদ্ধি প্রদর্শন করলেন। তা দেখে মহাজনতা অতিশয় আশ্চর্যন্বিত হলো। অচিরেই তার শুলের ক্ষতস্থান মুকিয়ে গেল। ভিক্ষুগণ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বন্ধু, শূলাগ্রে এতদুঃখ ভোগ করে কী প্রকারে বিদর্শন ভাবনা করতে সমর্ হলেন?’ ‘বন্ধগণ, আমি পূর্বহতেই সংসারের দোষ ও সংস্কার সমূহের স্বভাবদেখেছি। সেই কারণে শূলাগ্রে থেকেও বিদর্শন ভাবনাবলে অর্হত্ত্ব লাভ করতে সমর্থ হয়েছি।’

পরবর্তীকালে তিনি নিজের পূর্বকৃত কর্ম স্মরণ করে আনন্দিত মনে নিজের পূর্বজীবনের কাহিনি প্রকাশ করতে গিয়ে ‘সুমেধ নামে সুম্বদ্ধ’ প্রভৃতি গাথা বলেছিলেন।

৫৫.বত্রিশ মহাপুরুষলক্ষণবিশিষ্ট সম্বুদ্ধ সুমেধ ভগবানবিবেককামী হয়ে হিমালয়ে গিয়েছিলেন।

৫৬.কারুণিক, শ্রেষ্ঠমুনি, পুরষোত্তম ভগবান হিমালয়ে প্রবেশ করে পদ্মাসনে বসেছিলেন।

৫৭.তখন আমি এক আকাশচারী বিদ্যাধর ছিলাম। তখন আমি হাতে ত্রিশূল নিয়ে আকাশে বিচরণ করতাম।

৫৮.সেই সময় বুদ্ধ পর্বতের উপর অগ্নির ন্যায়, পঞ্চদশীর পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় ও সুপস্পিত শালরাজের ন্যায় সমগ্র বনভূমিকে আলোকিত করছিলেন।

৫৯.তখন আলোকোজ্জ্বল বুদ্ধরশ্মি বন হতে চৌদিকে টকরে িপড়ছিল। আমি নলাগ্নি বর্ণসদৃশ বুদ্ধরশ্মি দেখে অতীব পসন্নচিত্ত হয়েছিলাম।

৬০.তখন আমি বনে দেবগন্ধযুক্ত কণিকার পুষ্প দেখতে পেয়েছিলাম। সেখান থেকে তিনটি পুষ্পনিয়ে আমি বুদ্ধশ্রেষ্ঠকে পূজা করেছিলাম।

৬১.তখন বুদ্ধের অনন্তগুণ প্রভাবে আমার সেই তিনটি পুষ্প ঊর্ধ্ববৃন্ত ও অধোপত্র হয়ে মোট ছয়টি হয়ে গিয়েছিল।

৬২.সেই সুকৃতপুণ্যপ্রভাবে ও প্রার্থনা অনুসারে মনুষ্যদেহ ত্যাগ করে আমি তাবতিংস দেবলোকে জন্মগ্রহণ করেছিলাম।

৬৩.সেখানে আমার সুনির্মিত ষাটযোজন দীর্ঘও ত্রিশযোজন প্রস্থ ভবনটি ‘কণিকার’ নামে পরিচিত হয়েছিল।

৬৪.আমার সেই ভবনে সহস্রকাণ্ড, শতভাণ্ড বিশিষ্ট হিরন্ময় ধ্বজা ও লাখো রক্ষাবেষ্টনী প্রাদুর্ভূত হয়েছিল।

৬৫-৬৬. সেখানে আমার জন্যে স্বর্ণময়, মণিময়, লোহিতময় ফলক, পালঙ্ক ও তুলাময় বিকতিযূক্ত, ঊর্ধ্বলোমী, সুবর্ণবিম্বসমন্বিতমহার্ঘ শয্যা প্রভৃতি আমি যখনি যা চাইতাম তা-ই উৎপন্ন হতো।

৬৭.আমি আমার দেবভবন হতে বের হয়ে দেবসংঘ পরিবেষ্টিত হয়ে যথেচ্ছা গমনামন করতাম।

৬৮.আমি পুষ্পের উপরদাঁড়াতাম। আমার উপর শতযোজন দীর্ঘ কণিকার পুষ্পাচ্ছাদনী থাকত।

৬৯.ষাট হাজার দিব্যতূর্য সকাল-সন্ধ্যা আমার সেবা করত এবং রাত-দিন অতন্দ্রভাবে আমাকে পরিবেষ্টিত করে থাকত।

৭০.সেখানে আমি নাচ, গান, বাদ্য বাজনা প্রভৃতি আমোদ-প্রমোদে রমিত হতাম এবং পঞ্চ কামগুনে আমোদিত হতাম।

৭১.সেখানে আমি আমার উত্তম প্রাসাদে নারীগণ পরিবেষ্টিত হয়ে খেয়ে- দেয়ে, পান করে পামোদফূর্তি করতাম।

৭২.আমি পাঁচশতবার দেবরাজত্ব করেছিলাম এবং তিনশতবার চক্রবর্তী রাজা হয়েছিলাম। আর প্রাদেসিক রাজা তো অসংখ্যবার হয়েছিলাম।

৭৩.ভবভবান্তরে জন্মসঞ্চরণকালে আমি মহাভোগ সম্পত্তির অধিকারী হতাম। ভোগসম্পত্তির অভাব আমার কখনো কোনো সময় হতো না। ইহা আমার বুদ্ধপুজারই ফল।

৭৪.আমি দেবলোকে অথবা মনুষ্যলোকে এই দুইলোকে মাত্র জন্মগ্রহণ করেছিলাম। এছাড়া আমার অন্যগতি হয়েছিল বলে আমার জানা নেই। ইহা আমার বুদ্ধপূজারই ফল।

৭৫.আমি ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণ এই দুই কুলে মাত্র জন্মগ্রহণ করেছিলাম। নীচকুলে জন্মেছি বলে আমার জানা নেই। ইহা আমার বুদ্ধপূজারই ফল।

৭৬.হস্তিযান, অশ্বযান, সিবিকাযান প্রভৃতি সবকিছুই আমি লাভ করতাম। ইহা আমার বুদ্ধপূজারই ফল।

৭৭.দাস-দাসী ও সুসজ্জিতা, সমলংকৃতা নারীপ্রভৃতি সবকিছুই আমি আমি লাভ করতাম। ইহা আমার বুদ্ধপূজারই ফল।

৭৮.কোশেয়্য কম্বল, ক্ষৌমবস্ত্র ও কার্পাস বস্ত্র প্রভৃতি সবকিছুই আমি আভ করতাম। ইহা আমার বুদ্ধপূজারই ল।ফ

৭৯.নতুন বস্ত্র, নতুন ফল ও নবান্ন ভোজন প্রভৃতি সবকিছুই আমিলাভ করতাম। ইহা আমার বুদ্ধপূজারই ফল।

৮০.‘ইহা খাও, ইহা ভোজন কর, এই শয্যায় তুমি শয়ন কর’ এভাবে আমি সবকিছুই লাভ করতাম। ইহা আমার বুদ্ধপূজারই ফল।

৮১.আমি সর্বত্র পূজিত হতাম। আমার যশ সর্বত্র প্রচারিত হয়েছিল। আমি সব সময় মহানশিক্ষক হতাম। আমার পরিষদ সব সময় ঐক্যবদ্ধ থাকত। আমি সব সময় জ্ঞাতিদের মদ্যে শ্রেষ্ঠ হতাম। ইহা আমার বুদ্ধ পূজারই ফল।

৮২.আমি শীত, উষ্ণ অনুভব করতাম না। আমার পরিদাহ তথা দাবদাহ বলতে কিছুই ছিল না। এমনকি আমার মনে চৈতসিক দুঃখ পর্যন্ত ছিল না।

৮৩.আমি জন্মজন্মান্তরে সুবর্ণবর্ণ হয়েই জন্মগ্রহণ করেছিলাম। বিবর্ণতা কী জিনিস আমি তা জানতাম না। ইহা আমার বুদ্ধপূজারই ফল।

৮৪.পূর্বকৃতপুণ্যপ্রভাবে আমি দেবলোক হতে চ্যুত হয়ে শ্রাবস্তী নগরে এক ধনাঢ্য মহাশাল কুলে জন্মগ্রহণ করেছিলাম।

৮৫.আমি পঞ্চকামগুণ ত্যাগ করে অনাগারিক প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছিলাম এবং জন্মের মাত্র সাত বৎসর বয়সেই অর্হত্ত্ব লাভ করেছিলাম।

৮৬.চক্ষুষ্মান বুদ্ধ আমার গুণের কথা অবগত হয়ে আমাকে উপসম্পদা দিয়েছিলেন। আমি তরুণ বয়সেই পূজনীয় হলাম। ইহা আমার বুদ্ধপূজারই ফল।

৮৭.আমার দিব্যচক্ষু অত্যন্ত বিশুদ্ধ। আমি সমাধিতে অতীব দক্ষ। আমি অভিজ্ঞা পারমীলাভী। ইহা আমার বুদ্ধপূজারই ফল।

৮৮.আমি প্রতিসমিদালাভী,্ভ ঋদ্ধিপাদে অভিজ্ঞ, ধর্মসমুহে পারমীপ্রাপ্ত। ইহা আমার বুদ্ধপূজারই ফল।

৮৯.আজ থেকে ত্রিশহাজার কল্প আগে আমি যেই বুদ্ধপূজাকরেছিলাম, সেই থেকে একবারও আমাকে অপায় দুর্গতিতে পড়তে হয়নি। ইহা আমার বুদ্ধপূজারইসুফল।

৯০.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

৯১.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

৯২.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃকার্যত হয়েছি।

ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মানউত্তর স্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন। [উত্তর স্থবির অপদান ষষ্ঠ সমাপ্ত]

৭. অপর উত্তর স্থবির অপদান

এই স্থবিরও অতীত বুদ্ধগণের নিকট বিবিধপুণ্যকর্ম করে জন্মজন্মান্তরে সুখদপুণ্যসঞ্চয় করতে করতে আজ থেকে চুরানব্বইকল্প আগে সিদ্ধার্থ ভগবানের সময়ে এক কুলিন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তিনি একদিন তিনি শাসনের প্রতি শ্রদ্ধান্বিত হয়ে নিজের উপাসকত্ব নিবেদন করলেন।

তিনি শাস্তার পরিনির্বাণের পর নিজ জ্ঞাতিদের একত্র করে ধাতুপূজা করেন। সেই পুণ্যপ্রভাবে তিনি দেবমনুষ্যলোকে বিচরণ করে এই গৌতম বুদ্ধের সময়ে সাকেত নগরে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার নাম রাখা হলো ‘উত্তর’।

একদিন তিনি কোনো এক কার্যোপক্ষে শ্রাবস্তাীতে গেলে বুদ্ধপ্রদর্শিত যুগ্ম ঋদ্ধিপ্রতিহার্য দেখতে পেলেন। তাতে অতীব প্রসন্ন হয়ে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। অতঃপর শাস্তার সাথে রাজগৃহেগিয়ে উপস্পদা লাভ করেন। উপসম্পদা লাভের পর বিদর্শন ভাবনা বলে অচিরেই তিনি ষড়াভিজ্ঞ অর্হত্ত্ব হন। ষড়াভিজ্ঞা লাভের পর বুদ্ধকে সেবা করার জন্যে রাজগৃহে হতে শ্রাবস্তীতে আসলে ভিক্ষুগণ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আবুসো, আপনার প্রব্রজ্যাকৃত্য সম্পন্ন হয়েছে কি?’ তিনি তখন যথার্ জবাব দিলেন।

অর্হত্ত্ব লাভের পর তিনি আনন্দিত মনে নিজের পূর্বজীবনের কাহিনি প্রকাশ করতে গিয়ে ‘লোকনায়ক, লোকনাথ সিদ্ধার্ ’ প্রভৃতি বলেছিলেন।

৯৩.লোকনায়ক, লোকনাথ সিদ্ধার্ ভগবান পরিনির্বাপিত হলে পরে আমি আমার জ্ঞাতিদের একত্র করে ধাতুপূজা করেছিলাম।

৯৪.আজ থেকে ত্রিশহাজার কল্প আগে আমি যেই বুদ্ধপূজা করেছিলাম, সেই থেকে একবারও আমাকে অপায় দুর্গতিতেপড়তে হয়নি। ইহা আমার বুদ্ধপূজারই সুফল।

৯৫.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

৯৬.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

৯৭.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মান অপর উত্তরস্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন। [অপর উত্তর স্থবির অপদান সপ্তম সমাপ্ত]

৮. ভদ্দজি স্থবির অপদান

এই স্থবিরও অতীত বুদ্ধগণের নিকট বিবিধপুণ্যকর্ম অনুষ্টানের মাধ্যমে জন্মজন্মান্তরে সুখদ পুণ্যসঞ্চয় করতে করতে পদুমুত্তরভগবানের সময় এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ব্রাহ্মণবিদ্যায় বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করে তাপসপ্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন এবং গহীন অরন্যে আশ্রম তৈরি করে বাস করতেন। একদিন শাস্তাকে আকাশ পথে গমন করতে দেখে প্রসন্নচিত্তে কৃতাঞ্জলিপুটেদাঁড়িয়ে ছিলেন। ভগবান তার অভিপায় জ্ঞাত হয়ে আকাশ হতে নামলেন। তখন তিনি ভগবানকে মধু, মৃণাল ও ঘৃত দান করলেন। ভগবান ওই দান গ্রহণ করে দানফল ব্যাখ্যা করে চলে গেলেন। তিনি সেই পুণ্যফলে তুষিত স্বর্গে উৎপন্ন হন। পরে বিপশ্বী বুদ্ধের সময় মহাধনাঢ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করে আটষট্টি হাজার ভিক্ষুকেভোজন দান করেন এবং ত্রিচীবর দান করেন।

তারপর তিনি দেবলোকে উৎপন্ন হন। দেবলোক হতে চ্যুত হয়ে বুদ্ধশূন্য কল্পে মনুষ্যলোকে জন্মগ্রহণ করেন। এই জন্মে পাঁচশত পচ্চেক বুদ্ধের চীবর-পিণ্ডপাত-শয্যাসন- ওষুধ এই চারিপ্রত্যয় দান করেন। পরে রাজকুলে উৎপন্নহন। তার এক পুত্র পচ্চেক বুদ্ধ হলেন। বহুদিন তার সেবা করেন। তার পরিনির্বাণের পর ধাতুচৈত্য নিমার্ণকরে বহুদিন পূজা করলেন। পরে গৌতম বুদ্ধেরসময়ে আমি কোটি সম্পত্তি অধিকারী তদ্দিয় শ্রেষ্ঠীর একমাত্র পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেন। তার নাম রাখা হলো ‘ভদ্দজি’। তিনি ধনসম্পত্তিতে রাজা বেশ্বান্তর সদৃশ ছিলেন।

তখন ভগবান শ্রাবস্তীতে বর্ষাবাস করে ভদ্দজি কুমারের উদ্দেশে ভিক্ষুসংঘসহ ভদ্দিয় নগরের জাতীয় উদ্যানে উপস্থিত হলেন এবং কুমারের জ্ঞানপরিপক্ক না হওয়া অবধি সেখানে অপেক্ষা করলেন। একসময় ভদ্দজি প্রাসাদের উপর তলা হতে সিংহ পঞ্জর দিয়ে দেখছিলেন যে, কিছুলোক ধর্মশ্রবণের জন্যে যাচ্ছে। এই লোকগুলো কোথায় যাচ্ছে? জিজ্ঞেস করে তিনি নিজেও সপরিবারে বুদ্ধের নিকট গমন করলেন। সেখানে বুদ্ধের ধর্ম শ্রবণ করে সর্বাভরণ ভূষিতাবস্থায় অর্হত্ত্ব লাভ করলেন। তখন ভগবান অর্হত্ত্ব লাভ করেছে। তাকে এখনি প্রব্রজ্যা প্রদান করা উচিত। প্রব্রজ্যা গ্রহণ না করলে অচিরেই পরিনির্বাপিত হবে।’ শ্রেষ্ঠী বললেন, ‘আমার পুত্র বাল্যকালে পরিনির্বাণ লাভ করুক, আমি তা চাই না। আপনি তাকে প্রব্রজ্যা প্রদানের ব্যবস্থা করুন।’ ভগবান তাকে প্রব্রজ্যা ও উপম্পদা প্রদান করে সাত সপ্তাহ পর কোটিগ্রামে চলে গেলেন। এই গ্রামটি গঙ্গাতীরে অবস্থিত। গ্রামবাসীরা বুদ্ধপ্রমুখ ভিক্ষুসংঘকে মহাদান দিলেন। তখন ভদ্দজি স্থবির গ্রামের অদূরেগঙ্গাতীরে রাস্তার পাশে ধ্যানে বসলেন এবং ভগবান আসলে তবেই ধ্যান হতে উঠবেন বলে সংকল্প করলেন। মহা স্থবিরগণ আসলেও তিনি

না উঠে বুদ্ধ আসার পরই আসন হতে উঠলেন। পৃথকজন ভিক্ষুরা তার এই ব্যবহার দেখে দোষারোপ করতে লাগল, ‘ইনি নতুন প্রব্রজ্জিত। ইনি মহা স্থবির দেখলেও মানমদে স্ফীত হয়ে আসন হতে উঠে না।’

এদিকে কোটিগ্রামবাসীরা বহু নৌকা একত্রে বেঁধে রাখল। ভগবান ভাবলেন, ‘আজ ভদ্দজির প্রভাব দেকতে হবে।’ ভগবান নৌকায় উঠে ভদ্দজি কোথায় জিজ্ঞেস করলেন। ভদ্দজি বললেন,

‘ভন্তে, আমি এখানেই আছি।’ তখন তিনি বুদ্ধের নিকটেএসে কৃতাঞ্জলি হয়েদাঁড়ালেন। ভগবান বললেন, ‘এসো আমাদের সাথে নৌকায় হঠো।’ তিনি তা-ই করলেন। ভগবান জিজ্ঞেস করলেন, ‘দেখ ভদ্দজি, একসময় তুমি মহাপনাদ রাজা হয়ে রত্নময় প্রাসাদে অবস্থান করতে। এখন তোমার সেই প্রাসাদ কোথায়?’ ‘ভন্তে, এই জায়গায় ডুবে আছে।’ ‘তাহলে সব্রহ্মচারীদের সন্দেহ দূর কর।’ তখননি ভদ্দজি স্থবির বুদ্ধকে বন্দনা করে ঋদ্ধিবলে প্রাসাদের চূড়ায় পদাঙ্গুলিবেশপ্র করিয়ে টানতে লাগলেন। তিনি পঁচিশ যোজন বিশিষ্ট প্রাসাদটি নিয়ে জল হতে পঞ্চাশ যোজন উপরে আকাশে তুলে উধাও হলেন। পূর্বজন্মে তার প্রসাদে যে সমস্ত জ্ঞাতি প্রাসাদ লোভে মৎস্য-কচ্ছপ -মণ্ডুক হয়ে তথায় জনহয়্মে তথায় জন্ম নিয়েছিল, প্রাসাদ জল হতে উঠবার সময় সকলে জলে পড়ে গেল। তখন ভগবান বললেন, ‘ভদ্দজি, তোমার জ্ঞাতিবর্গের বড়ই কষ্ট হচ্ছে।’ স্থবির তখনি প্রাসাদটি ছেড়ে দিলেন। প্রাসাদটি যথাস্থানে গিয়ে প্রতিষ্ঠিত হলো। ভিক্ষুরা জিজ্ঞেস করলেন, ‘ভন্তে, কখন ভদ্দজি স্থবির এই প্রাসাদে ছিলেন?’ ভিক্ষুদের উত্তরে ভগবান মহাপনাদ জাতক দেশনা করলেন। মহাজনতাও ধর্মামৃত পান করলেন।

অর্হত্ত্ব লাভের পর স্থবির নিজের পূর্বকৃতপুণ্যসম্বার স্মরণ করে আনন্দিত মনে নিজের পূর্বজীবনের কাহিনি প্রকাশ করতে গিয়ে ‘আমি যেই পুস্করিনীতে’ প্রভৃতি গাথা বলেছিলেন।

৯৮.তখন আমি নানা কুঞ্জরে পরিশোভিত পুষ্করিনীতে নেমেঘাসের জন্যে মঞ্জরী তুলছিলাম।

৯৯.ভগবান পদুমুত্তর বুদ্ধ তখন রক্তিম আভাছড়িয়ে সুনীল আকাশ পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন।

১০০.আমি পাশুকূলবস্ত্র ধুনতে ধুনতে কিছু একটা শব্দ শুনতে পেয়েছিলাম। তারপর উপরে তাকাতে গিয়ে আমি লোকনায়ক বুদ্ধকে দেখতে পেয়েছিলাম।

১০১-১০৪. আমি দাঁড়ানো অবস্থাতেই লোকনায়ক বুদ্ধকে প্রার্থনা জানিয়েছিলাম এই বলে: ‘হে চক্ষুষ্মান বুদ্ধ, আমার প্রতি অনুকম্পাবশত এই মধু, মৃণাল ও ঘৃত গ্রহণ করুন!’ তারপর মহাযশস্বী, কারুণিক, চক্ষুষ্মান শাস্তা আকাশে থেকে নেমে আমার প্রতি অনুকম্পাবশত আমার

সেই ভিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। গ্রহণ করার পর তিনি এই বলে আমার দান অনুমোদন করেছিলেন: ‘হে মহাপুণ্য, তুমি সুখী হও। তোমার সুগতি লাভহোক। এই মৃণাল দানের ফলে তুমি বিপুল সুখ লাভ ।’কর

১০৫.পদুমুত্তর সম্বুদ্ধ জিন এই কথা বলে আমার ভিক্ষা নিয়ে আকাশপথে চলে গিয়েছিলাম।

১০৬.সেখানে থেকে কিছু মঞ্জরী নিয়ে আমি আমার আশ্রমে চলে গিয়েছিলাম। তারপর সেগুলো গাছে টাঙিয়ে আমি আমার দান স্মরণ করেছিলাম।

১০৭.তখন আকাশে শক্তিশালী বাতাস এসে গোটা বনকে ঝাকিয়ে দিছিল। বিকট শব্দে আকাশ থেকে বজ্রপাত হচ্ছিল।

১০৮.তখন হঠাৎ আমার মাথার উপর বজ্র আঘাত হেনেছিল। আর তাতে করে আমি মারা গিয়েছিলাম।

১০৯.আমি পুণ্যকর্ম-সমন্বিত হয়ে তুষিত স্বর্গে উৎপন্ন হয়েছিলাম। আমি আমার মনুষ্যকলেবর সম্পূর্ণ ত্যাগকরেছিলাম। আমি দেবলোকে রমিত হয়েছিলাম।

১১০.সেখানে ছিয়শি হাজার অলংকৃতা নারী সকাল-সন্ধ্যা আমার সেবা করত। ইহা আমার মঞ্জরী দানেরই ফল।

১১১.আমি মনুষ্যযোনিতে জন্মগ্রহণ করেও সুখী হয়েছিলাম। তখনো আমার মঞ্জরি দানেরই ফল।

১১২.এখন আমি দেবাতিদেব বুদ্ধের কাছ থেকে অনুকম্পা পেয়েছি। আমার সমস্ত আসব পরিক্ষীণ হয়েছে। এখন আর আমার পুনর্জন্ম নেই।

১১৩.আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে আমি যেই মঞ্জুরীদান করেছিলাম, সেই থেকে একবারও আমাকে অপায় দুর্গতিতে পড়তে হয়নি। ইহা আমার মঞ্জরী দানেরই সুফল।

১১৪.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

১১৫.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

১১৬.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মান ভদ্দজি স্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন। [ভদ্দজি স্থবির অপদান অষ্টম সমাপ্ত]

৯. সীবক স্থবির অপদান

এই স্থবিরও অতীত বুদ্ধগণের নিকট বিবিধপুণ্যকর্ম অনুষ্টানের মাধ্যমে জন্মজন্মান্তরে সুখদ পুণ্যসঞ্চয় করতে করতে বিপশ্বী ভগবানের সময় এক কুলিনপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। একদিন তিনি ভগবানকে পিণ্ডাচারণ করতে দেখেন। তখন তিনি প্রসন্নমনে পাত্র নিয়ে তাতে পিঠা দান করেন। সেই পুণ্যকর্মের ফলে দেবমনুষ্যলোকে বিচরণ করে এই গৌতম বুদ্ধের সময়ে রাজগৃহে ব্রাহ্মণ পরিবরেজন্মগ্রহণ করেন। তার নাম রাখা হলো ‘সীবক’। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তিনি বিদ্যাশিল্পে বিশেষ পারদর্শিতা অর্জন করেন। কামভোগ ত্যাগ করে তিনি তাপসপ্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। বিচরণ করতে করতে একদিন শাস্তার কাছে উপস্থিত হয়ে ধর্মশ্রবণ করেন। তার পর শ্রদ্ধান্বিত হয়ে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন এবং বিদর্শন ভাবনাবলে অচিরেই অর্হত্ত্ব লাভ করেন।

অর্হত্ত্ব লাভের পর তিনি আনন্দিত মনে নিজের পূর্বজীবনের কাহিনি প্রকাশ করতে গিয়ে ‘মহর্ষি বিপশ্বী ভগবান’ প্রভৃতি গাথা বলেছিলেন।

১১৭. মহর্ষি বিপশ্বী ভগবানকে শূন্যপাত্রে পিণ্ডচারণ করতে দেখে আমি তাতে পিঠা দান করেছিলাম।

১১৮.আজ থেকে একানব্বই কল্প আগে আমি যেই ভিক্ষাদান করেছিলাম, সেই থেকে একবারও আমাকে অপায় দুর্গতিতে পড়তে হয়নি। ইহা আমার পিঠা দানেরই সুফল।

১১৯.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

১২০.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

১২১.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মানসীবক স্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন। [সীবক স্থবির অপদান নবম সমাপ্ত]

১০. উপবান স্থবির অপদান

এই স্থবিরও অতীত বুদ্ধগণের নিকট বিবিধপুণ্যকর্ম অনুষ্টানের মাধ্যমে জন্মজন্মান্তরে সুখদ পুণ্যসঞ্চয় করতে করতে কোন এক অকুশর কর্মের ফলে পদুমুত্তর ভগবানের সময় একদরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। বুদ্ধ যখন পরিনির্বাণ লাভ করেন, তখন দেব-মনুষ্য- গরুড়-যক্ষ-কুমাণ্ড্ভ-গন্ধর্ব সকলে মিলিত হয়ে বুদ্ধের অস্থিধাতু নিয়ে সপ্তরত্নময় চৈত্য নির্মাণ করেন।

এই দরিদ্র পুরুষ তার সুধেীত উত্তরীয় বস্ত্র বাঁশের উপর ঝুলিয়ে ধ্বজাসেবেহি পূজা করেন। যক্ষসেনাপতি অভিসম্মত সেই ধ্বজা নিয়ে অদৃশ্যভাবে আকাশপথে তিনবার চৈত্য প্রদক্ষিণ করেন। সে তা দেখে অতিশয় আনন্দিত হলো। সেই পুণ্যপ্রভাবে গৌতম বুদ্ধেরসময় শ্রাবস্তীর এক ব্রাহ্মণ পরিবারে তার জন্ম হয়। তার নাম রাখা হলো উপবান। জেতবনে বুদ্ধপ্রভাব দেখে তিনি প্রব্রজ্যা গ্রহণকরেন এবং বিদর্শন ভাবনা বলে ষড়াভিজ্ঞা অর্হৎ হন। কিছুদিন এই উপবান স্থবির ভগবানের সেবক ছিলেন। ভগবানের বাতব্যধি উৎপন্নকালিন স্থবিরের গৃহিন্ধু দেবহিত নামক ব্রাহ্মণ শ্রাবস্তীতে বাস করতেন। তিনি স্থবিরকে চীবর-পিণ্ডপাতাদি দানের উদ্ধেশে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। সেই সময় স্থবির ব্রাহ্মণের নিকট উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘হে ব্রাহ্মণ, কোনো একটি প্রয়োজনে স্থবির তোমার নিকটে এসেছে।’ ‘ভন্তে, কীসের প্রয়োজনে বলুন।’ স্থবির তর প্রয়োজন জানাতে গিয়ে এই গাথাদ্বয় বললেন:

“ত্রিলোকপূজ্য সুগত, অর্হৎ, মুনি, সর্বজ্ঞ বুদ্ধ বাতব্যাধিতে ভীষণভাবে রোগাক্রান্ত। হে ব্রাহ্মণ, যদি তোমার নিকট গরম জল থাকে, তবে আমাকে দাও।”

“আমি তা দিয়ে পরম পূজনীয়, ইন্দ্র-দেব-ব্রহ্মাদ্বারা পূজিত, শ্রদ্ধাভাজন, সম্মানযোগ্য সর্বজ্ঞবুদ্ধের বাতব্যাধি উপশম করতে ইচ্ছা করি।”

ব্রাহ্মণ গাথাদ্বয় শুনে উষ্ণ জল ও উপযুক্ত ওষধ নিয়ে ভগবানকে দান করেন। ভগবান তার দান গ্রহণ করলেন।

পরবর্তীকালে আয়ুষ্মান উপবানস্থবির নিজের পূর্বকৃত কর্ম স্মরণ করে আনন্দিত মনে নিজের পূর্বজীবনের কাহিনি প্রকাশ করতে গিয়ে ‘পদুমুত্তর জিন’ প্রভৃতি গাথা বলেছিলেন।

১২২.সর্ববিধ ধর্মে বিশেষ পারদর্শী সম্বুদ্ধ, পদুমুত্তর জিন অগ্নিস্কন্ধের ন্যায় প্রজ্জ্বলিতহয়ে পরিনির্বাপিত হয়েছিলেন।

১২৩.মহাজনতা সম্মিলিতভাবে তথাগতকে পূজা করেছিল এবংশ্মশানে বুদ্ধের শরীকে তুলেছিল।

১২৪.তারা বুদ্ধের শরীরকে অগ্নিদগ্ধ করে ধাতুগুলো কুড়িয়ে নিয়েছিল। দেবতুল্য সকলেই একটি বুদ্ধস্তুূপ তৈরি করেছিল।

১২৫-১২৭. প্রথমে স্বর্ণময়, দ্বিতীয়ত মণিময়, তৃতীয়ত রৌপ্যময়, চর্তুত স্ফটিকময়, পঞ্চমত লোহিতংকময় ও ষষ্ঠত মসারগল্লময়- এভাবে সেই বুদ্ধস্তুূপটিকে সম্পূর্ণ রত্নময় করা হয়েছিল। সেই বুদ্ধস্তুূপের বিমগুলো মণিময় ও বেদিগুলো রত্নময় ছিল। সম্পূর্ণ স্বর্ণময় সেই বুদ্ধস্তূপটি ছিল এক যোজন উচ্ছতাবিশিষ্ট।

১২৮.তখন সেখানে দেবতারা সমবেত হয়ে পরামর্শ করেছিল যে, আমারাও লোকনাথ বুদ্ধের জন্যে স্তুপ তৈরি করব।

১২৯.বুদ্ধের ধাতুগুলো এমন নয় যে তার জন্যপৃথক পৃথ কচৈত্য তৈরি করা যাবে। সমস্ত শরীরই এক পিণ্ডবিশিষ্ট। আমরা এই বুদ্ধস্তুপের উপর আরও এক যোজনের মতো স্তুপ তৈরি করব।

১৩০.তখন দেবতারা সপ্তবিধ রত্ন দিয়ে সেই বুদ্ধস্তুপটি পরিসর আরও এক যেজন বর্ধিত করেছিল। সেটি সমস্ত অন্ধকারকে দূরকরে জ্বল জ্বল করছিল।

১৩১.তখন সেখানে নাগেরাও একত্র হয়ে পরামর্শ করেছিলযে, দেবতারাও মানুষেরা তো একটি বুদ্ধস্তুপ তৈরি করল।

১৩২.আমরা প্রমত্ত হয়ে থাকব এটা কেমন কথা। দেবমনুষ্যরা সবাই এখন সচেতন। আমরাও লোকনাথ বুদ্ধের জন্যে একটি স্তুপ তৈরি করব।

১৩৩.তারপর তারা ইন্দ্রনীল ও মহানীল এই দুধরণের উজ্জ্বল মণি সংগ্রহ করে তা দিয়ে বুদ্ধস্তুপটিকে আচ্ছাদিত করেছিল।

১৩৪.তখন সমস্ত বুদ্ধচৈত্যটি সম্পূর্ণ মণিময় হয়ে গিয়েছিল। বুদ্ধস্তুপটির উচ্চতা তিন যোজন হয়ে গিয়েছিল। সেটি চৌদিকে উজ্জ্বল আলো ছড়িয়েছিল।

১৩৫.তখন গরুড়েলাও সেখানে একত্র হয়ে পরর্মশ করেছিল যে, মানুষেরা, দেবতারা ও নাগেরা তো বুদ্ধস্তুপতৈরি করল।

১৩৬.দেবমনুষ্য-নাগেরা সবাই এখন সচেতন। আমারাই শুধু প্রমত্ত হয়ে থাকব এটা কেমন কথা। কাজেই আমরাও লোকনাথ বুদ্ধের জন্যে একটি স্তুপ তৈরি করব।

১৩৭.অতঃপর তারা ও সেটির উপর সম্পূর্ণ মণিময় একটি স্তুপ তৈরি করেছিল। তারা সেই বুদ্ধচৈত্যটিকে আর ও এক যোজ উচুঁকরেছিল।

১৩৮.তখন সেই চারিযোজন উচ্চতাবিশিষ্ট বুদ্ধস্তুপটি বিরচিত হয়েছিল। সেটি শতরশ্মি সূর্যের ন্যায় সকল দিক আলোকোজ্জ্বল করেছিল।

১৩৯-১৪০. তখন সেখানে কুমাণ্ডরাও সমবেত হয়ে পরামর্শ করেছিল যে, মানুষ, দেবতা, নাগও গরুড়েরা সবাই মিলে বুদ্ধশ্রেষ্ঠর জন্যে স্তুপ তৈরি করল। তারা সবাই অত্যন্ত সচেতন। আমরাই শুধুপ্রমত্ত হয়ে থকবা এটা কেমন কথা।

১৪১.অতএব আমরাও লোকনাথ বুদ্ধের উদ্দেশে স্তুপ তৈরি করব। সেই বুদ্ধস্তপটিকে রত্নদিয়ে আচ্ছাদিত করব।

১৪২.তারা সেই বুদ্ধস্তুপটিকে আরও এক যোজন উঁচু করেছিল। মোট পাঁচ যোজন উচ্চতাবিশিষ্ট সেই বুদ্ধস্তুপটি তখন চৌদিকে আলো ছড়াচ্ছিল।

১৪৩-১৪৪. তখন সেখানে যক্ষরাও সমবেত হয়ে পরামর্শ করেছিল যে, মানুষ, দেবতা, নাগ, গরুড় ও কুমাণ্ডরা্ভ সবাই অত্যন্ত সচেতন। আমরাই শুধুপ্রমত্ত হয়ে থাকব এটা কেমন কথা।

১৪৫.অতএব আমরাও লোকনাথ বুদ্ধের উদ্দেশে স্তুপ তৈরি করব। সেই বুদ্ধস্তুপটিকে স্ফটিক দিয়ে আচ্ছাদিত করব।

১৪৬.তারা সেই বুদ্ধস্তপটিকে আরও এক যোজন উঁচু করেছিল। মোট ছয় যোজন উচ্চতাবিশিষ্ট সেই বুদ্ধস্তুপটি তখন চৌদিকে আলো ছড়াচ্ছিল।

১৪৭-১৪৮. তখন সেখানে গন্ধর্বরাও সমবেত হয়ে পরামর্শ করেছিল যে, মানুষ, দেবতা, নাগ, গরুড়, কুমাণ্ড ও যক্ষরা সবাই বুদ্ধশ্রেষ্ঠের উদ্দেশে স্তুপতৈরি করল। তারা সবাই অত্যন্ত সচেতন। আমরাই শুধুপ্রমত্ত হয়ে থাকব এটা কেমন কা!

১৪৯.সেই গন্ধর্বরা সবাই সাতটি বেদি ও ছয় ধ্বজা তৈরি করেছিল এবং বুদ্ধস্তুপটি সম্পূর্ণ স্বর্ণময় করেছিল।

১৫০.তখন সাত যোজন উচ্চতাবিশিষ্ট স্তুপটি চৌদিক আলোকিত করছিল। রাত-দিন বুঝার কোনো উপায় ছিল না। দিনের মতো সব সময় আলোকিত থাকত।

১৫১.এমনকি চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারাগুলো ও বুদ্ধস্তুটির সেই আভাকে এতটুকু ম্লান করতে পারত না। চৌদিকে শত যোজন জায়গা জুড়ে প্রদীপ প্রজ্জ্বলনের প্রয়োজন হতো না।

১৫২.সেই সময় সে সকল মানুষ সেই স্তুপটিকে পূজা করত, তারা তাতে উঠতে পারত না। তাই তারা পূজার উপকরণগুলো আকাশে ছুঁেড় মারত।

১৫৩.দেবগণের দ্বারা সেখানে নিয়োগকৃত অভিসম্মত নামক এক যক্ষ সেই ধ্বজা বা পুষ্পমাল্যগুলো স্তুপের উপরে তুলে দিত।

১৫৪.লোকেরা সেই যক্ষকে দেখতে পেত না। তার শুধু পুষ্পমাল্যই দেখতে পেত। এভাবে শুধু পুষ্পমাল্যের গমন দেখে তারা সবাই সুগতিতে গমন করত।

১৫৫.তৎকালে বিরুদ্ধবাদী ও শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষেরা অলৌকিক কিছু দেখার ইচ্ছায় সেই স্তুপটিকে পূজা করত।

১৫৬.তখন আমি হংসবতী নগরে এক দরিদ্র কর্মচারী হয়ে জন্মেছিলাম। একদিন আমি আমোদিত লোকজনকে দেখে এরূপ চিন্তা করেছিলাম:

১৫৭.অহো, এই ভগবান কতই মহৎ! যার ধাতুচৈত্য এত পূজা করেও এই জনতাসকল পরিতৃপ্ত হতে পারছে না!

১৫৮.আমিও সেই লোকনায়ক বুদ্ধকে পূজা করব। ভবিষ্যতে কোনো এক বুদ্ধেরশাসনে ধর্মৌরসজা উত্তরাধিকারী হবো।

১৫৯.আমি আমার সুধৌত উত্তরীয় বস্ত্রটি বাঁশের আগায় টাঙিয়ে ধ্বজাস্বরূপ আকাশে উড়িয়েছিলাম।

১৬০.আমার সেই ধ্বজা অভিসম্মত নামক যক্ষটি নিয়ে আনন্দিত মনে আকাশে উড়েছিল। বাতাসে ঢেই খেলানো আমার সেই ধ্বজাটিকে দেখে আমি আরও বেশি খুশী হয়েছিলাম।

১৬১.তখন আমি প্রসন্নচিত্ত নিয়ে এক শ্রমণের কাছে গিয়ে তাকে ইহার বিপাক সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করেছিলাম।

১৬২.তিনি ইহার বিপাক সম্বন্ধে বলে দিয়ে আমার মনে আনন্দ ও প্রীতি সঞ্চার করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘সেই ধ্বজা দানের বিপাক তুমি সব সময় ভোগ করবে।’

১৬৩.হস্তি, অশ্ব, রথ ও পদাতিক সেনা- এই চতুরঙ্গিনী সেনা তোমাকে নিত্য গিরে থাকবে। ইহা আমার ধ্বজা দানেরই ফল।

১৬৪.ষাট হাজার সমলংকৃত তূর্য-ভেরি নিত্য তোমাকে ঘিরে থাকবে। ইহা তোমার ধ্বজা দানেরই ফল।

১৬৫-১৬৬. সুসজ্জিতা ও সমলংকৃ,তাবিচিত্র বস্ত্রধারী, মাথায় মণিকুণ্ডল ধারী, সুঢৌল নিতম্ববিশিষ্ট, মৃদু, কোমল, সদা হাস্যময়ী ছিয়াশি হাজার নারী তোমাকে নিত্য ঘিরে থাকবে। ইহা তোমার ধ্বজাদানেরই ফল।

১৬৭.তুমি ত্রিশ হাজার কল্প দেবলোকে রমিত হবে। আর আশিবার দেবেন্দ্র হয়ে দেবরাজত্ব করবে।

১৬৮.হাজরবার চক্রবর্তী রাজা হবে। আর প্রাদেসিক রাজা তো অসংখ্যবার হবে।

১৬৯.আজ থেকে লক্ষ কল্প পরে ওক্কাকুকুলে গৌতম নামক শাস্তা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করবেন।

১৭০.তখন তুমি দেবলোক হতে চ্যুত হয়ে পূর্বকপুণ্যবলেৃত পুণ্যবলে পুণ্যকর্ম সমন্বিত হয়ে ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মগ্রহণ করবে।

১৭১.আশি কোটি ধন ও বহু দাস-কর্মচারী ত্যাগ করে তুমি গৌতম ভগবানের শাসনে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করবে।

১৭২.তখন শাক্যপুঙ্গব গৌতম বুদ্ধের আরাধনা করে উপবান নামে শাস্তা শ্রাবক হবে।

১৭৩.আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে আমার কৃতকর্ম এই জন্মেও ফল দিচ্ছে। আমি এখন সুমুক্ত। তীরের গতিতে আমি আমার ক্লেশকে দগ্ধ করেছি।

১৭৪.চারিদ্বীপের অধিশ্বর চক্রবর্তী রাজার ন্যায় তিন যোজন জায়গা জুড়ে আমার উদ্দেশে সব সময় ধ্বজা উড্ডীন থাকে।

১৭৫.আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে আমি যেই কর্ম করেছিলাম, সেই থেকে একবারও আমাকে অপায় দুর্গতিতে পড়তে হয়নি। ইহা আমার ধ্বজা দানেরই ফল।

১৭৬.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

১৭৭.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

১৭৮.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মানউপবান স্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন। [উপবান স্থবির অপদান দশম সমাপ্ত]

১১. রাষ্ট্রপাল স্থবির অপদান

এই স্থবিরও অতীত বুদ্ধগণের নিকট বিবিধপুণ্যকর্ম অনুষ্টানের মাধ্যমে জন্মজন্মান্তরে সুখদ পুণ্যসঞ্চয় করতে করতে পদুমুত্তর ভগবানের উৎপত্তির হংসবতী নগরে হপতিগৃ মহাশাল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতার মৃত্যুর পর মহাদনের অধিকারী হলে কোষাধ্যক্ষ তাকে সেই অপরিমেয় রত্ন ভাণ্ডার দেখালেন। তিনি সেসব ধনসম্পত্তি দেখে ভাবলেন, ‘এই ধনরাশি আমার পিতা কিংবা পিতামহ কেউই সঙ্গে নিয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু আমাকে অবশ্যই এই সমস্ত ধনসম্পত্তি সঙ্গে করে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করতে হবে।’ সেই থেকে তিনি ভিখারীদের প্রত্যহ মহাদান দিতে লাগলেন। তিনি একজন জ্ঞানী তাপসের সেবা করতেন। তাপস তাকে দান দিয়ে স্বর্গগামী হতে উপদেশ দিতেন। এভাবে তিনি আজীবন পুণ্যকর্ম সম্পদন করে দেবতা হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। পরে পদুমুত্তর বুদ্ধের সময়ে মনুষ্যকুলে জন্মগ্রহণ ।করেনএক সময় তিনি উপাসকের সাথে শাস্তার ধর্মোপদেশ শুনছিলেন, এমন সময় শাস্তা এক ভিক্ষুকে শ্রদ্ধাপ্রব্রজ্জিদের মধ্যে শ্রেষ্ঠপদে প্রতিষ্ঠিত করছিলেন। তা দেখে তিনিও সেই শ্রেষ্ঠপদ প্রার্ ী হয়ে এক লক্ষ ভিক্ষুকে সাতদিন পর্যন্ত মহাদান দিলেন। শাস্তা গৌতম বুদ্ধের সময়ে তার প্রার্থনা পূর্ণ হবে বলে প্রকাশ করলেন। মৃত্যুর পর তিনি দেবলোকে জন্মগ্রহণ করেন।

পুনরায় ফুশ্য বুদ্ধের সময়ে শাস্তার বৈমাত্রেয় ভাই তিনজন রাজপুত্র যখন দান দিচ্ছিলেন, তখন তিনি জন্মগ্রহণ করে তাদের সঙ্গে পুণ্যকাজ সম্পাদন করে গৌতম বুদ্ধের সময়ে কুরুরাজ্যে খুল্লকোট্‌ঠিনগরে রাষ্ট্রপাল শ্রেষ্ঠীর গ্রহে জন্মগ্রহণ করেন। ভগ্নশীল রাজ্য সংযোজন করতে সমর্ বিধায় সংশানুগত ‘রাষ্ট্রপাল’ নামে পরিচিত হলেন। মাতাপিতা মহাসমারোহে তাঁর বিবাহকার্য সম্পন্ন করলেন। সেই থেকে তিনি পুণ্যপ্রভাবে দেবতুল্য বিভব ভোগ করতে লাগলেন। ভগবান যখন কুরুরাজ্যে থুল্লকোটঠিত নগরে পর্দাপন করেন। তখন তিনি বুদ্ধের কাছে উপস্থিত হয়ে ধর্মশ্রবণ করেন। তারপর তার প্রব্রজ্যা গ্রহণের বলবতী ইচ্ছা উৎপন্ন হলেও মাতাপিতা অনুমতি দিলেন না। বহুকষ্ঠে মাতাপিতার অনুমতি নিয়ে তিনি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। জ্ঞানত মনোনিবেশ সহকারে বিদশর্ন ভাবনা করে তিনি অচিরেই অর্হত্ত্ব লাভ করেন।

পরবর্তীকালে তিনি নিজের পূর্বকৃত কর্মস্মরণ করে আনন্দিত মনে নিজের পূর্বজীবনের কাহিনি প্রকাশ করতে গিয়ে ‘পদুমুত্তর ভগবান’ প্রভৃতি গাথা বলেছিলেন।

১৭৯-১৮০. আমি ত্রিলোকশ্রেষ্ঠ পদুমুত্তর ভগবানকে ঈষাদন্ত, শ্বেতচ্ছত্র পরিশোবিত, অলংকার পরিশোভিত, হস্তি গোপাকসহ, রাজকীয় হস্তিনাগ দান করেছিলাম। এই হস্তিনাগের সমান সংখ্যক টাকা দিয়ে একটি সংঘারাম তৈরি করেছিলাম।

১৮১.সেই সংঘারামে আমি চুয়ান্নহাজার ঘর তৈরি করেছিলাম। তারপর মহার্ঘ দানের আয়োজন করে মহর্ষি বুদ্ধকে দান করেছিলাম।

১৮২.সয়মূ,্ভ অগ্রপুদ্গল, মহাবীর বুদ্ধ আমার দান অনুমোদন করেছিলেন। তারপর তিনি সকল জনতাকে আনন্দ দান করে অমৃতপদ নির্বাণ দেশনা করেছিলেন।

১৮৩.তখন পদুমুত্তর বুদ্ধ ভিক্ষুসংঘের মাঝে উপবিষ্ট হয়ে আমার সম্পর্কে এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন।

১৮৪.এই ব্যক্তি চুয়ান্ন হাজার ঘর দান করেছে। এখন আমি তার ফল সম্পর্কে বলব। তোমরা আমার কথা মনযোগ দিয়ে শ্রবণ কর।

১৮৫.ভবিষ্যতে তার আঠার হাজার কূটাগার উৎপন্ন হবে, যেগুলো হবে সম্পূর্ন স্বর্ণময়।

১৮৬.পঞ্চামবার দেবেন্দ্র হয়ে দেবরাজত্ব করবে। আটান্নবার চক্রবর্তী রাজা হবে।

১৮৭.আজ থেকে লক্ষ পরে ওক্কাকুকুলে গৌতম নামক শাস্তা পৃথিবীতে উৎপন্নহবেন।

১৮৮.তখন সে দেবলোক হতে চ্যুত হয়ে পূর্বকৃপুণ্যবলেত এক মহাধনাঢ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করবে।

১৮৯.পূর্বকৃতপুণ্যবলে সে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে রাষ্ট্রপাল নামে এক শাস্তা শ্রাবক হবে।

১৯০.তখন সে ভাবনানিরত, উপশান্ত, নিরূপধি হয়ে ও পরিজ্ঞা দ্বারা সর্বাসব ক্ষয় করে সম্পূর্ণঅনাসক্ত হয়ে নির্বাপিত হবে।

১৯১.আমি আমার বিশাল ভোগসম্পত্তি থুথুর ন্যায় ত্যাগ করে গৃহত্যাগকরেছিলাম। সেই সমস্ত ভোগসম্পত্তির প্রতি আমার বিন্দুমাত্র প্রেম ছিল না।

১৯২.বীর্য আমার দৃঢ়বদ্ধ জোঁয়ালের ন্যায়ও যোগক্ষেম সমাধি আমার বাহন সদৃশ। সম্যকসম্বুদ্ধের শাসনে এই আমার অন্তিম দেহধারণ।

১৯৩।]

[যশবর্গ ছাপ্পান্নতম সমাপ্ত]

স্মারক-গাথা

যশ, নদীকাশ্যপ, গয়াকাশ্যপ, কিমিল ও বজ্জিপুত্র, উত্তরদুই, ভদ্দজি, সীবক, উপবান ও রাষ্ট্রপাল স্থবির, সর্বমোট একশ পঁচানব্বই এইবর্গ সমাপ্ত।

[স্থবির অপদান সমাপ্ত]

[এই পর্যন্ত বুদ্ধ-অপদান, পচ্চেকবুদ্ধ-অপদান ও স্থবির-অপদান সমাপ্ত]