১.একোপোসথিকা থেরী অপদান
১.বন্ধুমতি নগরে বন্ধুমা নামক এক ক্ষত্রিয় রাজা ছিলেন। তিনি পূর্ণিমা দিবসে উপোসথ পালন করতেন।
২.সেই আমি সেখানকার এক কুমদাসী্ভ ছিলাম। একদিন সসৈন্য রাজাকে উপোসথ পালন করতে দেখে আমি এরূপ চিন্তা করেছিলাম:
৩.‘রাজা রাজ্যত্যাগ করে উপোসথশীল পালন করেছেন। তার সেই উপোসথকর্ম পূর্ণাঙ্গ সফল বলা চলে। কারণ, রাজ্যের সমস্ত জনতা আজ আনন্দে দিন কাটাচ্ছে।’
৪.আমি দুর্গতি ও দারিদ্রতাকে জ্ঞানযোগে পর্যবেক্ষণ করে মনকে প্রফুল্ল করে উপোসথ পালন করেছিলাম।
৫.সম্যকসম্বুদ্ধের শাসনে উপোসথশীল পালন করে আমি সেই কর্মফলে তাবতিংস দেবলোকে জন্মেছিলাম।
৬.সেখানে আমার জন্যে কূটাগার তুল্য, মহা আসনবিশিষ্ট, এক যোজন উচ্চতাবিশিষ্ট সুনির্মিত দেবভবন উৎপন্ন হয়েছিল।
৭.লাখো অস্পরা আমাকে নিত্য সেবা-শুশ্রুষা করত। আমি সব সময় অন্যদেবতাদের অতিক্রম করে বিরচিত হতাম।
৮.আমি চৌষট্টিবার চৌষট্টিজন দেবরাােজর মহিষী হয়েছিলাম এবং তেষট্টিবার তেষট্টিজন চক্রবর্তী রাজার মহিষী হয়েছিলাম।
৯.আমি সুবর্ণবর্ণ দেহের অধিকারী হয়ে ভবসমূহে বিচরণ করেছিলাম। সর্বত্রই আমি শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী হয়েছিলাম। ইহা আমার উপোসথশীল পালনেরই সুফল।
১০.আমি হস্তিযান, অশ্বযান, রথযানও সিবিকাযান- সবকিছুই পালনেরই ফল।
১১.আমি স্বর্ণময়, রৌপ্যময়, স্ফটিকময় ও লোহিতঙ্গময় সবকিছু লাভ করেছিলাম।
১২.আমি কোশেয়্য, কম্বল, ক্ষৌম কার্পাস প্রভৃতি মহার্ঘ বস্ত্রই লাভ করেছিলাম।
১৩.আমি অন্ন পানীয় খাদ্য, বস্ত্র, শয্যাসন সবকিছুই লাভকরেছিলাম। ইহা আমার উপোসথশীল পালনেরই ফল।
১৪.আমি শ্রেষ্ঠ সুগন্ধী পুষ্পমাল্য, চূর্ণ, বিলেপনযোগ্য দ্রব্য সবকিছুই লাভ করেছিলাম। ইহা আমার উপোসথশীল পালনেরই সুফল।
১৫.আমি কূটাগার, প্রাসাদ, মণ্ডপ, হর্ম্য, গুহা প্রভৃতি সবকিছুই লাভ করেছিলাম। ইহা আমার উপোসথশীল পালনেরই সুফল।
১৬.আমি জন্মের মাত্র বৎসর বয়সে অনাগারিক প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছিলাম। আমি প্রব্রজ্যা গ্রহণের পনের দিনের মধ্যেই অর্হত্ত্ব লাভ করেছিলাম।
১৭.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে। আমার জন্মসকল ধ্বংস হয়েছে। আমার সর্বাসব পরিক্ষীণ হয়েছে। এখন আমার আর কোনো পুনজন্ম নেই।
১৮.আজ থেকে একানব্বই কল্প আগে আমি যেই দান করেছিলাম, সেই থেকে একবারও আমাকে অপায় দুর্গতিতে পড়তে হয়নি। ইহা আমার উপোসথশীল পালনেরই সুফল।
১৯.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।
২০.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।
২১.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।
ঠিক এভাবেই একোপোসথিকা থেরী অপদান এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন। [একোপোসথিকা থেরী অপদান প্রথম সমাপ্ত]
২.সললপুষ্পিকা থেরীঅপদান
২২.তখন আমি চন্দ্রভাগা নদীতীরে এক কিন্নরী হয়ে জন্মেছিলাম। একদিন আমি দেবাতিদেব, নরশ্রেষ্ঠ বুদ্ধকে চংক্রমণ করতে দেখেছিলাম।
২৩.আমি সলল পুষ্প সংগ্রহ করে বুদ্ধশ্রেষ্ঠকে দান করেছিলাম। মহাবীর বুদ্ধ তখন আমার দান করা দেবগন্ধী সললপুষ্পের ঘ্রাণ নিয়েছিলেন।
২৪.তারপর লোকনায়ক বিপশ্বী সম্বুদ্ধ সেগুলো গ্রহণ করেছিলেন। তখন মহাবীর বুদ্ধ আমি দখি মতো করে সললপুষ্পের ঘ্রাণ নিয়েছিলেন।
২৫.তারপর আমি হাত দুটি অঞ্জলিবদ্ধ করে দ্বিপদোত্তম বুদ্ধকে বন্দনা করেছিলাম এবং অতীব প্রসন্নমন নিয়ে পর্বতের উপর আরোহণ করেছিলাম।
২৬.আজ থেকে একানব্বই কল্প আগে আমি যেই পুষ্প দান করেছিলাম, সেই থেকে একবারও আমাকে অপায় দুর্গতিতে পড়তে হয়নি। ইহা আমার বুদ্ধপূজারইফল।
২৭.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।
২৮.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীবশুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।
২৯.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।
ঠিক এভাবেই সললপুষ্পিকাভিক্ষুণীঅপদান এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন। [সলল পুষ্পিকা থেরী অপদানদ্বিতীয় সমাপ্ত]
৩.মোদকদায়িকা থেরী অপদান
৩০.বন্ধুমতি নগরে আমি এক কুমদাসী্ভ হয়ে জন্মেছিলাম। আমার মোয়া ভাগটি নিয়ে ও কোলসীভরা জল নিয়ে আমি যাচ্ছিলা।
৩১.তখন আমি পথিমধ্যে শান্তচিত্ত, সমাহিত এক শ্রমণকে দেখে অতীব প্রসন্নমনে তিনটি মোয়া দান করেছিলাম।
৩২.সেই সুকৃত কর্মের ফলেও প্রার্থনা অনুযায়ী আমি একানব্বই কল্প পর্যন্ত বিনিপাত অপায়ে গমন করিনি।
৩৩.সেই তিনটি মোয়া দান করে আমি জন্মে জন্মে সর্ববিধ সম্পত্তি ভোগ করেছিলাম এবং এই শেষ জন্মে আজ আমি অচলপদ নির্বাণ লাভ করেছি।
৩৪.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।
৩৫.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।
৩৬.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।
ঠিক এভাবেই মোদকদায়িকা ভিক্ষুণীএই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন। [মোদকদায়িকা থেরী অপদান তৃতীয়সমাপ্ত
৪.একাসনদায়িকা থেরী অপদান
৩৭.হংসবতী নগরে তখন আমি এক বালিকা হয়ে জন্মেছিলাম। একদিন আমার মাতাপিতা কাজে চলে গিয়েছিলাম।
৩৮.তখন আমি মধ্যাহ্ন সূর্যে দিন দুপুরে এক শ্রামণকে পথ দিয়ে হেটে যেতে দেখেছিলাম। আমি তাকে বসার আসন পেতে দিয়েছিলাম।
৩৯.সুচিত্রিত উন্নত পশমী কাপড় দিয়ে সুসজ্জিত বসার আসন পেতে দিয়ে আমি প্রসন্নমনে এই কথা নিবেদন করেছিলাম।
৪০.চৌদিকে তপ্ত ভূমি, এখন মধ্যাহ্ন সূর্য, কোথাও বাতাস প্রবাহিত হচ্ছে না। ভিতরে আসুন, বিশ্রাম নেওয়ার এখনই উপযুক্ত সময়।
৪১.হে মহামুনি, আপনার জন্য বসার আসন প্রস্তুত। অনুকম্পা করেআমার পেতে দেওয়া বসার আসনে একটু বসুন।
৪২.তখন সুদান্ত, শুদ্ধচিত্ত শ্রমণটি আমার পেতে দেওয়া আসনে বসেছিলেন। আমি তার পাত্র নিয়ে রান্না করা যা কিছু ভাত-তরকারি ছিল সেগুলো তার পাত্রে দান করেছিলাম।
৪৩.সেই সুকৃত কর্মের ফলে ও প্রার্থনা অনুসারে মনুষ্যদেহ্যাগ তকরে আমি তাবতিংস দেবলোকে জন্মেছিলাম।
৪৪.সেখানে আমার জন্যে সুসজ্জিত আসনসহষাট যোজন দীর্ঘ ও ত্রিশ যোজন প্রস্থ একটি দেবভবন উৎপন্ন হয়েছিল।
৪৫.সেখানে আমার জন্যে স্বর্ণময়, মণিময়, স্ফটিকময়, লোহিতময় বিবিধ পালঙ্ক ছিল।
৪৬.আমার সেই পালঙ্কগুলো ছিল তুলাবৃত, চিত্রিত, বিভিন্ন পশমী লোমে আবৃত ও সুবিন্যস্ত।
৪৭.আমি যখনই কোনো জায়গায় যাওয়ার ইচ্ছা করতাম, তখন একদম হেসে-খেলে উত্তম পালঙ্ক সমেত প্রার্থিত জায়গায় যেতাম।
৪৮.আমি আশিবার আশিজন দেবরাজের মহিষী হয়েছিলাম এবং সত্তরবার সত্তরজন চক্রবর্তীরাজার মহির্ষী হয়েছিলাম।
৪৯.ভবভবান্তরে বিচরণকালে আমি মহাভোগম্পত্তি কোনো অভাব ছিল না। ইহা আমার একাসন দানেরই ফল।
৫০.আমি দেবলোক অথবা মনুষ্যলোক এই দুই লোকে মাত্র জন্মগ্রহণ করেছি। অন্যকোনে ভবে তথা লোকে জন্মগ্রহণ করেছি বলে আমার জানা নেই। ইহা আমার একাসন দানেরই ফল।
৫১.আমি ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণ এই দুই কুলে মাত্র জন্মগ্রহণ করেছি। আমি সর্বত্রই উচ্চকুলেই জন্মেছি। ইহা আমার একাসন দানেরই ফল।
৫২.দৌর্মনস্য, চিত্তসন্তাপ প্রভৃতি কীভাবে উৎপন্ন হয়-তা আমি জানতাম না। আমার শরীর কখনো বিশ্রী হয়েছে আমার জানা নেই। ইহা আমার একাসন দানেরই ফল।
৫৩.আমাকে বহু কুঁজো অধঃস্তন ধাত্রী সেবা করত। আমি তাদের একজনের কোল থেকে আরেকজনের কোলে বিচরণ করতাম। ইহা আমার একাসন দানেরইফল।
৫৪.আমাকে সব সময় অন্যেরা স্নান করাত, ভোজন করাত, রমিত করে রাখত এবং আমার গায়ে সুগন্ধি মাখিয়ে দিত। ইহা আমার একাসন দানেরই ফল।
৫৫.মণ্ডপে, বৃক্ষমূলে অথবা শূন্যগারে বসবাসকালে আমার মনোভাব অবগত হয়ে আপনাতেই আমার জন্যে পালঙ্ক উৎপন্ন হতো।
৫৬.এই ভবে এই আমার শেষ জন্ম। এই জন্মেও আমি রাজ্য ত্যাগ করে অনাগারিক প্রব্রজ্যা ত্যাগ করেছি।
৫৭.আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে আমি যেই দান করেছিলাম, সেই থেকে একবারও আমাকে অপায় দুর্গতিতে পড়তে হয়নি। ইহা আমার একাসন দানেরই সুফল।
৫৮.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।
৫৯.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।
৬০.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।
ঠিক এভাবেই একাসনদায়িকা ভিক্ষুণীএই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন। [একাসনদায়িকা থেরী অপদান চতুথসমাপ্তর্]
৫. পঞ্চদীপদায়িকা থেরী অপদান
(৬১ নং হতে ৮৪ নং পর্যন্ত সম্পূর্ণ পূর্বোক্ত পঞ্চদীপিকা থেরী অপদানের ৯১ নং হতে ১১৪ নং পর্যন্ত একই।)
৮৫.চারি প্রতিসম্ভিদা অষ্ট বিমোক্ষ, ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।
ঠিক এভাবেই পঞ্চদীপদায়িকা ভিক্ষুণীএই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলাম। [পঞ্চদীপদায়িকা থেরী অপদান পঞ্চম সমাপ্ত]
৬.নলমালিকা থেরী অপদান
৮৬.তখন আমি চন্দ্রভাগা নদীতীরে এক কিন্নরী হয়ে জন্মেছিলাম। ... ৮৮ নং পর্যন্ত পূর্বোক্ত ৩৭, ৩৮, ৩৯ নং সদৃশ।
৮৯.আমি ছত্রিশবার ছত্রিশজন দেবরাজের মহিষী হয়েছিলাম। আমি মনে মনে চাইবার সাথে সাথে আমার ইপ্সিত বস্তুটি উৎপন্ন হতো।
৯০.আমি দশবার দশজন চক্রবর্তী রাজার মহিষী হয়েছিলাম। আমি কৃতপুণ্যা হয়েই ভবে বিচরণ করেছিলাম।
৯১.আমার কুশলপুণ্য বিদ্যমান থাকার সময়েই আমি অনাগারিক প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছিলাম। তাই শাক্যপুত্রের শাসনে আজ আমি পরম পূজনীয়।
৯২.আমার মন আজ সম্পূর্ণ বিশুদ্ধ, পাপহীন। আমার সমস্ত আসব পরিক্ষীণ হয়েছে। এখন আমার আর কোনো পুনর্জন্ম নেই।
৯৩.আজ থেকে চুরানব্বই কল্প আগে আমি যেই বুদ্ধপূজাকরেছিলাম, সেই থেকে একবারও আমাকে অপায় দুর্গতিতে পড়তে হয়নি। ইহা আমার নলমালা দানেরই সুফল।
৯৪.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।
৯৫.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।
৯৬.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।
ঠিক এভাবেই নলমালিকা ভিক্ষুণীঅপদান এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন। [নলমালিকা থেরী অপদান ষষ্ঠ সমাপ্ত]
৭.মহাপ্রজাপতি গৌতমী থেরী অপদান
৯৭.একসময় লোকপ্রদ্যোৎ, নরসারথি বুদ্ধ বৈশালীর মহাবনে কূটাগারশালায় বসবাস করছিলেন।
৯৮.তখন জিনের মাসীমা মহাগৌতমী ভিক্ষনী সেই বৈশালীর মহাবনে কূটাগারশালার ভিক্ষুণীনিবাসে বাস করছিলেন।
৯৯.পাঁচশত বিমুক্তাভিক্ষুণীর সাথে নির্জনে বসে থাকার সময়ে তার এরূপ চিন্তার উদয় হয়েছিল:
১০০.অহো, আমি তো বুদ্ধ, অগ্রশ্রাবকদ্বয়, রাহুল, আনন্দ, নন্দ কারো পরিনির্বাণ দেখতে পাব না!
১০১-১০২. তাই আমাকে মহর্ষি লোকনাথ বুদ্ধের অনুমতিক্রমে বুদ্ধ, অগ্রশ্রাবকদ্বয়, মহাকাশ্যপ, নন্দ, আনন্দ ও রাহুলের পরিনির্বাণের আগেই আয়ুষ্কালের পরিনির্বাণের আগই আয়ুসংস্কার পরিত্যাগ করে নিবৃতিতে যেতে হবে অর্ াৎ নির্বাণ লাভ করতে হবে।
১০৩.ঠিক তার মতো করে তার সহগামী পাঁচশত ভিক্ষুণীর মনেও এই চিন্তার উদয় হয়েছিল। এমনকি ক্ষেমাদি মহাশ্রাবিকাদের ও তেমন চিন্তার উদয় হয়েছিল।
১০৪.ঠিক তখনি পৃথিবী কম্পিত হয়েছিল। দেবদুন্দুভি বেজে উঠেছিল। বিহারে অবস্থিত দেবতারা শোকপীড়িত হয়েছিল।
১০৫-১০৭. এভাবে দেবতারা বিলাপ করতে করতে করুণ সুরে অঝোর ধারায় অশ্রু ঝরিড়েছিল। তারপর সকল ভিক্ষুণীগৌতমীর কাছে গিয়ে তার পায়ে মাথা ঠেকিয়ে এই কথা নিবেদন করেছিল: ‘আর্যে, আমরা যখন নির্জনে নীরবে বসে ছিলাম, তখন পৃথিবী কম্পিত হতে দেখলেন। দেবদুন্দুভি বেজে উঠতে ওদবতাদের েবিলাপ শুনতে পেলাম। আর্যে গৌতমী, ইহার কারণ কী?’
১০৮.তখন তিনি যেভাবে চিন্তা করেছিলেন সবকিছু খুলে বললেন এবং অন্য তিনজনও যেভাবে চিন্তা করেছিলেন সবকিছু খুলে বললেন।
১০৯.তখন তারা বলল, হে আর্যে, আপনার যদি একান্তাই পরম সুখ নির্বাণ লাভের ইচ্ছা হয়, তবে আমরাও সুব্রত বুদ্ধের অনুমতিক্রমে পরিাপির্তনব হবো।
১১০.আমারা আপনার সাথেই গৃহত্যাগ করেছিলাম। অতএব এই সংসার থেকে ও আপনার সাথে পরম উত্তমপদ নির্বাণে গমন করব।
১১১.নির্বাণ গমনেচ্ছু ভিক্ষুণীদের গৌতমী বললেন, ‘আমি আর কী বলব ?’ তখন সেই সকল ভিক্ষুণীদের সঙ্গে করে গৌতমী ভিক্ষুণীনিবাস হতে বেরিয়ে পড়লেন।
১১২.তখন গৌতমী সেই বিহারে অবস্থিত দেবতাদের লক্ষ করে বললেন, তোমরা আমায় ক্ষমা করো। এই ভিক্ষুণীনিবাসকে এই আমার শেষ দর্শন।
১১৩.যেখানে জরা সেই, মৃত্যুনেই, অপ্রিয় সংযোগ নেই, প্রিয়বিয়োগ নেই, আমি সেই অসংস্কৃত নির্বাণে চলে যাব।
১১৪.সেই কথা শুনে সুগতের ঔরসজাত অবীতরাগীভিক্ষুণীরা শোকার্ত হয়ে এই বলে পরিদেবন করল, অহো, আমারা ভীষণ অল্পপুণ্যা!
১১৫.তখন মুহূর্তের মধ্যেই সমস্তভিক্ষুণীনিবাসে শূন্যতা নেমে আসল। চারিদিেক শূন্যতায় খাঁ-খাঁ করছিল। প্রভাত হলে যেমন তারাদের আর দেখা যায় না, তেমনি ভিক্ষুণীরাও আর তাদের দেখতে পেল না।
১১৬.গঙ্গানদী যেমন অন্য শত শত নদীকে বক্ষে ধারণ করে সাগরে চলে যায়, তেমনি সহগামী পাঁচশত ভিক্ষুণীকে সঙ্গে করে গৌতমী নির্বাণে চলে যাচ্ছেন।
১১৭.শ্রদ্ধাবতী উপাসিকারা সেই ভিক্ষুণীদের রথে চড়ে চড়ে যেতে দেখে ঘর হতে বেরিয়ে এসে পায়ে পড়ে এই কথা বলল:
১১৮.আর্যে, এই যে মহা ভোগসম্পত্তি তাতে প্রসন্ন হোন! আপনাদের ছাড়া আমরা যে একদম অসহায় হয়ে যাব! এখন আপনাদের নির্বাণ যাওয়া উচিত নয়! এভাবে সেই উপাসিকারা বিলাপ করল।
১১৯.তাদের শোক দূর করার জন্যে গৌৗতমী মধুরস্বরে বললেন, উপাসিকা, শোককরো না। এখন তো তোমাদের আনন্দিত হওয়ার সময়।
১২০.আমি দুঃখকে পরিজ্ঞাত হয়েছি। আমি দুঃখের হেতুস্বরূপ অবিদ্যা-তৃষ্ণাকে সম্পূর্ণ বর্জন করেছি। আমি নিরোধ নির্বাণকে সাক্ষাৎ করেছি। আমার দ্বারা আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ সুভাবিত হয়েছে।
[প্রথম ভানবার সমাপ্ত]
১২১.শাস্তা আমার দ্বারা সম্মান্বিত, পূজিত হয়েছেন। আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি। আমার কাধঁথেকে দুর্বহ বোঝা নেমে গিয়েছে। ভবনেত্রী তৃষ্ণা সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়েছে।
১২২.আমি যেই উদ্দেশে আগার হতে অনাগারিক প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছি, সেই উদ্দেশে আমার সফল হয়েছে। আমার সকল সংযোজন ক্ষয় হয়েছে।
১২৩.বুদ্ধ ও তার সদ্ধর্মশাসন স্বমহিমায় বিরাজমান থাকাকালেই আমার নির্বাণ লাভ করার উপযুক্ত সময়। উপাসিকা, তোমরা শোক করো না।
১২৪.উপাসিকা, কোণ্ডাঞ্ঞ, নন্দ, আনন্দ, রাহুল, স্বয়ং বুদ্ধ এবং অনুত্তর সংঘ তো থাকবেনই। তীর্থিয়গণ এখন হৃতগৌরব, নিষ্প্রভ।
১২৫.ওক্কাকু বংশের কুলপুত্রগণ যশস্বী, উন্নতশির ও মারসেনা প্রমর্দনকারী। উপাসিক, তাই এখনই আমার নির্বাণ লাভের উপযুক্ত সময়।
১২৬.দীর্ঘকাল ধরে আমি যেই জিনিসটির আশায় ছিলাম, আজ আমার সেই আশাপূর্ণ হতে যাচ্ছে। তাই উপাসিকা, এখন তো তোমাদের আনন্দ করার সময়। তোমরা কেন কান্নাকরছ?
১২৭.যদি তোমরা আমাকে দয়া কর, যদি তেমরা আমার প্রতি কৃতজ্ঞ হও, তবে তোমরা সবাই সদ্ধর্মশাসন স্থিতি কল্পে দৃঢ়ভাবে চেষ্টাশীল হও।
১২৮.আমার বারংবার সকরুণ প্রার্থনায় সম্বুদ্ধ আমাদের প্রব্রজ্যা দিয়েছেন। তাই আমি যেভাবে তোমাদের উপদেশ দিয়েছি, সেভাবেই আচরণ কর।
১২৯.তাদের এভাবে উপদেশ দিয়ে ভিক্ষুণীপরিবৃত হয়ে গৌতমী বুদ্ধের কাছে গিয়ে বন্দনা করে এই কথা নিবেদন করলেন:
১৩০.হে সুগত, আমি আপনার মাতা। অন্যদিকে আপনিই আমার বীর পিতা সদ্ধর্মসুখদায়ক না, হে গৌতম, এই শাসনে আপনার দ্বারাই আমার জন্ম হয়েছে।
১৩১.হে সুগত, আপনার রূপকায় তথা শরীর আমার দ্বারাই বর্ধিত হয়েছে। অন্যদিকে আপনার দ্বারাই আমার অনিন্দিত ধর্মজ্ঞান লাভ সমব্ভ হয়েছে।
১৩২.ক্ষুধা পেলেই আমিআপনাকে প্রতি-মুহুর্তে দুগ্ধপান করিয়েছি অন্যদিকেআপনিই আমাকে অত্যন্ত শান্ত ধর্মদুগ্ধ পান করিয়েছেন।
১৩৩.হে মহামুনি, আপনি আমাকে সংসার বন্ধন হতে মুক্ত করেছেন। তাই আপনি এখন সম্পূর্ণ ঋণমুক্ত। পুত্রকামীরা যেন আপনার ন্যায় পুত্রই লাভকরে থাকে।
১৩৪.হে পুত্র, মান্ধাতাদি নরেন্দ্র রাজাগণের মায়েরা এখনো ভবসাগরে ভাসছেন। আপনি কিন্তু আমাকে ভবসাগর হতে তীর্ণ করে দিয়েছেন।
১৩৫.মেয়েদের পক্ষে রাজমাতা মহিষি হওয়া সহজ, কিন্তু বুদ্ধমাতা হওয়া যে পরম দুলর্ভ।
১৩৬.হে মহাবীর, আমি সেই দুলর্ভ জিনিসই লাভ করেছি। আমি অন্যূনক মহৎ প্রণিদান করেছিলাম, আমার সেই আশা আজ পূর্ণ হয়েছে।
১৩৭.হে বীর, হে দুঃখখান্তকারী নায়ক, আমাকে আদেশ দিন, আমি পরিনির্বাণ লাভ করতে ইচ্ছা করি। আমি এই দেহ ত্যাগ করব।
১৩৮.হে পুত্র, আপনার চক্রাঙ্কাশধ্বজাকীর্ণ সুকোমল পাদদ্বয় প্রসারিত করুন। আমি আপনার রাতুল পদযুগলে প্রণাম নিবেদন করব।
১৩৯.হে মহানায়ক, আপনার সুবর্ণরাশিতুল্য উজ্জ্বল শরীর আমি দেখেছি। আমি পরম শান্তি নির্বাণে যাব।
১৪০.তখন জিন বত্রিশ মহাপরুষ লক্ষণসম্পন্ন, প্রভাসম্পন্ন, অলংকৃত তবু, উজ্জ্বল তরুণের ন্যায় নিজেকে সাসীমার কাছে প্রদর্শন করলেন।
১৪১.গৌতমৗ উদাসিত্ভ রবিতুল্য, তরুণাদিত্যপ্রভাময়, চক্রাঙ্কিত কোমল পদতলে মাথা ঠেকালেন।
১৪২.হে নরাদিত্য, হে আদিত্যকুলের ধ্বজা, আপনাকে প্রনাম নিবেদন করছি। এই মনণই আমার শেষ মরণ। আমি তা আর পুনরায় ইচ্ছা করি না।
১৪৩.হো লোকাগ্র, স্ত্রীলোকেরা সর্ববিধ দোষের আকর বলে সবাই জানে। হে করুণাঘন, আমার যদি কোনো দোষ থেকে থাকে, তবে আমাকে ক্ষমা করুন।
১৪৪.আমি বারবার মেয়েদের প্রব্রজ্যা দেওয়ার জন্যে আপনার সকাশে প্রার্থনা করেছি। হে নরশ্রেষ্ঠ, এতে যদি আমার কোনো অপরাধ হয়ে থাকে, তবে আমায় ক্ষমা করুন।
১৪৫.হে বীর, ভিক্ষনীরা আপনার আদেশে আমার দ্বারাই শাসিত হয়েছে। হে ক্ষমাশীল, তাতে যদি কোনো ভুল-ত্রুটি হয়ে থকে, তবে আমায় ক্ষমা করুন।
১৪৬.ভগবান বললেন, তেমরা এমন গুণভূষণে ভূষিত যে তোমাদের ক্ষমা করার কীই বা আছে। তোমরা এখন নির্বাণ যাত্রী। তোমাদের এখন আমি এর বেশি কী আর বলব!
১৪৭.আমার ভিক্ষুসংঘ অত্যন্ত পরিশুদ্ধ এবং এই পৃথিবীতে তারা স্বভাবতই ক্ষমাশীল, অনেকটা প্রভাতে আলোকিত ভোর দেখা দিলে যেমন বর্ধিষ্ণু চন্দ্র অদৃশ্য হয়ে যায়, তেমন।
১৪৮.তখন অন্যন্য ভিক্ষুণীরা জিনশ্রেষ্ঠ বুদ্ধকে চন্দ্রানুগত তারার ন্যায় প্রদক্ষিণ করে, পায়ে মাথা ঠেকিয়ে, তারপর সামনে দাড়িয়ে তার মুখের দিকে অনিমেষনেত্রে চেয়ে থাকলেন।
১৪৯.পূর্বে আপনাকে দেখে আমারও দুখেচা কখনো তৃপ্তি আসেনি। আপনার মধুর কথা শুনে আপনার দুকানে কখনোতৃষ্টি আসেনি। আমার চিত্তে কেবলমাত্র একবারই তৃপ্তিএসেছিল যেদিনে আমি ধর্মরস পান করেছি।
১৫০.দুন্দুভি যেমন আঘাত করলে বেজে উঠে, অনুরূপভাবে আপনি চারিপরেষদে সিংহনাদ করেন। হে নর পুঙ্গব, যারা আপনার শ্রীমুখের দর্শন পান, তারা ধন্য।
১৫১.হে গুণধর, যারা আপনার দীর্ঘাঙুলীবিশিষ্ট সুগঠিত নখ, দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে অত্যন্ত সুন্দর পাদদ্বয়ে প্রণাম নিবেদন করে, তাদের জীবন ধন্য।
১৫২.হে নরোত্তম, যারা আপনার মধুর স্বরে ভাষণ করা দোষবিদূরক হিতকর উপদেশবাসী শুনে থাকে, তাদের জীবন ধন্য।
১৫৩.হে মহাবীর, আপনার পদপূজা করতেপেরে আমার জীবন আজধন্য। হে শ্রীমান, আপনার সুললিত উপদেশবানীশুনে আমি সংসারকান্তারপথ অতিক্রম করেছি।
১৫৪.তারপর গৌতমী সুব্রত ভিক্ষুসংঘ প্রমুখ রাহুল, আনন্দও নন্দকে বন্দনা করে এই কথা নিবেদন করলেন:
১৫৫.ঘোর ভিষালয়, ব্যাধিরমন্দির, জরামরণে আবিষ্ট, অত্যন্ত দুঃখপূর্ণ এই দেহের প্রতি আমি সম্পূর্ণ নিষ্পৃহ।
১৫৬.এই দেহ নানাবিধ কালিমায় ক্লিষ্ট, পরাধীন ও অত্যন্ত নিরীহ। অতএব হে বৎসগণ, আমাকে অনুমতি দাও, আমি পরিনির্বাণ লাভ করতে চাই।
১৫৭.নন্দ ও রাহুল ছিলেন বীতশোক্ত, অনাসক্ত। তাই তারা ছিল ধীর, স্থির। তারা ধর্মত এমন চিন্তা করেছিল:
১৫৮.এই দেহ সংস্কৃত, লোলতাপূর্ণ, কলাগাছের ন্যায় অসার, মায়ামরীচিকা তুল্য এবং কোনো জায়গায় অবস্থিত থাকে না।
১৫৯.বুদ্ধের মাসীমা, বুদ্ধ পোষিকা এই গৌতমী নির্বাণে চলে যাচ্ছেন জগতের সবকিছুই অনিত্য।
১৬০.তখন আনন্দ ছিলেন শৈক্ষ্য। তাই তিনি ভীষণভাবে শোকাভিভূত হলেন। তিনি সাশ্রু নয়নে কাঁদতে কাঁদতে করুণ সুরে পরিদেবনকরতে লাগলেন।
১৬১.তিনি বরছিলেন, গৌতমী নির্বাণ চলে যাচ্ছেন। বুদ্ধও অচিরেইইন্ধনহীন আগুণের ন্যায় নির্বাণে চলে যাবেন।
১৬২-১৬৩. এভাবে বিলাপ করতে থাকা আনন্দকে গৌতমী বললেন, হে পুত্র, তুমি শ্রুতসাগরগমীর্ভ ও বুদ্ধের প্রধান সেবক। তোমার পক্ষে শোক করা যুক্তিযুক্ত নয়। এখন আনন্দিত হওয়ার সময়। হে পুত্র, তুমিই আমার শরণ, নির্র্বাণে উপনীতকারী।
১৬৪.বৎস, তোমার কল্যাণেই আমরা প্রব্রজ্যা গ্রহণের অনুমতি পেয়েছিলাম। হে পুত্র, হতাশ হইও না। তোমার পরিশ্রম সফল হয়েছে।
১৬৫.যা অন্যপরাতন তীথিয়চার্যরা দেখতে পায়নি, সেই শান্তিপদ নির্বাণ এখন সাতবৎসর বয়স্ক সুকুমারশিশুদের দ্বারাও সাক্ষাৎকৃত।
১৬৬.হে বুদ্ধশাসনরক্ষাকারী, আপনাকে এই আমার শেষ দর্শন। হে পুত্র, আমি এমন এক জায়গায় যাচ্ছি যেখানে গেলে আর দেখা যায় না।
১৬৭.লোকাগ্রনায়ক বুদ্ধ একদা ধর্মদেশনা করলে আমি তখন অনুকম্পা পরবশ হয়ে আশীষবাক্য বলেছিলাম:
১৬৮.হে মহাবীর, দীর্ঘজীবি হও। হে মহামুনি, সর্বলোকের কল্যাণের জন্যে কম্পকাল বেঁেচ থাক; অজর, অমর হও।
১৬৯.এভাবে বললে বুদ্ধ আমাকে বলেছিলেন, ‘হে গৌতমী, তুমি যেভাবে বুদ্ধকে বন্দনা নিবেদন করছ, বুদ্ধগণ সেভাবে বন্দিত হন না।’
১৭০.গৌতমী বলেছিলেন, কীভাবে আচরণ করলে সর্বজ্ঞ তথাগতগণ বন্দিত হন ? আর কীভাবেই বা অবন্দিত হন ? দয়া করে আমার প্রশ্নের উত্তর দেন।
১৭১.যেই সমস্ত শ্রাবক আরদ্ধবীর্য, ভাবিতচিত্ত ও দৃঢ় পরাক্রমী হয়ে অবস্থান করছে তাদের দেখ। এই হচ্ছে বুদ্ধগণকে প্রকৃত বন্দনা নিবেদন।
১৭২.তারপর আমি আমার নিবাসেগিয়ে একাকী চিন্তা করলাম, ত্রিভব বিশেষজ্ঞ নাথ সমগ্র পরিষদের ভবগতি রোধ করেদিয়েছেন।
১৭৩-১৭৪. আমি পরিনির্বাণ লাভ করলে ভালে হয়। এতে কেনো অন্তরায় বা বিপত্তি আমি দেখতে পাচ্ছি না। এভাবে চিন্তা করার পর আমি ঋষিশ্রেষ্ঠ বিনায়ক বুদ্ধকে দেখে আমার পরিনির্বাণ লাভের ইচ্ছার কথা ব্যক্ত করেছি। তখন তিনি আমাকে বললেন, ‘হে গৌতমী, তুমি যা ভালো মনে কর।’
১৭৫.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।
১৭৬.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।
১৭৭.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।
১৭৮.হে গৌতমী, যে সমস্ত মূর্খা এখনো তোমার ধর্মজ্ঞান লাভে সন্দেহবাতিকগ্রস্ত, তাদের মিথ্যাদৃষ্টি দূর করার জন্যে ঋদ্ধিপ্রদর্শন কর।
১৭৯.তখন গৌতমী বুদ্ধের আদেশে প্রথমেসম্বুদ্ধকে নতশিরে বন্দনা করে আকাশে উত্থিত হলেন এবং বহুবিধ ঋদ্ধি প্রদর্শন করলেন।
১৮০-১৮১. তখন তিনি এক থেকে বহু হন, বহু থেকে আবার এক হন। কখনো আবির্ভূত হন, অনায়াসে দিক-বিদক গমন করেন, মাটিতে দাঁড়িয়ে যথেচ্ছা গমনের ন্যায় পানিতেও আনায়াসে গমন করেন।
১৮২.পাখির ন্যায় আকাশে গমনাগমন করে। শূন্যের উপর পদ্মাসনে বসে থাকেন। এমনকি ব্রহ্মলোক পর্যন্ত তার শরীরে নিয়ন্ত্রণে আনেন।
১৮৩.নিনেরু পর্বতকে লাঠি করে, এই মহাপৃথিবীকে ছাতা করে সবকিছু পরিবর্তিত রূপ ধারণ করে আকাশে চংক্রমণ করেছিল।
১৮৪.তখন তিনি চোখে পানি চলে আসে মতো করে সমস্ত লোককে ধূমায়িত করলেন। তাতে করে মূহুর্তের মধ্যে সমস্ত লোক জ্বালাময় হয়ে উঠল।
১৮৫.মুচলিন্দ, মহাসেল ও মেরূপর্বত সবকিছুকে তিনি সর্ষপের ন্যায় এক মুষ্টিতে ধরলেন।
১৮৬.তিনি আঙুল দিয়ে তীব্র সূর্যরশ্মিকে ঢেকে ফেললেন এবং হাজারো চন্দ্রসূর্যকে গলার হারের ন্যায় ধারণ করলেন।
১৮৭.চারটি সাগরে সমস্ত জল এক হাতে ধারণ করলেন এবং তারপর সেই সাগরগুলোর উপর অঝোরধারায় বর্ষণ করালেন।
১৮৮.তিনি ঋদ্ধিবলে নভোমণ্ডলে সপরিষদ চক্রবর্তী রাজা তৈরি করলেন। গর্জনরত গরুড়, সিংহ প্রভৃতিপ্রাণিকে প্রদর্শন করলেন।
১৮৯.তিনি এ থেকে অসংখ্য ভিক্ষুণীসৃষ্টি করলেন, পুনরায় অন্তর্হিত করায়ে এক হয়ে মহামুনি বুদ্ধকে বললেন:
১৯০.হে মহাবীর, আমি আপনার মাসীমা, আপনার উপদেশ পালাকারিনী। আমার নিজের কল্যাণ আমি অর্জন করেছি। হে চক্ষুষ্মান, আপনার রাতুল চরণে বন্দনা নিবেদন করছি।
১৯১.এভাবে তিনি বিবিধ ঋদ্ধি প্রদর্শন করে নবোমণ্ডল হতে নেমে এসে লোকপ্রদ্যোৎ বুদ্ধকে বন্দনা করে একপার্শ্বে বসলেন।
১৯২.হে মহাবীর, আমার বয়স এখন একশত বিশ বৎসর। হে বীর, হে নায়ক, আমার যথেষ্ট বয়স হয়েছে। এখন আমি পরিনির্বাণ লাভ করব।
১৯৩.তখন উপস্থিত সমগ্র পরিষদ বিস্ময়ে অভিভূত হলো। তারা কৃতাঞ্জলি হয়ে বলল, ‘আর্যে, কীভাবে এই অতুলনীয়ঋদ্ধি পরাক্রম অর্জন করলেন সে কথা আমাদের বলুন।’
১৯৪.আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে সর্ববিধ ধর্মে চক্ষুষ্মান, নায়ক পদুমুত্তর জিন উৎপন্নহয়েছিলেন।
১৯৫.তখন আমি হংসবতী নগরে সমান্ত্ভ্র বংশীয় মহাধনাঢ্য অমাত্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলাম।
১৯৬.একদিন আমি দাসীগণ-পরিবৃত পিতার সাথে নরশ্রেষ্ঠ বুদ্ধের নিকট উপস্থিত হয়েছিলাম।
১৯৭.তখন তিনি বর্ষার মহামেঘের ধর্মবারি বর্ষণ করছিলেন। তখন তিনি শরতের আকাশে উদিত সূর্যেরন্যায় বুদ্ধরশ্মিতে সমুজ্জ্বল।
১৯৮.তাঁকে দেখে ও তার সুভাষিত ধর্মকাথা শুনে আমি প্রসন্নতায় ভরে উঠেছিল। তখন তিনি মাসীমা ভিক্ষুণীকে শ্রেষ্ঠপদে প্রতিষ্ঠিত করছিলেন।
১৯৯.তা শুনে আমি বুদ্ধ প্রমুখ সংঘকে সপ্তাহকাল যাবৎ বহুবিধ প্রত্যয়সহ মহাদান দিয়েছিলাম।
২০০.তারপর তাঁর পদমূলে নিপতিত হয়ে সেই শ্রেষ্ঠপদ প্রার্থনা করেছিলাম। তখন ঋষিশ্রেষ্ঠ বুদ্ধ সেই মহাপরিষদেবলেছিলেন:
২০১.যেই মহিলা লোকনায়ক বুদ্ধ প্রমুখ সংঘকে ভোজন করিয়েছে, এখন আমি তার ভূয়শ প্রশংসা করব। তোমরা মনযোগ দিয়ে শ্রবন কর।
২০২.আজ থেকে লক্ষ কল্পপরে ওক্কাকুকুলে গৌতম নামক শাস্তা পৃথিবীতে উৎপন্ন হবেন।
২০৩.তার ধর্মে সে ধর্মৌরসজাত উত্তরাধিকারিনী গৌতমী নামে শাস্তাশ্রাবিকা হবে।
২০৪.সে সেই বুদ্ধের মাসীমা ও লালনপালনকারিনী হবে এবং সেই সাথেভিক্ষুণীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠপদ লাভ করবে।
২০৫.তা শুনে আমি ভীষণ রকম আনন্দিত হয়েছিলাম। তারপর থেকে আমি আজীবন জিন শাসনে বুদ্ধ প্রমুখভিক্ষুসংঘকে চতুর্প্রত্যয়ে সেবা-শুশ্রুষা করে মৃত্যুবরণ করেছিলাম।
২০৬.আমি তাবতিংস দেবলোকে জন্মগ্রহণ করেছিলাম। সেখানে জন্ম নিয়ে আমি দশটি বিষয়ে অন্য দেবীদের ছাড়িয়ে যেতাম।
২০৭-২০৮. রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস, স্পর্শ, আয়ু, বর্ণ, সুখ, যশ, আধিপত্য- এই দশটি বিষয়ে আমি অন্যদের ছাড়িয়ে বিরোচিত হতাম। সেই আমি অরিন্দম রাজার মহিষী হয়েছিলাম।
২০৯.সংসারে বিচরণকালে আমি কর্মানুযায়ী কাশি রাজার রাজ্যে এক দাসগ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলাম।
২১০.সেই দাসগ্রামে পাঁচশত জন দাস বসবাস করতেন। তাদের মধ্যে যিনি সকলের জ্যেষ্ঠ তথা প্রধান ছিলেন আমি তার স্ত্রী হয়েছিলাম।
২১১.একদিন সেই গ্রামে পাঁচশথ পচ্চেকবুদ্ধ পিণ্ডর্া প্েরবেশ করলে তাদের দেখে আমি অন্য সকল স্ত্রীর সাথে ভীষণ রকম খুশী হয়েছিলাম।
২১২.আমরা সকল স্ত্রীরা সংঘবদ্ধ হয়ে তাদের চার মাস যাবৎ সেবা-পূজা করেছিলাম। শেষে ত্রিচীবর দান করে আমরা সস্বামীক হয়ে সংসরণ করেছিলাম।
২১৩.মৃত্যুর পর আমরা সবাই তাবতিংস দেবলোকে জন্মেছিলাম। বহু কাল পরে এই শেষ জন্মে আমরা সবাই দেবদহ নগরে জন্মগ্রহণ করেছিলাম।
২১৪.আমার পিতা অঞ্জনশাক্য ও আমার মাতা সুলক্ষণা। একদিন তারা কপিলাবস্তুতে শুদ্ধোধন রাজার ঘরে গিয়েছিলেন।
২১৫.বাকি সবাই শাক্যকুলে শাক্যদের ঘরে ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিল। আমি তাদের সকলের চেয়ে বিশিষ্টাহয়েছিলাম। আমি ছিলাম জিনের লালনপালনকারিনী।
২১৬.আমার পুত্র গৃহত্যাগকরে বিনায়ক বুদ্ধ হয়েছিলেন। আর বহু পরে আমি পাঁচশত শাক্যকন্যাকে সঙ্গে করে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছিলাম।
২১৭-২১৮. আমি ধীর শাক্যকন্যাদের সাথে শান্তিসুখ নির্বাণ লাভ করেছিলাম। পূর্বজন্মে যারা আমাদের স্বামী ছিল তারাও তখন আমাদের সাথে পুণ্যকর্ম করেছিল। তাই তারও সুগতের অনুকম্পায় অর্হত্ত্ব লাভ করেছিল।
২১৯.অন্য ভিক্ষুণীরাও নভোমলে আরোহন করেছিলেন। সেই ঋদ্ধিমতি ভিক্ষুণীরা আকাশে উজ্জ্বল তারার ন্যায় বিরোচিত হয়েছিলেন।
২২০.সুশিক্ষিত স্বর্ণকার যেমন স্বর্ণকে নানাভাবে ব্যবহারকরে, তেমনি তারা নানাভাবে ঋদ্ধিপ্রদর্শন করেছিলেন।
২২১.এভাবে নানাবিধ বৈচিত্রপূর্ণ ঋদ্ধিপ্রতিহার্য দেখিয়ে সপরিষধ বাদীশ্রেষ্ঠ মুনি বুদ্ধকে পরিতুষ্ট করেছিলেন।
২২২.তারপর তারা আকাশ থেকে নেমে এসে ঋষিশ্রেষ্ঠ বুদ্ধকে বন্দনা করে তার অনুমতি নিয়ে যথাস্থানে বসেছিলেন।
২২৩.হে গৌতমী, আপনি আমাদের সকলের দীঘদিনের পরম অনুকম্পাকারিনী! আপনার পূতপুণ্যস্পর্শেই আমরা আসবক্ষয় জ্ঞান লাভ করেছি।
২২৪.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।
২২৫.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীবশুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।
২২৬.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।
২২৭.হে মহামুনি, আমরা ঋদ্ধিমতি, দিব্যশ্রোত্র ও পরচিত্তবিজাননজ্ঞান লাভ করেছি।
২২৮.আমরা পূর্বজন্ম স্মরণ করতে পারি। আমাদের দিব্যচক্ষু বিশুদ্ধ। আমাদের সর্বাসব পরিক্ষীণ হয়েছে। এখন আর আমাদের পুনর্জন্ম নেই।
২২৯.হে মহাবীর, আপনার কাছে এসে আমাদের অথর্, ধর্ম, নিরুক্তি ও প্রতিভাণ এই চারিপ্রতিসমিদাজ্ঞান্ভ উৎপন্ন হয়েছে।
২৩০.হে নায়ক, আমরা আপনার অনুশাসন, উপদেশবানী মৈত্রীবানী মৈত্রী তদ্গতচিত্তে যথাযথভাবে অনুশীল করেছি। হে মহামুনি, অনুমতি দিন, আমরা পরিনির্বাপিত হতে চাই।
২৩১.তখন বুদ্ধ বললেন, যারা পরিনির্বাপিত হবো বলে ইচ্ছা প্রকাশ করে তাদের আমি কীই বা বলব। তোমরা যা-ই ভালো মনে কর।
২৩২.প্রথমে গৌতমী তারপর অন্য ভিক্ষুণীরা বুদ্ধকে বন্দনা করে আসন হতে উঠে চলে গেলেন।
২৩৩.তখন মহাজনতাসহ লোকনায়ক বীর বুদ্ধ মাসীমাকে তোরণমার্গ পর্যন্ত পরিবৃত করেছিল।
২৩৪.তখন গৌতমীসহ অন্যসকল ভিক্ষুণী লোকবন্ধু ভগবানের পায়ে নিপতিত হয়ে শেষবারের মতো বন্দনা করেছিলেন।
২৩৫.গৌতমী বললেন, লোকনাথ বুদ্ধকে এইআমার শেষ দর্শন। আপনার মমতামাখা শ্রীমুখ আর পুনর্বার দেখতে পাব না।
৩৩৬.হে লোকাগ্র বীর, আপনার সুকোমল পায়ে আমার বন্দনা আর স্পর্শ করবে না। কারণ, আজই আমি পরিনির্বাপিত হচ্ছি।
২৩৭.আপনার রূপ দেখেই বা আমার কী হবে? এখন যেমন পরবর্তীকালে তেমন। সবকিছুই সংস্কৃত তথা প্রত্যয় সমবায়ে ক।ৃতকোনো কিছুই জীবনকে তৃপ্তি দিতে পারে ।না
২৩৮.গৌতমী অন্য ভিক্ষুণীদের সঙ্গে করে ভিক্ষুণীনিবাসে চলে গেলেন। তারপর নির্দিষ্ট বসার আসনে অর্ধপদ্মাসন করে বসলেন।
২৩৯.তখন বুদ্ধমাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলা উপাসিকা সেই খবর পেয়ে তাকে পদবন্দনা করার জন্যে সেখানে গেল।
২৪০.হাত দিয়ে ছিড়ে ফেললে যেমন লতাগুল্ম মাটিতে নুইয়ে পড়ে, অনুরপভাবেূ উপসিকারা করুণ সুরেকাঁদতে কাঁদতে শোর্কাত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল।
২৪১.হে শরণদায়িনী নাথ আর্যে, আমাদের ছেড়ে নির্বাণে চলে যাবেন না। আমরা সবাই পায়ে পড়ে নতশিরে প্রার্থনা করছি।
২৪২.তাদের মধ্যে যেই উপাসিকা প্রধানতম, শ্রদ্ধাবতী ও প্রজ্ঞাবতী তিনি তাদের মাথায় হাত বুলিয়েএই কথা বললেন:
২৪৩.বোন, তোমরা শোক করিওনা। তারা সম্পূর্ণরূপে মারপাশ মুক্ত। সংস্কৃত তথা প্রত্যয় সমবায়ে কৃত সবকিছুই অনিত্য ও বিয়োগশীল।
২৪৪.তারপর গৌতমী তাদের ত্যাগ করে ক্রমান্বয়ে প্রথম ধ্যান, দ্বিতীয় ধ্যান, তৃতীয় ধ্যান ও চতুর্থধ্যানে মনোনিবেশ করলেন।
২৪৫.তারপর যথাক্রমে আকাশ-অনন্ত-আয়তন, বিজ্ঞান-অনন্ত-আয়তন, অকিঞ্চনায়তন ও নৈবসংজ্ঞা-নাসজ্ঞায়তন ধ্যানে মনোনিবেশ করলেন।
২৪৬.তারপর গৌতমী প্রতিলোম আকারে প্রথমধ্যান র্পযন্ত মনোনিবেশ করলেন এবং তারপর আবার ক্রমান্বয়ে চতুর্থ ধ্যানে মনোনিবেশ করলেন।
২৪৭.তারপর পরই সেই চতুর্ ধ্যান থেকে উঠে ইন্ধনহীন দীপশিখার ন্যায় পরিনির্বাপিত হলেন। তখন সঙ্গে সঙ্গে ভূকম্পন হলো এবং আকাশ থেকে বজ্র পড়ল।
২৪৮.দুন্দুভিসকল বেজে উঠল। দেবতারা বিলাপ করল। আকাশ থেকে পৃথিবীর উপর পুষ্পবৃষ্টি বর্ষিত হলো।
২৪৯.রঙ্গমঞ্চে নটনটীর ন্যায় মেরুরাজও কম্পিত হলো। শোকার্ত মানুষের ন্যায় সাগরও গর্জে উঠল।
২৫০.সেই মুহুর্তে দেবতা, নাগ, অসুর ও ব্রহ্মারা সংবিগ্ন হলো। তারা বলল, ‘সকল সংস্কার অনিত্য। অতীতে উৎপন্ন হয়েছিল, আর এখন বিলয় হয়েছে।
২৫১.যেই উপদেশ পালনকারিনী শাস্তাশ্রাবিকারা গৌতমীকে পরিবৃত করে ছিল তারও ইন্ধনহীন দীপশিখার ন্যায় পরিনির্বাপিত হলো।
২৫২.হায়, যোগযুক্তারা যোগমুক্তা হলেন! হায়, সংস্কৃত সবকিছুই অনিত্য! হায়, জীবন সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেল! এভাবে পরিদেবন করল।
২৫৩.তারপর দেব-ব্রাহ্মরা লোকধর্মের অতীত ঋষিশ্রেষ্ঠ বুদ্ধের কাছে গিয়ে বিষয়টি জানাল।
২৫৪.তখন শাস্তা শ্রুতসাগর আনন্দকে সম্বোধন করে বললেন, ‘আনন্দ, যাও, ভিক্ষুগণকে বল যে তাদের মাতা পরিনির্বাপিত হয়েছে।’
২৫৫.তখন আনন্দ নিরানন্দ মনে সাশ্রুপূর্ণ নয়নে কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, ‘ভিক্ষুগণ আসুন।
২৫৬.উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব, পশ্চিমদিকে বসবাসকারী সুগতৌরসজাত ভিক্ষুগন আমার কথা শ্রবণ করুন।
২৫৭.যেই গৌতমী ভগবানকে দুগ্ধ পান করিয়ে বড় করেছেন, সেই গৌতমীই সূর্যোদয়ে তারাগুলো অদৃশ্য হওয়ার ন্যায় পরম শান্তিপদ নির্বাণে গত হয়েছেন।
২৫৮.তাকে বুদ্ধমাতা হিসেবে সবাই জানে। তিনি এমন জায়গায় গিয়েছেন যেখানে গেলে নায়ক বুদ্ধ পঞ্চচক্ষু দিয়েও তার গতি দেখতে পান ।না
২৫৯.যিনি সুগতের প্রতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাবতী, যিনি মহামুনির অত্যন্ত প্রিয় সেই বুদ্ধমাতার সৎকার করুন।
২৬০.আয়ুষ্মান আনন্দের কথা শুনে দূরবর্তী ভিক্ষুগণও শিগগিরি আসলেন। কেউ কেউ বুদ্ধপ্রভাবে, কেউ কেউ স্বীয় ঋদ্ধিযোগে আসলেন।
২৬১.তারপর তারা স্বর্ণময় সুন্দর রমনীয় কূটাগারে একটি মঞ্চ তৈরি করালেন যেখানে গৌতমী শায়িত ছিলেন।
২৬২.চারি লোকপাল রাজা সেই মঞ্চের চারিটিকোণ ধরল বাকি দেবতার কূটাগারটি ধরল।
২৬৩.বিশ্বকর্মা পাঁচশত ভিক্ষুণীর জন্যে আদিত্যবর্ণসম্পন্ন পাঁচশত কূটাগার তৈরি করলেন।
২৬৪.পাঁচশত ভিক্ষুণীকে সেই পাঁচশত মঞ্চে শায়িত করানো হলো। দেবতারা সেগুলো কাঁধে নিয়ে শ্মশানে নিয়ে গেল।
২৬৫.সমস্ত নভোমণ্ডল শামিয়ানা ছেয়ে গেল। সমস্ত চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, তারা কনকময় হয়ে গেল।
২৬৬.বহু ধ্বজাপতাকা উড্ডীন করা হলো। সমস্ত পৃথিবী জুড়ে পদ্মপুষ্প উদ্গত হলো।
২৬৭.চন্দ্র-সূর্য দৃশ্যমান হলো তারকারা প্রজ্জ্বলিত হলো। আদিত্য মধ্যে গগণে গত হলেও পূর্ণ শশীর ন্যায় তাপদগ্ধ করল না।
২৬৮.দেবতারা দিব্য গন্ধ, মাল্য, সুরভি, বাদ্য-বাজনা, নাচ, গানে পূজা করল।
২৬৯.নাগ, অসুর, ব্রহ্মারা শক্তি অনুসারে পরিনির্বাপিত বুদ্ধমাতাকে পূজা করল।
২৭০.আগে সুগতৌরসজাত পরিনির্বাপিত অন্যভিক্ষুণীদের নেওয়া হলো, পরে বুদ্ধপোষিকা গৌতমীকে নেওয়া হলো।
২৭১.সামনের সারিতে দেব, মনুষ্য, নাগ, অসুর ও ব্রহ্মারা এবং পেছনের সারিতে সশ্রাবক বুদ্ধ মাতাকে পূজা করার জন্যে গেলেন।
২৭২.বুদ্ধের পরিনির্বাণ ঈদৃশ বা তাদৃশ ছিল, কিন্তু গৌতমীর পরিনির্বাণ ছিল অতিআশ্চর্যজনক।
২৭৪.তারপর তারা শ্মশানকে সর্ববিধ সুগন্ধিময় ও গন্ধচূর্ণময় করে দাহকৃত্য করলেন।
২৭৫.সবশেষে হাঁড়গুলো দগ্ধ হলো। তখন আনন্দ এই সংবেগজনক কথা বললেন,
২৭৬.গৌতমীকে পরির্নিবাপিত হলেন। তাঁর শরীর দাহ করা হলো। ইহা হচ্ছে বুদ্ধ পরিনির্বাণ লাভের পূর্বসংকেত। তিনিও অচিরেই পরিনির্বাণ লাভ করবেন।
২৭৭.তারপর বুদ্ধের আদেশে আনন্দ গৌতমীর ধাতুগুলো তার পাত্রে নিয়ে বুদ্ধের কাছে নিয়ে গেলেন।
২৭৮-২৮৯. তারপর সেগুলে হাতে নিয়ে ঋষিশ্রেষ্ঠ বুদ্ধ বললেন, ‘বৃক্ষ যতই সারবান ও বড় হোক না কেন তার শাখাগুলো যেমন ভেঙে ভেঙে পড়ে, বড়ই অনিত্য! অনুরূপভাবে ভিক্ষুণীসংঘসহ গৌতমী পরিনির্বাপিত হয়েছেন।’
২৮০.আনন্দ বুদ্ধকে দেখে বললেন, অহো, কী আশ্চর্য! নিজের মাতা পরিনির্বাপিত হওয়া সত্ত্বেও, এমনকি শরীরকৃত্য শেষ হওয়ার সত্ত্বেও ভগবান বুদ্ধের কোনো শোক, পরিদেবন নেই!
২৮১.তারপর ভগবান ভিক্ষগণকে সম্বোধন করে বললেন, হে ভিক্ষুগণ, গৌতমী সংসারসাগরতীর্ণ, সন্তাপবর্জিত, শীতিভূত, নিবৃত। অতএব তার জন্যে শোক করো না।
২৮২.হে ভিক্ষুগণ, গৌতমী পণ্ডিত, মাহপ্রাজ্ঞ, পৃথুপ্রাজ্ঞ ওভিক্ষুণীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হিসেবে স্বীকৃত। এভাবেই তাকে তোমরা ধারণ কর।
২৮৩.গৌতমী ঋদ্ধি, দিব্যশ্রোত্র, ও পরচিত্তবিজানন জ্ঞানলাভী।
২৮৪.সেই পূর্বনিবাসানুস্মৃতি জ্ঞানলাভী। তার দিব্যচক্ষু অত্যন্ত বিশুদ্ধ। তার সর্বাসব পরিক্ষীণ হয়েছে। তার আর কোনো পুনর্জন্ম নেই।
২৮৫.সে অথর্, ধর্ম, নিরুক্তি ও প্রতিভাণ এই চারিপ্রতিসমিদায়্ভ পরিশুদ্ধ জ্ঞানলাভী তাই তার জন্যে শোক করার কিছুই নেই।
২৮৬.জ্বলন্ত প্রদীপের শিখা যেমন ক্রমিক গতিতে নিভে গেলেও তার গতি জানা যায় না।
২৮৭.অনুরূপভাবে যারা সম্যক বিমুক্ত, কামোঘত্তীর্ণ, নির্বাণলাভী, তাদের গতিও জানা সমব্ভ নয়।
২৮৮.তাই তোমরা আত্মদীপ হও, স্মৃতিপ্রস্থানভাবনায় নিয়োজিত হও, সপ্ত বোজ্ঝাঙ্গ ভাবিত করে দুঃখের অন্তসাধন কর।
ঠিক এভাবেই মহাপ্রজাপতি গৌতমী এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন। [মহাপ্রজাপতি গৌতমী থেরী অপদান সপ্তম সমাপ্ত]
৮.ক্ষেমা থেরী অপদান
২৮৯.আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে পৃথিবীতে সর্ববিধ ধর্মে চক্ষুষ্মান, নায়ক, পদুমুত্তর জিন উৎপন্ন হয়েছিলেন।
২৯০.তখন আমি হংসবতি নগরে এক শ্রেষ্ঠী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলাম। আমি নানাবিধ রত্নপরিবেষ্টিত হয়ে মহাসুখে দিনাতিপাত করছিলাম।
২৯১.একদিন আমি সেই মহাবীর বুদ্ধের কাছে গিয়ে ধর্মদেশনা শুনেছিলাম। তাতে আমার শ্রদ্ধা উৎপন্ন হয়েছিল এবং আমি বুদ্ধের শরণ গ্রহণ করেছিলাম।
২৯২.মাতাপিতার অনুমতি নিয়ে আমি ষশ্রাবক বিনায়ক বুদ্ধকে নিমন্ত্রণ করে সাতদিন পর্যন্ত ভোজন করিয়েছিলাম।
২৯৩.সাতদিন পর নরসারথি বুদ্ধ এক ভিক্ষুণীকে ভিক্ষুণীদের মধ্যে অগ্রশ্রাবিকাপদে প্রতিষ্ঠিত করলেন।
২৯৪.তা শুনে তিনি ভীষণ রকম খুশি হলেন। পুনরায় তিনি মহর্ষি বুদ্ধকে মহাদান দিয়ে সেই শ্রেষ্ঠপদ প্রার্থনা করলেন।
২৯৫.তখন জিনশ্রেষ্ঠ আমাকে বললেন, তোমার প্রার্থনা পূর্ণ হবে। আমাকে ও সংঘকে যে তুমি দান দিয়েছ, তার অপ্রমেয় ফল তুমি লাভ করবে।
২৯৬.আজ থেকে লক্ষ কল্প পরে ওক্কাকুকুলে গৌতম নামক শাস্তা পৃথিবীতে উৎপন্ন হবেন।
২৯৭.তাঁর ধর্মে ধর্মৌরসজাত উত্তরাধিকারিনী ক্ষেমা নামী অগ্রশ্রাবিকা হবে।
২৯৮.সেই সুকৃত কর্মের ফলে ও প্রার্থনা অনুসারে মনুষ্যদেহ ত্যাগ করে আমি তাবতিংস দেবলোকে জন্মেছিলাম।
২৯৯.সেখান থেকে চ্যুত হয়ে আমি যাম স্বর্গে, সেখান থেকে চ্যুত হয়ে তুষিত স্বর্গে, সেখান থেকে চ্যুত হয়ে নির্মাণরতি স্বর্গে এবং সবশেষে সেখান থেকে চ্যুত হয়ে পরনির্মিত বশবর্তী স্বর্গে জন্মেছিলাম।
৩০০.পূর্বকৃত কর্মের ফলে আমি যেখানে যেখানে জন্মেছিলাম, সর্বত্রই রাজমহিষি হয়েছিলাম।
৩০১.সেখান থেকে চ্যুত হয়ে মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করেও আমি চক্রবর্তী রাজার মহিষি ও প্রাদেসিক রাজার মহিষি হয়েছিলাম।
৩০২.আমি দেবতা ও মানুষ হয়ে জন্ম নিয়ে উভয় সম্পত্তি ভোগ করে সর্বত্রই সুখী হয়ে বহুকল্প বিচরণ করেছিলাম।
৩০৩.আজ থেকে একানব্বই কল্প আগে চারুদর্শন, সর্ববিধ ধর্মে বিদর্শক, লোকনায়ক বিপশ্বী বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন।
৩০৪.আমি সেই লোকনায়ক, নরসারথি বুদ্ধের কাছে গিয়ে ধর্মকথা শুনে অনাগারিক প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছিলাম।
৩০৫.আমি সেই বীর বুদ্ধের শাসনে যোগযুক্ত , বহুশ্রুতা হয়ে দশহাজার বৎসর ব্রহ্মচর্যা পালন করেছিলাম।
৩০৬.তখন আমি ছিলাম প্রত্যয়াকারে দক্ষ, চর্তুসত্য বিশারদ, নিপুণ ধর্মকথিকা ও শাস্তার উপদেশ পালনকারিনী।
৩০৭.সেখান থেকে চ্যুত হয়ে আমি তুষিত স্বর্গে উৎপন্ন হয়েছিলাম। অতীতে ব্রহ্মচর্যা পালনের ফলে আমি সেখানে যশস্বিনী হয়ে অন্য দেবীদের ছাড়িয়ে গিয়েছিলাম।
৩০৮-৩০৯. পূর্বে বুদ্ধের শাসনে ব্রহ্মচর্যা আচরণের ফলে আমি যেখানেই জন্মগ্রহণ করি না কেন, সর্বত্রই মহাধনী, মহাভোগসম্পত্তিশালিনী, মেধাবিনী, শীলবতী, বিনীত পরিষদ হয়েছিলাম। আমি সর্ববিধ সম্পত্তি লাভ করেছিলাম। আমি সকলের প্রিয় ও মনোজ্ঞ হয়েছিলাম।
৩১০.আমার প্রতিপত্তি বলের প্রভাবে যে আমার স্বামী ছিল- আমি যেখানেই যাই না কেন-সে আমাকে অসম্মান করত না।
৩১১.এই ভদ্রকল্পে ব্রহ্মবন্ধু, মহাযশস্বী কোণগমন বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন।
৩১২.তখন বারাণসীতে ধনাঞ্চনী, সুমেধা ও আমি এই তিনজন এক সমান্ত্ভ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলাম।
৩১৩.আমারা তিনজন পরস্পর দানসহায়িকা ছিলাম। আমরা তিনজনে মিলে সংঘের উদ্দেশে সংঘারাম ও বিহার তৈরি করে দান করেছিলাম।
৩১৪.সেখান থেকে চ্যুত হয়ে আমরা সবাই তাবতিংস স্বর্গে জন্মেছিলাম, মানুষ হয়ে জন্মগ্রহণ করে ঠিক তদ্রুপ।
৩১৫.এই ভদ্রকল্পে ব্রহ্মবন্ধু, মহাযশস্বী কাশ্যপ বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন।
৩১৬.তখন বারাণসী নগরের কাশিরাজ কিকী নামক নরাধিপতি মহর্ষি বুদ্ধের উপস্থায়ক তথা সেবক।
৩১৭.আমি ছিলাম সেই রাজার জ্যেষ্ঠা কন্যা। আমাকে সবাই ‘শ্রমনী’ হিসেবে জানত। আমি জিনশ্রেষ্ঠ বুদ্ধের ধর্মকথা শুনে প্রব্রজ্যা আকাঙ্কা করেছিলাম।
৩১৮-৩১৯. কিন্তু পিতার অনুমতি মেলেনি। তাই আমরা গৃহে েেক অতন্দ্রভাবে বিমহাজার বৎসর কৌমার ব্রহ্মচর্যা অনুশীলন করেছিলাম। আমরা সাতজন রাজকন্যা ছিলাম। অত্যন্ত সুখিনী, বুদ্ধসেবায় নিরতা। তাতে আমরা বেশ খুশী ছিলাম।
৩২০.সেই সাতজন রাজকন্যা হলো সমনী, সমণগুপ্তা, ভিক্ষুণী, ভিক্ষুদায়িকা, ধর্মা, সুধর্মা ও সংঘদায়িকা।
৩২১.বর্তমানে সেই সাতজন রাজ কন্যা হচ্ছি যথাক্রমে আমি, উৎপলবর্ণা, পটাচারা, কুণ্ডলা, কৃশাগৌতমী, ধর্মদিন্না ও বিশাখা।
৩২২.একদিন সেই নরাদিত্য বুদ্ধ মহানিদান সুত্তন্ত দেশনা করলেন। আমি তা শুনে শুনেই শিক্ষা করেছিলাম।
৩২৩.সেই সুকৃত কর্মের ফলে ও প্রার্থনা অনুসারে মনুষ্যদেহ ত্যাগ করে আমি তাবতিংস দেবলোকে জন্মেছিলাম।
৩২৪.তারাপর এই শেষ জন্মে আমি সাকল নগরে মদ্দরাজার অতি প্রিয়, মনোজ্ঞ কন্যা হয়ে জন্মগ্রহণ করলাম।
৩২৫.আমার জন্মের পর পরই সেই নগরে ক্ষেশ তথা কল্যাণ উৎপন্ন হলো। তাই আমার নাম রাখা হলো ‘ক্ষেমা’।
৩২৬.আমি যখন রূপলাবন্যময় যুবতি হলাম তখন পিতা আমাকে বিম্বিসার রাজার সাথে বিয়ে দেন।
৩২৭.তকন আমি রাজার অতিপ্রিয় পত্নী ছিলাম। আমি ভীষণ রূপচর্যা করতাম। ভগবান বুদ্ধ আমার রূপের দোষ বর্ণনা করবেন এই ভেবে আমি তার কাছে যতাম েনা।
৩২৮.তখন বিম্বিসার রাজার আদেশে রাজপুরীস্থ সকলে আমার প্রতি অনুগ্রহ করে নানা উপমা যোগে বেনুবনের সৌন্দর্যের বর্ণনা করলেন এভাবে:
৩২৯-৩৩২. আমাদের মনে হয়, যে সুগতালয় বেণুবণ বিহারটি দেখেনি, সে এখানো সৌন্দর্য কী দেখেনি। যে অনিন্দ্যসুন্দর বেণুবনটি দেখেছে, সে প্রকৃত সৌন্দর্যের দেখা পেয়েছে। তাই দেবতারা দেবসৌন্দর্য ফেলে এই পৃথিবীতে এসে দৃষ্টি নন্দন বেণুবন বিহারটি দেখে থাকেন। তারা অনিমেষ দৃষ্টিতে দেখতেই থাকেন, কিছুতেই তৃপ্ত হন ।নাবেণুবন বিহারটি রাজপুন্যে উৎপন্নএবং বুদ্ধপুন্যে ভুষি।তাই এমন বেণুবনের গুণের কথা কে বলে শেষ করতে পারবে ?
৩৩৩.বেণবন বিহারের এমন শ্রুতিমধুর গুণকীর্তন শুনে আমি বুদ্ধকে দর্শনেচ্ছু হলাম। এবং আমার ইচ্ছার কথাটি রাজাকে জানালাম।
৩৩৪.তারপর রাজা আমাকে বিশাল পরিষদ পরিবেষ্টিত করে বুদ্ধকে দর্শনের জন্যে পাঠালেন।
৩৩৫.যাও, দেখো, সুগত বুদ্ধরশিত্মে উজ্জ্বল সেই দৃষ্টিনন্দন বেণুবন বিহারটিকে, যা থেকে নিরত সৌন্দর্য নিংড়ে পড়ছে।
৩৩৬.রাজগৃহ নগরে বুদ্ধযখন পিণ্ডের জন্যে বিচরণ করতে বের হলেন, ঠিক তখনি আমি দৃষ্টিনন্দন বেণুবন বিহারটিকে দেখতে প্রবেশ করলাম।
৩৩৭-৩৩৯. তখন আমি সেই ফুলে ফুলে সাজানো, নয়নাভিরাম, ভ্রমর, কোকিলসহ নানা পাকপাখালির কূজনে মুখরিত, ময়ূয়ের নাচে শোভিত, নির্জন, নিরিবিলি, কুটি-মণ্ডপ সমাকীর্ণ, যোগীবরের বাসস্থান বেণুবনবিহারটির চারপাশে ঘুরে ঘুরে মুগ্ধদৃষ্টিতে দেঘছিলাম। তখন আমি যোগযুক্ত তরুণ এক ভিক্ষুকে দেখে ভাবলাম:
৩৪০.এই নবযৌবনপ্রাপ্ত, সুদর্শন, মনোজ্ঞ কান্তি ভিক্ষু ঈদৃশ রমনীয় বনে বসবাস করছেন।
৩৪১.অহো, এই মণ্ডিত মস্তক ভিক্ষুযৌবনের আনন্দ-ফূর্তি ত্যাগ করে সংঘাটি পরিধান করে বৃক্ষমূলে বসে ধ্যান করছেন।
৩৪২.এই ভিক্ষুর পক্ষে গৃহস্থহয়ে কামসুখ ভোগ করে পরে বৃদ্ধ বয়সে শ্রমন্যধর্মঅনুশীলন করা উচিত নয় কি?
৩৪৩.তারপর ক্রমে জিনালয় গন্ধকূটিতে গিয়ে আমি উদীয়মান সূর্যের ন্যায় ভাস্বর জিন বুদ্ধকে দেখলাম।
৩৪৪. তিনি একাকী সুখাসনে বসে আছেন আর তাঁেক বাতাস করে দিচ্ছে এক অনিন্দ্যসুন্দরী নারী। এমন দৃশ্য দেখে আমি ভাবলাম, ‘এই নরশ্রেষ্ঠ বুদ্ধ তো দেখছি বিশ্রী নন।’
৩৪৫-৩৪৭. সেই নারীটিও সোনারঙা, পদ্মলোচনা, রক্তললাট, মালতী ফুলের ন্যায় মনোহরিনী, হেম দোলাভূষণা, উন্নত রক্ষা, সুঢৌল নিতম্ব, পরিপাটি ও বিচিত্র বস্ত্রধারিনী, সদাহাস্যময়ী, যার রূপ-লাবন্য দেখে তৃপ্ত হওয়া যায় না।
৩৪৮. মেয়েটিকে দেখে আমি ভাবলাম, অহো, কী অনিন্দ্যসুন্দরী! আমি তো এমন অনিন্দ্যসুন্দরী মেয়ে আগে কখনো দেখিনি!
৩৪৯-৩৫১. তারপর আস্তে আস্তে সেই মেয়েটি জরাগ্রস্ত, বিবর্ণ, বিশ্রী, হলো। মেয়েটির গালে ভাঁজ পড়ল, দাঁতগুলো ভেঙে পড়ল, চুলগুলো পেকে সাদা হয়ে গেল, মুখ থেকে লালা ঝড়ে পড়ছিল। কানগুলো ও সুঢৌল স্তনগুলো নিচের দিকে ঝুলে পড়ল। তারগাত্রে শিরাগুলো ভেসে উঠল। তার শরীর নুয়ে পড়ে যেতে লাগল। তাকে লাঠি ধরতে হলো। তার শরীর এতই কৃশ হয়ে গেল যে তাকে দেখতে ভীষণ রকম বিশ্রী দেখাচ্ছিল। তার শরীর কাঁপতে লাগল আর সে বেশ বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছিল।
৩৫২. তা দেখে আমার মনে ভীষণ রকম সংবেগ উৎপন্ন হলো। শরীরে অদুত্ভ রকমের লোমহর্ষণ হলো। ধিক! ধিক! এই অশুচি রূপকে ধিক! মূর্খরাই এই রূপে রমিত হয়।
৩৫৩.তথন সুগত মহাকারুণিক বুদ্ধ সংবিগ্ন অবস্থায় আমাকে দেখে এই গাথাগুলো ভাষণ করলেন:
৩৫৪.হে ক্ষেমা, দেখো সূর্খা অভিনন্দিত এই পূতিময়, অশুচিতে পূর্ণ দেহকে দেখো।
৩৫৫.একাগ্র ও সুসমাহিত চিত্তে অশুভ ভাবনা কর, কায়গতানুস্মৃতি ভাবনা কর, আর তাতে দেহের প্রতি বিরাগবহুল হও।
৩৫৬.ইহা যেমন উহাও তেমন, উহা যেমন ইহাও তেমন। নিজ ও পরদেহের প্রতি যে তষ্ণাৃ তা ত্যাগ কর।
৩৫৭.অনিমিত্ত ভাবনা কর। মানানুশয় ত্যাগ কর। মানানুশয় ত্যাগ করলে পরে সম্পূর্ণ উপশান্ত হয়ে থাকতে পারবে।
৩৫৮.যারা রাগমদে মত্ত হয়ে বাস করে তারা নিজকৃত জালে আবদ্ধ মাকড়সার মতো আবদ্ধ হয়। যারা এই সত্য উপলদ্ধি করেছে তারা এই সমস্ত অসার কামসুখ ত্যাগ করে, পরিবর্জন করে।
৩৫৯.তার পর নরসারথি বুদ্ধ আমার চিত্ত স্বচ্ছ, নির্মল, জ্ঞান লাভের উপযুক্ত হয়েছে জেনে আমাকে বিনীত করার জন্যে মহানিদান সুত্তন্ত দেশনা করলেন।
৩৬০.সেই সুত্তন্ত শোনার পর পরই আমি আমার পুর্বলব্ধ সংজ্ঞা স্মরণ করেছি। সেখানে দাঁিড়য়েই আমি ধর্মচক্ষু লাভ করেছি।
৩৬১.তৎক্ষণাৎ আমি মহর্ষি বুদ্ধের পদমূলে নিপতিত হয়ে এই অশুচি দেহের দোষ সম্বন্ধে দেশনা করার জন্যে এই কথা নিবেদন করেছি:
৩৬২.হে সর্বদশী, আপনাকে নমস্কার। হে করুণাঘন, আপনাকে নমস্কার। হে তীর্ণসংসার, আপনাকে নমস্কার। হে অমৃতদায়ক, আপনাকে নমস্কার।
৩৬৩.এখন আমি মিথ্যাদৃষ্টি সম্পূর্ণ বর্জন করেছি। কামরাগে বিমোহিতা আমাকে আপনি বেশ সুকৌশলে যথার্ উপায়ে বিনীত করেছেন।
৩৬৪.আপনার ন্যায় মহর্ষি বুদ্ধের সাক্ষাৎ না পেয়ে বহু রাগমদে মত্ত সত্ত্ব সংসারসাগরে মহাদুঃখ ভোগ করছে।
৩৬৫.লোকশরণ, অরণ, অরণবিদ বুদ্ধকে আমি কাছাকাছি জায়গায় অবস্থান করা সত্ত্বেও দেখতে আসিনি। আমি অকপটে সেই দোষ স্বীকার করছি।
৩৬৬.মহাহিতৈষী, শ্রেষ্ঠদাতা বুদ্ধকে আমি অহিতৈষী জ্ঞান করেছি। আমি আমার রূপাভিমানে মত্ত হয়ে তার কাছে যাইনি। আমি অপটে আমার সেই দোষ স্বীকার করছি।
৩৬৭.ঠিক তখনি মহাকারুণিক জিন মধুর স্বরে আমাকে ক্ষেমা, এবার ক্ষান্ত হও’ বলে আমার উপর অমৃতবারি ঢেলে দিলেন।
৩৬৮.তারপর আমি নতশিরে প্রণাম নিবেদন করে প্রদক্ষিণ করে চলে গেলাম। চলে যাবার পর নৃপতি বিম্বিসারকে দেখে আমি এই কথা নিবেদন করেছিলাম:
৩৬৯.অহো, নৃপতি, আপনার চিন্তা যথার্থই ছিল! আপনি আমাকে বেণুবন দর্শনের জন্যে পাঠিয়েছেন! আর মহামুনি বুদ্ধ আমায় নির্বাণ দর্শন করিয়েছেন।
৩৭০.হে মহারাজ, এখন আমি মহামুনির উপদেশে রূপের প্রতি বীতরাগ। আপনার অনুমতি পেলে আমি বুদ্ধের শাসনে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করব।
[দ্বিতীয় ভাণবার সমাপ্ত]
৩৭১. হাত জোড় করে নৃপতি তখন বললেন, হে ভদ্রে, আমি তোমায় প্রব্রজ্যা গ্রহণের অনুমতি প্রদান করছি। তোমার আশা পূর্ণ হোক!
৩৭২-৩৭৩. প্রব্রজ্জিত হওয়ার পনের দিন পরে আমি জ্বলন্ত প্রদীপের নিভে যাওয়ার দেখে সর্ববিধ সংস্কারের প্রতি নির্বেদপ্রাপ্ত ও প্রত্যয়াকারে বিশারদ হয়ে কামোঘ, ভবোঘ, দৃষ্টি-ওঘ, অবিদ্যা-ওঘ এই চারি ওঘ অকিক্রম করে অর্হত্ত্ব লাভ করেছি।
৩৭৪-৩৭৬. আমি বিবিধ ঋদ্ধি, দিব্যশ্রোত্র, পরচিত্ত বিজাননজ্ঞান ও পূর্বনিবাসানুস্মৃতিজ্ঞান লাভ করেছি। আমার দিব্যচক্ষু অত্যন্ত বিশুদ্ধ। আমার সর্বাসব পরিক্ষীণ হয়েছে। আমার আর কোনো পুনর্জন্ম নেই। অথর্, ধর্ম, নিরুক্তি, প্রতিভাণ এই চারিপ্রতিসমিদায়্ভ আমার বিশুদ্ধ জ্ঞান উৎপন্ন হয়েছে।
৩৭৭.আমি সপ্ত বিশুদ্ধিতে অভিজ্ঞ, কথাবত্থুবিশারদ, অভিধর্ম নয়বিশারদ ও বুদ্ধশাসনে বশীপ্রাপ্ত।
৩৭৮.তারপর একদিন রাজদরবারের প্রবেমদ্বারে কোশলরাজ প্রসেনজিৎ আমাকে নিপুণ কিছু প্রশ্ন করলে আমি তার যথার্ উত্তর দিয়েছি।
৩৭৯.তখন সেই রাজা সুগত বুদ্ধের কাছে গিয়ে সেই একই প্রশ্ন করলে বুদ্ধও সেই একই উত্তর দিলেন, ঠিক যেভাবে আমি দিয়েছি।
৩৮০.তারপর নরোত্তম জিন আমার গুনে তুষ্ট হয়ে আমাকেভিক্ষুণীদের মধ্যে মহাপ্রজ্ঞায় শ্রেষ্ঠ অগ্রশ্রাবিকা পদে বসালেন।
৩৮১.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।
৩৮২.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।
৩৮৩.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি। ঠিক এভাবেই ক্ষেমা ভিক্ষুণীএই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন।
[ক্ষেমা থেরী অপদান অষ্টম সমাপ্ত]
৯.উৎপলবর্ণা থেরী অপদান
৩৮৪.উৎপলবর্ন ভিক্ষুণীঅসমব্ভ ঋদ্ধিমতি। তিনি একদিন শাস্তার পায়ে বন্দনা নিবেদন করে এই বললেন:
৩৮৫.হে মহামুনি, আমি জন্মসঞ্চরণ তথা বারবার জন্মগ্রহণ উত্তীর্ণ হয়েছি। অচলপদ নির্বাণ লাভ করেছি। আমার সর্ববিধ দুঃখ ক্ষীণ হয়েছে। আমি তা আপনাকে জ্ঞাত করছি।
৩৮৬.জিনশাসনের প্রতি প্রসন্ন যত পরিষদ আছে, তাদের কারো কাছে যদি আমি কোনো অপরাধ করে থাকি, তবে এই জিনের সামনেই আমার সেই কৃত অপরধ ক্ষমা করুন।
৩৮৭.হে মহাবীর, সংসারে বিচরণ করার সময় আমি যদি কোনো অপরাধ করে থাকি, আমি সেই কৃত অপরাধ অকপটে স্বীকার করছি। আমার কৃতঅপরাধ ক্ষমা করুন!
৩৮৮.হে উৎপলবর্ণা, তুমি আমার শাসনে উপদেশ পালনকারিনী। তুমি তোমার অধীত অলৌকিক ঋদ্ধি প্রদর্শন কর। ভিক্ষু, ভিক্ষুণী, উপাসক, উপাসিকা এই চারিপরিষদের সন্দেহ দূর কর।
৩৮৯.হে মহাবীর প্রজ্ঞাবান, জ্যোতিধর, আমি আপনার কন্যা। আমি বহু অতিদুষ্কর কর্ম সম্পাদন করেছি।
৩৯০.আমার শরীরবর্ণ উৎপলবর্ণের মতো বিধায় আমার নাম রাখা হয়েছে উৎপলাবর্ণা। হে মহাবীর চক্ষুষ্মান, আপনার শ্রাবিকা আমি আপনার রাতুল চরণেবন্দনা নিবেদন করছি।
৩৯১.আমি এবং রাহুল বহু শত জন্ম ধরে একই মানসিকতাসম্পন্ন হয়ে একত্রে জন্মেছি।
৩৯২.অতীতে একত্রে জন্মালেও এই শেষ জন্মে কিন্তু আমরা উভয়েই আলাদাভাবে ভিন্ন জাতিতে জন্মেছি।
৩৯৩.এখন আপনার পুত্র হচ্ছে রাহুল আর কন্যাহচ্ছে রাহুল আর কন্যা হচ্ছি আমি উৎপলবর্না। হে বীর, দেখুন আমার অলৌকিক ঋদ্ধিশক্তি। আমি শাস্তাকে আমার শক্তি দেখাব।
৩৯৪.কুমার যেমন হাতে রাখা তেল ছুড়ে মারে, তেমনি উৎপলবর্ণও চারিসমুদ্রের সমস্ত পানি হাতে নিয়ে ছুড়ে মারলেন।
৩৯৫.যুবা কুমার যেমন মুঞ্জ নামক এক ধরণের লতাকে ধরে উপরায়ে ফেলে, তেমনি উৎপলবর্নাও সমগ্র পৃথিবীকে উপরায়ে ফেলেছুড়ে মারলেন।
৩৯৬.সমস্ত চক্রবালকে হাত দিয়ে আচ্ছাদিত করে বারবার নানা রকম বৃষ্টি অঝোর ধারায় বর্ষণ করালেন।
৩৯৭.উৎপলবর্না যুবাকুমারেরন্যায় ভূমিকে ঢেঁকি, পাথরগুলোকে ধান্য ও সিনেরু পর্বতকে মুশলদণ্ড করে পিষ্ট করলেন।
৩৯৮.তারপর বললেন, আমি বুদ্ধশ্রেষ্ঠের কন্যা। আমার নাম উৎপলবর্ণ। আমি ষড়াভিজ্ঞ ও আপনার উপদেশ পালনকারিনী।
৩৯৯.লোকনায়ক বুদ্ধকে নানাবিধ অলৌকিক ঋদ্ধিপ্রদর্শন করে এবং নিজের নামগোত্র প্রকাশ করে বললেন, হে চক্ষুষ্মান, আমি আপনার পায়ে বন্দনা নিবেদন করছি।
৪০০-৪০২. আমি বিবিধ ঋদ্ধি, দিব্যশ্রোত্র, পরচিত্তবিজাননজ্ঞান ও পূর্বানিবাসানুস্মৃতি জ্ঞান লাভ করেছি। আমার দিব্যচক্ষু অত্যন্ত বিশুদ্ধ। আমার সর্বাসব পরিক্ষীণ হয়েছে। আমার আর কোনো পুনর্জন্মনেই। অথর্, ধর্ম, নিরুক্তি, প্রতিভাণ এই চারিপ্রতিসমিদায়্ভ আমার বিশুদ্ধ জ্ঞান উৎপন্ন হয়েছে।
৪০৩.পূর্বপূর্ব জিনশ্রেষ্ঠগণের কথায় আপনার সাথে আমার সম্পর্কে কথা প্রকাশিত হয়েছে। হে মহামুনি, একমাত্র আপনার জন্যেই আমি বহুপুণ্যকরেছি।
৪০৪.হে মুনি, আমি যে কুশলকর্ম সম্পাদন করেছি তা স্মরণ করুন। হে মহাবীর, একমাত্র আপনার জন্যেই সেসব পুণ্যআমি সঞ্চয় করেছি।
৪০৫.আমি যতটুকু সমব্ভ অনুপযুক্ত স্থান ও অনৈতিক কার্যকলাপ বর্জন করে চরেছি। হে মহাবীর, একমাত্র আপনার জন্যেই আমার এই জীবন।
৪০৬.হে মহামুনি, আমি দশ হাজার কোটিবার আমার জীবন দান করেছি। অমার তুচ্ছ জীবন বিসর্জন দিয়েছি। তা একমাত্র আপনার জন্যেই করেছি।
৪০৭.তখন সবাই অপার বিস্ময়ে নতশিরে কৃতাঞ্জলি হয়ে বললেন, হে আর্যে, কী অতুলনীয় আপনার ঋদ্ধিপরাক্রম!
৪০৮.আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে আমি এক নাগকন্যা হয়ে জন্মেছিলাম। তখন আমার নাম ছিল ‘বিমলা’। অন্য নাগকন্যাদের মধ্যে আমিই ছিলাম সবচেয়ে সম্মানিত।
৪০৯.একসময় মহানাগ জিনসশাসনের প্রতি প্রসন্ন হয়ে সশ্রাবক মহাতেজস্বী পদুমুত্তর বুদ্ধকে নিমন্ত্রণ করলেন।
৪১০.তখন মহানাগরাজ রত্নময় বালুকারাশি ছিটিয়ে বেশ আরামদায়ক রত্নময় মণ্ডপও রত্নময় পালঙ্ক তৈরি করালেন।
৪১১-৪১২. রাগরাজ বুদ্ধের জন্য রত্নধ্বজা সজ্জিত রাস্তা তৈরি করালেন। তারপর তূর্য বাজিয়ে সম্বুদ্ধেকে আনা হয়ে নাগরাজের নাগভবনের শ্রেষ্ঠ বুদ্ধাসনে বসলেন।
৪১৩.তারপর নাগরাজ মহাযশস্বী বুদ্ধকে অন্ন, পানীয়, উত্তম খাদ্য-ভোজ্য দান করলেন।
৪১৪.ভোজনের পর সম্বুদ্ধ পাত্র ধুয়ে ঋদ্ধিমতি নাগকন্যাদের দেশনা করলেন।
৪১৫.নাগকন্যারা মহাযশস্বী সর্বজ্ঞ বুদ্ধকে বেশ হাসিখুশি দেখে শাস্তার প্রতি আমার মনচিত্ত ভীষণ রকম প্রসন্ন ও প্রফুল্ল হলো।
৪১৬.আমার মনোভাব জ্ঞাত হয়ে মহাবীর পদুমুত্তর বুদ্ধ সেই মুহুর্তে এক ঋদ্ধিমতি ভিক্ষুণীকে ঋদ্ধি দেখতে বললেন।
৪১৭.সেই বিশারদ ভিক্ষুণীবহুধরণের ঋদ্ধি দেখালেন। তা দেখে আমি ভীষণরকম খুশি হলাম। তারপর শাস্তাকে এই কথা নিবেদন করলাম:
৪১৮.হে বীর, আমি এই ভিক্ষূণীল অলৌকিক ঋদ্ধি দেখলাম। এখন আমার প্রশ্ন হচ্ছে, এই বিশারদ ভিক্ষুণীকীভাবে এমন অলৌকিক ঋদ্ধিসম্পন্না হলেন?
৪১৯.এই ঋদ্ধিমতি ভিক্ষুণীআমার ধর্মৌরসজাত কন্যা, আমার উপদেশ পালনকারিনী ও বিবিধ ঋদ্ধিতে বিশারদপ্রাপ্ত।
৪২০.বুদ্ধের কথা শুনে তখন আমি প্রার্থনা করলাম, আমিও তার মতো ঋদ্ধিতে বিশারদ
হতে চাই।
৪২১.হে নায়ক, আমি অত্যন্ত খুশিমনে সেইভিক্ষুণীর মতো হবার প্রার্থনা করছি। আমিও ভবিষ্যতে তার মতো হতে চাই।
৪২২.তারপর আমি সেই প্রভাস্বর মণ্ডপে ও মণিময় পালঙ্কে বসা সশ্রাবক লোকনায়ক বুদ্ধকে অন্নপানীয়ে পরিতৃপ্ত করলাম।
৪২৩.শ্রেষ্ঠ নাগ পুষ্প ও উৎপলপুষ্প দিয়ে লোকনায়ক বুদ্ধকে পূজা করে প্রার্থনা করলাম, আমার শরীরের বর্ণ যাতে উৎপল বর্ণেরমতো হয়।
৪২৪.সেই সুকৃত কর্মের ফলে ওপ্রার্থনা অনুসারে মনুষ্যদেহ ত্যাগকরে আমি তাবতিংস দেবলোকে জন্মগ্রহণ করেছি।
৪২৫.সেখান থেকে চ্যুত হয়ে আমি মনুষ্যলোকে জন্ম নিয়ে তৎকালীন এক সয়মূ্ভ পচ্চেক বুদ্ধকে উৎপলপুষ্পে আচ্ছন্ন পিণ্ডপাত দান করেছি।
৪২৬.আজ থেকে একানব্বই কল্প আগে পৃথিবীতে চারুদর্শন, সর্ববিধ ধর্মে চক্ষুষ্মান, নায়ক বিপশ্বী ভগবান উৎপন্ন হন।
৪২৭.তখন আমি বারাণসী নগরে এক শ্রেষ্ঠী জন্ম নিয়ে সশ্রাবক লোকনায়ক সমুদ্ধক্ভে নিমন্ত্রণ করেছি।
৪২৮.সশ্রাবক বুদ্ধকে মহাদান দিয়ে ও উৎপলপুষ্পে পুজা করে মনে মনে ‘আমার শরীরের রং উৎপলবর্ণ হোক,’ বলেপুজা‘আমার শরীরে রং উৎপলন হয়েছিলেন।
৪২৯.এই ভদ্রকল্পে বৃহ্মবন্ধু, মহাযগশস্বী কাশ্যপ বুদ্ধ উপন্ন হয়েছিল।
৪৩০.তখন বারাণসী নগরের কাশিরাজ কিকী নরেশ্বর মহর্ষি বুদ্ধের সেবক ছিলেন।
৪৩১.আমি তখন সেই রাজার দ্বিতীয় কন্যা ছিলাম। আমার নাম শ্রবণগুপ্তা। আমি জিনশ্রেষ্ঠের ধর্মকথা শুনে প্রব্রজ্যা গ্রহণের ইচ্ছা পোষণ করেছিলাম।
৪৩২.বাবা আমাদের অনুমতি দেননি। তার পর আমরা বোনেরা সবাই মিলে গৃহে থেকেই বিশহাজার বৎসর অতন্দ্রভাবে বিচরণ করেছিলাম।
৪৩৩.আমরা সাতজন সুখিনী রাজকন্যা সবাই মিলে খুশি মনে ব্রহ্মচর্যা ও বুদ্ধসেবায় নিয়োজিত ছিলাম।
৪৩৪.সেই সাতজন রাজকন্যা হচ্ছে, সমনী, সমণগুপ্তা, ভিক্ষুণী ভিক্ষদায়িকা, ধম্মা, সুধম্মা ও সংঘদায়িকা।
৪৩৫.বর্তমানে যথাক্রমে আমি, প্রজ্ঞাবতি ক্ষেমা, পটাচারা, কুণ্ডলা, কৃমাগৌতমী, ধর্মদিন্না ও বিশাখা।
৪৩৬.সেই সুকৃত কর্মের ফলে ও প্রার্থনা অনুসারে মনুষ্যদেহ ত্যাগ করে আমি তাবতিংস দেবলোকে জন্মেছিলাম।
৪৩৭.সেখান থেকে চ্যুত হয়ে আমি মনুষ্যলোকে এক কুলীন পরিবারে জন্মগ্রহণ ।করি তখন অমি এক অর্হৎকে একটি শ্রেষ্ঠ পীত বস্ত্র দান করেছিলাম।
৪৩৮.সেখান থেকে চ্যুত হয়ে আমি এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করি। আমি তখন তিরিটিবচ্ছ ব্রাহ্মণের এক সুন্দরী কিন্তু উন্মাদিনী কন্যা হলাম।
৪৩৯.সেখান থেকে চ্যুত হয়ে আমি জনৈক পরিবারে জন্ম নিলাম। তখন আমি নিয়মিত শালি ধান জমা করতাম।
৪৪০-৪৪১. একদিন আমি পচ্চেক বুদ্ধকে দেখেপাঁচশত শষ্য ও পাঁচশত পদ্মফুল দান করে পাঁচশত পদ্মফুল দান করেপাঁচশত পুত্র লাভের প্রার্থনা করেছিলাম। তারাও সয়মূ্ভ পচ্চেক বুদ্ধকে মধু দান করে এই প্রার্থনা করেছিলেন। সেখান থেকে চ্যুত হয়ে আমি অরন্যে একপদ্মগর্ভে জন্মেছিলাম।
৪৪২.তারপর আমি কাশিরাজের মহিষি হয়ে বহু সেবিত, পূজিত হয়ে অন্যূন একশত করে পাঁচশত রাজপুত্রের জন্মদিয়েছিলাম।
৪৪৩.তারা যৌবনে পদার্পন করলে পরে একদিন জলক্রীড়া করতে করতে পদ্মপাতা ঝড়ে পড়তে দেখে অনিত্য সংজ্ঞা নিয়ে পচ্চেক বুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
৪৪৪.তারা পচ্চেক বুদ্ধ হওয়ায় আমি তাদের হারিয়ে ভীষণভাবে শোকাগ্রস্তহয়েছিলাম এবং মৃত্যুর পর ইসিগিলি পর্বতের পাশে এক গ্রামে জন্মগ্রহণ করেছিলাম।
৪৪৫-৪৪৬. একদিন আমি যখন যাগু নিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন আটজন পচ্চেক বুদ্ধকে ভিক্ষার জন্যে গ্রামে যেতে দেখে আমার পুত্রদের কথা মনে পড়েছিল। তখন আমার মনে প্রবল পুত্রস্নেহ উৎপন্নহওয়ায় দুগ্ধধারা প্রবাহিত হয়েছিল।
৪৪৭.আমি সেই পচ্চেক বুদ্ধগণকে অতীব প্রসন্নমনে নিজ হাতে যাগু দান করেছিলাম। তার ফলে মৃত্যুর পর আমি তাবতিংস দেবলোকে নন্দন দেবভবনে উৎপন্ন হয়েছিলাম।
৪৪৮.এই ভবসংসারে বিচরণ করে বহু সুখ-দুঃখ ভোগ হে মহাবীর, একমাত্র আপনার উদ্দেশেই জীবন বিসর্জন দিয়েছিলাম।
৪৪৯-৪৫০. এভাবে বহুবিধ দুঃখ ও সম্পত্তি ভোগ করে আমি এই শেষ জন্মে শ্রাবস্তী নগরে মহাধনাঢ্য, নানাবিধ রত্নসমারের্ভ অধিকারী, সমান্ত্ভ ও সুখী শ্রেষ্ঠী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি।
৪৫১.সেই পরিবারে জন্ম নিয়ে আমি ভীষণভাবে সম্মানিত, পূজিত, মানিত ও রূপশ্রী প্রতিমণ্ডিত হয়েছি।
৪৫২.আমি পূর্বপ্রার্থনা অনুসারেঅত্যন্ত রূপবতী হওয়ায় বহুশত শ্রেষ্ঠীপুত্র আমার পাণি প্রার্থনা করেছিল।
৪৫৩.আমি গৃহত্যাগ করে অনাগারিক প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছিলাম এবং মাত্র পনের দিনের মধ্যেই চতুর্সত্য লাভ করেছিলাম।
৪৫৪.তারপর আমি ঋদ্ধিযোগে নির্মিত চতুরশ্বযোজিত রথে চড়ে লোকনাথ বুদ্ধের পায়ে বন্দনা করেছিলাম।
৪৫৫.পুষ্পিত তরুকুঞ্জে আগমন করে তুমি একাকিনী হয়ে ব্রহ্মমূলে দাড়িয়ে।আছতুমি তো অরক্ষিতা। মূঢ়, তুমি ধূর্তদের ভয় পাও না ?
৪৫৬.হে মার, তোমার ন্যায় হাজারো ধূর্ত আসলেও আমার কেশাগ্র মাত্র টলাতে পারবে না। আর তুমিএকা কী করিবে?
৪৫৭.আমি এখনি অদৃশ্য হয়ে তোমার দেহে প্রবেশ করতে পারি। দেখো, আমি তোমার ভ্রুযুগলের ভিতর দাড়িয়ে আছি। অথচ তুমি আমায় দেখতে পাচ্ছ না।
৪৫৮.আমার চিত্ত বশীভূত। আমি ঋদ্ধিপাদে সুপ্রতিষ্ঠিত। আমি সর্ববিধ বন্ধন হতে সম্পূর্ণ মুক্ত। তাই আবুসো, আমি তোমায় মোটেই ভয় পাই না।
৪৫৯.কামতৃষ্ণা ও স্কন্ধসমূহ শূলের ন্যায় বিদ্ধ করেছি। তুমি যাকে কামরতি তথা উপভোগু বিষয় বলেয়, তাতে আমার রতি নেই।
৪৬০.অজ্ঞতারূপ সমস্ত অন্ধকার বিদূরিত করে আমি সর্ববিধ ভোগতৃঞ্চার বিনাশ সাধন করেছি। হে পাপী, ইহা জেনে রেখো। হে অন্তক, তুমি নিহত হয়েছ।
৪৬১.বিনায়ক বুদ্ধ আমার গুণ তুষ্ট হয়ে পরিষদে ঋদ্ধিমতিভিক্ষুণীদের মধ্যে আমাকে শ্রেষ্ঠপদে বসালেন।
৪৬২.শাস্তা আমার দ্বারা অনুশীলিত হয়েছেন। আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি। আমার কাঁধ থেকে দুর্বহ বোঝা নেমে গিয়েছে। ভবনেত্রি তৃষ্ণা আজ সম্পূর্ন ধ্বংসপ্রাপ্ত।
৪৬৩.আমি যাঁর উদ্দেশে গৃহত্যাগ করে অনাগারিক প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছি, আমার সেই উদ্দেশ্যে সার্ ক হয়েছে। আমার সর্ববিধ সংযোজন ছিন্ন হয়েছে।
৪৬৪.চৌদিক হতে আমার উদ্দেশে হাজারো চীবর, পিণ্ডপাত, শয্যাসন, ও ওষুধ এই চারি প্রত্যয় প্রতি মুহুর্তে নিয়ে আসা হতো।
৪৬৫.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।
৪৬৬.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।
৪৬৭.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।
ঠিক এভাবেই উৎপলবর্ণা ভিক্ষুণীএই গাথাগুলে ভাষণ করেছিলেন। [উৎপলবর্ণা থেরী অপদান নবম সমাপ্ত]
১০.পটাচারা থেরী অপদান
৪৬৮.আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে সর্ববিধ ধর্মে বিশেষ পারদর্শী পদুমুত্তর জিন নায়ক উৎপন্ন হয়েছিলেন।
৪৬৯.তখন আমি হংসবতি নগরে নানাবিধ নত্নের অধিকারী মহাধনী শ্রেষ্ঠী পরিবারে জন্মগ্রহণ করে মহাসুখে দিনাতিপাত করছিলাম।
৪৭০.একদিন আমি সেই মহাবীর বুদ্ধের কাছে গিয়ে ধর্মদেশনা শুনেছিলাম এবং শ্রদ্ধন্বিত হয়ে বুদ্ধের শরণ গ্রহণ করেছিলাম।
৪৭১.তখন পদুমুত্তর বুদ্ধ এক লজ্জী, যোগ্য-অযোগ্য বিশারদ ভিক্ষুণীকে বিনয়ধারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হিসেবে ভূয়শী প্রশংসা করছিলেন।
৪৭২.তা শুনে আমি ভীষণ খুশি হয়ে সেই শ্রেষ্ঠপদ লাভের ইচ্ছায় সশ্রাবক দশবল লোকনায়ক বুদ্ধকে নিমন্ত্রণ করেছিলাম।
৪৭৩.সাত দিন যাবৎ ভোজন করিয়ে, ত্রিচীবর দান করে নতশিরে পায়ে নিপতিত হয়ে আমি এই কথা নিবেদন করেছিলাম:
৪৭৪.হে বীর মুনি, আজ থেকে সাতদিন আগে আপনি যাকে ভূয়শী প্রশংসা করেছেন, আমি তার মতো হতে চাই। হে নায়ক, আমার মনস্কার পূর্ণ হবে কনা িবলুন।
৪৭৫.তখন শাস্তা আমাকে বললেন, ভদ্রে, ভয় পেয় না। দীর্ঘকালপরে ভবিষ্যতে তোমার সেই মনোরথ পূর্ণ হবে।
৪৭৬.আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে ওক্কাকুকুলে গৌতম শাস্তা পৃথিবীতে উৎপন্ন হবেন।
৪৭৭.তাঁর ধর্মে ধর্মৌরসজাত উত্তরাধিকারী পটাচারা নামী শাস্তাশ্রাবিকা হবে।
৪৭৮.তা শুনে আমি ভীষণ খুশি হয়েছিলাম। আজীবন আমি মৈত্রীতদ্গতচিত্তে সশ্রাবক লোকনায়ক বুদ্ধকে পরিচর্যা করেছিলাম।
৪৭৯.সেই সুকৃত কর্মের ফলে ও প্রার্থনা অনুসারে মনুষ্যদেহ ত্যাগ করে আমিতাবতিংস দেবলোকে জন্মগ্রহণ করেছিলাম।
৪৮০.এই ভদ্রকল্পে ব্রহ্মবন্ধু, মহাযশস্বী কাশ্যপ বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন।
৪৮১.তখন আমি বারণসী নগরের নরেশ্বর কাশিরাজ কিকী মহর্ষি বুদ্ধের সেবক ছিলেন।
৪৮২.আমি সেই রাজার তৃতীয় কন্যা ছিলাম। আমার নাম ছিল তখন ‘ভিক্ষুণী’। একদিন জিনশ্রেষ্ঠর ধর্মকথা শুনে প্রব্রজ্যা গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলাম।
৪৮৩.কিন্তু তখন বাবা আমাদের অনুমতি দেননি। তাই আমরা গৃহে থেকেবিশ হাজার বৎসর অতন্দ্রভাবে বিচরণ করেছিলাম।
৪৮৪.আমরা সাতজন সুখিনী রাজকন্যা সবাই মিলে খুশি মনে ব্রহ্মচর্য ও বুদ্ধসেবায় নিয়োজিত ছিলাম।
৪৮৫.সেই সাতজন রাজকন্যা হচ্ছে, সমনী, সমণগুত্তা ভিক্ষুণী, ভিক্ষুদায়িকা, ধম্মা, সুধম্মা ও সংঘদায়িকা।
৪৮৬.বর্তমনে যথাক্রমে আমি, উৎপলবর্ণা, ক্ষেমা, ভদ্রা, কৃশাগৌতমী, ধর্মদিন্না ও বিশাখা।
৪৮৭.সেই সুকৃত কর্মের ফলে ও প্রার্থনা অনুসারে মনুষ্যদেহ ত্যাগ করে আমি তাবতিংস দেবলোকে জন্মেছিলাম।
৪৮৮.এই শেষ জন্মে আমি সমৃদ্ধ শ্রাবস্তী নগরে এক ধনাঢ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি।
৪৮৯.যৌবনে পদার্পন করার পর আমি বির্তকের বশীভূতহয়েছি। আমাদের ঘরের দাসকে দেখে আমি তার সাথেই ঘর ছেড়ে চরে গিয়েছি।
৪৯০.একটি পুত্রসন্তান প্রসব করার পর আমার গর্ভে দ্বিতীয় সন্তান আসল। তখন আমার মাতাপিতাকে দেখার প্রবল ইচ্ছা উৎপন্ন হলো।
৪৯১.স্বামী ঘরের বাইরে থাকাকালীন আমি তাতে কিছুই না জানিয়ে একাই ঘর হতে বের হয়ে শ্রাবস্তীর উদ্দেশে যাত্রা করলাম।
৪৯২.তখন আমার স্বামী ঘরে ফিরে অবস্থা বুঝতে পেরে আমারখোঁজে বের হলো। এদিকে তখন আমার অতি কষ্টকরপূবকর্মজ ব্যাথা উৎপন্ন হলো।
৪৯৩.আমার প্রসুতিকালীন আকাশে ঘনকালো মহামেঘ উৎপন্ন হলো। তখন আমার স্বামী প্রবল বৃষ্টি বাঁচানোর জন্যে তৃণ,খড়খুটো খুঁজতেগেলে সাপের দংশনে মারা গেল।
৪৯৪.তখন আমি প্রসববেদনায় ছটফট করছি। স্বামীর মৃত্যুর পর আমি একদম অনাথ ও নিঃস্ব হয়ে গেলাম। আমি দিগভ্রান্ত হয়ে যেতেযেতে পথিমধ্যে প্রবল জড়ে স্ফীত এক নদী দেখতে পেলাম। ঠিক তখনি আকাশপথে এক শ্যেন পাখি যাচ্ছিল।
৪৯৫.তখন আমি বড় শিশুকে নদীর পারে রেখে ছোট্ট শিশুকে নিয়ে নদীর পার করছি।
৪৯৬.এমন সময় শ্যেণ পাখি ডানা ঝাপটিয়ে আমার ছোটশিশুটিকে নিতে চাইলে আমি তাকে হাত দিয়ে ছোট শিশুটিকে নিতে চাইলে আমি তাকে হাত দিয়ে নানাভাবে তাড়া করতে লাগলাম। এদিকে আমার বড় শিশুটি তাকে ডাকছি মনে করে নদীতে ঝাপ দিলে স্রোত তাকে ও ভাসিয়ে নিয়ে গেল। আমি দুই পুত্রকে হারিয়ে ভীষণ রকম শোকাগ্রস্ত হলাম।
৪৯৭.তার পর আমি শ্রাবস্তী নগরে গিয়ে আমার পিতামাতাসহ সমস্ত জ্ঞাতিকুলের মৃত্যুর খবর শুনতে পেলাম। তখন আমি আরও বেশি শোকসন্তপ্ত হলাম।
৪৯৮.এদিকে আমার দুই পুত্র হারিয়েছি অরন্যে আমার স্বামীরমৃতদেহ পড়ে আছে। আমার মা, বাবা ও ভাই একই চিতায় দগ্ধ হচ্ছেন।
৪৯৯.তখন আমি প্রবলশোকে কৃশকায় হয়ে গেলাম। আমার শরীর পাণ্ডর্বণ হয়ে গেল। আমি তখন সম্পূর্ণ অসহায়, অনাথ, নিঃস্ব। এখানে ওখানে ঘুরতে ঘুরতে একদিন নরসারথি শাস্তাকে দেখতে পেলাম।
৫০০.তখন শাস্তা আমাকে বললেন, তুমি পুত্রের জন্যে শোক করিও না। নিজেকে নিয়ে তুমি গবেষণা কর। তাদের জন্যে তুমি নিরর্থক দুঃখ পাচ্ছ নয় কি?
৫০১.পিতা, পুত্র, জ্ঞাতি বর্গ, বন্ধু-বান্ধব কেউই তোমাকে মুক্তি দিতে পারবে না। মৃত্যু যখন তোমাকে গ্রাস করবে তখন তার কবল থেকে কেউই তোমাকে মুক্ত করতে পারবে না।
৫০২.মহামমুনির সেই কথা শুনে আমি স্রোতাপত্তিফর লাভ করেছি। তারপর প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে অচিরেই অহত্ত্ব লাভ করেছি।
৫০৩-৫০৪. আমি বিবিধ ঋদ্ধি, দিব্যশ্রোত্র, পরচিত্তবিজাননজ্ঞান ও পূর্বনিবাসানুস্মৃতিজ্ঞান লাভ করেছি। আমার দিব্যচক্ষু অত্যন্ত বিশুদ্ধ। সর্বাসব ক্ষয় করে এখন আমি বিশুদ্ধ, সুনির্মল।
৫০৫.তারপর আমি সর্বদশী শাস্তার কাছে সবিস্তারে সমগ্র বিনয় শিক্ষা করেছি।
৫০৬.বুদ্ধ জিন আমার গুণে তুষ্টহয়ে ‘বিনয়ধারীভিক্ষুণীদের মধ্যে পটাচারাই শ্রেষ্ঠ’ এই বলে আমাকে শ্রেষ্ঠপদে বসালেন।
৫০৭.বুদ্ধের উপদেশ, আমি পালন করেছি। বুদ্ধের শাসনে আমি কৃতকার্য হয়েছি। আমার কাঁধ থেকে দুঃখভার নেমে গিয়েছে।
৫০৮.যেই উদ্দেশ্য নিয়ে আমি গৃহত্যাগ করেঅনাগারিক প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছি, আমার সে উদ্দেশ্য সফল হয়েছি। আমার সর্ববিধ সংযোজ ক্ষয় হয়েছে।
৫০৯.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।
৫১০.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।
৫১১.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।
ঠিক এভাবেই পটচারা ভিক্ষুণীএই গাথাগুলে ভাষণ করেছিলেন। [পটাচারা থেরী অপদান নবম সমাপ্ত]
[একোপোসথিকা বর্গ দ্বিতীয় সমাপ্ত]
স্মারক-গাথা
একোপোসাতিকা, সলল ও মোদকাদায়িকা, একাসনা, পঞ্চদীপা, নলমালী ও গৌতমী, ক্ষেমা, উৎপলবর্না ও পটাচারা ভিক্ষুণী,
মোট পাঁচশত এগারটি গাথা এই বর্গে বর্ণিত।