৫৪.কাচ্চায়ন বর্গ

১.মহাকাচ্চায়ন স্থবির অপদান

এই স্থবিরও অতীত বুদ্ধগণের নিকট বিাবিধপুণ্যকর্ম করে জন্মজন্মান্তরে সুখদপুণ্যসঞ্চয় করতে করতে পদুমুত্তর ভগবানের সময়ে গৃহপতি মহাশাল কুলেজন্মগ্রহণ করেন। প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর একদিন তিনি শাস্তার নিকট ধর্ম শ্রবণ করতে গেলেন। তখন শাস্তা একজন ভিক্ষুকে সংক্ষিপ্ত ভাষণের বিস্তারিত অর্থ ব্যাখ্যাদানকারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠস্থানে প্রতিষ্ঠিত করছিলেন। তা দেখে তিনি নিজেও সেই শ্রেষ্ঠস্থান লাভের প্রাথর্না করলেন। তারপর দানাদি বহুপুণ্যসম্পাদন করে দেবমনুষ্যগণের মধ্যে জন্মপরিভ্রমণ করতে করতে তিনি সুমেধ ভগবানের সময় এক বিদ্যাধর হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। একদিন তিনি আকাশ পথে যেতে যেতে এক বনসণ্ডে উপবিষ্ট ভগবানকে দেখে প্রসন্নমনে কণিকার পুষ্প দিয়ে পূজা করেন।

সেই পুণ্যপ্রভাবে তিনি অপরাপর সুগতিলোকে জন্মপরিভ্রমণ করতে করতে কাশ্যপ দশবলের সময় বারাণসীর এক কুলগৃহে জন্মগ্রহণ করেন। ভগবানের পরিনির্বানের পর তিনি সুবর্ণ-চৈত্য কর্মস্থানে লক্ষটাকা মুল্যের সোনারইট দিয়ে পূজা করে এই বলে প্রাথর্না করেন: এই সোনার ইট দানের ফলে জন্মজন্মান্তরে আমার শরীর সোনারঙা হোক।

তারপর তিনি আজীবন কুশলকর্ম করে এক বুদ্ধান্তর কল্প দেবমনুষ্যলোকেজন্মপরিভ্রকুকরে এই গৌতম বুদ্ধের সময় উজ্জেনী রাজা চণ্ডপ্রদ্যোতের এক পরোহিতের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। নামকরণ দিনে তার মা ‘আমার পুত্র নিজেরসুবর্ণবণ নামক নিয়েই এসেছে’ ভেবে তার নাম কাঞ্চনমানব রাখলেন। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর তিনি ত্রিবেদ শিক্ষা করে পিতার মৃত্যুর পর পিতার পুলোহিতপদটি পেলেন। তিনি গোত্রবশে সকলের কাছে কাচ্চায়ন গোত্রীয় বলে পরিচিত ছিলেন। অতঃপর রাজা চণ্ডপ্রদ্যেৎ বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছেনশুনে তাকে এই বলে পাঠালেন : ‘আচার্য আপনি সেখানে গিয়ে শাস্তাকে এখানে নিয়ে আসুন।’ তারপর তিনি অপর সাতজনকে সঙ্গে নিয়ে শাস্তার কাছে গেলেন। শাস্তা তাদের ধর্মদেশনা করলেন। দেশনা শেষে অন্য শতজনের সাথে তিনি প্রতিসমিদাসহ্ভ অর্হত্ত্ব লাভ করলেন।

অর্হত্ত্ব লাভের পর তিনি নিজের পূর্বকৃত র্মকস্মরণ করে আনন্দিত মনে নিজের পূর্বজীবনের কাহিনি প্রকাশ করতে গিয়ে ‘পদুমুত্তর জিন’ প্রভৃতি গাথা বলেছিলেন।

১. সম্পূর্ণ বাসনামুক্ত, অজিতজয়ী পদুমুত্তর জিন আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে উৎপন্ন হয়েছিলেন।

২-৪. তিনি ছিলেন বীর, কমলপত্রচক্ষু, বিমল চন্দ্র, কনকসদৃশ, সূর্যের ন্যায় প্রভাস্বর, সত্ত্বগণের চোখের মণি, শ্রেষ্ঠ লক্ষণবিশিষ্ট, বাক্যদিয়ে প্রকাশের অতীত, মনুষ্য-পূজিত, সত্ত্বগণের বোধোদয়ে সম্বুদ্ধ, বাক্যবাগীশ, মধুরস্বরবিশিষ্ট, পরম করুনাপরায়ণ ও পরিষদে বিশারদ।

৫. তিনি চতুরার্যসত্য বিষয়ক মধুর ধর্মদেশনা করেন এবংমোহপঙ্কে নিমগ্ন প্রাণিদের উদ্ধার করেন।

৬.তখন আমি হিমালয়বাসী একাচারী তাপস হয়ে মনুষ্যলোকের উপর দিয়ে আকাশ পথে মনুষ্যলোকের উপর দিয়ে আকাশ পথে যাবার সময় পদুমুত্তর জিনকে দেখতে পেয়েছিলাম।

৭.তাঁর কাছে গিয়ে আমি ধর্মদেশনা শুনেছিলাম। তখন তিনি তাঁর একজন বীর শ্রাবকের মহৎগুণের কথা বলছিলেন এভাবে :

৮.আমার শ্রাবক কাচ্চায়ন আমার কথিত সংক্ষিপ্ত ভাষণকে বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করে পরিষদ ও আমাকে সন্তুষ্ট করে।

৯.আমি অন্য একজন শ্রাবককেও দেখছি না যে, এভাবে আমার কথিত সংক্ষিপ্ত ভাষণবে বিস্তারিতভাবে প্রকাশ করতে পারে। তাই হে ভিক্ষুগণ, আজ থেকে এবিষয়ে কাচ্চায়কেই শ্রেষ্ঠবলে অবধারণ করো।

১০.তখন আমি সবিস্ময়ে ভগবানের শ্রুতিমধুর মনোরম বাক্য শুনছিলাম। তারপর আমি হিমালয়ে চলেগিয়ে কিছু ফুল সংগ্রহ করেছিলাম।

১১.তারপর আমি লোকশরণ বুদ্ধকে সেই ফুল দিয়ে পূজা করে সেইশ্রেষ্ঠস্থান লাভের প্রার্থনা করেছিলাম। তখন তিনি আমার মনের ইচ্ছার কথা জেনে এভাবে বলেছিলেন:

১২-১৫. দেখো, তোমরা এই বিশুদ্ধ বনকবর্ণের দেহধারী, ঊর্ধলোমধারী, স্বাস্থবান, নিশ্চল অঞ্জলিবদ্ধ হাতে দাঁড়িয়ে থাকা, আনন্দদায়ী, পরিপূর্ণ নামধারী, বুদ্ধগণের প্রতি তদ্গতচিত্ত, ধর্মধ্বজাধারী, উদগ্রহৃদয় ও অমৃতসিক্ততুল্য ঋষিবরকে দেখো। সে আমার শ্রাবক কচ্চায়নের গুণের কথা শুনে সেই পদ লাভের জন্য প্রার্থনা করে দাঁড়িয়ে আছে। ভবিষ্যতে সে মহামুনি গৌতম বুদ্ধের ধর্মৌরসজাত ধর্মদায়াদ হবে। তখন সেও কচ্চায়ন নামে শাস্তাশ্রাবক হবে।

১৬.তখন সে বহুশ্রুত, মহাজ্ঞানী ও অভিপ্রায়বিদ্র মুনিহবে। ঠিক আমি যেভাবে যেভাবে বলেছি, সেভাবেই সে সেই শ্রেষ্ঠপদ লাভ করবে।

১৭.আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে আমি যেই কর্ম করেছিলাম, সেই থেকে একবারও আমাকে অপায় দুর্গতিতে পড়তে হয়নি। ইহা আমার বুদ্ধপূজারইফল।

১৮.আমি দেবলোক ও মনুষ্যলোকেএই দুই ভবেই মাত্র জন্মগ্রহণ করেছি। আমার অন্যগতি হয়নি। ইহা আমার বুদ্ধপূজারই ফল।

১৯.আমি মনুষ্যলোকে ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণ এই দুই কুলেই মাত্র গ্রহণজন্ম করেছি। আমি নীচ কুলে কখনও জন্মগ্রহণ করিনি। ইহা আমার বুদ্ধপূজারই ফল।

২০.এই অন্তিম জন্মে আমি উজ্জেনি রাজ্যে জন্মগ্রহণ করেছি চণ্ডপ্রদ্যেৎ রাজার পুরোহিতের ঘরে।

২১.আমি ছিলাম নিপুন, ত্রিবেদ পারদর্শী ও শ্রেষ্ঠকনকবর্ণের অধিকারী কচ্চায়ন। আমার বাবার নাম তিরিটিবচ্ছ ও মাতার নাম চণ্ডিমা।

২২-২৩. ভুমিপাল চণ্ডপ্রদ্যোৎ রাজা বুদ্ধকে পরীক্ষা করার জন্যে আমাকে পাঠালেন। আমি মোক্ষপুরের দ্বারদ, গুণধর নায়ক বুদ্ধকে দেখে ও তার গতিপঙ্কবিশোধক বিমল বাক্য শুনে আমার সঙ্গী সাতজন ব্যক্তিসহ শান্ত অমৃতপদ নির্বাণ লাভ করেছি।

২৪.মহামতি সুগত ভগবান আমাকে অভিপ্রায়বিদ ও সুসমৃদ্ধমনোরথ হিসেবে শ্রেষ্ঠস্থানে পতিষ্টিত করলেন।

২৫.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

২৬.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

২৭.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মান মহাকাচ্চায়নস্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন। [মহাকাচ্চায়ন স্থবির অপদান প্রথম সমাপ্ত]

২. বক্কলি স্থবির অপদান

এই স্থবিরও অতীত বুদ্ধগণের নিকট বিবিধ পুণ্যকর্ম করে জন্মজন্মান্তরে সুখদপুণ্যসঞ্চয় করতে করতে পদুমুত্তর ভগবানেরসময়ে হংসবতী নগরে এক কুলিন পরিবারেজন্মগ্রহণ করেন। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর একদিন তিনি উপাসকদের সাথে বিহারে গিয়ে সবার শেষে দাঁড়িয়ে ধর্মশ্রবণ করেন। তখন শাস্তা একজন ভিক্ষুকে শ্রদ্ধাশীল ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠস্থানে পতিষ্ঠিত করছিলেন। তা দেখে তিনি নিজে সেই পদ প্রাথর্না করে সাতদিন পর্যন্ত বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষুসংঘকে মহাদান দিলেন। শাস্তা ভগবান তার প্রাথর্না পূর্ণ হতে বলে প্রকাশ করলেন।

তিনি আজীবন কুশলকর্ম করে দেবমনুষ্যলোকে জন্মপরিভ্রমণ করতে করতে আমাদের গৌতম ভগবানের সময় শ্রাবস্তীর এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর নাম রাখা হলো ‘বক্কলি’। প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর তিনি ত্রিবেদ শিক্ষা করেন ও ব্রহ্মণবিদ্যায় দক্ষতা লাভ করেন। তিনি ভগবানের শারীরিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থেকে তৃপ্ত হতেন ।নাতাই ভগবানের সাথেই অবস্থান করতেন।

গৃহমধ্যে থাকলে সব সময় বুদ্ধের দর্শন পাব না ভেবে তিনি ভগবানের নিকট প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। কেবল ভোজনের সময় ব্যতীত যেখানে থেকে বুদ্ধকে দেখা যায় সেখানে থেকে অন্যান্য কাজ ত্যাগ করে সব সময় ভগবানের দিকে তাকিয়ে থাকতেন।

শাস্তা তাঁর জ্ঞান পরিপক্ক হবার সময় না আসা পর্যন্ত বহুকাল তাঁর রুপে মুুগ্ধ হয়ে বিচরণ করলেও কিছুই বলেননি। তারপর একদিন বললেন, হে বক্কলি, এই ঘৃণ্য শরীর দেখে তোমার কী লাভ ? হে বক্কলি, যে ধর্মকে দেখে সে আমাকে দেখে। যে আমাকে দেখে সে ধর্মকে দেখে। হে বক্কলি, ধর্মকে দেখলেই আমাকে দেখা হয়ে যাবে। তুমি ধর্মকে না দেখে শুধু আমার শরীরকে দেখে থাকলে ধর্মকে দেখতে পাবে না।

ভগবান এভাবে উপদেশ দিলেও তিনি বুদ্ধদর্শন ছেড়ে অন্যত্র যেতে পারতেন না। ভগবান ভাবলেন, এই ভিক্ষু সংবেগপ্রাপ্ত না হলে বুঝতে পারবে না। একদিন বর্ষাবাসারম ্ভ দিনে শাস্তা তাকে বললেন, হে বক্কলি, তুমি অন্যত্র চলে যাও।

শাস্তা তাকে এভাবে অন্যত্র চলে যেতে বলার পর তিনি আর শাস্তার সামনে বসে থাকতে পারলেন না। তিনি ভাবলেন, বেঁচে থেকে আমার কী আর লাভ! আমি তো আর শাস্তার দেখা পাব না।’ তারপর তিনি গৃধ্রকূট পর্বতের এক প্রপাতেগিয়ে উঠলেন। শাস্তা তার এই সংবাদ পেয়ে ভাবলেন, আমি এই ভিক্ষুকে এখন আশ্বাস প্রদান না করলে সে মার্গফলের হেতুকে ধ্বংস করে ফেলবে। তখন ভগবান তাকে দেখা দেবার জন্য উজ্জ্বল আলো ছড়িয়ে এই গাথাটি বললেন :

বুদ্ধশাসনের প্রতি প্রসন্ন ও আনন্দবহুল ভক্ষু িসংস্কার সমূহকে উপশম করে শান্তপদ নির্বাণ লাভ করেন। (ধর্মপদ-শ্লোক) তারপর ভগবান ‘এসো বক্কলি’ বলে হাত মেলে ধরলেন। স্থবির ভাবলেন, ভগবান আমাকে দেখতে পেয়েছেন। তাই’ এসো’ কথাটি আমি পেয়েছি। তখন তিনি বলবতী প্রীতি-সৌমনস্য উৎপন্ন করে অপ্রতিতভাবে ‘কোন দিকে যাব’ ভেবে না পেয়ে ভগবানের দিকেই আকাশপথে ধাবিত হলেন। তিনি প্রথম পা ফেলেই পর্বতে দাঁড়িয়ে ভগবানের কথিক গাথাটি চিন্তা করতে লাগলেন। তার পর তিনি আকাশেই স্ফুনণাপ্রীতি উৎপন্ন করে প্রতিসমিদাসহ্ভ অর্হত্ত্ব লাভ করলেন।

একদিন তিনি বদহজমের দরুন ভীষণভাবে বাতব্যাধিতে আক্রান্ত হলে ভগবান গাথাযোগে তার অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন:

“হে ভিক্ষু, তুমি বাতরোগাক্রান্ত হয়ে রোগের উপযুক্ত ওষুধপথ্য না পেয়ে এই মহা অরণ্যের কঠিন ভুমিতে কীভাবে বাস করবে?”

তা শুনে স্থবির প্রত্যুত্তরে বললেন:

“আমি বিপুল প্রীতি সুখে শরীকে স্ফুরিত করে দুঃখময় জীবনযাপন সহ্য করে কাননে বসবাস করব।”

“আমি চারিস্মৃতিপ্রস্থান, পঞ্চেন্দ্রিয়, পঞ্চবল, সপ্ত বোজ্ঝাঙ্গ প্রভৃতি ভাবনা করে কাননে বসবাস করব।”

“আমি আরদ্ধবীর্য, নির্বাণগত প্রাণ ও নিত্যদৃঢ়পরাক্রমশালী এবং পরম মৈতীভাবাপন্ন শীলবান ব্রহ্মচারীদের গুণ দেখেই কাননে বাস করব।”

“আমি শ্রেষ্ঠ, শান্ত, দান্ত, সমাহিত সম্যকসম্বুদ্ধকে অনুস্মরণ করে রাতদিনঅতন্দ্রভাবে কাননে বাস করব।”

অর্হত্ত্ব লাভের পর তিনি নিজের পূর্বক্রত কর্ম স্মরণ করে আনন্দিত মনে নিজের পূর্বজীবনের কাহিনি প্রকাশ করতে গিয়ে “আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে” প্রভৃতি গাথা বলেছিলেন।

২৮.আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে পৃথিবীতে অনোম নামে অমিতপদুমুত্তর নায়ক বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন।

২৯.তাঁর মুখপ্রস্ফুটিত পদ্মের মতো সুশ্রী আর দেহচ্ছবি ও পদ্মতুল্য। তিনি পদ্মের ন্যায় পৃথিবীর সবকিছুতে অলিপ্ত থাকেন।

৩০.তিনি বীর, শ্বেতপদ্মের পাতার মতো মনোজ্ঞ, কান্ত চক্ষুর অধিকারী ও পদ্মগ্ধী। তাই তিনি পদুমুত্তর।

৩১.তিনি ত্রিলোকশ্রেষ্ঠ, চক্ষুহীন অন্ধ সত্ত্বগণের চক্ষুসদৃশ, শান্তস্বভাবী, অনন্ত গুনের আধার ও করুণার সাগর।

৩২.সেই মহাবীর পদুমুত্তর বুদ্ধ ব্রহ্মা, অসুর ও দেবতাদের দ্বারা পূজিত। সদেব মনুষ্যাকীণ হয়ে জনমধ্যে তিনিই জিনুত্তম।

৩৩.তিনি সুগন্ধযুক্ত বদনে ও কোকিলের মতো মধুর কন্ঠে সকল পরিষদকে আনন্দ দান করেন। একদিন তিনি তাঁর এক ভিক্ষুকে এই বলে প্রশংসা করছিলেন :

৩৪.আমার শাসনে এই বক্কলি ভিক্ষুর মতো অন্য একজনও নেই, যিনি শ্রদ্ধাশীল, সুমতিপরায়ণ ও নিয়ত আমার দর্শনকামী।

৩৫.তখন আমি হংসবতী নগরে এক ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মেছিলাম। পদুমুত্তর ভগবানের মুখে সেই কথা শুনে আমিও মনে মনে তার মতো হবার ইচ্ছা পোষন করেছিলাম।

৩৬.তখন আমি সেই বিমল তথাগতকে সশিষ্যে নিমন্ত্রণ করে সাতদিন পযর্ন্ত ভোজন করিয়ে তাঁদের সকলকে একটি করে বস্ত্র দান করেছিলাম।

৩৭.আমি অনন্ত গুণের সাগর বুদ্ধকে নতশিরে বন্দনা নিবেদন করে প্রীতিপূর্ণ মন নিয়ে এই কথা নিবেদন করেছিলাম:

৩৮.ভন্তে ভগবান, আপনি যেই ভিক্ষুকে শ্রদ্ধাশীল ভিক্ষুদের মধ্যে বলে প্রশংসা করেছেন; আমিও তাঁর মতো হতে চাই।

৩৯.এভাবে প্রার্থনা জানালে অনাবরণদর্শন মহামুনি, মহাবীর বুদ্ধ পরিষদের মধ্যে এই কথা বলেছিলেন :

৪০.দেখো মসৃণ সুবর্ণবস্ত্র পরিহিত, গায়ে সুবর্ণ কোমর বন্ধ পরিহিত ও জনগণের মনোহরণকারী এই মানবকে দেখো।

৪১.এই ব্যাক্তিই ভবিষ্যতে মহর্ষি গৌতম ভগবানের শাসনে শ্রদ্ধশীল শ্রাবকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠস্থান লাভ করবে।

৪২.সে দেবলোকে অথবা মনুষ্যলোকে সর্বসন্তাপ বর্জিত হয়ে ও সকল প্রকার ভোগসম্পত্তির অধিকারী হয়ে সুখে জন্মসঞ্চরণ করবে।

৪৩.আজ থেকে লক্ষ কল্প পরে ওক্কাকুকুলে গৌতম নামক শাস্তা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করবেন।

৪৪.সে তাঁর শাসনে ধর্মৌরসজাত উত্তরাধিকারী হয়ে বক্কলি নামে শাস্তাশ্রাবক হবে।

৪৫.সেই কর্মের ফলে ও প্রার্থনা অনুসারে আমি মনুষ্যদেহ ত্যাগ করে তাবতিংস স্বর্গে জন্মেছিলাম।

৪৬.সর্বত্রই সুখী হয়ে ভবভবান্তরে জন্মপরিভ্রমণ করতে করতে আমিশ্রাবস্তীর এক জনৈক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলাম।

৪৭.আমার হস্তপদ ছিল নবনীত ও অশোক বৃক্ষের পত্রপল্লবের মতো মৃদু ও কোমল। তখন মন্দভাবে উত্থানশায়ী আমাকে এক পিশাচী ও এক যক্ষিনী ভয় দেখাত।

৪৮.ভয়ে আমার মাতাপিতা তখন আমাকে মহর্ষি সম্যকসম্বুদ্ধের পদমূলে শুইয়ে রেখে বললেন, হে নাথ, এই শিশুটিকে আপনার কাছে দান করছি। হে নায়ক, আপনি তাকে আশ্রয় দান করুন।

৪৯.তখন ভীতুদেরপরম আশ্রয় মহামুনি বুদ্ধতাঁর চক্রগঙ্কিত মৃদুকোমল হাত দিয়ে আমাকে গ্রহণ করলেন।

৫০.তখন আমি সর্বপ্রকার বৈরীমুক্ত ভগবানের দ্বারা সুরক্ষিত হয়ে সুখে বেড়ে উঠছিলাম।

৫১.আমি সুগতকে ছাড়া মোটেই থাকতে পারতাম না। ভীষণ উৎকন্ঠিত হতাম। আমি জন্মের মাত্র সাত বৎসর বয়সে অনাগারিক প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছি।

৫২.আমি সর্ববিধ পারমীসমার্ভ পরিপূর্ণ, নীলক্ষিবিশিষ্ট, শ্রেষ্ঠ রূপলাবন্যময়, সর্ববিধ শুভাকীর্ণ বুদ্ধকে অতৃপ্ত নয়নে দেখে দেখে বসবাস করতাম।

৫৩.বুদ্ধের রপলাবন্যের প্রতি আমার গভীর রতির কথ াঅবগত হয়ে তিনি তখন আমাকে এই বলে উপদেশ দিলেন: ‘যষ্টে হয়েছে, বক্কলি, মূর্খ জননন্দিত এই ূপের প্রতি রমিত হয়ে তোমার লাভ কী?’

৫৪.যে সদ্ধর্মকে দেখে সে আমাকে দেখে, সে পণ্ডিত। আর যে সদ্ধর্মকে দেখে না সে আমাকে দেখেও দেখে না।

৫৫.এই দেহের উপদ্রবের কোনো শেষ নেই। এই দেহ বিষবৃক্ষতুল্য, সকল প্রকার রোগের আবাসভূমি ও কেবল দুঃখের পুঞ্জ।

৫৬.তাই রূপের প্রতি বিরাগী হও। পঞ্চস্কন্ধের উদয়-ব্যয় দেখ। উপক্লেশগুলোকে চেয়ে দেখ। তবেই সুখে অবস্থান করতে পারবে।

৫৭.এভাবে পরম হিতৈষী লোকনায়ক বুদ্ধকতৃর্ক অনুশাসিত হয়ে আমি গৃধ্রকূট পর্বতের উঠে এক গিরিকন্দরে ধ্যানে রত হয়েছি।

৫৮. আমি যখন পর্বতের পাদদেশে অবস্থান করছি, তখন মহামুনি আমাকে আশ্বস্ত করলেন। তিনি ‘বক্কলি’ বলে আমাকে ডাক দিলেন। তাঁর সেই ডাক শুনে আমি ভীষণ রকম খুশি হয়েছিলাম।

৫৯.আমি বহুশত পুরুষপরিবেষ্টিত শৈলপ্রপাতের দিকে ধাবিত হয়েছিলাম। কিন্তু তখন আমি বুদ্ধের প্রভাবে সুখে ভূমিতে প্রতিষ্ঠিত ছিলাম।

৬০.পুনরায় তিনি আমাকে পঞ্চস্কন্ধের উদয়-ব্যয় ধর্ম দেশনা করেছিলাম। আমি সেই উদয়-ব্যয় ধর্মজ্ঞাত হয়ে অর্হত্ত্ব লাভ করেছিলাম।

৬১.একদিন বিশাল পরিষদের মধ্যে মহামতি বুদ্ধ আমাকে শ্রদ্ধাশীল ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

৬২.আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে আমি যেই কর্ম করেছিলাম, সেই থেকে একবারও আমাকে অপায় দুর্গতিতে পড়তে হয়নি। ইহা আমার বুদ্ধপূজারইফল।

৬৩.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

৬৪.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

৬৫.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মানবক্কলি স্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন। [বক্কলি স্থবির অপদান দ্বিতীয় সমাপ্ত]

৩. মহাকপ্পিন স্থবির অপদান

এই স্থবিরও অতীত বুদ্ধগণের নিকট বিবিধ পুণ্যকর্ম করে জন্মজন্মান্তরে সুখদপুণ্যসঞ্চয় করতে করতে পদুমুত্তরভগবানের সময় হংসবতী নগরে এককুলিন পরিবারেজন্মগ্রহণ করেন। প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার পর একদিন তিনি ভগবানের ধর্ম কথা শুনছিলেন, এমন সময় শাস্তা একজন ভিক্ষুকে উপদেশনাকারী ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠস্থানে প্রতিষ্ঠিত করলেন। তা দেখে তিনিও সেই শ্রেষ্ঠপদ লাভের প্রাথর্না করলেন।

তারপর তিনি আজীবন পুণ্যকর্ম করে দেবমনুষ্য লোকে বহুজন্মপরিভ্রমণ করতে করতে বারাণসীর অদূরে এক কারিগর গ্রামে প্রধান কারিগরের পুত্র হয়ে জন্মগ্রহণকরলেন। তখন একহাজার পচ্চেকবুদ্ধ হিমালয়ে আটমাস অবস্থানের পর বর্ষার চারিমাস জনপদে বসকবাস করতেন। তাঁরা একবার বারাণসীর অদূরে নেমে এসে ‘শয্যাসন তৈরির জন্য কিছু সরঞ্জান খোঁজ কর’ বলে রাজার কাছে আটজ পচ্চেকবুদ্ধকে পাঠালেন। কিন্তু তখন রাজার হলকর্ষন উৎসব চলছিল। তারপরও ‘পচ্চেকবুদ্ধগণ এসেছেন, শুনে উৎসব থেকে বেরিয়ে এসে রাজা কারণ জিজ্ঞেস করলেন। এদিকে পচ্চেকবুদ্ধগন অন্য কোনো গ্রামে প্রবেশের উদ্দেশে চলে গেলেন।

ঠিক সেই সময় প্রধান কারিগরের স্ত্রী কোনো এক কার্যোপলক্ষে বারাণসীতে যাচ্ছিলেন। যাবার সময় সেই পচ্চেক বুদ্ধগণকে দেখে বন্দনা করে জিজ্ঞেস করলেন, ভন্তে, এই অবেলায় কোথা থেকে আসছেন? তারা সবকিছু খুরে বললেন। সেই স্ত্রী ভীষণ শ্রদ্ধাবতী ও বুদ্ধিমতি। তাঁদের কথা শোনার পর সে তাদের সবাইকে নিমন্ত্রণ করল এই বলে: ‘ভন্তে, আগামীকাল অমাদের এখানে ভিক্ষা গ্রহণ করুর।’ ‘বো, আমনা তো অনেক।’ ‘ভন্তে, আপনারা কতজন?’ ‘বোন আমরা এক হাজার জন।’ ‘ভন্তে, আমাদের গ্রাম অনেক বড়। হাজারো মানুষের বাস। তারা একেক জন একেক জনকে ভিক্ষা দেবে। কোনো অসুবিধ নেই। আমরাই আপনাদের জন্য বাসস্থান তৈরি করে দেব।’ সেই স্ত্রীলোকটি গ্রামে গিয়ে সকলের উদ্দেশে ঘোষনা দিল যে, ‘মাবোনেরা, আমি এক হাজার পচ্চেকবুদ্ধকে দেখে নিমন্ত্রণ করেছি। তাঁদের জন্যে বসার

আসনের ব্যস্থা করুণ। যাগু-ভাত প্রভৃতিখাদ্য-ভোজ্য তৈরি করুন।’ তারপর সবাই গ্রামের মধ্যে মণ্ডপতৈরি করাল। বসার আসন তৈরি করাল। পরদিন তারা পচ্চেকবুদ্ধগণ েআসনে বসিয়ে উত্তম বুদ্ধগণকে বন্দনা করেবর্ষার অবস্থানের জন্যে নিমন্ত্রণ করল। পুনরায় তারা গ্রামবাসীদের সবকিছু ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানাল। তারপর তারা সবকিছু ব্যবস্থা করে দিলে পচ্চেকবুদ্ধগণ সেখানে সুখে বর্ষাবাস কাটালেন। বর্ষাশেষে পচ্চেক বুদ্ধগণ অনুমোদন করে চলে গেলেন। সেই গ্রামবাসীরাও এই পুণ্যের ফলে মৃত্যুর পর তাবতিংস দেবলোকে জন্মগ্রহণ করল। সেখানে তাদের নাম হলো ‘গণ দেবতা’।

তারা সেখানে প্রভূত দিব্যসম্পত্তি ভোগ করে কাশ্যপ সম্যকম্বুদ্ধের সময় একটুম্বিকের ঘরে জন্ম নিল। পূর্বে যে প্রধান কারিগর ছিল সে প্রধান কুটুম্বিকের পুত্র হয়ে জন।্ম নিলতার স্ত্রী ও প্রধান কুটুম্বিকের কন্যা হয়ে জননিল।্ম বাকি স্ত্রীলোকেরা অন্যান্য কুটুম্বিকের কন্যা হয়ে জন্ম নিল। তারা সবাই প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর পতিগৃহে গেল।

একদিন তাদের স্বামীরা বিহারে গিয়ে শুনতে পেল যে, শাস্তা ধর্মদেশনা করবেন। তাই তারা সবাই নিজ নিজ স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে ধর্ম শ্রবণের উদ্দেশ্যে বিহারে গেল। তারা বিহারের মাঝখানে পৌঁছামাত্রই প্রবল বর্ষণ শুরুহলো। যাদের কুলুপক বা জ্ঞাতি-শ্রামণের আছে তারা তাদের পরিবেণে ঢুকে পড়ল। কিন্তু তাদের সেরকম কোনো কুলুপক বা জ্ঞাতি-শ্রামণের না থাকায় তারা সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকল।

তারপর প্রধান কুটুম্বিক অন্য কুটুম্বিকদের ,বলল‘বন্ধুরা, দেখেছ, আমাদের এমন বিপদ দেখেও কুলপুত্ররা এতটুকু লজ্জ্বাবোধ করেনি!’ ,‘আর্যএখন আমরা কী করব?’ ‘আমাদের আস্থাভাজন কেউ না থাকায় আমরা এমন বিপদে পড়েছি। চলো, আমরা সবাই মিলে একটি বিশাল পরিবেণ তৈরি করব।’ ‘আর্য, ভালো’ বলে একজন কুটুম্বিক স্রহটাকা দিল। বাকিরা পাঁচশ টাকা করে দিল। তাদের স্ত্রীরা আড়াই শ টাকা করে দিল। তারা সেই টাকাগুলো দিয়ে শাস্তার বসবাসের জন্যে একটি বিশাল পরিবেণ তৈরি করল। তারপর তারা বুদ্ধপ্রমুখ ভিক্ষসংঘকে সপ্তাহকাল মহাদান দিল। বিশহাজার ভিক্ষুকে চীবর দান করল। এদিকে প্রধান কুটুম্বিকের স্থী ছিল অসম্বব প্রজ্ঞাবতী। সে ভাবল, আমি আরও বেশি করে শাস্তাকে পূজা করব। তারপর সে অনোজপুষ্পবর্ণের সহস্রটাকা মূল্যমানের একটি বস্ত্রও অনোজপুষ্প নিয়ে শাস্তাকে পূজা করল এবং বস্ত্রটি শাস্তার পদমূলে রেখে ‘ভন্তে, জন্মে জন্মে আমার শরীর অনোজপুষ্পবর্ণের মতো হোক!

বলে প্রার্থনা করল। শাস্তা ‘তা-ই হোক!’ বলে তার প্রার্থনা অনুমোদন করলেন। তারা সবাই যথা-আয়ুষ্কাল জীবিতথেকে মৃত্যুর পর দেবলোকে জন্মগ্রহণ করল। এই গৌতম বুদ্ধের সময়ে দেবলোক হতে চ্যুত হয়ে প্রধান কুটম্বিক কুক্কটবতী নগরে রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করল। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর সে মহাকপ্পিন রাজা নামে পরিচিতি হলো। বাকি সকলে রাজ-অমাত্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করল। প্রধান কুটুম্বিকের স্ত্রী মদ্দরাষ্ট্রেসারুল নগরে রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করল। তখন তার শরীর পূর্বপ্রার্থনা অনুযায়ী অনোজপুষ্পবর্ণের হলো। তাই তার নাম রাখা হলো অনোজা। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ারার পর মহাকপ্পিনরাজার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে সে ‘অনোজাদেবী’ নামেই সবিশেষ পরিচিত হলো।

বাকি স্ত্রীলোকেরাও অমাত্যকুলে জন্ম নিল এবং প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর অন্য অমাত্য কুলের পুত্রদের বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলো। তারা সকলে রাজ সম্পত্তির ন্যায় সম্পত্তির ভোগ করল। রাজা যখন অলংকার-প্রতিমণ্ডিত হয়ে হাতির পিঠে আরোহণ করে বিচরণ করতেন তখন তারা ও তার সহচর হতো। অনুরূপভাবে ঘোড়া অথবা রথে চড়ে বিচরণকালেও তারা সহচর হতো। এভাবে তারা একত্রে কৃতপুন্যের ফল একসাথেভোগ করল। কিন্তু তখন রাজার বালো, বালবাহনো, পুপএফোফ, পুস্পবাহন ও সুপত্তো নামেপাঁচটি ঘোড়া ছিল। রাজা নিজে সুপত্তে নামক ঘোড়ায় আরোহন করে সংবাদ আনা-নেওয়ার কাজ করত। একদিন রাজা তাদের খুব ভোরে ভোজন করিয়ে এই বলে পাঠিয়ে দিলেন: ‘বৎসগণ, যাও, চারদিকে তিন বা চার যোজন জায়গা ঘুরেবুদ্ধ, ধর্ম বা সংঘ উৎপন্ন হয়েছেন কিনা জেনে এসে আমাকে এই সুখবরটি জানাও।”তারা চারজনে চারটি দ্বার দিয়ে বের হয়ে দু-তিন যোজন জায়গা ঘুরে কোনো খবর না পেয়ে ফিরে আসল। একদিন রাজা সুপেত্তো ঘোড়ায় আরোহণ করে হাজারো অমাত্য পরিবৃত হয়ে উদ্যানে যাচ্ছিলেন। এমন সময় তিনি ক্লান্ত-শ্রান্ত পাঁচশ বণিককে নগরে প্রবেশ করতে দেখতে পেলেন। তারপর ‘এদের কাছ থেকেই একটি সুসংবাদ পাব’ এই ভেবে তিনি তাদের কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা কোথা থেকে আসছেন?’ ‘প্রভু, এখান থেকে বিশ শত যোজন দূরে শ্রাবস্তী নামক একটি নগর আছে। আমরা সেখান থেকে আসতেছি।’ ‘‘আপনাদের দেশের কোনো সুসংবাদ আছে কি?’ ‘প্রভু, তেমন কোনো সুসংবাদ তো নেই। তবে সম্যকসম্বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছেন।’ তৎক্ষণাৎ রাজার শরীর দিয়ে বলবতী স্ফুরণা প্রীতির সুবাস বয়ে গেল। হঠাৎ এমন কথা শুনায় তিনি ঘোরের মধ্যে পড়ে গেলেন। কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলেন ।নাকিছুক্ষণপর আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘বৎস, কী বলেছেন?’ ‘প্রভু, বুদ্ধ উৎপন্নহয়েছেন।’ রাজা তাদের উত্তরে ভীষণভাবে প্রীত হয়ে তাদের বললেন, ‘বৎসগণ, এমন একটি সুসংবাদ আমাকে দেওয়ার জন্যে আমি আপনাদের লক্ষ টাকা পুরষ্কার দেব।’ তারপর আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘বৎসগণ, অন্য কোনো সুসংবাদআছে কি?’ ‘প্রভু, আছে। ধর্ম উৎপন্ন হয়েছে।’ রাজা তা শুনে আগের মতো একবার, দুবার করে চতুর্ বার জিজ্ঞেস করলে তারা উত্তর করল, ‘প্রভু, ধর্ম উৎপন্ন হয়েছে।’ রাজা আগের মতো অত্যন্ত প্রীত হয়ে তাদের বলল, ‘আমি আপনাদের আরও এক লক্ষ টাকা পুরস্কার দেব।’ তারপর আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘বৎসগণ, আরও অন্য কোনো সুসংবাদ আছে কি?’ ‘প্রভু, আছে। সংঘ উৎপন্ন হয়েছে।’ রাজা তা শুনে আগের মতো একবার, দুবার করে চতুর্থবার জিজ্ঞেস করলে তারা উত্তর করল, ‘প্রভু, সংঘ উৎপন্ন হয়েছে।’ রাজা আগের মতো অত্যন্ত প্রীত হয়ে বলল, ‘আমি আপনাদের আরও একলক্ষ টাকা পুরস্কার দেব।’ তারপর রাজা আস্তে করে সহসর অমাত্যদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘বৎসগণ, এখন আমরা কী করব?’ ‘প্রভু, আপনি কী করতে চান ?’ ‘বৎসগণ, ‘বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছেন, ধর্ম উৎপন্ন হয়েছে, সংঘ উৎপন্ন হয়েছে’ শুনে আমার তো আর ঘরে ফিরে যাবার কোনো ইচ্ছা নেই। আমি এখন ভগবানের উদ্দেশে যাত্রা করব। আমি তাঁর কাছে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করব।’ ‘প্রভু, আমরাও আপনার সাথে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করব।’ রাজা তখন সোনার পাতে লিখে বণিকদের মাধ্যমে এই বার্র্তা পাঠালেন, ‘এই বার্তাটি অনোজা দেবীকে দেবেন। তিনি আপনাদের তিন লাখ টাকা দেবেন। আপনারা তাকে আমার হয়ে এই কথা বলে দেবেন, ‘রাজার সমস্ত বিষয় সম্পত্তি আপনি যথাসুখে পরিভোগ করুন!’ যদি জিজ্ঞেস করে ‘রাজা শাস্তার উদ্দেশে প্রব্রজ্জিত হওয়ার জন্যে চলে গিয়েছেন। অমাত্যগন ও নিজ নিজ স্ত্রীদের উদ্দেশে সেভাবে সংবাদ পাঠালেন। তারপর রাজা আর দেরি না করে বণিকদের বিদায় জানিয়ে ঘোড়ায় আরোহণ করে হাজারো অমাত্য পরিবেষ্টিত হয়ে বেরিয়ে পড়লেন।

এদিকে শাস্তাও সেদিন খুব ভোরে পৃথিবী অবলোকন করতে গিয়ে সপরিষদ মহাকপ্পিন রাজাকে দেখে ভাবলেন, এই মহাকপ্পিন রাজা বণিকদের কাছ থেকে ত্রিরত্নের কথা শুনে রাজ্য ত্যাগ করে হাজারো অমাত্য পরিবৃত হয়ে আমার উদ্দেশে প্রব্রজ্যা গ্রহণে ইচ্ছুক।

সপরিষদে সে প্রতিসম্ভিদাসহ অর্হত্ত্ব লাভ করবে। আমি নিজের অভ্যথর্না জানাব।’ পরদিন ভগবান নিজে পাত্রচীবর নিয়ে চন্দ্রভাগা নদীর তীরে এক নিগ্রোধ বৃক্ষমূলে ষড়বর্ণ বুদ্ধরশ্মি বির্কীণ করে উপবেশন করলেন। এদিকে রাজাও আসার সময় সামনে একটি নদী দেখে ‘এই নদীর নাম অপরচ্ছা নদী।’ ‘বৎসগণ, এই নদী কত বড় ?’ ‘প্রভু, এই নদীর গভীরতা প্রায় দুই মাইলের কাছাকাছি। আর এই নদীর দৈর্ঘ্য প্রায় চার মাইলের কাছাকাছি।’ ‘এখানে পার হবার জন্যে ভেলা আছে কি?’ ‘প্রভু, তেমন তো কিছুই দেখা যাচ্ছে না।’ ‘নৌকা, ভেলা প্রভৃতির খোঁজ করতে গিয়ে তো আমরা বুড়া হয়ে যাব, মরে যাব। আমি নির্দ্বিধায় ত্রিরত্নে উদ্দেশে বের হয়েছি। ত্রিরত্নের প্রভাবেই ‘এই জল জলের মতো না হোক!’ এই অধিষ্ঠান করে বারবার ‘ইতিপিসো ভগবা...’ বলে বুদ্ধগুণ স্মরণ করতে লাগলেন। তারপর সপরিবারে জলের উপর পা বাড়ালেন। আশ্চর্য হলেও সত্য যে, তারা সবাই সিন্ধু দেশীয় অশ্বপৃষ্ঠে রোহণেরআ ন্যায় সেই নদী পার হলেন।

তারপর কিছুদূর অগ্রসর হয়ে আরও একটি নদী সামনে পড়ল। তখন সহচরদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই নদীর নাম কী?’ ‘প্রভু, এই নদীর নাম নীলবাহা।’ ‘এই নদী কত বড়?’ ‘প্রভু, এই নদীর গভীরতা অর্ধযোজন, আর বিস্তৃতিও অর্ধযোজন।’ ঠিক আগের মতো করে তিনি এই নদীটিও ধর্মের গুণ স্মরণ করে পার হলেন।

তারপর কিছুদূর অগ্রসর হয়ে আরও একটি নদী সামনে পড়ল। তখনও তিনি সহচরদের জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই নদীর নাম কী?’ ‘প্রভু, এই নদীর নাম চন্দ্রভাগা।’ ‘এই নদী কত বড়?’ ‘প্রভু, এই নদীর গভীরতা ও বিস্তৃতি এক যোজন।’ এখানেও ঠিক আগের মতো করে তিনি এই নদীটি সংঘের গুণ স্মরণ করে পার হলেন।

সেই নদীটি পার হওয়ার পর সামনের দিকে আগ্রসর হচ্ছিলেন। এমন সময় শাস্তার শরীর হতে নির্গত ষড়বর্ণ বুদ্ধরশ্মির দ্বারা নিগ্রোধ বৃক্ষের পত্র-পল্লব জ্বল জ্বল করছিল। তা দেখে তিনি চিন্তা করলেন, এই জ্যোতি কোনো চন্দ্র, সূর্য অথবা দেব-মানব-ব্রহ্মা-সুপর্ণ নাগের হতে পারেনা। এই জ্যোতি নিশ্চয় শাস্তার। শাস্তা সম্যকসম্বুদ্ধ নিশ্চয় আমাকে দেখতে পেয়েছেন। তারপর তিনি অশ্বপৃষ্ঠ হতে নেমে শাস্তার কাছে গেলেন। তিনি শাস্তাকে বন্দনা করে একপাশ্বে বসলেন। সাথে অমাত্যরাও বসলেন। তখন শাস্তা তাদের আনুপূর্বিক কথা বললেন। দেশনা শেষ হওয়ার সাথে সপরিষদ রাজা স্রোতাপত্তিফলে প্রতিষ্ঠিত হলেন।

তারপর সবাই মিলে প্রব্রজ্যা প্রাথর্না করলেন। তখন শাস্তা তাদের ঋদ্ধিময় পাত্রচীবর লাভের হেতু আছে কি না জানতে গিয়ে দেখতে পেলেন, এই কুলপুত্ররা হাজারো পচ্চেক বুদ্ধকে হাজারো চীবর দান করেছিল। কাশ্যপ বুদ্ধের সময় বিশ হাজার ভিক্ষুকে বিশ হাজারীবরচ দান করেছিল। এই কুলপুত্রদের ঋদ্ধিময় পাত্রচীবর লাভের হেতু প্রবল। তারপর শাস্তা ডানহাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘এসো ভিক্ষগণ, দুঃখের অন্তসাধন করার জন্যে ব্রহ্মচর্য আচরণ করো।’ তৎক্ষণাৎ তারা অষ্টপরিষ্কার ধারী হয়ে ষাষ্টবর্ষীয় স্থবিরের ন্যায় আকাশে উত্থিত হয়ে শাস্তাকে বন্দনা নিবেদন করে একপার্শ্বে বসলেন।

এদিকে সেই বনিকেরা রাজার ঘরে গিয়ে অনোজা দেবীকে রাজার পাঠানো র্বাতাসহ সমস্ত ঘটনা সবিস্তারে শোনাল। দেবীও রাজার ন্যায় বুদ্ধ, ধর্ম ও সংঘের কথা শুনে পরম প্রীতিতে উদ্বেলিত হলো। তারপর দেবী তাদের সমস্ত রাজ্যধন দিয়ে দেওয়ার কথা ব্যক্ত করলে তারাও দেবীর সাথে প্রব্রজ্যা গ্রহণের ইচ্ছা পোষণ করল। তারাও ঠিক রাজার মতো করে প্রথমে অপরচ্ছানদী, তারপর নীলবাহা নদী এবং সর্বশেষে চন্দ্রভাগা নদী পার হলো।

এদিকে শাস্তা তাদের আসার কথ া জেনে তারা যাতে তাদের স্বামী ভিক্ষুদের দেখতে না পায় সেভাবে অধিষ্ঠান করলেন। তারাও ষড়বর্ণ বুদ্ধরশ্মিতে আলোকোজ্জ্বল শাস্তাকে দেখে প্রথমে বন্দনা করল। তারপর পকপার্শ্বে দাঁড়িয়ে দেবী শাস্তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘ভন্তে, মহাকপ্পিন রাজা আপনার উদ্দেশেই গৃহত্যাগ করেছেন, তিনি কোথায়? আমাকে দেখান।’ শাস্তা বললেন, ‘বসো, এখানেই তোমরা তাকে দেখতে পাবে।’ শাস্তার কথার তারা সবাই খুশী হয়ে বসে পড়ল। শাস্তা তাদের অনোজাদেবীসহ তারা সবাই স্রোতাপত্তি ফল লাভ করল। আর মহাকপ্পিন স্থবির তাদের উদ্দেশে দেওয়া ধর্মদেশনা শুনে সপরিষদ প্রতিসম্ভিদাসহ অর্হত্ত্ব লাভ করলেন। ঠিক সেই মুহুর্তে শাস্তা তাদের স্বামী ভিক্ষুদের দেখালেন। তারা আসার সাথে সাথেই যদি শাস্তা তাদের স্বামি ভিক্ষুদের দেখাতেন, তাহলে তাদের চিত্তের একাগ্রতা আসত না, তারা মার্গফল ও লাভ করতে পারত না। তাই তারা যখন মার্গফলে প্রতিষ্ঠিত হলো এবং স্বামী ভিক্ষুদের দেখালেন।

তারা তাদের স্বামী ভিক্ষুদের দেখে বন্দনা করে বললেন, ‘ভন্তে, আপনারা প্রব্রজিতের করণীয় কার্য শেষ করেছেন।’ তারপর তারা শাস্তাকে বন্দনা করে একপার্শ্বে দাঁড়িয়ে প্রব্রজ্যা প্রার্থনা করল।

এভাবে প্রব্রজ্যা প্রাথর্না করলে পরে শাস্তা উৎপলবর্ণা থেরীর আগমন চিন্তা করলেন। তৎক্ষণাৎ উৎপলবর্ণ থেরী আকাশ পথে এসে তাদের সবাইকে নিয়ে আকাশ পথে ভিক্ষুণী আবাসে নিয়ে গিয়ে প্রব্রজ্যা দিলেন। তারা সবাই অচিরেই অর্হত্ত্ব লাভ করল। শাস্তা এক হাজার ভিক্ষুকে সঙ্গে নিয়ে আকাশ পথে জেতবনে আসলেন। এদিকে আয়ুষ্মান মহাকপ্পিন প্রায়শ ‘অহো সুখ! অহো সুখ!’ প্রীতিপূর্ণ উদান গাথা বলতেন। ভগবান তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে কপ্পিন, সত্যিই কি তুমি কামসুখের জন্যে এই প্রীতিপূর্ণ উদান গাথা বলছ?’ তখন মহাকপ্পিন স্থবির বললেন, ‘ভন্তে, ভগবানই ভালো করে জানেন যে, আমি কামসুখের জন্যেই নাকি অন্য কিছুর জন্যে এই প্রীতিপূর্ণ উদানগাথা বলছি।’ তারপর শাস্তা বললেন, হে ভিক্ষুগণ, ‘আমার পুত্র কামসুখ বা রাজ্যসুখের জন্যে এইপ্রীতিপূর্ণ উদানগাথা বলছে না। আমার পুত্রের ধর্মচরণকালে ধর্মপ্রীতি উৎপন্ন হয়। সে অমৃত মহানির্ব ণকে ভিত্তি করেই এভাবে প্রীতিপূর্ণ উদানগাথা বলছে।’ অতঃপর শাস্তা এই ঘটনা প্রসঙ্গে ধর্ম দেশনা করতে গিয়ে এই গাথাটি বলেছেন:

“ধর্মপারী সুখে থাকে হয়ে বিপ্রসন্ন চিত, আর্যপ্রদর্শিত ধর্মে পণ্ডিত নিয়ত প্রীত।”

অতঃপর একদিন শাস্তা ভিক্ষুদের ধর্মদেশনা করে কি?’ ‘ভন্তে, তিনি প্রায় সময় নিজে দৃষ্টধর্মসুখবিহারে নিয়োজিত থাকেন। উপদেশ প্রায় দেন না বললেই চলে।’ তারপর শাস্তা কপ্পিনকে ডেকে বললেন, ‘হে কপ্পি, সত্যিই কি তুমি অন্তেবাসী ভিক্ষুদের কোনো উপদেশ দাও না?’ ‘হ্যাঁভন্তে, সত্য।’ ‘ব্রাহ্মণ, তুমি এমন কাজ করিও না। আজ থেকে তুমি ভিক্ষুদের ধর্মদেশনা করবে।’ ‘হ্যাঁভন্তে,’ বলে স্থবির ভগবানের কথায় সম্মত হলেন। তারপর একবার উপদেশ দিয়েই তিনি হাজারো শ্রমণকে অর্হত্ত্বে প্রতিষ্ঠিত করলেন। সেকারণেই শাস্তা তাকে এই বলে শ্রেষ্ঠপদে অধিষ্ঠিত করলেন, ‘হে ভিক্ষুুগণ, আমার ভিক্ষুদের উপদেশদানকারী শিষ্যদের মধ্যে মহাকপ্পিনই শ্রেষ্ঠ।’

এভাবে স্থবির অর্হত্ত্ব লাভের পর নিজের পূর্বকৃত কর্ম স্মরণকরে আনন্দিত মনে নিজের পূর্বজীবনের কাহিনি প্রকাম করতে গিয়ে ‘পদুমুত্তর জিন’ প্রভৃতি গাথা বলেছিলেন।

৬৬.সর্বধমে বিশেষ পারদর্শী পদুমুত্তর জিন শরতের আকাশে উদিত সূর্যের ন্যয় জগতের আকাশে উদিত হয়েছিলেন।

৬৭.সেই পদুমুত্ত জিন স্বীয় মধুর বাক্যের দ্বারা মানুষের বোধ উৎপন্ন করেছিলেন এবং জ্ঞানরশ্মির দ্বারা ক্লেশপঙ্ক শুষ্ক করেছিলেন।

৬৮.সূর্যের উদরে যেমন জোনাকি পোকার আলো নিষ্প্রভ হয়ে যায়, তেমনি পদুমুত্তর জিনের উৎপত্তিতে তীর্ িয়দের যশ হ্রাস পায়। তিনি আলোকোজ্জ্বল দিবাকরের মতো চতুরার্যসত্যের আভা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন।

৬৯.তিনি ছিলেন অনন্ত গুনের আধার ও অসংখ্য রত্নের সাগর। তিনি বর্ষণমুখর মহামেঘের ন্যায় ধর্মঘের দ্বারা অমৃতবারি বর্ষণ করছিলেন।

৭০.তখন আমি হংসবতী নগরে একজন প্রখ্যাত অক্ষদর্শী নামক আচার্য ছিলাম। একদিন আমি পদুমুত্তর ভগবানের কাছে গিয়ে ধর্মদেশনা শুনেছিলাম।

৭১.তখন তিনি আমার সামনে ভিক্ষুদের উপদেশ দানে অভিজ্ঞ এমন একজন ভিক্ষুর ভূয়শী প্রশংসা করলে পরে আমার মন খুশীতে ভরে উঠেছিল।

৭২.তা শুনে আমি ভীষণভাবে প্রীত ও খুশী হয়েছিলাম। তারপর আমি সশিষ্য তথাগতকে নিমন্ত্রণ করে ভোজন করিয়েছিলাম এবং সেই শ্রেষ্ঠপদ প্রার্থনা করেছিলাম।

৭৩-৭৪. তখন পদুমুত্তর ভগবান রাজহংস সদৃশ ভিক্ষুগণকে আহ্বান করে বলেছিলেন, হে ভিক্ষুগণ, দেখো, এই অভিজ্ঞ বিচারক মহাসত্যকে দেখো, যে ঊধ্বলোমধারী, মুক্তফলের ন্যায় প্রভাময় সুন্দর শরীরের অধিকারী ও পরিপূর্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গধারী হয়ে প্রসন্নমুখে আমার পদমূলে পতিত হয়েছে।

৭৫.মহতী পরিষদপরিবৃত, রাজযুক্ত, মহাযশস্বী এই ব্যক্তি পরম খুশীমনে হৃষ্ট-প্রহৃষ্ট হয়ে এই শ্রেষ্ঠপদ লাভের প্রার্থনা করেছে।

৭৬.এই প্রণিপাত, ত্যাগ ও প্রার্থনার দ্বারা সে লক্ষকল্প অপায় দুর্গতিতে জন্মগ্রহণ করবে না।

৭৭.দেবকুলে দেবসৌভাগ্য আর মনুষ্যকুলে মনুষ্যসৌভাগ্য ভোগ করে পরিশেষে সে পরম কাঙ্খিত নির্বাণ লাভ করবে।

৭৮.আজ থেকে লক্ষ কল্প পরে ওক্কাকুকুলে গৌতম নামক শাস্তা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করবেন।

৭৯.তাঁর ধর্মে ধর্মৌরসজাত ধর্মদায়াদ, ধর্মপুত্র কপ্পি নামক শাস্তাশ্রাবক হবে।

তারপর মহাকপ্পি স্থবির স্বগত উচ্চারণ করে নিজের সম্বন্ধে বলেছিলেন: ৮০. সেই থেকে আমি জিনশাসনে বহুপুণ্যকর্ম করে মনুষ্যদেহ ত্যাগ করে তুষিত স্বর্গে জন্মগ্রহণ করেছিলাম।

৮১.আমি শত শতবার দেবমনুষ্যলোকে রাজত্ব করে বারাণসীর সন্নিকটে কেনিয় জাতি েজন্ম নিয়েছিলাম।

৮২.তখন আমি সস্ত্রীক হাজারো আত্মীয় পরিজন পরবৃত হয়েপাঁচশত পচ্চেক বুদ্ধকে সেবা-শুশ্রুষা করেছিলাম।

৮৩.তিন মাস যাবৎ পাঁচশত পচ্চেকবুদ্ধকে ভোজন দান করার পর প্রত্যেককে ত্রিচীবর দান করেছিলাম। তারপর সেখান থেকে চ্যুত হয়ে আমনা সবাই তাবতিংস স্বর্গে জন্ম নিয়েছিলাম।

৮৪.পুনরায় আমরা সবাই মনুষ্যত্ব লাভ করেছিলাম, হিমালয়ের পাশ্ববর্তী কুক্কুট নগরে জন্মগ্রহণ করেছিলাম।

৮৫.আমি কপ্পিন নামে মহাযশস্বী রাজপুত্র হয়ে জন্ম নিয়েছিলাম বাকিরা অমাত্যকুলে জন্মনিয়ে আমাকেই পরিবৃত করেছিল।

৮৬.আমি সকল প্রকার ভোগসম্পত্তি লাভ করে প্রভূত রাজ্যসুখ পেয়েছিলাম। একদিন আমি বণিকদের মুখ থেকে বুদ্ধ-উৎপত্তির কথা শুনেছিলাম।

৮৭.পৃথিবীতে বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছেন। তিনিই অদ্বিতীয় ও একমাত্র ব্যক্তি যিনি অমৃত সুখকর সদ্ধর্ম দেশনা করেন।

৮৮. তাঁর শিষ্যরা বুদ্ধশাসনে সুনিয়োজিত, সুমুক্ত ও অনাসক্ত। আমি তাদের মুখে এই সুবচনশুনে বহু ধন দিয়ে তাদের পুরস্কৃত রেক ছিলাম।

৮৯-৯০. অমাত্য সকলকে সঙ্গে করে আমি রাজ্য ত্যাগ করে বুদ্ধমামক হয়ে গৃহত্যাগ করেছিলাম। সামনে কানাই কানাই পূর্ণ মহাচন্দ নদীকে দেখে আমি দুস্তর পারাপার কোনো আলম্বন ছাড়াই শুধু বুদ্ধগণ স্মরণ করে যতাসুখে সেই নদী পার হয়েছিলাম।

৯১.সত্যই যদি বুদ্ধ ভবস্রোত উত্তীর্ণ হন, লোকবিদ ও জ্ঞানী হয়ে থাকেন, তবে এই সত্যবাক্যের দ্বারা আমার গমন সফল হোক।

৯২.সত্যই যদি শান্তিগামী মার্গ মোক্ষপ্রদায়ক ও পরম সুখদায়ক হয়, তবে এই সত্যবাক্যের দ্বারা আমার গমন সফল হোক।

৯৩.সত্যই যদি সংঘ কান্তারোত্তীর্ণ, অনুত্তরপুণ্যক্ষেত্র হয়ে থাকে, তবে এই সত্যবাক্যের দ্বারা আমার গমন সফল হোক।

৯৪-৯৫. আমার এই সত্যক্রিয়ার ফলে পথ থেকে যেন সমসত জল সরে গিয়েছিল। তাতে

আমি নির্বিঘ্নে নদী পার হয়েছিলাম। তারপর আমি মনোরম নদীতীরে উপবিষ্ট উদীয়মান প্রখর সূর্যের ন্যায় প্রভাংকর বুদ্ধকে দেখতে পেয়েছিলাম। তখন তিনি সুবণ খণ্ডের ন্যায় জ্বল জ্বল করছিলেন এবং দীপবৃক্ষের ন্যায় জ্যোতির্ময় ছিলেন।

৯৬-৯৭. আমি নক্ষত্র-তারকারাজি পরিবেষ্টিত স্নিগ্ধোজ্জ্বল চাঁদের ন্যায় ও দেবপরিবৃত হয়ে বসবাসরত ইন্দ্ররাজার ন্যায় শ্রাবক পরিবেষ্টিত ভগবান বুদ্ধকে বন্দনা করে অমাত্রগণসহ একপার্শ্বে বসেছিলাম। তিনি আমাদের অভিপ্রায় জেনে সেভাবেই ধর্মদেশনা করেছিলেন।

৯৮.আমরা তাঁর বিমল ধর্মদেশনা শুনে আমরা তাঁকে এই কথা নিবেদন করেছিলাম: হে মহাবীর, আমাদের প্রব্রজ্যা প্রদান করুন। আমরা এই ভবের প্রতি নির্বেদপ্রাপ্ত হয়েছি।

৯৯.তখন মহামুনিবুদ্ধ আমাদের লক্ষ করে এই কথা বরেছিলেন: হে ভিক্ষুগণ, তোমাদের দুঃখের অন্তসাধনের জন্যে ধর্ম সুন্দররূপে ব্যাখ্যাত হয়েছে। তোমরা যথাযথভাবে ব্রহ্মচর্য আচরণ কর।

১০০.বুদ্ধ এই কথা বলার সাথে সাথই আমরা সবাই ঋদ্ধিময় পাত্রচীবর পেয়ে ষাটবর্ষীয় ভিক্ষুবেশ ধারণ করেছিলাম। আমরা বুদ্ধের শাসনে যুগপৎ উপসম্পন্ন ওস্রাতাপন্ন েহয়েছিলাম।

১০১.তারপর শ্রাবস্তীর জেতবনে গিয়ে বিনায়ক বুদ্ধ আমাদের অনুশাসন করেছিলেন। অনুশাসিত হয়ে আমরাসবাই অচিরেই অর্হত্ত্ব লাভ করেছিলাম।

১০২.তারপর একদিন আমি হাজারো ভিক্ষুকে অনুশাসন করেছিলাম। আমার দ্বারা অনুশাসিত হয়ে তারাও সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়েছিল।

১০৩.আমার গুনে তুষ্ট হয়ে জিনোত্তম বুদ্ধ আমাকে এই বলে শ্রেষ্ঠপদে বসিয়েছিলেন: ‘আমার ভিক্ষুদের উপদেশদানকারী শিষ্যদের মধ্যে কপ্পিনইশ্রেষ্ঠ।’

১০৪.আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে আমার কৃত কর্ম এই শেষ জন্মেও ফল দিয়েছে। এখন আমি প্রমুক্ত, তীরের গতিতে আমার সমস্ত ক্লেশকে দগ্ধ করেছি।

১০৫.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

১০৬.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

১০৭.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মানমহাকপ্পিন স্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন। [মহাকপ্পিন স্থবির অপদান তৃতীয় সমাপ্ত]

৪. মল্লপুত্র দব্বস্থবির অপদান

এই স্থবিরও অতীত বুদ্ধগণের নিকট বিবিধপুণ্যকর্ম করে জন্মজন্মান্তরে সুখদপুণ্যসঞ্চয় করতে করতে পদুমুত্তর ভগবানের সময়ে হংসবতী নগরে একশ্রেষ্ঠীপুত্র হয়েজন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন প্রভূত বিত্তবৈভবের অধিকারী মহাধনাঢ্য। শাস্তার প্রসন্ন হয়ে একদিন শাস্তার ধর্মদেশনা শুনতে শয্যাসন প্রজ্ঞাপক ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠপদে প্রতিষ্ঠিত করছেন। তারপর তিনি প্রসন্নমনে বুদ্ধ প্রমুখভিক্ষুসংঘকে নিমন্ত্রণ করলেন। সপ্তাহ কাল মহাদান দিলেন। পরিশেষে ভগবানের পদমূলে মাথা ঠেকিয়েসেই শ্রেষ্ঠপদ প্রার্থনা করলেন। ভগবান তার র্প্রাথনা পূর্ণ হবে বলে বললেন।

তারপর তিনি আজীবন কুশলকর্ম করে মৃত্যুর পর তুষিত স্বর্গে জন্মনিলেন। সেখানে প্রভূত দিব্যসম্পত্তি ভোগ করেন এবং আয়ুশেষে চ্যুত হয়েবিপশ্বী ভগবানের সময় এক কুলীন পরিবারে জন্ম নিলেন। তখন তিনি অসৎসংসর্গ করায় বিপশ্বী ভগবানের এক শ্রাবক ভিক্ষুকে ‘অর্হৎ’ বরে জানা সত্ত্বেও মিথ্যা অপবাদ দিয়েছিলেন। অন্যদিকে বিপশ্বী ভগবানেরই অন্য শ্রাবকদের পালাক্রমে দুধ দান দিয়েছিলেন। তিনি আজীবন এভাবে পুণ্যকর্ম করে দেবমনুষ্যলোকে জন্মপরিভ্রমণ করতে করতে উভয় সম্পত্তি ভোগ করেন। পরে তিনি কাশ্যপ বুদ্ধের সময় এক কুলীন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। কাশ্যপ বুদ্ধের শাসনের পরিহীন সময়ে ভগবানের পরিনির্বাণের পর ত্রিরত্নের প্রতি জনগণের অগৌরব, অশ্রদ্ধা চরম আকার ধারণ করলে তিনি সহ সাতজন লোক প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। তারা তাতে ভীষণ রকম হতাশ হয়ে এক প্রত্যন্ত জনপদের গভীর বনে সিড়ি তৈরি করলেন। সিড়ি বেয়ে বিশাল এক পর্বতে আরোহণ করে জীবন দুঃখের অবসান মানসে সিড়িটি ফেলে দিলেন। তাদের মধ্যে উপদেষ্টা জ্যেষ্ঠ স্থবির সপ্তাহ কালের মধ্যে অর্হত্ত্ব লাভ করলেন। তাঁর কনিষ্ঠ স্থবির অনাগামী হলেন। অন্য পাঁচজন ভিক্ষু পরিশুদ্ধ শীল পালনের দরুন মৃত্যুর পর দেবলোকে জন ্মগ্রহণ করলেন। সেখানে এক বুদ্ধান্তর কল্প দিব্যসুখ ভোগ করে এই গৌতমবুদ্ধের সময়ে চারজন যথাক্রমে পুক্কুসাতি, সভিয়, বাহিয় ও কুমার কাশ্যপ নামে জন্মগ্রহণ করেন। কিন্তু এই স্থবির মল্লরাষ্ট্রে অনুপিয় নগরে জন্মগ্রহণ করেন। কর্মের কী নির্মম পরিহাস, তিনি মাতৃগর্ভ থাকাকালেই তার মা মরে গেল। সেই মৃতশীরর দাহ করার সময় আগুনের তেজে পেট ফেটে গেলএবং এই পুণ্যবান শিশুটি এক দব্ব স্তম্ভে গিয়ে পড়ে থাকল। তার পিতমহী তাকে লালন-পালন করল। দব্বে পতিত হয়েছিল বিধায় তার নাম রাখা হলো ‘মলপুত্ত দব্ব’। পরবর্তী সময়ে তিনি পূর্বকৃতপুণ্যবলে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন এবং অচিরেই প্রতিসমিদাসহ্ভ অর্হত্ত্ব লাভ করেন। তিনি মনোযোগ সহকারে ও দরকার হলে ঋদ্ধিযোগে সংঘের সেবা করতে লাগলেন। ইহা দেখে ভগবান তাকে এই বলে শ্রেষ্ঠপদে বসালেন: ‘হে ভিক্ষুগণ, আমার শ্রাবক শয্যাসন প্রজ্ঞাপক ভিক্ষুদের মধ্যে মল্লপুত্র দব্বই শ্রেষ্ঠ।’

স্থবির নিজের পূর্বকৃতকর্ম স্মরণ করে আনন্দিত মনে নিজের পূর্বজীবনের কাহিনিপ্রকাশ করতে গিয়ে ‘পদুমুত্তর জিন’ প্রভৃতি গাথা বলেছিলেন।

১০৮.আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে পৃথিবীতে সর্বলোকবিদ, মুনি, চক্ষুষ্মান পদুমুত্তর জিন উৎপন্ন হয়েছিল।

১০৯.উপদেষ্ট, বিজ্ঞাপক, সকল প্রাণিকে তীর্ণকারী দেশনাকুশল বুদ্ধ বহু জনতাকে সংসারস্রোত তীর্ণ করে দিয়েছিলেন।

১১০.পরম অনুকম্পাকারী, মহাকারুণিক, সকলপ্রাণির হিতৈষী বুদ্ধ যেসবতীর্ িয় তাঁর মুখোমুখী হতো তাদের সবাইকে পঞ্চশীলে প্রতিষ্ঠি করেছিলেন।

১১১.এভাবেই তিনি নিরাকুল ও তীর্থিয়শূন্য হয়ে এবং বশীভূত অর্হৎ পরিবেষ্টিত হয়ে অবস্থান করেছিলেন।

১১২.সেই মহামুনি আটান্নপ্রকার রত্নে গৌরবমণ্ডিত, উজ্জ্বল কাঞ্চনতুল্য ও বত্রিশ মহাপুরুষলক্ষণ বিশিষ্ট।

১১৩.সেই সময় মানুষের গড় আয়ু ছিল লক্ষ বৎসর। তিনি পরিপূর্ণ আয়ু জীবিত থেকে বহুজনতাকে তীর্ণ করেছিলেন।

১১৪.তখন আমি হংসবতী নগরে মহাযশস্বী শ্রেষ্ঠীপুত্র হয়ে জন্মেছিলাম। একদিন লোকপ্রদ্যেৎ বুদ্ধের কাছে গিয়েতাঁর ধর্মদেশনা শুনছিলাম।

১১৫.তখন তিনি ভিক্ষুদের শয্যাসন প্রজ্ঞাপক এক শিষ্যের ভূয়শী প্রশংসা করছিলেন। তা শুনে আমি ভীষণভাবে খুশী হয়েছিলাম।

১১৬.মহর্ষি বুদ্ধওতাঁর শ্রাবক সংঘকে মহাদান দিয়ে আমি তাঁর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে এই শ্রেষ্ঠপদ প্রার্থনা করেছিলাম।

১১৭-১১৮. তখন মহাবীর বুদ্ধ আমার কৃতকর্মের এই বলে ভূয়শী প্রশংসা করেছিলেন: যেই ব্যক্তি লোকনায়ক বুদ্ধপ্রমুখ সংঘকে সপ্তাহকাল ভোজন দান করেছে, সেই কোমল অক্ষিধারী, সিংহের ন্যায় স্বর্ণোজ্জ্বল ত্বকধারী ব্যক্তি আমার পদমূলে নিপতিত হয়ে এই শ্রেষ্ঠপদ প্রার্থনা করেছে।

১১৯.আজ থেকে লক্ষ কল্প পরে ওক্কাকুকুলে গৌতম নামক শাস্তা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করবেন।

১২০.এই ব্যক্তি তখন তাঁর শ্রাবক হবে। সে ‘দব্ব’ নামে বিশ্ববিশ্রুত হবে এবং শ্রেষ্ঠ শয্যাসন প্রজ্ঞাপক হবে।

[অতঃপর মল্লপুত্র দব্বস্থবির স্বগত উচ্চারণ করে নিজের সম্বন্ধে বলেছিলেন:]

১২১.সেই সুকৃত কর্মের ফলে ও প্রার্থনা অনুসারে মনুষ্যদেহ ত্যাগ করে আমি তাবতিংস দেবলোকে জন্ম নিয়েছিলাম।

১২২.আমি তিনশতবার দেবরাজত্ব করেছিলাম এবং পাঁচশতবার চক্রবর্তী রাজা হয়েছিলাম।

১২৩.আর প্রাদেসিক রাজাতো অসংখ্যবার হয়েছিলাম। সেই কর্মের ফলে আমি সর্বত্রই সুখী হতাম।

১২৪.আজ থেকে একানব্বই কল্প আগে পৃথিবীতে চারুদর্শন, সর্ববিধ ধর্মে যথাযথ দর্শনকারী, নায়ক বিপশ্বী ভগবান উৎপন্ন হয়েছিলেন।

১২৫.সর্ববিধ আসব ক্ষয় করা তাঁর এক শ্রাবককে আমি ‘পরিাশুদ্ধ’ জেনেও প্রদুষ্টমনে অপবাদ দিয়েছিলাম।

১২৬.সেই নরবীর, শ্রাবকদের মহর্ষি বুদ্ধকে আমি শলাকা দুধভাত দান করেছিলাম।

১২৭.তার পর এই ভদ্রকল্পে ব্রহ্মবন্ধু, মহাযশস্বী কাশ্যপ বুদ্ধ পৃথিবীতে উৎপন্ন হয়েছিলেন।

১২৮.তিনি বুদ্ধশাসনকে উজ্জ্বল করেঅন্যতীর্ িদের পরাভূত করেছিলেন এবং বিনয়ন যোগ্যসত্ত্বগণকে বিনমিত বা দমন করে সশিষ্যে পরিনির্বাণ লাভ করেছিলেন।

১২৯.‘ভগবান নাথ সশিষ্য পরিনির্বাপিত হয়েছেন, শাসনের অনেক ক্ষতি হয়ে গেল’ এই বলে দেবতারা সংবিগ্ন হয়ে সাশ্রুনয়নে তীব্র স্বরে কেঁদেছিল।

১৩০.অহো, ধর্মচক্ষু নির্বাপিত হয়েছে! আমরা আর সুব্রত বুদ্ধ প্রমুখতাঁর শ্রাবকসংঘকে দেখতে পাব না! তাঁর সদ্ধম শুনতে পাব না! অহো, আমরা ভীষণ হতভাগা!

১৩১.চতুর্দিকে অমনুষ্যরা তখন বিকটভাবেঢোল বাজিয়েছিল বলে মনেহয়েছিল, চারদিক থেকে ভয়াবহ অশনি ফেটে পড়েছিল।

১৩৩.তখন আকাশ থেকে বৃষ্টির মতো উল্কা পড়েছিল। আকাশে ধুমকেতু দেখা গিয়েছিল। আর জালবদ্ধ হওয়ার ন্যায় করে স্থলচর পশু-পাখিরা তীব্রস্বরে চিৎকার করেছিল।

১৩৪.শাসন পরিহানী সূচক সূর্যউঠতে দেখে তখন আমরা সাতজন উদ্বিগ্ন ভিক্ষু চিন্তা করেছিলাম।

১৩৫.সম্বুদ্ধশাসন বিনা বেঁচে থেকে আমদের কী লাভ ? তাই আমরা সবাই মিলে মহারন্যে প্রবেশ করে জিনশাসনে আত্মনিয়োগ করব।

১৩৬.মহারণ্যের মধ্যে আমরা তখন বেশ উঁচুশৈলপর্বত দেখতে পেয়েছিলাম। আমরা সিড়ি বেয়ে তার উপর উঠে পড়েছিলাম এবং উঠার পর সিড়িটি নিচে ফেলে দিয়েছিলাম।

১৩৭.তখন আমাদের মধ্যে সবার জ্যেষ্ঠ স্থবির আমাদের এই বলে উপদেশ দিয়েছিলেন: বুদ্ধের উৎপত্তি অতীব দুর্লভ। বুদ্ধশাসনের সামান্য অংশ লাভ করাও পরম সৌভাগ্যের।

১৩৮.আমরা অনাদি কাল থেকে অনন্ত দুঃখের সাগরে নিপতিত। তাই আমাদের পক্ষে যতক্ষণ এই বুদ্ধশাসন আছে ততক্ষণ স্বীয় কর্তর্ব যথাযথভাবে সম্পাদন করা উচিত।

১৩৯.তারপর আমাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ স্থবির অর্হত্ত্ব লাভ করেছিলেন আর তাঁর কনিষ্টজন অনাগামী হয়েছিলেন। আমরা অন্য পাঁচজন যথাযথভাবে শীল রক্ষা করায় দেবলোকে জন্মেছিলাম।

১৪০-১৪১. যিনি অনাগামী লাভ করেছিলেন তিনি একাই সুদ্ধাবাসে জন্মনিয়ে সেখানেই সংসার সাগর উত্তীর্ণ হয়ে পরিনির্বাপিত হয়েছিলেন। আর আমি সহ অন্যরা পুক্কুসাতি, সভিয় বাহিয় ও কুমার কাশ্যপস্থবির হয়ে বিভিন্ন জায়গায় জন্মেছিলাম। মহাকারুণিক গৌতমবুদ্ধের পরম অনুকম্পায় আমরা এখন সবাই সংসার বন্ধন হতে মুক্ত হয়েছি।

১৪২.মল্লরাজ্যের কুশীরনায়ায় একজনের গর্ভে আমি জন্মালে আমার মা মারা গেল। তাকে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে আগুনে পোড়ানোর সময় তার পেট ফেটে আমি বের হয়েছি।

১৪৩.বের হয়ে আমি এক দব্বপুঞ্জে গিয়ে পড়েছি। তাই আমি ‘দব্ব’ নামেই পরিচিত হয়েছি। ব্রহ্মচর্য অনুশীলন বলেই আমি মাত্র সাত বৎসর সয়সে বিমুত্ত হয়েছি।

১৪৪.দুধভাত দান করার ফলে আমি অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পরিপূর্ণ হয়ে জন্মেচ্ছি। আর ক্ষীণাসব অর্হৎকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার ফলে আমি ও বহুভাবে নিন্দা, অপবাদ পেয়েছি।

১৪৫.পাপ-পুণ্যউভই অতিক্রম করে এখন আমি পরম শান্তিপদ নির্বাণ লাভ করে সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়েই অবস্থান করছি।

১৪৬.আমি পরমানন্দের সাথে ভিক্ষুসংঘের জন্য শয্যাসনপ্রজ্ঞাপ্ত করি। বুদ্ধ আমার এই গুণে খুশী হয়ে আমাকে শ্রেষ্ঠপদে বসিয়েছেন।

১৪৭.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

১৪৮.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

১৪৯.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি। ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মানমল্লপুত্রদব্বস্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন।

[মল্লপুত্রদব্বস্থবির অপদান চতুথসমাপ্তর্]

৫. কুমার কাশ্যপস্থবির অপদান

এই স্থবির পদুমুত্তর ভগবানের সময় এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। একদিন তিনি শাস্তা কাছে ধর্মশ্রবণ করতে গেলেন। তখন শাস্তা এক ভিক্ষুকে বিচিত্রধর্মকথিকদের মধ্যে শ্রেষ্ঠপদে প্রতিষ্ঠিত করছিলেন। তা দেখে তিনি নিজে ও সেই শ্রেষ্ঠপদ লাভের প্রার্থনা করলেন। ঠিক সেভাবেই তিনি আজীবন পুণ্যকর্ম সম্পাদন করলেন। মৃত্যুর পর তিনি দেবমনুষ্য লোকে জন্মপরিভ্রমণকালে উভয় সম্পত্তি ভোগ করেন এবং পরে কাশ্যপ ভগবানের সময় এক কুলীন পরিবরে জন্মগ্রহণ করেন। কাশ্যপ ভগবানের শাসনে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করে শ্রমণধর্ম অনুশীলন করেন এবং পরে কামসুগতি ভূমিতে দিব্য সুখ ও মনুষ্যসুখ ভোগ করে এইতমগৌবুদ্ধের সময় রাজগৃহে এক শ্রেষ্ঠীকন্যা গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। এই শ্রেষ্ঠকন্যা কুমারীকাল হতেই প্রব্রজ্যাপ্রার্থিনী ছিলেন। কিন্তু মাতাপিতার অনুমতি না পেয়ে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করতে পানেনি। তাকে বিয়ে দিলেও তার সেই ইচ্ছা কিছু একটা কমেনি। পেটে সন্তান আসলেও তার সেদিকে লক্ষ নেই। প্রায়শা স্বামীকে শরীরের নানা দোষ বর্ণনা করত। তারপর একদিন স্বামীকে সন্তুষ্ট করতে পেরে প্রব্রজ্যার অনুমতি মিলল এবং সাথে সাথে দেবদত্ত্বের নিকায়ে ভিক্ষুণীদের নিকটে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করল। ভিক্ষুণীরা নবীনা ভিক্ষুণীর গর্ভ হয়েছে দেখে দেবদত্তকে তা জানাল। দেবদত্ত ‘সে অশ্রমণী’ বলে তাকে তাড়িয়ে দিতে বলল। সে ‘আমি তো দেবদত্তের উদ্দেশে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করিনি। আমি ভগবানর উদ্দেশেই প্রব্রজ্যা নিয়েছি’ ভেবে ভগবানের কাছে গিয়ে সমস্ত ঘটনা প্রকাশ করল। শাস্তা উপালী স্থবিরকে বিচারের ভার দিলেন। উপালি স্থবির উপাসিকা বিশাখা প্রমুখ শ্রাবস্তীর কতিপয় ললনাদের ডেকে রাজপরিষদে ইহার বিচার করলেন। বিচারে প্রমাণ হলো যে, এই গর্ভ গৃহীকালের, প্রব্রজ্যার কোনো ক্ষতি হয়নি। তা শুনে ভগবান এই বিষয়ের সুমীমাংসা হয়েছে বলেস্থবিরকে সাধবাদ দিলেন।

কিছুদিন পর নবীনাভিক্ষুণীসুবর্ণ বিম্বসদৃশ এক পুত্র প্রসব করল। রাজা প্রসেনজিৎ সেই শিশুপুত্রকে লালন পালন করলেন। শিশুটির নাম রাখালেন ‘কাশ্যপ’।

পরে এই বালককে ভগবানের নিকটে নিয়ে প্রব্রজ্যা প্রদান করলেন। কুমারকালে প্রব্রজ্জিত হওয়াতে ভগবান বলতেন, কাশ্যকে ডাক। এই এই ফল, এই এই খাদ্য কাশ্যপকে দাও। ভিক্ষুরা বলতেন, কোন কাশ্যপকে দিব? ভগবান বলতেন, কুমার কাশ্যপকে দাও। সেই থেকে তিনি কুমার কাশ্যপ নামেই পরিচিত হলেন।

তিনি প্রব্রজ্যা গ্রহণের পর থেকে যুগপৎ বিদর্শন ভাবনা ও ধর্মশিক্ষা করতেন। পূর্বজন্মে এক উঁচুপর্বতে তাঁরা সাতজন কর্মস্থান ভাবনা করতেন। তন্মধ্যে একজন অনাগামী হয়ে সুদ্ধবাস ব্রহ্মলোকে জন্মগ্রহণ করেন। সেই মহাব্রহ্মা তাঁর ভাবনার শ্রীবৃদ্ধিকল্পে একসময়তাঁর নিকট উপস্থিত হয়ে ১৫টি প্রশ্ন করেন। স্থবির তখন অন্ধবনে থাকতেন। মহাব্রহ্মা স্থবিরকে বললেন, এই প্রশ্নগুলো আপনি ভগবানকে জিজ্ঞেস করবেন। তিনিও ভগবানকে এই প্রশ্নগুলো জিজ্ঞেস করেন এবং উত্তরগুলো শিক্ষা করে অচিরেই অর্হত্ত্ব লাভ করেন।

অর্হত্ত্ব লাভের পর তিনি নিজের পূর্বকৃত কর্ম স্মরণ করে আনন্দিত মনে নিজের পূর্বজীবনের কাহিনি প্রকাশ করতে গিয়ে ‘আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে’ প্রভৃতি গাথা বলেছিলেন।

১৫০.আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে পৃথিবীতে সর্বলোক হিতকারী, বীর, লোকনায়ক পদুমুত্তর বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন।

১৫১.তখন আমি একজন বিশ্ববিশ্রুত বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ছিলাম। একদিন দিবাবিহারের জন্যে হাঁটতে হাঁটতে লোকনায়ক বুদ্ধকে দেখতে পেয়েছিলাম।

১৫২.তখন তিনি দেবমনুষ্যগণের ধর্মবোধ জাগ্রত করার জন্যে চর্তুসত্য প্রকাশ করছিলেন এবং সেই সাথে মহাজনতার সামনে বিচিত্র ধর্মকথিক ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ এক ভিক্ষুকে ভূয়শী প্রশংসা করছিলেন।

১৫৩-১৫৪. তাঁর কথা শুনে আমি প্রসন্নতায় ভরে উঠেছিলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে তথাগত বুদ্ধকে নিমন্ত্রণ করেছিলাম। নানাবিধ বস্ত্রালংকারে ও রত্নে সুসজ্জিত একটি মণ্ডপ তৈরি করে তাতে বুদ্ধপ্রমুখমহান ভিক্ষুসংঘকে ভোজন করিয়েছিলাম। এভাবে নানাবিধ উত্তম উত্তম খাদ্য-ভোজ্য দিয়ে সপ্তাহকাল ধরে ভোজন করিয়েছিলাম।

১৫৫.সশিষ্য বুদ্ধকে নানা ধরণের ফুল দিয়ে পূজা করেতাঁর রাতুল পদমূলে নিপতিত হয়ে সেই শ্রেষ্ঠপদ প্রার্থনা করেছিলাম।

১৫৬-১৫৭. তখন করুণাঘন মুনিবর বুদ্ধ আমাকে লক্ষ করে বলেছিলেন, হে ভিক্ষুগণ, দেখো এই দ্বিজশ্রেষ্ঠ, পদ্মলোচন, প্রীতিপ্রমোদ্যবহুল, উদগ্রচিত্ত, ঊর্ধ্বলোমধারী, সদা হাস্যময়, আমার শাসনে সুপ্রসন্ন ব্যক্তিকে দেখো।

১৫৮.এই ব্যক্তি আমার পদমূলে পতিত হয়ে বিচিত্রধর্মকথিক ভিক্ষুদের মধ্যে ্রশেষ্ঠপদ লাভের প্রার্থনা করছে।

১৫৯.আজ থেকে লক্ষ কল্প পরে ওক্ককুকুলে গৌতম নামক শাস্তা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করবেন।

১৬০.তাঁর ধর্মে ধর্মৌরসজাত উত্তরাধিকারী হয়ে সে কুমারকাশ্যপ নামে এক শাস্তা শ্রাবক হবে।

১৬১.বিচিত্র পুষ্প, বস্ত্র ও রত্নসম্ভার দান করার ফলে সে বিচিত্রধর্মকথিক ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠপদ লাভ করবে।

১৬২.সেই সুকৃত কর্মের ফলে ও প্রার্থনা অনুসারে মনুষ্যদেহ ত্যাগ করে আমি তাবতিংস স্বর্গে জন্মেছিলাম।

১৬৩.পূর্বেআমি রঙ্গমঞ্চে কুশীলবের ন্যায় শাখামৃগ তথ বানর হয়ে জন্মেছিলাম।

১৬৪.আমি পেটে থাকা অবস্থায় আমার মায়ের মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল। তখন আমার মা দল ছেড়ে নিগ্রোধ বৃক্ষের আশ্রয়ে চলে গিয়েছিল।

১৬৫.সেভাবেই সে বানর রাজহতে রক্ষাপেয়েছিল। এভাবে মরণ থেকে রক্ষা পেয়ে সে আমাকে প্রায়ই এভাবে উপদেশ দিত:

১৬৬.বাছা, তুমি নিগ্রোধ বৃক্ষের সাহচর্যেই থাকবে। কখনো বানর দলের সাথে মিশবে না। বানরদলের সাথে বেঁচে থাকার চাইতে নিগ্রোধ বৃক্ষেৃত্যুম হওয়াই ভালো।

১৬৭.এই উপদেশ পেয়ে আমিও আমার মা মিলে সেভাবেই জীবন যাপন করেছিলাম। প্রবাসে যাওয়া ব্যক্তির মতো আমারা নিজ ঘরে অর্ াৎ রমনীয় তুষিত স্বর্গে জন্মেছিলাম।

১৬৮.তারপর আবার কাশ্যপ বুদ্ধের শাসনের একদম শেষ পর্যায়ে জন্ম নিয়ে এক শৈলপর্বতে উঠে জিনশাসনে আত্মনিয়োগ করেছিলাম।

১৬৯.এখন আমি রাজগৃহের এক শ্রেষ্ঠী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি। আমাকে গর্ভে নিয়েই অমার মা অনাগারিক প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছিলেন।

১৭০.তার গর্ভের কথা জেনে দেবদত্ত তাকে এই বলে তাড়িয়ে দিয়েছিল, এই ভিক্ষুণী পাপী, তাকে তাড়িয়ে দাও।

১৭১.কিন্তু বর্তমানে আমার মা মুনিন্দ্র জিনের অনুকম্পা পেয়েছেন। ভিক্ষুণীনিবাসে মাকে জায়গা দিয়েছেন। আমাকে সুখে প্রবস করেছেন।

১৭২.সে কথা জানার পর কোশলরাজ প্রসেনজিৎ আমাকে লালন পালন করেছেন। আমার নাম রাখলেন কাশ্যপ।

১৭৩-১৭৪. কিন্তু মহাকাশ্যপের নিকট এসে সুবর্ণবিম্বসদৃশ আমার শরীর দেখে আমার নাম রাখলেন কুমার কাশ্যপ। বুদ্ধের দেশনা শুনে আমার চিত্ত সম্পূর্ণ বিমুক্ত হয়েছিল। তারপর আমি বিচিত্র ধর্মকথা বলার মধ্য দিয়ে এই শ্রেষ্ঠপদ লাভ করেছি।

১৭৫.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

১৭৬.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

১৭৭.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি। ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মান কুমারকাশ্যপস্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন।

[কুমার কাশ্যপস্থবির অপদান পঞ্চম সমাপ্ত]

[চব্বিশতম ভাণবার সমাপ্ত]

৬. বাহিয় স্থবির অপদান

এই স্থবিরও অতীত বুদ্ধগণের নিকট বিাবিধপুণ্যকর্ম করে জন্মজন্মান্তরে সুখদপুণ্যসঞ্চয় করতে করতে পদুমুত্তর ভগবানের সময় ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ব্রাহ্মণ শিল্পে সবিশেষ দক্ষতা অর্জন করেন। একদিন শাস্তার কাছে ধর্ম কথা শুনতে গেলেন। শাস্তা কখন একজন ভিক্ষুকেক্ষিপ্রাভিজ্ঞ ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠপদে প্রতিষ্ঠিত করছিলেন। তা দেখে তিনি সেই শ্রেষ্ঠপদ লাভের ইচ্ছায় সাতদিন পর্যন্ত বুদ্ধপ্রমুখ ভিক্ষুসংকে মহাদান দিলেন। সাতদিন শেষে ভগবানের পদমূলে নিপতিত হয়ে তিনি এই বলে প্রার্থনা করলেন, ভন্তে ভগবান, আজ

থেকে সাতদিন আগে আপনি যেই ভিক্ষুকে ক্ষিপ্রাভিজ্ঞ ভিক্ষুদের মধ্যেশ্রেষ্ঠপদে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, ভবিষ্যতে আমিও তার মতো হতে চাই।

ভগবান ভবিষ্যতে তার প্রাথর্না সফল হবে বলে বললেন। আজীবন পুণ্যকর্ম সম্পাদন করে মৃত্যুর পর তিনি দেবলোকে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি দেবলোকে দেবসম্পত্তি আর মনুষ্যলোকে মনুষ্যসম্পত্তি ভোগ করে কাশ্যপ ভগবানের সময় এক কুলীন পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তখন শাস্তার পরিনির্বাণের পর তারা সাতজন প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। ভিক্ষু-ভিক্ষুণী ও উপাসক-উপাসিকা এই চারিপরিষদে বহু অনাচার দেখে তার ভীষণভাবে সংবেগপ্রাপ্ত হলেন। তারপর অরণ্যে প্রবেশ করে ‘বুদ্ধশাসন শেষ হবার আগেই আমরা নিজেদের সুপ্রতিষ্ঠিত করব’ এই বলে তারা সুবণ চৈত্যকে বন্দনা করলেন। গহীন অরন্যে এক উঁচু পর্বত দেখে তারা তাতে সিড়ি বেড়ে উঠলেন। উঠার পর সিড়িটি ফেলে দিয়ে শ্রমণধর্ম অনুশীলন করতে লাগলেন। সাতজনের মধ্যে সংঘ স্থবির এক রাত পরে অর্হত্ত্বলাভ করলেন। তিনি অনোতপদহ হ্রদে গিয়ে নাগলতা দন্তকাষ্ঠ খেয়ে, মুখ ধুয়ে উত্তরকুরু হতে পিণ্ডনিয়ে এসে সেই ভিক্ষুদের বললেন, ‘আবুসোগণ, এই পিণ্ডলো খান।’ তখন তারা বললেন, ‘ভন্তে, আমাদের মধ্যে কি এমন কথাবার্তা হয়েছিল, যে ভিক্ষুপ্রথম অর্হত্ত্ব লাভ করাবে তাঁর আনা পিণ্ড অন্যেরা ভোজন করব?’ ‘না, আবুসোগণ, সেরকম কথাবার্তা তো হয়নি।’ ‘তাহলে আমারাও আগে আপনার মতো অর্হত্ত্ব লাভ করব। তারপর নিজেরা পিণ্ডএনে ভোজন করব।’ এই বলে তারা পিণ্ড ভোজন করলেন না।

পরদিন দ্বিতীয় স্থবির অনাগামী লাভ করলেন। তিনিও সেভাবে পিণ্ড নিয়েএসে ভোজনের জন্য অন্যদের আহ্বান জানালেন। তখন তারা বললেন, ‘আবুসো, আমাদের মধ্যে কি এমন কথা হয়েছিল যে, মহাস্থবিরের নিয়ে আসা পিণ্ড ভোজন না করে দ্বিতীয় স্থবিরের নিয়ে আসা পিণ্ড ভোজন করব? ‘না, আবুসো, তেমন কথাবার্তা তো হয়নি।’ ‘তাহলে আমরাও আপনাদের মতো বিশেষ কিছু অর্জন করে নিজেরা এনে ভোজন করতে পারলেই কেবল ভোজন করব।’ এই বলে তারা পিণ্ডভোজন করলেন না।

তাদের মধ্যে যিনি অর্হৎ তিনি পরিনির্বাপিত হলেন। আর যিনি অনাগামী তিনি ব্রহ্মলোকে জন্মনিলেন। অন্য পাঁচজন বিশেষ কিছু লাভ করতে না পেরে অনাহারে সাত দিনের মাথায় মৃত্যু বরণ করে দেবলোকে জন্ম নিলেন। সেখানে দিব্যসুখ ভোগ করেএই গৌতম বুদ্ধের সময়ে সেখান থেকে চ্যুত হয়ে তারা মানুষ হয়ে জন্ম নিলেন। পাঁচজনের মধ্যে একজন হলেন পুক্কুসাতিরাজা, একজন কুমারকাশ্যপ, একজন বাহিয় দারুচীরিয়, একজন মল্লপুত্র দব্ব আর একজন সভিয় পরিব্রাজক।

এই বাহিয় দারুচীরিয় সুপ্পারক পট্টন নামক নগরে এক বনিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাণিজ্যকর্মে বিশেষ দক্ষতা অর্জন করে বিশাল ধনী হয়ে গেলেন। একদিন তিনি সুবর্ণ ভূমিগামী কণিকদের সাথে নৌকায় আরোহণ করেবিদেশ যাত্রা করলেন। কিছুদিন যাবার পর তাদের নৌকাটি সাগরের ঢেউয়ের আঘাতে ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেল। বাহিয়কে ছাড়া বাকি সবাইকে মাছেরা খেয়ে ফেলল। অনেক কষ্ট করে একটি কাষ্ঠফলকের সাহায্যে সাতদিন পর তিনি সুপ্পারক পট্টন নগরের এক তীরে এসেউঠলেন। তখন তার পরনে কিছুই ছিল না, একদম উলঙ্গ। তিনি আশেপাশে অন্য কিছুনা, দেখে শুষ্ককাষ্ঠখণ্ডে গাছের বাকল বেড়িয়ে পড়তে লাগলেন। আর দেবকুলহতে একটি ভিক্ষাপাত্র নিয়ে সুপ্পারক পট্টন নগরে গেলেন। লোকেরা তাকে দেখে ‘ইনি একজন অর্হৎ’ ভেবে যাগুভাত প্রভৃতিদান করতে লাগলেন। পরে তাকে কাপড় দেওয়া হলে তখন তিনি এই ভেবে সেসব পড়তেন না, ‘আমি যদি এখন কাপড় পরিধান করি, তবে আমার এই লাভ-সৎকার থাকবে না।’ তারপর তিনি বাকল পেঁচানো কাষ্ঠখণ্ড পড়েই থাকতেন।

লোকে যখন তাকে ‘অর্হৎ’ বলে খুব বিশ্বাস করতে লাগল, তখন তার মনে এই চিত্তবির্তক উৎপন্ন হয়েছিল, ‘পৃথিবীতে যদি অর্হত্ত্ব মার্গলাভী কেই থেকে থাকে, তবে আমি তাদের একজন।’ তারপর থেকে তিনি সেভাবেই কুহককর্মের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে লাগলেন।

দশবল কাশ্যপের শাসনে যেই সাতজন ভিক্ষু পর্বতে আরোহণ করে শ্রমণধর্ম অনুশীলন করেছিলেন, তাদের একজন অনাগামী হয়ে সুদ্ধাবাস ব্রহ্মলোকে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নিজের ব্রহ্মসম্পত্তি প্রাপ্তির কারণ চিন্তা করতে গিয়ে দেখতে পেলেন যে, তারা সাতজন ভিক্ষুশ্রমণধর্ম পালন করেছেন। তন্মধ্যে একজন পরিনির্বাণ লাভ করেছেন। অন্য পাঁচজন দেবলোকে জন্মগ্রহণ করেছেন। ‘তারা এখন কোথায় অবস্থান করছেন?’ দেখতে গিয়ে জানতে পারলেন যে, বাহিয় দারুচীরিয় সুপ্পারক পট্টনের আশ্রয়ে থেকে কুহণকর্মের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তারপর তিনি ভাবলেন, মূর্খকোথাকার! এ তো দেখছি নষ্ট হয়ে গিয়েছে। পূর্বে সে শ্রমণধর্ম পালন করতে গিয়ে নৈতিকতার কথা ভেবে অর্হৎ কর্তৃক আহৃত পিণ্ডপর্যন্ত ভোজন করেনি। অথচ এখন সে পেটের দায়ে অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে অর্হৎ ভেবে মানুষকে বঞ্চনা করে বিচরণ করছে। জগতে দশবল বুদ্ধের উৎপন্ন হওয়ার কথা সে জানে না। তাকে সংবেগপ্রাপ্ত করিয়ে বুদ্ধ-উৎপত্তির কথা জানাব। তারপর তিনি মুহূর্তের মধ্যেই ব্রহ্মলোক হতে অন্তর্হিত হয়ে সুপ্পারক পট্টনে গভীর রাতে বাহিয় দারুচীরিয়ের সামনে আবির্ভূত হলেন। তিনি নিজের বাসস্থানে উজ্জ্বল আলো দেখে বাইরে বেরোলেন। তারপর মহাব্রহ্মাকে দেখে হাত জোড় করে করে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনিকে?’ মহাব্রহ্মা বললেন, ‘আমি তোমার পুরোনো বন্ধু। অনাগামীফল লাভ করে ব্রহ্মলোকে জন্মেচ্ছি। আমাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ স্থবির অর্হৎ হয়ে পরির্বিাণ লাভ করেছেন। আর আপনারা বাকি পাঁচজন মিলে দেবলোকে জন্মগ্রহণ করেছেন। এখন আমি তোমাকে এই জায়গায় কুহনকর্মের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতে দেখে বোধোদয় করিয়ে দিতে এসেছি।’ তারপর মহাব্রহ্মা কারণটি ব্যাখ্যা করে বললেন, ‘হে বাহিয়, তুমি অর্হৎ নও, অর্হত্ত্বমার্গলাভীও নও। তোমর সেই প্রতিপদাও জানা নেই যে, যার দ্বারা তুমি অর্হৎ বা অর্হত্ত্বমার্গলাভী হতে পার।’ তারপর মহাব্রহ্মা তাকে শ্রাবস্তীতে শাস্তা উৎপন্ন হয়েছেন জানিয়ে তাঁর নিকট যেতে বলে ব্রহ্মলোকে ফিরে গেলেন।

এদিকে বাহিয় মনে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে আকাশে স্থিত মহাব্রহ্মাকে দেখে চিন্তা করলেন,

অহা, আমি যে কী অন্যায় কাজা করেছি। আমি অর্হৎ না হয়েও নিজেকে অর্হৎ ভেবেছি। এখন ইনি আমাকে বলেছেন, ‘তুমি অর্হৎও নও, অর্হৎমার্গলাভীও নও।’ তাহলে কি পৃথিবীতে অন্য কোনো অর্হৎ আছেন? তিনি তাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এমন কে আছেন যিনি অর্হৎ বা অহত্ত্বমার্গফললাভী ?’

অতঃপর দেবতা তাকে বললেন, ‘বাহিয়, একজন আছেন। উত্তর জনপদে শ্রাবস্তী নামে এক নগর আছে। সেখানে ভগবান অর্হৎ সম্যক সম্বুদ্ধ বসবাস করছেন। হে বাহিয়, সেই ভগবানই অর্হৎ এবং অর্হত্ত্ব লাভের জন্যেই তাঁর ধর্মদেশনা। এই ভাবে বাহিয় দারুচীরিয় ওই দেবতার কথায় সংবেগপ্রাপ্ত হইয়া সেদিনই সুপ্পারক হতে শাবস্তীর দিকে যাত্রা করলেন। সর্বত্র কেবল একরাত থেকে শ্রাবস্তী নগরে অনাথাপিণ্ডিক শ্রেষ্ঠীর জেতবন বিহারে পৌঁছলেন। কিন্তু শাস্তা তখন শ্রাবস্তীতে পিণ্ডার্থে প্রবেশ করেছেন।

তিনি জেতবনে ঢুকে একজন ভিক্ষুকে বাইরে চংক্রমণ করতে দেখে জিজ্ঞেস রলেন,ক ভন্তে, ‘শাস্তা এখন কোথায় ?’ ভিক্ষুটি ‘শাস্তা পিণ্ডার্থে শ্রাবস্তীতে প্রবেশ করেছেন’ বলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কোথায় থেকে এসেছেন?’ ‘আমি সুপ্পারক হতে এসেছি।’ ‘কখন বের হয়েছেন?’ ‘গতকাল সন্ধ্যায় বের হয়েছি।’ ‘আপনি অনেক দূর থেকে এসেছেন। বসুন। পা ধুয়ে নিন। পায়ে তেল মেখে বিশ্রাম নিন। পিণ্ড নিয়ে ফিরে আসলেই শাস্তাকে দেখতে পাবেন।’ ‘ভন্তে, শাস্তার অথবা আমার নিজের করা কখন জীবনের অন্তরায় হয় তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই আমি কোথাও না জিরিয়েই মাত্র এক রাতে একশ বিশ যোজন পথ হেঁটে এসেছি।

আমি প্রথমে শাস্তাকে দেখেই তারপর বিশ্রাম নেব।’

এভাবে বলার পর তিনি অতি শিগগিরি শ্রাবস্তীতে প্রবেশ করে অনুপম বুদ্ধশ্রীতে উদাসিত্ভ ভগবানকে পিণ্ডচারণ করতে দেখতে পেলেন এবং ভাবলেন, ‘অহো, আমি সুদীর্ঘকাল পর ভগবানকে দেখতে পেলাম।’ দেখামাত্রই পথিমধ্য শ্রদ্ধায় নতশিরে পঞ্চঙ্গ লুটিয়ে বন্দনা নিবেদন করে বললেন, ‘ভন্তে ভগবান, আমাকে ধর্মদেশনা করুন। হে সুগত, আমাকে ধর্মদেশনা করুন। যাতে আমার দীর্ঘকাল হিতসুখ সাধিত হয়।’ বাহিয় এরূপ বললে ভগবান বললেন, ‘বাহিয়, আমি পিণ্ডার্থে প্রবেশ করেছি। এখন অসময়।’

তা শুনে বাহিয় পুনরায় বললেন, ‘ভন্তে, সংসারে বিচরণকালে কবলিকার আহার লাভ করলেও আপনার বা আমার কার কখন জীবনের অন্তরায় হয়, তা জানা দুষ্কর। ভন্তে ভগবান, আমাকে ধর্মদেশনা করুন। হে সুগত, আমাকে ধর্মদেশনা করুন। যাতে আমার দীর্ঘকাল হিতসুখ সাধিত হয়।’

ভগবান দ্বিতীয় বারেও প্রত্যখ্যান করলেন। তারপর তৃতীয়বার প্রার্থনা করলে ভগবান তাকে পথিমধ্যে এই বলে ধর্মদেশনা করলেন, ‘তাহলে হে বাহিয়, এরূপ শিক্ষা করবে: দৃষ্টে দৃষ্ট মাত্র, শ্রুতে শ্রুতমাত্র ...।’

(উদানে দ্রষ্টব্য) তিনি শাস্তার ধর্মদেশনা শোনার সাথে সাথেই সর্বাসব ক্ষয় করে প্রতিসমিদাসহ্ভ অর্হত্ত্ব লাভ করলেন।

অর্হত্ত্ব লাভের পর তিনি নিজের পূর্বকৃত কর্ম স্মরণ করে আনন্দিত মনে নিজের পূর্বজীবনের কাহিনি প্রকাশ করতে গিয়ে ‘আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে’ প্রভৃতি গাথা বলেছিলেন।

১৭৮. আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে পৃথিবীতে মহাপ্রভাধর, ত্রিলকাগ্র, নায়ক পদুমুত্তর বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন।

১৭৯-১৮০. তিনি তাঁর শ্রাবক ক্ষিপ্রভিজ্ঞ ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ একজন ভিক্ষুকে ভূয়শী প্রশংসা করছিলেন। তা শুনে আমি ভীষণভাবে উদগ্রচিত্ত হয়েছিলাম। আমি ভক্তিসহকারে সশিষ্য মহর্ষি বুদ্ধকে সপ্তাহকাল দান দিয়েছিলাম। তারপর সম্বুদ্ধকে অভিবাদন করে সেই শ্রেষ্ঠপদ প্রার্থনা করেছিলাম।

১৮১.অতঃপর বুদ্ধ আমাকে লক্ষ করে বলেছিলেন, ‘হে ভিক্ষুগণ, দেখো এই ব্রহ্মকে, যে আমার পদমূলে নিপতিত হয়ে অতীব প্রসন্নমনে নিজের চর্যার কথা ভাবছে।’

১৮২.যার শরীর সুবর্ণাভাযুক্ত, বিম্বফলসদৃশ রক্তবর্ণের ওষ্ঠসম্বলিত, শুভ্র, তীক্ষ্ণ ও মসৃণ দন্তবিশিষ্ট।

১৮৩.বহুবিধ গুণে গুনান্বিত, উন্নত তনুুবিশিষ্ট, শ্রেষ্ঠ গুণধর ও প্রীতি-প্রফুল্লবদন।

১৮৪.এমন একজন ব্যক্তিই ক্ষিপ্রাভিজ্ঞ ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠপদ প্রার্থনা করেছে। ভবিষ্যতে পৃথিবীতে গৌতম নামক মহাবীর শাস্তা উৎপন্নহবেন।

১৮৫.তাঁর ধর্মে ধর্মৌরসজাত উত্তরাধিকারী বাহিয় নামে শাস্তাশ্রাবক হবে।

১৮৬.তখন আমি ভীষণরকম ভাবে খুশী হয়েছিলাম। তারপর থেকে আমি আজীবন মহামুনিবুদ্ধকে ভক্তিসহকারে দানাদি পুণ্যকর্ম করে মৃত্যুর পর নিজ ঘরে ফিরে যাবার ন্যায় স্বর্গে জন্মেছিলাম।

১৮৭.সেই কর্মের ফলে আমি দেবতা অথবা মানুষ যা-ই হয়ে জন্মাই না কেন সর্বত্রই সুখী হয়েছিলাম এবং বহু জন্মসঞ্চরণ করে উভয় সম্পত্তি ভোগ করেছিলাম।

১৮৮.পুনরায় কাশ্যপ বীরের শাসনের অন্তিম সময়ে আমরা সাতজন মিলেএকটি উঁচু শৈলপর্বতে আরোহণ করে জিনশাসনে আত্মনিয়োগ করেছিলাম।

১৮৯.তন্মধ্যে আমরা পাঁচজন শীলবিশুদ্ধ জীবন যাপন করে, প্রজ্ঞাবান ও জিনশাসন পালনকারী হয়ে মৃত্যুর পর দেবলোকে জন্মনিয়েছিলাম।

১৯০.তারপর সেখান থেকে আমি সুপ্পারক পট্টন নগরে বাহিয় হয়ে জন্মেছি। একদিন আমরা বহুবনিক মিলে বিদেশে অর্থ উর্পাজনের জন্য সাগর পথে যাত্রা করেছিলাম।

১৯১.যাত্রার কিছুদিন পর আমাদের বিশাল নৌকাটি ভেঙ্গে গিয়েছিল। তখন ভয়ানক অঘোর সাগরে পড়ে আমার সহযাত্রীরা সবাই মরে গিয়েছিল।

১৯২.তখন আমি অনেক চেষ্টা করে বিশাল সাগর পাড়ি দিয়ে সুপ্পারক পট্টনের তীরে পৌঁছাতে পেরেছিলাম।

১৯৩.তখন আমি সম্পূর্ণ বিবস্ত্র। তাই আমি কাষ্ঠখণ্ডের বস্ত্র পড়ে গ্রামে পিণ্ডার্থে প্রবেশ করলাম। লোকেরা আমায় দেখে ভীষণ খুশী হলো আর আমাকে ‘অর্হৎ’ মনে করল।

১৯৪.তারা আমাকে অন্ন, পানীয়, বস্ত্র, শয্যা ও ওষুধ দিয়ে সেবা-সৎকার করল এবং তাতে আমি সুখী হলাম।

১৯৫.তাদের দেওয়া চতুর্প্রত্যয় পেয়ে এবং তাদের দ্বারা মানিত, পূজিত হয়ে আমি নিজেকে অজ্ঞতাবশত ‘অহৎ’ মনে করলাম।

১৯৬.আমার মনের কথা অবগত হয়ে তখন আমার পূর্বের বন্ধু দেবতা আমার কাছে এসে বললেন, ‘বাহিয়, অর্হত্ত্ব লাভের উপায়ও তোমার জানা নেই। কীভাবে তুমি অর্হৎ হবে?’

১৯৭.তার দ্বারা সংবেগপ্রাপ্ত হয়ে আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘পৃথিবীতে নরোত্তম অর্হৎ বলে আছেন কি? থাকলে তিনি কোথায় থাকেন ?’

১৯৮.বুন্ধ দেবতা উত্তরে বললেন, ‘অবশ্যই আছেন। তিনি কোশলরাজ্যের শ্রাবস্তী নগরে থাকেন। তিনিই জিন, মহান প্রাজ্ঞ, শ্রেষ্ঠনগরে শাক্যপুত্র, অর্হৎ, অনাসক্ত। তিনিই অর্হত্ত্ব লাভের ধর্ম দেশনা করেন।’

১৯৯.তাঁর প্রাজ্ঞবচন শুনেই তুমি অমৃত পান করতে পারবে, নির্বাণরূপ অমুল্য গুপ্তধন লাভ করবে। তিনি উদগ্রচিত্ত, অর্হৎ, সুদর্শন ও অনন্তগোচরদর্শী।

২০০.তখন আমি বিমলনয়ন, জিন, শাস্তাকে দেখার জন্যে তড়িঘরি বেরিয়ে পড়েছিলাম। তারপর তার রমনীয় বন জেতবনে পৌঁছে একভিক্ষুকে জিজ্ঞেস করলাম। লোকনন্দন শাস্তা কোথায় ?

২০১.তিনি বললেন, ‘দেবনর নন্দিত বুদ্ধ তো পিণ্ডার্ গে্রামে প্রবেশ করেছেন। বিশ্রাম করো। তিনি শিগগিরি ফিরে আসবেন। তারপর সেই শ্রেষ্ঠপুদ্গলের কাছে গিয়ে বন্দনা নিবেদন করবে।

২০২.আমি তার কথা আমল না দিয়ে শিগগিরি শ্রাবস্তীর গ্রামে গেলাম। তাকে পিণ্ডের জন্যে দ্বারে দ্বারে ঘুরতে দেখতে পেলাম।

২০৩-২০৪. পাত্রহাতে বিচরণরত, জ্যোতির্ময়, শ্রীনিলয়তুল্য, প্রখর তেজস্বী সূর্যের ন্যায় বুদ্ধকে আমি নতশিরে বন্দনা করে এই কথা নিবেদন করেছিলাম, ‘হে গৌতম, আমি কুপথে পরিচালিত হয়েছি। এখন আপনিই আমার শরণ হোন!’

২০৫.মুনিশ্রেষ্ঠবুদ্ধ বললেন, ‘হে বাহিয়, এখন আমি পিণ্ডার্থে বিচরণ করছি। এখন অসময়।’

২০৬.আমি বারবার ধর্মশ্রবণের ইচ্ছায় বুদ্ধকে প্রার্থনা নিবেদন করলাম। তারপর তিনি আমাকে গমীর্ভ একপদযোগে ধর্মদেশনা করলেন।

২০৭.তার ভাষিত ধর্ম শুনে আমি আসবক্ষয় জ্ঞান লাভ করেছি। তখন আমার আয়ু ক্ষীণ হয়ে আসছিল। অহো, শাস্তার কী অনুকম্পা!

২০৮.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

২০৯.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

২১০.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

২১১.বাহিয় দারুচীরিয় স্থবির এভাবেই তার পূর্বজীবনের কাহিনি বর্ননা করলেন। অর্হত্ত্ব লাভের পর হেটে যাবার সময় এক গাভীর দ্বারা আক্রান্ত হয়ে তার নিথর দেহ পথের উপর পড়ে থাকল।

২১২.মহামতি স্থবির এভাবে নিজের পূর্বজীবনের কাহিনি প্রকাশ করেশ্রাবস্তী নগরে পরিনির্বাপিত হলেন।

২১৩-২১৪. নগর হতে বের হবার সময় ঋষিশ্রেষ্ঠ বুদ্ধ সেই আগতাগম, চিনশাসনকারক, গতায়ু, শুষ্কক্লেশ, ধীর বাহিয় দারুচীরিয়কে ইন্দ্রকেতুর ন্যায় পথের উপর পড়ে থাকতে দেখলেন।

২১৫.তারপর শাস্তা শিষ্যদের ডেকে বললেন, ভিক্ষুগণ, একে ধরো। শ্মশানে নিয়ে গিয়ে দগ্ধ করো। এ তো তোমাদেরই সব্রহ্মচারী।

২১৬.তার জন্যে স্তুপ তৈরি কর, পুজা কর। সেই মহামতি স্থবির পরিবির্বাপিত হয়েছে। সে আমার শিষ্য ক্ষিপ্রভিজ্ঞ ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ।

২১৭.অনর্থকর হাজারো গাথার চেয়ে একটি দাগাই শ্রেয়, যা শুনে সমস্ত ক্লেশকে উপশান্ত করা যায়।

২১৮.যেখানে পৃথিবী, আপ, তেজ, বায়ুর স্পর্শ নেই। শুভ্র গ্রহতারা সেখানে কোনো অন্ধকারও নেই। যখন কোনো ব্রাহ্মণ মুনিনীরবে থেকে নিজে নিজেই বুঝে থাকেন, তখন তিনি সমস্ত রূপারপে ও সুখদুঃখ হতে ক্তমুহন। ঠিক এভাবেই ত্রিলোকের শরণ, মুনি, নাথ বুদ্ধ ভাষণ করেছিলেন।

ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মান বাহিয়স্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন। [মহাকাচ্চায়ন স্থবির অপদান ষষ্ঠ সমাপ্ত]

৭. মহাকোট্‌ঠিত স্থবির অপদান

এই স্থবিরও অতীত বুদ্ধগণের নিকট বিবিধপুণ্যকর্ম করে জন্মজন্মান্তরে সুখদপুণ্যসঞ্চয় করতে করতে পদুমুত্তর ভগবানের সময়ে হংসবতী নগরে এক মহাধনাঢ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মাতাপিতার মৃত্যুর পর তিনি সাংসরিক কাজে আবদ্ধ হন। একদিন হংসবতী নগরে উপাসক-উপাসিকাদের সুগন্ধ মাল্য হাতে নিয়ে ত্রিরত্ন পূজা করতে যাচ্ছেন দেখেতিনিও তাদের সাথে বুদ্ধেরনিকটে উপস্থিত হলেন। বুদ্ধ তখন একজন ভিক্ষুকেপ্রতিসম্ভিদালাভী ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠপদে প্রতিষ্ঠিত করছেন। তা দেখে তারও ইচ্ছা হলো যে, আমাকেও এই ভিক্ষুর মতো প্রতিসম্ভিদা লাভী ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠহতে হবে। তারপর তিনি দেশনা শেষে লোকজন চলে গেলে ভগবানের কাছে আগামীকালের জন্য নিমন্ত্রণ করলেন। ভগবান তার নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন। পরদিন তিনি বুদ্ধপ্রমুখ ভিক্ষুসংঘকেখাদ্যভোজ্য দান দিয়ে চিন্তা করলেন, ‘আমি তো মহান একটি জিনিস প্রার্থনা করতে যাচ্ছি। মাত্র একদিন দান দিলে হবে না। আমি একাক্রমে সাতদিন দান দিয়ে তারপরই সেই শ্রেষ্ঠপদ প্রার্থনা করব।’

তারপর তিনি সাতদিন পর্যন্ত বুদ্ধপ্রমুখ ভিক্ষুসংকে মহাদান দিলেন। সাত দিন শেষে তিনি তথাগত বুদ্ধের কাছে গিয়েসেই শ্রেষ্ঠপদ লাভের প্রার্থনা করলেন। তখন ভগবান তাকে বললেন, ‘তুমি ভবিষ্যতে গৌতম বুদ্ধের শাসনে সেইশ্রেষ্ঠপদ লাভ করবে।’ সেই জন্মে তিনি আজীবন নানাবিধ পুণ্যকর্ম করে মৃত্যুর পরসে দেবস্পত্তি ভোগ করে অপরাপর দেবমনুষ্য লোকেও জন্মপরিভ্রমণ করলেন।

এভাবে দেবমনুষ্য লোকে জন্মপরিভ্রমণ শেষে তিনি এই গৌতম বুদ্ধের সময়ে শ্রাবস্তাীর এক ব্রাহ্মণ মহাশাল কুলে জন্মগ্রহণ করেন। তার নাম রাখা হলো ‘কোটঠিক’। তিনি প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর ত্রিভেদে ও ব্রাহ্মণশিল্পে দক্ষতা লাভ করলেন। একদিন তিনি শাস্তার নিকট গিয়ে ধর্মকথা শুনে পরম শুদ্ধায় প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। প্রব্রজ্যা গ্রহণ পর থেকে তিনি বিদর্শন ভাবনায় মনোযোগী হলেন। অচিরেই তিনি প্রতিসম্ভিদাসহ অর্হত্ত্ব লাভ করলেন। তারপর একদিন ভগবান তাকে এই বলে শেষ্ঠপদে বসালেন, ‘হে ভিক্ষুগণ, আমার শ্রাবক প্রতিসমিদালাভী্ভ ভিক্ষুদের মধ্যে মহাকোটঠিকই শ্রেষ্ঠ।

পরবর্তী সময়ে তিনি বিমুক্তিসুখ ভোগ করতে করতে আনন্দিত মনে নিজের পূর্বজীবনের কাহিনি প্রকাশ করতে গিয়ে ‘পদুমুত্তর জিন’প্রভতিৃ গাথা বলেছিলেন।

২২১.আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে পৃথিবীতে সর্বলোকবিদ মুনি, চক্ষুষ্মান জিন পদুমুত্তর বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন।

২২২.তিনি ছিলেন উপদেষ্টা, বিজ্ঞাপক, সকলপ্রাণির তীর্ণকারী ও দেশনাকুশল বুদ্ধ। তখন তিনি বহু জনতাকে সংসার সাগর তীর্ণ করেছিলেন।

২২৩.তিনি ছিলেন পরম অনুকম্পাকারী, কারুণিক ও সকলপ্রাণির পরমহিতৈষী এবং তিনি তখনকার অন্যতীর্থিয়দের পঞ্চশীলে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

২২৪.এভাবে তিনি সম্পুর্ণ নিরাকুল ও তীর্ িয়শুন্য হয়ে বশীভূত ক্ষীণাসব অর্হৎ পরিবেষ্ঠিত হয়ে অবস্থান করছিলেন।

২২৫.সেই মহামুনি আটান্ন প্রাকার রত্নে গৌরবমণ্ডিত, উজ্জ্বল কাঞ্চনতুল্য ও বত্রিশ মহাপুরুষলক্ষণ বিশিষ্ট।

২২৬.সেই সময় মানুষের গড় আয়ুছিল লক্ষ বৎসর। তিনি পুরিপূর্ণ আয়ু জীবিত থেকে বহু জনতাকে তীর্ণ করেছিলেন।

২২৭.তখন আমি হংবতী নগরে এক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মেছিলাম। একদিন সর্বলোকাগ্র বুদ্ধের কাছে গিয়েতাঁর ধর্মদেশনা শুনেছিলাম।

২২৮-২২৯. তখন তিনি তাঁর শ্রাবককে অথর্, ধর্ম নিরুক্তি ও প্রতিভাণ এই চারিপ্রতিসম্ভিদালাভী ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠপদেবসাচ্ছিলেন। তা শুনে আমি ভীষণ রকম খুশী হয়েছিলাম। তারপর আমি সাত দিন পর্যন্ত সশ্রাবক জিনবরকে ভোজন দান করেছিলাম।

২৩০.সশিষ্য বুদ্ধিসাগর বুদ্ধকে ত্রিচীবর দান করে তার পদমূলে নিপতিত হয়ে সেই শ্রেষ্ঠপদ লাভের প্রার্থনা করেছিলাম।

২৩১.তারপর লোকাগ্র বুদ্ধ বলেছিলেন, হে ভিক্ষুগণ, এই দ্বিজোত্তম কোমলপ্রভ ব্যক্তিকে দেখো, যে আমার পদমূলে মাথা ঠেকিয়েছে।

২৩২.এই ব্যক্তি তার শ্রদ্ধা, ত্যাগ ও সদ্ধর্ম শ্রবণের ফলে বুদ্ধ প্রমুখভিক্ষুসংঘের কাছে সেই শ্রেষ্ঠপদ প্রার্থনা করছে।

২৩৩.জন্মজন্মান্তরে সে সবর্ত্রই সুখী হবে এবং ভবিষ্যতে দীর্ঘকাল পরে তার মনোরথ পূরণ হবে।

২৩৪.আজ থেকে লক্ষ কল্প পরে ওক্কাকুকুলে গৌতম নামে এক শাস্তা পৃথিবীতে জন্ম নেবেন।

২৩৫.তাঁর ধর্মে সে ধর্মৌরসজাত উত্তরাধিকারী কোটঠিক নামক শাস্তাশ্রাবক হবে।

২৩৬.তা শুনে আমি ভীষণ রকম খুশী হয়েছিলাম। তারপর থেকে আমি জিনের প্রতি মৈত্রীচিত্তসম্পন্ন হযে এবং স্মৃতি ও প্রজ্ঞাসমন্বিত হয়ে আজীবন অতিবাহিত করেছিলাম।

২৩৭.সেই কর্মের ফলে ও প্রার্থনানুযায়ী মনুষ্যদেহ ত্যাগ করে আমি তাবতিংস স্বর্গে জন্মেছিলাম।

২৩৮.আমি তিনশতবার দেবরাজত্ব করেছিলাম। পাঁচশতবার চক্রবর্তী রাজা হয়েছিলাম।

২৩৯.আর প্রাদেসিক রাজাতো অসংখ্যবার হয়েছিলাম। আমি সেই কর্মের ফলে সর্বত্রই সুখী হয়েছিলাম।

২৪০.আমি দেবলোকে ও মনুষ্যলোকে এই দুই ভবেই শুধু জন্মগ্রহণ করেছি। অন্য কোনো গতি হয়েছে বলে আমার জানা নেই। ইহা আমার যথাযথা অনুশীলনেরই ফল।

২৪১.আমি ক্ষত্রিয় ও ব্রাহ্মণ এই দুই কুলেই শুধু জন্মগ্রহণ করেছি। কথনো নীচ কুলে জন্মেছি বলে আমার জানা নেই। ইহা আমার যথাযথা অনুশীলনেরই ফল।

২৪২.আজ থেকে শেষজন্মে আমি একজন ব্রাহ্মণ হয়েছি এবং শ্রাবস্তীর এক মহাধনাঢ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি।

২৪৩.আমার মাতার নাম চন্দ্রাবতী ও পিতার নাম অশ্বলায়ন। বুদ্ধ আমার পিতাকে সর্বতোভাবে শুদ্ধ ও বিনীত করেছিলেন।

২৪৪.তারপর একদিন আমি সুগতের প্রতি পসন্ন হয়ে অনাগারিক প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছিলাম। আমার আচার্য মোদ্গল্লায়ন ও উপাধ্যায় সারিপুত্র।

২৪৫.প্রব্রজ্যা গ্রহণের সময় যখন আমার কেশছেদন করা হচ্ছিল তখনই আমার মিথ্যাদৃষ্টি সমূলে ছিন্ন হয়েছিল। আর চীবর পরিধানের সময় আমি অর্হত্ত্ব লাভ করেছিলাম।

২৪৬.অথর্, ধর্ম, নিরুক্তি ও প্রতিভাণ এই চারি প্রতিসমিদায়্ভ আমার জ্ঞান দেখে লোকাগ্র বুদ্ধ আমাকে শ্রেষ্ঠপদে বসিয়েছিলেন।

২৪৭.উপধ্যায় উপতিষ্য (সারিপুত্র) সপ্রতিভভাবেই বিশ্লষণ করেছিলাম। তাই আমিই সম্যকসম্বুদ্ধের শাসনে প্রতিমমিদালাভীদের্ভ মধ্যে শ্রেষ্ঠ।

২৪৮.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

২৪৯.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

২৫০.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য য়ছি।হ েঠিক এভাবেই আয়ুষ্মান মহাকোটইঠকস্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন।

[মহাকোটঠিক স্থবির অপদান সপ্তম সমাপ্ত]

৮. উরুবেলা কাশ্যপ স্থবির অপদান

এই স্থবিরও অতীত বুদ্ধগণের নিকট বিাবিধপুণ্যকর্ম করে জন্মজন্মান্তরে সুখদপুণ্যসঞ্চয় করতে করতে পদুমুত্তর ভগবানের সময়এক কুলিনপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। একদিন তিনি শাস্তার ধর্মদেশনা শুনতে গেলেন। তখন শাস্তা এক ভিক্ষুকে মহাপরিষদলাভী ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠপদে বসাচ্ছিলেন। তা দেখে তিনি নিজে ও সেই শ্রেষ্ঠপদ লাভের আশায় মহাদান দিলেন এবং প্রাথর্না করলেন। তখন ভগবান তাকে বললেন, তুমি গৌতম বুদ্ধের শাসনে মহাপরিষদলাভী ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠপদ লাভ করবে।

তারপর তিনি আজীবন পুণ্যকর্ম করে মৃত্যুর পর দেবমনুষ্যলোকে বহুকাল বিচরণ করেন। আজ থেকে বিরানব্বই কল্প আগে তিনি ফুশ্য ভগবানেরবৈমাত্রেয় ভাই হয়ে জন্মগ্রহণ করেন।

তার আরও দুজন ভাই ছিল। তারা তিনজন মিলে বুদ্ধপ্রমুখ ভিক্ষুসংঘকে পরম পূজায় পূজা করেন। তারপর তারা দীর্ঘকাল পর আমাদের এই গৌতম বুদ্ধের জন্ম নেওয়ার কিছুকাল আগে বারাণসীতে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে সহোদর হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। কাশ্যপ গোত্রে জন্ম নেওয়ায় তারা তিনজনই কাশ্যপ নামে পরিচিত ছিলেন। প্রাপ্তবয়স্ক হলে পরে তারা ত্রিবেদ শিক্ষা করেন। তন্মধ্যে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার পাঁচশত, মধ্যম ভ্রাতার তিন শত এবং কনিষ্ঠ ভ্রাতার দুইশত পরিষদ ছিল। তারা গ্রন্থগুলোর সারবত্তা উপলদ্ধি করে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। তারপর অগ্রজ কাশ্যপ নিজ পরিষদকে নিয়ে উরুবেলায় গিয়ে ঋষি প্রব্রজ্যা গ্রহণ পূর্বক উরুবেলা কাশ্যপ নামে পরিচিত হন। মধ্যম কাশ্যপ মহাগঙ্গা নদীর বাঁকে ছিলেন বিধায় তিনি নদীকাশ্যপ নামে পরিচিত হন। আর কনিষ্ঠ কাশ্যপ গয়াশীর্ষে ছিলেন বিধায় গয়াকাশ্যপ নামে পরিচিত হন। এই তিনজন ঋষি সপরিষদ বহুকাল সেখানে বাস করেন।

তখন আমাদের গৌতম বোধিসত্ত্ব মহাভিনিষ্ক্রমণ করে বুদ্ধত্ব লাভ করেন এবং বারাণসীতে ধর্মচক্র প্রবর্তন করেন। সেখানে পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুদেরঅর্হত্ত্বফলে প্রতিষ্ঠিত করেন। ভগবান যশ স্থবির প্রমুখ পঞ্চান্ন জন বন্ধুকে অর্হত্ত্বফলে প্রতিষ্ঠিত করার পর আদেশ করেন ,যে‘হে ভিক্ষুগণ, তোমরা দিকে দিকে বিচরণ কর।’

তারপর ভগবান ভদ্রবর্গীয় কুমারদের দমন করে উরুবেলা কাশ্যপের বাসস্থানে উপনীত হন এবং তাঁর অগ্নিশালায় বাস করেন। সেখানে কিছুদিন থাকারপর নাগদমন প্রভৃতি৩৫০০ প্রকার ঋদ্ধি প্রদর্শন করে সপরিষদ উরুবেলা কাশ্যপকে প্রব্রজ্যা প্রদান করেন। তাঁর প্রব্রজ্যা গ্রহণের কথা শুনে অন্য দুজন ভাইও সপরিষদ বুদ্ধের নিকটে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেন। সবাই ঋদ্ধিময় উপসম্পদা লাভ করেন। ভগবান সেই এক হাজার ভিক্ষুকে সঙ্গে নিয়ে গয়াশীর্ষে এক সুবিস্তৃত পাথরের উপর বসেন এবং আদিত্য পর্যায় সূত্র দেশনা করে সকলকে অর্হত্ত্বফলে প্রতিষ্ঠিত করেন।

অর্হত্ত্ব লাভের পর তিনি আনন্দিত মনে নিজের পূর্বজীবনের কাহিনি প্রকাশ করতে গিয়ে ‘পদুমুত্তর জিন’ প্রভৃতি গাথা বলেছিলেন।

২৫১.আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে পৃথিবীতে সর্বলোকবিদ মুনি চক্ষুষ্মান জিন পদুমুত্তর বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন।

২৫২.তিনি উদেস্‌ঠ, বিজ্ঞাপক, সকল প্রাণির তীর্ণকারী ও দেশনাকুশল বুদ্ধ। তখন তিনি বহুজনতাকে সংসার সাগর তীর্ন করে দিয়েছিলেন।

২৫৩.তিনি ছিলেন পরম অনুকম্পাকারী, কারুনিক, ও সকল প্রাণির পরম হিতৈষী। তিনি তখনকার অন্যতীর্থিয়দের পঞ্চশীলে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

২৫৪.এভাবেই তিনি সম্পূর্ণ নিরাকুল ও অন্যতীর্থিয়শূন্য হয়ে বশীভূত ক্ষীণাসব অর্হৎ-পরিবেষ্টিত হয়ে অবস্থান করেছিলেন।

২৫৫.সেই মহামুনি আটান্ন প্রকার নত্নে গৌরবমণ্ডিত, উজ্জ্বল কাঞ্চনতুল্য ও বত্রিশ মহাপুরুষলক্ষণ বিশিষ্ট।

২৫৬.সেই সময় মানুষের গড় আয়ু ছিল লক্ষ বৎসর। তিনি পরিপূর্ণ আয়ু জীবিত থেকে বহু জনতাকে তীর্ণ করেছিলেন।

২৫৭.তখন আমি হংসবতী নগরে এক সাধু ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মেছিলাম। একদিন লোকপ্রদ্যেৎ বুদ্ধের কাছে গিয়েতাঁর ধর্মদেশনা শুনেছিলাম।

২৫৮.তখন তিনি তার এক শ্রাবককে মহাপরিষদ লাভী ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রষ্ঠপদে েবসাচ্ছিলেন। তা শুনে আমি ভীষণভাবে প্রীত হয়েছিলাম।

২৫৯.আমি মহতি পরিষদসহ মহাজিন বুদ্ধকে নিমন্ত্রন করে মহাদান দিয়েছিলাম।

২৬০.মহাদান দেওয়ার পর আমি নায়ক বুদ্ধকে অভিবাদন করেছিলাম। তারপর একপার্শ্বে দাঁড়িয়ে হৃষ্টমনে এই কথা নিবেদন করেছিলাম:

২৬১. হে বীর, আপনার প্রতি অচলা শ্রদ্ধাবশত ও কৃতপুণ্যবলে জন্মজন্মান্তরে আমার বিশাল পরিষদ লাভ হোক!

২৬২-২৬৩. তখন শাস্তা কোকিলেরন্যায় মধুর স্বরে পরিষদকে বলেছিলেন, হে ভিক্ষুগণ, এই ব্রাহ্মণকে দেখো তো যে হেমবর্ণের অধিকারী, বিশাল বাহুধারী, কোমল নয়নধারী, উদগ্রতনু, হৃষ্ট ও আমার গুণে ভীষণ শ্রদ্ধাশীল।

২৬৪.এই ব্যক্তি সিংহনাদ করে সেই শ্রেষ্ঠপদ লাভের প্রার্থনা করছে। আমি দৃঢ়ভাবে বলছি যে, সুদীর্ঘকাল পরে ভবিষ্যতেতার মনোরথ পূর্ন হবে।

২৬৫.আজ থেকে লক্ষ কল্প পরে ওক্কাকুকুলে গৌতম নামক শাস্তা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করবেন।

২৬৬.সে তাঁর ধর্মে ধর্মৌরসজাত উত্তরাধিকারী হয়ে কাশ্যপ গোত্রীয় শাস্তাশ্রাবক হবে।

২৬৭.আজ থেকে বিরানব্বই কল্প আগে এক অনুপম, অসদৃশ, অনুত্তর শাস্তা, লোকাগ্রনায়ক ফুশ্যবুদ্ধ ছিলেন।

২৬৮.তিনি সমস্ত অন্ধকার বিদূরিত করে কামজটাকে বিজটিত করেছিলেন এবং অমৃত বারি বর্ষণ করে দেবমনুষ্যদের পরিতৃপ্ত করেছিলেন।

২৬৯.তখন আমরা বারাণসী রাজার পুত্র তিন ভাই ছিলাম। আমরা পিতার খুবই বিশ্বাস ভাজন ছিলাম।

২৭০.আমরা ছিলাম বীর, প্রবল পরাক্রমী, শক্তিশালী ও সংগ্রামে অপরাজিত। কতখন এক প্রত্যন্ত রাজ্যেবিদ্রেহ দেখা দিলে মহারাজ পিতা আমাদের বললেন ;

২৭১.বৎসগণ, এদিকে এসো। বিশাল সৈন্যবাহিনী সঙ্গে নিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে উৎপন্ন বিদ্রোহ দমন কর। বিদ্রোহ দমন করে ফিরে এসে তোমরা বর চাইতে পার।

২৭২.তখন আমরা বলেছিলাম, হে পিত, আপনি যদি আমাদের নায়ক বুদ্ধকে সেবাপূজার সুযোগ দেন, তবে আমরা অবশ্যই বিদ্রোহ দমন করব।

২৭৩.মহারাজ পিতা আমাদের সেই বর দিলেন। আমরা বর পেয়ে বিপুর অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সেই প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে বিদ্রোহ দমন করে ফিরে এসেছিলাম।

২৭৪.তারপর আমরা আমদের প্রাপ্যবর লোকনায়ক বুদ্ধকে সেবাপূজা করারপ্রার্থনা করেছিলাম। বর পেয়ে আমরা আমৃত্যকাল বুদ্ধসেবায়আত্মনিয়োগ করেছিলাম।

২৭৫-২৭৬. আমরা শীলবান, কারুণিক ও ভাবনানিরত বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষুসংঘকে ধর্মতভাবে উপার্জিত মহার্ঘ বস্ত্র, উত্তম উত্তম রসযুক্ত খাদ্য-ভোজ্য ও সুন্দন সুন্দর শয্যাসন দান করেছিলাম।

২৭৭.আমরা পরম শ্রদ্ধায় ও মৈত্রীতদগতচিত্তে নায়ক বুদ্ধকে সেবা-পূজা করেছিলাম। এমনকি তাঁর পরিনির্বাণের পর ও শক্তিপ্রশাণে পূজা করেছিলাম।

২৭৮.মৃতুর পর আমরা সবাই তাবতিংস দেবলোকে জন্মেছিলাম এবং সেখানে মহাসুখ ভোগ করেছিলাম। ইহা আমাদের বুদ্ধপূজা করারই ফল।

২৭৯.মায়াকারেরা যেমন মঞ্চে নানা দৃশ্যের অবতারনা করেন, তদ্রু আমি ভবভবান্তরে ভ্রমণের সময় বিদেহাধিপতি হয়েছিলাম।

২৮০.গুণাচেলর কথায় আমি ভীষণ মিথ্যাদৃষ্টিপরায়ন হয়েছিলাম। তাতে করে আমি প্রায় নরক মার্গারূঢ় হয়েছিলাম।

২৮১.নারদ ব্রাহ্মণ (বুদ্ধ) আমাকে সিংহনাদে উপদেশ দিয়ে বহুভাবে তা থেকে শান্ত, নিবৃত করেছিলেন। তারপর আমি সেই পাপদৃষ্টি ত্যাগ করেছিলাম।

২৮২.তখন আমি দশবিধ কর্মপথ বিশেষভাবে পূরণ করেছিলাম। আর তাতে করে আমি মৃত্যুর পর নিজ ঘরে প্রত্যাবর্তনের ন্যায় স্বর্গে জন্মগ্রহণ করেছিলাম।

২৮৩.আজ এই শেষ জন্মে আমি বারাণসীর এক ব্রাহ্মণ মহাশাল কুলে ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মগ্রহণ করেছি।

২৮৪.মৃত্যু, জরা, ব্যাধিতে ভীত হয়ে আমি মহাধন ত্যাগ করে নির্বাণের সন্ধানে জটিল সন্ন্যাসীদের নিকট প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছিলাম।

২৮৫.আমাকে দেখে আমার দুই ভাইও আমার সাথে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছিল। আমি উরুবেলায় একটি আশ্রম তৈরি করে বসবাস করেছিলাম।

২৮৬.আমার জন্ম কাশ্যপ গোত্রে হওয়ায় ও উরুবেলাকে আশ্রয় করে সববাস করায় আমি উরুবেল কাশ্যপ নামেই সবিশেষ পরিচিত হয়েছিলাম।

২৮৭.নদীর কাছাকাছি বাঁকে বসবাস করায় আমার এক ভাইযের নাম নদী কাশ্যপ আর গয়াশীর্ষে বসবাস করায় আমার অন্য ভাইয়ের নাম গয়াকাশ্যপ হয়েছিল।

২৮৮.আমার কনিষ্ট ভাইয়ের দুইশত, মধ্যম ভাইয়ের তিনশত আর আমার পাঁচশত অনুগত শিষ্য ছিল।

২৮৯.তখন লোকাগ্র নায়ক, নরসারথি বুদ্ধ আমার কাছে উপনীত হয়ে নানা প্রকার ঋদ্ধি প্রতিহার্য দেখিয়ে আমাকে বিনীত করেছিলেন।

২৯০. আমাদের তিন ভাইয়ের মোট এক হাজার ভিক্ষুকে তিনি ‘এসো ভিক্ষু’ বলে উপসম্পদা দিয়েছিলেন। আমরা সবাই একসাথে অর্হত্ত্ব লাভ করেছিলাম।

২৯১-২৯২. সেই এক হাজার জন শিষ্য ও অন্য অনেক শিষ্য আমাকে পরিবৃত করে থাকত। আমি তাদের অনুশাসন করতে পারতাম। তাই ঋষিশ্রেষ্ঠ বুদ্ধ আমাকে মহাপরিষদ লাভী ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। অহা, বুদ্ধের কাছে কৃতপুন্যের কী প্রভাব! আজ আমার মনোরথ পূর্ণ হয়েছে।

২৯৩.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

২৯৪.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

২৯৫.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি। ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মানউরুবেলা কাশ্যপ স্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন।

[উরুবেলা কাশ্যপ স্থবির অপদান অষ্টম সমাপ্ত]

৯.রাধ স্থবির অপদান

২৯৬.আজ থেকে লক্ষ কল্প আগে পৃথিবীতে সর্বলোকবিদ মুনি চক্ষুষ্মান জিন পদুমুত্তর বুদ্ধ উৎপন্ন হয়েছিলেন।

২৯৭.তিনি উপদেষ্টা, বিজ্ঞাপক, সকলপ্রাণির তীর্ণকারী ও দেশনাকুশল বুদ্ধ। তখন তিনি বহু জনতাকে সংসার সাগর তীর্ণ করে দিয়েছিলেন।

২৯৮.তিনি ছিলেন পরম অনুকম্পকারী, কারুনিক, ও সকল প্রাণির পরম হিতৈষী। তিনি তখনকার অন্যতীর্থিদের পঞ্চশীলে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

২৯৯.এভাবেই তিনি সম্পূর্ণ নিরাকুল ও তর্ীয়িশূন্য হয়ে ও বশীভূত ক্ষীণাসব অর্হৎ পরিবেষ্টিত হয়ে অবস্থান করেছিলেন।

৩০০.সেই মহামুনি আটান্ন প্রকার রত্নে গৌরবমণ্ডিত, উজ্জ্বল কাঞ্চনতুল্য ও বত্রিশ মহাপুরুষলক্ষণ বিশিষ্ট।

৩০১.সেই সময় মানুষের গড় আয়ু ছিল লক্ষ বৎসর। তিনি পরিপূর্ণ আয়ু জীবিত থেকে বহুজনতাকে তীর্ণ করেছিলেন।

৩০২.তখন আমি হংসবতী নগরে এক মন্ত্রধর ব্রাহ্মণ হয়ে জন্মেছিলাম। একদিন আমি সেই নরশ্রেষ্ঠ বুদ্ধের কাছে গিয়েতাঁর ধর্মদেশনা শুনছিলাম।

৩০৩.তখন মহাবীর, পরিষদে বিশারদ, বিনায়ক বুদ্ধ এক ভিক্ষুকে প্রতিভাণক তথা জ্ঞানবান ভিক্ষুদের মধ্যে শেষ্ঠপদে বসাচ্ছিলেন।

৩০৪.তখন আমি লোকনায়ক বুদ্ধ প্রমুখ ভিক্ষুসংঘের উদ্দেশে বহু পুণ্যকার্য করে তাঁর পায়ে মাথা ঠেকিয়ে সেই শ্রেষ্ঠপদ প্রার্থনা করেছিলাম।

৩০৫.তখন ক্লেশমনলমুক্ত ও সুবর্ণখণ্ডের ন্যায় প্রভাময় ভগবান আমাকে লক্ষ করে মধুর কণ্ঠে বলেছিলেন:

৩০৬.সুখী হও। দীর্ঘায়ু হও। তোমার প্রার্থনা পূর্ণ হোক। তুমি যে আমার ওভিক্ষুসংঘের উদ্দেশ্যে বিপুলপুণ্যকার্য করেছ!

৩০৭.আজ থেকে লক্ষ কল্প পরে ওক্কাকুকুলে গৌতম নামক শাস্তা পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করবেন।

৩০৮.তাঁর ধর্মে সে ধর্মৌরসজাত উত্তরাধিকারী রাধ নামে শাস্তাশ্রাবক হবে।

৩০৯.শাক্যপুত্র নরশ্রেষ্ঠ নায়ক বুদ্ধ তার পূর্বহেতুগুণ দেখে তুষ্ট হয়ে তাকে প্রতিভাণক তথা জ্ঞানবান ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠপদেপ্রতিষ্ঠিত করবেন।

৩১০.তা শুনে আমি ভীষণ রকম খুশী হয়েছিলাম। তখন আমি আজীবন স্মৃতিমান ও প্রজ্ঞাসমন্বিত হয়ে মৈত্রীচিত্তে পদুমুত্তর জিনকে সেবা-পরিচর্যা করেছিলাম।

৩১১.সেই সুকৃতপুণ্যপ্রভাবে ও প্রার্থনা অনুসারে মনুষ্যদেহ ত্যাগ করে আমি তাবতিংস দেবলোকে জন্ম নিয়েছিলাম।

৩১২.আমি তিনশত বার দেবলোকে দেবরাজত্ব করেছিলাম এবং পাঁচশতবার চক্রবর্তী রাজা হয়েছিলাম।

৩১৩.আর প্রাদেসিক রাজা তো অসংখ্যবার হয়েছিলাম। সেই কর্মের ফলে আমি সর্বত্রই সুখী হয়েছিলাম।

৩১৪.এই শেষ জন্মে আমি গিরিব্বজ নগরে এক ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি।

৩১৫.একদিন আমি সারিপুত্রস্থবিরকে মাত্র একচামচ ভিক্ষা দান করেছিলাম। আমি জরাজীর্ণ হযে বৃদ্ধবয়সে প্রব্রজ্যা গ্রহণ করতে বিহারে গিয়েছিলাম।

৩১৬.জরাজীর্ণ, বৃদ্ধ ও দুর্বল হওয়ায় আমাকে কেউই প্রব্রজ্যা দিচ্ছিল ।নাতাই আমি ভীষণ দুঃখিত, বিষন্নবদন ও শোকগ্রস্ত হয়েছিলাম।

৩১৭.মহামুনি, মহাকারুণিক বুদ্ধ শোকগ্রস্ত আমাকে দেখে বলেছিলেন, বৎস, কী হয়েছে তোমার? তুমি এত শোক করছ কেন? বল দেখি কী হয়েছে তোমার?

৩১৮.হে বীর, আপনার সুব্যাখ্যাত ধর্মশাসনে আমি প্রব্রজ্যা গ্রহণ করতে পারছিনা। তাই আমি শোক করছি। হে নায়ক, আপনি আমার সহায় হোন!

৩১৯.তখন মুনিশ্রেষ্ঠ বুদ্ধ ভিক্ষুসংঘকে ডেকে জিজ্ঞেসরছিলেন,ক েহে ভিক্ষুগণ, দেখতো এই ব্যক্তি তোমাদের কাউকে কোনোদিন উপকার করেছে বলে স্মরণ করতে পার কি না ? সে যদি কাউকে উপকার করে থাকে, তবে সে-ই তাকে প্রব্রজ্যা প্রদান করুক।

৩২০.তখন সারিপুত্র বরেছিলেন, ভন্তে ভগবান, আমি স্মরণ করতে পারি। আমি পিণ্ডচারণ করতে গেলে একদিন সে আমাকে এক চামচ ভিক্ষা দিয়েছিল।

৩২১.(ভগবান বলেছিলেন) ‘সাধু, সাধু, সাধু, সারিপুত্র, তুমি কৃতজ্ঞ। তাহলে তুমিই তাকে প্রব্রজ্যা প্রদান কর। এ জ্ঞানগনদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ হবে।

৩২২.তারপর আমি প্রব্রজ্যা এবং উপসম্পদা উভই লাভ করলাম। অচিরেই আমি আসবক্ষয়জ্ঞানও লাভ করলাম।

৩২৩.আমি মুনিশ্রেষ্ঠ বুদ্ধের কথা খুব মন দিয়ে শুনতাম এবং শুনে ভীষণ খুশী হতাম। তারপর একদিন জিনশ্রেষ্ঠ বুদ্ধ আমাকে প্রতিভাণক তথা জ্ঞানবান ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠপদে বসালেন।

৩২৪.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

৩২৫.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

৩২৬.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি। ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মানরাধ স্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন।

[রাধ স্থবির অপদান নবম সমাপ্ত]

১০.মোগরাজ স্থবির অপদান

৩২৭.এই হতে ৩৩২ নং পর্যন্ত পূর্বেক্ত ২৯৬ নং হতে ৩০১ নং ক্রমিকের ন্যায় জ্ঞাতব্য।

৩৩৩.তখন আমি হংসবতী নগরে জনৈক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলাম। আমি পরের কাজ করেই জীবিকা নির্বাহ করতাম। তখন আমার তেমন কোনো ধন সম্পত্তি ছিল না।

৩৩৪.একসময় আমি এক প্রত্যাবর্তনশালায় বাস করছিলাম। তখন সেখানে আমি আগুন জ্বালিয়ে, মাটি পুড়িয়ে দগ্ধ কালো শিলা তৈরি করছিলাম।

৩৩৫.ঠিক সেই সময় চতুসর্ত্য প্রকাশক নাথ বুদ্ধ তার পরিষদে একজন জীর্ণশীর্ণ চীবরধারী ভিক্ষুর ভূয়শী প্রশংসা করছিলেন।

৩৩৬.তাঁর গুণের কথা শুনে আমি ভীষণ রকম তুষ্ট হয়েছিলাম। তারপর তথাগতে পায়ে পড়ে আমি সেই শ্রেষ্ঠপদ লাভের প্রার্থনা করেছিলাম।

৩৩৭-৩৩৮. তখন পদুমুত্তর ভগবানতাঁর শ্রাবকদের বলেছিলেন, হে ভিক্ষুগণ, শীর্ণকায়, কুঁজো, প্রীতিপ্রসন্নবদন, শ্রদ্ধাধন সমন্বিত, উদগ্রতনু, হৃষ্টচিত্ত ও অচল শালপিণ্ড তুল্য এই লোকটিকে দেখ।

৩৩৯.এই ব্যক্তি জীর্ণ চীবরধারী সত্যসেন ভিক্ষুর ভূয়শী প্রশংসা শুনে সেই শ্রেষ্ঠপদ লাভের প্রার্থনা করছে।

৩৪০.তা শুনে আমি ভীষণ খুশী হয়েছিলাম। আমি নতশিরে জিনশাসনে আজীবন শুভকর্ম করেছিলাম।

৩৪১.সেই সুকৃত কর্মের ফলে ও প্রার্থনা অনুসারে মনুষ্যদেহ ত্যাগ করে আমি তাবতিংস স্বর্গে জন্মেছিলাম।

৩৪২.আমি প্রত্যাবর্তন শালায় ভূমিদাহ কর্ম করার কারণে সুদীর্ঘকাল নিরয়ে বিষম বেদনার্ত হয়ে দগ্ধ হয়েছিলাম।

৩৪৩.সেই কর্মবশেষে আমি পাঁচশত জন্ম মনুষ্যকুলে উচ্চবংশে জন্মগ্রহণ করেছিলাম।

৩৪৪.সেই কর্মের ফলে আমি পাঁচশত জন্ম কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে মহাদুঃখ ভোগ করেছিলাম।

৩৪৫.এই ভদ্রকল্পে পূর্বেকার যশস্বী বুদ্ধকে প্রসন্নমনে পিণ্ডপাত দান করে পরিতৃপ্ত করেছিলাম।

৩৪৬.সেই সুকৃত কর্মের ফলে ও প্রার্থনা অনুসারে মনুষ্যদেহ ত্যাগ করে আমি তাবতিংস স্বর্গে জন্মেছিলাম।

৩৪৭.এই শেষ জন্মে এসেও আমি ক্ষত্রিয় কুলে জন্মগ্রহণ করেছি। পিতার মৃত্যুর পর আমার উপরই রাজ্যভার বর্তায়।

৩৪৮.কুষ্ঠরোগাক্রান্ত হওয়ায় আমি কখনো রতি কিংবা সুখ পাইনি। আমার রাজ্যসুখ মোঘ তথা তুচ্ছ বিধায় আমি মোঘরাজ নামেই পরিচিত হলাম।

৩৪৯.আমি শরীরের দোষ দেখে অনাগারিক প্রব্রজ্যা গ্রহণ করেছিলাম। আমি দ্বিজশ্রেষ্ঠ বাবরি ব্রাহ্মণের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলাম।

৩৫০.একদিন আমি বিশাল পরিষদকে সঙ্গে করে নরনায়ক বুদ্ধের নিকট উপনীত হয়েছিলাম। আমি সেই বীর বুদ্ধকে কিছু নিপুণ প্রশ্ন করেছিলাম।

৩৫১.আমি মহাযশস্বী গৌতমের ইহলোক, পরলোক, দেবলোক, ব্রহ্মলোক, দেখতে পাই না এবং জানি না।

৩৫২.এমন অতিক্রান্তদর্শী আপনার উদ্দেশে আমার কিছুপ্রশ্ন আছে, সেটি হচ্ছে: ‘এই লোককে আপনি কীভাবে দেখেন, যাতে মৃত্যুরাজ দেখতে না পান ?’

৩৫৩.হে মোঘরাজ, যে ব্যক্তি এই লোককে শুন্য হিসেবে দেখেন, তবেই মৃত্যুরাজ তাকে দেখতে পান না।

৩৫৪.‘ এভাবে এই লোককে দেখলে পরে মৃত্যুরাজ মোটেই দেখতে পান না’ এই কথা সর্বরোগের চিকিৎসক বুদ্ধ আমাকে বলেছিলেন।

৩৫৫.এই গাথাটা শোনার সাথে সাথেই আমি কেশশ্মশ্রু মুণ্ডিত, কাষায় বস্ত্রধারী ভিক্ষু হয়ে গিয়েছিলাম।

৩৫৬.আমি রোগপীড়িত হওয়ায় সাংঘিক বিহারে বসবাস করিনি। আমার কারণে বিহারটি দূষিত না হোক এবং ভিক্ষুরা পীড়িত না হোক!

৩৫৭.আমি বিভিন্ন আবর্জনাস্তুপ, শ্মশান ও পথঘাট থেকে কাপড় সংগ্রহ করে, তা দিয়ে সংঘাটি তৈরি করে জীর্ণ চীবরই পরিধান করতাম।

৩৫৮.আমার সেই গুণে খুশী হয়ে মহান চিকিৎসক বিনায়ক বুদ্ধ আমাকে জীর্ণচীবরধারী ভিক্ষুদের মধ্যে শ্রেষ্ঠপদে বসিয়েছেন।

৩৫৯.আমি পুণ্যপাপ পরিক্ষীণ হয়ে, সর্ববিধ রোগ বিবর্জিত হয়ে শিখীর ন্যায় অলগ্নভাবে সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে পরিনির্বাপিত হবো।

৩৬০.আমার সমস্ত ক্লেশ দগ্ধ হয়েছে, আমার সমস্ত জন্ম বিধ্বংস হয়েছে এবং নাগের ন্যায় সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে আমি সম্পূর্ণ অনাসক্ত হয়ে অবস্থান করছি।

৩৬১.বুদ্ধের কাছে আসাটা আমার অতীব শুভপ্রদ হয়েছে। ত্রিবিদ্যা লাভ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

৩৬২.চারি প্রতিসমিদা্ভ ও ষড়াভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে আমি বুদ্ধের শাসনে কৃতকার্য হয়েছি।

ঠিক এভাবেই আয়ুষ্মানমোঘরাজ স্থবির এই গাথাগুলো ভাষণ করেছিলেন। [মোঘরাজ স্থবির অপদান দশম সমাপ্ত]

[কাচ্চায়ন বর্গ চুয়ান্নতম সমাপ্ত]

স্মারক-গাথা

কাচ্চায়ন, বক্কলি স্থবির, মহাকপ্পিন, মল্লপুত্র দব্ব, কুমারকাশ্যপ, বাহিয়, মহাকোটঠিক, উরুবেলাকাশ্যপ, রাধ ও পণ্ডিত মোঘরাজ স্থবির দশম

মোট তিনশ বাষট্টিটি গাথায় এই বর্গ সমাপ্ত।