৫. রোহিতস্‌সবগ্গো-রহিতাশ্ব বর্গ

১. সমাধিভাবনাসুত্তং - সমাধি ভাবনা সূত্র

৪১. “হে ভিক্ষুগণ! চার প্রকার সমাধিভাবনা। সেই চার প্রকার কি কি? যথা-কোন সমাধিভাবনা ভাবিত, বহুলীকৃত হলে এজীবনে সুখ বিহারার্থে সংবর্তিত করে। কোন সমাধিভাবনা ভাবিত, বহুলীকৃত হলে এ’জীবনে জ্ঞান দর্শন প্রীতিলাভার্থে সংবর্তিত করে। কোন সমাধিভাবনা ভাবিত, বহুলীকৃত, হলে এ’জীবনের স্মৃতি সমপ্রজ্ঞানার্থে সংবর্তিত করে। কোন সমাধিভাবনা ভাবিত, বহুলীকৃত হলে এ’জীবনে আস্রব ক্ষয়ার্থে সংবর্তিত করে।

কোন সমাধিভাবনা ভাবিত, বহুলীকৃত হলে এ’জীবনে সুখ বিহারার্থে সংবর্তিত করে? এজগতে কাম ও অকুশল ধর্ম হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিতর্ক, বিচার ও বিবেকজনিত প্রীতিসুখ সমন্বিত প্রথম ধ্যানস্তরে অবস্থান করে। সে বির্তক, বিচারের উপশম হেতু আভ্যন্তরীণ সমপ্রসাদ, চিত্তের একাগ্রতাযু্‌ক্ত বির্তক, বিচারহীন এবং সমাধিজনিত প্রীতিসুখ সমন্বিত দ্বিতীয় ধ্যানস্তরে অবস্থান করে। অতঃপর প্রীতিতে বিরাগ উৎপাদন হেতু উপেক্ষাশীল হয়ে অবস্থান করে। উপেক্ষাশীল, স্মৃতিমান, সুখবিহারী বলে এঅবস্থাকে আর্যগণ তৃতীয় ধ্যানস্তর বলে থাকেন। এবার সে শারীরিক সুখ-দুঃখ পরিত্যাগ এবং পূর্বের সৌর্মনস্য-দৌর্মনস্য অস্তগত করে সুখ-দুঃখহীন উপেক্ষা ও স্মৃতি পরিশুদ্ধ নামক চতুর্থ ধ্যানস্তরে অবস্থান করে। এই সমাধিভাবনা ভাবিত বহুলীকৃত হলে এ’জীবনে সুখ বিহারার্থে সংবর্তিত করে।

কোন সমাধি ভাবনা ভাবিত, বহুলীকৃত হলে জ্ঞান দর্শন প্রতিলাভার্থে সংবর্তিত করে? এজগতে ভিক্ষু আলোক সংজ্ঞায় মনোনিবেশ করে, দিবাসংজ্ঞা অধিষ্ঠান করে- যেভাবে দিনে সেভাবে রাতে, যেভাবে রাতে সেভাবে দিনে। এভাবে জাগ্রত মনে চিত্তের আলোকিত অংশ ভঙ্গ না করে ভাবনা করে। এ’সমাধিভাবনা ভাবিত, বহুলীকৃত হলে জ্ঞানদর্শন প্রতিলাভার্থে সংবর্তিত করে।

কোন সমাধিভাবনা ভাবিত, বহুলীকৃত হলে স্মৃতি সমপ্রজ্ঞানে সংবর্তিত করে? এজগতে ভিক্ষুর জ্ঞাত বেদনা উদয়, স্থিতি এবং বিলয় হয়ে যায়। জ্ঞাত সংজ্ঞা উদয়, স্থিতি এবং বিলয় হয়ে যায়। জ্ঞাত বিতর্ক উদয়, স্থিতি এবং বিলয় হয়ে যায়। এ’সমাধিভাবনা ভাবিত, বহুলীকৃত হলে স্মৃতি সমপ্রজ্ঞানে সংবর্তিত করে।

কোন সমাধিভাবনা ভাবিত, বহুলীকৃত হলে আস্রব ক্ষয়ার্থে সংবর্তিত করে? এজগতে ভিক্ষু পঞ্চস্কন্ধের উদয়-ব্যয়দর্শী হয়ে অবস্থান করে- ‘এটি রূপ, এটি রূপ সমুদয়, এটি রূপ নিরোধ; এটি বেদনা, এটি বেদনা সমুদয়, এটি বেদনা নিরোধ; এটি সংজ্ঞা, এটি সংজ্ঞা সমুদয়, এটি সংজ্ঞা নিরোধ; এটি সংস্কার, এটি সংস্কার সমুদয়, এটি সংস্কার নিরোধ; এটি বিজ্ঞান, এটি বিজ্ঞান সমুদয়, এটি বিজ্ঞান নিরোধ।’ এ’সমাধিভাবনা ভাবিত, বহুলীকৃত হলে আস্রব ক্ষয়ার্থে সংবর্তিত করে। সমাধিভাবনা ভাবিত, বহুলীকৃত হলে আস্রব ক্ষয়ার্থে সংবর্তিত করে। এই চার প্রকার সমাধি ভাবনা।”

ভিক্ষুগণ! পরিপূর্ণতা পূর্ণপ্রশ্নে চিত্তপ্রসাদে এটি ভাষিত হয়েছে-

“সব বিষয় সজ্ঞানে জ্ঞাত ধরাতলে যিনি,

নেই চঞ্চলতা তার, সদা স্থির তিনি।

শান্ত-দান্ত, ক্লেশহীন আর অনাসক্ত,

তাকে বলি আমি যথার্থ জন্ম জরা মুক্ত।”

(প্রথম সূত্র)

২. পঞ্‌হব্যাকরণসুত্তং - প্রশ্ন ব্যাখ্যা সূত্র

৪২. “হে ভিক্ষুগণ! চার প্রকার প্রশ্ন ব্যাখ্যা। সেই চার প্রকার কি কি? যথা- কোন প্রশ্ন যথার্থ ব্যাখ্যা করণীয়, কোন প্রশ্ন বিভাগ করে ব্যাখ্যা করণীয়, কোন প্রশ্ন প্রতিজিজ্ঞাসা দ্বারা ব্যাখ্যা করণীয়, কোন প্রশ্ন স্থাপনীয়। এই চার প্রকার প্রশ্নের ব্যাখ্যা।”

“প্রথমটি যথার্থ, পরেরটি বিভাগ করণে,

তৃতীয়টি জিজ্ঞাসায়, চতুর্থটি স্থাপনীয়ে।

অনুধাবণে এসবের যিনি সর্বত্র জানে,

চারি প্রশ্নে দক্ষ সেই ভিক্ষুকে বলে।

কৌশলী, সুনিপুণ, জ্ঞানবান অজেয় যিনি,

অর্থ-অনর্থ উভয়েই হন অভিজ্ঞ তিনি।

অনর্থ ত্যাগে, অর্থ গ্রহণে যিনি সুপণ্ডিত,

ধীর পণ্ডিত, নির্বাণজ্ঞানে বিভূষিত।” (দ্বিতীয় সূত্র)

৩. পঠমকোধগরূসুত্তং-ক্রোধপরায়ণ সূত্র (প্রথম)

৪৩. “হে ভিক্ষুগণ! জগতে চার প্রকার পুদ্গল বিদ্যমান। সেই চার প্রকার কি কি? যথা- কেউ ক্রোধ পরায়ণ হয়ে সত্যধর্মের প্রতি অবিশ্বাসী হয়, কেউ পরনিন্দা পরায়ণ হয়ে সত্যধর্মের প্রতি অবিশ্বাসী হয়, কেউ লাভ প্রত্যাশী হয়ে সত্যধর্মের প্রতি অবিশ্বাসী হয়, কেউ সৎকার প্রত্যাশী হয়ে সত্যধর্মের প্রতি অবিশ্বাসী হয়। জগতে এ’চার প্রকার পুদ্গল বিদ্যমান।

হে ভিক্ষুগণ! জগতে (আরো) চার প্রকার পুদ্গল বিদ্যমান। সেই চার প্রকার কি কি? যথা- কেউ সত্যধর্মের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে ক্রোধ পরায়ণ হয় না, কেউ সত্যধর্মের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে পরনিন্দা পরায়ণ হয় না, কেউ সত্যধর্মের প্রতি বিশ্বাসী লাভ প্রত্যাশী হয় না, কেউ সত্যধর্মের প্রতি বিশ্বাসী হয়ে সৎকার প্রত্যাশী হয় না। জগতে এই চার প্রকার পুদ্গল বিদ্যমান।

“ক্রোধী, নিন্দুক, লাভ সৎকার প্রত্যাশে,

ধর্মে অবর্ধিত তারা সম্বুদ্ধের ভাষাতে।

সদ্ধর্ম বিশ্বাসী হয়ে করে বিহার, বিচরণ,

ধর্মে বর্ধিত তারা সম্বুদ্ধের এই দেশন।”

(তৃতীয় সূত্র)

৪. দুতিযকোধগরূসুত্তং-ক্রোধপরায়ণ সূত্র (দ্বিতীয়)

৪৪. “হে ভিক্ষুগণ! অসদ্ধর্ম চার প্রকার। সেই চার প্রকার কি কি? যথা- ক্রোধ করাটা অসদ্ধর্ম, পরনিন্দা করাটা অসদ্ধর্ম, লাভ প্রত্যাশা করাটা অসদ্ধর্ম, সৎকার প্রত্যাশা করাটা অসদ্ধর্ম। এই চার প্রকার অসদ্ধর্ম।

হে ভিক্ষুগণ! সদ্ধর্ম চার প্রকার। সেই চার প্রকার কি কি? যথা- ক্রোধ না করাটা সদ্ধর্ম, পরনিন্দা না করাটা সদ্ধর্ম, লাভ প্রত্যাশা না করাটা সদ্ধর্ম, সৎকার প্রত্যাশা না করাটা সদ্ধর্ম। এই চার প্রকার সদ্ধর্ম।”

“ক্রোধী, নিন্দুক, লাভ-সৎকার প্রত্যাশী,

উর্বরক্ষেত্রে নষ্টবীজ, সদ্ধর্মে উন্নতি নাশী।

সদ্ধর্ম বিশ্বাসী হয়ে করে অবস্থান বিচরণ,

সদ্ধর্মে উন্নতি তাদের, আদরনীয় হন।”

(চতুর্থ সূত্র)

৫. রোহিতস্‌সসুত্তং- রোহিতাশ্ব সূত্র

৪৫. একসময় ভগবান শ্রাবস্তীতে অনাথপিণ্ডিকের নির্মিত জেতবন বিহারে অবস্থান করছিলেন। তখন দিব্য আভরণে সজ্জিত দেবপুত্র রোহিতাশ্ব দিব্য জ্যোতিতে সমুদয় জেতবন আলোকিত করে শেষরাতে ভগবানের নিকট উপস্থিত হলেন। উপস্থিত হয়ে ভগবানকে অভিবাদন করতঃ একপার্শ্বে দাঁড়ালেন। একপার্শ্বে দাঁড়ানো দেবপুত্র রোহিতাশ্ব ভগবানকে এরূপ বললেন- “ভন্তে! যেখানে জন্ম নেই, জরা নেই, ধ্বংস নেই, মৃত্যু নেই ও উৎপত্তি রহিত নির্বাণলোকে (জগতের অন্তর) কেউ পদব্রজে গমণ করে জ্ঞাত হতে, দর্শন করতে এবং উপস্থিত হতে সক্ষম কি”? তদুত্তরে ভগবান বললেন- আবুসো! যেখানে জন্ম নেই, জরা নেই, ধ্বংস নেই, মৃত্যু নেই ও উৎপত্তি রহিত নির্বাণলোকে কেউ পদব্রজে গমণ করে জ্ঞাত হতে, দর্শন করতে এবং উপস্থিত হতে সক্ষম আমি এরূপ বলি না।”

খুবই আশ্চর্য! খুবই অদ্ভুত! ভন্তে; ভগবান কর্তৃক সুন্দরভাবে ভাষিত হয়েছে যে- “আবুসো! যেখানে জন্ম নেই, জরা নেই, ধ্বংস নেই, মৃত্যু নেই ও উৎপত্তি রহিত নির্বাণলোকে কেউ পদব্রজে গমণ করে জ্ঞাত হতে, দর্শন করতে এবং উপস্থিত হতে সক্ষম আমি এরূপ বলি না।”

“ভন্তে, অনেক আগে আমি ঋদ্ধিমান, আকাশপথে গমনকারী ভোজপুত্র রোহিতাশ্ব নামক তাপস ছিলাম। সেই সময় আমার এরূপ গতিবেগ ছিল, যেমন- ধনুবিদ্যায় পারদর্শী, দক্ষ, সুশিক্ষিত, সিদ্ধহস্ত, সুনিপুন ব্যক্তি ক্ষিপ্রভাবে ছুড়া তীর দ্বারা অনায়াসে আড়াআড়ি তালবৃক্ষ ভেদ করতে পারে। আমার এরূপ পদক্ষেপ ছিল, যেমন- পূর্ব সমুদ্র হতে পশ্চিম সমুদ্র পর্যন্ত। এ’রকম গতি ও পদক্ষেপের কারণে আমার এবম্বিধ ইচ্ছা উৎপন্ন হতো- ‘আমি পদব্রজে গমনে নির্বাণলোকে উপস্থিত হই’। সেই আমি ভোজন-পান ও মল-মূত্র এবং নিদ্রা-ক্লান্তি অপসারিত করে শতবর্ষ আয়ু, শতবর্ষ জীবি হওতঃ শতবর্ষ অতিক্রম করেও পদব্রজে গমনে নির্বাণলোকে উপস্থিত হতে না পেরে মহাকাশে মৃত্যুবরণ করি।

খুবই আশ্চর্য! খুবই অদ্ভুত! ভন্তে; ভগবান কর্তৃক সুন্দরভাবে ভাষিত হয়েছে যে, “আবুসো! যেখানে জন্ম নেই, জরা নেই, ধ্বংস নেই, মৃত্যু নেই ও উৎপত্তি রহিত নির্বাণলোকে কেউ পদব্রজে গমণ করে জ্ঞাত হতে, দর্শন করতে এবং উপস্থিত হতে সক্ষম আমি এরূপ বলি না।”

“আবুসো! যেখানে জন্ম নেই, জরা নেই, ধ্বংস নেই, মৃত্যু নেই ও উৎপত্তি রহিত নির্বাণলোকে কেউ পদব্রজে গমণ করে জ্ঞাত হতে, দর্শন করতে এবং উপস্থিত হতে সক্ষম আমি এরূপ বলি না। অন্যদিকে পদব্রজে গমণ করে নির্বাণলোকে উপস্থিত হতে পারাকে আমি দুঃখের অন্তসাধন বলি না। আমি স্ব-সংজ্ঞাযুক্ত এই ব্যামপ্রমাণ কলেবরে অর্থাৎ পঞ্চস্কন্ধে- লোক, লোকসমুদয়, লোকনিরোধ, লোকনিরোধের উপায় দেখতেছি।”

“গমনে জগতের অন্ত লাভ হয় না কখন,

জগতান্ত প্রাপ্তেও না হয় দুঃখে মুক্তন।

লোকবিদূ সুমেধ, বিজ্ঞ লোক উৎপত্তিতে,

লোকান্তেও বেদগূ, পরিপূর্ণ ব্রহ্মচর্যেতে।

লোক অন্তে শান্ত জেনে করে অবস্থান,

পরলোক নাশে তিনি অতি মহান।”

(পঞ্চম সূত্র)

৬. দুতিযরোহিতস্‌সসুত্তং-রোহিতাশ্ব সূত্র (দ্বিতীয়)

৪৬. অতঃপর ভগবান সেই রাতের অবসানে ভিক্ষুগণকে আহ্বান করে বললেন- “হে ভিক্ষুগণ! এ’রাতে দিব্য আভরণে সজ্জিত দেবপুত্র রোহিতাশ্ব সম্পূর্ণ জেতবন আলোকিত করে আমার নিকট উপস্থিত হয়েছিল। উপস্থিত হয়ে অভিবাদন করতঃ একপার্শ্বে দাঁড়াল। স্থিত অবস্থায় আমাকে জিজ্ঞাসা করল- “ভন্তে! যেখানে জন্ম নেই, জরা নেই, ধ্বংস নেই, মৃত্যু নেই ও উৎপত্তি রহিত নির্বাণলোকে কেউ পদব্রজে গমণ করে জ্ঞাত হতে, দর্শন করতে এবং উপস্থিত হতে সক্ষম কি?” রোহিতাশ্ব এরূপ বললে আমি তাকে বলি- “আবুসো, যেখানে জন্ম নেই, জরা নেই, ধ্বংস নেই, মৃত্যু নেই ও উৎপত্তি রহিত নির্বাণলোকে কেউ পদব্রজে গমণ করে জ্ঞাত হতে, দর্শন করতে এবং উপস্থিত হতে সক্ষম আমি এরূপ বলি না।” অতঃপর দেবপুত্র রোহিতাশ্ব আমাকে এরূপ বলল- খুবই আশ্চর্য! খুবই অদ্ভুত! ভন্তে; ভগবান কর্তৃক সুন্দরভাবে ভাষিত হয়েছে যে- “আবুসো, যেখানে জন্ম নেই, জরা নেই, ধ্বংস নেই, মৃত্যু নেই ও উৎপত্তি রহিত নির্বাণলোকে কেউ পদব্রজে গমন করে জ্ঞাত হতে, দর্শন করতে এবং উপস্থিত হতে সক্ষম আমি এরূপ বলি না।”

“ভন্তে, অনেক আগে আমি ঋদ্ধিমান, আকাশপথে গমনকারী ভোজপুত্র রোহিতাশ্ব নামক তাপস ছিলাম। সেই সময় আমার এরূপ গতিবেগ ছিল, যেমন- ধনুবিদ্যায় পারদর্শী, দক্ষ, সুশিক্ষিত, সিদ্ধহস্ত, সুনিপুণ ব্যক্তি ক্ষিপ্রভাবে ছুড়া তীর দ্বারা অনায়াসে আড়াআড়ি তালবৃক্ষ ভেদ করতে পারে। আমার এরূপ পদক্ষেপ ছিল, যেমন- পূর্ব সমুদ্র হতে পশ্চিম সমুদ্র পর্যন্ত। এরকমের গতি ও পদক্ষেপের কারণে আমার এবম্বিধ ইচ্ছা উৎপন্ন হতো- ‘আমি পদব্রজে গমন করে নির্বাণলোকে উপস্থিত হই’। সেই আমি ভোজন-পান ও মল-মূত্র এবং নিদ্রা-ক্লান্তি অপসারিত করে শতবর্ষ আয়ু, শতবর্ষ জীবি হওতঃ শতবর্ষ অতিক্রম করেও পদব্রজে গমন করে নির্বাণলোকে উপস্থিত হতে না পেরে মহাকাশে মৃত্যুবরণ করি।

খুবই আশ্বর্য! খুবই অদ্ভুত! ভন্তে; ভগবান কর্তৃক সুন্দরভাবে ভাষিত হয়েছে যে- “আবুসো! যেখানে জন্ম নেই, জরা নেই, ধ্বংস নেই, মৃত্যু নেই ও উৎপত্তি রহিত নির্বাণলোকে কেউ পদব্রজে গমন করে জ্ঞাত হতে, দর্শন করতে এবং উপস্থিত হতে সক্ষম আমি এরূপ বলি না।”

“আবুসো! যেখানে জন্ম নেই, জরা নেই, ধ্বংস নেই, মৃত্যু নেই ও উৎপত্তি রহিত নির্বাণলোকে কেউ পদব্রজে গমন করে জ্ঞাত হতে, দর্শন করতে এবং উপস্থিত হতে সক্ষম আমি এরূপ বলি না। অন্যদিকে পদব্রজে গমন করে নির্বাণলোকে উপস্থিত হতে পারাকে আমি দুঃখের অন্তসাধন বলি না। আমি স্ব-সংজ্ঞাযুক্ত এই ব্যামপ্রমাণ কলেবরে অর্থাৎ পঞ্চস্কন্ধে- লোক, লোকসমুদয়, লোকনিরোধ, লোকনিরোধের উপায় দেখতেছি।”

“গমনে জগতের অন্ত লাভ হয় না কখন,

জগতান্ত প্রাপ্তেও না হয় দুঃখে মুক্তন।

লোকবিদ সুমেধ, বিজ্ঞ লোক উৎপত্তিতে,

লোকান্তেও বেদগূ, পরিপূর্ণ ব্রহ্মচর্যেতে।

লোক অন্তে শান্ত জেনে করে অবস্থান।

পরলোক নাশে তিনি অতি মহান।”

(ষষ্ঠ সূত্র)

৭. সুবিদূরসুত্তং- দুর্জ্ঞেয় সূত্র

৪৭. “হে ভিক্ষুগণ! চারটি বিষয় দুর্জ্ঞেয়। সেই চারটি বিষয় কি কি? যথা- আকাশ এবং পৃথিবী- এটি প্রথম দুর্জ্ঞেয় বিষয়। সমুদ্রের দূরবর্তী অপর তীর- এটি দ্বিতীয় দুর্জ্ঞেয় বিষয়। যেখান হতে সূর্য উদিত হয় এবং যেখানে অস্তগমন করে- এটি তৃতীয় দুর্জ্ঞেয় বিষয়। সদ্ধর্ম এবং অসদ্ধর্ম (মিথ্যাধর্ম)- এটি চতুর্থ দুর্জ্ঞেয় বিষয়। এই চারটি বিষয় দুর্জ্ঞেয়।

“দূরের আকাশ, পৃথিবী উভয়ই দুর্জ্ঞেয়,

দুর্জ্ঞেয় সেরূপ সমুদ্রের দূরবর্তী অপরতীর।

দুর্জ্ঞেয় যেখান হতে হয় সূর্য উদিত,

সেরূপ দুর্জ্ঞেয় যেখান হতে সূর্য অস্তগত।

এসবের চেয়ে হয় অতীব দুর্জ্ঞেয়,

প্রভেদ করণ সদ্ধর্ম ও অসদ্ধর্ম।

সদ্ধর্ম সমাগমে নাহি অবনতি,

সেতাই ররে সুখে অবস্থিতি।

অতি দ্রুত হয় অসদ্ধর্মে আগমন,

সদ্ধর্মে আগমন কিন্তু দুর্জ্ঞেয়, কঠিন।”

(সপ্তম সূত্র)

৮. বিসাখসুত্তং- বিশাখ সূত্র

৪৮. একসময় ভগবান শ্রাবস্তীতে অনাথপিণ্ডিকের নির্মিত জেতবন বিহারে অবস্থান করছিলেন। তখন পঞ্চালপুত্র আয়ুষ্মান বিশাখ উপস্থানশালায় ভিক্ষুগণকে মার্জিত, সুন্দরভাবে প্রকাশিত, পরিশুদ্ধ, অর্থপূর্ণ, জ্ঞানগর্ভ, জ্ঞানের অর্ন্তভূক্ত, অনাসক্ত ধর্মকথায় সন্দর্শিত, উদ্দীপিত, সমুত্তেজিত এবং ধর্ম রসাস্বাদনে পরিতৃপ্ত করেন। অতঃপর ভগবান সন্ধ্যার সময় নির্জনতা হতে উঠে উপস্থানশালায় উপস্থিত হওতঃ প্রজ্ঞাপ্ত আসনে উপবিষ্ট হলেন। আর ভিক্ষুগণকে আহ্বান করে বললেন- “হে ভিক্ষুগণ! উপস্থাশালায় কে ভিক্ষুগণকে মার্জিত, সুন্দরভাবে প্রকাশিত, পরিশুদ্ধ, অর্থপূর্ণ, জ্ঞানগর্ভ, জ্ঞানের অর্ন্তভূক্ত, অনাসক্ত ধর্মকথায় সন্দর্শিত, উদ্দীপিত, সমুত্তেজিত এবং ধর্ম রসাস্বাদনে পরিতৃপ্ত করেছে? উত্তরে ভিক্ষুগণ বললেন- “ভন্তে! পঞ্চালপুত্র আয়ুষ্মান বিশাখ ভিক্ষুগণকে মার্জিত, সুন্দরভাবে প্রকাশিত, পরিশুদ্ধ, জ্ঞানগর্ভ, অর্থপূর্ণ, জ্ঞানের অর্ন্তভূক্ত, অনাসক্ত ধর্মকথায় সন্দর্শিত, উৎসাহিত, সমুত্তেজিত এবং ধর্ম রসাস্বাদনে পরিতৃপ্ত করেছেন।” অতঃপর ভগবান পঞ্চালপুত্র বিশাখকে আহ্বান করে বললেন- “বিশাখ! খুবই উত্তম, খুবই উত্তম; তুমি ভিক্ষুগণকে মার্জিত, সুন্দরভাবে প্রকাশিত, পরিশুদ্ধ, অর্থপূর্ণ, জ্ঞানগর্ভ, জ্ঞানের অর্ন্তভূক্ত, অনাসক্ত ধর্মকথায় সন্দর্শিত, উদ্দীপিত, সমুত্তেজিত এবং ধর্ম রসাস্বাদনে পরিতৃপ্ত করেছ।”

“অসমরূপে জানে মূর্খ পণ্ডিত মিত্রকে,

হাস্যকর বলে জানে অমৃতপদ দেশনাকে।

ভাষণে, ব্যাখ্যায় ধর্মকে শ্রেষ্ঠ ঋষিবর,

ধর্ম হল ঋষিদের, ঋষিই ধর্মে নিকটতর।”

(অষ্টম সূত্র)

৯. বিপল্লাসসুত্তং- বিকৃত সূত্র

৪৯. “হে ভিক্ষুগণ! চার প্রকার চিন্তায় সংজ্ঞা, চিত্ত এবং দৃষ্টি বিকৃত হয়। সেই চার প্রকার কি কি? যথা- অনিত্যে নিত্য চিন্তায় সংজ্ঞা, চিত্ত এবং দৃষ্টি বিকৃত হয়। দুঃখে সুখ চিন্তায় সংজ্ঞা, চিত্ত এবং দৃষ্টি বিকৃত হয়। অনাত্মে আত্ম চিন্তায় সংজ্ঞা, চিত্ত এবং দৃষ্টি বিকৃত হয়। অশুভে শুভ চিন্তায় সংজ্ঞা, চিত্ত এবং দৃষ্টি বিকৃত হয়। এই চার প্রকার চিন্তায় সংজ্ঞা, চিত্ত এবং দৃষ্টি বিকৃত হয়।

“হে ভিক্ষুগণ! চার প্রকার চিন্তায় সংজ্ঞা, চিত্ত এবং দৃষ্টি বিকৃত হয় না। সেই চার প্রকার কি কি? যথা- অনিত্যে অনিত্য চিন্তায় সংজ্ঞা, চিত্ত এবং দৃষ্টি বিকৃত হয় না। দুঃখে দুঃখ চিন্তায় সংজ্ঞা, চিত্ত এবং দৃষ্টি বিকৃত হয় না। অশুভে অশুভ চিন্তায় সংজ্ঞা, চিত্ত এবং দৃষ্টি বিকৃত হয় না। অনাত্মে অনাত্ম চিন্তায় সংজ্ঞা, চিত্ত এবং দৃষ্টি বিকৃত হয় না। এই চার প্রকার চিন্তায় সংজ্ঞা, চিত্ত এবং দৃষ্টি বিকৃত হয় না।

“অনিত্যে নিত্য, দুঃখে সুখ চিন্তনে,

অনাত্মতে আত্ম, অশুভে শুভ ধারণে।

সেজন মিথ্যাদৃষ্টি পরায়ণ জানিবে সকলে,

চিত্ত তার বিকৃত, সত্য-মিথ্যা বিকলে।

যেজন নহি মুক্ত, শৃঙ্খলিত মারের বন্ধনে,

অবিরাম সংস্কার তার, জন্ম-মৃত্যু অধীনে।

ধরাতলে উৎপন্নে মহাজ্ঞানী বুদ্ধ ভগবান,

তখনি প্রকাশিত, দুঃখোপশম ধর্ম মহান।

স-চিত্তে লব্ধ এধর্ম, মহাপ্রাজ্ঞ যারা,

অনিত্যে অনিত্য, দুঃখে দুঃখ জ্ঞাত তারা।

অনাত্মে অনাত্ম, অশুভে অশুভ দর্শনে,

সম্যকদৃষ্টিসম্পন্ন, সর্বদুঃখ অতিক্রমে।”

(নবম সূত্র)

১০. উপক্কিলেসসুত্তং- উপক্লেশ সূত্র

৫০. “হে ভিক্ষুগণ! চন্দ্র-সূর্যের চার প্রকার উপক্লেশ, যা দ্বারা উপক্লিষ্ট হয়ে চন্দ্র-সূর্য প্রকাশিত হতে পারে না, আলোকিত হতে পারে না, আলো বিতরণ করতে পারে না। সেই চার প্রকার কি কি? যথা-

মেঘ চন্দ্র-সূর্যের উপক্লেশ, যে উপক্লেশ দ্বারা উপক্লিষ্ট হয়ে চন্দ্র-সূর্য প্রকাশিত হতে পারে না, আলোকিত হতে পারে না, আলো বিতরণ করতে পারে না। তুষার চন্দ্র-সূর্যের উপক্লেশ, যে উপক্লেশ দ্বারা উপক্লিষ্ট হয়ে চন্দ্র-সূর্য প্রকাশিত হতে পারে না, আলোকিত হতে পারে না, আলো বিতরণ করতে পারে না। ধূম্র চন্দ্র-সূর্যের উপক্লেশ, যে উপক্লেশ দ্বারা উপক্লিষ্ট হয়ে চন্দ্র-সূর্য প্রকাশিত হতে পারে না, আলোকিত হতে পারে না, আলো বিতরণ করতে পারে না। অসুরিন্দ্র চন্দ্র-সূর্যের উপক্লেশ, যে উপক্লেশ দ্বারা উপক্লিষ্ট হয়ে চন্দ্র-সূর্য প্রকাশিত হতে পারে না, আলোকিত হতে পারে না, আলো বিতরণ করতে পারে না।

ভিক্ষুগণ! এরূপে শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণের চার প্রকার উপক্লেশ বিদ্যমান; যে উপক্লেশ দ্বারা উপক্লিষ্ট হয়ে কোন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ প্রকাশিত হতে পারে না, আলোকিত হতে পারে না, আলো বিতরণ করতে পারে না। সেই চার প্রকার কি কি? যথা- এমন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ আছে, যারা মাদকদ্রব্য সেবন করে, মাদকদ্রব্য সেবন হতে নিবৃত্ত হয় না। এটি শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণের প্রথম উপক্লেশ; যে উপক্লেশ দ্বারা উপক্লিষ্ট হয়ে কোন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ প্রকাশিত হতে পারে না, আলোকিত হতে পারে না, আলো বিতরণ করতে পারে না।

কোন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ আছে, যারা মৈথুনধর্ম সেবন করে, মৈথুনধর্ম সেবন হতে নিবৃত্ত হয় না। এটি শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণের দ্বিতীয় উপক্লেশ; যে উপক্লেশ দ্বারা উপক্লিষ্ট হয়ে এমন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ প্রকাশিত হতে পারে না, আলোকিত হতে পারে না, আলো বিতরণ করতে পারে না।

কোন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ আছে, যারা স্বর্ণ-রৌপ্য গ্রহণ করে, স্বর্ণ-রৌপ্য গ্রহণ হতে নিবৃত্ত হয় না। এটি শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণের তৃতীয় উপক্লেশ; যে উপক্লেশ দ্বারা উপক্লিষ্ট হয়ে এমন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ প্রকাশিত হতে পারে না, আলোকিত হতে পারে না, আলো বিতরণ করতে পারে না।

কোন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ আছে, যারা মিথ্যা জীবিকা দ্বারা জীবন যাপন করে, মিথ্যা জীবিকা হতে নিবৃত্ত হয় না। এটি শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণের চতুর্থ উপক্লেশ; যে উপক্লেশ দ্বারা উপক্লিষ্ট হয়ে এমন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ প্রকাশিত হতে পারে না, আলোকিত হতে পারে না, আলো বিতরণ করতে পারে না।

ভিক্ষুগণ! শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণের এই চার প্রকার উপক্লেশ বিদ্যমান; যে উপক্লেশ দ্বারা উপক্লিষ্ট হয়ে এমন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ প্রকাশিত হতে পারে না, আলোকিত হতে পারে না, আলো বিতরণ করতে পারে না।

“রাগ, হিংসায় উপক্লিষ্ট হয়ে শ্রমণ-ব্রাহ্মণ,

অবিদ্যার দাস, রূপে করে অভিনন্দন।

নেশাদ্রব্য পান করে, মৈথুন প্রতিসেবন,

স্বর্ণ-রৌপ্য গ্রহণে হয় ঘোর অজ্ঞান।

মিথ্যাজীবিকা অনুসরণে শ্রমণ-ব্রাহ্মণ,

উপক্লেশ এসব, আদিত্যবন্ধু বুদ্ধের ভাষণ।

এসবে উপক্লিষ্ট হয়ে শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণ,

প্রকাশিত, আলোকিত না-রে ধূম্র অজ্ঞান।

অবিদ্যা, তৃষ্ণার দাস হয় পুনর্জন্মচারী,

ধারণে পুনর্জন্ম তারা, শ্মশান বৃদ্ধিকারী।”

(দশম সূত্র)

রোহিতাশ্ব বর্গ সমাপ্ত

স্মারক গাথা-

সমাধি প্রশ্ন, দুই ক্রোধ আর দুই রোহিতাশ্ব,

দুর্জ্ঞেয়, বিশাখ, বিকৃত, উপক্লেশসহ দশম।

প্রথম পঞ্চাশক সমাপ্ত।