১. সোতানুগতসুত্তং-শ্রোতানুগত সূত্র
১৯১. “হে ভিক্ষুগণ! শ্রোতানুগত ধর্মের, বাক্য পরিচয়ের, মননকৃত বিষয়ের ও দৃষ্টি সুপ্রতিবিদ্ধের চার প্রকার আনিশংস প্রত্যাশিত হয়। চার প্রকার কি কি? যথা- এজগতে ভিক্ষু সূত্র, গেয়্য, ব্যাকরণ, গাথা, উদান, ইতিবুত্তক, জাতক, অদ্ভুতধর্ম ও বেদল্ল ধর্মসমূহ পরিপূর্ণভাবে শিক্ষা করে। সেই ধর্মসমূহ তার শ্রোতানুগত, বাক্যের দ্বারা পরিচিত, মননকৃত ও দৃষ্টিতে সুপ্রতিবিদ্ধ হয়। সে বিস্মৃত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেও কোন এক দেবলোকে উৎপন্ন হয়। তথায় তাকে অন্য কোন সুখীজন ধর্মপদ আবৃত্তি করে শোনায়। এরূপে মন্থরগতিতে তার পূর্বস্মৃতি ফিরে এলে সেই সত্ত্ব খুব দ্রুতই শ্রেষ্ঠতা লাভে অগ্রগামী হয়। ভিক্ষুগণ, শ্রোতানুগত ধর্মের, বাক্য পরিচয়ের, মননকৃত বিষয়ের ও দৃষ্টি সুপ্রতিবিদ্ধের এটিই প্রত্যাশিত প্রথম আনিশংস।
পুনঃ, এজগতে ভিক্ষু সূত্র, গেয়্য, ব্যাকরণ, গাথা, উদান, ইতিবুত্তক, জাতক, অদ্ভুতধর্ম ও বেদল্ল এধর্মসমূহ পরিপূর্ণভাবে শিক্ষা করে। সেই ধর্মসমূহ তার শ্রোতানুগত, বাক্যের দ্বারা পরিচিত, মননকৃত ও দৃষ্টিতে সুপ্রতিবিদ্ধ হয়। সে বিস্মৃত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেও কোন এক দেবলোকে উৎপন্ন হয়। তথায় তাকে অন্য কোন সুখীজন ধর্মপদ আবৃত্তি করে শোনায় না; অধিকন্তু, চিত্তবশীপ্রাপ্ত ঋদ্ধিমান ভিক্ষু দেব পরিষদে ধর্মদেশনা করে। তখন তার এরূপ স্মরণ হয় যে- ‘এটিই সেই ধর্মবিনয়, যেখানে আমি পূর্বে ব্রহ্মচর্য আচরণ করেছিলাম।’ এরূপে মন্থরগতিতে তার পূর্বস্মৃতি ফিরে এলে সেই সত্ত্ব খুব দ্রুতই শ্রেষ্ঠতা লাভে অগ্রগামী হয়। যেমন, ভেরী শব্দে দক্ষ কোন পুরুষ রাজপথে উপস্থিত হয়ে ভেরী শব্দ শুনতে পেলে ‘এটি ভেরীর শব্দ নাকি নয়’ এরূপে তার কোন সন্দেহ বা বিমতি হয় না। অতঃপর এটি ভেরী শব্দই বলে তার পূর্ণ বিশ্বাস জন্মায়। ঠিক এরূপেই ভিক্ষুও সূত্র, গেয়্য, ব্যাকরণ, গাথা, উদান, ইতিবুত্তক, জাতক, অদ্ভুতধর্ম ও বেদল্ল এধর্মসমূহ পরিপূর্ণভাবে শিক্ষা করে। সেই ধর্মসমূহ তার শ্রোতানুগত, বাক্যের দ্বারা পরিচিত, মননকৃত ও দৃষ্টিতে সুপ্রতিবিদ্ধ হয়। সে বিস্মৃতি হয়ে মৃত্যুবরণ করলেও কোন এক দেবলোকে উৎপন্ন হয়। তথায় তাকে অন্য কোন সুখীজন ধর্মপদ আবৃত্তি করে শোনায় না, অধিকন্তু চিত্তবশীপ্রাপ্ত ঋদ্ধিমান এক ভিক্ষু দেব পরিষদে ধর্মদেশনা করে। তখন তার এরূপ স্মরণ হয় যে- ‘এটিই সেই ধর্মবিনয়, যেখানে আমি পূর্বে ব্রহ্মচর্য আচরণ করেছিলাম।’ এরূপে মন্থরগতিতে তার পূর্বস্মৃতি ফিরে এলে সেই সত্ত্ব খুব দ্রুতই শ্রেষ্ঠতা লাভে অগ্রগামী হয়। ভিক্ষুগণ, শ্রোতানুগত ধর্মের, বাক্য পরিচয়ের, মননকৃত বিষয়ের ও দৃষ্টি সুপ্রতিবিদ্ধের এটিই প্রত্যাশিত দ্বিতীয় আনিশংস।
পুনঃ, ভিক্ষু সূত্র, গেয়্য, ব্যাকরণ, গাথা, উদান, ইতিবুত্তক, জাতক, অদ্ভুতধর্ম ও বেদল্ল এ’ধর্মসমূহ পরিপূর্ণভাবে শিক্ষা করে। সেই ধর্মসমূহ তার শ্রোতানুগত, বাক্যের দ্বারা পরিচিত, মননকৃত ও দৃষ্টিতে সুপ্রতিবিদ্ধ হয়। সে বিস্মৃত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেও কোন এক দেবলোকে উৎপন্ন হয়। তথায় তাকে অন্য কোন সুখীজন ধর্মপদ আবৃত্তি করে শোনায় না আর চিত্তবশীপ্রাপ্ত ঋদ্ধিমান কোন ভিক্ষু দেব পরিষদে ধর্ম দেশনা করে না, কিন্তু দেবপুত্র দেব পরিষদে ধর্ম দেশনা করে। তখন তার এরূপ স্মরণ হয় যে- ‘এটিই সেই ধর্মবিনয়, যেখানে আমি পূর্বে ব্রহ্মচর্য আচরণ করেছিলাম। এরূপে মন্থরগতিতে তার পূর্বস্মৃতি ফিরে এলে সেই সত্ত্ব খুব দ্রুতভাবে শ্রেষ্ঠতা লাভে অগ্রগামী হয়। যেমন, শঙ্খ শব্দে দক্ষ কোন পুরুষ রাজপথে উপস্থিত হয়ে শঙ্খ শব্দ শুনতে পেলে ‘এটি শঙ্খের শব্দ নাকি নয়’ এরূপে তার কোন সন্দেহ বা বিমতি হয় না। অতঃপর ইহা শঙ্খ শব্দ-ই বলে তার পূর্ণ বিশ্বাস জন্মায়। ঠিক এরূপেই ভিক্ষুও সূত্র, গেয়্য, ব্যাকরণ, গাথা, উদান, ইতিবুত্তক, জাতক, অদ্ভুতধর্ম ও বেদল্ল এধর্মসমূহ পরিপূর্ণভাবে শিক্ষা করে। সেই ধর্মসমূহ তার শ্রোতানুগত, বাক্যের দ্বারা পরিচিত, মননকৃত ও দৃষ্টিতে সুপ্রতিবিদ্ধ হয়। সে বিস্মৃত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেও কোন এক দেবলোকে উৎপন্ন হয়। তথায় তাকে অন্য কোন সুখীজন ধর্মপদ আবৃত্তি করে শোনায় না আর চিত্তবশীপ্রাপ্ত ঋদ্ধিমান কোন ভিক্ষুও দেবপরিষদে ধর্মদেশনা করে না, কিন্তু দেবপুত্র দেবপরিষদে ধর্মদেশনা করে। তখন তার এরূপ স্মরণ হয় যে- ‘এটিই সেই ধর্মবিনয়, যেখানে আমি পূর্বে ব্রহ্মচর্য আচরণ করেছিলাম। এরূপে মন্থরগতিতে তার পূর্বস্মৃতি ফিরে এলে সেই সত্ত্ব খুব দ্রুতভাবে শ্রেষ্ঠতা লাভে অগ্রগামী হয়। ভিক্ষুগণ, শ্রোতানুগত ধর্মের, বাক্যের পরিচয়ে, মননকৃত বিষয়ের ও দৃষ্টি সুপ্রতিবিদ্ধের এটিই প্রত্যাশিত তৃতীয় আনিশংস।
পুনঃ, ভিক্ষু সূত্র, গেয়্য, ব্যাকরণ, গাথা, উদান, ইতিবুত্তক, জাতক, অদ্ভুতধর্ম ও বেদল্ল এধর্মসমূহ পরিপূর্ণভাবে শিক্ষা করে। সেই ধর্মসমূহ তার শ্রোতানুগত, বাক্যের দ্বারা পরিচিত, মননকৃত ও দৃষ্টিতে সুপ্রতিবিদ্ধ হয়। সেই বিস্মৃত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেও কোন এক দেবলোকে উৎপন্ন হয়। তথায় তাকে অন্য কোন সুখীজন ধর্মপদ আবৃত্তি করে শোনায় না, চিত্তবশীপ্রাপ্ত ঋদ্ধিমান কোন ভিক্ষু দেবপরিষদে ধর্ম দেশনা করে না; আর দেবপুত্রও দেবপরিষদে ধর্ম দেশনা করে না। কিন্তু কোন উপপাতিক এরূপে স্মরণ করিয়ে দেয়- ‘প্রভু, আপনি স্মরণ করুন, আপনি স্মরণ করুন যে, যেখানে আমরা পূর্বে ব্রহ্মচর্য আচরণ করেছিলাম। প্রত্যুত্তরে সে এরূপ বলে- ‘প্রভু, আমি স্মরণ করছি, আমি স্মরণ করছি।’ এরূপে মন্থরগতিতে তার পূর্বস্মৃতি ফিরে এলে সেই সত্ত্ব খুব দ্রুতই শ্রেষ্ঠতা লাভে অগ্রগামী হয়। যেমন, ধূলি খেলার দুই সাথী মাঝে মধ্যে একে অপরের সাথে মিলিত হলে এক বন্ধু আরেক বন্ধুকে এরূপ বলে থাকে- ‘বন্ধু! এটি তোমার স্মরণ হচ্ছে কি? বন্ধু! এটি কি তোমার স্মরণ হচ্ছে? প্রত্যুত্তরে অপর বন্ধু এরূপ বলে- ‘বন্ধু! আমি স্মরণ করছি, বন্ধু! আমার স্মরণ হচ্ছে।’ ঠিক এরূপেই ভিক্ষুও সূত্র, গেয়্য, ব্যাকরণ, গাথা, উদান, ইতিবুত্তক, জাতক, অদ্ভুতধর্ম ও বেদল্ল এ’ধর্মসমূহ পরিপূর্ণভাবে শিক্ষা করে। সেই ধর্মসমূহ তার শ্রোতানুগত, বাক্যের দ্বারা পরিচিত, মননকৃত ও দৃষ্টিতে সুপ্রতিবিদ্ধ হয়। সে বিস্মৃত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেও কোন এক দেবলোকে উৎপন্ন হয়। তথায় তাকে অন্যকোন সুখীজন ধর্মপদ আবৃত্তি করে শোনায় না, চিত্তবশীপ্রাপ্ত ঋদ্ধিমান কোন ভিক্ষু দেবপরিষদে ধর্মদেশনা করে না। আর দেবপুত্রও দেবপরিষদে ধর্মদেশনা করে না, কিন্তু উপপাতিক উপপাতিককে এরূপ স্মরণ করিয়ে দেয়- ‘প্রভু, আপনি স্মরণ করুন, আপনি স্মরণ করুন যে, যেখানে আমরা পূর্বে ব্রহ্মচর্য আচরণ করেছিলাম।’ প্রত্যুত্তরে অন্যজন এরূপ বলে- ‘প্রভু! আমি স্মরণ করছি, আমি স্মরণ করছি।’ এরূপে মন্থরগতিতে তার পূর্বস্মৃতি ফিরে এলে সেই সত্ত্ব খুব দ্রুতই শ্রেষ্ঠতা লাভে অগ্রগামী হয়। শ্রোতানুগত ধর্মের, বাক্য পরিচয়ে, মননকৃত বিষয়ের ও দৃষ্টি সুপ্রতিবিদ্ধের এটিই প্রত্যাশিত চতুর্থ আনিশংস। ভিক্ষুগণ! শ্রোতানুগত ধর্মের, বাক্য পরিচয়ের, মননকৃত বিষয়ের ও দৃষ্টি সুপ্রতিবিদ্ধের এই চার প্রকার আনিশংস প্রত্যাশিত হয়।’’ (প্রথম সূত্র)
২. ঠানসুত্তং- বিষয় সূত্র
১৯২. “হে ভিক্ষুগণ! এই চার প্রকার বিষয় অপর চার বিষয় দ্বারা জ্ঞাতব্য। চার প্রকার কি কি? সহবস্থানের মাধ্যমে একজনের শীল সম্পর্কে জানতে হবে, তাও আবার দীর্ঘ সময় ব্যাপী, অল্পক্ষণে নয়; মনোযোগ প্রদানের মাধ্যমে, অমনোযোগের মাধ্যমে নয়; প্রজ্ঞাবানের মাধ্যমে, দুষপ্রাজ্ঞের মাধ্যমে নয়। সংস্রবের মাধ্যমে একজনের শুদ্ধতা (পবিত্রতা) সম্পর্কে জানতে হবে, তাও আবার দীর্ঘ সময় ব্যাপী, অল্পক্ষণে নয়; মনোযোগ প্রদানের মাধ্যমে, অমনোযোগের মাধ্যমে নয়; প্রজ্ঞাবানের মাধ্যমে, দুষপ্রাজ্ঞের মাধ্যমে নয়। আপদ বা বিপদের মাধ্যমে একজনের বল (শক্তি) সম্পর্কে জানতে হবে, তাও আবার দীর্ঘ সময় ব্যাপী, অল্পক্ষণে নয়; মনোযোগ প্রদানের মাধ্যমে, অমনোযোগের মাধ্যমে নয়; প্রজ্ঞাবানের মাধ্যমে, দুষপ্রাজ্ঞের মাধ্যমে নয়। আর আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একজনের প্রজ্ঞা সম্পর্কে জানতে হবে, তাও আবার দীর্ঘ সময় ব্যাপী, অল্পক্ষণে নয়; মনোযোগ প্রদানের মাধ্যমে, অমনোযোগের মাধ্যমে নয়; প্রজ্ঞাবানের মাধ্যমে, দুষপ্রাজ্ঞের মাধ্যমে নয়।
ভিক্ষুগণ! ‘সহাবস্থানের মাধ্যমে একজনের শীল সম্পর্কে জানতে হবে, তাও আবার দীর্ঘ সময় ব্যাপী, অল্পক্ষণে নয়; মনোযোগ প্রদানের মাধ্যমে, অমনোযোগের মাধ্যমে নয়; প্রজ্ঞাবানের মাধ্যমে, দুষপ্রাজ্ঞের মাধ্যমে নয়; এরূপে ব্যক্ত হয়েছে। তা কি কারণে ব্যক্ত হয়েছে? এজগতে একজন পুদগল আরেকজন পুদগলের সহিত সহবস্থানের দরুন এরূপ জানে যে- ‘এই আয়ুষ্মান দীর্ঘকাল ধরে শীলসমূহ ভঙ্গকারী, ছিদ্রকারী, সবলকারী (কলুষিতকারী), বিরুদ্ধকারী, অমঙ্গলকারী, অসামঞ্জস্যকারী এবং এই আয়ুষ্মান শীলসমূহেও দুঃশীল; শীলবান নয়।’
ভিক্ষুগণ! এজগতে একজন পুদগল আরেকজন পুদগলের সহিত সহবস্থানের দরুন এরূপ জানে যে- ‘এই আয়ুষ্মান দীর্ঘকাল ধরে শীলসমূহ অভঙ্গকারী, অছিদ্রকারী, অসবলকারী, অবিরুদ্ধকারী, সঙ্গতকারী, সামঞ্জস্যকারী এবং এই আয়ুষ্মান শীলসমূহেও শীলবান, দুঃশীল নয়।’ ‘সহাবস্থানের মাধ্যমে একজনের শীল সম্পর্কে জানতে হবে, তাও আবার দীর্ঘ সময় ব্যাপী, অল্পক্ষণে নয়; মনোযোগ প্রদানের মাধ্যমে, অমনোযোগের মাধ্যমে নয়; প্রজ্ঞাবানের মাধ্যমে, দুষপ্রাজ্ঞের মাধ্যমে নয়; এরূপে যা ব্যক্ত হয়েছে, এই হেতুতেই তা ব্যক্ত হয়েছে।
ভিক্ষুগণ! সংস্রবের মাধ্যমে একজনের শুদ্ধতা সম্পর্কে জানতে হবে, তাও আবার দীর্ঘ সময় ব্যাপী, অল্পক্ষণে নয়; মনোযোগ প্রদানের মাধ্যমে, অমনোযোগের মাধ্যমে নয়; প্রজ্ঞাবানের মাধ্যমে, দুষপ্রাজ্ঞের মাধ্যমে নয়’ এরূপে ব্যক্ত হয়েছে। তা কি কারণে ব্যক্ত হয়েছে? এজগতে একজন পুদগল আরেকজন পুদগলের সহিত সংস্রবের দরুন এরূপ জানে যে- ‘এই আয়ুষ্মান নানাভাবে একজনের সাথে একরকম আচরণ (ব্যবহার) করে, দুই জনের সাথে ভিন্নভাবে, তিনজনের সঙ্গে ভিন্নরূপে এমন কি বহুজনের সাথেও অন্যভাবে আচরণ করে। তার পূর্বের আচরণের সাথে পরের আচরণের সঙ্গতি থাকে না। এই আয়ুষ্মান আচরণগত দিক দিয়ে অপরিশুদ্ধ, পরিশুদ্ধ আচরণকারী নয়।’
ভিক্ষুগণ! এজগতে একজন পুদগল আরেকজন পুদগলের সহিত সংস্রবের দরুন এরূপ জানে যে- ‘এই আয়ুষ্মান একজনের সাথে একরকম আচরণ করে, দুইজনের সাথে একইভাবে, তিনজনের সঙ্গে একইরূপে, এমন কি বহুজনের সাথেও একইভাবে আচরণ করে। তার পূর্বের আচরণের সাথে পরের আচরণের সঙ্গতি থাকে। এই আয়ুষ্মান পরিশুদ্ধ আচরণকারী, অপরিশুদ্ধ আচরণকারী নয়।’ ‘সংস্রবের মাধ্যমে একজনের শুদ্ধতা সম্পর্কে জানতে হবে, তাও আবার দীর্ঘ সময় ব্যাপী, অল্পক্ষণে নয়; মনোযোগ প্রদানের মাধ্যমে, অমনোযোগের মাধ্যমে নয়; প্রজ্ঞাবানের মাধ্যমে, দুষপ্রাজ্ঞের মাধ্যমে নয়;’ এরূপে যা ব্যক্ত হয়েছে, তা এই হেতুতেই ব্যক্ত হয়েছে।
ভিক্ষুগণ! আপদ বা বিপদের মাধ্যমে একজনের বল (শক্তি) সম্পর্কে জানতে হবে, তাও আবার দীর্ঘ সময় ব্যাপী, অল্পক্ষণে নয়; মনোযোগ প্রদানের মাধ্যমে, অমনোযোগের মাধ্যমে নয়; প্রজ্ঞাবানের মাধ্যমে, দুষপ্রাজ্ঞের মাধ্যমে নয়’ এরূপে ব্যক্ত হয়েছে। তা কি কারণে ব্যক্ত হয়েছে? এজগতে কোন কোন পুদগল জ্ঞাতি ক্ষয়ে, ভোগসম্পত্তি বিনাশে ও রোগ-দুঃখ প্রাপ্ত হয়েও এরূপ গভীর চিন্তা করে না- ‘সেরূপ এজনসংবাস ও এদেহধারণ যেরূপ জনসংবাস ও দেহধারণের দরুন অষ্টলোক ধর্ম লোককে (জগতকে) ব্যাপৃত বা অনুপরিবর্তন করে এবং জগত ও অষ্টলোকধর্মে আবর্তিত হয়, যথা- লাভ, অলাভ, যশ, অযশ, নিন্দা, প্রশংসা, সুখ ও দুঃখ।’ সে জ্ঞাতি ক্ষয়ে, ভোগসম্পত্তি বিনাশে ও রোগ-দুঃখ প্রাপ্ত হয়ে অনুশোচনা করে, ক্লান্ত হয়, বিলাপ করে, বুক চাপড়িয়ে চাপড়িয়ে ক্রন্দন করে ও সম্মোহিত বা মতিভ্রম হয়।
ভিক্ষুগণ! এজগতে কোন কোন পুদগল জ্ঞাতি ক্ষয়ে, ভোগসম্পত্তি বিনাশে ও রোগ-দুঃখপ্রাপ্ত হয়ে এরূপ গভীর চিন্তা করে- ‘সেরূপ এজনসংবাস ও এদেহধারণ যেরূপ জনসংবাস ও দেহধারণের দরুন অষ্টলোকধর্ম লোককে ব্যাপৃত বা অনুপরিবর্তন করে এবং জগত ও অষ্টলোকধর্মে আবর্তিত হয়, যথা- লাভ, অলাভ, যশ, অযশ, নিন্দা, প্রশংসা, সুখ ও দুঃখ।’ সে জ্ঞাতি ক্ষয়ে, ভোগসম্পত্তি বিনাশে ও রোগ-দুঃখ প্রাপ্ত হয়ে অনুশোচনা করে না, ক্লান্ত হয় না, বিলাপ করে না, বুক চাপড়িয়ে চাপড়িয়ে ক্রন্দন করে না ও সম্মোহিত বা মতিভ্রম হয় না। ‘আপদ বা বিপদের মাধ্যমে একজনের বল (শক্তি) সম্পর্কে জানতে হবে, তাও আবার দীর্ঘ সময় ব্যাপী, অল্পক্ষণে নয়; মনোযোগ প্রদানের মাধ্যমে, অমনোযোগের মাধ্যমে নয়; প্রজ্ঞাবানের মাধ্যমে, দুষপ্রাজ্ঞের মাধ্যমে নয়।’ এরূপে যা ব্যক্ত হয়েছে, তা এই হেতুতেই উক্ত হয়েছে।
ভিক্ষুগণ! ‘আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একজনের প্রজ্ঞা সম্পর্কে জানতে হবে, তাও আবার দীর্ঘ সময় ব্যাপী, অল্পক্ষণে নয়; মনোযোগ প্রদানের মাধ্যমে, অমনোযোগের মাধ্যমে নয়; প্রজ্ঞাবানের মাধ্যমে, দুষপ্রাজ্ঞের মাধ্যমে নয়’ এরূপে উক্ত হয়েছে। তা কি কারণে ব্যক্ত হয়েছে? এজগতে একজন পুদগল আরেকজন পুদগলের সহিত আলাপ-আলোচনা করে এরূপ জানে যে- ‘এই আয়ুষ্মানকে উন্মার্গ ও মীমাংসামূলক প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে জানা গেল যে, ইনি আসলে দুষপ্রাজ্ঞ, প্রজ্ঞাবান নয়। তার কারণ কি? এই আয়ুষ্মান গম্ভীর, শান্ত, প্রণীত, তর্কাতীত, বিপুল ও পণ্ডিতের বোধগম্য ধর্মালোচনা করতে পারে না। সে যা ধর্ম ভাষণ করে, তা পর্যাপ্ত নয়; সংক্ষিপ্ত ও বিস্তারিতভাবে, অর্থ ব্যাখ্যা করে দেশনা করতে, প্রজ্ঞাপ্ত করতে এবং আরোপ, উদ্ঘাটিত, বিভাজন ও উন্মুক্ত করতেও অসমর্থ। তাই এই আয়ুষ্মান আসলে দুষপ্রাজ্ঞ, প্রজ্ঞাবান নয়।’
ভিক্ষুগণ! যেমন, চক্ষুষ্মান পুরুষ জলপূর্ণ হ্রদের তীরে দাঁড়িয়ে জলে ভেসে উঠা ছোট ছোট মৎস্য দর্শন করে। তার এরূপ মনে হয় যে- ‘এই মৎস্যগুলোর নড়াচড়া, তরঙ্গাঘাত ও চলার গতি দেখে ধারণা হয় যে, এই মৎস্য ছোট, বড় নয়। এরূপেই একজন পুদগল আরেকজন পুদগলের সাথে প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে জানে যে, ইনি দুষপ্রাজ্ঞ, প্রজ্ঞাবান নয়। তার কারণ কি? এই আয়ুষ্মান গম্ভীর, শান্ত, প্রণীত, তর্কাতীত, নিপুণ ও পণ্ডিতের বোধগম্য ধর্মালোচনা করতে পারে না।’ সে যা ধর্ম ভাষণ করে, তা পর্যাপ্ত নয়; সংক্ষিপ্ত ও বিস্তারিতভাবে অর্থ ব্যাখ্যা করে দেশনা করতে এবং আরোপ, উদ্ঘাটিত, বিভাজন ও উন্মুক্ত করতেও অসমর্থ। তাই এই আয়ুষ্মান দুপ্রাজ্ঞ, প্রজ্ঞাবান নয়।’
ভিক্ষুগণ! এজগতে কোন পুদগল আরেকজন পুদগলের সহিত আলাপ-আলোচনা করে এরূপ জানে যে- ‘এই আয়ুষ্মানকে উন্মার্গ ও মীমাংসামূলক প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে জানা যে, ইনি আসলে প্রজ্ঞাবান, দুষপ্রাজ্ঞ নয়। তার কারণ কি? এই আয়ুষ্মান গম্ভীর, শান্ত, প্রণীত, তর্কাতীত, নিপুণ ও পণ্ডিতের বোধগম্য ধর্মালোচনা করতে পারে। সে যা ধর্ম ভাষণ করে, তা পর্যাপ্ত, সংক্ষিপ্ত ও বিস্তারিতভাবে, অর্থ ব্যাখ্যা করে দেশনা করতে, প্রজ্ঞাপ্ত করতে এবং আরোপ, উদ্ঘাটিত, বিভাজন ও উন্মুক্ত করতেও দক্ষ। তাই এই আয়ুষ্মান আসলে প্রজ্ঞাবান, দুষপ্রাজ্ঞ নয়।
ভিক্ষুগণ! যেমন, চক্ষুষ্মান পুরুষ জলপূর্ণ হ্রদের তীরে দাঁড়িয়ে জলে ভেসে উঠা বড় মৎস্য দর্শন করে। তার এরূপ মনে হয় যে- ‘এই মৎস্যগুলোর নড়াচড়া, তরঙ্গাঘাত ও চলার গতি দেখে ধারণা হয় যে, এই মৎস্য বড়, ছোট নয়।’ ঠিক এরূপেই ভিক্ষুগণ! একজন পুদগল আরেকজন পুদগলের সহিত আলাপ-আলোচনা করে এরূপ জানে যে- ‘এই আয়ুষ্মানকে উন্মার্গ ও মীমাংসামূলক প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে জানা গেল যে, ইনি আসলে প্রজ্ঞাবান, দুষপ্রাজ্ঞ নয়। তার কারণ কি? এই আয়ুষ্মান গম্ভীর, শান্ত, প্রণীত, তর্কাতীত, নিপুণ ও পণ্ডিতের বোধগম্য ধর্মালোচনা করতে পারে। সে যা ধর্ম ভাষণ করে, তা পর্যাপ্ত, সংক্ষিপ্ত ও বিস্তারিতভাবে, অর্থ ব্যাখ্যা করে দেশনা করতে, প্রজ্ঞাপ্ত করতে এবং আরোপ, উদ্ঘাটিত, বিভাজন ও উন্মুক্ত করতেও দক্ষ। তাই এই আয়ুষ্মান আসলেই প্রজ্ঞাবান, দুষপ্রাজ্ঞ নয়।’
ভিক্ষুগণ! আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একজনের প্রজ্ঞা সম্পর্কে জানতে হবে, তাও আবার দীর্ঘ সময় ব্যাপী, অল্পক্ষণে নয়; মনোযোগ প্রদানের মাধ্যমে, অমনোযোগের মাধ্যমে নয়; প্রজ্ঞাবানের মাধ্যমে, দুষপ্রাজ্ঞের মাধ্যমে নয়’ এরূপে যা ব্যক্ত হয়েছে, এই হেতুতেই ব্যক্ত হয়েছে। এই চার প্রকার বিষয় অপর চার বিষয় দ্বারা জ্ঞাতব্য।’’ (দ্বিতীয় সূত্র)
৩. ভদ্দিযসুত্তং-ভদ্রিয় সূত্র
১৯৩. একসময় ভগবান বৈশালীতে অবস্থান করছিলেন মহাবনস্থ কূটাগারশালায়। সে সময় ভদ্রিয় লিচ্ছবি ভগবানের নিকট উপস্থিত হয়ে ভগবানকে অভিবাদন করে একপাশে উপবেশন করলেন। একপাশে উপবিষ্ট ভদ্রিয় লিচ্ছবি ভগবানকে এরূপ বললেন- “ভন্তে, আমি এরূপ শ্রবণ করেছি যে- ‘শ্রমণ গৌতম নাকি কুহকী মায়া জানেন, যা দ্বারা অন্য তীর্থিয় শ্রাবকদেরকেও আবর্তনী মায়ায় আবর্তিত করেন।’ ভন্তে! যারা এরূপ বলেন যে- ‘শ্রমণ গৌতম নাকি কুহকী মায়া জানেন, যা দ্বারা অন্য তীর্থিয় শ্রাবকদেরকেও আবর্তিত করেন’ তারা কি ভগবানের প্রতি অভূত (অসত্য) বিষয়ে দুর্নাম (অপবাদ) করল নাকি ধর্মানুধর্ম ব্যাখ্যা করল অথবা কি তাদের সহধার্মিক বাদানুবাদের দরুন নিন্দার্হ হয়? ভন্তে! আমরা ভগবানকে অপবাদ বা নিন্দা করতে অনিচ্ছুক।’’
“হে ভদ্রিয়! তোমরা এরূপে জনশ্রুতিতে কোন মতবাদ গ্রহণ করবে না। পুরুষ পরম্পরায়; অন্ধবিশ্বাসে, শাস্ত্রে ব্যক্ত হয়েছে বলে, তর্ক প্রসূত মতে, অনুমান বশতঃ, নিজের মতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলে ও ধর্মগুরুর প্রতি শ্রদ্ধাবশতঃ কোন মতবাদ গ্রহণ করবে না। কিন্তু, ভদ্রিয়! যখন তোমরা নিজে নিজেই জানতে পারবে যে- ‘এধর্মসমূহ অকুশল, দোষজনক, বিজ্ঞজনের নিন্দিত এবং এধর্মসমূহ সম্পাদিত হলে অহিত ও দুঃখের জন্য সংবর্তিত হয়; কেবল তখনিই তা তোমরা ত্যাগ করবে।
ভদ্রিয়! তা তোমরা কি মনে কর, পুরুষের আধ্যাত্মিকভাবে যে লোভ, দোষ (দ্বেষ), মোহ ও ক্রোধ উৎপন্ন হয় তা কি তার হিতের জন্য উৎপন্ন হয়, নাকি অহিতের জন্য? “ভন্তে! অহিতের জন্য।’’ “ভদ্রিয়! লোভী, দোষযুক্ত, মোহযুক্ত ও ক্রোধী পুরুষ পুদগল লোভ, দ্বেষ, মোহ ও ক্রোধের দ্বারা অভিভূত হয়ে (লোভ, দোষ, মোহ ও ক্রোধ চিত্তে) প্রাণীহত্যা করে, অদত্তবস্তু গ্রহণ করে, পরদারে গমন করে, মিথ্যা ভাষণ করে এবং অপরকেও সেই কার্যে প্রবৃত্ত বা উৎসাহিত করে; যা দীর্ঘকাল ধরে অহিত ও দুঃখের কারণ হয়।’’ “হ্যাঁ, ভন্তে! এরূপ।’’
“ভদ্রিয়! তা তোমরা কি মনে কর, এই ধর্মসমূহ কুশল নাকি অকুশল?’’ “ভন্তে! অকুশল।’’ “দোষযুক্ত নাকি দোষমুক্ত?’’ “ভন্তে! দোষযুক্ত।’’ “বিজ্ঞজনের গর্হিত (নিন্দিত) নাকি প্রশংসিত?’’ “ভন্তে! গর্হিত।’’ “সেই ধর্মসমূহ সম্পাদিত হলে অহিত ও দুঃখের জন্য সংবর্তিত হয় নাকি হয় না? আর তা যদি হয় কিরূপেই বা এরূপ হয়?’’ “ভন্তে! সেই ধর্মসমূহ সম্পাদিত হলে অহিত ও দুঃখের জন্য সংবর্তিত হয়। আর তা যদি হয় এভাবেই এরূপ হয় না।’’
ভদ্রিয়! সেই বিষয়ে তাদেরকে আমরা পূর্ব হতে এরূপ বলে আসছি যে- তোমরা এরূপে জনশ্রুতিতে কোন মতবাদ গ্রহণ করবে না। পুরুষ পরম্পরায়, অন্ধবিশ্বাসে, শাস্ত্রে উক্ত হয়েছে বলে, তর্ক প্রসুত মতে, অনুমানবশতঃ নিজের মতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলে ও ধর্মগুরুর প্রতি শ্রদ্ধাবশতঃ কোন মতবাদ গ্রহণ করবে না। কিন্তু, যখন তোমরা নিজে নিজেই জানতে পারবে যে- ‘এধর্মসমূহ অকুশল, দোষজনক, বিজ্ঞজনের নিন্দিত এবং এধর্মসমূহ সম্পাদিত হলে অহিত ও দুঃখের জন্য সংবর্তিত হয়’; কেবল তখনিই তা তোমরা ত্যাগ করবে। এরূপে যা ব্যক্ত হয়েছে; তা এই হেতুতেই ব্যক্ত হয়েছে।
ভদ্রিয়! তোমরা এরূপে জনশ্রুতিতে কোন মতবাদ গ্রহণ করবে না। পুরুষ পরম্পরায়, অন্ধবিশ্বাসে, শাস্ত্রে উক্ত হয়েছে বলে, তর্ক প্রসূত মতে, অনুমানবশতঃ নিজের মতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলে ও ধর্মগুরুর প্রতি শ্রদ্ধাবশতঃ কোন মতবাদ গ্রহণ করবে না। কিন্তু, যখন তোমরা নিজে নিজেই জানতে পারবে যে- ‘এধর্মসমূহ কুশল, দোষমুক্ত, বিজ্ঞজনের প্রশংসিত এবং এধর্মসমূহ সম্পাদিত হলে হিত ও সুখের জন্য সংবর্তিত হয়’; কেবল তখনিই তা তোমরা লাভ করে অবস্থান করবে।
ভদ্রিয়! তা তোমরা কি মনে কর, পুরুষের আধ্যাত্মিকভাবে যে অলোভ, অদোষ (অদ্বেষ), অমোহ ও অক্রোধ উৎপন্ন হয় তা কি তার হিতের জন্য উৎপন্ন হয়, নাকি অহিতের জন্য?’’ “ভন্তে! হিতের জন্য।’’ “ভদ্রিয়! অলোভী, দোষমুক্ত, মোহমুক্ত ও অক্রোধী পুরুষ পুদগল লোভ, দোষ, মোহ ও ক্রোধের দ্বারা অভিভূত না হয়ে (অলোভ, অদোষ, অমোহ ও অক্রোধ চিত্তে) প্রাণীহত্যা করে না, অদত্তবস্তু গ্রহণ করে না, পরদারে গমন করে না, মিথ্যা ভাষণ করে না এবং অপরকেও সেই কার্যে প্রবৃত্ত বা উৎসাহিত করায় না; যা দীর্ঘকাল ধরে হিত ও সুখের কারণ হয়।’’ হ্যাঁ, ভন্তে! এরূপ।’’
“ভদ্রিয়! তা তোমরা কি মনে কর, এই ধর্মসমূহ কুশল নাকি অকুশল?’’ “ভন্তে! কুশল।’’ “দোষযুক্ত নাকি দোষমুক্ত?’’ “ভন্তে! দোষমুক্ত।’’ “বিজ্ঞজনের গর্হিত নাকি প্রশংসিত?’’ “ভন্তে! প্রশংসিত।’’ সেই ধর্মসমূহ সম্পাদিত হলে অহিত ও দুঃখের সংবর্তিত হয় নাকি হয় না?’’ আর যদি তা হয় কিরূপেই বা এরূপ হয়?’’ “ভন্তে! সেই ধর্মসমূহ সম্পাদিত হলে হিত ও সুখের জন্য সংবর্তিত হয়। আর তা যদি হয় এভাবেই এরূপ হয় না।’’
ভদ্রিয়! সে বিষয়ে তাদেরকে আমরা পূর্ব হতে এরূপ বলে আসছি যে- তোমরা এরূপে জনশ্রুতিতে কোন মতবাদ গ্রহণ করবে না। পুরুষ পরম্পরায়, অন্ধবিশ্বাসে, শাস্ত্রে উক্ত হয়েছে বলে, তর্ক প্রসূত মতে, অনুমানবশতঃ নিজের মতের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ বলে ও ধর্মগুরুও প্রতি শ্রদ্ধাবশতঃ কোন মতবাদ গ্রহণ করবে না। কিন্তু, যখন তোমরা নিজে নিজেই জানতে পারবে যে- ‘এধর্মসমূহ কুশল, দোষমুক্ত, বিজ্ঞজনের প্রশংসিত এবং এধর্মসমূহ সম্পাদিত হলে হিত ও সুখের জন্য সংবর্তিত হয়’; কেবল তখনিই তা তোমরা লাভ করে অবস্থান করবে। এরূপে যা ব্যক্ত হয়েছে; তা এই হেতুতেই ব্যক্ত হয়েছে।
ভদ্রিয়! জগতে কোন সৎপুরুষ থাকলে তার শ্রাবককে এরূপে প্ররোচিত করে- ‘হে পুরুষ! এসো লোভকে ত্যাগ করে অবস্থান করো। লোভকে ত্যাগ করে অবস্থান করার সময় কায়িক, বাচনিক ও মানসিকভাবে লোভজনক কর্ম করো না। দোষকে (দ্বেষকে) ত্যাগ করে অবস্থান করো। দোষকে ত্যাগ করে অবস্থান করার সময় কায়িক, বাচনিক ও মানসিকভাবে দোষজনক কর্ম করো না। মোহকে ত্যাগ করে অবস্থান করো। মোহকে ত্যাগ করে অবস্থান করার সময় কায়িক, বাচনিক ও মানসিকভাবে মোহজনক কর্ম করো না। এবং ক্রোধকে ত্যাগ করে অবস্থান করো। ক্রোধকে ত্যাগ করে অবস্থান করার সময় কায়িক, বাচনিক ও মানসিকভাবে ক্রোধজনক কর্ম করো না।’’
এরূপ ব্যক্ত হলে ভদ্রিয় লিচ্ছবি ভগবানকে এরূপ বললেন- “অতি সুন্দর ভন্তে! অতি মনোরম! ভন্তে! যেমন, কেউ অধোমুখী পাত্রকে উর্ধ্বমুখী করে, আবৃতকে অনাবৃত করে, পথভ্রষ্টকে পথ বলে দেয় এবং অন্ধকারে তৈল প্রদীপ ধারণ করে যাতে চক্ষুষ্মান ব্যক্তি রূপাদি দেখতে পায়; ঠিক সেরূপেই ভগবানের দ্বারা অনেক পর্যায়ে ধর্ম প্রকাশিত হলো। এখন হতে আমি ভগবানের শরণ গ্রহণ করছি, ধর্ম এবং ভিক্ষু সংঘের শরণও গ্রহণ করছি। ভন্তে! আজ হতে আমাকে আপনার আমরণ শরণাগত উপাসকরূপে ধারণ করুন।’’
“হে ভদ্রিয়! তাহলে কি আমি তোমাকে এরূপ বলেছি যে- ‘ভদ্রিয়! এসো, আমার শিষ্যত্ব গ্রহণ কর, আমি তোমার শাস্তা হব?’’ “ভন্তে! না।’’ “এরূপবাদী ও এরূপ প্রকাশকারী কোন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণ আমাকে অসৎ, তুচ্ছ, মিথ্যা ও অভূতভাবে অপবাদ করে, যথা- ‘শ্রমণ গৌতম নাকি কুহকী মায়া জানেন, যা দ্বারা অন্য তীর্থিয় শ্রাবকদেরকেও আবর্তনী মায়ায় আবর্তিত করেন।’’ “ভন্তে! আবর্তনীয় মায়া সত্যি মঙ্গলপ্রদ ও কল্যাণকর। আমার প্রিয় আত্মীয়-স্বজনকে এই আবর্তনী মায়ায় আবর্তিত করতে পারলেই মঙ্গল।’’ ইহা আমার আত্মীয়-স্বজনদের দীর্ঘকাল হিত ও সুখের কারণ হবে। যদি সব ক্ষত্রিয়, ব্রাহ্মণ, বৈশ্য ও শূদ্রদের এই আবর্তনী মায়া দ্বারা আবর্তিত করতে পারি তবে তা সবার দীর্ঘকাল হিত ও সুখের কারণ হবে।’’
এরূপ ভদ্রিয়! তা এরূপই যে, অকুশল ধর্মসমূহ পরিত্যাগ ও কুশল ধর্মসমূহ লাভের জন্য যদি সব ক্ষত্রিয়দের এই আবর্তনী মায়া দ্বারা আবর্তিত করতে পারি তবে তা তাদের সবার দীর্ঘকাল হিত ও সুখের কারণ হবে। অকুশল ধর্মসমূহ পরিত্যাগ ও কুশল ধর্মসমূহ লাভের জন্য যদি সকল ব্রাহ্মণ, বৈশ্য ও শূদ্রদের আবর্তনী মায়া দ্বারা আবর্তিত করতে পারি তবে তা তাদের সবার দীর্ঘকাল হিত ও সুখের কারণ হবে। অকুশল ধর্মসমূহ পরিত্যাগের জন্য ও কুশল ধর্মসমূহ লাভের জন্য যদি সদেবলোক, সমারলোক, সব্রহ্মলোক, সশ্রমণ-ব্রাহ্মণগণ এবং সদেব মনুষ্যগণদেরও এই আবর্তনী দ্বারা আবর্তিত করতে পারি তবে তা তাদের সবার দীর্ঘকাল হিত ও সুখের কারণ হবে। আর ভদ্রিয়! অকুশল ধর্মসমূহ পরিত্যাগ ও কুশল ধর্মসমূহ লাভের জন্য যদি মহাশাল বৃক্ষরাজিকেও এই আবর্তনী মায়ায় আবর্তিত করতে পারি তবে তা তাদের সবার দীর্ঘকাল হিত ও সুখের কারণ হবে। আর মনুষ্যদের কথাই বা কি!’’ (তৃতীয় সূত্র)
৪. সামুগিযসুত্তং-সামুগিয় সূত্র
১৯৪. একসময় আয়ুষ্মান আনন্দ কোলিয়তে অবস্থান করছিলেন সামুগং নামক কোলিয়দের গ্রামে। অতঃপর বহুসংখ্যক সামুগিয় কোলিয়পুত্র আয়ুষ্মান আনন্দের নিকট উপস্থিত হয়ে তাকে অভিবাদন করে একপাশে উপবেশন করলেন। একপাশে উপবিষ্ট সেই সামুগিয় কোলিয়পুত্রগণকে আয়ুষ্মান আনন্দ এরূপ বললেন- “সেই ভগবান অরহত সম্যক সম্বুদ্ধ কর্তৃক সত্ত্বগণের বিশুদ্ধির জন্য, শোক-পরিদেবন অতিক্রমের জন্য, দুঃখ দৌর্মনস্য তিরোধানের জন্য, ন্যায়মার্গ লাভের জন্য ও নির্বাণ সাক্ষাতের জন্য চার প্রকার শ্রেষ্ঠ, পরিশুদ্ধ প্রধানীয় বা অনুশীলনীয় অঙ্গ জ্ঞাত, দর্শিত ও সম্যকরূপে ব্যাখ্যাত হয়েছে। সেই চার প্রকার কি কি? যথা- শীলপরিশুদ্ধি প্রধানীয় অঙ্গ, চিত্ত পরিশুদ্ধি প্রধানীয় অঙ্গ, দৃষ্টি পরিশুদ্ধি প্রধানীয় অঙ্গ ও বিমুক্তি পরিশুদ্ধি প্রধানীয় অঙ্গ।
শ্রেষ্ঠ শীল পরিশুদ্ধি প্রধানীয় অঙ্গ কিরূপ? এজগতে ভিক্ষু শ্রেষ্ঠ শীলবান হয়, প্রাতিমোক্ষ সংবরে সংযত, আচার-গোচরসম্পন্ন, অনুমাত্র নিন্দনীয় আচরণেও ভয়দর্শী হয়ে অবস্থান করে এবং শিক্ষাপদসমূহ গ্রহণ করতঃ চরিত্র গঠন করে। একেই শীল পরিশুদ্ধি বলে। এরূপে শীল পরিশুদ্ধি অপরিপূর্ণ থাকলে ‘পরিপূর্ণ করব’, পরিপূর্ণ থাকলে ‘সর্বত্র অনুগ্রহণ করব’ আর তথায় যেই ছন্দ (ইচ্ছা), ব্যায়াম (প্রচেষ্টা), উৎসাহ, উদ্যম, চেষ্টা, স্মৃতি ও সমপ্রজ্ঞান; একেই বলা হয় শীল পরিশুদ্ধি প্রধানীয় অঙ্গ।
শ্রেষ্ঠ চিত্ত পরিশুদ্ধি প্রধানীয় অঙ্গ কিরূপ? এজগতে ভিক্ষু শ্রেষ্ঠ কাম (কামনা) ও অকুশল ধর্মসমূহ হতে বিবিক্ত (পৃথক) হয়ে সবিতর্ক, সবিচার ও বিবেকজনিত প্রীতি সুখমণ্ডিত প্রথম ধ্যান লাভ করে অবস্থান করে। বিতর্ক ও বিচারের উপশমে আধ্যাত্মিক সমপ্রসাদী, চিত্তের একীভাব আনয়নকারী, অবিতর্ক, অবিচার সমাধিজনিত প্রীতি সুখমণ্ডিত দ্বিতীয় ধ্যান লাভ করে অবস্থান করে। সে প্রীতির প্রতিও বিরাগী হয়ে উপেক্ষাশীল হয়ে অবস্থান করে এবং স্মৃতিমান ও সমপ্রজ্ঞানী হয়ে কায়িক সুখ অনুভব করে; যে অবস্থায় থাকলে আর্যগণ ‘উপেক্ষক, স্মৃতিমান, সুখবিহারী’ বলে অভিহিত করেন সেই তৃতীয় ধ্যান লাভ করে অবস্থান করে। সর্ববিধ সুখ-দুঃখ পরিত্যাগ করে পূর্বেই মানসিক সৌমনস্য ও দৌর্মনস্যের বিনাশ সাধন করে সুখ-দুঃখহীন ‘উপেক্ষা স্মৃতি পরিশুদ্ধি’ নামক চতুর্থ ধ্যান লাভ করে অবস্থান করে। একেই চিত্ত পরিশুদ্ধি বলে। এরূপে চিত্ত পরিশুদ্ধি অপরিপূর্ণ থাকলে ‘পরিপূর্ণ করব’ পরিপূর্ণ থাকলে ‘সর্বত্র অনুগ্রহণ করব’। আর তথায় যেই ছন্দ, ব্যায়াম, উৎসাহ, উদ্যম, চেষ্টা, স্মৃতি ও সমপ্রজ্ঞান; একেই বলা হয় চিত্ত পরিশুদ্ধি প্রধানীয় অঙ্গ। দৃষ্টি পরিশুদ্ধি প্রধানীয় অঙ্গ কিরূপ? এজগতে ভিক্ষু ‘এটি দুঃখ’ তা যথার্থরূপে জানে, ‘এটি দুঃখ সমুদয়’, ‘এটি দুঃখ নিরোধ’, ‘এটি দুঃখ নিরোধের উপায়’ যথার্থভাবে জানে। একেই দৃষ্টি পরিশুদ্ধি বলে। এরূপে দৃষ্টি পরিশুদ্ধি অপরিপূর্ণ থাকলে ‘পরিপূর্ণ করব’, পরিপূর্ণ থাকলে ‘সর্বত্র অনুগ্রহ করব’ আর তথায় যেই ছন্দ, ব্যায়াম, উৎসাহ, উদ্যম, চেষ্টা, স্মৃতি ও সমপ্রজ্ঞান; একেই বলা হয় চিত্ত পরিশুদ্ধি প্রধানীয় অঙ্গ।
শ্রেষ্ঠ বিমুক্তি পরিশুদ্ধি প্রধানীয় অঙ্গ কিরূপ? শ্রেষ্ঠ আর্যশ্রাবক এই শীল পরিশুদ্ধি প্রধানীয় অঙ্গ, চিত্ত পরিশুদ্ধি প্রধানীয় অঙ্গ ও দৃষ্টি পরিশুদ্ধি প্রধানীয় অঙ্গ দ্বারা কামোদ্দীপক ধর্মসমূহ হতে চিত্তকে সরিয়ে রাখে ও বন্ধন মুক্তিকারক ধর্মসমূহ দ্বারা চিত্তকে মুক্ত করে। সে কামোদ্দীপক ধর্মসমূহ হতে চিত্তকে সরিয়ে রেখে ও বন্ধন মুক্তিকারক ধর্মসমূহ দ্বারা চিত্তকে মুক্ত করতঃ সম্যক বিমুক্তি লাভ করে। একেই বিমুক্তি পরিশুদ্ধি বলে। এরূপে বিমুক্তি পরিশুদ্ধি অপরিপূর্ণ থাকলে ‘পরিপূর্ণ করব’, পরিপূর্ণ থাকলে ‘সর্বত্র অনুগ্রহণ করব’ আর তথায় যেই ছন্দ, ব্যায়াম, উৎসাহ, উদ্যম, চেষ্টা, স্মৃতি ও সমপ্রজ্ঞান; একেই বলা হয় বিমুক্তি পরিশুদ্ধি প্রধানীয় অঙ্গ।
সেই ভগবান অরহত সম্যক সম্বুদ্ধ কর্তৃক সত্ত্বগণকে বিশুদ্ধির জন্য, শোক-পরিদেবন অতিক্রমের জন্য, দুঃখ-দৌর্মনস্য তিরোধানের জন্য, ন্যায়মার্গ লাভের জন্য ও নির্বাণ সাক্ষাতের জন্য এই চার প্রকার শ্রেষ্ঠ পরিশুদ্ধ প্রধানীয় বা অনুশীলনীয় অঙ্গ জ্ঞাত, দর্শিত ও সম্যকরূপে ব্যাখ্যাত হয়েছে।’’ (চতুর্থ সূত্র)
৫. বপ্পসুত্তং-বপ্প সূত্র
১৯৫. একসময় ভগবান শাক্য নগরীতে অবস্থান করছিলেন কপিলাবস্তুর নিগ্রোধারামে। সে সময়ে নির্গ্রন্থশ্রাবক বপ্প শাক্য আয়ুষ্মান মহামৌদ্গল্যায়নের নিকট উপস্থিত হয়ে তাকে অভিবাদন করতঃ একপাশে উপবেশন করলেন। একপাশে উপবিষ্ট নির্গ্রন্থশ্রাবক বপ্প শাক্যকে আয়ুষ্মান মহামৌদ্গল্যায়ন এরূপ বললেন-
“হে বপ্প! কায়িক, বাচনিক ও মানসিকভাবে সংযত হলে অবিদ্যা ধ্বংস হয়ে বিদ্যা উৎপন্ন হয়। সেই কারণ কি তুমি দেখতে পাচ্ছ না, যেই কারণে পুরুষ দুঃখবেদনীয় আস্রবসমূহের স্রোতে পড়ে পুনর্জন্ম হচ্ছে?’’ “হ্যাঁ ভন্তে! সেই কারণ আমি দেখতে পাচ্ছি। এটি পূর্বকৃত পাপকর্মের পরিপক্ক বিপাক। সেই কারণে বা হেতুতেই পুরুষ দুঃখবেদনীয় আস্রবসমূহের স্রোতে পড়ে পুনর্জন্ম হচ্ছে।’’ এভাবে আয়ুষ্মান মহামৌদ্গল্যায়ন ও নির্গ্রন্থশ্রাবক বপ্প শাক্যের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল। অতঃপর ভগবান সায়াহ্ন সময়ে নির্জনতা (ধ্যান) হতে উঠে উপস্থানশালায় উপস্থিত হয়ে প্রজ্ঞাপ্ত আসনে উপবেশন করলেন। প্রজ্ঞাপ্ত আসনে উপবিষ্ট ভগবান আয়ুষ্মান মহামৌদ্গল্যায়নকে এরূপ বললেন-
“হে মৌদ্গল্যায়ন! একত্রিত হয়ে তোমাদের মধ্যে কোন বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল?’’ “ভন্তে! নির্গ্রন্থশ্রাবক বপ্প শাক্যকে আমি এরূপ বলেছিলাম- ‘হে বপ্প! কায়িক, বাচনিক ও মানসিকভাবে সংযত হলে অবিদ্যা ধ্বংস হয়ে বিদ্যা উৎপন্ন হয়। সেই কারণ কি তুমি দেখতে পাচ্ছ না, যেই কারণে পুরুষ দুঃখবেদনীয় আস্রবসমূহের স্রোতে পড়ে পুনর্জন্ম হচ্ছে?’’ এরূপ বললে নির্গ্রন্থশ্রাবক বপ্প শাক্য আমাকে বলল- ‘হ্যাঁ ভন্তে! সেই কারণ আমি দেখতে পাচ্ছি। এটি পূর্বকৃত পাপকর্মের পরিপক্ক বিপাক। যেই কারণে বা হেতুতেই পুরুষ দুঃখবেদনীয় আস্রবসমূহের স্রোতে পড়ে পুনর্জন্ম হচ্ছে।’’ ভন্তে! এই বিষয়েই আমার ও নির্গ্রন্থশ্রাবক বপ্প শাক্যের মধ্যে আলোচনা হচ্ছিল; অনন্তর ভগবান আগমন করলেন।
অতঃপর ভগবান নির্গ্রন্থশ্রাবক বপ্প শাক্যকে এরূপ বললেন- “হে বপ্প! যদি তুমি আমাকে সঠিকরূপে জানতে পার, প্রত্যাখ্যানীয় বিষয় প্রত্যাখ্যান কর এবং আমার দ্বারা ভাষিত যেই বিষয়ের অর্থ বুঝতে না পার তা আমার নিকট উত্তরোত্তর জিজ্ঞাসা করতে পার যে- ‘ভন্তে! এটির অর্থ কিরূপ? আর এটি অনুকূল কথা নয় কি?’’ “ভন্তে! আমি ভগবানকে সঠিকরূপে জানব, প্রত্যাখ্যানীয় বিষয় প্রত্যাখ্যান করব এবং ভগবানের দ্বারা ভাষিত যেই বিষয়ের অর্থ বুঝতে না পারি বা আমি ভগবানের নিকট উত্তরোত্তর জিজ্ঞাসা করবো যে- ‘ভন্তে! এটির অর্থ কিরূপ? আর এটি অনুকূল কথা নয় কি?’’
বপ্প! তা তুমি কি মনে কর, যে ব্যক্তির কায়িক, বাচনিক, মানসিক ও অবিদ্যার দ্বারা কৃতকর্মের প্রত্যয়ে যেরূপ আস্রব ও পরিলাহ (কষ্ট) উৎপন্ন হয়, কিন্তু কায়িক, বাচনিক, মানসিক ও অবিদ্যার দ্বারা কৃতকর্ম হতে নিবৃত্তজনের সেরূপ আস্রব ও পরিলাহ উৎপন্ন হয় না। সে নতুনভাবে আর কোন কর্ম (কার্য) করে না, পুরনো কৃতকর্ম প্রাপ্ত হলেও তা ধ্বংস করে; যা সন্দৃষ্টিক, নির্জরা, অকালিক, এসে দেখার যোগ্য, ঔপনায়িক ও বিজ্ঞজন কর্তৃক জ্ঞাতব্য। সেই কারণ কি তুমি দেখতে পাচ্ছ না, যেই কারণে পুরুষ দুঃখবেদনীয় আস্রবসমূহের স্রোতে পড়ে পুনর্জন্ম গ্রহণ করছে।’’
“না ভন্তে!’’
বপ্প! এরূপে সম্যকভাবে বিমুক্তচিত্ত ভিক্ষুর সতত অবস্থানের দরুন ছয়টি বিষয় অধিগত হয়। যথা- যে চক্ষু দ্বারা রূপ দর্শন করে, সুমনা কিংবা দুর্মনা না হয়ে উপেক্ষক, স্মৃতিমান ও সমপ্রজ্ঞানী হয়ে অবস্থান করে। একইভাবে শ্রোত্র দ্বারা শব্দ শ্রবণ করে, ঘ্রাণ দ্বারা গন্ধ গ্রহণ করে, জিহ্বা দ্বারা রসাস্বাদন করে, কায় দ্বারা স্পষ্টব্য সংস্পর্শ করে এবং মন দ্বারা ধর্মানুভব করে সুমনা কিংবা দুর্মনা না হয়ে উপেক্ষক, স্মৃতিমান ও সমপ্রজ্ঞানী হয়ে অবস্থান করে। সে কায় দ্বারা সঙ্কীর্ণ বেদনা অনুভব করলে, ‘আমি কায় দ্বারা সঙ্কীর্ণ বেদনা অনুভব করছি’ বলে প্রকৃতরূপে জানে; জীবিত সঙ্কীর্ণ বেদনা অনুভব করলে ‘আমি জীবিত সঙ্কীর্ণ বেদনা অনুভব করছি’ বলে প্রকৃতরূপে জানে; আর ‘কায় ভেদে মৃত্যুর পর (জীবনাবসানের পর) এই সকল অনুভূতি অনভিনন্দিত ও প্রশান্ত হবে’ তাও প্রকৃতরূপে জানে।
যেমন, বপ্প! যজ্ঞীয় খুঁটি বা স্তম্ভের প্রত্যয়ে ছায়া প্রতিবিম্বিত হয়। অতঃপর কোন পুরুষ কোদাল এবং ঝুড়ি নিয়ে আগমন করে। সে সেই যজ্ঞীয় খুঁটির মূল ছেদন করে, মূল ছেদন পূর্বক সমূলে উঠিয়ে ফেলে উশীর নালি পর্যন্ত মূল অবশিষ্ট না রেখে সমস্ত মূল উপড়িয়ে নিয়ে আসে। তারপর খণ্ড-বিখণ্ড করে ছেদন করে। খণ্ড-বিখণ্ড করে ছেদন করতঃ ফাড়ে। ফাড়ার পর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত করে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র করে বিভক্ত করতঃ বাতাসে ও রৌদ্রে শুকায়। বাতাসে ও রৌদ্রে শুকিয়ে অগ্নিদ্বারা দগ্ধ করে। অগ্নি দ্বারা দগ্ধ করতঃ চূর্ণ করে, চূর্ণ করতঃ প্রচণ্ড বাতাসে উড়িয়ে দেয় অথবা খরস্রোত নদীতে ভাসিয়ে দেয়। বপ্প! এরূপে সেই যজ্ঞীয় খুঁটির প্রত্যয়ে প্রতিবিম্বিত ছায়া মূলোৎপাটিত তালবৃক্ষ সদৃশ সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস ও পুনরোৎপত্তি রহিত হয়।
বপ্প! ঠিক এরূপেই সম্যকভাবে বিমুক্তচিত্ত ভিক্ষুর সতত অবস্থানের দরুন ছয়টি বিষয় অধিগত হয়। যথা- সে চক্ষু দ্বারা রূপ দর্শন করে সুমনা কিংবা দুর্মনা না হয়ে উপেক্ষক, স্মৃতিমান ও সমপ্রজ্ঞানী হয়ে অবস্থান করে। একইভাবে শ্রোত্র দ্বারা শব্দ শ্রবণ করে, ঘ্রাণ দ্বারা গন্ধ গ্রহণ করে, জিহ্বা দ্বারা রসাস্বাদন করে, কায় দ্বারা স্পষ্টব্য সংস্পর্শ করে এবং মন দ্বারা ধর্মানুভব করে সুমনা কিংবা দুর্মনা না হয়ে উপেক্ষক, স্মৃতিমান ও সমপ্রজ্ঞানী হয়ে অবস্থান করে। সে কায় দ্বারা সঙ্কীর্ণ বেদনা অনুভব করলে ‘আমি কায় দ্বারা সঙ্কীর্ণ বেদনা অনুভব করছি’ বলে প্রকৃতরূপে জানে; জীবিত সঙ্কীর্ণ বেদনা অনুভব করলে ‘আমি জীবিত সঙ্কীর্ণ বেদনা অনুভব করছি’ বলে প্রকৃতরূপে জানে; আর ‘কায় ভেদে মৃত্যুর পর এই সকল অনুভূতি অনভিনন্দিত ও প্রশান্ত হবে’ তাও প্রকৃতরূপে জানে।
এরূপ উক্ত হলে নির্গ্রন্থশ্রাবক বপ্প শাক্য ভগবানকে এরূপ বললেন- “ভন্তে! যেমন, ধনাকাঙক্ষী পুরুষ পণ্যদ্রব্য সরবরাহ করে। সে তা লাভ করে না, অধিকন্তু পরিশ্রান্ত ও কষ্টের ভাগী হয়। তদ্রুপভাবেই আমিও ধনাকাঙক্ষী মূর্খ নির্গ্রন্থগণকে পূজা করেছি। তাই আমি কোন ফল লাভ করিনি, অধিকন্তু পরিশ্রান্ত ও কষ্টের ভাগী হয়েছি। ভন্তে! মূর্খ নির্গ্রন্থগণের প্রতি যে আমার শ্রদ্ধা ছিল আজ হতে তা আমি প্রচণ্ড বাতাসে উড়িয়ে দিচ্ছি এবং খরস্রোত নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছি। অতি সুন্দর ভন্তে! অতি মনোরম ভন্তে! যেমন, কেউ অধোমুখী পাত্রকে উর্ধমুখী করে, আবৃতকে অনাবৃত করে, পথভ্রষ্টকে পথ বলে দেয় এবং অন্ধকারে তৈল প্রদীপ ধারণ করে যাতে চক্ষুষ্মান ব্যক্তি রূপাদি দেখতে পায়; ঠিক সেরূপেই ভগবানের দ্বারা অনেক পর্যায়ে ধর্ম প্রকাশিত হলো। এখন হতে আমি ভগবানের শরণ গ্রহণ করছি, ধর্ম এবং ভিক্ষুসংঘের শরণও গ্রহণ করছি। ভন্তে! আজ হতে আমাকে আপনার আমরণ শরণাগত উপাসকরূপে ধারণ করুন।’’ (পঞ্চম সূত্র)
৬. সালহসুত্তং-সাল্হ সূত্র
১৯৬. একসময় ভগবান বৈশালীতে অবস্থান করছিলেন মহাবনস্থ কূটাগারশালায়। সে সময় সাল্হ ও অভয় লিচ্ছবি ভগবানের নিকট উপস্থিত হওতঃ ভগবানকে অভিবাদন করে একপাশে উপবেশন করলেন। একপাশে উপবিষ্ট সাল্হ লিচ্ছবি ভগবানকে এরূপ বললেন-
“ভন্তে! কোন কোন শ্রমণ-ব্রাহ্মণ আছেন যারা দ্বিবিধ বিষয়ের দ্বারা ওঘ (স্রোত) উত্তীর্ণ প্রজ্ঞাপ্ত করেন, যথা- শীল বিশুদ্ধি ও তপস্যা পরিহার। এক্ষেত্রে ভগবান কি বলবেন?’’
“হে সাল্হ! শীল বিশুদ্ধিকে আমি অন্যতর শ্রমণ্য অঙ্গ বলি। যেই শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণ তপস্যা পরিহারবাদী, তপস্যা পরিহারাচারী ও তপস্যা পরিহারাবদ্ধ হয়ে অবস্থান করে, তারা ওঘোত্তীর্ণ হতে অক্ষম হয়। আর যেই শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণ অপরিশুদ্ধ কায় সদাচারসম্পন্ন, অপরিশুদ্ধ বাচনিক সদাচারসম্পন্ন, অপরিশুদ্ধ মনো সদাচারসম্পন্ন ও অপরিশুদ্ধ জীবনধারী তারাও জ্ঞানদর্শন ও অনুত্তর সম্বোধি লাভ করতে অক্ষম।
সাল্হ! যেমন, পুুরুষ নদী পারেচ্ছুক হয়ে ধারালো কুঠার নিয়ে বনে প্রবেশ করে। সে তথায় বৃহৎ, ঋজু, সতেজ ও অধিক উচ্চতা সম্পন্ন শালবৃক্ষ দর্শন করে। তখন সেই বৃক্ষের মূল ছেদন করে, মূল ছেদন করতঃ অগ্রভাগ ছেদন করে; অগ্রভাগ ছেদন করতঃ শাখাপত্রাদি সুবিশোধিত ও পরিস্কার করে; শাখাপত্রাদি সুবিশোধিত ও পরিস্কার করতঃ কুঠার দ্বারা কিছু কিছু করে কেটে (ছেঁটে) নেয়; কুঠার দ্বারা কিছু কিছু করে কেটে ছেঁটে নেওয়ার পর ধারালো ছুরি দিয়ে আরো কিছু কিছু করে কেটে ছেঁটে নেয়; ধারালো ছুরি দিয়ে আরো কিছু কিছু করে কেটে ছেঁটে নেওয়ার পর লেখনী (কলম) দিয়ে লিখে; লেখনী দিয়ে লেখার পর পাষাণ গোলক (নরম পাথরের ঢেলা যা ধৌতকার্যে ব্যবহৃত হয়) দিয়ে ধৌত করে এবং পাষাণ গোলক দিয়ে ধৌত করতঃ নদীতে ভাসিয়ে দেয়।
সাল্হ! তা তুমি কি মনে কর, সেই পুরুষ কি নদী পার হতে পারবে?’’ “না ভন্তে!’’ “তার কারণ কি?’’ “ভন্তে! সেই শালবৃক্ষ বাহ্যিকভাবে সুপরিকর্মকৃত কিন্তু ভিতরে অবিশুদ্ধ, তার প্রতি এরূপ প্রত্যাশিত যে- শালবৃক্ষ ডুবে যাবে ও পুরুষটি দুর্বিপাকে পড়বে।’’
“সাল্হ! তদ্রুপ, যেই শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণ তপস্যা পরিহারবাদী, তপস্যা পরিহারাচারী ও তপস্যা পরিহারাবদ্ধ হয়ে অবস্থান করে, তারা ওঘোত্তীর্ণ হতে অক্ষম হয়। আর যেই শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণ অপরিশুদ্ধ কায় সদাচারসম্পন্ন, অপরিশুদ্ধ বাচনিক সদাচারসম্পন্ন, অপরিশুদ্ধ মনো সদাচারসম্পন্ন ও অপরিশুদ্ধ জীবনধারী তারাও জ্ঞানদর্শন ও অনুত্তর সম্বোধি লাভ করতে অক্ষম।
সাল্হ! যেই শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণ তপস্যা অপরিহারবাদী, তপস্যা অপরিহারাচারী ও তপস্যা অপরিহারাবদ্ধ হয়ে অবস্থান করে, তারা ওঘোত্তীর্ণ হতে সক্ষম হয়। আর যেই শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণ পরিশুদ্ধ কায় সদাচারসম্পন্ন, পরিশুদ্ধ বাচনিক সদাচারসম্পন্ন, পরিশুদ্ধ মনো সদাচারসম্পন্ন ও পরিশুদ্ধ জীবনধারী তারাও জ্ঞানদর্শন ও অনুত্তর সম্বোধি লাভ করতে সক্ষম হয়।
সাল্হ! যেমন, পুরুষ নদী পারেচ্ছুক হয়ে ধারালো কুঠার নিয়ে বনে প্রবেশ করে। সে তথায় বৃহৎ, ঋজু, সতেজ ও অধিক উচ্চতা সম্পন্ন শালবৃক্ষ দর্শন করে। তখন সেই বৃক্ষের মূল ছেদন করে, মূল ছেদন করতঃ অগ্রভাগ ছেদন করে; অগ্রভাগ ছেদন করতঃ শাখাপত্রাদি সুবিশোধিত ও পরিস্কার করে; শাখাপত্রাধি সুবিশোধিত ও পরিস্কার করতঃ কুঠার দ্বারা কিছু কিছু করে ছেঁটে নেয়, কুঠা’র দ্বারা কিছু কিছু করে পর ধারালো ছুরি দিয়ে আরো কিছু কিছু করে ছেঁটে নেয়; ধারালো ছুরি দিয়ে আরো কিছু ুকছু করে ছেঁটে নেওয়ার পর ধারালো বাটালি নিয়ে ভিতরে সুবিশোধিত ও পরিস্কার করে; ভিতরে সুবিশোধিত ও পরিস্কৃত করতঃ লেখনী দিয়ে লিখে; লেখনী দিয়ে লেখার পর পাষাণ গোলক দিয়ে ধৌত করে; পাষাণ গোলক দিয়ে ধৌত করতঃ পর নৌকা তৈরী করে; নৌকা তৈরী করার ক্ষেপণী (দাঁড়) বাঁধে এবং ক্ষেপণী বাঁধার পর নদীতে আনয়ন করে।
সাল্হ! তা তুমি কি মনে কর, সেই পুরুষ কি নদী পার হতে পারবে?’’ “হ্যাঁ ভন্তে!’’ “তার কারণ কি?’’ “ভন্তে! সেই শালবৃক্ষ বাহ্যিকভাবে সুপরিকর্মকৃত, ভিতরে সুবিশুদ্ধ ও ক্ষেপণী বাঁধা। তার প্রতি এরূপ প্রত্যাশিত যে- ‘নৌকাটি ডুবে না যাবে ও পুরুষটি নিরাপদে পরপারে গমন করতে পারবে।’’
“সাল্হ! তদ্রুপ, যেই শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণ তপস্যা অপরিহারবাদী, তপস্যা অপরিহারাচারী ও তপস্যা অপরিহারাবদ্ধ হয়ে অবস্থান করে, তারা ওঘোত্তীর্ণ হতে সক্ষম হয়। আর যেই শ্রমণ-ব্রাহ্মণগণ পরিশুদ্ধ কায় সদাচারসম্পন্ন, পরিশুদ্ধ বাচনিক সদাচারসম্পন্ন, পরিশুদ্ধ মনো সদাচারসম্পন্ন ও পরিশুদ্ধ জীবনধারী তারাও জ্ঞানদর্শন ও অনুত্তর সম্বোধি লাভ করতে সক্ষম হয়। যেমন, একজন যোদ্ধা বহু চমৎকার শর (বান) সম্বন্ধে জানে; অতঃপর সে তিনটি কারণে রাজার যোগ্য, রাজভোগ্য ও রাজার উপযুক্ত বলে পরিগণিত হয়। সেই ত্রিবিধ কারণ কি কি? দূরভেদক, অক্ষণভেদী ও বহুসংখ্যক বস্তু বা কায় বিদ্ধকারী।
সাল্হ! যেমন, একজন যোদ্ধা দূরভেদক হয়; ঠিক এরূপে আর্যশ্রাবকও সম্যক সম্বোধি সম্পন্ন হয়। সম্যক সম্বোধি সম্পন্ন আর্যশ্রাবক অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, অভ্যন্তরীণ, বাহ্যিক, স্থূল, সূক্ষ্ম, হীন, প্রণীত ও দূরে বা নিকটে যে সমস্ত রূপ আছে, সে সমস্ত রূপকে সে ‘এটি আমার নয়, এটি আমি নই ও এটি আমার আত্মা নয়’ এরূপে সম্যক প্রজ্ঞা দ্বারা যথাযথভাবে দর্শন করে। একইভাবে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, অভ্যন্তরীণ, বাহ্যিক, স্থূল, সূক্ষ্ম, হীন, প্রণীত ও দূরে বা নিকটে যে সমস্ত বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞান আছে, সে সমস্ত বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞানকে সে ‘এটি আমার নয়, এটি আমি নই ও এটি আমার আত্মা নয়’ এরূপে সম্যক প্রজ্ঞা দ্বারা যথাযথভাবে দর্শন করে।
সাল্হ! যেমন, একজন যোদ্ধা অক্ষণভেদী হয়; ঠিক এরূপে আর্যশ্রাবকও সম্যক দৃষ্টিসম্পন্ন হয়। সম্যক দৃষ্টিসম্পন্ন আর্যশ্রাবক ‘এটি দুঃখ’ তা যথার্থরূপে জানে, ‘এটি দুঃখ সমুদয়’ ‘এটি দুঃখ নিরোধ’ ও ‘এটি দুঃখ নিরোধের উপায়’ বলেও তা যথার্থরূপে জানে।
সাল্হ! যেমন, একজন যোদ্ধা বহুসংখ্যক বস্তু বা কায় বিদ্ধকারী হয়; তদ্রুপভাবে আর্যশ্রাবকও সম্যক বিমুক্তিসম্পন্ন হয়। সম্যক বিমুক্তিসমপন্ন আর্যশ্রাবক বৃহৎ অবিদ্যাস্কন্ধকে বিদ্ধ করে।’’ (ষষ্ঠ সূত্র)
৭. মল্লিকাদেবীসুত্তং-মল্লিকাদেবী সূত্র
১৯৭. একসময় ভগবান শ্রাবস্তীতে অনাথপিণ্ডিক কর্তৃক নির্মিত জেতবনারামে অবস্থান করছিলেন। সে সময় মল্লিকাদেবী ভগবানের নিকট উপস্থিত হয়ে ভগবানকে অভিবাদন করতঃ একপাশে উপবেশন করলেন। একপাশে উপবিষ্ট মল্লিকাদেবী ভগবানকে এরূপ বললেন-
“ভন্তে! কোন হেতু ও কোন প্রত্যয়ে কোন কোন স্ত্রীলোক দুর্বর্ণা, বিশ্রী, অত্যন্ত পাপী, দরিদ্র, নিঃস্ব, অল্পভোগী ও প্রভাবহীনা হয়?
কোন হেতু ও কোন প্রত্যয়ে কোন কোন স্ত্রীলোক দুর্বর্ণা, বিশ্রী ও অত্যন্ত পাপী হয় কিন্তু আঢ্য, মহাধনী, মহাভোগী ও প্রভাবশালী হয়?
কোন হেতু ও কোন প্রত্যয়ে কোন কোন স্ত্রীলোক অভিরূপা, দর্শনীয়া, প্রাসাদিকা ও পরম বর্ণ সৌন্দর্যতায় সমন্নাগতা হয় কিন্তু দরিদ্র, নিঃস্ব, অল্পভোগী ও প্রভাবহীনা হয়?
আর কোন হেতু ও কোন প্রত্যয়ে কোন কোন স্ত্রীলোক অভিরূপা, দর্শনীয়া, প্রাসাদিকা, পরম বর্ণ সৌন্দর্যতায় সমন্নাগতা এবং আঢ্য, মহাধনী, মহাভোগী ও প্রভাবশালী হয়?’’
“হে মল্লিকে! এজগতে কোন কোন স্ত্রীলোক ক্রোধী ও উপায়াসবহুলী হয়। সামান্য কিছু বললেই সে ক্রদ্ধ ও কুপিত হয়ে বিবাদ আর লাফালাফি করে (অত্যাধিক প্রতিবাদী হয়ে উঠে); কোপ, দোষ (দ্বেষ) ও অসন্তোষ প্রকাশ করে। সে শ্রমণ-ব্রাহ্মণকে অন্ন, পানীয়, বস্ত্র, যান, মাল্য, সুগন্ধি দ্রব্য, বিলেপনীয় বস্তু, শয্যা, গৃহ ও প্রদীপাদি কিছুই দান করে না। ঈর্ষাপরায়ণা হয়, অপরের লাভ-সৎকার-গৌরব-সম্মান-বন্দনা ও পূজাদি প্রাপ্তিতে ঈর্ষা করে, ঈর্ষাবশে আক্রোশ করে দোষ খোঁজে এবং ঈর্ষাচিত্ত পোষণ করে। সেরূপ কর্ম সম্পাদন হেতু তথা হতে মৃত্যুর পর স্ত্রীত্ব প্রাপ্ত হয়। সে যেই যেই স্থানে পুনর্জন্ম হোক না কেন দুর্বণা, বিশ্রী, দেখতে অত্যন্ত পাপী, দরিদ্র, নিঃস্ব, অল্পভোগী ও প্রভাবহীনা হয়।
মল্লিকে! এজগতে কোন কোন স্ত্রীলোক ক্রোধী ও উপায়াসবহুলী হয়। সামান্য কিছু বললেই সে ক্রদ্ধ ও কুপিত হয়ে বিবাদ আর লাফালাফি করে; কোপ, দোষ ও অসন্তোষ প্রকাশ করে। কিন্তু সে শ্রমণ-ব্রাহ্মণকে অন্ন, পানীয়, বস্ত্র, যান, মাল্য, সুগন্ধি দ্রব্য, বিলেপনীয় বস্তু, শয্যা, গৃহ ও প্রদীপাদি কিছুই দান করে। ঈর্ষাপরায়ণা হয় না, অপরের লাভ-সৎকার-গৌরব-সম্মান-বন্দনা ও পূজাদি প্রাপ্তিতে ঈর্ষা করে না, ঈর্ষাবশে আক্রোশ করে দোষ খোঁজে না এবং ঈর্ষাচিত্ত পোষণ করে না। সেরূপ কর্ম সম্পাদন হেতু তথা হতে মৃত্যুর পর স্ত্রীত্ব প্রাপ্ত হয়। সে যেই যেই স্থানে পুনর্জন্ম হোক না কেন দুর্বর্ণা, বিশ্রী, অত্যন্ত পাপী হয় কিন্তু আঢ্য, মহাধনী, মহাভোগী ও প্রভাবশালী হয়।
মল্লিকে! এজগতে কোন কোন স্ত্রীলোক অক্রোধী ও উপায়াস বিহীন হয়। তাকে বহু কিছু বলা হলেও সে ক্রদ্ধ ও কুপিত হয়ে বিবাদ আর লাফালাফি করে না; কোপ, দোষ (দ্বেষ) ও অসন্তোষ প্রকাশ করে না। কিন্তু সে শ্রমণ-ব্রাহ্মণকে অন্ন, পানীয়, বস্ত্র, যান, মাল্য, সুগন্ধি দ্রব্য, বিলেপনীয় বস্তু, শয্যা, গৃহ ও প্রদীপাদি কিছুই দান করে না। ঈর্ষাপরায়ণা হয়, অপরের লাভ-সৎকার-গৌরব-সম্মান-বন্দনা ও পূজাদি প্রাপ্তিতে ঈর্ষা করে, ঈর্ষাবশে আক্রোশ করে দোষ খোঁজে এবং ঈর্ষাচিত্ত পোষণ করে। সেরূপ কর্ম সম্পাদন হেতু তথা হতে মৃত্যুর পর স্ত্রীত্ব প্রাপ্ত হয়। আর সে যেই যেই স্থানে পুনর্জন্ম হোক না কেন অভিরূপা, দর্শনীয়া, প্রাসাদিকা ও পরম বর্ণ সৌন্দর্যতায় সমন্নাগতা হয় কিন্তু দরিদ্র, নিঃস্ব, অল্পভোগী ও প্রভাবহীনা হয়।
মল্লিকে! এজগতে কোন কোন স্ত্রীলোক অক্রোধী ও উপায়াস বিহীন হয়। তাকে বহু কিছু বলা হলেও সে ক্রদ্ধ ও কুপিত হয়ে বিবাদ আর লাফালাফি করে না; কোপ, দোষ (দ্বেষ) ও অসন্তোষ প্রকাশ করে না। সে শ্রমণ-ব্রাহ্মণকে অন্ন, পানীয়, বস্ত্র, যান, মাল্য, সুগন্ধি দ্রব্য, বিলেপনীয় বস্তু, শয্যা, গৃহ ও প্রদীপাদি দান করে। সে ঈর্ষা পরায়ণা হয় না, অপরের লাভ-সৎকার-গৌরব-সম্মান-বন্দনা ও পূজাদি প্রাপ্তিতে ঈর্ষা করে না, ঈর্ষাবশে আক্রোশ করে দোষ খোঁজে না এবং ঈর্ষাচিত্তও পোষণ করে না। সেরূপ কর্ম সম্পাদন হেতু তথা হতে মৃত্যুর পর স্ত্রীত্ব প্রাপ্ত হয়। সে যেই যেই স্থানে পুনর্জন্ম হোক না কেন অভিরূপা, দর্শনীয়া, প্রাসাদিকা, পরম বর্ণ সৌন্দর্যতায় সমন্নাগতা, আঢ্য, মহাধনী, মহাভোগী ও প্রভাবশালী হয়।
মল্লিকে! এই হেতু ও এই প্রত্যয়ের কারণে কোন কোন স্ত্রীলোক দুর্বণা, বিশ্রী, দেখতে অত্যন্ত পাপী, দরিদ্র, নিঃস্ব, অল্পভোগী ও প্রভাবহীনা হয়। এই হেতু ও প্রত্যয়ের কারণে কোন কোন স্ত্রীলোক দুর্বণা, বিশ্রী ও দেখতে অত্যন্ত পাপী হয় কিন্তু আঢ্য, মহাধনী, মহাভোগী ও প্রভাবশালী হয়। এই হেতু ও এই প্রত্যয়ের কারণে কোন কোন স্ত্রীলোক অভিরূপা, দর্শনীয়া, প্রাসাদিকা ও পরম বর্ণ সৌন্দর্যতায় সমন্নাগতা হয় কিন্তু দরিদ্র, নিঃস্ব, অল্পভোগী ও প্রভাবহীনা হয়। আর এই হেতু ও এই প্রত্যয়ের কারণেই কোন কোন স্ত্রীলোক অভিরূপা, দর্শনীয়া, প্রাসাদিকা, পরম বর্ণ সৌন্দর্যতায় সমন্নাগতা, আঢ্য, মহাধনী, মহাভোগী ও প্রভাবশালী হয়।’’
এরূপ উক্ত হলে মল্লিকাদেবী ভগবানকে এরূপ বলেলেন- “ভন্তে! সম্ভবত আমি পূর্বজন্মে ক্রোধী ও উপায়াসবহুলী ছিলাম, সামান্য কিছু বললেই ক্রদ্ধ ও কুপিত হয়ে বিবাদ করছি আর দুর্বিনীত আচরণ করেছি, কোপ, দোষ (দ্বেষ) ও অসন্তোষ প্রকাশ করেছি, যার দরুন আমি এখন দুর্বণা, বিশ্রী ও দেখতে অত্যন্ত পাপী।
ভন্তে! সম্ভবত আমি পূর্বজন্মে শ্রমণ-ব্রাহ্মণকে অন্ন, পানীয়, বস্ত্র, যান, মাল্য, সুগন্ধি দ্রব্য, বিলেপনীয় বস্তু, শয্যা, গৃহ ও প্রদীপাদি দান করেছি, যার দরুন এখন আমি আঢ্য, মহাধনী ও মহাভোগী।
ভন্তে! সম্ভবত আমি পূর্বজন্মে ঈর্ষাপরায়ণা ছিলাম না, অপরের লাভ-সৎকার-গৌরব-সম্মান-বন্দনা ও পূজাদি প্রাপ্তিতে ঈর্ষা করিনি, ঈর্ষাবশে আক্রোশ করে দোষ খুঁজিনি এবং ঈর্ষাচিত্তও পোষণ করিনি। যার দরুন এখন আমি প্রভাবশালী। ভন্তে! এই রাজকুলে ক্ষত্রিয় কন্যা, ব্রাহ্মণ কন্যা ও গৃহপতি কন্যা আছে, তাদেরকে আমি শাসন (অত্যাচার) করি। আজ হতে আমি অক্রোধী ও উপায়াস বিহীনা হবো, বহুকিছু বললেও ক্রদ্ধ ও কুপিত হয়ে বিবাদ করবো না আর দুর্বিনীত আচরণ করবো না; কোপ, দোষ (দ্বেষ) ও অসন্তোষও প্রকাশ করবো না; শ্রমণ-ব্রাহ্মণকে অন্ন, পানীয়, বস্ত্র, যান, মাল্য, সুগন্ধি দ্রব্য, বিলেপনীয় বস্তু, শয্যা, গৃহ ও প্রদীপাদি দান করবো। আমি ঈর্ষাপরায়ণা হবো না, অপরের লাভ-সৎকার-গৌরব-সম্মান-বন্দনা ও পূজাদি প্রাপ্তিতে ঈর্ষা করবো না। ঈর্ষাবশে আক্রোশ করে দোষ খুঁজবো না এবং ঈর্ষাচিত্তও পোষণ করব না। ভন্তে, অতি সুন্দর! অতি মনোরম! যেমন, কেউ অধোমুখী পাত্রকে উর্ধমুখী করে, আবৃতকে অনাবৃত করে, পথভ্রষ্টকে পথ বলে দেয় এবং অন্ধকারে তৈল প্রদীপ ধারণ করে যাতে চক্ষুষ্মান ব্যক্তি রূপাদি দেখতে পায়; ঠিক সেরূপেই ভগবানের দ্বারা অনেক পর্যায়ে ধর্ম প্রকাশিত হলো। এখন হতে আমি ভগবানের শরণ গ্রহণ করছি, তাঁর ধর্ম এবং ভিক্ষুসংঘের শরণও গ্রহণ করছি। ভন্তে! আজ হতে আমাকে আপনার আমরণ শরণাগত উপাসিকারূপে ধারণ করুন।’’ (সপ্তম সূত্র)
৮. অত্তন্তপসুত্তং-আত্মন্তপ সূত্র
১৯৮. “হে ভিক্ষুগণ! পৃথিবীতে চার প্রকার পুদগল বিদ্যমান। সেই চার প্রকার কি কি? এজগতে কোন কোন পুদগল আত্মন্তপ (আত্মপীড়ক) ও আত্মপরিতাপনানুযুক্ত হয়। কোন কোন পুদগল পরন্তপ (পরপীড়ক) ও পরপরিতাপনানুযুক্ত হয়। কোন কোন পুদগল আত্মন্তপ ও আত্মপরিতাপনানুযুক্ত এবং পরন্তপ ও পরপরিতাপনানুযুক্ত হয়। আর কোন কোন পুদগল আত্মন্তপ ও আত্মপরিতাপনানুযুক্ত এবং পরন্তপ ও পরপরিতাপনানুযুক্ত হয় না। যেই পুদগল আত্মন্তপ ও পরন্তপ নয়, সে ইহ জন্মে অনাসক্ত, নির্বৃত, শীতিভূত ও সুখানুভবকারী হয়ে ব্রহ্মার ন্যায় অবস্থান করে।
ভিক্ষুগণ! কিরূপে একজন পুদগল আত্মন্তপ ও আত্মপরিতাপনানুযুক্ত হয়? এজগতে কোন কোন পুদগল অচেলক (জৈন বা লগ্ন সমপ্রদায়) হয়, মুক্তাচার বা অসংযতচারী ও হস্তাবলেহনকারী হয়। ‘ভদন্ত, আসুন বা স্থিত হোন’ বলে সে কাউকেও অভিবাদন বা অভ্যর্থনা করে না। তার উদ্দেশ্যে আনীত খাদ্য গ্রহণ করে না, সঙ্কল্পিত (বা বিশেষ কারণ আনীত) খাদ্য আর নিমন্ত্রণও গ্রহণ করে না। সে কুম্ভ হতে খাদ্য গ্রহণ করে না; বন্ধনপাত্র হতে, প্রবেশ দ্বারে, লাঠির মধ্যে ও মুষলের (মুদ্গরের) মধ্যে খাদ্য গ্রহণ করে না। দুইজনে খাদ্য গ্রহণ করলে সে আহার করে না, গর্ভিনীর খাদ্য, স্তন্যদায়িনীর খাদ্য এমনকি পুরুষের সাথে যৌন সংসর্গকারীর খাদ্যও গ্রহণ করে না। সে মিশ্র সংগৃহীত খাদ্য, গ্রহণ করে না; উপনীত স্থানে, মক্ষিকা বিচরণ স্থানে খাদ্য গ্রহণ করে না। মাছ ও মাংস ভক্ষণ করে না; মদ, মাদকদ্রব্য এবং সির্কা (টকজাতীয় রসবিশেষ), যাগুও পান করে না। সে মাত্র এক গৃহ হতে ভিক্ষান্ন সংগ্রহ করে, এক গ্রাস মাত্র আহার করে অথবা দুই গৃহ হতে ভিক্ষান্ন সংগ্রহ করে দুই গ্রাস আহার করে। তিনটি গৃহ হতে ভিক্ষান্ন সংগ্রহ করে তিন গ্রাস, চারটি গৃহ হতে সংগ্রহ করে চার গ্রাস, পাঁচটি গৃহ হতে সংগ্রহ করে পাঁচ গ্রাস, ছয়টি গৃহ হতে সংগ্রহ করে ছয় গ্রাস এবং সাতটি গৃহ হতে সংগ্রহ করে সাত গ্রাস ভোজন করে। সে একদিনে একবার আহার করে জীবন ধারণ করে, দুই দিনে, তিন দিনে, চার দিনে, পাঁচ দিনে, ছয় দিনে এমনকি সাত দিনে একবার মাত্র আহার করে জীবন ধারণ করে। এইভাবে পর্যায়ক্রমে প্রদত্ত খাদ্য এমনকি মাসান্তর প্রদত্ত খাদ্য ভোজন করেই অবস্থান করে।
সে শাকসব্জি, জোয়ার (গমজাতীয় শস্য), নীবার (উড়িধান্য), দদ্দুল (এক প্রকার চাউল), শৈবাল বা জলজ উদ্ভিদ, চাউলের গুঁড়া, ভাতের মাড়, তৈলবীজের ময়দা, তৃণ ও গোবর আহার করে এবং বনে পতিত ফল-মূল আহার করে জীবন ধারণ করে।
সে পাট দ্বারা প্রস্তুতকৃত মোটা বা নিকৃষ্ট বস্ত্র পরিধান করে, মসাণ বস্ত্র (বিবিধ উপকরণে প্রস্তুত নিকৃষ্ট বস্ত্র), শববস্ত্র (মৃতদেহের বস্ত্র), আবর্জনা স্তুপের বস্ত্র, তিরীট বস্ত্র (লোধ্রবৃক্ষের বাকল দ্বারা তৈরীবস্ত্র), মৃগচর্মের বস্ত্র, চিতাবাঘচর্মের বস্ত্র, কুশতৃণের বস্ত্র, বল্কবস্ত্র, কাষ্ঠফলকের বস্ত্র, কেশ কম্বল, অশ্ব কেশের তৈরী কম্বল এবং পেঁচা পক্ষীর পালক দ্বারা প্রস্তুতকৃত পোশাক পরিধান করে। সে কেশ-শ্রশ্রু (গোঁফদাড়ি) উৎপাটনকারী হয় ও কেশ-শ্রশ্রু উৎপাটনেও অনুযুক্ত হয়। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে এবং আসন প্রত্যাখ্যান বা বসতে আপত্তি করে। সে উৎকুটিক হয়ে বসার চেষ্টা বা উদ্যোগ গ্রহণ করে ও উৎকুটিক হয়ে বসে কণ্টকময় শয্যায় শয়নকারী হয়, কণ্টকময় শয্যায় শয়ন করে এবং সন্ধ্যাবেলায় তৃতীয়বার জলে নিমজ্জিত হয়ে অবস্থান করে। এভাবে সে বিভিন্ন উপায়ে দেহকে যন্ত্রণা ও পীড়ন করে অবস্থান করে। এরূপেই একজন পুদগল আত্মন্তপ ও আত্মপরিতাপনানুযুক্ত হয়।
ভিক্ষুগণ! কিরূপে একজন পুদগল পরন্তপ ও পরপরিতাপনানুযুক্ত হয়? এজগতে কোন কোন পুদগল ভেড়াঘাতক, শূকর হত্যাকারী, পাখিমারক, ব্যাধ, শিকারি, মৎস্যঘাতক (জেলে), চোর, চোরঘাতক, গোঘাতক (কসাই) ও জেলদারোগা হয় এবং কোন কোন জন নিষ্ঠুর চরিত্রের বা নিষ্ঠুরকর্মী হয়। এরূপেই একজন পুদগল পরন্তপ ও পরপরিতাপনানুযক্ত হয়।
ভিক্ষুগণ! কিরূপে একজন পুদগল আত্মন্তপ ও আত্মপরিতাপনানুযুক্ত এবং পরন্তপ ও পরপরিতাপনানুযুক্ত হয়? এজগতে কোন কোন পুদগল মূর্ধাভিষিক্ত (রাজমুকুট পরিহিত) ক্ষত্রিয় রাজা হয় অথবা ব্রাহ্মণ মহাশাল (মহাধনী) হয়। তিনি পূর্বদিকের নগরে নূতন সন্থাগার (সভাগৃহ) তৈরী করায়ে কেশ-শ্রশ্রু মুণ্ডন করতঃ অমসৃণ চর্মের পরিধেয় বস্ত্র পরিধান পূর্বক দেহে ঘৃত ও তেল মেখে মেঠোপথ দিয়ে পৃষ্ঠদেশ চুলকাতে চুলকাতে সেই নতুন সন্থাগারে মহর্ষী, ব্রাহ্মণ ও পুরোহিতদের সাথে একত্রে প্রবেশ করে। অনন্তর তথায় তিনি সুবিধার্থে ভূমি হরিতচূর্ণ দ্বারা লেপন করে শয্যা প্রস্তুত বা উপযুক্ত করায়। একটি গাভী হতে বাছুরের জন্য একটি স্তনে যেই ক্ষীর (দুধ) উৎপন্ন হয় তা দ্বারা রাজা জীবন ধারণ করেন; দ্বিতীয় স্তনে উৎপন্ন ক্ষীর দিয়ে মহেষী, তৃতীয় স্তনের ক্ষীর দ্বারা ব্রাহ্মণ-পুরোহিত, চতুর্থ স্তনের ক্ষীর দিয়ে অগ্নিপূজা করে এবং অবশিষ্টাংশ বা উদ্ধৃত ক্ষীর দ্বারা বৎসটি জীবন ধারণ করে। তিনি এরূপ আদেশ করেন- ‘এত সংখ্যক বৃষভ (ষাঁড়), এত সংখ্যক বলদ, এত সংখ্যক গাভী এত সংখ্যক ছাগল, এত সংখ্যক ভেড়া ও অশ্ব এত সংখ্যক যজ্ঞ বা বলীদানের জন্য হত্যা কর, এত সংখ্যক বৃক্ষ যূপকাষ্ঠের (ষজ্ঞস্তম্ভ) জন্য ছেদন কর এবং এত পরিমাণ যজ্ঞের জন্য তৃণ কর্তন কর।’ যারা দাস, দূত ও কর্মচারী তারা দণ্ডের ভয়ে ভীত, ত্রাসিত ও অশ্রুমুখ হয়ে রোদন করতে করতে পরিকর্মাদি করে। এরূপেই একজন পুদগল আত্মন্তপ ও আত্মপরিতাপনানুযুক্ত হয় এবং পরন্তপ ও পরপরিতাপনানুযুক্ত হয়।
ভিক্ষুগণ! কিরূপে একজন পুদগল আত্মন্তপ ও আত্মপরিতাপনানুযুক্ত এবং পরন্তপ ও পরপরিতাপনানুযুক্ত হয় না আর সেই পুদগল আত্মন্তপ ও পরন্তপ না হয়ে ইহজন্মে অনাসক্ত, নির্বৃত, শান্ত ও সুখানুভবকারী হয়ে ব্রহ্মার ন্যায় অবস্থান করে? এজগতে তথাগত পৃথিবীতে উৎপন্ন হয় অরহত সম্যক সম্বুদ্ধ, বিদ্যা ও সুআচরণ সম্পন্ন, সুগত, লোকজ্ঞ, অনুত্তর পুরুষ দমনকারী, সারথি, দেব-মানবের শাস্তা, বুদ্ধ, ভগবানরূপে তিনি এই পৃথিবী, দেবলোক, মারভুবনসহ ব্রহ্মলোকে শ্রমণ-ব্রাহ্মণ, দেব-মনুষ্যগণকে স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা প্রত্যক্ষ করে প্রকাশ করেন। তিনি যা ধর্মদেশনা করেন তা আদিতে কল্যাণ, মধ্যে কল্যাণ, পর্যাবসানে কল্যাণ এবং শুধুমাত্র পরিপূর্ণ, পরিশুদ্ধ ব্রহ্মচর্য প্রকাশ করেন। গৃহপতি, গৃহপতিপুত্র ও অন্যতর কুলে পুনর্জন্ম প্রাপ্তজন সেই ধর্ম শ্রবণ করে। সেই ধর্ম শ্রবণ করে তথাগতের প্রতি শ্রদ্ধান্বিত হয়ে সে এরূপ চিন্তা করে- ‘গৃহজীবন বাধাপূর্ণ ও রজঃপূর্ণ পথ আর প্রব্রজ্যা জীবন উন্মুক্ত; আগারে বসবাস করে একান্ত পরিপূর্ণ, একান্ত পরিশুদ্ধ ও মসৃণ শঙ্খের ন্যায় ব্রহ্মচর্য আচরণ করা অসম্ভব; তাহলে আমি কেশ-শ্রশ্রু মুণ্ডন করে কাষায় বস্ত্র পরিধান করতঃ আগার হতে অনাগারে প্রব্রজিত হব।’ সে ভবিষ্যতে বা অন্য কোন সময়ে অল্প ভোগস্কন্ধ (অল্পধন), বৃহৎ ভোগস্কন্ধ (বিপুল ধনভাণ্ডার), অল্প সংখ্যক জ্ঞাতি ও বহু সংখ্যক জ্ঞাতিমণ্ডল পরিত্যাগ করে কেশ-শ্রশ্রু মুণ্ডন করে কাষায় বস্ত্র পরিধান করতঃ আগার হতে অনাগারে প্রব্রজিত হয়।
সে এরূপে প্রব্রজিত হয়ে ভিক্ষুগণের অভিন্ন শিক্ষানীতিতে সমাপন্ন হওতঃ প্রাণীহত্যা পরিত্যাগ করতঃ প্রাণীহত্যা হতে প্রতিবিরত হয় এবং দণ্ড, শস্ত্র নিক্ষেপ না করে লজ্জাশীল, দয়ালু ও সকল প্রাণীর প্রতি হিতানুকম্পী (হিতৈষী) হয়ে অবস্থান করে। অদত্তবস্তু পরিত্যাগ করতঃ অদত্তবস্তু গ্রহণ হতে প্রতিবিরত হয়, আর বদান্য বা প্রদত্তবস্তু গ্রহণে ইচ্ছুক হওতঃ পরিশুদ্ধ হয়ে অবস্থান করে। অব্রহ্মচর্য পরিত্যাগ করে ব্রহ্মচর্য প্রতিপালন করে, ধর্মতঃ জীবন যাপন করতঃ অধর্ম ও গ্রাম্যধর্ম (মৈথুন সেবন) হতে বিরত হয়। মিথ্যাভাষণ হতে প্রতিবিরত হয় এবং সত্যবাদী, সত্যসন্ধ (সত্য প্রতিজ্ঞ), বিশ্বস্ত, বিশ্বাসী ও জগতের অবিসংবাদী হয়ে অবস্থান করে। পিশুন বাক্য বলা হতে প্রতিবিরত হয় এবং একজন হতে শ্রবণ করে বিভেদ সৃষ্টির লক্ষে তা অন্যের কাছে প্রকাশ করে না ও অন্যের কাছ হতে শ্রবণ করে তার কাছে প্রকাশ করে না। পরস্পর ভিন্ন অনৈক্য জনকে একত্রিত করে, সঙ্গীদের সাথে মিলিত করে দেয়; সন্ধিতে আনন্দিত, ঐক্যবদ্ধতায় রত ও মিত্রতায় সন্তুষ্ট হয় এবং মিত্রতাকরণ বাক্য ভাষণ করে। কর্কশ বাক্য বলা হতে প্রতিবিরত হয়; এবং যে বাক্য নির্দোষ, কর্ণসুখকর, প্রীতিপূর্ণ, মনোহর, শিষ্ট, বহুজনের আনন্দদায়ক ও বহুজনের মনোজ্ঞ সেরূপ বাক্যই ভাষণ করে। সমপ্রলাপ বাক্য বলা হতে প্রতিবিরত হয়; আর সে কালবাদী, ভূতবাদী, অর্থবাদী, ধর্মবাদী ও বিনয়বাদী হয় এবং উপযুক্ত সময়ে কারণ সম্বন্ধীয়, মঙ্গলজনক বাক্য বিবেচনা সহকারে প্রয়োজনানুরূপ ভাষণ করে।
সে বীজগ্রাম (বীজ দ্বারা সৃষ্ট বস্তু) ও ভূতগ্রাম নষ্ট করা হতে প্রতিবিরত হয়। একাহারী হয়ে রাত্রে বা বিকালে ভোজন হতে প্রতিবিরত হয়। নৃত্য-গীত-বাদ্য-বাজনা দর্শন, মালা-সুগন্ধিদ্রব্য বিলেপন, ধারণ, মণ্ডন ও বিভূষণ হতে প্রতিবিরত হয়। উচ্চশয্যা, মহাশয্যা এবং স্বর্ণ, রৌপ্য প্রতিগ্রহণ হতে বিরত হয়। অপক্কশষ্য, অপক্ক মাংস, স্ত্রীলোক ও কুমারী, দাস-দাসী, ছাগল, ভেড়া, মোরগ, শূকর, হস্তি, ষাঁড়, অশ্ব এবং ঘোটকী গ্রহণ হতে প্রতিবিরত হয়। সে ক্ষেত্র বা জমি গ্রহণ করে না, দৃত্যকার্যে নিযুক্ত হয় না, ক্রয়-বিক্রয়ও করে না, তুলাকূট (ওজনে কম দেয়া), কংসকূট (টাকা পয়সা আদান প্রদানে প্রবঞ্চনা), মানকূট (পরিমাপে প্রবঞ্চনা) আর উৎকোচও (ঘুষ) গ্রহণ করে না, প্রতারণা, প্রবঞ্চনা ও কপটতাকরণ হতে প্রতিবিরত হয়। আর ছেদন, বধ, বন্ধন, ডাকাতি এবং দিনের বেলায় গ্রাম আক্রমণ করতঃ ডাকাতি, লুণ্ঠন করে না।
সে দেহরক্ষাকারী চীবরে ও জীবন রক্ষাকরণ পিণ্ডপাতে সন্তুষ্ট হয়। যেভাবে প্রস্থান করা উচিত তদনুরূপে প্রস্থান করে। শকুনপক্ষী যেমন যেইভাবে উড্ডয়ন করে, পাখাদ্বয়ের ভারের দ্বারাই উড্ডয়ন করে; তদ্রুপভাবেই ভিক্ষুও দেহরক্ষাকারী চীবরে ও জীবন রক্ষাকারী পিণ্ডপাতে সন্তুষ্ট হয়। যেভাবে প্রস্থান করা উচিত তদনুরূপে প্রস্থান করে। সে এই আর্য শীলস্কন্ধ দ্বারা সমৃদ্ধ হয়ে অধ্যাত্মভাবে অনবদ্য সুখ অনুভব করে।
সে চক্ষু দিয়ে রূপ দেখে নিমিত্তগ্রাহী, অনুব্যঞ্জনগ্রাহী হয় না। এহেতুতে সামান্য অসংযতভাবে বিচরণকারী চক্ষু ইন্দ্রিয়কে অভিধ্যা-দৌর্মনস্যাদি অকুশল পাপধর্ম আক্রমণ করলেও আচ্ছন্ন করতে পারে না। যেহেতু ভিক্ষু চক্ষু সংবরণে অভিনিবিষ্ট থাকে, চক্ষু ইন্দ্রিয়কে রক্ষা করে, চক্ষু ইন্দ্রিয়ে সংবরণ উৎপন্ন করে। কর্ণ দিয়ে শব্দ শুনে নিমিত্তগ্রাহী, অনুব্যঞ্জনগ্রাহী হয় না। এহেতুতে সামান্য অসংযতভাবে বিচরণকারী কর্ণ ইন্দ্রিয়কে অভিধ্যা-দৌর্মনস্যাদি অকুশল পাপধর্ম আক্রমণ করলেও আচ্ছন্ন করতে পারে না। যেহেতু ভিক্ষু কর্ণ সংবরণে অভিনিবিষ্ট থাকে, কর্ণ ইন্দ্রিয়কে রক্ষা করে, কর্ণ ইন্দ্রিয়ে সংবরণ উৎপন্ন করে। নাসিকা দিয়ে ঘ্রাণ নিয়ে নিমিত্তগ্রাহী, অনুব্যঞ্জনগ্রাহী হয় না। এহেতুতে সামান্য অসংযতভাবে বিচরণকারী নাসিকা ইন্দ্রিয়কে অভিধ্যা-দৌর্মনস্যাদি অকুশল পাপধর্ম আক্রমণ করলেও আচ্ছন্ন করতে পারে না। যেহেতু ভিক্ষু নাসিকা সংবরণে অভিনিবিষ্ট থাকে, নাসিকা ইন্দ্রিয়কে রক্ষা করে, নাসিকা ইন্দ্রিয়ে সংবরণ উৎপন্ন করে। জিহ্বা দিয়ে রস আস্বাদন করে নিমিত্তগ্রাহী, অনুব্যঞ্জনগ্রাহী হয় না। এহেতুতে সামান্য অসংযতভাবে বিচরণকারী জিহ্বা ইন্দ্রিয়কে অভিধ্যা-দৌর্মনস্যাদি অকুশল পাপধর্ম আক্রমণ করলেও আচ্ছন্ন করতে পারে না। যেহেতু ভিক্ষু জিহ্বা সংবরণে অভিনিবিষ্ট থাকে, জিহ্বা ইন্দ্রিয়কে রক্ষা করে, জিহ্বা ইন্দ্রিয়ে সংবরণ উৎপন্ন করে। কায় দিয়ে স্পর্শ অনুভব করে নিমিত্তগ্রাহী, অনুব্যঞ্জনগ্রাহী হয় না। এহেতুতে সামান্য অসংযতভাবে বিচরণকারী কায় ইন্দ্রিয়কে অভিধ্যা-দৌর্মনস্যাদি অকুশল পাপধর্ম আক্রমণ করলেও আচ্ছন্ন করতে পারে না। যেহেতু ভিক্ষু কায় সংবরণে অভিনিবিষ্ট থাকে, কায় ইন্দ্রিয়কে রক্ষা করে, কায় ইন্দ্রিয়ে সংবরণ উৎপন্ন করে। মন দিয়ে ধর্ম জেনে নিমিত্তগ্রাহী, অনুব্যঞ্জনগ্রাহী হয় না। এহেতুতে সামান্য অসংযতভাবে বিচরণকারী মন ইন্দ্রিয়কে অভিধ্যা-দৌর্মনস্যাদি অকুশল পাপধর্ম আক্রমণ করলেও আচ্ছন্ন করতে পারে না। যেহেতু ভিক্ষু মন সংবরণে অভিনিবিষ্ট থাকে, মন ইন্দ্রিয়কে রক্ষা করে, মন ইন্দ্রিয়ে সংবরণ উৎপন্ন করে। সে এই আর্য ইন্দ্রিয়সংবর দ্বারা সমৃদ্ধ হয়ে অধ্যাত্মভাবে বিশুদ্ধ সুখ অনুভব করে। সে গমনাগমন করার সময় সমপ্রজ্ঞানী হয়। অবলোকন, নিরীক্ষণ ও হস্তপদ সঙ্কোচন-প্রসারণকালেও সমপ্রজ্ঞানী হয়। সংঘাটি, পাত্র ও চীবর ধারণকালে, ভোজনে, পানাহারে ও আস্বাদনকালে সমপ্রজ্ঞানী হয়। বাহ্য-প্রস্রাব ত্যাগে, গমনে, দাঁড়ানে, উপবেশনে, শয়নে, জাগরণে, ভাষণে এবং মৌনাবলম্বনেও সমপ্রজ্ঞানী হয়।
সে এই আর্য শীলস্কন্ধ, আর্য সন্তুষ্ট, আর্য ইন্দ্রিয়সংবর ও আর্য স্মৃতি সমপ্রজ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে অরণ্যে, বৃক্ষমূলে, পর্বতে, কন্দরে, গিরিগুহায়, শশ্মানে, বনপ্রান্তে, উন্মুক্ত স্থানে, তৃণস্তুপে ও নির্জন স্থানে গমন করে। সে ভিক্ষান্ন সংগ্রহ হতে প্রত্যাবর্তন করে ভোজনের পর দেহকে সোজা করে লক্ষ্যাভিমুখে স্মৃতি উপস্থাপিত করে পদ্মাসনে উপবেশন করে। সে লোকে (দেহে) অভিধ্যা পরিত্যাগ করে অভিধ্যা বিগত চিত্তে অবস্থান করে এবং অভিধ্যা হতে চিত্তকে পরিশুদ্ধ করে।
ব্যাপাদ-প্রদোষ ত্যাগ করে দ্বেষমুক্ত চিত্তে সকল প্রাণীর প্রতি হিতানুকম্পী হয়ে অবস্থান করতঃ ব্যাপাদ-প্রদোষ চিত্তকে পরিশুদ্ধ করে। সে আলস্য-তন্দ্রা পরিত্যাগ করে বিগত আলস্য-তন্দ্রা, আলোকসংজ্ঞী, স্মৃতিমান ও সমপ্রজ্ঞানী হয়ে অবস্থান করতঃ আলস্য-তন্দ্রা হতে চিত্তকে পরিশুদ্ধ করে। ঔদ্ধত্য-কৌকৃত্য পরিত্যাগ করে অনুদ্ধত ও অধ্যাত্ম্য প্রশান্ত চিত্ত হয়ে অবস্থান করতঃ ঔদ্ধত্য-কৌকৃত্য হতে চিত্তকে পরিশুদ্ধ করে। সে বিচিকিৎসা ত্যাগ করে সন্দেহোত্তীর্ণ ও কুশল ধর্মসমূহে সন্দেহমুক্ত হয়ে অবস্থান করতঃ বিচিকিৎসা হতে চিত্তকে পরিশুদ্ধ করে। সে চিত্তে উপক্লেশ ও প্রজ্ঞা দুর্বলকারী এই পঞ্চনীবরণ পরিহার করে কাম (কামনা) ও অকুশল ধর্মসমূহ হতে বিবিক্ত হয়ে সবিতর্ক, সবিচার ও বিবেকজনিত প্রীতি-সুখমণ্ডিত প্রথম ধ্যান লাভ করে অবস্থান করে। বিতর্ক ও বিচারের উপশমে আধ্যাত্মিক সমপ্রসাদী, চিত্তের একীভাব আনয়নকারী, অবিতর্ক, অবিচার সমাধিজনিত প্রীতি-সুখমণ্ডিত দ্বিতীয় ধ্যান লাভ করে অবস্থান করে। সে প্রীতির প্রতিও বিরাগী হয়ে উপেক্ষাশীল হয়ে অবস্থান করে এবং স্মৃতিমান ও সমপ্রজ্ঞানী হয়ে কায়িক সুখ অনুভব করে; যে অবস্থায় থাকলে আর্যগণ ‘উপেক্ষক, স্মৃতিমান, সুখবিহারী’ বলে অভিহিত করেন সেই তৃতীয় ধ্যান লাভ করে অবস্থান করে। সর্ববিধ সুখ-দুঃখ পরিত্যাগ করে পূর্বেই মানসিক সৌমনস্য ও দৌর্মনস্যের বিনাশ সাধন করে সুখ-দুঃখহীন ‘উপেক্ষা স্মৃতি পরিশুদ্ধি নামক চতুর্থ ধ্যান লাভ করে অবস্থান করে।
সে এইরূপ সমাহিত চিত্তে, পরিশুদ্ধ, পরিস্কৃত, নিষ্কলঙ্ক, বিগত উপক্লেশ, মৃদুভূত, কর্মক্ষম, স্থিত ও আনেঞ্জা (শূন্যতা) প্রাপ্ত হয়ে পূর্বনিবাস স্মৃতিজ্ঞান অর্জনের নিমিত্ত চিত্তকে নিয়োজিত করে। বিভিন্ন উপায়ে সে পূর্ব পূর্ব জন্মের অনুস্মরণ করে, যেমন- এক জন্ম, দুই জন্ম, তিন জন্ম, চার জন্ম, পাঁচ জন্ম, দশ জন্ম, বিশ জন্ম, ত্রিশ জন্ম, চল্লিশ জন্ম, পঞ্চাশ জন্ম, শত জন্ম, সহস্র জন্ম, শত সহস্র (লক্ষ) জন্ম, এমনকি বহু সংবর্তকল্প, বহু বিবর্তকল্প ও বহু সংবর্তিত কল্পে ‘অমুকজন্মে আমার এ’নাম, এ’গোত্র, এ’বর্ণ, এরূপ আহার, এরূপ সুখ-দুঃখ ভোগ এবং এপরিমাণ আয়ু ছিল। সেখান হতে চ্যুত হয়ে এস্থানে জন্মগ্রহণ করেছি।’ এরূপে সে অপরজন সম্বন্ধেও জানতে পারে যে- ‘অমুক জন্মে তার এ’নাম, এ’গোত্র, এ’বর্ণ, এরূপ আহার, এরূপ সুখ-দুঃখ ভোগ এবং এই পরিমাণ আয়ু ছিল। সেখান হতে চ্যুত হয়ে এস্থানে জন্মগ্রহণ করেছে। এরূপে সে আকার ও গতিসহ বহু প্রকার পূর্বজন্ম অনুস্মরণ করে। এবং সে এরূপ সমাহিত চিত্তে, পরিশুদ্ধ, পরিস্কৃত, নিষ্কলঙ্ক, বিগত উপক্লেশ, মৃদুভূত, কর্মক্ষম, স্থিত ও আনেঞ্জা (শূন্যতা) প্রাপ্ত হয়ে আস্রবক্ষয় জ্ঞানের জন্য চিত্তকে নিয়োজিত করে। সে ‘এটি দুঃখ’, ‘এটি দুঃখ সমুদয়’, ‘এটি দুঃখ নিরোধ’, ও ‘এটি দুঃখ নিরোধের উপায়’ বলে যথার্থরূপে জানে। ‘এটি আস্রব’, ‘এটি আস্রব সমুদয়’, ‘এটি আস্রব নিরোধ’, ‘এটি আস্রব নিরোধের উপায়’ বলেও যথার্থরূপে জানে। এরূপে অবগত ও দর্শনের দরুন কামাস্রব হতে তার চিত্ত বিমুক্ত হয়, ভবাস্রব ও অবিদ্যাস্রব হতেও তার চিত্ত বিমুক্ত হয় এবং ‘বিমুক্তিতে বিমুক্ত’ এরূপ জ্ঞান উৎপন্ন হয়। ‘জন্মক্ষীণ হয়েছে, ব্রহ্মচর্য উদ্যাপিত হয়েছে, করণীয় কৃত হয়েছে এবং দুঃখ মুক্তির জন্য আর অন্য কোন কর্তব্য নাই’ এরূপে প্রকৃষ্টরূপে জানে। ভিক্ষুগণ! এরূপেই কোন কোন পুদগল আত্মন্তপ ও আত্মপরিতাপনানুুযুক্ত এবং পরন্তপ ও পরপরিতাপনানুযুক্ত হয় না। আর সেই পুদগল আত্মন্তপ ও পরন্তপ না হয়ে ইহজন্মে অনাসক্ত, নির্বৃত, শীতিভূত ও সুখানুভবকারী হয়ে ব্রহ্মার ন্যায় অবস্থান করে।
ভিক্ষুগণ! এই চার প্রকার পুদ্গল পৃথিবীতে বিদ্যমান।” (অষ্টম সূত্র)
৯. তণ্হাসুত্তং-তৃষ্ণা সূত্র
১৯৯. ভগবান এরূপ বললেন- “হে ভিক্ষুগণ! তোমাদেরকে জালসদৃশ, সংসারান্তরে প্রবাহমান নদী, জালের ন্যায় বিস্তৃত, এবং দৃঢ় সংলগ্নতা রূপ তৃষ্ণা সম্বন্ধে দেশনা করব; যাতে এই জগত আব্রাপ্ত, আবৃত, দড়ির গোলকের ন্যায় জড়িত, ব্রণে আচ্ছাদিত, মুঞ্জ ঘাসের ন্যায় মোচড়ানো এবং যদ্দরুণ অপায় দুগর্তি বিনিপাত ও সংসার চক্র অতিক্রম করা যায় না। তা শ্রবণ কর, উত্তমরূপে মনোনিবেশ কর আমি দেশনা করছি।” “হ্যাঁ, ভন্তে” বলে সে ভিক্ষুগণ ভগবানকে প্রত্যুত্তর দিলেন। অতঃপর ভগবান এরূপ বললেন-
ভিক্ষুগণ! সেই জালসদৃশ, সংসারান্তরে প্রবাহমান নদী, জালের ন্যায় বিস্তৃত এবং দৃঢ় সংলগ্নতারূপ তৃষ্ণা কিরূপ; যাতে এই জগত আব্রাপ্ত, আবৃত, দড়ির গোলকের ন্যায় জড়িত, ব্রণে আচ্ছাদিত, মুঞ্জ ঘাসের ন্যায় মোচড়ানো, এবং যদ্দরুণ অপায় দুগর্তি বিনিপাত ও সংসার চক্র অতিক্রম করা যায় না? ভিক্ষুগণ! আধ্যাত্মিক অনুসারে তৃষ্ণার দ্বারা বিচরিত (ভ্রমিত) আঠার প্রকার চিন্তা এবং বাহ্যিক অনুসারে তৃষ্ণা বিচরিত আঠার প্রকার চিন্তা।’
ভিক্ষুগণ! আধ্যাত্মিক অনুসারে তৃষ্ণা বিচরিত আঠার প্রকার চিন্তা কি কি? ভিক্ষুগণ! যথা-‘আমি নিজ হই, ‘আমি’ এরূপ ধারণা হেতু এমন চিন্তা জাগে যে-‘আমিই এই জগতে,’ ‘আমি এরূপ,’ ‘আমি অন্যরূপ,’ ‘আমি নই,’ ‘আমি নিত্য,’ ‘আমি আছি,’ ‘আমি এই জগতমাঝে আছি,’ ‘আমি এরূপ আছি,’ আমি অন্যরূপ আছি,’ ‘আমি হই,’ ‘আমি এজগতমাঝে হই,’ ‘আমি এরূপ হই,’ ‘আমি অন্যথা হই,’ ‘আমি হব,’ ‘আমি এজগতে হব,’ ‘আমি এরূপ হব,’ ‘আমি অন্যরূপ হব।’ এই আঠার প্রকার চিন্তা সমূহ হচ্ছে আধ্যাত্মিক অনুসারে তৃষ্ণা দ্বারা বিচরিত।
ভিক্ষুগণ! বাহ্যিক অনুসারে তৃষ্ণাদ্বারা বিচরিত আঠার প্রকার চিন্তা কি কি? যথা- ‘এটির দ্বারা আমি এরূপ ধারণ হেতু এমন চিন্তা জাগে যে- ‘এটির দ্বারা আমিই এই জগতে,’ ‘ইহার দ্বারা এরূপ,’ ‘্ইহার দ্বারা আমি অন্যরূপ,’ ‘ইহার দ্বারা আমি নিত্য,’ নই,’ ইহার দ্বারা আমি নিত্য ইহার দ্বারা আমি আছি,’ ‘ইহার দ্বারা আমি এজগত মাঝে আছি,’ ‘ইহার দ্বারা আমি এরূপ আছি,’ ইহার দ্বারা আমি অন্যথারূপ আছি,’ ‘ইহার দ্বারা আমি হই,’ ‘ইহার দ্বারা আমি এজগতে হই, ইহার দ্বারা আমি এরূপ হই,’ ইহার দ্বারা আমি অন্যথা হই,’ ‘ইহার দ্বারা আমি হব,’ ইহার দ্বারা আমি এজগতে হব,’ ‘ইহার দ্বারা আমি এরূপ হব,’ এবং ‘ইহার দ্বারা আমি অন্যরূপ হব,’ এই আঠার প্রকার চিন্তা হচ্ছে বাহ্যিক অনুসারে তৃষ্ণা দ্বারা বিচরিত।
“এটিই আধ্যাত্মিক অনুসারে তৃষ্ণার দ্বারা বিচরিত আঠার প্রকার চিন্তা এবং বাহ্যিক অনুসারে তৃষ্ণা দ্বারা বিচরিত আঠার প্রকার চিন্তা।
ভিক্ষুগণ! একেই বলা হয় সাইত্রিশ প্রকার তৃষ্ণার বিচরিত। অনুরূপভাবে অতীতে সাইত্রিশ প্রকার তৃষ্ণার বিচরিত, অনাগতে সাইত্রিশ প্রকার তৃষ্ণার বিচরিত এবং বর্তমানেও সাইত্রিশ প্রকার তৃষ্ণা বিচরিত আছে। এরূপেই একশত আট প্রকার তৃষ্ণা বিচরিত হয়।
ভিক্ষুগণ! ইহাই সেই জাল সদৃশ, সংসারান্তরে প্রবাহমান নদী, জালে ন্যায় বিস্তৃত এবং দৃঢ় সংলগ্নতা রূপ তৃষ্ণা; যাতে এই জগত আব্রাপ্ত, আবৃত, দড়ির গোলকের ন্যায় জড়িত, ব্রণে আচ্ছাদিত, মুঞ্জ ঘাসের ন্যায় মোচড়ানো এবং যদ্দরুন অপায় দুর্গতি-বিনিপাত ও সংসার চক্র অতিক্রম করা যায় না।” (নবম সূত্র)
১০. পেমসুত্তং-প্রেম সূত্র
২০০. “হে ভিক্ষুগণ! চার প্রকারে প্রেম উৎপন্ন হয়। সেই চার প্রকার কি কি? যথা- প্রেম হতে প্রেম উৎপন্ন হয়, প্রেম হতে দ্বেষ বা হিংসা উৎপন্ন হয়, দ্বেষ হতে প্রেম উৎপন্ন এবং দ্বেষ হতে দ্বেষ উৎপন্ন হয়।
ভিক্ষুগণ! কিরূপে প্রেম হতে প্রেম উৎপন্ন হয়? এজগতে কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তির ইষ্ট, কান্ত ও মনোপুত হয়। অন্যরা ও সেই ব্যক্তির সাথে ইষ্ট, কান্ত মনোপুত আচরণ করে। তখন প্রথম ব্যক্তির এমন চিন্তা হয়- ‘যে আমার ইষ্ট, কান্ত ও মনোপুত; অন্যরাও তার সাথে ইষ্ট, কান্ত ও মনোপুত আচরণ করছে’। তাই সে তাদের প্রতি প্রীতিভাব উৎপাদন করে। ভিক্ষুগণ! এরূপেই প্রেম হতে প্রেম উৎপন্ন হয়।
কিরূপে প্রেম হতে দ্বেষ উৎপন্ন হয়? এজগতে কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তির ইষ্ট, কান্ত ও মনোপুত হয়। কিন্ত অন্যরা সেই ব্যক্তির সাথে অনিষ্ট, অকান্ত ও অমনোপুত আচরণ করে। তখন প্রথম ব্যক্তির এমন চিন্তা হয়- ‘যে আমার ইষ্ট কান্ত ও মনোপুত; কিন্তু অন্যরা তার সাথে অনিষ্ট, অকান্ত ও অমনোপুত আচরণ করছে। তাই সে তাদের প্রতি দ্বেষ বা হিংসাভাব উৎপাদন করে। ভিক্ষুগণ! এরূপেই প্রেম হতে দ্বেষ উৎপন্ন হয়।
কিরূপে দ্বেষ হতে প্রেম উৎপন্ন হয়? এজগতে কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তির অনিষ্ট, অকাণ্ড ও অমনোপুত হয়। কিন্তু অন্যরা সেই ব্যক্তির সাথে অনিষ্ট, অকাণ্ড ও অমনোপুত আচরণ করে। তখন প্রথম ব্যক্তির এমন চিন্তা হয়- ‘যে আমার অনিষ্ট, অকান্ত ও অমনোপুত; অন্যরাও তার সাথে অনিষ্ট, অকান্ত ও অমনোপুত আচরণ করছে। তাই সে তাদের প্রতি প্রীতিভাব উৎপন্ন করে। ভিক্ষুগণ! এরূপেই দ্বেষ হতে প্রেম উৎপন্ন হয়।
ভিক্ষুগণ! কিরূপে দ্বেষ হতে দ্বেষ উৎপন্ন হয়? এজগতে কোন ব্যক্তি অপর ব্যক্তির অনিষ্ট, অকান্ত ও অমনোপুত হয়। কিন্তু অন্যরা সেই ব্যক্তির সাথে ইষ্ট, কান্ত ও মনোপুত আচরণ করে। তখন প্রথম ব্যক্তির এমন চিন্তা হয়- ‘যে আমার অনিষ্ট, অকান্ত ও অমনোপুত; অন্যরা তার সাথে ইষ্ট, কান্ত ও মনোপুত আচরণ করছে। তাই সে তাদের প্রতি দ্বেষভাব উৎপন্ন করে। ভিক্ষুগণ! এরূপেই দ্বেষ হতে দ্বেষ উৎপন্ন হয়। ভিক্ষুগণ! এই চার প্রকারেই প্রেম উৎপন্ন হয়।
“ভিক্ষুগণ! যেই সময়ে ভিক্ষু কাম সম্পর্ক হতে বিবিক্ত হয়ে এবং অকুশল চিন্তা হতে বিচ্ছিন্ন হয়ে সবির্তক, সবিচার ও বিবেকজ প্রীতি সুখমণ্ডিত প্রথম ধ্যান লাভ করে অবস্থান করে; সেই সময়ে তার নিকট পূর্বের ন্যায় প্রেম হতে প্রেম উৎপন্ন হয় না। পূর্বের ন্যায় প্রেম হতে দ্বেষ উৎপন্ন হয় না; পূর্বের ন্যায় দ্বেষ হতে প্রেম উৎপন্ন হয় এবং পূর্বের ন্যায় দ্বেষ হতে দ্বেষ উৎপন্ন হয় না।”
যেই সময়ে ভিক্ষু বির্তক-বিচারের উপশমে আধ্যাত্মিক সমপ্রসাদী, চিত্তের একীভাব আনয়নকারী, বিতর্ক-বিচারাতীত সমাধিজ প্রীতিসুখমণ্ডিত দ্বিতীয় ধ্যান লাভ করে অবস্থান করে; সেই সময়ে তার নিকট পূর্বের ন্যায় প্রেম হতে প্রেম উৎপন্ন হয় না, পূর্বের ন্যায় প্রেম হতে দ্বেষ উৎপন্ন হয় না, পূর্বের ন্যায় দ্বেষ হতে প্রেম উৎপন্ন হয় না ও পূর্বের ন্যায় দ্বেষ হতে দ্বেষ উৎপন্ন হয় না।
যেই সময়ে ভিক্ষু প্রীতির প্রতিও বিরাগী হয়ে উপেক্ষাভাবে অবস্থান করে, স্মৃতিমান ও সমপ্রজ্ঞানী হয়ে স্বচিত্তে (প্রীতি নিরপেক্ষ) সুখ অনুভব করে; যেই অবস্থাকে আর্যগণ ‘উপেক্ষাসম্পন্ন, স্মৃতিমান ও সুখ বিহারী’ আখ্যা দেন সেই তৃতীয় ধ্যান লাভ করে অবস্থান করে; সেই সময় তার পূর্বের ন্যায় প্রেম হতে প্রেম উৎপন্ন হয় না; পূর্বের ন্যায় প্রেম হতে দ্বেষ উৎপন্ন হয় না, পূর্বের ন্যায় দ্বেষ হতে প্রেম উৎপন্ন হয় না এবং পূর্বের ন্যায় দ্বেষ হতে দ্বেষ উৎপন্ন হয় না।
যে সময়ে ভিক্ষু দৈহিক সুখ-দুঃখ পরিত্যাগ করে, পূর্বেই সৌমনস্য-দৌর্মনস্য (মনের হর্ষ-বিবাদ) অস্তমিত করে, সুখ-দুঃখহীন বা উপেক্ষাভাবে ও স্মৃতি দ্বারা পরিশুদ্ধ চিত্তে চতুর্থ ধ্যান লাভ করে অবস্থান করে, সেই সময়ে তার পূর্বের ন্যায় প্রেম হতে প্রেম উৎপন্ন হয় না; পূর্বের ন্যায় প্রেম হতে দ্বেষ উৎপন্ন হয় না; পূর্বের ন্যায় দ্বেষ হতে প্রেম উৎপন্ন হয় না ও পূর্বের ন্যায় দ্বেষ হতে দ্বেষ উৎপন্ন হয় না।
যেই সময়ে ভিক্ষু আস্রবসমূহ ক্ষয় করে অনাস্রব হয়ে এ’জীবনে স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা চিত্ত-বিমুক্তি, প্রজ্ঞা-বিমুক্তি লাভ করে অবস্থান করে। যার কারণে প্রেম হতে উৎপন্ন প্রেম প্রহীন হয়; তা উচ্ছিন্নমূল তালবৃক্ষের ন্যায় ভবিষ্যতে আর পুনরুৎপত্তি হয় না। প্রেম হতে উৎপন্ন দ্বেষ প্রহীন হয়; তা উচ্ছিন্নমূল তালবৃক্ষের ন্যায় ভবিষ্যতে আর পুনরুৎপত্তি হয় না। দ্বেষ হতে উৎপন্ন প্রেম প্রহীন হয়; তা উচ্ছিন্নমূল তালবৃক্ষের ন্যায় ভবিষ্যতে আর পুনরুৎপত্তি হয় না। দ্বেষ হতে উৎপন্ন দ্বেষ প্রহীন হয়; তা উচ্ছিন্নমূল তালবৃক্ষের ন্যায় ভবিষ্যতে আর পুনরুৎপত্তি হয় না। ভিক্ষুগণ! একেই বলা হয় ভিক্ষুর নিজেকে আকর্ষণ না করা, নিজেকে বৈরীভাবাপন্ন্ না, নিজেকে ধুমায়িত না, নিজেকে প্রজ্জ্বলিত না করা, নিজেকে হতবুদ্ধি না করা।
ভিক্ষুগণ! কিরূপে ভিক্ষু নিজেকে আকর্ষণ করে। এজগতে ভিক্ষু রূপকে আত্ম মনে করে; আত্মাকে রূপ আত্মার মধ্যে রূপ; রূপের মধ্যে আত্মাকে মনে করে; বেদনাকে আত্মা মনে করে, আত্মাকে বেদনা, মনে করে। বেদনাকে আত্মা মনে করে, আত্মাকে বেদনা, আত্মার মধ্যে বেদনা, ও বেদনার মধ্যে আত্মাকে মনে করে; সংজ্ঞাকে আত্মা মনে করে, আত্মাকে সংজ্ঞা, আত্মার মধ্যে সংজ্ঞা, ও সংজ্ঞার মধ্যে আত্মাকে মনে করে; সংস্কারকে আত্মা মনে করে, আত্মাকে সংস্কার, আত্মার মধ্যে সংস্কার এবং সংস্কারের মধ্যে আত্মাকে মনে করে ও বিজ্ঞানকে আত্মা মনে করে, আত্মাকে বিজ্ঞান, আত্মার মধ্যে বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানের মধ্যে আত্মাকে মনে করে। ভিক্ষুগণ! এরূপে নিজেকে আকর্ষণ করে।
কিরূপে ভিক্ষু নিজেকে আকর্ষণ করে না (ন উস্েসানতি)? এজগতে ভিক্ষু রূপকে আত্ম মনে করে না, আত্মকে রূপ মনে করে না, রূপকে আত্মার মধ্যে মনে করে না, আত্মাকে রূপের মধ্যে মনে করে না; বেদনাকে আত্ম মনে করে না, আত্মকে বেদনা মনে করে না, বেদনাকে আত্মার মধ্যে মনে করে না, আত্মাকে বেদনার মধ্যে মনে করে না; সংজ্ঞাকে আত্ম মনে করে না, আত্মকে সংজ্ঞা মনে করে না, সংজ্ঞাকে আত্মার মধ্যে মনে করে না, ঐ আত্মাকে সংজ্ঞার মধ্যে মনে করে না; সংস্কারকে আত্ম মনে করে না, আত্মকে সংস্কার মনে করে না, সংস্কারকে আত্মার মধ্যে মনে করে না, আত্মাকে সংস্কার মধ্যে মনে করে না; বিজ্ঞানকে আত্ম মনে করে না, আত্মকে বিজ্ঞান মনে করে না, বিজ্ঞানকে আত্মার মধ্যে মনে করে না, আত্মাকে বিজ্ঞান মধ্যে মনে করে না। ভিক্ষুগণ! এরূপে ভিক্ষু নিজেকে আকর্ষণ করে না (ন উস্েসনেতি)।
কিরূপে ভিক্ষু বৈরীভাবপন্ন হয়? (পটিসেনেতি)। এজগতে ভিক্ষু আক্রোশকারীকে আক্রোশ করে, ক্রোধান্বিত কারীকে ক্রোধান্বিত করে এবং কলহকারীকে কলহেপূর্ণ করে। ভিক্ষুগণ! এরূপেই ভিক্ষু বৈরভাবাপন্ন হয়।
কিরূপে ভিক্ষু বৈরীভাবাপন্ন হয় না? (ন পটিসেনেতি) এজগতে ভিক্ষু আক্রোশকারীকে আক্রোশ করে না, ক্রোধান্বিত ব্যক্তিকে ক্রোধান্বিত করে না এবং কলহকারীকে কলহে পূর্ণ করে না। ভিক্ষুগণ! এরূপেই ভিক্ষু বৈরীভাবাপন্ন হয় না।
কিরূপে ভিক্ষু ধূমায়িত (ধুপাযতি) করে? এজগতে ভিক্ষুর ‘আমি’ এরূপ ধারণা হেতু এমন চিন্তা জাগে যে ‘আমিই এই জগতে;’ ‘আমি এরূপ;’ ‘আমি অন্যরূপ;’ ‘আমি নিত্য নই;’ আমি নিত্য;’ ‘আমি আছি;’ ‘আমি এ-জগত মাঝে আছি;’ আমি এরূপ আছি;’ আমি অন্যরূপ মাঝে আছি;’ আমি হই;’ ‘আমি এ-জগত মাঝে হই;’ ‘আমি এরূপ হই;’ ‘আমি অন্যথা হই;’ ‘আমি হবো;’ ‘আমি এ-জগতে হবো;’ ‘আমি এরূপ হবো;’ এবং আমি অন্যরূপ হবো’। ভিক্ষুগণ! এরূপে ভিক্ষু নিজেকে ধূমায়িত করে।
কিরূপে ভিক্ষু নিজেকে ধুমায়িত করে না? (না ধূপাযতি ) এজগতে ভিক্ষুর ‘আমি এরূপ’ ধারণা হেতু এমন চিন্তা জাগে যে- আমিই এই জগতে নই;’ ‘আমি এরূপ নই;’ ‘আমি অন্যরূপ নই;’ “আমি অনিত্য নই;’ ‘আমি নিত্য নই;’ ‘আমি নাই;’ ‘আমি এ-জগত মাঝে নাই;’ ‘আমি এরূপ নাই;’ ‘আমি অন্যরূপ নাই;’ ‘ আমি হই না;’ ‘আমি এ-জগত মাঝে হই না;’ ‘আমি এরূপ হই না;’ ‘আমি অন্যথা হই না;’ ‘আমি হবো না;’ ‘আমি এ-জগতে হবো না;’ ‘আমি এরূপ হবো না;’ এবং আমি অন্যরূপ হবো না।’ ভিক্ষুগণ! এরূপে ভিক্ষু নিজেকে ধূমায়িত করে না।
কিরূপে নিজেকে প্রজ্জ্বলিত করে? (পজ্জলতি) এজগতে ভিক্ষুর ‘ইহার দ্বারা আমি’ এরূপ ধারণা হেতু এমন চিন্তা জাগে যে ‘ইহার দ্বারা আমি এই জগতে;’ ‘ইহার দ্বারা আমি এরূপ;’ ‘ইহার দ্বারা অন্যরূপ;’ ‘ইহার দ্বারা আমি নিত্য নই;’ ‘ইহার দ্বারা আমি নিত্য;’ ‘ইহার দ্বারা আছি;’ ‘ইহার দ্বারা এ-জগত মাঝে আছি;’ ‘ইহার দ্বারা আমি এরূপ আছি;’ ‘ইহার দ্বারা আমি অন্যরূপ আছি;’ ‘ইহার দ্বারা আমি হই;’ ‘ইহার দ্বারা আমি এ-জগতে হই;’ ‘ইহার দ্বারা আমি এরূপ হই;’ ‘ইহার দ্বারা আমি অন্যথা হই;’ ‘ইহার দ্বারা আমি হবো;’ ‘ইহার দ্বারা আমি এ-জগতে হবো;’ ‘ইহার দ্বারা আমি এরূপ হবো;’ এবং ‘ইহার দ্বারা আমি অন্যরূপ হবো।’ ভিক্ষুগণ! এরূপে ভিক্ষু নিজেকে প্রজ্জ্বলিত করে।
কিরূপে ভিক্ষু নিজেকে প্রজ্জ্বলিত করে না (ন পজ্জলতি)? এজগতে ভিক্ষুর ‘ইহার দ্বারা আমি’ এরূপ নই ধারণা হেতু এমন চিন্তা জাগে যে ‘ইহার দ্বারা আমি এ-জগতে নাই; ‘ইহার দ্বারা আমি এরূপ নই;’ ‘ইহার দ্বারা আমি অন্যরূপ নই;’ ‘ইহার দ্বারা আমি অনিত্য নই; ‘ইহার দ্বারা আমি নিত্য নই;’ ‘ইহার দ্বারা আমি নাই;’ ‘ইহার দ্বারা আমি এ-জগতে নাই; ‘ইহার দ্বারা আমি এরূপ নাই;’ ‘ইহার দ্বারা আমি অন্যরূপ নাই;’ ‘ইহার দ্বারা আমি না হই; ‘ইহার দ্বারা আমি এ-জগতে না হই; ‘ইহার দ্বারা আমি এরূপ না হই; ‘ইহার দ্বারা আমি অন্যথা না হই;’ ‘ইহার দ্বারা আমি হবো না; ‘ইহার দ্বারা আমি এ-জগতে হবো না; ‘ইহার দ্বারা আমি এরূপ হবো না; এবং ‘ইহার দ্বারা আমি অন্যরূপ হবো না।’ ভিক্ষুগণ! এরূপে ভিক্ষু নিজেকে প্রজ্জ্বলিত করে না।
কিরূপে ভিক্ষু হতবুদ্ধি হয় (সম্পজ্ঝাযতি)? ভবিষ্যতে অনুৎপত্তি ধর্ম উচ্ছিন্নমূল তালবৃক্ষের ন্যায় ভিক্ষুর আমিত্ববোধ প্রহীন হয় না। এরূপে ভিক্ষু হতবুদ্ধি হয়।
ভিক্ষুগণ! কিরূপে হতবুদ্ধি হয় না (ন সম্পজ্ঝাযতি)? ভবিষ্যতে অনুৎপত্তি ধর্ম উচ্ছিন্নমূল তালবৃক্ষের ন্যায় ভিক্ষুর আমিত্ববোধ প্রহীন হয়। এরূপে ভিক্ষু হতবুদ্ধি হয় না।
(মহাবর্গ সমাপ্ত)
স্মারকগাথাঃ
শোতানুগত, স্থান, ভদ্দিয়, সামুগিয় বপ্প ও সাল্হা,
মল্লিকাদেবী, আত্মপীড়া, এবং তৃষ্ণা ও প্রেম সূত্র দশ।
চতুর্থ পঞ্চাশক সমাপ্ত।
৫. পঞ্চমপন্নাসকং-পঞ্চম পঞ্চাশক