৪. চক্কবগ্গো-চক্র বর্গ

১. চক্কসুত্তং-চক্রসূত্র

৩১. “হে ভিক্ষুগণ! চার প্রকার চক্র; যাতে সমন্বিত হয়ে দেব-মনুষ্যগণের চতুর্চক্র চালিত হয়। সেই সমন্বিত দেব-মনুষ্যগণ অতি শীঘ্র-ই ভোগের মধ্যে মহত্ত্ব, বৈপুল্য লাভে সফলকাম হয়। সেই চার প্রকার কি কি? যথা-প্রতিরূপ দেশে বাস, সৎ পুরুষের সাহচর্য, নিজের সম্যক প্রতিজ্ঞা, পূর্বজন্মের কৃতপুণ্য। ভিক্ষুগণ! এ’চার প্রকার চক্র। যাতে সমন্বিত হয়ে দেব-মনুষ্যগণের চতুর্চক্র চালিত হয়। সেই সমন্বিত দেব-মনুষ্যগণ অতি শীঘ্র-ই ভোগের মধ্যে মহত্ত্ব, বৈপুল্য লাভে সফলকাম হয়।

“প্রতিরূপদেশে বাস, আর্যমিত্রে কর সেবা,

সম্যক শ্রেষ্ঠকর্মী হলে পূর্বের কৃতপুণ্য তারা।

অবিরাম পুণ্য ভোগ জানিবে ইহাতে,

ধন-ধান্যে, যশঃ কীর্তি লাভ হয় তাতে।”

(প্রথম সূত্র)

২. সঙ্গহসুত্তং-সংগ্রহ সূত্র

৩২. “হে ভিক্ষুগণ! সংগ্রহের বিষয় চার প্রকার । সেই চার প্রকার কি কি? যথা-দান, প্রিয়বাক্য, দয়ালুতা, সমদর্শীতা। এই চার প্রকার সংগ্রহ বিষয়।”

“দান, প্রিয়বাক্য আর দয়ালুতা যথা,

ধর্মে সমদর্শি হবে যারা এতে রতা।

এসব সংগ্রহ চলে পৃথিবী মাঝার,

রথচাকা ন্যায়ে ঘুরে বারে বার।

কেবল সংগ্রহ নহে, পিতা-মাতা সেবনে,

পুত্র পায় সম্মান পূজা, ঐকার্য সাধনে।

এসংগ্রহে মনোযোগী যত পণ্ডিতগণ,

তাতেই মহত্ব আর প্রশংসালাভী হন।”

(দ্বিতীয় সূত্র)

৩. সীহসুত্তং-সিংহ সূত্র

৩৩. “হে ভিক্ষুগণ! পশুরাজ সিংহ সন্ধ্যার সময়ে আশ্রয়স্থান হতে বের হয়। আশয়স্থান হতে বের হয়েই হাই তোলে। হাই তোলার পর চারিদিকে ভালোভাবে অবলোকন করে। অতঃপর তিনবার সিংহনাদে গর্জন করে। তিনবার সিংহনাদে গর্জন করার পর শিকার স্থানে সবেগে ধাবিত হয়। যেসব তির্যক প্রাণী পশুরাজ সিংহের গর্জন শব্দ শুনে, সেসব প্রাণী ভীষণ ভয়ে, সন্ত্রস্ত হয়ে সবেগে পালিয়ে যায়। গর্তে অবস্থানকারীরা গর্তে প্রবেশ করে, জলে অবস্থানকারীরা জলে ডুব দেয়, বনে অবস্থানকারীরা ঘনবনে প্রবেশ করে, পাখিরা আকাশে আশ্রয় নেয়। রাজহস্তী গ্রাম-নিগম-রাজধানীর মধ্যে চামড়ার ফিতা দ্বারা দৃঢ় বন্ধনে অবদ্ধ হলেও সেই বন্ধনাদি ছিন্ন-ভিন্ন করতঃ ভীত হয়ে মল-মূত্র ত্যাগ করতে করতে এদিক-সেদিক পালিয়ে যায়। এভাবে পশুরাজ সিংহ তীর্যক প্রাণীদের মধ্যে এক মহা পরাক্রমশালী, মহাশক্তির, অধিকারী এবং মহাপ্রভাবশালী।

“হে ভিক্ষুগণ! এভাবে জগতে যখন তথাগত অর্হৎ সম্যকসম্বুদ্ধ, বিদ্যাচরণসম্পন্ন, সুগত, লোকবিদ, শ্রেষ্ঠ, পুরুষদমনকারী সারথী, দেব-মনুষ্যগণের শাস্তা, বুদ্ধ, ভগবান আর্বিভূত হন; তখন তিনি ধর্মদেশনা করেন যে- ‘এটা সৎকায়, এটা সৎকায় সমুদয়, এটা সৎকায় নিরোধ, এটা সৎকায় নিরোধগামিনী প্রতিপদা।’ যেসব দেবতা দীর্ঘায়ু, শ্রীসম্পন্ন, বহুল সুখের অধিকারী, উৎকৃষ্ট বিমানের মধ্যে দীর্ঘকাল স্থায়ী তারা তথাগতের ধর্মদেশনা শুনে অতি ভয়, সংবেগ এবং সন্ত্রস্তভাব উৎপন্ন করে-“ওহে মহাশয়গণ! আমরা সত্যিই অনিত্য, কিন্তু (এতোদিন) নিত্য মনে করেছিলাম; অধ্রুব, কিন্তু (এতোদিন) ধ্রুব মনে করেছিলাম; অশাশ্বত, কিন্তু (এতোদিন) শাশ্বত মনে করেছিলাম। আমরা সত্যিই অনিত্য, অধ্রুব, অশাশ্বত সৎকায় প্রতিপন্ন।” এভাবে তথাগত দেব-মনুষ্যগণের মধ্যে এক মহাপরাক্রমশালী, মহাশক্তির, অধিকারী এবং মহা প্রভাবশালী।”

“স্বীয় অভিজ্ঞায় করেন বুদ্ধ ধর্মচক্র প্রবর্তন,

দেব-মনুষ্য লোকাদিতে তিনি শ্রেষ্ঠ পুদ্গল হন।

সৎকায়, সৎকায় নিরোধ আর সমুদয় তার,

আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গ আচরিলে কি-বা দুঃখ আর।

দীর্ঘায়ু, সুশ্রী আর যশস্বী যতো দেবগণ,

ভীত সবাই বুদ্ধতে, যেন বুদ্ধ সিংহ রাজন।

অনিত্য এই সৎকায় করি হে অতিক্রম,

বুদ্ধের বাক্য শুনে হই, তাদৃশ দুঃখ নিষ্ক্রান্ত।”

(তৃতীয় সূত্র)

৪ অগ্গপ্পসাদসুত্তং- অগ্রপ্রসাদ সূত্র

৩৪. “হে ভিক্ষুগণ! অগ্র প্রসাদ চার প্রকার। সেই চার প্রকার কি কি? যথা-যেসব পদহীন, দ্বিপদী, চতুষ্পদী, বহুপদী, রূপী, অরূপী, সংজ্ঞী, অসংজ্ঞী, সংজ্ঞীও নয় অসংজ্ঞীও নয় সত্ত্ব রয়েছে, তাদের মধ্যে তথাগতই অর্হৎ, সম্যক সম্বুদ্ধরূপে অগ্রে প্রকাশিত হন। যারা বুদ্ধের প্রতি প্রসন্ন, তারা অগ্রে প্রসন্ন; অগ্রে প্রসন্নকারীর অগ্রফল লাভ হয়।

যেসব সঙ্খত ধর্ম রয়েছে, সে সবের মধ্যে আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গই অগ্রে প্রকাশিত হয়। যারা আর্য অষ্টাঙ্গিক মার্গে প্রসন্ন, তারা অগ্রে প্রসন্ন; অগ্রে প্রসন্নকারীর অগ্রফল লাভ হয়।

সেসব সঙ্খত এবং অসঙ্খত ধর্ম রয়েছে, সে সবের মধ্যে বিরাগ-ই অগ্রে প্রকাশিত হয়। যাতে অহমিকা পরিত্যাগ, বিনয়, প্রতিপালনে বলবতী ইচ্ছা, আসক্তি উচ্ছেদ, পুনর্জন্মচক্র ধ্বংস, তৃষ্ণাক্ষয়, বিরাগ, নিরোধ, নির্বাণ বিদ্যমান। যারা বিরাগ ধর্মে প্রসন্ন, তারা অগ্রে প্রসন্ন; অগ্রে প্রসন্নকারীর অগ্রফল লাভ হয়।

যেসব সংঘ বা গণ রয়েছে, সে সবের মধ্যে তথাগতের শ্রাবকসংঘই অগ্রে প্রকাশিত হয়। চারি যুগল অষ্টবিধ পুদ্গল ভগবানের শ্রাবকসংঘ আহ্বানের যোগ্য, পূজা পাবার যোগ্য, দক্ষিণা পাবার যোগ্য, অঞ্জলি পাবার যোগ্য, ত্রিলোকের অনুত্তর পুণ্যক্ষেত্র। যারা সংঘে প্রসন্ন, তারা অগ্রে প্রসন্ন; অগ্রে প্রসন্নকারীর অগ্রফল লাভ হয়।

ভিক্ষুগণ! এগুলোই চার প্রকার অগ্র প্রসাদ।”

অগ্রপ্রসাদকারী জ্ঞাত জান যতো অগ্রধর্ম,

অনুত্তর দাক্ষিণেয় বুদ্ধে চিত্ত তাদের প্রসন্ন।

বিরাগ, উপশম ধর্মে হয় তারা তুষ্ট,

অনুত্তর পুণ্যক্ষেত্র সঙ্ঘে, চিত্ত তাদের হৃষ্ট।

অগ্রদানে লাভ হয় যতো অগ্রপুণ্য,

আয়ু-বর্ণ, যশ-কীর্তি, সুখ-বল অনন্য।

অগ্রদাতা মেধাবী হয়ে অগ্রধর্মে প্রতিষ্ঠিত,

হয় দেব-মনুষ্যলোকে অগ্রফলে প্রমোদিত।

(চতুর্থ সূত্র)

৫. বস্‌সকারসুত্তং-বর্ষকার সূত্র

৩৫. একসময় ভগবান রাজগৃহের বেনুবনে কলন্দক নিবাপে অবস্থান করছিলেন। তখন বর্ষকার ব্রাহ্মণ ভগবানের কাছে উপস্থিত হওতঃ প্রীতিপূর্ণ কুশলালাপ করে একপার্শ্বে উপবেশন করলেন। একপার্শ্বে উপবিষ্ট বর্ষকার ব্রাহ্মণ ভগবানকে এরূপ বললেন-“মহাশয় গৌতম! আমরা চার প্রকার ধর্মে সমন্বিত মহাপ্রাজ্ঞ, মহাপুরুষকে প্রকাশ করি। সেই চার প্রকার কি কি? যথা-এজগতে কেউ বহুশ্রুত হয়; তার সেই বহুশ্রুত জ্ঞানে, ভাষিত বিষয়ে অর্থ জানে- ‘এই ভাষিত বিষয়ের এ’অর্থ, এই ভাষিত বিষয়ের এ’অর্থ। স্মৃতিমান হয়; সুদীর্ঘকাল পর্যন্ত কৃতকর্ম, ভাষিত বিষয়ে কি করণীয় তা’ স্মরণ, অনুস্মরণ করে এবং উপায় মীমাংসা করে তা’ (সম্পাদন) করতে এবং অন্যকে প্রকাশ করতে দক্ষ ও অনলস হয়। আমরা এ’চার সমন্বিত মহাপ্রাজ্ঞ, মহাপুরুষকে প্রকাশ করি। মহাশয় গৌতম! আমার এবিষয় যদি আপনার অনুমোদনযোগ্য মনে হয়, তাহলে অনুমোদন করুন; আর যদি প্রত্যাখ্যান যোগ্য মনে হয়, তাহলে প্রত্যাখান করুন।

“হে ব্রাহ্মণ! আমি তা অনুমোদনও করছি না, প্রত্যাখানও করছি না। আমিও চার ধর্মে সমন্বিত মহাপ্রাজ্ঞ, মহাপুরুষকে প্রকাশ করি। সেই চার প্রকার কি কি? যথা- এজগতে কেউ বহুজনের হিতার্থে, বহুজনের সুখার্থে প্রতিপন্ন হয়; তার কারণে বহুজনতা আর্যধর্মে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়, যা কল্যাণধর্মতা ও কুশলধর্মতা। সে যেই ধ্যানে নিমগ্ন থাকতে ইচ্ছা করে, সেই ধ্যানে নিমগ্ন থাকে; যেই ধ্যানে নিমগ্ন থাকার ইচ্ছা করে না, সেই ধ্যানে নিমগ্ন থাকে না। যেই সংকল্প পোষণ করে, সেই সংকল্পে অটুট থাকে; যেই সংকল্প পোষণ করে না, সেই সংকল্পে অটুট থাকে না। এভাবে তার চিত্ত ধ্যানপথে বশীভূত। চার প্রকার ধ্যানে আত্মজ্ঞানে নির্ভরশীল হয়ে দৃষ্ট-ধর্মে সুখে অবস্থানকারীদের মধ্যে সন্তুষ্টলাভী, অকৃত্যলাভী, বিনাশ্রমেলাভী হয়। আস্রব ক্ষয় হেতু নিরাস্রব হয়ে এজীবনে স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা চিত্তবিমুক্তি, প্রজ্ঞাবিমুক্তি সাক্ষাৎ করে অবস্থান করে। ব্রাহ্মণ, আমি তোমার ব্যক্ত বিষয় অনুমোদনও করছি না, প্রত্যাখানও করছি না। আমি এ’চার প্রকার ধর্মে সমন্বিত মহাপ্রাজ্ঞ, মহাপুরুষকে প্রকাশ করি।

মহাশয় গৌতম, খুবই আশ্চর্য! খুবই অদ্ভুত! মহাশয় গৌতম কর্তৃক সুন্দরভাবে ভাষিত হয়েছে। আমরা আপনাকে এ’চার ধর্মে সমন্বিত বলে ধরে নিচ্ছি। আপনি বহুজন হিতার্থে, সুখার্থে প্রতিপন্ন; আপনার আশ্রয়ে বহু জনতা আর্যজ্ঞানে সুপ্রতিষ্ঠিত, যা কল্যাণধর্মতা ও কুশলধর্মতা। আপনি যে ধ্যানে নিমগ্ন থাকতে ইচ্ছা করেন, সে ধ্যানে নিমগ্ন থাকেন; সে ধ্যানে নিমগ্ন থাকার ইচ্ছা করেন না, সে ধ্যানে নিমগ্ন থাকেন না। যে সংকল্প পোষণ করেন সে সংকল্পে অটুট থাকেন; সে সংকল্প পোষণ করেন না, সে সংকল্পে অটুট থাকেন না। এভাবে আপনার চিত্ত ধ্যানপথে বশীভূত। চার প্রকার ধ্যানে আত্মজ্ঞানে নির্ভরশীল হয়ে দৃষ্টধর্মে সুখে অবস্থানকারীদের মধ্যে সন্তুষ্টলাভী, বিনাশ্রমেলাভী, অকৃত্যলাভী। আপনি আস্রব ক্ষয় হেতু নিরাস্রব হয়ে এজীবনে স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা চিত্তবিমুক্তি, প্রজ্ঞাবিমুক্তি সাক্ষাৎ করে অবস্থান করেন।

ব্রাহ্মণ! নিশ্চয় ইহা স্বভাবসিদ্ধভাবে আমার পরীক্ষার্থে এ’বাক্য ভাষিত হয়েছে। তথাপি তা আমি প্রকাশ করবো- আমি বহুজন হিতার্থে, সুখার্থে প্রতিপন্ন। আমার আশ্রয়ে বহুজনতা আর্যজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত, যা কল্যাণধর্মতা ও কুশলধর্মতা। আমি যে ধ্যানে নিমগ্ন থাকতে ইচ্ছা করি, সে ধ্যানে নিমগ্ন থাকি; যে ধ্যানে নিমগ্ন্‌ থাকতে ইচ্ছা করি না, সে ধ্যানে নিমগ্ন থাকি না। যে সংকল্প পোষণ করি, সে সংকল্পে অটুট থাকি; সে সংকল্প পোষণ করি না, সে সংকল্পে অটুট থাকি না। এভাবে আমার চিত্ত ধ্যানপথে বশীভূত; চার প্রকার ধ্যানে আত্মজ্ঞানে নির্ভরশীল হয়ে দৃষ্টধর্মে সুখে অবস্থানকারীদের মধ্যে সন্তুষ্টলাভী, বিনাশ্রমেলাভী, অকৃত্যলাভী। আমি আস্রব ক্ষয় হেতু নিরাসক্ত হয়ে এ’জীবনে স্বয়ং অভিজ্ঞা দ্বারা চিত্ত বিমুক্তি, প্রজ্ঞা বিমুক্তি সাক্ষাৎ করে অবস্থান করি।”

“জ্ঞাত যিনি সত্ত্বের মৃত্যুপাশ মোচনের,

প্রকাশেন সেধর্ম, হিতে দেব-নরে।

যাকে দেখে শ্রদ্ধান্বিত হয় বহুজনে,

সেরূপ প্রসন্ন হয় উপদেশ শ্রবণে।

কৃত-কৃত্য, অনাসব, মার্গামার্গে পারদর্শী,

বুদ্ধ মহাপ্রাজ্ঞ, মহাপুরুষ, অন্তিম দেহধারী।” (পঞ্চম সূত্র)

৬. দোণসুত্তং-দ্রোণ সূত্র

৩৬. একসময় ভগবান উক্কট্‌ঠ এবং সেতব্য নগরের মধ্যবর্তী দীর্ঘ রাস্তা দিয়ে গমন করছিলেন। দ্রোণ ব্রাহ্মণও সেপথে গমন করছিল। দ্রোণ ব্রাহ্মণ ভগবানের পাদদ্বয়ের তলদেশে দু’টি চক্র; চক্রে অরা-নেমি-নাভিযুক্ত সহস্র চিহ্ন অঙ্কিত সর্বকার পরিপূর্ণ দেখতে পায়। তখন তার এ’চিন্তা উদয় হল- “এ’মহাশয় বড়োই আশ্চর্য! বড়োই অদ্ভুত! এরূপ পদচিহ্ন সাধারণ মানুষের হয় না।”

অতঃপর ভগবান পথপার্শ্বস্থ কোন এক বৃক্ষমূলে পদ্মাসনে বসে দেহ ঋজু রেখে নির্বাণ অভিমুখে স্মৃতি উপস্থাপিত করেন। দ্রোণ ব্রাহ্মণ ভগবানের পদ অনুসরণ করে রমনীয়, প্রসাদনীয়, শান্ত-সংযত ইন্দ্রিয়, শান্ত-দান্ত, রক্ষিত, শান্তমন এবং উৎকৃষ্ট সংযম-উপশমেরত নাগ ভগবানকে বৃক্ষমূলে উপবিষ্ট অবস্থায় দেখতে পায়। অতঃপর সে ভগবানের নিকট উপস্থিত হয়ে এরূপ বলে- “আপনি নিশ্চয় আমাদের দেবতা হবেন? ব্রাহ্মণের প্রশ্নের উত্তরে বুদ্ধ বলেন-“হে ব্রাহ্মণ! আমি দেবতা নই।” -“গন্ধর্ব হবেন?” “ব্রাহ্মণ! আমি গন্ধর্ব নই।” “যক্ষ হবেন?” “ব্রাহ্মণ, আমি যক্ষ নই।” “মানব হবেন?” ব্রাহ্মণ, আমি মানব নই।”

এবার দ্রোণ ব্রাহ্মণ ভগবানকে এরূপ বলে উঠে- “আপনি আমাদের দেবতা হবেন? এরূপ জিজ্ঞাসিত হলে-‘ব্রাহ্মণ! আমি দেবতা নই’ বলেন; ‘গন্ধর্ব হবেন? এরূপ জিজ্ঞাসিত হলে-‘ব্রাহ্মণ, আমি গন্ধর্ব নই’ বলেন; ‘যক্ষ হবেন?” এরূপ জিজ্ঞাসিত হলে-‘ব্রাহ্মণ, আমি যক্ষ নই’ বলেন; ‘মানব হবেন?’ এরূপ জিজ্ঞাসিত হলে-‘ব্রাহ্মণ, আমি মানব নই’ বলেন; তাহলে আপনি কিভাবে অবস্থান করেন?

যাদের আস্রবসমূহ অপরিত্যক্ত, তাদেরকে আমি দেবতা বলি। সেসব আস্রব আমার প্রহীন হয়েছে, মূলউচ্ছিন্ন তালবৃক্ষের ন্যায় তা আর ভবিষ্যতে উৎপন্ন হবে না। যাদের আস্রবসমূহ অপরিত্যক্ত, তাদেরকে আমি গন্ধর্ব বলি। সেসব আস্রব আমার প্রহীন হয়েছে, মূলউচ্ছিন্ন তালবৃক্ষের ন্যায় তা আর ভবিষ্যতে উৎপন্ন হবে না। যাদের আস্রবসমূহ অপরিত্যক্ত, তাদেরকে আমি যক্ষ বলি। সেসব আস্রব আমার প্রহীন হয়েছে, মূলউচ্ছিন্ন তালবৃক্ষের ন্যায় তা আর ভবিষ্যতে উৎপন্ন হবে না। যাদের আস্রবসমূহ অপরিত্যক্ত, তাদেরকে আমি মানব বলি। সেসব আস্রব আমার প্রহীন হয়েছে, মূলউচ্ছিন্ন তালবৃক্ষের ন্যায় তা আর ভবিষ্যতে উৎপন্ন হবে না। যেমন-উৎপল, পদুম, শ্বেতপদ্ম জলে উৎপন্ন, বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওতঃ জলে লিপ্ত না হয়ে স্থিত থাকে; এরূপে আমিও জগতে উৎপন্ন বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হওতঃ তাতে লিপ্ত না হয়ে জগতের উর্ধ্বে অবস্থান করি। হে ব্রাহ্মণ! আমাকে বুদ্ধ বলে ধারণা কর।”

“যেভাবে হয় দেব উৎপত্তি আর গন্ধর্ব জনম,

সেভাবে করি আমি যক্ষ মনুষ্যতে বিচরণ।

ছিন্নভিন্ন, ধ্বংস করি যতো সব তৃষ্ণা,

তাই আমার ক্ষীণ ভব দুঃখ-যন্ত্রণা।

পুণ্ডরীক নাহি হয় লিপ্ত কোন জলে,

বুদ্ধ হয়ে আমিও নির্লিপ্ত এজগতে।”

(ষষ্ঠ সূত্র)

৭. অপরিহানিযসুত্তং- অপরহানীয় সূত্র

৩৭. “হে ভিক্ষগণ! চার প্রকার ধর্মে সমন্বিত ভিক্ষু পরিহানীর অযোগ্য, নির্বাণের সন্নিকটে। সেই চার প্রকার ধর্ম কি কি? যথা- এজগতে ভিক্ষু শীলসম্পন্ন হয়, ইন্দ্রিয়সমূহে সংযত হয়, ভোজনে মাত্রাজ্ঞ হয় এবং জাগরণে দৃঢ় সংকল্প হয়।

কিভাবে ভিক্ষু শীলসম্পন্ন হয়? এজগতে ভিক্ষু প্রাতিমোক্ষ সংবরণে সংযত, আচার গোচরসম্পন্ন, অল্পমাত্র পাপেও ভয়দর্শী এবং শিক্ষাপদসমূহ গ্রহণ করতঃ শিক্ষা করে শীলবান হয়। এভাবে ভিক্ষু শীলসম্পন্ন হয়।

কিভাবে ভিক্ষু ইন্দ্রিয়সমূহে সংযত হয়? এজগতে ভিক্ষু চক্ষু দিয়ে রূপ দেখে নিমিত্তগ্রাহী, অনুব্যঞ্জনগ্রাহী হয় না। এ’হেতুতে সামান্য অসংযতভাবে বিচরণকারী চক্ষু ইন্দ্রিয়কে অভিধ্যা , দৌর্মনস্য , অকুশল পাপধর্ম আক্রমণ করলেও আচ্ছন্ন করতে পারে না। যেহেতু ভিক্ষু চক্ষুর সংবরণে নিযুক্ত থাকে; চক্ষু ইন্দ্রিয়কে রক্ষা করে, চক্ষু ইন্দ্রিয়ে সংবরণ উৎপন্ন করে। কর্ণ দিয়ে শব্দ শুনে নিমিত্তগ্রাহী, অনুব্যঞ্জনগ্রাহী হয় না। এ’হেতুতে সামান্য অসংযতভাবে বিচরণকারী কর্ণ ইন্দ্রিয়কে অভিধ্যা, দৌর্মনস্য, অকুশল পাপধর্ম আক্রমণ করলেও আচ্ছন্ন করতে পারে না। যেহেতু ভিক্ষু কর্ণ সংবরণে নিযুক্ত থাকে; কর্ণ ইন্দ্রিয়কে রক্ষা করে, কর্ণ ইন্দ্রিয়ে সংবরণ উৎপন্ন করে। নাসিকা দিয়ে গন্ধ পেয়ে নিমিত্তগ্রাহী, অনুব্যঞ্জনগ্রাহী হয় না। এ’হেতুতে সামান্য অসংযতভাবে বিচরণকারী নাসিকা ইন্দ্রিয়কে অভিধ্যা, দৌর্মনস্য, অকুশল পাপধর্ম আক্রমণ করলেও আচ্ছন্ন করতে পারে না। যেহেতু ভিক্ষু নাসিকা সংবরণে নিযুক্ত থাকে; নাসিকা ইন্দ্রিয়কে রক্ষা করে, নাসিকা ইন্দ্রিয়ে সংবরণ উৎপন্ন করে। জিহ্বা দিয়ে রস আস্বাদন করে নিমিত্তগ্রাহী, অনুব্যঞ্জনগ্রাহী হয় না। এ’হেতুতে সামান্য অসংযতভাবে বিচরণকারী জিহ্বা ইন্দ্রিয়কে অভিধ্যা, দৌর্মনস্য, অকুশল পাপধর্ম আক্রমণ করলেও আচ্ছন্ন করতে পারে না। যেহেতু ভিক্ষু জিহ্বা সংবরণে নিযুক্ত থাকে; জিহ্বা ইন্দ্রিয়কে রক্ষা করে, জিহ্বা ইন্দ্রিয়ে সংবরণ উৎপন্ন করে। কায় দিয়ে স্পর্শ করে নিমিত্তগ্রাহী, অনুব্যঞ্জনগ্রাহী হয় না। এ’হেতুতে সামান্য অসংযতভাবে বিচরণকারী কায় ইন্দ্রিয়কে অভিধ্যা, দৌর্মনস্য, অকুশল পাপধর্ম আক্রমণ করলেও আচ্ছন্ন করতে পারে না। যেহেতু ভিক্ষু কায় সংবরণে নিযুক্ত থাকে; কায় ইন্দ্রিয়কে রক্ষা করে, কায় ইন্দ্রিয়ে সংবরণ উৎপন্ন করে। মন দিয়ে ধর্ম জেনে নিমিত্তগ্রাহী, অনুব্যঞ্জনগ্রাহী হয় না। এ’হেতুতে সামান্য অসংযতভাবে বিচরণকারী মন ইন্দ্রিয়কে অভিধ্যা, দৌর্মনস্য, অকুশল পাপধর্ম আক্রমণ করলেও আচ্ছন্ন করতে পারে না। যেহেতু ভিক্ষু মন সংবরণে নিযুক্ত থাকে; মন ইন্দ্রিয়কে রক্ষা করে, মন ইন্দ্রিয়ে সংবরণ উৎপন্ন করে। এভাবে ভিক্ষু ইন্দ্রিয়সমূহে সংযত হয়।

কিভাবে ভিক্ষু ভোজনে মাত্রাজ্ঞ হয়? এ’জগতে ভিক্ষু এরূপে সতর্কভাবে আহার গ্রহণ করে-“খেলার জন্য নয়, প্রমত্ততার জন্য নয়, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বৃদ্ধি সাধনের জন্য নয়, সৌন্দর্য বৃদ্ধির জন্য নয়; শুধুমাত্র এ’চতুর্মহাভৌতিক দেহের স্থিতি ও রক্ষার জন্য, ক্ষুধা-রোগ নিবারণার্থ, ব্রহ্মচর্যের অনুগ্রহার্থ; পুরানো ক্ষুধা-যন্ত্রণা বিনাশার্থ, নতুন যন্ত্রণা অনুৎপাদনার্থে আমি এ’ভোজন করছি। এই পরিমিত ভোজনে আমার মধ্যম প্রতিপদার অবস্থা প্রকাশিত হবে এবং আমি অনবদ্য সুখে অবস্থান করবো।” এভাবে ভিক্ষু ভোজনে মাত্রাজ্ঞ হয়।

কিভাবে ভিক্ষু জাগরণে দৃঢ় সংকল্প হয়? এ’জগতে ভিক্ষু দিনে চংক্রমণে অতিবাহিত করে আবরণীয় ধর্মসমূহ দ্বারা চিত্তকে পরিশুদ্ধ করে। রাতের মধ্যমযামে দক্ষিণপার্শ্ব দ্বারা সিংহশয্যা নির্ধারণ করে এক পায়ের উপর অন্য পা রেখে স্মৃতি সম্প্রজ্ঞানে, মনে গাত্রোত্থান সংজ্ঞা রেখে শয়ন করে। রাতের শেষযামে গাত্রোত্থান পূর্বক চংক্রমণে অতিবাহিত করে আবরণীয় ধর্মসমূহ দ্বারা চিত্তকে পরিশুদ্ধ করে। এভাবে ভিক্ষু জাগরণে দৃঢ় সংকল্প হয়। এই চার প্রকার ধর্মে সমন্বিত হয়ে ভিক্ষু পরিহানীর অযোগ্য, নির্বাণের সন্নিকটে হয়।”

“শীলে প্রতিষ্ঠিত ভিক্ষু, ইন্দ্রিয়েও সুসংযত,

ভোজনে মাত্রাজ্ঞ আর জাগরণে সংকল্পিত।

এরূপ উদ্যমে বিহারি, দিনরাত হয়ে বিচক্ষণ,

যোগক্ষমে উন্নতি সদা, কুশলধর্মে ভাবিত মন।

যেই ভিক্ষু অপ্রমাদে রত, ভয়দর্শী প্রমাদে,

পরিহানী অসম্ভব, নির্বাণ লাভে অবাধে।”

(সপ্তম সূত্র)

৮. পতিলীণসুত্তং-উচ্ছিন্নকারী সূত্র

৩৮. “হে ভিক্ষুগণ! এভাবে ভিক্ষুকে মিথ্যাধারণা বিদূরীতকারী, সর্ব স্পৃহা ধ্বংসকারী, কায়সংস্কার প্রশান্তকারী, উচ্ছিন্নকারী বলা হয়।

কিভাবে ভিক্ষু মিথ্যাধারণা বিদূরীতকারী হয়? এজগতে ভিক্ষুর সাধারণ শ্রমণ-ব্রাহ্মণের যেই কতিপয় সত্য, যেমন- জগত শাশ্বত, জগত অশাশ্বত, জগত অন্ত, জগত অনন্ত, যা জীবন তা শরীর, জীবন এক শরীর অন্য, মরণের পর তথাগতের অস্তিত্ব থাকে, মরণের পর তথাগতের অস্তিত্ব থাকে না, মরণের পর তথাগতের অস্তিত্ব থাকে না এবং থাকে না তাও নয়; এসব মিথ্যধারণা অপসারিত, বিদূরীত, বর্জিত, পরিত্যক্ত, নিঃসারিত, তিরোহিত, বিসর্জিত হয়। এভাবে ভিক্ষু মিথ্যাধারণা বিদূরীতকারী হয়।

কিভাবে ভিক্ষু সর্বস্পৃহা ধ্বংসকারী হয়? এজগতে ভিক্ষুর কাম-সুখের ইচ্ছা প্রহীন হয়, পুনর্জন্ম লাভের ইচ্ছা প্রহীন হয় এবং ব্রহ্মচর্যের ইচ্ছা প্রশমিত হয়। এভাবে ভিক্ষু সর্বস্পৃহা ধ্বংসকারী হয়।

কিভাবে ভিক্ষু কায়সংস্কার প্রশান্তকারী হয়? এজগতে ভিক্ষু শারীরিক সুখ-দুঃখ পরিত্যাগ করে, পূর্বের সৌর্মনস্য-দৌর্মনস্য অস্তগত করে, সুখ-দুঃখহীন উপেক্ষা ও স্মৃতি পরিশুদ্ধ নামক চতুর্থ ধ্যানস্তরে আরোহণ করে। এভাবে ভিক্ষু কায়সংস্কারের প্রশান্তকারী হয়।

কিভাবে ভিক্ষু উচ্ছিন্নকারী হয়? এজগতে ভিক্ষুর আমিত্ব ধারণা প্রহীন হয়, উচ্ছিন্ন মূল তালবৃক্ষের মতো সমূলে উৎপাটিত হয়, তা ভবিষ্যতে আর উৎপন্ন হয় না। এভাবে ভিক্ষু উচ্ছিন্নকারী হয়। ভিক্ষুগণ, এভাবে ভিক্ষুকে মিথ্যাধারণা বিদূরীতকারী, সর্বস্পৃহা ধ্বংসকারী, কায়সংস্কার প্রশান্তকারী, উচ্ছিন্নকারী বলা হয়।”

“কাম ইচ্ছা, ভব ইচ্ছা আর ব্রহ্মচর্যের,

এই সত্য সংস্পর্শের দৃষ্টিস্থান সমচ্চয়ের।

সর্বরাগে অনাসক্তে তৃষ্ণা ধ্বংস বিমুক্ত,

অপসৃত দৃষ্টিস্থান, হলে ইচ্ছা পরিত্যক্ত।

শীলবান ভিক্ষু সদা সুস্থির অপরাজিত,

অহংকার বিমুক্ত বলে বুদ্ধ আখ্যায়িত।”

(অষ্টম সূত্র)

৯.উজ্জযসুত্তং-উজ্জয় সূত্র

৩৯. একসময় উজ্জয় ব্রাহ্মণ ভগবানের কাছে উপস্থিত হয়ে প্রীতিপূর্ণ কুশলালাপ করতঃ একপার্শ্বে উপবেশন করল। উপবিষ্ট অবস্থায় ভগবানকে এরূপ বলল-

“মহাশয় গৌতম! আপনি নাকি যজ্ঞের গুণকীর্ত্তন করে থাকেন।” ভগবান বললেন-“হে ব্রাহ্মণ! আমি সব যজ্ঞের গুণকীর্ত্তন করি না; আবার সব যজ্ঞের যে গুণকীর্ত্তন করি না, তাও নয়।” যেরূপ যজ্ঞে গরু, ছাগল, ভেড়া, মুরগী, শুকর হত্যা করা হয় তথা বিবিধ প্রাণী হত্যা করা হয়; সেরূপ হত্যাযজ্ঞের গুণকীর্তন আমি করি না। তার কারণ কি? এরূপ হত্যাযজ্ঞ দ্বারা অর্হত্বে উপনীত বা অর্হত্ব মার্গে সমাপন্ন হওয়া যায় না।

যেরূপ যজ্ঞে গরু, ছাগল, ভেড়া, মুরগী, শুকর এবং বিবিধ প্রাণী হত্যা করা হয় না; সেরূপ পশুবলি বিহীন যজ্ঞের গুণকীর্তন করি আমি। যেমন, নিত্য দান দেওয়া যথোপযুক্ত যজ্ঞ। তার কারণ কি? পশুবলি বিহীন যজ্ঞ দ্বারা অর্হত্বে উপনীত বা অর্হত্বমার্গে সমাপন্ন হওয়া যায়।”

“পশুবলি, নরবলি, ঘৃতাহুতি যতো মহাযজ্ঞ,

কদলীবৃক্ষ সম সারহীন, নহে মহপ্‌ফল।

ছাগ, ভেড়া, গরু বিবিধ প্রাণী হননে,

নাহি সম্যকগত, সাধে না মহির্ষগণে।

যথোপযুক্ত যজ্ঞ জান, প্রাণীবলি বিহীন,

নাহি প্রয়োজন তাতে ছাগ, গরু হনন;

ইহাই সম্যকগত, সাধেন মহির্ষগণে।

এ’মহাফলদায়ী যজ্ঞে তৎপর মেধাবীগণ,

জানিবে এযজ্ঞ শ্রেষ্ঠ, নাহিক পাপ আগমণ;

এতেই বৈপুল্য লাভ, দেবগণও প্রসন্ন হন।”

(নবম সূত্র)

১০. উদাযীসুত্তং-উদায়ী সূত্র

৪০. একসময় উদায়ী ব্রাহ্মণ ভগবানের কাছে উপস্থিত হয়ে প্রীতিপূর্ণ কুশলালাপ করতঃ একপার্শ্বে উপবেশন করল। উপবিষ্ট অবস্থায় ভগবানকে এরূপ বলল-

“মহাশয় গৌতম! আপনি নাকি যজ্ঞের গুণকীর্ত্তন করে থাকেন।” ভগবান বললেন-“হে ব্রাহ্মণ! আমি সব যজ্ঞের গুণকীর্ত্তন করি না; আবার সব যজ্ঞের যে গুণকীর্ত্তন করি না, তাও নয়।” যেরূপ যজ্ঞে গরু, ছাগল, ভেড়া, মুরগী, শুকর হত্যা করা হয় তথা বিবিধ প্রাণী হত্যা করা হয়; সেরূপ হত্যাযজ্ঞের গুণকীর্ত্তন আমি করি না। তার কারণ কি? এরূপ হত্যাযজ্ঞ দ্বারা অর্হত্বে উপনীত বা অর্হত্ব মার্গে সমাপন্ন হওয়া যায় না।

যেরূপ যজ্ঞে গরু, ছাগল, ভেড়া, মুরগী, শুকর বিবিধ প্রাণী হত্যা করা হয় না; সেরূপ পশুবলি বিহীন যজ্ঞের গুণকীর্ত্তন করি আমি। যেমন, নিত্য দান দেওয়া যথোপযুক্ত যজ্ঞ। তার কারণ কি? পশুবলি বিহীন যজ্ঞ দ্বারা অর্হত্বে উপনীত বা অর্হত্বমার্গে সমাপন্ন হওয়া যায়।

“যথোপযুক্ত যজ্ঞ হয় পশুবলি বিহীনে,

এরূপ যজ্ঞ সাধে সংযত ব্রহ্মচারীগণে।

পুনর্জন্ম ধ্বংসে যারা, পৃথিবী উত্তীর্ণ,

সেই অভিজ্ঞগণে এযজ্ঞে গুণকীর্তন।

সাধে যদি এযজ্ঞ, কেউ উপযুক্ত সময়ে,

উর্বরক্ষেত্র ব্রহ্মচারী পূজা, প্রসন্ন হৃদয়ে।

উপযুক্ত পাত্রে দান হলে সুসাধিত,

এতে ফলপ্রদ, দেবগণ হয় আনন্দিত।

দান করে মুক্তচিত্তে মেধাবীগণ,

জগতে সুখ তার, রহে দুঃখহীন।”

(দশম সূত্র)