(১৯) ৪. ব্রাহ্মণবগ্‌গো-ব্রাহ্মণ বর্গ

(১) যোধজীবসুত্তং-যোদ্ধা সূত্র

১৮১. “হে ভিক্ষুগণ! চার প্রকার অঙ্গে সমন্বিত যোদ্ধা রাজার যোগ্য হয়, রাজভোগ্য হয় ও রাজার উপযুক্ত বলে পরিগণিত হয়। সেই চার প্রকার কি কি? যথা- এজগতে যোদ্ধা স্থান সম্বন্ধে দক্ষ (সুশিক্ষিত), দূর-ভেদক, অক্ষণভেদী (বিদ্যুৎ বেগে লক্ষ্যবস্তু বিদ্ধকারী) আর বহুসংখ্যক বস্তু (বৃহৎবস্তু) বা কায় বিদ্ধকারী হয়। ভিক্ষুগণ, এই চার প্রকার অঙ্গে সমন্বিত যোদ্ধা রাজার যোগ্য হয়, রাজভোগ্য হয় ও রাজার উপযুক্ত বলে পরিগণিত হয়। ঠিক এরূপেই চার প্রকার ধর্মে সমন্বিত ভিক্ষুও আহ্বানের যোগ্য হয়, সম্মানের যোগ্য হয়, দক্ষিণার বা দানের যোগ্য হয়, অঞ্জলির (বন্দনার) যোগ্য হয় ও জগতের অনুত্তর পুণ্যক্ষেত্র হয়। সেই চার প্রকার কি কি? যথা- এজগতে ভিক্ষু স্থান সম্বন্ধে দক্ষ, দূর ভেদী, অক্ষণ ভেদী ও বৃহৎ বস্তু বা কায় বিদ্ধকারী হয়।

কিরূপে ভিক্ষু স্থান সম্বন্ধে দক্ষ (সুশিক্ষিত) হয়? এজগতে ভিক্ষু শীলবান হয়, প্রাতিমোক্ষ সংবরে সংযত, আচার-গোচরসম্পন্ন, অনুমাত্র নিন্দনীয় আচরণেও ভয়দর্শী হয়ে অবস্থান করে এবং শিক্ষাপদসমূহ গ্রহণ করে চরিত্র গঠন করে। এরূপেই একজন ভিক্ষু স্থান সম্বন্ধে (সুশিক্ষিত) হয়।

কিরূপে ভিক্ষু দূরভেদী হয়? এজগতে অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, অভ্যন্তরীণ, বাহ্যিক, স্থূল, হীন, প্রণীত, দূরে বা নিকটে যে সমস্ত রূপ আছে, সে সমস্ত রূপকে সে ‘এটি আমার নয়, এটি আমি নই, ও এটি আমার আত্মা নয়’ এরূপে সম্যক প্রজ্ঞা দ্বারা যথাযথভাবে দর্শন করে। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, অভ্যন্তরীণ, বাহ্যিক, স্থূল, হীন, প্রণীত, দূরে বা নিকটে যে সমস্ত বেদনা আছে, সে সমস্ত বেদনাকে সে ‘এটি আমার নয়, এটি আমি নই, ও এটি আমার আত্মা নয়’ এরূপে সম্যক প্রজ্ঞা দ্বারা যথাযথভাবে দর্শন করে। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, অভ্যন্তরীণ, বাহ্যিক, স্থূল, হীন, প্রণীত, দূরে বা নিকটে যে সমস্ত সংজ্ঞা আছে, সে সমস্ত সংজ্ঞাকে সে ‘এটি আমার নয়, এটি আমি নই, ও এটি আমার আত্মা নয়’ এরূপে সম্যক প্রজ্ঞা দ্বারা যথাযথভাবে দর্শন করে। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, অভ্যন্তরীণ, বাহ্যিক, স্থূল, হীন, প্রণীত, দূরে বা নিকটে যে সমস্ত সংস্কার আছে, সে সমস্ত সংস্কাকে সে ‘এটি আমার নয়, এটি আমি নই, ও এটি আমার আত্মা নয়’ এরূপে সম্যক প্রজ্ঞা দ্বারা যথাযথভাবে দর্শন করে। অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ, অভ্যন্তরীণ, বাহ্যিক, স্থূল, হীন, প্রণীত, দূরে বা নিকটে যে সমস্ত বিজ্ঞান আছে, সে সমস্ত বিজ্ঞানকে সে ‘এটি আমার নয়, এটি আমি নই, ও এটি আমার আত্মা নয়’ এরূপে সম্যক প্রজ্ঞা দ্বারা যথাযথভাবে দর্শন করে। ভিক্ষুগণ! একজন ভিক্ষু এরূপেই দূরভেদী হয়।

কিরূপে ভিক্ষু অক্ষণভেদী (বিদ্যুৎ বেগে লক্ষ্যবস্তু বিদ্ধকারী) হয়? এজগতে ভিক্ষু যথাযথরূপে জানে যে, ‘ইহা দুঃখ’, ‘ইহা দুঃখ সমুদয়’, ‘ইহা দুঃখ নিরোধ’ ও ‘ইহা দুঃখ নিরোধের উপায়।’ ভিক্ষুগণ! এরূপেই একজন ভিক্ষু অক্ষভেদী হয়।

কিরূপে ভিক্ষু বৃহৎ বস্তু বা কায় বিদ্ধকারী হয়? এজগতে ভিক্ষু বৃহৎ অবিদ্যাস্কন্ধ বিদ্ধ করে। এরূপেই একজন ভিক্ষু বৃহৎ বস্তু বা কায় বিদ্ধকারী হয়। ভিক্ষুগণ! এই চার প্রকার ধর্মে সমন্বিত ভিক্ষু আহ্বানের যোগ্য হয়, সম্মানের যোগ্য হয়, দক্ষিণার বা দানের যোগ্য হয়, অঞ্জলির (বন্দনার যোগ্য হয় ও জগতের অনুত্তর পুণ্যক্ষেত্র হয়।” (প্রথম সূত্র)

২. পাটিভোগসুত্তং-প্রতিভূ (জামিনদার) সূত্র

১৪২. “হে ভিক্ষুগণ! জগতের শ্রমণ-ব্রাহ্মণ, দেবতা, ব্রহ্মা ও মার কেউই চার প্রকার ধর্মের জন্য জামিনদার (বা দায়ী) হতে পারে না।

সেই চার প্রকার কি কি? যথা- ‘জরাধর্ম আমাকে জীর্ণ না করুক’ এই বিষয়ে জগতের শ্রমণ-ব্রাহ্মণ, দেবতা, ব্রহ্মা ও মার কেউই চার প্রকার ধর্মের জন্য জামিনদার (বা দায়ী) হতে পারে না। ‘ব্যাধিধর্ম আমাকে পীড়িত না করুক’ এই বিষয়ে জগতের শ্রমণ-ব্রাহ্মণ, দেবতা, ব্রহ্মা ও মার কেউই চার প্রকার ধর্মের জন্য জামিনদার (বা দায়ী) হতে পারে না। ‘মরণধর্ম আমাকে মৃত্যুমুখে পতিত না করুক’ এই বিষয়ে জগতের শ্রমণ-ব্রাহ্মণ, দেবতা, ব্রহ্মা ও মার কেউই চার প্রকার ধর্মের জন্য জামিনদার (বা দায়ী) হতে পারে না। এবং পূর্বে নিজের দ্বারা কৃত পাপ, সংক্লেশ, পুনঃজন্ম প্রদান না করুক’ বেদনাদায়ক দুঃখবিপাকী ও এই জন্ম-জরা-মরণ প্রদায়ী সেই বিপাক আমার পুনঃজন্ম প্রদান না করুক’ এই বিষয়ে জগতের শ্রমণ-ব্রাহ্মণ, দেবতা, ব্রহ্মা ও মার কেউই চার প্রকার ধর্মের জন্য জামিনদার (বা দায়ী) হতে পারে না।

ভিক্ষুগণ! জগতের শ্রমণ-ব্রাহ্মণ, দেবতা, ব্রহ্মা ও মার কেউই চার প্রকার ধর্মের জন্য জামিনদার (বা দায়ী) হতে পারে না।” (দ্বিতীয় সূত্র)

৩. সুতসুত্তং-শ্রুত সূত্র

১৮৩. একসময় ভগবান রাজগৃহে অবস্থান করছিলেন, বেলুবনে কলন্দকনিবাপে। সে সময় মগধ মহামাত্য বর্ষাকার ব্রাহ্মণ ভগবানের নিকট উপস্থিত হওতঃ ভগবানের সাথে মিলিত হলেন। অতঃপর প্রীতিপূর্ণ কুশল বিনিময় করে একপার্শ্বে উপবেশন করলেন। একপার্শ্বে উপবিষ্ট মগধ মহামাত্য বর্ষকার ব্রাহ্মণ ভগবানকে এরূপ বললেন-

“হে মাননীয় গৌতম! আমি এরূপ মতাবাদী ও এরূপ দৃষ্টি পোষণকারী যে- ‘কোন জন দৃষ্ট বিষয়ে বলে থাকে যে, আমি এরূপ দেখেছি, তাতে কোন দোষ নেই; কোন জন শ্রুত বিষয়ে বলে থাকে যে, আমি এরূপ শ্রবণ করেছি, তাতে কোন দোষ নেই; কোন জন অনুমিত (নাসিকা, জিহ্বা ও স্পর্শ ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উপলব্ধ) বিষয়ে বলে থাকে যে, আমি এরূপ উপলব্ধি করেছি, তাতে কোন দোষ নেই এবং কোন জন বিজ্ঞাত (মনের দ্বারা অনুভূত বা জ্ঞাত) বিষয়ে বলে থাকে যে, আমি এরূপ অনুভব করেছি, তাতে কোন দোষ নেই।’ ”

“হে ব্রাহ্মণ! সমস্ত দৃষ্টবিষয় ভাষণ করা উচিত তা আমি বলি না, আবার সমস্ত দৃষ্টবিষয় ভাষণ করা উচিত নয় তাও আমি বলি না। সকল শ্রুতবিষয় ভাষণ করা উচিত তা আমি বলি না, আবার সকল শ্রুতবিষয় ভাষণ করা উচিত নয় তাও আমি বলি না। সকল অনুমিত বা উপলব্ধির বিষয় ভাষণ করা উচিত তা আমি বলি না, আবার সকল উপলব্ধির বিষয় ভাষণ করা উচিত নয় তাও আমি বলি না। এবং সকল বিজ্ঞাত বিষয় ভাষণ করা উচিত তা আমি বলি না, আবার সকল বিজ্ঞাত বিষয় ভাষণ করা উচিত নয় তাও আমি বলি না।

যেই দৃষ্টবিষয় ভাষণ করলে অকুশল ধর্মসমূহ অভিবৃদ্ধি হয় কুশল ধর্মসমূহ ক্ষয় প্রাপ্ত হয়, আমি বলি এরূপ দৃষ্টবিষয় ভাষণ করা অনুচিত। আর যেই দৃষ্টবিষয় ভাষণ না করলে কুশল ধর্মসমূহ ক্ষয়প্রাপ্ত হয় ও অকুশল ধর্মসমূহ অভিবৃদ্ধি হয়, আমি বলি এরূপ দৃষ্টবিষয় ভাষণ করা উচিত।

যেই শ্রুতবিষয় ভাষণ করলে অকুশল ধর্মসমূহ অভিবৃদ্ধি হয় কুশল ধর্মসমূহ ক্ষয় প্রাপ্ত হয়, আমি বলি এরূপ শ্রুতবিষয় ভাষণ করা অনুচিত। আর যেই শ্রুতবিষয় ভাষণ না করলে কুশল ধর্মসমূহ ক্ষয়প্রাপ্ত হয় ও অকুশল ধর্মসমূহ অভিবৃদ্ধি হয়, আমি বলি এরূপ শ্রুত বিষয় ভাষণ করা উচিত।

যেই অনুমিত বা উপলব্ধি বিষয় ভাষণ করলে অকুশল ধর্মসমূহ অভিবৃদ্ধি হয় কুশল ধর্মসমূহ ক্ষয় প্রাপ্ত হয়, আমি বলি এরূপ অনুমিত বা উপলব্ধি বিষয় ভাষণ করা অনুচিত। আর যেই অনুমিত বা উপলব্ধি বিষয় ভাষণ না করলে কুশল ধর্মসমূহ ক্ষয়প্রাপ্ত হয় ও অকুশল ধর্মসমূহ অভিবৃদ্ধি হয়, আমি বলি এরূপ অনুমিত বা উপলব্ধি বিষয় ভাষণ করা উচিত।

যেই বিজ্ঞাত বিষয় ভাষণ করলে অকুশল ধর্মসমূহ অভিবৃদ্ধি হয় কুশল ধর্মসমূহ ক্ষয় প্রাপ্ত হয়, আমি বলি এরূপ বিজ্ঞাত বিষয় ভাষণ করা অনুচিত। আর যেই বিজ্ঞাত বিষয় ভাষণ না করলে কুশল ধর্মসমূহ ক্ষয়প্রাপ্ত হয় ও অকুশল ধর্মসমূহ অভিবৃদ্ধি হয়, আমি বলি এরূপ বিজ্ঞাত বিষয় ভাষণ করা উচিত।

অতঃপর মগধ মহামাত্য বর্ষকার ব্রাহ্মণ ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন ও অনুমোদন করে আসন হতে উঠে প্রস্থান করলেন।” (তৃতীয় সূত্র)

৪. অভযসুত্তং-অভয় সূত্র

একসময় জানুশ্রোণি ব্রাহ্মণ ভগবানের নিকট উপস্থিত হওতঃ ভগবানের সাথে মিলিত হলেন। অতঃপর প্রীতিপূর্ণ কুশল বিনিময় করে একপাশে উপবেশন করলেন। একপার্শ্বে উপবিষ্ট জানুশ্রোণি ব্রাহ্মণ ভগবানকে এরূপ বললেন-

“হে মাননীয় গৌতম! আমি এরূপ মতবাদী ও এরূপ দৃষ্টি পোষণকারী যে- ‘এমন কোন ব্যক্তি নেই যিনি মরণ ধর্মকে ভয় করেন না ও মৃত্যুর শঙ্কা (ভয়) অনুভব করেন না।” “হে ব্রাহ্মণ! মরণধর্মে ভীত ব্যক্তি আছে এবং মৃত্যুর শঙ্কা অনুভবকারীও আছে; আর এমন ব্যক্তি আছে যে মরণধর্মকে ভয় করে না এবং মৃত্যুর শঙ্কাও অনুভব করে না।”

মরণধর্মে ভীত ব্যক্তি এবং মৃত্যুর শঙ্কা অনুভবকারী কিরূপ? এজগতে কোন কোন ব্যক্তি কামে অনুরাগী হয়, কামে আকাঙক্ষী হয়, কামে প্রেমী হয় এবং কাম-পিয়াসী হয়, কাম পরিদাহী হয় ও কাম তৃষ্ণায় বশীভূত হয়। সে কোন তীব্র রোগাতঙ্ক অনুভব করে। তার সেই তীব্র রোগাতঙ্কে এরূপ চিন্তা উৎপন্ন হয়ে যে- ‘প্রিয় কামসমূহ আমাকে পরিত্যাগ করবে, আমিও প্রিয় কামসমূহ পরিত্যাগ করব।’ সে তাই অনুশোচনা করে, ক্লান্তি অনুভব করে, বিলাপ করে, বুক চাপড়িয়ে চাপড়িয়ে ক্রন্দন করে ও সম্মোহিত বা মতিভ্রম হয়। একেই বলে মরণধর্মে ভীত ব্যক্তি এবং মৃত্যুর শঙ্কা অনুভবকারী।

পুনঃ, এজগতে কোন কোন ব্যক্তি দেহে অনুরাগী হয়, দেহ আকাঙক্ষী হয়, দেহ প্রেমী হয় এবং দেহ পিয়াসী হয়, দেহ পরিদাহী হয় ও দেহ তৃষ্ণায় বশীভূত হয়। সে কোন তীব্র রোগাতঙ্ক অনুভব করে। তার সেই তীব্র রোগাতঙ্কে এরূপ চিন্তা উৎপন্ন হয় যে- ‘প্রিয় কায় আমাকে পরিত্যাগ করবে, আমিও প্রিয় কামসমূহ পরিত্যাগ করব।’ সে তাই অনুশোচনা করে, ক্লান্তি অনুভব করে, বিলাপ করে, বুক চাপড়িয়ে চাপড়িয়ে ক্রন্দন করে ও সম্মোহিত বা মতিভ্রম হয়। একেই বলে মরণধর্মে ভীত ব্যক্তি এবং মৃত্যুর শঙ্কা অনুভবকারী।

পুনঃ, এজগতে কোন কোন ব্যক্তি অকল্যাণকারী হয়, অকুশলকারী হয়, ভীরুর রক্ষাকারী হয় না, পাপী হয়, নিষ্ঠুর (নির্দয়) হয় ও অসৎকর্মী হয়। সে কোন তীব্র রোগাতঙ্ক অনুভব করে। তার সেই তীব্র রোগাতঙ্কে এরূপ চিন্তা উৎপন্ন হয় যে- ‘আমার দ্বারা কল্যাণকর্ম করা হয়নি, কুশল কর্ম করা হয়নি, ভীরু ব্যক্তিদের রক্ষা করা হয়নি; আমার দ্বারা পাপকর্ম করা হয়েছে, নির্দয়পূর্ণ কার্য করা হয়েছে ও অসৎ কর্ম সম্পাদন করা হয়েছে। অকল্যাণকারী, অকুশলকারী, ভীরুর অরক্ষাকারী, পাপী, নির্দয়ী ও অসৎকর্মীদের যেই গতি হয়, মৃত্যুর পর আমারও সেই গতি হবে।’ সে তাই অনুশোচনা করে, ক্লান্তি অনুভব করে, বিলাপ করে, বুক চাপরিয়ে চাপরিয়ে ক্রন্দন করে ও সম্মোহিত বা মতিভ্রম হয়। একেই বলে মরণধর্মে ভীত ব্যক্তি এবং মৃত্যুর শঙ্কা অনুভবকারী।

পুনঃ, এজগতে কোন কোন ব্যক্তি সন্দেহকারী হয়, বিচিকিৎসাসম্পন্ন (সন্দেহ পোষণকারী) হয় ও সদ্ধর্মের অনিষ্টকারী হয়। সে কোন তীব্র রোগাতঙ্ক অনুভব করে। তার, সেই তীব্র রোগাতঙ্কে এরূপ চিন্তা উৎপন্ন হয় যে- ‘আমি সন্দেহকারী, বিচিকিৎসী ও সদ্ধর্মে অনিষ্টকারী।’ সে তাই অনুশোচনা করে, ক্লান্তি অনুভব করে, বিলাপ করে, বুক চাপড়িয়ে চাপড়িয়ে ক্রন্দন করে ও সম্মোহিত বা মতিভ্রম হয়। একে বলে মরণধর্মে ভীত ব্যক্তি ও মৃত্যুর শঙ্কা অনুভবকারী। এগুলোই হচ্ছে চার প্রকার মরণধর্মে ভীত ব্যক্তি ও মৃত্যুর শঙ্কা অনুভবকারী।

“হে ব্রাহ্মণ! মরণধর্মে অভীরু ব্যক্তি ও মৃত্যুর শঙ্কা অননুভবকারী কিরূপ? এজগতে কোন কোন ব্যক্তি কামের প্রতি বীতরাগী (অনাসক্ত) হয়, অনাকাঙক্ষী হয়, অপ্রেমী হয়, অপিয়াসী হয়, অপরিদাহী হয় ও তৃষ্ণায় বশীভূত হয় না (বিতষ্ণ হয়)। সে কোন তীব্র রোগাতঙ্ক অনুভব করে। তার সেই তীব্র রোগাতঙ্কের কারণে এরূপ চিন্তা উৎপন্ন হয় না যে- ‘প্রিয় কামসমূহ আমাকে পরিত্যাগ করবে, আমিও প্রিয় কামসমূহ পরিত্যাগ করব।’ তাই সে অনুশোচনা করে না, ক্লান্তি অনুভব করে না, বিলাপ করে না, বুক চাপড়িয়ে চাপড়িয়ে ক্রন্দন করে না ও সম্মোহিত বা মতিভ্রম হয় না। একে বলে মরণধর্মে অভীরু ব্যক্তি ও মৃত্যুর শঙ্কা অননুভবকারী।

পুনঃ, এজগতে কোন কোন ব্যক্তি দেহের প্রতি বীতরাগী হয়, অনাকাঙক্ষী হয়, অপ্রেমী হয়, অপিয়াসী হয়, অপরিদাহী হয় ও তৃষ্ণায় বশীভূত হয় না। সে কোন তীব্র রোগাতঙ্ক অনুভব করে। তার সেই তীব্র রোগাতঙ্কে এরূপ চিন্তা উৎপন্ন হয় যে- ‘প্রিয় কামসমূহ আমাকে পরিত্যাগ করবে, আমিও প্রিয় কামসমূহ পরিত্যাগ করব।’ তজ্জন্য সে অনুশোচনা করে না, ক্লান্তি অনুভব করে না, বিলাপ করে না, বুক চাপড়িয়ে চাপড়িয়ে ক্রন্দন করে না ও সম্মোহিত বা মতিভ্রম হয় না। একে বলে মরণধর্মে অভীরু ব্যক্তি ও মৃত্যুর শঙ্কা অননুভবকারী।

পুনঃ, এজগতে কোন কোন ব্যক্তি নিষ্পাপী (ধার্মিক) হয়, দয়ালু হয়, সৎকর্মী হয়, কল্যাণকারী হয়, কুশলকারী হয় ও ভীরুর রক্ষাকারী হয়। সে কোন তীব্র রোগাতঙ্ক অনুভব করে। তার সেই তীব্র রোগাতঙ্কে এরূপ চিন্তা উৎপন্ন হয় যে- ‘আমার দ্বারা পাপকর্ম করা হয়নি, নির্দয়পূর্ণ কার্যকর্ম করা হয়নি, অসৎকর্ম করা হয়নি; আমার দ্বারা কল্যাণকর কর্ম করা হয়েছে, কুশলকর্ম করা হয়েছে ও ভীরু ব্যক্তিদের রক্ষা করা হয়েছে। নিষ্পাপী, দয়ালু, সৎকর্মী, কল্যাণকারী, কুশলকারী, ভীরু রক্ষাকারী ব্যক্তির যেই গতি হয়, মৃত্যুর পর আমারও সেই গতি হবে।’ তজ্জন্য সে অনুশোচনা করে না, ক্লান্তি অনুভব করে না, বিলাপ করে না, বুক চাপড়িয়ে চাপড়িয়ে ক্রন্দন করে না ও সম্মোহিত বা মতিভ্রম হয় না। একে বলে মরণধর্মে অভীরু ব্যক্তি ও মৃত্যুর শঙ্কা অননুভবকারী।

পুনঃ, এজগতে কোন কোন ব্যক্তি সন্দেহহীন হয়, বিচিকিৎসাহীন হয় ও সদ্ধর্মে পূর্ণতালাভী হয়। সে কোন তীব্র রোগাতঙ্ক অনুভব করে। তার সেই তীব্র রোগাতঙ্কে এরূপ চিন্তা উৎপন্ন হয় যে- ‘আমি সন্দেহমুক্ত, বিচিকিৎসাহীন ও সদ্ধর্মে পূর্ণতালাভী।’ তজ্জন্য সে অনুশোচনা করে না, ক্লান্তি অনুভব করে না, বিলাপ করে না, বুক চাপড়িয়ে চাপড়িয়ে ক্রন্দন করে না ও সম্মোহিত বা মতিভ্রম হয় না। একে বলে মরণধর্মে অভীরু ব্যক্তি ও মৃত্যুর শঙ্কা অননুভবকারী। ব্রাহ্মণ! এগুলোই হচ্ছে চার প্রকার মরণধর্মে অভীরু ব্যক্তি ও মৃত্যুর শঙ্কা অননুভবকারী।”

“হে মাননীয় গৌতম, অতি আশ্চর্য! অতি অদু্ভত! যেমন কেউ অধোমুখী পাত্রকে ঊর্ধমুখী করে, আবৃতকে অনাবৃত করে, পথভ্রষ্টকে পথ বলে দেয় এবং অন্ধকারে তৈল প্রদীপ ধারণ করে, যাতে করে চক্ষুষ্মান ব্যক্তি রূপাদি দেখতে পায়; ঠিক এরূপেই মাননীয় গৌতমের দ্বারা অনেক পর্যায়ে ধর্ম প্রকাশিত হলো। এখন হতে মাননীয় গৌতমের শরণ গ্রহণ করছি, তাঁর ধর্ম এবং ভিক্ষু সংঘের শরণ গ্রহণ করছি। আজ হতে আমৃত্যু পর্যন্ত আমাকে উপাসকরূপে ধারণ করুন।” (চতুর্থ সূত্র)

৫. ব্রাহ্মণসচ্চসুত্তং-ব্রাহ্মণ্য সত্য সূত্র

১৮৫. একসময় ভগবান রাজগৃহস্থ গৃধ্রকূট পর্বতে অবস্থান করছিলেন। সেই সময় বহুসংখ্যক নামকরা (জ্ঞাত), প্রসিদ্ধ (অভিজ্ঞাত) পরিব্রাজক সিপ্পিনিকাতীরে পরিব্রাজকারামে অবস্থান করছিলেন, যেমন- অন্নভার, বরধর, সকুলুদায়ী প্রমুখ অন্যান্য নামকরা ও প্রসিদ্ধ পরিব্রাজগণ। একদিন ভগবান সায়হ্ন সময়ে নির্জনতা (ধ্যান) হতে উঠে সিপ্পিনিকাতীরে পরিব্রাজকারামে উপস্থিত হলেন।

সে সময়ে সেই অন্যতীর্থিয় পরিব্রাজকগণ একত্রিত হলে তাদের মধ্যে এরূপ অলোচনার সূত্রপাত হয়েছিল- “এটিই ব্রাহ্মণ্য সত্য, এটিই ব্রাহ্মণ্য সত্য।” অনন্তর ভগবান সেই পরিব্রাজকদের নিকট উপস্থিত হয়ে প্রজ্ঞাপ্ত আসনে উপবেশন করলেন। প্রজ্ঞাপ্ত আসনে উপবিষ্ট ভগবান পরিব্রাজকদেরকে এরূপ বললেন-

“হে পরিব্রাজকগণ! একত্রিত হয়ে তোমাদের মধ্যে কোন বিষয়ে আলোচনা হচ্ছিল?” “হে মাননীয় গৌতম! এখানে আমরা একত্রিত ও সম্মিলিত হলে আমাদের মধ্যে এরূপ আলোচ্য বিষয় উত্থাপিত হয়েছিল-‘এটিই ব্রাহ্মণ্য সত্য, এটিই ব্রাহ্মণ্য সত্য।”

“হে পরিব্রাজকগণ! চার প্রকার ব্রাহ্মণ্য সত্য আমার কর্তৃক স্বয়ং অভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে প্রচারিত হয়েছে। সেই চার প্রকার কি কি? যথা- এজগতে কোন ব্রাহ্মণ এরূপ বলে থাকে- ‘সব প্রাণীই অবধ্য (হত্যার অনুচিত)।’ এরূপ ভাষণের দরুন ব্রাহ্মণটি সত্য বলে থাকে, মিথ্যা নয়। সে তদ্বারা নিজেকে শ্রমণ বলে মনে করে না, ব্রাহ্মণ বলে মনে করে না; অপরের চেয়ে নিজের শ্রেষ্ঠ (উত্তম) বলে মনে করে না, সদৃশ মনে করে না ও (অপর ব্যক্তির চেয়ে) নিজেকে হীন মনে করে না। অধিকন্তু সে সেই সত্য উত্তমরূপে জ্ঞাত হয়ে প্রাণীদের প্রতি সহানুভূতি ও অনুকম্পায় প্রতিপন্ন হয়।

পুনঃ, কোন ব্রাহ্মণ এরূপ বলে থাকে- ‘ সব কাম অনিত্য, দুঃখ ও বিপরণামধর্মী।’ এরূপ ভাষণের দরুন ব্রাহ্মণটি সত্য বলে থাকে, মিথ্যা নয়। সে তদ্বারা নিজেকে শ্রমণ বলে মনে করে না, ব্রাহ্মণ বলে মনে করে না; অপরের চেয়ে নিজের শ্রেষ্ঠ (উত্তম) বলে মনে করে না, সদৃশ মনে করে না ও হীন মনে করে না। অধিকন্তু সে সেই সত্য উত্তমরূপে জ্ঞাত হয়ে কামসমূহের নির্বেদ, বিরাগ ও নিরোধের জন্য প্রতিপন্ন হয়।

পুনঃ, কোন ব্রাহ্মণ এরূপ বলে থাকে- ‘ সকল ভব অনিত্য, দুঃখ ও বিপরীণামধর্মী।’ এরূপ ভাষণের দরুন ব্রাহ্মণটি সত্য বলে থাকে, মিথ্যা নয়। সে তদ্বারা নিজেকে শ্রমণ বলে মনে করে না, ব্রাহ্মণ বলে মনে করে না; অপরের চেয়ে নিজেকে শ্রেষ্ঠ বা উত্তম বলে মনে করে না, সদৃশ মনে করে না ও হীন মনে করে না। অধিকন্তু সে সেই সত্য উত্তমরূপে জ্ঞাত হয়ে ভবসমূহের নির্বেদ, বিরাগ ও নিরোধের জন্য প্রতিপন্ন হয়।

পুনঃ, কোন ব্রাহ্মণ এরূপ বলে থাকে- ‘কোন কিছুর সাথে আমি সম্পর্কযুক্ত নই এবং কোন কিছুর প্রতি আমার আসক্তি নাই।’ এরূপ ভাষণের দরুন ব্রাহ্মণটি সত্য বলে থাকে, মিথ্যা নয়। সে তদ্বারা নিজেকে শ্রমণ বলে মনে করে না, ব্রাহ্মণ বলে মনে করে না; অপরের চেয়ে নিজের শ্রেষ্ঠ বা উত্তম বলে মনে করে না, সদৃশ মনে করে না ও হীন মনে করে না। অধিকন্তু সে সেই সত্য উত্তমরূপে জ্ঞাত হয়ে আকিঞ্চন (শূন্য অবস্থা অর্থাৎ কিছুই নেই) প্রতিপদায় প্রতিপন্ন হয়। পরিব্রাজকগণ! এই চার প্রকার ব্রাহ্মণ্য সত্যই আমার কর্তৃক স্বয়ং অভিজ্ঞা সাক্ষাৎ করে প্রচারিত হয়েছে।” (পঞ্চম সূত্র)

৬. উম্মগ্গসুত্তং-উন্মার্গ সূত্র

১৮৬. একসময় জনৈক ভিক্ষু ভগবানের নিকট উপস্থিত হয়ে অভিবাদন করে একপাশে উপবেশন করলেন। একপাশে উপবিষ্ট সেই ভিক্ষু ভগবানকে এরূপ বললেন- “ভন্তে! লোক বা জগত কি দ্বারা চালিত হয়, কি বা কার দ্বারা লোক নিরীক্ষণ করা যায় এবং কি-ই-বা উৎপন্ন হলে বশ (আয়ত্বাধীন) হয়?”

সাধু, সাধু, ভিক্ষু! তুমি অত্যন্ত মঙ্গলজনক, উন্মার্গ, উত্তমগুণসম্পন্ন, জ্ঞানসম্পন্ন ও কল্যাণকর প্রশ্ন করেছে। হে ভিক্ষু! তুমি এরূপই প্রশ্ন করেছে- ‘ভন্তে! লোক বা জগত কি দ্বারা চালিত হয়, কি বা কার দ্বারা নিরীক্ষণ করা যায় এবং কি-ই-বা উৎপন্ন হলে বশ (আয়ত্বাধীন) হয়?’ ” “হ্যাঁ, ভন্তে! এরূপ”। “ভিক্ষু! চিত্তের দ্বারা লোক বা জগত চালিত হয়, চিত্তের দ্বারা লোক নিরীক্ষণ করা যায় এবং চিত্ত উৎপন্ন হলেই বশ বা আয়ত্বাধীন।”

‘সাধু, ভন্তে!” বলে সেই ভিক্ষু ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন ও অনুমোদন করে আরও প্রশ্ন করলেন- “ভন্তে! এই যে ‘বহুশ্রুত ধর্মধর, বহুশ্রুত ধর্মধর’ বলা হয়; কিরূপে একজন বহুশ্রুত ধর্মধর হয়?”

সাধু, সাধু ভিক্ষু!” তুমি অত্যন্ত মঙ্গলজনক, উন্মার্গ, উত্তমগুণসম্পন্ন জ্ঞানসম্পন্ন ও কল্যাণকর প্রশ্ন করেছ। হে ভিক্ষু! তুমি এরূপই প্রশ্ন করেছ-“ভন্তে! এই যে ‘বহুশ্রুত ধর্মধর, বহুশ্রুত ধর্মধর’ বলা হয়; কিরূপে একজন বহুশ্রুত ধর্মধর হয়?” “হ্যাঁ, ভন্তে! এরূপ।” “হে ভিক্ষু! আমার কর্তৃক বহু প্রকারে ধর্ম দেশিত হচ্ছে, যথা- সূত্র, গেয়্য, ব্যাকরণ, গাথা, উদান, ইতিবুত্তক, জাতক, অদ্ভুতধর্ম ও বেদল্ল। ভিক্ষু! চতুষ্পদ গাথার অর্থ ও ধর্ম বিবেচনা (বিচার) করে ধর্মনুধর্মে প্রতিপন্ন ব্যক্তিকেই যথার্থরূপে বহুশ্রুত ধর্মধর বলা হয়।”

“সাধু, ভন্তে!” বলে সেই ভিক্ষু ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন ও অনুমোদন করে আরও প্রশ্ন করলেন- “ভন্তে! এই যে ‘শ্রুতবান তীক্ষ্নপ্রাজ্ঞ, শ্রুতবান তীক্ষ্নপ্রাজ্ঞ বলা হয়। কিরূপে একজন শ্রুতবান তীক্ষ্নপ্রাজ্ঞ হয়?”

“সাধু, সাধু ভিক্ষু! তা অত্যন্ত মঙ্গলজনক, উন্মার্গ, উত্তমগুণসম্পন্ন, জ্ঞানসম্পন্ন ও কল্যাণকর প্রশ্ন করেছ। হে ভিক্ষু! তুমি এরূপই প্রশ্ন করেছ-“ভন্তে! এই যে ‘শ্রুতবান তীক্ষ্নপ্রাজ্ঞ, শ্রুতবান তীক্ষ্নপ্রাজ্ঞ’ বলা হয়। কিরূপে একজন শ্রুতবান তীক্ষ্নপ্রাজ্ঞ হয়?” “হ্যাঁ, ভন্তে! এরূপ।” ভিক্ষু! এজগতে ভিক্ষুর ‘ইহা দুঃখ’ তা শ্রুত হয়, প্রজ্ঞা দ্বারা তার অর্থ তন্নতন্ন করে দর্শন করে; ‘ইহা দুঃখ সমুদয়’ তা তার শ্রুত হয়, প্রজ্ঞা দ্বারা তার অর্থ তন্নতন্ন করে দর্শন করে; ‘ইহা দুঃখ নিরোধ’ তা তার শ্রুত হয়, প্রাজ্ঞ দ্বারা তার অর্থ তন্নতন্ন করে দর্শন করে; ‘ইহা দুঃখ নিরোধের উপায়’ তাও তার শ্রুত হয়, প্রজ্ঞা দ্বারা তার অর্থ তন্নতন্ন করে দর্শন করে;

“সাধু, ভন্তে!” বলে সেই ভিক্ষু ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন ও অনুমোদন করে আরও প্রশ্ন করলেন- “ভন্তে! এই যে ‘পণ্ডিত মহাজ্ঞানী, পণ্ডিত মহাজ্ঞানী’ বলা হয়। কিরূপে একজন পণ্ডিত মহাজ্ঞানী হয়?”

সাধু, সাধু, ভিক্ষু! তা অত্যন্ত মঙ্গলজনক, উন্মার্গ, উত্তমগুণসম্পন্ন, জ্ঞানসম্পন্ন ও কল্যাণকর প্রশ্ন করেছ। হে ভিক্ষু! তুমি এরূপই প্রশ্ন করেছ- “ভন্তে! এই যে ‘পণ্ডিত মহাজ্ঞানী, পণ্ডিত মহাজ্ঞানী’ বলা হয়; কিরূপে একজন পণ্ডিত মহাজ্ঞানী হয়?” “হ্যাঁ, ভন্তে! এরূপ।” “ভিক্ষু! এজগতে পণ্ডিত মহাজ্ঞানী নিজের অনিষ্টতা চিন্তা করে না, অপরের অনিষ্টতা চিন্তা করে না, উভয়ের অনিষ্টতা চিন্তা করে না; আত্মহিত, পরহিত, উভয়হিত এবং সর্বলোকের হিত চিন্তা করে। হে ভিক্ষু! এরূপেই একজন পণ্ডিত মহাজ্ঞানী হয়।” (ষষ্ঠ সূত্র)

৭. বস্‌সকারসুত্তং- বর্ষকার সূত্র

১৮৭. একসময় ভগবান রাজগৃহে অবস্থান করছিলেন বেলুবনস্থ কলন্দকনিবাপে। সেই সময়ে মগধমহামাত্য বর্ষকার ব্রাহ্মণ ভগবানের নিকট উপস্থিত হওতঃ ভগবানের সাথে মিলিত হলেন। অতঃপর প্রীতিপূর্ণ কুশল বিনিময় করে একপাশে উপবেশন করলেন। একপাশে উপবিষ্ট মগধমহামাত্য বর্ষকার ব্রাহ্মণ ভগবানকে এরূপ বললেন-

“মাননীয় গৌতম! একজন অসৎপুরুষ অন্য একজন অসৎপুরুষকে ‘এই ব্যক্তি অসৎপুরুষ’ বলে চিনতে (জানতে) পারে কি?” “হে ব্রাহ্মণ! একজন অসৎপুরুষ অন্য একজন অসৎপুরুষকে ‘এই ব্যক্তি অসৎপুরুষ’ বলে চিনবে, তা অসম্ভব।” “মাননীয় গৌতম! একজন অসৎপুরুষ অন্য একজন সৎপুরুষকে ‘এই ব্যক্তি সৎপুরুষ’ বলে চিনতে পারে কি?” “হে ব্রাহ্মণ! একজন অসৎপুরুষ অন্য সৎপুরুষকে ‘এই ব্যক্তি সৎপুরুষ’ বলে চিনবে, তা অসম্ভব।” “মাননীয় গৌতম! একজন সৎপুরুষ অন্য একজন সৎপুরুষকে ‘এই ব্যক্তি সৎপুরুষ’ বলে চিনতে পারে কি?” “হে ব্রাহ্মণ! একজন সৎপুরুষ অন্য একজন সৎপুরুষকে ‘এই ব্যক্তি সৎপুরুষ’ বলে চিনবে, তা সম্ভব।” “মাননীয় গৌতম! একজন সৎপুরুষ অন্য একজন অসৎপুরুষকে ‘এই ব্যক্তি অসৎপুরুষ’ বলে চিনতে পারে কি? “হে ব্রাহ্মণ! একজন সৎপুরুষ অন্য অসৎপুরুষকে ‘এই ব্যক্তি অসৎপুরুষ’ বলে চিনবে, তা সম্ভব।”

মাননীয় গৌতম, কি আশ্চর্য! কি অদ্ভুদ! গৌতমে দ্বারা এটি সুভাষিত হল যে- “হে ব্রাহ্মণ! একজন অসৎপুরুষ অন্য অসৎপুরুষকে ‘এই ব্যক্তি অসৎপুরুষ’ বলে চিনবে, তা অসম্ভব। একজন সৎপুরুষ অন্য একজন অসৎপুরুষকে ‘এই ব্যক্তি সৎপুরুষ’ বলে চিনবে, তা অসম্ভব। একজন সৎপুরুষ অন্য একজন সৎপুরুষকে ‘এই ব্যক্তি সৎপুরুষ’ বলে চিনবে, তা সম্ভব। একজন সৎপুরুষ অন্য একজন অসৎপুরুষকে ‘এই ব্যক্তি অসৎপুরুষ’ বলে চিনবে, তা সম্ভব।

মাননীয় গৌতম! একসময় তোদেয়্য ব্রাহ্মণের পরিষদ এরূপ বদনাম করছিল যে- ‘এই মূর্খ এলেয়্যো রাজা শ্রমণ রামপুত্রের প্রতি বিপ্রসন্ন (ভক্ত), শ্রমণ রামপুত্রের প্রতি এরূপে পরম বিনীতভাব প্রদর্শন করেন, যথা- অভিবাদন, প্রত্যুত্থান, অঞ্জলিকর্ম (বন্দনা) ও সমীচিনকর্ম বা শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এমনকি এলেয়্যো রাজার পরিষদ, যথা- যমক, মোগ্গল্লো, উগ্র, নাবিন্দকী, গন্ধর্ব, অগ্নিবৈশ্যগণও মূর্খ যারা শ্রমণ রামপুত্রের প্রতি বিপ্রসন্ন। তারাও শ্রমণ রামপুত্রের প্রতি এরূপে পরম বিনীতভাব প্রদর্শন করেন, যথা- অভিবাদন, প্রত্যুত্থান, অঞ্জলিকর্ম ও সমীচিনকর্ম করেন।” হে ব্রাহ্মণ! তোদেয়্যো ব্রাহ্মণ তাদেরকে এই ভাবেই (পরিচালিত করে) উপদেশ দেয়। তারা কি মনে করে যে, পণ্ডিত এলেয়্যো রাজা কার্যমীমাংসায় এবং অন্যের চেয়ে বেশী অন্তদৃর্ষ্টিসম্পন্ন?” ‘মাননীয়! এরূপই, পণ্ডিত রাজা এলেয়্যো কার্য-মীমাংসায় এবং বাদ-মীমাংসায় অন্যের চেয়ে বেশি অন্তদৃর্ষ্টিসম্পন্ন।”

“মাননীয়! যেহেতু, রামপুত্র শ্রমণ কায়মীমাংসায় বাদ-মীমাংসায় পণ্ডিত রাজা এলয়্যোর চেয়ে বেশি অন্তদৃর্ষ্টি সম্পন্ন, তাই রাজা এলেয়্যো শ্রমণ রামপুত্রের প্রতি অভিপ্রসন্ন, এবং তিনি রামপুত্র শ্রমণের প্রতি এরূপে বিনীতভাব প্রদর্শন করেন, যথা- অভিবাদন, প্রত্যুত্থান, অঞ্জলিকর্ম ও সমীচিনকর্ম করেন।”

“হে ব্রাহ্মণ! তারা মনে করে যে, পণ্ডিত এলেয়্যো রাজার পরিষদ, যথা- যমক, মোগ্গল্লো, উগ্র, নাবিন্দকী, গন্ধর্ব, অগ্নিবৈশ্যগণ কায় মীমাংসায় এবং বাদ-মীমাংসায় অন্যের চেয়ে বেশী অন্তদৃর্ষ্টিসম্পন্ন?” ‘মাননীয়! এরূপই, পণ্ডিত এলেয়্যো রাজার পরিষদ যথা- যমক, মোগ্গল্লো, উগ্র, নাবিন্দকী, গন্ধর্ব, অগ্নিবৈশ্যগণ কায় মীমাংসায় এবং বাদ-মীমাংসায় অন্যের চেয়ে বেশী অন্তদৃর্ষ্টিসম্পন্ন।”

“মাননীয়! যেহেতু রামপুত্র শ্রমণ কায-মীমাংসায় ও বাদ-মীমাংসা পণ্ডিত এলেয়্যো রাজার পরিষদের চেয়ে বেশী অন্তদৃর্ষ্টিসম্পন্ন, তাই পণ্ডিত এলেয়্যো রাজার পরিষদ শ্রমণ রামপুত্রের প্রতি অভিপ্রসন্ন। এবং তারা শ্রমণ রামপুত্রের প্রতি এরূপে পরম বিনীতভাব প্রদর্শন করেন, যথা- অভিবাদন, প্রত্যুত্থান, অঞ্জলিকর্মও সমীচিনকর্মও করেন।”

“মাননীয় গৌতম, কি আশ্চর্য! কি অদ্ভুদ! মাননীয় গৌতমের দ্বারা এটি সুভাষিত হলো যে- ‘হে ব্রাহ্মণ! একজন অসৎপুরুষ অন্য একজন অসৎপুরুষকে ‘এই ব্যক্তি অসৎপুরুষ’ বলে চিনবে, তা অসম্ভব। একজন অসৎপুরুষ অন্য একজন সৎপুরুষকে ‘এই ব্যক্তি সৎপুরুষ’ বলে চিনবে, তা অসম্ভব। একজন সৎপুরুষ অন্য একজন সৎপুরুষকে ‘এই ব্যক্তি সৎপুরুষ’ বলে চিনবে, তা সম্ভব। আর একজন সৎপুরুষ অন্য অসৎপুরুষকে ‘এই ব্যক্তি অসৎপুরুষ’ বলে চিনবে, তা সম্ভব। মাননীয় গৌতম! আমরা এখন গমন করব। আমাদের বহুকৃত্য (কার্য) ও করণীয় আছে।” “হে ব্রাহ্মণ! এখন তুমি যা উচিত মনে কর।” অতঃপর মগধমহামাত্য বর্ষকার ব্রাহ্মণ ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন ও অনুমোদন করে আসন হতে উঠে প্রস্থান করলেন। (সপ্তম সূত্র)

৮. উপকসুত্তং-উপক সূত্র

১৮৮. একসময় ভগবান রাজগৃহস্থ গৃধ্রকূট পর্বতে অবস্থান করছিলেন। সে সময়ে মণ্ডিকাপুত্র উপক ভগবানের নিকট উপস্থিত হয়ে ভগবানকে অভিবাদন করে একপাশে উপবেশন করলেন। একপাশে উপবিষ্ট মণ্ডিকাপুত্র উপক ভগবানকে এরূপ বললেন-

“ভন্তে! আমি এরূপ মতবাদী ও এরূপ দৃষ্টিপোষণকারী যে- ‘কোন ব্যক্তি অপরকে নিন্দা করে থাকে, সে অপরকে নিন্দা করলেও সব নিন্দা কার্যে পরিণত করতে পারে না। কার্যে পরিণত করতে না পেরে ঘৃণার্হ ও নিন্দার্হ হয়।” “হে উপক! তদ্রুপ তুমিও অপরকে নিন্দা কর, কিন্তু অপরকে নিন্দা করলেও সেই নিন্দা কার্যে পরিণত করতে পারো না। কার্যে পরিণত করতে না পেরে ঘৃণার্হ ও নিন্দা হও।” (তখন উপক বলল) “ভন্তে! যেমন জালে ভেসে উঠা মৎস্যকে বৃহৎ পাশ বা রজ্জু দ্বারা বন্ধন (বা আবদ্ধ) করে; ঠিক এরূপেই আমিও ভেসে উঠে ভগবানের মহৎ কথা পাশে আবদ্ধ হয়েছি।”

“হে উপক! আমার কর্তৃক প্রজ্ঞাপ্ত হয়েছে যে, ‘ইহা অকুশল বিষয়। তথাগতের যেই ধর্মদেশনা অপরিমাণ পদযুক্ত ও অপরিমাণ ব্যঞ্জনযুক্ত তাই হচ্ছে অকুশল। উপক! মৎ কর্তৃক প্রজ্ঞাপ্ত সেই অকুশল পরিত্যাগ করা উচিত। তথাগতের অপরিমাণ পদযুক্ত ও অপরিমাণ ব্যঞ্জনযুক্ত সেই অকুশল পরিত্যাগ করা উচিত।

উপক! আমার কর্তৃক প্রজ্ঞাপ্ত হয়েছে যে, ‘ইহা কুশল বিষয়।’ তথাগতের যেই ধর্মদেশনা অপরিমাণ পদযুক্ত ও অপরিমাণ ব্যঞ্জনযুক্ত তাই হচ্ছে কুশল। উপক! মৎ কর্তৃক প্রজ্ঞাপ্ত সেই কুশল ভাবিত বা বৃদ্ধি করা উচিত। তথাগতের অপরিমাণ পদযুক্ত ও অপরিমাণ ব্যঞ্জনযুক্ত সেই কুশল ভাবিত বা বৃদ্ধি করা উচিত।”

অতঃপর মণ্ডিকাপুত্র উপক ভগবানের ভাষণ অভিনন্দন এবং অনুমোদন করে আসন হতে উঠে ভগবানকে অভিবাদন ও প্রদক্ষিণ করে মগধ রাজ্যের রাজা বৈদেহিপুত্র অজাতশত্রুর নিকট উপস্থিত হলেন। উপস্থিত হয়ে ভগবানের সাথে যেরূপ কথাবার্তা হয়েছিল তৎসমস্ত মগধ রাজ্যের রাজা বৈদেহিপুত্র অজাতশত্রুকে বললেন।

এরূপ উক্ত হলে মগধ রাজ্যের রাজা বৈদেহিপুত্র অজাতশত্রু কুপিত ও অসন্তুষ্ট হয়ে মণ্ডিকাপুত্র উপককে এরূপ বললেন-“বিধ্বংসী লবণ প্রস্তুতকারী বালক, মুখর (বাচাল) ও কি দুঃসাহসী যে, সেই ভগবান অরহত সম্যকসম্বুদ্ধের সম্মুখবর্তী হওয়া উচিত বলে মনে করে। উপক! দূর হও এখান হতে, বিনাশ হোক তোমার, তোমাকে যাতে আর এখানে না দেখি! (অষ্টম সূত্র)

৯. সচ্ছিকরণীযসুত্তং-উপলব্ধি যোগ্য সূত্র

১৮৯. “হে ভিক্ষুগণ! চার প্রকার ধর্ম উপলব্ধিযোগ্য। সেই চার প্রকার কি কি? যথা- এমন ধর্ম আছে, যা কায় দ্বারা উপলব্ধিযোগ্য, এমন ধর্ম আছে, যা স্মৃতিদ্বারা উপলব্ধিযোগ্য, এমন ধর্ম আছে, যা চক্ষু (জ্ঞান চক্ষু) দ্বারা উপলব্ধি যোগ্য ও এমন ধর্ম আছে, যা প্রজ্ঞা দ্বারা উপলব্ধি যোগ্য। ভিক্ষুগণ! কায় দ্বারা উপলব্ধি যোগ্য ধর্ম কিরূপ? অষ্টবিধ বিমোক্ষ কায় দ্বারা উপলব্ধি যোগ্য।

স্মৃতি দ্বারা উপলব্ধি যোগ্য ধর্ম কিরূপ? স্মৃতি দ্বারা পূর্বনিবাস (পূর্বপূর্ব জন্মের বাসস্থান) উপলব্ধি যোগ্য।

চক্ষু (জ্ঞান চক্ষু) দ্বারা উপলব্ধি যোগ্য কিরূপ? সত্ত্বগণের চ্যুতি-উৎপত্তি (জন্ম-মৃত্যু) চক্ষু দ্বারা উপলব্ধি যোগ্য।

প্রজ্ঞা দ্বারা উপলব্ধি যোগ্য ধর্ম কিরূপ? আস্রব ক্ষয়ই প্রজ্ঞা দ্বারা উপলব্ধি যোগ্য। ভিক্ষুগণ! এগুলোই হচ্ছে চার প্রকার উপলব্ধি ধর্ম।” (নবম সূত্র)

১০. উপোসথসুত্তং-উপোসথ সূত্র

১৯০. একসময় ভগবান শ্রাবস্তীতে অবস্থান করছিলেন পূর্বারামস্থ মিগারমাতা প্রসাদে। সেই সময় ভগবান উপোসথ দিবসে ভিক্ষুসংঘ পরিবৃত হয়ে উপবিষ্ট ছিলেন। অতঃপর ভগবান তুষ্ণীভূত ভিক্ষুসংঘকে তুষ্ণীভূত (মৌনাবলম্বিত) অবস্থায় দেখে ভিক্ষুগণকে আহ্বান করে বললেন-

“হে ভিক্ষুগণ! এই পরিষদ অনলস, নিষপ্রলাপী ও পরিশুদ্ধ সারে প্রতিষ্ঠিত। এই ভিক্ষুসংঘ ও পরিষদও সেরূপ। যেইরূপ পরিষদের দর্শন লাভ করা জগতে দুর্লভ, সেরূপ এই ভিক্ষুসংঘ ও এই পরিষদ। যেরূপ পরিষদ আহ্বানের যোগ্য, পূজার যোগ্য, দক্ষিণার যোগ্য, অঞ্জলি করণীয় (বন্দনার যোগ্য) ও জগতের অনুত্তর পুণ্যক্ষেত্র, এই ভিক্ষুসংঘ আর এই পরিষদও সেরূপ। যেই পরিষদে অল্প দানে বহুফল হয় ও বহুদানে বহুতর ফল হয়, এই ভিক্ষুসংঘ ও পরিষদও সেরূপ। যেই পরিষদ দর্শনের জন্য খাদ্য-দ্রব্যসহ যোজন যোজন রাস্তা গমন করে, এই ভিক্ষুসংঘ ও পরিষদও সেরূপ।

এই ভিক্ষুসংঘে দেবত্বপ্রাপ্ত হয়ে অবস্থান করছে এমন ভিক্ষু আছে। এই ভিক্ষুসংঘে ব্রহ্মত্বপ্রাপ্ত হয়ে অবস্থান করছে এমন ভিক্ষুও আছে। এই ভিক্ষুসংঘের মধ্যে আনেঞ্জাপ্রাপ্ত (শূন্যতা ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত) হয়ে অবস্থান করছে এমন ভিক্ষু আছে। আর এই ভিক্ষুসংঘের মধ্যে আর্যপ্রাপ্ত (অর্হত্বপ্রাপ্ত) হয়ে অবস্থান করছে এমন ভিক্ষুও আছে।

কিরূপে ভিক্ষু দেবত্বপ্রাপ্ত হয়? এজগতে ভিক্ষু কাম (কামনা) ও অকুশল ধর্মসমূহ হতে বিবিক্ত (পৃথক) হয়ে সবির্তক, সবিচার ও বিবেকজনিত প্রীতি-সুখমণ্ডিত প্রথম ধ্যান লাভ করে অবস্থান করে। বির্তক ও বিচারের উপশমে আধ্যাত্মিক সমপ্রসাদী, চিত্তের একীভাব আনয়নকারী, অবির্তক অবিচার সমাধিজনিত প্রীতি-সুখমণ্ডিত দ্বিতীয় ধ্যান লাভ করে অবস্থান করে। সে প্রীতির প্রতিও বিরাগী হয়ে উপেক্ষাশীল হয়ে অবস্থান করে এবং স্মৃতিমান ও সমপ্রজ্ঞানী হয়ে কায়িক সুখ অনুভব করে; যে অবস্থায় থাকলে আর্যগণ ‘উপেক্ষক, স্মৃতিমান, সুখবিহারী’ বলে অভিহিত করেন সেই তৃতীয় ধ্যান লাভ করে অবস্থান করে। সর্ববিধ সুখ-দুঃখ পরিত্যাগ করে পূর্বেই মানসিক সৌমনস্য ও দৌমনস্যের বিনাশ সাধন করে সুখ-দুঃখহীন ‘উপেক্ষা স্মৃতি পরিশুদ্ধি’ নামক চতুর্থ ধ্যান লাভ করে অবস্থান করে। এরূপেই ভিক্ষু দেবত্বপ্রাপ্ত হয়।

কিরূপে ভিক্ষু ব্রহ্মত্বপ্রাপ্ত হয়? এজগতে ভিক্ষু মৈত্রীসহগত চিত্তে একদিকে স্ফুরিত (পরিব্যাপ্ত) করে অবস্থান করে। তথা দুই দিকে, তিন দিকে ও চারিদিকে স্ফুরিত করে অবস্থান করে। এরূপেই উর্ধ্ব, অধঃ, নিুে আড়াআড়িতে সর্বত্র সব প্রাণী ও সমগ্র লোকের প্রতি বিপুল, মহদ্গত, অপ্রমাণ, অবৈরী ও মিত্রভাবাপন্ন হয়ে মৈত্রীসহগত চিত্তে স্ফুরিত করে অবস্থান করে। ভিক্ষু করুণাসহগত চিত্তে একদিকে স্ফুরিত করে অবস্থান করে। তথা দুই দিকে, তিন দিকে ও চারিদিকে স্ফুরিত করে অবস্থান করে। এরূপেই উর্ধ্বে, অধেঃ, নিুে তির্যকক্রমে সর্বত্র সব প্রাণী ও সমগ্র লোকের প্রতি বিপুল, মহদ্গত, অপ্রমাণ, অবৈরী ও মিত্রভাবাপন্ন হয়ে করুণাসহগত চিত্তে স্ফুরিত করে অবস্থান করে। ভিক্ষু মুদিতাসহগত চিত্তে একদিকে স্ফুরিত (পরিব্যাপ্ত) করে অবস্থান করে। তথা দুই দিকে, তিন দিকে ও চারিদিকে স্ফুরিত করে অবস্থান করে। এরূপেই উর্ধ্বে, অধেঃ, নিম্নে তির্যকক্রমে সর্বত্র সকল প্রাণী ও সমগ্র লোকের প্রতি বিপুল, মহদ্গত, অপ্রমাণ, অবৈরী ও মিত্রভাবাপন্ন হয়ে মুদিতাসহগত চিত্তে স্ফুরিত করে অবস্থান করে। ভিক্ষু উপেক্ষাসহগত চিত্তে একদিকে স্ফুরিত করে অবস্থান করে। তথা দুই দিকে, তিন দিকে ও চারিদিকে স্ফুরিত করে অবস্থান করে। এরূপেই উর্ধ্বে, অধেঃ, নিুে তির্যকক্রমে সর্বত্র সব প্রাণী ও সমগ্র লোকের প্রতি বিপুল, মহদ্গত, অপ্রমাণ, অবৈরী ও মিত্রভাবাপন্ন হয়ে উপেক্ষাসহগত চিত্তে স্ফুরিত করে অবস্থান করে। এরূপেই ভিক্ষু ব্রহ্মত্বপ্রাপ্ত হয়।

কিরূপে ভিক্ষু আনেঞ্জাপ্রাপ্ত হয়? এজগতে ভিক্ষু সর্বতোভাবে রূপসংজ্ঞাসমূহ অতিক্রম করতঃ প্রতিঘসংজ্ঞা ধ্বংস করে নানাত্বসংজ্ঞায় অমনোযোগী হয়ে ‘অনন্তআকাশ’ সংজ্ঞায় আকাশ অনন্তায়তন লাভ করে অবস্থান করে। সে সম্পূর্ণরূপে আকাশ অনন্তায়তন অতিক্রম করতঃ ‘অনন্ত বিজ্ঞান’ সংজ্ঞায় বিজ্ঞান অনন্তায়তন লাভ করে অবস্থান করে। সর্বতোভাবে বিজ্ঞান অনন্তায়তন অতিক্রম করতঃ সংজ্ঞায় বিজ্ঞান অনন্তায়তন লাভ করে অবস্থান করে। সর্বতোভাবে বিজ্ঞান অনন্তায়তন অতিক্রম করতঃ কিছুই নাই’ সংজ্ঞায় আকিঞ্চনায়তন লাভ করে অবস্থান করে। এবং সর্বতোভাবে আকিঞ্চনায়তন অতিক্রম করতঃ নৈবসংজ্ঞায়তন লাভ করে অবস্থান করে। এরূপেই ভিক্ষু আনেঞ্জাপ্রাপ্ত হয়।

কিরূপে ভিক্ষু আর্যপ্রাপ্ত (অর্হৎ) হয়? এজগতে ভিক্ষু ‘ইহা দুঃখ’ তা যথার্থরূপে জানে, ‘ইহা দুঃখ সমুদয়’ তা যথার্থরূপে জানে,‘ ইহা দুঃখ নিরোধ’ তা যথার্থরূপে জানে, ইহা দুঃখ নিরোধের উপায়’ তা যথার্থরূপে জানে। এরূপেই ভিক্ষু আর্যপ্রাপ্ত হয়।” (দশম সূত্র)

ব্রাহ্মণ বর্গ সমাপ্ত।

স্মরক গাথাঃ

যোদ্ধা, প্রতিভূ, শ্রুত, অভয়, ব্রাহ্মণ্য সত্য পঞ্চম;

উন্মার্গ, বর্ষকার, উপক, উপলব্ধি যোগ্য ও উপোসথ।