(৭) ২. পত্তকম্মবগ্গো-প্রাপ্তকর্ম বর্গ

১. পত্তকম্মসুত্তং-প্রাপ্তকর্ম সূত্র

৬১. একসময় গৃহপতি অনাথপিণ্ডিক ভগবানের কাছে উপস্থিত হলেন। উপস্থিত হয়ে ভগবানকে অভিবাদন করতঃ একপার্শ্বে উপবেশন করলেন। উপবিষ্ট গৃহপতি অনাথপিণ্ডিককে ভগবান এরূপ বললেন- “হে গৃহপতি! জগতে চার প্রকার ধর্ম ইষ্ট, কান্ত, মনোজ্ঞ এবং দুর্লভ। সেই চার প্রকার কি কি? যথা- “ধর্মানুসারে আমার ভোগ (উপভোগ্য বস্তু) উৎপন্ন হোক”- এই প্রথম ধর্ম, জগতে ইষ্ট, কান্ত, মনোজ্ঞ এবং দুর্লভ।

“ধর্মানুসারে লব্ধ ভোগে আমার জ্ঞাতিসহ উপধ্যায়ের যশঃ লাভ হোক”- এই দ্বিতীয় ধর্ম, জগতে ইষ্ট, কান্ত, মনোজ্ঞ এবং দুর্লভ।

“ধর্মানুসারে লব্ধ ভোগ, যশেঃ আমি জ্ঞাতি, উপধ্যায়ের সাথে দীর্ঘায়ু হই, দীর্ঘায়ুকে রক্ষা করতে পারি”- এই তৃতীয় ধর্ম, জগতে ইষ্ট, কান্ত, মনোজ্ঞ এবং দুর্লভ।

“ধর্মানুসারে লব্ধ ভোগ, যশেঃ আমি জ্ঞাতি, উপধ্যায়সহ দীর্ঘকাল জীবিত থেকে, দীর্ঘায়ু রক্ষা করে মৃত্যুর পর সুগতি স্বর্গলোকে উৎপন্ন হতে পারি”- এই চতুর্থ ধর্ম, জগতে ইষ্ট, কান্ত, মনোজ্ঞ এবং দুর্লভ।

গৃহপতি! জগতে ইষ্ট, কান্ত, মনোজ্ঞ এবং দুর্লভ এ’চার ধর্মের প্রতিলাভার্থে অপর চার প্রকার ধর্ম সংবর্তিত হয়। সেই চার প্রকার কি কি? যথা- শ্রদ্ধা সম্পদ, শীল সম্পদ, ত্যাগ সম্পদ, প্রজ্ঞা সম্পদ।

শ্রদ্ধা সম্পদ কি রকম? এজগতে আর্যশ্রাবক তথাগতের জ্ঞানে শ্রদ্ধাসম্পন্ন হয়- ‘ইনি সেই ভগবান অর্হৎ, সম্যক সম্বুদ্ধ, বিদ্যা ও সু-আচরণ সম্পন্ন, সুগত, লোকজ্ঞ, অনুত্তর (শ্রেষ্ঠ) পুরুষদমনকারী সারথি, দেব-মানবের শাস্তা, বুদ্ধ, ভগবান’। একে বলা হয় শ্রদ্ধা সম্পদ।

শীল সম্পদ কি রকম? এজগতে আর্যশ্রাবক প্রাণীহত্যা হতে প্রতিবিরত হয়, চুরিকর্ম হতে প্রতিবিরত হয়, ব্যভিচার হতে প্রতিবিরত হয়, মিথ্যাবাক্য হতে প্রতিবিরত হয়, প্রমাদের কারণ মাদকদ্রব্য সেবন হতে প্রতিবিরত হয়। একে বলা হয় শীল সম্পদ।

ত্যাগ সম্পদ কি রকম? এজগতে আর্যশ্রাবক দানে উদার, বিশুদ্ধহস্ত, সমর্পিত, উৎসর্গীকৃত, নিযুক্ত হয়ে মাৎসর্যমলমুক্ত চিত্তে গৃহে অবস্থান করে। একে বলা হয় ত্যাগ সম্পদ।

প্রজ্ঞা সম্পদ কি রকম? এজগতে কেউ লোভাভিভূত চিত্তে অবস্থানকালে অকৃত্য সম্পাদন করে, কৃত্য লঙ্ঘন করে। সেই অকৃত্য সম্পাদন এবং কৃত্য লঙ্ঘন করতঃ স্থায়ী যশঃ, সুখ ধ্বংস করে। হিংসাভিভূত চিত্তে অবস্থানকালে অকৃত্য সম্পাদন করে, কৃত্য লঙ্ঘন করে। সেই অকৃত্য সম্পাদন এবং কৃত্য লঙ্ঘন করতঃ স্থায়ী যশঃ, সুখ ধ্বংস করে। আলস্য-তন্দ্রাভিভূত চিত্তে অবস্থানকালে অকৃত্য সম্পাদন করে, কৃত্য লঙ্ঘন করে। সেই অকৃত্য সম্পাদন এবং কৃত্য লঙ্ঘন করতঃ স্থায়ী যশঃ, সুখ ধ্বংস করে। উদ্বেগ-চঞ্চলাভিভূত চিত্তে অবস্থানকালে অকৃত্য সম্পাদন করে, কৃত্য লঙ্ঘন করে। সেই অকৃত্য সম্পাদন এবং কৃত্য লঙ্ঘন করতঃ স্থায়ী যশঃ, সুখ ধ্বংস করে।

গৃহপতি! লোভ চিত্তের উপক্লেশ, ইহা জ্ঞাত হওয়ার দরুন আর্যশ্রাবকের চিত্তের সেই লোভ উপক্লেশ প্রহীন হয়। হিংসা চিত্তের উপক্লেশ, ইহা জ্ঞাত হওয়ার দরুন আর্যশ্রাবকের চিত্তের সেই হিংসা উপক্লেশ প্রহীন হয়। আলস্য-তন্দ্রা চিত্তের উপক্লেশ, ইহা জ্ঞাত হওয়ার দরুন আর্যশ্রাবকের চিত্তের সেই আলস্য-তন্দ্রা চিত্তের উপক্লেশ প্রহীন হয়। উদ্বেগ-চঞ্চলতা চিত্তের উপক্লেশ, ইহা জ্ঞাত হওয়ার দরুন আর্যশ্রাবকের চিত্তের সেই উদ্বেগ-চঞ্চলতা চিত্তের উপক্লেশ প্রহীন হয়। সন্দেহ চিত্তের উপক্লেশ, ইহা জ্ঞাত হওয়ার দরুন আর্যশ্রাবকের চিত্তের সেই সন্দেহ উপক্লেশ প্রহীন হয়। এই আর্যশ্রাবককে বলা হয় মহা প্রজ্ঞাবান, অধিকতর প্রজ্ঞাবান, আপাতদসো (দশ পরিসরে প্রজ্ঞাবান), প্রজ্ঞাসম্পন্ন। একে বলা হয় প্রজ্ঞা সম্পদ। গৃহপতি, এরূপে জগতে ইষ্ট, কান্ত, মনোজ্ঞ এবং দুর্লভ- এ’চার ধর্মের প্রতিলাভার্থে এই (অপর) চার ধর্ম সংবর্তিত হয়।

গৃহপতি! আর্যশ্রাবক অধিগত বীর্য , ভোগ, বাহুবল, পরিশ্রম, ধর্ম এবং ধর্মগুণ দ্বারা চার প্রকার প্রাপ্তকর্মের কর্তা নয়। সেই চার প্রকার কি কি? যথা- এজগতে আর্যশ্রাবক অধিগত বীর্য, ভোগ, বাহুবল, পরিশ্রম, ধর্ম এবং ধর্মগুণ দ্বারা নিজের সম্যক সুখকে সুষ্ঠু ও পরিপূর্ণভাবে সংরক্ষণ করে। পিতা-মাতার সম্যক সুখকে সুষ্ঠু ও পরিপূর্ণভাবে সংরক্ষণ করে। স্ত্রী, পুত্র-কন্যা, দাস-দাসীর সম্যক সুখকে সুষ্ঠু ও পরিপূর্ণভাবে সংরক্ষণ করে। বন্ধু ও বন্ধুরূপী পরামর্শ দাতার সম্যক সুখকে সুষ্ঠু ও পরিপূর্ণভাবে সংরক্ষণ করে। এভাবে প্রথম প্রাপ্ত বিষয়গত জ্ঞানের পর্যায়ভূক্ত হয়।

পুুনঃ, গৃহপতি! আর্যশ্রাবক অধিগত বীর্য, ভোগ, বাহুবল, পরিশ্রম, ধর্ম এবং ধর্মগুণ দ্বারা অগ্নি, জল, রাজা, চোর, পুত্র, শত্রু হতে যেসব বিপদ হয়; সেই বিপদসমূহের প্রতিরোধার্থে সংবর্তিত হয় এবং নিজেকে মুক্ত করে। এভাবে দ্বিতীয় প্রাপ্ত বিষয়গত জ্ঞানের পর্যায়ভূক্ত হয়।

পুনঃ, গৃহপতি! আর্যশ্রাবক অধিগত বীর্য, ভোগ, বাহুবল, পরিশ্রম, ধর্ম এবং ধর্মগুণ দ্বারা পঞ্চ পূজার কর্তা হয়- জ্ঞাতি পূজা, অতিথি পূজা, পূর্ব প্রেত পূজা, রাজা পূজা, দেবতা পূজা। এভাবে তৃতীয় প্রাপ্ত বিষয়গত জ্ঞানের পর্যায়ভূক্ত হয়।

পুনঃ, গৃহপতি! আর্যশ্রাবক অধিগত বীর্য, ভোগ, বাহুবল, পরিশ্রম, ধর্ম এবং ধর্মগুণ দ্বারা যেসব শ্রমণ-ব্রাহ্মণ মদ, প্রমাদ হতে বিরত; ক্ষমাগুণে ও নম্রতায় নিবিষ্ট; গোপনে নিজেকে দমন, শান্ত, পরিনির্বাপিত করে; সেরূপ শ্রমণ-ব্রাহ্মণকে উৎকৃষ্ট বস্তু দান করে স্বর্গসুখ, সুখজনক ফল এবং স্বর্গ সংবর্তনিকে প্রতিষ্ঠিত করে নিজেকে। এভাবে চতুর্থ প্রাপ্ত বিষয়গত জ্ঞানের পর্যায়ভূক্ত হয়।

গৃহপতি! সেই আর্যশ্রাবক অধিগত বীর্য, ভোগ, বাহুবল, পরিশ্রম, ধর্ম এবং ধর্মগুণ দ্বারা এ’চার প্রাপ্ত কর্মের কর্তা হয়। অন্যত্র যে কোন ব্যক্তির এ’চার প্রাপ্ত কর্মের দ্বারা ভোগ ক্ষয় প্রাপ্ত হয়; একে বলা হয় ভোগ অস্থানগত, অপ্রাপ্তগত, অজ্ঞানের পর্যায়ভূক্ত। গৃহপতি! এই চার প্রাপ্তকর্ম দ্বারা যে কোন ব্যক্তির ভোগ ক্ষয় প্রাপ্ত হয়; একে বলা হয় ভোগ ক্ষয়ের স্থানগত, প্রাপ্তগত, স্থানের পর্যায়ভূক্ত হয়।

“ভোগ-ভুক্ত, রক্ষিত-পোষিত, বিপদোত্তীর্ণ আমি,

সর্বোৎকৃষ্ট দানে মম, কৃত হয় পঞ্চবিধ বলি;

পূজিতে সংযত শীলবানে মোর চিত্ত আকুলি।

যেসব ভোগ সম্পদ ইচ্ছেন পণ্ডিত ব্যক্তিগণ,

হয়েছে সেসব লাভ মম, অতীত অনুশোচন।

অনুস্মরে মৃত্যু চিন্তা, আর্যধর্মে স্থিত নর,

ইহলোকে প্রশংসা, পরলোকে সুখ অধিকতর।

(প্রথম সূত্র)

২. আনন্যসুত্তং-ঋণমুক্ত সূত্র

৬২. একসময় গৃহপতি অনাথপিণ্ডিক ভগবানের কাছে উপস্থিত হলেন। উপস্থিত হয়ে ভগবানকে অভিবাদন করতঃ একপার্শ্বে উপবেশন করলেন। উপবিষ্ট অনাথপিণ্ডিককে ভগবান এরূপ বললেন- “হে গৃহপতি! কামভোগী গৃহী সময়ে সময়ে চার প্রকার সুখ ভোগ করে। সেই চার প্রকার কি কি? যথা- প্রাপ্তি (অত্থি) সুখ, ভোগ সুখ, ঋণমুক্ত সুখ, অনবদ্য সুখ।

প্রাপ্তি সুখ কিরূপ? এজগতে কোন কুলপুত্রের অধিগত বীর্য, ভোগ, বাহুবল, পরিশ্রম, ধর্ম এবং ধর্মগুণ লাভ হয়। সে “আমার অধিগত বীর্য, ভোগ, বাহুবল, পরিশ্রম, ধর্ম এবং ধর্মগুণ আছে” বলে সুখ, সৌর্মনস্য লাভ করে। একে বলা হয় প্রাপ্তি সুখ।

ভোগ সুখ কিরূপ? এজগতে) কোন কুলপুত্র অধিগত বীর্য, ভোগ, বাহুবল, পরিশ্রম, ধর্ম এবং ধর্মগুণ দ্বারা সুখ ভোগ করে, পুণ্যকর্ম সম্পাদন করে। সে “আমি অধিগত বীর্য, ভোগ, বাহুবল, পরিশ্রম, ধর্ম এবং ধর্মগুণ দ্বারা সুখ ভোগ করছি, পুণ্যকর্ম সম্পাদন করছি” এ’বলে সুখ, সৌর্মনস্য লাভ করে। একে বলা হয় ভোগ সুখ।

ঋণমুক্ত সুখ কিরূপ? এজগতে কোন কুলপুত্র কারো কাছ থেকে অল্প কিংবা বেশী ঋণ গ্রহণ করে না। সে “আমি কারো কাছ থেকে অল্প কিংবা বেশী ঋণ গ্রহণ করিনি” এবলে সুখ, সৌর্মনস্য লাভ করে। একে বলা হয় ঋণমুক্ত সুখ।

অনবদ্য সুখ কিরূপ? এজগতে আর্যশ্রাবক অনবদ্য কায়-বাক-মনোকর্মে সমন্বিত হয়। সে “আমি অনবদ্য কায়-বাক-মনোকর্মে সমন্বিত” এবলে সুখ, সৌর্মনস্য লাভ করে। একে বলা হয় অনবদ্য সুখ। গৃহপতি! এই চার প্রকার সুখ কামভোগী গৃহী সময়ে সময়ে উপভোগ করে।

“ঋণমুক্ত সুখ আর অত্থিসুখে হয়ে পরিজ্ঞাত,

পরকে লিপ্ত দেখেও জ্ঞানী, তাতে অক্ষত।

সেই উভয় সুখকে সুমেধ করে অনুধাবন,

অনবদ্য সুখে, নহে ষোড়াংশ সমান।

(দ্বিতীয় সূত্র)

৩. ব্রহ্মসুত্তং-ব্রহ্মা সূত্র

৬৩. “হে ভিক্ষুগণ! যে পুত্র-কন্যাদের গৃহে পিতা-মাতা পূজিত হয়, সে গৃহাদিতে তারা ব্রহ্মা সদৃশ। যে পুত্র-কন্যাদের গৃহে পিতা-মাতা পূজিত হয়, সে গৃহাদিতে তারা পূর্বাচার্য সদৃশ। যে পুত্র-কন্যাদের গৃহে পিতা-মাতা পূজিত হয়, সে গৃহাদিতে তারা পূর্বদেবতা সদৃশ। যে পুত্র-কন্যাদের গৃহে পিতা-মাতা পূজিত হয়, সে গৃহাদিতে তারা পূজার উপযুক্ত।

“ভিক্ষুগণ! এখানে ব্রহ্মা হচ্ছে পিতা-মাতার অধিবচন। পূর্বাচার্য হচ্ছে পিতা-মাতার অধিবচন। পূর্বদেবতা হচ্ছে পিতা-মাতার অধিবচন। পূজার উপযুক্ত হচ্ছে পিতা-মাতার অধিবচন। তার কারণ কি? পিতা-মাতা পুত্র-কন্যাদের বহু উপকারী; জন্ম হতে-ই রক্ষাকারী, ভরণ-পোষণকারী এবং এই পৃথিবী প্রদর্শনকারী।”

“মাতা পিতা হল ব্রহ্মা আর পূর্বাচার্য,

পুত্র-কন্যাদের সেবা পাবার যোগ্য।

হয়ে পুত্রকন্যার পরম অনুকম্পাকারী,

পণ্ডিতে জানাই তাতে পূজা আর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

উত্তম অন্ন, জল আর বস্ত্র, শয্যাদি প্রদানে,

সুগন্ধি, ্লান আর পদধৌত করণে।

মাতা-পিতা সেবে পূজে যেই পণ্ডিত,

ইহলোকে প্রশংসা, স্বর্গেও আনন্দিত।”

(তৃতীয় সূত্র)

৪. নিরযসুত্তং-নিরয় সূত্র

৬৪. “হে ভিক্ষুগণ! চার ধর্মে সমন্বিত পুদগল নিঃসন্দেহে নিরয়ে উৎপন্ন হয়। সেই চার ধর্ম কি কি? যথা- প্রাণীহত্যা, অদত্তবস্তু গ্রহণ, ব্যভিচার এবং মিথ্যাবাক্য ভাষণ করা। এই চার ধর্মে সমন্বিত পুদগল নিঃসন্দেহে নিরয়ে উৎপন্ন হয়।”

“প্রাণীহত্যা, চুরি ও ব্যাভিচার, মিথ্যাভাষণ,

মার্গ ইহা নরকের, নিন্দে পণ্ডিতগণ।”

(চতুর্থ সূত্র)

৫. রূপসুত্তং-রূপসূত্র

৬৫. “হে ভিক্ষুগণ! জগতে চার প্রকার পুদগল বিদ্যমান। সেই চার প্রকার কি কি? যথা- রূপপ্রিয়, রূপসম্পন্ন; ঘোস (গুণকীর্তন) প্রিয়, ঘোস প্রসন্ন; রুক্ষপ্রিয়, রুক্ষ প্রসন্ন; ধর্মপ্রিয়, ধর্ম প্রসন্ন। জগতে এই চার প্রকার পুদগল বিদ্যমান।

“রূপ আর শব্দের প্রতি যারা বিমোহিত,

জানে না হায়! ছন্দরাগে হয় বশীভূত।

আধ্যাত্মিক অজ্ঞাত, বাহ্যিকও অদর্শিত,

সর্বাবরণে মূর্খ, শব্দে হয় মোহিত।

আধ্যাত্মিক অজ্ঞাত, বাহ্যিক দর্শিত,

বাহ্যিক ফলদর্শী, শব্দে হয় মোহিত।

আধ্যাত্মিক জ্ঞাত, বাহ্যিকও দর্শিত,

নিবরণমুক্ত জ্ঞানী নহেন মোহিত।”

(পঞ্চম সূত্র)

৬. সরাগসুত্তং-সরাগ সূত্র

৬৬. “হে ভিক্ষুগণ! জগতে চার প্রকার পুদগল বিদ্যমান। সেই চার প্রকার কি কি? যথা- রাগযুক্ত, দ্বেষযুক্ত, মোহযুক্ত এবং অহংকারযুক্ত। জগতে এই চার প্রকার পুদগল।

“হলে কামে রাগাভিভূত আর প্রিয়রূপে নন্দিত,

মোহে আবদ্ধ সত্ত্ব, বন্ধন করে দৃঢ়, বর্ধিত।

রাগ, দ্বেষ, মোহ ত্যাগে যতো জ্ঞানীগণ,

সম্পাদনে কুশলকর্ম, ধ্বংসেন সব দুঃখ যাতন।

অবিদ্যাচ্ছন্ন পুরুষ, যেন জ্ঞান আর দৃষ্টিহীন,

ধর্মই উত্তম, এধারণায় সে দীন অতি দীন।”

(ষষ্ঠ সূত্র)

৭. অহিরাজসুত্তং-অহিরাজ সূত্র

৬৭. একসময় ভগবান শ্রাবস্তীতে অনাথপিণ্ডিকের নির্মিত জেতবন বিহারে অবস্থান করছিলেন। সেই সময় শ্রাবস্তীতে জনৈক ভিক্ষু সর্প কর্তৃক দংশিত হয়ে মৃত্যুবরণ করছিল। অতঃপর ভিক্ষুগণ ভগবানের নিকট উপস্থিত হলেন। উপস্থিত হয়ে ভগবানকে অভিবাদন করতঃ একপার্শ্বে উপবিষ্ট হয়ে ভগবানকে এরূপ বললেন- “ভন্তে! এ’শ্রাবস্তীতে জনৈক ভিক্ষু সর্প দংশিত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে।” ভিক্ষুগণের মুখে একথা শুনে ভগবান বললেন- “হে ভিক্ষুগণ! সেই ভিক্ষু নিশ্চয় চার প্রকার অহিরাজকুলের প্রতি মৈত্রী চিত্ত পোষণ করেনি। যদি সেই ভিক্ষু চার প্রকার অহিরাজকুলের প্রতি মৈত্রী চিত্ত পোষণ করত, তাহলে সর্প দংশনে তার মৃত্যু হতো না।

সেই চার প্রকার অহিরাজকুল কি কি? বিরূপাক্ষ অহিরাজকুল, এরাপথ অহিরাজকুল, ছব্যাপুত্র অহিরাজকুল, কৃষ্ণ গৌতমক অহিরাজকুল। সেই ভিক্ষু নিশ্চয় এ’চার অহিরাজকুলের প্রতি মৈত্রী চিত্ত পোষণ করেনি। যদি সে এ’চার প্রকার অহিরাজকুলের প্রতি মৈত্রী চিত্ত পোষণ করত, তাহলে তাকে সর্প দংশনে প্রাণ ত্যাগ করতে হতো না।

হে ভিক্ষুগণ! আত্মগুপ্তি, আত্মরক্ষা এবং আত্ম পরিত্রাণের জন্য এ’চার প্রকার অহিরাজকুলের প্রতি মৈত্রী চিত্ত পোষণ করতে অনুজ্ঞা প্রদান করছি।

“মৈত্রী মোর বিরূপাক্ষের, আরো এরাপথের,

মোর মৈত্রী ছব্যাপুত্রের, কণহগোতমকের।

পদহীনে মৈত্রী মম, আরো দ্বিপদে,

চর্তুপদে মৈত্রী মম, আর বহুপদে।

সব সত্ত্ব, সবপ্রাণী আর যতো ভূতগণ,

দৃষ্টিপরায়ণ হোক, না হোক পাপ আগমন।

অপ্রমিত বুদ্ধের গুণ, ধর্মের গুণ অপ্রমিত,

সঙ্ঘের গুণ অপ্রমিত কিন্তু সরীসৃপ সীমিত।

সর্প, বৃশ্চিক, মাকড়সা আর শতপদী,

সরভূ, মূষিক প্রমেয় হয়ও যদি।

করেছি আমি রক্ষাবন্ধন পরিত্রাণ পাঠ,

সব ভূত প্রাণী না হিংসে দূরে সরে যাক;

প্রণমি সপ্ত বুদ্ধকে আমি, সদা দিন-রাত।”

(সপ্তম সূত্র)

৮. দেবদত্ত সুত্তং-দেবদত্ত সূত্র

৬৮. একসময় ভগবান রাজগৃহে গৃধ্রকূট পর্বতে অবস্থান করছিলেন, দেবদত্ত বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার অল্প সময়ের মধ্যে। তথায় ভগবান ভিক্ষুগণকে আহ্বান করে দেবদত্ত সম্বন্ধে বললেন- “হে ভিক্ষুগণ! আত্মনাশের জন্যেই দেবদত্তের লাভ-সৎকার, সুখ্যাতি উৎপন্ন (লাভ) হয়েছে। ধ্বংসের জন্যেই দেবদত্তের লাভ-সৎকার, সুখ্যাতি উৎপন্ন হয়েছে।

যেমন কদলীবৃক্ষ আত্মনাশের জন্যেই ফলবতী হয়, ধ্বংসের জন্যেই ফলবতী হয়; ঠিক তেমনি আত্মনাশের জন্যেই দেবদত্তের লাভ-সৎকার, সুখ্যাতি উৎপন্ন হয়েছে, ধ্বংসের জন্যেই দেবদত্তের লাভ-সৎকার, সুখ্যাতি উৎপন্ন হয়েছে।

যেমন বাঁশ আত্মনাশের জন্যেই ফলবতী হয়, ধ্বংসের জন্যেই ফলবতী হয়; ঠিক তেমনি আত্মনাশের জন্যেই দেবদত্তের লাভ-সৎকার, সুখ্যাতি উৎপন্ন হয়েছে, ধ্বংসের জন্যেই দেবদত্তের লাভ-সৎকার, সুখ্যাতি উৎপন্ন হয়েছে।

যেমন নল আত্মনাশের জন্যেই ফলবতী হয়, ধ্বংসের জন্যেই ফলবতী হয়; ঠিক তেমনি আত্মনাশের জন্যেই দেবদত্তের লাভ-সৎকার, সুখ্যাতি উৎপন্ন হয়েছে, ধ্বংসের জন্যেই দেবদত্তের লাভ-সৎকার, সুখ্যাতি উৎপন্ন হয়েছে।

যেমন অশ্বতরী আত্মনাশের জন্যেই গর্ভবতী হয়, ধ্বংসের জন্যেই গর্ভবতী হয়; ঠিক তেমনি আত্মনাশের জন্যেই দেবদত্তের লাভ-সৎকার, সুখ্যাতি উৎপন্ন হয়েছে, ধ্বংসের জন্যেই দেবদত্তের লাভ-সৎকার, সুখ্যাতি উৎপন্ন হয়েছে।

“ধ্বংসের তরে কদলী, বাঁশ, নল ফলবতী,

অশ্বতরী গর্ভধারণ করলে মৃত্যুই নিয়তি।

কাপুরুষের লাভ-সৎকারও ধ্বংসই গতি।” (অষ্টম সূত্র)

৯. পধান সুত্তং-প্রধান সূত্র

৬৯. “হে ভিক্ষুগণ! প্রধান চার প্রকার। সেই চার প্রকার কি কি? যথা- সংবরণ প্রধান, প্রহান প্রধান, ভাবনা প্রধান, অনুরক্ষণ প্রধান।

সংবরণ প্রধান কাকে বলে? এজগতে ভিক্ষু অনুৎপন্ন অকুশল পাপ ধর্মের অনুৎপাদনার্থে ইচ্ছা, উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং চিত্তকে দৃঢ় করে। একে-ই বলে সংবরণ প্রধান।

প্রহান প্রধান কাকে বলে? এজগতে ভিক্ষু উৎপন্ন অকুশল পাপ ধর্মের ধ্বংস সাধনের ইচ্ছা, উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং চিত্তকে দৃঢ় করে। একে-ই বলে প্রহান প্রধান।

ভাবনা প্রধান কাকে বলে? এজগতে ভিক্ষু অনুৎপন্ন কুশল ধর্মের উৎপাদনের ইচ্ছা, উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং চিত্তকে দৃঢ় করে। একে-ই বলে ভাবনা প্রধান।

অনুরক্ষণ প্রধান কাকে বলে? এজগতে ভিক্ষু উৎপন্ন কুশল ধর্মের স্থিতি, সুরক্ষা, বৃদ্ধি, বৈপুল্য, বর্দ্ধন ও পূর্ণতার জন্য ইচ্ছা, উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং চিত্তকে দৃঢ় করে। একে-ই বলে অনুরক্ষণ প্রধান। এটিই চার প্রকার প্রধান।

“সংবরণ, প্রহীন আর ভাবনা অনুরক্ষণ,

সম্যক প্রধান, আদিত্যবন্ধু বুদ্ধের দেশন।

যেই ভিক্ষু এসব পূরণে হয় উদ্যোগী,

দুঃখ, পাপ ধ্বংসে তিনি হন চিরসুখী।

(নবম সূত্র)

 

১০. অধম্মিক সুত্তং-অধার্মিক সূত্র

৭০. “হে ভিক্ষুগণ! যে সময়ে রাজাগণ অধার্মিক হয়, সে সময়ে উপরাজাগণও অধার্মিক হয়। উপরাজাগণ অধার্মিক হবার কারণে ব্রাহ্মণ-গৃহপতিগণও অধার্মিক হয়। তাদের কারণে নিগম-জনপদবাসীও অধার্মিক হয়। নিগম-জনপদবাসী অধার্মিক হবার কারণে চন্দ্র-সূর্য নিজস্ব কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে না। চন্দ্র-সূর্য নিজস্ব কক্ষপথে পরিভ্রমণ না করার কারণে নক্ষত্র-তারকাদিও নিজস্ব কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে না। নক্ষত্র-তারকাদি নিজস্ব কক্ষপথে পরিভ্রমণ না করার কারণে সঠিক সময়ে দিন-রাত হয় না। সঠিক সময়ে দিন-রাত না হবার কারণে সঠিক সময়ে পক্ষ, মাস হয় না। সঠিক সময়ে পক্ষ, মাস না হবার কারণে সঠিক সময়ে ঋতু, বছর হয় না। সঠিক সময়ে ঋতু, বছর না হবার কারণে অসময়ে, অনিয়মিতভাবে বায়ু প্রবাহিত হয়। অসময়ে, অনিয়মিতিভাবে বায়ু প্রবাহিত হবার কারণে দেবতাগণ কুপিত হয়। দেবতাগণ কুপিত হবার কারণে যথাসময়ে বৃষ্টি বর্ষিত হয় না। যথাসময়ে বৃষ্টি বর্ষণ না হবার কারণে অল্প সময়ে শষ্য পরিপক্ক হয়। অল্প সময়ে পরিপক্ক শষ্য পরিভোগ করে মনুষ্যগণ অল্পায়ু, দুর্বর্ণ (কুৎসিৎ), বহু রোগগ্রস্ত হয়।

অপরদিকে, যে সময়ে রাজাগণ ধার্মিক হয়, সে সময়ে উপরাজাগণও ধার্মিক হয়। উপরাজাগণ ধার্মিক হবার কারণে ব্রাহ্মণ-গৃহপতিগণও ধার্মিক হয়। তাদের কারণে নিগম-জনপদবাসীও ধার্মিক হয়। নিগম-জনপদবাসী ধার্মিক হবার কারণে চন্দ্র-সূর্য নিজস্ব কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে। চন্দ্র-সূর্য নিজস্ব কক্ষপথে পরিভ্রমণ করার কারণে নক্ষত্র-তারকাদিও নিজস্ব কক্ষপথে পরিভ্রমণ করে। নক্ষত্র-তারকাদি নিজস্ব কক্ষপথে পরিভ্রমণ করার কারণে সঠিক সময়ে দিন-রাত হয়। সঠিক সময়ে দিন-রাত হবার কারণে সঠিক সময়ে পক্ষ, মাস হয়। সঠিক সময়ে পক্ষ, মাস হবার কারণে সঠিক সময়ে ঋতু, বছর হয়। সঠিক সময়ে ঋতু, বছর হবার যথাসময়ে, নিয়মিতভাবে বায়ু প্রবাহিত হয়। যথাসময়ে, নিয়মিতভাবে বায়ু প্রবাহিত হবার কারণে দেবতাগণ সন্তুষ্ট হয়। দেবতাগণ সন্তুষ্ট হবার কারণে যথাসময়ে বৃষ্টি বর্ষিত হয়। যথাসময়ে বৃষ্টি বর্ষণের কারণে নির্দিষ্ট সময়ে শষ্য পরিপক্ক হয়। নির্দিষ্ট সময়ে পরিপক্ক শষ্য পরিভোগ করে মনুষ্যগণ দীর্ঘায়ু, সুবর্ণ, বলবান, অল্প রোগগ্রস্ত হয়।

গমনকালে প্রধান ষাড় চলে যদি একেবেঁকে,

অন্য গো সবও চলে বেঁকে, অনুসরণে তাকে।

মনুষ্যশ্রেষ্ঠ নৃপতি যদি চলেন অধর্ম পথে,

প্রজা সব হয় অধার্মিক, দুর্বল রাজকার্য তটে;

বিরাজে সমস্ত রাজ্যে দুঃখ, রাজার অধর্মতে।

গমণকালে প্রধান ষাড় চলে যদি সোজাভাবে,

অন্য গো সবও চলে সোজা, নহে অন্যভাবে।

মনুষ্যশ্রেষ্ঠ নৃপতি যদি চলেন ধর্মপথে,

প্রজা সব হয় ধার্মিক, রাজার আদর্শতে;

বিরাজে সমস্ত রাজ্যে সুখ, রাজার ধর্মেতে।

(দশম সূত্র)

প্রাপ্তবর্গ সমাপ্ত

স্মারক গাথা-

“প্রাপ্তকর্ম, ঋণমুক্ত, ব্রহ্মা, নিরয়, রূপসহ পঞ্চম,

রাগমুক্ত, অহিরাজ, দেবদত্ত, প্রধান, অধার্মিক এ’দশম।”