ব্রেকিং নিউজ

গৃহী উপগুপ্ত ও বাসবদত্তা (পর্ব-১)

ইলা মুৎসুদ্দী

upogupto1

শ্রীমান উপগুপ্তের ব্যবসার উন্নতি এবং সুনাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল তাঁর বিক্রয় লব্ধ দ্রব্যের গুণাগুণের কথা আর তাঁর সুসংযত অমায়িক ভদ্রব্যবহার ও শীলগুণের কথা। সেই সময়ে নগরীতে রূপের পশরা খুলে জাঁকিয়ে বসেছিলো বাসবদত্তা নাম্নী এক যুবতী গণিকা। সে ছিলো প্রায় ধনাঢ্য বণিকদের মানস-প্রিয়া ও অনুগ্রহিতা। পূর্ণ-যৌবনা বাসবদত্তা কলাকৌশলে, গণিকা সুলভ লাস্যে, প্রাণ-মাতানো কোমল-মধুর কণ্ঠস্বর, জল-তরঙ্গের মতো হাসির লহর, মধুময় সুরের আমেজ, ছন্দের দোলা, নৃত্যের হিল্লোল সকলকে বিভোর করে তুলতো।

এক সময় বাসবদত্তা গণিকা সুগন্ধদ্রব্য ক্রয়ার্থে প্রেরিতা তপতী নামের দাসীর মুখে শুনলেন সুগঠিত অঙ্গ-সৌষ্ঠব, উজ্জ্বল গৌরতনু, স্নিগ্ধোজ্জ্বল শোভন-মোহন নয়ন যুগল, অপূর্ব মধুর রূপশ্রী আর সুমধুর কণ্ঠস্বর, ভদ্র ব্যবহার, চমৎকার কোমল-মোহন প্রিয়সম্ভাষণ! শ্রীমান উপগুপ্তের রূপ ও গুণের প্রশংসা কাহিনী। শুনে মুগ্ধ হলো বাসবদত্তা গণিকা। উদ্বেলিত করে তুল্ল তাকে। এবং মনে জাগল কামনা-বাসনার তীব্র তাড়না, অনুরাগের প্রবল আকর্ষণ।

এই বিশেষ সময়ে মথুরার রাজপথ বিদেশী পথিকদের কর্মচাঞ্চল্যে সর্বদা কোলাহল মুখর থাকে। কারণ নগরবাসীর প্রধানতম অনুষ্ঠান মদন-উৎসব সমাগত। উৎসবে যোগদানের অভিপ্রায়ে প্রতি বৎসর উত্তরাপথের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বহু বিদেশী মথুরায় এসে সমবেত হন। বিচিত্র মানুষের সমাবেশে নগরী তখন এক নবীন রূপ ধারণ করে।

অভিজাত পল্লীর এক সুউচ্চ প্রাসাদের অলিন্দে দাঁড়িয়ে রাজপথের জনপ্রবাহের দিকে অলস দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে সুন্দর দেহিনী বাসবদত্তা। চলমান জনতার স্রোত লক্ষ্য করে হঠাৎ কাকে দেখে সে অনুভব করে এক অভূতপূর্ব শিহরণ, দেখে এক ফুল্লযৌবন-মাধুর্যে বিভূষিত এক রূপবান তরুণ চলেছেন ধীর পদক্ষেপে। শান্ত-সৌম্য তাঁর অবয়ব, দৃষ্টি আনত, গতি সংযত। প্রথম দৃষ্টিতেই মনে হয় যুবক অভিজাত বংশজাত। বাসবদত্তা চঞ্চল হয়ে উঠ্লো তাঁকে দেখে। দ্রুত গাত্রোত্থান করে অসীম ব্যগ্রতা নিয়ে দাসীকে ডাকতে থাকে “তপতী! তপতী!”

বাসবদত্তার ডাকে অতি ব্যগ্রতা বুঝতে পেরে তাড়াতাড়ি ছুটে এসে দাসী “ডাকছ আমায়?”

“হ্যাঁ, দেখেছ তপতী রাস্তায় চলেছেন এক অসাধারণ রূপবান যুবক। নিশ্চয়ই সে তোমারই দেখা সেই সুব্যাখ্যাত যুবক। তাঁর নবীন গৌরকান্তি দেখছি যে কোন নারীর হৃদয় আকর্ষণ করে।”

“দেখেছি, কিন্তু কেন? তোমার রূপ বড়ো নিষ্ঠুর। এই রূপ মুগ্ধ-পুরুষের হৃদয় বিদ্ধ, বিবশ ও বিক্ষত করে। অনেক পুরুষই তো পতঙ্গের মতো ছুটে এসেছে তোমার রূপের অনলে দগ্ধ হওয়ার জন্য। কতো ধনকুবের শ্রেষ্ঠী তোমার কৃপা লাভের আশায় দিতে চেয়েছে তাঁদের যথা সর্বস্ব। সকলকেই তুমি নিরাশ করেছ। তবে আজ কেন এই যুবকের প্রতি তুমি দৃষ্টিপাত করছ?” দাসীর কন্ঠস্বরে যেন এক অভিযোগ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে।

“জানি তপতী। এ পর্যন্ত এইসব শুনে শুনে আমার রমনীয়মন অসার হয়ে পড়েছিল। আজ এই প্রিয়দর্শন নরোত্তমকে দেখে তাঁর সাথে মিলনের জন্য আমি ব্যগ্র হয়েছি। যেমন করে হোক্ তাঁকে আমার চাই।”

“যদি তিনি তোমার আহ্বানে সাড়া না দেন?”

“সাড়া দেবেন না? কি বলছ তপতী? তুমি কি ভুলে গেলে মথুরা নগরীর সুন্দরীশ্রেষ্ঠা বাসবদত্তার অক্ষিতারকার কটাক্ষ কেউ অগ্রাহ্য করতে পেরেছেন?”

“বলো, আমায় কি করতে হবে?”

নারী হৃদয় আকর্ষণকারী এই রূপোত্তম যুবকে জানাবে “বাসবদত্তা আজ রজনীর প্রথম প্রহরে প্রেমমুগ্ধ সতৃষ্ণ অন্তরে তাঁর প্রতিক্ষায় থাকবে। তিনি যেন এই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। আরো বলবে বাসবদত্তা তাঁর প্রণয়াকাক্ষিণী, কোন প্রকার রজতমুদ্রা আশা করে না।”

বাসবদত্তার প্রেরিতা দূতী  শ্রীমান উপগুপ্তের নিকট উপস্থিত হয়ে বাসবদত্তার মনোভাব নিবেদন করে বললেন বাসবদত্তা আপনার পাণি প্রার্থনা করেছেন। তিনি আজ রজনীর প্রথম প্রহরে আপনার প্রতিক্ষায় থাকবে। আপনি যেন এই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। আরো বলেছেন তিনি শুধু আপনার প্রণয়াকাক্ষিণী, কোন প্রকার রজতমুদ্রা আশা করে না। একথা শুনে ক্ষণকালের জন্য ভাবের অতলান্তিকে ডুবে গেলেন উচ্চমনা শ্রীমান উপগুপ্ত। মনে মনে চিন্তা করলেন “ইহা প্রলোভন! এ প্রলোভনে আত্মহুতি দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ চতুরঙ্গ আর্যসত্যরূপ অমৃতের বিদ্যমানে পঞ্চ কটুরস কেন পান করবো? তিনি আরো ভাবলেন “বৈরীহীন নৈষ্ক্রম্যের বিদ্যমানে শত্রুবহুল কামাসক্তিতে কী প্রয়োজন? রাজা, অগ্নি, জল, চোর এবং অপ্রিয় উত্তরাধিকারী প্রভৃতি কামের বহুশত্রু। বাসবদত্তার মতিভ্রম হয়েছে, সে কামান্ধ! কিন্তু, অমাকে যত্নশীল হতে হবে; অবলম্বন করতে হবে উপায়-কুশলতা। যা’তে ঐ গণিকার বিদূরিত হয় বিমতি-বিভ্রান্তি, চিত্ত-ভাব যেন হয় বিশোধন; উপলব্ধি হয় যেন সত্যদর্শন।

অতঃপর শ্রীমান উপগুপ্ত বাসবদত্তা গণিকার দূতীকে স্মিত-হাস্যোজ্জ্বল মধুর-মোহন প্রিয়-বাক্যে বললেন “এখন তার সাথে দেখা করার সময় নয়; যখন উপযুক্ত সময় হবে, তখন নিমন্ত্রণের অপেক্ষা না করে আমি নিজেই তার সাথে দেখা করে আসব; এখন যেতে পার।” এই বলে বাসবদত্তার প্রেরিতা দূতীকে বিদায় দিলেন।

পূর্ণ হলো না মনোবাঞ্ছা। অন্যন্যোপায় হয়ে বাসবদত্তার বিশ্বস্ত দূতী নিঃশব্দে ফিরে এলো। এরিমধ্যে বাসবদত্তাকে সুরমগ্ন দেখে তপতী তাকে ডাকেনি। কিন্তু বাসবদত্তা সম্বিৎ ফিরে নিজেই প্রশ্ন করে “যুবক কি উত্তর দিলেন, তপতী?”

“যুবক আমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি।”

বিশ্বস্ত দূতীর মুখে হতাশা-ব্যঞ্জক কথা শুনে বিশ্বাস করতে না পেরে অবমর্দিতা ভুজঙ্গীর ন্যায় রুষ্ট কণ্ঠে আবারো জিজ্ঞাসা করে “বাসবদত্তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করেননি?”

 “হ্যাঁ, তিনি বলেছেন সময় হলে উপগুপ্ত নিমন্ত্রণের অপেক্ষা না করে নিজেই আসবেন বাসবদত্তার সংকেতকুঞ্জে।” ধীরে ধীরে সময় অতিক্রান্ত হয়। কিন্তু বাসবদত্তার অশান্ত মন কিছুতেই শান্ত হয় না। উপগুপ্তের স্মৃতি সে সহজে ভুলতে পারে না।

 

সূত্র-শ্রীমৎ মেত্তাবংশ ভিক্ষু রচিত মার বিজয়ী অরহত উপগুপ্ত

সম্মন্ধে ela mutsuddi

এটা ও দেখতে পারেন

খুব সংক্ষেপে মহাসতিপট্ঠান সহায়িকা

একূশটি উপায়ে অরহ্ত্ত্ব লাভের উপায় তথা কর্মস্থান সংযূক্ত গভীর অর্থসংযুক্ত মহাসতিপট্ঠান সূত্তI এখানে একুশটি উপায়ে …

Leave a Reply

Translate »